একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৩৮

0
56

#একজোড়া_আগুন_পাখি
®অরনীতা_তুশ্মি(#তুশকন্যা)

পর্ব→৩৮(১ম অংশ)

আনায়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় তার পেছনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখল। ব্যক্তিটির হাতের পিস্তলটা এখনো ইনায়ার দিকে তাক করে রাখা। আনায়া পাভেলকে এহেন কাজ করতে দেখে সম্পূর্ণ হতবাক। অন্যদিকে আনায়ার স্তব্ধ ভাবগতিক দেখে পাভেল বিচলিত হয়ে বললো,

“আপনি ঠিক আছেন তো?”

আনায়া কিছু বলল না। বরং সেভাবেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অন্যদিকে পাভেলের নজর পড়ে কেনীথের দিকে। কেনীথের এহেন অবস্থায় পাভেল নিজেও হতভম্ব। সে আনায়াকে পাশ কাটিয়ে একপ্রকার দৌড়ে কেনীথের কাছে যায়। তড়িঘড়ি করে ছটফটিয়ে অতিদ্রুত কেনীথের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিতে উদ্বিগ্ন সে। অন্যদিকে আনায়ার মস্তিষ্ক খানিকটা সচল হয়ে উঠতেই সে একবার কেনীথ আর পাভেলের দিকে নজর বুলিয়ে পুরনোয় মাটিতে পড়ে থাকা ইনায়াকে দেখে। অতঃপর খানিকটা ছুটে ইনায়ার কাছে পৌঁছে,ওর পাশে বসে পড়ে। ইনায়া চোখ বুঁজে রইছে, শ্বাসও ধীর গতিতে ছুটছে। চারপাশটা লাল র”ক্তে পরিপূর্ণ। অন্ধকারে যা স্রেফ কালচে তরল পদার্থের মতোই মনে হচ্ছে। আনায়া ইনায়ার এহেন অবস্থায় নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল৷ আকস্মিক তার চোখে পানি এসে ভীর করছে। অসহ্য লাগছে এই জীবনকে। সবাই কেনো এভাবে চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা স্বাভাবিক জীবন তো তাদেরও হতে পারতো কিন্তু…।

আনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়াকে আঁকড়ে ধরে। ইনায়ার মাথাটা কোলের উপর তুলে অসহায়ত্বের সাথে ডাকতে লাগে।

—“ইরা! ইরা! বোন আমার উঠে যা। কত্ত বড় হয়ে গিয়েছিস তুই। আমি ভেবেছিলাম তোকে হয়তো আর কখনো খুঁজেও পাবো না কিন্তু এখন… এতো বছর পর আমি তোকে এভাবে পেতে চাইনি। তুই কথা বল প্লিজ।”

আনায়া অনবরত ডাকে কিন্তু ইনায়া ওঠে না। এরই মাঝে পাভেল আনায়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল। কেনীথের বাঁধন গুলো খোলা শেষ হলে আনায়ার কাছে এগিয়ে এসে বলল,

“আপনি এভাবে কাঁদছেন কেনো? ও কে?”

আনায়া পাভেলের কথায় ওর দিকে নজর উঁচিয়ে দেখে পুনোরায় ইনায়ার দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল,

“ও ইনায়া… আমার একমাত্র বোন।”

এটুকু বলেই আনায়া কেঁদে ওঠে। অন্যদিকে পাভেল খানিকটা বিস্ময়ের স্বরে বলল,

“কিহ! ও-ই ইনায়া?”

আনায়া মাথা ঝাঁকায়। পাভেল কিছুটা ব্যস্ততার সাথে বলে,

“আপনি কাঁদবেন না প্লিজ, কিচ্ছু হবে না ওর।”

এই বলেই পাভেল গিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে সিঁড়ির উপরের দিকে উদ্দেশ্য করে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কয়েকজন লোককে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গে উপর হতে কিছু লোক নিচে নামতে লাগল। প্রথমে দুজন গিয়ে কেনীথকে ধরাধরি করে নিয়ে যেতে লাগে। কেনীথের মনে হচ্ছে যেন পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। তবুও যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে যায়। তবে তার নজর পুরোটা সময় রইল আনায়ার দিকে। আনায়া শক্ত চোখের চাহনিতে একবার তাকালেও নিমিষেই তার নজর এক অজানা তিক্ততায় ফিরিয়ে নেয়।

কেনীথও খানিকটা ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেই ঘরটা থেকে বেড়িয়ে যায় লোকগুলোর সাথে। অন্যদিকে ইনায়াকে পাভেল তড়িঘড়ি করে পাঁজাকোলে তুলে নিয়ে, আনায়াকেও জায়গাটা থেকে দ্রুত বেড়িয়ে যেতে বলে। আনায়ার চোখেমুখে অজানা ভয় আর অস্থিরতা রইলেও ও ইনায়ার সঙ্গ ছাড়লো না। পাভেলের সাথে সাথে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে লাগল। তবে আনায়া কেনো যেন এসবের মাঝেও আশপাশে ইতস্ততভাবে চোখ বুলাতে লাগল। যার ফলে ও সবার চেয়ে অনেকটা পেছনে পেছনে পড়ে যায়। বাকিরা সকলেই উপরে চলে গিয়েছে। যথারীতি আনায়া সিঁড়ির দিকে এগোতে নিলে আচমকা আশপাশ থেকে কিছু আওয়াজ কানে আসে।

আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে ফেলে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে চেয়েও আর ওঠে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সিঁড়ি পাশে একটা দরজা রয়েছে। বুঝতে আর বাকি নেই দরজার ওপাশ থেকেই শব্দগুলো আসছে। মনে তো হচ্ছে রুমের ভেতরে কেউ রয়েছে। আনায়ার মনোযোগ হঠাৎ এদিকে সরে এসেছে। দরজাটার সামনে গিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে, আওয়াজটা কিসের। অদ্ভুত এক গোংরানির আওয়াজ। নিমিষেই আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়। তবে খুব বেশি একটা সময় না নিয়ে দরজাটা খোলার চেষ্টা করে। তখনই খপয়াল করে বাহির থেকে তালা লাগানো। আনায়া খানিকটা দৃঢ়তার সাথে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে হাতের পিস্তলটা দিয়ে তালাটা ভেঙ্গে ফেলে।

পরবর্তীতে এক মূহুর্তেও দেরি না করে সোজা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘরের কোণা থেকে কারো নড়াচড়া আর উদ্ভট গোংরানির আওয়াজ মিলছে। আনায়া সাবধানে রুমের ভেতর খানিকটা এগিয়ে যেতেই খেয়াল করে, রুমের মাঝ বরারব একটা লাইট টাইপের কিছু ঝুলছে। রুমে যেহেতু লাইট রয়েছে তবে আশেপাশে নিশ্চয় সুইচ বোর্ডও রয়েছে। আনায়া দরজার আশপাশে দেওয়ালে হাতিয়ে সুইচ বোর্ডটা খুঁজে পেতেই রুমের লাইটটা অন করল।

নিমিষেই আকস্মিক কারো চেঁচাচেচিতে আনায়ার নজর গিয়ে ঠেকে ঘরের কোণায়। কিছু সময়ের জন্য আনায়া সম্পূর্ণ হতভম্ব হয়ে যায়। ছন্নছাড়া কুৎসিতের ন্যায় অর্ধনগ্ন এক মানব রুমের কোণায় ঝটফট করছে। পায়ে তার মোটা শিকল বাঁধানো। হাত পা সহ শরীরের প্রত্যেক জায়গায় ছোট বড় বিশ্রী সব পঁচা ঘা। মাংস শুকিয়ে গিয়ে শরীরের চামড়া ফেড়ে যেন হাড়হাড্ডি সব বেড়িয়ে আসছে। পুরো মুখ বড় বড় দাঁড়ি আর চুলে ভর্তি।

মূলত হঠাৎ রুমে আলো জ্বলায় এই ন”রখাদক মানবের এহেন অবস্থা। ধসে পড়া নোংরা দেওয়ালের আবদ্ধ ঘরে তাকে বেশিরভাগ সময়ই কাঁটাতে হয়।আর হুট করে অন্ধকারে থাকা অস্তিত্বটা আলোর স্পর্শে এলে ছটফটিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ সময় একইভাবে অতিবাহিত হবার পর নরখা”দক ছেলেটি কিছুটা স্বাভাবিক হলো।এতোক্ষণ দু’হাতে মাথা ঢাকার চেষ্টা করলেও, এখন সে ধীরে ধীরে মুখ উঁচিয়ে আনায়ার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে।

আনায়া খানিকটা বিস্ময়ের সাথে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যায়।সেই সঙ্গে হাতের পিস্তলের স্লাইডটাও টেনে নেয়। ওদিকে ছেলেটি একদম বাচ্চাদের মতো আনায়ার দিকে বিস্ময়ের চাহনিতে তাকিয়ে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে, আনায়া হয়তো তার পরিচিত কেউ। অন্যদিকে আনায়াও ছেলেটির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে। অন্ধকার রুমের সামান্য বাল্বের আলোয় ছেলেটির চেহেরা পরিষ্কার নয়।

আনায়া আরেকটু সমানে এগিয়ে যেতেই ছেলেটি কিছুটা অস্থির হয়ে ওঠে।নিচে বসে থাকা অবস্থাতেই ঘেঁষে ঘেঁষে আনায়ার দিকে এগিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে, উঠে দাঁড়ানোর মতো নূন্যতম শক্তি তার নেই। আনায়ার অনেকটা কাছে আসতে নিলে শিকলে টান পড়ায় সে থেমে যায়। আনায়ার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে শিকল খুলে দিতে ইশারা করে।

এদিকে আনায়া কি করবে তা বুঝতে পারছে না। আবার এখান থেকে বেড়িয়ে যেতেও ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু তবু সে নিজের হাতে থাকা পিস্তলের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে ছেলেটির শিকলের মাঝে গুলি করতেই তা তা দুখণ্ড হয়।ছেলেটি ছাড়া পেয়েছে তা বুঝতেই বিস্তৃত হাসিতে তার মুখ ছেয়ে যায়। সেই সাথে আকস্মিক উম্মাদের মতো আচরণ করতে লাগে।

ছেলেটির হাভভাবে আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে যায়। কিন্তু খুব বেশি সুযোগ হয় না তার নিজেকে রক্ষা করার। বরং ছেলেটি উম্মাদের ন্যায় আনায়ার দিকে ধেয়ে আসে। আনায়া প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে ছুটতে শুরু করে। মাঝে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিচে পড়ে যাওয়ায় আর তার দরজা লাগানো সম্ভব হয় না। বরং কোনো মতে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগে। কিন্তু এরই মাঝে পেছন থেকে ছেলেটি আধা শিকল বাঁধা পা নিয়ে অনবরত আনায়ার পেছনে ছুটতে থাকে। লোহার শিকলের শব্দে মাটির নিচের আবদ্ধ জাগয়াটা যেন বারবার লোমহর্ষক ধ্বনিতে মেতে উঠেছে।

এদিকে আনায়ার অসাবধানতার কারণে সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে পুনোরায় উঠতে নিলে পেছন থেকে ছেলেটি আনায়ার পা টেনে ধরে। আনায়া কোনো মতে লাথি ঝাড়ি দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিয়ে পুনোরায় তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। সবশেষে গিয়ে উপরে পৌঁছাতেই হাঁপিয়ে ওঠে। এদিকে আকস্মিক এতো শব্দ আর হুড়োহুড়িতে উপরে থাকা লোকজনগুলো অবাক হয়ে বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ কি থেকে কি হলো তা যেন কেউই বুঝে উঠতে পারছে না।

সেই সাথে আনায়া খেয়াল করলো উপরে থাকা নার্স সহ বাকি আরো কিছু পাভেলের লোকজন ছোটাছুটি করছে। তবে আশেপাশে কোথাও পাভেল নেই। সেই সাথে ইনায়াকে অন্য একটা লোক পাজকোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবার এই বিস্ময়ের মাঝেই পেছন থেকে নরখাদক ছেলেটির উপরে উঠে এলো। নার্সদের হাবভাবে মনে হলো তারা এই ছেলেটিকে ভালো করেই চেনে, সেই সাথে ছেলেটিকে দেখামাত্রই নার্স সহ প্রত্যেকেই আ”তংকে, বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।
নার্স সহ যে যার মতো পিছিয়ে দূরে সরে যায়। অন্যদিকে আনায়া সহ বাকি কয়েকজন কিছু করে উঠবে এর পূর্বেই ছেলেটির নজর পড়ে ইনায়ার দিকে। সবকিছু ছাড়িয়ে সে ইতস্তত হয়ে ছুটে যায় ইনায়ার কাছে। পাগলের মতো হাঁপাতে শুরু করে। ইনায়ার কাছে যাওয়া মাত্রই ছেলেটির পাগলামি দেখে ইনায়াক কোলে নিয়ে থাকা ব্যক্তিটি খানিকটা ঘাবড়ে যায়। সেই সাথে ছেলেটি যখন বারবার ইনায়াকে ছোঁয়ার জন্য ব্যক্তিটির দিকে আক্রমনাত্মক ভাবে উম্মাদের মতো করতে শুরু করে,তখন ইনায়াকে ধরে রাখা ব্যক্তিটি কোনো মতে ভয়ে হাঁটু গেঁড়ে ইনায়াকে নিচে শুইয়ে দিয়ে সরে যায়।

তবে আশেপাশ থেকে বাকি লোকজন ছেলেটিকে ধরার চেষ্টা করার পূর্বেই ছেলেটি অদ্ভুত আচরণ করতে লাগে। এতোক্ষণ যে উম্মাদের মতো আক্রমনাত্মক আচরণ করছিল, সে এখন হু হু করে কান্না করছে। কখনো ইনায়ার নিথর দেহকে জড়িয়ে ধরছে, তো কখনো ইনায়ার মুখ আলতোভাবে ধরে জাগানোর চেষ্টা করছে। তবে তার বলা অদ্ভুত আওয়াজ গুলোর কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়।

ওদিকে আনায়া বাকিদের মতো কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। সবকিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এই মূহুর্তে তার ঠিক কেমন রিয়েক্ট করা উচিত তাও তার অজানা। হুট করেই তার মস্তিষ্কে অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে হয়তো সে চেনে। কিন্তু এমন একটা জরাজীর্ণ মানবকে সে কি করে চিনতে পারে তাই আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না।
বিস্ময়ের চোখে ছেলেটির কাজকর্ম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে। পরিস্থিতি সামলাতে আনায়া এবার ওদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলে,আচমকা বাহির থেকে তড়িঘড়ি করে পাভেল ভিতরে প্রবেশ করে।

—“কি হলো, এখনো ইনায়াকে নিয়ে যাওয়া…”

পাভেলের কথা আর সম্পূর্ণ হলো না।ভেতরের পরিস্থিতি দেখে সে অনেকটাই অবাক। এখানে হচ্ছেটা কি? সে তো গাড়ি ঠিক করে কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে গিয়েছিলো সেই সাথে ইনায়াকে দ্রুত গাড়ির কাছে নিয়ে যেতে বলেছিলো। কিন্তু অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যেন কারো কোনো খোঁজ খবর পাওয়া গেলো না তখন দ্রুত ছুটে ভেতরে চলে আসে।

পাভেল একবার আনায়া সহ বাকিদের দেখছে, সেই সাথে এই অদ্ভুত পাগলের কার্যকলাপ দেখছে।
—“কি হয়েছে সবার? এই পাগলটা আবার কে?”

পাভেল কথা বলতে বলতেই ইনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। ছেলেটির গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিতে গেলে আকস্মিক ছেলেটি ক্ষিপ্ত হয়ে পাভেলের হাতে কামড়ে দেয়। পাভেল নিমিষেই ব্যাখা আর রাগের চোটে ছেলেটির গায়ে লাথি দেয়। ফলে পাভেল নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ছেলেটিও আঁচড়ে নিচে শুয়ে যায়।

পাভেল নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে হাত থেকে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মূহুর্তেই সম্পূর্ণ মেজাজ বিগড়ে যায় সেই সাথে চিৎকার দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“এখানে কি সবাইকে,তামাশা দেখতে নিয়ে এসেছি আমি? আর এই পাগল কে?ইনায়াকে গাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছি সেই কখন অথচ ও এখানে পড়ে রয়েছে কেনো?…তাকিয়ে তাকিয়ে আমার চেহেরা না দেখে পাগল-ছাগলটাকে দূরে সরা আর ইনায়াকে গাড়িতে নিয়ে যা। হসপিটালে নিতে বেশি দেরি হলে, প্রবলেম হয়ে যাবে।”

পাভেলের কথা অনুযায়ী, যে যার মতো এদিকটায় ছুটে আসে। তড়িঘড়ি করে ইনায়াকে একজন কোলে তুলে নেয়, বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে যেন ছেলেটি আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। উম্মাদের ন্যায় সেদিকে তেড়ে আসতে নিলে সবাই আবারও কিছুটা ভড়কে যায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পাভেল আশপাশে খুঁজে একটা লাঠি খুঁজে পেতেই তা দিয়ে সোজা ছেলেটির মাথায় জোরে আঘাত করতে বসে। মূহুর্তেই সে মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যায়।

এদিকে ইনায়াকে লোকজন নিয়ে গাড়ির কাছে চলে গিয়েছে। কিন্তু আনায়া এখনও স্তব্ধ হয়ে সবকিছু দেখে যাচ্ছে। খানিকটা সময়ের জন্য নিজের এই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যাওয়াটা তার কাছে অজ্ঞাতই রইল। আনায়ার এই চুপ থাকার মাঝেই পাভেল তার কাছে গিয়ে বলতে লাগলো,

“আপনাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে? চিন্তা করবেন না, কারো কিচ্ছু হবে না। ভাইকে আগেই হসপিটালের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছি। আশাকরি ইনায়াও তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে…এন্ড খুব জলদি সবাই সুস্থ হয়ে যাবে। আপনি আর প্লিজ দেরি করবেন না। আমাদের মনে হয় এখনই এখান থেকে যাওয়া উচিত। বাকিটা এরা সামলে নেবে।”

আনায়া শুধু চুপচাপ কান দিয়ে পাভেলের কথাগুলো শুনে গেল। কিন্তু কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া করলো না। বরং তার নজর এখনো সেই ন”রখাদক মানবদের দিকে। তার দিক থেকে যেন আমার নজরই সরছে না। কিছুতো একটা অদ্ভুত চিন্তাভাবনায় হারিয়ে যাচ্ছে সে। এরই মাঝে ছেলেটি আবারও চিৎকার চেচামেচি শুরু করলে পাভেল তা দেখে বলে উঠলো,

“তোরা তাকিয়ে দেখছিস কি? ওটাকে আজ পিটি”য়ে মে”রেই ফেল।”

পাভেল কথাগুলো বলতে না বলতেই চারপাশে থেকে ওর লোকজন গুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছেলেটিকে অনবরত মার”ধোর করতে শুরু করে। কখনো গায়ে সজোরে লাথি দিচ্ছে তো কখনো চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে ফ্লোরে আঁচড়ে
ফেলছে। নড়বড়ে দেহটা যেন নিমিষেই ভঙ্গুরের ন্যায় কুঁকড়ে যাচ্ছে বারবার।অথচ ব্যাথার চোটে করা আর্তনাদের প্রতিটা শব্দই অস্পষ্ট।

এই পর্যায়ে এসে আনায়া আর পুরো সময়ের মতো চুপচাপ থাকতে পারলো না। ছেলেটির দিকে এগিয়ে যেতে নিলে পাভেল আচমকা বাঁধা সেধে তাকে বাহিরে যেতে বলে। আনায়া বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। কিন্তু এরই মাঝে আকস্মিক আনায়ার মন মস্তিষ্ক এমন কিছুর জানান দেয় যে আনায়া সম্পূর্ণভাবে আঁতকে ওঠে। সে যা ভাবছে তা যদি সত্যি হয় তবে…আনায়া আর বেশি কিছু ভাবতে পারল না। বিস্ময়ে আর ভয়ে অনেকটাই হতবাক সে। এমনই মূহুর্তে সে খেয়াল করলো তার চোখজোড়াও যেন ভিজে উঠেছে। আনায়া আর পাভেলের বাঁধায় নিজেকে না থামিয়ে ছেলেটির দিকে ছুটে আসে। সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়ে পঁচা ঘা আর মারধরের ফলে র”ক্তে সিক্ত ফিনফিনে দেহটাকে আঁকড়ে ধরলো। এদিকে ছেলেটি প্রায় অচেতন হয়ে আনায়ার কোলেই ঢেলে পড়েছে।

অন্যদিকে এসবের কোনো কিছুই যেন পাভেলের বোধগম্য নয়। এসব হচ্ছেটা কি? আনায়া কেনো এমন করছে? তার সাথে সাথে আশে-পাশের লোকগুলোও কিছুটা অবাক চোখে আনায়াদের দিকে তাকিয়ে। আনায়া অনবরত কাঁদছে আর প্রতিনিয়ত ফুঁপিয়ে উঠছে।

পাভেল দ্রুত আনায়ার কাছে এগিয়ে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে। এবং আনায়ার উদ্দেশ্যে কপাল কুঁচকে বলতে লাগে,

“এ কে? আপনি কেনো এমন করছেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।…প্লিজ কিছু বলুন। আপনি কি এই পাগলটাকে চেনেন?”

আনায়া কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো, “রোহান… ও রোহান।”

আনায়ার কথায় পাভেল কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে ফেললো।—“রোহান? কোন রোহান…”

—“ও রেহানের ভাই রোহান।”

—“রেহান আহমেদের ভাই রোহান?”

—“হ্যাঁ।”

পাভেল কথাটা প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে বলতেই আনায়া ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকালো। এদিকে পাভেল যেন সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গিয়েছে। এসব একের পর এক কি হচ্ছে, কেনো হচ্ছে সবই যেন তার অজ্ঞাত।
_____________

মধ্যরাতে হসপিটালের শুনশান নীরব জায়গায় চুপচাপ বসে রয়েছে আনায়া। চোখেমুখে বিস্তর ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু এখন বিশ্রাম নেওয়ার মতো নূন্যতম সময় তার নেই। ক্লান্তির পাশাপাশি এক আকাশ সমান চিন্তা দুশ্চিন্তায় আঁটকে রয়েছে সে। আনায়া আনমনে ভাবনা চিন্তার মাঝেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

রাত প্রায় অনেকটা হয়েছে। আরেকটু পর হয়তো ভোরও হয়ে যাবে। ইনায়াকে হসপিটালের আনতে না আনতেই অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওর অবস্থা তখন নিত্যন্তই নাজুক ছিলো। হসপিটালের আনতে দেরি হওয়ায় বাঁচা না বাঁচার প্রশ্ন উঠে যায়। যদিও শেষমেশ অপারেশনটা যথাযথ ভাবে সাকসেসফুলি কমপ্লিট হয়। তবে এখনো ইনায়ার জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তারের কথা অনুযায়ী জ্ঞান ফিরতে খানিকটা দেরি হতে পারে তবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

অন্যদিকে কেনীথকে হসপিটালে আনা হয়েছে অনেকটা আগেই। ওকেও যথাযথ ট্রিটমেন্ট করে রেস্টে রাখা হয়েছে। কেনীথের অবস্থা খুব একটা ভালো কিংবা খারাপ বলা যায় না। অতিরিক্ত ট”র্চার আর অভার ডোজের মেডিসিন পুশ করায় শারিরীক অবস্থা কিছুটা নাজুক। কিন্তু আশাকরা যায়, সকালের মাঝে ঘুম ভাঙ্গার পর অনেকটাই সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

এ দুজন ব্যতীত আনায়ার আরো একজনকে নিয়েও প্রচন্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সেই ছেলেটিই যে রোহান তা আনায়ার বুঝতে বা নিশ্চিত হতে আর বাকি নেই। ওকে হসপিটালে নিয়ে আসার পর যা শুনেছে তাতে আনায়ার যেন সকল ভাষাই হারিয়ে গিয়েছে। তার দেখা সেই সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেটার আজ কি করূন দশা। ওর ক্রিটিকাল এবং বাহ্যিক অবস্থা দেখে ডাক্তারদের ধারণা সে কিনা একটা নরখাদক। যদিও এটা নিশ্চিত হওয়া যাবে ফরেনসিক রিপোর্ট এলে। তবুও এসব কি আদতে বিশ্বাস যোগ্য? এই ভেবে যেন প্রতিনিয়ত চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। সর্বদা এটাই মনে হচ্ছে, এই সবার পরিণতি কিন্তু এই সবকিছুর জন্য শুধুমাত্র সে দায়ী। রেহানের পুরো পরিবারটা শুধুমাত্র তার জন্য আজ ধ্বং”স হয়ে গিয়েছে। এতো অভিশপ্ত একটা জীবন নিয়ে আর একমুহূর্ত বেঁচে থাকতেও যেন নিজের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষে গা গুলিয়ে আসছে।

আনায়া চুপচাপ রইলেও এসব ছাড়িয়ে আরো অনেকগুলো বিষয় তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ওখানে সে অদ্ভুত কিছু বিষয় লক্ষ করেছে। একে তো ওখানে নার্স ছিলো সেই সাথে ভেতর থেকে অনেক বাচ্চার আওয়াজও শুনেছে। তখন ওখান থেকে চলে আসায় এই ব্যাপারগুলো নিয়ে তেমন কিছু জানতে পারেনি। তবে আপাতত সবকিছু মিটে গেলে পাভেলের সাথে এই বিষয়ে একবার কথা বলতে হবে। সে চলে আসার পর তো সব কিছু পাভেলের লোকজনই করেছে।

আনায়া সবমিলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। করিডরে নার্সগুলো কাজের জন্য ছোটাছুটি করছে। আনায়া তাদের থেকে দূরে খানিকটা নীরবে বসে রয়েছে। পরণে সেই একই ওয়েস্টার্ন পার্টি ড্রেস। আলাদা করে ড্রেস চেঞ্জ করার সময় সুযোগ কিংবা পরিস্থিতি হয়ে ওঠেনি। তবে গায়ে এখনো বড়সড় একটা কালো রঙের চাদর পেঁচানো। এক চাদরেই প্রায় নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে নিয়েছে।

হুট করেই আনায়ার মনে পড়লো রেহানের কথা। সে কি করে এসব রেহানকে জানাবে। কিভাবে বলবে তার ভাই রোহানের খোঁজ মিলেছে কিন্তু সে তো…আনায়ার দুশ্চিন্তায় মাথায় ভার হয়ে এলো। রেহান এসব জানার পর কিভাবে রিয়েক্ট করবে তা আনায়া জানে না। তবে সে এতটুকু নিশ্চিত যে, ছেলেটা রোহানই। বাকিটা রেহান আর রোহানের ডিএনএ টেস্ট করালেই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

রোহানকে আনায়া খুব বেশি সামনাসামনি দেখেনি। তবে তার ছবি সে রেহানের মাধ্যমে প্রায়ই দেখতো। একটা পাগলাটে,সহজ সরল… কত সুন্দর দেখতে ছিলো। সবসময় শুনেছে, পড়াশোনাতেও যথেষ্ট ব্রিলিয়ান্ট ছিলো। অথচ ওর সাথেই কেনো এমন কিছু হলো? আনায়া আর এতো কিছু ভাবতে পারছে না। এতোবছর ধরে খোঁজ করতে থাকা নিজের বোন, নিজের ছোট ভাইয়ের স্থানে জায়গা দেওয়া ভাই রোহান কিংবা স্বামী নামক এক অমানুষের…একই সাথে সকলের এমন করূন পরিণত কোনটাই সামলে উঠতে পারছে না আনায়া। সেই সাথে আগামী পরিকল্পনার অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা তো রয়েছেই।

আনায়া জোরে শ্বাস ফেলে দু-হাতে চুলগুলো এলোমেলো কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেয়। মাথা প্রচন্ড ঝিমঝিম করছে। সকাল ভোর হয়ে এলে একবার রেহানকে এসব বিষয়েও জানাতে হবে। ভাই হিসেবে ওকে দ্রুত এই বিষয়টা জানানো উচিত।

এরই মাঝে আনায়া মাথা উঁচিয়ে পাশে ফিরে দেখে, পাভেল তার দিকে এগিয়ে আসছে। হাতে একটা দুটো মগ। আনায়ার কাছে আসতেই একটা মগ আনায়ার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ধোঁয়া ওঠা গরম কফি। আনায়া পাভেলের দিকে তাকিয়ে দেখে তার চেহেরায় তীব্র হতাশা। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। আনায়া কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মগটা হাতে নেয়। মনে মনে ভাবতে থাকে পাভেলকে নিয়ে। এই ছেলেটা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কম কষ্ট করেনি। সবসময় কেনীথের পাশে দেখেছে। নিজের সহ বাকিদের বিপদেও ও যতটা পেরেছে, পাশে থেকেছে। মাঝেমধ্যে আনায়ার মনে হয়, পাভেল যদি কেনীথের সঙ্গ না পেতো তবে হয়তো ওর জীবনটাও এতো ধোঁয়াশার মাঝে হারিয়ে যেতো না। বাকি সবার মতো পাভেল নিজেও একটা সুস্থ জীবন যাপন করতে পারতো।

আনায়াকে আনমনে একটানা তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাভেল কিছুটা ইতস্ততবোধ করে। ওর হাবভাবে আনায়ার ধ্যান ভাঙতেই নিজেকে সামলে নিয়ে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। অতঃপর স্বাভাবিক ভাবে বসে নিয়ে দু-হাতে কফির মগটা ধরে বলে ওঠে,

—“হাতে সময় থাকলে বসুন, কিছু কথা বলার আছে।”

আনায়া ভাবগাম্ভীর্যের তৎপরতায় পাভেল কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আনায়ার পাশে বসল। দু’জনের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব। আনায়া বিষয়টা খেয়াল করে আনমনে মুচকি হাসে। আনায়া শুরু থেকেই খেয়াল করে এসেছে, পাভেল বরাবরই তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যদিও সে তার অনেক ছোট। মূলত কেনীথকে বড়ভাই মানার প্রেক্ষিতেই তার প্রতি এতো সম্মান। এছাড়া অবশ্য কারো সাথে কখনো খারাপ বিহেভিয়ারও আনায়া করতে দেখেনি।

আনায়া চুপচাপ বসে রয়েছে কিন্তু কিছু বলছে না দেখে পাভেল পুনরায় কিছুটা বিব্রত হয়। ইতস্ততভাবে স্বাভাবিক হতে গিয়ে, গরম কফি মুখে দেওয়ায় জিহ্বার খানিকটা যেন পুড়ে গিয়েছে। এরই মাঝে আনায়া তার দিকে না তাকিয়েই বলে ওঠে,

“ধীরেসুস্থে খান, এতোটাও নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। কেনীথকে বড় ভাই মনে করলেও, আমাকে ছোট বোন মনে করুন। আমি আপনাকে সবসময় বড় ভাই হিসেবেই মেনেছি।”

যদিও আনায়ার নজর ছিলো তার হাতে থাকা ধোঁয়া ওঠা কফির দিকে। তবে তার কথায় পাভেলের যেন আরো কিছুটা ইতস্তত হয়।চোখমুখ খিঁচে নিজেকে সামলে নিয়ে তড়িঘড়ি করে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

“আপনি কিছু বলতে চাইছিলেন!”

আনায়া খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিতে একবার চুমুক দিয়ে বললো,

“কেনীথ আপনার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?”

আনায়া প্রশ্নে পাভেল কিছুটা ঘাবড়ে যায়। হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ তার জানা নেই। তবে পাভেল কিছু বলছে না বিধায়, আনায়া পাশে ফিরে পাভেলের উদ্দেশ্য পুনোরায় বলতে লাগে,

“যদি কখনো তাকে নিজ হাতে শেষ করতে হয়, তখন আপনি কি করবেন?”

পাভেলের হাতে থাকা কফির মগটা খানিক কেঁপে উঠলো বিস্ময়ের সাথে আনায়ার দিকে তাকাতেই আনায়া নির্লিপ্ত ভাবে আবারও বলল,

“উত্তর দিন।”

—“এসব কি বলছেন? পাগলামি কেনো করছেন…আপনি প্লিজ রেস্ট করুন। নয়তো বাসায় চলে যান। আমি এদিকটা সামলে নেবো।”

আনায়া যেন পাভেলের কথাগুলো শুনেও শুনলো না। নির্বিকার কফিতে চুমুক দিয়ে বলে উঠল,

—“ধরুন,আমি আপনাকে এই কাজটা করতে বললাম। আপনি পারবেন না! কেনীথকে চিরতরে শেষ করে দিতে?”

পাভেলের ঘাম ছুটে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাত কাঁপছে অনবরত। সেইসাথে কফির কাপটাও। কোনো কিছুই আনায়ার দৃষ্টির অগোচর নয়।

—“পার…বো না আমি এস…ব করতে। কখনোই পা…রবো না।

—“কেনো পারবেন না?”

আনায়ার নির্লিপ্ত আর দৃঢ়তার চাহনিতে পাভেল শক্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আনায়া আবারও বলে ওঠে,

“ধরুন,কেউ আপনার পুরো পরিবার,প্রিয়জনদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। সবাই প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে দিনের পর দিন মৃত লা” শ হয়ে বেঁচে রয়েছে। এরজন্য দায়ী শুধু একটি মানুষ বেশে থাকা এক অমানুষ। এরপরও আপনি সেই অমানুষটাকে ছেড়ে দিবেন? ইচ্ছে হবে না তাকে চিরতরে শেষ করে দিতে?”

—“………

—“উত্তর দিন!”

—“অবশ্যই! আমিও তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না।”

পাভেল আকস্মিক দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বলতেই আনায়া ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তবে সেই মূহুর্তে পাভেল আবারও বলতে লাগলো,

“তবে ভাইয়ের সিচুয়েশন আর সবার সিচুয়েশন এক ছিলো না।সে নিজেও অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।… হ্যাঁ, সে যেটা করেছে তা সম্পূর্ণ ভুল, অন্যায়। কিন্তু…”

—“কোনো কিন্তু নেই। আপনার ভাইয়ের সাথে যা হয়েছে তার জন্য দায়ী হলো আমার বাবা। সেক্ষেত্রে তার শিকার হওয়ার কথা ছিলো,শুধুমাত্র আমার বাবা। কিন্তু এমনটা তো হয়নি। আচ্ছা মানলাম, তার সাথে আমার শুরু থেকে একটা সম্পর্ক ছিলো বিধায় আমিও দোষী। তবে শাস্তিটা শুধু আমি আর আমার বাবার প্রাপ্য ছিলো, তাই না?

তবে কেনো আমাদের পাপের শান্তি ইনায়া, রোহান, রেহান সহ তার পুরো পরিবারকে ভোগ করতে হচ্ছে? রেহানের বাবা মা কিংবা ওর ভাই রোহান—ওদের কারোরই তো কোনো দোষ ছিলো না। আমার বোনটাই বা কি দোষ করেছিলো? আর আমার ফ্রেন্ডগুলো? ওদের একেকটার জীবন নরক বানিয়ে ছেড়েছেন উনি। এরপরও কিভাবে ছাড় দেই ওনাকে। কিভাবে সব ভুলে মাফ করে দেই?”

—“তবে আপনি কি চাইছেন?”

পাভেলের প্রশ্নের উত্তরে আনায়া ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। অস্থির লাগছে তার। চোখ বন্ধ করে আনমনে বলে উঠলো,

“জানি না। কিচ্ছু জানি না। কিন্তু আমার আর এসব সহ্য হচ্ছে না। সব শেষ করে দিয়ে নিজেকেও শেষ করতে ইচ্ছে হচ্ছে। আ’ম টোটালি টাইয়ার্ড অব দিস ফা%কিং লাইফ!”

পুনোরায় দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। অনেকটা সময় হয়ে যায় আনায়া কিংবা পাভেল কোনো কথা বলে না। ওদিকে পাভেলের কফি এতোক্ষণে ঠান্ডাও হয়ে গিয়েছে। অথচ তার নজর মগে থাকা ঘন কালো মিশ্রণ থেকে এখনো সরেনি। আনায়া অনেকটা সময় চুপচাপ থাকার পর বলে উঠলো,

“ওই জায়গাটা নিয়ে কিছু জানার ছিল।”

আনায়ার কথায় পাভেলের ধ্যান ভাঙতেই কিছুটা নড়েচড়ে বসে। অন্যদিকে আনায়াও কিছুটা সিরিয়াস হয়।

—“কোন জায়গা…”

—“যেখান থেকে ইনায়াদের পেলাম।”

—“ওহ হ্যাঁ, জ্বী বলুন।

—“ওখানে আসলে হয়টা কি? আমি কিছু নার্সদের দেখেছি। অনেক ছোট বাচ্চার আওয়াজও শুনেছি। আরেকটা বিষয়, ইনায়াকে নার্সগুলো ম্যাম বলছিলো। ইনায়া ওখানে কি করত? এসব ঠিক আমার বুঝে আসছে না।”

পাভেল খানিকটা ভাবুক ভঙ্গিতে বলে উঠল,

“কাহিনি তো আমিও বুঝতে পারছি না, কিন্তু… ”

—“ঐ নার্সগুলো কোথায়? আর আমি নিশ্চিত ওখানে অনেকগুলো বাচ্চা ছিল।আপনার লোকগুলো যেহেতু ওখানে তবে…ওরা এখন কোথায়? এখনো ওখানেই রয়েছে?”

—“নাহ, আমি আমার লোকেদের বলেছি ওদের ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে।”

—“সত্যিই ওখানে বাচ্চা ছিল, তাই না?”

—“জ্বী।”

—“আর ঐ অলিভার নামের লোকটা, সে কি বেঁচে রয়েছে?”

—“নাহ।”

আনায়া খানিকটা চুপচাপ থেকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,

“অলিভারটা বেঁচে থাকলে হয়তো সহজেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতাম। যাই হোক, এদিকটা একটু স্বাভাবিক হলে, নার্সের সাথে আর বাকি যদি কোনো কর্মী বেঁচে থাকে তবে… ওদের সাথে আমি দেখা করতে চাই। বাকিটা হয়তো ইনায়া স্বাভাবিক হলে জানতে পারব।”

পাভেলও আনায়ার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে সহমত পোষণ করে। সেই সাথে কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়াতেই, দেখে তা একদম ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বিরক্ত হয়ে ঘড়িতে সময় দেখে বুঝল, খুব শীঘ্রই নতুন ভোরের সূচনা হতে চলেছে।

______

ভোর হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে আনায়া খানিকটা অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগেই সে রেহানকে হসপিটালে আসতে বলেছে। তবে কোনো কিছু জানায়নি। শুধু বলা হয়েছে,অত্যন্ত জরুরী বিষয়। না আসলেই নয়।

সেই সাথে বেড়েছে ইনায়ার জ্ঞান না ফেরার আশংকার ভয়। ওদিকে রোহানের উপর চলছে যথাসাধ্য ট্রিটমেন্টের তোরজোর। ওকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছিলো প্রায় অজ্ঞান অবস্তায়। খানিকটা আগে জ্ঞান ফিরলেও সে প্রচন্ড পাগলামিতে মেতে ওঠে। তাকে সামলাতে গিয়ে ডক্টরদের হিমশিম খেতে হয়েছে। ফলস্বরূপ পরিশেষে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে পরিস্থিতি সামলাতে হয়। আপাতত সে এখন গভীর ঘুমে।

আনায়া করিডোরে অনবরত পায়চারী করছে। ওদিকে পাভেল হঠাৎ হসপিটালের কাজে বাহিরে গিয়েছে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্তা করতে। এমনিতেও এখন হসপিটালের বড় পরিধির একটা অংশ তাদের জন্য কাজ করছে। ডাক্তার কিংবা নার্স, সার্ভেন্ট কেউ থেমে নেই। যে যার কাজে অনবরত ছুটছে।

আনায়া বারবার হসপিটালের মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখছে, রেহানের দেখা পাবার আশায়। তবে এরইমাঝে রেহানের পরিবর্তনে কিছু ওয়ার্ডবয় আর নার্স ভেতরে প্রবেশ করে। তবে খানিটা অবাক করা বিষয় হলো প্রত্যেকেরই মাস্ক আর ক্যাপ পড়ো। যা হসপিটালের বাকি লোকদের মতো না। খুব বেশি হলে চার থেকে পাঁচজন ছিল তারা। আনায়া খুব একটা প্রয়োজনীয় না মনে করে, বিষয়টাকে গুরুত্ব দিল না।

আরেক কয়েকবার পায়চারি করতে করতেই হঠাৎ নজরে এলো রেহান। কালো জ্যাকেট,কালো প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট পড়া।চুলগুলো এলোমেলো, চোখেমুখে বিধ্বস্ততা। সব মিলিয়ে ভাবভঙ্গি এমন যেন আনায়ার খবর পেয়েই সে ছুটে এসেছে।

রেহান আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবে এর পূর্বেই আচমকা তার নজর পড়ে আনায়ার দিকে। খুব বেশি দেরি না করে রেহান ছুটে যায় তার কাছে।

—“কি হয়েছে, তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেনো?আর হটাৎ হসপিটালে কেনো… ”

—“তুমি প্লিজ শান্ত হও। আমি যা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবে। ঘাবড়ানো কিংবা দুশ্চিন্তার কিছু নেই।”

রেহান খানিকটা কপাল কুঁচকে বলল,

“আনায়া ভণিতা না করে জলদি বললো কি হয়েছে!”

—“রেহান! রোহানকে পাওয়া গিয়েছে।”

—“কিহ! কি বলছো…”

—“হ্যাঁ,তুমি ঠিকই শুনেছো।”

—“কোথায় ও…আর হস…পিটালে…ওর কিছু…’

—“ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই। ওর ট্রিটমেন্ট চলছে।”

—“ওর কি হয়েছে? কিসের ট্রিটমেন্ট চলছে?এখন কোথায় আছে…আমি দেখা করবো ওর সাথে।”

—“রেহান প্লিজ, আমার কথা শোনো তোমায় আরো কিছু বলার আছে।”

আনায়ার হাবভাব অভিব্যক্তি কোনো কিছুই রেহানের সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না। মন মস্তিষ্ক এটাই বলছে, কিছু তো একটা ঘাবলা রয়েছেই। না জানে আনায়া তাকে কি বলতে চাইছে। তবে শেষমেশ আনায়াকে সবটাই রেহানকে জানাতে হলো। আনায়ার বলা ঘটনাগুলো শুনে রেহান যেন সম্পূর্ণ বাকরূদ্ধ। কিভাবে সম্ভব এসব তা তার মাথাতেই কাজ করছে না।

—“পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি? কিভাবে বলছো যে রোহান নরখাদক… আর ইউ মেড?নরখাদকের অর্থ বুঝো তুমি?”

আনায়া খানিকটা অস্থিরতার সাথে ভারী শ্বাস ফেলল। হুট করে কেমন যেন প্যানিক করছে সে। পুরো ঘটনা বলতে গিয়ে হাত পা কাঁপছে। এমন কেনো হচ্ছে বুঝতে পারলো না।এতক্ষণ তো সব ঠিকই ছিলো। হয়তো রেহানের সামনে এসেই সে আর এই বিষয়গুলো সহজতর ভাবে নিতে পারছে না।

আনায়া রেহানের বিস্ময় আর রাগের সংমিশ্রণ চেহরার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ ওকে দেখার পর,নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত গলায় বলতে লাগলো,

“নিশ্চয়, আমি তোমায় এখানে মজা করতে ডাকিনি! সবকিছু জেনে বুঝেই তোমাকে কথা গুলো বলছি।”

রেহান আনায়ার কথা শুনে পাশে ফিরে মাথায় হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগে। মাথা ঘুরছে তার। সব কিছু দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এতোটা এলোমেলো অগোছালো জীবন কিভাবে হতে পারে। এদিকে আনায়ার যেন ইচ্ছে হচ্ছে নিজের গলা চেপে নিজেই শেষ করতে। আর কত এসব সহ্য করতে হবে।

এরই মাঝে আচমকা হসপিটালের একপাশ থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ এলো। রেহান আনায়া দুজনেই অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনা কি। আনায়া দৌড়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেলে তার পেছন পেছন রেহানও ছুটে যায়। নার্স ডাক্তার সহ সকলেই ছোটাছুটি করছে কেনো, তা কেউই বুঝতে পারল না। আনায়া আবার ভীরের মাঝেই একজন নার্সকে চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,

“কি হয়েছে? সবাই এমন কেনো করছে?”

নার্সটা খানিকটা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে লাগল,

“সঠিকটা বলতে পারছি না, তবে মাঝরাতে যে পেশেন্টগুলো এসেছিলো তাদের মাঝে একজনের অবস্থা বেশ ক্রিটিকাল।”

এটুকু বলেই নার্সটা তার কাজের জন্য ছুটে গেলেও, আনায়া সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মাঝরাতে বলতে তো…তারাই এসেছে। আর তারমাঝে একজনের অবস্থা ক্রিটিকাল বলতে কি বোঝালো নার্স।

আনায়া আর রেহান দ্রুত নার্সদের পেছন পেছন ছুটে যায়। সর্বপ্রথম রোহানের কেবিনের কাছে আসতেই দু’জন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুরো রুমে ডাক্তার নার্সদের তোরজোর। কাউকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। বেডের উপর হাত পা ছড়িয়ে ছটফট করছে রোহান। হার্টরেড বেড়ে গিয়েছে,মনিটরে অস্বাভাবিক রিডিং দেখে ডাক্তাররা চমকে উঠেছে। ডাক্তাররা দ্রুত ওকে ইলেক্টিক শক্ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। বুকের মাঝে প্রতিবার শক্ দেওয়ার পর, রোহান বুক চেড়ে শূন্যে উঠে যায়। আবার ধপ করে বিছানায় পড়ে। তবে খুব বেশি একটা সময় এই কার্যক্রম পুনরাবৃত্তি হলো না। আকস্মিক মুখ থেকে অস্বাভাবিকভাবে ফেনা বেরিয়ে আসে। এবং খুব দ্রুতই রোহান সম্পূর্ণ রূপে স্তব্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে ডাক্তাররাও প্রচন্ড হতাশা নিয়ে নিজেদের কার্যক্রম থামিয়ে দেয়।

এদিকে বাহির থেকে স্তব্ধ হয়ে, চাতকের ন্যায় তাকিয়ে ছিলো রেহান আর আনায়া। গ্লাসের অপর প্রান্ত থেকে সবকিছুই তাদের চোখে সামনে ঘটে যায়। রোহানের সর্বশেষ অবস্থা দেখে আনায়া আকস্মিক ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে সামলাতে একহাতে মুখ চেপে ধরে। এদিকে রেহান যেন বুঝতেই পারছে না কি থেকে কি হয়ে গেল। তার চোখ মুখ থেকে যেন বিস্ময়ই কাটছে না। আর আনায়াই বা এভাবে কাঁদছে কেনো।

খানিকটা সময়ের মাঝেই ডাক্তার কেবিন থেকে বেড়িয়ে, তাদেরকে দেখে এগিয়ে এলো। আনায়ার কান্নার বেগ এখনো কমেনি। শব্দ না করেই অনবরত কেঁদেই চলেছে। এদিকে রেহান একদম নির্লিপ্ত। ডাক্তার তার সামনে এগিয়ে এলেও সে কিছু বলছে না। স্তব্ধ হয়ে সে একবার আনায়াকে দেখছে তো একবার ডাক্তারকে। এরই মাঝে ডাক্তার খানিকটা অনুতপ্ত আর হতাশা নিয়ে বলে উঠল,

সরি টু সে, বাট হি হ্যাজ পাস্ট অ্যাওয়ে। আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি।”

এ কথা শোনা মাত্রই আনায়া আরো বেশি কান্নায় ভেঙে পড়ল। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। ওদিকে রেহান পাগল প্রায় অবস্থা। কেমন অস্থিরতায় সম্পূর্ণ ছটফটে হাভভাব তার।অস্থির হয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে এসব। আনায়া এভাবেই কেনো কাঁদছে। কে ঐ ছেলেটা। ওমন বিদঘুটের মতো নিস্তেজ শরীরের জন্য এতো কেনো কষ্ট পাচ্ছে আনায়া৷ ও কি আনায়ার পরিচিত কেউ? আর তার ভাই রোহানই বা কোথায়। এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তার চলে যেতে নিলে, আচমকা রেহান বলে উঠল,

“আমার ভাই কোথায়? রোহান কোথায়? আনায়া তুমি বলেছিলে ও এই হসপিটালে রয়েছে৷ প্লিজ একটু বলো, ও কোথায়? ওর সাথে কথা বলবো আমি।”

এবার আনায়া সম্পূর্ণ হু হু করে কেঁদে উঠল।ডাক্তার তাদের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। এদিকে আনায়ার কান্না রেহান খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল,

“তুমি এভাবে কাঁদছো কেনো? ঐ পাগলের মতো লোকটাকে তুমি চেনো?”

আনায়া কান্নার মাঝেই ভাঙা স্বরে বলে উঠল,

“ওটাই রোহান…ও আর নেই৷ রোহান আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছে ।”

কোনোমতে এটুকু বলতে না বলতেই আনায়া পুনোরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এদিকে রেহান যেন সম্পূর্ণ নিস্তেজ হয়ে পড়ল৷ হাত পা অসার হয়ে আসছে তার। গ্লাসের দেওয়ালের ওপারে থাকা, বিদঘুটে দেখতে মানুষটা কিনা তার ভাই। রেহান অপলক সেদিকে তাকিয়ে রইল। মনে মনে পাগলের মতো হাসতে হাসতে আওড়াল,

“আনায়া মিথ্যে বলছে। আমার ভাই মোটেও ওমন দেখতে না। রোহান তো অনেক সুন্দর। কতসুন্দর ফর্সা, বড় বড় সিল্কি চুল, একদম স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে সে। এমন রোগা,বিদঘুটে লোকটাকে, আনায়া কিভাবে রোহান বলছে? ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে? আবার বলছে, রোহান নেই। রোহান কোথায় গিয়েছে তবে? রোহান ম”রতে পারে না। আমার ভাই ম” রতে পারে না। মিথ্যে বলছে আনায়া৷ একদম মিথ্যে বলছে।”

রেহান সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছে। বাহির থেকে গ্লাসে দুহাত রেখে রোহানের নিথর দেহটাকে দেখছে। এরই মাঝে আবারও সোরগোল বেঁধে গেলে আনায়া থমকে যায়। কান্না থামিয়ে কোনো মতে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। একজন নার্স এসে ডাক্তারকে খবর দেয় ইনায়ার অবস্থা ভালো না।হার্ট রেড বেড়ে গিয়েছে। ডাক্তার একমুহূর্তও দেরী না করে ইনায়ার কাছে ছুটে যায়। আনায়াও পাগলপ্রায় রূপে তাদের পেছনে যায়। কিন্তু রেহান সেইখানেই স্তব্ধ মানবের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে।

এদিকে ডাক্তার নার্সরা আনায়াকে আর ভেতরে ঢুকতে দিল না। দ্রুত ওর অবস্থা দেখে ইলেক্ট্রিক শক্ এর ব্যবস্থা করে। ইনায়া হুবহু রোহানের মতো বিহেভ করছে। যা দেখামাত্রই ডাক্তার সহ প্রত্যকেই খানিকটা অবাক। এদিকে আনায়াও সম্পূর্ণ অস্থির হয়ে উঠেছে। তার ঘাম ছুটে যাচ্ছে, চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝড়ছে। আনায়া হাসফাস করতে লাগল। এরই মাঝে তার কাছে ছুটে এলো পাভেল। আনায়ার অবস্থা দেখে কপাল কুঁচকে বলে উঠল,

“কি হয়েছে এখানে? কি হচ্ছে এসব?”

পাভেল হসপিটালে প্রবেশ করার পর থেকে হসপিটালের অবস্থা দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। সবার ব্যস্ততার মাঝে জিজ্ঞেস করে তেমন কোনো উত্তরও পায়নি। শুধু শুনেছে দুজন পেশেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। কিন্তু তারা কারা সেটা জানা হয়নি। পাভেল তাই দ্রুত এগিয়ে আসতেই হঠাৎ ইনায়ার কেবিনের সামনে আনায়ার দিকে তার নজর পড়ে। আর আনায়ার কাছে আসতেই ওর অবস্থা দেখে সম্পূর্ণ অবাক হয়ে যায়। আপাতত বোঝার চেষ্টা করছে এখানে হয়েছেটা কি! এরই মাঝে তার চোখ পড়ে গ্লাসের অপাশে থাকা ইনায়ার দিকে। বিস্ময়ে যেন তার হুঁশই ফিরছে না। আনায়ার কান্না দেখে পাভেল বলে উঠল,

“কি হয়েছে ওর? ওমন কেনো…”

—“জানি না, ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। আর..রোহান…রোহান…”

–“কি হয়েছে রোহানের?”

—“”রোহান আর নেই৷ ডাক্তার বললো,ও…ও…মা”রা গিয়েছে।”

—“কখন হয়েছে এটা?”

—“এ…একটু আগেই।”

পাভেল প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে থমকে দাঁড়াল।কি বলছে এসব। এটুকু সময়ের মাঝে কিভাবে কি! এদিকে আনায়ার কান্না থামছেই না। পাভেল কি বলবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার। তবে হুট করেই তার কেনীথের কথা মাথায় এলো। প্রচন্ড উত্তেজনার সাথে বলে উঠল,

“ভাই কোথায়?”

আনায়া পাভেলের কঢ়া কথায় খানিকটা চুপ হয়ে যায়। সে কিছু বলতে নেবে তার পূর্বেই পাভেল আনায়ার হাভভাবে যা বোঝার বুঝে যায়।সঙ্গে সঙ্গে জোর গলায় বলতে লাগল,

“এতোটা কেয়ারলেস হলে কি করে হবে? এখানে এতোকিছু ঘটে যাচ্ছে আর এই হসপিটালের এতগুলো মানুষ…এই বাস্টা%র্ড গুলো করছেটা কি!”

এই বলতেই না বলতেই পাভেল দৌড়ে কেনীথের কেবিনের দিকে ছুটে গেল। আশেপাশে তেমন কাউকেই দেখতে না পাওয়ায় মাথা যাস্ট ঘুরতে থাকে। একটা নার্স, ডক্টর, ওয়ার্ডবয় বলতে আশেপাশে কেউ নেই। পাভেল দ্রুত কেবিনের দরজাটা একটানে খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। রুমের ভেতরের পরিস্থিতি তার সমানে দৃশ্যমান হতেই, সে সম্পূর্ণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

চলবে………………..🪄

#একজোড়া_আগুন_পাখি ®অরনীতা_তুশ্মি(#তুশকন্যা)
পর্ব→৩৮(২য় অংশ)

পাভেল কেবিনে প্রবেশ করতেই দেখে, বেডের এককোণায় কেনীথ কাত হয়ে শুয়ে রয়েছে। একটু নড়চড় হলেই ধুপ করে নিচে পড়বে। চারপাশের জিনিসপত্র সব ছড়ানো ছিটানো। যেন এইমাত্র ভুমিকম্পে সব লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছে। পাভেল রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় ছুটে কেনীথের কাছে যায়। তড়িঘড়ি করে কেনীথকে ঠিকঠাক মতো শুইয়ে, তার পালস্ চেক করে। নাকে আঙ্গুল রেখে বোঝার চেষ্টা করে শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকঠাক চলছে কিনা। সবকিছু চেক করা হলে, পাভেল স্বস্তিতে ভারী শ্বাস ফেলে।

এদিকে খানিকটা সময়ের মাঝেই আনায়ার সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়৷ তার সাথে নার্স এবং একজন ডাক্তারও যায়। চারপাশের অবস্থা দেখে প্রত্যেকেই হতভম্ব। এসব কি হয়েছে এখানে! অথচ হসপিটালের এতোসব মানুষজন কেউ কিছু জানতেই পারলো না। ডাক্তার আর নার্সকে দেখে পাভেল ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“কি হচ্ছে এসব এখানে? এতো বড় হসপিটালের, এই সব নমুনা? একটাকেও ছাড়বো না, পুরো হসপিটাল ডুবিয়ে ছাড়বো।”

পাভেলের রাগে ডাক্তার নার্স সকলেই খানিকটা আঁতকে উঠলেও, তারা দ্রুত নিজেদের কাজে লেগে পড়ে। আসলেই তো! এতো বড় হসপিটালে এতোকিছু ঘটে গেলো অথচ কেউই জানে না? বিষয়টা নিত্যান্তই অস্বাভাবিকও বটে। আবার এমন ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেওনি।

রাক্তার কেনীথকে ভালোভাবে চেক করে দেখে, কোনো ক্ষত কিংবা অস্বাভাবিক কিছু হয়েছে কিনা। মোটামুটি ঠিকঠাকই রয়েছে। তবে তার ঘুমের ঔষধের রিয়াকশন এখনো সে অচেতন। ডাক্তার কিছুটা অবাক হয়, কেনীথের এতো ঘুমের তাগিদ দেখে। তাকে তো খুব কঢ়া ডোজের ঔষধ দেওয়া হয়নি। যার ফলে এতো কিছু হয়ে যাওয়ার পরও, সে ম”রার মতো ঘুমাবে। বিষয়টাতে ডক্টরের খানিক খটকা লাগে। সে দ্রুত আবারও কেনীথের বিভিন্ন অংশ আরো ভালো ভাবেই চেক করতে বুঝে যায় যে, কেনীথের ঘুমের মাঝেও তার মুখে চেতনানাশক স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে৷

ডাক্তার এক মূহুর্তও দেরি না করে, একজন নার্সকে বললো সিসিটিভি ফুটেজ রুমে লোক পাঠাতে। তার কথা শুনে নার্স তার কাজে ছুটে যায়, সেই সাথে পাভেল নিজেও যেতে লাগল। তবে দরজার কাছে আনায়াকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখায় থেমে গিয়ে বলল,

“আপনি ঠিক আছেন?”

আনায়া কেনীথের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার মন মস্তিষ্ক চিন্তাভাবনা সব অন্য দিকে ছিল।আর পাভেলের কথা শোনা মাত্রই সে ঘোর থেকে বেড়িয়ে আনায়া খানিকটা নড়েচড়ে ওঠে। পাভেল আবারও জিজ্ঞেস করে,

“ইনায়ার কি অবস্থা?… তবে ইনায়াও কি…”

—“নাহ! না… ওর কিছু হয়নি। ডাক্তার বলেছে,ইরা এখন কিছুটা স্বাভাবিক।”

আনায়ার অস্ফুট উত্তরে পাভেল খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলল। অতঃপর আর এক মূহুর্তও দেরী না করে সিসিটিভি রুমে ছুটে যায়। তবে সেখানে গিয়ে বুঝতে পারে, তাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। প্রয়োজনীয় সকল সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব। গত কিছু সময়ের মাঝের আশেপাশের কোনো ফুটেজই আর নেই। এতো বড় কাজটা কে অথবা কিভাবে করলো তা কারোরই মাথায় আসছে না।

_____________

সকাল নয়টার দিকে কেনীথের জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার এসে যথাযথ চেক-আপও করে গিয়েছে। মোটামুটি সবার চেয়ে কেনীথ যথেষ্ট সুস্থ। শরীরের ক্ষত গুলোতে নার্স পুনোরায় এসে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে গিয়েছে। কেনীথ চুপচাপ বেডের উপর আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে, এমন পর্যায়ে ট্রে হাতে, রুমে প্রবেশ করল আনায়া। আনায়াকে দেখমাত্রই কেনীথ চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে রইল।কিন্তু আনায়ার তাতে ধ্যান জ্ঞান নেই। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত মলিন চেহেরায় সে কেনীথ কাছে এগিয়ে এলো। কেনীথের কাছে ওর ভাবগতিক স্পষ্ট নয়।দেখে মনে হচ্ছে, একটা খারাপ কিছু হয়েছে। কেনীথ কিছু বলতে নিবে,তার পূর্বেই আনায়া ভাঙ্গা গলায় কেনীথের উদ্দেশ্য বলল,

“এখন শরীরের কি অবস্থা?”

কেনীথ ওর আওয়াজে অনেকটাই অবাক হলো। মনে হচ্ছে, প্রচুর পরিমাণে কেঁদেছে সে। কেনীথ আঁতকে উঠল, এই ভেবে যে ইনায়ার কিছু হয়েছে কিনা। কেনীথ দ্রুত বলে উঠল,

“আমি…ঠিক আছি। কিন্তু কারো কিছু হয়েছে কি?”

আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হাসে। যে হাসির সম্পূর্ণটাতেই ছিলো তাচ্ছিল্যে পরিপূর্ণ। আনায়া ট্রেটা টেবিলের উপর রেখে,স্যুপের বাটিটা নিয়ে কেনীথের পাশে বসে। চামচ দিয়ে গরম স্যুপটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। এক চামচ স্যুপ তুলে নিয়ে, কেনীথের মুখের সামনে ধরতেই কেনীথ বলল,

“ইনায়ার কি অবস্থা? ওর কিছু… ”

—“নাহ,ঠিক আছে ও।”

কেনীথ খানিকটা স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে, স্যুপটুকু মুখে নেয়। ঠিক সেই মূহুর্তে আনায়া বিধ্বস্ত কন্ঠে বলে ওঠে,

“আজকের পর থেকে, আমাদের মতো রেহানেরও আর কেউ রইলো না। ওর ছোট ভাই, রোহানকে চেনেন? ও আর নেই। ম”রে গিয়েছে।”

কেনীথ আনায়ার এলোমেলো কথাগুলো শুনে খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে আবারও বলল,

“আপনি খুশি হননি? আমি তো ভাবলাম, এটা শুনে আপনি খুশি হবেন। কি অদ্ভুত এই দুনিয়া তাই না! যে কোনো দোষ করলো না সেও আজ সব হারালো।”

কেনীথ খানিকটা অস্থির হয়ে বলে উঠল,

“শুনেছিলাম, রোহানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। হঠাৎ ও কিভাবে…কি হয়েছে, আমায় খুলে বল তো!”

—“ন”রখাদক ছিলো। জ”ন্তু জানো”য়ার আর মানু””ষের মাং””স খে”তো। আপনাকে আর ইনায়াকে যেখানে পেয়েছি, ওখানেই এতোদিন ছিলো। একদম অন্ধকার জগতে ছিলো তার বসবাস। হাস্যকর! ঐ ছেলেটার কপালেও কেনো এমন মৃত্যু ছিলো, বুঝলাম না।”

আনায়া এটুকু বলতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। কেনীথের মুখের সামনে আবারও চামচ ধরতেই কেনীথ বলে উঠল,

—“আর খাবো না আমি।”

—“খাবেন না? কেনো খাবেন না? আরে খেয়ে নিন, খেয়ে নিন। আপনারই তো সময়। আগে শুনতাম, পৃথিবীটা হলো খারাপদের জন্য। যে যত বেশি খারাপ, তার জীবনটা তত বেশি সুন্দর। আসলেই তাই!
তাই এখন সুন্দর মতো খেয়ে নিন। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আবার অনেক মানুষের জীবন ধ্বং”স করতে হবে, তাই না?”

আনায়ার তাচ্ছিল্যে পরিপূর্ণ কথা আর ভাবভঙ্গিতে কেনীথের চোখমুখ শক্ত হলো। কিছু বলতে নিয়েও আর বললো না।ঠিক ঐ মূহুর্তেই আনায়া হিসহিসিয়ে বলল,

“রেগে যাচ্ছেন? আর রেগেই বা কি লাভ? সব তো শেষ, এখন শুধুমাত্র আমি রয়েছি। বাকি যারাও আজ বেঁচে রয়েছে, তারা ভেতরে ভেতরে কিন্তু পুরোটাই শেষ। আমাকেও শেষ করেছেন আপনি! চিরতরে শেষ করেছেন। এখন চাইলে জ্যান্ত হোক বা মৃত; যেভাবে ইচ্ছে দাফন করুন৷ কিচ্ছু যায় আসে না।”

—“………….

—“আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবেন?”

—“কি?”

—“আমার সাথে একবার রাশিয়া যেতে হবে। হাতে সময় কম। খুব দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে।”

আনায়ার এলোমেলো অভিব্যক্তিতে কেনীথ আর একটা কথাও বললো না। আনায়াও একটুও সময় নষ্ট না করে কেনীথকে খাবার খাইয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। পরবর্তী নার্স গিয়ে তাকে ঔষধ খাইয়ে দেয়।

আনায়া রুম থেকে বের হয়েই দেখল, রেহান করিডরে চুপচাপ বসে রয়েছে। চোখের চাহনিতে নির্লিপ্ততা। আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই। বিধ্বস্ত চেহেরার অপলক চাহনিতে সামনে দিকে তাকিয়ে। নিশ্চিত কোনো ঘোরের মাঝে আঁটকে রয়েছে। আনায়া রেহানের কাছে গিয়ে ওর পাশে বসে। দুজনের মাঝে অনেকটাই দূরত্ব। রেহানকে আনায়া একবার নাম ধরে ডাকলেও তেমন কাজ হলো না।রেহান যেন তা শুনতেই পায়নি। আনায়া হাত বাড়িয়ে রেহানের হাতের উপর হাত রাখলে, আকস্মিক সে খানিকটা চমকে আনায়ার দিকে তাকায়। এবং ত্বরিত নিজের হাতটা সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নজরও সরিয়ে ফেলে। অতঃপর অদ্ভুত ভাবে বি”ক্ষিপ্ত স্বরে বলতে লাগল,

“আমাকে ছুঁয়ে আর নিজেকে পাপের ভাগীদার করো না।দূরে থাকো, দূরে থাকো আমার।”

আনায়া নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়। রেহানের দিকে তাকিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকার পর ভারী নিশ্বাস ফেলে। রেহান এসব কথা কিছুক্ষণ আগেও বলেছে। রেহান যখন রোহানের কাছে যায় তখন অবস্থা একদম পাগলের মতো ছিলো। কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। যে রেহান শুরুতে রোহানের শরীরকে বিদঘুটে বলেছিলো, সেই পরবর্তীতে ওর বিদঘুটে শরীরটা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কখনো পাগলের মতো সারা শরীরের হাত বুলিয়েছে, কখনো চুল দাড়িয়েতে পরিপূর্ণ বিশ্রী চেহেরাটায় অনবরত উম্মাদের মতো চুমু খেয়েছে। সেই সাথে করুণ স্বরে আর্তনাদ করে বারবার বলেছে,

“ভাই একবার চোখ খুলে তাকা আমার দিকে। তোকে আমার অনেক কথা বলার আছে। অনেক কথা জমা রয়েছে আমার। এবার তো তোকে খুজে পেয়েছি, প্রমিজ করছি আমারা দুজন মিলে সবার থেকে দূরে চলে যাবো। তখন দেখবি, আমাদের আর কেউ কষ্ট দেবে না। প্লিজ একবার শুধু চোখ খোল। তুই আমাকে এভাবে ছেড়ে গেলে আমি আর কিভাবে বাঁচব? সবার মতো তুইও আর আমাকে, এভাবে নিঃস্ব করে ফেলে রেখে যাস না। প্লিজ রোহান! প্লিজ! একবার শুধু চোখ খোল ভাই, আমার।

ওর কান্নায় আনায়া নিজেও নিজেকে সামলাতে পারেনি। সে নিজেও হু হু করে কেঁদেছে। আর রোহানকে সামলাতে গেলে তখন ঠিক এভাবেই তাকে দূরে সরে যেতে বলেছে। এমন পরিস্থিতিতে রেহানের অভিব্যক্তি অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু সব মিলিয়ে আনায়া নিজেও আর কিছু সহ্য করতে পারছে না। আর কত হবে এসব, তা কেউ জানে না।

রেহান আর আনায়ার মাঝেই তাদের কাছে পাভেল এলো। দুজনের অবস্থা দেখে পাভেল আদতে কি বলবে তা নিজেও বুঝতে পারলো না। তবে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনায়া বলল,

” কিছু হয়েছে?”

—“না না, কিছু হয়নি। বলছিলাম যে ডেড বডি চাইলে এখান থেকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া যাবে। আমি সব ব্যবস্তা করে দিয়েছি, আলাদা কোনো ঝামেলা হবে না।”

পাভেলের কথা শুনে আনায়া চুপচাপ বসে রইল। পাভলেও সম্পূর্ণ চুপ থেকে বি”ধ্বস্ত রেহানের দিকে তাকিয়ে। আনায়া চাইলেও কিছু বলতে পারছে না, এরই মাঝে পাভেল অনেকটা নরম গলায় রেহানের উদ্দেশ্যে বলল,

“মিস্টার রেহান! ডেড বডিকে তবে…”

রেহানের যেন কেবল হুঁশ ফিরল।সে পাভেলের দিকে বিধ্ব”স্ত চোখে তাকিয়ে এলোমেলো কন্ঠে বলল,

“ডেড বডি নয়, ও আমার ভাই। ওর একটা নামও রয়েছে, রোহান! ওকে আমাদের বাবা মায়ের কবরের পাশে দাফন করব। আমাদের গ্রামের বাড়িতে।… এই শহর বিষাক্ত! আমি আর এখানে থাকতে চাইনা। সব কেড়ে নিয়েছে আমার,সব!”

রেহান এটুকু বলতে না বলতেই পুনরায় চুপ হয়ে নিজের খেয়ালে হারিয়ে গেল। সকালে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো এখন পুরো পাখির বাসার মতো হয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে চেহেরার হাল সম্পূর্ণ বেহাল। আনায়ার এর আগে কখনো এভাবে রেহানকে কাঁদতে দেখেনি। কিন্তু এবার যেন সম্পূর্ণ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছে। চোখের পানিও শুকিয়ে গিয়েছে। আর এখন সম্পূর্ণ পাথরের ন্যায় বসে রয়েছে।

—“তবে আমি বরং, আপনার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাতেই রোহানকে পাঠানোর ব্যবস্তা করছি।”

এই বলেই পাভেল কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল। রেহান হতে কোনো প্রতিত্তোর না আসায় সে চলে যেতে নিলে, পেছন থেকে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

“ধন্যবাদ! অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের। নয়তো আমার ভাইটাকে নিয়ে টা”নাহ্যাঁচ”ড়া করে,ওকে আরো বেশি কষ্ট দেওয়া হতো। আমি চাইনি কখনো এমনটা হোক।

অবশ্য, আমি যা চাইনি তা-ই তো হয়েছে। যা চেয়েছি তা চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।”

এটুকু বলতে না বলতেই রেহান আবারও নিজের খেয়ালে হারালো। অন্যদিকে ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাভেল চলে যেতেই আনায়ার চোখ হতে না চাইতেও কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

____________

দুদিন পেরিয়ে গিয়েছে।রোহানেও দাফন হয়ে গিয়েছে,তার বাবা মায়ের কবরের পাশে। আর রেহান এখন ছন্নছাড়া হয়ে তার গ্রামের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছে।

আর এদিকে আনায়া নিজেকে কোনোমতে সবকিছু মানিয়ে সামলে নিয়েছে৷ অনেক কাজ বাকি তার। ইনায়ার অবস্থার খানিকটা উন্নতিও হয়েছে৷ আগের যে অনেকটাই ভালো। অবশ্য এই পুরো দায়িত্বটা পাভেলকে দেওয়া হয়েছে। ইনায়ার উপর যেন কঢ়া সর্তকতা অবলম্বন করা হয়। কোনো মতেই যেন ওর কিছু না হয়। সবমিলিয়ে পাভেল তার লোকজন দিয়ে সবকিছু সামলে নিয়েছে।

আপাতত আজ তাদের রাশিয়ায় যাওয়ার কথা। যদিও পাভেল কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যের বিষয়ে তেমন কিছুই জানে না। তবে এক প্রকার আনায়ার জন্যই তাদের রাশিয়ায় যেতে হচ্ছে।

এদিকে গতকাল আনায়া গিয়ে সেই নার্সগুলোর সাথে দেখা করে এসেছে। এটা শুধু পাভেল আর আনায়াই জানে। কেনীথকে এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। তবে আনায়া নার্সগুলোর কাছ থেকে যা শুনেছে তাতে সে সম্পূর্ণ বিস্মিত। আদতেও যে এতোদিন ধরে বাচ্চাদের নিয়ে এতো জঘ”ন্যসব কাজ করা হচ্ছিল, তা তার কোনো মতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। যেন প্রত্যেকের কথাগুলো তার কাছে সপ্নের মতো লাগছিল। তবে আনায়া কারো কাছ থেকেই এই কোম্পানির সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতে পারেনি। তাদের কথা, তারা শুধু বাধ্য হয়ে কাজ করেছে। আর যারা অবাধ্য হয়েছে তাদের কঠিনের চেয়েও কঠিন শাস্তি হয়েছে। মূলত সেসব বিষয়ে অনেককিছু জানতে পারলেও কাজের তেমন কিছু সে পায়নি৷

নার্সদের কথা অনুযায়ী, অলিভার আর ইনায়া ছিলো এসব কাজের মূল কর্তা। তারা যা বলতো, তাদের তাই করতে হতো। এসবের মাঝে আনায়াকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল ইনায়ার বিষয়টা। ইনায়ার সম্পর্কে তাদের মুখ থেকে যতটুকু শুনেছে তাতে সে সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ। তার বোন, এতটা জঘ”ন্য, নৃশং”স কাজ করেছে তা তার কাছে এসব সম্পূর্ণ দুঃস্বপ্নের মতো। কি করে সম্ভব…!

ডবে সবকিছু শোনার পর আনায়া অনেকটাই চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। তার মাথায় যে আদতে কি চলছে তা কেউই বুঝতে পারছে না। আর এখন শেষমেশ কোনো কিছু না বলেই কেনীথ, পাভেলকে নিয়ে সোজা রাশিয়ায় চলে এলো।

আনায়া, পাভেল আর কেনীথকে দেখে মিসেস লুসিয়া নিত্যন্তই খুশি মনে তাদের আপ্যায়ন করে। কিন্তু আনায়ার এসবের কোনো কিছুতেই কোনো হেলদোল নেই। সে একদম নির্লিপ্ত, নিশ্চুপ। এদিকে আর সবার মতো আনায়ার ভাবগতিক কেনীথ নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। ও আদতে করতে চাইছেটা কি?

সারাদিন খাওয়াদাওয়া বলতে আনায়ার তেমন কিছুই হয়নি। সর্বক্ষণ কি একা একা কি ভেবেছে আর কি করেছে কেনীথ কিছুই টের পায়নি। কিন্তু এতটুকু তো বুঝেছে, আনায়া কোনো বড় কিছু করার উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছে। রাতের বেলায় চুপচাপ বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আনায়া। পরনে কালো কুচকুচে সাধারণ গাউন। একদম সাদামাটা, চুলগুলো এলেমেলো। তার নির্লিপ্ত চোখের চাহনি সামনের অন্ধকারের মাঝে।

ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ বারান্দায় কেনীথ এলো। তার নির্লিপ্ত ভাবগতিক আনায়ার কাছে স্পষ্ট ছিল না।সে তার ঘোর এবং বাস্তবতার মাঝে আঁটকে রয়েছে। আশেপাশে হয়তো কেনীথ রয়েছে এটা বুঝতে পারলে তার থাকা না থাকায় যেন আনায়ার কিছুই যায় আসে না। সে বরাবরের মতোই নিজের ভাবনায় মত্ত।

তবে এরইমাঝে কেনীথ ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু ওর স্তব্ধ ভাবগতিক দেখে সে কিছুই বলে না, বরং পাশ থেকে চুপচাপ আনায়াকে দেখতে থাকে।কিছুক্ষণ সময় এভাবে অতিক্রম হওয়ার পর, কেনীথ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আনায়ার চুলে হাত দিতে নিলে,আনায়া খানিকটা শান্ত ভাবে সরে গিয়ে বলে উঠল,

“ছোঁবেন না আমায়! আপনার প্রতি আমার প্রচন্ড ঘেন্না হয়।”

কেনীথ হাতের মুঠো শক্ত করে বাড়িয়ে নেওয়া হাতটা সরিয়ে আনে। তার অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। এরইমাঝে আনায়া আবারও শক্ত চোখে কেনীথের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপনি জানেন? আপনি আমার আশেপাশে থাকলে আমার শরীর ঘিনঘিন করে। আপনার নামটা শুনলেও তো,এখন আমার ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে।”

কেনীথ আনায়া এমন বি”দ্বেষপূর্ণ কথা শুনেও নির্লিপ্ত স্বরে বলল,

“ভালো।”

আনায়া আকস্মিক বিস্মিত হলো। হুরহুর করে তার রাগ বেড়ে ওঠে। দাঁত খিঁচে কপাল উঁচিয়ে বলল,

“ভালো?”

কেনীথ আবারও নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দেয়,

“হুম, ভালো! আর যাই হোক, তোর আমার মাঝে অন্তত একটা বি”দ্বেষের সম্পর্ক তো রয়েছে।”

—“লজ্জা করে না? এতোকিছুর পরেও একটুও লজ্জা হয় না? বেঁচে আছেন কিভাবে? আবার নির্লজ্জের মতো আমার কাছে স্বাভাবিক হতে আসেন। কিভাবে পারেন আপনি এসব? আমাকেও দয়া করে শিখিয়ে দেবেন তো! আমিও আপনার মতো হতে চাই।”

—“আমার মতো হয়ে, তোর কোনো কাজ নেই । যা রয়েছিস, তাই থাক! আর যে বিদ্বেষের পাহাড় গড়ে তুলেছিস আমার প্রতি, সেটাও কখনো ভাঙ্গতে দিস না। নয়তো তোর অবশিষ্ট অস্তিত্বটুকুও এই ভি.কে. নামক বিষাক্ত অগ্নিকু”ণ্ডের উ’ত্তাপে ঝলসে যাবে।”

—“কি বোঝাতে চাইছেন? এতোকিছুর পরেও আমি আপনার জীবনে স্বাভাবিক হয়ে ফিরতে পারবো? সবকিছু ভুলে আপনাকে ভালোবেসে, আপনার সাথে থাকব? এমন দুঃস্বপ্নের কথা কিভাবে ভাবেন?”

—“এইজন্যই তো ভাবি না। যেখানে জীবনগুলোই অস্বাভাবিক, সেখানে সম্পর্কগুলো কিভাবে স্বাভাবিক হতে পারে! আর তোর আমার মাঝে ভালোবাসা… এই শব্দটাকে ব্যবহার করাও হাস্যকর।”

আনায়া আর কিছু বলল না৷ চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার তীব্র অস্বস্তিতে সে অস্থির হয়ে ওঠে। সত্যি সত্যিই আর কেনীথে পাশে এখানে আর থাকতে চাইছে না।সে পেছনে ফিরে রুমে আসতে নিলে, কেনীথ আচমকা ওর হাত টেনে ধরে। আনায়া পেছনে ফিরে তাকালে, কেনীথ শীতল কন্ঠে বলে ওঠল,

“খাবারটা খেয়ে যা। সারাদিন কিছু খাসনি। অসুস্থ হয়ে পড়বি।”

আনায়ার চোখে আকস্মিক পানি চলে এলো৷সে জানে না এটা, অতিরিক্ত রাগ, ক্ষোভ কিংবা কষ্টের কারণে কিনা। তবে খানিকটা ক্ষোভ এবং অসহায় মিশ্রিত স্বরে বলল,

“কেনো করছেন এসব? কি লাভ এসব করে?”

—“কোনো লাভ নেই। তোর শরীর, তোর অসুস্থতা…অসুখ হলে তুই নিজেই ভুগবি।”

—“তবে এসব আমাকে বুঝতে দিন না! আমাকে নিয়ে আপনার কেনো চিন্তা? দোহাই আপনার, আর দয়া করে এসব ড্রামা করবেন না৷ এসব দেখতে দেখতে, অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি আমি।”

—“দেখ যেটা ভালো বুঝিস।”

—“হাত ছাড়ুন আমায়।”

—“ঠিকঠাক নিজের খেয়াল রাখতে শিখে নে! ওয়াদা করছি, সারাজীবনের জন্য ছেড়ে দেবো তোকে।”

আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলল। কেনীথের সবকিছুই যেন তার কাছে শুধু এক বাজে অভিনয়ই মনে হচ্ছে। আনায়া চুপচাপ খানিকটা চুপ থেকে আকস্মিক বলতে লাগল,

“আপনার বাবা মাকে ধন্যবাদ। এমন একটা মাস্টারপিস বানানোর জন্য। এখন তো আর, না ভয় হয়, না ঘৃণা! শুধু অবাক হই আমি।”

—“ধন্যবাদ তোর বাপকে দিস। আমাকে বানানোর কারিগর সে নিজেই। আমার বাপ মা আমাকে এমন বানায়ি।”

—“হ্যাঁ,অবশ্যই। এখন তো মনে হয় আমার বাপ যা করেছে ঠিকই করেছে। নয়তো তোমার বাপ মা বেঁচে থাকলে, ছেলের এমন রূপ দেখে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ত।”

আনায়া রাগের মাথায় কি বলছে তা হয়তো নিজেও জানে না।কখনো তুমি তো কখনো আপনি। এদিকে কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে,আনায়ার হাত ধরে রাখা বাঁধনটা শক্ত করল। কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

“আনায়া! লিমিট ক্রস করিস না। আমি এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাচ্ছি না।”

আনায়া যেন এই কথায় আরো কিছুটা রেগে যায়। এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে, হুট করেই প্রচন্ড তাচ্ছিল্যের সাথে বলতে লাগল,

“লিমিট ক্রস? এটুকুতেই আমার লিমিট ক্রস হয়ে গেল? তা তুমি যেসব করেছে সেসব কি?… আর রইল তোমার বাবা মায়ের প্রসঙ্গ…তারা কি এমন মহান কাজ করে গিয়েছেন শুনি? একটা জানো””য়ার, একটা কুলা/ঙ্গারকে পয়দা করে রেখে গিয়েছে। এই পাপের ফল তো তারা ম”রে গিয়ে ভোগ করছে হয়তো।”

আনায়া আর কিছু বলার সুযোগই পেল না। তার আগেই বজ্রাঘাতের ন্যায় কেনীথের বলিষ্ঠ হাতের সজোড়ে দেওয়া এক থাপ্পড় এসে পড়ল আনায়ার গালে।কেনীথের ডানহাতের আঘাতে আনার মাথা সম্পূর্ণ কেঁপে ওঠে, চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে চারদিক। শরীরটা ছিটকে গিয়ে ধাক্কা খায় ব্যালকনির রেলিংয়ে।ধাতব রেলিংয়ের সঙ্গে তার পিঠের ধাক্কা লাগতেই একটা খাঁচায় আটকে পড়া পাখির মতো কেঁপে উঠল সে।

কিন্তু এখানেই থামল না কেনীথ।বরং তার চোখের ভেতর যেন তখনও আগুন জ্বলছিল। এদিকে আনায়া এখনও ব্যথায় কুঁকড়ে রয়েছে। আনায়া ঠিকমতো দাঁড়ানোর আগেই কেনীথ এগিয়ে আসে জড়ের গতিতে। আচমকা তার ডানহাত দিয়ে আনায়ার গলা চেপে ধরে।
এমন ভাবে চেপে ধরে, যেন গলার ভেতর থেকে নিঃশ্বাসটুকু ছিনিয়ে নিতে চায়। সেই সঙ্গে অন্য হাতে আনায়ার বামহাত মোচড় দিয়ে পেছনে টেনে নিয়ে, এমন ভাবে শক্ত হাতে চেপে ধরল যেন হাড় সম্পূর্ণ ভেঙে দেবে। অবশ্যই আকস্মিক এই আঘাতে আনায়া মনে হল, হাতটা যেন সত্যিই চিড়চিড় করে উঠেছে।

“আর একটা শব্দও বের হলে… সোজা খু’ন করে ফেলব তোকে!”

ফিসফিস করে কথাটা বলতেই কেনীথ আনায়ার উপর আরো বেশি বল প্রয়োগ করল। অথচ তার সেই কণ্ঠে এমন এক শীতলতা ছিল যা অগ্নি ঝড়ের চেয়েও বেশি ধ্বং”সাত্মক।

আনায়া শ্বাস নিতে পারছে না। তার গলা এখন কেনীথের লোহার মত শক্ত মুঠোয় বন্দী। চোখ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে উঠছে, ঠোঁট কাঁপছে। চেষ্টা করছে কিছু একটা বলার, কিন্তু গলা দিয়ে শুধু ক্ষীণ শব্দ বের হচ্ছে। আনায়ার শরীর এতক্ষণে রেলিংয়ের গা ঘেঁষে বেঁকে রয়েছে।রেলিংয়ের ধাতব রেখা তার পিঠে কেটে বসছে। শরীরটা বেঁকে গিয়ে অস্বাভাবিকভাবে হেলে পড়েছে।
আনায়ার শরীর কাঁপছে… নিঃশ্বাস যেন বুকেই জমে আছে।কেনীথের চোখ তখন নিস্তেজ, অথচ সেই নিস্তেজতায় এক ভয়ানক উন্মত্ততা লুকানো। যেন সামনে থাকা মানুষটা তার কাছে কোনো অস্তিত্বই নয়।শুধু একটা শাস্তিযোগ্য উপাদান।

রাতের বাতাস থেমে গিয়েছে। ব্যালকনির চারপাশে এক নিঃসাড়, ঠান্ডা নীরবতা। আর সেই নিঃশব্দতার মধ্যেই আনায়া বুঝতে পারল, আজ হয়তো খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। কেননা এমন পরিস্থিতিতে তার নিজের রাগ একটুও কমেনি। বরং উল্টো বেড়ে চলেছে।

এর পরবর্তী মূহূর্ত যেম আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করল।একটা ছোট্ট ভুল ব্যালান্স এবং সেকেন্ডের ভগ্নাংশে ঘটল বিপর্যয়।

জান বাঁচাতে কেনীথের হাত থেকে ছাড়া পেতে আনায়া যখন তার উন্মুক্ত অন্য হাতের সাহায্যে জোর প্রয়োগ করেও বৃথা। এই সময় দুজনের অদ্ভুত সংঘর্ষের মাঝে ,আকস্মিক আনায়ার শরীর রেলিংয়ের উপর দিয়ে পুরোপুরি উল্টে যায়।নিচে এক বিশাল অন্ধকার।তার মাথার চুল বাতাসে উড়ছে, শরীর ভারহীন হয়ে শূন্যে পতন হতে শুরু করেছে। আনায়ার এক মূহুর্তের জন্য মনে হল,আজ যদি কোনোমতে সে ম”রে যায় তবে হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি সে নিজেই হবে। তবে তার এই ক্ষনিকের ইচ্ছে পূরণেও বাঁধা সাধল কেনীথ। ঠিক মৃত্যুর শেষ প্রান্তে একটা শীতল নিঃশ্বাসের মতো নিখুঁত ক্ষিপ্রতায়, কেনীথের হাত এসে ধরে ফেলল আনায়ার কবজি। কেনীথ যেন নিজের রাগের আগুনে নিজেই পুড়ছিল তখন।

আনায়া এখনো শূন্যে ঝুলে রয়েছে। কেনীথ তার কবজি ছেড়ে দিলেই সে সম্পূর্ণ নিচে। অন্য হাতটাও অবশ্য এখন বাতাসে ঝুলছে। যদিও তারা দোলতায় রয়েছে,তবে তাদের এই ক্যাসেলের প্রতিটা ফ্লোরের উচ্চতা এতোই বেশি যে, এই দুই তলাও ছয়তলা সমান মনে হবে।

এরই মাঝে আকস্মিক নিজের ভর ছেড়ে দিলে, কেেনীথের হাতের বাধন খানিটা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সেই সাথে কেনীথের রাগও খানিকটা কমে গিয়ে সে সিরিয়াস হয়ে ওঠে। আর ঠিক তখনই,কেনীথ আর এক মুহূর্ত দেরি না করে, সেই বলিষ্ঠ হাতের সাহায্যে,খানিকটা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে টেনে তোলে।অতঃপর একপ্রকার ছুড়ে দেয়ার মতো করে ফেলে দেয় ব্যালকনির মেঝেতে।

আনায়া সম্পূর্ণ মেঝেতে আছড়ে পড়ে। চুল তার এলোমেলো, চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। তবুও ফর্সা চেহেরায় ফেসে ওঠা রাগের লালিমা কাটেনি। শ্বাস চলছে, তবে বি”ক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু চোখে তার উত্তপ্ত আগুনের ন্যায় ক্ষো”ভ স্পষ্ট।

এদিকে কেনীথ দাঁড়িয়ে থাকে নিঃশব্দে। তার চোখে তখনও জ্বলছে আগুন। সেই সাথে নেই বিন্দুমাত্র অনুশোচনা। শত চেষ্টা করেও কোনোমতেই যেন রাগই কমছে না।

আনায়া ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, তার দেহের প্রতিটি কোষে যেন আগুন জ্বলে উঠেছে। রক্তে সিক্ত মুখে লালিমা ছড়িয়ে, চোখে ক্ষোভের জ্বালা স্পষ্ট। এদিকে কেনীথ যখন খানিকটা অমনোযোগী হয়ে নিজের রাগ কমানোর খেয়ালে ডুবে গিয়েছে, ঠিক সেই মূহুর্তেই আনায়া কেনীথ গাল বরাবর নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রযোগ করে চ”ড় লাগায়। আর চ”ড়ের সেই শব্দে যেন চারিদিকে নীরবতা চূর্ণ হয়ে যায়।

কেনীথ কিছু বলার আগেই, আনায়া সম্পূর্ণভাবে আরো বিকৃত হয়ে উঠল। পাগলির ন্যায় রাগ ও ক্ষোভের আগুনে দহন হয়ে, সে কেনীথের গলা, বাহু আর খামচে ধরে, ইচ্ছে মতো কি’ল, ঘু’ষি,আঘাত দিতে শুরু করল। সম্পূর্ণ বিকৃত মস্তিষ্কের অনিয়ন্ত্রিতহীন মানবের ন্যায় রাগের বশে অদ্ভুত সব আচরণ করতে শুরু করে। হাত কিড়মিড় করে কখনো কেনীথকে মারতে চাইছে তো কখনো নিজেকেই আঘাত করতে চাইছে। সেই সাথে আনায়ার প্রতিনিয়ত ফেলা অস্থির নিশ্বাস খানিকটা লোমহর্ষক আবহ তৈরি করল। কেনীথের উপর আনায়ার প্রতিটি আঘাত যেন তার অন্তরের গহীনে সঞ্চিত যন্ত্রণাকে প্রকাশ করে চলেছে।একদিকে ছিল নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাওয়া, অপরদিকে ছিল সেই ভেঙে পড়া মানবিক অনুভূতির নিদর্শন।

আর এই মুহূর্তে, কেনীথ হঠাৎ বুঝতে পারল—আনায়ার মোটেও স্বাভাবিক নেই। এমন অস্থির, ক্ষি”প্ত সত্তার আনায়াকে সে কখনোই দেখেনি।আনায়া যেন এক নিঃস্বার্থ ক্ষিপ্ত রাগে পূর্ণ এক অচেতন প্রাণবিকাশে পরিণত হয়েছে। তার রাগে, অশান্তিতে যেন তার নিজের অস্তিত্ব ধোঁয়াশার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। যা বুঝতেই, কেনীথ তাড়াহুড়া করে আচমকা আনায়াকে জড়িয়ে ধরল। শুরুতে কোনোমতেই আনায়ার হাত ছোটাছুটির জন্য তাকে সামলে নিতে পারল না। একের পর এক আনায়ার আঁচড়,আঘাতে কেনীথ ব্যথিত দেহটা আরেকটু বিষিয়ে উঠল। অবশ্য তার ক্ষতগুলো যে এখনোও সারেনি। তবে কেনীথ সেসব পাত্তা না দিয়ে অনেকটা শক্ত হাতে আনায়াকে সম্পূর্ণভাবে নিজের বাঁধনে আঁটকে ফেলল। সেই জড়িয়ে ধরার মধ্যে ছিল এক নিপুণ কৌশল, যেখানে কেনীথ জানত—এই মুহূর্তে শব্দের চেয়ে শরীরের ভাষা বেশি কিছু বলতে পারে। আশেপাশের বাতাস যেন তার ক্রোধের সঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত সুরে ধ্বনিত হতে লাগল।

এই লড়াইয়ে, একদিকে আনায়ার বিদীর্ণ রাগ আর অন্যদিকে কেনীথের ঠাণ্ডা, সতর্ক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায়, মানবিকতা আর ক্ষোভের মিলিত প্রক্ষিপ্ত চিত্র ফুটে উঠল। এক ক্ষণ যেন সময় থমকে গিয়েছে। যেখানে উভয়েরই হৃদয়ে এক ভিন্ন ধরনের ব্যথা ও পরাজয়ের ছাপ রয়েছে।

কেনীথের একহাত আনায়ার পিঠের উপর, অন্যহাত মাথার পেছনের এলোমেলো চুলের মাঝে। কেনীথ শক্ত হাতে আনায়ার মাথা নিজের বুকের মাঝে আঁকড়ে নিয়েছে। বলতে গেলে, সম্পূর্ণ আনায়াকেই যেন নিজের মাঝে আঁকড়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে তার।আর প্রতিনিয়ত অদ্ভুত শীত কন্ঠে চুলে হাতে বুলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বলতে থাকল,

—“প্লিজ, শান্ত হ! প্লিজ! পাগলামি করিস না,তারা! এভাবে নিজেকে কষ্ট দিস না।”

তবে আনায়ার রাগ এক নিমিষেই কমে না বরং, কেনীথের বাঁধন থেকে শত মোচড়া মুচড়ি করে বেরোতে না পেরে, একটা সময় ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করে।কখনো অদ্ভুত স্বরে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে, আবার কখনো প্রচন্ড বিদ্বেষ নিয়ে কেনীথকে আঘাত করার চেষ্টা করা করে। আনায়া যখন প্রায় অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছে তখন কেনীথ পুনরায় ব্যাথিত স্বরে বলে উঠল,

“সরি! সরি! আমার বোঝা উচিত ছিলো…কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস?…এমন পাগলামি কেনো করিস বলতো!”

আনায়া একদম নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে। কান্না আর রাগ মিশ্রিত স্বরে, কেনীথের বুকে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই অস্ফুটস্বরে বলতে লাগল,

“কেনো করেন এসব? আপনি যে খারাপ, তা বারবার কেনো ভুলে যান? এসব ভালোমানুষি দেখিয়ে কি প্রমাণ করতে চান? এসব করলে আপনি ভালো হয়ে যাবেন?
শুনুন! আমি আপনাকে ঘৃণা করি। প্রচন্ড ঘৃণা করি। ম”রে যাবো, কিন্তু কখনোই ভালোবাসবো না আপনাকে! কখনো না, কোনোদিনও না। দেখবেন, পরের জন্মেও আমি আপনাকে ঘৃণা করবো। প্রচন্ড ঘৃণা। আপনার প্রতি জমা আমার বিদ্বেষ কোনো কালেই ফুরাবে না।”

কেনীথ দম আটকে একনাগাড়ে বলা আনায়ার কথাগুলো শুধু শুনে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পুনোরায় বলে উঠল,

“যদি পূর্বজন্ম বলতে সত্যিই কিছু হয়, তবে আমি তখনও শুধুমাত্র একজনকেই ভালোবাসতে চাই। আর সে হলো একমাত্র তুই।”


আনায়া আকস্মিক মাথা উঁচিয়ে কেনীথের দিকে তাকায়। চোখে তার অদ্ভুত চাহনি। খানিকটা রাগ আর খানিকটা বিস্ময়। কেনীথ ওর চাহনির দিকে তাকিয়ে খানিকা মুচকি হাসল।অতঃপর চোখ ফিরিয়ে দূর অন্ধকার আকাশের মেঘে ঢাকা চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“মেয়েদের প্রতি আমার কখনোই বিশেষ কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। তবে শুধু এটুকু জানতাম, আমার একজন রয়েছে। যাকে আমার মা আমার জন্য রেখে গিয়েছে। কিন্তু তার প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মানোর পূর্বেই, বিদ্বেষ জন্মে গিয়ছিল। কিন্তু দিনশেষে আমি তাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতেও পারিনি। এটাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানিনা। কিন্তু যদি হয়, তবে তাই!”

—“যদি আমাকে এতোই ভালোবাসতি, তবে শুরুতে আসলি না কেনো? বল আমাকে? কেনো সবকিছু ধ্বং”স করার জন্যই তোকে আসতে হলো?”

কেনীথ আনায়ার ক্ষিপ্ত কন্ঠ আর চাহনির দিকে অবাক চোখে তাকায়। আনায়ার তুইতোকারিতে কেনীথের কোনো হেলদোল নেয়। বরং সে অবাক হচ্ছে এই ভেবে, আনায়ার এহেন কথার পেছনে লুকিয়ে থাকা অনুভূতিগুলো সব ভিন্ন। এই কথাগুলোতেও যেন সে তার উপর অধিকার ফলাচ্ছে। সত্যিকারের অধিকার! যা আগে কখনো করেনি। বরং সেসব কথায় তো শুধু ছিলো তাচ্ছিল্যের আভাস।
কেনীথ খানিকটা সময় চুপ থেকে, ভেবে নিয়ে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই, আনায়া এবার হাত দুটো কোনো মতে ছাড়িয়ে নিয়ে কেনীথের বুকের টিশার্ট খামচে ধরে বলে উঠল,

“তুই যদি আমায় সত্যিই ভালোবাসতি তবে কখনো আমার জীবন ধ্বং”স করার জন্য আসতি না। যখনই দেখলি, আমার জীবনটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তারেক শিকদারের মেয়েরা সুখে থাকতে শুরু করছে। তখন আর তোর সেসব সহ্য হলো না। আর ওমনি সবার জীবনটা তছনছ করতে চলে এলি। অথচ এখন বলছি, আমাকে ভালোবাসিস। কেনো মিথ্যে বলছিস? আর কত কষ্ট দিবি বল? আর কত?”

চলবে………..

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব→৩৮(৩য় অংশ)

—“কোনো উত্তর নেই, তাই না? জানি আমি…কিচ্ছু বলতে পারবেন না আপনি। তবে দয়া করে আর আমার জীবনেও নতুন করে প্রবেশ করার চিন্তাভাবনাও করবেন না। এটা আর সম্ভব নয়, কখনোই সম্ভব নয়। আমি ম’রে গেলেও চাইনা এমন কিছু হোক। আপনি কি করেছেন, না করেছেন তা না-হয় আপনার কাছেই থাকুক। আমি আর নতুন কোনো হিসেব-নিকেশের মাঝে জড়াতে চাইনা। আমাকে আর আমার বোনকে এবার শান্তি মতো… আমাদের মতো করে বাঁচতে দিন। নয়তো… মেরে ফেলুন।”

কেনীথ আনায়ার এতো প্রশ্ন, কথার প্রতিত্তরে কিছুই বলল না।বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অন্যদিকে আনায়া কিছুক্ষণ কাঁদার পর আর ঠিকঠাক দাঁড়িয়ে থাকার আর শক্তি পেল না। আনায়ার পাশাপাশি কেনীথও অনুভব করল,আনায়ার শরীর অনবরত কাঁপছে। কেনীথ খানিকটা মাথা নিচু করে ওর দিকে তাকাতেই দেখে, সে কেমন যেন তার বুকের মাঝেই নেতিয়ে পড়েছে। কেনীথ কপাল কুঁচকে চিন্তিত স্বরে বলে উঠল,

“তারা! তুই ঠিক আছিস?”

আনায়া আর কিছুই বলে না। যেন সে বলতে পারছে না৷ নূন্যতম বলার জোরটুকু আর অবশিষ্ট নেই। কেনীথ একহাতে ওকে শক্ত করে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। অন্যহাতে আনায়ার গাল ছুঁয়ে মুখ উঁচিয়ে ধরতেই আনায়ার বি’ধ্বস্ত চেহেরায় কেনীথ খানিকটা আঁতকে উঠল। হঠাৎ এতো বাজে অবস্থা কি করে হলো কিছুই মাথায় আসছে না। কেনীথ প্রচন্ড উদ্বিগ্ন স্বরে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“এমন করছিস কেনো?…বেশি খারাপ লাগছে? কথা বলছিস…”

—“দয়া করে আমায় একটু ছাড়ুন…আমি রুমে…”

কেনীথের বাঁধন থেকে আনায়া চাইলেও নিজের শারিরীক অবস্থার কারণে, নড়াচড়াটুকুও করতে পারছিল না৷ হাত পা যে সব অবশ হয়ে আসছে। মাথা প্রচন্ড ভার..চোখ খুলে তাকিয়ে থাকাও যেন কষ্টকর। আনায়া নিজেও বুঝতে পারছেনা, তার এতো কেনো খারাপ লাগছে। আর শেষমেষ কথা বলতে গিয়ে আর তার কথা সম্পূর্ণ হলো না।বরং তার পূর্বেই মাথা ঢুলে কেনীথের বাহুতে অচেতন হয়ে পড়ল।

আনায়া অজ্ঞান হয়েছে তা বুঝতেই কেনীথ তড়িঘড়ি করে ওর গাল চাপ্টে ওকে ডাকতে শুরু করে।

—“তারা! তারা! উঠে যা প্লিজ…”

কেনীথ এ কথা বলতে না বলতেই আনায়াকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। এক মূহুর্তও দেরি না করে আনায়াকে নিয়ে রুমে ছুটে যায়। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েই, লোকজন ডেকে ঘর ভরিয়ে ফেলে। ওর উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা সবকিছুই পাগল প্রায়। চারপাশের সার্ভেন্টগুলোও ওর কাজকর্মে ভীতু হয়ে দাঁড়িয়ে। অবশ্য সেই ভয় নিয়েই প্রত্যেকে নিজেদের কাজটা যথাযথ করে চলেছে।

_____________

” রাতের শহর জেগে থাকে, নিঃশব্দের দরজায়_____
আমি একা গুনি তোমার অব্যক্ত ব্যবধান

মুখ ফিরিয়ে থাকো তুমি
আমি তবু তোমারই থাকি!
জানো না, জানতেও দাও না—একজোড়া আগুন পাখি

> ভয় নয়, ক্রোধ নয় — এই ভালোবাসা পুড়ে যায়
কষ্ট নয়, শব্দ নয় — শুধু নিরবতায় বাঁচে এই হৃদয়

> আমি আগুন — তুমি বাতাস
ছুঁতে গেলেই মিলায় আশ্বাস________
তবু থেকে যাই তোমার আকাশে
একজোড়া আগুন পাখি — পুড়ে ম’রে নিঃশ্বাসে

> শত প্রশ্ন জমে আছে ঠোঁটের কিনারায়।
বলা হয়নি অনেক কথা ছায়া হয়ে বায়_____
হয়ত তোর ঘৃণা — হয়ত ভুল বোঝা সবই!
তবু হৃদয়ে ভাসে শুধু ____ তুই সেই আমার আগুন পাখি।

জানো না, জানতেও চাও না,
তবু হৃদয় জানে তুমি ছিলে।
আমরা একজোড়া আগুন পাখি—
ভালোবাসারও আগুনে জ্বলেছি নীরবে…

উড়তে পারি না পাশাপাশি,
তবুও পুড়ে যাই সমান তালে—
নিঃশব্দ ভালোবাসায়,
অভিমানী আগুনে।

(Lyrics writer—V.K.)

https://www.facebook.com/share/v/1ALgfPRNAm/

রাতের নিস্তব্ধ আবহে গাওয়া গান হঠাৎ থেমে যায়।
তার সাথে যেন থেমে যায় সময়ের কাঁটা।
সেই থেমে যাওয়া সুরের ভাঁজে, কেনীথের দীর্ঘশ্বাস একটুকরো ছায়া হয়ে ঢেউ তোলে শূন্যে।

বারান্দার রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মুখটা উপরের দিকে তুলে রাখা, দৃষ্টিটা স্থির—অন্ধকার আকাশের পানে।যেন আকাশের অসীমতার মধ্যে কোথাও লুকিয়ে আছে তার সব প্রশ্নের উত্তর।যা সে কখনো পায়নি… আর পাবে বলেও মনে হয় না।চোখে তার অবাধ শূন্যতা, নিস্তব্ধতা আর হাহাকার…।

আনায়াকে অজ্ঞান অবস্থায় বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার পর কিছুক্ষণের মাঝেই ওর জ্ঞান ফেরানো হয়। সেই সাথে বাড়ির পারসোনাল ডক্টর এসে চেক-আপ করে যায়। ডাক্তারের অভিব্যক্তিতে গুরুতর কিছু নয়, অনেকটা সময় না খেয়ে থাকার জন্যই এই অবস্থা। অতঃপর ওকে অর্ধ অচেতনতার মাঝেই কোনো মতে কিছু খাবার খায়ানোর পর, অল্প কিছু সময়ের মাঝেই সে ঘুমিয়ে যায়। এবং তখন হতে এখন পর্যন্ত পুরো সময়টাতেই কেনীথ আনায়ার পাশেই থাকে৷ তবে একটা দীর্ঘ সময় পর অজানা সব চিন্তা ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠলে সোজা বারান্দায় চলে আসে।

ভোর হতে আরো অনেকটা দেরি৷ কেনীথের সবকিছুই প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। খানিকটা সময় আনমনে গান গাওয়ার পর এখন প্রচন্ড অস্বস্তিতে হাসফাস করতে লাগল।
কেনীথ চোখদুটো আলগোছে ধীরে ধীরে বুঁজে আনে।হিম হাওয়া গায়ে এসে ঠেকে, কেনীথ খানিকটা কেঁপে ওঠে।তবু নড়ে না, হঠাৎই মৃদু স্বরে, নিজের সঙ্গে নিজের একান্ত কথোপকথনে লিপ্ত হয় সে।

“কত সহজে তুই মিশে যাস সবার মাঝে।
সবাইকে ভালোবাসিস, ছুঁয়ে থাকিস আলগোছে…
আর আমি কে? কে আমি?
আমি তো শুধু তোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা ছায়া মাত্র। যার উপস্থিতি তুই কখনো অনুভব করিসনি।”

কেনীথের স্বরে কষ্ট নেই, কিন্তু রয়েছে আকাশস্পর্শী শূন্যতা।একটা নির্লিপ্ত বেদনাবোধ, যা চিৎকার করে না।,তবুও ভেতরে গভীর ক্ষরণ তোলে। পুনরায় পিনপতন নিরবতায় চারপাশে ছেয়ে যায়। কেনীথ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর পুনোরায় আওরায়,

“আমি যেন তোরই চেনা শহরে সবচেয়ে অচেনা এক মানুষ।

আমি জানি, তুই ভালোবাসিস না আমাকে। হয়তো কোনোদিনও…।তবুও তো আমি তোকে ভালোবেসেই নিঃশব্দে পুড়ে গিয়েছি।বারবার পুড়ে ছারখার হয়েছি।

তবুও বিন্দুমাত্র অনুভব করতে পারিস না আমায়? কেনো পারিস না? মানছি আমার দোষ রয়েছে। তোর কথা মতো সব দোষ আমার, কিন্তু… এই কিন্তুই তো সরছে না। আর কত কিন্তুর মাঝে ফেঁসে থাকব, আর কত?

কখনো কোনো অভিযোগ করিনি। কখনো বলিনি কেনো ভালোবাসিস না আমায়। কেননা আমাকে ভালোবাসার…”

কেনীথের কথা যেন সম্পূর্ণ হয়না। সে চোখ খুলে অন্ধকারে ডুবে থাকা আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে।তার মধ্যে হয়তো সে খোঁজে আনায়ার অবয়ব…কিংবা সেই না-বলা কথাগুলো, যেগুলো কেবলই জমে রয়েছে ঠোঁটের কোণায়।

—“আমি তো সেই আগুন পাখি—
যে উড়তে চায়, তোকে ছুঁতে চায়,
আর ছুঁতেই গিয়ে নিজেই ছাই হয়ে যায়।”

“ভালোবাসা তো আমি চাইনি…
শুধু তোর একফোঁটা নির্ভরতা চেয়েছিলাম।একটুখানি বিশ্বাস,একটুখানি ভরসা।হয়তো কখনো বলবি,‘তুই বুঝিস আমাকে।’
তা-ও পেলাম না। তুই জানিস না,জানতেও চাস না,কখনো আমাকে বোঝার চেষ্টাও করিস না।তবুও আমি জানি, তুই আমারই ছিলি…কোনো একভাবে, কিংবা অনুচ্চারিত কোনো এক ভাষায়।”

পাশের ঘরে আনায়া নিশ্চুপ, গভীর ঘুমে।
অথচ তার ঘুমের নিঃশ্বাসে ধরা পড়ে কেনীথের পুড়ে যাওয়া স্তব্ধ সময়৷ এমন সময় কেনীথের কানে এক শীতল হাওয়ায় ভেসে আসা শীত কন্ঠ ফিসফিস করে বলে উঠল,

“একটা অসমাপ্ত প্রেম,
একটা অপ্রাপ্ত সম্পর্ক—আর একজোড়া আগুন পাখি।যারা কেবল উড়তে চেয়েছিল…
তবে ঝলসে গিয়েছে ফিনিক্স হয়ে উঠার আশায়।”

যদিও এটা কেনীথের কেবলমাত্র ভ্রম ব্যতীত কিছুই নয়। তবে কেনীথ এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। বরং আকস্মিক মুচকি হেসে ফেলল। আরো কিছুটা সময় এভাবেই একা একা অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ রুমে ফেরার সিন্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে প্রবেশ করতেই সে খানিকটা চমকে যায়। রুমের কোথাও আনায়া নেই। বিছানা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ওয়াশরুমের দিকে খেয়াল করে দেখল, সেখানেও কেউ নেই। তবে এই সময় আনায়া গেলটা কোথায়?

_____________

মাঝরাতে আনায়ার যখন ঘুম ভাঙে তখন তার নজর পড়ে বারান্দায়। কেনীথ গ্রিলের সাথে হেলান দিয়ে আকাশের পানে চেয়ে কিছু বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে। কিন্তু আনায়ার তাতে কোনো হেলদোল নেই। সে তার অসুস্থতায় ভাড় হয়ে আসা শরীরটা নিয়েই আলগোছে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য তাদের বাবুশকা লুসিয়া…।

সাধারণত এতো রাতে কোনো বৃদ্ধ বয়সী নারীর জেগে থাকার কথা নয়। কিন্তু আনায়া জানে অভ্যসগত কারণে বাবুশকা এতোক্ষণে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে নয়তো এখনো ঘুমায়নি। তবে তাকে সজাগ অবস্থায় পাওয়ার জন্য এই সময়টা ভুল নয়।

আনায়া নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়েই বাবুশকা অর্থাৎ লুসিয়ার রুমের কাছে গিয়ে পৌঁছায়। দরজায় একবার শব্দ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। গতকাল সকালে পাভেলের জোরাজুরিতে শেষ একবার ফলের জুশ খেয়েছিল। এরপর আর একটা খাবারও মুখে তোলেনি। এখন মনে হচ্ছে,নিজের সাথে এমন ভুলভাল জেদ দেখানোটা সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে। অন্তত এমন সিচুয়েশনে এসব কাজকর্ম মানায় না। না খাওয়ার ইচ্ছে রইলেও, নিয়ম করে অল্প অল্প খাওয়া উচিত ছিল তার।

আনায়ার চিন্তাভাবনার মাঝেই আচমকা দরজা খুলে যাওয়ায় আনায়া খানিকটা চমকে ওঠে। আজ জায়গাটা খানিক ব্যতীক্রম লাগছে। আশপাশে তেমন কোনো গার্ডও নেই। সাধারণ এদিকটায় গার্ড অনেক বেশি থাকে। আনায়া এই নিয়ে মাথা ঘামাল না। দরজা খুলে যাওয়ায় লুসিয়ার অপ্রস্তুত হাস্যজ্জল মুখের দিকে আনায়া কিঞ্চিৎ হেঁসে ফেলল। কেন যেন আনায়ার মনে হল, লুসিয়া হয়তো জানত সে এসেছে নয়তো আসবে।

আনায়াকে দেখামাত্রই নিমিষেই লুসিয়ার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। সে খানিকটা দুশ্চিন্তার সাথে আনায়াকে বলল,

“তোমার শরীর ঠিক আছে? রেস্ট না নিয়ে এতো রাতে…কোনো বিশেষ প্রয়োজন?”

মূহুর্তেই লুসিয়াস দুইরকম ভাবগাম্ভীর্যই যেন আনায়ার খটকাকে সত্যি করে তুলল। তবে নিছকই মুচকি হেসে বাবুশকা উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,

“জ্বী! তেমন কিছুই ভাবতে পারেন। আ…বাবুশকা যদি কিছু মনে না করেন তবে কি ভেতরে আসতে পারি?”

লুসিয়া খানিকটা অপ্রস্তুত স্বরে বলে উঠল,

“আ…হ্যাঁ,হ্যাঁ… ভেতরে এসো। বাহিরে কেনো দাঁড়িয়ে আছো? ”

আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। লুসিয়া এতোটা কঠোর ব্যক্তিত্বের হওয়ার পরও তার মৃদু অস্থিরতা, সংকোচ কোনটাই আনায়ার নজরের অগোচর হয়না।

আনায়াকে লুসিয়া বসতে বললে সে গিয়ে সোফায় চুপচাপ বসে পড়ে। সেইসাথে তার মুখোমুখি হয়ে বসে লুসিয়া। অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় দুজনের মাঝে কোনো কথাবার্তা হয়না। আনায়া আড় চোখে লুসিয়াকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। লুসিয়ার হাভভাব আজ অনেকটাই পরিবর্তন। খুব অদ্ভুত লাগছে বিষয়গুলো। লুসিয়া যেন না চাইতেও বারবার নজর সরিয়ে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে। আনায়াও তার মতো আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল, তারা ব্যতীত রুমে আর কেউ রয়েছে কিনা।

এরই মাঝে আনায়া আবহটাকে স্বাভাবিক করতে লুসিয়াস উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“বাবুশকা, রোজ কোথায়? এখানে আসার পর একবারও ওকে দেখিনি আমি।”

আনায়ার এই স্বাভাবিক প্রশ্নটাও যেন বাবুশকার গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো ছিল। আচমকা এই প্রশ্নের জন্য যেন সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। বৃদ্ধ চেহারায় আতংকের ছাপ পড়াতে আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল। অন্যদিকে লুসিয়া নিজেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করে ত্বরিত স্বাভাবিক স্বরে জবাব দেয়,

“রোজ তো কনভেন্টে রয়েছে।”

—“রোজ আশ্রমে…আই মিন কনভেন্টে… কবে থেকে?”

—“এই যে তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পরই, ও ওখানে চলে গিয়েছে। ফিরে আসবে, খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবে।”

—“ও তো কিছু বছর আগেও গিয়েছিল না ওখানে?”

—“হ্যাঁ,টেম্পোরারি ভাউস হিসেবে…তবে ওই প্রসেসটা দীর্ঘ সময়ের ছিলো। এবার তো অল্প কিছুদিনের জন্য গিয়েছে।”

—“ওহ।”

আনায়া আর এই প্রসঙ্গটাকে বাড়াতে চাইল না। এই খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে সে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা জানে। গত কয়েক বছর আগেও রোজ টেম্পোরারি ভাউস… অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কনভেন্টে বা খ্রীষ্টধর্মীয় আশ্রমে থেকে ধর্মীয় নিয়ম মানার শপথ নিতে হয়।যেটা মূলত একপ্রকার অস্থায়ী সন্ন্যাসী হওয়ার মতো। কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী নয়। আর রোজও প্রায় দুবছরের মতো কনভেন্টে ছিল। যার ফলে পুরো সময়টা তার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু সেই ঘটনা আর এবারের ঘটনার মাঝেও একটা ছোট্ট মিল হয়েছে। তখন আনায়া লুসিয়াস কাজের জন্য রাশিয়ার বাহিরে ছিল আর ফিরে এসে শোনে হঠাৎ রোজ কনভেন্টে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিয়ে ওখানে চলে গিয়েছে । আর এবারও সে রাশিয়ার বাহিরে যেতে না যেতেই রোজ আবারও কনভেন্টে?

আনায়ার গভীর চিন্তাভাবনার মাঝেই আচমকা লুসিয়া আনায়াকে প্রশ্ন করে,

“শুনলাম, তোমার বোনকে নাকি পেয়েছো? ওর কি অবস্থা এখন?

আনায়া লুসিয়ার এহেন প্রশ্নে খানিকটা অপ্রস্তুত হলো। পরবর্তীতে মূহুর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

” আ…ভালো!ভালোই আছে ও।ডাক্তার বলেছে চিন্তার কোনো কারণ নেই।”

“কেনীথ আর তোমার মাঝে এখন সব ঠিকঠাক তো?

“আপনার তো সবাটাই জানার কথা৷ আশাকরি সব খবরই পেয়েছেন!”

আনায়ার সুক্ষ্ম অভিব্যক্তিতে লুসিয়া খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল।

—“আমার মনে হয় তুমি আমায় অন্য কিছু বোঝাতে চাইছ।”

আনায়া খানিকটা রুক্ষ হেসে বলে,

“আপনি জ্ঞানী মানুষ, না বললেও সবটাই জানেন, সবটাই বোঝেন। সেই সাথে, আপনার লোকজনও তো যথেষ্ট রয়েছে। সময়মত সব খবরই তো পাবার কথা, আশাকরি তা পেয়েছেন!”

আনায়ার কথা শুনে লুসিয়া নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। তার এহেন নির্লিপ্ত ভাবভঙ্গিতে আনায়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বাঁকা হাসে। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পর আনায়া নিজেই বলতে লাগল,

“আপনার প্রাণ প্রিয় নাতীর সাথে আমার সম্পর্কটা কখনোই স্বাভাবিক ছিলনা, বাবুশকা। আর আশাকরি ভবিষ্যতেও কখনো স্বাভাবিক হবে না। কারণ এটা সম্ভব নয়, কিংবা আমি চাইনা এমন কিছু হোক।”

—“যদি এমনটাই হয়, তবে তুমি কেনো আমায় মিথ্যা বলে বিডিতে গেলে?”

—“মিথ্যে? কেমন মিথ্যে বাবুশকা?”

—“তুমি….”

লুসিয়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই আবায়া তীক্ষ্ণ হেসে বলতে লাগল,

“যে আপনি সাত বছর আমার দেখভাল করলেন। অথচ একবারও আমার বোনের খোঁজ দিতে পারলেন না, এতো বড় মাফিয়া হয়েও…এতোসব পাওয়ার থাকার পরও। আপনি কি ভেবেছিলেন, আমি বুঝিনি যে গেইমটা আপনিও খেলছিলেন!”

—“কি বলতে চাইছো!”

—“এটাই যে, আমাকে বাধ্য হয়েই আপনার সাথেই গেইম খেলতে হয়েছে। আমি জানতাম,আপনি কোনো না কোনোভাবে আমার বোনের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন।”

—“নাহ,আমি জানতাম না কিছু!”

—“মিথ্যে বলবেন না…”

—“আনায়া…!”

—“সরি বাবুশকা, কিন্তু আজ কিছু কঢ়া কথা না বললেই নয়। আপনি কিভাবে সোজাসাপ্টা মিথ্যে বলতে পারেন? যখন আপনি সবটা জানতেন!”

—“তোমার কাছে কোনো প্রমাণ রয়েছে? নাকি মনগড়া সব বলে যাচ্ছ?”

—“জ্বী অবশ্যই, এতোবছর পর এইসব কথা আমি নিশ্চিয় এমনি এমনি বলতে আসিনি।”

—“………….

—“আমার জীবনে আর যদি কেউ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থেকে থাকে তবে সে হলো আমার বোন। ওর জন্য আমি সবটা করতে পারি৷”

—“আর কেনীথ?”

আনায়া লুসিয়ার কথায় খানিকটা থমকে যায়। একটু আগেই যে নারীটি এতো কঠোর অভ্যিব্যক্তি প্রদর্শন করছিল, সে কিনা কেনীথের প্রসঙ্গে মূহুর্তেই এতোটা নরম হয়ে পড়ছে! আনায়া এই বিষয়টা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। কারণ সে যা জেনে এসেছে তা তো…। আনায়ার ভাবনার মাঝে লুসিয়া আবারও বলল,

“এখনো চুপ করে রয়েছ কেনো ?কেনীথ তোমার কেউ না?”

—“নাহ, কেউ না। সে আমার জীবনের ধ্বং”স, ব্যতীত কিছু নয়।”

আনায়ার নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিত্বে লুসিয়া যেন প্রচন্ড হতাশ হলো। আনায়া যেমন কিছু বলতে চেয়েও বলছে না,তেমনি লুসিয়াও। খানিকটা সময় অদ্ভুত চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এবং পরক্ষণেই ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“তবে কেনো ওর জীবনে ফিরে গেলে?”

—“আমি মোটেও ওনার জীবনে ফিরিনি৷”

—“আনায়া! তুমি কি আমার সাথে মজা করতে এসেছ? আমি কিন্তু তোমার কথাবার্তায় বিরক্ত হচ্ছি।”

—“বিরক্তির জন্য দুঃখীত,কিন্তু আপনার বিরক্তির কারণটাও আমার ঠিক জানা নেই, বাবুশকা!”

দু’জনের তীক্ষ্ণ কথার সুক্ষ্ম লড়াইয়ের পর দুজনেই চুও হয়ে যায়। খানিকটা সময় পর লুসিয়া আনায়ার দিকে কঢ়া চোখে তাকিয়ে থাকার পর বলে উঠল,

“তবে চিরতরে সরে যাচ্ছো না কেনো ওর জীবন থেকে? ওর প্রতি এতো আ”ক্রোশ, এতো রাগ, ক্ষোভ থাকার পরও কেনো ওর মুখোমুখি হতে হলো তোমায়? সাতটা বছর মৃত হিসেবে ওর থেকে দূরে থাকার পর, পুনরায় এমন কি প্রয়োজন হলো যে ওর কাছেই ফিরতে হয়েছে তোমাকে।”

—“এরজন্য হয়তো দায়ী আপনি।”

-লুসিয়া চোখ গরম করে তাকাতেই আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলতে লাগল,

“সবকিছুই স্বাভাবিকই থাকত, আমাকেও হয়তো তার মুখোমুখি হতে হতো না যদি আপনি আমাকে একটু সাহায্য করতেন৷ কিন্তু আপনি তা করেননি বরং আমার কাজেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে দিয়ে যা নয় তাই কাজ করিয়েছেন, আমিও নির্দ্বিধায় তা করেছি। জেনে হোক, না জেনে হোক, বহু পাপ আমিও করেছি। তাই এই নিয়ে আমার কোনো কথা বলার নেই।

কিন্তু আমি শুধু চেয়েছিলাম আমার বোনকে আপনি খুঁজে দিবেন। নয়তো আমিই খুঁজে নেবো, আপনি একটু সাহায্য করবেন। কিন্তু আপনি তা না করে আড়ালে আমার কাজেই বাঁধা হয়েছেন, সবজায়গায় আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছেন যেন আমি কিছুই করতে না পারি৷ কি ঠিক বললাম তো?”

–;”………..

—“চুপ করে থেকে লাভ নেই বাবুশকা। আপনি আমাকে সাহায্য না করেই সবচেয়ে বড় ভুল করেছেন। আমার বোনকে খুঁজে পেলে আমি চলে যেতাম।সবার থেকে দূরে সরে যেতাম। সারাজীবন মৃ’ত হয়েই থাকতাম, কেউ জানত না আমাদের কথা; কেনীথও না! কিন্তু আপনার সাথে খেলতে গিয়েই যে আমি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি রহস্যের সন্ধান পেয়েছি। হয়তো এমন কিছু যা আপনার জন্যই ক্ষ”তিকর।”

লুসিয়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে উঠল,

“তুমি আমার কিছুই করতে পারবে না, কিছুই না!”

—“আগেই বলছেন, আমি কিছু করতে পারব না।তা জানতে চাইবেন না, আমি কি পেয়েছি!”

—“জানিও না, জানতেও চাইনা। পারলে তুমি চলে যাও। যা ইচ্ছে তাই করো, কিন্তু আমাদের থেকে দূরে সরে যাও।”

আনায়া লুসিয়ার অস্থির হাভভাবে কপাল কুঁচকে ফেলল। লুসিয়ার আচরণ নিত্যন্তই অদ্ভুত ঠেকছে তার কাছে।

—“আপনি কি এমন কিছু বলতে চাইছেন যা আপনি বলতে পারছেন না? কেনো জানিনা আমার এমন… ”

আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই লুসিয়া ঠোঁট ভিজিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

“আমি আর কি বলব? বলার মতো আর কিছু আছে আমার? অন্তত তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, আনায়া! কিন্তু… তুই সেই বিশ্বাসও রাখোনি।”

—“…………

—-“আমার ভুল হয়েছে যে তোমার মতো একটা ইউজলেসকে আমি কেনীথের জন্য যোগ্য ভেবেছিলাম। খাল কেটে আনা… কুমির পেলেছি এতোদিন।”

লুসিয়ার তিক্ত কথায় আনায়ার চোখমুখ শক্ত হলেও সে স্বাভাবিক রইল। এবং খানিকটা রুক্ষ হেসেই বলতে লাগল,

“তবে আপনি কি ভেবেছিলেন, এতোকিছু হওয়ার পরও আমি আপনার ঐ অমানুষ নাতীর সাথে সংসার করব?তেমন কিছু করার উপায় রেখেছে সে? কতগুলো জীবন ধ্বং’স করেছে…তার জন্য আমাকে সবকিছু হারাতে হয়েছে।”

—“শুধু তুমিই হারিয়েছো? ও কিছু হারায়নি? ওর জীবনটা খুব সুন্দর, তাই না আনায়া?”

—“………….

—“কি হলো, কথা বলছ না কেনো? শুধু নিজেদের কষ্ট, দুঃখ,অভিযোগের হিসেব করে যাচ্ছ, কখনো ওর কথা ভেবেছো? ওই ছেলেটার কি আছে? কিচ্ছু নেই ওর। সবকিছু থেকেও,আজ ওর কিছুই নেই। বর্তমানে ওর সবটা হলে তুমি! আমরা ওর কেউ না। আর ক’দিনই বা থাকব আমরা?”

—“……………

—“বিশ্বাস করো, যদি আমি জানতাম তুমিও ছলনা করছো,তবে আমি কখনই তোমাকে দেশে পাঠাতাম না। তোমাকে ওর ধারেকাছেও যেতে দিলাম না। প্রয়োজনে তোমার মৃ’ত পরিচয়কে সত্যি সত্যি জীবন্ত করে তুলতাম। আমি নিজেই তোমাকে শেষ করতাম৷”

আনায়া চোয়াল শক্ত করে চুপচাপ লুসিয়ার দিকে তাকিয়ে। অন্যদিকে লুসিয়া একের পর এক হিসহিসিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। তার রাগ ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু কেনীথের প্রতি লুসিয়ার এতো টান, এতো চিন্তা আনায়াকে ভাবাচ্ছে। যদি লুসিয়া কেনীথের এতোই ভালো চায় তবে কেনো সে এতোদিন ধরে নানান সব চক্রান্ত সাজিয়েছে। নাকি সে যতটুকু জানতে পেরেছে তা শুধুই আংশিক। নাকি এর পেছনে আরো কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে!

—“আপনি আমাকে খারাপ ভেবে সব দোষ দিতেই পারেন। আমি কিছুই মনে করব না৷ কিন্তু একটা চরম সত্য হলো, আজ আমার এই খারাপ হওয়ার পেছনে কোনো না কোনভাবে আপনিও দায়ী।

আপনিই আমাকে এতোটা কঠোর হতে শিখিয়েছেন। নয়তো আমি তো কখনোই এমন চিলাম না। আর আমার প্রতি আপনার এতো আ”ক্রোশের অন্যতম কারণ যদি হয়… কেনো আমি আজ কেনীথের পাশে নেই। তবে এটাকে অসম্ভব আপনিই করেছেন। হ্যাঁ, এটা সম্ভব হতো,… আমি হয়তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার সংসার করে নিতাম। সব ভুলে বাকিটা জীবন তার হাতের পুতুল হয়ে থাকতাম। কিন্তু এমনটা তখনই হতো যদি আমি আগের আনায়া থাকতাম। তাকে আপনারা চাইলেই হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে পারতেন৷ কিন্তু এমনটা না করে, আপনিই আমাকে কঠোর বানিয়েছেন। আমার এই হাত দিয়ে শতশত দোষী কিংবা নির্দোষের জীবন নিয়েছেন। এখন তো চাইলেও আর আপনি আমায় ভাঙতে পারবেন না, বাবুশকা।”

—“বাহ! আসলেই, অসাধারণ কঠোর ব্যক্তিত্ব বানিয়েছো তুমি। সেই সাথে হয়েছ একটা নির্লজ্জ আর স্বার্থপর।”

আনায়া খানিকটা রুক্ষ হেসে বলল,”বাবুশকা!সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই তো স্বার্থপর। অবশ্য, আপনিও বা কম কিসে।”

—“খবরদার! নিজের সাথে আমার তুলনা করবে না। ঐ যোগ্যতা তোমার নেই৷”

—“হ্যাঁ,তা তো অবশ্যই। আমি তো অত্যন্ত কাঁচা খেলোয়াড়, নতুন নতুন শিখছি মাত্র। অবশ্য তা আপনার কল্যাণেই। আসল খেলোয়াড় তো আপনিই,তাই না?”

লুসিয়া কঢ়া চাহিনে তাকাতেই আনায়া রুক্ষ হেসে নিরেট স্বরে বলতে লাগল,

“মাফ করবেন, কিন্তু আমার মনে হয় না যে আমি কিছু ভুল বলেছি। আপনি যে শুধু গত সাতবছর আমার উপর নজর রেখেছেন তা নয়, বরং আমি বিডিতে যাওয়ার পরও সর্বত্রে আপনি আমার উপর নজরদারি করেছেন। তাই বাধ্য হয়েই আপনার গুনধর নাতীর সাথে আমার অভিনয় করতে হয়েছে। দেখাতে হয়েছে, আমি তাকে সম্পূর্ণ রূপে মেনে নিতে চেয়েছি। কেননা,আমি যা যা করব, তাই তো আপনি জানবেন।আর আমি এটাও বুঝেছিলাম যে,আপনি আমায় কখনোই বিডিতে যেতে দিবেন না যদি আমি কেনীথের সাথে পুনোরায় সম্পর্কটা স্বাভাবিক না করি। তাই আমাকে এখানেও মিথ্যে বলতে হয়েছে। কারণ সবকিছুর উর্ধ্বে আমার উদ্দেশ্য একটাই ছিল তা হলো আমার বোনকে খুঁজে বের করা।আর আমি খুব ভালো করেই জানতাম, একমাত্র দেশে যেতে পারলেই আমি আমার বোনের খোঁজ পাব। …সবকিছুই সময়মত পাভেল ভাই আপনাকে জানিয়েছে, তাই না?… আরো কেউ রয়েছে, নাকি শুধু উনিই!”

আনায়ার শেষ কথায় লুসিয়ার মুখ ফেকাসে হয়ে যায়। আনায়া তা দেখে মুচকি হেসে বলে,

“নিজেকে এতোটাও চালাক ভাববেন না। সবটাই জানতাম আমি৷ পাভেল ভাই কিন্তু এক আজব মানুষ। সে যে শুধু আপনার পক্ষ নিয়ে কাজ করেছে তা নয়, বরং কেনীথ সহ আমার… প্রত্যেকরই সাহায্য করেছে। আবার এটা ভাবতে যাবেন না,সেও আপনার সাথে বিশ্বা”সঘাতকতা করল। মোটেও না, সে কখনোই আমাকে পরোক্ষভাবে সাহায্য করেনি। করলে হয়তো আমায় এতোকিছু পেঁচিয়ে নিজের কাজ করতে হতো না।

তবে এটুকু শিওর ছিলাম, শুরু থেকেই ঘটতে থাকা ছোট বড় সব কিছুই আপনি জানতেন, তার মাধ্যমে। আর সর্বপ্রথম সন্দেহটা জাগে কিছুমাস পূর্বেই, যখন পাভেল ভাই রাশিয়াতে আসে এবং বিডিতে কি হচ্ছে না হচ্ছে, কেনীথ কি করছে না করছে সবকিছু আপনাকে জানায়৷ ওদিকে পাভেল ভাই আমাকেও এখানে নানান ইনফরমেশন দিয়ে যেত। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম , কাহিনি কি ঘটছে।
তবে একটা জিনিস কি জানেন, আমি এখনও বুঝতে পারিনি আপনার মূল উদ্দেশ্য কি। আমার এতোদিনের সন্ধানে যতটুকু জেনেছি তা মোটেও আপনার খেলা বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়।”

লুসিয়া খানিকটা সময় আনায়ার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকার পর স্তব্ধ স্বরে বলে উঠল,

“কি জেনেছো তুমি?”

—“অনেক কিছুই। তবে আগে এটুকু বলুন যে পাভেল ভাইকে আপনি কোথায় পেয়েছিলেন?”

—“………….

—“না, আমি জানি সে কেনীথের ছোটবেলার সঙ্গী। বপনি কেনীথের জন্যই তাকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, তার বাবা মা… পরিবার বলতে কেউ নেই?”

—“পাভেলের বাবা আমার বিশস্ত সার্ভেন্ট ছিল। এবং ওর বাবার মৃ”ত্যুর পর, আমি ওকে আমার কাছেই রাখার সিন্ধান্ত নেই।”

—“ওহ আচ্ছা, কিন্তু আমি তো জেনেছি আপনি তার বাবা মা সহ পুরো পরিবারকে শেষ করেছেন। হয়তো সেটা নিজের কর্মের স্বার্থেই কিংবা অন্যকিছু। তা এসব কি পাভেল ভাই জানে?”

—“কি যা তা বলছো, আমি কেনো ওর পরিবারকে…”

—“প্লিজ উত্তেজিত হবেন না, মূল আলোচনা তো কেবল শুরু। আপনার কাছ থেকে, আমার অনেক কিছু জানার রয়েছে। অনেক প্রশ্নের উত্তর চাই আমার।”

আনায়ার স্পষ্ট অভিব্যক্তিতে লুসিয়া ফেকাসে চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ঠোঁট গুলো বারবার কেঁপে উঠছে, যে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা।এরই মাঝে আনায়া শীতল কন্ঠে বলতে শুরু করে,

“কেনীথের নানু কিংবা আপনার স্বামী আর্তেমের মৃ”ত্যুটা কি শুধুই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা ছিল, নাকি এর পেছনেও ভিন্ন কোনো কারণ রয়েছে,বাবুশকা! এছাড়া আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ‘দ্য গ্রেভ মেকার’ খ্যাত আন্ডারগ্রাউন্ডের সবচেয়ে বড় মাফিয়া আর্তেম দিমিত্রি কিভাবে তার এতোবড় সাম্রাজ্যের সবকিছু তার স্ত্রী…যে কিনা নিজেও একজন বড়সড় মাফিয়া হওয়া সত্বেও… তাকে কিছুই না দিয়ে সম্পূর্ণ সম্পত্তি তার একমাত্র নাতী কেনীথকে দিয়ে যায়?

আমি এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই বাবুশকা। এমন কি কারণ রয়েছে, যার জন্য তিনি তার পুরো রাজত্বেরের সমস্ত পাওয়ার, প্রোপার্টিস… এভরিথিং কেনীথের নামে দিয়ে গিয়েছেন। সেটাও কিনা পস্টহিউমাস ট্রান্সফার অব ওউনারশিপ এগ্রিমেন্টে।
যা উনি মা”রা যাবার অনেক বছর আগেই করেছেন, যখন কেনীথ নিজেও অনেক ছোট।তবে কেনীথ এখনও সেসবের ওউনার নয়। কেননা তিনি তার এগ্রিমেন্টে নিদিষ্ট করে সময়টাও উল্লেখ করে গিয়েছেন। আর্তেম দিমিত্রির সত্তর বছর অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক আরো পাঁচ বছর পর কেনীথের জন্মদিনেই কেনীথ এসবকিছুর মালিক হবে।

আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো,কেনীথ এসবের ওউনার হওয়ার পরও, যদি অন্যকাউকে নিজ হাতে এইসবকিছু হস্তান্তর না করে, তবে কারো সাধ্য নেই তার আগে বা পরে এই বিশাল সাম্রাজ্যর অধিকারী হবার। এবং এই পাঁচ বছরের মধ্যে যদি কোনো ভাবে কেনীথের কিছু হয় কিংবা সে যদি মা’রা যায়, তবে তার সাথে সাথে আর্তেম খ্যাত পুরো মাফিয়া সাম্রাজ্য ধ্বং”স হয়ে যাবে।

এখন নিশ্চয় আপনি এটা বলবেন না যে, এসবের কিছুই আপনি জানেন না।”

—“হ্যাঁ,সবটাই জানি আমি। কিন্তু তুমি এসব বলে কি বোঝাতে চাচ্ছো ?”

আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে বলল,”অনেক কিছুই তো বললাম, আর কি বলা বা বোঝানো যায়, বলুন তো?”

—“……………

—“বাবুশকা! আমার মনে হয় আমার সন্দেহটা ভুল নয়। কেনীথ কিন্তু এসবের কিছুই জানত না এতোদিন। আর এই পুরো বিষয়টা সিক্রেট থাকার কথা ছিল। অথচ দেখুন আপনি কিংবা আমি দুজনেই এটা জানি । এর মানে এটা আর সিক্রেট নেই। কাহিনিতে কিন্তু অনেক গড়মিল রয়েছে। আমার ছোট্ট মাথায় ঢুকছে না, একটু বুঝিয়ে বলবেন প্লিজ?”

—“আমি তোমার সাথে আপতত আর কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। যাও গিয়ে রুমে রেস্ট করো।”

–“না না, এটা বললে তো হয় না। হাতে যে সময় কম। আমাকে জানতে হবে, ভোর হবার পূর্বেই সবটা জানতে হবে।

আচ্ছা, কেনীথের প্রতি আপনার এতো সচেতনতা, এতো চিন্তা, ভালোবাসা… এসবের একমাত্র কারণ আবার এটা নয়তো…আপনি এইসব প্রোপার্টি, পাওয়ার নিজের করতে চান। এছাড়া তো আর কোনো…”

—“আনায়া….! হাউ ডেয়ার ইউ…কোন সাহসে তুমি এসব…”

লুসিয়াস দাঁত খিঁচে বলা ক্ষি’প্ত কথাগুলো সম্পূর্ণ হবার আগেই আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“সন্দেহ জিনিসটা ভালো না হলেও, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিষয়টা মন্দও নয়। যাই হোক, আপনি যে সে মানুষ তো আর নন। হিসেব নিকেশ করেই তো আপনাদের জীবন। এমনও তো হতে পারে, আপনি আমাকে আর কেনীথকে এক করে… দুজনকেই নিজের হাতের পুতুল বানিয়ে ক্ষমতা আত্মসাৎ করতে চান।”

—“আনায়া লিমিট ক্রস করো না! একটু আগে তুমিই না বললে,তুমি তোমার বোনকে পেলে সবকিছু ছেড়ে দূরে চলে যাবে। তবে এখনও এখানে কি করছো? এখন তো তোমার রাস্তা খোলা, চলে যাবার হলে চলে যাও।”

—“জ্বী, অবশ্যই! আমি যাবো, খুব শীঘ্রই সব ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু তার আগে আমার কিছু কাজ না করলেই যে নয়। আমার বোনকে আমি স্বাভাবিক ভাবে পাইনি, ও নিজেই একটা সাইকোপ্যাথ হয়ে গিয়েছে। কিভাবে হয়েছে, কেনো হয়েছে, এর পেছনে আদোও কে কে রয়েছে, এছাড়া নবজাতক বাচ্চাদের নিয়ে অনৈতিক, নৃ”শংস কাজ করা এস.পি.হান্স কোম্পানি মূলত কার হয়ে কাজ করে সবটাই জানতে চাই আমি।”

রাতের এই নির্জন পরিস্থিতি আর বারান্দা থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাস যেন এক রুদ্ধশ্বাস আবহ তৈরি করেছে। ঘরের পর্দাগুলো ঢেউ খেলে দুলে উঠছে। আর এমনই পরিস্থিতিতে আচমকা এক শব্দে দু’জনের কথোপকথনের মনযোগে ব্যঘাত ঘটায়। আনায়া কপাল কুঁচকে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আওয়াজটা কোথায় থেকে এলো। সেই সাথে আকস্মিক দাড়িয়ে গিয়ে লুসিয়াস উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“আমরা ব্যতীত এখানে কি আরো কেউ… ”

আনায়ার কথা সম্পূর্ণ হলো না।হঠাৎ দরজার ঠক্ ঠক্ আওয়াজে তাদের নজর সরে যায় দরজার কাছে। কিন্তু আনায়ার মনে হলো আওয়াজ এসেছে বারান্দা থেকে। কিছু একটা নড়াচড়া কিংবা পড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল। তবে মনোযোগ দরজার দিকে চলে যাওয়ায়, সে ঘটনা স্বাভাবিক মনে হলো। হয়তো বা বাতাসের কারণেই বারান্দায় কিছু পড়ে গিয়ে শব্দ হয়েছে। তবে কেনো যেন মনের মাঝে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে।

এরই মাঝে বাবুশকা বলে উঠল,

“কে?”

বাহির থেকে কোনো প্রতিত্তোরে এলো না। আনায়া যেহেতু দাঁড়িয়েই ছিল তাই সে এগিয়ে দরজার কাছে যায়। কপালের ভাজগুলো এখনো দৃশ্যমান। আনায়া কোনোরকমের দ্বিধা না করে ত্বরিত দরজাটা খুলতেই, তার সামনে দৃশ্যমান হওয়া ব্যক্তিকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। নিমিষেই চেহেরাটা ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। যেন এই সময় মোটেও , এই ব্যক্ত্বিকে প্রত্যশা করেনি সে।

চলবে……….

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব—৩৮(৪র্থ অংশ)

🔺[সম্পূর্ণ কাল্পনিক গল্প, বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি মেলানোর চেষ্টা করে নিজের মাথা পঁ”চাবেন না ]

আনায়া দরজা খুলতেই দেখে কেনীথ দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। আনায়াকে দেখামাত্রই সে নিজেও খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলল। আনায়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আনায়া দরজা থেকে সরে আসে। ওদিক থেকে লুসিয়া খানিকটা মুচকি হেসে বলল,

“ভেতরে এসো! বাহিরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”

কেনীথ আনায়াকে আর কিছু না বলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে আনায়া কি যেন ভেবে আকস্মিক রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। যা দেখামাত্রই কেনীথ এবং লুসিয়া সেদিকেই নজর ফিরিয়ে তাকায়। আনায়ার ভাবগতিক তার কাছে স্পষ্ট নয়। কেনীথ লুসিয়ার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,

“তোমরা কি কোনো প্রযোজনীয় বিষয়ে কথা বলছিলে?”

—“না,তেমন কিছুই…”

—“জ্বী,একটু বেশিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে…”

দু’জনে একসাথে বলে ওঠায়, দুজনেই পরবর্তীতে থেমে যায়। এদিকে দু’জনের কাজকর্মে খানিকটা কপাল কুঁচকে বলল,

“কোনো সমস্যা?”

এবার লুসিয়া কিছুই বলল না। তাই আনায়া বলতে লাগল,

“সমস্যা নয়,তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলছিলাম আমরা।”

—“ও আচ্ছা, তবে আমি না হয়…”

—“এসেছেন যখন তবে থাকুন, একসাথে আলোচনায় বসা যাবে।”

—“কিসের আলোচনা?”

কেনীথ অনেকটা কপাল কুঁচকে কথাটা বলতেই আবায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“বাবুশকার গেইম প্ল্যান…”

_______________

জার্মানির বার্লিন থেকে প্রায় তেতাল্লিশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ব্র্যান্ডেনবুর্গে অবস্থিত পরিত্যক্ত একটি স্যানাটোরিয়াম—বেলিট্স-হেইলস্ট্যাটেন। ১৯৩০-এর দশকে যেখানে যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা হতো।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তা রূপ নেয় নাৎ’সি মেডিকেল এক্সপেরিমেন্টের আঁতুড়ঘরে।আর যু’দ্ধের পর, সোভিয়েত বাহিনী এটিকে সামরিক হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করে। আর এখন তা সরকারি রেকর্ডে ‘ডিকমিশনড”—কার্যত পরিত্যক্ত। কিন্তু সত্যিটা আরও গা ছমছমে।

এই ভগ্নপ্রায় ভবনের নিচেই গড়ে উঠেছে একটি গোপন গবেষণাগার। নাম—”S.P. Hans Biotech & Aesthetics”। বহির্বিশ্বে এটি বিলিয়ন ডলারের স্কিনকেয়ার ও এন্টি-এজিং প্রডাক্ট তৈরির প্রতিষ্ঠান। সেলিব্রিটিরা ব্যবহার করে যেসব ক্রিম বা ইনজেকশন, তার গোপন উপাদানই হলো Neuroderm X—এক ধরনের নিউরোট্রফিন সমৃদ্ধ সিরাম।

Neuroderm X এমন একটি উপাদান যা কোষের বার্ধক্য থামিয়ে দেয়। চোখের নিচের কালি গায়েব করে। ত্বক করে শিশুর মতো কোমল। কিন্তু এর প্রধান উপাদান আসে মানব ভ্রূণের নিউরাল টিস্যু থেকে। বিশেষত সেইসব অংশ, যেখানে আবেগ, অনুভূতি এবং মানসিক প্রতিক্রিয়া গঠিত হয়।

আর এসব সংগ্রহ করা হয় লুকিয়ে থাকা ক্লিনিক থেকে। সবচেয়ে বেশি টার্গেট হয়,সোমালিয়া, ইউ”ক্রেন,সিরিয়া,বাংলাদেশ,ইয়েমেন সহ আর বিভিন্ন দেশ। যেখানে তাদের কাজ করা ব্রাঞ্চগুলোর রয়েছে তারাই মূলত এই বাচ্চা সংগ্রহের কাজ করে থাকে। আশেপাশের এলাকা বা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসব শিশুর স্নায়বিক তরল সংগ্রহ করে সিরাম প্রস্তুত করে S.P. Hans। আন্তর্জাতিকভাবে এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ইউরোপের উচ্চ বিত্ত সমাজের গোপন রুটে এটি পৌঁছায় হাই-ফ্যাশন জগতের সেলেব্রিটিদের হাতে।

কালো পাথরে মোড়া রাস্তা, ভাঙাচোরা দালান চারপাশে ছড়িয়ে আছে এই শহরে। যার শীতল বাতাস যেন, শতাব্দীর পুরোনো কোনো কবরস্থানের…ধীরে ধীরে শহরের গায়ে মিশে গিয়েছে। এই শহর সাধারণ পর্যটকের চোখে নিস্তেজ। অথচ নিভৃতে এখানে গড়ে উঠেছে এস.পি.হান্স নামের একটি কসমেটিক ও বায়োটেকনোলজি কোম্পানি। যার নাম শুনলেই বিশ্ব জুড়ে হাই-ফ্যাশন আর স্কিনকেয়ারের ভ্রান্ত ছবি চোখে ভাসে।

শহরের চূড়ায় ঝুঁকে থাকা গির্জার চূড়াও যেন ঈশ্বরকেও অনুনয় জানায়,এ শহরের পাপ যেন মাফ না হয়।এ শহর শিশুদের বাঁচার অধিকার দেয় না।কেননা তারা উৎপাদিত হয়—গবেষণার জন্য, পরীক্ষার জন্য, প্রসাধনীর জন্য।

একসময় যেখানে যু’দ্ধবিধ্বস্ত মানুষের চিকিৎসা হতো, আজ সেখানে চিকিৎসা হয় নিষ্ঠুরতার। সরকারি নথিতে এলাকাটি ডিকমিশনড। অথচ মাঝরাত পেরোলেই ঘুমন্ত শহরের নিচে সক্রিয় হয় নানান যন্ত্র। জ্বলে ওঠে নীল আলো,বায়োমেট্রিক স্ক্যানিংয়ের অদ্ভুত সব আওয়াজ। কেউ জানে না ঠিক কোথা থেকে শুরু হয় এই নরক সাম্রাজ্যের চক্র। আবার কোথায় গিয়ে শেষ হয় মানব মস্তিষ্ক থেকে নিষ্কাশিত ‘NeuraSerum’ নামের সেই রহস্যময় তরল। যা এখন ইউরোপের বিলিয়ন ডলারের বিউটি ইন্ডাস্ট্রির শ্রেষ্ঠতম গোপন উপাদান।

রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ঠিক ভোর ৪:২৭ এআকাশে উঠে আসে এক বিশেষ ম্যাট ব্ল্যাক কালারে হেলিকপ্টার। যা দূরের অন্ধকার আকাশে যেন ছায়া হয়ে মিশে গিয়েছে। আনায়ারা খুব বেশি একটা সময় নেয়নি। রাশিয়াতে ভোর হবার পূর্বেই তারা তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।যেহেতু রাশিয়ার চেয়ে সময়ের গতিতে জার্মানি পিছিয়ে তাই তারা পৌছাতে পৌছাতে এখানেও এখনো ভোর হয়ে ওঠেনি।

হেলিকপ্টারে পাইলট ব্যতীত আরো তিনজন ব্যক্তি প্রচন্ড সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। কেনীথের ডান হাতে গাঁথা রয়েছে বিশেষ ধরনের একটি ইলেক্ট্রনিক ব্লে’ড। যা পেশির চাপে বেরিয়ে আসে শব্দহীনভাবে। আর কোমরের পিছনে রয়েছে এক বিশেষ ধরনের কম্প্রেসড সাইলেন্ট-গান।যার শব্দ না থাকলেও ব্যক্তির মৃ’ত্যু চিৎকার নিশ্চিত করে তোলার ক্ষমতা যথেষ্ট ।

অন্যদিকে আনায়া আর পাভেলও নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে তৈরি৷ বিশালাকার সিলিকন প্যাডে হ্যাকিংয়ের সফটওয়্যার নিয়ে, সকল সিকিউরিটি ট্র্যাকিং নিয়ে আগাম প্রস্তুতি চলছে তাদের।যেন সেখানে পৌঁছেই গোপনে ইউনিভার্সাল কোডগুলো সহজেই এক্সট্রাক্ট করতে পারে।
আনায়া যে একসাথে এতোকিছু প্ল্যান আর ব্যবস্তা করে রেখেছে তা কেনীথ বা পাভেল কেউই টের পায়নি।শেষ মূহুর্তে আনায়া যখন দুজনকে ডেকে তার পরিকল্পনা জানায় তখন দুজনেই খানিকটা বিস্মিত হয়। বিশেষ করে এস.পি.হান্স কোম্পানি সম্পর্কে আনায়ার পাওয়া বিস্তারিত তথ্য জানার পর।

ভোর হতে না হতেই নিজেদের প্রাইভেট হেলিকপ্টারে করে, রাতের গভীর অন্ধকারে পৌঁছায় তারা। শহরের আকাশ থেকে নিচে তাকালে বোঝাই যায়, এখানে কিছু একটা অস্বাভাবিক। খালি রাস্তা, অদ্ভুত সব ধূসর আলো, রাস্তায় থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে কেবল একটা একটা করে ঝুলে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা। আর ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মুখোশধারী সব নির্লিপ্ত মানুষজন।

লিকপ্টার নামে শহর থেকে কিছুটা দূরে, এক পরিত্যক্ত রেল টানেলের ধারে।যা এখন ল্যান্ডমাইন দিয়ে ঘেরা এবং সরকারি নথিতে নিষিদ্ধ অঞ্চল।চারপাশে জমে থাকা শৈত্য আর কুয়াশা যেন গিলে খাচ্ছে আবহকে।

তারা তিনজন নেমে পড়ে…কাঁধে কালো রাঙা ব্যাগ।তার ভেতরে মডিফায়েড ড্রোন, ইলেকট্রনিক হ্যাকিং ট্যাব সহ আইডেন্টিটি স্কিন-গ্লাভস। যা তাদের আঙুলের ছাপ বদলে দেওয়ার কাজে লাগবে।তাদের গন্তব্য—S.P. Hans-এর আন্ডারগ্রাউন্ড ল্যাব। যা একটি বায়োমেট্রিক-সিকিওর্ড ট্রান্সপোর্ট টানেল দিয়ে সংযুক্ত।

কেনীথ হালকা শীতল কণ্ঠে বলল,

“এটাই সেই রাস্তা। এখান দিয়ে ভ্যানগুলো আসে বাচ্চা আর রসদ আনতে। এবার না হয় আমরা ওদের রসদ হব।”

তারা তিনজন মাটির নিচের সিক্রেট গেট খুলে ঢুকে পড়ে। এসবের খোঁজ তাদের লোক লাগিয়ে পূর্বেই জেনে রেখেছে। সবাই এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে দেখে। চারপাশে সাইলেন্ট অ্যালার্ম আর ইনফ্রারেড সেন্সর।
আনায়া তার ট্যাব খুলে এক মিনিটের জন্য সিস্টেম বা ইনফ্রারেড ভিশনকে জ্যাম করে ফেলে। এসব কাজ মোটামুটি আয়ত্ত করা হয়েছে তার। বাকিটা পাভেল সামলে নেয়, কারণ পাভেল আগে থেকেই এসবে এক্সপার্ট।

তারা খুবে বেশি একটা সময় নেয় না।এই সময়ের মাঝেই তারা দ্রুত নেমে পড়ল ভূগর্ভস্থ ঢালু করিডোরে।যা এক সময় ট্রেন যাতায়াতের পথ ছিল।এখন সেখানে গড়ানো হয়ে শি”শুদের মাংসপিণ্ড ফেলার আস্তানা হিসেবে। যেসব শিশু সময়ের অন্ধকারে, মায়ের স্নেহের আদলে না থেকে হারিয়ে গিয়েছিল, আজ তারাই হয়েছে উৎপাদন পণ্য।

এরপর সেই অন্ধকার পথ ধরে সামনে এগিয়ে যায় তারা। আলোর জন্য, হাতে থাকা সামান্য টর্চ লাইট ব্যতীত আর কিছুই নেই। আর খুব তাড়াতাড়িই তিনজনে নিঃশব্দে চলে যায় ল্যাব-সার্ভিস এলিভেটরের দিকে।

কিন্তু এস.পি.হান্সের এই শহরে অবস্থিত শাখাটি যেন এক অন্ধকার ন”রক। এখানে, নবজাতক শিশুদের নিয়ে দিনের পর দিন চলেছে ভ”য়ংকর সব গবেষণা।নতুন ওষুধ ও সৌন্দর্য পণ্য তৈরির নাম করতে, তাদের দেহকে পরিণত করা হয়েছে জৈবপ্রযুক্তির পুতুলে। চামড়া প্রতিস্থাপন, ত্বক সংরক্ষণ, চোখের কর্নিয়ায় রাসায়নিক পরীক্ষার পর চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া, মস্তিষ্কে ইলেকট্রোড প্রবেশ করিয়ে মানসিক সাড়া বিশ্লেষণ, হাড় গলিয়ে তৈরি হওয়া স্নেহমিশ্রণ…এসব কিছুই হচ্ছে ল্যাবরেটরির নিচের গোপন ফ্লোরে। এর গন্ধ, শব্দ, কিংবা কর্কশ কান্না সাধারণ কারো কানে পৌঁছায় না। কারণ শহরের আশেপাশের আবাসিক ভবনগুলোতে বসবাস করে শুধুই নিঃশব্দতা।

আর আনায়ারা ভেতরে প্রবেশ করে স্পা’ই হিসেবে। সে নিজের ছদ্মপরিচয় ঠিক করে—একজন বায়োকেমিস্ট। যার কাজ হবে কোম্পানির নতুন প্রকল্পে কাজ করা। কেনীথ হয় লজিস্টিক হেড, যে কিনা আগের নিরাপত্তা ইনচার্জের জায়গায় এসেছে। আর পাভেল রয়ে গেল বাহিরে। তার কাজ দূর থেকে বাকিসব কন্ট্রোল করা।

আনায়ার প্রস্তুতি মূলত এখানে সবচেয়ে বেশি আর গোছানো ছিল। তারা মেইন স্পর্টে যাবার পূর্বেই নিজেদের জন্য গুছিয়ে আনা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুলো পড়ে নেয়। অতিরঞ্জিত কিছু নয়, যতটুকু ছদ্মবেশ ধারণের জন্য না হলেই নয়, ঠিক ততটুকুই। সাদা এপ্রন, চোখে গগলস্, মুখে মাস্ক… এছাড়া প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ভুয়া বায়োডাটা, জার্মান ভাষায় মডিফায়েড অ্যাকসেন্ট…, সব সাজিয়ে সোজা দুজন চলে যায় ভবনের ভেতরে। নিজেদের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করতে।

এছাড়া তাদের আইডেন্টিটি স্কিন গ্লাভসে ছিল দুই মৃ’ত টেকনিশিয়ানের আঙুলের ছাপ ও পেশি-তাপ।যার ফলে তাদের ভেতরে যেতে আর কোনো অসুবিধা রইল না।

তারা দুজন শুরুতে পৌঁছায় লিফট শ্যাফটের সামনে। যা উপরে ওঠে না, বরং নিচে নামবে। প্রতিটি লেভেলে আলাদা প্রহরা, আলাদা সাউন্ড-সেন্সর। লেভেল ৩, “Project RED.FIRE”—শিশু ক্লোনদের নিউরাল রেজিস্ট্রি-তে রাগের জিন কৃত্রিমভাবে সক্রিয় করা হয়। লেভেল ৫-এ ‘ইমোশন কাট সেল’,যেখানে শিশুর মুখে বিশেষ ন্যানো-সা’র্জারি করে ইমোশন গ্ল্যান্ড বাদ দেওয়া হয়। লেভেল ৯-এ হলো ‘স্কিন ফ্লেইম ট্রায়াল’, যেখানে একটা শিশুকে পঁচিশ রকম কেমিক্যাল দিয়ে বানান পরীক্ষা করা হয়। আর লেভেল ১৪ হলো চূড়ান্ত— আর্কাইভ ও লাইভ ট্রায়াল সেন্টার। যেখানে সফল ও ব্যর্থ ক্লোনদের পরিণতি দেওয়া হয়। যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে মৃ”ত্যু। নয়তো জ্যান্ত কিংবা মৃত ক্লোন কাঁচের কন্টেইনারে সংরক্ষণ করা হয় মিউজিয়ামে মতো। এভাবে সবমিলিয়ে প্রতিটা সেক্টরে নানান কার্যক্রম হয়ে থাকে। সেই সাথে এটাও বোঝা যায় যে এস.পি.হান্স কোম্পানি শুধু কসমেটিক আর মেডিসিন এর উপরই কাজ করে না বরং এরা বাচ্চাদের উপর বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টও চালিয়ে থাকে…বিশ্ববিখ্যাত সকল বি”কৃত মস্তিষ্কের সাইন্টিস্টদের দিয়ে।

কেনীথ আনায়া ভিতরে ঢুকতেই, তাদের চোখ আটকে যায় কাঁচের ল্যাবে। একটি নবজাতক শিশু, চোখ দুটি ফাঁকা, মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মুখে সিরাম লাগানো হয়েছে। আর তার স্নায়ু ধীরেধীরে বেরিয়ে আসছে গলার কাছ থেকে। আশেপাশে সাদা অ্যাপ্রনে থাকা গবেষকেরা হাসছে, কেউ কেউ চিপস খাচ্ছে। অন্যদিকে একটা বাচ্চাকে রাখা হয়েছে টেবিলের মাঝ বরাবর। বাচ্চার দেহের মাঝে অদ্ভুত সব ইলেকট্রোড লাগিয়ে কয়েকজন সাদা এপ্রন পড়া সাইন্টিস্ট একসাথে গোল হয়ে, কিসব যেন খাতায় নোট করে ব্যস্ত।

এসব দেখে আনায়ার হুঁশ উড়ে গেল। কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল,

” এগুলো মানুষ না, জা”নো’য়ার!”

এস.পি.হান্স ভবনের ভিতরটা আধুনিক অথচ শীতল। খুব বেশি আলো নেই। যা আছে তা নীলাভ—যেন সব কিছুতেই এক রোবোটিক শ্বাস-প্রশ্বাস। দেওয়ালজুড়ে ভার্চুয়াল স্ক্রিন। সিলিং থেকে ঝুলে থাকা অটোমেটিক ড্রোন-গার্ড, মেঝের নিচে ইনফ্রারেড সেন্সর। আর প্রবেশদ্বারে ফিঙ্গারপ্রিন্টের সঙ্গে আইরিস স্ক্যানার। যাতে চোখের রেটিনার জটিল নকশা মিলে না গেলেই লেজার লাইটের দরূন নিমিষেই দেহ ছারখার হয়ে যাবে।

আর ল্যাবের ভেতরের মানুষগুলো যেন মানুষ নয়।সবই যেন একেকটা অমা”নুষ। পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত শিশুদের থেকে আহরিত কোষ দিয়ে তৈরি হয়েছে বায়ো-স্লেভ। যারা চুপচাপ ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছে। যাদের মুখে নেই কোনো অভিব্যক্তি, চোখে নেই কোনো সত্তা। এরাই স্যাম্পল আনে, ট্রে নেয়, পরিষ্কার করে। আবার কাজ শেষে সরিয়ে নেয় ডাস্টবিনে পড়ে থাকা আধ-মৃ’ত শিশুদের দেহ।

কেনীথ যে ঘরে প্রবেশ করে, সেটি ‘সেক্টর বি-9’। এখানেই রাখা হয় শিশুদের। হিমঘরের মতো এক এলাকা। যেখানে শিশুদের রাখা হয় কাচের কনটেইনারে। কিছু ঘুমন্ত, কিছু কাঁদছে, কিছু আবার একদম নিঃপ্রাণ। প্রতিটি শিশুর গলায় সেন্সর লাগানো। হৃদস্পন্দনের ওঠানামা বিশ্লেষণ হচ্ছে কম্পিউটারের মনিটরে।

আরেকটি কক্ষ—”নিউরোসার্জিকাল টেস্ট সেক্টর”। এখানে শিশুদের মাথায় বসানো হয় অত্যাধুনিক নিউরো-ম্যাপিং হেলমেট কিংবা প্যাড। যার মাধ্যমে তাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে এই কোম্পানির গবেষকরা। পরবর্তীতে তৈরি করে এমন কসমেটিক দ্রব্য, যা মস্তিষ্কে আরাম বা নেশা সৃষ্টি করে। অথচ পণ্যের বিজ্ঞাপন কিংবা ডেসক্রিপশনে বলা হয়—“দিস প্রোডাক্ট ফিলস্ লাইক লাভ”। সবকিছুই যেন সুস্থ মস্তিষ্কেদের তৈরি অমানবিক সকল কার্যক্রম।

আনায়া আর কেনীথ এসব দেখে রীতিমতো স্তব্ধ। কেনীথের এসব সেক্টর নিয়ে তেমন একটা ধারনা নেই। তবে কাজের সূত্রে সে জানত যে, পৃথিবীতে এমন এমন কিছু জায়গা রয়েছে, যেখানে এই ধরনের কাজক্রম গুলো হয়েই থাকে। তাই তার কাছে বিষয়টা একদম নতুন কিংবা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আনায়া যেন এসব কোনোমতে মানতেই পারছে না। চোখের সামনে এইসব কিছু তার অবিশ্বাস্য ঠেকছে। কিভাবে পারে মানুষ এসব করতে? তাও কিনা সদ্য পৃথিবীতে আসা নবজাতকদের সাথে। ওরা তো পৃথিবীতে সৌন্দর্য বোঝার পূর্বেই জেনে গেল, এই পৃথিবী শুধু পিশাচদের।এখানে ভালোদের বেঁচে থাকা, আর ম’রে যাওয়া দুটোই সমান। আর সবচেয়ে কষ্টের বিষয়, এতোবড় জ”ঘন্য পাপের অন্যতম ভাগীদার তার নিজেরই বোন।

গা ছমছমে পরিবেশে দুজনে দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেদের কাজে লেগে পড়ে। আনায়া ও কেনীথ ধীরে ধীরে সবকিছুর ফাইল করে পাভেলের কাছে পাঠাতে থাকে। তারা ছবি তোলে, রেকর্ড করে, তবে সবকিছুই হয় গোপনে এবং অত্যধিক কৌশল, সাবধানতার মাঝে। কারণ একবার ধরা পড়লে সোজা “ইনভিজিবল সেক্টর” এ ফেঁসে যাবে। যেখানে প্রবেশের পরে কেউ ফিরে আসে না। কেউ জানে না ভেতরে কি হয়। শুধু একটা কালো কাচের দেয়াল আছে।যেটার পেছন থেকে মাঝে মাঝে কেবল কিছু শব্দ আসে। কান্না, আর ধাতব চাবু’কের ন্যায় কিছু একটার স্ল্যাশিং সাউন্ড।

তারা দুজন ঠিক করে, রাতে ভেতরে ঢুকবে ডেটা সার্ভার রুমে। ওখানে রয়েছে এস.পি.হান্সের সব প্রজেক্টের তথ্য।কোথা থেকে বাচ্চা আনা হয়, কে কয়টা ম”রে, কোন প্রোডাক্টে কোন কোষ ব্যবহার হয়…সব!

কিন্তু কেনীথ সব তথ্য নিয়ে জানায় যে, সেখানে প্রবেশ করতে হলে লাগবে বায়োমেট্রিক অ্যাকসেস। যা আছে কোম্পানির “প্রিন্সিপাল সায়েন্টিস্ট” ফ্রাঙ্ক ডেলারোর কাছে। আনায়া আর কেনীথ বহু খুঁজতে খুঁজতে তার সন্ধান পায়। তবে সরাসরি তাকে নয় বরং তার চেম্বার খুজে পায়৷ যেখানে স্পষ্ট করে তার নাম লেখা রয়েছে। আনায়া এক মূহুর্তও দেরি না করে তার ভেতরে পৌঁছে যায়। কেনীথ তখন অন্যকাজে ব্যস্ত।

আনায়া জায়গাটার ভেতরে প্রবেশ করে দেখে, এটা যেন সবচেয়ে ভয়া”নক এক জায়গা। হিসেব ছাড়া শিশু বাচ্চাদের কাঁচের কন্টেইনারে কেমিক্যালের মাঝে ডুবানো রয়েছে। এসব দেখে আনায়া সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ। না চাইতেও বারবার শ্বাস আঁটকে আসছে। গ্লাসের ডেস্কের উপর শিশু বাচ্চা ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ না”ড়ীভুঁড়ি… কিসব দেখে সম্পূর্ণ গা গুলিয়ে আসছে।

আনায়া এসব রেখে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। বেশি সময় নেই হাতে, সে দ্রুত আশপাশে খুঁজে অ্যাক্সেস পাসওয়ার্ড খুঁজতে লাগে। কিন্তু তেমন কিছু না পেলেও একটা ছোট কফির মগ পায়৷ আর হঠাৎ কি যেন ভেবে আনায়া সেটা নিজের সাথে নিয়ে নেয়। সাবধানে নেয় যেন তাতে লেগে থাকা ফিঙ্গার প্রিন্ট নষ্ট না হয়। এবং সেই সাথে ডেস্কের কাঁচের দেওয়ার কিছু ফাইলের পাশে ফটোডিটেক্টর চিপ লাগিয়ে দিয়ে যায়।

এবং সেখান থেকে সরে আসতেই তার নজর পড়ে ফ্রাঙ্ক ড্রেলারের দিকে। যদিও আনায়া তাকে কখনো দেখেনি তবে এপ্রনের গায়ে লাগানো সোনালী নেইম-প্লেট দেখে সে তাকে ঠিকই চিনে নেয়।

আধপাকা চুল, বিদেশি মুখ, বৃদ্ধ বয়সী এক লোক। হাঁটাচলাও খানিকটা কুঁজো হয়ে করে। তবে আনায়ার নজর সে এখন যাচ্ছেটা কোথায়! কেন জানিনা তাকে আনায়ার খানিকটা সন্দেহ হয়। বিশেষ কোনো কারণ নেই তবে আনায়া তার পিছু নেয়। কিন্তু এরইমাঝে বিপত্তি ঘটে যখন অন্যএক মধ্য বয়স্ক সাইন্টিস্ট যখন, তাকে পাশ থেকে ডাক দেয়।

—“ড.লুনা… ”

আনায়া পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখে লোকটি তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রয়েছে। যা দেখলাত্রই আনায়ার হার্টবিট আকস্মিক থেমে যায়। তার মনে হয়, এই না জানি ধরা পড়ে গিয়েছি। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে শক্ত করতেই বুঝল এখনো তেমন কিছু হয়নি। এই লোকটা অদ্ভুত। শুধু ইনি হয় বরং আশেপাশের সব সাইন্টিস-ই এমন। কেমন যেন অসুস্থ মস্তিষ্কের মনে হয়। কেউ কারোর কাজে ব্যা’ঘাত দিচ্ছে না। নিজেদের মতো কাজ করছে,কখনো কখনো চিপস কফি খাচ্ছে, মজা করছে। যেন এটাই তাদের স্বাভাবিক দুনিয়া।

আনায়া লোকটির কথায় শুনে খানিকটা ঢোক গিলে বলল,”ইয়েস…”

লোকটি আনায়ার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকার পর চোখ জোড়া ছোট ছোট করে। নিজের মুখটা খানিক আনায়ার দিকে বাড়িয়ে নেয়। ওর এপ্রনের নেইম-প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখার পর শান্ত স্বরে বলে,

“ডু বিস্ট দখ ফ্রি-দা লো-রে-লাই।” (তুমি তো ফ্রিদা লোরেলাই)

আনায়া জার্মান ভাষা মোটামুটি ভালোই জানে। লোকটার অবাক অভিব্যক্তিতে আনায়াও জার্মান একসেন্টে স্বাভাবিক ভাবে বলতে লাগল,

ইয়া, ইখ বিন বিয়োকেমিকারিন ফ্রি-দা লো-রে-লাই… ব্রাউখেন জি এপ্স, ডক্টর?”

(জ্বী, আমি বায়োকেমিস্ট ফ্রি-দা লো-রে-লাই।… আপনার কি কিছু প্রয়োজন, ডক্টর?)

—“নাইন, ইখ ব্রাউখে নিখ্‌টস। ইখ জুখে ডক্টর লুনা।”
(নাহ, আমার কিছু প্রয়োজন নেই। আমি ড.লুনাকে খুঁজছি।)

—“ওহ… ডান, ডক্টর, দার্ফ ইখ ইয়েট্‌স্‌ গেন?”
“ওহ… তবে, ডক্টর, আমি কি এখন যেতে পারি?)

—“ইয়া গে!… আল্‌জো, ম্যুশটেস্ট ডু কাফে?ইখ কান জেয়ার গুটেন কাফে মাখেন।”

(হ্যাঁ,যাও!…আচ্ছা,তুমি কফি খাবে? আমি অনেক ভালো কফি বানাতে পারি।”

লোকটির কথায় আনায়া খানিক বেশম খেল। তবুও কোনোমতে বলে উঠল,

“ডাঙ্কে, আবার হয়্‌টে নিখ্‌ট। ফিলাইখ্‌ট আইন আন্ডারমাল।”
(ধন্যবাদ, কিন্তু আজ না। হয়তো অন্য কোনোদিন।)

আনায়া এই বলেই সেখান থেকে কোনোমতে কেটে পড়ল। সাথে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে আওতায়,

“সব পাগল ছাগলই আমার কপালে জোটে। কত শখ,আমাকে কফি খাওয়াবে!…কেমিক্যালে চুবিয়ে যে মে’রে ফেলবে না, তার গ্যা”রান্টি কি!”

আনায়ার পাশাপাশি, ওদিকে সেই লোকটিও খানিকটা মুচকি হাসতে হাসতে হেলে-দুলে নিজের কাজে উদ্দেশ্য চলে যায়।

এদিকে আনায়া আবারও ফ্রাঙ্ক ডেলারকে খুঁজতে শুরু করে। সেই সাথে একটু আগে দেখা হওয়া লোকটিকও গা”লাগালি করে।সে বেটা তার কাজে বাঁধা না হলে এতোক্ষণে তার সব কাজ হয়ে যেত।
আনায়া খুঁজতে খুঁজতে দেখে ফ্রাঙ্ক একটা সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আনায়াও কৌশলে তার পেছন পেছন যেতে লাগল।কিন্তু এরই মাঝে সে আবার আরেকজন সাইন্টিস্টের সাথে কথা বলতে শুরু করে। আনায়া খেয়াল করে দেখে হাতে সময় কম, অথচ এদের কথাও শেষ হচ্ছে না।

আনায়া তাদের আশেপাশেই কাজের বাহানায় দাঁড়িয়ে থাকে। মোটামুটি তাদের কাজ নিয়ে কথা বলছিল বিধায় আনায়ার আর সেসব তেমন প্রয়োজনীয় মনে হলো না। সে অপেক্ষা করছে কখন ফ্রাঙ্ক সেই সরু রাস্তার দিকে এগোবে। কিন্তু আনায়া এরই মাঝে খেয়াল করে, জায়গাটাতে এমনি এমনি যাওয়ার উপায় নেই। নিশ্চিত এর ভেতর প্রবেশ করতেও কোনো অ্যাকসেস পাস ইউজ করতে হবে। পুরো জায়গাটাই তো ইলেকট্রনিক ম্যাটে”রিয়ালস্ এ সাজানো।

আনায়া ভাবছে এই মূহুর্তে তার কি করা উচিত। ঠিক সেই মূহুর্তে তার কানে থাকা ইয়ারবাডে কেনীথের ফিসফিসিয়ে বলা কথার আওয়াজ শুনতে পায়।

—“যেখানেই দাঁড়িয়ে আছিস, ওখান থেকে ফিরে আয়। ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করিস না। চারপাশের লেজার সিস্টেম এক্টিভ রয়েছে। সিকিউরিটি পাস ব্যতীত ভেতরে প্রবেশ করা, সম্ভব না।”

আনায়া কেনীথের কথা শোনা মাত্রই আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেনীথ দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।তার নজর আনায়ার দিকেই। আনায়া কেনীথকে দেখামাত্রই খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সেখান থেকে চলে আসতে নেয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে তার তো সার্ভার রুমের অ্যাকসেস
অথেনটিশন লাগবে। সেটা ব্যাতীত সে ভেতরে কিভাবে প্রবেশ করবে?

হুট করেই তার মাথায় এলো তার কাছে ন্যানো মাইক্রোফোন রয়েছে। যেটা নিত্যন্তই ছোট হলেও,ভয়েস রেকর্ডের জন্য একদম পারফেক্ট।

আনায়া খেয়াল করে দেখল দু’জনের কথা প্রায় শেষের দিকে। এরই মাঝে আনায়া আর একমুহূর্তও দেরি না করে,ফ্রাঙ্কোর পাশ কেটে চলে আসার ভান করে। সেই সাথে কৌশলে ন্যানোমাইকটা ফ্রাঙ্কোর এপ্রনের সাথে ঘাড়ের কাছে লাগিয়ে দেয়। জিনিসটা ক্লিপের মতো হওয়ায় তার বেশি একটা অসুবিধা হয়না,তা লাগাতে। সেই সাথে ফ্রাঙ্কোও কিছু টের না পাওয়ায়, আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে মনে মনে আওরায়,

“আধ পাগল হয়ে, কাজই হয়েছে তবে।”

এরপর সেখান থেকে চলে আসতে আসতে একবার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ফ্রাঙ্কো নিজের ফ্রিঙ্গার প্রিন্ট আর আইরিশ পাস দিয়ে ভেতরের দিকে ঢুকে যাচ্ছে। এদিকে আনায়াও খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল এই ভেবে যে কাল আবারও আসতে হবে। আজকে কাজের কাজ সেভাবে কিছুই হলো না।

______________

রাত আড়াইটা। বাহিরের শীতল বাতাসে যেন সমস্ত চহর জমে আছে। এক অদ্ভুত নীরবতা ব্র্যান্ডেনবুর্গে শহরটাকে আঁকড়ে ধরেছে। শহরের আলোও আজ ঝিমিয়ে পড়েছে। চারপাশে কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে এস.পি.হান্স ভবনটা দাঁড়িয়ে আছে এক দানবের মতো। নিঃশব্দ, অথচ ভূগর্ভের নিন্ম স্তরের প্রতিটা দেয়ালের ভেতর পৈশাচিক কোলাহল।

কেনীথ আর আনায়া, নিজেদের প্ল্যান খানিকটা পরিবর্তন করেছে। গতরাতে তারা কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি। তাই আজ আবারও এখানে আসতে হয়েছে। তাদের টার্গেট আজ “ডেটা সার্ভার রুম”—যেখানে লুকিয়ে আছে শিশু নি”র্যাতন, জৈব অস্ত্রের গবেষণা, অ”বৈধ বায়োপ্রোডাক্ট, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের লিস্ট, এমনকি মানব পাচারকারীদের যোগাযোগ নম্বরসহ সম্পূর্ণ তথ্যভাণ্ডার।

সেই সাথে তারা আরো একটা তথ্য পেয়েছে, তা হলো সার্ভার রুমে প্রবেশ করার দুটো পথ রয়েছে। একটা হলো গতকাল ফ্রাঙ্কো যে পথে প্রবেশ করেছিল…আর দ্বিতীয়টি হলো ভবনের একদম আন্ডারগ্রাউন্ড সেক্টর। যেখানে প্রবেশ করতে হলে আগে পৌঁছাতে হবে ইনফ্রারেড করিডোর পেরিয়ে। এটা এমন এক পথ। যেখানে মানুষের দেহের উষ্ণতা বা চলাচলের শব্দে রুম লক হয়ে যায়। এবং ছয় মিনিটের মধ্যে পালানো না গেলে,পুরো চেম্বার ভরে ওঠে নিউরোটক্সিন গ্যাসে। এই পথ শুধু কয়েকজন হাই প্রোফাইল সায়েন্টিস্টই পেরোতে পারে।এর মাঝে ফ্রাঙ্কো অন্যতম। যাদের কার্ডে একসাথে এনক্রিপটেড আইডি, রেটিনা স্ক্যান ও শব্দ সিগন্যাল থাকে।

আনায়া অবশ্য এই কাজগুলো আগেই করে ফেলেছে। তা হলো ফ্রাঙ্ক ডেলার–এর কাছ থেকে ভয়েস স্যাম্পল রেকর্ড করে নেওয়া। গতকাল তার লুকিয়ে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন সেট করাটা মূলত এই কাজেই লেগেছে। পাভেল কেনীথ যখন ভাবতে ব্যস্ত পরবর্তী কার্যক্রম কি হবে। তখন আনায়া সেসব থেকে রেকর্ড হওয়া ভিডিও ফুটেজ আর ভয়েস রেকর্ড থেকে সে সমাধানও বের করে নেয়। ভয়েস রেকর্ড থেকে পায় সেই অ্যাকসেস পাস।

এবং তারা নিজেদের পরবর্তী মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু জোগাড় করে ফেলে। সার্ভার রুমের অ্যাকসেস পাস হলো ‘হ্যালো অ্যাক্সেস রিকুয়েস্ট’। যা ফ্রাঙ্কো ব্যতীত অন্যকারো কন্ঠস্বরের জন্য প্রযোজ্য নয়৷ তাই রেকর্ড হওয়া এই কথাটি তারা ধারণ করে রাখে একটি বিশেষ ফোল্ডেবল ভয়েস মিনিক ডিভাইসে। এটা এমন একটি যন্ত্র, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কারও কণ্ঠ অনুকরণ করে নির্দিষ্ট কমান্ডে ব্যবহার করা যায়। আর আইরিশ স্ক্যান এর জন্য… বিশেষ রেটিনা স্ক্যান সিমুলেশন ডিভাইস।যা তারা আজ তাদের বিশেষ চশমার সাথে সেট করে নিয়ে এসেছে।এবং এটি আইরিশ স্ক্যানের সামনে নিলে ইনফ্রারেড প্যার্টান প্রজেক্ট হয়ে লক খুলে যায়।আর সেই কফির কাপের গ্লাসে লেগে থাকা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে তারা বিশেষ ভাবে গ্লাভস বানায়।

এক রাত-দিনের মাঝে এতোসব কাজ করা যদিও সহজ ছিল না, তবে এটা তাদের সম্ভব করতেই হতো। মোটামুটি তিনজনে যার যার মতো প্রস্তুতি নিয়ে কাজে লেগে পড়ে।

কেনীথ নিজের জ্যাকেটের ভেতর থেকে বের করে EMF সেন্সর ব্ল্যাঙ্কার। এটা দিয়ে সে ভবনের নিচতলার ইলেকট্রিক ম্যাগনেটিক সেন্সরগুলোর উপর সাময়িক হস্তক্ষেপ করা যাবে। তবে মাত্র ৪ মিনিট সময় পাওয়া যাবে।

রাত ৩:১০। ভবনের পূর্ব পাশের লিফট দিয়ে তারা নামে আন্ডারগ্রাউন্ড করিডোরে। আশপাশে কেবল লাল আলো, হালকা বাজের মতো শব্দ।যা আসছে ভবনের বিদ্যুৎচালিত জেনারেটর থেকে। কার্নিশে ছোট ছোট ড্রোন ইউনিট বসানো, যেগুলোর ক্যামেরা মুভমেন্ট ডিটেক্ট করে।

কেনীথ ড্রোনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক সময়ে। আর আনায়া পিছন থেকে মাইক্রো EMP ডিভাইস দিয়ে একেকটা ড্রোনের ইলেকট্রিক সার্কিট ব্লাস্ট করে দেয়। যেন তার সার্কিট নিষ্ক্রিয় হয় কিছু মুহূর্তের জন্য।

আর এতো কিছুর পর, অবশেষে তারা পৌঁছায় সার্ভার রুমের মূল দরজায়।দরজাটি ধাতব নয় বরং একধরনের স্মার্ট ম্যাটারিয়াল দিয়ে তৈরি। যা ন্যানোশিটে আবৃত। এটা টেম্পারেচার, সাউন্ড, প্রেসার, সব চিহ্নিত করে। একটু ভুল করলেই দরজা নিজেই “ডিফেন্স মুড” অন করে দেয়।এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে এক প্রকার লেজার স্ন্যাপ দিয়ে টুকরো করে ফেলে।

আনায়া আর দেরি করে না। ভয়েস মিনিক অন করে লুকাসের কণ্ঠে বলে, “Hello, access request.”

দরজা হালকা কম্পন দিয়ে সরে যায়। তারা ভেতরে প্রবেশ করে। সার্ভার রুমের ভিতরটি পুরো অন্ধকারের মাঝে কিছু লাল আলোয় মিশে রয়েছে ।তবে হঠাৎ হঠাৎ একেকটা স্ক্রিন জ্বলে উঠছে। সবগুলোতে বাচ্চাদের ছবি, নাম, বয়স, কী ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে, কাদের কাছে পাঠানো হবে, প্রোডাক্ট নম্বর, ও এমনকি ‘REJECTED’ লেখা লাল মার্কিং। মানে যে শিশু পরীক্ষায় টিকতে পারেনি, তার তথ্য—মৃত।

তাদের সামনে বিশাল এক স্ক্রিনে তখন দেখা যায়—“Project SoulSkin: Phase 03”। এখানে দেখা যাচ্ছে কিছু শিশুর চোখ খুলে দেওয়া হয়েছে। তাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে ন্যানোইলেকট্রোড ঢুকিয়ে এমন প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে।যা তাদের অনুভূতি চুরি করে বড়দের জন্য আরামদায়ক অনুভব তৈরি করছে। ঠিক যেন মানব ফার্ম।

তারা দ্রুত পেনড্রাইভ দিয়ে তথ্য ডাউনলোড করতে থাকে। এর মাঝেই আবার পাভেল বাইরে থেকে রিমোট সিস্টেমে ঢুকে পড়েছে। তাকে অস্থির হতে দেখে কেনীথ কপাল কুঁচকে বলে,

“কি হয়েছে? এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেনো?”

— “ব্রো! তোমরা দুই মিনিটের মধ্যে বের হও। গার্ডরা কিছু বুঝে গিয়েছে।”

কেনীথ আর আনায়া খুব বেশি একটা সময় নষ্ট করল না।তবে সব ফাইল ডাউনলোড হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। পাভেল কিংবা কেনীথের কোনো তাড়াহুড়োতেই সে উত্তেজিত নয়। বরং মাথায় যেন জেদ চেপে ধরেছে, যেভাবেই হোক সব কিছু নিয়েই সে এখান থেকে বের হবে। কিন্তু কেনীথ তো আর তার কাজে সায় দেবেনা। সে কোনোমতে নিজেদের প্রয়োজনীয় ডিভাইস গুলো দ্রুত গুছিয়ে নেয়। যতটুকু ডাউনলোড হয়েছে তা নিয়েই পেন ড্রাইভটা খুলে নেয়।এবং আনায়ার হাত শক্ত করে ধরে বের হয়ে আসতে নিলে, আচমকা আনায়ার নজর থমকে যায় হঠাৎ স্ক্রিনের একপাশের কোণায়। যেখানে জ্বলজ্বল করে তার নামের মতো কিছু ভেসে উঠেছে।

“Anaya No. A3-094 | Source: Bangladesh (Hospital Collection) | Genetic Type: High Empathy Receptor | Fetal Status: 12 Weeks Post-Conception.

আনায়া থমকে দাঁড়ায়। তার চোখে খানিকটা স্তব্ধতা। ও বুঝতে পারছে না ওখানে ওসব কি লেখা।আর এসবের মানেই বা কি!

আনায়াকে থমকে দাঁড়াতে দেখে,কেনীথ ওকে টেনে ধরে বের হতে হতে বলল “এখন নয়,আজ বাঁচলে কাল আবারও আসা যাবে।”

তারা তিনজন দৌড়ে পালায়। আর পেছন হতে শোনা যায় রেড অ্যালার্মের কঢ়া আওয়াজ। ইনফ্রারেড করিডোর ইতোমধ্যে গ্যাসে ভরে যাচ্ছে। কিন্তু কেনীথ সঙ্গে আনা আক্সিজেন ক্যাপসুল গ্লাভস ব্যবহার করে ৬০ সেকেন্ডের জন্য বাতাস চুষে নেয় গলার কাছে, এবং তিনজনে ছুটে সেখান থেকে বেড়িয়ে পড়ে।

🔺[পরবর্তীতে আরো অনেক কিছু সংযোজন বিযোজন করা হবে ]

_____________

ভোর প্রায় হতে চললো। জার্মানির লিচটেনবার্গ শহর এখনো ঘুমিয়ে। কিন্তু বাতাসে যেন কোনো অদৃশ্য শীতল চাপ অনুভব হচ্ছে। পিচঢালা রাস্তায় কিছুক্ষণ পর পর বিভিন্ন গাড়ির চলাচল।পুরোনো রেলস্টেশনের পাশের এক টেলিগ্রাফ ভবন।যা এখন ব্যবহার হয় না। তার নিচেই, অন্ধকার গর্তের মতো গোপন চেম্বারে বসে রয়েছে তিনজন মানুষ। তাদের চোখে ঘুম নেই, শরীরে ভয় নেই। একেকজন যেন চলমান আগুন।

কেনীথ মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল। পাভেল তখনো রক্তমাখা বাঁ কাঁধ চেপে ধরে আছে, যেখানে রাতের ঘটনায় তাদের পালিয়ে বাঁচাটা খুব একটা সহজ ছিলোনা ।তারা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে নিলে, সেখানে অনবরত গার্ডরা গুলি ছোড়ে। আর একটা গুলি লেগে যায় পাভেলের পেছন কাঁধে। আর আনায়ার ক্ষেত্রে একটা গুলি তার পায়ের সাথে ঘেঁষে বেরিয়ে যায়।যার ফলে র’ক্ত ঝড়লেও ব্যাথা তেমন অনুভূত হচ্ছে না।অবশ্য সেসব হওয়ার আপাতত সুযোগ নেই। কাজের চাপে আনায়া যেন তা ভুলতেই বসেছে।
এসব থেকে অবশ্য কেনীথ বেঁচে গিয়েছে। কারণ সে ছিল সামনে আর আনায়ারা পেছনে। যদিও আনায়ার হাত পুরোটা সময় কেনীথই ধরে রেখেছিল। আর শেষমেশ আনায়ার গুলি লাগার পর কেনীথ আনায়াকে পাজকোলে তুলে নিতে চাইলে আনায়া বাঁধা দেয়। কিন্তু কেনীথ তা সে বাঁধাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়েই আনায়াকে একপ্রকার কাঁধে তুলে নিয়েই ছুটতে থাকে।আর সবশেষে বিপত্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তারা আশ্রয় নেয় এই জায়গায়।

পাভেলের গায়ে লাগা গুলি সে নিজে এবং কেনীথ আনায়ার সাহায্যে টেনে বের করেছে।এরপর প্রয়োজনীয় মেডিসিন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। পাভেল খানিকটা ব্যথাতুর চেহেরায় দাঁড়িয়ে।আর আনায়া নিঃশব্দে তার পাশে দাঁড়িয়ে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা অক্ষরগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে নিচ্ছে। বরফের মতো শীতল মুখ, কিন্তু চোখ জ্বলছে দগদগে আগুনে শিখার ন্যায়।

আজ এই ভোর রাতটা খানিক ভিন্ন। এখন তাদের অভিযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আজ ট্রান্সমিশনের দিন। তারা যা সংগ্রহ করেছে, সেই ভয়ংকর তথ্যগুলো একসাথে ছড়িয়ে দেবে পৃথিবীর সব ডা”র্কনেট ফোরাম, ওপেন সোর্স সার্ভার, স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টে। যাতে এক মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে SP Hans-এর বহু”রাষ্ট্রীয় মুখোশ।

এবার মনিটরের সামনে থেকে কেনীথ উঠে পড়ে। আর পাভেল গিয়ে বাকি কাজ সামলাতে লাগে। যেহেতু এসব কাজে সবচেয়ে বেশি এক্সপার্ট সে, তাই এবার দায়িত্বটা পাভেলের।

কেনীথ গিয়ে আনায়ার পাশে দাঁড়ায়। তাকিয়ে দেখে আনায়া মনিটরের স্ক্রিনে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তাকিয়ে। কেনীথ আনায়ার খানিকটা কাছে ঘেঁষে ওর দিকে মাথা এগিয়ে নেয়, তবে আনায়ার মতো তার নজরও মনিটরের স্ক্রিনে।

—-“ঐ বুড়ো তোকে কি বলছিল?”

কেনীথের ফিসফিস আওড়ানো সিরিয়াস কথার দরূন আনায়ার মনোযোগ সরে যায়। সে পাশে মুখ ফেরাতেই দেখে কেনীথ একদম তার পাশে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে সিরিয়াস আবহের ছাপ। আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে বলে উঠল,

“কোন বুড়ো?”

কেনীথ আনায়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিঞ্চিৎ ঢোক গিয়ে বলে,

“ঐ যে, লিলিপুটের মতো দেখতে…”

আনায়া কেনীথের হাভভাব আর অভিব্যক্তিতে কপালটা আরো খানিক কুঁচকে ফেলতেই হঠাৎ তার সেই সাইনটিস্টের কথা মনে পড়ল। যেটাও কিনা প্রথম দিনের ঘটনা। আর সে প্রায় ভুলেও গিয়েছিল।

—“হঠাৎ এ কথা?”

—“মনে ছিল না, এখন মনে পড়েছে…যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দে!”

আনায়া কেনীথের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নির্বিকারে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। এবং নির্লিপ্ত স্বরে বলে,

“আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই আমি। আর এমনিতেও এটা তেমন প্রয়োজনীয় নয় যে, আপনাকে বলতে হবে।”

—“উত্তর না৷ দিলে… খারাপ হবে কিন্তুু!”

—“কি খা’রাপ হবে তা আমিও দেখতে চাই।”

কেনীথ আনায়ার নির্লিপ্ত কথায় চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সেও নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

—“ঠিক আছে!তবে তোর এতোসব পরিশ্রম, কষ্ট ভেস্তে দেই…কি বলিস?”

—“মানে?”

—“এই যে এতসব প্ল্যান বানিয়ে হান্সের ডকুমেন্টস গুলো হাতিয়ে নিয়ে এলি।…পাভেলকে বললে, ওর বেশি সময় লাগবে না এইসবকিছু নষ্ট করে দিতে।”

কেনীথ এহেন কথায় আনায়া বিস্ময় আর রক্তিম চাহনিতে তাকায়। খানিকটা হিসহিসিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“আপনি কি মানুষ?”

—“নাহ, আমি অমানুষ…জানোয়ার! তুই-ই তো বলেছিলিস, এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গিয়ে এখন আবার নিজেই জিজ্ঞেস করছিস?”

আনায়া জোরে দম নেয়। চোয়াল শক্ত করে বলে,

“এমন কিছু করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাববে না। নয়তো ঐ দুঃস্বপ্নে ভরা কলিজাকে টেনে হিঁচড়ে বের করতে আমার বেশি কষ্ট হবে না!”

—“বাপরে…এক সেকেন্ড, যদি এমন কিছু না করি আর যদি তোকে বলি আমায় মে’রে ফেলতে, তবে তোর কষ্ট হবে?”

আনায়া এবার কেনীথের এহেন অভিব্যক্তিতে চুপ করে যায়। কিছু না বলে, চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে উঠল,

“বলছিল যে, সে ভালো কফি বানাতে পারে। আমি খাব কিনা, তাই জিজ্ঞেস করেছিল।”

—“ঐ বুড়োটা?”

—“সাইন্টিস্ট উনি…সেই সাথে শয়তানের শি”ষ্য।”

আনায়ার খানিকটা রাগ নিয়েই কথাটা বলতেই কেনীথ আবারও বলল,

“যেটাই হোক,তুই কি বললি?”

আনায়া এবার খানিকটা কপাল কুঁচকে কেনীথের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

“আপনার কানে না ইয়ারপোড লাগানো ছিলো? আমাদের সবকথাই তো আপনার শোনার কথা৷”

কেনীথ এবার খানিক তব্দা খেয়ে বলে উঠল,

“তোরা জার্মান ভাষায় কথা বলছিলি। আমি জার্মান পারি না।”

কেনীথের সহজ অভিব্যক্তিতে আনায়া ভ্রু কুঁচকে ফেলল। খানিকটা কঢ়া স্বরে বলে,

“মিথ্যা কেনো বলছেন? আপনি সত্যিই জার্মান পারেন না?”

—“নাহ…হ্যাঁ,মানে ঐ একটু আকটু।তবে খুব বেশি না।”

—“ওহ!”

আনায়া আর এই বিষয়ে কথা বাড়ায় না।যদিও কেনীথের নির্লিপ্ত স্বীকারোক্তিটা তার মোটেও সত্যি মনে হলো না। কেনো যেন মনে হচ্ছে কেনীথ মিথ্যে বলল। তবে আনায়ার এতে কিছু আসে যায় হা।সে ব্যস্ত তার মিশনের পরবর্তী প্ল্যানের বিস্তারিত সাজানোতে। আর সেই সাথে, মস্তিষ্কের আবছা ভাবনায় ভেসে থাকা স্ক্রিনের সেই লেখাগুলো। আনায়া এখনো বুঝতে পারেনি সেসব আদতে কি ছিল।

এদিকে আবার কেনীথ নিজের মতো মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“আহ্…বুড়োর শখ কত! আমার বউ, আমিই চান্স পাই না। আর বুড়া ব্যাটা আসে, আমার বউকে তার হাতের কফি খাওয়াতে?”

মূলত কেনীথ খুব ভালো ভাবেই জার্মান জানে।এবং আনায়া আর সেই সাইন্টিস্টের সব কথাই সে শুনেছে এবং বুঝেছে। শুধু তাই নয়, বরং তারা যখন কথা বলছিল তখন কেনীথ নিজের কাজ ফেলে রেখে আনায়াকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে।এবং দূর থেকে কপাল কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে থেকে সবকিছুই দেখতে থাকে।

—“স্ট্যাটিক সিগন্যাল লকড!৩০ সেকেন্ডের মধ্যে নেটওয়ার্কে ঢুকছি।”

পাভেল নিজের কোডিং শেষ করে একবার চোখ বন্ধ করল। এটাই তাদের লাস্ট কার্ড। রুমের ভেতর আলো নিভে গিয়ে আবার জ্বলে উঠল। সার্ভারের মনিটরে ক্লক ডাউন শুরু হলো। 5…4…3…2…

অথচ হঠাৎ করেই, সবকিছু থেমে গেল।মনিটরের আলো নিভে যায়। ল্যাপটপের স্ক্রিন কালো হয়ে আসে। ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পুরনো পাখা হঠাৎ করে ঘুরে উঠল। যেন কেউ বাতাসে নোংরা কিছুর গন্ধ ছড়াল। বাইরে মেঘের গর্জন, তারপর সবকিছুই নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল।

আনায়া বিস্ময়ের সাথে বলে,”কি হলো?”

পাভেল তাড়াতাড়ি সিস্টেমে ঢোকার চেষ্টা করল।কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। একের পর এক ফেইলড এন্ট্রি।

—“আমরা ঢুকতে পেরেছিলাম। কিন্তু কেউ আমাদের আগেই ধরে ফেলেছে। কেউ ট্রান্সমিশন অ্যাকসেস ব্লক করে দিয়েছে। আর শুধু ব্লক না…পুরো সিগন্যাল রিসিভার ডিজঅ্যাবলড।”

কেনীথ ঠান্ডা স্বরে বলল, “মানে ওরা জানত আমরা এসব করতে চলেছি।”

তাদের চোখের সামনে অন্ধকার ছায়ার মতো বাস্তব ফুটে উঠল। আনায়া সহ তাদের এতোসব প্ল্যান, সংগৃহীত ফুটেজ, সার্ভারে রাখা প্রতিটি প্রমাণ—সব এখন অফলাইনে। এমনভাবে ডিজেবল করা হয়েছে যেন কেউ বিশ্বাসই করবে না যে কিছু ঘটেছিল।

—“ওরা শুধু সিস্টেম বন্ধ করেনি, ওরা আমাদের উপরে নজর রেখেছিল। আমাদের ট্রান্সমিশন স্পট, টাইমিং, ফাইল স্ট্রাকচার, এমনকি আমাদের ব্যাকআপ পর্যন্ত ট্রেস করে ফেলেছে। কেউ একজন ভিতর থেকে আমাদের মুভমেন্ট ফাঁস করেছে। বুঝতে পারছি না, এসব কে করছে, আর কিভাবেই করছে! ”

পাভেলের কথায় শেষ হতেই এক মুহূর্তেই চুপচাপ হয়ে রইল তিনজন। বাইরে ভোরের আলো ছড়াতে শুরু করেছে। লাইটের তীব্রতা কমে গিয়ে ভোরের প্রকৃতির শীতল আবহে ছেয়ে যাচ্ছে। তবুও সে বাতাসে একটা ঘন নীরবতা ছড়িয়ে আছে, যা মোটেও কাউকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না।

অনেকক্ষণ সব সবাই নিস্তব্ধ হয়ে থাকার পর, আনায়া বলল, “এখন কী করবো?”

কেনীথ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। সেই সাথে বলতে লাগল,
“তথ্য প্রকাশ করে কিছু হবে না। এতো বড় এক ইন্টারন্যাশনাল কাম্পানি। এমন সব অনৈতিক কাজ নিশ্চয়, এমনি এমনি করবে না! বুকে কলিজা রয়েছে দেখেই, এতোবছর ধরে এমন দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে যাচ্ছে। ওরা হয়তো মিডিয়া কিনে ফেলেছে, পুলিশ-আইনও কিনে ফেলেছে। ডিজিটাল সার্ভার হ্যাক করাতেও ওস্তাদ। আমাদের ট্রান্সমিশন এখন কিচ্ছু না। যদি ওদের অস্তিত্ব শেষ করতে হয়, তাহলে তাদের ভেতর থেকেই নষ্ট করতে হবে।”

পাভেল মুখ তুলে তাকাল।—“মানে?”

—“মানে, এখন আমাদের একমাত্র টার্গেট—SP Hans এর অর্থদাতারা কিংবা মাস্টারমাইন্ড। যার জন্যই এই কোম্পানির উৎপত্তি। এছাড়া তাদের যদি কোনো প্রধান গবেষণাগার আর যদি এককেন্দ্রিক সার্ভার থাকে…যেখানে সবকিছুর উৎস কোড রাখা হয়।… একবার ঐটার ভেতরের বায়োলজিক্যাল নোড ধ্বংস করতে পারলে।ওদের সবকিছু শেষ। ওটাই হান্সের দেহের মেরুদণ্ড।ওটা ভাঙলে শরীর টিকবে না।এমনিতেই সব ধ্বং”স হবে।”

—“তার মানে, তুমি বলতে চাচ্ছো, আমাদের এখন এই এস.পি.হান্সকে বের করতে হবে! কিন্তু সে তো বহু বছর আগেই ম’রে গিয়েছে।”

পাভেলের এহেন অভিব্যক্তিতে কেনীথ খানিকটা বিরক্ত হলো।—”গাধার মতো কথা বলিস না।আমিও জানি এস.পি.হান্স মা’রা গিয়েছে। কিন্তু এই কোম্পানি তো আর হাওয়ার উপর চলছে না। নিশ্চয় হান্সের কোনো উত্তরাধিকারী কিংবা… অন্য কেউ তো রয়েছে, যে এই সবকিছু পরিচালনা করছে।”

—“হুম, হুম, তাও ঠিক। কিন্তু এই হান্সের খোঁজ পাব কোথায়? এতো ইনফরমেশন ঘাটাঘাটি করা হলো, কোথাও তো এর খোঁজ পাইনি। আর কেউ জানেও না আদোও সেই হান্স মানুষ না ভুত।”

এমন সিরিয়াস মোমেন্টেও পাভেলের এমন কথাবার্তা কেনীথের প্রচন্ড বিরক্ত লাগল। চোখ মুখ কুঁচকে কিছু কঢ়া কথা বলতে নিয়েও আর বলল না।

—“তোর এতো চিন্তা করতে হবে না। বহুত করেছিস, বাকিটা এবার আমি করছি।”

______________

ভোর গড়িয়ে সকাল হয়, সকাল গড়িয়ে গভীর রাত…এরপর আসে মধ্যেরাত। পুরোটা সময় তিনজনেই অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে নিজেদের কাজ করে যায়। কেনীথ, পাভেল এবং আনায়া, সবাই একসঙ্গে বসে রয়েছেন একটি অন্ধকার কক্ষে। তারা তাদের আগের আস্তানা থেকে সরে এসেছে। এই জায়গাটা লোকালয় থেকে আরো বেশি অগোচরে। চারপাশে কোনো আলো নেই। একমাত্র আলোক উৎস হলো একটি পুরোনো টেবিল ল্যাম্প। যেটি বর্তমানে টিমটিম করে জ্বলছে। তাঁদের সামনে বড় একটা ম্যাপ। একপাশে কিছু নথিপত্রও ছড়িয়ে রয়েছে। আনায়া হাতের মুঠো ভেঙে টেবিলের ওপর রেখে বলে উঠল,

“এই হান্স কিংবা মাস্টারমাইন্ড… কোথায় থাকতে পারে, সেটা জানার জন্য আমাদের দ্রুত একটা পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।”

পাশ থেকে কেনীথ কিছু ডকুমেন্টস প্রচন্ড মনোযোগী হয়ে দেখতে দেখতে বলে,

“কাজ প্রায় হলে এলো বলে…দেখা যাক, কি হয়!”

তারা জানে, এই সন্ধান কোনো সাধারণ কাজ নয়। হান্স…যে ব্যক্তি, বহু বছর ধরে এই আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের মস্তিষ্ক। তার অবস্থান এতই গোপন যে, সারা বিশ্বে কেউ জানে না সঠিকভাবে, কোথায় থাকে সে। আর তার আসল পরিচয়ই বা কি! কিন্তু তারা আপাতত সব সিক্রেট ইনফরমেশন জোগাড় করার পর এটা জেনেছে যে, একটি গোপন দুর্গ রয়েছে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে। যে দুর্গে এস.পি. হান্সের প্রায়ই গোপন তথ্য সরবরাহ করে থাকে তার সঙ্গীদের জন্য।

আর এসব তথ্য মূলত কেনীথই জোগাড় করেছে তার কিছু চেনাশুনা আন্ডারগ্রাউন্ডের বিশেষ স্পাই দিয়ে। যাদেরকে আবার এসব তথ্য দিয়েছে সেই দূর্গের সাবেক সহকর্মী জোহান। এছাড়া কেনীথের লোকজন আরো একটি এনক্রিপ্টেড ফাইল পাঠায় ডেড সার্ভারের মাধ্যমে, যাতে একটি ট্র্যাকিং রিপোর্ট থাকে। গত তিন সপ্তাহে ইউরোপজুড়ে তিনটি কালো অ*স্ত্র কার্গো আটকানো হয়েছে। যার সব কটার উৎসস্থল ছিল জার্মানির ভিটজেনবুর্গের কাছাকাছি।
এছাড়া ফ্র্যাঙ্কফুর্টের একটি পুরোনো আর্কাইভ হাউজে, রাতের আঁধারে এক বেনামি তথ্যদাতার থেকে কেনীথ পেয়েছিল একটি ছেঁড়া কাগজ…যেখানে হাতে লেখা ছিল একটা জায়গার সমন্বয়। সেটিই মূলত শ্লোস ভিটজেনবুর্গ,…যে দুর্গেই পাওয়া গিয়েছিল হান্সের নাম।

“শ্লোস ভিটজেনবুর্গ” জার্মানির সাক্সনি-আনহাল্টের কুয়েরফুর্ট শহরের পাশে নিঃশব্দ এক উপত্যকায় দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন দুর্গ। যার অস্তিত্ব ইতিহাসে প্রথম পাওয়া যায় নবম শতকের শেষদিকে। এই দুর্গ একসময় ছিল খ্রিস্টান নানদের আবাসস্থল। কিন্তু পরবর্তীতে একে একে বিভিন্ন অভিজাত পরিবারের হাতে এসে…রেনেসাঁস, বারোক, ও নিও-রেনেসাঁস আর্কিটেকচারের মিশেলে এক ভয়ং”কর সৌন্দর্যে রূপ নেয়।

এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটি ব্যবহৃত হয়েছে শিশুদের আবাসিক স্কুল এবং মানসিক রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।জঙ্গলে ঘেরা এই বিশাল কাঠামো এখন একটি অন্ধকার ও নিষিদ্ধ স্থানে পরিণত হয়েছে।যেখানে মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায় বলে গুজব রয়েছে। বর্তমানে এটি ব্যক্তিমালিকানাধীন হলেও কোনো সংরক্ষণ নেই, এবং এটি জনসাধারণের প্রবেশের জন্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। আর কেনীথের অনুসন্ধান অনুযায়ী এই ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপত্য, অতীত ইতিহাসে মোড়া, নির্জন এলাকাতেই ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে এস.পি. হান্সের মাস্টারমাইন্ড।

দুর্গটির চারপাশে বনভূমি, যেখানে কোনো মানুষ প্রায় প্রবেশ করে না। নিকটবর্তী কোনও শহর বা জনবসতিও নেই। আর এখানে কেনীথদের প্রবেশ করতে হলে, তাদের রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালাতে হবে। এবং তারা জানে, সামান্য কোনো ভুল করলে তাদের পরিণতি হবে ভয়াবহ।

তাদের প্রথম কাজ হল,হান্সের আস্তানা সম্পর্কে মাইক্রোফিল্ম থেকে আরো তথ্য উদ্ধার করা।আর আনায়া সফলভাবে সেই তথ্য বের করে ফেলল। এবং তাদের হাতে চলে আসে সেই মাইক্রোফিল্মে লুকানো নির্দিষ্ট স্থান, দুর্গের প্রবেশদ্বার, গোপন পথ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।

তাদের কাছে ছিল জোগাড় করা সেই, একমাত্র একটি পুরোনো ও গোপন তথ্যসমৃদ্ধ মানচিত্র। সেখানে ছিল দুর্গের পশ্চিম দিকের একটি সিক্রেট এন্ট্রান্স। যেখানে কেউ সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু ভেতরে প্রবেশের জন্য এই একটি রাস্তাই তারা ব্যবহার করতে পারবে। নয়তো মেইন গেইট দিয়ে, সরাসরি গার্ডদের সম্মুখীন হয়ে ভেতরে প্রবেশ একপ্রকার অসম্ভব। আর এতো সহজে থেমে যাওয়ার মানুষ তারা নয়।

তারা ছোট চপারে করে পাহাড়ঘেরা একটা জায়গায় নামে, যেখান থেকে দুর্গ প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। কুয়াশা ঘেরা, পাহাড়ি ট্রেইলে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় তারা দেখতে পায়—একটা শ্যাডো টাওয়ারের মতো কিছু যেন ঝাপসা হয়ে পাহাড়ের ঢালে লুকিয়ে আছে।

আর তাদের গোছানো সেই সূত্র ধরেই তাদের যাত্রা শুরু হয়। এরপর একটি কালো SUV গড়িয়ে আসে দূরে, অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে।গাড়ি চালিয়ে জঙ্গল, পাহাড়ের গা বেয়ে যখন তারা দুর্গের কাছাকাছি পৌঁছায়। গাড়ি থেকে নামে তিনজন। কেউ কথা বলে না।প্রত্যেকের পরনে কালো মাস্ক। পাভেলের মাথায় অবশ্য একটা কালো ক্যাপও রয়েছে।

তারা জানে, এখানে প্রবেশ মানেই মৃত্যুর স্বাক্ষর। কিন্তু ওদের সামনে এখন বিকল্প নেই। তাদের হাতে ছিল হ্যান্ডগান, সাইলেন্সার, আর অস্থায়ী EMP ডিভাইস।

ান্যদিকে গার্ডরা… যারা আসলে হান্সের নিয়োজিত পেইড মিলিশিয়া। অস্ত্র হাতে টহল দিচ্ছিল। এদের কেউই পেশাদার সেনা নয়। কিন্তু এতটাই ভয়ংকর যে একজন গার্ড একা তিনজনকে সামলে দিতে পারত।তারা প্রস্তুত ছিল পুরো এলাকায়। তারা অস্ত্রসজ্জিত এবং অত্যন্ত দক্ষ ছিল।

এদিকে দুর্গে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব মনে হলেও, তারা শেষ পর্যন্ত সফল হয়। কারণ তাদের প্রস্তুতি ছিল গোছানো ও জোরদার। প্রথমে তারা গোপনে, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে দুর্গের আশপাশের লোকজনের যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করে নেয়। এবং সেই যোগাযোগের মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে যে তারা অল্প কিছু সময়ের সুযোগ পাবে। এই সময়টুকু তারা সতর্ক থাকলে, তারা সুরক্ষিতও থাকবে।

অবশেষে, সকল প্রস্তুতি শেষে তারা তাদের গন্তব্যের দিকে এগোয়। গাঢ় অন্ধকারের এক ভূতুড়ে কুয়াশার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সেই দুর্গ শ্লোস ভিটজেনবুর্গ৷ যার আশেপাশের জায়গাজুড়েও বেশি সুবিধার নয় ।চারপাশ ঘিরে জঙ্গল, বিপজ্জনক পাহাড়ি রাস্তা এবং মধ্যযুগীয় টাওয়ার। তারা তিনজন দূর্গ হতে প্রায় অনেকটা দীরে পাহারি রাস্তায় দাঁড়িয়ে।আর সামনে বিশাল আকৃতির একটা লোহার গেট।

তারা দুর্গের পাশে পুরোনো এক বনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায়। আনায়ার হাতে IR ভিশন।যারমাধ্যমে সে আশপাশটা পরীক্ষা করে নিয়ে বলে,

“”এখানে একটা ভূগর্ভস্থ ট্রান্সফার পয়েন্ট রয়েছে।”

—“তার মানে…আমাদের মাটির নিচ দিয়ে ঢুকতে হবে?”

পাভেলের প্রশ্নের প্রতিত্তোরে কেনীথ বলে,

“ওরা এখানেই অস্ত্র আনে। দুর্গে ঢোকার এটিই একমাত্র সুযোগ।”

তারা খুব বেশি একটা সময় নেয় না।চুপচাপ, নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে মাটির নিচের করিডরে। কাঁদা আর পচা গন্ধে ভরে আছে পুরো পথ। দূর থেকে গার্ডদের চলাচল ও রেডিও কমান্ডের আওয়াজ ভেসে আসে। অনেকটা পথ ভালোমতোই অতিক্রম করতে পারলেও,আরেকটু সমানের দিকে এগোতেই সামনে পেলো গার্ড এবং স্নাইপারদের একটি দল। যারা চারপাশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল।আর আনায়াদের দূর্ভাগ্যবশত এতো প্লানিং এর পরও গার্ডরা হয়তো তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায়।

কেনীথ চোয়াল শক্ত করে হালকা সিগন্যাল দেয়। পাভেল তার পেছনটা কভার নেয়। আনায়া হাত ঘড়ির দিকে তাকায়, তারপর নিঃশব্দে পিস্তলের স্লাইড টেনে ট্রিগারে শক্ত করে আঙ্গুল ছোয়ায়।

আর যেই না তাদের দিকে গার্ডগুলো ধেয়ে আসে।ওমনি তিনজন কৌশলে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হারিয়ে ফেলল। পিস্তল ও রাইফেলের আওয়াজের গর্জনে চারপাশ রুদ্ধশ্বাসে পরিণত হয়েছে। র”ক্তের সঙ্গে গুলির বর্ষব মিলে একাকার। পাভেল যখন একজন গার্ডের দিকে তীব্রভাবে গুলি চালাল, তার পাশের এক টাওয়ারে তখন স্নাইপার তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল।তারা নিচু হয়ে এগোতে থাকে। পথরোধ করে আরো দুটি সশস্ত্র প্রহরী। গার্ডরা চুপচাপ, কিন্তু শরীরের মুভমেন্ট থেকে বোঝা যায়, তারা যেকোনো সময় আক্র’মণ করবে।
কথা না বাড়িয়ে, কেনীথ হাতের সিগ সাওয়ার তুলে নেয়, টানা দুটো গুলি।…একজন মাটিতে পড়ে যায়।ওদিকে আরেকজনের পা লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে পাভেল। কিন্তু ঠিক সেই সময় আড়াল থেকে আসে আরও চারজন।

গোলাগুলি শুরু হয়। বনের মাঝের বদ্ধ দুর্গের ভেতরে… গুলির শব্দ ঠাণ্ডা বাতাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের যু”দ্ধটা খুবই দুর্ধ”র্ষ হয়ে উঠেছে। আনায়া ফ্ল্যাঙ্কিং পজিশনে গিয়ে দুই গার্ডকে নিজে সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে একে একে সরিয়ে ফেলে। তবু কেনীথ কাঁধে হালকা গুলিবিদ্ধ হয়, আর পাভেলের কপালের পাশে ছুঁয়ে যায় একটা বুলেট। হাফাতে হাফাতে,তারা রক্তে মাখা জামা পরা অবস্থায় মূল গেটের দিকে এগোয়।

আরো অভ্যন্তরীনে প্রবেশের পর তারা দেখে, জিনিসটা যতটা পুরোনো, তার চেয়ে বেশি ভয়ংকর। ভেতরে ডাস্টি কার্পেট, সেকেলে বাতি, আর দেয়ালে ঝুলে থাকা নাৎসি যুগের কিছু চিত্র।কিন্তু আধুনিক সেনা অস্ত্র গুদামও দেখা যায়। সেখানে আরো তিনজন সশস্ত্র লোক, যারা প্রত্যক্ষ যুদ্ধের জন্য তৈরি। পাভেল তখন আগুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।কেনীথ পিছন থেকে কভার দেয়, আর আনায়া ডান পাশ ঘুরে বুলেট ছুঁ’ড়ে দেয়। তিনজনেই প্রায় শেষ শক্তি দিয়ে লড়াই চালায়। এবং অবশেষে দুর্গের একদম গভীরে পৌঁছে যায়।

তিনজনের মাঝেই আনায়াই ছিল সবচেয়ে দ্রুত এবং নিঃশব্দ। যখন গার্ডরা তাদের দিকে পৌঁছাতে চেষ্টা করছিল, আনায়া তাদের একের পর এক নিঃশব্দে আগুনের ন্যায় মতো শুট করতে লাগে।
কেনেথ এবং পাভেলও মদত দেয়। তাদের গুলি ও কৌশল দিয়ে সাঁজানো। কিন্তু একসময় পাভেল আহত হয়, যদিও সে তা জানায় না। কিন্তু তা আনায়ার নজরের অগোচর হয় না। সে তার উদ্দেশ্যে জোড়ে সতর্ক করে,
“ভাই, সাবধানে!”

আশেপাশে লা’শের স্তু”প জমে গিয়েছে। আশা করা যায় এই দুর্গে আপাতত আর কোনো গার্ড নেই। প্রত্যেকেই জোরে জোরে শ্বাস ফেলে। প্রত্যেকেই হাঁপিয়ে উঠেছে। কিন্তু আনায়া একমুহূর্তও নষ্ট করতে চায় না।সে দৌড়ে দূর্গের আরো ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। উদ্দেশ্য, যেভাবেই হোক মাস্টারমাইন্ড আর মেইন সার্ভারকে ডেস্ট্রয় করা।

আনায়াকে ছুটতে দেখে এদিকে কেনীথ খানিকটা থতমত খেয়ে যায়। তার নিজের গায়েও গুলি লেগেছে কিন্তু সে ব্যাথার দরূন ওখানে পড়ে থেকে লাভ নেই। খানিকটা চোখমুখ কুঁচকে আনায়াকে ডাকলেও আনায়ার তাতে পাত্তা না দিয়েই ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। আর তা দেখে কেনীথ নিজেও ওর পেছন পেছন ছুটে যায়।সেই সাথে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“এই মেয়েমানুষ গুলো এতো ঘ্যাড়ত্যাড়া আর বেশি বোঝে কেনো? হিসেবে তো দুনিয়ায় সব মিউজিয়ামে এদেরকে নিয়ে রাখা উচিত।”

________

একটি অন্ধকার ঘরে একটি মধ্য বয়স্ক লোক নির্লিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে কালো লম্বা কোর্ট, কালো হ্যাট। এছাড়া তার হাতে ছিল একটি পুরনো চামড়ার ডায়রি। টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান কাগজপত্র। এছাড়া এখানেই সার্ভারের মেইন ফাইলগুলো রয়েছে।যেগুলো শেষ করতে পারলে এস.পি.হান্সের সবকিছু ধ্বং”স হয়ে যাবে। এবং এখানে রয়েছে তার আরো পরিকল্পনা। সে যদিও জানত , কেনীথ ও তার দল আসবে। কিন্তু কবে বা কিভাবে তা অজানা ছিল। মূলত কেনীথদের দুর্গের ভেতরের অবস্থান করাটা তার জন্য খানিকটা অপ্রস্তুত বিষয়। অবশ্য এতোক্ষণ ধরে সে দুর্গের বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখা সিসিটিভির মাঝে সবকিছু তার সামনে থাকা মনিটরে দেখছিল। কিন্তু মাত্র তিনজনে যে এতগুলো লোককে শেষ করে দেবে তা বুঝে উঠতে পারেনি। লোকটি খানিক ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে নিজের পিস্তলের ম্যাগাজিনে গুলি ভড়তে লাগে। যেন তার কিছুই হবে না।যেন তাকে বাঁচানোর জন্য বিশেষ কেউ রয়েছে।

এদিকে আনায়া যখন সেই কক্ষে প্রবেশ করে, তখন লোকটি কিছুটা অট্টহাসি দিয়ে জার্মান ভাষায় বলল,

“মেয়ে মানুষ হয়ে এতো দেমাগি ভালো নয়। কিন্তু কিছুই করার নেই, শয়তানের জালে ধরা দিয়েছো। না চাইতেও এবার মরতে হবে।”

“ওয়েলকাম টু দ্য এন্ডগেম…”

এই বলেই লোকটি আনায়ার দিকে আচমকা শুট করে। আকস্মিক এ ঘটনায় আনায়া কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নেয় শুটের শব্দ শুনে। হয়তো ভেবেই নিয়েছে গুলিটা তারই গায়ে লেগেছে।কিন্তু পরক্ষণেই অনুভব করে সে কারো উষ্ণ বাহুডোরের বেষ্টনে আবৃত। আর তার মোটেও একটুও কোথাও ব্যাথাও লাগছে না। তবে গুলিটা কার লাগল! আনায়া ত্বরিত চোখ খুলে দেখে কেনীথ চোখমুখ খিঁচে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। মূলত গুলিটা কেনীথের পিঠের বা পাশে লেগেছে। অথচ কেনীথ চিন্তিত স্বরে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“ঠিক আছিস?”

আনায়া কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আবারও গুলি ছোঁড়ার শব্দ হলো। এবার শুট করেছে কেনীথ। আনায়াকে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই, কি যেন আন্দাজ করতেই ডানহাতটা পেছনের দিকে নিয়ে সোজা শুট করে দেয়। পেছনে কি হয়েছে তা দেখলো না তবে, ব্যাথার দরূন কারো চেঁচানোর আওয়াজ শুনতেই কেনীথের ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিৎ বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।

এদিকে আনায়াকে সাইড করে, কেনীথ পেছন ঘুরে দাঁড়ায়। তবে এরই মাঝে আকস্মিক আরো এক ঘটনা ঘটে যায়। আচমকা ধোঁয়ায় ভরে ওঠে চারপাশ। কেনীথ জানে, নিশ্চিত সেই লোকটিই একাজ করেছে। কিন্তু আশেপাশে এতো ধোঁয়ার কারণে আনায়া কিংবা কেনীথ কেউই কিছু দেখতে পারছে না।উল্টো দুজনের কাশি উঠে যায়।তবে কেনীথ ঠিকই আনায়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরে রাখে।

কিন্তু এরইমাঝে সেই লোকটি কৌশলে তার পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়। ধোঁয়ার মাঝেই সে কেনীথের দিকে পিস্তল তাক করে ট্রিগার চাপতেই আকস্মিক গুলির আওয়াজে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। চারপাশের ধোঁয়াও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।এরই মাঝে আরো কয়েকটি গুলি ছোঁড়ার আওয়াজে চারপাশটা যেন কেঁপে ওঠে।

এরই সাথে একটি দেহ আকস্মিক মাটিতে পড়ে যেতে ধরে। আর কেনীথ অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,

“পা..ভে…ল!”

কেনীথের কথা শুনে সেই লোকটি পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতেই সম্পূর্ণ ভাবে শক্ত ফ্লোরে আঁচড়ে পড়ল। মূলত সবগুলো গুলি তার শরীরেই লেগেছে আর প্রত্যেকটা শুট করেছে পাভেল।যে কারণে পাভেল তার মুখ থেকে মাস্ক খুলতেই, শেষবারের মতো একঝলক লোকটি তার নিজের খুনিকেও দেখে নেয়।

লোকটি যখন কেনীথকে শুট করতে ট্রিগারে চাপ দেবে ঠিক ঐ মূহুর্তেই পেছন থেকে পাভেল একেবারে পর একে গুলি ছুঁড়ে লোকটির দেহকে ঝাঁঝড়া করে দেয়।
লোকটিকে একপ্রকার ডেং-ইয়ে পাভেল তার উপর দিয়ে কেনীথ কাছে ছুটে আসে। তার নিজের পায়েও গুলি লেগেছে আর সেখান থেকে অনবরত শ’ক্ত ঝড়ছে।

—“ভাই ঠিক আছো?…তোমাদের কিছু হয়নি তো?”

কেনীথ স্তব্ধ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে ইশারায় উত্তর দেয় যে তাদের কিছু হয়নি। যা বোঝা মাত্রই পাভেলও যেন খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অথচ চারপাশে এখন শুধু নিস্তব্ধতা। আর সেই লোকটিও তাদের দিকে অদ্ভুত এক অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখ বুজে নেয়। কে জানে, হয়তো তার ভাগ্যেও যে এমন আক”স্মিক মৃ”ত্যু রয়েছে তা শেষ সময়ে নিজেও বিশ্বাস করতে পারছেনা।

__________

পাভেল সহ প্রত্যেকের মুখে পড়া মাক্সগুলো খুলে ফেলেছে।এতক্ষণ এতসব কিছু পড়ে থাকা…আর সব ঘটনা মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। তবে তারা একটুও থেমে নেই বরং এখনো যে যার মতো কাজ করতে ব্যস্ত। চারপাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানান কাগজের সহ নানান ফাইল ঘাঁটতে বসেছে। পাভেল সকল সার্ভার ডাটা ডেস্ট্র”য় করতে ব্যস্ত। মোটামুটি তাদের প্রয়োজনীয় সব ফাইলই পেয়ে গিয়েছে। কিছু কিছু আলাদা ভাবে পেন ড্রাইভে ডাউনলোড করাও হয়ে গিয়েছে।পরবর্তীতে কাজে লাগতে পারে, এই উদ্দেশ্যেই। এরই সাথে এটাও জানা গিয়েছে যে লোকটি এস.পি.হান্সের ছেলে নিকোলাই হান্স।

এরই মাঝে কেনীথের হাতে পড়ল সেই ছিঁড়া চামড়ায় মোড়ানো পুরনো ডায়েরিটা। কেনীথ আগ্রহ নিয়ে ডায়েরিটা খুলতেই খানিকটা অবাক হয়। সে ভেবেছিল এই নিকোলাই হয়তো কোনো জার্মানি। কিন্তু ডায়েরির একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখে যে লাইনের পর লাইন সব লেখাই রুশ ভাষায় লেখা। কেনীথ কপাল কুঁচকে ওলোট পালোট করে দেখতে দেখতেই একটা জায়গায় গিয়ে তার নজর আঁটকে যায়। এদিকে তওকে এতো মনোযোগী হতে দেখে আনায়াও এসে তার পাশে দাঁড়ায়। ঠিক সে সময়েই কেনীথ প্রচন্ড বিস্ময়ের সাথে আওড়ায়,

“রাদিত্‌ — ইয়েশ্চো নে জান্‌চিত্‌ বিত্ব মাত্‌য়ের্যু। মায়া মামা লুসিয়া, নিকাগ্‌দা নে লিউবিলা মিন্যা…”

(জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। আমার মা লুসিয়া, কখনোই আমাকে ভালোবাসেনি…।)
—নিকোলাই হান্স

শুধু কেনীথ নয়, বরং আনায়ারও নজর আঁটকে গিয়েছে সেই একমাত্র শব্দে…”লুসিয়া”! এসবের রহস্য কি, তার সন্ধান তো এবার এই ডায়েরিতেই মিলবে।

চলবে_____________