#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি(#তুশকন্যা)
পর্ব→৩৭(১ম অংশ)
“বেশি না! যাস্ট চার-পাঁচ রাউন্ড খেলেই ঘুমিয়ে যাবো,পাক্কা!”
এই বলেই আনায়া আবার কেনীথের দিকে বিস্তৃত হেঁসে বাম চো”খ মারলো।
“ছিহ! আনায়া, তুই কত জ”ঘন্য।”
কেনীথের এহেন রিয়াকশনে আনায়া খানিকটা ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“হেই কিসের জ’ঘন্য! বউ আমি তোমার, হক আছে আমার।”
কেনীথ নিজের গলা থেকে নিজের দুহাত দিয়ে আনায়ার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিতে নিতে আশেপাশে তাকিয়ে খোজাখুজি করতে করতে বলতে থাকলো,
“ছাড় তুই আমায়।ছেড়ে দে বলছি, ছেড়ে দে! এক মিনিট আমার টিশার্ট…টিশার্ট কোথায় আমার। ওহ টিশার্ট গায়েই আছে।”
কেনীথ নিজের গায়ে টিশার্ট আছে দেখে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে নিশ্বাস ফেললেও। আনায়া কিছুটা বিরক্তি নিয়ে নিজের হাতের বন্ধনটা দৃঢ় করে বললো,
“মেজাজ খারাপ করো না। এতো রিয়েক্ট করার কি আছে। ভুল কি বলেছি আমি?”
—“নি”র্লজ্জ বে”হায়া,, সর আমার থেকে।”
এই বলেই কেনীথ চোখমুখ খিঁচে আনায়াকে সরাতে চাইলেও আনায়ার সরে গেলো না। উল্টো চোখমুখ শক্ত করে কেনীথের চুল শক্ত করে টেনে ধরে বসে রইলো। ঠিক সেই সময় কেনীথ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো,
“তোর কথা শুনতো রাজি রয়েছি। তবে তার আগে আমার আগে একটা শর্ত রয়েছে।”
কেনীথের মাথা ঝিমঝিম করছে তবুও নিরেট কন্ঠে বললো,
“একটা গেইম খেলবো। যদি তুই জিতে যাস তবে তুই যা বলবি তাই করবো আর যদি আমি জিতে যাই তবে আমি যা বলবো তাই করবি।”
—“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
—“কি ঠিক আছে, আমায় ছেড়ে আগে ভালো মতো বস।”
আনায়া যথারীতি কেনীথের কথামতো ওকে ছেড়ে দিয়ে কেনীথের সামনে বসে পড়লো। অতঃপর নিজের নিভু নিভু চোখ গুলো দুহাতে কিছুটা ঘষাঘষি করে বড় বড় করে তাকিয়ে বলতে লাগলো,
“বলো এবার, কি গেইম খেলতে হবে।”
—“বেশি কিছু না। রক, পেপার, সিজার ; খেলেছিস কখনো?”
আনায়া কিছুটা প্রফুল্লচিত্তে বললো,
“হুম, তো। বাচ্চাকালে অনেক খেলেছি।”
—“তাহলে ঠিক আছে। ওটাই খেলতে হবে। শুধু তিনবার খেলবো। এতে যে আগে জিতে যাবে সেই উইনার।”
আনায়াও বাচ্চাদের মতো ঘাড় এপাশ ওপাশ করে সম্মতি জানালো। এরপর দুজনে অনেক তোরজোর নিয়ে যুদ্ধের ময়দানের সৈনিকের ন্যায় ভাবসাব নিয়ে খেলতে বসলো। বেশি না, মিনিট খানেকের মধ্যে দুজনের খেলা শেষ হয়ে গেলো। আনায়া প্রথম বার জিতলেও বাকি দুইবার কেনীথ জিতে গিয়ে বিস্তৃত হাসলো। তখনই আনায়া কিছুটা নেশাগ্রস্তের ন্যায় দুহাতে মাথা উপর নিচ ঝাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“মানে আমি হেরে গিয়েছি?”
কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেঁসে বললো,
“হুম,আর আমি জিতে গিয়েছি।”
এবার আনায়া কিছুটা অবুঝের ন্যায় হাভভাব নিয়ে বললো,
“তাহলে এবার কি করতে হবে।”
কেনীথ আনায়ার কথা শুনে চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে আনায়ার ঘাড় ধরে টেনে বালিশের মধ্যে ঠেসে শুইয়ে দিয়ে বললো,
“কিচ্ছু না,ঘুমাতে হবে। আরেকবার বিরক্ত করলে এখানেই শেষ করে ফেলবো।”
কেনীথের কথামতো আনায়াও দীর্ঘ শ্বাস তার নিভু নিভু চোখ জোড়া বুঁজতে বুঁজতে বিড়বিড় করে বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে, ঘুমাই তবে।”
_______________
অনেকটা বেলা করেই কেনীথের ঘুম ভাঙ্গলো। এ যেন ম’রার ঘুম ঘুমিয়েছিলো। এতো ঘুম হঠাৎ কোথায় থেকে এলো তা কেনীথের জানা নেই। তবে উপর হয়ে বিছানায়া ঘুমাতে থাকা কেনীথের ঘুম ভাঙ্গতেই ও কিছুটা অবাক হলো। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মনে হলো তার পিঠের উপর আস্ত এক আলুর বস্তুা। যে কারণে নড়াচড়া করতেও অসুবিধা হলো। কেনীথ বালিশ থেকে মাথা উচিয়ে কোনো মতে ঘাড় পেছনের দিকে ঘুরিয়ে তাকাতেই ওর চোখমুখ কুঁচকে গেলো।
পিঠের উপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে রইছে আনায়া। তবে বিছানায় শুধু তার পা থাকলেও মাথাটা বেডের বাহিরে চলে গিয়েছে। উপর থেকে দেখলে হয়তো দুজনকে ক্রস সিম্বলের মতো লাগবে। কেনীথ মাথাটা অন্যপাশে ঘুরিয়ে দেখলো আনায়ার মাথাটা বিছানার বাহিরে নিচের দিকে হেলে রইছে। বড় বড় চুলগুলো ফ্লোর ছুঁইয়েছে। সঙ্গে নিজের হাত দুটোও উল্টো হয়ে শূন্যে ঝুলছে। কেনীথের নড়াচড়াও একটু বেশি তারতম্য হলেই সোজা মাথা উল্টে নিচে পড়ে যাবে। এরপর মাথা-নাক ফা”টার পাশাপাশি হাত-পাও ভাঙ্গবে।
কেনীথ এসব দেখে নিমিষেই বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। সকাল সকাল এমন কিছু দেখতে হবে তা আশা করেনি হয়তো। কেনীত বিরক্তি নিয়ে আনায়াকে কয়েকবার ডাকলো ঠিকই কিন্তু আনায়ার কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেনীথের মনে হলো আনায়ার শুধু জান যাওয়াটা বাকি এছাড়া পুরো মৃ”ত মানুষের মতো ঘুমিয়ে রইছে। এবার কেনীথ প্রথমে উপর হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় আনায়া একপা শক্ত করে চেপে ধরলো। অতঃপর কোনো মতে ওর একটা হাত উল্টো ভাবে ধরে নিয়ে কোনো মতে ধাক্কা দিয়ে আনায়াকে নিজের পিঠ থেকে সরিয়ে নিলো। অতঃপর খুব দ্রুত বিছানা থেকে নেমে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আনায়াকে দেখলো।
গত কাল রাতেই পড়ে আসা জামাকাপড়েই দিব্যি উল্টোপাল্টা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। কেনীথের কেনো যে এইসব বিষয় ঠিক মনে হলো না। কাল হাতে হুট করেই হেডেক হলো অতঃপর ঘুমিয়ে গেলো। কিন্তু এরপর আর কিছুই মনে নেই। বিষয়টা সেদিন রিসোর্টের মতো মনে হচ্ছে।
কেনীথ দাঁড়িয়ে থেকে কিসব ভাবনা চিন্তা করার পর রুম থেকে বেরিয়েই যেতে নিয়েছিলো তবে আনায়ার ড্রেসআপ ঠিকঠাক ছিলো না বিধায় কিছুটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আনায়ার কাছে ফিরে এলো। অনেকটা অনীহার ন্যায় ভাবসাব নিয়েই আনায়ার হাটুর উপর উঠে থাকা প্লাজোটা টেনে নিচে নামিয়ে দিলো। এরপর আবারও চলে যেতে নিয়েও পুনোরায় ফিরে এসে আনায়ার দিকে ঝুঁকে বালিশটা ঠিক করে দিলো।
তবে এবার আর কেনীথ রুম থেকে চলে যেতে উদ্বেগ প্রকাশ করলো না বরং আচমকা নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আনায়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে পলকহীনভাবে চেয়ে রইলো। এতবছরে কেনীথ এতটুকু বুঝেছে যে আনায়ার শুধুমাত্র এই একটি বিষয়ই তাকে প্রতিবার দূর্বল করে দেয়। আনায়ার এই ঘুমন্ত চেহেরায় আদতে কি রয়েছে তা কেনীথের অজানা। কিন্তু এর আকর্ষণ শক্তি এতোটাই প্রবল যে কেনীথ না চাইতেও বারবার এই মূহুর্তে নিজের সর্বস্বকে দূর্বল অনুভব করে।
কেনীথ অকপটে নিষ্পলক চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। চোখের ঘন-কালো পাপড়ি, সুউচ্চ নাকের ডগা,মসৃণ গাল, গোলাপি ঠোঁট। যে ঠোঁটের উপর বিচ্ছিন্ন ভাবে হালকা লিপস্টিকের প্রলেপ। কেনীথ ঠোঁটের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই আকস্মিক মুচকি হাসলো।
কেনীথ এবার আনায়ার কপাল আর গালের উপর কিছু অংশে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো৷ এদিকে আনায়া প্রায় কিঞ্চিৎ হা করে ঠোঁট কিছুটা উন্মুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যাচ্ছে। ওর ঘুমানোর হাল দেখে কেনীথের কিছুটা হাসিও পেলো। তবে এরই মাঝে কেনীথের নজর গিয়ে ঠেকলো অন্যজায়গায়। আনায়ার শার্টের প্রথম একটা বাটন এমনিতেই খোলা ছিলো। তবে তার নিচের আরো একটা বাটন হয়তো উল্টোপাল্টা ঘুমানোর কারণেই হয়তো খুলে গিয়েছে। যার দরূন আনায়ার ফর্সা বাম পাশের বুকের কিছুটা উপরে, ছোট্ট একটা কালো কুচকুচে তিল কেনীথের নজরে জ্বলজ্বল করছে। আচমকা কেনীথের নজর গিয়ে সেখানেই আঁটকে যেতেই কেনীথ কিছুটা অবাক হয়ে ভাবতে বসলো। আর মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়াতে লাগলো,
“এটা আবার কোথায় থেকে আসলো। এতোদিন তো কখনো নজরে…”
কেনীথ আর মনে মনে নিজের বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করলো না। হুশ ফিরতেই আকস্মিক তিলটার দিকে চেয়ে থাকা অবস্থাতেই ঢোক গিলো।গলায় মাঝে খুসখুস করছে। এই মূহুর্তে কেশে ফেললে পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে যাবে। আর থাকা সম্ভব না। কোনোমতে আলতো হাতে তড়িঘড়ি করে শার্টের বাম পাশের কলারটা টেনে ঠিক করে দিয়েই সোজা দাঁড়িয়ে পড়লো। অতঃপর আশেপাশে আর কিছুতে নজর দেওয়ার সময় হলো না বরং তার আগেই একপ্রকার দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
তবে রুম থেকে বের হতেই কেনীথের নজরে পড়লো পাভেল। কেনীথের এহেন তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হতে দেখে পাভেল খানিকটা কপাল কুঁচকে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইছে। পাভেলের এমন তির্যক চাহনিতে কেনীথ খানিকটা ভরকে গেলেও পুনোরায় নিজেকে সামলে নিয়ে গাম্ভীর্যের সাথে কেনীথের উদ্দেশ্য বলতে লাগলো,
“এখানে কি করছিস?”
কেনীথের কথায় এবার পাভেল ভরকে গিয়ে বলতে লাগলো,
“সরি ব্রো, আ’ম রিয়েলি সরি। আমি তোমায় সবকিছু জানাতেই চেয়েছিলাম কিন্তু…”
—“তো কবে জানাতেন আমায়? আমি ম”রে মাটির নিচে যাওয়ার পর?”
কেনীথের তাচ্ছিল্যতে পাভেলের আর কিছু বলার জোর হলো না। কেনীথের মেজাজ যে কোনো সময় বিগড়ে যাওয়ার আগেই তার এখান থেকে সরে পড়াটাই মঙ্গল হবে। যথারীতি বেশি আর একটা দেরী না করে কোনো মতে কেনীথের কাছ থেকে সরে নিচে চলে গেলো। অবশ্য কেনীথও বিষয়টা বুঝতে পেরে পাভেলের উপর কিছুটা বিরক্তও হলো।
_______________
ঘুম থেকে উঠে কোনোমতে ফ্রেস হয়েই আনায়া রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। আসতেই সবার প্রথমে নজর পড়লো কেনীথের উপর। সোফার উপর পায়ের পা তুলে লেপটপে কিছু একটা করতে ব্যস্থ। পড়নে তার সেই চিরপরিচিত কালো রংএর হুডি আর প্যান্ট। আনায়া মুচকি হেসে হাত দিয়ে নিজের চুলগুলো ওলটপালট করে ঠিক করে নিয়ে দ্রুত গিয়ে কেনীথের সামলে গিয়ে বললো,
“কলিজা! চলে যাচ্ছি, একটু পাপ্পা ঝাপ্পা দিয়ে দেও তো।”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো। সং সেজে ভং ধরে মুখে এক বিস্তৃত শয়তানি হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইছে। কেনীথ বিশেষ কোনো ভাবভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ না করে পুনোরায় মাথা নিচু করে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।যা দেখা মাত্রই আনায়া বাম পাশের ভ্রু উঁচিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে কিঞ্চিৎ হাসলো।
—“আমার কথা কি তুমি বুঝো না? আরো সহজ করে বলবো?”
কেনীথ আনায়ার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। এদিকে আনায়া কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হুট করেই কিছুটা ইনোসেন্ট ভাবে বলতে লাগলো,
“আমার না একটা বিশাল সমস্যা হয়ে গিয়েছে। চারপাশের সবকিছু কেমন যেন এলো মেলো হয়ে যাচ্ছে। নেশা না করেও মাতাল মাতাল লাগে। মাথার মগজটা মনে হয়, গাধার মগজের সাথে একচেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। তাই বলছি, নিয়ম করে বেলায় বেলায় বেশি করে চুমু দেও।সামনে অনেক কাজ, সাথে বহু প্যাচ। চুমু দিলে নাকি মগজের IQ বাড়ে। অন্তত আমার IQ আপগ্রেড করতে একটু হেল্প করো,কলিজা!
আর এতো নাক ছিটকাও কেন?বউই তো তোমার, পাশের বাসার আন্টি তো আর না।”
—“ফালতু কথা না বলে যেখানে যাওয়ার সেখানে চলে যা। বিরক্তি করবি না।”
—“তারমানে কথা শুনবে না, তাই তো? ঠিক আছে, তবে কাজের কথা বলি। সন্ধ্যায় তৈরি হয়ে থেকো। একটা জায়গায় যেতে হবে।”
—“কোথাও যেতে পারবো না। অন্তত তোর সাথে না।”
কেনীথ সবগুলো কথা মাথা নিচু করে বললো। তবে এবার গিয়ে আনায়ার ফুরফুরে মেজাজ বিগড়ে গেলো। হিসহিসিয়ে ধমকে বলতে লাগলো,
“কলিজা!বেশি ফরফর করে আমার মেজাজ খারাপ করো না। নয়তো তোমার ঐ কলিজা টেনে হিঁচ”ড়ে বের করে, কুচিকুচি করে কেটে লবণ দিয়ে চিবিয়ে খাবো।”
আনায়ার এহেন কথা শোনা মাত্রই কেনীথ ল্যাপটপটা একহাতে বন্ধ করলো। অতঃপর আনায়ার দিক মুখ তুলে চেয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।যা দেখা মাত্রই আনায়া কোনো প্রকার ভড়কে না গিয়ে জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে একগাল জোরপূর্বক মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
“চিন্তা করো না, টেস্ট ভালো না হলে লবণের সাথে আরো মসলাও এড করে দেবো। হোয়াট এভার, যেটা বলতে চাচ্ছিলাম আরকি। সন্ধ্যার পর একজনের সাথে দেখা করতে যেতে হবে। কেনো যেতে হবে, কার সাথে দেখা করতে হবে তা পড়ে জানাবো। আমার সাথে গিয়ে নিজেই দেখে নিও। শুধু একটু রেডি হয়ে থেকো। অবশ্য না হলেও প্রবলেম নেই, তোমায় কাপড়চোপড় ছাড়াও হয়তো আ”গুন লাগবে।”
শুরুতে প্রচন্ড সিরিয়াস হয়ে কথাগুলো বললেও শেষের দিকে আনায়া কেনীথের উপর মজা নিয়ে ভুলভাল বলে চোখ মা”রলো। এদিকে কেনীথের বিরক্তিতে চোখমুখ কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো।
—“ঠিক আছে।”
কেনীথ এটুকু বলেই পুনোরায় ল্যাপটপ খুলে কাজে লেগে পড়লো। অন্যদিকে আনায়ার আর দেরী না করে কেনীথের সামনে থেকে সরে গিয়ে চলে যেতে লাগলো। কেনীথ আনায়াকে নিজের কাছ থেকে সরতে দেখেই অজানা স্বস্তিতে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। তবে আচমকা গালে চু”মু পড়তেই কেনীথ কিছুটা চমকে উঠলো। কেনীথ বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগেই কেনীথের বসে থাকা সোফার পেছন দাঁড়িয়ে থেকে কেনীথের গালে চু”মু খাওয়া আনায়া ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
“জামাই নিরামিষ হলে তাকে আমিষ বানানোর দায়িত্ব বউয়ের। যত বড়ই ভ’ণ্ড শয়তানের কাছ থেকেই বিদ্যা নেও না কেনো।রোমান্টিক বিষয়ে ভ’ণ্ডামি করলে একদম নিজ দায়িত্বে ভ’ণ্ডামি ছাড়িয়ে দেবো।”
আনায়ার কথাগুলো কেনীথ কড়া চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে শুনছিলো। আনায়ার কথা শেষ হলেই চলে যেতে নিলেও পুনোরায় কেনীথের কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
“সন্ধ্যায় বেড়োনোর কথা ভুলে যেও না। আর হ্যাঁ,আমার দেবর মশাই এই বিষয়ে যেন কিছু না।”
_____
“আরে দেবর মশাই! শুনে যান একটু৷”
আনায়া নিচে গিয়ে দেখতে পেলো পাভেল গার্ডদের সাথে কথা বলছে। আনায়ার ডাক শুনে তাকে দেখামাত্রই মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
“আরে আপনি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছেন?”
আনায়া একগাল মুচকি হেসে বললো,
“আরেহ একবারে যাচ্ছি না তো,আবার আসবো।”
—“ওহ আচ্ছা।”
—“ভাবছি সন্ধ্যায় আপনার নিরামিষ ভাইটাকে নিয়ে একটু ঘুরে আসবো। দিনে গেলে হয়তো বেশি ভালো হতো। সূর্যের আলো গায়ে না লাগিয়ে বান্দা তো পুরো ফার্মের মুরগীর মতো হয়ে গিয়েছে। উপরে ফকফকা সাদা চামড়া আর ভেতরে হয়তো রক্ত শূন্যতা। আপাতত এখন না হয় একটু চান্দের আলো লাগিয়ে নিয়ে আসি। জামাইটা পুরো নিরামিষ হয়ে গিয়েছে। এখন যদি পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় দুই চামচ মধু খাইয়ে আমিষ বানানো যায়।”
পাভেল পুরো হতভম্ব আনায়ার নির্বিকার কথা শুনে। বুঝতে পারছে না আনায়া বললোটা কি আর সে রিয়াকশনটা দিবে কি। তবুও অপ্রস্তুত হয়ে মুচকি হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু পাভেলকে আরেকটু ভড়কে দিয়ে আনায়া আচমকা পাভেলের কাঁধের উপর একহাত ঠেকিয়ে খানিকটা ভড় ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“গেইমগুলো কিন্তু ভালোই খেলছেন দেবর মশাই!”
পাভেল আনায়ার এহেন কথায় থতমত খেয়ে গিয়ে বললো,
“মানে?কিসের গেইম?”
আনায়া এবার ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
“কালকে রাতে ঐ শরবতে কিছু উল্টো পাল্টা মিশিয়ে ছিলেন। সে রাতের রিসোর্টের মতো, তাই না?”
—“না মানে…”
—“আহা, বলতে এতো লজ্জা কিসের। আমারটা না মেশালেও পাড়তেন। সারারাত খালি উল্টোপাল্টা করে ঘুমিয়েছি। কাজের কাজ কিছুই তো হয়নি। উল্টো আবার কিছু মনেও পড়ছে না।”
চলবে….
#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)
পর্ব→৩৭ (অংশ ২)
“অলিভার কি এখনো, ফেরেনি?”
ইনায়ার শান্ত কন্ঠস্বরের প্রশ্নতে জারা নামক মেয়েটি ভেতর হতে অনেকটা চমকে উঠলো। কিঞ্চিৎ ভয়ার্ত চেহারা বানিয়ে ঢোক গিলে তড়িঘড়ি উত্তর দিলো,
“নাহ, না ম্যাম। এখনো আসেনি?”
ইনা শান্ত চোখের তির্যক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বললো,
“বাচ্চাগুলো ঠিকঠাক ভাবে নিয়ে গিয়েছে তো? এতোক্ষণে তো ফিরে আসার কথা ছিলো।”
—“জ্বী… মানে উনি বলেছিলেন উনার আসতে হয়তো এবার একটু দেরী হবে। আপনি চিন্তা করবেন, উনি হয়তো ঠিকঠাক ভাবেই বাচ্চাগুলো নিয়ে গিয়েছে। ফিরেও আসবে হয়তো তাড়াতাড়ি,আজকেই ফিরবে।তবে একটু বেশি রাত হতে পারে।”
জারা সম্পূর্ণ ভয়ে ভয়ে নিজের কথাগুলো কোনোমতে এলোমেলো ভাবে শেষ করে আড় চোখে ইনায়াকে দেখলো। ইনা সবার কাছেই একটা আ”তংক। এই মূহুর্তে ইনার সামনে থেকে সরে যেতে পারলেই যেন সব মঙ্গল। তবে ইনা কিছু না বলে চুপচাপ রইছে দেখে জারা আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠলো। এরই মাঝে হঠাৎ অকপটে বলতে লাগলো,
“আমি আজ একটু বাহিরে যাবো। অলিভার ফিরে আসার আগেই চলে আসবো।”
ইনার কথা শোনা মাত্রই জারা তড়িঘড়ি করে বলতে লাগলো,
“কিন্তু ম্যাম, আপনার তো বাহিরে যাওয়াটা নিষেধ মানে অলিভার স্যারই তো একদম মানা করেছে তার পারমিশন…”
জারার কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনা রাগান্বিত স্বরে বলতে লাগলো,
“আমি কোনো বাচ্চা না। এমনিতেও শপিং করতে যাবো আমি। এছাড়া আর কোনো বিশেষ কারণ নেই।”
ইনার এহেন কন্ঠে জারা প্রথমে খানিকটা কেঁপে উঠলেও পরবর্তীতে ইতস্ততভাবে বলতে লাগলো,
“ঠিক আছে ম্যাম। কিন্তু একবার যদি স্যার…”
“অলিভার কাজে গিয়েছে। ওর কাজে মাঝে বিরক্ত করতে চাই না। আশা করি, আমার শপিং করতে যাওয়া নিয়ে ওর তেমন কোনো প্রবলেম হবে না। এমনিতেও বেশি দেরী করবো না আমি। তুমি যেতে পারো।”
ইনার কথা শুনে মেয়েটির আর বেশি কিছু বলার রইলো না। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুকিয়ে ইনাকে কুর্নিশ করেই চলে গেলো। এদিকে জারার চলে যাওয়ার দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতেই ইনা মনে মনে আওড়ালো,
“অনেক তো চেষ্টা হলো, ভিকে! বারবার ম”রতে গিয়েও ম” রলে না তুমি।এবারের শেষ চেষ্টাটা না হয় আমি করি। আশা রাখছি, এরপর আর কষ্ট করে তোমায় এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে হবে না।”
_________
সাত বছর আগে যখন ইনায়াকে আলাদা করে খুব অল্প কিছুদিনের জন্য একটি আশ্রমে নিয়ে রাখা হয়; তার কিছুদিন পরই কেনীথের পরিকল্পনা অনুযায়ী সে ইনায়াকে আলাদা করে নিজের কাছে নয়তো পরিস্থিতি ভেদে আনায়ার সাথে অন্যকোথাও পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। তবে আশ্রমে খুব বেশিদিন সে থাকতে পারেনি। বরং এর আগেই হুট করেই আনায়া পালিয়ে যায়। এটি কেনীথদের কাছে পুরো ঘটনায় ইনায়ার আশ্রম থেকে পালিয়ে যাওয়াটাই উল্লেখ হলেও আদতে এটিও ছিলো একটি ভুল তথ্য। কেননা ইনায়া একাই কোথাও পালিয়ে যায়নি বরং তাকে খুব কৌশলে আশ্রম থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিলো রাতের আঁধারে। আর ইনায়ার আশ্রম থেকে হঠাৎ উধাও হওয়াতে সবাই ভেবেছিলো ও হয়তো পালিয়ে গিয়েছিলো।
অথচ ঠিক এখান থেকেই ইনায়ার সম্পূর্ণ জীবনের মোড় নিমিষেই পাল্টে গিয়েছিলো। অচেনা আজানা জায়গায় দিনের পর দিন সেই অল্প বয়সে প্রতিনিয়ত নানান অত্যাচার সহ্য করেছে। শুরুতে তাকে তেমন কিছু করা হতো না। কিন্তু তার মতো তেজী জেদি মেয়ে চুপচাপ কোনো কিছু সহ্য করার মতো নয়। চিল্লাচিল্লি কিংবা নিজের তেজ-ক্ষো’ভ দেখাতে গিয়ে হুট করেই সেই অল্প বয়সে নানান নির্মমতার স্বীকার হতে হয়েছে তাকে। এক অন্ধকার ছোট্টো ঘরে দিনের পর দিন তাকে না খাইয়ে রাখা হয়েছে। ২-৩ দিন পর্যন্ত না খেয়ে থাকার পর অল্প একটু খাবার পানির সাথে জোর করে শরীরে ইনজেকশন পুশ করে দেওয়া হতো কড়া ডোজের নানান সব ড্রা”গ। ইনায়া জানতো না তার সাথে ঠিক কি হচ্ছে, আর কেনই বা হচ্ছে । তবে সেসময় যারা তাকে মা’রধর কিংবা খাবার-পানি, ড্রা’গ দিতো; তাদের কাছ থেকে সে প্রায়ই শুনতো, এসব নাকি কেনীথের নির্দেশেই হচ্ছে; ইনায়ার পরিবার-জীবন তছনছ করে দেওয়া সেই ভিকে।
ইনায়ার পিঠে আজও সেই গরম লোহার রড দিয়ে মা”রার কালচে দাগগুলো স্পষ্ট ফুটে রইছে। সেসময় পিঠের নরম ফর্সা মাংস যেন উত্তপ্ত লোহার দরূন ঝলসে গিয়ে খানিকটা মাংস সহ চামড়া উঠে গিয়েছিলো। সময়ের বিবর্তনে আজ হয়তো সেই ব্যহ্যিক ক্ষতগুলো সেরে গিয়ে আজ তা পোশাকের আদলে ঢেকে থাকে। কিন্তু জ্যান্ত ইনায়ার সাথে হওয়া প্রতিটা নির্মম ঘটনা আজও ইনায়া অত্যন্ত যত্নের সাথে তার বিকৃত মন-মস্তিষ্কের পুষে আসছে।
_________
বিকেল গড়িয়ে আর কিছুক্ষণ পড় সন্ধ্যা নামবে।একটি সম্পূর্ণ ফাঁকা রেস্টুরেন্টের শেষ প্রান্তের টেবিলে চুপচাপ গম্ভীর্যের সাথে পায়ের উপর পা তুলে বসে রইছে আনায়া। পড়নে একদম ক্যাজুয়াল শার্ট আর প্লাজো। এমনিতে তেমন কোনো সাজগোজ নেই আর। তবে চোখেমুখে এক অদ্ভুত চিন্তার ছাপ।
আনায়ার পাশে আরো কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে রইছে। পোশাকের ধরনে বোঝা যাচ্ছে তারা সবাই বডিগার্ড। আনায়া একবার নিজের বাম হাতের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে সময়টা দেখে নিলো। আনায়া হয়তো মনে মনে এবার কিছুটা বিরক্ত। একজনকে আনতে এতো দেরী তো লাগার কথা না।
এরই মাঝে আচমকা রেস্টুরেন্টের ভেতরে দুজন বডিগার্ড একটা লোকের চোখে কাপড় বেঁধে দুজন দুপাশ থেকে ধরে নিয়ে এলো। যা দেখা মাত্রই আনায়ার ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটে উঠলো। সেই দুজন বডিগার্ড চোখে কাপড় বেঁধে দেওয়া লোকটিকে ধরে আনায়ার সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। অতঃপর একটানে চোখের কাপড়টা সরিয়ে দিয়ে দুজন দুপাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো।
এদিকে সেই চোখে কাপড় বাঁধা লোকটি আর কেউ না বরং রেহান। পরনে সাদামাটা সাদা টিশার্ট আর তার উপর ব্রাউন কালারের জ্যাকেট। এরই মাঝে রেহান আনায়ার দিকে তাকানো মাত্রই আকস্মিক বিস্মিত হতো। বুঝে উঠতে পারছে না এসব সপ্ন না সত্যি।
রেহানকে এহেন ভাবে বিস্মিত হতে দেখে আনায়া কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলো। অতঃপর দু’হাত টেবিলের উপর রেখে এক করে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
“কেমন আছো রেহান?”
রেহান এখনো তার চোখের সামনে বসে থাকা হাস্যজ্জ্বল নারীটির দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে। ওর চোখের পলক পড়ছে না। চোখমুখ হতে বিস্ময়ও সরছে না। এতোগুলো বছর ধরে যাকে সে মৃ”ত জেনে এসেছে সেই কিনা আজ তার চোখে সামনে বসে রইছে। দিব্যি স্বাভাবিক ভাবে কথাও বলছে।
—“অবাক হচ্ছো? এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেঁচে রয়েছি আমি।”
রেহান নিজেকে এবার যথাসাধ্য তটস্থ করার চেষ্টা করলো। চোখের পলক ফেলে ঠোঁট ভিজিয়ে ইতস্ততভাবে বলতে লাগলো,
“আ…আনা…আনায়া, এটা কি সত্যিই তুমি?”
রেহানের কথায় আনায়া আবারও রুক্ষ ভাবে হেসে বললো,”হুম।”
এই পর্যায়ে রেহান কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার পর চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে শিরদাঁড়া সোজা করে জোর জোর কয়েকবার নিশ্বাস নিতে লাগলো। আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছে সে। কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক করে কিছু বলার চেষ্টা করলো। তবে হয়তো পারলো না। ওর এতো প্রচেষ্টা দেখে আনায়া নিজেই অকপটে বলতে লাগলো,
“এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। যা দেখছো তা সত্যিই। দেখো পূর্বে যা ছিলো তা পূর্বেই সমাপ্ত হয়েছে। আপাতত নতুন করে পুরোনো কোনো কিছুকে টেনে এনে সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার কাছে সময় কম। কিছু কথা বলবো এরপর চলে যাবো।”
রেহান আনায়ার কথাবার্তা ভাবভঙ্গিতে খানিকটা অবাক। এ যেন বিস্ময় কাটতে না কাটতেই সে নতুন করে বিস্মিত হচ্ছে। তবুও রেহান বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। এমন বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে সে নিজেও ভাবেনি। তবে এবার আনায়া কিছু বলার আগেই রেহান তড়িঘড়ি করে বললো,
“আনায়া আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটা তুমি। এটা কিভাবে…ওরা তো বলেছিলো তুমি নাকি ম…রে গিয়েছো। আমি নিজেও তোমার কত খোঁজ করেছি কিন্তু…এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?”
—“কারা বলেছিলো আমি ম…রে গিয়েছি?”
—“আ…ঐ ভিকে যাদের আমার আশেপাশে নজরদারির জন্য রেখেছিলো। কয়েকবছর আগে তোমায় কোথাও খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ ওদেরকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন ওরাই জানায় যে তুমি… যদিও আমার তখন বিশ্বাস হয়নি কিন্তু তোমায় কোথাও খুঁজে না পাওয়ার পর… ”
রেহান আর কিছু না বলে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। অন্যদিকে আনায়া কিছুক্ষণ রেহানের দিকে একজনের তাকিয়ে থাকার পর খেয়াল করলো রেহানের চোখজোড়ায় জল এসে ভীড় জমিয়েছে। যা দেখলামই আনায়া কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“এখনো ভালোবাসো আমায়?”
আনায়া কথাটা অকপটে বললেও রেহান শোনা মাত্রই আকস্মিক খানিকটা কেঁপে উঠলো। কিঞ্চিৎ ঢোক গিয়ে মলিন হাসিতে মুচকি হেঁসে আনায়ার দিকে তাকালো। অন্যদিকে আনায়া হাতের ইশারায় তার আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে দূরে সরে যেতে বললো। বডিগার্ড গুলোও যথারীতি আনায়ার আদেশ মতো দূরে সরে যেতেই আনায়া আবারও বললো,
” বিয়ে-শাদি করেছো?”
রেহান তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে বললো,
“নাহ।”
—“জানতে তো তোমার আনায়া ম”রে গিয়েছিলো। তবে বিয়ে কেনো করলে না?”
—“জানি না। কারণ আমার জীবনে আমি একজনকেই ভালো বেসেছিলাম।
—“এতো বছর পর আমায় দেখে কি আবারও আমায় পাওয়ার আশা রাখছো?”
রেহান কিছু বললো না। বরং আনায়ার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে আনায়া আবারও বলতে লাগলো,
“রেহান, তুমি কি জানো আমি অন্য কারো। বরং আমি কখনো তোমার ছিলামই না। হয়তো বা ছিলাম, আনায়া হয়ে। কিন্তু সে আনায়া তো বহু বছর হলে মৃত। মৃত মানুষ তো আর কখনো ফিরে আসে না রেহান।
তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার বহু আগেই আমি অন্যকারো হয়ে গিয়েছিলাম। যার জন্য আজ আমি-তুমি সব হারিয়ে নিঃস্ব। সেই মানুষটারই বউ আমি।এরপরও কি তুমি আমায় চাইলেও তো আমি তোমার হতে পারবো না রেহান।”
রেহানের চোখ থেকে আকস্মিক কেমন যে জল গড়িয়ে পড়লো৷ নিজেকে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মনে হচ্ছে। তবে তার মতো ছেলে মানুষের চোখে এমন কান্না যে সত্যিই বেমানান। আনায়া নিজেও তা অনুভব করে বললো,
“তোমার চোখে জল মানায় না রেহান। পৃথিবীটা স্বার্থপর, সাথে আমিও। হয়তো অন্য কোথাও স্বার্থ্য খুঁজে পেয়েছি তাই তোমায় ছেড়ে দিয়েছি। এই বলেই নিজের মন মস্তিষ্ককে শান্তনা দিয়ে দিও। দেখবে আর কোনো সমস্যা হবে না। আমি এখন অনেকের কাছেই খারাপ,নিজের কাছেও। এবার না হয় তোমার কাছেও হয়ে গেলাম। খুব বেশি কি ক্ষতি হবে?”
রেহান এবার নিজের চোখের পানি নিমিষেই মুছে নিয়ে অকপটে বলতে লাগলো,
“কোথায় থেকে কিভাবে শুরু করবো জানি না। এখনো আমার কাছে এসব অবিশ্বাস্য। এই আনায়াকে সত্যিই আমি কেমন যেন চিনতে পারছি না। তবে…আমি সত্যিই বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।”
—“থাক, তবে আমিই না হয় কাজের কথায় আসছি। বেশিদিন থাকবো না আমি, খুব তাড়াতাড়িই হয়তো আবার সবাইকে ছেড়ে দূরে কোথাও সরে যাবো।
যাই হোক,তোমার পরিবারের কি অবস্থা। তারা সবাই কেমন আছেন?যদিও আঙ্কেলের মৃ”ত্যু জন্য আজও নিজেকে দায়ী করবো আমি। সেক্ষেত্রে তুমিও চাইলে আমাকে নিজের বাবার খু”নি ভাবতে পারো। তোমার জীবনের সাথে না জড়ালে হয়তো… ”
এই পর্যায়ে আনায়ার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রেহান খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলতে লাগলো,
“এতোদিন তুমি ঠিক কোথায় ছিলে বলো তো? না মানে তুমি বাবার মৃ”ত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছো। আমি এই রেহান নামক জীবন্ত লা”শের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমার মা আর ভাইয়ের পরিনতির জন্যও কি তোমার নিজেকে দায়ী করা উচিত না?”
আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে বললো,
“মানে? আন্টি আর রোহান…”
—“বাবার মৃ”ত্যুর মা বেশিদিন বাঁচেনি। অসুস্থতায় আমাকে আর আমার ভাইকে একা রেখে তিনিও চলে যান। এরপর রেহানও…?”
আনায়া রেহানের কথায় অনেকটা হতভম্ব হয়ে পড়লো। এবার যেন রেহানের কথাগুলো তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
—“মানে, কি বলতে চাইছো। আমি তো জানতাম তোমার মা তোমাদের গ্রামের বাড়িতে আর রেহান তোমার সাথেই…”
রেহান চোখের পানি চিকচিক করছে। অথচ মুখে এক ফালি হাসি ঝুলিয়ে বলতে লাগলো,
“তুমি দেখছি কিছুই জানো না।হঠাৎ কি ভেবে আজ পুরোনো ঘা-এর খোঁজ নিতে এসেছো? আমার হয়ে তো আর ফিরে আসনি, তবে কখনো আর নাই ফিরতে। বাকিটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে নিতাম আমি।
জানোই তো,যে ভালোবাসে সে কখনো একা থাকে না। তার সঙ্গী থাকে তার হৃদয়। যা বিধ্বস্ত হলেও গ্রহনযোগ্য।”
—“রেহান প্লিজ বলো, রোহানের কি হয়েছে? ও কিভাবে…”
—“জানি না, ম’রে গিয়েছে নাকি বেঁচে রইছে তা সত্যিই জানি না। দুবছর আগে হুট করেই গায়েব হয়ে যায়। তোমার মতো ওকেও কোথাও খুঁজে পায়নি। এবার তোমায় দেখার পর শুধু ওর আশায় রয়েছি। যদি কখনো ফিরে আসে তবে আমিও সবকিছু ছেড়ে ওকে নিয়ে দূরে সরে যাবো। আর হ্যাঁ,ভুলেও এই সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করো না। আর কি বলবো, এইটুকুই। প্রার্থনা করি, যেখানেই যেভাবে থাকো সবসময় হাসিখুশি থাকো। আমায় যেতে হবে, স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হবে। ওরা আমার অপেক্ষায়।”
রেহান কথাগুলো অকপটেই বলে ফেললো। যেন নিষ্প্রাণ দেহের কোনো নিষ্প্রাণ মানব কথা বলছে। সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে রেহান আনায়ার সামনে হতে পালাতে চাইছে। তার বলার হয়তো ছিলো অনেক কিছুই কিন্তু শেষমেশ যেন আর কিছুই বলতে পারলো না। এরই মাঝে আনায়া আবারও রেহানের ভাবভঙ্গি দেখে অকপটে বললো,
“তুমি কি পালাতে চাইছো?”
—“হঠাৎ এমনটা কেন মনে হচ্ছে তোমার? শোনো মেয়ে অতিথি পাখি, এই জীবনে আমি শুধু আমার বউপাখিকেই ভালোবেসেছি। কিন্তু তুমি বললে সে মৃ”ত। কারণ আমি যাকে বউপাখি ভেবেছিলাম সে আদতে অতিথিপাখি। যেভাবে সে আমার জীবনে সবকিছু পরিপূর্ণ করতে এসেছিলো,ঠিক সেভাবেই সবকিছু সাথে করে নিয়ে গিয়েছে সে। আপাতত তোমায় আর আমি নিজের বউপাখি ভেবে বড় কোনো ভুল করতে চাই না।
আর আমার বউ পাখি শুধু আমার ছিলো, আমারই থাকবে। এই জীবনে আর কোনো অতিথি পাখিকে জায়গা দিতে চাই না আমি।”
আনায়া তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বসলো,
“তোমার কথাগুলো অগোছালো রেহান। যাই হোক, যেটা বলতে চাইছো। ঠিক তেমনটাই হয়তো আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমি অস্বীকার করতে পারবো না, আমি যেমন অন্যকারো অর্ধাঙ্গিনী তেমনি একসময়ের তোমার জীবনে বউপাখি হয়ে আসা বহুরূপী অতিথি পাখি। এটা হয়তো তোমায় ভাষায়।
আমার সহজ ভাষায় যদি বলি,তোমার প্রতি আমার অনুভূতি এখনো হৃদয়ের গভীরে অমলিন হয়ে রয়েছে। তবে সময়ের নিষ্ঠুর বিধান এবং বাস্তবতার প্রাচীর আমাদের মাঝে এমন একটি দূরত্ব তৈরি করেছে, যা পার হওয়া আর সম্ভব নয়।
তুমি আমার জীবনের এমন একটি অধ্যায়, যা কখনোই শেষ হবে না। তবে সেই অধ্যায় নতুন কোনো গল্প যোগ করার আর সুযোগ রাখেনি। হৃদয়ের সেই কোণটি শুধু তোমার স্মৃতির জন্যই রয়ে যাবে।
আর এটাও সত্য যে, তোমার প্রতি আমার অনুভূতি এখনো আগের মতোই তীব্র। তবে পরিস্থিতির পরিক্রমায় আমি বুঝে গেছি, কিছু ভালোবাসা চিরদিনের হলেও, তা শুধুই নীরব থেকে যায়। যথারীতি সেই অনুভূতিটুকু চিরকাল নিঃশব্দে আমার হৃদয়ে বাস করবে।
কারণ আমি জীবনে প্রথমবার মনপ্রাণ দিয়ে কাউকে পাওয়ার জন্য ভালোবেসেছিলাম। সেটা পৃথিবীর আর সবার কাছে ছলনার গল্প হলেও, আমার কাছে তা ভালোবাসাই ছিলো। কিন্তু এসবকিছুর উর্ধ্বে এটাই সত্য যে, আমি কারো অর্ধাঙ্গিনী সাথে একটা মৃ”ত লাশও। আমি কোনোদিনও আর তোমার হতে পারবো না। পারলে মন থেকে এই সত্যটা মেনে নিও।”
_______________
সন্ধ্যা রাতের রাস্তার মাঝ দিয়ে সাই-সাই করে এগিয়ে চলছে কালো কুচকুচে মার্সিডিজ। আনায়া নির্বিকারে ড্রাইভিং করছে আর আনায়ার পাশে হুডিতে হাত গুঁজে চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে রইছে কেনীথ। অবশ্য আনায়ার চোখমুখও যথেষ্ট গম্ভীর।
কিছুক্ষণ আগে আনায়াই কেনীথকে বাসা থেকে নিয়ে এসেছে। আর সেই তখন থেকেই দুজনের মধ্যে পিনপতন নীরবতা। এই পর্যায়ে কেনীথ আনায়ার দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগলো,
“রেহানের সাথে দেখা করেছিস?”
আনায়া কেনীথের দিকে ফিরে তাকালো না বরং একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“হুম।”
আনায়াকে হঠাৎ এমন চুপচাপ গম্ভীর দেখে কেনীথ বলতে লাগলো,
“হঠাৎ চেহারার এই হাল কেনো? পুরনো প্রেমিকের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলি, মুড তো আরো ভালো থাকার কথা।”
আনায়া এবারও কেনীথ দিয়ে তাকালো না। বরং সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই বললো,
“সামনে কোথাও গাড়ি থামাই, কি বলো? আইসক্রিম খাবে? জ্বালাপোড়া কমবে হয়তো।”
এইবার কেনীথ কড়া চোখে আনায়ার দিকে ফিরে তাকালো। আনায়াও গাড়ির স্পিডটা কমিয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর্যের সাথে হেসে বললো,
“আজ একটা বিষয়ে জানতে চাই, উত্তর দেবে?”
কেনীথ আনায়ার দিকে তাক করে রাখা নিজের কড়া চাহনিকে স্বাভাবিক করলো। অন্যদিকে আনায়াও সমানের দিকে পুনোরায় তাকিয়ে বললো,
“সত্যি করে বলো তো, কোনোদিনও কি আমায় তুমি ভালোবেসে ছিলে?”
~চলবে….
#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা তুশ্মি (#তুশকন্যা)
পর্ব→৩৭(৩য় অংশ)
“সত্যি করে বলো তো, কোনোদিনও কি আমায় তুমি ভালোবেসে ছিলে?”
কেনীথ আনায়ার কথায় নির্বিকার বসে রইলো। অন্যদিকে আনায়াও কেনীথের থেকে কোনো উত্তর না পাওয়ায় রুক্ষ হেসে পাশে ফিরে তাকালো। তাকিয়ে দেখলো কেনীথ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
—“ভালোবাসোনি কখনো, তাই না?”
—“জানি না।”
কেনীথের অকপটে বলা কথায় আনায়া কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে বললো,
“তবে জানোটা কি? কিভাবে শুধু মানুষের জীবন তছনছ করতে হয়? আমার না আফসোস হয়, বাবা পাগল ছিলো। যা করেছে তা কোনো জানো”য়ারের চাইতেও কম কিছু নয়। তবে সেদিন একটা কাজ অসম্পূর্ণ রেখে বড্ড ভুল করেছে। তোমার বাবা মায়ের সাথে তোমাকেও উপরে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত ছিলো। ওহ,তোমাকে ছাড়া আমি আবার একা একা কি করতাম। আমাকেও মে”রে ফেলা উচিত ছিলো। তাহলে হয়তো আজ আর বিনাদোষে কতগুলো জীবন শেষ হতে দেখতে হতো না।”
আনায়ার কথা শেষ হতেই কেনীথ আনায়ার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে পুরনোয় অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এদিকে আনায়ারও যেন কেনীথের এহেন নির্বিকার ভাবভঙ্গিতে খুব বেশি বিরক্ত। দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ কেনীথকে দেখার পর পুনোরায় নজর সামনে ফিরিয়ে আবারও বলতে লাগলো,
“এতো সহজে ম”রবে না তুমি তাই না? আচ্ছা তুমি আমায় এটা বলো তো, তুমি ঠিক চাও। তোমার জীবনে আর কি অপূর্ণতা রয়েছে যা পূর্ণ হলে তুমি তোমার এই ধ্বং”সলীলা থামাবে? আমায় আর কি করতে হবে বলো? সাত বছর তো ম”রার অভিনয় করলাম। কই কিছুই তো হলো না, শুনেছি দু-এক বছর বউ ম”রার বিরহে কাটিয়েছো,এরপর? সেই আবার তোমার অমা”নুষিক কার্যক্রম শুরু। বারবার এভাবে চুপ করে না থেকে দয়া করে বলেন, আর কার কার জীবন ধ্বং”স করতে চান?”
—“প্রাক্তনের বিরহের গল্প তবে মস্তিষ্কে একটু বেশিই লাড়াচাড়া দিয়েছে।”
—“এ্যা…ই, অসময়ে ফালতু কথা বলে মেজাজ খারাপ করাবে না। নয়তো গাড়ি নিয়ে কিন্তু সোজা উপরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবো।”
—“তোর আ”জাইরা তেজ আমায় দেখাতে আসবি না।”
কেনীথের নির্বিকার কথাবার্তা আর আনায়ার রাগ-বিরক্তি মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ায় বড়সড় কিছু হওয়ার আভাস দিচ্ছে। তবে আনায়া মোটেও ইচ্ছে নেই এই মূহুর্তে কেনীথের সাথে এসব বিষয়ে লাগার। বরং বারবার তার নজর সরে যাচ্ছে তাদের গাড়ির পেছনে থাকা একটা কালো রংএর বড়সড় গাড়িটার দিকে। সাইড মিররে কয়েকবার আনায়ার সেই গাড়িটির দিকে নজরও পড়েছে। যদিও বিষয়টা সে গুরুতর ভাবে দেখছে না। তবে সেই কখন থেকে খেয়াল করছে যে তার গাড়ির স্পিড বাড়ানো কিংবা কমানোর সাথে সাথেই পেছনের গাড়িটিরও গতি বাড়ছে-কমছে। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই গাড়িটি তাদের ফলো করছে। আবার না খুব বেশি সামনে যাচ্ছে না খুব বেশি পেছনে, একদম তাদের গাড়ির স্পিডের সাথে সমানতালে এগিয়ে আসছে। এদিকে আনায়া চুপচাপ থাকার মাঝেই কেনীথ আকস্মিক অদ্ভুত স্বরে বলতে লাগলো,
“আমি ম”রলে সবচেয়ে বেশি খুশি তুই-ই হবি, তাই না?”
কেনীথের কথা আনায়া নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে কেনীথের দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলো কেনীথের নজর সামনের দিকে। আনায়াও পুনোরায় নিজের নজর সামনের দিকে ফিরিয়ে খানিকটা কঢ়া কন্ঠে বলতে থাকলো,
“অবশ্যই, একদম ঠিক বলেছেন। আপনি ম”রলে সবচেয়ে খুশি তো আমিই হবো। এতোই খুশি হবো যে আমি নিজেও খুশিতে ম””রে যাবো।”
এই বলতেই না বলতেই আনায়া আচমকা গাড়ির স্পিডটা বাড়ালো। অন্যদিকে কেনীথও আকস্মিক আনায়ার কথায় কিঞ্চিৎ মুচকি বাঁকা হাসলো। তবে আচমকা আনায়ার হেঁচকির আওয়াজে কেনীথ ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“এমন উটপাখির মতো শব্দ না করে পানি খা। এসব আওয়াজ শুনতে বিরক্ত লাগে।”
আনায়াও বিরক্তির সাথে বললো,
—“হেঁচকির আওয়াজ উটপাখির মতো?কোথায় পাও এসব লজিক।…পানি দেও… পানির বোলতটা কোথায়?
কেনীথ একটু খুঁজে নিয়ে পানির বোতল বের করতেই দেখলো পুরো বোতলটা খালি পড়ে রইছে। এটা দেখামাত্রই আনায়ার সাথে সাথে কেনীথও বিরক্ত হলো। আনায়া আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি নিয়ে মোটামুটি নির্জন একটা রাস্তার পাশে গিয়ে থামালো। রাস্তার দুপাশে মোটামুটি কয়েকটা দোকান রয়েছে। কেনীথ যেতে চাইলেও আনায়া বাঁধা দিয়ে গাড়ি থেকে কিছুটা কাছেই থাকা দুটো খোলা দোকানে গিয়ে দেখলো খাবার পানি নেই। তবে রাস্তার অপর পাশে কয়েকটা বড় দোকান রয়েছে, সেখানে পানি পাওয়া নিশ্চিত। আনায়াও যথারীতি জানালা দিয়ে কেনীথকে ইশারা করে রাস্তার অপর পাশে পৌঁছে গেলো।
এদিকে কেনীথ গাড়িতে বসে বসে আনায়াকে দেখতে থাকা অবস্থাতেই হুট করেই গাড়ি হতে বেড়িয়ে এলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষের ভীড়ও তেমন নেই। মাঝেমধ্যে কয়েকটা গাড়ি রাস্তা দিয়ে চলাচল করছে। রাস্তায় তেমন চকচকে আলো দেওয়ার মতো লাইট, ল্যাম্পপোস্ট খুব একটা নেই। বোঝাই যাচ্ছে শহর থেকে তারা অনেকটাই দূরে। কিন্তু আনায়া ঠিক কোথায় যাচ্ছে তা নিয়ে কেনীথ অবগত নয়। কেনীথ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রাস্তার অপর প্রান্তের দূরের দোকান গুলোর ভীরের ভিতের তাকিয়ে থাকা আনায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। অসময়ে যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কেনীথ তার এই অজানা অনুভুতির সাথে পরিচিত নয়। কিছু অজানা বিষয় নিয়ে তার মস্তিষ্ক ভাবতে বসেছে।
কেনীথের এই খেয়ালে-বেখেয়ালির মাঝেই আচমকা তার সামনে বৃদ্ধ মহিলা এলো। পরনে সাদাকালো শাড়ি। মাথায় বড় ঘোমটা দেওয়া। চুলগুলো সাদা কালো। কিছুটা কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে রইছে। হাতে একটি ছোট বাচ্চার ন্যায় কিছু কাপড়ের আদলে পেঁচানো। কেনীথের পর্যবেক্ষণে এমনটাই মনে হলো। তবে হঠাৎই এই বৃদ্ধার আগমন কোথায় হতে এলো তা কেনীথের ঠিক বোধগম্য হলো না। আড়চোখে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো দূরে দূরে শুধু মানুষের চলাচল আর কয়েকটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা। কেনীথের মনোযোগ সরে এলো নারীটির কথার স্বরে। আচমকাই নারীটির বৃদ্ধ মহিলার মতো কন্ঠস্বরে থেমে থেমে বলতে লাগলো,
“বা…বা! একটা সাহা…য্য করবে?”
কেনীথ কপাল কুঁচকে ফেললো। নারীটি লম্বায় তার সমান না হলেও কুঁজো হয়ে থাকায় কেনীথ আর তার মুখটাও ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে না। তবে কুঁচকে যাওয়া গলা, হাত আর মুখের কিছুটা অংশ নারীটিকে তার বৃদ্ধার মতোই লাগছে। তবুও কি যেন একটা কনফিউশান থেকেই যাচ্ছে। কেনীথ আজ অদ্ভুত ভাবে কেনো যেন এসব ভাবতেও বসেছে। এরই মাঝে নারীটি আবারও বলতে লাগলো,
“বাবা,দয়া করে আমার এই নাতনীটাকে ধরবে? আমি একটু ঐ দিকটায়… টয়লেটে যাবো, এক্ষুণি চলে আসবো।”
কেনীথ আবারও কপাল কুঁচকে কাপড়ে পেঁচানো বাচ্চাটার দিকে তাকালো। মুখটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘুমন্ত বাচ্চাকে কাপড় দিতে পেঁচিয়ে রাখা রয়েছে। কেনীথ আকস্মিক কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। এই স্বাভাবিক বিষয়টাকেও সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। কেনীথ আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কাছে দূরে ওয়াশরুম থাকলে থাকতেও পারে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিকও না।
কেনীথও আর বেশি ভাবলো না। নারীটির মৃদু কাঁপা কাঁপা হাত হতে মোটা কাপড়ের প্রলেপে পেঁচানো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিলো। কেনীথ বাচ্চাটার দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। কুঁচকে যাওয়া কপালটা মিলিয়ে গেলো। একদম ফুটফুটে একটা চেহেরা তার চোখের সামনে দৃশ্যমান। কালো কুচকুচে পাপড়িগুলো নিস্তব্ধে বুঁজে রইছে। কোনো নড়চড় নেই। কেনীথ ভেবেই নিলো বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে।
এছাড়া আকস্মিকই তার নিজের অনাগত সন্তানের কথা স্মরণ হলো। সে সময়ের সবকিছু যদি ঠিক থাকতো তবে আজ নিশ্চয় তারও একটা একটা সন্তান থাকতো। এতদিনে যথেষ্ট বড়ও হতো। তাকে বাবা বলেও ডাকতো। সেও তো বাবা হতে পারতো। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। শুধু হয়েছে ধ্বং”স। সবকিছু ধ্বং”স হয়েছে।যার সবকিছু পেছনে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে সে নিজেই দায়ী।
কেনীথ কিছুক্ষণের জন্য ধ্যানে হারিয়ে গিয়েছিলো। হুঁশ ফিরতেই জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাচ্চাটা থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো সেই বৃদ্ধা নারীটি আর নেই। কেনীথ ত্বরিত পাশে ফিরে তাকাতেই দেখলো সাদা কালো শাড়ি পড়া নারীটি দূরে থাকা একটা কালো গাড়ির পেছনে যেতেই সে কেনীথের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলো। অন্যদিকে কেনীথ নজর ফিরিয়ে রোডের অপরপ্রান্তে তাকাতেই দেখলো আনায়া একটা পানির বোলত হাতে নিয়ে তা খেতে খেতে রাস্তা পেরোনোর জন্য উদ্বিগ্ন। তবে কেনীথ তার দিকে তাকাতেই আনায়াও কেনীথের দিকে অপর পাশ হতে কপাল কুঁচকে তাকালো। হাতের ইশারায় বোঝালো কেনীথের হাতে কি রয়েছে। কেনীথ আনায়ার ইশারায় কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। বরং এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে পুনোরায় বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকালো। তবে এবার আকস্মিক ভাবেই কোথাও হতে একপ্রকার টিক টিক টিক আওয়াজ শুনতে পেলো। আওয়াজ হয়তো সে বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ায় পর হতেই অনুভব করছিলো তবে মনোযোগী না হওয়ায় বিষয়টা বুঝতে পারেনি। অবশ্য এই আওয়াজ নিত্যান্তই মৃদু। কেনীথ আকস্মিক থমকে গিয়ে কি যে ভেবে আচমকা বাচ্চাকে পেঁচিয়ে রাখা কাপড়টা এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো। মূহুর্তেই তার সামনে দৃশ্যমান হলো বাচ্চাটার পেট বরাবর সদ্য সেলাই করা কাঁ”টা অংশ। কেনীথের আর বুঝতে বাকি নেই যে কি হতে চলেছে।
সে আচমকা একবার পাশে ফিরতেই তার নজর পরলো দূরে কালো রংএর গাড়ির পাশে আবছা আলোয় সটান ভাবে দাঁড়িয়ে সাদা শাড়ি পড়া সেই নারীটির দিকে। দূর থেকে চেহেরাটা স্পষ্ট নয় অথচ কেনীথের সামনে কুঁজো হয়ে থাকা নারীটির ভাবমূর্তি এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্ধকার আবছা আলোতেও কেনীথের কাছে নারীটির চোখ জোড়া যেন ভিন্ন কিছুর আভাস দিচ্ছিলো। সে তীর্যক দৃষ্টিতে কেনীথের দিকে তাকিয়ে।তবে কেনীথ যখনই তার হাতে ছোট্ট রিমোট সরূপ কিছু ধরে থাকতে দেখলো তখনই কেনীথের টনকনড়লো। মূহুর্তেই আগপাছ কিছু না ভেবে নিজের হাত থেকে বাচ্চাটাকে নিজের গাড়ির খোলা জানালার দিকে ছুড়ে মেরে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রায়শে ছুটতে নিয়েছিলো তো ঠিকই। কিন্তু তার আগেই বিকট শব্দে পুরো জায়গায় জুড়ে আকস্মিক কেঁপে উঠলো।
ধ্বংসয’জ্ঞের ন্যায় গাড়ির আশেপাশের প্রতিটি অংশ ভেঙ্গে ছিটকে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। আশেপাশের মানুষজন আ”তংকে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালো। কিছুজনে ছিটকে যাওয়া গাড়ির বিভিন্ন অংশের দরুন আঘাতপ্রাপ্ত হলো। কেউ বা দৌড়ে ছুটে এলো নয়তো দূরে সরে গেলো। ধ্বং”সপ্রাক্ত বিধস্ত গাড়িতে দাও দাও করে করে আগুন জ্বলছে। আর এতোসব কোলাহলের মাঝে কেনীথ ছিটকে রাস্তায় একপাশের কোণায় আধম”রা হয়ে পড়ে রইছে। মাথা ফেটে র”ক্ত ঝড়ছে, হাত পা শরীরের বিভিন্ন অংশে ছিঁলে গিয়েছে। এরইমাঝে একদল লোকজনের কোলাহলে গাড়ির আশপাশটা ঘিরে ধরলো।
অন্যদিকে রোডের অপরপ্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আনায়া। আকস্মিক এ ঘটনায় তার হাত থেকে পানির বোতলটাও পড়ে গিয়েছে। স্তব্ধ নয়নে বিস্মিয়ের সহিত চারপাশের মানুষজনের ছোটাছুটি দেখছে। আনায়ার ধ্যান ফিরতেই নিজের অকার্য দেহটাকে নিয়ে ছুটতে লাগলো। ভীরের মাঝে ঢুকে পাগলের মতো এদিকে ওদিক কেনীথকে খুঁজতে লাগলো। লোকজন গাড়ি সহ আশেপাশের আগুন নিভাতে ব্যস্ত। কিন্তু আনায়া ছন্নছাড়া অগোছালো হয়ে কেনীথকে খুঁজে চলেছে। কিন্তু কেনীথের সাক্ষাৎ তার মিলছে না। নাহ!কেনীথ আশেপাশে কোথায়ও নেই। এরই মাঝে আনায়ার নজর পড়লো আচমকা দ্রুত গতিতে ছুটে চলা সেই কালো গাড়িটার দিকে। কেন জানিনা আনায়ার মনে হলো, এইমাত্র গাড়িটায় কয়েকজন লোক কাউকে তুলে নিয়ে চলে গেলো। যদিও সে পুরোপুরি খেয়াল করেনি তবুও কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়েছে সে।যে কারণে এই মূহুর্তে প্যানিক করে আর সময় নষ্ট করার মতো কোনো মানেই নেই। আনায়া আকস্মিক ঢোক গিলে নিজেকে দৃঢ় করলো। অতিদ্রুত ভীরের মাঝ হতে বেরিয়ে এসে প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দ্রুত কাউকে কল করলো। ফোনের অপর প্রান্তের ব্যাক্তিটি কল রিসিভ করা মাত্রই আনায়া তড়িঘড়ি করে বলতে লাগলো,
“কেনীথকে নিয়ে গিয়েছে। যা করার এবার খুব দ্রুত করতে হবে। এসব কে করছে না করছে, মাস্টারমাইন্ড কে সবটা জানা চাই আমার। কিন্তু এর আগে কেনীথকে বাঁচাতে হবে।ওদের আস্তানায় যেভাবেই হোক পৌঁছাতে হবে আজ। আমার মন বলছে, কেনীথকে পেয়ে গেলে ইনায়াকেও পেয়ে যাবো। বহুদিনের পরিকল্পনা এদের, কিছু তো গড়বড় রয়েছে এখানে। শুধু বরাবরের মতো হাতে ছোঁয়ার বাহিরেই রয়ে গিয়েছে।”
_____________
রাত এগারোটা পেরিয়েছে। শহর থেকে অনেকটা দূরে নির্জন আবছা আলোয় পরিপূর্ণ রাস্তায় অনেকক্ষণ পরপর দু-একটা গাড়ি চলাচল করছে। রাস্তার দু’ধারে বড়বড় গাছপালা আর কিছুটা দূরত্ব পেরিয়ে বড়বড় ল্যাম্পপোস্ট। এমনই এক পরিস্থিতিতে মোটামুটি আলো রয়েছে এমন জায়গায় রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে আনায়া।
পরনে একটা ওয়েস্টার্ন স্টাইলিশ ড্রেস। যতদ্রুত সম্ভব পরিকল্পনা অনুযায়ী সোজাসাপটা সেজে আসা যায়। চুলগুলো একদম কোনোমতে ঠিকঠাক করে ছেড়ে রাখা। কানে তার ছোট্ট ব্লুটুথ ইয়ারপড। এছাড়া বর্তমানে আনায়া দৃঢ়তার সহিত ধীর আওয়াজে কথা বলতে ব্যস্থ। অনবরত অপর প্রান্তের ব্যক্তির দেওয়া সিগন্যালে মনোযোগী সে।
সন্ধ্যারাতের সে ঘটনার পর আনায়া খুব বেশি দেরি না করে সেখান থেকে দ্রুত বেড়িয়ে পড়েছিলো তার মূল গন্তব্যে। যেখানে তার কেনীথকে সহ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। দেশে আসার পর আনায়া অনেকটা গোপনেই একজন বিশেষ ব্যক্তির সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ বলতে আনায়া পূর্বপরিচিত নয় বরং সেই লোকটি আনায়ার কাজে সাহায্য করতে পারবে। আর দেশে আসার পর থেকে আনায়াকে এই ব্যাপারে গোপনে সাহায্য করে যাচ্ছিলো ইমন। সেই ইমন যার হাত ধরেই আনায়া কেনীথের সাক্ষাৎ কিংবা পি এ হওয়ার সূত্রপাত হয়েছিলো। আনায়ার মনে হয়েছিলো বরাবরের মতো ইমন তাকে কোনো না কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারবে। নয়তো দেশে এমন কেউ নেই যে আনায়া এই অল্প সময়ের মাঝে বিশ্বাস করবে কিংবা লুসিয়ার পাঠানো লোকেদের সাহায্য নিয়ে কিছু করতে পারবে। কেননা আনায়া মোটেও চায় না যে কেনীথের নানী লুসিয়া কোনো ভাবেই তার দেশে আসার মূল মনোভাব সম্পর্কে কিছু জানতে পারুক।
যথারীতি আনায়া ইমনের সাথে সবকিছু শেয়ার না করলেও তার সাহায্য নিয়ে একজন বড়সড় আন্ডারগ্রাউন্ড ক্রা”মই ফিক্সার কিংবা ইনফরমারের সাথে যোগাযোগ করে। অতঃপর সেই ব্যাক্তির সাহায্য নিয়ে শেষমেশ এটুকু জানতে পেরেছে এই পুরো গেইমের সাথে অলিভার নামক একজন জড়িত রয়েছে এছাড়া এদের পুরো একটা টিম দেশের মধ্যেই গোপনে নিজেদের আস্তানায় কয়েকবছর ধরেই সিক্রেট কোনো ক্রা”মই করে যাচ্ছে। আর এরাই হয়তো কেনীথকে নিয়ে গিয়েছে এবং ইনায়ার সন্ধান এদের কাছ হতেই পাওয়া যাবে। এইজন্য আগে তাদের আস্তানা খুঁজে পাওয়াটা খুব জরুরী। এবং ইনফরমেশন অনুযায়ী আজ ঠিক এই রাস্তা দিয়েই অলিভার নামক লোকটি যাওয়ার কথা রয়েছে।
এছাড়া অলিভার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এটুকু জানা গিয়েছে যে এই লোক বহু বছর ধরেই বিভিন্ন ক্রাইমের সাথে জড়িত রয়েছে। আর এ কেনো বাংলাদেশীও নয়। অলিভার একজন বিদেশী এবং কোনো ইন্টারন্যাশনাল ক্রা”ইম টিমের হয়ে হয়ে কাজ করে যাচ্ছে৷ এছাড়া তাদের পরিকল্পনার প্রয়োজনে আরো একটি তথ্য মিলেছে যে এই অলিভার মেয়েলোকের প্রতি একটু ভিন্ন ভাবেই আকৃষ্ট। যেটাকে স্যাটাইরিয়াসিসও বলা চলে। আর যদি এই সুযোগ কাজে লাগানো যায় তবেই কিছু একটা করা সম্ভব। নয়তো এদের মতো ধূর্ত ব্যাক্তিদের ধরাটা অনেকটাই অসম্ভব।আর না তাদের কাছে যথাযথ কোনো পরিকল্পনা রয়েছে।
আনায়া ফিসফিস করে সেই ব্যক্তি আর ইমনের সাথে কথা বলছে। এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যেই গাড়িতে করে এই রাস্তায় অলিভারের যাওয়ার কথা। আনায়া ইচ্ছে করেই নিজের সাথে ইমন বা অন্য কাউকে নেয়নি। তাদের এই পরিকল্পনা খুব বেশি জোরদার নয়। তবে এই মূহুর্তে এরচেয়ে বেশি কিছু করাও সম্ভব নয়।
অনেকক্ষণ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও রাস্তায় কোনো গাড়ির চলাচল নেই। আনায়া বিরক্ত সাথে অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছে। অলিভার ব্যতীত অন্যকেউও তো এই মূহুর্তে যেতে পারে। কিন্তু সে কিভাবে বুঝবে ঠিক কোনটা অলিভার। এই পরিকল্পনার তো কোনো নিশ্চয়তাই নেই। কি হচ্ছে না হচ্ছে, এই সময়ে ঠিক কি করা উচিত তার কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। অন্য কারো হতে যে সাহায্য নিবে সে উপায়ও তো নেই। এই মূহুর্তে কাউকেই সে বিশ্বাসও করতে পারছে না। যদি বিশ্বাস করা সম্ভবই হতো তবে আজ ইনায়াকেও এভাবে খুঁজে হতো না। আর না কেনীথের এই হাল হতো।
এরই মাঝে আনায়া খানিকটা বিরক্ত হয়ে ফিসফিসয়ে বললো,
—“কাজ হবে তো?সেই কতক্ষণ হয়ে গিয়েছে এখনো একটা গাড়িও আসেনি এদিকে।”
—“অস্থির হবেন না। এই মূহুর্তে ধৈর্য ধরা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই। ওরা যেনো তেনো কোনো ক্রি”মিনাল নয় যে সহজেই ধরে ফেলতে পারবো। আর আমাদের প্লানটাও যাস্ট অন্ধকারে ঢিল ছোড়বার মতো। আপনি শুধু ধৈর্য ধরুন আর সত”র্ক থাকুক।”
আনায়া অপরপ্রান্তের ব্যক্তিটার কথা শোনামাত্রই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর আচমকাই একটা কালো রংএর গাড়ির দেখা মিললো। ভালোই দ্রুত গতিতেই ছুটে আসছে। আনায়া ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলো। সময়টা ঠিকঠাক, এবার আরেকটা রিস্ক নেওয়া যাক। আনায়া শুধু ধীর সুরে আরেকবার বললো,
“একটা গাড়ি আসছে। আমি ট্রাই করে দেখি, যা হওয়ার হবে।”
—“জ্বী!জ্বী! আরেকটা বিষয়, অলিভার যেহেতু বিদেশী তাই আপনি হয়তো তাকে দেখলেই কিছুটা বুঝে যাবেন। যদি সাধারণ বা খারাপ কেউ হয়…যদি এমন কিছু আপনার মনে হয় তবে প্লিজ চলে আসবেন। এই মূহুর্তে অন্তত আপনার কোনো ভুল ডিসিশন নেওয়া উচিত হবে না।”
—“হুম।”
এরপর আর আনায়া বেশি দেরি করলো না। রাস্তার কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বিপদগ্রস্ত পথিকের ন্যায় অভিনয় করে গাড়ি থামাতে হাত উঁচিয়ে ইঙ্গিত দিতে লাগলো। আনায়ার মনে যথেষ্ট সং”শয় রয়েছে। শুরুতে একটা গাড়ি থামিয়েছিলো তবে সেখানে শুধুমাত্র একজন সাধারণ মানুষ ছিলো। সেই সময় কোনো মতে তালবাহানা দিয়ে বিষয়টা কাটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু এবার কি হতে চলেছে সে নিজেও জানে না।
তবে আশানুরূপ ফল হিসেবে এবার আচমকা গাড়িটা আনায়ার সামনে এসে থেমে গেলো। আনায়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলো সোডিয়ামে আলোতে গাড়িটা একদম চকচক করছে সাথে দামী ব্রান্ডেরও মনে হচ্ছে। এই রাস্তায় এইধরনের গাড়ি কিংবা মানুষজনের যাওয়া আসার বিশেষ কোনো কারণ থাকার কথা না। আনায়ার খানিকটা সন্দেহও হলো সঙ্গে কিছুটা প্রত্যাশার আলোও দেখতে পেলো।
গাড়িটা থেমে যেতেই আনায়া নিজে থেকেই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। এরই মাঝে গাড়িটার জানালার গ্লাসটাও ভেতরে থাকা ব্যাক্তিটা খুলে ফেলেছে। আনায়া কাছে যাওয়া মাত্রই দেখতে পেলো একজন কালো কোর্ট পড়া ব্যাক্তি মুখে কালো মাক্স পড়ে বসে রইছে। আনায়াকে দেখে সেই লোক মুখ ঘুরিয়ে আনায়ার দিকে তাকালো তবে কিছু বললো না। আনায়াও নিজেকে কিছুটা দৃঢ় করে বিপদগ্রস্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
“প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। আশেপাশে একটা গাড়িও নেই। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। প্লিজ আপনি কি আমায় গাড়িতে লিফট দিতে পারবেন?”
আনায়া খেয়াল করলো মুখ ঢাকা লোকটির চোখ দুটোতে এক অদ্ভুত কা”মুকতার আভাস। আনায়া এবার আরো নিশ্চিত হলো তার অন্ধকারে ঢিল ফেলার পরিকল্পনা ভুল দিকে এগোয়নি তবে। লোকটি সম্পূর্ণ মুখ স্পষ্ট দেখা না গেলেও একে দেশী তো মনে হচ্ছে না। এরই মাঝে লোকটি নিজের মাস্ক খুলে নেশাতুর স্বরে বললো,
“অফকোর্স, কাম হেয়ার ডার্লিং।”
আনায়া কিছুটা মুচকি হাসলো। এবার তো এর কন্ঠস্বর আর চেহারায় সেও সম্পূর্ণ নিশ্চিত এটাই হয়তো অলিভার। গাড়ির দরজাট খুলতেই আনায়া গিয়ে দ্রুত গাড়িতে বসে পড়লো। সাথে কৌশলে কান থেকে ব্লুটুথটাও খুলে সরিয়ে ফেললো। নিশানা যেহেতু সঠিক জায়গায় লেগেছে তবে এটা আর আপাতত রাখা ঠিক হবে না। অলিভারের চোখে পড়ে গেলে আবার গড়বড় হয়ে যাবে। আনায়া বসার সাথে সাথেই পাশ থেকে লোকটি একদম স্পষ্ট বাংলাতে বলতে লাগলো,
“কোথায় যাবে তুমি? এখানে কিভাবে এসেছো?”
—“জ্বী!আ…আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওদের সাথে ঝগড়া হওয়া পর, মাঝরাস্তায় আসার পর ওরা আমায় ঐ রাস্তার মোড়ে রেখে চলে যায়। আমার না অনেক ভয় হচ্ছে…আমায় বাড়ি যেতে হবে। এখানকার কিছুই চিনি না আমি। কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”
আনায়া খেয়াল করলো লোকটি তার কথার দিকে কোনো ধ্যান জ্ঞানই নেই। নেশাতুর চোখজোড়া যেন সম্পূর্ণ তার দিকে বিচরণ করছে। আনায়ার পড়নে একদন স্টাইলিশ কালো রংএর পার্টি ড্রেস আর ছোট্ট একটা ব্যাগ। ফর্সা ত্বরে কালো রংএরটা মানিয়েছেও বেশ। কিন্তু ভেতরে যে তার রা”গ ক্ষো”ভের আগুন জ্বলছে তাতে মনে হচ্ছে এখনই পায়ের কাছ বাঁধা পিস্তলটা দিয়ে এখনই একে শেষ করে দিতে। আনায়া নিজেকে বরাবরের মতোই শান্ত করলো। অন্যদিকে সেই লোকটি বললো,
“কোথায় যাবে তুমি? তোমার বাড়ি কি শহরের দিকটায় নাকি?”
—“জ্বী জ্বী, প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন।”
—“আহা, সাহায্য তো আমি করবোই কিন্তু এতো রাতে তোমার বাড়ি মানে শহরের দিকে যেতে যেতে তো অনেক দেরি লাগবে। তুমি যদি কিছু মনে না করো তবে আজ রাতটা তোমায় আমি একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। সকাল হলেই না হয় আমি তোমায় তোমার বাড়ি রেখে আসবো।”
—“নিরাপদ জায়গা মানে… ঠিক কোথায়…”
—“এই যে কিছুটা সামনেই। একটু সময় লাগবে তবে বেশিদূর না। তোমার বাড়িতে পৌঁছানোর সময়ের আগেই আমরা ওখানে পৌঁছে যেতে পারবো।”
আনায়াও কিছুটা ভং ধরে বললো,
“ঠিক আছে।আমার কোনো সমস্যা নেই।”
আনায়ার কথা শোনা মাত্রই লোকটি নিজের গাড়ি স্টার্ট করলো। ভালোই স্পিডে গাড়ি চালাতে থাকলো । কিছুটা দূর যাওয়ার পর লোকটি আবারও আনায়াকে জিজ্ঞেস করলো,
“নাম কি তোমার?”
—“জ্বী…আমার নাম সান্তা মেরিসা। আমি একজন খ্রিষ্টান।”
—“ওহ, আমিও৷ আমার নাম অলিভা…আ..আমি অলিভার।”
অলিভার নিজরে নাম স্বইচ্ছায় প্রথমে বলতে না চাইলেও পরবর্তীতে বলেই ফেললো। অন্যদিকে আনায়ও কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হাসলো।
—“আচ্ছা, তুমি তোমার ফ্যামিলিকে জানাবে না যে তুমি আজ বাড়ি যাচ্ছো না?তারা তো দুশ্চিন্তা করবে।”
—“সে সুযোগ নেই। আমার ফোনের চার্জ নেই আর আমার বাবা মা কিংবা ফ্যামিলি বলতেও কিছু নেই।”
—“ওহ…সো স্যাড।”
এইরকম আরো কিছু কথাবার্তা হলো দুজনের মাঝে। অলিভার যেন অনেকটাই তিতিক্ষিত হয়ে উঠেছে। আনায়াও বরাবরের মতো নিজেকে সামলে নিচ্ছে সাথে ঠিক কোন রাস্তা পেরিয়ে অলিভার কোথায় যাচ্ছে তাতেও নজর রাখছে। ইনফরমারের তথ্য অনুযায়ী এদের আস্তানা একটাই রয়েছে এই শহরে। আনায়া কে যদি অলিভার কোথায় নিয়ে যায় তবে সেখানেই নিয়ে যাবে হয়তো।অনেকক্ষণ হয়ে যাচ্ছে, এই অলিভার কি সব অজানা অদ্ভুত রাস্তা দিয়ে নির্জন সব জায়গায় প্রবেশ করেছে। অথচ থামবার কোনো নাম গন্ধ্যই নেই। আনায়া একবার সময় দেখে নিলো। বারোটা বাজতে আরো কয়েক মিনিট রয়েছে।
এরই মাঝে আনায়া খেয়াল করলো এই অলিভার অদ্ভুত এক রাস্তা ধরে এগোতে লাগলো। চারপাশে দূরদূরান্ত হতে মানুষের আনাগোনা মিলবে কিনা সন্দেহ। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে কাঁচা রাস্তায় কোথায় হতে কোথায় যাচ্ছে কিচ্ছু টের পাওয়া যাচ্ছে না। আনায়া এই পর্যায়ে চুপ না থেকে অলিভারের উদ্দেশ্যে বললো,
“এটা আবার কোন রাস্তা। কোথায় যাচ্ছে…”
—“ভয় পাচ্ছো নাকি?”
আনায়া অলিভারে কথায় তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো,
“আরেহ না, এইসব রাস্তা আগে কখনো দেখিনি তো তাই।”
—“চিন্তা করো না। আর বেশিক্ষণ লাগবে না। চলে এসেছি প্রায়।”
অলিভারের কথামতো আনায়াও চুপচাপ বসে রইলো। এবং অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই অলিভার গাড়িটা নিয়ে বড় বড় ঘাস গাছ লতাপাতায় পূর্ণ একটা জঙ্গলের পথ ধরে এগোতে লাগলো। অনেকটা পথ এগোনোর পর অলিভার গাড়ি থামিয়ে আনায়াকে নামতে বললো। আনায়াও অলিভারের কথামতো নিচে নেমে পড়লো। অতঃপর অলিভার আনায়াকে বললো সে যেনো তার সাথে সাথে এবার সামনের দিকে এগোয়।
কিছুক্ষণের মাঝেই দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট্ট ভাঙ্গা বাড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছালো। অলিভার আনায়াকে নিয়ে সেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। বাহির থেকে অগোছালো লাগলেও ভেতরেরটা অনেকটাই পরিষ্কার। এছাড়া দুজন মানুষও কালো পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে রইছে। যারা অলিভারকে দেখে কুর্নিশ করলো।
এদিকে অলিভার গিয়ে আলগা কাঠের দেওয়ালের ছোট্ট অংশ সরিয়ে দিতেই একটা ফিঙ্গার স্ক্যানারের সন্ধান মিললো। নিজের বাম হাত ছুঁতেই সম্পূর্ণ অটোমেটিক ভাবে একটা দরজা খুলে গিয়েছে মাটির নিচে অংশের যাবার জন্য সিঁড়ি দৃশ্যমান হলো। আনায়ার কাছে এইসব বিষয়গুলো অস্বাভাবিক নয় তবে কিছুটা ভং ধরে অলিভারের উদ্দেশ্যে বললো,
“এসব কি?…মাটির নিচে যেতে হবে নাকি?”
নেশাতুর স্বরে অলিভার বললো,
“ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো। এখানে তুমি আজকের রাতটা একদম সুরক্ষিত থাকবে। সকাল হলেই তো আমি তোমায় তোমার বাড়ি পৌঁছে দেবো।”
এই বলেই অলিভার আনায়ার হাত ধরলো। আনায়াও বেশি ঘাবড়ালো না। দুজনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নিলেই পেছন হতে আপনা-আপনি দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। প্রায় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অনেকটা সিঁড়ি নিচে নামবার পর একটা বড় গেইট এবং কয়েকজন কালো পোশাক পড়া লোক পুনোরায় দৃশ্যমান হলো। তারা অলিভারকে দেখা মাত্রই মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্নিশ করলো। অতঃপর তারা গেটটাও খুলে দিতেই অলিভার আনায়াকে নিয়ে আরো ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো।
মাটির নিচে এমন অদ্ভুত জায়গায় পরিবেশটা খুব একটা ভালো লাগলো না আনায়ার। অদ্ভুত সব মেডিসিন সহ নানান টাইপের গন্ধ আশেপাশে বিদ্যমান। আবার কতগুলো রুমও চতুর্পাশে। যার বেশির ভাগই দরজা লাগিয়ে রাখা। আনায়ার ভ্রু কুঁচকে গেলেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টায় রইলো। তবে হঠাৎ কয়েকজন নার্সের পোশাক পড়া মেয়ে দেখতেই আনায়া কিছুটা অবাক হলো। মেয়েগুলোর চোখেমুখে এক অদ্ভুত আ”তংক। হয়তো সেটা অলিভারকে ঘিরেই কিন্তু আনায়া ভাবতে বসেছে এখানে আদতে হয়টা কি?
অলিভার আনায়াকে একটা রুমের কাছে নিয়ে গেলো। আনায়ার হাতটা ছেড়ে দিয়ে দরজটা খুলে দিয়ে আনায়ার উদ্দেশ্যে পেছন ঘুরে কিছু বলতে যাবে ঠিক তার আগেই অলিভার নিজের কপালে ঠেকানো কোনো সরু বস্তুর স্পর্শ অনুভব করলো। সাথে আনায়ার দৃঢ় কন্ঠস্বর।
“একদম নড়াচড়া করবি না! বল কেনীথ কোথায়?”
আনায়ার কথায় অলিভার প্রথমে খানিকটা অবাক হলেও পরবর্তীতে খুব বেশি একটা ঘাবড়ালো না। বরং নিজের নেশাতুর মস্তিষ্কের দরূন সে যে বোকামিটা করে একজন অজ্ঞাত মেয়েকে কোনো কিছু না ভেবেই এখানে নিয়েছে এসেছে, তা ভেবেই তার নিজের উপর তাচ্ছিল্য হলো তার।
অন্যদিকে আনায়ার এহেন পদক্ষেপে আশেপাশের কালো পোশাক পড়া লোকগুলো এগিয়ে আসতে নিলে আনায়া জোর গলায় চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
“খবরদার কেউ আসবে না। নয়তো একটাকেও বাঁচতে দেবো না।”
আনায়ার পিস্তল সম্পূর্ণ লোড করা রয়েছে। আপাতত শুধু মন মজরি অনুযায়ী একেকটা গুলি জায়গামতো ব্যবহার করা। আয়ানার কথা না শুনেই লোকগুলো এগিয়ে আসতে নিলে আনায়া পিস্তলটা আরো শক্ত করে অলিভারের কপালে চেপে ধরলো। যথারীতি অলিভারও নিজের সবাইকে ইশারায় কাছে আসতে মানা করলো। ততক্ষণে আনায়া কিঞ্চিৎ রুক্ষ হেসে বললো,
“ভেরী গুড, এবার বল কেনীথ কোথায়?ওকে কেনো ধরে নিয়ে এসেছিস? আর ই…”
আনায়ার কথা সমাপ্ত হবার পূর্বেই অলিভার জোরে আনায়ার পায়ে ল্যাং মা”রলো ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টায়। আনায়াও আচমকা নিজেকে সামলাতে না পেরে ছিটকে নিচে পড়ে গেলো। সাথে হাত থেকে পিস্তলটা ছুটে সরে যেতেই অলিভার দ্রুত সেটা তুলে নেওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হলো। তবে আনায়া ঠিক তার আগেই নিচ থেকে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা হাতে না আগপাছ কিছু না ভেবে সোজা অলিভারকে নিশানা করে শুট করলো। ঘটনা এতোই দ্রুত ঘটলো যে অলিভার সহ আশেপাশের কেউই তা বুঝতে পারেনি। আনায়া নেহাতই প্রচন্ড ক্ষি”প্ত, খোলা চুলগুলো বিচ্ছিন্ন ভাবে এলোমেলো।আনায়া থামলো না বরং অলিভারকে কোনো সুযোগ না দিয়েই ওর বুক বরাবর আরো দুটো গুলি বিঁধিয়ে দিলো। অলিভার আকস্মিক নিচে পড়ে যেতেই আশেপাশে থেকে যে কয়েকজন লোক দৌড়ে এলো, আনায়া একে একে তাঁদেরকেও গুলি করলো। চিন্তা ভাবনা যেন একটাই যে, এই মূহুর্তে কাউকে জ্যান্ত রাখা যাবে না।
আশেপাশে কয়েকটা লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তেই কয়েকজন নার্স এসবে সম্পূর্ণ ভয়ে কাঁপতে লাগলো। তারা পালিয়ে ভেতরে চলে যাওয়ার আগে আনায়া ক্ষিপ্ত স্বরে বললো,
“কেউ পালাবে না, নাহলে সবগুলোকে শেষ করবো।”
এই কথা শুনে একজন ভয়ে ভয়ে বললো,
“প্লিজ আমাদের মার” বেন না। আমাদের কোনো দোষ নেই। আমাদের এখানে জোর করে… ”
আনায়া ওদের কথা শেষ হবার পূর্বেই আবারও জিজ্ঞেস করলো,
“কেনীথ কোথায়?কেনীথকে কি করা হয়েছে?”
আনায়ার কথা মেয়েগুলো হয়তো বুঝলো না। কেনীথ নামে তো তারা কাউকে সেভাবে চেনে না।আনায়া আবারও ক্ষি”প্ত বললো,
“কি হলো, কথা বলছো না কেনো? বলো কেনীথ কোথায়?এখানে একজন লোককে আনা হয়নি? তবে বলো কেনীথ কোথায়?আমার বোন ইনায়া কোথায়? বলো ইনায়া-কেনীথ,এরা কোথায়?”
নার্সগুলো কেনীথকে শুরুতে না চিনলেও এবার আনায়ার কথায় কিছুটা অবাক হলো। তাদের ভাবনা অনুযায়ী যা বুঝলো তা হলো,আনায়া হয়তো তাদের ইনা ম্যামকেই খুঁজছে। তবে ইনা যে আনায়ার বোন এটাতে তারা কিছুটা অবাক ।এছাড়া একটু আগে তাদের ইনা ম্যাম তবে যে লোকটি ধরে নিয়ে এসেছে সেই হয়তো কেনীথ। এই ভাবনা অনুযায়ী তারা আনায়াকে বললো,
“নিচে…গ্রাউন্ড ফ্লোরে ইনা ম্যাম আছে।ঐ যে ওদিকটায় যাওয়ার রাস্তা আছে। ওখানে হয়তো ওই…আপনি যার কথা বলছেন তিনিও আছে। আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না।”
নার্সগুলো ইনাকে ম্যাম বলছে,এটা শুনে আনায়া কিছুটা অবাক হলো। বুঝতে পারছে না এরা কাকে ইনা ম্যাম বানাচ্ছে। সে যেটাই হোক, এখন এসব ভাববার সময় নেই।আনায়া কথামতো নার্সের দেখানো রাস্তা অনুসরণ করেই সামনে দিকে এগিয়ে গেলো। নিচে যাওয়ার জন্য আরো একটি সিঁড়ির রাস্তা দেখা যাচ্ছে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার তবুও আনায়া দেরি করলো না বরং অতিদ্রুত গতিতে নিচের দিকে নামতে লাগলো।
_______________
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে একটা ছোট্ট নীল বাল্বের আলোয় চারপাশটা কিছুটা স্বচ্ছ দেখা যাচ্ছে। চেয়ারের উপর বসে রইছে হাত পা বাঁধা এক বলিষ্ঠ দেহের মানব। বড়বড় চুলগুলো এলোমেলো। দেখতেও সম্পূর্ণ বিধ”স্তের ন্যায় ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে, তো মাঝেমধ্যে ঝিমাচ্ছে। মাথা সহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট ইলেকট্রোড লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বাহ্যিক পরিস্থিতি দেখে এটাই মনে হচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগেই লোকটিকে ইলেক্টিক শক্ দেওয়া হয়েছে। এই বিধ্বস্ত মানবটি আর কেউ নয় বরং কেনীথ।
সবাই যখন গাড়ির আশেপাশে গিয়ে সোরগোল করতে ব্যস্ত ছিলো ঠিক তখন কেনীথ পড়ে রইছিলো রাস্তার কোণায়। আর সেই সাদা শাড়ি পড়া নারীটি আর কেউ নয় বরং ইনায়াই ছিলো। বিকৃত মস্তিষ্কের এই ইনায়া তড়িঘড়িতেও খুব ঠান্ডা মাথায় নিজের পরিকল্পনা সাজিয়েছে। নিজেকে পরিপূর্ণ বৃদ্ধা বানাতে কোনো কসরত বাকি রাখেনি। সাথে বো”ম সেট করতে একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে বলী দিতেও দুবার ভাবেনি। তবে সে যখন দেখলো তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কেনীথ একবারেই শেষ হয়ে যায়নি তখন আর বিন্দুমাত্র সময়ও দেরী না করে দ্রুত তার লোকজন সহ গাড়ি নিয়ে লোকচক্ষুর সম্মুখীন হবার পূর্বেই কেনীথকে জোর করে গাড়িতে তোলা হয়। এছাড়া কেনীথকে সামলানোর জন্য আলাদা করে ওর ঘারে ইনায়া ইনজে”কশনও পুশ করেছিলো।
এরপর সোজা নিয়ে আসা হয়েছে এখানে। ইনায়ার কার্যক্রমে বাঁধা দেওয়ার মতো সাহস এখানে কারোরই নেই। এদিকে অলিভারও ছিলো না যে তাকে কিছু বলে আটকাতে পারবে। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে ইনায়া। বহুদিনের প্রতি”শোধের আগুন জ্বলছে ইনায়া মাঝে। কিন্তু বরাবরই তাকে নানান বাহানা করে দমিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিবারই শুনেছে কেনীথকে তার কথা মতো মে’রে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। অথচ কেনীথ নাকি এখন অব্দি ম:রলো না। একটা সময় গিয়ে ইনায়া খুব ভালো করেই বুঝেছে যে এসব একপ্রকার বাহানা। বরাবরের মতো তাকে শুধু ব্যবহার করা হচ্ছে। তারও আপত্তি ছিলো না এসব করতে। শুধু শর্ত ছিলো সে কেনীথের মৃ”ত্যু চায়। কিন্তু তার এ ইচ্ছেটাই যেন কেউ পূরণ করতে পারছিলো না।
বর্তমানে ইনায়ার হাতে ধারালো একটা প্লাস। ইনায়া সেটির দিকে একমনে তাকিয়ে। ঠোঁটের কোণায় মৃদু বাঁকা হাসি। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে তার। ধীরে ধীরে ইনায়া নিজস্ব ভঙ্গিতে কেনীথের দিকে এগিয়ে গেলো। কেনীথের সামনে যাওয়া মাত্রই ও হাঁটু গেড়ে কেনীথের সামনে বসে পড়লো। নিচ হতে মাথাটা বাঁকা করে কেনীথের বিধ্বস্ত চেহারার দিকে তাকালো। অতঃপর নিরেটভাবে বলতে লাগলো,
“তোমার মনে আছে ভিকে? একটা সময় তোমার জন্য কত পাগলামো করেছি? তোমাকে আমার নিজের আইডল ভেবেছি। হাহ! কতটা বোকা ছিলাম আমি। বড়রা সবসময় বলতো, আইডল হয় ভালোরা। তোমার মতো ইবলিশরা কখনো আইডল হতে পারে না। তবে আমি বলবো হতে পারে, অবশ্যই হতে পারে। এই যেমন তুমি আজও আমার আইডল। পার্থক্য একটাই, তখন আমি একজন রকস্টারের গানের পাগল ছিলাম। আর এখন আমি একজন পিশাচের পৈশাচিকতার।”
এইটুকু বলেই ইনায়া খানিকটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। অতঃপর স্বাভাবিক নরম কন্ঠে হয়ে পুনোরায় বলতে লাগলো,
“ভিকে! বাবার সাথে তোমার করা সবকিছু আমার চোখে ভাসছে। কি করি বলো তো? আমার না তোমার সাথেও ঠিক তেমন কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে। দেখো, এতোদিন ধরে কতকিছুর বন্দবস্ত করে রেখেছি আমি। শুধু একটাই চাওয়া ছিলো তোমার মৃ”ত্যুর খবরটা শুনতে চাই। নিজ হাতে তোমায় শেষ করতে চাই। অবশেষে যেন আজ সেই সুযোগ হয়েছে।”
এই বলেই ইনায়া কিছুটা তটস্থ হয়ে কেনীথের আঙ্গুলের দিকে তাকালো। ডান হাতের আঙ্গুল গুলোর উপর কয়েকবার প্লাস দিয়ে ছোঁয়ালো। মূহুর্তেই পৈশাচিক ভাবে কিঞ্চিৎ হেঁসে ফেললো।যদিও এখানে নিয়ে আসার পর ইনায়ার লোকজন দিয়ে নানান ট”র্চার করা হয়েছে কেনীথকে। কিন্তু একটা সময় ইনায়ার নিজ ইচ্ছেতেই সে কেনীথের সমাপ্তিটা নিজ হাতে করার সিন্ধান্ত নেয়। কোনো ভাবেই যেন তার ভেতরে জ্বলতে থাকা ক্ষো”ভের আগুন নিভছে না। ইনায়ার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে যুগের পর যুগ কেনীথ বেঁচে থাকুক, আর সে নিজ হাতে কেনীথকে ধীরে ধীরে কঠিন য”ন্ত্রণার সহিত শেষ করুক। কিন্তু পরক্ষণেই তার অস্থির মস্তিষ্ক চাইছে কেনীথকে নিমিষেই শেষ করাটাই উত্তম হবে। এতো সময় তো তার কাছে নেই।
ইনায়া আচমকাই অস্থির হয়ে উঠলো। আগপাছ না ভেবেই কেনীথের তর্জনী আঙ্গুলের নখের উপর প্লাসটা চেপে ধরলো। ধারালো অংশ দিয়ে নিমিষেই নখের পুরো অংশটা এবড়োথেবড়ো ভাবে টেনে তুলে ফেললো। নখের পাশাপাশি র’ক্ত যুক্ত খানিকটা মাং”সও ছিঁ”ড়ে উঠে এলো। কেনীথও ব্যাথার চোটে পুরো সময়টা দাঁত খিঁচে চোখ বুজে রইলো। কিন্তু ইনায়া এতে মোটেও খুশি হলো না। সে তো চাইছে কেনীথ তার বাবার মতোই কঠিন য”ন্ত্রণা অনুভব করুক। কিন্তু সেই শুরু থেকেই দেখছে যে কেনীথ সেভাবে কোনো প্রতিক্রিয়াই করছে না।এমনটা হলে কিভাবে হয়, তার তো কেনীথের হৃদ”য়বিদারক চিৎকার শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।
ইনায়া আ”ক্রশে হাত থেকে প্লাসটা দূরে ছুঁড়ে ফেললো। তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে কেনীথ চুল সজোড়ে টেনে ধরে কেনীথের ঝোঁকানো মাথাটা টেনে উপরে তুললো। কেনীথ নিভু নিভু চোখে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে। একে তো ইনজেকশনের রিয়াকশন এখনো কাটেনি তার উপর আবার টর্চা”র।
ইনায়া কেনীথের উদ্দেশ্যে হিসহিসিয়ে বলতে লাগলো,
“চিৎকার কেনো করছিস না? তোর চোখে পানি দেখতে চাই আমি। তোর আর্ত”নাদ শুনতে চাই আমি। শেষ করে দিয়েছিস তুই। সবকিছু শেষ করে দিয়েছিস। আমার পুরো পরিবার আমার প্রিয়জন, প্রত্যেকেই আজ তোর জন্য ধ্বং”স। কিসের এতো আ”ক্রোশ ছিলো তোর? আমার বাবা, আমার বোন, আমি? কি করেছিলাম তোর? জবার দিচ্ছিস না কেনো? তোর কিসের ক্ষতি করেছিলাম আমরা?বল! কথা বল কুকুর!”
কেনীথ কয়েকবার ঢোক গিললো। বলার মতো জোর নেই তার, কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। তবুও আধোআধো স্বরে আওড়ালো,
“ইনা…য়া…”
এটুকু বলতে না বলতেই ইনায়া কিছুর আওয়াজ শুনতে পেলো। মূহুর্তেই নিজের ধ্যান অন্যদিকে ফিরলো। ঘড়িতে সময় দেখলো আর মাত্র দুই মিনিট রয়েছে বারোটা বাজতে। ইনায়া ভাবতে লাগলো হয়তো অলিভার চলে এসেছে। এই মূহুর্তে যদি অলিভার এখানে চলে আসে তবে হয়তো সে তার কাজে বাঁধা দিতে পারে। কিন্তু এমনটা তো হতে দেওয়া যাবে না। ইনায়া কেনীথকে ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে রুমের দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। এটা সম্পূর্ণটাই মাটির নিচে। এবং এখানে আসার জন্য রুমের বাহিরে একটা সিঁড়ি রয়েছে। সেটা বেয়ে ওঠা নামা করতে হয়। ইনায়া তাকিয়ে দেখলো বাহিরটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন তবে উপর থেকে কারো নিচে আসার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
ইনায়া দ্রুত কেনীথের কাছে এগিয়ে এলো। ইনায়া আর কেনীথের মাঝে কিছুটা দূরত্ব রয়েছে। ইনায়া নিজের স্কার্টের পেছনে গুঁজে রাখা পিস্তলের অর্ধেকটা ধরে একটানে বের করে কেনীথের দিকে তাক করলো। ঘড়িতে তাকিয়ে একবার সময়টা দেখে নিলো। নিমিষেই অসু’স্থ মস্তি”ষ্কের ন্যায় বিস্তৃত মুচকি হেসে কেনীথের উদ্দেশ্যে বললো,
“সময় শেষ ভিকে। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। নতুন দিনের সূচনা আর তোমার জন্য হচ্ছে না ভিকে। আমার পুরোপুরি ইচ্ছে পুরণ না হোক, তবে তোমায় নিজ হাতে শেষ করতে পারবো এটাই আমার শান্তি। ওপারের ন’রকয”ন্ত্রণার জন্য তোমায় আমার শুভকামনা রইলো।”
এই বলেই ইনায়া সময় গুনতে লাগলো,
“দশ,নয়,আট,সাত,ছয়,পাঁচ,চার,তিন,দুই…”
ইনায়া হয়তো “এক” বলেই ট্রিগারে চাপ দিতো কিন্তু তার আগেই আকস্মিক হাতের পিস্তল থেকে গুলি ছুটলো। তবে সেটা নিশানা অনুযায়ী কেনীথের গায়ে লাগলো না বরং অন্যদিকে ছিটকে সরে গেলো। সঙ্গে ইনায়া নিজেকে সামলাতে না পারায় সেও নিচে পড়লো। তার হাতের পিস্তলটাও ছিটকে পাশে পড়ে গিয়েছে। আকস্মিক এ ঘটনায় কি ঘটলো তা বুঝবার আগেই সে খেলায় করলো তার হাতে গুলি লেগেছে। যেখান থেকে অনবরত র”ক্ত ঝড়ছে।
ইনায়া পাশে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকারে ঝাপসা আলোয় দূরে একটা মেয়ে তার দিকে পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে রইছে। যদিও ইনায়া মেয়েটার চেহেরা স্পষ্ট দেখতে পারছে না। আর তার ইচ্ছেও নেই এই মূহুর্তে তাকে দেখার। ইনায়া আক্রো”শে নিজের হাতের ব্যাথার কথা ভুলে গেলো। মূহুর্তেই পাশ থেকে পিস্তলটা তুলে নিয়ে সটানভাবে দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখেমুখে তার তীব্র ক্ষোভ।
এরই মাঝে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে র*ক্ত গরম চোখে তাকিয়ে থাকা মেয়েটা অর্থাৎ আনায়া চিৎকার করে বললো,
“সেভাবে রয়েছিস সেভাবেই থাক। নয়তো আমি আবারও শুট করতে একবারও ভাববো না।”
ইনায়ার এসব কথা শুনতে ধ্যান নেই। সে আনায়ার দিক থেকে নজর সরিয়ে কেনীথের দিকে তাক করলো। অতঃপর আনায়ার দিকে পুনোরায় মুখ ফিরিয়ে জোর গলায় হিসহিসিয়ে বললো,
“কিচ্ছু করতে পারবে না,কেউ আমার। তবুও যদি মা”রতে চাস তবে মে”রে ফেল আমায়। কিন্তু আগে আমায় ওকে নিজ হাতে শেষ করতে দে। ওকে আজ ম”রতেই হবে। ওকে আর বাঁ”চতে দেবো না আমি।”
এই পর্যায়ে আনায়া খানিকটা চমকে উঠলো। এই কন্ঠস্বর তো তার একদম পরিচিত। নিমিষেই যে মানুষটার কথা তার মাথায় এলো তাতে আনায়া আরো বেশি বিস্মিত। কিছুক্ষণের জন্য হিতাহিতজ্ঞানশূন্য মনে হলো নিজেকে। এটা তো ইনায়ার কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে, তার বোন ইনায়া। যাকে সে এতোদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ইনায়া। কিন্তু ও এখানে এভাবে… আবার কেনীথ ওভাবে…
আনায়া কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। অথচ ইনায়ার এসবে কোনো খেয়াল নেই। সেই নিজের নজর ঘুরিয়ে কেনীথের দিকে তাকালো। কেনীথের বিধস্ত হয়ে মাথা কিছুটা ঝুকিয়ে রেখেছে। আবার সে ইনায়া আর আনায়া দুজনকেই দেখার চেষ্টা করছে। আনায়ার কন্ঠস্বরেই সে বুঝেছে যে আনায়া এসেছে এখানে। বিড়বিড় করে কয়েকবার আনায়ার নামও আওড়িয়েছে কিন্তু জোর গলায় কিছু বলার মতো পরিস্থিতি নেই তার। নয়তো এই মূহুর্তে তার কিছু বলার ছিলো। কিছু নয় বরং অনেক কিছু বলার ছিলো। বিশেষ করে আনায়াকে। কিন্তু শেষ সময়ে তার এমন ইচ্ছেতেই কেনো যেন নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য হচ্ছে।
এদিকে ইনায়ার কার্যক্রম দেখে আনায়া নিজেকে তটস্থ করলো। ইনায়া এসব করতে চাচ্ছেটা কি? ইনায়াকে পরবর্তী বোঝা যাবে কিন্তু আগে ওকে থামানোটা জরুরি। আনায়া ঠোঁট ভিজিয়ে জোর গলায় থাকলো,
“ইরা! কি করছিস এসব, থেমে…”
আনায়ার কথা আর শেষ হলো না। বরং গুলির আওয়াজে মাটির নিচের এহেন বদ্ধ রুমটা যেন কেঁপে উঠলো। গুলির আওয়াজ বারবার প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করলো। আনায়া আকস্মিক স্তব্ধ হয়ে পড়লো। ইনায়া আনায়ার মুখে নাম ইরা নাম শুনে হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছিলো। সে কেনীথের দিক থেকে নজর সারিয়ে আনায়ার দিকে অবাক চাহনিতে একপলক তাকিয়ে ছিলো মাত্র। তবে ঠিক সেই মূহুর্তেই আনায়ার দিক হতে একটা গুলি গিয়ে সোজা ইনায়ার বুকের একপাশে গিয়ে লাগলো। ইনায়া ছিটকে কিছুটা গা কাঁপিয়ে পেছনে সরে গেলো।
ইনায়া যেমন আকস্মিক কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না তেমনি আনায়াও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইছে। এইবার নিজের দুহাতে ইনায়ার দিকে তাক করে রাখা পিস্তলের দিকে তাকালো তো আরেকবার ইনায়ার দিকে। বুঝে উঠতে পারছে না এইমাত্র ইনায়ার গায়ে লাগা গুলিটা কি তার পিস্তল থেকেই বেরিয়েছে? কিন্তু সে তো ট্রিগারে চাপই দেইনি এখনো। আর তার পিস্তলে তো সাইলেন্সার লাগানো রয়েছে। তার পিস্তল থেকে শুট করলে তো এতো আওয়াজ হওয়ার কথা নয়। আনায়া বোঝার চেষ্টা করলো যে গুলিটা তার পেছন থেকে গিয়ে লেগেছে ইনায়ার। এরমানে তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে রইছে। আনায়া নিজেকে কোনমতে সামলে পিছনে ফিরে সেই আগুন্তকঃ কে দেখতে যাবে ঠিক তার পূর্বেই আরো একটা গুলি গিয়ে ইনায়ার বুকের পাশে লাগলো। ইনায়াও এবার আর নিজের ভারসাম্য ধরে না রাখতে পেরে নিচে গুটিয়ে পড়ে গেলো। র”ক্তের স্রোতে তার চারপাশটা পরিপূর্ণ হতে থাকলো।
অন্যদিকে আনায়া পেছনে ঘুরে পিস্তল হাতে দৃঢ়তার সহিত দাঁড়িয়ে থাকা আগুন্তকঃ কে দেখে আকস্মিক আরো একবার চমকে উঠলো। এই মূহুর্তে তার ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত আদতে আনায়া নিজেও জানে না। সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ আর অচল লাগছে নিজেকে। বারবার এটাই মনে হচ্ছে, কেনো হচ্ছে এসব। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিলো না। কেনো সবাই এভাবে একে একে ধ্বং”সযজ্ঞের খেলায় মেতে উঠেছে। কেনো সবাই শান্তিতে বাঁচতে চাইছে না। কেনো সবাই একে অপরকে শেষ করতে ম”রিয়া হয়ে উঠছে। এ কেমন নরকের আগুনে পুড়ছে সকলে।
চলবে……