#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
পর্ব→৩৯(৩য় অংশ)
[উত্তে”জ”না মূলক পর্ব—সিঙ্গেল ও ভণ্ডদের দূরে থাকার আমন্ত্রণ রইল ]
আনায়া ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে। নিজেকে উপলব্ধি করে কম্বলে মোড়ানো অবস্থায়। আশেপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখল,সে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। খানিকটা উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথা ভার হয়ে আসে। প্রথমে চারপাশের সবকিছু ঝাপসা…চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় একটা ছায়াময় অবয়ব। আধো আলোয় মাথা নুইয়ে বসে রয়েছে। অতঃপর ধীরে ধীরে সেই মুখটা আনায়ার স্পষ্ট হতে লাগল। ভেজা চুল, কপালে কুঁচকে থাকা ভ্রু, আর তার চেয়েও গভীর সেই দৃষ্টি…।
আনায়ার ঠোঁট কেঁপে উঠল।অস্পষ্ট গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল,
“আ…আপনি।”
কেনীথ ওর দিকে তাকিয়ে, একরাশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। আনায়া নজর সরিয়ে পাশে ফিরে দেখে, কেনীথের কালো কোটটা ফ্লোরের একপাশে পড়ে রয়েছে। কেনীথের পরণে আপাতত একটা ভেজা কালো টিশার্ট আর কালো প্যান্ট। কাদামাখা জুতোজোড়াও ঘরের এক কোণায়। আনায়া খেয়াল করে দেখল কেনীথ যেখানটায় বসে রয়েছে—বিছানার ঠিক সেই জায়গাটুকু একদম ভিজে উঠেছে। আনায়া এসব দেখে কিছুটা বিরক্ত ও হতাশ হলেও, আকস্মিক খানিকটা সময় পূর্বের কথা মনে পড়তেই, পুনরায় তীব্র বিব্রতবোধে সে নুইয়ে পড়ল। সেই সাথে শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গিয়ে গলা শুষ্ক কাঠের ন্যায় শুকিয়ে ওঠে।
আনায়া কিছু বলতে না পারার বিষয়টা কেনীথ ঠিকই বুঝতে পারে। কিন্তু সে আদতে কি বলবে তাই তো বুঝতে পারছে না।তবুও আমতা আমতা করে আওড়ায়,
“আনায়া…দেখ ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি সত্যি বলছি কিছুই… কিছুই করিনি আমি। বিশ্বাস কর…”
আনায়া কেনীথের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর একবার নিজেকে দেখল। এরপর কিছুটা বিব্রত হয়ে, চাপা স্বরে বলে উঠল,
“কিছুই করেন নি?তবে…আমায় জামা কে পড়িয়েছে?…ইনায়া?
—“হ্যাঁ মানে না…না মানে হ্যাঁ…আ…জামা আমিই পড়িয়েছি… কিন্তু… ”
এটুকু বলতে না বলতেই কেনীথ আকস্মিক ঢোক গিলে ঠোঁট ভিজিয়ে পাশে মুখ ফিরিয়ে নেয়। একই সাথে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, কিছু মূহুর্ত আগের কথা।
” আনায়া অজ্ঞান অবস্থায় কেনীথের বুকে ধসে পড়তেই মুহূর্তটা যেন থমকে যায়। রুমের বাতাস নিঃশব্দ… শুধু জানালার বাইরে বৃষ্টির নিস্তরঙ্গ শব্দ।আনায়ার ভেজা চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি কেনীথের ঘাড় বেয়ে নামছে। আর তার ভেজা জামার ভেতর দিয়ে শরীরজুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধবোধ সহ এক অজানা শীতল শিহরণের মৃদু কাঁপুনি।
কেনীথ দুই হাতে ওকে সামলে বিছানায় নিয়ে যায়। আনায়া তখনও নিঃস্পন্দ, একটুও নড়চড় নেই। তার গায়ে তখন কিছুই নেই। শরীরের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি স্পষ্ট ভাজ… ভিজে টাওয়েলের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়া এক জীবন্ত নিস্পাপতার মতো। কিন্তু কেনীথের চোখে কোনো কামনা নেই। ওর চোখে শুধু তীব্র অপরাধবোধ আর তার অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ভালোবাসা।
কেনীথ আনায়াকে বিছানায় শুইয়ে একপাশে চোখ ফিরিয়ে নেয়। দ্রুত পাশে ভাজ করে রাখা পাতলা কম্বলটা আনায়ার গায়ে মিলিয়ে দেয়।অতঃপর তড়িঘড়ি করে নিজের পরনের কোট আর জুতো গুলো খুলে, রুমের একপাশে ফেলে রেখে, সোজা আলমারি কাছে চলে যায়। পুরো আলমারি খুঁজে একটা কালো রংএর গাউন এনে আবারও আনায়ার কাছে এসে দাঁড়াও।
অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছে তার। যতবার আনায়াকে জামা পড়ানোর জন্য হাত বাড়িয়েছে ততবারই হাত সরিয়ে থেমে যাচ্ছে। গলাও কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন তো নয় যে এই প্রথম এমন কিছুর সম্মুখীন হয়েছে সে। এরআগেও তো আনায়াকে জামা… কেনীথ এসব ভাবতে গিয়ে আকস্মিক থেমে যায়। মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“ওসব তো বহু বছর পুরনো কথা। কিন্তু এখন কিভাবে…অবশ্য না হওয়ারও বা কি রয়েছে।”
নিজের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝে কেনীথ ভারী নিশ্বাস ফেলে। আনায়ার দিকে এগিয়ে ধীরে ধীরে ওর পাশে বসে। চোখ মেলে না, তবে হাত বাড়িয়ে যত্নসহকারে তার কাজ করে যায়। নিজের কাঁপা কাঁপা হাতদুটো দিয়ে আলতো হাতে আনায়ার শরীরে জামাটা পরিয়ে দিতে থাকে। বারবার আঙ্গুল কাঁপে, নিশ্বাস থেমে যায়। একটা হাত গলিয়ে দেয়, তারপর আরেকটা।
আঙুলগুলো যখন আনায়ার গলার বোতাম লাগাতে কাছে আনে…কেনীথ তখন আকস্মিক আবারও থেমে যায়। দৃষ্টি আঁটকে যায় আনায়ার গলার ভাঁজে।
তখন ওতো জো’রে গলা চেপে ধরায়, ফর্সা ত্বকের সম্পূর্ণটাই কালচে লাল হয়ে আঙ্গুলের ছাপ বসে গিয়েছে।এছাড়া গলার মাংস শুঁকিয়ে হাড় বেড়িয়ে আসছে । মাথায় আসছে না, দিন দিন এর এতো অধঃপতন হচ্ছে কি করে। কেনীথ বোতামগুলো লাগিয়ে, ওকে নিজের বুকের বা পাশে আঁকড়ে ধরে।কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। তোয়ালে দিয়ে বাদবাকি ভেজা চুল গুলো মুছে ফেলে। এরপর আনায়াকে আলতো হাতে শুইয়ে দিতেই, ভেজা চুলগুলো ঝরে পড়ে বালিশে—একরাশ অগোছানো মেঘের ন্যায়।
আনায়ার ঠোঁট ফেটে রয়েছে,চেহেরার রং ফ্যাকাসে, চোখের নিচে গভীর কালো দাগ। যেন বহু রাতের অনিদ্রা জমে আছে সেখানে। তবু নিঃশ্বাসের ভারে বোঝা যায়, ওর বুকের ভেতর অস্থির ঢেউ বইছে।কেনীথ শান্ত চোখে ওর বি””ধ্বস্ত চেহেরার দিকে তাকিয়ে রইল। এভাবেই আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কেনীথ আনায়ার সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখার পর আড়ালে ভারী শ্বাস ফেলল।অতঃপর আনায়ার কানের কাছে,মুখ এনে ফিসফিস করে আওড়ায়,
“এসবের জন্যও আমিই দায়ী, তাই না?”
কেনীথ জানে উত্তর আসবে না। তবুও কেনো যেন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো। যদিও উত্তরটা হয়তো তার জানা। তবে আনায়াকে সে আপাতত জাগাবে না। যতক্ষণ অচেতন থাকার থাকুক। আরো কিছুক্ষণ কেনীথ ওর দিকে তাকিয়ে রইল। এরপর আলতোভাবে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে মনে মনে বলতে লাগল,
“আমি ছাড়া উনি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। আমি না থাকলেই তার জীবনে সব শান্তি ফিরবে… অথচ এই তার নমুনা!”
এই কয়েকটা দিন আনায়ার কেমন গিয়েছে কেনীথ হয়তো তা পুরোপুরি জানে না। কিন্তু সে তো মোটেও ভালো থাকতে পারেনি। শুরুতে আনায়ার মতোই কঠিন জেদ নিয়ে বসে ছিল। আর যাই হোক, কোনোমতেই কোনোভাবেই আর আনায়ার সামনে যাবে না। সেও দেখতে চায় আনায়া তাকে ছাড়া ঠিক কতটা ভালো থাকে। আপাতত এমন রূপে আনায়াকে দেখে সে খুশি হয়ে হাসবে, না কষ্ট পেয়ে হতাশ হবে, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। তবুও কিছুটা আলতো হেসে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,
“ঠিকই হয়েছে, একদম ঠিক হয়েছে। তোর আরো ক”ষ্ট পাওয়া উচিত।…অস”ভ্য ঘাড়ত্যাড়া একটা!”
এটা বলতে না বলতেই কেনীথ আবারও চুপ হয়ে যায়। হুট করেই মাথায় ঘুরতে থাকে, সে নিজেই বা কতটা ঠিকঠাক ছিলো। মাঝেমধ্যে আনায়ার উপর অনেক বেশি রাগ হয়। তার জীবন থেকে যখন মৃ’ত হয়ে হারিয়েই গিয়েছিল, তবে ফিরে আসার কি প্রয়োজন ছিল। সেসব কষ্টের চেয়ে তো এখন ফিরে এসে আবার দূরে যেতে চাওয়ার ক”ষ্টগুলো,তাকে আরো বেশি পোড়ায়। কেনীথ আবারও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আনায়ার দিকে চেয়ে থাকে।
রুমের হালকা আলোয় তাদের ছায়া পড়েছে দেয়ালের ওপর। একটি বৃষ্টিময় রাত, আধো অন্ধকার ঘর , একটি ভাঙা নিরেট হৃদয় আর এক পাগল প্রেমিক—যে বুঝতে পারছে না যে, কীভাবে তার এই ভালোবাসার মানুষটাকে ঠিক করবে। যে কিনা এখন তার সামনে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। সাথে অন্তর্নিহিত কোমল সত্তাটাকেও, দিনকে দিন পাথর বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কেনীথ কিছুটা দ্বিধা নিয়েই ওর দিকে ঝু”কে পড়ে।আনায়ার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়েও মনে হয়, এটা হয়তো তার প্রাপ্য নয়। কিন্তু শেষমেশ কি যে ভেবে ওর কপালে আলতোভাবে চুমু খায়…একেবারে নিঃশব্দে। অতঃপর এক হাত ওর মাথার নিচে,ও আরেক হাত বুকের উপর রেখে ওর পাশেই বসে থাকে, মাথা নিচু করে।
ঘরজুড়ে তখনো সেই নরম বৃষ্টির শব্দ।আর কিছু অজানা চঞ্চলতা—যা কেবল প্রেম কিংবা যন্ত্রণা নয়। বরং এ দুটোর মিশ্রণ সমানতালে অনুভূত হয়ে চলেছে।
তবুও একটা অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়েছে ঘরের ভেতর। বৃষ্টির ধারা হালকা হয়। বাতাসে মিশে রয়েছে ভেজা মাটির গন্ধ।আর বিছানার বসে, ঘুমিয়ে থাকা সেই পাগল প্রেমিকের, পাগলী প্রেমিকা। যারা নিজেদের অনুভূতি সম্পর্কে অবগত নয়। হলেও তা যথাযথ ভাবে একে-অপরের কাছে প্রকাশ করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। যারা নামে একজোড়া আগুন পাখি হলেও, কাজে সব পাগল পাখি।
অথচ সেই পাগল প্রেমিক…যে এখনও প্রেমিকার ঠাণ্ডা আঙুল আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছে।যেন সব দুঃখ সয়ে নিয়ে বলছে,
“তুই জেগে উঠলে আমি তোকে আর এক ফোঁ’টাও কাঁদতে দেব না। মোটেও আর একটুও ক’ষ্ট দেব না৷ তুমি আমায় মেনে নিলে, হয় এবার তোর কাছে থাকব, নয়তো সত্যি সত্যি সারাজীবনের জন্য তোর জীবন থেকে সরে যাব…প্রমিজ!”
কেনীথের আনমনের খেয়ালের মাঝেই সে আকস্মিক ঢোক গেলে। ততক্ষণে আবার আনায়া বিছানা থেকে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই কেনীথ কোন খেয়ালে হারিয়ে আনায়া সেটাও বুঝতে পারছে না। তবে এভাবে বসে থাকতে তার কেমন যন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। আনায়া উঠতে নিলে কেনীথ তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
—“আনা…”
—“দেখুন যা হওয়ার হয়েছে। আমার মনে হয় না, সেসব নিয়ে এখন আর ভাবার প্রয়োজন আছে। বিষয়টা নিত্যন্তই… বি…বিব্রতকর।”
আনায়া মাথা নুইয়ে, এটুকু বলেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এরপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই সে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মেঝের অবস্থা দেখে সে কি বলবে, তা মাথায় আসছে না। এমন কোনো জায়গা নেই সেটা নোং”রা হয়নি। সবজায়গায় কাঁ”দা পানির অস্তিত্ব দৃশ্যমান।
কেনীথ ওকে এভাবে থেমে যেতে দেখে,মুখ ফিরিয়ে পাশে তাকায়। পরবর্তীতে যা বোঝার তা বুঝে যায়।কিছুটা ইতস্ততভাবে আনায়াকে কিছু বলতে নিলে, আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলে,
“থামুন! যা করেছেন ভালো করেছেন। এখন বাকিটা আমায় করতে দিন।”
________
রুমের এককোণে কেনীথ চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তার ভেজা কাপড়চোপড় এখন চুপসে তার গায়ে লেপ্টে রয়েছে। ওদিকে আনায়া প্রচন্ড মনোযোগী হয়ে রুমের মেঝে পরিষ্কার করছে। কেনীথ একবার সাহায্যের জন্য বললেও আনায়া তাতে কোনো পাত্তা দেয়নি। উল্টো আনায়া চোখ গরম করায়, কেনীথ বাধ্য হয়েই চুপচাপ একজায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আনায়ার কাজ প্রায় শেষের দিকে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁদা পানি মুঝে চারপাশ একদম ঝকঝকে পরিষ্কার করে ফেলেছে। শেষমেশ পানি ভর্তি ময়লা বালতি নিয়ে বাহিরে রেখে আসতে নিলে, কেনীথ ওর দিকে সাহায্যের এগিয়ে যায়। কিন্তু আনায়া ওকে কিছুই করতে না দিয়ে উল্টো বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
“আপনার সমস্যা কি বলুন তো? সেধে কেনো জঞ্জাল বাঁধাতে আসছেন? বলেছিলাম না এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে। এতোক্ষণ কষ্ট করে ঘর মুছলাম। আপনি শুকানোর আগেই কেনো হেঁটে বেড়াচ্ছেন।”
—“আরেহ আমি তো…আচ্ছা সরি।”
কেনীথ এই বলে চলে যেতে নিলে আনায়া আবারও বলে উঠল,
“এই দাঁড়ান।”
—“হুম বল।”
কেনীথের স্বাভাবিক অভিব্যক্তিতে আনায়া কপাল কুঁচকে বলল,
“আপনি এখনো এখানে কি করছেন?”
—“যেতেই তো নিয়েছিলাম। কিন্তু তুই-ই তো.. ”
—“আমি জিজ্ঞেস করেছি, আপনি এখনো আমার বাড়িতে কি করছেন?”
কেনীথ কিছুটা ভেবে বলল,
“তবে কোথায় যাব?”
—“কি আজব! আপনি কোথায় যাবেন, তা আমি কি জানি? যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই যান।”
কেনীথ কিছুটা ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে বলল,
—“বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, আআআনু।”
—“বৃষ্টি কমে গিয়েছে।”
—“বেড়ে যাবে আবার।”
আনায়া কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকার পর কিছুটা বিরক্তির সাথে বলল,
“আপনাকে এমন ইনোসেন্ট মুখে মোটেও মানায় না। ন্যাকা ন্যাকা বাদরের মতো লাগে।”
আনায়ার কথা শুনে নিমিষেই কেনীথের চোয়ার শক্ত হলো। তবুও ঠোঁটো ঠোঁট চেপে, মুচকি হেঁসে নিজের মেজাজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। আজ তার মোটেও এখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। যেভাবেই হোক থাকতেই হবে।
—“তারা! দেখ অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। মনে হয় রাতে ঝড়ও হতে পারে। এইসময় যে কারো বাসার বাহিরে যাওয়াটা সেইফ নয়।”
—“আচ্ছা, আপনি কি চাইছেন। সরাসরি বলুন তো!”
—“আজকের রাতটা এখানে থাকা যায় না?”
—“সম্ভব না।”
—“কেনো?”
—“সম্ভব না, কারণ এই বাসায় শুধু দুটো রুমই আছে। একটা আমার, আরেকটা ইনায়ার।”
—“ঠিকই তো আছে, তবে সমস্যা কোথায়?”
আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে বলল,
“কি ঠিকই আছে? একটাতে ইনায়া ঘুমাচ্ছে। এখন এটা যদি আপনাকে দিয়ে দেই, তবে আমি কোথায় থাকব?”
—“আমার সাথেই।”
—“কি!!!”
—“না মানে… তুই তোর রুমেই থাক, আর ইনায়ার রুমে। আমি না হয়, তোদের ড্রইং রুমে গিয়ে থাকছি।”
আনায়া শুরুতে কিছুটা ক্ষে”পে চিল্লিয়ে উঠলেও, পরবর্তী কিছু একটা ভেবে নিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল,
“প্রয়োজন নেই। আপনি এখানেই থাকুন। আমি না হয় ইনায়ার সাথে থাকব।”
কেনীথও আনায়ার কথা মতো ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। এদিকে আনায়া বালতি জায়গা মতো রেখে, আবারও রুমে আসতেই কেনীথ বলল,
“ঐ শুন, একটা হেল্প করতে পারবি?”
—“হুম বলুন।”
—“বলছিলাম… ”
কেনীথের ইতস্তত ভাবগতিকে আনায়া কপাল কুঁচকে ফেলল।
—“কোনো সমস্যা?”
—“আমি কোনো এক্সট্রা জামাকাপড় আনিনি। আ…এখন এই ভেজা কাপড় নিয়ে কিভাবে… কি?”
আনায়া কিছুটা বিরক্তি ও হতাশা মিশ্রিত চাহনিতে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইল।জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে উঠল,
“এখন আমাকে কি করতে বলছেন?”
কেনীথ কিছুই বলে না, বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।এদিকে কেনীথের এমন নির্বিকারে চুপ থাকতে দেখে আনায়া যেন আরো বেশি হতাশ হয়।
—“এই মাথা নিয়ে আপনি বউয়ের সংসার কিভাবে করবেন? আপনার বউ তো দুদিনেই পালিয়ে… ”
আনায়া কথা বলতে বলতেই থেমে যায়। কেনীথের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে চোখ ছোট ছোট করে অদ্ভুত চাহনিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আনায়া নিজের উপর কিছুটা বি”রক্ত হয়ে কেনীথের সামনে হতে সরে আসে। আলমারি খুলে কিছু একটা খুঁজতে গিয়ে মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“কি সব বলছি। শেষে আমিও এদের মতো পাগল হলাম? কি কপাল আমার৷”
খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আনায়া জামাকাপড় উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। যতদূর জানা, এইখানে কেনীথের পড়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু সমাধান তো একটা বের করতে হবে। এরই মাঝে পেছন থেকে কেনীথ বলল,
“তোর টিশার্ট বা গেঞ্জি টাইপের কিছু নেই?”
আনায়া চমকে ওঠার ন্যায় পেছন ফিরে কেনীথের দিকে তাকায়। চোখ পিটপিট করে বলে,
“আমার গেঞ্জি আপনার মতো জলহস্তীর হবে?”
আনায়ার এহেন কথায় কেনীথের ঠোঁট বিস্ময়ে খানিকটা হা হয়ে যায়। এটা কোন ধরনের কথা ছিল? কপাল কুঁচকে বিস্ময়ের সাথে দূরে থাকা আয়নার নিজেকে একবার দেখে নেয়। পরবর্তীতে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
“সিরিয়াসলি!… জলহস্তী?”
আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেয়,
“তা নয়তো কি? আমার জামা কি আপনার মতো…”
—“এক সেকেন্ড! কিসের জলহস্তীর মতো? আমাকে তো কোন এঙ্গেলে জলহস্তী মনে হয়?”
কেনীথের তীব্র সন্দিহান কন্ঠে, আনায়া ভাবলেশহীন জবাবে বলে,
”
“সব এঙ্গেলেই।…মানুষ হতে হবে মানুষের মতো।তা মেন্টালি হোক কিংবা ফিজিকালি…। তা না হয়ে যদি, এভাবে জোর করে শরীরের বারোটা বাজিয়ে কেউ জলহস্তি, হনুমানের মতো হতে যায়… তবে কেমন লাগে বলুন তো? ছ্যাহ্,আমার তো পুরো বি”শ্রী লাগে।”
কেনীথ চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। বুঝে আসছে না, সে আদতে কোন দুনিয়ায় রয়েছে।
—“আনায়া! তোর কি চোখের সমস্যা রয়েছে? তুই জানিস,এই জলহস্তীর মতো… সরি, আমার এই ট্রাইসেপস,অ্যাবস… বিল্ড ম্যাসেলস্ এর জন্য কত-শত মেয়ে পাগল ছিলো?”
—“ওরা পাগল ছিল কারণ, ওরা নিজেরা পাগল তাই, পাগলের উপর পাগল ছিল।”
কেনীথ ছোট ছোট করে বলে,
“এ্যাই তোর মাথার তার ছিঁ”ড়েছে।”
আনায়া কেনীথের কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে উঠল,
“মোটেও না। ওদের আসলে রুচির দুর্ভিক্ষ ছিল। এছাড়া আর কিছুই নয়,তাই ওদের কথা ভেবে নিজেকে বেশি কিছু মনে করতে যাবেন না। ওরা এসব উৎপটাং জিনিসপাতি দেখে ফাঁসলেও, আমি ফাঁসব না।”
—-“তা কেনো ফাঁসবি, আপনার তো পছন্দ সব ছ্যাকাখো’রদের।”
কেনীথ কপাল কুঁচকে বিড়বিড়িয়ে এ কথা বলতেই, আনায়া কঢ়া স্বরে করে বলে,
“কিছু বললেন?”
—” নাহ্! তুই আমার মাথা না খেয়ে কাজ কর তো,আমার বিরক্ত লাগছে।”
—“বিরক্ত তো আমার আপনাকে লাগছে। যাই হোক, হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই৷”
—“আবার কি হাওয়ার সম্ভবনা নেই?”
কেনীথের এমন গুলিয়ে ফেলা কথাবার্তা শুনে,আনায়া অনেকটা বিরক্ত হলো।
—“এখানে আমার কোনো টিশার্ট নেই, যেটা আপনার হবে।”
—“আমি ফ্রি সাইজের কথা বলেছি।”
—“তো আমার কাছে ফ্রি সাইজ কিংবা চিকনি চামেলি, কোনোটাই নেই।”
—“বাহ… আগে তো ঠিকই পড়তি। হঠাৎ এতো উন্নতি, এতো সুশীল…।”
—“আমি সর্বকালেই সুশীল…। বাজে কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। নয়তো বাড়ি থেকে বের করে দেব।”
আনায়াও আর কথা বাড়িয়ে,আবারও নিজের কাজে লেগে পড়ল। ওদিকে কেনীথ পেছন থেকে আনায়ার দিকে চোয়াল শক্ত তাকিয়ে রইল। বিষয়টা তার কাছে কিছুটা হাস্যকরও বটে।
আনায়া অনেকক্ষণ খোঁজা খুঁজি করে কাজের মতো কিছুই পেল না। শেষমেশ কোমড়ে হাত গুঁজে কিছুটা একটা ভাবতে লাগল। অতঃপর দুটো মোটা সাদা ও কালো রঙের ওড়নার পাশাপাশি একটা বড়সড় সাদা রঙের নতুন তোয়ালে বের করল। সেসব নিয়ে কেনীথের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“এগুলোর ছাড়া আর উপায় নেই।”
কেনীথ জিনিসগুলো দেখে খানিকটা কপাল কুঁচকে বলল,
“এসব দিয়ে কিভাবে কি?”
—“কিচ্ছু করার নেই, উপরেরটার ব্যবস্তা হবে না। নিচেরটার হবে। চাইলে একটা দিয়ে গা ঢাকতে পারেন। ঐ একই কথা৷”
—“মানে কি?”
আনায়া কেনীথের এমন অবুঝের মতো ভাবভঙ্গিতে আরো খানিকটা বিরক্ত হয়।
—“মানে হলো,এগুলোর মধ্য থেকে পছন্দ মতো একটা নিয়ে লুঙ্গি বানিয়ে পড়ে নিবেন। আর যদি চান খালি গায়ে থাকবেন তবে থাকুন, নয়তো আরেকটা গায়ে পেঁচিয়ে নিতে পারেন। এমনিতেও, ঘুমাবেন তো কম্বল মুড়িয়েই।”
—“কি! তোর মাথা ঠিক আছে?… লুঙ্গি? এ জিনিস আমি আমার লাইফ হিস্ট্রিতে কখনো পরিনি।”
—“পড়েননি যখন তবে আজ পড়ুন। পড়ে ইতিহাস গড়ুন।”
—“আনায়া!প্লিজ মজা করিস না!”
—“আমি মোটেও মজা করছি না… আচ্ছা শুনুন। আপনাকে লুঙ্গি পড়তে হবে না। আপনি বরং এটাকে যাস্ট পেঁচিয়ে নিন। গোসলের পর তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়েছেন না? তো সেভাবেই এটাকেও পেঁচিয়ে টুপ করে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আর কাল সকাল হতে না হতে বরং আপনি পাভেল ভাইকে বলে জামাকাপড় আনিয়ে,আমার বাসা থেকে বিদায় হবেন… তো কাহিনি এখানেই শেষ।”
—“সব ঠিক আছে, কিন্তু ঘুমের ঘোরে যদি খুলে যায়?”
—“তো কি হয়েছে? ওটা খুলে গিয়েছে, নাকি ঠিকঠাক রয়েছে, এসব দেখতে কে আসবে!”
—“আসতেও তো পারে।”
—“কি আজব, এই বাড়িতে আমি আর আমার বোন ছাড়া আর কে আছে?… এক সেকেন্ড, আপনি কি মিন করতে চাচ্ছেন,রাত-বিরেতে আমি আপনার ওসব দেখার জন্য আসব?”
—“আসতেও তো পারিস। অস্বাভাবিক কিছু তো নয়।”
আনায়ার চোখমুখ খিঁচে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়। ইচ্ছে হলো, আলাভোলা চেহেরা বানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কেনীথের মুখ বরাবর কষিয়ে ঘু”ষি মা”রতে। কিন্তু এটা এই মূহুর্তে এমন করাটা মোটেও সভ্য কাজ হবে না। বহু কষ্টে নিজের রাগ থামিয়ে কথার প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে কিছুটা দাঁত খিঁচে বলল,
“আপনি থাকুন, আমি ঘুমাতে চললাম।”
এই বলেই আনায়া আর আশেপাশে না তাকিয়ে সোজা চলে যেতে নিয়ে, পুনরায় পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে,
“এই যে শুনুন,খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন?”
কেনীথ যেন কিছু বলতে নিয়েও আর বলতে পারল না। এটা কেমন কথা। তার যেতে যেতে তো সেই সকাল হবে।
কেনীথ কিছুই বলছে না দেখে, আনায়া ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর খানিকটা হতাশ হয়ে নিজেই বলল,
“আচ্ছা থাকুন, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
আবারও আনায়া রুম থেকে বাহিরে, চলে যেতে নিয়ে, পুনরায় কি যেন ভেবে পেছন ফিরে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“এই যে শুনুন, মাথার চুলগুলো ভালোমতো মুছে নিবেন।রাত-বিরেতে অসুখ হলে,আমি কিন্তু কোনো প্যারা নিতে পারব না।”
আনায়া এটুকু বলেই সোজা রুম থেকে বেরিয়ে যায়।ওদিকে কেনীথ আনায়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। অতঃপর ভেজা জামাকাপড় বদলে নেওয়ার জন্য সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
____________
আনায়া প্লেটে খাবার সাজিয়ে রুমের দরজার কাছে আসে। তার একহাতে খাবারের প্লেট অন্যহাতে পানির গ্লাস।কিন্তু শুরুতে কেনীথকে কোথাও নজরে না পড়ায় তার কপাল খানিক কুঁচকে ফেলে।তবে যেই না মুখ ফিরিয়ে পাশে তাকায় ওমনিই আনায়া সম্পূর্ণ থমকে যায়।
রাতের আকাশের গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে একটানা ঝরছে বৃষ্টি। এই বৃষ্টির আজ যেন থামবার কোনো নাম নেই। কখনো কমছে তো, কখনো বাড়ছে। জানালার কাঁচে টুপটাপ শব্দ ঘিরে রেখেছে পুরো ঘরটাকে। মাঝে মাঝে দূর আকাশে মেঘের গর্জন, নিঃশব্দে ঢাকা শান্ত আবহকে অশান্ত করে তুলছে।
আনায়া খাবারের প্লেট আর পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরের আরো ভেতরের দিকে পা বাড়ায়। অন্ধকারে হালকা আলো নিভু নিভু করে জ্বলছে।আনায়া চারদিকে চোখ বুলিয়ে কেনীথকে খোঁজে, কিন্তু কোথাও তার দেখা নেই। নিমিষেই তার ভ্রু কুঁচকে যায়।এক পা এগিয়ে পেছনে ফিরতেই — “ধপাস!”
এক শক্ত, উষ্ণ, ভেজা শরীরের সাথে সজোরে ধাক্কা লাগে তার।বিশেষ করে মুখ গিয়ে ঠেকে যায় কারো টানটান বলিষ্ঠ বুকের মাঝ বরাবর। প্লেটের খাবার টলমল করে ওঠে। হাত থেকে গ্লাস না পড়লেও, তাতে থাকা পানির কিছুটা ছিটকে পড়ে নিচে।
আনায়া আঁতকে উঠে মাথা তোলে।এবং সাথে সাথে তার নিঃশ্বাস আটকে আসে গলায়।সামনেই কেনীথ দাঁড়িয়ে।কোমরের নিচে মাত্র একটি সাদা তোয়ালে পেঁচানো, গলায় ঝোলানো ঢিলেঢালা ছোট একটি তোয়ালে। এছাড়া আর পরণে কিছুই নেই।
তার ভেজা ত্বক চকচক করছে মৃদু আলোয়। বুকের মাংসপেশি যেন কাট কাট স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। প্রতিটি বিন্দু পানির ফোঁটা ধীরে ধীরে বয়ে যাচ্ছে বুক হতে পেটের দিকে।
চুল ভিজে কপালে লেপ্টে পড়েছে, আর চোখ…চোখ দুটো যেন গভীর, অন্ধকারের কোনো অতল সমুদ্র। এবং যা হতে চোখ সরানোই এখন আনায়ার জন্য দায়।
আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে।তার হৃদপিণ্ড বেপরোয়া হয়ে বেজে ওঠে বুকের ভেতর। হাত কাঁপছে, প্লেট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস খানিকটা সময়ের জন্য থমকে গিয়েছে। ঠোঁটও শুকিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে আনায়া জিভ দিয়ে অজান্তেই ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
এদিকে কেনীথ নির্বিকারে তার দিকে তাকিয়ে।আনায়ার এহেন ভাবগতিকে কেনীথ সামান্য ঝুঁকে আসে, তার শরীরের তাপমাত্রা একটুখানি ছুঁয়ে যায় আনায়ার মাঝে। কেনীথ গলা খানিক নীচু করে। খানিকটা রুক্ষ, খানিক দুষ্টু স্বরে বলে,
“তুমি যদি এতটাই কাছে আসতেই চাও, তবে আমায় সরাসরি-ই বলতে পারতে, আ…না…য়া!”
আনায়া শ্বাস আটকে চোখ সরাতে চায়, কিন্তু পারছে না। সেই সাথে কেনীথের এমন তুমি সম্মোধন যেন তার মাথাটাকে আরো বেশি গুলিয়ে দিচ্ছে ।নিজেকে প্রবল চেষ্টায়, টেনে সরায় সে। কয়েক কদম পিছিয়ে, গলার কাঁপুনিকে চেপে রেখে বলে,
“খাবার দিতে এসেছি। ব্যাস, আর কিছু না। খেয়ে-দেয়ে দয়া করে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
আনায়ার গলার রুক্ষতা, কেনীথের ঠোঁটে আরও গভীর হাসি ফুটিয়ে তোলে।সে আলতো করে মাথা নাড়িয়ে, নিজের চুল হতে পানি ঝাড়ে। পানি ছিটকে এসে আনায়ার গায়ে লাগে। আনায়া অনভিপ্রেতভাবে সরে আসে।আকস্মিকতায় নিমিষয়েই তার গাল লাল হয়ে ওঠে।
এদিকে কেনীথ তার গলা আরও একটু নীচু করে, ফিসফিসিয়ে আওড়ায়,
“বাহিরের বৃষ্টির চেয়ে, ভেতরের ঝড়টা হয়তো বেশি জোরালো, তাই না?”
আনায়া কোনো উত্তর না দিয়ে তড়িঘড়ি করে খাবারের প্লেট টেবিলে রাখে।গ্লাসটা রাখতে গিয়ে হাত কেঁপে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।তবুও কোনোমতে সামলে নেয়।চোখ নামিয়ে নেয় নিচের দিকে। ঠোঁট আঁকড়ে ধরে, যেন নিজের মুখের ভেতরের অপ্রত্যাশিত সকল আবেগ অনুভূতিকে গিলে ফেলবে।
—“দ্রুত খাবার খেয়ে রেহাই দিন আমায়।”
এরপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, দ্রুত পেছন ঘুরে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে কি যেন ভেবে সে কাজের বাহানায় আবার বিছানার কাছে চলে আসে। বিছানায় পানি পড়ে অনেকটা ভিজে গিয়েছিল, নতুন করে ঠিক না করলে এতে রাতে শোয়া সম্ভব না।
এদিকে কেনীথ এক চিলতে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আনায়ার কাজকর্ম অভিব্যক্তি সবকিছুই তার সুক্ষ্ম নজরে ধরা দিচ্ছে। সেই সাথে তার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে এক অপার রহস্য। এক অনুচ্চারিত টান। এই রাত, এই বৃষ্টি, এই অনির্বচনীয় মুহূর্ত…সবকিছুই যেন তাদের অজান্তেই কিছু অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে ফেলেছে।
কেনীথ কিছুটা হেলে-দুলে গিয়ে সোফায় বসে। একই সাথে গানের সুরে বিড়বিড়িয়ে দু’লাইন আওড়ায়,
“প্রেমে পড়েছে…বউ আমার,…জওয়ানি দেখে।
লণ্ঠন জ্বালাইয়া নিভাইয়া চমকে চমকে রাতে…
“প্রেমে পড়েছে…বউ আমার,…জওয়ানি দেখে”
কেনীথ আনমনে গান গেয়ে খেতে বসলেও, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে ফেলে। যদি কেনীথের পুরো গানের কথাগুলো তার কাছে স্পষ্ট ছিল না। তবে সে পেছন ফিরে কেনীথের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠল,
“আপনি কি কিছু…”
আনায়া কথা বলতে গিয়েই থেমে যায়। তবে কেনীথ ঠিকই উত্তর দেয়,
“নাহ,তেমন কিছু বলিনি৷ গানটা সুন্দর, তাই গাইলাম।”
অথচ পেছন ফিরে থাকা আনায়াকে দূর হতে তাকিয়ে দেখতে দেখতে, কেনীথ মনে মনে আওড়ায়,
“আহ্,কে যেন বলেছিল আমার এই বিল্ড বডি তার কাছে জলহস্তীর মতো লাগে। ছ্যাহ্, তার তো এসব নাকি বিশ্রী লাগে।
তা ম্যাম,শেষমেশ আপনার কেনো এই দশা হলো শুনি। উফ্, এবার বুঝতে পেরেছি৷ ম্যামের ঝামেলা তবে তখনই হয়েছিল। ওসব যাস্ট নিজেকে স্বাভাবিক রাখার কায়দা।
তাই তো বলি,দুনিয়ার সব মেয়ে যেখানে এই একজায়গায় গলে যায়, সেখানে আপনি বা আবার কোন ফুলের মধু।
হোয়াট এভার, এতো ভাব ধরে কোনো লাভ নেই। একবার যাস্ট সুযোগ পাই। তোর সব ভ’ণ্ডামি, ছাড়িয়ে দেব আমি।”
কেনীথ কিঞ্চিৎ তীর্যক মুচকি হেসে মাথা নুইয়ে খাওয়া শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। তবে চামচ দিয়ে প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কি যেন ভেবে হুট করে আনায়ার উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করে,
“তুই খেয়েছিস?”
কেনীথের কুঁচকে যাওয়া কপাল আর সিরিয়াস অভিব্যক্তিতে, আনায়া খানিকটা দ্বিধা নিয়েই জোর গলায় বলল,
“রাতে খাই না আমি।”
—“ওহ্, আ…চ্ছা।”
এই বলেই কেনীথ মাথা নিচু করে খেতে বসল। ওদিকে আনায়া কোন কাজের জন্য এসে কি করছে তাই বুঝতে পারছে না। ঠিক তখনই পেছন থেকে আওয়াজ এলো,
“বিছানা, পানিতে পুরো চুপসে গিয়েছিল…আমি নতুন করে আবার সব চেঞ্জ করে নিয়েছি।”
আনায়া পেছন ফিরে দেখে কেনীথ চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। সে কেনীথের কথামতো সামনে ঘুরে আবার বিছানায় তাকাতেই দেখে চাদর সহ সবকিছুই নতুন। অথচ, এতোক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও সে এসব খেয়ালই করেনি। আনায়া নিজের উপরই কিছুটা বিরক্ত হলো। রুম থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্য পেছন ফিরতে না ফিরতেই কেনীথ আবারও বলল,
“আমার খাওয়া শেষ। এসব নিয়ে যা৷”
এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ… আনায়া খানিকটা অবাক হলো। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে, কেনীথ চুপচাপ বসে রয়েছে। তার সামনে টেবিলে পড়ে থাকা প্লেটের সব খাবার একপাশে সুন্দর মতো জড়ো করে রাখা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, আনায়া যতটুকু খাবার দিয়েছিল, তার খুব অল্প পরিমানই কেনীথ খেয়েছে।
কেনীথের সামনে গিয়ে আনায়া কপাল কুঁচকে দাঁড়ায়। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে থাকা কেনীথের উদ্দেশ্যে কিছুটা বিরক্তির নিয়ে বলে ওঠে,
“মাত্র এটুকুতেই আপনার খাওয়া হয়ে গেল?”
—“যতটুকু প্রয়োজন ছিল ততটুকু খেয়েছি, আর খেতে পারব না।”
—“খেতে পারবেন না মানে? এ খাবার আমি কি করব?”
—“তা আমি কি জানি৷ চাইলে ফেলে দে।”
আনায়া কিছুক্ষণ থেমে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। অতঃপর কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আবারও বলে,
“আগে না খুব জ্ঞান দিতেন, আপনি খাবার কখনো নষ্ট করেন না। আর এখন বলছেন, এতোগুলা ফেলে দেব?”
—“কি আজব, তোকে ফেলতেই হবে এটা কে বলল।ফেলতে ইচ্ছে না হলে, খেয়ে নে।”
আনায়া আর কিছু বলে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। অন্যদিকে কেনীথ আড়ালে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে।
______
কেনীথ বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে রয়েছে।গায়ের উপর পাতলা একটা কোম্বল। হঠাৎ মাথাটা খানিক ভারী লাগছে। কিছুটা ব্যাথাও করছে। তবে তার সেদিকে তেমন গুরুত্ব নেই। সে তাকিয়ে রয়েছে সামনের দিকে। সোফায় বসে থেকে আনায়া খাবার খাচ্ছে। তার অবশিষ্ট খাবারটুকুই সে খাচ্ছে। আর এসব দূর থেকে দেখে কেনীথ আড়ালে মুচকি মুচকি হাসছে। আনায়ার খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় কেনীথ আনায়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আনায়া! এই সেইম খাবার কি রাতে, ইনায়াও খায়?”
কেনীথের কথা শুনে,আনায়া খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে যায়। খানিকটা ভ্রু কুঁচকে,কেনীথের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জবাব দেয়,
“না, ওর খাবার আলাদা।”
এই বলেই আনায়া চামচ নেড়ে আবারও খেতে শুরু করে। ওদিকে কেনীথ আবারও বলে,
“ওহ, তা এই খাবার কার জন্য রেঁধেছিলি? না মানে, তুই তো নাকি আবার, রাতে কোনো কিছু খাস না৷”
আনায়া কোনো জবাব দেয় না৷ চুপচাপ বসে থাকে। যা দেখে কেনীথ আবারও খানিকটা মুচকি হেসে ফেলে৷
—“তাহলে, তুই কি জানতিস যে, আমি আসব?”
আনায়া এবারও চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“কি বলতে চাইছেন?আমি এতোই মানব দরদী যে, আমার নিজের খাবার আমি না খেয়ে, আপনাকে দিয়েছি? আপনি এতোই মহান ব্যক্তি, আর আমিই এতোই ভালো?”
—“কেনো তুই ভালো না?”
—“আ..অবশ্যই আমি ভালো… তবে এতোটাও ভালো নই যে, নিজে না খেয়ে আপনাকে খাইয়ে সেবা করব।”
—“ওহ্ আচ্ছা।”
—“আচ্ছা আপনার সমস্যা কি! আপনি বারবার এভাবে হাসছেন কেনো? এমন করলে কিন্তু সোজা বাড়ি থেকে বের করে দেব ।”
—“এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? আমার এখানে থাকা নিয়ে কতবার খোঁচা দিয়েছিস, হিসেব আছে?”
—“এছাড়া আর কি করব, যতক্ষন আমার চোখের সামনে থাকবেন, ভালো মতো থাকবেন। নয়তো এমন খোঁচা আরো শুনতে হবে।”
—“কেনো, আমায় দেখে কি আপনার গা জ্বলে, নাকি… কাহিনি…আরো গভীর কিছু?”
—“গভীর কিছু বলতে কি বোঝাতে চাইছেন..আ..আমি…”
আনায়ার কথার মাঝেই কেনীথ বিছানা থেকে উঠে ধাড়ায়।ওকে নিজের কাছে আসতে দেখে আনায়া নিজেও খানিকটা অজান্তেই ভড়কে যায়।
—“কি… কি..হলো?…না ঘুমিয়ে এদিকে আসছেন কেনো?”
কেনীথ কোনো জবাব দেয় না বরং,তার পাশের সোফায় গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। যদিও দুজন দুসোফায় বসে রয়েছে, কিন্তু কেনীথ তবুও তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসতেই আনায়া তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,
“সমস্যা কি আপনার? কি শুরু করেছেন?”
—“আমি তো এখনো কিছু করলামই না, ভয় পাচ্ছো?”
—“কি আজব, ভয় পাব কেনো? আপনাকে ভয় পাওয়ার কাল, বহু আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। আপাতত এটা বলুন, আমাকে ‘তুমি’ ‘তুমি’ করে আবার নতুন কোন ভং ধরছেন?”
কেনীথ কিছুই বলে না। শুধু আনায়ার ঘাবড়ে যাওয়ার পরও, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার প্রচেষ্টা দেখে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে।
—“তা তুমি কেনো আমায় ‘আপনি’ ‘আপনি’ করছো, শুনি?”
—“আমি তো আপনাকে শুরু থেকেই ‘আপনি’…”
—“নাহ, শুরুর কথা ভিন্ন। কিছুদিন আগেও তুমি আমায়…”
—“আরেহ, তখন তো… তখন তো ওসব…অ…অভিনয় ছিল। এখন আপনিও কি…”
—“একটু আকটু অভিনয় আমিও পারি। চর্চা করলে, ব্যাপারটা মন্দ নয়৷”
আনায়ার ঠোঁট চুপসে যায়। হাতে থাকা চামচটা বারবার কচলাতে শুরু করে৷ তবুও দৃঢ়তার সাথে বলে,
“শুনুন!!!”
—“হ্যাঁ,বলুন৷”
—“আপনি আমার মাথা খাবেন না।”
—“ছিহ্, মাথা কি খাওয়ার জিনিস?…আমি যা খেতে চাইব, তা তো আপনি দেবেন না।”
কেনীথের নির্লিপ্ত কথাবার্তা আর মাঝেমধ্যে মুচকি মুচকি হেসে চলা… সবকিছুই আনায়াকে আরো গুলিয়ে ফেলছে। আনায়া আরো বেশি ভরকে গেলেও নিজেকে সামলাতে আকস্মিক উঠে দাঁড়ায়।
—“আরেহ,কি হলো? আপনার খাওয়া তো এখনো শেষ হয়নি।”
আনায়া কেনীথের কথামত নিচে তাকিয়ে দেখে, টেবিলের উপর থাকা প্লেটটায় এক-দুই চামচের মতো খাবার অবশিষ্ট পড়ে রয়েছে। কিন্তু আনায়া সেদিক থেকে নজর সরিয়ে কেনীথ দিকে তাকিয়ে কঢ়া স্বরে বলে,
“শেষবারের মতো বলছি, আমাকে শান্তিমতো থাকতে দিন। মোটেও আর কোনো অশান্তি করবেন না।”
কেনীথও আনায়ার কথায় মুচকি হেসে বলে,
“ঠিক আছে,… কিন্তু আগে খাবারটা তো শেষ করে নে। খাবার ন”ষ্ট করা কিন্তু ভারী অন্যায়, আ…না…য়া!”
আনায়াও খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুনরায় বসে পড়ে। আর এক চামচ খাবার মুখে তুলতেই কেনীথ আবারও বলে,
“আমি ছাড়া তোর জীবন খুব শান্তিতে কাটে তাই না?”
আনায়া নির্বিকার উত্তর দেয়,”অবশ্যই৷”
—“হুম, তা তো দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
আনায়া খাবার চিবাতে চিবাতে কেনীথের দিকে তাকায়। কেনীথ আলতোভাবে মুচকি হাসে। দু’জনে আবারও নিজেদের নজর একে-অপরের থেকে সরিয়ে নেয়৷ কিন্তু এভাবে আরো কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ আবারও বলল,
“এমন কঙ্কালসারের মতো চেহেরা বানিয়েছিস কেনো?… ডায়েট করিছ?”
—“হুম, ওমন কিছুই ভাবতে পারেন৷”
—“ভালো, ডায়েট করা ভালো। তবে খেয়াল রাখিস,এভাবে চলতে থাকলে দুদিন বাদে কঙ্কালসার থেকে সুতা কৃমির মতো চেহেরা হতে, বেশিদিন লাগবে না।”
আনায়া র’ক্তগরম চোখে কেনীথের দিকে তাকায়। দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠে,
“খেতে বসেছি আমি৷”
—“উফ,সরি। ভুলে গিয়েছিলাম।”
কেনীথের অভিব্যক্তি অদ্ভুত। কখনো নির্লিপ্ত স্বরে উল্টোপাল্টা কথা বলছে তো, কখন সেই ফাঁকে মুচকি মুচকি হাসছে। তবে সর্বক্ষণ তার নজর আনায়ার দিকে।
—“আমাকে নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি, আশাকরি ভবিষ্যতেও আরো ভালো থাকব।”
—“হুম, বুঝলাম।”
আনায়ার খাবার খাওয়া শেষ। পুরো প্লেট আপাতত পরিষ্কার। গ্লাসে থাকা পানি থেকেও কিছুটা খেয়ে নেয়। এরই মাঝে কেনীথ খানিকটা নাক ছিটাকনো স্বরে বলে উঠল,
“ছিহ্! আনায়া… ইয়াক!”
হঠাৎ কেনীথের এমন ভাবভঙ্গিতে আনায়ার হুঁশ উড়ে যায়।চোখ পিটপিট করে তাকায়।কেনীথ এমন করছে কেনো?
—“কি হলো? এমন পোয়াতির মতো করছেন কেনো?”
এবার আনায়ার কথা শুনে কেনীথের চেহেরা পাল্টে গেল। কিছুটা কপাল কুঁচকে অজানা স্বরে বলল,
“এ পোয়াতি কি জিনিস?”
কেনীথের প্রশ্ন শুনে আনায়া কেশে উঠল। কোনোমতে কথা ঘুরিয়ে আবারও বলল,
“ও কিছু না, এটা বলুন… হুট করে এমন নাক ছিটকাচ্ছেন কেনো?”
কেনীথ আনমনে কিছুটা মুচকি হাসতে হাসতে বলে,
“তুই আমার এঁটো খাবার খেয়েছিস ঠিক আছে। কিন্তু… তাই বলে এঁটো চামচে কিভাবে খেলি,আনায়া?আবার একই গ্লাস থেকে পানি…ছ্যাহ!”
আনায়া কেনীথের দিকে চোখ ছোট ছোট করে, দাঁত খিঁচিয়ে বলে,
“খাওয়াদাওয়া শেষ, আর এখন এই কথা বলছেন!”
—“এখন বললাম দেখেই তো,নিজ চোখে তোকে… আমার এঁটো চামচে…ছিহ্ ছিহ্।”
আনায়া রাগে-বিরক্তিতে চামচ শক্ত করে ধরে, প্লেটের উপর সজোরে আঘাত করল। তৎক্ষনাৎ কেনীথ ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে আবারও বলল,
“আরেহ আস্তে! ভেঙ্গে যাবে তো!
“অস’ভ্য লোক! মানুষ হতে পারবেন না কোনোদিন।”
আনায়া আর একমুহূর্তও বসে না৷ দ্রুত প্লেটটা নিয়ে,বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে আসতে নেয়।একই সময়ে কেনীথও পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে দৌড়ে আনায়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়।
—“পানির গ্লাসটা তো নিয়ে যা!”
আনায়া একটা কথাও না বলে শুধু কেনীথে দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে রইল। কেনীথের অসময়ের অদ্ভুত হাসি তার মোটেও পছন্দ হলো না। কেনীথের হাত থেকে গ্লাসটা নিতে চাইলে, কেনীথ আবার তা সরিয়ে নিয়ে গ্লাসের অবশিষ্ট সামান্য পানিটুকু খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ করেই আবার গ্লাসটা আনায়ার দিকে এগিয়ে দিলে, আনায়া তা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেতে ধরে। কিন্তু একই সময় কেনীথ বাঁধা দিয়ে আবারও বলে,
“চোখের নিচে এমন ডার্ক সার্কেল বানানো কি… মেয়েদের বিউটি স্টাইলের নতুন ট্রেন্ড?”
আনায়া এবারও কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ কঢ়া চোখে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে কেনীথ চুপচাপ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবারও বলে উঠল,
—“আমায় ছাড়া তোমার তো সুখে থাকার কথা। প্রতিটা দিন রাত তো শান্তিময় হওয়া কথা। কিন্তু তোমার এই চোখের নিচের কালচে দাগ তো ভিন্ন কথা বলে। এতো নির্ঘুম রাত কেনো কাটাও, ব্লাড! সুখী মানুষের চোখে তো এতো বিষাদের ছায়া থাকে না… ”
অকস্মা কেনীথ এহেন কথায় আনায়া নিজের অজান্তেই কিছুটা কেঁপে উঠল। অজানা এক শিহরণে তার গলা শুকিয়ে এলো। যদিও সবটাই কেনীথের সুক্ষ্ম চাহনিতে স্পষ্ট ধরা পড়েছে। তবে কেনীথের চোখের দিকে আর একমুহূর্তও তাকিয়ে থাকা আনায়ার সম্ভব হয় না। কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিতে গিয়েও, কেনীথের চোখের নিচে জমে থাকা অপ্রকাশিত নানান কথা, ক্লান্তি কিংবা নির্ঘুমে রাত কাটানোর ফলাফল হিসেবে সামান্য কালচে দাগ…সবই তার নজরে ধরা দেয়।
তবে আনায়া আর একমুহূর্তও কেনীথের সামনে দাঁড়ায় না। যতটা সম্ভব পারা যায়, দ্রুত সে কেনীথের সামনে থেকে সরে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উদ্বিগ্ন। কেনীথও এবার আর বাঁধা দেয় না। শুধু আনায়ার যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে।
আনায়া রুম থেকে কোনোমতে বেড়িয়ে এসেই জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। দম তা ফুরিয়ে আসার দায়। একই সাথে কিছুটা স্বাভাবিক হলেই, আনায়া বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“ভেবেছে আমি কিছুই বুঝিনা। লাভ নেই, এসব করে কোনো লাভ নেই। এই আনায়া আর এসবে গলছে না।”
__________
ঘরের সবকিছু অন্ধকারে ডুবে রয়েছে।ঘরজুড়ে অঝোরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। জানালার ফাঁক গলে ছিঁড়ে আসা বাতাসের ঝাপটায় পর্দা বারবার ছিটকে দুলে উঠছে। আবার কখনো জানালার বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি আর ছিন্নভিন্ন বাতাসের ভয়”ঙ্কর শব্দ ঘর কাঁপিয়ে তুলছে।
ঘরের কোণে পুরনো দেয়ালঘড়িটার টিকটিক শব্দের মাঝেই, বাইরে থেকে গর্জে ওঠা বিদ্যুতের ঝলকানিতে আনায়ার নিদ্রাভঙ্গ হয়। সে ছটফট করতে করতেই খানিকটা কেঁপে ওঠে। অস্থিরতা নিয়ে চোখ মেলে দেখে পাশে ইনায়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নিঃশ্বাসের মৃদু শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়। বাইরে প্রবল ঝড়ো হাওয়া জানালার কাঁচ কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বিদ্যুতের বিকট চমক কখনো পুরো ঘরটাকে ভৌতিক আলোয় উজ্জীবিত করছে ,তো কখনো আবার গিলে নিচ্ছে গভীর অন্ধকারে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ…জানালার ফাঁক বেয়ে থমথমে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে।
আনায়া চোখ খুলেই খানিকটা চমকে ওঠার ন্যায় বসে পড়ে। পাশে ফিরে আবারও, একপলক গভীর ঘুমে ডুবে থাকা ইনায়ার দিকে তাকায়। তার শান্ত মুখ দেখে খানিকটা আশ্বস্তও হয় আনায়া। তবুও বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা থেকেই যায়।
আনায়া ঘড়িতে সময়টা একবার দেখে নেয়। ঠিক একদম মধ্যরাত।কাল সারাদিনে কত কাজ, অথচ কয়েক ঘন্টাও ঠিকঠাক ঘুম হলো না তার। এরইমাঝে নিমিষেই মাথাটা ধরে যায়। মনের মাঝের অস্থিরতা আর মাথা ব্যাথায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এলোমেলো চুলগুলো দুহাতে ঠেলে পেছনে ছড়িয়ে দেয়।
তবুও আনায়ার বুকের ভেতর অজানা অস্থিরতা।
বাইরের ঝড় যেন তার মনেও ঝড় তুলেছে।
একবার মনে হয়, সবকিছু ঠিক নেই। আবার পরক্ষণেই মনে হয়,সব ঠিক আছে।কিছু একটা ভেবে নিয়ে, সে নিজেকে দৃঢ়ভাবে বোঝায়, “কিছুই না… এত রাতে কোথাও যাওয়ার মানে নেই।”
কিন্তু প্রতিবার কেনীথের কথা মনে পড়তেই এক অদ্ভুত টান তাকে গ্রাস করে। সঙ্গে সঙ্গে তর্জনী কামড়ে নিজেকে সামলায়। যদিও প্রবল ঝড়ের রাতে একা পাশের ঘরে যাওয়ার ইচ্ছে তার দৃঢ় মন সহজে অনুমতি দেয় না। তবুও একটা অলক্ষ,অব্যক্ত—টান, চাপা উদ্বেগ তাকে বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে।
ঝড়ের এমন রাতে, একটু হলেও খবর নেবার প্রয়োজন পড়ে,তাই না? কিন্তু এসব ভেবে পরক্ষণেই সে নিজেই নিজেকে ধমকায়,
“এতো রাতে কে কার কাছে যাবে! নিশ্চয় ঠিকই আছে।”
কিন্তু বারংবার নিজেকে করতে থাকা এই শাসন, কোনো কাজেই লাগে না। পানির অজুহাতে আনায়া নিজের রুম থেকে বেরিয়ে, ড্রইংরুম পর্যন্ত আসে। বাইরে বিদ্যুতের চমক আবার চারপাশ আলোকিত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। সেই আলোয় ভেসে ওঠে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে ঢেকে থাকা নতুন পুরাতন আসবাবপত্রের ছায়া। আনায়া সেসব হতে নজর সরিয়ে জোরে শ্বাস নেয়। গ্লাসে পানি ঢেলে তাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে নেয় তো ঠিকই, কিন্তু তার নজর পড়ে থাকে কেনীথের শোবার ঘরে। আনায়া নিজের ঠোঁট শক্ত করে চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে।
তবশেষে, সবকিছুতে ব্যর্থ হতে হয় তাকে। কী এক অজানা টানে, দিক পাল্টে নিজের রুমে না গিয়ে, সরাসরি কেনীথের রুমে সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়।
দরজার ফাঁক দিয়ে ঝড়ের আলো বাহির অব্দি ছুঁয়েছে।কিছুক্ষণ সময় দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর, একটা সময় আনায়া নিজেকে হার মানায়।
হালকা ঠেলা দিয়ে দরজা খুলতেই ঝড়ের প্রবল হাওয়ায় দরজা দুলে ওঠে। বিদ্যুতের ঝলকানিতে ঘরের চিত্র স্পষ্ট হয়। পুরোনো গ্লাসের জানালাটা বারবার ঝাঁকুনি খাচ্ছে। দেয়ালের ফ্রেমগুলো ঠকঠক করে কাঁপছে। আর বাতাসে পর্দাগুলো যেন ছিঁড়ে আসার উপক্রম। বাতাসের অস্থিরতায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে আছে।
সবকিছু উপেক্ষা করে আনায়ার দৃষ্টি বিছানার দিকে পড়ে।পাতলা কম্বলের নিচে কেনীথ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। কিন্তু তার শরীর মৃদু কম্পনে হলেও অনবরত কাঁপছে। যেন প্রচণ্ড শীতে জবুথবু হয়ে রয়েছে।বিষয়টা আনায়ার কাছে কেন যেন স্বাভাবিক ঠেকল না।
আতঙ্কিত হয়ে আনায়া ছুটে যায় কেনীথের কাছে।একই সাথে তার পাশে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে পড়ে। কপালে হাত দিতেই অকস্মা চমকে ওঠে।কেনীথের গা আগুনের মতো গরম। সেই সঙ্গে তার কাঁপুনি থামছেই না।
এরই মাঝে আনায়ার হাত কেনীথের চুলে পড়তেই সে টের পায়, চুলগুলো এখনো ভিজে। একই সময় তার মনে পড়ে, সে আগেই নিষেধ করেছিল,,,ভেজা চুলে থাকলে অসুখ হবে। কিন্তু কেনীথ তা শোনেনি। উল্টো ভিজে চুল নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।নিমিষয়েই রা’গ বিরক্তিতে আনায়া দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। কেনীথের মাথার কাছেই পড়ে থাকা সাদা ছোট তোয়ালেটা শক্ত হাতে খিঁচে নেয়।অত:পর দাঁত খিঁচে হিসহিসিয়ে আওড়ায়,
“এটা মানুষ না…পুরো বলদ! অপ”দার্থ একটা!”
আনায়া এই বলেই কেনীথের পাশ থেকে উঠে আসে। প্রতিনিয়ত কাঁপতে থাকা কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবারও বলে ওঠে,
“পারব না আমি। কিচ্ছু করতে পারব না। পড়ে পড়ে মরুক, আমার কি!”
কেনীথকে অমন অবস্থায় রেখে, আনায়া রুম থেকে বেরিয়ে আসতে নেয়। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই আকস্মিক থমকে যায়। কোনো এক অদৃশ্য টানে,পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। পিছন ফিরে তাকাতেই নিজের অজান্তেই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে তার।অত্যাধিক রা’গে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হয়ে, হাতে থাকা তোয়ালেটা ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। তৎক্ষণাৎ আবার সেটি কুড়িয়ে নেয়। দু’হাত শক্ত ভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁত খিঁচিয়ে বলে,
“কাঁদিস কেনো বলদি,এখানে কাঁদার কি আছে?”
আনায়া আর একটুও সময় নষ্ট করে না। দ্রুত পায়ে ফিরে এসে কেনীথের পাশে বসে পড়ে। ভেজা চুল মুছে দিতে থাকে স্বযত্নে। অতঃপর তড়িঘড়ি করে জলপট্টির ব্যবস্থা করে। তোয়ালে বারবার পানিতে ভিজিয়ে চিপে নিয়ে,তা আলতো হাতে কেনীথের কপালে চেপে ধরে। একই সাথে কেনীথের উন্মুক্ত গায়ে হাত বুলিয়ে ঘামে ভেজা শরীর মুছে দিতে লাগে। সেই মুহূর্তে আনায়ার নিজের শরীরও প্রতিনিয়ত এক অজানা শিহরণে কেঁপে ওঠে। নিজের আবেগ সামলে সে ছুটে আলমারির কাছে যায়।সেখান থেকে ভারী কম্বল টেনে এনে কেনীথের গায়ে জড়িয়ে দেয়।
এদিকে কেনীথ ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বিড়বিড় করতে শুরু করে। এটা দেখে আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে নেয়। চুপচাপ বোঝার চেষ্টা করে কেনীথ কি বলছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কেনীথের কোনো কথাই সে স্পষ্ট শুনতে পায় না।যদিও সে বোঝে না কি বলছে। তবে শুধু এটুকু টের পায় যে, কেনীথ তার অবচেতন হৃদয়ের গহীন কোনো কথা উগরে দিচ্ছে।
।আনায়া এতে কিছুটা আগ্রহী হয়ে কেনীথের দিকে ঝুঁকে তার কথা শোনার চেষ্টা করে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, কেনীথ তার বলিষ্ঠ হাতের জোরে,এক ঝটকায় আনায়াকে নিজের কাছে হেঁচকা টেনে আনে। আনায়া এক মুহূর্তেই ভারসাম্য হারায়।চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“আরেহ আরেহ, কি করছেন? আপনার মাথা ঠিক নেই। পাগল হয়ে গিয়েছেন আপ…”
আনায়ার কথা সম্পূর্ণ হবার পূর্বেই, আনায়া সরাসরি কেনীথের উপর পড়ে যায়।ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, তার কিছু বোঝার সুযোগই হয় না।
একই মূহূর্তে আনায়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই,তার শরীরের ওপর কেনীথ উঠে পড়ে। নিমিষয়েই আনায়ার শ্বাস-প্রশ্বাস থমকে যায়। সমস্ত শরীর অবশ বসে আসছে।ক্রমাগত চোখ মুখের রঙ ফেঁকাসে হয়ে যাচ্ছে। একইসাথে সামান্য নড়াচড়া করার সমস্ত শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। শ্বাস আঁটকে রয়েছে গলার মধ্যখানে। চোখের পলকও ফেলতেও যেন সে ভুলে গিয়েছে। শুধু জ্বরে পোড়া একজোড়া লালচে উম্মাদ, মাতাল চোখের দিকে তার চোখজোড়া নিবদ্ধ। কোনোক্রমেই সেই নেশা মেশানো চোখজোড়া হতে তার নজর সরাতেই পারছে না। কেনীথের জ্বরে পো”ড়া কাঁপা কাঁপা লালচে ঠোঁটও তার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনকে থামিয়ে নিষ্ক্রিয় করে তুলছে।
কেনীথ আর আনায়ার মাঝে দূরত্বের সমীকরণ নেই বললেই চলে। কেনীথের সমস্ত ভর আনায়ার উপর। তার হাতদুটো আনায়ার কাঁধের দুপাশে ঢেকিয়ে, খানিকটা উঁচু থেকে আনায়ার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। কেনীথের অনবরত ফেলা এলোমেলো ভারী উত্তপ্ত নিশ্বাস — আনায়ার মুখশ্রীতে প্রতিনিয়ত আঁচড়ে পড়ছে।এবং প্রতিবারই অদ্ভুত শিহরণে আনায়ার চোখ মুখ শুকিয়ে…জান যায় যায় অবস্থা প্রায়।
অথচ এমন রুদ্ধশ্বাস আবহের মাঝেই কেনীথ আরো এক কান্ড ঘটায়। আনায়ার দিকে নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে তাকতেই,অকস্মা তার নরম গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে নেয়। তার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির খসখসে ঘষায় আনায়ার গাল আর গলার কোমল চামড়া ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।তবুও আনায়া চোখ খিঁচে, ঠোঁট চেপে ধরে ব্যথা সহ্য করে নেয়।কিন্তু কেনীথ উন্মাদনার প্রতিটি কার্যক্রম যেন আনাকে একদম ভেতর থেকে শেষ করে দিতে চায়। এতোক্ষণ কেনীথের উত্তপ্ত নিশ্বাস তার মুখে আছড়ে পড়লেও, এখন তা তার গলার প্রতিটি অংশে উন্মুক্ত হয়ে সর্বস্বে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
আনায়ার হাত-পা আরো বেশি অবশ হয়ে আসে।কেনীথের উত্তপ্ত বলিষ্ঠ দেহ, উত্তপ্ত নিশ্বাস কিংবা প্রতিটি স্পর্শ তাকে আরো বেশি রুদ্ধ করে তোলে। এই মুহূর্তে যেন তার সমস্ত ইন্দ্রিয় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
আনায়া নিজেকে স্বাভাবিক করতে চেয়েও পারে না। তবুও ছাড় পাওয়া এক হাতে, বিছানার চাদর আঁকড়ে ধরল অসহায়ভাবে । অথচ কেনীথের উত্তপ্ত শরীরের ঘন ঘন স্পর্শে, তার অগ্নি’গর্ভ নিঃশ্বাসের দমকে আনায়া যেন নিজেকে সর্বোপরি হারিয়ে ফেলেছে।
এমনই পরিস্তিতে ঝড়ে কাঁপতে থাকা জানালার বাহিরে, অন্ধকারে বিদ্যুৎ গ’র্জে ওঠে।অথচ বদ্ধ ঘরের ভেতরে কেবল দুজন মানুষের দমবন্ধ করা নিশ্বাসের আওয়াজ। একই সময়,কেনীথ আনায়ার চুল ও গলায় মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই, জ্বরের ঘোরে মাতালের মতো অস্ফুটে কিছু বলে ওঠে,
“হেই ব্লা”ড! বাহিরে দেখ, মেঘেগুলো মনে হয় পা’গল হয়ে গিয়েছে।ওরা আমাদের দেখে হিং’সে করছে। নয়তো এতো লাইটনিং করার কি আছে?জ্বলছে! জ্বলছে!আমাদের দেখে জ্বলছে!”
এ কেমন মাতালের মতো কথাবার্তা। আনায়া কিছু বলে না বরং চুপচাপ ঘাপটি মে”রে একইভাবে স্তব্ধ শুয়ে থাকে। তবে কেনীথ কিন্তু মোটেও থামে না।
—“কি হলো, কিছু বলছিস না কেনো?”
—“হুহ্!… হুম, ওদের উপর ঠাডা পড়া উচিত।”
আনায়া তালগোল হারিয়ে কি ছেড়ে কি বলছে নিজেও জানে। তার লিট্র্যালি কান্না পাচ্ছে। এদিকে কেনীথ আনায়াকে আবারও জিজ্ঞেস করে,
“হুম, তা তো ঠিক… কিন্তু তোর ভয় করছে না?”
আনায়া কিছু বলে না। চুপচাপ স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে৷তবে কেনীথ আবারও বলে,
“আমার তো অনেক ভয় করছে।”
এই বলেই, সে আনায়াকে আকস্মিক দু’হাতে জড়িয়ে নিজের মাঝে চেপে ধরে। পুনোরায় আনায়ার কানের লতিতে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে,কাঁপা কাঁপা স্বরে ভারী নিশ্বাসের সহিত, ফিসফিসিয়ে আওড়ায়,
“আনা…য়া!…মাই ব্লাড!… ইউর স্মেল ফিলস লাইক মাই ডেস্ট্রাকশন… ইউর টেস্ট ফিলস…লাইক মাই ড্যামনেশন…প্লিজ, ডোন্ট মুভ! আই যাস্ট ডেস্পা’রেটলি নিড ইউ।”
এটুকু বলেই কেনীথ চুপ করে গেলেও,আনায়ার জমে গিয়ে, দম বেড়িয়ে বেহুশ হওয়ার উপক্রম। তীব্র অস্বস্তিতে বেচারির চোখের কিনারায় জল জমে গিয়েছে।সে কান্না থামাতে আবার ঠোঁট চেপে কামড়ে ধরে।নিজেকে এই মূহুর্তে একটা আধমরা মুরগী, আর কেনীথকে মস্ত বড় এক শিয়াল ব্যতীত আর কিছুই মনে হচ্ছে না তার।
একে তো কেনীথের নিচে এমনভাবে চাপা পড়েছে যে, নড়চড়ের কোনো উপায় নেই। সেইসাথে আবার কেনীথ নিজেদের উপর দুটো কম্বল মুড়িয়ে ঢেকে নিয়েছে। আনায়ার নিজেকে এখন আ”ধমরা মুরগী থেকে প্রি-হিট অভেনে বেক হতে থাকা সেদ্ধ মুরগী মনে হচ্ছে। তবুও সে, প্রচন্ড অস্বস্তিতে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে আওড়ায়,
“এ কোথায় ফেঁসে গেলাম আমি।”
একই সময়ে আনায়াকে পুরোদমে শেষ করে দিতে,কেনীথ আরো এক কাজ করে বসে। এতোক্ষণ আনায়ার নরম চামড়ার ভাজে মুখ গুঁজে রাখলেও…এবার সে আনায়ার গলার ভাঁজে, নিজের নাক, মুখ,ঠোঁট দিয়ে বারংবার উম্মাদের ন্যায় ঘর্ষণ দিতে শুরু করে।যার ফলে তার গাল, গলার কোমল চামড়া যেন এবার নিমিষেই পুরোপুরি ছিলে যাচ্ছে। একই সাথে কেনীথের উত্তপ্ত ঠোঁট আনায়ার ত্বকে বারংবার স্পর্শ করায় আনায়ার দম আঁটকে ম”রে যাওয়ার দশা।
আনায়া হাঁপাতে থাকে, নিঃশ্বাস এবার পুরোপুরি আটকে আসে।কেনীথের উষ্ণ, ভারী নিঃশ্বাস বারবার তার গলার কাছে লাগে। যেন তা সম্পূর্ণরূপে চামড়াকেই জ্বালিয়ে দিচ্ছে।আনায়া এবার সম্পূর্ণভাবে জমে যায়।
মূহুর্তেই আনায়া অসহনীয় তীব্র ব্যাথায় ঠোঁট কামড়ে চোখ-মুখ খিঁচে ফেলল। অজান্তেই চোখের কোণে জমে ওঠা একফোঁটা অশ্রুও গড়িয়ে পড়ল।মুঠো করে রাখা চাদরের শক্ত বাঁধনও, হলো আরো দৃঢ়। কিন্তু একই সময়ে কেনীথ তার খোঁচা খোঁচা চাপদাড়ি দিয়ে লেপন করতে করতে আকস্মিক থেমে যায়।আধো আধো স্বরে, তার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে, নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে, আনায়ার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে,অনবরত কিছু আওড়াতে লাগে।যার প্রতিটি উচ্চারণ, আনায়ার সমস্ত অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে তোলে। তবে সেই নেশাতুর মাতাল করানোর মতো কন্ঠস্বরে বলা কেনীথের কথাগুলো তার কানে দীর্ঘ সময় ধরে বাজতে থাকে। খুব তীব্র ভাবে, খুব স্পষ্ট ভাবে।
“তোর গাল ভিজে উঠুক আমার জ্বরে পোড়া কপালে… তোর শরীর ঝলসে যাক আমার গায়ের দহনে। যদি আমার ভেজা শরীর, কাঁপা কণ্ঠ আর ধুঁকে ওঠা নিঃশ্বাসে তুই এভাবে আমার হয়ে যাস। তাহলে আমায় আরো জ্বর দে, বৃষ্টি দে,নিঃসঙ্গ রাত দে… আর নিজের তপ্ত ছোঁয়ায় আমায় ভাসিয়ে নে।”
—কেনীথ
চলবে__________________