একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪১(১ম অংশ)

0
12

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব—৪১(১ম অংশ) সারপ্রাইজ পার্ট

প্রায় দুমাস পর রাশিয়া থেকে দেশে আসার সুযোগ হয়েছে কেনীথ-আনায়ার। মালদ্বীপ থেকে তারা সরাসরি রাশিয়ায় চলে যায়। এরপর ধীরে ধীরে অগোছালো সব কাজগুলো সামলে নিয়েই, আবার দুজন বাংলাদেশে ফিরে আসে। নাহ্, ইনায়া কিংবা অন্যকেউ তাদের সাথে আসেনি। কিছুদিন পূর্বে রোজ কনভেন্ট থেকে ফিরে এলে, ইনায়াকে তার দায়িত্বেই রেখে দুজন চলে আসে।এছাড়া বাকি সবকিছুর দেখভালের জন্য তো সেইখানে পাভেলও রয়েছে।

তারা দুজন আপাতত তাদের এ্যাপার্টমেন্টেই থাকছে। কেনীথ সোফায় বসে কেনেল আর ক্লারার সাথে টাইমপাস করছে। এতো সব ঝামেলার জন্য, এই দু’জন থেকেই দূরে সরে গিয়েছে। অথচ একসময় তার বাঁচার সঙ্গীই ছিলো এই দুটো কুকুর।

কেনীথের পরনে কালো রংএর টিশার্ট আর প্যান্ট। বড় বড় চুলগুলো খানিক ভেজা। একটু আগেই গোসল সেরেছে। এদিকে আনায়ার তেমন খবর নেই। কেনীথ কিছুদিন হলো খেয়াল করছে, আনায়া একটু অদ্ভুত আচরণ করছে। যদিও সেসব নিয়ে সে তেমন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু আনায়ার কারনে অকারণে তার থেকে দূরে সরে থাকার কারণটা ঠিক বোধগম্য নয়।

যদিও বা কেনীথ কেনেল আর ক্লারার সাথে খেলা করছে। তবে তার চোখ বারবার খুঁজছে আনায়াকেই। সেই কতক্ষণ হলো গোসলে গিয়েছে, অথচ এখনোও তার ফিরে আসার কোনো নাম নেই। এই নিয়ে কেনীথ খানিকটা বিরক্তও বটে।

এরইমাঝে আচমকা ড্রইংরুমে আনায়ার আগমন ঘটে। চোখেমুখে শূন্যতা। একদম চুপচাপ কেনীথের কাছে এসে সামনাসামনি হয়ে দাঁড়ায়।কেনীথ আনায়াকে লক্ষ করলেও সেভাবে ফিরে তাকায় না। একবার মাথা উঁচিয়ে আনায়াকে দেখে, পুনোরায় কেনেল আর ক্লারা দিকে নজর দেয়। এদিকে আনায়ার কোনো নড়চড় নেই। সে চুপটি করে কেনীথের সামনে দাঁড়িয়ে। অবশ্য তার একহাত খানিকটা পেছনে। হয়তো কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।

কেনীথ সব দেখেও না দেখার ভাণ করল।ওদিকে কেনীথ কিছু বলছেনা আবার তাকে পাত্তাও দিচ্ছে না দেখে, আনায়াও খানিকটা বিরক্ত হলো। কিছুটা অসহায়ত্বের স্বরে বলে উঠল,

“এই যে শুনছেন?”

কেনীথ আনায়ার দিকে না তাকিয়েই বলে,

“হুম, বল!”

এটা দেখে আনায়া যেন আরো অসহায়ের ন্যায় ভেঙে পড়ল। তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। প্রচন্ড অস্থির; বিরক্তিকর লাগছে তার সবকিছু। গত কয়েক দিন হতে প্রায় বমি হচ্ছে। আজ সে বমির কারণও তার কাছে স্পষ্ট। কিন্তু কিছুদিন হতে সে দূরে দূরে থাকছে বলে, কেনীথেরও এমন খামখেয়ালী হয়ে যাওয়াটা তার মোটেও পছন্দ নয়। আনায়া খানিক তীব্র ভাঙা স্বরে বলল,

“আপনি এমন করছেন কেনো?”

আনায়ার কন্ঠস্বরে কেনীথ খানিকটা চমকে ওঠে। কপাল কুঁচকে মাথা উঁচিয়ে, আনায়ার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ ঠিকভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এবার তার চোখ আনায়াতে আঁটকে যায়। মুখ জুড়ে অদ্ভুত স্নিগ্ধতা বিদ্যমান। মাথার চুলগুলো ভিজে; টুপটুপ করে পানি ঝড়ছে। পরনে পাতলা সাদা রঙের গাউন। বেখেয়ালি আনায়ার জন্য, তা খানিকটা চুলে পানিতে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে রয়েছে। চোখমুখে অপার্থিব মাধুর্যতা। গায়ের সাথে লেগে থাকা পানির সুক্ষ্ম বিন্দুকণা এখনো দৃশ্যমান। কেনীথ সবমিলিয়ে কিঞ্চিৎ ঢোক গেলে। তবে নিজেকে যথারীতি সামলে নিয়ে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“কি করেছি?”

আকস্মিক আনায়ার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। সে ঠোঁট চেপে ধরে; নাকের পাটা ফুলে যায়।বিস্ময়ে কেনীথের কপাল আরো খানিকটা কুঁচকে যায়। আনায়া কেনীথের দিকে আরো দু’পা এগিয়ে আসে। ক্রন্দনরত ভাঙা স্বরে জবাব দেয়,

“ভালো লাগছে না আমার৷”

কেনীথের কুঁচকে থাকা কপালে ভাজ এবার খানিকটা মিলিয়ে যায়। হাতের ইশারায় নিজের আশেপাশে আর কোল থেকে, কেনেল ক্লারাকে নামিয়ে দেয়। আনায়ার ডান হাত আলতোভাবে টেনে, নিজের উরুতে বসিয়ে দেয়। আনায়া মাথা নুইয়ে চুপচাপ বসে থাকে। তার বাম হাতটা এখনো মুষ্টিবদ্ধ। কেনীথ একহাতে আনায়ার কোমড় পেঁচিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। অন্যহাতে আনায়ার কপালের চুলগুলো আলগোছে ঠিক করে দিয়ে, গলার ভাঁজে হাত রেখে অস্পষ্ট সুরে বলতে লাগল,

“কি হয়েছে, বল আমাকে! কিছুদিন ধরেই দেখছি তুই অদ্ভুত সব আচরণ…”

কেনীথের কথা অসম্পূর্ণই রইল। তার নজর থমকে গিয়েছে আনায়ার বাম হাতের দিকে। তার কপাল খানিকটা কুঁচকে যায়। কেনীথ আনায়ার দিকে একবার তাকিয়ে, পরবর্তীতে আনায়ার বাম হাতটা টেনে নিয়ে বলে,

“কি লুকাচ্ছিস? দেখাবি না আমায়?”

আনায়া কিছু বলে না। শুধু কেনীথের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে। তার অকস্মাৎ এমন কান্না কেনো আসছে, তা তার বোধগম্য নয়। এদিকে কেনীথ আনায়ার হাতের মুঠো খুলতেই, বিস্ময়ে তার মুখ আকস্মিক খানিকটা খুলে যায়। আনায়ার হাত থেকে প্রেগন্যান্সির কিটটা নিয়ে, বিস্ময়ে ঘেরা চোখে তাকিয়ে থাকে। কেনীথের শ্বাস প্রশ্বাসের বেগ ধীর হয়ে এসেছে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।

কেনীথ আনায়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। আনায়া চুপচাপ ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তৎক্ষনাৎ সে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

“এ…এসব কি সত্যি?”

আনায়া কিছু বলে না। বরং তার চাপা কান্নার বেগ যেন আরো বেড়ে যায়।কেনীথ আবারও বলে,

“আমার সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে।”

কেনীথ জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। প্রেগ্ন্যাসির কিটে স্পষ্ট ফুটে থাকা, একজোড়া লাল দাগের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। এমন সময় সে আবারও আনায়ার দিকে তাকায়। আনায়ার চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে।
—“হেই ব্লাড! কাঁদছিস কেনো?”

আনায়া কোনো উত্তর দেয় না। কেনীথ কিটটা পাশে রেখে আনায়াকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে। গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে অসহায়ত্বের সুরে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,

“সরি বউ! প্লিজ, ক্ষমা করে দে। আমার তোকে বোঝা উচিত ছিল। এই কারণেই হয়তো তুই…অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি,সরি।”

আনায়া আলতোভাবে গলার ভাঁজে চুমু একে দিয়ে, মুখ তুলে আনায়ার দিকে তাকায়। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে ওঠে,

“এইজন্যই গত কিছুদিন ধরে বমি করছিলি?”

আনায়া আলতোভাবে মাথা নাড়ে। কেনীথ আবারও বলে,

“কবে থেকে হচ্ছে এসব।আমাকে কিছু বলিসনি কেনো?”

আনায়া ভাঙা স্বরে জবাব দেয়,

“আপনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এদিকে আমি ছিলাম কিছুটা কনফিউজড। একবার মনে হচ্ছিল আমার ধারনা ভুল, পরবর্তী…। আবার প্রথমবার যখন প্রেগন্যান্ট হলাম। তখনকার ঘটনা সত্যিকার অর্থে, আমার ঠিক মনেই নেই…।এই জন্য বুঝতে পারছিলাম না…”

কেনীথ আনায়ার কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

“সরি, আ’ম রিয়েলি সো সরি। আমি তোকে বোঝার চেষ্টা না করে উল্টো আরো নিজেই দূরে সরে আসতে চেয়েছি। ভেবেছি তুই যখন আমার সাথে হয়তো ক”ম্ফোর্টেবল ফিল করছিস না।তাই তোকে কিছুদিনের জন্য একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো।… আ’ম রিয়েলি সো সরি। আমি একটুও বুঝতে পারিনি।”

আনায়া কিছু না বলে সোজা ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেলে। কেনীথ এতে অনেকটাই উ’দ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আনায়াকে সোফায় বসিয়ে নিজে ফ্লোরে হাঁটু গেঁড়ে বসে। আনায়ার হাত দুটো মুঠো করে উদ্বিগ্নতার সাথে বলে,

“তারা মাই ব্লাড! কাঁদছিস কেনো? তুই কি চাস না আমাদের সন্তান দুনিয়ায় আসুক? যদি কোনো সমস্যা থাকে তবে নির্দ্বিধায় বলে ফেল। তুই না চাইলে আমিও চাই না… ”

কেনীথের কথা শেষ হবার পূর্বেই আনায়া আবারও বলে উঠল,

“নাহ, আমি এমন কিছু চাইছি না। শুধু কেনো জানি… ”

আনায়ার অসম্পূর্ণ অভিব্যক্তি কেনীথের কাছে স্পষ্ট। সে আনায়াকে মুঠো হাত দুটোকে শক্ত করে, নিজের দু’হাতের মাঝে আঁকড়ে ধরে বলল,

“আমি আছি না? তবে আর কিসের চিন্তা করছিস? দেখবি কোনো ভয় নেই…যাস্ট বি স্ট্রং।”

এইটুকু বলেই কেনীথ আনায়ার পেটে মুখ গুঁজে দিয়ে, আলতোভাবে চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল,

“হেই বেবি! ডোন্ট বি অ্যাফ্রেইড। তোমার পাপা আছে তো…তোমার আর মাম্মামের সাথে।”

__________

প্রায় একটা মাস পেরিয়ে গিয়েছে। একইসাথে আনায়ার পাগলামিতে কেনীথের জীবন হয়েছে আধমরা। না সইতে পারে, না কিছু করতে পারে৷ মুখ বুজে হয়েও আনায়ার সকল পাগলামি সহ্য করতে হচ্ছে তাকে। তবে দিন শেষে সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তিও কাজ করে তার মাঝে।

তাদের গতমাসেই রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হুট করেই আনায়া বলে, সে দেশ ছাড়বে না। বরং এখানেই থাকবে। অন্তত আপাতত দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি নয় সে। আনায়ার কথাকে মান্য করে কেনীথও আর কোনো জোরাজুরি করেনি। বরং যা যেমন চলছে, তা সেভাবেই রেখে দুজন এখন নিজেদের এপার্টমেন্টে পড়ে রয়েছে।

কিন্তু দিনদিন আনায়ার পাগলামি আর সহ্য করার মতো না।হুট করেই কাঁদছে, তো হুট করেই হাসছে। মাঝেমধ্যে কি সব উল্টোপাল্টাও বকছে। কেনীথ নিত্যন্তই হতাশ তবে একই সাথে এক অদ্ভুত গিল্টি ফিলও হচ্ছে। প্রথমবার যখন আনায়ার গর্বে তার সন্তান এলো, তখন সে কতটাই না অমানুষিক কার্যক্রম করেছে। শুধুমাত্র তার দোষের জন্যই, তার প্রথম সন্তান আর পৃথিবীর আলো দেখতে পারেনি। একইসাথে আনায়াকে ওমন অবস্থায় যতটা কষ্ট দিয়েছে… তা ভাবতেই যেন নিজের প্রতি তীব্র বিদ্বে”ষে ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যায়।

আনায়া সোফায় চুপচাপ বসে রয়েছে। বিশাল বড় টিভির স্ক্রিনে চলছে টম এন্ড জেরি কার্টুন। তবে আনায়ার নজর টিভির স্ক্রিনে নয় বরং কিচেনের দিকে। ড্রইংরুম থেকে দূরের কিচেন স্পষ্ট দেখা যায়। ওখানে কেনীথ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও তাদের সব রান্না শেফ করতো। কিন্তু আনায়া অদ্ভুত এক কারণে শেফের রান্না মোটেও সহ্য করতে পারত না। এমনকি রান্নার সময় রান্নার গন্ধও তার সহ্য হতো না। কেনীথ শুরতে দু থেকে তিনবার শেফ চেঞ্জ করার পর বুঝতে পারে… এভাবে আর কাজ হবে না।যে কারণে এরপর থেকে সকল রান্না সে নিজেই করে। এতে অবশ্য তার অসুবিধা হয় না, বরং এসব করতে ভালোই লাগে।

কিন্তু মাঝেমধ্যে ভালোই ভোগান্তি পোহাতে হয়। কিছুদিন পূর্বেই আনায়া শুঁটকি মাছ খাবার বায়না করে। এদিকে কেনীথ জীবনে শুঁটকি মাছ খাওয়া তো দূরের কথা, শুঁটকির আশেপাশেও কখনো যায়নি। কিন্তু শেষমেশ বাধ্য হয়ে, সেই শুঁটকিই তাকে রেঁধে, আনায়াকে খাওয়াতে হয়েছে। যা ছিল তার কাছে এক প্রকার যু”দ্ধের সমান। সেদিন পরনে শুধু গ্লাভস আর আর কিচেন এপ্রন ছিল না, বরং এসবের সাথে মুখে দু’দুটো মাক্সও ছিল। শুটকির গন্ধে কেনীথের জান যায় যায় উপক্রম। মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। অথচ তার কারবার দেখে আনায়া পারলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করে।

আনায়া চুপচাপ দূর থেকে কেনীথকে দেখছে। পরনে কিচেন এপ্রন, দুহাতে কালো গ্লাভস্…রান্নার প্রতি অন্তত কঢ়া মনোযোগ। সবমিলিয়ে একদম প্রপার শেফের মতো তার কার্যক্রম। এদিকে আনায়ার পরনে ঢিলেঢালা গাউন। যদিও অত্যধিক মুড সুইং আর বমি হওয়া ব্যতীত তার তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। গালগুলো একটু ফুলে, চেহেরাটা গুলুমুলু হয়ে যাচ্ছে… এই যা।

কেনীথ আনায়ার হাতে একটা স্ট্রবেরি স্মুদি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছে। যা আনায়ার না চাইতেও জোর করে হলেও খেতে হচ্ছে। কেনীথ তার সব জেদ মানলেও,খাবার নিয়ে হেলাফেলা করলে তা মোটেও সহ্য করে না৷

আনায়ার স্মুদি শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ সকালের বাদবাকি নাস্তা নিয়ে হাজির। টি টেবিলের উপর খাবার গুলো রেখে আনায়ার পাশে বসল। চুলগুলো বাম হাতে খানিকটা পেছনে ঠেলে দিয়ে আনায়ার দিকে তাকায়। নিমিষেই তার কপাল কুঁচকে যায়।

—“এটা খেতে এতো দেরি লাগে?”

—“খেতে ইচ্ছে করছে না।”

—“আচ্ছা, তবে এগুলো খা।”

—“আর কিছু খাব না, অনেক খেয়েছি।”

—“দেব এক ঘু”ষি।বলেছি না তোকে,আর যাই করিস না কেনো, কখনো খাবার খাওয়া নিয়ে জেদ করবি না! তোর যেটা ইচ্ছে খেতে হয়…জাস্ট বলবি আমায়।বাকি ব্যবস্তা আমি করব। কিন্তু একদমই খাওয়া দাওয়া করতে না চাইলে…সরাসরি বলবি! আমি তোকে মে’রে সোজা উপরে পাঠিয়ে দেব।”

কেনীথের এহেন কথায় আনায়া চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। না চাইতেও এখন তাকে, বসে বসে সবগুলো খাবার শেষ করতে হলো। শুরুতে নিজের হাতে খেলেও, পরবর্তীতে কেনীথই বাদবাকি খাবারগুলো তার নিজ হাতে খাইয়ে দেয়।অবশ্য বেশিরভাগ সময় এমনটাই হয়। আনায়ার সব কাজকর্মই কেনীথ আগ বাড়িয়ে নিজেই করে। আর আনায়া যদিও বা বাঁধা দেয়, সেক্ষেত্রে কেনীথ যেন সেসব পাত্তাই দেয় না।

আনায়া কোনোমতে খাবার গুলো একপ্রকার গিলেছে। এখন খেয়ে ঠিকমতো নড়াচড়া করতেও পারছে না। ঢেঁকুর তুলতে গিয়েও অসুবিধায় পড়তে হলো। ওর হাভভাবে কেনীথ খানিকটা মুচকি হাসে। খাবার গুলো সরিয়ে আনায়ার হাত দুটো ধরে মুঠো করে নেয়। অতঃপর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। কিন্তু যে যেই না ঠোঁট ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবে…ওমনি বাঁধে এক মহা বিপত্তি। নিমিষেই সম্পূর্ণ আবহ পরিবর্তন হয়ে যায়।কেনীথের সম্পূর্ণ শরীর ভেসে যায় সদ্য বমির স্রোতে৷ আনায়া আচমকা সোজা এভাবে বমি করে ফেলবে, তা দু’জনের কেউই বুঝতে পারেনি। চুমু খাওয়া প্রচেষ্টায়… কেনীথ আনায়ার একদম মুখোমুখিই ছিল। যার ফলে সব বমি গিয়ে তার মুখ সহ গলা, গায়ে বাজে ভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে যায়।

কেনীথ চোখমুখ খিঁচে মুখ বুঁজে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। অতঃপর আলগোছে খানিকটা মুচকি হেসে… কোনোমতে চোখজোড়া খুলতেই আনায়া ছলছল মুখশ্রীর সম্মুখীন হয়। আনায়ার প্রায় কেঁদে ফেলার উপক্রম। কেনীথের দিকে সে করুন চোখে তাকিয়ে। অবশ্য এর যথেষ্ট একটা কারণও রয়েছে। কেনীথ বমি সহ্য করতে পারেনা। এটা সে কিছুদিন আগে পাভেল দেশে এলে… তখনই তার কাছ থেকে শুনেছে।

এতোদিন আলাদা ভাবে বমি করলে কেনীথই সব পরিষ্কার করেছে… ব্যাপারটা ঠিক আছে৷ কিন্তু আজ আনায়া সরাসরি যে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে….আনায়ার ভাবতেই তীব্র কান্না পাচ্ছে।

কেনীথের ওর ভাবগতিকে এমন পরিস্থিতিতেও খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আনায়াকে আশ্বস্ত করার প্রয়াশে বলে ওঠে,

“কিচ্ছু হয়নি দেখ! একদম কাঁদবি না। ইট’স কমপ্লিটলি নরমাল। আমারই ভুল হয়েছে এতো জোর করে খাওয়ানো…একদমই ঠিক হয়নি। আ’ম রিয়েলি সো সরি। অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে, তাই না?”

আনায়া কিছু বলে না৷ বরং কেনীথের কথা শুনে সম্পূর্ণ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। এদিকে কেনীথ আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে সোজা উঠে দাঁড়ায়। এ গায়ে আনায়াকে ছোঁয়ার মতো অবস্থা নেই। কেনীথ নিজের সহ আশপাশে তাকিয়ে দেখে, এতোক্ষণ যা যা খেয়েছিল সবই আস্ত ভাবে বমির সাথে বেড়িয়ে এসেছে। কেনীথ এসব দেখে নিজের প্রতিই খানিকটা হতাশ হলো। এতোটাও জোর করা উচিত হয়নি তার।

সে দ্রুত গা থেকে কোনোমতে টিশার্টটা খুলে ফেলে। এরপর তা দিয়ে যতটুকু নিজেকে পরিষ্কার করা যায়…ততটুকু মুছে নিয়ে পাশে ফেলে দেয়।

—“হেই ব্লাড! যা গিয়ে এখনই গোসল করে নে। আমি এগুলো সব পরিষ্কার করে,গোসল সেরে এক্ষুনি আসছি। আর প্লিজ কাঁদবি না। কাঁদার মতো কিচ্ছু হয়নি।”

আনায়া খানিকটা ফুঁপিয়ে অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,

“কিন্… কিন্তু আপনি তো বমি সহ্য করতে পারেন না।”

আনায়া এই বলেই একদম হুহু করে কেঁদে ফেলে৷ এদিকে কেনীথ যে এগিয়ে গিয়ে আনায়াকে সামলাবে সেই উপায়ও নেই। দূর থেকে আনায়াকে বলে,

“কে বলেছে তোকে এসব?… পাভেল? ও গাধা কিচ্ছু জানে না। ছোট বেলায় একটু প্রবলেম হতো, কিন্তু… এখন এসবে আমার কোনো প্রবলেম হয়না।”

—“মিথ্যে বলছেন, আপনি!”

—“আহা্,মিথ্যে কেনো বলব? আমি তো ঠিক আছি একদম, এই দেখ! কোনো প্রবলেম হচ্ছে না আমার। তবে তুই কেনো এতো চিন্তা করছিস? যা গিয়ে দ্রুত গোসল সেরে নে। ফ্রেশ হলে ভালো লাগবে।”

আনায়া না চাইতেও, কেনীথের আদেশে বাধ্য হয়ে রুমে চলে যায়৷ এদিকে কেনীথ সোফা, টেবিল সহ যত জায়গায় ময়লা রয়েছে তার সবকিছু দ্রুত কোনোমতে মুছে পরিষ্কার করে নেয়। বাকিটা সার্জেন্ট করে নেবে৷ একইসাথে খুব বেশি একটা সময় নষ্ট না করে, সে নিজেও গোসলে চলে যায়।

_______

বিছানায় কেনীথের কোলে গুটিয়ে বসে রয়েছে আনায়া। একহাতে ডার্ক চকলটে অন্যহাতে টিভির রিমোট। টিভির স্ক্রিনে ভাসছে এক হরর মুভি। একে তো হরর মুভি, তার উপর দিনের বেলা…এই জিনিসের উপর কেনীথের কোনো ফিলিংসই কাজ করছে না। অবশ্য সে ব্যস্ত ভিন্ন কাজে।

গোসলের পর একটুও সময় নষ্ট না করে সে আনায়ার জন্য দ্রুত ফ্রুটস সালাদ্ বানিয়ে এনেছে। আপাতত সেটাই টিভিতে মনোযোগী আনায়াক, নিজ হাতে খাওয়াতে ব্যস্ত সে।

কেনীথ আনায়ার দিকে একমনে তাকিয়ে। ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি। কিছুক্ষণ একমনে কি যেন সব ভেবে, আচমকা আলতোভাবে আনায়ার মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু খায়। পরক্ষণেই দীর্ঘ প্রশান্তির শ্বাস ফেলতে না ফেলতেই, আনায়া পেছনে মুখ ঘুরিয়ে বলে,

দেখেছো! কত ভয়ানক এটা? তোমার ভয় করছে না?

কেনীথ টিভির স্ক্রিনের দিকে একপলক তাকিয়ে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেলে। সামান্য এক মুখোশ আর মেকাপ করে, কি অদ্ভুত সেজে একটা ভুত, ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। আর তার সাথে চলছে অদ্ভুত সব আজব হরর সাউন্ড। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা কেনীথের কাছে হাস্যকর ও কিছুটা বির”ক্তিকর ঠেকল। তবুও সে খানিকটা মুচকি হেসে বলে,

“তোর মতো পারসোনাল একটা রেড কালারের শাঁকচুন্নি বউ থাকতে, আমি আবার এইসব কার্টুন ভুতকে ভয় পাব?”

আনায়া কিছু বলে না বরং কেনীথের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই কি যেন ভেবে গোমড়া মুখেই, কেনীথের মুখের কাছে ডার্ক চকলেটের না খাওয়া, অন্য অংশ টুকু এগিয়ে দেয়। কেনীথ মুচকি হেসে আচমকা আনায়ার খাওয়া অংশটুকু থেকেই খানিকটা মুখে তুলে নেয়। এতে আনায়া শুরুতে খানিকটা চমকে গেলেও, পরবর্তীতে বিস্তৃত মুচকি হেসে অকস্মাৎ কেনীথের ঠোঁটে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। একই সময় কেনীথ কিছুটা কপাল কুঁচকে মুচকি হেসে আওড়ায়,

“উহুম, উহুম…এই যে ম্যাম! এসব করে প্লিজ আমায় উত্তে”জিত করবেন না। চাইলেও আমি কিছু করতে পারব না।”

কেনীথের এ কথা শোনা মাত্রই আনায়া ফিক করে হেঁসে ফেলল। কেনীথ ওর হাসি দেখে কপাল কুঁচকে ফেলতেই, আনায়া আরো খানিকটা চকলেট খাওয়ার নামে ঠোঁটের চারপাশে ভালোমতো লাগিয়ে নেয়। এরপর আচমকাই কেনীথের গলায় একহাত পেঁচিয়ে তার ওষ্ঠে ওষ্ঠ চেপে ধরে। বিস্ময়ে কেনীথের চোখ ছানাবড়া হলেও সে নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আনায়ার পাগলামি যেন থামছেই না। যেভাবে পারছে সেভাবেই, দৃঢ় চুম্বনের আবেশে কেনীথকে ঘায়েলের সর্বচ্চ চেষ্টা করছে। এদিকে কেনীথ সইতেও পারছে না, আবার কিছু করতেও পারছে না। সে চোয়াল শক্ত করে, চোখ খিঁচে চুপটি করে বসে রয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত সকল উত্তে”জনার শিহরণে গলার মধ্যখানে অবস্থানরত অ্যাডামস অ্যাপেল প্রতিনিয়ত ধীরগতিতে ওঠানামা করছে। অথচ আনায়া এতেই যেন অন্তরালে হে’সে মরিয়া। সে সোজা ওষ্ঠে কামড়ানো সহ আরো বেশি পাগলামি শুরু করলে কেনীথ আর সহ্য করতে পারে না। আনায়াকে এখনই না থামালে, বাজে কিছু হয়ে যাবে। সে তৎক্ষনাৎ নিজেকে শক্ত করে, একহাতে আনায়ার ঘাড় পেছন থেকে, খানিকটা আলতোভাবে চেপে ধরে। অতঃপর কিছুটা জোরাজুরি করেই আনায়াকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়।

কেনীথ আর আনায়া দু’জন মুখোমুখি হলেও, কিছুটা দূরত্ব রয়েছে। কেনীথের চোখ হতাশায় নিমজ্জিত, আর আনায়ার ঠোঁটে তখনও বিস্তৃত শয়তানি মুচকি মুচকি হাসি। কেনীথ খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, নিজের হাতের তালু দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়। নিমিষেই খানিকটা গলানো ভিজে চকলেট হাতের তালুতে লেগে যায়। ঠোঁট তার অনবরত জ্বলছে। কেনীথ হাতাশায় আবারও ভারী শ্বাস ফেলে। আনায়ার দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখে, ওর ঠোঁট থেকে শুরু করে গালের আশপাশ পর্যন্ত চকলেট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সে অদ্ভুত শয়তানির দৃষ্টিতে কেনীথের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁট কামড়ে মিনমিন করে হাসছে।

—“কাজটা কিন্তু ঠিক হলো না!”

আনায়া মুচকি হেসে বলল,

“কেনো মাই ডিয়ার খলিজা,আর খাবে না…চক…লেট?”

কেনীথ হতাশায় নিমজ্জিত চাহনিতে আনায়ার হাসিমাখা ফেসটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

“খুব মজা নিচ্ছিস তাই না? চিন্তা করিস না, একবার শুধু সুস্থ মতো আমার লেডিবাগ চলে আসুক। তারপর দেখাব মজা,তোর সব শয়তানি আমি এক রাতে গায়েব করে ছাড়ব। মালদ্বীপের কথা নিশ্চয়, ভুলে যাস নি!”

আনায়া খানিকটা চোখ ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বলল,

“ভুলবো কেনো। ওসব না হলে কি আর আজ আমার এই দশা হতো?”

কেনীথ আনায়ার কথায় অকস্মাৎ হেসে ফেলল। এদিকে আনায়া আবারও বলল,

“সব বুঝলাম, কিন্তু এই লেডিবাগটা কে? আমার সন্তান মানুষ হবে, কোনো পোকামাকড় না।”

—“আরেহ্ বুদ্দু,আমি আমার মেয়ের কথা বলেছি। ওকে আমি লেডিবাগ বলেই ডাকব।”

—“কেবলমাত্র তিনমাস হলো। আপনি কি করে জানলেন, আমাদের মেয়ে হবে?”

—“আমি 99.99% সিওর, আমার মেয়েই হবে।”

—“এ্যাহ আসছে আমার, পীরে উল্লাহ কেনীথ বাবা। আমার ছেলেই হবে, ও আমি বলে রাখলাম।”

—“হ, তুই বেশি জানোস।”

—“আমি জানব তো আপনি জানবেন? বাচ্চা কি আমার পেটে নাকি আপনার পেটে।”

নিমিষেই কেনীথের মেজাজ বিগড়ে যায়। ওদিকে আনায়া আবারও বলে,

“যত যাই বলেন,আপনার এতো সাধুগিরি কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছে না।”

কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে বলে,

“মানে?”

নিমিষেই আনায়ার ভাবগতিক পরিবর্তন হয়ে যায়। কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে কেনীথের দিকে অপলক, ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে। কেনীথ কিছু বুঝে নিয়ে করে উঠবে তার পূর্বেই, আনায়া কেনীথের বুক ঘেঁষে লেপ্টে বসে। আরো একবার চকলেট মুখে নিয়ে, বাকিটুকু পাশে রেখে দেয়।

দু’জনের চাহনি একে অপরের দিকে। কেনীথের চোয়াল শক্ত, দিব্যি বুঝতে পারছে আনায়া আবারও শয়তানি করবে। আর তার ধারনাই ঠিক হলো। আনায়া একহাতে কেনীথের গলা পেঁচিয়ে, অন্যহাতে তর্জনী উঁচিয়ে কেনীথের গলা বরাবর নিয়ে আসে। অতঃপর শুরু হয় তার এক অদ্ভুত দুষ্টুমি। নিজের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে বারংবার কেনীথের গলায় এলোমেলো ভাবো ছুঁয়ে দিতে শুরু করে। এদিকে কেনীথের মাথা আকস্মিক অজান্তেই খানিকটা পেছনে দিয়ে ঝুকে গিয়েছে। একই সাথে টানটান হয়েছে গলার ত্বক। কেনীথের অ্যাডামস্ অ্যাপেল বারংবার ধীর গতিতে ওঠানামা করছে। আর আনায়ার নজর ঠিক তাতেই পড়ে। সে একবার কেনীথকে দেখছে তো, কখনো অ্যাডমস্ অ্যাপেলকে…।নিমিষেই তার তর্জনী গিয়ে কেনীথের অ্যাডমস্ অ্যাপেল বরাবর স্পর্শ করে। যার ওঠা-নামার পাশাপাশি আনায়ার আঙ্গুলও ওঠানামা করে।

কেনীথ ঠোঁট চেপে,চোয়াল শক্ত করে, নিজেকে শান্ত রেখেছে। হাত দুটো করে রেখেছে মুষ্টিবদ্ধ। এদিকে আনায়া এসবে যেন আরো বেশি মজা পাচ্ছে। সে এবার মুখটা খানিকটা হা করে কেনীথের অ্যাডামস্ অ্যাপেল বরাবর গলার ত্বরে ঠোঁট স্পর্শ করতেই, কেনীথ আর নিজেকে থামাতে হা পারলে আকস্মিক আনায়ার পিঠে শক্ত ভাবে হাতের থাবায় নিজের সাথে চেপে ধরে। পরক্ষণেই জোরে জোরে কিছুটা শ্বাস ফেলার পর, শক্ত গলায় চাপা স্বরে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

“পাগলামি করিস না!”

কেনীথের নিশ্বাস ভারী। চোখমুখে অজানা শূন্যতা। কপালের আশেপাশে কিঞ্চিৎ ঘাম জমে গিয়েছে। এরইমাঝে আনায়া মুচকি হেসে আবারও কেনীথের অ্যাডামস্ অ্যাপেল…আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে, ফিসফিসিয়ে আওড়ায়,

“ক্ষিদে পেয়েছে! এটা কামড়ে খেয়ে ফেলি?”

_______

গোসল শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নিজেকে পরখ করে দেখতে ব্যস্ত আনায়া। চুলগুলো খানিকটা ভিজে;টুপটাপ কয়েক ফোঁটা পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আনায়ার সেদিকে নজর নেই। সে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত।

সময়ের সাথে সাথে আরো তিনমাস পেরিয়ে গিয়েছে; আনায়া এখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা। একই সাথে তার পেটটাও খানিক ফুলে উঁচু হয়েছে; স্বাস্থ্যবানও হয়েছে যথেষ্ট। ওজন বেড়ে যাওয়ায়, হাঁটা চলায় খানিকটা বেগ পেতে হয়। অবশ্য হবেই না বা কেনো, কেনীথের বানানো বেলায় বেলায় নানান রকম খাবার খেয়েই তার এই দশা।

ফর্সা গাল, মুখ, শরীর ফুলে গিয়ে একদম গুলুমুলু বেলুনের ন্যায় হয়ে গিয়েছে। অথচ কেনীথের কাছে আনায়ার এই পরিবর্তন ভালো লাগলেও, আনায়া এসবে কিছুটা অসন্তুষ্ট। কখনো নিজেকে এভাবে দেখে মাতৃত্বের ভালোবাসার খেয়ালে নিজেকে জড়িয়ে নেয়, তো কখনো এমন বেলুনের মতো ফুলে ওঠা চেহারায় নিজেই বিরক্ত হয়। এই নিয়েই চলছে তার জীবন। হুটহাট কখনো হাসছে, তো কখনো তোরজোর লাগিয়ে কান্না শুরু করে দিচ্ছে। আর সবকিছুই শুরু থেকে এখন অব্দি এক হাতে সামলে যাচ্ছে কেনীথ।

আনায়া অভিব্যক্তি স্পষ্ট নয়। নিজেকে অদ্ভুত ভাবে আয়নায় দেখছে সে। সে আদতে খুশি মনে রয়েছে, নাকি খানিক সময়ের মাঝেই কেঁদে উঠবে তা বোঝা মুশকিল। ইদানীং গাউন ছেড়ে মেক্সি পড়া শুরু করেছে। কিন্তু এমন ড্রেসআপে সে নিজেই নিজেকে নিয়ে অদ্ভুত খেয়ালে হারিয়ে যায়।

কেনীথ গোসল সেড়ে এসে দেখে আনায়া আয়নার সামনে অপলকভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সে তোয়ালে দিয়ে নিজের চুল গুলো মুছতে মুছতে আনায়ার দিকে এগিয়েছে। চোখেমুখে তার যথেষ্ট ক্লান্তি। গত কয়েকমাসে পরিশ্রম যেমন তেমন হয়েছে। কিন্তু ঘুমটা তার মোটেও ভালো করে হচ্ছে না।অবশ্য সেই সুযোগই হয়ে উঠছে না। আগে আনায়া রাতে স্বাভাবিক ভাবে ঘুমিয়ে পড়লেও, কেনীথ চিন্তায় ঘুমাতে পারতো না। যে কারণে বেশিরভাগ রাতই তার জেগেই কাটাতে হতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভিন্ন। এখন সে চেয়েও ঘুমাতে পারে না।

ইদানীং রাত হলেই আনায়া অদ্ভুত সব বায়না ধরে। শুরু হয় তার নানান রকমের পাগলামি।গল্প আলাপ সহ, নানান সব জেদ। যেসব না মানলে বেশিরভাগ সময়ই আনায়া কান্না জুড়ে দেয়। কখনো সারারাত ধরে কেনীথের সাথে অদ্ভুত সব পাগলামির গল্প আলাপ করে। আবার কখনো আঁকাআকির নাম করে কেনীথের বুকে, পিঠে শত রকমের ছবি একে দেয়, নানান রঙের মার্কার পেন দিয়ে।

আবার এমনও ঘটনা রয়েছে যে,কেনীথ তাকে শতবার বুঝিয়েও কিছু বোঝাতে পারে না। আবার কখনো কেনীথের প্রত্যাশার বাহিরে গিয়ে, আনায়া সবকিছু সহজেই মেনে নিয়ে খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। এভাবেই নানান কাহিনি করে সারারাত জাগতে হয়, আর দিনের বেলায় তো আনায়ার দেখভালের ব্যাপার রয়েছেই।

আনায়ার চুলে পানি দেখে কেনীথ কিছুটা বিরক্ত হলো। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে কেনীথ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আনায়ার পেছন বরাবর দাঁড়িয়ে পড়ে। হাতের তোয়ালেটা দিয়ে আলতোভাবে আনায়ার চুলগুলো মুছে দিতে লাগে।

ওদিকে আনায়ার নজর নিজের থেকে সরে গিয়ে কেনীথের উপর পড়েছে। সে আয়নায় একপলক কেনীথকে দেখে নিয়ে পরক্ষণেই বলে ওঠে,

“তুমি কি এখন আর আমাকে ভালোবাসো না?”

আনায়ার গম্ভীর স্বরে বলা এ কথা শোনা মাত্রই কেনীথ খানিকটা বেশম খেল। দিনরাত যার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবন যায় যায় উপক্রম…আজ সেই জিজ্ঞেস করছে, তাকে সে ভালোবাসে কিনা।
আনায়ার চুলগুলো কোনোমতে মুছে দেওয়া শেষ হলে, কেনীথ আনায়ার কাঁধে চোয়াল ঠেকিয়ে…একহাতে আনায়ার পেট আলতোভাবে জড়িয়ে বলল,

“কে বলেছে, ভালোবাসি না?…আমি তোকে সবসময় ভালোবাসি। সর্বক্ষণে ভালোবাসি।”

আনায়া আয়নাতেই কেনীথের দিকে তাকায়। খানিকটা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

“দেখো কেমন দেখা যাচ্ছে আমাকে, এইসব মেক্সি টেক্সি পড়ে। পুরো বেলুনের মতো।”

কেনীথ যেন এবার আনায়ার অভিব্যক্তি স্পষ্ট বুঝতে পারল। সে খানিকটা মুচকি হেসে আয়নায় একপলক আনায়াকে দেখে নেয়। পরক্ষণেই আনায়াকে ছেড়ে দিয়ে তাকে তার মুখোমুখি করে দাঁড় করায়। তার দু বাহুতে হাত রেখে একপলক দেখে নিয়ে, পরক্ষণেই আনায়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,

“আহ্! মেক্সি পড়ে বউ আমার, পুরো সেক্সি লাগছে!”

এটা শোনামাত্রই আনায়া চোখ বড় করে তাকাতেই, কেনীথ খানিকটা বেশম খেয়ে কেশে ওঠে। পরক্ষণেই নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে বলে,

“আ…আই মিন, মেক্সি পড়ে অনেক কিউট লাগছে। হ্যাঁ,হ্যাঁ,অনেক বেশি কিউট লাগছে।”

আনায়া কেনীথের দিকে কিছুক্ষণ কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে থাকার পর অকস্মাৎ ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল। ওর কান্না দেখে কেনীথ হতভম্ব হয়ে আনায়াকে আগলে নিয়ে বলল,

“কি হলো,কাঁদছিস কেনো? সরি, সরি, মুখ ফঁসকে কথাটা বেড়িয়ে গিয়েছিল। আর কখনো ওসব… ”

—“আমায় আর আগের মতো হট লাগে না, তাই না?”

এই বলতে না বলতেই কেনীথের বুকে আনায়া লেপ্টে গিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। ওদিকে কেনীথ হতভম্ব হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সে কি ভাবল আর আনায়া কি বলল?

কেনীথ কয়েকবার চোখ পিটপিট করে, খানিকটা ঠোঁট ভিজিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। ওদিকে আনায়ার কান্না থামার কোনো নাম নেই। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে অনবরত কেঁদে উঠছে। কেনীথ আনায়াকে দু’হাতে জড়িয়ে আগলে নেয়। আনায়ার মাথার উপর গলার অগ্রভাগ ঠেকিয়ে শীতল কন্ঠে বলতে লাগে,

“তারা মাই ব্লাড! হুঁশ! আর কত কাঁদবি? এসব ব্যাপারে কেউ কাঁদে? আমি কি কখনো বলেছি তোকে আমার এই রূপে পছন্দ নয়? বলিনি তো! তবে কেনো কাঁদছিস? তুই বিশ্বাস কর বা না কর, আমার কিন্তু এই গুলুমুলু বউটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। প্রতিবছর বউ আমার এভাবে গুলুমুলু হয়ে গেলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না! তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস তো,কি বলছি আমি?”

কেনীথ আনায়ার মাথার পেছনে, চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দেয়। এদিকে আনায়ার কান্নাও ক্রমশই কমে আসতে শুরু করে। একটা সময় সে কিছুক্ষণের জন্য কান্না থামিয়ে, কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,

“ভালো লাগে না আমার।”

কেনীথ আনায়ার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই বলে,

“কেনো,কোনো কি সমস্যা হচ্ছে? এমন কিছু যা তোর একদমই পছন্দ হচ্ছে না। প্লিজ আমায় বল, আমি সব ঠিক করার ব্যবস্তা করছি।”

আনায়া শুরুতে কিছুই বলে না। পরবর্তীতে কেনীথের বুকে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থাতেই কাঁদো কাঁদো স্বরে অস্ফুটভাবে বলে,

“আমার একটা জিনিস চাই।”

—“হুম, বল। কি চাই তোর?”

—“সতীন চাই আমার।”

এই বলেই আনায়া হু হু করে কান্না জুড়ে দেয়। এদিকে কেনীথ বিস্ময়ে স্তব্ধ। আনায়ার দু বাহু ধরে ওর নিজের মুখোমুখি করে, বিস্ময়ের স্বরে বলে,

“সতীন?”

—“হুম।”

—“এ ভুত কোথায় থেকে মাথায় চাপলো?”

আনায়া নিজের কান্না খানিকটা থামিয়ে বলে,

“জানি না। আমার একা একা ভালো লাগে না। সতীন চাই আমার।”

—“আমি তোর সতীনের চেয়ে কম নাকি? আর কত সতীন লাগবে তোর?”

—“এ্যাহ্, আপনি না আমার বর। তাহলে সতীন হতে যাবেন কেনো দু্‌ক্কে?”

কেনীথ মুখে কিছু বলে না। বরং মনে মনে আওড়ায়,

“তোর মতো শাঁকচুন্নিকে বউ বানানোর দুক্কে। ইতিহাসে তুই-ই হয়তো প্রথম কোনো মেয়ে, যে সেঁধে এসে নিজের স্বামীর কাছে, সতীনের জন্য আবদার করছে।”

চলবে________________