#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
পর্ব—৪০ (১ম অংশ)
কেনীথ রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রইংরুমে আসতেই পাভেলের সম্মুখীন হলো। সে কানে ইয়ারপোড গুঁজে ফোন স্ক্রোল করে যাচ্ছে। কিন্তু কেনীথের উপস্থিতি টের পেতেই একদম লাফিয়ে সে তার কাজকর্মে বিরতি টানে। ওর লাফানোতে কেনীথ নিজেই কিছুটা চমকে যায়।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলে,
“কি রে! এভাবে বাঁদরের মতো লাফাচ্ছিস কেনো?”
পাভেল কেনীথের কথায় পাত্তা না দিয়ে উল্টো ভ্রু উঁচিয়ে নানান সব আকার ইঙ্গিত করে। যার পুরোটাই কেনীথের মাথার উপর দিয়ে যায়। একইসঙ্গে কপাল কুঁচকে সন্দিহান কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে তো? কোনো সমস্যা? নয়তো এমন করছিস কেনো?”
এবার পাভেল কিছুটা বিরক্ত হলেও, মুচকি হেসে চাপা স্বরে বলে,
“তুমি যে এতো ফাস্ট, তা তো আমি কল্পনাতেও ভাবিনি।”
এবার গিয়ে কেনীথ ওর অভিব্যক্তি স্পষ্ট বুঝতে পারে। সে নিজেও ঠোঁটের কোণায় বুড়ো আঙুল ঘষে কিঞ্চিৎ তীর্যক বাঁকা হাসে। অতঃপর পাভেলের কাছে এসে ওর পাশেই দু’হাতে ছড়িয়ে সোফায় বসে পড়ে।
—“এবার আশাকরি সব ঠিকঠাক?”
কেনীথ কিঞ্চিৎ চোখ কুঁচকে বলে,”হুম, বলাই যায়।”
—“যাক,এতো কষ্ট তবে সার্থক হলো।”
পাভেলের হাস্যজ্জ্বল কথা শুনে কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,
“বুঝলাম না। কষ্ট করলাম আমি আর তুই… এমন ভাবে বলছিস যেন সব কষ্ট তুই করেছিস?”
কেনীথের কথা শুনে পাভেল কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে বলে ওঠে,
“না,আমি তা বলিনি কিন্তু… আমিও তো যথেষ্ট কষ্ট করেছি। পারলে তোমার চেয়ে বেশি।”
—“বাহ্, কাল দেড় ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধালাম আমি। সেই উছিলায় বউদের সাথে…”
—“হ্যাঁ,হ্যাঁ,বলো ব্রো! তারপর…? ”
—“দেব এক কানের নিচে, অসভ্য!”
কেনীথের হঠাৎ থেমে গিয়ে হুঁশ ফিরে আসতেই, পাভেল পুরো অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। কেনীথ ওর কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে চোখমুখ কুঁচকে বসে থাকে। এরইমাঝে পাভেল আবারও ওর কাছে কিছুটা এগিয়ে এসে বলে উঠল,
“ওয়েই! হয়েই!”
কেনীথ কপাল কুঁচকে বলল,”আবার কি হলো?”
পাভেল কিছু না বলে দ্রুত নিজের ফোনটা দিয়ে কেনীথের ঠোঁটের একটা ছবি তুলে নেয়। অতঃপর তা কেনীথের সামনে এগিয়ে দিতেই কেনীথ কপাল কুঁচকে ফোনটা নিয়ে ছবিটা দেখতে থাকে। নিমিষেই তার কুঁচকে যাওয়া কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। একইসঙ্গে ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিৎ তীর্যক হাসি।
________
আনায়া কিচেনে প্রচন্ড তোড়জোড় নিয়ে রান্নার কাজ করছে। আশেপাশে কি হচ্ছে কোনো দিকেই তার হুঁশ নেই। এমনিতেই আজ অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।
এরইমাঝে কেনীথ প্রচন্ড সাবধানে কিচেনে ঢুকে পড়ে। আলগোছে সাবধানতার সাথে দরজাটা লক করে দেয়। মৃদু পায়ে আনায়ার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ওর কাজকর্ম দেখতে থাকে। এদিকে আনায়া ডিম পোচের জন্য ফ্রাইপ্যানে ডিম ভেঙ্গে দিয়ে সবজি কাটাকাটিতে লেগে পড়েছে। এদিকে যে কেনীথ তার পেছনে দাড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে সেদিকে তার কোনো হুঁশই নেই।
কেনীথ আশপাশে তাকিয়ে দেখল, রান্নাঘরটা নিত্যন্তই ছোট। কেনীথ সবকিছু চোখ ছোট ছোট করে পরখ করে দেখতে লাগল। এরইমাঝে আনায়া নড়াচড়া করতে গিয়ে আচমকা কারো সাথে ধাক্কা লাগায় চমকে উঠল। আনায়া বিস্ময়ে পেছনে ফিরে তাকানোর পূর্বেই কেনীথ ওর কোমড় পেঁচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। আনায়ার কাঁধের উপর আলতোভাবে নিজের চোয়াল রাখে। ততক্ষণে আনায়া পুরো জমে গিয়েছে। কিঞ্চিৎ ঢোক গিয়ে, খানিকটা কঢ়া স্বরে বলল,
“আপনি এখানে কি করছেন?”
কেনীথ ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলে,
“আহ্, তারা! একটা বড়সড় পোকা দেখ আমার কি অবস্থা করছে।”
কেনীথের কথা শোনামাত্রই আনায়া উদ্বিগ্ন হয়ে পেছন ফিরে তাকায়৷ কেনীথের মুখোমুখি হতেই বলে ওঠে,
“কি হয়েছে? কেমন পোকা…কোথায়…”
আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ নিজের ঠোঁট দেখিয়ে বলে,
“এই দেখ! দেখেছিস…কিভাবে কামড়েছে আমায়?”
কেনীথের ঠোঁটের দিকে তাকাতেই আনায়ার চোখমুখ শুকিয়ে যায়। অনেকটা ইতস্ততবোধ করতে থাকে। কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে কেনীথের কাছ থেকে দূরে সরতে চায়। কিন্তু কেনীথ এমনভাবে তার সমানে দাড়িয়ে রয়েছে যে, সামান্য এদিক ওদিক যাবারও সুযোগ নেই। ঠিক তৎক্ষনাৎ আনায়ার ভাবগতিক বুঝতে পেরে কেনীথ আনায়ার কোমড় শক্ত করে চেপে ধরে তাকের উপর বসিয়ে দেয়। অতঃপর নিজের দু’হাতে আনায়ার দুপাশে রেখে খানিকটা আনায়ার দিকে ঝুঁকে বলে ওঠে,
এই পোকার কি করা উচিত বল তো?”
আনায়া কিছু বলে না বরং চুপচাপ বসে থাকে। কেনীথের নজর থেকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে। কেনীথ তা বোঝামাত্রই কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। আর আনায়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তৎক্ষনাৎ আনায়ার ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। একদম নিজের মতোই ক্ষত তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কেনীথ আনায়াকে ছাড়ে না।আনায়া নিজেকে কেনীথ হতে ছাড়ানোর চেষ্টায় আশেপাশে হাত ছোটাছুটি করতে নিলে দুই একটা বাসন চামচ ফ্লোরে পড়ে যায়। নিমিষেই ঝনঝন শব্দে চারপাশ ছেয়ে যায়। তবুও কেনীথের ছাড়বার নাম নেই। যতক্ষণ না নিজের সাধ মেটে ততক্ষণ সে আনায়াকে নিজের সাথে আঁকড়ে রাখে।আর ছেড়ে দেওয়ামাত্রই আনায়া চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই কেনীথ মুচকি হেসে বলে,
“এবার ঠিক আছে। সমান সমান, একদম পারফেক্ট।”
একইসময় কেনীথ ফোন বেজে উঠতেই কেনীথ বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলে। আর তার বিরক্তি আরো বেড়ে যায় যখন সে দেখে পাভেল তাকে ফোন করেছে। কেনীথ ফোন রিসিভ করতেই রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে,
“ফোন কেনো দিয়েছিস? কোথায় তুই!”
—“ব্রো! ওটা রান্নাঘর। যে কাহিনি চালাচ্ছো ভেতরে,বাহির থেকে তো সবই শোনা যাচ্ছে।”
—“শা”লা অসভ্য! তুই এটার জন্য ফোন দিয়েছিস আমায়?”
এদিকে আনায়া কেনীথের কথার ফাঁকে সরে যেতে নিলে কেনীথ ওকে আঁটকে নিজের সাথে ধরে রাখে। আনায়া কিছু বলতে গেলে কেনীথ ওর মুখ চেপে উল্টো ঘুরিয়ে নিজের সাথে মিশিশে নেয়।এদিকে পাভেল হাসতে হাসতে মশকরা করে বলে,
আমার উপরও তো একটু দয়ামায়া করতে পারো। সিঙ্গেল মানুষ আমি, তার উপর এভাবে আমাকে বসিয়ে… ”
—“তোকে বসে থাকতে কে বলেছে? বের হয়ে রাস্তায় চলে যা।প্রয়োজনে ম’রে যা তবুও… ”
কেনীথের কথার মাঝেই এক অদ্ভুত গন্ধে তার চোখমুখ কুঁচকে আসে। ওদিক থেকে পাভেল জিজ্ঞেস করে,
“ব্রো! কিচেন থেকে কেমন পোড়া পোড়া গন্ধ আসছে।”
কেনীথ কপাল কুঁচকে আশেপাশে তাকায়। এদিকে আনায়া অনবরত চেঁচিয়েই যাচ্ছে। অথচ কেনীথ এমন ভাবে মুখ চেপে রেখেছে যে কিছু বলার মতোও সাধ্য নেই তার।
তবে যেই না কেনীথের নজর চুলোর দিকে গিয়েছে ওমনিই তার হাত থেকে ফোনটা খসে নিজে পড়ে যায়। আকস্মিক হাত ঢিলে হয়ে যাওয়ায় আনায়া নিজেকে ছাড়িয়ে চুলোর কাছে যায়। ফ্র্যাইপেনের ডিম পুড়ে কালো কুচকুচে কয়লা মতো হয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে গিয়েছে। আরেকটু হলে আগুন ধরে যেত। আনায়া কোনোমতে ফ্রাইপ্যানটা তুলে নিয়ে পানিতে চুবিয়ে দেয়। কোনমতে এই ব্যাপারটা সামলে নিতে না নিতেই, কেনীথ ইতস্ততভাবে আনায়ার দিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলে, আনায়া তীব্র ক্ষি”প্ততার সাথে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“বাঁ’চতে যদি চান তবে বেড়িয়ে যান এখান থেকে। নয়তো আজ আমার চেয়ে আর খারা”প হবে না।
________________
বিকেলের শেষভাগে চারজনে মিলে হাঁটতে বেড়িয়েছে। সকালের ঘটনার পর আনায়া পারলে তখন তখনই দুজনকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কোনোমতে ওর রাগকে সামলে নিয়ে কেনীথ আর পাভেল এতোটা বেলা ঐ বাড়িতে স্থায়ী হতে পেরেছে। তবে আনায়ার খিটখিটে মেজাজ এখনো টিক হয়নি।
আপাতত কোলাহল পূর্ণ পার্কের একটা ব্রেঞ্চে আনায়া চুপচাপ বসে রয়েছে। তার পাশেই একটা কোণ আইসক্রিম হাতে,কেনীথ চুপচাপ বসে রয়েছে। দু’জনের মাঝেও দুরত্বটাও যথেষ্ট। আনায়ার পরনে অফ হোয়াইট কালারের ট্রেঞ্চ কোট। চুলগুলো মেসিবান করে বাঁধা। ওদিকে কেনীথের পরনেও কালো রংএর অভার কোট।চোখেমুখ দ্বিধাদ্বন্দে উদ্বিগ্ন। এমনিতেই আনায়ার মেজাজ ঠিক হয়নি, ওদিকে আবার সে যা বলতে চাইছে… আদৌও আনায়া তা মানবে কিনা তাও বুঝতে পারছে না।
ওদিকে আবার কেনীথ পাভেলকে বলে ইনায়াকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইনায়া চুপচাপ আইসক্রিম খাচ্ছে, আর ওর পাশাপাশি পাভেল কখনো বকবক করছে, তো কখনো ইনায়ার এমন চুপচাপ তাকতে দেখে নিজেই বিরক্ত হচ্ছে। আবার কখনো একটা আইসক্রিম ফুরিয়ে যেতেই অন্য আইসক্রিম এনে খেতে শুরু করছে।
এদিকে আনায়া চুপচাপ পার্কের মানুষজনের আনাগোনা দেখছে। অথচ তার পাশে বসে থাকা মানুষটাকে নিয়ে যেন তার কোনো আগ্রহই নেই। এভাবেই দুজনের মাঝের পিনপতন নীরবতায় অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়।কেনীথের হাতে থাকা আইসক্রিমটাও গলতে শুরু করে। কেনীথ এবার খানিকটা অস্থির হয়ে ওঠে। আনায়ার উদ্দেশ্য কিছুটা করুন স্বরে বলে,
“আনায়া!”
আনায়া শুরুতে কোনো জবাব দেয় না।কেনীথ আবারও বলে,
“তারা! শুনছিস?”
—“জ্বী বলুন।”
আনায়া স্তব্ধ কন্ঠের জবাবে কেনীথ মুচকি হাসে। আনায়ার দিকে খানিকটা এগিয়ে বসে।
—“আইসক্রিম ঠান্ডা হয়ে… নাহ, সরি…গলে যাচ্ছে। খেয়ে নে প্লিজ।”
আনায়া কেনীথের দিকে না তাকিয়েই জবাব দেয়,
“খাব না আমি।”
আনায়ার কথায় কেনীথ তেমন পাত্তা দেয় না। আইসক্রিমটা আনায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
” প্লিজ!”
আনায়া কিছু না বলে কেনীথের দিকে মুখ ফিরিয়ে কিঞ্চিৎ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আর তৎক্ষনাৎ কেনীথ মুচকি হেসে ওর মুখের কাছে আইসক্রিমটা এগিয়ে দেয়।আনায়া আইসক্রিম হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে। একই মূহুর্তে কেনীথ কিছুটা ইতস্ততভাবে বলে,
“ঐ শুন, একটা কথা বলার ছিল।”
—“বলতে থাকুন, আমি শুনছি।”
কেনীথ আনায়ার দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকায়।খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে। ব্রেঞ্চে দু’হাত দুপাশে ছড়িয়ে দেয়। একহাত আনায়ার পিঠের পেছনে রেখে ওকে কিছুটা নিজের কাছে টানে।অথচ তার চাহনি দূর আকাশের পানে।
—“মালদ্বীপে যেতে হবে।”
আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলে,
“হুম যান, না করেছে কে?”
—“আমি একা নয়,তোকেও যেতে হবে।”
—“হঠাৎ মালদ্বীপে…তাও আমি…কোনো জরুরী?”
—“আরেহ না, ট্যুরে যাব। আমরা সবাই…আই মিন, আমরা চারজন ।”
আনায়া কেনীথের দিকে পিটপিট করে তাকায়। কেনীথ কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে ওর ওদিকে চেয়ে থাকে। আনায়া কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,”ঠিক আছে।”
আনায়ার সম্মতিতে কেনীথ যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গিয়েছে। বিস্তৃত মুচকি হেসে একদম আনায়ার গা ঘেঁষে বসে। টুপ করে আনায়ার গালে চুমু খেতেই আনায়া পুরো থতমত খেয়ে যায়।
—“থাংক ইউ, বউ!”
এই বলেই কেনীথ আনায়ার আইসক্রিম থেকে খানিকটা খেয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলে। আর আনায়া বসে বসে শুধু ওর কাজকর্ম দেখে যায়।
____________
চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নেপচুনের কুয়াশাচ্ছন্ন
শীতল ভৌতিক এক উপত্যকায় চুপচাপ বসে রয়েছে আনায়া। পরনে তার বিয়ের শাড়ি। মাথায়, ফুল, গায়ে অলংকার।এছাড়াও চারপাশে ফুল দিয়ে সাজানো বাসরঘরের ন্যায় কিছু একটা।তবে সবকিছুই কেমন অদ্ভুত। আনায়া চোখ পিটপিট করে চারপাশটা দেখে। তার কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। আশেপাশে নীলচে-কালো ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। আনায়ার মাথায় ঢুকছে না এটা কেমন জায়গা। আবার আকাশ থেকে অদ্ভুত এক পদার্থের বৃষ্টিও হচ্ছে। আনায়া হাত বাড়িয়ে দিতেই কিছু চকচকে পদার্থ তার হাতে পড়ে যায়।সে চোখ পিটপিট করে বোঝার চেষ্টা করে এগুলো কি! নিমিষেই তার চোখমুখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে যায়। এগুলো তো সব হীরের কণা।
এরই মাঝে, হঠাৎই তার চোখ পড়ে দূরে একটা পাথরের ঢিবির উপর। সেখানে কেউ বসে রয়েছে।তবে আনায়া তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পারছে না। আনায়া চোখ পিটপিট করে শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকে। লোকটির হাতে একটা গিটারও রয়েছে। আর শুধু সেই বাজনার ধ্বনি ধীরে ধীরে ভেসে আসছে বাতাসে। আনায়ার বুকের মাঝে কেমন একটা অজানা অনুভূতি জন্ম নেয়। সে কাঁপা কাঁপা চোখে চারপাশ দেখে।সব কিছু যেন বাস্তব আবার অবাস্তব।
“তুই অন্য গ্রহের চাঁদ______
আমার একলা থাকার ছাদ______
তোমার ফেরার সম্ভাবনা,
পূর্ণিমায় জোছনা__________
এরইমাঝে সেই ব্যক্তিটি গান গাইতে শুরু করে। আর আনায়া সেই কন্ঠস্বরে ঠিকই বুঝে যায় যে লোকটি কে। এটা নিশ্চিত কেনীথ। আর কেউ নয়। আনায়া চিৎকার দিয়ে কেনীথকে ডাকে কিন্তু সে কোনো উত্তর দেয় না। কেনীথ এভাবে কিছু না বলে শুধু গান কেনো গেয়ে যাচ্ছে তা আনায়া ঠিক বুঝতে পারে না। সে আবারও কেনীথকে জিজ্ঞেস করে,” এই যে শুনছেন? আমরা এখানে কি করছি?”
কেনীথ নির্বিকারে জবাব দেয়,”কেনো তুই জানিস না।আজ আমাদের এখানে বাসর!”
—“কি বলছেন আপনি? হুঁশ আছে আপনার? কিসের বাসর?”
সে চোখ পিটপিট করে দু’বার তাকায়। কেনীথের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই, মুহূর্তেই চারপাশ পাল্টে যায়।এবার সে যেন মঙ্গল গ্রহে। লাল ধূলোময় চারপাশ, বিশাল বিশাল পাথরের স্তূপ। হঠাৎই দূরে কিছু নড়ছে। ভয়ং’কর…অজানা কিছু প্রাণীর ছায়া ভেসে ওঠে। আনায়া চিৎকার করে ওঠে, পেছন ফিরে দৌড়ায়। আবার সবকিছু নিমিষেই পাল্টে যায়।
এবার তার মনে হয়,সে যেন চাঁদে। ধূসর, ধূলিময় পৃষ্ঠে সে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারদিকে ঝকমকে তারা,অনেকটা দূরে পৃথিবীকে ন্যায় কিছু একটা দেখা যাচ্ছে।এখানে কোনো শব্দ নেই, শুধু নিঃস্তব্ধতা। আনায়া অদ্ভুত ভাবে চারপাশ দেখতে থাকে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সে উড়ছে। শূন্যেয় ভাসছে। তার মাথা কাজ করছে না। নিমিষেই মাথায় দুটো বারি দেয়। এরইমাঝে হঠাৎ পেছন থেকে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসে। আনায়া তা স্পষ্ট অনুভব করে। তবে সে ঘুরে তাকানোর আগেই আবারও দৃশ্য পাল্টে যায়।
এবার সে শনির বলয়ে। ঘন, কালো মেঘে ছেয়ে আছে চারপাশ। শূন্যে ভেসে থাকা এক অদ্ভুত দুনিয়া।আতং”কে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। আনায়া বিরক্ত হয়ে প্রতিবার কেনীথকে খুঁজতে লাগল। কোথাও কেনীথকে দেখতে না পেয়ে তার মেজাজ বিগড়ে যায়।কিন্তু আচমকাই তার নজর পড়ে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বি’কটদর্শ’ন এক প্রাণীর দিকে।প্রাণীটি হঠাৎই আনায়ার দিকে তেড়ে আসতে শুরু করে। আনায়ার বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া। গলা তার শুকিয়ে চৌচির। সে কোনোদিকে আর না ভেবে তেড়েফুঁড়ে দৌড়াতে লাগল। একইসাথে আতঙ্কে চেঁচিয়ে ওঠে,
— “কেনীথের বাচ্চা কেনীথথথথথ! কোথায়য়য়য়য়য়য়য় আপনিইইইই?”
কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া নেই। এককথায় কেনীথ গায়েব।ঠিক সেই সময় শুরু হয় এক ভয়াবহ ঝড়। হাওয়ার তোড়ে সবকিছু গুলিয়ে মিশে যাচ্ছে। এই ঝড়ের মাঝে হঠাৎই শোনা যায় কেনীথের কন্ঠস্বর।—”আনায়া! আমি এখানে!”
আনায়া চারপাশে তাকায়। কেনীথকে খোঁজে, কিন্তু কোথাও নেই সে। হঠাৎ সে অনুভব করে তার শরীর ঝড়ের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আনায়া অনুভব করে, তাকে ব্ল্যাক হোল সদৃশ্য কিছু টেনে নিচ্ছে। সে এবার চিৎকার করে, ছটফট করতে থাকে। হুট করেই কান্না পাচ্ছে তার। ঘেমে অবস্থা নাজেহাল।
একই সময় চারপাশ থেকে হঠাৎ পানি আসতে শুরু করে। ভয়ানক জলপ্রলয়ের মতো পানিতে সে ডুবে যেতে থাকে। শ্বাসরুদ্ধ, দিশেহারা সে।
—“আআআআআআআআআআআআ….”
আনায়ার এতো জোরে চিৎকারের পর আবারও দূর থেকে শোনা যায় কেনীথের কণ্ঠ।
— “আনায়া! কিসব শুরু করেছিস? এবার তো উঠে যা।”
হঠাৎই সে ঝাঁকুনি খেয়ে চমকে ওঠে।চোখ মেলতেই দেখে বাস্তবে সে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখ গলা, জামা সহ অনেকটা জাগায় পানিতে ভিজে রয়েছে। কেনীথ তার পাশে বসে, ভীষণ চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছে। হাতে তার পানির গ্লাস। ওদিকে তার সম্মূখে দাঁড়িয়ে থাকা পাভেলেরও একই অবস্থা।
—“কিরে তুই ঠিক আছিস?”
আনায়া প্রচন্ড অবাক। হাপাতে হাপাতে উঠে বসে। বিস্ময়ে চারপাশ দেখতে থাকে। এখন আর কোনো গ্রহ নেই, নেই কোনো ভয়া’বহ প্রাণী। চারপাশই যেন এখন বাস্তবতায় ঘেরা।আনায়া ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলে,”এটা কি… স্বপ্ন ছিল?
কেনীথ আনায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলে,”স্বপ্ন ছাড়া তো আর কিছু মনে হচ্ছে না। তোর খেয়াল আছে, তুই এই স্বপ্নের চক্করে কতবার চিৎকার করেছিস?”
আনায়া কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। ওদিক থেকে পাভেল একগ্লাস পানি এনে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“এমন কি সপ্ন দেখছিলেন আপনি? বাঘ ভাল্লুক টাইপের কিছু… ”
আনায়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে পাভেলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সবকিছু বলতে শুরু করে। একটা সময় উদ্বিগ্ন হয়ে এক নিঃশ্বাসের বলা শুরু করে। এদিকে ওর স্বপ্নের ঘটনা শুনে কেনীথ আর পাভেল দু’জনেই স্তব্ধ। এসব শুনে হাসবে নাকি হাসতে হাসতে কাঁদবে বুঝতে পারছে না। কেনীথ ঠোঁট চেপে মুচকি মুচকি হাসতে থাকলেও পাভেল আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কোনোমতে নিজেকে দমিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“বাহ কি স্বপ্ন!কিন্তু কথা হলো আপনি ওখানে একা একা কি করতে গিয়েছিলেন?”
পাভেল হাসির ছলে কথাটা বললেও, আনায়া পুরো সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে,
“বললামই তো উনিও ছিল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলমা তখন উনি বলল আমাদের বাস…”
আনায়া বলতে বলতেই আকস্মিক থেমে যায়। ওদিকে পাভেল বিষয়টা ঠিকই বুঝতে পেরে হেসে ওঠে। কোনোমতে নিজেকে দমিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে শেষবারের মতো কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে,
“চালিয়ে যাও ব্রো!”
পাভেল চলে যেতেই আনায়া স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ওদিকে কেনীথ খানিকটা কেশে মুচকি হেসে বলল,
“তুই যে আজকাল এসব স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিস… ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না৷”
আনায়া খানিকটা ছোট ছোট করে জবাব দেয়,
“স্বপ্ন কি আমি ইচ্ছে করে দেখি?”
—“বিষয়টা তা নয়, তবে কেউ যদি সবসময় এসব চিন্তাভাবনা করে তবে স্বপ্নে ঠিক ওসবই দেখবে।”
—“ওসব বলতে কি বোঝাচ্ছেন আপনি?”
—“ওসব বলতে ওসবই, যেসব আপনি আমাকে ছাড়াই দেখেন।”
—“উল্টো পাল্টা কথা বলে মেজাজ খারাপ করবেন না আমার।”
—“আরেহ বাহ, আপনি উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখতে পারবেন আর আমি সত্যি বললেই দোষ? কই আমি তো কখনো ওসব স্বপ্ন দেখিনা। নয়তো আমিও একটু-আধটু ফিল নিতে পারতাম।”
কেনীথ আলাভোলা চেহেরা বানিয়ে কথাটা বলতেই, আনায়া ওর টিশার্ট খিঁচে নেয়। চোখ রাঙিয়ে শা”সিয়ে বলে ওঠে,
“বেশি কিছু করলে কিন্তু… আমি যাব না মালদ্বীপ।”
—“আরেহ না না, তা বললে হয় নাকি! অনেক হয়েছে, সারারাত ঘুমিয়েছিস, মহাকাশে গিয়েও অকাজ করে এসেছিস। আপাতত ফ্ল্যাইটের জন্য দৌড়াতে হবে। চল! চল! চল! তারাতাড়ি যেতে হবে।
____________
রাত তখন গভীর। চারপাশে নিস্তব্ধতা। কেবল সাগরের নিচের মৃদু শব্দ আর হালকা ঢেউয়ের দোলা।আনায়া ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে The Muraka–র নিচতলার করিডোর দিয়ে। এটা অনেকটা কাঁচে ঘেরা সুড়ঙ্গের ন্যায়।চারপাশটা পানি, আর তার মাঝ দিয়ে তৈরি একমাত্র রাস্তাটা নরম আলোয় ঝলমল করছে। পরনে তার পাতলা সাদা গাউন।চুলগুলো খোলা, চোখে কিছুটা ভয় আর কৌতূহল। সে হা”টতে হাটতে নিচ তলার মাস্টার বেডরুমের দরজার সামনে এসে থেমে যায়।
মালদ্বীপের এক নির্জন প্রান্তে, চারদিকে বিস্তৃত নীল জলরাশি আর সাদা বালুর দ্বীপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কনরাড মালদ্বীপস রাংগালি আইল্যান্ড। আর এই দ্বীপেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র দুইতলা পানির নিচের আন্ডারওয়াটার রেসিডেন্স— দ্য মুরাকা।
দ্য মুরাকার এই মাস্টার বেডরুমটি সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৬ ফুট নিচে। পুরো ঘরটাই বিশাল কাঁচ দিয়ে ঘেরা। চারপাশে শুধু পানি আর পানি৷ নীরব, গভীর, অথচ জীবন্ত। এছাড়া বিভিন্ন মাছ, রঙিন রিফ, মাঝে মাঝে ছোট হাঙরের ছায়া সরে যাচ্ছে কাচের ওপারে।
আনায়া ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে।তার পা পড়তেই নরম আলোয় আলোকিত ফ্লোরে কিছু যেন চকচক করে ওঠে।সে থেমে যায়। চোখপড়ে বিস্তৃত ফ্লোরের দিকে।গোলাপের পাপড়ি আর বেলি ফুল দিয়ে লেখা—“Happy Birthday Anaya”
মন ছুঁয়ে যাওয়া মতো তাক লাগানো সুন্দর । এই মুহূর্তে, একটুকরো ফুল যেন পানির নিচেও সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। আনায়া বিস্ময়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আজ কি তার জন্মদিন? সে তো ভুলেই গিয়েছিল আজ তার জন্মদিন।
আনায়া ফ্লোর থেকে নজর সরিয়ে চারপাশটা দেখতে থাকে। নিমিষেই তার নজর পড়ে রাউন্ড বেডের উপর রাখা কিছু জিনিসের দিকে।একটি শাড়ি ভাঁজ করে রাখা।সাদা আর লাল বর্ডারযুক্ত—পাতলা ফিনফনে । এবং সাথে একটা সাদা ব্লাউজ। পাশে রাখা একটা ছোট চিরকুট।
আনায়া চিরকুটটা হাতে তুলে নেয়।সাদা পাতায় কেনীথের হাতে স্পষ্ট লেখাটুকু মনে মনে আওড়ায়।
“এই রাতটা শুধু তোর। আমি চাই, তুমি এই শাড়িটা পড়। বাকিটা তোর ইচ্ছে।”
—কেনীথ”
তার গাল গরম হয়ে ওঠে। ভাবতে থাকে কি করবে। আনায়া শাড়িটা হাতে নিয়ে ঢোক গেলে। এতো ফিনফিনে শাড়ি? কিছুটা কপালও কুঁচকে ফেলে। একইসাথে মনে মনে আওড়ায়,
“কোন আক্কেলে এমন শাড়ি পড়তে বলছে? এই লোক কি আদৌও হুঁশে আছে?”
আনায়া অভিব্যক্তি কখনো গম্ভীর, কখনো নির্লিপ্ত। অথচ গ্লাসের ওপাশে তখনও মাছেরা ধীরে ধীরে ভেসে চলেছে।কখনো গ্লাসে এসে ঠোকা দিচ্ছে তো কখনো ছায়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে।
________
আনায়া চুপচাপ গুটিসুটি হয়ে বিছানায় বসে রয়েছে। পরনে সেই সাদা ফিনফিনে শাড়ি। অত্যন্ত গুছিয়েই পড়ার চেষ্টা করেছে সে। তবে শাড়ি পড়ার পর হতেই শুরু হয়েছে যত সব অস্বস্তি। আনায়ার প্রচন্ড বিব্রত বোধ হচ্ছে। যদিও আগেও সে নানান রকমের ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়েছে… এমনকি সেদিন পার্টির রাতেও তো স্লিট ড্রেস পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখন ততটা অস্বস্তি হয়নি যতটা আজ হচ্ছে। অজান্তেই অচেনা সকল শিহরণ তাকে কাঁপিয়ে তুলছে।
আনায়া চুলগুলো খোলাই রেখেছে। বড় বড় চুলগুলো দিয়ে পিঠটা ঢেকে রাখার প্রচেষ্টায়।একই সাথে আনায়া কিছুটা বিরক্তও বটে। কেনীথ হঠাৎ বেছে বেছে এমন শাড়িই আর ব্লাউজ-ই কেনো এনেছে তা তার মাথায় ঢুকছে না।
আনায়ার এতোক্ষণ দুহাত মুঠো করে বসে রইলেও এখন আর চুপচাপ থাকতে পারল না। শাড়িটা চাদরের মতো গা ঢেকে পেঁচাতে চাইলেও তা বারবার পড়ে যেতে লাগল। আনায়া আরো বেশি বিরক্ত হলো। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে রুমের মাঝে পায়চারী করতে লাগল।তার চোখজোড়া একবার ফ্লোরে সাজানো ফুলগুলোর দিকে যাচ্ছে, তো একবার গ্লাসের ওপাশে ঘুরে বেড়ানো মাছের দিকে।
আনায়া মাছ আর ফুলগুলো দিয়ে লেখা তার নামের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়ায়,
“জায়গাটা সুন্দর, মাছগুলোও সুন্দর, ফুলগুলোও…কিন্তু তাই বলে… নিজেকেই কেমন যেন বন্দী বন্দী লাগছে না? মনে হচ্ছে, কোনো এ্যাকুরিয়ামে মাছ নয়, যেন আমাকে বন্দী করে রেখেছে।”
আনায়া এসব বিড়বিড় করতে করতেই আচমকা রুমের ভেতর জ্বলতে থাকা লাইটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অকস্মাৎ এমন কিছুর সম্মুখীনে আনায়া কিছুটা ভীত। সে পাশে ফিরে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে একটা ছোট্ট মোমবাতিতে জ্বলতে থাকা আগুনের আলো স্বরূপ তার দিকে এগিয়ে আসছে। আনায়া শুরুতে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও পরবর্তীতে মোমবাতির আলোয় কেনীথের মুখটা দৃশ্যমান হতে শুরু করে। আনায়া চুপচাপ কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেনীথের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। আর সেই মোমবাতিটা মূলত ছোট্ট একটা কেকের উপর গেঁথে রাখা৷
মাঝারি আকারের কেকটা কেনীথের একহাতে। অন্যহাত তার প্যান্টের কাছে। কেনীথ আনায়ার সামনে দাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“হ্যাপি বার্থডে ব্লাড।”
কেনীথের এই অদ্ভুত কন্ঠস্বরে আনায়া অজান্তেই কিছুটা কেপে উঠল। কেনীথ কিছুটা মুচকি হেসে,ইশারায় মোমবাতিটা ফু দিয়ে নিভিয়ে দিতে বলে। আনায়া কিছুটা দ্বিধা নিয়েই হালকা ফু দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দেয়। নিমিষেই চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়। আবার তৎক্ষনাৎ রুমের লাইটগুলো জ্বলে উঠলে আনায়া কিছুটা স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে।
কিন্তু একইসময় কেনীথের দিকে নজর পড়তেই সে কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। আজ প্রথম সে কেনীথকে ভিন্ন সাজে দেখছে। সাদা প্যান্টের সাথে সাদা সিল্কের শার্ট। হাতাটা কুনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। বুকের কাছের দুটো বাটন খোলা। চুলগুলোর অর্ধেকটা পেছনে মেসিবান করে রাখা,আর বাকিগুলো ছেড়ে রাখা। একইসাথে সবমিলিয়ে যথেষ্ট পরিপাটি দেখতে লাগছে তাকে।
আনায়াকে এভাবে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেনীথ কিছুটা কপাল কুঁচকে বলল,
“অদ্ভুত লাগছে, তাই না?”
আনায়া কেনীথের কথায় কিছুটা চমকায়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর শীতল কন্ঠে বলে,
“নাহ,চমৎকার লাগছে।”
—“সত্যিই?”
কেনীথের সন্দিহান জিজ্ঞাসায় আনায়া আলতোভাবে মাথা দুলিয়ে বলে,
“হুম।”
কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হাসে। তার অন্যহাতে থাকা একটা ছোট ছুরি আনায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নে,নিজের জন্মদিনে না হয় এটাকেই কুপিয়েই নতুন জীবনের সূচনা কর। নয়তো আমাকে কুপিয়ে মারা”র সাধ্য তো আর তোর হলো না।”
এমন এক আবহে হঠাৎ কেনীথের এমন কথা নিত্যান্তই আনায়ার কাছে বেমানান লাগল। কিছুটা চোখ কুঁচকে কেনীথের দিকে তাকাতেই, কেনীথ বিস্তৃত হাসল। ওদিকে আনায়া পুনোরায় স্বাভাবিক হয়ে ছুরিটা হাতে নেয়। এতোক্ষণ পর এসে সে কেকের দিকে তাকায়। হার্ট শেইপের একটা সাদা কেকের উপর লাল রঙে লেখা,”Happy Birthday blo’o’d”
আনায়া কেকের দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল,”এটা কি ব্লা”ড কেক?”
কেনীথ মুচকি হেসে বলে,”বাহ, এতো দ্রুত বুঝে গিয়েছিস?”
আনায়াও কেনীথের কথায় কিছুটা মুচকি হেসে, ছুরিটা কেকের মাঝ বরাবর আঘাত করতেই র”ক্তের ন্যায় সদৃশ অনেকটা লাল তরলে কেকটা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আনায়া কিছুটা কেকের অংশ কেটে নিয়ে কেনীথের মুখের সামনে ধরতেই কেনীথ তা কিছুটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে মুখে তুলে নেয়। আনায়া শুধু ওর অভিব্যক্তিতে খানিকটা কপাল কুঁচকে মুচকি হাসে।
এদিকে কেনীথ নিজে কেক খেলেও আনায়াকে মোটেও খাওয়ায় না। বরং কেকটা পাশেই একটা টেবিলের উপর রেখে দেয়। আনায়া কিছুটা কপাল কুঁচকে ওর কার্যক্রম দেখে। কেনীথ ঘুরে ফিরে আনায়ার দিকে তাকাতেই সে নিজেও কপাল কুঁচকে বলে,
“কি হলো?”
আনায়া নির্লিপ্ত স্বরে বলে,
“বার্থডেটা কার?”
—“কেনো তোর!”
কেনীথের এমন আলাভোলা কথা শুনে আনায়া চোখ ছোট ছোট করে বলে,
“তা কেকটা কি নিজের খাওয়ার জন্য নিয়ে এসেছিলেন?”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিছুটা অবুঝের মতো করে বলে,”ওহ! সরি, মনে ছিল না।”
এই বলেই সে কেকের ছোট্ট একটা অংশ দু’আঙ্গুলে তুলে নিয়ে আনায়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। তবে কেকাটা সরাসরি আনায়াকে খাইয়ে না দিয়ে…আনায়ার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের কাছে টানে। আচমকা কেনীথের এহেন কান্ডে আনায়া নিজের ভারসাম্য হারিয়ে কেনীথের বুকের উপর পরে। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে কেনীথের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই কেনীথ মুচকি হেসে ওর মুখে কেকটা তুলে দেয়। তবে আনায়া কেক খাওয়ার পূর্বেই কেনীথ আরো এক কাজ করে বসে। অকস্মাৎ আনায়ার ঠোঁটের আগায় কেক থাকা স্বত্বেও সে তার ঠোঁট আঁকড়ে ধরে। এরপর যা হবার তাই হয়। আনায়া কেনীথের হুটহাট কান্ডে অপ্রস্তুত হলেও, কেনীথের কাছে পুরো ব্যপারটা উপভোগ্য। তবে আনায়া এদিকে ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়েছে। কেনীথ আনায়াকে ওষ্ঠ ছেড়ে দিয়েই বিস্তৃত হেঁসে বলে,
“হ্যাপি বার্থডে, তারা মাই ব্লাড!”
আনায়া কেনীথের দিকে অসহনীয় চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, নিজের ঠোঁট আঙ্গুল ছোঁয়াল। নিমিষেই কিছুটা র’ক্ত তার আঙ্গুলের ডগায় লেগে যায়। আনায়া তা দেখে কেনীথের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই কেনীথ নির্বিকারে বাচ্চাদের মতো করে হেসে বলল,
“সরি, কিন্তু এমনি উইশ করে প্রোপার ফিলটা ঠিক পাচ্ছিলাম না। এবার ঠিক আছে।”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। ওমনি কেনীথ আবারও বলল,
” কেকের টেস্টও কিন্তু ভালো ছিল।”
আনায়া কিছু না শুধু চোখ রাঙিয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইল। ওদিকে কেনীথের নজর সরে গিয়েছে…সে এখন আনায়াকে দেখতে ব্যস্ত।যা আনায়া বোঝামাত্রই কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে বলল,
“কি…কি দেখছেন?”
–“তোকে! আমার পছন্দ অবশ্য খারাপ না। ভালোই আছে।”
—“কে বলেছে, আপনার পছন্দ খারাপ না? এটা…এটা কোনো শাড়ি হলো? কবে দেখেছেন, আমি এমন শাড়ি পড়েছি?”
—“দেখেনি বলেই তো দেখতে চেয়েছি। অবশ্য আমি কিন্তু লিখেছিলাম, ‘বাকিটা তোর ইচ্ছে।’ এরপরও যদি তুই এ শাড়ি পড়ে, এখন আবার আমায় কথা শোনাচ্ছিস… এটা কি ঠিক হচ্ছে?”
আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে বলে,
“তো কি করব, আপনি লিখেছেন-ই ওভাবে…?”
—“কিভাবে?”
—“ওতোকিছু জানি না, আপনার পছন্দ খুব বাজে।”
—“ওহ! তবে তো তুইও বাজে।”
—“মানে?”
আনায়া চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করতেই কেনীথ আলতোভাবে মুচকি হেসে জবাব দেয়,
“তুই যদি আমার পছন্দের নাই হতি, তবে নিশ্চয় আজ আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম না। এখানে অন্যকেউ থাকত।… তুই যাকে চাইতিস, হয়তো বা সে।”
আনায়া কেনীথ দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দুবার চোখের পলক ফেলে। ওমনি কেনীথ মুচকি হেসে বলে,
“বেশি পাত্তা দেই বলেই তো, দাম দিস না। যখন সুদূরে হারিয়ে যাব, তখন আর কেঁদেও খুঁজে পাবি বা।”
অকস্মাৎ কেনীথের এমন অভিব্যক্তিতে আনায়া কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। কেনীথ গভীর চোখজোড়ার দিকে অপলক চেয়ে থেকে নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে বলল,
“চিন্তা করবেন না, জমের ঘর বেঁধে এসেছেন আপনি। মনে তো হয়না, এতো সহজে আপনি আমার পিছু ছাড়বেন।”
আনায়ার কথায় কেনীথ আবারও আলতো হাসল। বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোঁটের কাছে দুবার আলতোভাবে ঘরে বলল,
সব গল্পই একদিন থেমে যায়।যা শুরু হয়, তা একদিন শেষও হয়।আমি তো কেবল সেই নিয়মেরই এক ক্ষুদ্র উদাহরণ।”
আনায়া কিছু বলে না। শুধু অপলক কেনীথের দিকে তাকিয়ে তাকে। নিমিষেই চারপাশের আবহ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায়। কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই খানিকটা মুচকি হাসে।
—“চিন্তা করিস না, এবার যখন স্বেচ্ছায় আমার হয়েছিস। তবে আমি না ম’রা অব্দি তুই আমার বক্ষপিঞ্জরেই বন্দী থাকবি। এরপর না হয়…আমার পিঞ্জর ভেঙে তুই মুক্ত হয়ে যাস।”
আনায়া নিমিষেই নিজের হাতদুটো শক্তভাবে মুষ্টিবদ্ধ করে। অজান্তেই চোখের কোণে জল জমে ওঠায় সে কিছুটা বিরক্ত হলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আপনার এতো ভালোমানুষি কথাবার্তা আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। যা আছেন তাই থাকুন না, এতো কেনো…”
কেনীথ আলতোভাবে মুচকি হাসে। আবহটাকে স্বাভাবিক করতে বলে ওঠে,
“ঠিক আছে। তো বল, এই জায়গাটা পছন্দ হয়েছে কিনা? যদিও এসব আমার প্ল্যান নয়, সবটাই পাভেলের। আমি আর এসব কি…ঠিক বুঝিও না কারিও না।”
কেনীথ মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুল এলোমেলো করে কথা বলেই আনায়ার দিকে তাকায়।এদিকে আনায়া বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,
“তা পারবেন কেনো? পারবেন শুধু কখন সুযোগ বুঝে অকাজ করতে হয়।”
—“তুই কি কিছু বললি?”
—“নাহ, কিচ্ছু বলিনি।”
মুখে এ কথা বললেও,আনায়া মনে মনে আওড়ায়,
“আসল কথাই আর শুনবে না, বয়ড়া একটা!”
এদিকে কেনীথ কিছুটা আশেপাশে তাকিয়ে গম্ভীর্যের সাথে বলে,
“আমি এতোটাও বয়ড়া না। একটু সাবধানে।”
—“কি সাবধানে? ঢং করতে কে বলেছে আপনাকে?”
—“ওই, তোর কি আমার সাথে শুধু ঝগড়াই করতে ইচ্ছে হয়? দুটো ভালো কথা বলতে নিলেও দেখি, সেধে ঝগড়া করতে চলে আসিস। ঝগড়াটে মহিলা!”
—“তবে আপনি কি? ঝগড়াইট্টা বেটা ছৈইল।”
শুরুতে আনায়া ভাষা বুঝতে কেনীথের কিছুটা অসুবিধা হলেও পরবর্তীতে ঠিকই আন্দাজ করে বুঝে নেয়। কোনো মতে নিজের বিরক্তিকে সামলিয়ে বলে,
“যাহ, আজকের মতো ছাড় দিলাম। আর দয়া করে মাথা গরম করিস না।”
আনায়া রেগে কিছু বলতে নিয়েও আর বলল না। উল্টো কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এখন কি করব?”
কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে বলে,
“কি করবি মানে? তোর কি আমার সাথে মা”রামা”রি করতে ইচ্ছে হচ্ছে? বিশ্বাস কর তারা, তোর যে কঙ্কালসারের মতো চেহেরা হয়েছে না… আমি একটা টোকা দিলেই তো হাড় হাড্ডি ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে।”
—“হাহ্, আসছে! এইজন্যই তো বলি জলহস্…”
—“আনায়া!তোকে কিন্তু নিষেধ করেছি আমাকে এ নামে…”
–“তো আপনিও ভালো হয়ে যান। আমিও ভালো হয়ে যাব। আই মিন,আমি তো ভালোই। আপনার কথা শুনব আরকি।”
কেনীথ চোখ পিটপিট আনায়ার দিকে তাকায়। এরইমাঝে আচমকা গ্লাসের দরজার ওপার হতে কাউকে আসতে দেখে আনায়া ত্বরিত কেনীথের পিছনে লুকিয়ে যায়।হঠাৎ আনায়া এমন কেন করল তা বুঝতে না পেরে কেনীথ সমানে তাকিয়ে দেখে পাভেল তাদের দিকে দৌড়ে আসছে। দরজার কাছে এসেই সে ডাক দিয়ে বলল,
“ব্রো!”
কেনীথ কিছুটা কপাল কুঁচকে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।ওদিকে তার পেছন পেছন নিজেকে আড়াল করে আনায়াও এগিয়ে যায়। কেনীথ আনায়ার বিষয়টা খেয়াল না করে পাভেলের উদ্দেশ্যে বলে,
“কাহিনি কি? তুই হঠাৎ এখানে কেনো?”
পাভেল হাঁপাচ্ছে। আজ অবশ্য কেনীথের কথায় কিছুটা বিরক্ত হলো।
–“আমি না চাইলেও,তোমার সব কিছুতেই আমায় ঢুকে পড়তে হয়। কবে যে তুমি…যাই হোক, তোমার এই জিনিসগুলো। এগুলো না নিয়েই চলে এসেছো।”
পাভেল কেনীথ দিকে একটি বেলি ফুলের গাজরা আর একটি গোলাপ ফুলের তোড়া হাতে ধরিয়ে দিয়েই কোনো মতে ছুটে দৌড়ে পালায়।কেননা আনায়ার বিষয়টা সে কিছুটা হলেও আন্দাজ করেছে।
এদিকে কেনীথ ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে,একবার দেখে নেয়। কয়েকটা লাল গোলাপের মাঝে তিনটে কালো গোলাপ। সবমিলিয়ে হয়তো এগারোটা গোলাপ রয়েছে।
কেনীথ পাশে ফিরে দেখে আনায়া উঁকি দিয়ে তার হাতের ফুলগুলো দেখছে। আবার কখনো তাকিয়ে রয়েছে দরজার দিকে। কেনীথ একদম পেছনে ফিরে তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“এভাবে লুকালি কেনো?”
আনায়া কেনীথের কথা শুনে নিজেকে স্বাভাবিক করে।
—“তো কি করব। হুট করে যে উনি আসবে…”
আনায়ার কথা অসম্পূর্ণ রইলে, কেনীথ বলে,
“তোর কাহিনি কি, আমি ঠিক বুঝি না। কখনো দেখি ঠ্যাং বের করে ভরা পার্টিতে ড্যাংড্যাঙিয়ে নেচে-গেয়ে বেড়াচ্ছিস।আবার কখনো দেখব সাধু সেজে… এমন গিরগিটির মতো চেঞ্জ হলে… না জানি আমার বাচ্চাকাচ্চা গুলো কেমন হবে।”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া শুরুতে ওর বাহুতে কিছুটা আ”ঘাত করলেও পরবর্তীতে আমতা আমতা করে বলল,
“ঐ রাতে পার্টিতে তো…. তোমার জন্যই ওভাবে সেজে গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমিই তো আমার দিকে ফিরেও তাকাওনি।”
কেনীথ আনায়ার দিকে চোখ ছোট ছোট করে, গম্ভীর স্বরে বলল,
“বাহানা দেওয়ার জায়গা পাচ্ছিস না? বাই দ্য ওয়ে, আমার ওমন বেহায়াপনা করা মেয়েদের প্রতি কোনো কালেই কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ওইদিনও তোকে ঠিক রুচিতে আসেনি। তাই ফিরে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করিনি।
আর আমি যদি একটুও বুঝতাম যে, ওটা তুই ছিলি। বিশ্বাস কর, ওখানেই তোর ঠ্যাং ভে’ঙে গুঁ’ড়িয়ে দিতাম। তোর কোনো ধারনা রয়েছে…সবাই কিভাবে তোকে চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছিল। ইচ্ছে তো করছে, এখনই গিয়ে ওদের গি’লে খেয়ে আসি।”
আনায়া শেষমেশ কিছুটা হেসে ফেলল। তা দেখে কেনীথ কপাল কুঁচকে বলল,
“আমার কথায় তোর হাসি পাচ্ছে?”
আনায়া ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
“আপনি জেলাস…?”
—“মোটেও না। তুমি বেহায়াপনা করবা আর আমি কিছুই করব না, তা তো হয়না। আমি আমার মা কিংবা তোর মা… কখনোই কাউকে… এসব তো বহু দূরের কথা। তারা যথেষ্ট শালীনতার সাথে নিজের জীবন পার করেছে। আর তুইও কখনো তাদের মেয়ে ,বৌমা হয়ে এসব উল্টোপাল্টা কাজকর্ম করবি না। নয়তো আমার চেয়ে খা’রাপ কেউ হবে।”
কেনীথ শুরুতে প্রচন্ড গম্ভীর্যের সাথে নিজের কথাগুলো শেষ করল। তবে পরক্ষণেই আবার মুচকি হেসে বলল,
“তবে যদি চাস, শুধু আমার সামনে ওসব যখন পড়তে পারিস। আমি কিছু মনে করব না।”
কেনীথের কথার উদ্দেশ্য বোঝামাত্রই আনায়া চোখ ছোট ছোট করে আওড়ায়,
“জাতে মাতাল, তালে ঠিক।”
—“না হয়েই বা আর কি করব বলো? আমার বউ যেন আন রোমান্টিক।”
—“এ্যাহ! আসছে…আমার রোমিও৷”
—“তুমি আমার জুলিয়েট হয়ে যাও প্রিয়, আমি তোমায় আরো কিছু হয়ে দেখাব৷”
—“প্রয়োজন নেই, যা আছেন তাই থাকুক। যাই হোক, ফুলগুলো কি আমার জন্য এনেছেন নাকি ওগুলোও কেকের মতো নিজেই নিজেকে… ”
—“আরেহ নাহ্, ভাবছি এগুলো ফ্রাই করে খাব।”
আনায়া কেনীথের কথায় কপাল কুঁচকে ফেলল। ওদিকে কেনীথ আনায়ার কপালে ছোট করে টোকা দিয়ে বলল,”বুদ্ধু!”
কেনীথের এহেন কান্ডে আনায়া কিছুটা চমকে ওঠে। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, এমনটা কেনীথ আগেও করেছে। সে আচমকা কেনীথের দিকে তাকাতেই কেনীথ বলল,
—“কি?”
“এটা কি আপনি আগেও করেছেন?”
কেনীথ কপাল কুঁচকে, আচমকাই এবার আনায়ার মাথার পেছনে আলতোভাবে বারি দিয়ে বলে।
“কোনটা…এটা?”
আনায়া ভারসাম্য হারিয়ে মাথাটা খানিক সামনে ঝুকিয়ে নেয়।আবার ততক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে কেনীথের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই, কেনীথ কি যেন ভেবে বলে উঠল,
“এই! তোর তো এসব মনে থাকার কথা না। তুই কি কোনোভাবে…”
—“জানি না, হুট করে এমনটাই মনে হলো।”
—“বাহ, ব্যাপারটা ভালো তো।”
—“হুম। সব ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে মাথায় টোকা দেওয়া এটা কেমন স্বভাব আপনার? আপনি না বলেছিলেন, আপনি প্রচন্ড সাধু ছিলেন ছোট বেলায়।”
—“সিরিয়াসলি? আমার এই মাথা টোকায় দেওয়া নিয়ে তুই…শুন, তুই যতটা খচ্চর ছিলি তার সাথে এটা কিছুই নয়। আমি ভালো ছিলাম বিধায়, তোকে সবসময় মাফ করে দিতাম। নয়তো… ”
—“ওটাকে ভালো বলে না। তুমি বলদ ছিলে বিধায় আমায় ছেড়ে দিতে। আর শেষে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে।”
—“তারা, বেশি যেন হয়না।”
—“কম হয়ে গেল বুঝি? ইশ, আমি আরেকটু বড় থাকলেই আজ হতো। তাহলে তোমার এসব চাপার ঢোল পেটানোর সবকিছু ফাঁস হয়ে যেত।”
আনায়া এসব বলতে বলতেই হেসে উঠল। ওদিকে কেনীথ কিছুটা বিরক্তির সাথে চেয়ে থাকার পর খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আনায়ার দিকে গোলাপ ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এই নে!”
আনায়া ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”কি করব?”
কেনীথের নির্বিকারে বলে,”আমি কি জানি।”
আনায়া চোখ মুখ কিছুটা কুঁচকে ফুলটা হাতে। একইসাথে মনে মনে আওড়ায়,”আবার আমাকে আন রোমান্টিক! নিরামিষ একটা!”
আনায়া ফুলটা নিয়ে সরে যেতে নিলে কেনীথ পেছন থেকে বলে উঠল,
“ঐ শুন।”
আনায়া পেছন ফিরে তাকাতেই, কেনীথ ওর কাছে এগিয়ে এলো। আনায়ার দুবাহু ধরে ওকে উল্টো ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। অতঃপর হাতে থাকা বেলি ফুলের গাজরাটা আনায়ার খোলা চুলে লাগিয়ে দেওয়ার পুরো চেষ্টা করতে লাগে। অদক্ষ হাতে কাজটা করতে কেনীথকে কিছুটা বেগ পেতে হলেও, শেষমেশ তার কাজ সম্পন্ন হয়। চুলে আলগাভাবে বেলী ফুলের গাজরা লাগানো হলে, কেনীথ নিজের প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে সটানভাবে দাড়ায়। অতঃপর প্রচন্ড তীক্ষ্ণতার সহিতে সে আনায়ার চুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে আনায়া পেছনে ফিরে ঘুরে তাকাতেই কেনীথ বলে,
“কি, এবার খুশি তো? তুই যতটা ভাবিস ততটাও নিরামিষ নই আমি।”
হঠাৎ কেনীথ কিভাবে তার মনের কথা বুঝে গেল, তা আনায়ার বোধগম্য হলো না। সে শুরুতে কিছুটা কপাল কুঁচকে ফেললেও, পরবর্তীতে বিস্তৃত হেসে বলল,
“হুম, খুব খুশি।”
কেনীথও খানিকটা মুচকি হাসে। অতঃপর দুজনের মাঝে পুনোরায় পিনপতন নীরবতা। আনায়া চুপচাপ থাকার মাঝেও কেনীথ কিছুটা অস্বস্তির আবহ টের পেলো। সে চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে বলল,
“জায়গাটা একটু দমবন্ধকর লাগছে, তাই না?”
—“আ..নাহ,ঠিক আছে তবে… কেমন যেন বন্দী বন্দী লাগছে। মনে হচ্ছে, মাছগুলো নয় বরং আমাদেরই কেউ বন্দী বানিয়ে আঁটকে রেখেছে। নয়তো দেখুন, ওরা কতসুন্দর ছুটে বেড়াচ্ছে।”
—“তবে চল আমারও যাই।”
—“মানে? আপনি এখন এতো রাতে, মাছদের মতো পানির নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?”
—“আরেহ না, গাধী। সবমসময় এতো বেশি বুঝিস কেনো?”
এই বলেই কেনীথ ফোন বের করে পাভেলকে ফোন দেয়। এরপর কি যেন সব একের পর এক বলতে থাকে। আর আনায়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কেনীথের কাজকর্ম দেখে। মাঝেমাঝে ফুলের মাঝে নাক ছুঁইয়ে দীর্ঘ টানে ঘ্রাণ শুঁখে নেয়।আবার নিমিষেই মিটমিট করে মুচকি হাসতে থাকে।
কেনীথের কথা বলা শেষ হলে সে আনায়া উদ্দেশ্যে বলে,
“চল!”
—“কোথায়?”
—“বাহিরে হাটতে যাবো। যাবি তো? নাকি ঘুম পেয়েছে?”
হঠাৎ এতো রাতে বাহিরে…আনায়া শুরুতে কিছুটা চমকায়। পরবর্তীতে সম্মতি দিতে গিয়েও কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়।তবে কেনীথ যেন ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তাই সে নির্লিপ্ত স্বরে বলে,
“চিন্তা নেই, পাভেলকে বলে দিয়েছি। আশেপাশে কেউ থাকবে না। শুধুমাত্র আমরা ব্যতীত।”
আনায়া এবার কিছুটা মুচকি হাসে। অতঃপর দুজন মিলে রুম থেকে বেড়িয়ে উপর তলায় যেতে লাগে।আনায়ার হাতে অবশ্য তখনও ফুলের তোড়াটা। সে আর এটি রুমে ফেলে রেখে আসেনি।
যেহেতু এই রিসোর্টটা দুটো দ্বীপের সংযোগে তৈরি। একটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য, অন্যদিকে পরিবারের সদ্যদের জন্য। কেনীথরা এই রিসোর্টে থাকলেও, ইনায়া আর পাভেল মূলত অন্যটায় গিয়ে থাকছে। এবং এখানে আসার দুটো পথ, হয়তো বোটে আসতে হয় নয়তো হেটে হেটে দীর্ঘ ওয়াকওয়ে পেরিয়ে আসতে হয়। কেনীথরা শুরুতে বোটেই এসেছে। কিন্তু এতোরাতে আর আলাদা করে তাদের বোট কিংবা অন্যকিছুতে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তাই সে আনায়াকে বলল,
“শুন, আইল্যান্ডে যেতে হলে কিন্তু অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। পারবি তো?”
কেনীথ আনায়ার কথায় নির্বিকারে সম্মতি জানায়। এরপর দুজন মিলে হাঁটতে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়ে। চারপাশে সমুদ্রের জল।মাঝে বিস্তৃত বিস্তৃত সরু রাস্তা। আকাশে বিস্তৃত পূর্নিমার আলোয় চারপাশটা আলোকিত। সেই আলো সাগরের জলধারায় প্রতিফলিত হয়ে চকচক করছে। চারপাশ হতে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় আনায়া অজান্তেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠছে।
তার পরনের পাতলা ফিনফিনে শাড়ি বাতাসের দোলায় উড়ে বেড়াচ্ছে। পিঠের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলোও দুলছে সমান তালে। সমুদ্রের পানি ঝাপটে এসে তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। খানিকটা পানির ছিটে গায়ে এসেও লাগছে। কেনীথের ক্ষেত্রেও বিষয়টা ব্যতীক্রম নয়। তবুও তারা দুজন এগিয়ে চলেছে নিজেদের গন্তব্যে।
এদিকে হাঁটার মাঝেই আনায়া একবার হাতে থাকা ফুলগুলোর দিকে তাকায়,আবার কখনো চাঁদের দিকে। পরক্ষণেই তাকায় আড়চোখে কেনীথের দিকে। যদিওবা কেনীথের নজর একদম সম্মুখে। একইসময় হঠাৎ আনায়া এক কাজ করে বসে। অকস্মাৎ কি যেন ভেবে কেনীথের একপাশের বাহুতে নিজে হাত পেঁচিয়ে নেয়। কেনীথ কিছুটা চমকে পাশে ফিরে তাকালে আনায়া নির্বিকারে, কেনীথের সাথে একপ্রকার ঘেঁষে এগিয়ে যেতে থাকে।
কেনীথ খানিকটা চোখ পিটপিট করে পুনোরায় সামনের দিকে ফিরে তাকায়। কি যেন ভেবে নিমিষেই বিস্তৃত মুচকি হাসে। এদিকে আনায়াও না চাইতেও মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। তবে হঠাৎ করেই ফুলের কথা মনে পড়তেই সে বলে,
“ধন্যবাদ।”
কেনীথ কপাল কুঁচকে ওর দিকে ফিরে তাকায়।—”কিসের জন্য?”
—“সবকিছুর জন্যই। তবে বিশেষ করে বেলী ফুলগুলো…এটা একটু বেশিই সুন্দর।”
কেনীথ মৃদু হেসে সামনে ফিরে তাকায়। চাঁদের দিকে একপলক চেয়ে গম্ভীর্যের সাথে বলে,
“আমার একমাত্র বউয়ের প্রিয় ফুল বলে কথা। তার জন্মদিনে এইটুকু দিতে না পারলে, আমার জীবন তো অনর্থক।”
চলবে_____________________