একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪০(২য় অংশ)

0
16

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব—৪০(২য় অংশ)

“আমার একমাত্র বউয়ের প্রিয় ফুল বলে কথা। তার জন্মদিনে এইটুকু দিতে না পারলে, আমার জীবন তো অনর্থক।”

আনায়া ঠোঁট চেপে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসল। পরক্ষণেই কি যেন ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ফেল, আবারও আলতোভাবে হাসল।

বিস্তৃত সরু রাস্তার বুকে আলতো পায়ে হেঁটে যাচ্ছে একজোড়া নবদম্পতি।নবদম্পতিই অবশ্য বলা চলে। বহু দ্বিধাদ্বন্দ্ব, মান অভিমান,রাগ,ক্ষো’ভ,যু’দ্ধের পর তাদের এই নতুন জীবনের পথচলার সূচনা হয়েছে। কেনীথের বাহুতে আনায়ার পেঁচানো হাত,কাঁধের কাছে ঠেকানো মাথা। কি চমৎকার সেই অপার্থিব সৌন্দর্য!

নিঃশব্দ সমুদ্ররাত্রি তাদের পায়ের নিচে আলো ছড়ানো জলপথ বিছিয়ে রেখেছে। সাঁঝ আর রাতের সীমানায় এক অপার্থিব নিস্তব্ধতা। জোছনায় ঝলমল করে উঠছে জলরেখ। বাতাসে দুলছে আনায়ার চুল আর তার ফিনফিনে শাড়ির প্রান্তভাগ। সেই প্রান্ত ছুঁয়ে যায় কেনীথের হাতে।

সমুদ্রের পাড়ঘেঁষা ওই দীর্ঘ সরু পথটিতে একটানা হেঁটে চলে দু’টো প্রাণ। যাদের এই অনবদ্য সম্পর্ক সদ্য জন্ম নিয়েছে, অথচ শিকড় এত গভীরে যেন বহু জন্মের পূর্বচেনা। চাঁদের আলো কখনো ছায়া ফেলে তাদের শরীরে।কখনো জলরেখায় ছড়িয়ে পড়ে নরম মোহে।

আনায়ার হাতে ধরা গোলাপ ফুলের তোড়া তখনো সতেজ। শুভ্র পাপড়িগুলো বাতাসে সামান্য দুলে উঠে, জানান দেয় তার অস্তিত্ব। এই ফুল কেবল তার জন্মদিনের উপহার নয়, এ যেন এই সম্পর্কের প্রতীক—নির্মল, কোমল আর নিরালম্ব।

চারপাশে জলের ঝাপটা।পায়ের কাছে কখনো ছুঁয়ে যায় হালকা স্রোতের ফেনা। বাতাসে লবণের গন্ধ, আর তাতে মিশে থাকা একরকম অপরিচিত স্নিগ্ধতা।

রাস্তার শেষপ্রান্ত ধীরে ধীরে কাছে আসছে। কিন্তু তাদের গতি একটুও বাড়ছে না। যেন শেষ না হোক, এই রাতটা থেমে থাকুক, এই হাঁটাটুকু অনন্তকাল ধরে চলুক।

কেনীথ-আনায়া সরু রাস্তা পেরিয়ে ধীরে ধীরে দ্বীপের কাছে এসে পৌঁছায়। কোনোকিছু না ভেবেই তারা খালিপায়ে বিচে নেমে পড়ে। একপাশে জঙ্গল, বড়বড় নারিকেল গাছ… জোছনার আলো দ্বীপের বালিতে অদ্ভুত ছায়া ফেলে অনবদ্য এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সমুদ্র জল খানিকক্ষণ পরপর পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে। এইজায়গায় শীতল বাসাতের দাপটও কিছুটা বেশিই।

কেনীথ আনায়া নিজেদের মতো সামনে এগিয়ে যায়। তবে হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে আনায়া থমকে দাঁড়ায়।—”আহ্”

তার পায়ে কিছু একটা গেঁথে গিয়েছে। কিছুটা ব্যাথা করায় শুরুতে অস্ফুটস্বরে আওয়াজ করেও ওঠে। কেনীথ উদ্বিগ্ন হয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। আনায়ার দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করে,

“কি হয়েছে?’

আনায়া নিজের বাম পা-টা খানিক উঁচিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। কেনীথের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে বলে,

” আ…তেমন কিছু না।পায়ে হয়তো কিছু…”

আনায়ার কথা শেষ হয়না। বরং তার পূর্বেই কেনীথ হাঁটু গেঁড়ে আনায়ার সামনে বসে পড়ে। আচমকা আনায়ার বাম পা টেনে নিয়ে নিজের হাঁটুর উপর রাখে।

—“আরেহ আরেহ্, কি করছেন?”

—“চুপ থাক। আমায় ধরে দাঁড়া, নয়তো পড়ে যাবি।”

—“কিন্তু আপনি আমার পা কেনো…?”

—“কেনো, আমি ছুঁলে কোনো সমস্যা?”

—“বুঝতে পারছেন না কেনো…আপনি আমার বড়৷”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ মুখ উঁচিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

“সিরিয়াসলি! বয়সে বড় বরকে হুটহাট চ”ড় মারতে পারিস আর এখন তোর পা ছুঁতেই… বড়ছোটর হিসেব নিকেশ চলছে? ট্রাস্ট মি,আরেকবার উল্টোপাল্টা কথা বললে সোজা মে’রে এখানেই বালির মধ্যে গেঁড়ে নয়তো সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে যাব।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। কিন্তু কেনীথ তাতে কোনো পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। আনায়ার পায়ের তালুতে নজর পড়তেই দেখে একটা ছোট্ট কাঁটা সদৃশ্য কিছু গেঁথে রয়েছে। কেনীথ অকস্মাৎ কোনোকিছু না ভেবেই কাঁটাটা টেনে তুলে ফেলে। নিমিষেই আনায়া ব্যাথায় চোখ রাঙিয়ে বলে,

“আহ্, আস্তে!”

কিন্তু কেনীথ নির্বিকারে বলে, “মরে যাসনি তুই!”

কাঁটাটা তুলে ফেললেই দুই ফোঁটা র”ক্ত গড়িয়ে পড়ে। পায়ের তালুতে বিচের বালি আলগাভাবে লেগে রয়েছে। কেনীথ নিজ হাতেই তা ঝেড়ে সরিয়ে দেয়। অতঃপর আনায়ার পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আনায়া বালিতে পা ফেলে না। কিছুটা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে থাকে। কেনীথ ওর অবস্থা দেখে বলে,

“বালিতে পা ফেলার প্রয়োজন নেই৷ ইনফেকশন হতে পারে।”

—“আরেহ্, পাগল নাকি? এটুকুতে ইনফেকশন? আর বালিতে পা না ফেলে যাব কিভাবে।”

আনায়ার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়না কেনীথ। বরং অকস্মা আনায়ার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ওকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। নিমিষেই আনায়া বিস্ময়ে চোখ বড়বড় করে তাকায়। আনায়াকে হুঁশে ফেরাতে কেনীথ ওকে কিছুটা ঝাঁকুনি দিতেই আনায়া ঝাপটে কেনীথের গলা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে। কেনীথ কিছুটা মুচকি হেসে, দ্বীপের আরো সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

আনায়া শুরুতে কিছুটা বিস্ময়ে স্তব্ধ রইলেও পরবর্তীতে কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে কেনীথের বুকের সংলগ্নে মাথা ঠেকায়। লম্বা চুলগুলো কেনীথের বাহু ছাপিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছে। বাতাসের দোলে ও মৃদুপায়ে হেঁটে চলার তালে সেগুলো অনবরত দুলছে। আনায়ার হাতে থাকা ফুলের তোড়া টা কেনীথের ঘাড়ের পেছনে ঠেকছে। আনায়া কি যেন ভেবে, কেনীথের গলাটা আরেকটু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে। এদিকে কেনীথের দৃষ্টি একদম সম্মুখে। অভিব্যক্তিও তার অদ্ভুত। গম্ভীর অথচ যেন ঠোঁটের কোণায় এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি। আনায়ার সব কার্যক্রমও তার কাছে স্পষ্ট।

এদিকে কেনীথ সমুদ্রের কিনারা ধরে এগিয়ে, চুপচাপ হেটে চলেছে। পাশ থেকে সমুদ্রের জল ঝাঁপটে কিনারায় আছড়ে পড়ছে। পানির ছিটেফোঁটা এসে লাগছে গায়ে। নিমিষেই অদ্ভুত এক শীতল শিহরণে দুজনে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠছে। অনেকটা সময় এভাবেই অতিক্রম হবার পর, আচমকা কেনীথ বলে উঠল,

“তুই এভাবে লজ্জা পাচ্ছিস কেনো?”

যদিও বা আনায়া কেনীথের বুকের কাছে মুখ গুঁজে মুচকি মুচকি হাসছিল।কিন্তু কেনীথের কথা শোনামাত্রই তার প্রফুল্ল অভিব্যক্তিটুকু মিলিয়ে যায়। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে কঢ়া স্বরে বলে,

“লজ্জা যখন পাচ্ছিই, তবে পেতে দিন না! আপনার সাথে থেকে থেকে তো আমার লজ্জা সরমও চলে গিয়েছে।”

অকস্মাৎ এহেন কথা শুনে কেনীথ আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারল না। আনায়ার এমন অভিব্যক্তি প্রচন্ড হাস্যকর লাগল তার কাছে। সে গা দুলিয়ে বিস্তৃত হেঁসে ফেলতেই আনায়া আবারও কপাল কুঁচকে বলে ওঠে,

“এই খবরদার! একটুও হাসবেন বলছি।”

আনায়া পা ছোটাছুটি করতে নিলে কেনীথ খানিকটা ঝাঁকি দিয়ে আনায়ার মুখোমুখি নিজের মুখ এগিয়ে গাম্ভীর্যের সাথে বলে,

“একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না? আশেপাশে কিন্তু কেউ নেই। আমাকে কন্ট্রোল লেস বানিয়ে…এইখানেই উল্টোপাল্টা কিছু করে ফেললে কিন্তু পরে দোষ দিতে পারবি না।”

এই কথা শোনামাত্রই আনায়া নিমিষেই চুপ হয়ে যায়। কেনীথের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ ঢোক গিলতেই কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হাসে। এরপর আর একটুও সময় নষ্ট করে না। রাত যত গভীর হচ্ছে ততই চারপাশের নিস্তব্ধতা বাড়ছে। কেনীথ আনায়াকে নিয়ে সমুদ্রের পাশে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আনায়াকে নিচে নামিয়ে দেয়। আনায়া বালিতে বসে পা দুটো পানিতে ভিজিয়ে দেয়। একইসাথে কেনীথও তার সঙ্গী হয়। দু’জন সমুদ্রের পানিতে নিজেদের পা ভিজিয়ে, চুপচাপ বসে থাকে।

আনায়া ব্যাপারটা যথেষ্ট উপভোগ করছে। মাঝেমাঝে সমুদ্রের ঢেউ দৃঢ় হলে তা সোজা আনায়ার শাড়ির অনেকটা অংশই ভিজিয়ে দিচ্ছে।অথচ এদিকে কেনীথ অপলক তার দিকে তাকিয়ে। চোখমুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তির ছাপ।

এরইমাঝে কেনীথ কি যেন ভেবে দূর সমুদ্রের পানে তাকায়। কখনো চোখ ফিরিয়ে আকাশের চাঁদ দেখে। কিছু যেন বলতে চাইছে, নয়তো সে চাইছে কিছু জানতে। কেনীথ অভিব্যক্তি কিছুটা পরিবর্তন হয়। সে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“তারা! একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া তার দিকে ফিরে তাকায়। কেনীথের এমন অদ্ভুত হাভভাবে তার মুখটাও খানিক মিলিয়ে যায়।

—“হুম, বলুন।”

কেনীথ আনায়ার দিকে ফিরে তাকায়। আজ কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না। কেনীথ ভারী শ্বাস ফেলে। অতঃপর মাথা নাড়িয়ে বলে,

“কিছু না।”

কেনীথের অভিব্যক্তি অদ্ভুত ঠেকল আনায়ার কাছে। কেনীথ সামনে মুখ ফিরিয়ে অদ্ভুত ভাঙা স্বরে বলল,

“শুধু আর কখনো ছেড়ে যাস না৷ আমি আর কিছু চাই না।”

আনায়া স্তব্ধ চোখে কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা ভেবে আলতো ঢোক গিলে কেনীথের গা ঘেঁষে বসে। কেনীথের বাহুতে হাত পেঁচিয়ে কাঁধে মাথা ঢেকিয়ে আলতো স্বরে বলে,

“যাব না, আর কখনো ছেড়ে যাব না। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন আপনার জীবন ভাজাভাজা করতে হলেও আমি আপনার পাশে থাকব।”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ হেসে ফেলে। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে পুনোরায় দুজনে মুচকি হাসিতে মেতে ওঠে। এভাবে আরো কিছুটা সময় পর অতিক্রম হবার পর আনায়া আবারও বলল,

“আগামীতে কি করবেন কিছু ভেবেছেন?”

—“কোন বিষয়ে?”

—“আগে যা করতেন, ভবিষ্যতেও কি সেসবই করার…বাবুশকা তো সব আপনাকেই…”

আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ বলল,

“ছেড়ে দেব! ভাবছি সব ছেড়ে দিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।”

আনায়া কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেলল।

—“ভেবে চিন্তে বলছেন তো?”

–“হুম,অবশ্য এখনো ফাইনাল ডিসিশন নেই নি। কিন্তু…আচ্ছা, তুই বল তো কি করা উচিত।”

আনায়া কিছুক্ষণ ভাবুক মনে বসে থাকে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,

“আপনার নানু বহু বছর আগেই আপনারকে সবটা দিয়ে গিয়েছে…এরমানে বুঝছেন তো? উনি আপনাকেই সবকিছুর জন্য শ্রেষ্ঠ ভেবেছে। তবে আপনি কেনো চাইছেন, সবকিছু ফেলে দূরে সরে যেতে। এরপর বাবুশকাও তো সব দায়িত্ব আপনাকে দিয়েছে, তাই না?”

—“তবে তুই চাইছিস, আমি বাকিটা জীবন এসবেই আঁটকে থাকি? আনায়া,সত্যি বলতে আমার আর এসব ভালো লাগে না৷ আমার খুব করে মনে হয়, আমি… আমি সবাইকে নয়তো নিজেকে খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলব। অনেককিছু হারিয়েছি আমি, আর কোনো কিছু হারানোর ইচ্ছে নেই আমার। এসব পাওয়ার প্রোপার্টির নেশাও আমার খুব একটা নেই৷ অন্তত আমি আমার জীবনের শেষাংশটুকু কোনোমতেই নষ্ট করতে চাই না। বাঁচতে চাই আমি, আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো।”

আনায়া একনাগাড়ে কেনীথের বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। কেনীথ কন্ঠস্বর খানিকটা ভাঙা, খানিকটা ভারী। অজান্তেই আনায়ার চোখ ছলছল করে ওঠে। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে কেনীথের বাহু আরেকটু আঁকড়ে ধরে বলে,

“এমন কেনো বলছেন? দেখবেন, এসব কিছুই হবে না।এতো চিন্তার কিছু নেই। আর আপনি যেহেতু চাচ্ছেন সবকিছু থেকে সরে যেতে, তবে তাই হোক। কিন্তু একটু ভেবে দেখবেন,আপনি চাইলেই ঐ সবকিছু স্বাভাবিক ভাবেই ব্যালেন্স করতে পারেন৷ আর সবার মতো নিকৃ”ষ্ট হবার তো প্রয়োজন নেই আমাদের। আমারা না হয় সবার নিয়মের উল্টোপথে হাঁটব। কি হবে তাতে? খুব বেশি হলে ঐ আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্ডে আমাদের পাওয়ার কমে যাবে। এই তো! এছাড়া আপনি ব্যতীত আর কেউই নেই যে ওসব সামলাতে পারবে। আর আমিও চাই না, আমার সন্তানরা কখনো ওসব জীবনে জড়িয়ে পড়ুক।”

আনায়া কথাগুলো সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতেও, শেষের কথাগুলো শোনামাত্রই কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। মুচকি হেসে আনায়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা কেশে ওঠে,

“উহুম…উহুম…!”

আনায়া মুখ ফিরিয়ে কপাল কুঁচকে বলে,

“কি হলো?”

—“বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যানও করে ফেলেছিস? আমিই কিন্তু এখনো এতদূর ভাবিনি।”

—“আপনি ভাবেন নি তাই বলে কি আমি ভাবতে পারব না?”

—“নাহ, কথা তা নয়…”

—“কথা যেটাই হোক, আগে ভাবেননি তবে এখন ভাবুন। জানি সবকিছু এতদ্রুত ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু আমি ভুলে যেতে চাই। সংসার যখন আপনার সাথেই পেতেছি, তবে ওসব বাচ্চাকাচ্চা হয়েই যাবে।”

কেনীথ ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। পরক্ষণেই সিরিয়াস হওয়ার প্রচেষ্টা বলে উঠল,

“হুম, হুম, তা ঠিক কথা৷”

—“তা ম্যাম, আর কিছু ভেবেছেন?”

—“আর কি ভাবব?”

—“কতজন হলে ঠিকঠাক হয়?”

আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আকস্মিক কিছুটা নুইয়ে পড়ল। আচমকা অজানা লজ্জায় গাল দুটো লাল হয়ে উঠল। গালের দুপাশে ছোট-বড় দুখানা টোলের দেখা মিলল । তা দেখামাত্রই কেনীথ বলল,

“এই তোর কাহিনি কি, বল তো! বারবার এমন গিরগিটির মতো চেঞ্জ হচ্ছিস কেনো? তোর চক্করে আমার বাচ্চাকাচ্চাগুলো গিরগিটি না হলেই হলো।”

কেনীথের এহেন কথা যেন, আনায়ার ইমোশনে পুরো জল ঢেলে দেওয়ার মতো। আনায়া তৎক্ষনাৎ চোখ ছোট ছোট করে বিরক্তির চাহনিতে কেনীথের দিকে তাকায়। তা দেখামাত্রই কেনীথ খানিকটা ভেবাচেকা খেয়ে যায়।

—-“কি হলো আবার?”

আনায়া বিরক্তির সাথে জবাব দেয়, “কিচ্ছু না।” পরক্ষণেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“গান গাইতে পারেন?”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ কেশে উঠল।মনে মনে বিরবির করে আওড়ায়,
“এমন ভাবে বলছে, যেন জানেই না আমি কে!”

কিন্তু কেনীথ মুখে বলল,

“খুব একটা পারি না। কিন্তু আপনার জন্য মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব।”

—“হুম, তবে তাই করুন।”

এই বলেই সে চুপচাপ গম্ভীর মুখে হাঁটু দুটো এক করে বসে পড়ল। কেনীথের বাহু থেকে হাত ছাড়িয়ে দুহাত হাঁটুর উপর রেখে, মুখ গুঁজে দিয়ে সমুদ্রের পানে চেয়ে রইল। এদিকে কেনীথ নিজের দুহাত পেছনের দিকে বালির মাঝে ঠেসে, আধশোয়ার ন্যায় বসে। খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ বুঁজে নেয়। তারপর অদ্ভুত এক শীতল কন্ঠে গাইতে শুরু করে,

তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও_______
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়_____
তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়_______

আমি তোমারো বিরহে রহিবো বিলীন,
তোমাতে করিবো বাস।
দীর্ঘ দিবসো দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস।

যদি আর কারে ভালোবাসো,
যদি আর ফিরে নাহি আসো___________
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেনো পাও,
আমি যতো দুঃখ পাই গো_______

আমারো পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই, তুমি তাই গো_______
আমারো পরানো যাহা চায়…
তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়_______

কেনীথ সম্পূর্ণ নিজের ধ্যানে হারিয়ে গিয়ে গানটু্ুকু সম্পূর্ণ করে। অথচ এদিকে যে একজনের কাঁদতে কাঁদতে বেহাল অবস্থা তা তার খেয়ালেই নেই। কেনীথের গান শেষ হতেই সে অনুভব করে, কারো ফুঁপিয়ে কান্না লুকানোর আওয়াজ। চোখ বুঁজে থাকা অবস্থাতেই তার কপাল কুঁচকে যায়।তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে পাশে ফিরে তাকিয়ে দেখে, আনায়া এলোমেলো ভাবে দু’হাতে নিজের চোখ মুছে যাচ্ছে।

এটা দেখামাত্রই কেনীথ ঠিকঠাক হয়ে, আনায়ার দিকে ঘুরে ফিরে বসে।তার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা। দু’হাতে আনায়ার বাহু ধরে বলল,

“কি হলো, কোথায়ও ব্যাথা পেয়েছিস?এভাবে কাঁদছিস কেনো? কিছু হয়েছে? প্লিজ বল কি হয়েছে? পায়ে কিছু…”

এই বলেই কেনীথ পা দেখতে নিলে আনায়া ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠল,

“নাহ,পায়ে কিছু হয়নি।”

—“তাহলে কি হয়েছে? আমি কিছু ভুল… ”

কেনীথের কথা সম্পূর্ণ হয়না। সে কি যেন আন্দাজ করতেই আনায়াকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টানে। নিমিষেই আনায়ার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। কেনীথের বুকের সংস্পর্শে আরো ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। কেনীথ একহাতে আনায়ার মাথার পেছনে রেখে আলতো স্বরে বলে,

“আরেহ্ পাগলী, কাঁদছিস কেনো?এটা তো শুধুমাত্র একটা গান ছিল। এইজন্য কেউ এতো কাঁদে?”

আনায়া নিজের মতো করে কেঁদেই চলেছে। কোনোমতেই যেন আর নিজেকে সামলাতে পারছে বা। যদিও বা সামলে নিতো কিন্তু কেনীথের সংস্পর্শে তা আর কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না। উল্টো আর নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।

কেনীথ এবার আনায়াকে ধরে সোজা করে বসায়। দু’হাতে তার মুখ দুটো তুলে আলতোভাবে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলে,

আকাশের রঙ যেমন বদলায়, তেমনি আমিও একদিন মিশে যাবো অন্য কোনো আলোছায়ায়। পৃথিবীর কোনোকিছুই তো চিরন্তন নয়। তবে আমি কেনো এই নিয়মের ব্যতীক্রম হবো?”

এই বলেই কেনীথ আনায়ার কপালে আলোতোভাবে ঠোঁট ছোঁয়ায়। অথচ আনায়া কান্নারত অবস্থাতেই কেনীথের দিকে কঢ়া চোখে তাকিয়ে থাকে। যা দেখে কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। আনায়া চুপচাপ রয়েছে তবে তার চোখ বেয়ে পানি পড়া কমছে না। মাঝেমাঝে মৃদু কেঁপেও উঠছে। কেনীথ ওর কান্না থামাতে এক অদ্ভুত পদ্ধতি অবলম্বন করে। আচমকা আনায়ার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিয়ে কয়েকবার ঘষে দিতেই আনায়া অকস্মাৎ চমকে ওঠে। কেনীথের বাহুর শার্টের অংশটুকু দৃঢ়ভাবে খিঁচে আঁকড়ে ধরে। নিমিষেই তার কান্না সম্পূর্ণ থেমে যায়। কেনীথ বিষয়টা বোঝা মাত্রই গলার ভাঁজে আলতোভাবে খানিকটা চুমু খেয়ে মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। আনায়াকে দম আঁটকে বিস্মিত হয়ে বসে থাকতে দেখে, কেনীথ বিস্তৃত হেসে ফেলে। আনায়ার কপাল বরাবর কিঞ্চিৎ টোকা দিয়ে বলে,

“হয়েছে, এবার শ্বাস নে।নয়তো দম আঁ”টকে মরে যাবি।”

কেনীথের কথা শোনামাত্রই আনায়া হুঁশ ফেরে। কেনীথের বুকের বা পাশে আলতোভাবে ঘু”ষি মা’রতেই কেনীথ ব্যথাতুর স্বরে বলে উঠল,

“আহ্, এই মেয়ে দেখি ভারী বেয়া’দব। কিছু বললেও মা’রে, কিছু করলেও মা’রে।”

—“তোমার ম’রে যাওয়াই উচিত। শুধু শুধু আমার মুডের বারোটা বাজিয়ে দিলে।”

—“বারোটা নয়, এবং রাত একটা দুটো বাজে ম্যাম।”

—“ফালতু কথা বলবে না। দুনিয়াতে আর কোনো গান নেই, হুট করে এসবই কেনো…”

কেনীথ আলতো হেসে বলল,
“গান গাইতে হয় মন থেকে। যদি গানের কথায় অন্তেরর অভিব্যক্তিই প্রকাশ না পায়, তবে সে গান গেয়ে কি লাভ, শুনি?”

—“ওতো কিছু বুঝি না। আমার ভালো লাগছে না।”

—“আচ্ছা ঠিক আছে। এসব বাদ দেই। তোকে কিছু দেবার আছে আমার।”

—“আমাকে?… আরো কিছু?”

কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে।

—“চোখ বন্ধ কর।”

কেনীথ আদেশে আনায়া কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকার পর,চোখ বুঁজে নেয়।ওদিকে কেনীথ ওর পাশ থেকে উঠে আসে। পেছনে এসে হাঁটু গেঁড়ে বসে। অতঃপর প্যান্টের পকেট থেকে একটা গোল্ডের চেইন বের করে৷ যার মাঝ বরাবর ঝুলছে, গাঢ় কালচে লাল রাঙা দুটো চেরি সদৃশ চকচকে পেনডেন্ট।

কেনীথ আনায়াকে নেকলেসটা পড়িয়ে দিতেই, আনায়া চোখ খুলে নিজের গলার দিকে তাকায়। নিমিষেই কিছুটা বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,

“এটা তো…”

—“পছন্দ হয়েছে?”

আনায়া চেরি দুটো হাতে ধরে অপলকভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে,

“পছন্দ না হয়ে উপায় আছে? অসম্ভব সুন্দর এটা!”

কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে আনায়ার ঘাড়ে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে, চুলগুলো পেছনের দিকে মিলিয়ে দেয়। অতঃপর আনায়ার পাশে গিয়ে বসতেই ,আনায়া আবারও বলে উঠল,

“এটা কোথায় পেয়েছেন আপনি?”

হঠাৎ আনায়ার এহেন প্রশ্নে কেনীথ কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে খানিকটা সামলে স্থির স্বরে বলে,

“ব্ল্যাকহোল থেকে কুড়িয়ে এনেছি।”

—“এটা কি ডায়মন্ড?”

—“নাহ,তুশন্ডিয়াম সালফেট।”

আনায়া খানিকটা আগ্রহ নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,

—“এটা কেমন পদার্থ?”

—“এটা উন্নত জাতের অপদার্থ।”

কেনীথের এহেন নির্লিপ্ত কথাবার্তায় আনায়ার কপাল আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করতে থাকা চেরি দুটোর দিক হতে নজর সরিয়ে, কেনীথের দিকে পাশে ফিরে তাকায়।খানিকটা সন্দিহান কন্ঠে বলে,

“মজা করছেন আমার সাথে?”

—“তবে এটা কেনো জিজ্ঞেস করছিস যে, এটা আমি কোথায় পেয়েছি? নিশ্চয় চু’রি, ডা’কাতি করে নিয়ে আসিনি!”

কেনীথের এহেন কথায় আনায়া কপালের কুঁচকে যাওয়া ভাজ মিলিয়ে দিয়ে বলল,

“করতেও তো পারেন। আপনাকে আমার বিশ্বাস নেই।”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ আর কিছু বলল না। শুধু জোরে ভারী শ্বাস ফেলতেই আনায়া আবারও বলে উঠল,

“এক সেকেন্ড! আমার যদি ভুল না হয় তবে এটা কি রেড ডায়মন্ড? যেটা অনেক বেশি রেয়ার হয়ে থাকে। আর এমন কিছু সম্পর্কে, আমি হয়তো রাশিয়াতেও কিছু জেনে ছিলাম। আপনার মায়ের কাছে হয়তো…”

—“ঠিকই ধরেছিস। এটা এতোটাই দুষ্প্রাপ্য যে, এই পুরো বিশ্বে সবমিলিয়ে হয়তো ২০ থেকে ৩০ টি রেড ডায়মন্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মাঝে মায়ের কাছে ছিলো ৩ টি। অবশ্য এসব মা পেয়েছিল নানুর কাছ থেকে। শুনেছিলাম, নানু এসব আমার জন্মের পর মাকে খুশি হয়ে দিয়েছিল। আর পরবর্তীতে কিছুদিন আগে গিয়ে আমাদের ক্যাসেলেই এগুলো খুঁজে পেয়েছি ৷এবং দুটো দিয়ে এই নেকলেস বানিয়েছি।”

আনায়া কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল,

“আপনি কি সত্যিই এতোটা পাগল?”

—“কেনো, আবার কি করলাম।এই না বললি, এটা তোর পছন্দ হয়েছে।”

—“পছন্দ-অপছন্দের বিষয় পড়ে আসছে। আগে এটা বলুন, আপনি এমন অলক্ষুণে কাজ কোন আক্কেলে করতে গিয়েছেন?”

—“আরেহ আবার কি ভুল করলাম? তোর পছন্দ হবে ভেবেই তো এটা বানিয়েছি।”

—“একে তো এতোটা রেয়ার এই জিনিস, তার উপর আপনি এই হীরেকে এভাবে কেটে কুটে…শেষ করেছে পুরো! না জানে এই ডিজাইন করতে গিয়ে কতটুকু হীরে নষ্ট হয়েছে। বড়মায়ের জিনিসটাকেই পুরো বারোটা বাজিয়েছেন। কে বলেছিল এতো মাতব্বরি করতে? ওগুলোকে তো এমনিই রেখে দিতে পারতেন।”

কেনীথ খানিকটা বিরক্তিতে আনায়ার মাথার পেছনে টোকা দিয়ে বলে উঠল,

“সবমসময় এতো বেশি বুঝিস কেন, বলতো? এগুলোকে এমনি রেখে দিয়ে কি আমি ধুয়ে ধুয়ে পানি খাব? আর আমার মায়ের জিনিস, আমাকে দিয়ে গিয়েছে। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই, তা দিয়ে আমি আমার বউয়ের জন্য কিছু বানিয়েছি। এতে তোর এতো সমস্যা কেনো?”

—“বললেই হলো? একটু আগেই বললেন, এগুলো আপনি কিছুদিন আগে পেয়েছেন। এখন আবার বলছেন, এসব নাকি আপনার মা আপনাকে দিয়ে গিয়েছে।”

—“তোর কি মনে হয়, আমি মিথ্যে বলছি? তিনটে ডায়মন্ডের মাঝে একটা দিয়ে মা আংটি বানিয়েছিল। বাকি দুটো… ছোট থাকতে মা একবার এসব দেখিয়ে বলেছিল, আমি যখন বড় হব, আমার একটা লাল টুকটুকে বউ হবে… তখন যেন বাকি দুটো দিয়ে আমার সেই লাল টুকটুকে বউয়ের জন্য, নিজের মন মতো কিছু একটা বানিয়ে দেই।

কিন্তু এটা কে জানত, মায়ের বলা সেই লাল টুকটুকে বউ বলতে আমার কপালে একটা রেড কালারের শাঁকচুন্নি জুটবে। যে সবসময় বেশি হাই ভোল্টেজের রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, কথায় কথায় বেশি বুঝবে, আর আমার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করবে।”

কেনীথের কথা শেষ হতে না হতেই তার বাহুতে দুম করে একটা আঘাত লাগল। আনায়া পাশে চোখ রাঙিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কেনীথ খানিকটা ব্যথাতুর চোখে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আরো একটা মহৎ গুন বাদ গিয়েছে। এই রেড কালারের বউ ভারী বেদ্দপ। কথায় কথায় আমাকে মা” রতেও তার দ্বিধাবোধ হয় না।”

আনায়া কিছু বলল না। চুপচাপ কেনীথের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রইল। এদিকে কেনীথ আবারও বলল,

“আহ্ মা, শেষে কিনা তুমি তোমার একমাত্র ছেলের জন্য এমন এক শাঁকচুন্নিকে পছন্দ করে রেখে গেলে।”

—“লজ্জা করছে না এসব বলতে?”

—“লজ্জা করবে কেনো? আর এমনিতেও, তোর যখন এই নেকলেস নিয়ে এতো সমস্যা, তবে ওটা আমায় দিয়ে দে। আমি এবার নিজে একটা লাল টুকটুকে বউ খুঁজে এনে, তাকে ওটা দিয়ে দেব।”

—“একটা কেনো, দশটা আনুন। লাল, নীল, গ্রীন, ইয়োলো, পিংক, পার্পেল সহ যত রঙের শাঁকচুন্নি বউ আনতে হয়, আনুন। তবুও এ জিনিস আমার কাছ থেকে নিয়ে অন্য কাউকে দেওয়ার সহস করবেন না! এটা আমার বড় মায়ের জিনিস, আমার শ্বাশুড়ি মায়ের জিনিস… সে তার ছেলের বউ হিসেবে আমাকে পছন্দ করে গিয়েছে,আর আমি এখন তার ছেলের বউ। অতএব এসবে সবচেয়ে বেশি অধিকার আমার। আবার যদি কখনো এসব বলতে শুনেছি…ওতো কিছু জানিনা, যা আমার তা আমারই। আমি আমার জিনিস,অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করতে পারব না।”

—“বাহ্, আর আমি কেউ না?”

আকস্মিক এহেন কথায় আনায়া কিছুটা থমকে যায়। পরবর্তীতে খানিকটা ইতস্তত স্বরে বলে,

“আপনিও আ…আমার… মানে…”

—“জ্বী, আমিও আপনার। তবে আমাকে অনেক গুলো কালার ফুল শাঁকচুন্নির সাথে ভাগাভাগি করতে আপনার কোনো সমস্যা নেই, তাই তো?”

কেনীথ ভ্রু উঁচিয়ে আনায়ার দিকে তাকিয়ে। আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে। কেনীথ তা দেখে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,

—“আমার কাছে আরো দুটো পেনডেন্ট রয়েছে।”

আনায়া খানিকটা আগ্রহী স্বরে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। কেনীথ তার প্যান্টের পকেট থেকে দুটো ব্রেসলেট বের করে। একটা তার সেই চিরচেনা কালো রংএর ব্রেস্টলেট। যার আড়ালে সে লুকিয়ে রাখত সেই স্টার শেপের পেনডেন্ট। আরেকটা হলো গোল্ডের হালকা ব্রেসলেট। যার সাথেও আরেকটা স্টার শেপের পেনডেন্ট লাগান।

কেনীথ আনায়ার হাতটা এগিয়ে নিয়ে, নিজ হাতে ব্রেসলেটটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

“আমারটার মতো এটাকেও ব্রেসলেট বানিয়ে ফেলেছি। পছন্দ হয়েছে তো?”

আনায়া খানিকটা চাপা মুচকি হেসে বলে,

“হুম, অনেক।”

আনায়ার হাসিতে কেনীথও কিঞ্চিৎ হেসে ফেলে। পরবর্তীতে সে নিজের ব্রেসলেটটা পড়তে নিলে পাশ থেকে আনায়া বলে ওঠে,

“আমি পড়িয়ে দেই?”

কেনীথ আনায়ার দিকে চেয়ে খানিকটা হেসে ফেলল। অতঃপর ব্রেসলেটটা আনায়ার হাতে দিতেই, আনায়া তা কেনীথকে পড়িতে দিতে দিতে বলল,

“আগে তো দেখতাম সবসময় এটা পড়ে থাকতেন। কবে থেকে এটা পড়া বাদ দিয়েছিলেন? আমি তো এতোদিন খেয়ালই করিনি।”

কেনীথ খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,

“যখন শুনলাম, তুই আর বেঁচে নেই। তখন আমার অবস্থা পাগলপ্রায়। ধীরে ধীরে অবস্থার আরো অবনতি হতে শুরু করে। একটা সময় নেশা নিতে শুরু করি। তোকে ভুলতেই মূলত আমার এই প্রচেষ্টা। এরপর তোর স্মৃতিতে যা কিছু রেখেছিলাম, তার সবকিছু নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেই।”

আনায়ার ব্রেসলেট পড়ানো শেষ। কেনীথের কথা শুনে সে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। কেনীথ পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে, আনায়ার দিকে নিজের ব্রেসলেট পড়া মুষ্টিবদ্ধ হাত এগিয়ে দিতেই,,, আনায়াও বিস্তৃত হেসে নিজের ব্রেসলেট পড়া হাতটা মুঠো করে আলতোভাবে ছুঁইয়ে দুজনে ফিস্ট বাম্প করে। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরপরই আচমকা কিসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আনায়ার কিছুটা একটা মনে পড়তেই, সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,

“আপনার কাছ থেকে আমার একটা বিষয়ে জানার আছে।”

কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বলে,”কি?”

—“আমার যদি ভুল না হয় তবে, আমি যখন তোমার অফিসে পিএ হিসেবে জয়েন্ট করলাম…তখন তুমি আমায় সেই ঝড়ের রাতে এক্সিডেন্টের পর ঐ জঙ্গলের বাড়িটাতে নিয়ে গিয়েছিলে। আর আমাকে হয়তো র’ক্তের বাথটাবে…যদি আমার ধারনা ভুল না হয়, তবে তোমার ওসব করার কারণ কি ছিলো?”

কেনীথ শুরুতে চুপচাপ আনায়ার কথাগুলো শুনে মুখ ফিরিয়ে সমুদ্রের পানে তাকায়। ওকে এভাবে চুপচাপ থাকতে দেখে আনায়া আবারও বলল,

“কাহিনি কি? কথা বলছো না কেনো? আমি কিন্তু পরদিন বাড়ি ফেরার পর ঠিকই কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। তবে আমার জামাকাপড়ে না কোনো র’ক্তের দাগ পেয়েছিলাম আর না কোনো…জামাটাও একদম নতুন ছিল। তবে তোমার সেই ব্লাড পারফিউমের স্মেল কিন্তু আমি ঠিকই পেয়েছিলাম।”

কেনীথ নিজের বাম পাশের ভ্রু, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে বলতে লাগল,

“এই টপিকটা এই মূহুর্তে বাদ দিলে হয় না?”

—“কেনো? কেনো? বাদ দেব কেনো? আমি জানতে চাই, মূল ঘটনা কি ছিল।”

—“ঘটনা সত্যিই ছিল,আর তোর আন্দাজও।”

কেনীথের এহেন নির্বিকার কথায় আনায়া কিছুটা বিস্মিত।

—“কিন্ত আপনার এমনটা করার কারণ?”

—“সত্যি বলতে, আমি যখন বুঝতে পারলাম তুই-ই তারেক শিকদারের মেয়ে তখন না চাইতেও তোর কারণে আমার অদ্ভুত সব সিম্পটমস্ দেখা দিয়েছিল। আমি নিজেও তখন বুঝতে পারছিলাম না আমার সাথে কি হচ্ছে। তবে তোর প্রতি তখন আমার ভালো লাগার চেয়ে রা’গ, ক্ষো’ভ, ঘৃণাই বেশি কাজ করছিল। আর রাতে ঝড়ের মাঝে ড্রাইভিং এর সময় যখন দেখলাম,তুই ঐ রেহানে সাথে…জানি না, কোনো এক কারণ বশত আমার সবাইকেই মে”রে ফেলার নেশা জেগে ওঠে। আর সত্যি কথা হলো…আমি তোকে সেদিন মে’রে ফেলতেই নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে হয়তো র”ক্তের মতো তোর প্রতিও এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছিল আমার। আমি শুধু একটা দোটানায় ঝুলছিলাম। তোকে কি আদৌও মা”রব কি মা”রব না।”

কেনীথ একবারে কথাগুলো বলতেই খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। পাশে বসে থাকা আনায়াও নিশ্চুপ। দুজনের মাঝে পিনপতন নীরবতা এসে ভীড় জমালো। তবে এরইমাঝে আনায়া আবারও ধীর স্বরে বলল,

“তবে ঐ জামার বিষয়টাও ভুল নয়, তাই তো!”

—“হুম।”

আনায়া কেনীথের নির্বিকার জবাবে কিছুটা বিরক্ত হলো। আড়চোখে কেনীথের দিকে তাকাতেই কেনীথ কিঞ্চিৎ কেশে উঠল।

—“কিসে হুম? লজ্জা করল না এসব কাজকর্ম করতে? কোন আক্কেলে একটা অপরিচিত মেয়ের জামা… আহ,ছিহ্!”

আনায়ার এমন হা হুতাশ দেখে কেনীথ কপাল কুঁচকে বলল,

“তোর তো কপাল ভালো, তোকে তখন না মে”রে ঠিকঠাক বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। একবারও ভেবে দেখেছিলি, যদি তোকে ওদিন মে” রে ফেলতাম তবে কি হতো?”

—“তবে মা”রতে নিয়েও মা”রেন নি কেনো? আর ওসব কথা থাক। আপনি কেনো আমার জামা…আমার সবকিছু …. আমার ভাবতেই তো… আআআআ।”

—“ও কাজ করেছিলাম দেখেই বেঁচে আছিস।”

—“মানে?”

আনায়ার সন্দিহান প্রশ্নের জবাবে কেনীথ খানিকটা ইতস্ততভাবে বলল,

“ওসব দেখে ছিলাম বলেই তো, পরে তোকে পছন্দ হয়ে যায়।”

কেনীথের এহেন কথার অর্থ যেন আনায়ার কাছে বিস্ফো”রণের ন্যায়। বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গিয়েছে। ওর ওমন ভাবগতিকে কেনীথ হাতের তালু দিয়ে, আনায়ার চোয়াল উঁচিয়ে দিয়ে বলল,

“এতো বড় করে হা করার প্রয়োজন নেই। আশেপাশে মশা না থাকলেও সামনে সমুদ্র রয়েছে। টুপ করে একটা সার্ক এসে মুখের ভেতর ঢুকে যেতে বেশি সময় লাগবে না।”

আনায়া বিরক্তিতে কেনীথের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল,

“রাখুন আপনার আলাপ। কতটা অসভ্য আপনি, ভাবা যায়? ছিহ্, অত্যন্ত আমি আপনার ক্যারেক্টারের দিক থেকে ঠিক ভেবেছিলাম। ওহ খোদা,আমার কপালেই কেনো এমন জুটলো।”

এবার কেনীথ কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে বলল,

“ওই! ক্যারেক্টার বলতে কি বোঝাচ্ছিস তুই? আর এতে ছিঃ ছ্যাহ্-ই বা কেনো করছিস? তুই তখনও আমার বউ ছিলি, এখনও আমার বউ। তো হিসেব তো একই হলো।”

আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুই বলে না সে। অসহ্য লাগছে তার। হুট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আমি আর এখানে থাকব না, অসহ্য লাগছে। ঘুম পেয়েছে, ঘুমাতে যাব।”

কেনীথ খানিকটা নিরাশ হয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,

“আচ্ছা চল।”

এই বলেই সেও উঠে দাঁড়ায়। আনায়া আগে আগে এগিয়ে চলেছে আর কেনীথ তার পেছন পেছন। এরইমাঝে আচমকা কেনীথের কিছু একটা মনে পড়তেই সে পেছন থেকে ডাক দেয়,

“আনায়া!”

আনায়া খানিকটা চমকে পেছনে ফিরে তাকাতেই বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ায়। সে পেছনে ফিরতেই কেনীথ দ্রুত তার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। একটা চকচক করতে থাকা রিং আনায়ার দিকে তুলে ধরে বলে ওঠে,

“এটাই বাকি ছিল। যদিও এসব করার অভ্যাস আমার নেই। ভুলত্রুটি হতে পারে, কিন্তু সবকিছুর মতো মাফ করে দিস।”

আনায়া এখনো বিস্ময়ের সাথে তার দিকে তাকিয়ে। এদিকে কেনীথ অনবরত ঢোক গিকে ঠোঁট ভিজিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা সময় এভাবেই অতিবাহিত হবার পর কেনীথ আবারও এলোমেলো স্বরে বলল,

“বললাম না,মা আরেকটা রেড ডায়মন্ড দিয়ে নিজের জন্য রিং বানিয়েছিল৷ এটাই সেই রিং। যদিও আমি তার ছেলে, অথচ সে সবকিছু দিয়ে গিয়েছে তার ছেলের বউয়ের জন্য। এটা পছন্দ হয়েছে তো?”

আনায়া এবার কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আকস্মিক ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে। নিজেকে সামলাতে ঠোঁট চেপে পাশে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এদিকে আনায়াকে আচমকা কাঁদতে দেখে নিজেই হতবাক। সে দ্রুত দাঁড়িয়ে আনায়ার কাছে এসে দাঁড়ায়। একহাতে আনায়াকে আগলে নিতে গেলে, আনায়া নিজেই কেনীথকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর শুরু হয় তার অজস্র কান্নার ঝড়। কেনীথও খানিকটা শক্তভাবে আনায়াকে আগলে নিয়ে বলতে লাগল,

“আমি জানি, শুরু থেকে আমি এখন পর্যন্ত যা যা করেছি তা কোনোটাই ঠিক নয়। আমার বারবার মাফ চাওয়াটাও যৌক্তিক নয়।কিন্তু তুই না মাফ করলে আর কার কাছে মাফ চাইব আমি? তুই ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কে-ই বা আছে? এইটুকু বুঝিস না তুই?”

আনায়া আর কিছুই বলছে না। কেনীথের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদে চলেছে তো চলেছেই। কেনীথ আনায়ার বিষয়গুলো হয়তো স্পষ্ট বুঝতে পারে। সে আবারও বলে,

“আমি হয়তো জানি তুই কেনো কাঁদছিস। আমি নিজেকে যতটুকু বুঝতে পারি, তুই তার একটুও নিজেকে বুঝতে পারিস না। সবসময় তোর মাঝে দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে। তা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। আর আমি এটাও জানি, আমাদের এই নতুন পথচলা এতোটাও সহজ হবে না। আমার কথা না হয় বাদ, তুই তো বরাবরই একটা স্বাভাবিক মানুষ ছিলি। সেক্ষেত্রে তোর সবকিছু ভুলে একদম স্বাভাবিক হওয়াটা এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। আমি জানি সেটা৷ কিন্তু বিশ্বাস কর, পারব না আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে। তুই সবদিক থেকে আমায় ভঙ্গুর করে ছেড়েছিস। তোকে ছাড়া একটা মূহুর্তও আমার ভাবতে গেলেও দমবন্ধকর লাগে।”

আনায়া মুখ তুলে কেনীথের দিকে তাকায়। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলে,

“বলেছি তো যাব না। আপনার সাথেই সবসময় লেপ্টে থাকব। তবে শুধু শুধু কেনো এসব কথা বলেন? আমি ছেড়ে গেলে খুশি হবেন?”

—“মোটেও না, এবার ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করলে সোজা মে’রে উপরে পাঠিয়ে দেব। যাওয়ার হলে ওখানেই যাবি।”

নিমিষেই চারপাশের আবহ পরিবর্তন। আনায়ার কান্না থেমে গিয়েছে, একই সাথে কেনীথের ইমোশনাল গলার স্বর। কেনীথ আনায়াকে ছেড়ে দিতেই খানিকটা কঢ়া স্বরে আনায়া বলে,

“উপরেরই যখন পাঠানোর নিয়ত, তবে এতো ঢং এর কথা কেনো বলেন, শুনি? অলরেডি দুবার কাঁদিয়েছেন আমায়। অথচ আজ কিনা আমার জন্মদিন।”

কেনীথ খানিকটা থতমত খেয়ে জবাব দেয়,

“আরেহ,আমি কখন কাঁদালাম? তুই নিজেই তো…আচ্ছা ঠিক আছে, এই টপিক এখন বাদ।”

এই বলেই কেনীথ খানিকটা স্বাভাবিক হয়। আনায়া হাতটা টেনে রিংটা পরিয়ে দিয়ে বলে,

“এবার সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। একদম আমার মায়ের সেই লাল টুকটুকে ছেলের বউ। আর আমার রোড কালারের শাঁকচুন্নি।”

আনায়া গাল ফুলিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ফেলল। কেনীথ কিছুটা মুচকি হেসে হাতের দিকে ইশারা করতেই আনায়া আংটিটার দিকে তাকায়। লালচে হীরের খুব সিম্পল ডিজাইন, অথচ এটাতো আকর্ষণীয় যে… যে কারো চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। রাতের আধারেও গলার ভাঁজে ঝুলে থাকা পেনডেন্ট আর রিং…দুটোই অদ্ভুত রকমের জ্বলজ্বল করছে।”

—“আর কিছু চাই?”

কেনীথের কথার জবাবে আনায়া কিছু বলে না।বরং কেনীথের দিকে তাকিয়ে,তার মাথাটা নিচু করার জন্য ইশারা করে। কেনীথও তার মাথাটা খানিক নিচু করতেই আনায়া আলতোভাবে কেনীথের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। কেনীথ কিছুটা অবাক হলেও, নিজেকে তৎক্ষনাৎ সামলে নেয়। ওদিকে আনায়া কেনীথের চোখে চোখ রেখে বলে উঠল,

“ফুটবল টিম চাই আমার।”

কেনীথ নিমিষেই কিছুটা কপাল কুঁচকে ফেলে। খানিকটা বিস্ময়ের সাথে বলে,

“ফুটবল টিম মানে…”

—“জ্বী, যেটা ভাবছেন সেটাই৷”

এই বলেই আনায়া নিজের হাতে থাকা ফুলগুলো কেনীথকে দেখি বলল,

“দেখুন এখানে আটটা লাল গোলাপ আর তিনটা কালো গোলাপ রয়েছে। সবমিলিয়ে এগারোটা। তো আমারও আটটা ছেলে আর তিনটা মেয়ে হলেই চলবে।”

আনায়ার অভিব্যক্তিতে কেনীথ বিস্মিত। এই মেয়ের সত্যি সত্যি মাথা গিয়েছে। সে কিছু হেসে বলল,

“তোর সত্যি সত্যি লজ্জা সরম গায়েব হয়ে গিয়েছে রে আনায়াআআআ।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়ার মুখ থেকে বিস্তৃত হাসি মিলিয়ে যায়।

—“কেনো আপনার চাই না? নাকি অন্যকোনো চিন্তা… ”

—“আরেহ, বেশি বুঝিস না। তোর ক্যালকুলেশন ঠিকই আছে তবে কিছুটা চেঞ্জ করতে হবে। আমার তিনটা ছেলে আর আটটা মেয়ে লাগবে।”

—“তবে দুটো টিম বানাই। একটা আমার, একটা আপনার। সমানে সমান।”

আনায়া এসব নির্বিকার কথাবার্তায় কেনীথ পুরো হতভম্ব।

—“তুই কি হুঁশে আছিস?”

—“হয়তো, আবার না৷ আমার ঘুম পাচ্ছে কিন্তু ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না।”

কেনীথ কিছু না বলে শুধু চোখ ছোট ছোট করে আনায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর,মাথায় দু আঙুল দিয়ে খানিকটা টোকা দিয়ে আলতোভাবে মুচকি হেসে আওড়ায়,”বুদ্দু!”

পরবর্তীতে সে নিজেই বলে আবার উঠল,”আমার পায়ের উপর পা রাখ তো!”

কেনীথের কথায় আনায়া নিজের কপাল কুঁচকে ফেলে। পরবর্তীতে কেনীথের ইশারায় তার পায়ের উপর পা রেখে উঠে দাঁড়ায়। কেনীথ তৎক্ষনাৎ আনায়ার কোমড় পিঠ আঁকড়ে বলে,

“আরেকটা গান শোনাই?”

আনায়া কেনীথের গলা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। কেনীথ কিছুটা মুচকি হেসে নিজের মতো করে গাইতে শুরু করে। আর ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে হাঁটতে শুরু করে। কখনো ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে, তো কখনো প্রশান্তিতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আর এদিকে আনায়া অপলকভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে।

“found a love for me_____
Oh, darling, just dive right in and follow my lead.
Well, I found a girl, beautiful and sweet
Oh, I never knew you were the someone waitin’ for me.

‘Cause we were just kids when we fell in love, not knowin’ what it was
I will not give you up______this time____
Oh, darling, just kiss me slow,
your heart is all I own
And in your eyes, you’re holding mine

আনায়া কেনীথ ঠোঁট আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেসে আবারও গাইতে শুরু করে…

Baby, I’m dancin’ in the dark with you between my arms
Barefoot on the grass while listenin’ to our favourite song
When you said you looked a mess, I whispered underneath my breath
But you heard it, “Darling, you look perfect tonight”

দুজনেই সময়টা উপভোগ করছিল তো ঠিকই। তবে মাঝে এসে হঠাৎ আনায়া কিছু মনে পড়তেই সে বলে,

“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

কেনীথ গান থামিয়ে, নির্বিকারে জবাব দেয়,”হুম, এটা কেনো, দশটা জিজ্ঞেস কর।”

—“আমার জীবনে কখন কে এসেছিস তা তো আপনি জানেন৷ কিন্তু আপনার জীবনে কি… কেউ এসেছিল?”

কেনীথ আচমকা থেমে যায়। খানিকটা মুচকি হেসে বলে,

হুম।”

আনায়া কথাটা শুনে খানিকটা অবাক হয়৷ তবে সে কিছু বলার পূর্বেই কেনীথ আবারও বলে,

“আমার কাছে কিন্তু আরো একটা পেনডেন্ট রয়েছে।”

আনায়া কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“আরো?”

—“হুম,তোর এক্সিডেন্টের ঘটনাস্থল হতে দুটো পেয়েছিলাম। একটা তো এখন যে ব্রেসলেট পড়ে রয়েছিস সেটা। আরেকটা…আই থিংক, রেহানের দেওয়া। তুই চাইলে ওটা নিতে পারিস।”

আনায়া স্তব্ধ স্বরে জবাব দেয়,

“প্রয়োজন নেই। ওটা যেখানে রয়েছে সেখানেই রাখুন।বাই দ্য ওয়ে,আপনি কিন্তু কথা ঘুরাচ্ছেন।”

—“মানে?”

—“বললেন না তো,কে ছিলো সে?”

আনায়ার তীক্ষ্ণ কথার মানে বুঝতে পেরে, কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে বলে,

—“ছিলো কেউ একজন।”

—“তাই তো জিজ্ঞেস করছি, কে সে। দেশী না বিদেশী?”

—“জানাটা কি খুব প্রয়োজন?”

—“আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার ইচ্ছে হলে বলুন, নয়তো না। এমনিতেও আমার ঘুম..”

এই বলেই আনায়া সরে আসতে নিলে কেনীথ তার হাতের বাঁধনটা দৃঢ় করে। কোমড়ে শক্ত করে চেপে নিজের সাথে মিশিয়ে মুচকি হাসে। আনায়ার অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত। কেনীথ দূর আকাশের পানে চেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“মেয়েটা বাংলাদেশী। আমি যখন তাকে প্রথমবার দেখি…তখন শহরজুড়ে মুশলধারে বৃষ্টি ঝড়ছে। রাস্তায় কাঁদা পানি, সামনে বিশাল গাড়ির জ্যাম। আর আমি আঁটকে রয়েছি নিজের গাড়িতে। অপেক্ষা ব্যাপারটা আমার কাছে নিত্যন্তই বিরক্তিকর। বিরক্তিতে আমার মাথা ভার হয়ে এসেছে।এমন সময় চোখ ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই, আমার চাহনি আঁটকে যায় সেই মেয়েটিতে।

রাস্তার ধারের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে চলেছে। পরনে নীল-সাদা স্কুল ড্রেস। বুকের সামনে স্কুল ব্যাগ ঝুলিয়ে, দুহাতে আঁকড়ে রেখেছে। কাঁধের দুপাশে ঝোলানো দুটো লম্বা বেণী। বৃষ্টির জন্য জামার সাথে সাথে চুলগুলো অনেকটা ভিজে চুপসে রয়েছে। এরইমাঝে মেয়েটা আচমকা হোঁচট খায়। পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নেয়। অথচ এদিকে ওকে হোঁচট খেতে দেখে আমার উদ্বিগ্নতা আচমকা বেড়ে যায়। শুরু থেকেই একটিবারের জন্যও আমার নজর সরে না। ওর সবকিছু সুক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।
এরপর আবার দেখলাম, হুট করেই সে কিছুটা বিরক্ত হলো। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে যায় তার। তার সাথে সাথে আমারও। অথচ পরবর্তীতে হুট করেই আবার সে হেসে ফেলল৷ হাসির কারণ আমি বুঝলাম না, আর বুঝতেও চাইলাম না। কারণ আমার জগৎ দুনিয়া তখন থমকে গিয়েছে।

কি অদ্ভুত সেই স্নিগ্ধ হাসি! যে হাসির তালে দু’গালে স্পষ্ট দুটো ছোট বড় টোল ফুটে ওঠে। আমার চোখের পলক পড়ে না। জীবনের প্রথম কোনো মেয়েকে আমি ওতোটা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। কপালের কাছে ভিজে লেপ্টে থাকা ছোট ছোট চুল, ফর্সা ত্বকে পানির ছোট ছোট বিন্দু…কি চমৎকার সে দৃশ্য! কি প্রাণবন্ত, হাস্যজ্জল সেই মেয়ে! আজও সে স্মৃতি মনে পড়লে, অজান্তেই হৃদয় কাঁপে আমার।

সেদিন অবশ্য মনে মনে বিড়বিড় করে আওড়িয়েও ছিলাম,’মা, দেখো! আমি হয়তো তোমার ছেলের বউকে খুঁজে পেয়েছি।’ আবার হুঁশ ফিরতেই, নিজেই নিজের এমন ভাবনায় হেসেছি। এই পুঁচকে মেয়ে কিনা আমার বউ হবে। ব্যপারটা নিত্যন্তই হাস্যকর।

আহ্! বয়স আর কতই হবে, ক্লাস নাইন-টেনে পড়ে হয়তো। অথচ সেই পুঁচকে মেয়েই আমার পুরো দুনিয়া থমকে দিয়েছিল। ভাবা যায় এসব?”

কেনীথ বলতে বলতেই যেন সেই পুরোনো স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়েছে। ঠোঁটের কোণায় তার অদ্ভুত প্রশান্তিময় বিস্তৃত হাসি। এদিকে আনায়া তার দিকে বিস্ময়ের সাথে তাকিয়ে।

—“ক্লাস নাইনে-টেনে পড়া একটা মেয়ে? এতো ছোট?…আর আপনি কিনা…”

খানিকটা আবারও কিছুটা মুচকি হেসে নির্বিকারে বলে,

“কি আর করার বল,তখন আমার নিজের যৌবনের আগুনই টগবগিয়ে ফুটছে। আর ঐ সময়, হুট করে মেয়েটাও চোখে পরে… ওতো কিছু কি আর খেয়াল থাকে৷”

—“তাই বলে…কতবছর আগের ঘটনা এটা?”

—“বহু বছর তো হলো। আমি তখন সবেমাত্র দেশে এসে থাকতে শুরু করেছি। ক্যারিয়ারও সেভাবে গোছানো হয়নি।”

আনায়া আড়ালে খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। পরবর্তীতে আবারও বলল,

“তারপর কি হলো? এখনো কি তাকে…”

কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা মুচকি হাসে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

—“তারপর আর কি! মেয়েটা তার গন্তব্যে আর আমি আমার। সে-সময়ের জন্য হারিয়ে ফেললাম তাকে। কিন্তু বিশ্বাস কর, ওর যে লুকটা ছিল…পুরো খেয়ে ফেলার মতো। ফোলা ফোলা গাল দুটো…উফ! পুরো স্ট্রবেরি… নাহ্,একদম টকটকে রসালো চেরির মতো। আজও মনে পড়লে…টুপ করে কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

কেনীথের এহেন অভিব্যক্তিতে আনায়া সম্পূর্ণ বিস্মিত। সে যেন বিস্ময়ের ঘোর থেকে বেড়োতেই পারছে না। তার বিস্ময়ে ঘেরা চোখ জোড়ার তীক্ষ্ণ চাহনি কেনীথের দিকে নিক্ষিপ্ত। এদিকে কেনীথ ধ্যান ভিন্ন দিকে।

এভাবে কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আনায়া কেনীথের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কেনীথ হুঁশ ফিরে ওকে আটকাতে চাইলে, আনায়া সজোড়ে হাতের ঝাপটায় কেনীথকে বাঁধা দেয়। একমুহূর্তও দেরি না করে রিসোর্টে দিকে এগিয়ে যেতে লাগে।এদিকে কেনীথ পেছন থেকে বলে ওঠে,

“কিরে, আবার কি হলো? একা একা কোথায় যাচ্ছিস তুই!”

আনায়া প্রথমে কোনো জবাব দেয় না।কেনীথ তার পেছন পেছন এগিয়ে যেতে যেতে আবারও যখন জিজ্ঞেস করে,তখন আনায়া মুখটা কোনোমতে পেছন ফিরিয়ে ক্ষি”প্ত স্বরে ফুঁসে বলে ওঠে,

“কারো জীবনে নানান সময়ে, ভালোবাসা আসতেই পারে। কাউকে পছন্দ হতেই পারে।সকলরেই কম বেশি অতীত থেকেই থাকে। তাই বলে, আজকের দিনে এসে… যখন আমি আপনার বউ তখন আপনি কিভাবে…কিভাবে এসব জঘ’ন্য কথাবার্তা বলতে পারেন?

এমন নয় যে আমার জীবনে এমন কোনো ঘটনা নেই৷ আমিও কাউকে ভালোবেসেছি। আপনি তাকে একবার দেখেই…আজ এসব কথা বলছেন। এদিকে আমি যাকে এতো বছর ভালো বাসলাম, তাকেই ফেলে রেখে শেষমেশ সবকিছু ভুলে, আপনার কাছে এসেছি কি এসব শোনার জন্য? ছিহ্, কতটা জ’ঘন্য আপনি! কতটা জঘ”ন্য আপনার চ”রিত্র। থাকুন, আপনি আপনার ওই পুঁচকে ফুঁচকে টিকটিকিকে নিয়ে।আমি চললাম।”

আনায়া হিসহিসিয়ে কথাটুকু বলতেই আবারও নিজের মতো হাঁটা শুরু করল। এদিকে কেনীথ হাসতে গিয়েও হাসতে পারছেনা। কোনোমতে হেসে আওড়াল,

“টিকটিক? সিরিয়াসলি?”

কেনীথ আনায়ার পেছনে পেছনে আরো দ্রুত এগিয়ে যায়।

—“আনায়া,আগে আমার পুরো কথা শুন, প্লিজ।”

আনায়া কোনো জবাব দেয় না। সে তার মতো করে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে কেনীথ আরো কয়েকবার ডাকলেও সে সাড়া দেয় না।

—“আনায়া, দাঁড়া। আগে আমার কথা শুনে যা।”

—“পারব না আমি আপনার কোনো কথা শুনতে।”

—“তারা, মাই ব্লাড।”

—“করব না আমি, আপমার সংসার।”

—“এই নাহ! আমাদের এখনো ফুটবল টিম বানানো বাকি। চল!চল! বাড়ি চল!”

কেনীথ একপ্রকার ছুটে গিয়ে আনায়াকে কাঁধে তুলে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে। তারাহুরোয় সে নিজেও ভুলে গিয়েছে সে কোথায় যাচ্ছে। এদিকে আনায়া ছাড়া পাওয়ার জন্য কেনীথ পিঠে আর কাঁধে ইচ্ছেমতো কিল-ঘুষি দিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় প্রচন্ড আ”ক্রোশে জোরে কেনীথের গায়ে ধাক্কা দিতেই, কেনীথ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে আনায়াকে নিয়ে সোজা নিচে পড়ে যায়। বালির মাঝে মাখামাখি হয়ে দুজনের বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এমন অবস্থায় আনায়া আবারও জেদ দেখিয়ে সরে আসতে নিলে কেনীথ আনায়ার হাত চেপে ধরে। ওমনি আনায়া একমুঠো বালি খামচে তুলে নিয়ে সরাসরি কেনীথের মুখে ছুঁড়ে মা’রে। আচমকা যে আনায়া এমন কিছু করবে…তার জন্য কেনীথ নিজেও প্রস্তুত ছিল না। মেজাজ খারাপ হলো তার৷ চোখেমুখে বালি ঢুকে গিয়েছে। ঠিকমতো চোখ মেলেও তাকাতে পারছে না।

এদিকে এবার যেন আনায়ার কিছুটা হুঁশ ফিরে এলো। চলে না গিয়ে, কেনীথের কাছে ফিরে এলো। হুট করে যে সে এমন কিছু করবে, তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। আনায়া কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে কেনীথের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলে, কেনীথ চোখ কচলাতে কচলাতে কোনোমতে বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,

“ফিরে এলি কেনো? চলে যা। তোর কোনো আলগা দরদের প্রয়োজন নেই আমার৷ একটা কথাও শুনিস না আমার।”

আনায়ার যেন এখন নিত্যন্তই তীব্র অনুশোচনা হচ্ছে। কেনীথের সামনাসামনি বসে কেনীথের দিকে হাত এগিয়ে দিলে, কেনীথ হাত সরিয়ে দেয়। আনায়া কিছুটা ঠোঁট উল্টে অসহায়ের মতো করে বলে,

—“এমন করছেন কেনো? আমি তো আর ইচ্ছে করে এমন কিছু করতে চাইনি… হয়ে গিয়েছে আরকি। দেখতে দিন না,প্লিজ…আমি ঝেড়ে দিচ্ছি।”

কেনীথ আর এবার বাঁধা দেয় না। আনায়া একহাতে কেনীথের মাথা আঁকড়ে ধরে। অন্যহাতে স্বযত্নে চোখের আশেপাশের বালিগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে। কখনো আলতোভাবে ভাবে ফুঁ দেয়, তো কখনো পরিষ্কারের সুবিধার্থে শাড়ির আঁচল ব্যবহার করে।

মোটামুটি বালি গুলো পরিষ্কার হয়ে গেলে, কেনীথ ঠিকঠাক চোখ মিলিয়ে তাকায়। ওমনি আনায়া বলে ওঠে,

“এমন কাজ করার জন্য সরি কিন্তু আপনি যা করেছেন তাও কিন্তু ঠিক না।”

কেনীথ খানিকটা কঢ়া স্বরে বলল,

“কোনটা ঠিক না? সবসময় বেশি বেশি বুঝবি তুই আর পরে বলবি সরি?”

কেনীথের ঝাঁঝালো স্বরে আনায়া নিজেও আবার তেজ দেখিয়ে বলল,

“সরি বলেছি মানে এই না যে, আমি আপনাকে নিজের তেজ দেখাতে বলেছি। আমি কিন্তু আপনার সংসার করব না, তা একবার বলে দিয়েছি। মানুষ কতটা নিন্ম মন-মানসিকতার অধিকারী হলে ওমনসব কথা বলে। অসভ্য একটা। এমন বজ্জাত লোকের সাথে তো আমি কোনোকালেই সংসার করব না। প্রশ্নই ওঠে না।”

—“দেব এক কানের নিচে। ওটা তুই-ই ছিলি গাধী।”

আনায়া খানিকটা থমকায়৷ চোখ পিটপিট করে বলে,

“আমি ছিলাম মানে? এখন কথা ঘুরাচ্ছেন? আপনি, বললেন আর আমি বিশ্বাস করব?”

—“আহ্ তারা, আমি মিথ্যে কেনো বলতে যাব? ওটা যে তুই-ই ছিলি, তা তো আমি তখন জানতামই না৷ পরবর্তীতে গিয়ে না বুঝিছি যে, ওটাই আমার রেড কালারের শাঁকচুন্নি বউ।”

আনায়া কেনীথের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। কেনীথ আবারও বলে,

“একটু খেয়াল করে দেখ, আমি বলেছিলাম কিন্তু ঐ মেয়েটা হাসলে গালে ছোট বড় দুটো টোল পড়ত। আর তোরও কিন্তু এমনটা হয়। তো…এবার তুই-ই ভেবে দেখ, আমি সত্যি না মিথ্যে বলছি।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া ভাবতে বসে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে, যেন নিজের ভুল বুঝতে পারে।

—“এসব কি সত্যিই?”

—“তা নয়তো কি!”

—“আচ্ছা সরি,আমার আপনার পুরো কথা শোনা উচিত ছিলো। কিন্তু আপনিই তো ইচ্ছে করে…আচ্ছা, তবুও সরি।”

এদিকে কেনীথ আচমকা অদ্ভুত ভাবে হেসে ফেলল। খানিকটা নিরেট স্বরে শয়তানি তীর্যক হেসে বলল,

“কিসের সরি, ব্লাড! আমায় বালি খাইয়েছো, এখন তুমি পানি খাও।”

এই বলতে না বলতেই কেনীথ আকস্মিক আনায়ার ঘাড় চেপে… অতঃপর সোজা পাশেই সমুদ্রের পানির মাঝে আনায়ার মুখ চেপে ধরে। দুজনে এতোক্ষণ সমুদ্রের ধারেই ছিল।
আকস্মিক এ ঘটনায় আনায়া সম্পূর্ণ হতভম্ব। পানিতে মুখ ডুবিয়ে তার অবস্থার বেহাল। কিছুক্ষণ একটানা কেনীথ আনায়ার সাথে এই কাজ করার পর, ঘাড় ধরে উঠে বসায়। আনায়ার চোখমুখ ছানাবড়া, জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। অথচ কেনীথ আনায়াকে ছেড়ে দিয়ে মিনমিন করে মুচকি হাসছে। যা দেখমাত্রই আনায়ার রাগ বেড়ে যায়। সে কোনোমতে নিজেকে স্বাভাবিক করে কেনীথের বুকে সজোড়ে দুহাতে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। কেনীথ চিত হয়ে পানিতে পড়তেই, আনায়া দুহাতে বালি তুলে ওর মুখের উপর ছুঁড়ে মারতে নিলে…কেনীথ তৎক্ষনাৎ আনায়ার পা ধরে হেঁচকা টান দেয়।নিমিষেই আনায়া উল্টে পানি আর বালি… দুটোর মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে। তা দেখে কেনীথ পাশ থেকে খিলখিল করে হাসতে লাগলে, আনায়া কোনো মতে উঠে বসে কেনীথের চুল টেনে ধরে। কেনীথও উল্টো আনায়ার চুল টেনে ধরে।

—“ছাড় আমায়!”

—“আপনি ছাড়ুন, আমায়!”

—“তুই আগে আমার চুল ছেড়ে দে।”

দু’জন শুধু এসব বলেই যায়। অথচ কেউই কারো চুল ছাড়ে না। এভাবে দুজনের চুলোচুলির সময় আরো দীর্ঘ হয়। কেউ কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। পানি বালি..জামা-কাপড়, গা সহ সর্বত্র লেগে গিয়েছে। চুলোচুলিতে পারলে নিজেদের অর্ধেক চুলও ছিঁড়ে ফেলেছে। প্রায় এভাবে আরো খানিকটা সময় অতিবাহিত হবার পর, কেনীথ কোনোমতে আনায়ার কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। আর তৎক্ষনাৎ সেখান থেকে ছুঁটে দৌড়াতে শুরু করে। কেননা ততক্ষণে আনায়া নিজেও উঠে গিয়ে তার পেছনে তেড়েমেড়ে ধাওয়া করেছে। দুহাতের মুঠো ভর্তি বালি। চোখমুখে স্পষ্ট ক্ষো”ভের ছাপ।

—“দাঁড়ান বলছি! আজ আপনাকে শেষ করে ফেলব আমি।”

কেনীথ দাঁড়ায় না। বরং সে তার মতো ছুটে চলেছে। এক নিশুতি রাতে, বিস্তৃত চাঁদের আলোয় দু’টো পাগলাটে প্রেমিক প্রেমিকা সমুদ্রের পারে অদ্ভুত পাগলামি সব পাগলামি করে চলেছে। চারপাশে দমকা হাওয়া বইছে, আর তার মাঝেই ছুটছে কেনীথ আর আনায়া।তাদের জামা কিংবা চুল…সবই তাদের দৌড়ের বেগে উড়ছে।

দু’জনের দূরত্বটা যথেষ্ট বড়। কেননা, কেনীথের সাথে আনায়া যে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতো সহজে হার মানার পাত্রী আনায়াও নয়। তবে তার চোখেমুখে ক্ষি”প্ত”তা রইলেও, কেনীথের কাছে বিষয়টা যেন বেশ উপভোগ্য। সে ছুটতে ছুটতে আকাশের বিস্তৃত চাঁদের পানে তাকিয়ে জোর স্বরে বলতে লাগল,

“মা!!! দেখো, দেখো, তোমার পছন্দ করে রেখে যাওয়া, ছেলের বউয়ের অবস্থা দেখো। তোমার নিষ্পাপ অবলা ছেলেটাকে একা পেয়ে কি হাল বানিয়ে ছেড়েছে। এই রেড কালারের শাঁকচুন্নি চয়েজ না করে,সেদিন একটা লাল টুকটুকে বউ চয়েজ করলে কি, আজ তোমাকে এই দিন দেখতে হতো? বড্ড ভুল করেছো মা। তোমার এমনটা করা মোটেও উচিত হয়নি।”

এদিকে কেনীথের সব কথাই আনায়া স্পষ্ট শুনতে পায়। সে রেগে গিয়ে আরো তী”ব্র স্বরে বলে ওঠে,

“আসলেই ঠিক হয়নি। তোমার মতো একটা অপদার্থকে দুনিয়াতে রেখে যাওয়া মোটেও উচিত হয়নি। আবার বলছে আমাকেই…সাহস থাকলে দাঁড়াও। আমি এখনই তোমার ভ’ণ্ডামি ছাড়াচ্ছি।”

—“ও মা! দেখো! দেখো! এই মেয়ে তোমার ছেলেকে মা”রার হুমকি দিচ্ছে। এই রেড কালারের শাঁকচুন্নি কত্ত ডে”ঞ্জারাস, ভাবতে পারছো?”

দুজনে দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে উঠেছে। তবুও কারো থামবার নাম নেই। ওদিকে কেনীথের উল্লাসও যেন ফুরচ্ছে না।

—“হ্যাঁ, বড় মা। দেখো একবার তুমি। কতবড় অপদার্থ একটা! বউকে কি কেউ চুল ধ”রে মারে? আর শুধু চুল ধরে কেনো…তোমার এই অপদার্থ ছেলে তো আমায় যখন তখন মা”রে। বউয়ের প্রতি একটুও মায়া দয়া নেই।”

এই কথা কানে আসা মাত্রই কেনীথ অকস্মা থেমে যায়।পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠল,

“এক সেকেন্ড, এটা কি বললি তুই?চুলোচুলি তো প্রথমে তুই শুরু করলি,আমি কখন…আর আমি তোকে যখন তখন মা’রি? এতোবড় মিথ্যে তুই কিভাবে বললি, আনায়া? আমি তোকে আদর করি না?”

কেনীথের সাথে সাথে আনায়াও থেমে গিয়েছে। কিন্তু দুজনের মাঝে দূরত্বটা যথেষ্ট। আনায়ার প্রশ্নে কেনীথ বলে,

“মিথ্যে কখন বললাম। যা বলেছি সত্যিই বলেছি। আর আপনি আমাকে আদর তো দূরে থাক, সবসময় ঝগড়াটে মহিলাদের মতো পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করেন।”

—“ওরেহ্! তাই নাকি! চল তবে, আজ এখানেই দেখাচ্ছি, আমার আদর কত প্রকার ও কি কি।”

এতোক্ষণ আনায়া কেনীথের পেছনে ছুটছিলো, আর এখন কেনীথ আনায়ার দিকে উল্টো তেড়ে আসছে। আনায়া কোনমতে নিজেকে সামলে হাতের বালিগুলো ফেলে দিয়ে উল্টো ছুটতে লাগল।

—“এই নাহ! আমি তা বলিনি। শোনো, শোনো, আআআআআআআআ…”

আনায়া দৌড়াতে দৌড়াতেই ধপাস করে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে যায়। আনায়া কোনোমতে উল্টে ঠিকঠাক হয়ে বসতে নিলেই দেখে, প্রায় তার কাছে চলে এসেছে। সে তৎক্ষনাৎ দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে, চোখ খিঁচে নিয়ে আধশোয়া অবস্থাতেই বলে উঠল,

“প্লিজ, এখানে উল্টোপাল্টা কিছু করো না। আমি কিন্তু… ”

আনায়ার কথা অসমাপ্তই রয়ে যায়। তার পূর্বেই সে অনুভব করে আশেপাশে কারো কোনো সাড়া শব্দ নেই। আচমকাই চোখ বুঁজে সে বোঝার চেষ্টা করে, কেনীথ কি চলে গিয়েছে নাকি! নয়তো কোথায় রয়েছে?

সে আলগোছে মুখ থেকে দুহাত সরিয়ে, যেই না তাকিয়েছে, ওমনই তার কপাল বরাবর কেনীথ টোকা দিয়ে বলল,

“উঠে যা বুদ্দু!”

আনায়া তাকিয়ে দেখে কেনীথ তার পাশে এক হাঁটু গেঁড়ে বসে রয়েছে। চোখে মুখে বিস্তৃত মুচকি। এতোক্ষণ ছোটাছুটি করে দুজনের চুলের অবস্থাই এখন পাখির বাসার মতো। দেখতেও দুজনকে অদ্ভুত লাগছে।

কেনীথ আনায়ার উঠে বসার জন্য হাত এগিয়ে দেয়। আনায়া তার সাহায্য উঠে বসতেই কেনীথ বলে,

“তুই কি খেয়াল করেছিস, তুই আমাকে কখনো তুমি, তো কখনো আপনি বলছিস?”

আনায়া কেনীথের কথায় চোখ পিটপিট করে তাকায়। তবে কিছু বলে না।

কেনীথ নিজেই আনায়ার মাথার চুলগুলো একহাতে এলোমেলো করে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

“এভাবেই ঠিক আছে। শুনতে ভালো লাগে।”

এরপর আর কিছু না বলে, আনায়াকে টেনে সে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। নিজের শার্ট,প্যান্ট খানিকটা ঝেড়ে দিয়ে বালিগুলো সরানোর চেষ্টা করে। আনায়াও তাই করে। এরপর দুজন মিল রিসোর্টের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। কেনীথের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে আনায়া হেঁটে চলেছে। তবে কিছুটা সময় যাওয়ার পর, আচমকা আনায়া নিজের গা দিয়ে, কেনীথের বাহুতে দু’বার ঘষা দিতেই কেনীথ পাশে ফিরে তাকায়৷ কপাল কুঁচকে চোখের ইশারায় বোঝায়, আনায়া কি চাইছে?

তৎক্ষনাৎ আনায়া বলে উঠল,

“আমার না পায়ে কাটা বিঁ”ধেছিল।”

—“হুম, তো?”

–“তো, মানে? এভাবে খালি পায়ে হাঁটলে না আমার পায়ে ইনফেকশন হবে?”

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল। তবে নিজের চাপা হাসিকে দমিয়ে রেখে খানিকটা গম্ভীর্যের সাথে বলল,

“ভালো হবে তো। আমি খুশি হব।”

এ কথা শুনে আনায়ার চোখ মুখ কুঁচকে যায়। কেনীথের সঙ্গ ছেড়ে নিজে নিজেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কেনীথ পেছন থেকে কিছুটা মুচকি হেসে, ছুটে আনায়ার সামনে গিয়ে উল্টো ভাবেই বসে পড়ে। অতঃপর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আনায়ার উদ্দেশ্য বলে,

” উঠে পড়েন, আমার মহারানী।”

কেনীথের এহেন কান্ডে আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে ফেলল। এক মূহুর্তও দেরি বা করে কেনীথের পিঠে চড়ে যায়। দুহাত কেনীথের কাঁধে পাশে ঝুলিয়ে, শক্ত ভাবে গলা জড়িয়ে ধরে।এবং তৎক্ষনাৎ কেনীথ উঠে দাঁড়িয়ে, আনায়াকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। একই সাথে বিস্তৃত হেসে বলে,

“আপনার পায়ে ইনফেকশন হলে, দুদিন বাদে আপনার পা কেটে ফেলে দিতে হবে। তারপর সারাজীবন আমাকে, এই ছোট্ট একটা কারণে, আপনাকে এভাবেই পিঠে বয়ে নিয়ে চলতে হবে। এরচেয়ে ভালো, আজই আপনার খেদমত করে দেই।”

কেনীথের কথা শুনে পেছন থেকে আনায়াও কিছুটা হেসে ফেলল। তবুও সে হাসি লুকিয়ে, খানিকটা সন্দিহান স্বরে বলে উঠল,

“তারমানে আমি যখন বুড়ি হয়ে যাব, হাঁটতে পারব না। তখন আপনি আমাকে ফেলে রেখে চলে যাবেন?”

যদিও আনায়ার প্রশ্নটা মজার ছলে বলা, যা কেনীথও স্পষ্ট বুঝতে পারে। কিন্তু সে নিজেও খানিকটা সিরিয়াস হয়ে বলে ওঠে,

“আরেহ, কার সাথে কি? এ কথা আমি কখন বললাম? আমি তো…”

—“হুম, হুম, বলুন বলুন। তখন কি করবেন?”

—“হ্যাঁ,হ্যাঁ,আমি তখনও আপনাকে এভাবে বয়ে নিয়ে বেড়াব। আমি দুনিয়াতে এসেছিই তো আপনার দাসগিরি করতে। আপনি আমার মহারানী বলে কথা।”

কেনীথের কথায় আনায়া খিলখিল করে হেসে উঠল। তৎক্ষনাৎ কেনীথ বিস্তৃত হেসে আবারও বলল,

“শুধু মহারানী নয়, মাই ডিম্পল কুইন, মাই ব্লাড…রেড কালারের শাঁকচুন্নি, এভরিথিং, এভরিথিং, এভরিথিং…আমার সবকিছুই তুই।”

চলবে_____________________