একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৩৯(১ম অংশ)

0
18

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব→৩৯(১ম অংশ)

তিন রাত, তিন দিনের দু”র্ধর্ষ অভিযানের পর, অবশেষে তারা রাশিয়ায় ফিরেছে। হান্সের পুরো কোম্পানি বন্ধ করার দায়িত্ব এবার পাভেলের হাতে।অবশ্য তার বেশি একটা সমস্যা হবে না একাজ করতে। মূলত সে শুধু ডিরেকশন দেবে, বাকিটা তার লোকজনই ব্যবস্তা করে ফেলবে। এমনিতেও, তারা যেহেতু আন্ডারগ্রাউন্ডের লোক, তাই হান্সের ধ্বং”স তারা সকলের আড়ালেই করবে। মূল কথা তাদের আসল কাজ হলেই হলো।

তবে গতরাতে আকস্মিক হা”ন্সকে এতোগুলো গু*লি করার জন্য অবশ্য কেনীথের কথাও শুনতে হয়েছে পাভেলকে।তার হুটহাট মা’থা গরম করে কাজ করাতে কেনীথ বেজায় খানিক বিরক্ত।গতকাল নিকোলাই হান্সের লা”শের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কেনীথ বলেছিল,

“শা”লা মাথা কি একটু ঠান্ডা রাখতে পারিস না? ওতো গুলো গু”লি করার কি দরকার ছিল! এখন এই আধপঁ”চা লা”শটাকে নিয়ে কি করব? বেঁচে থাকলেও তাও কাজে লাগানো যেত।”

কেনীথের আফসোস আর রাগের মাঝে পাভেল আর কিছু বলেনি। অবশ্য বলেও লাভ নেই, হিসেবে বরাবরের মতো এবারও সে ভুল করে ফেলেছে। সে নিজেও মাঝেমধ্যে বুঝতে পারেনা, সে করতে চায় কি, আর শেষমেশ হয়টা কি! পাভেল খানিকটা হতাশ হয়েই কেনীথের সব কথা হজম করে নেয়।তবে কেনীথকে বড় ভাই হিসেবে মান্য করায়, তার সব বিদ্ঘুটে কথাবার্তা কিংবা রাগে সে কখনোই কেনীথের উপর রাগ দেখায় না। সে সাহস কিংবা মনমানসিকতা কোনোটাই যেন তার নেই।

জার্মানি থেকে ফেরার আজ প্রায় একদিন পেরিয়ে গিয়েছে। সেই সাথে ঘটে গিয়েছে অনেক কিছুই। রাশিয়ার আন্ডারগ্রাউন্ডের সবচেয়ে বড় মাফিয়া সাম্রাজ্য যেন পুরোটাই বদলে গিয়েছে। কেননা,এই সাম্রাজ্যের কর্তৃত্ব পালনকারী লেডিবস মাফিয়া এখন সাম্রাজ্যের সবকিছু ছেড়ে অনেকটাই দূরে। এতোটা বছর এই সাম্রাজ্যকে যে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, এই অবেলায় যেন তার অস্তিত্বই আজ হারিয়ে গিয়েছে। লুসিয়ার বর্তমান অবস্থান এখন খ্রিষ্টীয় আশ্রয়ে। সে তার ইচ্ছে অনুযায়ীই এই সিন্ধান্ত নিয়েছে।কোনো জোরজব”রদস্তি কিংবা বাঁধাতে নয়। আচমকাই তার এতবড় সিন্ধান্ত নেওয়া…না চাইতেও সবাইকে ভাবাচ্ছে। এমনিতেও লুসিয়া বলেছে সে সারাজীবনে মতো এইসব কিছু ছেড়ে দিয়েছে। বাকিটা এতো সহজেই সে এমন সিন্ধান্তই কেনো নেয়, এটা যেন কিছুটা রহস্য হিসেবে অজানাই থেকে যায়৷

জার্মানি থেকে ফেরার দিন সন্ধ্যায়,পাভেল, কেনীথ, আনায়াও লুসিয়া… চারজন চুপচাপ বদ্ধ রুমে বসে রয়েছে। কেনীথ আর লুসিয়ার মাঝে চলছে এক নীরব সংঘ”র্ষ। কেউ কারো কথার প্যাচে ফাঁসতে রাজি নয়। কেনীথের অভিব্যক্তি যেমন স্পষ্ট, লুসিয়ারও তেমন। তবে কিছুটা রহস্যজনক।

কেনীথ কোনো প্যাচ না রেখে সরাসরি লুসিয়াকে নিকোলাই হান্সের কথা জিজ্ঞেস করে। তারা ভেবেছিল লুসিয়া হয়তো ইনিয়েবিনিয়ে কথা এড়িয়ে যেতে চাইবে কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। আকস্মিক সে একে একে কেনীথকে সব বলতে শুরু করে। নেই কোনো সংকোচ, নেই কোনো দ্বিধা।

গল্পটা শুরু হয়, বহু বছর পূর্বে। লুসিয়ার জন্ম এক প্রভালশালী মাফিয়ার ঘরেই হয়। আর বিয়েও হয় কেনীথের নানা তথা মাফিয়া আর্তেমের সাথে। কিন্তু তার যৌবনের ভালোবাসা ছিল অন্যকেউ। সেই ভালোবাসার মানুষটাই ছিল, এস.পি.হান্স কিংবা সের্গেই পেত্রিন হান্স। যে ছিল দেশের অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের ছেলে। তার বাবা ছিল এক সাধারণ ব্যবসাহী। তবে পেত্রিন ছিল প্রচন্ড বুদ্ধিমত্তা ও আকর্ষণীয়। বিজ্ঞানের তুখোড় ছাত্র, হওয়ার পাশাপাশি তার রূপ, অভিব্যক্তি, সৌন্দর্য—যে কাউকে আকর্ষণ করতে পারত। আর তারই মায়াজালে ফেঁসেছিল লুসিয়া। শুরুতে সে কখনোই আর সবার মতো কঠোর হৃদয়ের মানুষ ছিলনা। তার কোমল হৃদয়ে খুব সহজেই সে পেত্রিনকে জাগয়া দিয়ে দেয়।

তাদের পরিচয়টা হয় ঠিক, কেনীথের বাবা মায়ের মতো। ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে গিয়েই তাদের ভালোবাসার সূচনা । এরপর তা গড়ায় বিয়ে অব্দি। কিন্তু এদিকে লুসিয়ার পরিবার কেউ কিছুই জানতে পারেনা। আর এদিকে তারা বিয়ের পর সিন্ধান্ত নেয় পালিয়ে যাবার।

তবে একটা প্রভাবশালী মাফিয়ার মেয়ে, একজন সাধারণ মানুষের সাথে পালিয়ে যাবে অথচ লুসিয়ার পরিবার কিছুই করতে পারবেনা, এমনটা তো হয়না। লুসিয়া জানতো, তারা পালালে তার পরিবার তাকে খুব অল্প সময়ে ঠিক খুঁজে বের করবে। আর হয়তো পেত্রিনকে মে”রে ফেলবে। কিন্তু সে এটা কখনোই চাইতো না এবং হতেও দিতো না। লুসিয়া যে শুধু কোমল হৃদয়ের এক সুন্দরী নারী ছিল, তা নয়। বরং তার বুদ্ধিমত্তায় যে কেউ ঘায়েল হতে বাধ্য ছিল। চালাকি সে নিজেও কম করেনি। নিজের পরিবারের গুপ্ত কিছু তথ্যের জোগাড় করে, সহজেই দুটো বছর সে নিজের পরিবার থেকে পালিয়ে বাঁচে। দুবছরে পেত্রিন আর লুসিয়া নিজেদের মতো সংসার সাজায়।আর পালিয়ে যাওয়ার খুব অল্প কিছুদিনের মাঝেই, লুসিয়ার গর্ভে আসে নিকোলাই হান্স। যার পুরো নাম সার্গেই নিকোলাই হান্স।

তিনজনের জীবন সংসার খুব সুখের মাঝেই কাটছিল। পেত্রিন হান্স ছিল যথেষ্ট ভালো মনের এক মানুষ। পড়াশোনা, সংসার আর গবেষণা…এই তিনটে মিলিয়েই তার জীবন৷ তবে তাদের সুখের সংসার বেশিদিন টিকতে পারেনি। এক অন্ধকার ঝড়ে সবকিছু ল”ন্ডভ”ন্ড হয়ে যায়। লুসিয়াস পরিবার অকস্মা তাদের খোঁজ পেয়ে যায়। তবে এখানেও লুসিয়া নিজের বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগায়। তার পরিবারের হাত থেকে পেত্রিন আর নিকোলাইকে বাঁচাতে সে তাদের জার্মানিতে পাঠানোর ব্যবস্তা করে ফেলে। রাশিয়া থেকে জার্মানি…নিজের প্রিয়তমাকে রেখে ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে এতোদূরের পথ পারি দেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না তার পক্ষে। আর সময়টাও ছিল তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর। সবমিলিয়ে অত্যন্ত ভোগান্তি আর কষ্ট নিয়েই বাবা ছেলের দিন কাটাতে হয়েছে।

ওদিকে ছেলে স্বামী নিরাপদে সরে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও, লুসিয়া বাদবাকি জীবন কাহিনি খুব বেশি সুখের ছিলনা। বাবা মায়ে কাছে একপ্রকার বন্দীর মতো জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে। দিনের পর দিন নানান ক”ষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। একদিকে যখন তার দুধের শিশুর জন্য হৃদয়ে চলছে হাহাকার, ঠিক তখনই খবর আসে লুসিয়াকে বিয়ে দেওয়ার সিন্ধান্ত নিয়েছে তার পরিবার। আরেক মাফিয়া সাম্রাজ্যের অধিপতি আর্তেমের সাথে।

লুসিয়া কোনো মতেই এই বিয়েতে রাজী ছিল না। তবে তার কিছু করারও ছিলনা। একে যে ম”রে গিয়ে বেঁচে যাবে সেই উপায়ও নেই। সে ম”রে গেলে তার বাচ্চা স্বামীকে দেখার মতো আর কেউ নেই। এদিকে অবশ্য লুসিয়ার পরিবার জানত না যে, লুসিয়ার একটা ছেলেও রয়েছে। অবশ্য এটা লুসিয়াই নিজের সর্বচ্চ চেষ্টায় গোপন করেই রেখেছে।

এরপর বহুবছর পেরিয়ে যায়। আর্তেমের ঘরে প্রচন্ড কঢ়া নিয়ম-কানুনের মাঝে তার জীবন কাটে। এই কয়েকবছরে নিজের স্বামী সন্তানকে দেখা তো দূরের কথা, বেঁ”চে রয়েছে কিনা ম”রে গিয়েছে, তা জানারও সুযোগও হয়না তার।দিনের পর দিন বহু চেষ্টা করে একদিন সে হাঁপিয়ে ওঠে।

এদিকে তার ঘরেও আরো দুটো সন্তান জন্ম নেয়।তখন তার আরো একটা ছেলের পাশাপাশি, একটা ফুটফুটে মেয়েও রয়েছে। এই নতুন সংসারও ভালোই কেটে যায়। তবে তার এই সন্তানদের চোখের সামনে বড় হতে দেখলেও, নিকোলাইকে একটিবারও দেখার সুযোগ হয়না।

এভাবে আরো কয়েকটা বছর কেটে যায়। এরইমাঝে লুসিয়া খোঁজ পায়, এস.পি.হান্স নামক একটা ছোট্ট কোম্পানির। তার আর বুঝতে বাকি থাকেনা, এটা তারই প্রথম স্বামীর গড়া প্রতিষ্ঠান। লুসিয়া আরো কিছু অনুসন্ধান চালিয়ে বিষয়টা নিশ্চিত হয়।এটা জেনে সে মনে মনে প্রচন্ড খুশি হয়। মনের কল্পনায় ভাবতে থাকে, এখন নিশ্চিত তার স্বামী সন্তানের আর কোনো কষ্ট রইবে না। একটা সময় আর্তেমের সংসারের পাশাপাশি, আর্মেতের নানান প্রোফেশনাল কাজে টুকটাক কাজ করে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, তা মন ধীরে ধীরে পেত্রিন আর নিকোলাই হতে সরে আসে।

এদিকে আর্তেমের ঘরের দুই ছেলে মেয়ে কিংবা নিকোলাই… তিনজনই এখন যথেষ্ট বড় হয়ে যৌবনে পা দিয়েছে। আর এমনই সময় হঠাৎ লুসিয়া খবর পায় পেত্রিন মা”রা গিয়েছে। কোনো এক কঠিন রোগেই তাকে পৃথিবী থেকে বিদেয় নিতে হয়। এটা জানার পর সে আর থাকতে পারেনি। কৌশলে আর্তেমের সাম্রাজ্য আর রাশিয়ার কঢ়া গন্ডি পেরিয়ে সে জার্মানিতে ছুটে যায়।সেখানে গিয়েও বাঁধে বিপত্তি। এতোবড় দেশে কোথায় খুঁজবে ওদের। হাতেও যে সময় কম। তবুও বহু চেষ্টার পর নিজের অত্যন্ত বিশস্ত লোকেদের দিয়ে লুসিয়া অবশেষে তার স্বামী সন্তানের ঠিকানা পায়।

এক বরফে ঢাকা শীতের মৌসুমে সর্বপ্রথম মুখোমুখি হয় নিকোলাই আর লুসিয়া। নিকোলাই তার মায়ের সম্পর্কে পেত্রিনের মুখে অনেক কথাই শুনেছে। যা শুনতো সবই যেন রূপকথার এক সুন্দর মনের সুন্দর রাণীর বর্ননা। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে, সেই সব গল্পই তার কাছে বি”ষাক্ত এবং বানো”য়াট মনে হতে লাগে। পেত্রিনের অজান্তেই যে তার ছেলে মায়ের প্রতি এক বিষাক্ত ঘৃ”ণা জন্ম দিতে শুরু করেছে, তা পেত্রিন নিজেও কখনো টের পায়নি।

এবং নিকোলাই আর লুসিয়ার সাক্ষাৎটা হয় একদম ভুল সময়ে। কেননা,লুসিয়া নিকোলাই এর সাথে দেখা করে জানতে পারে পেত্রিন মা”রা গিয়েছে আরো দুমাস আগেই। এটা শুনে লুসিয়া যতটা না ভেঙ্গে পড়েছিল, তার চেয়েও বেশি ক”ষ্ট পায় নিকোলাই এর অত্যন্ত ঘৃ”ণাপূর্ণ বা”জে ব্যবহারে। নিকোলাই যেন তাকে সহ্যই করতে পারেনা। ছেলে তার আজ বহু বড় হয়ে গিয়েছে। মায়ের প্রতি একটু আকটু ঘৃ”ণা অস্বাভাবিক নয়। তবে নিকোলাই এর ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। সেদিন ওভাবেই লুসিয়াকে রাশিয়ায় ফিরে আসতে হয়। একদিকে একটু স্বস্তি ছিল যে, বাবার পর নিকোলাই নিজেই নাকি এস.পি.হান্স কোম্পানির দায়িত্ব নিয়েছে। এখন ছেলে যা করবে তা হয়তো ভালোই করবে। সে নিজে সুযোগ না পেলেও যেন তার ছেলে ভালো থাকে।

তবে লুসিয়া বুঝতে পারেনি যে, তার অকস্মা জার্মানিতে আসায় আর্তেমের জন্য কতটা সন্দেহজনক ছিল। আর্তেম শুরু থেকেই লুসিয়াকে সন্দেহ করে আসছিল তবে, সেটা তেমন জোরালো ছিলনা। কারণ সে, লুসিয়ার বিয়ের পূর্বের কোনো ঘটনা সম্পর্কেই জানত না। পরবর্তীতেও জানা হতো না যদি, লুসিয়ার বিশস্ত লোকেদের মাঝে একজন গিয়ে আর্তেমকে জার্মানির ঘটনা সম্পর্কে না জানাত। এরপর বাকিসব কিছুই আর্তেম নিজেই খোঁজ নিয়ে সহজেই জেনে ফেলে।

লুসিয়ার মুখ এতোকিছু শোনার পর রুমের প্রত্যেকেই চুপচাপ বসে রইল। লুসিয়ার মুখোমুখি বসে থাকা কেনীথের হাতে তখন নিকোলাই এর সেই পুরোনো ডায়েরি। তার অভিব্যক্তি শূন্যতায় মোড়ানো। যেমনটা লুসিয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

কেনীথ ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে লুসিয়ার দিকে তাকায়। লুসিয়া চুপচাপ বসে রয়েছে। চোখ-মুখে কাঠিন্যের ছাপ।

—“তবে কি বাবুশকা… নানুর মৃ”ত্যুর পেছনের কারণটা কি তবে…”

—“নাহ্,তাকে আমি কিছু করিনি। সে যত যাই হোক, সে আমার স্বামীই ছিল। আমার সন্তানদের বাবা ছিল। এমনিতেও, আর্তেম সবকিছু জানার পর আমার কিংবা নিকোলাই এর কোনো ক্ষ”তি করেনি।”

লুসিয়ার সহজ অভিব্যক্তিতে কেনীথ আবারও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ওদিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পাভেল আর আনায়া শুধু শুনেই যাচ্ছে। কোনো কিছুই বলছে না তারা।

—“তবে নানু কেনো,তার সকল প্রোপার্টি-পাওয়ার আমাকে দিয়ে গিয়েছে? তাও এতো জল ঘোলা করে, যখন আমি নিজেই অনেক ছোট।”

লুসিয়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল,

“সে আমার অতীত সম্পর্কে জানার পর হয়তো ধারণা করেছিল, আমি একটা সময় পর নিশ্চয় তার প্রোপার্টি, পাওয়ার আমার প্রথম সন্তান… অর্থাৎ নিকোলাইকে দেওয়ার চেষ্টা করব। তাই তুমি হওয়ার পর হয়তো সে তোমাকেই যোগ্য ভেবে এই কাজটা করেছে। এমনিতেও তোমার জন্মের কিছু বছর আগে থেকেই সে কিছুটা অসুস্থ ছিল। যা ধীরে ধীরে বয়সের সাথে সাথে আরো বাড়তে থাকে। যে যত বড়ই ক্ষমতাধর হোক না কেনো, মৃ”ত্যুর চিন্তা একটা না একটা সময় সবাইকেই গ্রাস করে।”

রুমের মাঝে আবারও পিনপতন নীরবতা ভীড় জমায়। কেনীথ মাথা ঝুকিয়ে হাতে থাকা ডায়েরিটাকে দেখছে। এমন সময় আনায়া নীরবতা ভেঙ্গে সরাসরি লুসিয়ার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,

“আপনি পাভেল ভাইয়ের পরিবারকে কেনো মে”রেছিলেন?”

আনায়ার কথায় কেনীথের পাশাপাশি পাভেলেও কপাল কুঁচকে যায়। সে অবাক চোখে একবার আনায়াকে তো একবার লুসিয়া দেখতে থাকে। ওদিকে আনায়ার প্রশ্নে লুসিয়া একটুও ঘাবড়ে যায় না। বরং পাভেলের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ওর বাবা আমার বিস্তত কর্মীদের মাঝে অন্যতম ছিল। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, আমার জার্মানিতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্ক সবকিছু আগ বাড়িয়ে আর্তেমকে ওর বাবাই বলেছে…এটা জানার পর আর প্রয়োজন মনে করেনি তাকে বাঁচিয়ে রাখার।”

—“কিন্তু আপনিই তো বললেন,আপনার স্বামী তাতে কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করেনি। আপনার প্রথম ছেলে কিংবা আপনার সংসারেও কোনো নতুন সমস্যাও হয়নি। তবে কেনো আপনি এতো বড় কাজটা করলেন?”

আনায়ার কথা শুনে লুসিয়া কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। ওদিকে কেনীথ বিস্ময়ের সাথে বলে,

“এসবের মানে কি?”

—“আমার পরিবারে যে ভাঙ্গন ধরাতে চেয়েছে আমি তাকে বাঁচিয়ে রা”খব… এতোটাও ভালো তো আমি নই। ঠিক এই কারণেই, আমি ওর পরিবারকেও শে”ষ করে ফেলি। কিন্তু পাভেল ছোট ছিল বিধায়… ওকে আর মা”রার প্রয়োজন মনে করেনি। যে কারণেই, ও আজ তোমাদের সামনে।”

এসব শুনে কেনীথ আর পাভেলের অভিব্যক্তি হতে বিস্ময় কাটতেই না। এদিকে এসব শুনতে শুনতে পাভেলের চোখ বেয়ে একফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়েছে। কেনীথ ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে উঠে দাঁড়ায়। পাভেলের কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলে,

“তুই চাইলে রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে পারিস।”

পাভেল কিছুটা ভাঙা গলায় জবাব দেয়,

“নাহ, আমি ঠিক আছি।”

এদিকে লুসিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে সবটাই দেখে।কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসেও ফেলে। তবে এসব যেন তার কাছে বিরক্তিকর। কোনোকিছুতেই যেন তার কিছু এসে যায় না। উল্টো সে ভারী শ্বাস ফেলে কঢ়া গলায় বলে,

“আমি একটা সিন্ধান্ত নিয়েছি।”

কেনীথের পাশাপাশি আনায়াও কিছুটা আগ্রহী হয়ে তার দিকে তাকায়।ওমনি লুসিয়া বলে,

“তার আগে তোমরা বলো, তোমরা কি ডিসিশন নিয়েছো।”

কেনীথ কিছুটা কপাল কুঁচকে পুনোরায়, লুসিয়ার মুখোমুখি হয়ে বসে।

—“তুমি কেমন ডিসিশনের কথা বলছো?”

লুসিয়া কিছুই বলে না। বরং চুপচাপ বসে থাকে। তার অভিব্যক্তি একদমই নির্লিপ্ত। এরইমাঝে আনায়া বলে,

“আপনাকে একটা ব্যাপার এখনো বলা হয়নি। আপনার প্রথম পক্ষের একমাত্র ছেলে…সের্গেই নিকোলাই হান্স আর বেঁচে নেই।”

আনায়া ভেবেছিল লুসিয়া মা হিসেবে হয়তো একটু হলেও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়না। বরং সে নির্লিপ্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে,

“তোমরা মে”রেছো?”

আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে জবাব দেয়,

“হুম। ক্যাসেলে… উনি আমাদের আক্রমণ করতে নিলে…পাভেল ভাই পেছন থেকে গু”লি করে।যেকারণে তার তখন তখনই মৃ”ত্যু হয়।”

লুসিয়া পাভেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আওড়ায়,

“ভালোই হয়েছে…বিশ্বাসঘাতক।”

ওর এহেন চাহনি আর কথা শুনে পাভেল সহ কেনীথ আনায়াও কিছুটা অবাক হয়। এই লুসিয়ার মাথা আদোও ঠিক আছে!

—“আপনি কাকে বলছেন এটা…?”

আনায়ার কথা শুনে লুসিয়া মৃদু হেসে জবাব দেয়,

“যার বাবা আমার সাথে বিশ্বা”সঘাতকতা করেছিল তাকেই বলছি।”

আনায়া কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেলে। বুঝতে পারে যে, লুসিয়া রাগের বশে হয়তো পাভেলের কথাই বলছে। এদিকে আবার এসব দেখে, কেনীথ বলে,

“নিকোলাই হান্সের এই ডায়েরিতে বহুবার এটা লেখা রয়েছে যে, তার মা তথা তুমি কখনো তাকে ভালোবাসাওনি এবং বোঝোওনি? এই ঘৃ”ণাবোধটা কি শুরু থেকেই?”

লুসিয়া খানিক তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলে।

—“গাধা তো গাধাই হয়, সে কিভাবে মায়ের ভালোবাসা বুঝবে?”

কেনীথ চুপচাপ লুসিয়াস দিকে তাকিয়ে থাকে। তার অভিব্যক্তি নিত্যন্তুই অদ্ভুত।

—“তুমি কি এই ডায়েরিটা একবার দেখবে?”

—“নাহ, প্রয়োজন নেই। তোমাদের কাছেই রেখে দেও।”

—“নিকোলাই হান্সের প্রতি তোমার এই বিদ্বেষেের কারণ কি? যতই হোক, তুমি তার মা। সেক্ষেত্রে তার মৃ”ত্যুতে তো তোমার…।”

—“কি চাইছো?আমি ওর মৃ”ত্যুতে ক”ষ্ট পাব? জীবনে বহু মানুষ হারিয়েছি আমি। আমার বাবা মা,স্বামী হোক কিংবা ছেলেমেয়ে… প্রত্যেকেই আমায় ছেড়ে আজ বহু দূরে। আর কত কাঁ”দতে বলো আমায়?
আর রইল, নিকোলাই এর প্রতি আমার বিদ্বে”ষ। সব ঠিকই ছিল তবে ও আমার মর্ম বুঝতে পারেনি। আমাকে যেমন নিজের শ”ত্রু ভেবেছে, তেমনি আবার আমাকে দিয়েই নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে চেয়েছে। অপ”দার্থ… সাইকো ছিলো একটা।”

লুসিয়ার কন্ঠস্বর নিরেট, অথচ এসব বলতে বলতেই তার মতো এতো কঠোর মানুষের চোখ বেয়েও একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। লুসিয়া তা নিমিষেই মুছে ফেলে,পুনোরায় নিরেট কন্ঠে বলে উঠল,

“যাই হোক, তোমাদের আর কোনো কিছু জানার থাকলে বলো। নয়তো আমাকে আবার কনভেন্টের যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। যদিও সবকিছু গুছিয়েই রেখেছি, বাকি আরো কিছু কাজ এখনো বাকি।”

লুসিয়াস এ কথা শুনে কেনীথ আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়।কেনীথ বলে ওঠে,

“তুমি হঠাৎ কনভেন্টে…হঠাৎ এ সিন্ধান্ত? কদিনের জন্য?”

লুসিয়া মুচকি হেসে জবাব দেয়,

“হয়তো অবশিষ্ট পুরো জীবনটার জন্য।”

—“আর ইউ সিরিয়াস? ভেবে চিন্তে বলছো তো?”

—“না ভেবে চিন্তে, কোনো কাজ করিনা আমি, কেনীথ!”

কেনীথের পাশাপাশি আনায়াও প্রচন্ড বিস্মিত। ঘটনা কি? লুসিয়ার মতো মানুষ হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত। এদিকে আনায়া তো ভেবেছিলো, লুসিয়া যা করেছে সব এই সম্পত্তি আর ক্ষমতার জন্যই করেছে। অথচ এখন বলছে, সবছেড়ে সারাজীবনের জন্য আশ্রমে চলে যায়। এই নিয়ে তার বিস্ময় তো কাটছেই না। এদিকে লুসিয়া আবারও কিছুটা মুচকি হেসে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলল,

“এই সবকিছু এখন তোমার। সবসময় এটা মাথায় রাখবে। জীবন নিয়ে এতো হেলাফেলা করো না। যা করবে নিজের বুদ্ধিতে করবে। নিজের সিন্ধান্তকেই সর্বচ্চ মূল্যায়ন করবে।তা যেমনই হোক না। দশ মুখের সিন্ধান্তের চেয়ে,নিজের ভুল সিন্ধান্তও অনেক সময় ভালো হয়। চোখ কান খোলা রাখবে, স”তর্ক থাকবে সবসময়।”

এটুকু বলা শেষ হলেই, লুসিয়া একবার কেনীথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনায়া আর পাভেলকে একপলক দেখে নেয়। পরবর্তী আবারও কেনীথের দিকে মুচকি হেসে বলে উঠল,

“পারলে ভালোবাসতে শেখো। তবে ভুল মানুষকে নয়। জীবন কাকে কোথায় নিয়ে যায়, তা তো বলা যায় না।তবে আশা রাখছি, তোমরা ভালো থাকবে।”

লুসিয়া এটা বলেই অকস্মা দাঁড়িয়ে যায়। তার এই কথায় আদতে কি ছিল তা কেউই বুঝতে পারেনা। সে ছোট করে বিদায় নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে।অথচ তার ছড়িয়ে দেওয়া, এক অজানা রহস্য যেন বদ্ধ ঘটেই আঁটকা পড়ে থাকে। তবে চলে যাওয়ার পূর্বে সে কেনীথকে নিজের কাছে, ডেকে আরো একটা কথা বলে,

“তুমি সাধারণ কেউ নও। তুমি কে তা কোনোমতেই কখনো ভুলে যেও না। এই অফুরন্ত ক্ষমতার কখনোই কোনো অপ”ব্যবহার করো না। আর কাউকে করতেও দিও না। এতটুকুই চাওয়া আমার। ভালো থেকো। কয়েকমাস পর হয়তো রোজ ফিরে আসবে। ওর দায়িত্বটা না হয় তোমাকেই দিলাম। মেয়েটা একটু পাগল…তবে নিজের বোন ভেবেই ওর খেয়াল রেখো।”

এই কথাগুলো বলার মূহুর্তে লুসিয়ার অভিব্যক্তি ছিল অদ্ভুত। নাহ্,সে মোটেও কাঁদছিল না। নিরেট ছিল তার অভিব্যক্তি। তবে তার বলা প্রতিটা শব্দে যেন এক নীরব ক্রন্দন বিদ্যমান।

লুসিয়া দরজার কাছে এসে, শেষবারের মতো ঘরটার দিকে ফিরে তাকায়। কক্ষটায় তখন এক ধরনের ভারী নীরবতা ছড়িয়ে।তার চোখে জল নেই, কিন্তু মুখে এক অব্যক্ত বি”ষাদের রেখা।
সে নিঃশব্দে দরজার হাতলে হাত রাখে।তারপর হঠাৎ থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য । যেন ভেতরে কিছু আটকে গিয়েছে। কান্না নয়, কেবল একরাশ অপ্রকাশিত কথা।

তার ঠোঁট হালকা নড়ে ওঠে। যেন মনে মনে কিছু বলল,কিন্তু কেউই শুনতে পেল না।দরজা খোলার আগে সে খুব নিচু স্বরে বলতে থাকে,

“আজ যা অব্যক্ত হিসেবে রেখে গেলাম। আমি চাই, খুব দ্রুত তা কেনীথ খুঁজে বের করুক।”

একই মুহূর্তে বাতাসে এক অদ্ভুত ঠান্ডা স্রোত বইতে থাকে। জানালার পর্দা একটু নড়ে ওঠে। মনে হয়, সময় নিজেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।আলতো পায়ে হেটে লুসিয়া ঘর ছাড়ে। শব্দ না করে ধীরে ধীরে সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। কেউ কিছু বলে না, কেউ তাকে থামায় না।তবে তার চির বিশ্বাস,সবাই তার সেই শেষ চাহনিকে, সেই না-বলা কথাগুলোকে গেঁথে নিয়েছে।

বাইরে বেরিয়ে লুসিয়া মাথার স্কার্ফটা একটু টেনে নেয়। আকাশ তখন ধূসর, নীলচে-ছাই রঙের মেঘ ও লাল আভায় ছেয়ে গিয়েছে ।সে হেঁটে চলে যায়, ধীরে ধীরে, একটি গন্তব্যহীন পথের দিকে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সে যা রেখে গেল, তা শুধুই দায়িত্ব নয়, বরং এক দীর্ঘমেয়াদি ধোঁয়াশা…আর যেন এক পরোক্ষ নব যু”দ্ধের সূচনা।

________

প্রাসাদ সমতুল্য বাড়িটায় এখন শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। যেন বাড়ির মূল অস্তিত্বটাই মিলিয়ে গিয়ে শ্ম”শানে পরিনত হয়েছে। বাড়ির সার্ভেন্ট থেকে শুরু করে সকল কর্মী— প্রত্যেকেরই কাজকর্মে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে।

নিজের ঘরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে কেনীথ। শরীরের প্রচন্ড ক্লান্তি, আর একইসাথে ঘুমের ঔষধের রিয়াকশন। কেনীথ গায়ে হালকা কম্বল টানা। তার পাশে বিছানার একপাশে, কেনীথের মাথার কাছেই বসে রয়েছে আনায়া। তার পাশেই টেবিলের উপর আবার এঁটো প্লেট রাখা। একটু আগেই খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছে কেনীথকে। যদিও সে কেনীথকে ব্যাথার ঔষধের পাশাপাশি, না জানিয়েই ঘুমের ঔষধ দিয়েছে। এটা সে কেনো করেছে, তা নিয়েই তার মাঝে এখন দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে। এছাড়া হাতে তার রয়েছে সাইলেন্সার লাগানো কালো রংএর পিস্ত”ল। কেনীথের বুকের আশেপাশে বারবার ওটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নাড়াচাড়া করছে। হাতের আঙুল শক্ত ভাবে ট্রিগারের উপর ছোঁয়ানো থাকলেও, তার অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। সম্পূর্ণ চাহনি তার কেনীথের ঘুমন্ত মুখের উপর।

লুসিয়া গতকালই চলে গিয়েছে। কোনো বাঁধা মানেনি। আনায়া নিজেও বুঝতে পারেনি ঘটনাটা কি হলো। তবে এরইমাঝে আরো এক খবর যেন আনায়ার সবকিছুকে এলোমেলো করে দেয়। ভেঙে দেও, নতুন করে কোনো অনুসন্ধানের মন-মানসিকতাও।

ইনায়ার শারিরীক অবস্থার অকস্মা অবনতি হচ্ছে। এটাই বিশেষ করে তাকে বেশি ভাবাচ্ছে। কি ছেড়ে কি করবে মাথায় আসছে না।তবে সে যে আর কেনীথের সাথে থাকবে না এই সিন্ধান্তে সে একদম অটল। তবে হয়তো খুব তাড়াতাড়িই তার এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। আনায়া তেমন কিছুই ভেবেছে। তবে শেষমেশ কেনীথকে মা”রার পরিকল্পনা আর সফল হলো না। প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই সে কেনীথের পাশে পিস্তল হাতে নিয়ে বসেছিল। গতকাল অবশ্য কেনীথের সাথে তার কিছু কথা-কাটাকাটিও হয়েছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে কেনীথ আনায়াকে সাফ জানিয়ে দেয় যে,সে চাইলে যেন তাকে মে”রে ফেলতেও পারে। কেনীথ তাতে কোনো বাঁধা দেবে না। কিন্তু কেনীথের এতোবড় সম্মতি থাকা সত্ত্বেও, সে তাকে কিছুই করতে পারল না।

আনায়া কেনীথের বুক থেকে পিস্তলটা সরিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এবং সেই সাথে বলে উঠল,

“দীর্ঘজীবী হোন!”

এই বলেই আনায়া পিস্তলটাকে ট্রের একপাশে রেখে এঁটো খাবারগুলো নিয়ে রুমের বাহিরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। দরজার কাছে এসে পেছনে ফিরে, শেষবারের মতো কেনীথকে একপলক দেখে আওড়ায়,

“আমাদের আর কখনো দেখা না হোক। ভালো থাকবেন।”

আনায়া রুম থেকে বেড়িয়ে, দরজা চাপিয়ে দেয়। ঠিক তখনই ওদিক থেকে পাভেল কে আসতে দেখে সে থেমে দাঁড়ায়। আনায়ার অভিব্যক্তি পাভেলের কাছে অদ্ভুত লাগে। আর কাছে আসতেই যখন, ট্রে এর মাঝে পিস্তল দেখে তখনই যেন ওর হুঁশ প্রায় উড়ে যায়। আনায়া ওর অকস্মা উদ্বিগ্ন হবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে,কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। পাভেল যেন সে হাসিতে আরো বেশি ঘাবড়ে যায়। তবে আনায়াকে আশ্বস্ত করে বলে,

“চিন্তা করবেন না। মা’রতে গিয়েও মা” রতে পারিনি। কেনো যেন আর সম্ভব হলো না। আপাতত তিনি ঘুমাচ্ছেন।”

আনায়ার কথা শুনে পাভেল কিছুটা স্বস্তি পেলেও সে অবাক হয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে আনায়া আবারও বলে,

“সে যাই হোক, আপনাকে আমার একটা সাহায্য করতে হবে। যদি সম্ভব হয় তবে করবেন।আর যদি আমাকে ঘৃ”ণ্য লাগে তবে করার প্রয়োজন নেই।”

—“ছিঃ ছিঃ… এসব কেনো বলছেন? বলুন কি করতে হবে?”

আনায়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, মুচকি হাসে।

—“আমি আজ রাতের মাঝেই রাশিয়া ছাড়তে চাচ্ছি। উদ্দেশ্য দূরে কোথাও চলে যাব। এই শহর, আপনার কিংবা বিশেষ করে কেনীথ… সবার থেকে দূরে।”

পাভেল কিছুটা বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,

“হঠাৎ এমন সিন্ধান্ত?”

—“হঠাৎ নয়, এই সিন্ধান্ত আমার বহু আগের। হোয়াট এভার, একদিন না একদিন এসব ছেড়ে যেতেই হতো আমায়। তবে আজ চলে যাওয়াটাই হয়তো বেশি ভালো হবে। এমনিতেও খবর এসেছে, ইনায়ার দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। ওকে আমার প্রয়োজন।”

—“জ্বী বুঝেছি, কিন্তু ভাইয়েরও তো আপনার প্রয়োজন। তার কি হবে?”

পাভেলের কথায়, আনায়া কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পরবর্তীতে নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেয়,

“তার জন্য আপনি রয়েছেন। আশাকরি আপনি এবারও সব সামলে নেবেন।”

—“হাহ্…আমি আর আপনি এক নাকি?”

—“তা অবশ্য ঠিক,আপনিই বা আর ক’দিন এসব সহ্য করবেন। তবে একটা উপায় অবশ্য রয়েছে। যা মাধ্যমে আপনি কিংবা উনি, দু’জনেই মুক্তি পেতে পারেন। এমনটা না হলেও, একটা নতুন সুস্থ জীবন পাবেন।”

পাভেল কিছুটা উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করে,

“কি উপায়?”

—“আপনারা দু’জন মিলে নিজেদের পছন্দ মতো কাউকে খুঁজে বের করে নিন। এরপর বিয়ে-শাদি করে,শান্তিতে সুখে সংসার করুন। আর কতদিন এসব অশান্তির জীবন কাটাবেন?”

আনায়ার কথা শুনে পাভেল ফিক করে হেসে ফেলল।

—“হাসালেন আপনি!”

—“আমি মোটেও হাসির কিছু বলিনি।”

আনায়ার নির্লিপ্ত জবাবে, পাভেল আরো হেসে ফেলল।

—“ভাই এসব জানতে পারলে, আপনাকেও ছাড়বে হা।আমাদের দু’জনকে মে”রে, দুনিয়া ছাড়া করবে।”

আনায়া কিছুই বলে না বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।ওদিকে পাভেল নিজেকে থামিয়ে, এবার কিছুটা সিরিয়াস হয়।

—“ব্রো কি জানে, আপনি চলে যাচ্ছেন?”

—“নাহ্, তাকে কিছুই বলা হয়নি। আমি চাইছিও না আপাতত সে কিছু জানুক। আমি চলে যাওয়ার পর না হয় আপনি তাকে জানিয়ে দেবেন। তবে দয়া করে আমার সন্ধান আপনি তাকে দেবেন না।”

—“এটা কি করে সম্ভব? আগেরবার না হয়, আমি মৃ”ত হওয়ার অভিনয় করে পার পেয়ে গিয়েছেন। এবার তো ব্রো জানে আপনি বেঁ”চে….”

—“এই কারণেই আমি আবারও আপনার সাহায্য চাইছি।তাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আপনার। তার পক্ষে আমার ঠিকানা বেরা করাটা, কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়।আপনি সাহায্য না করলেও, সে এটা ভিন্ন উপায়েও করতে পারবে।তাই আমি চাইছি, আপনি তাকে বোঝান। যেন আর আমার জীবনে তার ফিরে আসার কোনো প্রয়োজন না পড়ে। আমিও চাইনা আর তার জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকতে।”

—“তবে এটাই কি আপনার ফাইনাল ডিসিশন? ”

—“জ্বী! আপনি ইনায়াকে আমার কাছে পাঠানোর ব্যবস্তা করুন। এখানে যেহেতু আমার আর কিছুই নেই, তাই এবার সরাসরি নতুন গন্তব্য…!”

__________

প্রায় একটা মাস কেটে গিয়েছে। রাশিয়ার সেই জটিল শহর থেকে কানাডার টরেন্টো শহরে পাড়ি দিয়েছে আনায়া। আর সঙ্গে এনেছে তার ছোট বোন ইনায়া। ইনায়াকে আনায়ার কাছে নিয়ে আসার ব্যবস্তা সহ সবকিছুতেই পাভেল যথাসাধ্য সাহায্য করেছে।তবে এখানে আসার পর খুব প্রয়োজন ব্যতীত তার সাথে আর যোগাযোগও হয়নি।

এদিকে এখনো ইনায়া পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কখনো চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। তবে একদমই কথা বলে না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ হু হা করে মাথা নাড়ায়। নিজের নামটাই অবশ্য মনে রাখা দায় হয়েছে তার। একদিকে যেমন শারিরীক অসুস্থতা,অন্যদিকে আবার মানসিক ট্রিটমেন্ট,মেডিসিনের রিয়াকশন… সবমিলিয়ে আদও সে ঠিক হচ্ছে না, নাকি আরো অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে তা আনায়া বুঝে উঠতে পারেনা। বেশিরভাগ সময়-ই সে ঘুমিয়ে থাকে। আর যতক্ষণ জেগে রয়, ততক্ষণ তার ভাবনার বিচরণ যেন সর্বদা এক অন্ধকার ঘোরের মাঝে…।

হাঁটাচলা ঠিকঠাক করে নিলেও,বেশির ভাগ সময়-ই আনায়া সাহায্য করে। খাবার, ঔষধও সবসময় আনায়াই খাইয়ে দেয়। আজকাল তো খাবার মুখে তুলতেও ভুলে যায় সে। আনায়ার বহু ডাকের পর খানিকটা চমকে উঠে সাড়া দেয়।এছাড়া মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে অজানা সব ভয় চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসে। ডাক্তারের মতে, ওর মধ্যে এখনোও একধরনের সাইকো সাইলেন্স কাজ করছে। আপাতত ট্রিটমেন্ট চলছে…নিয়মিত থেরাপি, ওষুধ আর মন মস্তিষ্ক শান্ত রাখার প্রচেষ্টা।

অন্যদিকে, আনায়া বেশ শান্তভাবেই তার বোনের যত্ন নিচ্ছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে, একরকমই নির্বিঘ্ন জীবন কাটানোর। যদিও তার মন মস্তিষ্ক এখনও অনেক কিছু নিয়ে জড়িয়ে। যা থেকে সে নিজেও বেরিয়ে আসতে পারছে না। এক মাস আগে, রাশিয়া থেকে চুপচাপ, কাউকে কিছু না জানিয়ে…আনায়া ইনায়াকে নিয়ে কানাডা চলে আসে। তার চিন্তা ভাবনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত ছিল যে, এখানকার পরিস্থিতি হয়তো ইনায়ার জন্য ভালো হবে। কিন্তু আদতে এমন কিছু হয়েছে কিনা তারও যথাযথ উত্তর আনায়ার কাছে নেই।

আনায়া টরেন্টোর একটি শান্ত উপশহরে ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। তার বাসাটি আধুনিক, তবে খুব বেশি বড় নয়। তবে এটিই তার এবং ইনায়ার জন্য যথেষ্ট। দুটো রুম—একটা আনায়ার আরেকটা ইনায়ার। ছোট রান্নাঘর, বারান্দা আর একটা ড্রইংরুম…সবমিলিয়ে ভালোই দিন কাটছে তাদের। তবে এসবের মাঝে আনায়া তার অগোছালো জীবনে একটা রুটিন তৈরি করে নিয়েছে। যাতে তার বোনের যত্ন নেওয়া সহজ হয়।

টরেন্টোতে আসার পর আনায়া প্রথম কয়েক সপ্তাহ পুরোপুরি ইনায়ার চিকিৎসা আর মানসিক অবস্থার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। শুরুতে ছিলো কিছু সঞ্চিত টাকা, সঙ্গে বাকি যা যা লাগে তার সবই পাভেলের সহায়তা।

কিন্তু এভাবে সাহায্য নিয়ে তো আর সারাজীবন চলতে পারবে না তারা। সম্পর্ক যখন ছিন্ন করে এসেছেই তবে পুরোপুরিই করা উচিত। যদিও তার মনেপ্রাণে ইচ্ছে ছিল, তাদের চলে আসা সম্পর্কে যেন পাভেলও কিছু না জানে। কিন্তু পাভেলের সাহায্য ছাড়া এইসব কিছু আরো বেশি কঠিন হয়ে যেত।বিশেষ করে কেনীথকে সামলানোর কাজ সে পাভেলকেই দিয়ে এসেছে। অন্তত আর পুরোনো কোনো মুখের সম্মুখীন হতে চায় না সে।

মূলত এসব কারনেই, এখানে আসার পর আনায়া একটা পার্ট-টাইম হোম অফিস জব শুরু করে।একজন অনলাইন কনটেন্ট রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করতে হয়, এক বিদেশি এজেন্সির জন্য।যেকারণেই দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়টা, কাজের দরূন ল্যাপটপের সাথেই কাটাতে হয় তাকে। বাকিটা সময় কাটায় সে ইনায়ার পাশে। যদিও এই কাজগুলো খুব চ্যালেঞ্জিং নয়। কিন্তু মনঃসংযোগও লাগে—যা ওর পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না।

এসবের পাশাপাশি আনায়া একটা স্থানীয় লাইব্রেরিতে সপ্তাহে দুদিন ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে। সেখানে ছোট শিশুদের গল্প পড়িয়ে শোনায়।অবশ্য এই জায়গাটা তার নিজের মনকেও একটু শান্তি দেয়। যেন নিজের ভেতরের ভাঙন গুলো কিছু সময়ের জন্যও হলেও জোড়া লাগে।বর্তমানে তার একমাত্র স্বপ্ন—ইনায়াকে সুস্থ করা।এই শান্ত নিস্তব্ধ ও ব্যস্ততা মিশ্রিত শহরে…এই বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাগুলোর ফাঁকে, সে আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেকে একত্রে ধরে রাখার।

দুজনের জীবনই এখন নিত্যান্তই সাধারণ। তবে গুছানো এক জীবন গড়ে তুলেছে তারা। আনায়া নিজেই রান্না করে, বাজার করে, ইনায়াকে ঠিক সময় ওষুধ দেওয়া, ওর সাথে গল্প করা… যদিও সবসময় শুধু আনায়াই বলে যায়; ইনায়া হতে কখনোই কোনো উত্তর মেলে না। এছাড়াও ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট ডেট অনুযায়ী ইনায়াকে চেকআপের জন্য নিয়ে যাওয়া…সবমিলিয়ে মোটামুটি একটা ব্যস্ত জীবনের মাঝে জড়িয়ে গিয়েছে সে।

কানাডার এই সিজনটায় মোটামুটি ভালোই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির দেখা মেলে।আজও তার ব্যতীক্রম নয়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতে চলল।অথচ টরেন্টোর আকাশে এখনো ভারী মেঘ। ঠাণ্ডা, কুয়াশাভেজা এক সন্ধ্যা। বাড়ির চারপাশে থাকা ম্যাপেল লিফ গুলো ঝড়ে গিয়ে পানির সাথে মিশে ঘাসের উপর লেপ্টে রয়েছে।

দিনশেষে বৃষ্টি এখন টুপটাপ করে জানালায় গায়ে আছড়ে পড়ছে। ঘরের দেয়ালে তার একটানা শব্দ বিরাজমান। এই শহরের গ্রীষ্মকালেও মাঝেমাঝেই এমন বৃষ্টি নামে। আর এই সপ্তাহটায় যেন আরও বেশি উদাসীন হয়ে উঠেছে।

আজ সন্ধ্যায় ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু আনায়ার চোখে কোনো উজ্জ্বলতা নেই। সে জানালার পাশে কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছে। তার স্টাডি টেবিলের উপর বইপত্র ফাইল সহ নানান জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জীবনটা তার অসহনীয় ঠেকছে। কিন্তু সবকিছু মেনে নেওয়া ব্যতীত তার যেন আর কিচ্ছু করার নেই।

সবসময় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এমন বৃষ্টি দেখতে মোটেও ভালো লাগে না তার। তবুও তার স্তব্ধ চোখজোড়ার বিধ্ব”স্ত চাহনি এখানেই থেমে থাকে । চোখের নিচে স্পষ্ট কালচে দাগ, মুখে ক্লান্তির ছায়া। চোখেমুখে বিধ্ব”স্ততা। সবমিলিয়ে আনায়া নিজেও যেন এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। প”ঙ্গু হয়েছে তার অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা।

আনায়ার গায়ে একটা কালো চাদর জড়ানো।পরনে ঘিয়ে রঙের লম্বা কুর্তি। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করে রাখা। অভ্যাসগত কারনে বিকেলের সময়টুকু এবং সন্ধ্যার পর ইনায়াকে খাবার,ঔষধ ও ঘুম পাড়িয়েই জানালার ধারে বসা হয় তার। ইদানীং ইনায়া চোখ বড় বড় করে এক জায়গায় তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দেয়ালের দিকে হাত বাড়িয়ে কিছুকে ছুঁতে চায়।আনায়া জানে, তার বোনের ভেতর এখনো একটা অদ্ভুত নীরব যুদ্ধ চলছে।তাই প্রতিটা সন্ধ্যায় সে যতটা পারে চুপচাপ থাকে। যেন শব্দ না হয়… যেন ইনায়ার মস্তিষ্কে আবার নতুন কোনো ঝড় না উঠে।

বরবারের মতো একটা কফির মগ তার দু’হাতের মাঝে নিবদ্ধ।যদিও তাতে কোনো উষ্ণতা নেই। অনেকক্ষণ আগেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।

আনায়া কখনো তার সামনে পড়ে থাকা ডায়েরিটার দিকে তাকায়, তো কখনো চুপচাপ বাহিরে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে চাপা ক্লান্তি, কিন্তু চোখে একরকম দায়িত্ববোধের দীপ্তি। এখানে আসার কিছুদিন পরেই অজানা এক কারণে ডায়েরিটা কিনেছিল সে। কেনো কিনেছে আনায়ার তা জানা নেই। কখনো এটাকে তার প্রচন্ড অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, তো কখন ভাবে এটাকে প্রয়োজনীয় করার দায়িত্ব তো তার। কিসব অদ্ভুত দ্বিধাবোধে আঁটকে পড়েছে সে, তা নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না। এই যে, সেই বিকেল থেকে ডায়েরিতে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছিল। তবে সে দু’এক লাইনের বেশি কিছুই লিখতে পারেনি। আবার সেই দু’লাইনও আনায়া বি”শ্রী ভাবে কলমের কালিতে ভরাট করেছে। এসব নতুন নয়, পুরো ডায়েরির বেশিরভাগ জায়গাতেই এমন দৃশ্যের দেখা মেলে।

তার অনুভূতিরা যেন আজ সব মরে গিয়েছে। আনায়া বুঝতে পারছে না, ইনায়ার মতো সে নিজেও কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? হতে পারে… আনায়ার খুব বেশি একটা ভাবতেও ইচ্ছে করেনা এখন। কেমন যেন মাথা ধরে যায়। প্রচন্ড রাগ ওঠে—চারপাশের সবকিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। সবই যেন তার চোখের সামনে ভাসে। তবে কিছুক্ষণ সময় পরই সে আবারও শান্ত হয়ে যায়। এছাড়া আর কি করবে! কিছুই তো তার করার নেই।

আনায়া এখন আরো একটা অভ্যাস গড়ার চেষ্টা করছে। জানে হয়তো, এটা একপ্রকার পাগলামি। কিন্তু আনায়া চাচ্ছে এমনটা হোক।সেও ইনায়ার মতো সব অতীত ভুলতে চায়। সেই সাথে অতীতের সকল মানুষ ও তাদের স্মৃতি…। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত এমন কিছুই হচ্ছে না। একটা না একটা সময় ঠিকই, তিক্ত অনুভূতিতে জড়ানো মানুষ গুলো তার ভাবনায় এসে ধরা দেয়।

এক ধ্যানে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতেই আনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ওদিকে পাশের রুমে ইনায়া এখন ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যার সময়ই তার রাতের খাবার ও ঔষধ খেতে হয়। এরপর সোজা গভীর ঘুৃমে ডুবে যায়। অথচ আনায়ার নিঃশ্বাসে অস্পষ্ট আত”ঙ্ক আর মনে অদ্ভুত শূন্যতা। কতরাত যে নির্ঘুম কাটাতে হয় তার হিসেব আনায়া নিজেও কখনো রাখেনা।

এমনই সময়, সন্ধ্যার আলো ম্লান হতে হতে হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ে।সেই শব্দ ঘরের স্তব্ধতা ছেদ করে।শুরুতে আনায়া নির্বিকারে বসে রয়। ভেবে নেয় হতো তার মনের ভুল।তবে একই শব্দটা আবার হয়। এবার একটু জোরে।

এতে আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলে। এই সময় তো কেউই আসেনা। আর আসারও কথা নয়। তবে কি নিচ তলার সেই বয়স্ক বাড়িওয়ালা…নাহ্, সে এসময় ইনায়ার মতো ঘুমিয়ে থাকে। আনায়া ত্বরিত উঠতে নিয়েও, সে দাঁড়াতে পারেনা। যার ফলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে হয় তাকে। ইদানীং শরীর প্রচন্ড ভারী লাগে। চেহারার রং দিনদিন ফেঁকাসে হয়ে যাচ্ছে। পায়ের নিচে কাঠের মেঝেতে হালকা ঠাণ্ডা স্যান্ডেল গলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। হাতে কোনো তাড়াহুড়া নেই। মনে আর তেমন কোনো প্রত্যাশাও নেই।তবে দরজাটা খুলতেই হঠাৎ থেমে যায় সে। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তার সামনে স্ব শরীরে পাভেল দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখ-মুখ আর হাভভাবে পরিষ্কার করে বোঝা যাচ্ছে না, ঘটনা কি! হঠাৎ কিছু না জানিয়েই সে কেনো এখানে… আনায়া ঠিক বুঝতে পারছেনা।

আনায়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাভেল চোখ নামিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ায়। আনায়ার চোখ পেরিয়ে তখন দৃশ্যমান হয় কেনীথ।

ভেজা কালো রঙের লম্বা কোটের কাঁধের, চারপাশে বৃষ্টির ছাপ। ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে কপাল বেয়ে পড়ছে। মুখে কোনো কথা নেই, চোখে কোনো প্রশ্ন নেই।শুধু চুপচাপ তাকিয়ে আছে সে।

এদিকে আনায়া সম্পূর্ণ স্তব্ধ চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে। যেন বাস্তব বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে।মুখের আগায় কিছু কথা বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। কেবল এক ভারী নিঃশ্বাস শ্বাসনালীর মাঝে আঁটকে রয়েছে। বুকের মাঝে ঝড় উঠেছে, অথচ সে বলার মতো কোনো শব্দও খুঁজে পাঁচ্ছে না।

দুজনই দাঁড়িয়ে থাকে একে অপরের সামনে।একটা নিঃশব্দ, ঠাণ্ডা সন্ধ্যায়… একজনের অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত, তো অন্যজন বিস্মিত। পেছনে বৃষ্টির শব্দ, আর ভেতরে জমে থাকা হাজার প্রশ্ন, অনুশোচনা কিংবা অভিমান।সবকিছু মিলিয়ে যেন পুরো মুহূর্তটায় সময় থমকে গিয়েছে।

কেনীথ বরাবরের মতো একবার আনায়াকে শান্ত, শীতল-অদ্ভুত চোখে পরখ করে দেখল। চোখমুখের বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট। অবশ্য হওয়া-ই উচিত। প্রায় একমাস পর দুজন আবারও মুখোমুখি। আনায়া হয়তো ভেবেই নিয়েছিল, সে আর আসবে না। অথচ আজ তার আগমন আনায়ার মাঝে ঝড় উঠিয়েছে।
কিন্তু কেনীথ ভাবছে অন্যকিছু। আনায়াকে পরখ করতে দেখে গিয়ে তার কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়।এমন বিধ্ব”স্ত আনায়াকে দেখেছিল সে বহু বছর পূর্বে। তাদের সন্তানের মৃ”ত্যুর আগ সময়টাতে আনায়া এমনটাই ছিল। হঠাৎ এতো বছর সেই একই রূপে আনায়াকে যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারল না সে।

সে তো ভেবেছিল আনায়া এতো সবকিছু ছেড়ে আসার পর নিত্যন্তই খুশি আর শান্তিতে রয়েছে। অন্তত তার চেয়ে তো হাজার গুণে ভালো থাকার কথা। কিন্তু এখন তো দেখছে সম্পূর্ণ চিত্রটাই ভিন্ন।

এদিকে তাদের দুজনের মাঝে এহেন নীরবতা দেখে পাভেলের খানিকটা ইতস্তত বোধ হয়। বিষয়টা খানিক কাবাবে হাড্ডি হওয়ার মতো। এখান থেকে চলে যাবে কিনা তাও বুঝতে পারছে না।তবুও পাভেল খানিকটা গলা খাকিয়ে উঠতেই, আকস্মিক থমকে যাওয়া দুজনেই স্বাভাবিক হলো। তবে কেনীথ তার পা বাড়িয়ে রুমে প্রবেশ করতে নিলে, আনায়া নির্লিপ্ত ভাবে নিরেট কন্ঠে বলে উঠল,

“আমি কাউকে ভেতরে আসতে বলিনি।”

আনায়ার এহেন কথায় পাভেল কিঞ্চিৎ কেশে ফেলল। ওদিকে কেনীথ তার বাড়িয়ে নেওয়া পা পিছিয়ে সমান ভাবে দাঁড়াল। সেইসাথে চোয়াল শক্ত করে নিরেট স্বরে বলল,

“তবে বাহিরে আয়। কিছু কথা বলার আছে।”

—“আমি বাহিরে যেতে পারব না ৷ যা বলার এখানেই বলুন।”

কেনীথ খানিকটা রাগ ও গম্ভীর্য মিশ্রিত স্বরে বলল,

“তোকে মে”রে ফেলার জন্য আসিনি আমি।একান্তই তোর সাথে কিছু কথা বলতে চাই…। হয় বাহিরে আয় নয়তো…”

—“ঘরে আমার অসুস্থ বোন ঘুমিয়ে। এই সন্ধ্যারাতে আমি কোনো অপরিচিতর জন্য বাহিরে যেতে পারব না।”

কেনীথ এবার বেজায় বিরক্ত হলো। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে চোয়াল শক্ত করল।সেইসাথে আনায়ার এমন তেজ ওর কাছে খানিকটা হাস্যকরও।ঠিকমতো কথাও যে বলতে পারছেনা। যে কারণে কেনীথ মনে মনে তাচ্ছিল্যের সাথে আওরায়,

“চেহেরা আর শরীরের যে হাল বানিয়েছে তাতে দেখে মনে হচ্ছে, এখনই উল্টে পড়বে। অথচ এখনো তার তেজের কি ছিঁড়ি!”

ওদিকে পাভেল এদের কাজকর্ম দেখে আমতাআমতা করে বলল,

“বলছিলাম যে আমি…”

—“আপনি কোনো কথা বলবেন না! আপনি বলেছিলেন আমাকে, এমন কিছুই হবে না। তাহলে কেনো…”

আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ শান্ত স্বরে বলে,

“ওকে কিছু বলে লাভ নেই। তোর কি মনে হয়, ওকে এসব বলে রেখে তুই আমাকে আটকাতে পারবি?”

—“এতোদিন তো আসলেন না! অথচ মাসখানেক পর হঠাৎ এমন কি হলো যে, আজ আমার চেহেরা দেখতে এখানে হাজির হয়েছেন।”

—“আমি মোটেও তোর চেহেরা দেখার জন্য আসিনি। আমি কিছু বলার জন্য এসেছি।”

আনায়া খানিকটা শান্ত হলো। আচমকা নিজের উপরই বিরক্ত লাগছে। ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,

“ভেতরে আসুন।”

এই বলেই সে দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে কেনীথও ওর পেছন পেছন যেতে লাগলে পাশ থেকে আবার পাভেল বলে উঠল,

“আপনারা ভেতরে কথা বলেন। আমি বাহির থেকে…”

কিন্তু ওর কথা শেষ হবার পূর্বেই আনায়া পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে কঢ়া স্বরে বলে,

“আপনিও ভেতরে আসুন।”

আনায়ার কথায় দ্বিমত দেওয়ার সুযোগ পাভেলের হলো না। কেনীথের পূর্ববর্তী নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গেই তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে হলো। আনায়ার কথামতো দু’জনে গিয়ে সোফায় বসতেই আনায়া রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। এদিকে পাভেল ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখছে।চারপাশের সবকিছু একদম সাজানো গোছানো। অতিরিক্ত কিছুই নেই। তবে এসব দেখতে দেখতেই কেনীথের চোখমুখ খানিক কুঁচকে যায়।পাভেলের উদ্দেশ্যে বলে,

“এই শহরে এই বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না? কেমন যেন একটু… ”

—“তোমার বউয়ের ইচ্ছে। সে জেদ করলে, আমি আর সেখানে কি করব!”

কেনীথ পাভেলের দিকে খানিকটা বিরক্তির চাহনিতে তাকায়। তখনই পাভেল পুনরায় বলে ওঠে,

“তুমি না বললে, এখানে এসে তুমি কোনো ঝামেলা করবে না। অথচ কিভাবে ঝগড়া শুরু করেছো, খেয়াল আছে?”

—“চুপ কর গাধা, শুধু আমারটাই দেখলি। ওরটা দেখিসনি! কঙ্কালসারের মতো চেহেরা বানিয়েছে, অথচ তেজটা কি!”

—“তার যা ইচ্ছে তাই হোক, তাতে তোমার কি! এতোদিন না নিজেই বলেছিলে, সে বাঁচুক, ম’রুক কিংবা জাহা”ন্নামে যাক। তাতে নাকি তোমার কিচ্ছু আসে যায় না৷ তবে এখন কেনো…।”

পাভেলের কথায় কেনীথ খানিকটা দমে যায়। তবে তার কথা শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ হিসহিসিয়ে বলে উঠল,

“তোকে আমি বয়ান দেওয়ার জন্য নিয়ে আসিনি। চুপ থাক, নয়তো চলে যা।”

এদিকে পাভেল চুপ হলেও সামনে থেকে আনায়া বলল,

“কে চলে যাবে? যদি যাওয়ার হয় তবে দুজনকেই যেতে হবে।”

দু’জনের নজর সরে যায় সামনের দিকে। আনায়া দু’হাতে ট্রে নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। ট্রে টা তাদের সামনে টেবিলের উপর রেখে, দুটো কফির মগ দুজনের দিকে ঠেলে দেয়। এবং সে গিয়ে পাশের সিঙ্গেল সোফায় বসে পড়ে।

আনায়ার কাজকর্মে বেজায় বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। পাভেলের কাছে তা ঝাঁ’টা পেটা করার মতোই মনে হচ্ছে। সে পারছে না, কোনো মতে এখান থেকে সরে যেতে। নিশ্চিত এখানে আজ একটা ঝামেলা বাঁধবে।

—“বলছিলাম যে…আমি একটু ওয়াশরুমে যাব। তা ওয়াশরুমটা যেন কোন দিকে?”

আনায়া পাভেলের দিকে কঢ়া নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডান দিকে ইশারা করে বলল,

“ওদিকে!”

পাভেল আর এক মূহুর্তও দেরি না করে, একপ্রকার ছুটে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল।এদিকে ওর এই কান্ডে কেনীথ খানিকটা মুচকি হাসল। টি টেবিল থেকে একটা কফির মগে নিয়ে, পায়ের উপর পা তুলে বসে তাতে চুমুক দিয়ে আনায়ার বলল,

“ভালো বানিয়েছিস।”

—“যা বলতে এসেছেন, তা বলেন।”

কেনীথ আনায়ার দিকে না তাকিয়েই, পুনোরায় কফির মগে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

“সরি।”

কেনীথ এহেন ভঙ্গিতে সরি বলার কারণ আনায়া ঠিক বুঝল না। এমন হাসতে হাসতে মজায় মজায় সে কিসের জন্য সরি বলছে! আনায়া কপাল কুঁচকে নরম স্বরে বলল,

“জ্বী!”

—“সরি!”

—“হুম, শুনেছি। কিন্তু কিসের জন্য।”

—“সবকিছুর জন্য।”

—“সবকিছু বলতে?”

কেনীথ এবার আনায়ার দিকে খানিকটা ঘুরে বসে, সিরিয়াস ভঙ্গিতে কিছুটা আমতা আমতা স্বরে বলল,

“আ…ওসব মানে…ওসব…”

—“কোন সব?”

—“শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা… যা… ”

—“আপনি আমতা আমতা করছেন কেনো?”

আনায়ার নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিতে কেনীথ খানিকটা কেশে উঠল।নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কফির মগে যেই না ঠোঁট ছুঁইয়েছে…ওমনি আনায়ার আরো এক বি”স্ফো”রক কথায় তী”ব্র ভাবে কেশে উঠল।

—-“আপনি কি, এতোদিন পর এতদূর এসেছেন, শুধুমাত্র আমায় এই এক সরি ভিক্ষা দিতে?”

আনায়ার নির্লিপ্ত স্বরে বলা তীক্ষ্ণ কথায় প্রতিত্তোরে কেনীথ কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না৷ কোনোমতে কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে আনায়ার দিকে কিছুটা এগিয়ে বসল। তবে এরচেয়ে বেশিকিছু করার মতো জোর হলো না তার। মূহুর্তেই মাথা নুইয়ে পড়ে চুপচাপ হয়ে যায়৷ এদিকে কেনীথের এমন সব হাবভাব আনায়ার সম্পূর্ণ মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার নিজের শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না ইদানীং। এরমাঝে হুট করে কেনীথের আগমন,আবার অদ্ভুত সব বিহেভিয়ার… সবমিলিয়ে আনায়া কিছু বিরক্ত ও উদাসীন।

আনায়া খেয়াল করে দেখল কেনীথ মাথা নিচু করে কিছু বিড়বিড় করে যাচ্ছে। আনায়ার চোখমুখ কিছুটা কুঁচকে যায়। মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

“এ কি নার্ভাস? কিন্তু কিসের জন্য?…ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য।”

আনায়া চুপচাপ করে বসে রইল কেনীথের অভিব্যক্তি বোঝার আশায়। তবে কেনীথের কোনো নড়চড়ই নেই। সত্যিকার অর্থে কেনীথ নিজেও জানেনা সে কি বলবে। শুরুটাই বা কিভাবে করবে। এমন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে সে এর আগে কখনো পড়েনি। একবার ইচ্ছে হচ্ছে সোজা এখান থেকে চলে যেতে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছে আজ চলে গেলে হয়তো পরবর্তীতে আর কখনো সুযোগ না-ও হতে পারে। আর আনায়া ছাড়া সে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। কখনোই পারবে না। এই একমাস অনেক চেষ্টা করেছে, আর আনায়ার জীবনে ফিরবে না। সে যেভাবে সবকিছু ছেড়ে চলে গিয়েছে, কেনীথও সেভাবে ওর থেকে বাকি জীবনটা দূরে থাকবে। কিন্তু দিনশেষে আর কি লাভ হলো। কতগুলো নির্ঘুম রাত, সময়ের অসময়ে নানান অজানা অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসা… কেনীথ এসব ভেবে খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এবার মাথা উঁচু করে দৃঢ় চোখে আনায়ার দিকে তাকায়। আনায়াও উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। কেনীথ যেন চাহনিতে আবারও কিছুটা খাবড়ে যায়। কেমন যেন সব গুলিয়ে ফেলছে। এবারও আনায়া নিজেও হতাশ হয়ে বলে ওঠে,

“আপনি কি বলতে চান… কিছু বলার থাকলে…।”

আনায়ার কথা শেষ হবার আগেই কেনীথ ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে লাগল,

“দেখ আনায়া, আমি যা চাইছি… আ…আমি যা করেছি… ”

—“আপনি কি নার্ভাস? পানি খাবেন?”

—“হ্যাঁ…না…না…প্রয়োজন নেই। ঠিক আছি আমি৷”

—“হুম তো বলুন।”

আনায়ার কন্ঠস্বর একদমই নির্লিপ্ত ও শীতল। খুব বেশি কঢ়া স্বরের ব্যবহার করার মতো শক্তি সামর্থ্য যেন ফুরিয়ে এসেছে৷ আর সে চাইছেও না এসব। তবে কেনীথের সকল কথাই এলোমেলো। যতবাই কিছু বলতে চাইছে ততবারই সবকিছু গুলিয়ে ফেলছে। শেষমেশ নিজেকে সামলিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে কিছুটা থেমে থেমে বলতে লাগল,

“তারা! কথা বাড়ানোর স্বভাব আমার নেই। তাই আজও বাড়াব না।…আমি যা যা করেছি তা নিঃসন্দেহে পা’প। তুই যে আমাকে ঘৃণা করিস—এটাও আমার প্রাপ্য৷ যদি সবকিছুর জন্য আমিই দায়ী থাকি তবে তাই…। কিন্তু আমি জানিনা, এই শেষবেলায় সবকিছু শেষ হয়ে যাবার পরও আমি তোর কাছে কেনো এসেছি। আমার ক্ষমা চাওয়া কবা পাবার অধিকার… আদৌ রয়েছে কিনা… সেটাও জানিনা আমি। যদি না-ও বা থাকে তবুও আমি বলতে চাই…আনায়া…আ’ম সরি।…পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

কেনীথের থেমে এই কথাগুলো বলতে একটা দীর্ঘ সময় লেগে যায়।তবে আনায়া চুপচাপ কেনীথের প্রত্যেকটা কথা শুনতে থাকে। অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় দু’জনের মাঝে কোনো কথাবার্তা হয় না। কেনীথ মাথা নিচু করে রইলেও, আনায়া অপলক নির্লিপ্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে। এরই মাঝে কেনীথই আবার নীরবতা কাটিয়ে,মুখ তুলে আনায়ার দিকে তাকিয়ে কিছু চাইলে… আনায়াই নির্লিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“তো আপনি এখন কি চাইছেন?”

কেনীথ থমকে গিয়েছে। একদম চুপটি করে বসে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে তার চোখ যেন হাজারো অব্যক্ত কথা বলার জন্য উতলা হয়ে উঠেছে। মনেপ্রাণে চাইছে,সে না বললেও যেন আনায়া সেসব কথা বুঝে যায়।

কেনীথের ওমন রহস্যময় চোখজোড়া হতে আনায়াও একটিবারের জন্যও, নিজের নজর সরিয়ে নেয় না। তার চাহনি নির্লিপ্ত হলেও, যেন কেনীথের উদ্দেশ্য ঠিকই বুঝে যায়৷ আনায়া খেয়াল করে দেখল, কেনীথ একটু পর পর ঢোক গিলছে। যার ফলে তার অ্যাডাম অ্যাপেল ক্রমশই ওঠানামা করছে। অন্যান্য সময়, যে কোনো নারীর কাছে এটি আকর্ষণীয় মনে হলেও, আনায়ার কাছে তেমন কিছুই মনে হয় না। সে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একদম স্বাভাবিক। তবুও সে নিজের সরিয়ে নিয়ে বলতে লাগল,

“এই একমাস হিসেব-নিকেশ আমিও করেছি। পুরোপুরি কিছুই মেলাতে না পারলেও,প্রতিবার জীবনের এই ক্যালকুলেশন থেকে পালিয়ে বেড়ানোটা, হয়তো মোটেও উচিত হয়নি। যাই হোক, যা বলতে চাচ্ছি আরকি…শুধু আপনাকে একার দোষ দেওয়া কখনোই যৌক্তিক নয়৷ শুরুতে নানান সময়, আপনার উপর নানান ক্ষো”ভে আমি সব কিছুর জন্য হয়তো শুধু আপনাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছি৷ কিন্তু এটা কখনোই যৌক্তিক হতে পারেনা। ভুল কিংবা পাপ…কম বেশি সকলেরই ছিল। কেননা একহাতে তোর আর তালি কখনোই বাজে না৷”

আনায়া এটুকু বলেই থেমে যেতেই কেনীথ কিছুটা উৎসুক দৃষ্টিতে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। আনায়াও কেনীথের বিষয়টা ঠিকই বুঝতে পেরে খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে লাগল,

“দেখুন, আমি হয়তো খুব ভালো করেই জানি আপনি এখানে কেনো এসেছেন। আর যদি আমার মতামত জানতে চান… তবে আমি বলব, সম্ভব না।”

—“কেনো নয়?”

কেনীথ কন্ঠস্বর কিছুটা কাঁপা কাঁপা। হাতদুটো মু’ষ্টিবদ্ধ করা।চোখে-মুখে নীরব উদ্বিগ্ন। সবকিছুই আবায়ার কাছে স্পষ্ট ধরা দিয়েছে।

—“সম্ভব নয়, কারণ আমি আর এমন কিছু চাই না। আমি আপনাকে হয়তো মাফ করেছি কিন্তু… সেটাও হয়তো বা নিজেরেই কোনো স্বার্থে। আইন মোতাবেক আমাদের সবার জন্যই কমবেশি শা’স্তি প্রাপ্য। ইনায়াও বাদ যাবে না। কিন্তু আমি চাইছি না ওর সাথে আর কিছু হোক৷এবার যতটা সম্ভব, আমি ওর পাশে থাকতে চাই। পুরোপুরি না হলেও, ওকে আমি আবার একটা সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। মায়ের মৃ”ত্যুর সময় এমনটাই ওয়াদা করেছিলাম আমি। তবে সময়ে অসময়ে সে ওয়াদা ঠিকমতো রাখতে না পারলেও এখন অন্ততঃ…. এইক্ষেত্রে আমি নিজেকে নিত্যন্তই স্বার্থপর হিসেবেই মানছি। কিন্তু আমি আপাতত, আমার বোন ব্যতীত আর কারো কথা ভাবতে চাইনা৷”

কেনীথ চোয়াল শক্ত করে আনায়ার দিকে তাকিয়ে। আনায়া চুপচাপ বসে রয়েছে। আনায়ার কথা শেষ হতেই কেনীথ ভারী শ্বাস ফেলে বলে উঠল,

“ইনায়াকে নিয়ে আমার কখনোই কোনো সমস্যা ছিল না। আর ভবিষ্যতেও থাকবে না। তবে তো, আর কোনো সমস্যা…”

—“আপনি এখন আমাকে কেনো চাইছেন, বলুন তো?…কি লাভ আর… থাকি না এবার, যে যার মতো। কি এসে যায়, একসাথে থাকা না থাকায়?”

—“আনায়া… আমি জানি, আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই কিন্তু… ”

—“আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু হারিয়েছি৷… অবশ্য অনেক কিছুই হারিয়েছি। সকলই এখন প্রায় সব হারিয়ে নিঃস্ব।
ছোটো থাকাকালীন, বুঝ হতে না হতেই মাকে হারালাম। এরপর বাবার অসুস্থতা। সংসারের সব দায়িত্ব নিয়ে কাজে লেগে পড়লাম। বোনটাও ছোট…আমি ব্যতীত তখন সংসার সামলানোর জন্য আর কেউ নেই। ঐ সময় দায়িত্ব সামলাতে হিমশিম খেলেও জীবনটা অনেক সুন্দর ছিল। বিশেষ করে অত্যন্ত শান্তিময় ছিল— সেই জীবন। অন্তত সকল ব্যস্ততার পর দিনশেষে শান্তির নিশ্বাসটুকু প্রাণভরে নেওয়া যেত। ওইটুকুতেই খুশি ছিলাম আমি, অনেক বেশি পরিমাণে খুশি ছিলাম। আমার আর কিছুই লাগতো না, এক জীবনে সবটাই পেয়ে গিয়েছিলাম হয়তো।

কিন্তু সেইটুকু সুখও আমার কপালে বেশিদিন স্থায়ী হলো না। একটা কালো অন্ধকার ঝড় এসে জীবনের সবকিছু ওলোট পালোট করে দিল। সর্বপ্রথম নিজের বিয়েতে আমার প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেললতাম।যাকে ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষকে কল্পনাতেও ভাবিনি… আমি শেষে তাকেই হারালাম। এরপর হারালাম বাবাকে…নিজ চোখে বাবার নৃশং”স মৃ”ত্যু দেখতে হলো। তারপর জানতে পারলাম, সেই বাবার সকল কুকী”র্তি সম্পর্কে। একটার পর একটা, কোনোকিছুরই কমতি ছিল না। সেই ঝড় আমারকে প্রতিনিয়ত ছিন্নভিন্ন করতে উঠেপড়ে লাগল।
হারিয়ে গেলাম আমি। দিনশেষে আমিও আর সবার মতো পাগল হয়ে উঠলাম। বুঝেও বুঝতে পারলাম না,আমার ভেতরেও আরো একটা অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছে। আমাকে বাঁচতে হতো, অন্ততঃ ওর জন্য হলেও বাঁচতে হতো। ও আমার সন্তান ছিল, আর আমি মা৷ কিন্তু এখানেও হেরে গেলাম আমি। নিজেই নিজের সন্তানকে শেষ করলমা। তারপর… সব শেষ…!”

শেষমেশ কাঁপা কাঁপা স্বরে আনায়ার কথার সমাপ্ত হলো। একই সাথেই নিজের অজান্তেই একফোঁটা জল গড়িয়ে আনায়া মুষ্টিবদ্ধ হাতের উপর পড়ল। আনায়া সেদিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে আবারও বলতে লাগল,

“নাহ! আমি শুধু নিজের হারানোর হিসেবটাই করিনি। সবারটাই করেছি আমি৷ আমার মতো আরো অনেকেই অনেক কিছুই হারিয়েছে। আমার সাথে রেহানের কোনো সম্পর্ক না থাকলে হয়তো, অকালে তার বাবা মা কিংবা ছোট ভাইয়ের হঠাৎ মৃ”ত্যুর সম্মুখীন হতে হতো না। ও নিজেও আর সবার মতো স্বাভাবিক একটা জীবন পেতে পারত।কিন্তু এমনটা হয়নি। কোনো না কোনো ভাবে, এজন্য আমি চিরকাল নিজেকেই দায়ী করব।

আর প্রসঙ্গ যদি হয় আপনার… তবে আপনিও সব হারিয়েছেন। আর কোনো না ভাবে, আপনার সবকিছু হারানোর জন্য হয়তো আমিই দায়ী। আমার বাবার কারণে নিজের বাবা মাকে হারিয়েন। অনেক ছোট বয়সে নিজ চোখে বাবা মায়ের নৃশং”স মৃ”ত্যু… এই ট্রমা থেকে সহজেই যে কেউ বের হতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। আর কেউ সাই”কোপ্যা”থও এমনি এমনি কিংবা একদিনেও হয়না। আমাদের পাশে হয়তো কেউ না কেউ ছিল, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে… অনেকে থেকেও হয়তো কেউ ছিল না৷ আমার মতো আপনিও আপনার সন্তানকে হারিয়েছেন। আমাকে পেয়েও আর পাননি।…হিসেব শেষে, পা”প কিংবা ক”ষ্টের ভাগীদারে, কেউ কারোর চেয়ে কম নয়৷
তবে আমায় মাফ করবেন। আপনি যা চাইছেন, আমি আর তা চাইনা। আমাদের সম্পর্ক হলো একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের। আমরা কি চাই তাই হয়তো কখনো ঠিকভাবে বুঝতে পারব না।আপনিও হয়তো পারছেন না। সাতটা বছর তো আমাকে মৃ”ত হিসেবে জেনেই বেঁচে ছিলেন। আশাকরি ভবিষ্যতেও পারবেন। অসম্ভব মনে হলে, ভেবে নিবেন আমি মৃ”ত। কিন্তু আমি আর… চাই না, কিছুই চাই না আমি। আমার বোনটা এখন বেঁচে থাকুল,এটুকুই চাওয়া আমার। নয়তো এই আমি তো বহু আগেই ম”রে গিয়েছে। যা আপনার সামনে আজ দৃশ্যমান, সে আমি কখনো আমি হতে পারিনা। এখন আমার বাঁচাও যা, মরে যাওয়াও তা। আমার বাঁচা ম”রায়, চাওয়া পাওয়ার আর কিছু এসে যায় না আমার। এখন যা আছি, যেমন আছি…ঠিক আছি। আশা রাখছি সামনেও এভাবে ঠিকই থাকব।”

আনায়ার কথাগুলো গোছালো নয়। অনেকবেশি এলোমেলো। আনায়ার কথা শেষ হতেই কেনীথ মাথা নিচু করে ঝুঁকিয়ে ফেলে। পুনোরায় দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। কিছুক্ষণ সময় এভাবেই অতিক্রম হওয়ার পর আনায়া কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,

“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নিন৷ আর ওনাকে বলুন ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতে।”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ মুখ তুলে তাকায়। ওদিকে আনায়া সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে একটা তোয়ালে নিয়ে পুনোরায় ফিরে আসে। কেনীথ দিকে হাত বাড়িয়ে, তোয়ালে এগিয়ে বলে,

“নিন, মাথা মুছে নিন। ভেজা চুলে বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

কেনীথ মাথা উঁচিয়ে, আনায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আনায়ার তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। কেনীথের প্রতি তার চাহনি একদমই নির্লিপ্ত এবং কিছুটা ক্লান্ত,হতাশাগ্রস্ত।

__________

টুপটাপ বৃষ্টি ঝড়ছে। আনায়ার বাড়ির সামনের রাস্তা বেয়ে এগিয়ে চলেছে হতাশাগ্রস্ত দুই মানব।পাভলে ছাতা ধরে রয়েছে, যেন তার গায়ে বৃষ্টি না লাগে। অথচ কেনীথের তাতে কোনো ভাবান্তর নেই। সে সামনের দিকে তাকিয়ে, আনমনে হেঁটে চলছে তো চলছেই৷ মাঝেমধ্যে দমকা হাওয়াও পরনের হাঁটু সমান কালো রঙের ওভার কোটটা হেলেদুলে নেচে উঠছে। কেনীথ এসবেও কোনো ভাবান্তর নেই।

এদিকে এসব দেখে পাভেল কিছুক্ষণ পর পর শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে। সামনেই তাদের গাড়ি…রাতও যথেষ্ট হয়েছে। এখন সোজা গিয়ে হোটেলে ফেরা ব্যতীত আর কোনো উপায় নেই। যে কাজে আশা নিয়ে এসেছিল তার কিছুই হয়নি। ওয়াশরুমে ঘাপটি মে”রে থাকলেও তার কান ছিল কেনীথ আনায়ার কথাবার্তায়। ভেবেছিল আজ হয়তো এদেরও সম্পর্কের একটা সঠিক সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু আনায়া ভাবভঙ্গি আর চিন্তাভাবনায় যা বোঝা গিয়েছে, এসব আর সম্ভব না। ধীরে ধীরে সব আশা কেমন যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। অবশ্য আনায়ার কথাগুলো তো ভুল নয়, কিন্তু…কেনীথকেও এভাবে কষ্ট পেতে দেখে তো তার মোটেও ভালো লাগে না। এর একটা না একটা সমাধান তো এবার হওয়ায়ই উচিত।

তখন আনায়ার কথাগুলো বলার পর কেনীথ আর কিছুই বলতে পারেনি। পাভেলও যেহেতু ওয়াশরুম দাঁড়িয়ে থেকে সবটাই শুনছিল, তাই আনায়ার বলার পর সে নিজেও ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসেছে। কিন্তু আলাদাভাবে আর কফি খাওয়ার ইচ্ছে জাগেনি। খুব হালকা বিদায় বিনিময় করেই দুজন বাসা থেকে বেড়িয়ে এসেছে। আর কেনীথও কোনো কথা তো দূরের কথা, একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত একইভাবে চুপচাপ রয়েছে সে। কি যে ভেবে যাচ্ছে কে জানে!
পাভেল কিছুটা অস্থির হয়ে উঠল। কেনীথের মাথায় ছাতা ধরতে গিয়ে কখনো তার পরণের কালো হুডি ভিজে যাচ্ছে, তো নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে গিয়ে কেনীথ ভিজে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে সে বেজায় বিরক্ত। আবার অনেক বেশি হতাশও। এভাবে অনবরত নীরবে দুজন হাঁটতে হাঁটতে, একটা সময় পাভেল অস্থির হয়ে বলে উঠল,

“ব্রো! এবার কি করবে?”

কেনীথ আনমনে চলছে। পাভেলের কথা তার কান অব্দি পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ। কেনীথ কোনো উত্তর না করায় পাভেল আবারও কিছুটা জোর স্বরে বলে,

“ব্রো!”

এবার কেনীথ কিছুটা কেঁপে উঠল। পাশে ফিরে একপলক পাভেলকে দেখে নিয়ে, পুনরায় সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আলতো স্বরে বলে উঠল,

“হুম!”

—-“এখন কি করবে, কিছু ভেবেছো?”

—“জানিনা৷”

—“তবে আরকি! চলো হোটেল ফিরে যাই। গিয়ে কিছু একটা উপায় বের করা যাবে।আর বৃষ্টি হয়তো আরো জোরে নামবে।”

কেনীথ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জবাব দেয়,”হুম চল।”

_____________

বিকেলের শেষভাগে লাইব্রেরির শান্ত কোণে… জানালার কাঁচে ঝিম ধরা সোনালি রোদ এক রকম উদাস হয়ে লুটিয়ে পড়ছে। লাইব্রেরির বাতাসে বইয়ের পুরোনো গন্ধ মিশে গিয়ে তৈরি করেছে এক নিঃশব্দ ঘোর। বড়দের জন্য নয়…আজকের এই লাইব্রেরির ঘরজুড়ে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট পা, ফিসফিসানো কৌতূহল, আর শিশুমনের উদ্দীপনা।

মেঝেতে গোল হয়ে বসে থাকা দশ-বারোটা বাচ্চা চুপচাপ তাকিয়ে আছে এক প্রাণবন্ত হাস্যজ্জ্বল নারীর দিকে। আনায়ার পরণে সাদা-ধূসর রাঙা কুর্তি।খোলা চুলগুলো পিঠ ছুঁয়ে আছে। তার চোখে প্রশান্তি, ঠোঁটে একধরনের কোমল দৃঢ়তা। হাতে ধরা একটা চিলড্রেন বুক…যেখানে জাদুকরীর গল্পে এখন রাজপুত্র অন্ধকার জঙ্গল পেরিয়ে ঘোড়ায় ছুটছে। আর সেটাই যেন আনায়ার কণ্ঠে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

এই কাজটা সে ভালোবেসেই করে। সপ্তাহে দুদিন লাইব্রেরির ‘ভলান্টারি স্টোরি আওয়ার’-এ এসে শিশুদের গল্প পড়ে শোনায়। আনায়ার জন্য এটা কেবল চাকরি নয়, বরং নিজের ভেতরের ক্লান্তি,অশান্তি কিংবা অস্থিরতাকে দমিয়ে রাখার একটা উপায়।

কিন্তু লাইব্রেরির এক কোণে, জানালার ধারে একটা চেয়ার পেতে বসে আছে আরেকটা মেয়ে। ওর চোখ অন্যমনস্ক। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।আর সেই মেয়েটার নাম ইনায়া।পরনে সাদা রংএর একটা লং গাউন। ছোট ছোট কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখা।

মানসিকভাবে অসুস্থ হলেও, ডাক্তার পরামর্শ অনুযায়ী ইনায়াকে সাধারণ জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনার জন্য, তাকে সাধারণ পরিবেশে রাখাটা বেশি জরুরী। লোকজন,আলো-হাওয়ায় মাঝে নিয়মিত মিশে থাকলেই, একটা না একটা সময় ঠিকই তার উন্নতি হতে থাকবে। আর এই জন্যই আনায়া যখন সময় সুযোগ হয়, ওকে নিজের সাথে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায়।বেশিরভাগ সময় তার বাড়ির পাশে পার্ক নয়তো লাইব্রেরীতেই বেশি আসা হয়।

তবে ইনায়া সবসময় আলাদা থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলে না, চোখে চোখ রাখে না। লাইব্রেরির শিশুরা ওকে একটু ভয় পায়, আবার কেউ কেউ কৌতূহল নিয়ে তাকায়।কিন্তু বড় সত্য হলো এটা যে, ইনায়া নিজেই সবচেয়ে বেশি বাচ্চাদের ভয় পায়। যে কোনো ছোট বাচ্চাকে দেখামাত্রই সে এক অজানা কারণে অস্থির হয়ে ওঠে। তবে আজ, আনায়ার গল্প শুনতে শুনতে তার দৃষ্টিতে একধরনের শান্ত স্থিরতা দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু ঠিক তখনই আনায়ার পাশে এসে দাঁড়াল, একজন লাইব্রেরির কর্মী।

—“আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন।”

আনায়া খানিক ভ্রু কুঁচকে তাকাল।
—“কে?”

দুজনের সব কথাই ইংরেজিতে হলে, আনায়ার শেষ প্রশ্নের উত্তরে কর্মীটি কেবল একটি কোণার দিকে ইশারা করল। লোকটির ইশারা অনুযায়ী আনায়া তাকিয়ে দেখে, বইয়ের তাকের পাশে ছায়ামুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে… একজন দীর্ঘদেহী, ধূসর রাঙা ওভার কোট আর কালচে প্যান্ট পরা। তার মুখটা খানিকটা ঝাপসা লাগছিল প্রথমে। তবে আনায়ার পুরপুরি চিনতে খুব বেশি একটা সময় লাগল না।

আনায়ার বুকের ভেতর দিয়ে হঠাৎ এক ঝাপসা হাওয়া বয়ে গেল।একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বিস্তৃত হেসে বলল,
—“আজ এখানেই শেষ করব আমরা। সবাই ক্ল্যাপ করো তো রাজপুত্রের জন্য!”

নিমিষেই হাসির ছোট্ট ছোট্ট ঝিলিক ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।আনায়া বইটা বন্ধ করে, শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল।সে হাঁটছে, আর বইয়ের তাকগুলোর ফাঁক দিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, কেনীথ। আনায়া ওর কাছে যেতেই দুজনের চোখে চোখ পড়ল।

কেনীথের ঠোঁটে হালকা কাঁপুনি।তবুও নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর ও স্থির রেখে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,

“ভালো আছিস?”

আনায়া সংযত স্বরে জবাব দেয়,

“হ্যাঁ, আপনি?”

—“হুম!”

আনায়া খেয়াল করে দেখে, কেনীথের চোখের নিচে গভীর ক্লান্তির ছাপ।কেনীথ আনায়ার হাতের দিকে একটা চিঠির খাম আর মাঝারি আকারের কালো রংএর শপিং ব্যাগ এগিয়ে দেয়। কিছুটা অস্থিরতা নিয়েই বলে,

“এইটা তোর জন্য…লেটারে একটা খাম…রয়েছে…সরি! খামে একটা লেটার রয়েছে… পরে পড়ে নিস। মানে এখনই পড়বি তবে আমি চলে যাওয়ার পরে ৷আর হ্যাঁ… প্লিজ, পড়িস কিন্তু!”

আনায়া কিছু বলতে নেবে তার আগেই, কেনীথ দৃষ্টি সরিয়ে বলল,

“আমার একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি …তোর কাজ শেষ হলে খামটা দেখে নিস।”

আর কোনো কথা না বলে কেনীথ পেছন ফিরল।
দীর্ঘ পা ফেলে চলে গেল লাইব্রেরি থেকে।
চলে যাওয়ার সময় দরজার গায়ে হাত রাখতেই যেন থেমে গেল এক মুহূর্ত। কিন্তু আর পেছনে ফিরে তাকানো হলো না। লাইব্রেরী থেকে বেড়িয়েই জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

এদিকে আনায়া অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। চারপাশের কোলাহল ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। আনায়া পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখে,দূরে ইনায়া চুপচাপ বসে রয়েছে।আনায়া পুনরায় মুখ ফিরিয়ে হাতে থাকা খামটার দিকে তাকায়।কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে অবশেষে খামটা খুলেই ফেলে।

ভেতরে হাতে লেখা একটা চিঠি। এলোমেলো, ছেঁড়া সকল বাক্যে সাজানো। যেন অনেক দিন ধরে জমে থাকা আবেগ,অনুভূতিগুলো শব্দ খুঁজে না পেয়ে কেবল ঢেলে দিয়েছে কাগজে। আনায়ার অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে কাগজে থাকা প্রতিটি শব্দ মনে মনে আওড়াতে লাগল। তবে কিছুসময় পর ঠিকই তার কপাল কুঁচকে যেতে লাগল। কেনীথের দেওয়া চিঠিতে যে এমন কিছুও থাকতে পারে, তা যেন আনায়ার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যশিত।

চলবে__________