একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪১(২+৩য় অংশ)

0
13

একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
পর্ব—৪১(২য় অংশ)

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

পর্ব—৪১(২য় অংশ) সারপ্রাইজ পার্ট

—“এ্যাহ্, আপনি না আমার বর। তাহলে সতীন হতে যাবেন কেনো দু্‌ক্কে?”

কেনীথ মুখে কিছু বলে না। বরং মনে মনে আওড়ায়,

“তোর মতো শাঁকচুন্নিকে বউ বানানোর দুক্কে। ইতিহাসে তুই-ই হয়তো প্রথম কোনো মেয়ে, যে সেধে নিজের স্বামীর কাছে সতীনের জন্য আবদার করছে।”

—“কি হলো? কিছু বলছেন না কেনো?”

কেনীথ আলতোভাবে আনায়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে,আনায়াকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে বলল,

“কাল রাতে একটুও ঘুমাসনি। নিশ্চিয় মাথা ব্যথা করছে। চল, আগে চুলে তেল দিয়ে ম্যাসেজ করে দেব। এরপর সোজা ঘুমিয়ে যাবি। আর কোনো কথা নয়।”

নিমিষেই আনায়ার কথার প্রসঙ্গ ও অভিব্যক্তি পাল্টে যায়। সকল কান্না থামিয়ে, অনেকটা খুশি মনে হেসে ওঠে। আনায়া কেনো হাসছে তা ও-ই জানে। তবে ওর মুখে হাসি ফুটতে দেখে, কেনীথও খানিকটা মুচকি হাসে।

___

আনায়া বিছানায় চুপচাপ বসে রয়েছে। বলতে গেলে সে এক প্রকার ঝিমাচ্ছে। আর ওদিকে কেনীথ তার পেছনে, বিছানায় হাঁটু গেঁড়ে বসে… দু’হাতে তেল মাখিয়ে আনায়ার চুলে লাগিয়ে দিচ্ছে। অতঃপর আলতোভাবে যতটা পারা যায়, ধীরে ধীরে প্রচন্ড দক্ষতার সাথে ম্যাসেজ করে দেয়।

কেনীথের তেল দিয়ে ম্যাসেজ করা শেষ হলে, সে আনায়ার চুলে একটা লম্বা বেনুনী গাঁথতে শুরু করে। একই সময় আনায়া চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই বলে উঠল,

“আপনি দেখেছেন?দিনে দিনে আমার চুল পড়ে মাথাটা কেমন জাম্বুরার মতো হয়ে যাচ্ছে।”

কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলে। কথাটা ভুল নয়। ইদানীং আনায়ার ভালোই চুল পড়ছে। যদিও এটা প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আপাতত আনায়ার কথার সাথে তাল মেলালে, আনায়া আবারও এই নিয়ে কান্না জুড়ে দেবে।

—“তোকে কে বলে এসব? আমি তো এমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আর ওই একটু আকটু চুল পড়লে তাতে কি এসে যায়? একটা চুল পড়লে পরবর্তীতে তা থেকে আরো তিনটে চুল গজিয়ে যাবে, ব্যাপার না! কিন্তু তোর তালবাহানা করলে চলবে না। আমি যখনই বলব চুলে তেল দিতে তখনই দিবি। তাহলেই দেখবি আর চুলের কিছুই হবে না।”

এমন আরো কিছু ভুজুংভাজুং বলে আনায়াকে এই ব্যাপারে শান্ত করে। এরইমাঝে আনায়া হাই তুলতে শুরু করেছে। দুপুর বেলায় এখন না ঘুমালেই নয়। কিন্তু কেনীথ ভালো করেই জানে, এখন ঘুমালে আজ রাত তবে পুরোটাই জাগতে হবে। কিন্তু এছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই।

আনায়ার চুলে বিনুনি গাঁথা শেষ করে, তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে আলতোভাবে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। অতঃপর আনায়াকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই আনায়া বলে,

“এভাবে ঘুম আসবে না। দিনের বেলায় ঘুমাতে ভালো লাগে না আমার।”

আনায়ার কথা শোনা মাত্রই, কেনীথ বলে ওঠে,

“এক সেকেন্ড, এখনই দিনকে রাত বানিয়ে দিচ্ছি।”

এই বলেই সে রুমের চারপাশে সকল জানালা দরজা বন্ধ করে দিয়ে, পর্দা টেনে দেয়। নিমিষেই চারপাশ অনেকটাই অন্ধকার হয়ে যায়। কেনীথ আবারও আনায়ার কাছে আসতেই দেখে সে চোখ বুঁজে রয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণ সময় যেতে না যেতেই আচমকা অস্থির হয়ে উঠে বসে কান্না জুড়িয়ে দেয়। হঠাৎ আবারও কান্না করতে দেখে কেনীথ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,

“আবার কি হলো?”

—“ভালো লাগছে না আমার।”

—“ঘুম আসছে না? ঘুরতে যাবি?”

—“নাহ, যাব না আমি কোথাও।”

কেনীথ খানিকটা ঠোঁট ভিজিয়ে ভাবতে থাকে, এখন ঠিক কি করা যায়। এদিকে আনায়ার কান্নার বেগ বেড়ে গিয়ে…আনায়া বলে,

“তুমি আর আমাকে একটুও আদর করো না। আমার আর কিছুই ভালো লাগে না।”

সেকেন্ডে সেকেন্ডে আনায়ার এমন মুড সুইং ব্যাপারটা সত্যিই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু এসব চুপচাপ সহ্য করা ব্যতীত আর কোনো উপায়ও নেই। অবশ্যই আনায়ার ভেতরের সমস্যা গুলোকে তো বুঝতে হবে। প্রেগ্ন্যাসিতে হরমোন ইস্যুতে এসব মুড সুইং এর ব্যাপারগুলো একদমই স্বাভাবিক। তবে তা কারো ক্ষেত্রে বেশি, আবার কারো ক্ষেত্রে কম হয়ে থাকে। আর ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী, আনায়াকে এসব বিষয়ে একটু বেশিই খেয়াল রাখতে হবে…কেননা তার প্রথম প্রেগ্ন্যাসির পুরো সময়টাই ছিল অত্যন্ত ক্রিটিকাল। কেনীথ খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজেকে স্বাভাবিক করে অসহায়ত্বের স্বরে বলে,

“কে বলেছে আমি তোকে আদর করি না? আমি তোকে আদর করি তো! আচ্ছা তবে এখনই অনেকগুলো আদর করে দিচ্ছি।”

এই বলেই কেনীথ আনায়াকে নিজের কাছে টেনে নেয়। এরপর আনায়ার সামনা-সামনি বসে,নিজের দু’হাতের তালু এক করে, আনায়ার মাথার পেছনে ঠেকিয়ে বলে,

“চোখ বুঁজে থাকবি…যতক্ষণ না আমি খুলতে বলছি।”

কিন্তু আনায়া চোখ বুঁজতে চায় না। সে জানে কেনীথ এখন তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তার ঘুমাতে ইচ্ছে হচ্ছে না।তবে বাধ্য হয়েই যেন তাকে শেষমেশ চোখ বুঝতে হলো। আর তৎক্ষনাৎ কেনীথ অদ্ভুত এক কার্যক্রম শুরু করে দেয়।

আনায়া মাথা পেছনের দিকে কিছুটা হেলে রয়েছে। গলার ভাঁজ মিলিয়ে ত্বক টান-টান। আর কেনীথ সেই গলার আশেপাশে সর্বত্রে, অসংখ্যবার ঠোঁটের কোমল ছোঁয়ায় চুমু একে দিচ্ছে। একইসাথে গুনগুন করে ধীর স্বরে, বাচ্চাদের ন্যায় আওড়াতে থাকে,” মাই ব্লাড!,মাই চেরি ব্লাস্ট!,মাই হার্টবিট!,ডিম্পল কুইন,মহারানী, রেড কালারের শাঁকচুন্নি… ”

এভাবে একের পর এক আনায়াকে দেওয়া অদ্ভুত সব নাম আওড়াতে থাকে। যদিও আনায়াকে ঘুম পাড়ানোর এই উপায়টা অদ্ভুত, তবে যথেষ্ট কার্যকর। কেননা এতোক্ষণে আনায়া প্রায় ঘুমের ঘোরে ঝিমিয়ে পড়েছে। আর এদিকে কেনীথ ধীরে গলার স্বর কমিয়ে শুধু গুনগুন করতে লাগল। একই সাথে গলার ভাঁজে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভরিয়ে দিতে থাকে অজস্র চু’মুর আলতো স্পর্শ।

অল্প কিছু সময়ের মাঝেই, আনায়া প্রায় ঘুমে ঢ’লে পড়ে যাওয়ার ন্যায় উপক্রম। কেনীথ আর দেরি না করে আনায়ার মাথাটা বালিশের উপর রেখে শুইয়ে দেয়। অতঃপর গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে প্রশান্তিতে ভারী শ্বাস ফেলে মুচকি হাসে। কিন্তু সে খুশি মনে চলে যেতে উদ্বিগ্ন হলে, আনায়া ঘুমের ঘোরে তার হাত টেনে ধরে বলে,

“যেও না, ভয় করে আমার।”

কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে খানিকটা দীর্ঘ ফেলে। অতঃপর সে নিজেও গিয়ে আনায়ার পাশে শুয়ে পড়ে। এবং নিমিষেই আনায়া কেনীথের টি-শার্ট উঁচিয়ে, তার মাঝে ঢুকে গিয়ে, উন্মুক্ত বুকের মধ্যিখানে মুখ গুঁজে, কেনীথকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়। একইসঙ্গে কেনীথও খানিকটা বিস্তৃত হেসে, একহাতে আনায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই, সে নিজেও ঘুমের আবেশে চোখ বুঁজে নেয়।

__________

রাত একটা গড়িয়ে দুটো বাজতে চলল। কিন্তু আনায়ার ঘুমানোর কোনো নাম নেই। রাতের বেলায় বসে বসে কেনীথের সাথে লুডু খেলছে।একটু আগে রক,পেপার, সিজার খেলছে। সেটায় আর মন বসছিল না বিধায় এখন এই খেলা। কেনীথ খেলায় আগের খেলায় প্রতিবার ইচ্ছে করে হেরে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সে বেশিবার জিতে গেলে দেখা যাবে, আনায়া সেই নিয়েই এই মাঝরাতে কান্না জুরে দিয়েছে। কেনীথের চোখেমুখে ক্লান্তি। তবে আনায়ার হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে সে-ও মুচকি হাসছে। যত যাই হোক, ইদানীং নিজের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি কাজ করে।

এদিকে আনায়া লুডুর আরেকটা গুটি চালান দিতেই,অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠল,

“আহ্,ভালো লাগছে না।”

কেনীথ কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে যায়।—”এটা খেলতে ভালো লাগছে না? চল তবে অন্যকিছু খেলি।”

—“নাহ, আর কিছুই খেলব না।”

_-“ঘুম পেয়েছে?ঘুমাবি?”

—“নাহ,ঘুমাতে ভালো লাগে না আমার।”

—“তবে কি করবি?”

আনায়া কেনীথের মুখপানের দিকে চেয়ে থাকে। চোখে-মুখে ভীষণ ক্লান্তির ছাপ। চুলগুলো বিধ্ব”স্ত রকমের এলোমেলো। নিমিষেই আনায়ার চোখ-মুখ চুপসে যায়। এদিকে আনায়াকে একমনে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে বলে,

“কি হলো?”

আনায়া নির্বিকারে জবাব দেয়,

“আপনি কেনো জেগে রয়েছেন, ঘুমিয়ে যান না!”

—“তোর ঘুমানোর আগে, আমি কখনো ঘুমিয়েছি?”

–“ঘুমান না কেনো! আমার সাথে তাল মিলিয়ে এতো কষ্ট করতে কে বলে?”

কেনীথের খানিকটা কপাল কুঁচকে যায়। কিছুটা সন্দিহান স্বরে বলে ওঠে,

“ঘটনা কি? আজ হঠাৎ এসব নিয়ে… ”

—“বলাটা কি উচিত নয়?”

কেনীথ কিছুটা থমকায়। আনায়ার চোখজোড়া জলে ভিজে ওঠে।সে কেনীথের দিকে, তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে গালে হাত রাখে।

—“আয়নায় কি নিজের চেহেরাটা একবারও দেখেছেন?আমার পেছনে ছুটতে ছুটতে…সে সময়টাও তো আপনার নেই৷ চেহারার কি হালটাই না হয়েছে।”

আনায়ার কথায় কেনীথ আলতোভাবে মুচকি হাসে। আনায়ার মুখের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ধীর স্বরে আওরায়,

“কেনো? এখন আর আমায় ভালো লাগে না বুঝি?”

আনায়া কিছুটা ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলে,

“মজা কারবেন না! আমার সত্যিই আর কিছু ভালো লাগে না।”

আনায়া এটুকু বলেই মাথা নুইয়ে ফেলে। না চাইতেও চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। কেনীথ খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আনায়াকে নিজের কাছে টানে। কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে, চোখের জল মুছে দিয়ে বলে,

“এতো চিন্তা কেনো করতে যাস? দেখিস কিচ্ছু হবে না। তুই শুধু খাবি,মজা করবি,ঘুমাবি…আর কিসের চিন্তা তোর?”

আনায়া মুখ তুলে কেনীথের পানে চেয়ে,কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

“আর আপনি? আমার জন্য যে আপনার এই দশা হচ্ছে, তার কি করবেন?”

কেনীথ কিছুটা মুচকি হাসে। আনায়ার কপালের মাঝ বরাবর আঙুলের টোকা দিয়ে বলে,

“বুদ্ধু! আমার জন্য তোর এসব চিন্তা না করলেও চলবে। আমি একদম ঠিক আছি। তুই আমার লেডিবাগের চিন্তা কর। বাই দ্য ওয়ে, তুই লেডিবাগের জন্য কোনো নাম ঠিক করেছিস?

নিমিষেই আনায়ার কান্না থেমে যায়।খানিকটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,

” নাহ তো!”

কেনীথ যতদ্রুত সম্ভব, আনায়ার মনোযোগ এদিকে ফেরাতে বলে ওঠে,

“আয় হায়, বলিস কি? আমাদের কি উচিত নয় যে, বেবির জন্য নাম ঠিক করে রাখা?”

—“হুম, তা তো ঠিক। কিন্তু রাখব টা কি?”

এই বলেই আনায়া কিছু ভাবতে শুরু করে। এরইমাঝে কেনীথ বলে উঠল,

“ওতো ভাবতে হবে না। নাম আছে কাছে আমার কাছে। তবে… ”

—“সত্যি? কি নাম?”

—“মেয়ে হলে ‘কেনায়া শিকদার’—কেনীথ প্লাস আনায়া।এই নাম আমি না, মা রেখেছিল। তবে তোর এই নাম পছন্দ হলে, এখন নিকনেমটা খুঁজতে হবে।”

আনায়া কিছুটা হাসোজ্জল অভিব্যক্তিতে বলে উঠল,”এটা অনেক সুন্দর।তবে এটাই থাক আর নিকনেমটা না হয় হবে ‘অরিন’।

—“ওয়াও, অরিন? ইট’স ঠু গুড। তুই-ও তো দেখি যথেষ্ট ভালো নাম খুঁজে বের করেছিস।”

—“আরেহ এই নাম আমি না,রে…”

আনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই কেনীথ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে ফেলে,”তবে কে?” এদিকে আনায়া খানিকটা হুঁশ ফিরতেই ইতস্ততভাবে বলে ওঠে,

“এটা রেহান রেখেছিল। বলেছিল,যদি আমার মতো দেখতে কোনো মেয়ে হয় তবে তার নাম রাখবে অরিন।তো…”

—“বুঝেছি। আর বলতে হবে না।”

কেনীথের গাম্ভীর্যের ভাবভঙ্গিতে আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গিলে বলে,”আহ্, সরি। আমরা না হয় অন্য কোনো নাম…”

—“প্রয়োজন নেই। এটাই থাকুক,’কেনায়া শিকদার অরিন’।

আনায়া কেনীথের নির্বিকার অভিব্যক্তিতে ভ্রু উঁচিয়ে, সন্দিহান স্বরে বলল,

“সত্যি? এটাই রাখবেন?”

—“হুম, আমার তো কোনো সমস্যা নেই।”

কেনীথ মুখে এটা বললেও মনে মনে আওড়ায়,

“হাহ্ শান্তি, বউ আর মেয়ে…দুটোই আমার।”

এরইমধ্যে আনায়া আবারও বলে,

“মেয়ের নাম তো হলো, কিন্তু ছেলের নাম?”

—“ওটা তুই ঠিক কর।”

—“কেনো? যদি ছেলে হয়,তবে তাকে কি আপনি ফেলে দেবেন নাকি? আমার ছেলে কোন পাপ করেছে?”

—“আরেহ, বেশি বুঝিস কেনো? আচ্ছা তবে ঠিক আছে, ছেলে হলে নাম রাখব…আ…কায়রাভ! কায়রাভ শিকদার?”

—“হ্যাঁ,এটাই একদম পারফেক্ট এটা অনেক পছন্দ হয়েছে আমার।”

—“আহ্,তবে নাম তো রাখা শেষ। এবার কি করবি বল? ঘুমাবি নাকি আরো কিছু…”

আনায়া নিমিষেই ঠোঁট উল্টে জবাব দেয়,

“ঘুম পায় না তো আমার। আ…আচ্ছা তুমি ঘুমিয়ে যাও। আমি বরং আঁকাআকি করব।”

—“এতো রাতে ড্রইং করবি? আচ্ছা ঠিক আছে, আমি মার্কার পেন আর পেপারস্ নিয়ে আসছি।”

কেনীথ এই বলে উঠে যেতে নিলে, আনায়া পেছন থেকে বলে উঠল,

“পেপার টেপার লাগবে না। শুধু… ”

আনায়া এই বলেই থেমে যেতেই কেনীথ খানিকটা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থেকে দেখে।আনায়ার মিনমিন করে তাকিয়ে থাকা অভিব্যক্তিতে, কেনীথ যা বোঝার তা সে বুঝে গিয়েছে।সে ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“হাহ্,তারা! তুই আর ভালো হলি না!”

আনায়া কিছু না বলে, শুধু মিনমিন করে মুচকি হাসল। এদিকে কেনীথ আনায়ার জন্য অনেকগুলো কালার পেন এনে হাতে ধরিয়ে দেয়। এগুলো ওয়াটার পেন টাইপের। হালকা পানিতেই উঠে যায়। আনায়া পেনগুলো হাতে নিয়ে খুশিতে গদগদ হতেই, পাশ থেকে কেনীথ নিজের টিশার্টটা খুলে, উন্মুক্ত পিঠে উপর হয়ে শুয়ে পড়ে। পাশে মুখ ফিরিয়ে ঘুমন্ত স্বরে বলে,

আমি ঘুমাচ্ছি, তোর আঁকাআঁকি শেষ হলে ঘুমিয়ে পড়িস। আর কোনো প্রয়োজন হলে পাকনামি না করে, ডেকে দিস আমায়।”

আনায়া কিছু বলে না। খানিকটা বিস্তৃত হেসে মাথা হেলায়। এদিকে কেনীথের ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই যেন ঘুমের অতল সাগরে ডুবে গিয়েছে। কেনীথ ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই, আনায়া ওর উন্মুক্ত বিস্তৃত পিঠের উপর…মার্কার দিয়ে আঁকাআকি করতে শুরু করে। বাচ্চাদের মতো একের পর এক অদ্ভুত, এলোমেলো ফুল, ফল, গাছ প্রাণী একে নিজেই খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। এভাবে প্রায় অনেকটা সময় কেটে যায়। একইসঙ্গে আনায়াও হাঁপিয়ে ওঠে। আর কিছুই ভাল্লাগছে না। কেনীথের সম্পূর্ণ পিঠের সর্বত্র জায়গা জুড়ে তার আঁকা অদ্ভুত ছবি ফুটে রয়েছে। আনায়া সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অতঃপর আচমকাই কি যেন মনে হতেই সে বিছানা থেকে নামতে ধরে। কিন্তু অকস্মাৎ হাতে টান পড়ায় পেছনে ফিরে তাকায়। কেনীথ তার হাত ধরে রয়েছে। কেনীথ তার নিভু নিভু নিস্তেজ চাহনিতে আনায়ার দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

—“তুমি এখনো ঘুমাওনি?”

—“পাকনামি করে একা একা কোথায় যাচ্ছিস, তা বল।…ওয়াশরুমে যাবি?”

আনায়া খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“নাহ,আচার খাব। আচার আনতে যাচ্ছিলাম।”

—“এতো রাতে আচার…আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এনে দিচ্ছি।”
—“আরেহ,এইটুকু তো আমিই করতে… ”

—“চুপ থাক।”

এই বলেই কেনীথ আনায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে, শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর রুম ছাড়তে গিয়ে, পুনোরায় আনায়ার দিকে পেছন ফিরে বলে,

“কিসের আচার খাবি?”

আনায়া দ্রুত কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,

“আ…তেঁতুলের…এই নাহ,কাঁচা তেঁতুল খাব আমি। ওটাই আনো।”

কেনীথ কিছুটা ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,

“যতদূর জানি,কাঁচা তেঁতুল তো নেই। ওয়েট, আমি ব্যবস্থা করছি।”

এই বলেই কেনীথ কাউকে ফোন করে। নিচ তলায় তাদের কেয়ারটেকার রয়েছে। সে ফোনটা রিভিস করতেই, কেনীথ কাঁচা তেঁতুলের কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সে জানায়, বাসায় কোনো কাঁচা তেঁতুল নেই। এমনিতে তেঁতুলের আচার রয়েছে, সাথে পাকা তেঁতুলও রয়েছে। কেনীথ খানিকটা নিরাশ হয়ে ফোনটা কেটে দেয়। অতঃপর আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“হেই ব্লাড! কাঁচা তেঁতুল তো নেই। পাঁকা কিংবা এমনি আচার খাবি?”

আনায়ার চুপসে যাওয়া অভিব্যক্তিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,”না! থাক আমি কিছু খাব না। আমার ঘুম পেয়েছে, ঘুমাব।”

এই বলেই আনায়ার বলা নেই, কওয়া নেই সোজা বিছানার এককোনায় শুয়ে পড়ে। এদিকে কেনীথ ওর ভাবভঙ্গিতে যা বোঝার বুঝে গিয়েছে। সে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলল,

“কিছুক্ষণ একা থাকতে পারবি?”

—“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

—“একটু কাজ রয়েছে। বেশি না, কিছুটা সময় একটু একা থাক। আমি একটু পরই আসছি।”

এই বলেই, কেনীথ রুমের লাইটটা অফ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।এরপর সোজা নিচে চলে গিয়ে, বাসার গার্ডের সাথে গিয়ে দেখা করে। মধ্যবয়স্ক এক লোক। প্রফেশনাল পোশাকে ক্লান্ত শরীরে বসে ছিল। কেনীথকে দেখা মাত্রই সজাগ হয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়। খানিকটা ভীতু স্বরে বলে ওঠে,

“স্যার আপনি এতো রাতে এখানে? কোনো সমস্যা? ”

কেনীথ সেসবে কোনো পাত্তা দেয়না। লোকটির দিকে একপলক কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকা পর, সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,

“একটা হেল্প করতে হবে। এতো রাতে সুপারশপগুলোতে কাঁচা তেঁতুল পাওয়া যাবে না ,তা জানি আমি। কিন্তু আমার এক্ষুণি কাঁচা তেঁতুল লাগবে। তুমি যেহেতু লোকাল এরিয়ায় থাকো। সেক্ষেত্রে লোকাল কোনো মার্কেটে কি… ”

কেনীথের কথা সম্পূর্ণ হবার আগেই লোকটি খানিকটা হাতাশায় নিমজ্জিত স্বরে বলে ওঠে,

“না স্যার। এতোরাতে কোনোখানেই আপনি তেঁতুল পাবেন না। কিন্ত…”

—“কিন্তু কি?”

কেনীথের এতো উদ্বিগ্নতায় লোকটি খানিক অবাক হয়। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, কেনীথ আনায়ার জন্যই হয়তো এতোরাতে কাঁচা তেঁতুলের সন্ধান করছে।কিন্তু সামান্য তেঁতুলের জন্য তার এতো উদ্বিগ্নতা… সত্যিই অবাক করার মতো। এখানে সে কাজের সূত্রে বহু বছর ধরে থাকছে। আর দিন যতই যাচ্ছে ততই যেন, আগের কেনীথের সাথে এখনকার কেনীথের আকাশ পাতাল তফাত দেখতে পায়।

—“স্যার, আপনি এতো রাতে কাঁচা তেঁতুল কোনো তেঁতুল গাছ ছাড়া আর কোথাও পাবেন না।”

—“তোমার কাছে এমন কোনো তেঁতুল বাগানের সন্ধান রয়েছে? থাকলে প্লিজ, বাগানের ঠিকানা বলো, নয়তো মালিকের ফোন নাম্বার দেও।”

কেনীথের এতো অস্থিরতায় লোকটি ঢোক গেলে। খানিকটা ইতস্ততভাবে বলে,

“স্যার শান্ত হোন। আশেপাশে তেঁতুল বাগান বলতে তেমন কোনো জায়গা আমার জানা মতে নেই। তবে আপনি… এক মিনিট একটা জায়গা আছে! কিন্তু… ”

—“আবার কিসের কিন্তু?”

—“না মানে, একটা ছোট তেঁতুল বাগান আছে। কিন্তু সেটা এখান থেকে প্রায় অনেকটাই দূরে। অবশ্য রাতের বেলায় জ্যাম না থাকায়, গাড়ি দিয়ে তাড়াতাড়িই গিয়ে ফিরে আসা যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো, তেঁতুল বাগানটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ির। আর তার পাশেই ওই বিশাল বড় পুরোনো শ্মশান। দিনের বেলায় বাচ্চা পোলাপানগুলো সারাদিনই তেঁতুল বাগানে নেচে বেড়ালেও, রাতের বেলায় ওদিকে বড়রাও যাবার সাহস পায় না। এই জন্যই বলছিলাম যে…”

কেনীথ লোকটির ভাবভঙ্গিতে যা বোঝার বুঝে যায়।তবে সে সেসবে পাত্তা না দিয়ে, বাগানের ঠিকানাটা নিয়েই, তার গন্তব্যের উদ্দেশ্য গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। তবে যাবার পূর্বে মনে করে একবার লোকটির উদ্দেশ্যে বলে,

“ভেতরে গিয়ে রেস্ট নেও।”

—“কিন্তু স্যার আমার তো আজ…”

—“হুম, জানি আমি সেটা। যদি পারো, তবে তোমার জায়গায় অন্য কাউকে পাঠিয়ে দেও।এবং ওপরে তোমার ম্যাম একা। সবাইকে এলার্ট থাকতে বলো।আর কাজ করতে এসেছো, তাই কাজ করো। কিন্তু এতো বেশি প্রেসার নিয়ে অসুস্থ হবার প্রয়োজন নেই।”

একসাথে এসব বলে কেনীথ চলে যায় তো ঠিকই। কিন্তু এদিকে লোকটির যেন বিস্ময়ই কাটেনা। সে যে কিছুটা অসুস্থ তা কেনীথ কিভাবে টের পেলো? আর কেনীথই কিনা বলছে, ভেতরে গিয়ে রেস্ট নিতে। লোকটি মনে মনে বিস্ময়ের সাথে আওড়ায়,

“এতো পাষাণ মনের মানুষটার এতো উন্নতি? কিভাবে সম্ভব?”

পরক্ষণেই আবার সে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,

“সবই…ঘরে বউ বাচ্চা থাকার জাদু। খোদা এদের ভালো করুক।”

_______

নিস্তব্ধ রজনী। আকাশে জোছনার আলোয় চারপাশটা চকচক করছে। পুরোনো এক লোকাল এড়িয়ায়…রাস্তার কিনায়ায় কালো রঙের গাড়ির সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেনীথ। নজর তার সামনের বিশাল বড় পরিত্যক্ত বাড়ির একপাশের মাঝারি এক তেঁতুল বাগানের দিকে। বাড়িটা আর চারপাশের আবহ…সবকিছুই কেনীথের কাছে নিত্যন্তই কোনো এক হরর মুভির সেটআপ বলে মনে হলো। চারপাশে শীতল হাওয়া বইয়ে। গা ছমছমে পরিবেশ। আধভাঙ্গা বিশাল বড় বাড়ি, আর বাগান রূপের এক পরিত্যক্ত জঙ্গল। ওদিকে আবার খানিকটা কাছেই এক বিশাল বড় শ্মশান।

কেনীথ খানিটা ভারী শ্বাস ফেলে। তাড়াহুড়োয় শুধু একটা টিশার্ট পড়ে আসায়, বেঁধেছে বিপত্তি। ভালোই ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু কেনীথের সেদিকে তেমন হেলদোল নেই। সে দ্রুত সময় নষ্ট না করে বাগানের দিকে এগিয়ে যায়।

এতো রাত করে এখানে আসার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আনায়া ভাবভঙ্গিতে যে কেউ ভাবতে পারে, আজ রাতে সামান্য তেঁতুল না পেলে এমন কি হতো। আনায়া তো আর কোনো জেদ করেনি। তবে জেদ না করাটাই সমস্যা। আনায়া যখন কোনো বিষয়ে জেদ ধরে, তখন সেটা কেনীথের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু চাওয়ার পর হুট করেই নুইয়ে গিয়ে সবকিছু মেনে নেওয়াটাই মূল সমস্যা। কারণ তখন কোনো কিছু না হলেও, পরবর্তীতে আনায়া নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে অদ্ভুত ভাবে কিছু না কিছু পাকিয়ে ফেলে। যে কারণে দু একদিন যেতে না যেতেই সে ভীষণ ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর যা কোনো ঔষধে সারানো সম্ভব হয়না। এইজন্য কেনীথ কোনো রিস্ক নিতে চায়নি। দিন যতই এগোচ্ছে, ততই সতর্ক হতে হবে। তার সামান্য হেলাফেলার জন্য আনায়ার কিছু হোক,তা সে কখনোই চায়না।

এরইমাঝে কেনীথ প্রায় বাগানের মাঝ বরাবর প্রবেশ করে ফেলেছে। হাতে তার ফোনের লাইটটা অন করা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, গাছের ডালগুলোতে, মোটামুটি ভালোই কাঁচা তেঁতুলের থোকা ঝুলছে। কেনীথ কিছুটা স্বস্তিতে ভারীশ্বাস ফেলে। আজকের জন্য অল্প কয়েকটা হলেই চলবে। কাল সকাল হলে আবার, মার্কেট থেকে বেশি করে নিয়ে আসা যাবে। এই ভাবনায় কেনীথ একটা হেলে পড়া নিচু গাছের ডাল টেনে ধরে। এতো রাতে গাছে ওঠার শখ নেই তার।

তবে এরইমাঝে আচমকা এক শিরশিরানি হাওয়ায় তার সর্বস্ব গায়ে শিহরণ বয়ে যায়। কেনীথ খানিকটা সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে আশেপাশে ফিরে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে না পেয়ে, খানিকটা স্বস্তিতে শ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই আবার নিজের কাজকর্মে প্রচন্ড াবাক হয়। কিছুটা বিস্ময় ও বিরক্তির সাথে কপাল কুঁচকে, নিজের উদ্দেশ্য বলে,

“হোয়াট দ্য হেল?আমি কি ভয় পাচ্ছি? এ্য ভি! তোর হয়েছেটা কি? সব মানলাম, তাই বলে এতোটা অধঃপতন?”

সে শুরুতে কিছুটা বিরক্ত হলেও, পরবর্তীতে তাচ্ছিল্যের সাথে আওড়ায়,

“এতো প্যারা নেওয়ার কিছু নেই। এমনিতেও আমার রেড কালারের শাঁকচুন্নি বলেছে, তার নাকি সতীন চাই। প্রয়োজন তেঁতুল গাছ থেকে এবার একটা গ্রীন কালারের শাঁকচুন্নি ধরে নিয়ে যাব। দুটোর মিলবে ভালো।”

নিজের এই ভাবনায় কেনীথ নিজেই অকস্মাৎ হেসে ফেলল। এরপর আর সময় নষ্ট না করে, হাতের মুঠোয় আরো কয়েকটা বড় দেখে তেঁতুল নিয়ে, পুনোরায় গাড়ির কাছে ফিরে এলো। এবার তার গন্তব্য—তার ব্লাডের কাছে যেতে হবে। বেচারি এখন ঘুমিয়ে না গেলেই হলো। যদিও কেনীথ জানে, আনায়া হয়তো এতো সহজে ঘুমাবে না। মনের মধ্যে জিলাপির প্যাচ লাগিয়ে অসুস্থ হতে হবে যে।

_____

কেনীথ ধীর পায়ে রুমের ভেতর প্রবেশ করে। যেভাবে লাইট অফ করে রেখে গিয়েছিল, এখনো সেভাবেই রয়েছে। সে ফোনের ফ্ল্যাশটা অন করে সেজা আনায়ার কাছে যায়। বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। আনায়া গুটিসুটি হয়ে একপাশ হয়ে ঘুমাচ্ছে।

—“হেই ব্লাড! ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

কেনীথের ফিসফিসিয়ে আওড়ানো কথার সুরে, আনায়া কিছুটা চমকে জেগে ওঠে। চোখ মেলে তাকাতেই সামনা-সামনি নজরে আসে, কেনীথের বিস্তৃত হাসিমাখা মুখ। মূহুর্তেই কেনীথ তার হাতে থাকা তেঁতুলের থোকাটা তুলে ধরে বলে,

“এই দেখ,কি এনেছি।”

আনায়া তেঁতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই,আচমকা কেঁদে ফেলে। ওর কান্নাতে কেনীথ কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। টেবিল ল্যাম্পটা অন করতেই আনায়া উঠে বসে। কেনীথও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে,তার পাশে গিয়ে আনায়াকে আগলে নেয়। পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“তারা মাই ব্লাড! কাঁদছিস কেনো? আবার কি করেছি আমি?”

আনায়া কাঁদো কাঁদো স্বরে, কেনীথের বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে বলে ওঠে,

“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? আপনাকে কে করতে বলে এসব? আমি কি একবারও এসবের জন্য বায়না করেছিলাম? আমি তো কোনো জেদও করিনি। তবে কেনো এতো বেশি বুঝতে যান?রাত বিরাতে আমার জন্য আপানাকে এতো ভোগান্তি পোহাতে দেখে, আমার মোটেও ভালো লাগেনা। আপনি সব বোঝেন, অথচ এটা কেনো বোঝেন না?”

কেনীথ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। মনে মনে হাতাশায় নিমজ্জিত স্বরে আওড়ায়,

“জানতাম, বসে বসে এতোক্ষণে পুরে অভারথিংকিরং এর পাহার গড়ে ফেলেছে। এখন কিছু করলেও কথা শোনো, না করলেও কথা শোনো। ব্যাপার না, সয়ে নে ভি। পাঁচটা না, দশটা না, একটামাত্রই বউ তোর।”

আচমকা বউয়ের প্রসঙ্গ আসতেই, কেনীথের কিছু একটা মনে পড়ে। সে ত্বরিত আনায়ার উদ্দেশ্য বলে,

“হুঁশ,ব্লাড! আর কত কাঁদবি? শুন, তোকে একটা বিষয় বলার আছে। জানিস আজ কার দেখা পেয়েছি?”

আনায়ার কান্নার বেগ কিছুটা কমে যায়।সে কেনীথের বুক থেকে মাথা তুলে, তার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়। এরইমাঝে কেনীথও কিছুটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে লাগল,

“আজ তুই সতীনের কথা বলেছিলি না? তো আমি শ্মশানের ঐ পরিত্যক্ত বাড়ির পাশের তেঁতুল বাগানে গিয়ে দেখি, গাছের ডালে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে রয়েছে।”

কেনীথ অভিব্যক্তিতে আনায়া কপাল কুঁচকে যায়।সকল কান্না গায়েব হয় নিমিষেই। প্রচন্ড দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,

“মেয়ে? তেঁতুল খোঁজার নাম করে, কোন মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন আপনি?’

কেনীথ মনে মনে মুচকি হাসে। তবে অভিব্যক্তি তার যথেষ্ট গাম্ভীর্যপূর্ণ।

—” আরেহ আগে আমার কথা শেষ হতে দে। তো কোথায় ছিলাম যেন… ওহ হ্যাঁ। বিশ্বাস কর আনায়া,মেয়েটা এতো সুন্দর…”

আনায়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

“কত সুন্দর?”

—“আরেহ, হেব্বি সুন্দর। দেখলেই, মনটা চায় খেয়ে ফেলি।তোর সতীন হিসেবে একদম পারফেক্ট।”

এটুকু বলেই কেনীথ আড়ালে দাঁত খিঁচে ফেলল। এখনো আনায়া তার হাতের আগলে। তবে কখন কিভাবে চেতে যায়, কে জানে। আর কেনীথের ধারনাটাও হলো তাই। তবে আনায়া একেবারে কান্না জুড়ে দেবার আগেই কেনীথ আবার বলে উঠল,

“আনায়া জানিস, ও কত বেশি সুন্দর। একবার দেখেই তো আমি পুরো পাগল হয়ে গিয়েছি। এখন তোর আপত্তি না থাকলে আমি বরং ওকেই তোর সতীন হিসেবে…”

কেনীথের কথা শেষ হয়না, বরং তার পূর্বেই আনায়া কেনীথের বুকের মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। আর মাঝেমধ্যে আওড়ায়,

“চাইনা আমার সতীন। আমার কোনো সতীন লাগবে না। আমি না হয়, তখন পাগলামি করে সতীনের কথা বলে ফেলেছি। তাই বলে আপনি সত্যিই…এ্যায়য়য়য়য়য়য়।”

এই বলেই আনায়া আবারও কাঁদতে শুরু করে। এদিকে কেনীথ শুরু থেকেই মিটমিট করে শয়তানিতে হাসিতে মুচকি মুচকি হাসছে।

—“কিহ! সতীন চাইনা? আমি তো আরো…উফ এখন কি হবে? মেয়েটার কত সুন্দর, ঠোঁট; পুরো বেগুনের মতো লাল। চুলগুলো কত বড় বড় বিশাল। কান আর নখগুলোও বড় বড়। চোখগুলো লাল টকটকে। তবে বাকিসব কিছু গ্রিন কালারের। তোর এতো সুন্দর একটা সতীন হলে কিন্তু মন্দ হয়না। এখনো সময় আছে, ভেবে দেখ।

আনায়া এবার কেনীথের দিকে মুখ তুলে তাকায়।কান্না থামিয়ে দিয়ে, গাল ফুলিয়ে বলে,

“মজা করছেন আপনি?”

—“আরেহ মজা করব কেনো? এখন আমার একটা রেড কালারের শাঁকচুন্নি আছে।ওটাকে ধরে এনে তোর সতীন বানালে,তখন তো আমার একটা গ্রীন কালারেরও শাঁকচুন্নি হয়ে যাবে। এমনটা হলে মন্দ হয় না কিন্তু।”

আনায়া চোখমুখ ছোট করে কেনীথের থেকে দূরে সরতে চায়। কিন্তু কেনীথ ওকে যেতে না দিয়ে, নিজের সাথেই আগলে রাখে।

—“কি হলো, আবার রাগ করছিস কেনো?”

—“আমাকে কাঁদাতে আপনার ভালো লাগে তাই না?”

কেনীথ খানিকটা মুচকি হাসে। পরবর্তীতে হাসি থামিয়ে বলে,

“মিথ্যে বলব না, তবে…তোর মাথার ভেতর থেকে এসব উৎপটাং ভুতগুলো বের করতে ভালোই লাগে।”

আনায়া গাল ফুলিয়ে কেনীথের হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে আবার কেনীথ তার লাগে দুআঙুলে চাপ দিয়ে, বাতাস বের করে দিয়ে বলে,

“হয়েছে আর বেলুনের মতো ফুলতে হবে না। এভাবে ফুলতে ফুলতে একদিন আকাশেই উড়ে যাবি।”

—“চিন্তা নেই, আপনি আবার আমায় টেনে নিচে নামিয়ে আনবেন।”

এই বলেই আনায়া খিলখিল করে হেসে উঠল।ওদিকে কেনীথ আনায়ার হাতে তেঁতুলগুলো খাওয়ার জন্য ধরিয়ে দেয়। কেনীথ সেগুলো ধুয়েই রুমে নিয়ে এসেছে। আনায়া তেঁতুল খেতে খেতে আবারও বলল,

“শুনুন! আমার কোনো সতীন মতীন চাই না। আরেকবার যদি এসব মজাও কখনো করেছেন…সবগুলো সতীনের হাড়গুঁড় ভেঙে আপনার হাতে ধরিয়ে দেব।মনে যেন থাকে।”

কেনীথ শুধু কিছুটা মুচকি হাসল।—“জ্বি ম্যাম,আপনার কোনো সতীনও চাইনা,কোনো মতীনও চাই না। তাই তো?”

—“হুহ্!”

ওদিকে আনায়া আবারও কেনীথের উদ্দেশ্য বলল,

“আপনার একা একা ওমন জঙ্গলে যেতে ভয় লাগল না?”

কেনীথের খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,

“ভয়? তাও আবার আমি? সিরিয়াসলি?”

কেনীথের এতো ভাব দেখে আনায়া মুখ ভেংচিয়ে বলে,

“এ্যাহ, হয়েছে এতো ভাব ধরতে হবেনা। সব জানি আমি।”

কেনীথ কিছুটা কপাল কুঁচকে বলে,

“কি জানিস তুই?”

আনায়া খানিক মুচকি হেসে বলে,

“এই যে, ছোট বেলায় তুমি… কবে কোথায় কি দেখেছিলে, আর তাতেই তিনদিন নাকি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলে। আবার ভুতের ভয়ে একা একা বাথরুমেও যেতে পারতে না।”

এই বলেই আনায়া হাসতে লাগল। এদিকে কেনীথ আরো খানিক গাম্ভীর্যের সাথে বলল,

“এসব কে বলেছে তোকে?”

—“কে আবার, পাভেল ভাই বলেছে। ছিহ্,কতটা ভীতু ছিলে তুমি।”

এরপরই শুধু হয় আনায়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠার শব্দ। ওর হাসি যেন থামবার কোনো নামই নেই। এদিকে কেনীথের চোখমুখ কুঁচকে গিয়েছে। খানিকটা বিরক্তির সাথে বলে উঠল,

“ওমনটা ছোট বেলা সবাই একটু আকটু…আমিও ছিলাম, তাতে কি এসে যায়?”

—“হুম সেটাই তো, একা একা বাথরুমেই যেতে পারতে না। কত সাহসী বর আমার।”

—“আমি না হয় ভীতু ছিলাম, একা একা বাথরুমে যেতে পারতাম না।কিন্তু তুই যে বড় হয়েও বিছানাতেই হিসু করতিস! তার বেলায় কিছু না?”

নিমিষেই আনায়ার হাসি থেমে গিয়ে চোখমুখ গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢেকে যায়। আনায়ার থমকে যাওয়ায়, কেনীথ মিটমিট করে হাসতে লাগে। এদিকে কেনীথের মিটমিট করে হাসতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, আচমকা আনায়া তার মুখ বরাবর ঘুষি মা”রে। নিমিষেই কেনীথের চোখমুখ ব্যাথায় কুঁচকে যায়।ঘুষিটা সোজা তার নাকের পাশে এসে লেগেছে।সে নিজেকে কোনোমতে সামনে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠে,

“শালী, মারিস কেন?”

—“শালা, মারব না তো কি করব? আমি কি বড় হইনি? এসব কথা কেউ বলে? আমার লজ্জা করেনা? একটুও হুঁশ আক্কেল নেই, বলদ একটা!”

__________

ভারী শরীরে আনায়া ছোটাছুটি করছে। কোনোমতেই খাবার খাবে না। খাবারের নাম শুনেই তার গা গুলিয়ে আসে। দেখতে দেখতে আরো অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। আনায়া শরীর ফুলে ভারী হয়েছে। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতেও প্রচন্ড অসুবিধা হয়। কেননা তার গর্ভাবস্থার কারণে এখন তার পেট যথেষ্ট উঁচু হয়ে ফুলে উঠেছে। বাচ্চার নড়াচড়া কিংবা হুটহাট লাথি দেওয়া…সবাই এখন স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। ডক্টরের বলা ডেলিভারি টাইমিং অনুযায়ী আরো প্রায় এক মাসের মতো সময় রয়েছে। কিন্তু এই এক মাস তাকে যথেষ্ট কেয়ারফুল থাকতে হবে। কেনীথ তার দিক থেকে সর্বচ্চ চেষ্টা করলেও, আনায়া হয়েছে এক নাছোরবান্দা। সবকিছুতেই তার তালবাহানা। আর খাবারের বেলায় তো কোনো কথাই নেই। সোজা পালিয়ে বেড়াবে এমন অবস্থা।

আজও ঠিক তাই হয়েছে। হুট করেই বিকেল বেলায় বায়না ধরেছে, আজ সে সাজবে। শাড়ী পড়বে, গহনা পড়বে, এরপর একদম সুন্দরমতো নতুন বউ হয়ে সেজে থাকবে। কেনীথও তার কথা মতো নিজ হাতেই তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। হালকা একটা নীল রাঙা সুতি শাড়ী আর কিছু হালকা অর্গামেন্টস্ এর ব্যবস্তা করেছে। নীল শাড়ির কথা অবশ্য আনায়াই বলেছে। তার শখ জেগেছে, আজ সে নীল পরির মতো নতুন বউ হবে।

#একজোড়া_আগুন_পাখি
পর্ব —৪১ (২য় অংশের শেষভাগ)

বিকেলের শেষভাগে কেনীথ আনায়াকে ঠিকঠাক সাজানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। শাড়িটা ঠিকঠাক পড়িয়েছে। ফুলে ওঠা মস্ত বড় পেটটায়, শাড়ির প্রতিটা ভাজও প্রচন্ড সাবধানতার সাথে গুঁজে দিয়েছে। আপাতত ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক আর চোখে কাজল লাগিয়ে দিয়ে, চুলগুলো ভালো ভাবে খোঁপা করে দেয়। এরপর বারান্দা থেকে কয়েকটা বেলীফুল এনে আনায়ার খোপায় আলতোভাবে গেঁথে দেয়। এই বেলীফুলের দুটে গাছ বারান্দায় কেনীথ নিজেই লাগিয়েছে। বাগান করাটা তার বরাবরই পছন্দের। আর বেলী যেহেতু আনায়ার পছন্দের, সেক্ষেত্রে তো আর কোনো কথাই নেই।

আনায়ার সাজগোছ শেষ। খুব সাদামাটা হলেও, গর্ভাবস্থায় তার সৌন্দর্য এক অনবদ্য রূপে ধরা দিয়েছে। কেনীথ খানিকটা বিস্তৃত হেসে আনায়া কপালে আলতোভাবে চুমু খায়। এরপর সে নিজেও একটা নতুন কালো টিশার্ট আর প্যান্ট পড়ে নেয়। কিন্তু আনায়া এখানেও জেদ ধরে। আজ কালো নয় বরং সাদা কিছু পড়তে হবে তাকে। কেনীথ বাধ্য হয়েই, সেই সাদা শার্টটা পড়ে নেয়। নয়তো তার এ ব্যতীত একটা সাদা টিশার্ট পর্যন্তও নেই।

সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। চুলগুলো গুছিয়ে অর্ধেকটা বেঁধে নেয়। কিন্তু এরইমাঝে বাঁধে নতুন বিপত্তি। কেনীথ রেডি হয়ে নিলে,আনায়া আচমকা তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই জিজ্ঞেস করে বসে,

“তুমি সবসময় কালো ড্রেস কেনো পড়ো?”

অন্য সময় হলে কেনীথ প্রশ্নটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিতো। তবে আনায়া প্রেগ্ন্যাসির পর সে তার কোনো কথাই ফেলতে পারেনা। কেনীথ মনে মনে কিছুটা ইতস্তত হলেও, মুখে স্বাভাবিক স্বরে বলল,

“এমনিতেই। হয়তো এটা আমায় শান্ত রাখে। নয়তো আমার ভেতরটা যে এরচেয়েও বেশি অন্ধকার।”

আনায়া কেনীথের কথা বোঝেনা। বরং বোঝার চেষ্টাও করেনা। সে কপাল কুঁচকে কেনীথের দিকে একপ্রকার তেড়ে আসে। কেনীথ ওর ভাবগতিকে কপাল কুঁচকে ফেলে। এদিকে আনায়া ওর শার্টের আশেপাশে ভালোমতো নজর বুলিয়ে বলল,

“প্লিজ কথা ঘুরাবে না! সত্যি করে বলো তো!”

—“কি সত্যি বলব? যা বলার তাই তো বললাম।”

—“মিথ্যে বলছ তুমি। আমি জানি তুমি কেনো কালো ছাড়া অন্যকোনো রঙের ড্রেস পড়ো না।”

কেনীথ নিজেও কিছুটা হতভম্ব হয়ে বলে,

“কেনো পড়িনা?”

—“এই কারণেই পড়ো না যাতে…যাতে করে তুমি কোনে আকাম কুকাম করলেও আমি বুঝতে না পারি।”

—“মানেহ্?”

—“আগে এটা বলো, তোমার কোনো জামায়, কেনো কোনো মেয়ের, লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁটের ছাপ পাওয়া যায় না?… কারণ তুমি সবসময় কালো ড্রেস পড়ো। কালো কাপড়ে লিপস্টিকের দাগ কেনো, আরো অন্যকিছু লাগলেও তো আমি বুঝতে পারব না। আমি জানি, তুমি অনেক চালাক। এসব তুমি চালাকি করেই করো। কিন্তু আমি আজ তোমার সব চালাকি ধরে ফেলেছি।

আনায়ার কথা শুনে কেনীথ চোয়াল ঝুলে পড়ার মতো উপক্রম। হতবাক হয়ে অপলক সে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। এদিকে আনায়া চুপচাপ তাকিয়ে থাকতে থাকতেই প্রায় কেঁদে ফেলবে, এমন অবস্থা। একে তো কাজল দেওয়া চোখ। আর এমন বাহিরে যাবার মূহুর্তে সে আবার কান্নাকাটি শুরু করলে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে যাবে। কেনীথ নিজেকে কোনোমতে সামলে, আনায়াকে দু’হাতে আগলে নেয়।

—“হেই ব্লাড! কিসব বলছিস? আমি না সর্বক্ষণ তোর সাথেই থাকি? অন্য কোনো মেয়ের কাছে গেলামটা কখন আমি?”

—“তার মানে আমি না থাকলে,তুমি ঠিকই যেতে?”

—“আরেহ,আমি এটা কখন বললাম। আমি বলছি যে…আচ্ছা শুন, তুই যদি আমাকে কখনো কিস-ই না করিস। তবে আমার জামায় লিপস্টিকের দাগটা পাবি কিভাবে? তুই ছাড়া আমি দূরদূরান্তরেও কোনো মেয়ের আশেপাশে যাই না।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া কিছু একটা ভাবতে শুরু করে। পরবর্তীতে হুট করেই মুচকি হেসে বলে,

“আমি করে দেই?”

—“কিহ্?”

—“কিস!”

—“সত্যিই? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। আজ চাঁদ কি মঙ্গল গ্রহে উঠবে?”

কেনীথের কথা শুনে আনায়া খিলখিল করে হেসে উঠল। এরইমাঝে আনায়া আচমকা কেনীথের শার্টের একপাশের কলারে, তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। নিমিষেই হালকা লিপস্টিক মাখানো ঠোঁটের স্পষ্ট ছাপ তাতে একে যায়। কেনীথ আয়নায় ভালোমতো একবার নিজেকে দেখে নিয়ে বিস্তৃত মুচকি হাসে। আনায়া কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,

“চল, এবার যাওয়া যাক। ”

আনায়া একবার ফুঁপিয়ে ভারী শ্বাস ফেলে,বাচ্চাদের মতো করে বলে,

“হুম, কিন্তু প্লিজ। তুমি আমাদের বেবি না আসা পর্যন্ত কখনো ওসব কাজ করবে না। ঠিক আছে?”

নিমিষেই কেনীথের চোখ মুখ চুপসে যায়।একে এতো বুঝিয়ে লাভটাই বা কি!

—“তার মানে, বেবি আসার পর আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারি? তখন তুই কিচ্ছু বলবি না?”

—“এ্যাহ,মামার বাড়ির আবদার নাকি? তখন আমি সুস্থ হয়ে যাব। উল্টো পাল্টা কিছু করতে গেলে, ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে মার”ব।সাথে আমার ছেলে নয়তো মেয়েও থাকবে। তাই বলছি, আগে বেবিটা হয়ে যাক।”

আনায়ার হুট করেই এমন তেজ দেখানোতে,কেনীথ অকস্মাৎ হেসে উঠল। মাথার মধ্যে আলতোভাবে টোকা দিয়ে বলল,

“পাগলি একটা!— তবুও আমার।”

অতঃপর প্রশান্তিতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আনায়াকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে, বাসা থেকে বেড়িয়ে যায়।

অনেক দিন হতেই আনায়া ঘুরতে যাওয়ার জন্য বায়না করছিল। আজও করেছে। তাই কেনীথ হাতে সময় নিয়েই তাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছি। এরমধ্যে গত কিছুদিন আগেই তারা রাশিয়া হতে ঘুরে এসেছে। বেশিরভাগ সময় এখন ওখানেই থাকা হয়। মাঝেমধ্যে আনায়ার ইচ্ছে মতো আবার দেশে ফিরে আসে। এছাড়া আনায়ার ডেলিভারিও রাশিয়াতেই করানোর সিন্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমনিতেও, এখানে তারা ব্যতীত আর তেমন কেউই নেই।

লিফটের কাছে এসে আনায়া বায়না ধরে, সে লিফটে যাবে না। ওখানে নাকি তার দমবন্ধ লাগে।তাই সে সিঁড়ি দিয়ে নিজেই হেঁটে হেঁটে যাবে।এই জেদ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে একাই নামতে চাইলে… কেনীথ কঢ়া স্বরে বলে ওঠে,

“লিফটে যাবি না, ভালো কথা। কিন্তু পাকনামি করে, সিঁড়ি দিয়ে একা একা নামতে কে বলেছে?”

কেনীথের কথা শুনে আনায়ার মুখ চুপসে যায়। এমনিতেই দিনে দিনে চেহেরা ফুলে বেলুনের মতো হয়ে গিয়েছে। তার উপর রাগে গাল ফোলানোতে, গাল দুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়।যা দেখে কেনীথ আচমকা হেসে ফেলে। দু’হাতের দু’আঙুল দিয়ে দুগালে আচমকা চাপ দিতেই, আনায়ার মুখ থেকে বাতাস বেড়িয়ে যায়।আনায়া রেগে গিয়ে কেঁদে ফেলবে ঠিক এমন মূহুর্তেই, কেনীথ আচমকা আনায়াকে কোলে তুলে নেয়।

“শক্ত করে ধর।”

কেনীথের কথা শোনামাত্রই আনায়া ওর গলা দুহাতে পেঁচিয়ে ধরে। আপাতত কান্নাকাটি করার মতো সময় নেই তার। কেনীথ অত্যন্ত সাবধানতার সাথে তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে। আনায়া কেনীথের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। কখনো বা বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে নাক, কপাল ঘষছে। ওর কান্ড দেখে, কেনীথ নিজেও খানিকটা মুচকি হেসে ফেলে।

____

হাঁটতে হাঁটতে কেনীথ আনায়াকে নিয়ে পার্কের কাছে চলে এসেছে। সামনেই একটা ছোট অর্নামেন্টাল লেক রয়েছে। দেখতে অনেকটা পুকুরের মতোই। চারপাশে কিছু কৃষ্ণচূড়া,জারুল, সহ আরো কিছু ছোট বড় ফুল ফলের গাছ রয়েছে। বসন্তের আগমনে মোটামুটি সব গাছেই টাটকা ফুলে পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে। যার সুবাস নিত্যন্তই মনোমুগ্ধকর।

কেনীথ আনায়াকে নিয়ে লেকের পাড়ে, একটা বেঞ্চের মাঝে সাবধানে বসিয়ে দেয়। অতঃপর সে নিজেও গিয়ে তার পাশে বসে পড়ে। আর আনায়া তৎক্ষনাৎ কেনীথের বাহু দু’হাতে আঁকড়ে, কাঁধে মাথা ঠেকায়। কেনীথ কিছুটা বিস্তৃত হেসে বলে,

“ভালো লাগছে?”

আনায়া লেকের দিক থেকে নজর সরিয়ে, কেনীথের দিকে তাকায়। খানিকটা বিস্তৃত হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়,

“হুম!”

কেনীথ আনায়ার কপালে আলতোভাবে চুমু খায়।আশেপাশে লোকজন তেমন নেই। ভিআইপি জোনের মানুষ জীবনের আনন্দের চেয়ে কাজের মাঝেই বেশি সীমাবদ্ধ থাকে। তাদের দিনরাত কাজ আর নামি-দামি বিলাসবহুল জীবনই তাদের সব। প্রকৃতির মাঝে আনন্দ খুঁজে নেবার মতো সময় কিংবা শখ…খুব অল্প মানুষেরই রয়েছে।

দু’জনে চুপচাপ বসে বসে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানে বসে থাকা ব্যতীত, করার মতো তেমন কিছুই নেই। আচমকাই সে কি যেন ভেবে মুখ ফসকে বলে ফেলে,

“আইসক্রিম খাবি?”

কেনীথ এটা বলেই যেন হতভম্ব হয়ে যায়। আনায়ার এই অবস্থায় ঠান্ডা না খাওয়াই উত্তম। কিছুদিন আগেও এই আইসক্রিম খাওয়ার জেদ করে তার ঠান্ডা লেগে গিয়েছিল। আজ কদিন হলো এই নেশা ভুলে গিয়েছে…আর আজ কিনা কেনীথ নিজেই এটা ওকে মনে করিয়ে দিল?

কেনীথ খানিকটা ঢোক গিলতেই, আনায়া উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,

“হুম! হুম! খাব আমি আইসক্রিম।”

—“আনায়া শুন, আমি বলছিলাম যে…”

—“কোনো কথা শুনতে চাইনা। প্লিজ এনে দিন না। যাস্ট একটাই খাব।আজ কিন্তু আপনি নিজেই বলেছেন। ঐ ঠান্ডা লাগার পর থেকে আপনি আমাকে আর একটা আইসক্রিমও খেতে দেননি।”

আনায়া কাঁদো কাঁদো স্বরে কথাটা বলতেই, কেনীথ হাতাশায় দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এখন আর বুঝিয়ে লাভ নেই। একবার যখন বলেছে খাবে, তখন খাবেই। মানা করলে না জানি, এখানেই কেঁদে ম’রে।

—“আচ্ছা তবে তুই থাক। আমি ক্যান্টিন থেকে এখনই আইসক্রিম নিয়ে আসছি।”

এই বলে কেনীথ ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে এগোতে থাকে। তবে যাওয়ার মাঝেই পেছন ফিরে আরো একবার আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,

“চুপচাপ ওখানেই বসে থাকবি। নয়তো আইসক্রিম পাবি না।”

—“চিন্তা নেই, আমি এখানেই থাকব।”

—“হুম, তাই যেন হয়।”

___

কেনীথ একটা কোন আইসক্রিম নিয়ে লেকের দিকে এগিয়ে এলো। লেক থেকে ক্যান্টিন প্রায় অনেকটা দূরে। আইসক্রিম কিনতে গিয়ে সে দুটো কিনতে চেয়েছিল…একটা তার, আরেকটা আনায়ার।তবে কি যেন ভেবে, পরবর্তীতে একটাই নিয়ে এসেছে। এদিকে লেকের কাছে এসে দেখে বেঞ্চে আনায়া বসে নেই। এমনকি আশেপাশে কোথাও তার দেখা নেই। নিমিষেই কেনীথের ঘাম ছুটে যায়। এতো করে বলে গেল,যেন একা একা কোথাও না যায়। আর এই অল্প একটু সময়ের মাঝেই সে হাওয়া?

কেনীথ এদিকে পাগলের মতো ছুটে আনায়াকে খুঁজতে শুরু করে। কোথাও তার দেখা নেই। অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই সে ঘেমে একাকার হয়ে যায়। এরইমধ্যে তার নজর পরে খানিকটা দূরের জারুল গাছের নিচে। হালকা নীল শাড়ি পড়া গোলগাল গরনের এক নারী, হাত বাড়িয়ে জারুলের হেলে পড়া ডাল থেকে ফুল নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভারী শরীর নিয়ে, পা উঁচিয়ে শত চেষ্টা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কেনীথ ওর কার্যকলাপ দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। একহাতে মাথার চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে, ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

বেগুনি রঙের এক থোকা জারুল ফুল, নিচের দিকে নুইয়ে পড়েছে। আনায়া একটুর জন্য তা ধরতে পারছে না। সেই কখন থেকে চেষ্টা করছে তবুও কাজ হচ্ছে না। নিমিষেই বিরক্তিতে তার মেজাজ বিগড়ে যায়।চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। কি যেন ভেবে একবার লাফ দেওয়ার সাহস যোগায়। সে লাফ দেওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন, এমন অবস্থায় পেছন থেকে একটা বড়সড় বলিষ্ঠে হাত তাকে আবদ্ধ করে নেয়। আনায়ার আর বুঝতে বাকি নেই, এটা কেনীথ ছাড়া আর কেউ নয়। আনায়ার হুঁশ ফিরতেই খানিকটা ঢোক গেলে। কেনীথ তাকে বলেছিল, তাকে না বলে যেন সে কোথায়ও না যায়। কিন্তু সে সেই খেয়াল হারিয়ে একা একাই এখানে চলে এসেছে। নিশ্চিত তাকে অনেকক্ষণ ধরে কেনীথ খুঁজেছে। কেননা কেনীথের বিধ্বস্ত হৃদয় স্পন্দন আনায়ার স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে।

এদিকে কেনীথ ডান হাতে থাকা আইসক্রিমটা আনায়ার হাতে ধরিয়ে দেয়। হাত বাড়িয়ে জারুল ফুলের থোকাটা ছিঁড়ে তার সামনাসামনি ধরে। আনায়া কোনো কথা না বলে, পেছন ফিরে কেনীথের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো চোখে, কেনীথের বিধ্ব”স্ত চেহেরাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেনীথ কিছুই বলে না, কিন্তু আনায়া নিজ থেকেই হাত বাড়িয়ে, কেনীথের বুকের বা’পাশে নিজের হাতের তালু চেপে ধরে। ওমনিই কেনীথের এলোমেলো হৃৎস্পন্দন যেন আরো দৃঢ়ভাবে অনুভব করে। আনায়া খানিকটা ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,

“সরি! আমার মনে ছিল না…”

—“আমি তোকে কিছু বলেছি?”

আনায়ার নাকের পাটা ফুলে যায়। চোখ পানি এসে ভীর জমায়।কেনীথ কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, আনায়াকে দু’হাতে আগলে জড়িয়ে ধরে। আনায়াও কেনীথের বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে।এদিকে কেনীথ তার মাথায় নিজের চোয়াল ঠেকিয়ে বলে,

“খবরদার একটুও কাঁদবি না। এতো কাঁদলে তো মানুষ তোকে ছিঁচকাঁদুনে বলে ডাকবে।”

—“বলুক! মানুষ আমাকে এসব বললে আপনি ওদের মুখ, ঘুষি মে”রে ফাটিয়ে দেবেন।”

—“আর যদি এমনটা আমিই বলি?”

আনায়া এটা শোনামাত্রই নিমিষেই নিজের কান্না থামিয়ে, মুখ তুলে কেনীথের দিকে তাকায়। কেনীথের হাসিমাখা মুখ দেখে, আনায়া ওকে ছেড়ে দিয়ে, জোরে কান্না করা শুরু করে দেয়।

“করবো না আমি আপনার সংসার।চলে যাব আমি।”

ুই বলতে বলতেই আনায়া একা একা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে।আর কেনীথ পেছন থেকে ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে,হেসে ফেলে। চাপা স্বরে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে,দ্রুত পায়ে হেটে, আনায়ার সামনে গিয়ে আবারও ওকে আগলে জরিয়ে ধরে।

—“কিছু হলেই বলে সংসার করবে না। এমনটা হলে, কি করে হবে? তুই না বলেছিলি দুটো টিম বানাবি। একটা তোর, আরেকটা আমার। কেবল তো একটা আসছে। যদি আমার সংসারই না করিস, তবে বাকিগুলোর কি হবে শুনি?”

আনায়া তবুও কিছু বলে না। এখনো কেনীথের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। কেনীথ খানিকটা চাপা স্বরে হেসে নিয়ে বলে উঠল,

“আচ্ছা সরি, আর এমন মজা আর করব না। আমি কি তোকে ছিঁচকাঁদুনে বলতে পারি নাকি? ছিহ্,তোকে এসব বললে তো আমার ঘোর অন্যায় হবে। আমি কখনোই তোকে এসব বলব না,প্রমিজ।”

নিমিষেই আনায়ার কান্না থেমে যায়।সে মুখ উঁচিয়ে কেনীথের দিকে হাসি মুখে তাকায়। পরবর্তীতে আবার কি যেন ভেবে হাসি গায়েব করে বলে,

“আমি আপনার সংসার করব, তবে একটা শর্ত আছে।”

-কেনীথ ভ্রু কুঁচকে বলে,”কি?”

—“আমাকে এখন থেকে প্রতিদিন অনেকগুলো করে আইসক্রিম খেতে দিতে হবে।”

আয়ানার কথা শোনা মাত্রই কেনীথ ওকে ছেড়ে দেয়। খানিকটা দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে,

“প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে বরং আমিই তোর সংসার করব না। এই দে,আমার আইসক্রিম দে।”

—“সংসার করবেন না, ভালো কথা! আইসক্রিম কেনো চাচ্ছেন? আইসক্রিম দেব না আমি।”

কেনীথ আইসক্রিম নিতে এলে, আনায়া ঠোঁট উল্টে সেখান থেকে চলে যেতে লাগে। কেনীথ গিয়ে ওকে খপ করে ধরে বলে,

“এই আস্তে! পড়ে যাবি। না জানি কপালে কি আছে। মায়েই এমন বিচ্ছুর মতো ছোটাছুটি করে। আমার মেয়ে তো তবে এর চেয়েও বড় বিচ্ছু হবে।”

—“আপনি দেখে নিয়েন, আমার ছেলে হবে।আর ও বিচ্ছু হবে না। বরং আপনার মতো অনেক সুন্দর হবে।”

—“হুম,তা সময় এলেই দেখা যাবে। এখন আমাকে আগে আইসক্রিম দে। আমি খেয়ে তারপর তোকে দেব।”

আনায়া চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,

“মানে? আমি কেনো আমার আইসক্রিম দেব? একটা আইসক্রিমই এনেছেন।এখন আবার এটারও ভাগ চাইছেন? এতোই যখন খেতে ইচ্ছে করে,দুটো কেনো আনলেন না তবে?”

—“ছিহ্ তারা! তুই যে এতোটা কিপট, তা জানা ছিল না।”

—“হুম, হুম, সব জানি আমি। আমি যেন কম খেতে পারি তাই আপনি ইচ্ছে করেই একটা এনেছেন। আবার এখন আমাকেই কিপটে বলছেন।”

আনায়ার ধারনা ভুল নয়। কেনীথ এই ভাবনাতেই মূলত দুটোর জায়গায় একটা আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। কেনীথ কিছুটা হেসে বলল,

“হিসেবে তো আমার পুরোটাই খাওয়ার কথা। আমি না তোর বর লাগি? আমি খেলেই তো, তোর খাওয়া হয়ে যাবে।”

আনায়া আইসক্রিম খেতে খেতে চোখ ছোট ছোট করে জবাব দেয়।

—“কচু লাগেন!… তাও একটু দয়াধর্ম করে দিলাম।এই নিন!”

এই বলেই আনায়া কেনীথের মুখের কাছে আইসক্রিমটা ধরতেই, কেনীথ এক বাইট নিয়ে বিস্তৃত হেসে ফেলল। এভাবে দুজন খেতে খেতে আবারও নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তবে এরইমাঝে কেনীথের নজর ফুল গাছের দিকে পড়তেই, সে আনায়াকে দাড় করিয়ে খানিকটা কাছে থেকেই কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া আর কয়েক রংএর জারুল ফুলের গুচ্ছ… একসাথে লতা দিয়ে বেধে আনায়ার কাছে নিয়ে আসে। এরপর তা আনায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, পকেট থেকে ফোনটা বের করে দুজন মিলে দুটো সেলফি তুলে নেয়। যার একটাতে আনায়া লজ্জামাখা মুখে কেনীথের গালে আচমকা চুমু খেয়েছে।

কেনীথ সাধারণত ছবি তোলেনা। কিন্তু আজ হঠাৎ অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে। যে কারনে সে আর কোনো কিছুতেই নিজেকে বাঁধা দেয়না।

আনায়া কেনীথের বাহু জড়িয়ে ঘেঁষে রয়েছে। কেনীথের হাতে তার পরনের জুতো জোড়া। সবুজ ঘাসের উপর হাঁটবে বলেই তার বায়না। কেনীথও আর মানা করেনি। নিজ হাতে জুতো জোড়া খুলে, তুলে নিয়েছে। আর এখন দুজন মিলে মৃদু পায়ে হেঁটে যাচ্ছে।

বিকেল গড়িয়ে, সন্ধায় নেমে এসেছে। চারপাশ হতে সূর্যের আলো দমিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে হলুদ লাল আভায় নীল আকাশটা মিলিয়ে যাচ্ছে। আর এদিকে লেকের পাড় ঘেঁষে, একজোড়া লাভ বার্ডস্ চলেছে, তাদের নিজ বাসার গন্তব্যে।

#চলবে______________

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
পর্ব—৪১(৩য় অংশ)

🐞সারপ্রাইজ নামক উত্তে”জনা মূলক পর্ব

আনায়া কিচেনে রান্নার কাজে ব্যস্ত। এদিকে কেনীথ ড্রইং রুমের ফ্লোরে বসে বসে অরিনের সাথে খেলা করছে অরিন এখন হাটাহাটি করে অনেকটাই হাঁটতে শিখে গিয়েছে। মাথার লাল রাঙা চুলগুলো ঘাড় পর্যন্ত হয়েছে। টুকটাক কথা বলতেও পারে। তার শেখা প্রথম শব্দ ছিল ‘পাপা’ আনায়ার সুযোগ হয়নি, নিজের মেয়েকে প্রথমে ‘মা” ডাক শেখানোর। কেননা, কেনীথ শুরু থেকেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল—যেভাবেই হোক, মেয়ে আগে তার বাপকেই ডাকবে। আর সে এই যু’দ্ধে সফলও হয়।

কেনীথ দুহাত ছড়িয়ে,অরিনের উদ্দেশ্যে অনবরত ডেকে চলছে।

—-“পাপা!পাপা!পাপা! লেডিবাগ, এদিকে এসো!”

কেনীথের কথা শুনে অরিন খিলখিল করে হেসে ওঠে। অরিন হাঁটি হাঁটি করে কেনীথের দিকে এগিয়ে এলো। অস্ফুটস্বরে হেসে বলে,

“পা…পা!”

এই বলে না বলতেই— অরিন কেনীথ বুকে চলে আসতেই, কেনীথ জাপ্টে তাকে জড়িয়ে ধরে।এরপর দুজনে মিলে, আবারও চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খেলনা দিয়ে—খেলতে শুরু করে
কেনীথ একপাশ হয়ে ফ্লোরে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ে,মাথার কাছে একহাত ঠেকায়। ওদিকে অরিন বসে বসে খেলনা দিয়ে খেলছে। কিন্তু কেনীথের ধ্যাহ জ্ঞান ভিন্ন দিকে। ভেতরে অদ্ভুত এক অস্বস্তি হচ্ছে। রান্নাঘরের দিকে কয়েকবার তাকিয়ে, আনায়ার কাজকর্ম দেখে। পরক্ষণেই বিরবির করে আওড়ায়,

“শা’লী ঠ্যাংওয়ালা চেংরীর—এখনও কাজকর্ম শেষ হয়না। এদিকে যে আমি, তার বিরহে সকাল থেকে শুঁকিয়ে শুঁকিয়ে আধমরা হচ্ছি—তা দেখবে কে শুনি? নিয়ম করে, বেলায় বেলায় দশ-বারোটা চুমু দিয়ে গেলেও তো—একটু-আধটু এনার্জি পাওয়া যায়।”

কেনীথ আর স্থির হয়ে থাকতে পারল না। ঠিকঠাক মতে উঠে বসে, অরিনের আশেপাশে বেশি করে কয়েকটা খেলনা সাজিয়ে দিয়ে — অরিনের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করে বলল,

“হেই লেডিবাগ! আমি তোমার মাম্মামের কাছে যাচ্ছি।তোমার পাপার,এক্ষুনি কিছু এনার্জি ডোজের প্রয়োজন। তুমি সাবধানে থেকো।”

অরিন কি বুঝল তা সেই জানে। খিলখিল করে হেসে সে নিজের খেলায় ব্যস্ত হলো। এদিকে কেনীথ অরিনকে ওভাবে রেখেই, একপ্রকার ছুটে
রান্নাঘরে চলে যায়।

গিয়েই দেওয়ালেন সাথে হেলান দিয়ে, বুকে হাত গুজে—আনায়ার কাজকর্ম দেখতে লাগে। আনায়া মাংস কষাতে ব্যস্ত। কপালের আশেপাশে মৃদু ঘাম জমে গিয়েছে। এদিকে কেনীথ কিছুক্ষণ সময় তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল,

“এ্যাই বউ! ক্ষিদে পেয়েছে।”

আনায়া কেনীথের দিকে তাকায় না। মেজাজ তার এখন নিত্যন্তই কঢ়া। কাজ শেষে গোসলের পর হয়তো ঠান্ডা হবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত সে পুরো অগ্নিকুণ্ডের ন্যায় জ্বলবে। আনায়া নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে,গাম্ভীর্যের সাথে জবাব দেয়,

“রান্না এখনো শেষ হয়নি।”

কেনীথ ওর গলার স্বরেই যা বোঝার বুঝে যায়।আলতোভাবে ঘাড় কাত করে, মিনমিনিয়ে বলে,”আচ্ছা।”

এরপর আর কোনো কথা নেই। সোজা আনায়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, তার ঘর্মাক্ত গলার ভাঁজেই চোয়াল ঠেকিয়ে দেয়। রান্নার কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলে,

“হেই ব্লাড! কি করিস?”

কেনীথের ধ্যান অন্য কোথাও। সে বলতে চেয়েছে একটা, অথচ বলেছে আরেক। কিন্তু কেনীথের কথা শুনে নিমিষেই আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়। কেনীথ কি এই অবস্থায় তার সাথে মজা করতে এসেছে? নয়তো স্বচক্ষে সব দেখার পরও, এই প্রশ্ন কিভাবে করে? নিমিষেই মেজাজটা যেন হুহু করে বেড়ে যায়। কিন্তু কেনীথ তা মোটেও বুঝতে পারেনা। ওদিকে তার মেয়ে যে নির্দ্বিধায় খেলছে, এতেই সে খুশি।

তবে আনায়া কিছু বলছে না দেখে, কেনীথ পেছন থেকেই আনায়ার কপালের চুলগুলো, আঙুলের সাহায্যে কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতেই বলে,

“তারা মাই ব্লা’ড!…আমার জানপাখি, কি হয়েছে? কথা বলিস না কেনো?”

আনায়া এবার তার কাজকর্ম থামিয়ে দেয়। চুলার আঁচটা কমিয়ে, কড়াইয়ে ঢাকনাটা দিয়ে ঢেকে দেয়।অতঃপর পেছনে ঘুরে কেনীথের মুখোমুখি হয়ে বলে,

“কি চাই?”

আনায়া থমথমে অভিব্যক্তিতে, কেনীথ বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে — উল্টো বাচ্চাদের মতো নাটকীয় স্বরে, ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

“দেখ,এনার্জির অভাবে শুঁকিয়ে শুঁকিয়ে আমার কি হালটাই না হয়েছে।”

আনায়া শুরুতে কপাল কুঁচকে তাকালেও, পরবর্তীতে কেনীথের চেহেরার অবস্থা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,

“শরবত বানিয়ে দেব?”

—-“নাহ,শরবতে কাজ হবে না। এনার্জি ডোজ লাগবে।”

নিমিষেই আনায়া কপাল কুঁচকে বলে,

“মানে?”

আনায়ার বলতে না বলতেই, কেনীথ তার মুখটা আনায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“চুমু লাগবে। কঢ়াহ্ চুমু। দশ-বারোটা দিয়ে দে। আধঘন্টার জন্য ফুল এনার্জি পেয়ে যাব।”

কেনীথের সাধাসিধা অভিব্যক্তিতে, আনায়া চোখমুখ সহ চোয়াল শক্ত হয়। দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর, পুনোরায় উল্টো ঘুরে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে কেনীথের কপাল কিছুটা কুঁচকে যায়। সে আবারও আনায়ার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, যেইনা আনায়ার কোমড় হাত দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে যাবে…ওমনি আনায়া হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

“খবরদার, ছোঁবেন না!”

আচমকা আনায়ার এহেন পরিবর্তনে, কেনীথ কিছুটা চমকে ওঠে। কয়েকবার চোখ পিটপিট করে, মনে মনে ভাবে হঠাৎ আবার কি হলো। এইতো সব ঠিক ছিল।

—-“কি হয়েছে ব্লা”ড? হঠাৎ কেনো…”

আনায়া পুনোরায় কেনীথের দিকে ফিরে তাকায়। চোখ রাঙিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“মেয়েকে একা রেখে এসেছো কেনো?”

কেনীথ একবার রান্নাঘর থেকে সামনের দিকে উঁকি দিয়ে, অরিনকে দেখে নিয়ে বলে,

“মেয়ে তো ঠিকই আছে।”

—“কিসের ঠিক আছে?ও একটা বাচ্চা। ওকে এভাবে একা একা ফেলে আসার মানেটা কি?”

—“”আরেহ, হঠাৎ এমন করছিস কেনো?”

—-“তো কি করব? তামাশা করি আমি? দেখতেই পারছেন, কাজে ব্যস্ত। তবে কোন আক্কেলে এখানে তামশা করতে এসেছেন?”

—-“বউ আমার। শান্ত হো…”

কেনীথ কিছুটা ভারী শ্বাস ফেলে, আনায়াকে আঁকড়ে ধরতে নিলে…আনায়া দু’হাতে কেনীথকে সরিয়ে দিয়ে বলে,

“যাস্ট শা’টআপ। ছোঁবেন না আমায়। অসহ্য লাগে আপনার এসব কাজকর্ম। আমার তো আপনাকেই অসহ্য লাগে। যত্তসব বি’রক্তিকর। খবরদার আর আমার আশেপাশেও আসবেন না। আপনি আশেপাশে থাকলে, আমার গা জ্বলে। কাজ করি আমি, আপনার মতো শুয়ে-বসে থাকিনা। এক মেয়েকে একটু সামলাতে দিয়েছি তাও পারেনা৷”

—-“আনায়া…”

—-“চুপ থাকেন। আপনাদের না খাঁচা ভর্তি মেইল ইগো। তো এতো কথা শোনাই,তবুও কেনো কথা মাথায় ঢোকে না? মিনিমাম সেলফ্ ইগো থাকলে, আর একবারও যেন আমার আশেপাশে না দেখি। এখন যান এখান থেকে।”

আনায়া এই বলেই, পুনোরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে কেনীথ একমনে আনায়ার কথা শগনে, কিচেন থেকে আলগোছে বেড়িয়ে পড়ে। বাড়তি একটা শব্দও করেনা। একই সাথে কেনীথের অভিব্যক্তি ঠিক কি রইল,তাও বোঝা যায় না।

________________

কেনীথ প্রচন্ড মনোযোগী হয়ে নিজের ল্যাপটপে কাজ করছে। এমনিতেই অরিনের হওয়ার পর থেকে, তার কাজকর্ম করার সময়ই হয়ে ওঠে না। বেশির ভাগই একপ্রকার পাভেলের উপর ছেড়ে দিয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে টুকটাক দেখভাল না করলেও নয়। তাই রাতের সময়টুকু…অরিন ঘুমিয়ে পড়লেই শান্তিতে কাজের সুযোগটুকু মেলে। নয়তো অরিন জেগে রইলে সর্বক্ষণ তার চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খায় আর তার কাজেও কোনো প্রকার মন বসে না।

কেনীথের পরনে কালো রংএর হুডি আর টাউজার। বেডরুমে আপাতত সে ব্যতীত আর কেউই নেই। ঘরের এক পাশের কোণায়, জানালার পাশে স্টাডি টেবিলে বসে বসে নিজের কাজ করে যাচ্ছে।ইদানীং রাতের বেলায় ভালোই ঠান্ডা পড়ে। যার দরূন জানালাটা খোলা রাখায় হঠাৎই দমকা শীতল হাওয়া গায়ে উপর উপচে পড়ছে। তবে তা কেনীথের কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না।

এরইমাঝে রুমে হঠাৎ আনায়া এলো। কোলে তার ঘুমন্ত অরিন। এতোক্ষণ ড্রইং রুমে কোলে নিয়ে, ঘুরে ঘুরে ঘুম পাড়াতে হয়েছে। সারাদিন এতো কাজ আর পরিশ্রমের পর, এভাবে ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে ঘুম পাড়াতে খানিকটা বেগ পেতে হলেও, অরিনের ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সবকিছুই যেন শান্ত। এই নিয়ে খানিকটা প্রশান্তি কাজ করলেও, সারাদিন অরিনের সাথে হেসে খেলে সময় পার করাটাও একটু বেশিই উপভোগ্য। যা সে ঘুমিয়ে গেলে আর পাওয়া যায় না।

আনায়া অরিনকে বিছানায় ভালো মতো শুইয়ে দেয়। এতোক্ষণ সেভাবে আর কেনীথকে খেয়াল করার তার সুযোগ হয়নি। এমনিতে সবসময় কেনীথ তার আশেপাশে থাকলেও, আজ বিকেল থেকে কেনীথ অদ্ভুত ভাবে তার থেকে দূরে সরে রয়েছে। আনায়া বিষয়টা ভাবতেই খানিকটা ভ্রু কুঁচকে ফেলল।ভাবতে লাগল আজ হঠাৎ এমন কি হলো যে, সারাক্ষণ তার পেছন পেছন ঘুরঘুর করতে থাকা কেনীথ এখন তার থেকেই এতো সময় ধরে দূরে সরে রয়েছে। এমনিতে বিকেলের পর থেকে তার সাথে কেনীথের কোনো কথাও হয়নি।

এরইমাঝে আনায়ার আচমকা কিচেনের ঘটনার কথা মনে পড়ে। এরপর যা বোঝার, তা সে বুঝে নেয়। কিছুটা মুচকি হেসে কেনীথের দিকে এগিয়ে যায়।

—“এই যে শুনছেন?”

আনায়া খানিকটা আলতোস্বরেই তাকে ডাক দেয়। বহু কষ্টে অরিনকে ঘুম পাড়িয়েছে। এখন একটু জোর স্বরের কারণে যদি উঠে পড়ে, তবে তাতেই বিপত্তি। এদিকে আনায়ার কথায় কেনীথ কোনো সারা দেয় না। আনায়া আবারও ডাকে,

“এই যে ভিকে মশাই,শুনছেন?”

কেনীথ এবারও কোনো জবাব দেয় না। এদিকে আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আওড়ায়,

“বুঝেছি, আজ আর এভাবে কাজ হবে না। তবে চিন্তা নেই, আমিও আবার কম কিসে। এখনই এই খারুছের রাগ গায়েব করার ব্যবস্তা করছি।”

এই বলেই আনায়া আলমারির দিকে এগিয়ে যায়। আলমারিতে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে খানিকটা কপাল কুঁচকে ফেলে। পেছনে মুখ ফিরিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে,

“এই তোমার সাদা টিশার্ট নেই? সবই তো দেখছি কালো।”

কেনীথ কোনো উত্তর দেয় না।বরং চোয়াল আরো শক্ত করে, দৃঢ় চাহনিতে ম্যাকবুকের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে আনায়া খানিকটা বি”রক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিছুটা বিরবির করে আওড়ায়,

” উফফ,এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। এই জনমে আর হয়তো তাকে এই কালো ছাড়া অন্য কোনো রং-এ দেখতে পাব না। সবই আমার কপাল।”

এই বলতে না বলতেই আনায়ার অন্য কিছুর কথা মনে পড়ে। আবারও আলমারিতে কিছু খুঁজতে খুঁজতে বলে ওঠে,

“এ্যাই! তুমি যে মালদ্বীপে সাদা কালারের শার্টটা পড়েছিলে, সেটা কোথায়?”

যদিও এবারও কেনীথের কোনো প্রতিত্তোর মেলে না। তবে আনায়া খানিকটা আশান্বিত হয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,

“ওটা যথেষ্ট বড়সড় ছিল।তবে কিছুটা পাতলা,কিন্তু ব্যাপার না! ওটাই ঠিক কাজে লাগবে।”

এই বলতে না বলতেই আনায়া সেই সাদা রংএর টিশার্টটা খুঁজে বের করে। আদৌও এটা কি সেই শার্ট কিনা আনায়া বুঝতে পারছে না। সেইদিনের পর কখনো কেনীথকে এসব সাদা কিংবা কালো ব্যতীত অন্য কালারের কিছু পড়তেও দেখেনি। এই নিয়ে খানিকটা হতাশ হলেও, সাদা শার্ট যে খুঁজে পেয়েছে এতেই সে খুশি।

Darlin, can I be your favorite?
I’ll be your girl, let you taste it
I know what you want, yeah, just take it
Darlin’, can I be your favorite?
Want you to tell me you crave it
My name’s whatever you make it

আনায়া প্রচন্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে, গুন গুন করে গান গাইতে গাইতেই বাথরুমে শাওয়ার নিতে চলে যায়।

যদিও এমনিতে এতো রাতে ঠান্ডার মাঝে গোসলের কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবে আনায়ার কাছে এটাই বেস্ট অপশন বলে মনে হলো।

এদিকে আনায়া বাথরুমে ঢুকে যাওয়া মাত্রই কেনীথ শান্তিতে ভারী শ্বাস ফেলল। এবং পুনোরায় কঠোর গম্ভীরমুখে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

প্রায় অনেকটা সময় পর, আনায়া লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। পরনে শুধু কেনীথের সেই সাদা শার্ট আর মাথায় জড়ানো সাদা তোয়ালে। এছাড়া পরনে আর কিছুই নেই। গায়ে এখনো পানির বিন্দু কণা লেগে আছে। ভেজা শরীরের সাথে সাদা শার্টটা পুরো লেপ্টে রয়েছে। একইসাথে দৃশ্যমান শরীরের প্রতিটি বাঁকের ,প্রতিটি ভাজ। শার্টের হাত দুটো কনুই পর্যন্ত এলোমেলো ভাবে গুটিয়ে রাখা। খুব বেশি হলে শার্টটা তার উরু অব্দি লম্বা। কিন্তু এতে আনায়ার কোনো হেলদোল নেই। যেন এসব সে নিজ প্রস্তুতিতেই করেছে। গলার দুটো বাটন খোলা রেখে, একপাশের বিস্তৃত কাঁধ উন্মুক্ত রেখেছে।

এতোক্ষণে রাতও হয়েছে অনেকটাই গভীর। সে রুমে প্রবেশ করে দেখে, কেনীথ এখনো বসে বসে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। ওদিকে তার মেয়ে দিব্যি শান্তিতে ঘুমোচ্ছে।

আনায়া শুরুতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে একপলক নিজেকে দেখে। নিমিষেই লজ্জায় তার গা কুঁকড়ে যায়।সে নিজেকে কোনো মতে সামলে, ভিকে স্পেশাল ব্লা’ড পারফিউমটা খুঁজে নিয়ে ইচ্ছেমতো গায়ে লাগিয়ে নেয়। এরপর সরাসরি কেনীথের কাছে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে কেনীথের কাঁধে চোয়াল ঠেকিয়ে স্ক্রিনের দিকে নজর দেয়। শুরুতে কেনীথ কিছুই বলে না। এমনকি আশেপাশে ফিরে আনায়ার দিকে তাকানোরও প্রয়োজন মনে করে না। আনায়া খানিকটা সময় ওভাবেই অতিবাহিত করার পর, আচমকা একহাত এগিয়ে ম্যাকবুক লিড নামিয়ে বন্ধ করে দিতে নিলে… ওমনিই কেনীথ ক্ষিপ্ত চাহনিতে পাশে ফিরে আনায়ার দিকে তাকায়। আনায়া কেনীথের অভিব্যক্তিকে একটুও পাত্তা না দিয়ে মুচকি হাসে।

কেনীথ আবারও মুখ ফিরিয়ে, ম্যাকবুক অন করে নিজের কাজে মনোযোগী হবার চেষ্টা করে। কিন্তু আনায়া এতেও বাঁধা সাধে। সে আবারও ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়ে, পাশে এসে সোজাসুজি দাঁড়িয়ে যায়। এদিকে কেনীথও টুল থেকে দাঁড়িয়ে, ক্ষিপ্ত চাহনি নিয়ে আনায়ার দিকে ফিরে তাকিয়ে, হিসহিসিয়ে বলে,

“আনায়া!!!”

আনায়া আচমকা ঠোঁট চেপে হেসে, টুপ করে গিয়ে কেনীথের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে পুনোরায় দূরে এসে দাঁড়ায়।

—“ইয়েহ্, কাজ হয়েছে তবে।”

আনায়া এহেন কান্ড ঘটিয়ে,প্রচন্ড খুশি হলেও কেনীথ মোটেও সন্তুষ্ট হয় না এসবে। বরং এতে আরো বেশি তার মেজাজ খারাপ হয়। কোনোমতে নিজেকে সামলে, পুনরায় মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, টুলে বসে পড়ে। এদিকে আনায়া যে কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তা একবারও তার নজরে পড়ে না।সে আবারও ম্যাকবুক অন করতে নিবে এমন মূহুর্তে… আচমকা আনায়া নিজের মাথা থেকে তোয়ালে খুলে, ফ্লোরে ছুঁড়ে মা”রে। অতঃপর গিয়ে কেনীথের উরুর উপর, তার মুখোমুখি হয়ে চড়ে বসে। কেনীথ এতে হতভম্ব হয়ে গেলেও,আনায়া সম্পূর্ণ নির্বিকারে তার দিকে তাকিয়ে। নিজের উন্মুক্ত দুটো ভেজা সিক্ত পা, কেনীথের উরুর দুপাশে ঝুলছে। আনায়া নিজেকে খানিকটা ঠেলে, কেনীথের বুকের সংলগ্নে নিজেকে মিশিয়ে নেয়। তার ভেজা চুল কেনীথের গায়ে গলার সাথে লেপ্টে রয়েছে। এছাড়া আনায়ার পরনের শার্টটাও ভেজা চুলের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণটাই ভিজে যাচ্ছে।

এদিকে আনায়া সেসবে পাত্তা না দিয়ে, কেনীথের হুডির গলার ফিতে দুটো, দু’হাতে টেনে ধরে বলে,

“এই যে খলিজা! এতো রাগ কেনো শুনি?”

কেনীথ কোনো কথা বলে না। সে চোয়াল শক্ত করে মুখ উঁচিয়ে, সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে। এদিকে আনায়ার থামবার কোনো নাম নেই। সে কেনীথের গলার টানটান ত্বকে— ক্রমশই ওঠানামা করা অ্যাডম অ্যাপেলে আলতোভাবে আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতে থাকে।

I was nineteen in a white dress
When you told me I’m your princess
So I played right in to your fantasy
Was your good girl, so I’d sit tight
And if I don’t speak, then we can’t fight
Looked in the mirror, now I can’t believe

I forgot I was a bad bitch, tragic
Breaking all the rules ’cause they were only habits
Cinderella’s dead now, casket
You thought the shoe fit but I
(Da-da-da, da-da-da, da-da-da, da-da-da-da…

I আনায়া গুন গুন করে গাইতে গাইতেই অকস্মাৎ থেমে যায়।অতপর কি যেন ভেবে নিয়ে বলে,

“উফ,ভুল হয়েছে। আমি তো আবার এক বুড়োর সাথে থেকে থেকে বুড়ি হয়ে গিয়েছি। নাইন্টিন হতে যাব কোন দু্ক্কে?”

আনায়া নির্বিকারে নিজের কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে কেনীথ যেন সব কিছু মিলিয়ে আরো খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইতস্ততভাবে আনায়ার দিকে না তাকিয়েই তাকে দূরে সরাতে নিলে, আনায়া বাঁধা সাধে। সে একদম মোহনীয় স্বরে আওড়ায়,

“এই যে আমার জলহস্তী। রাগ কমেনি?”

কেনীথ কিছু বলেনা। এদিকে আনায়া আবারও বলে,

“আমি এতো কথা বলছি, কিছু বলছো না কেনো?”

আনায়ার কন্ঠস্বরে যথেষ্ট দৃঢ়তা। কিন্তু তার এই তেজ-ই যেন কেনীথের সহ্য হচ্ছে না। সে মুখ ফিরিয়ে জোর করেই পুনোরায় ম্যাকবুক ছুঁতে নিলে…আনায়া এবার আচমকা বিস্ময়কর কান্ড ঘটিয়ে ফেলে। নিমিষেই মেজাজ ক্ষি”প্ত করে, কোনো মতে পাশে ফিরে, ম্যাকবুকটা হাতে তুলে নিয়ে— সোজা জানালা দিয়ে বাহিরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মূহুর্তেই কেনীথের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয়ে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়। তিন তলা থেকে নিচে পড়ে এতোক্ষণে তা নিশ্চিত ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো। তার চেয়ে বড় কথা সেখানে থাকা সব কাজের ফাইল…।কেনীথের চোয়াল শক্ত, ক্ষি’প্ত চাহনিতে আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, তাকে ধাক্কা দিয়ে নিজে দূরে সরে আসতে চাইলে…আনায়া উল্টো তাকে আরো নিজের কাছে টানে। দু’হাতে গলার কাপড়ের অংশটুকু শক্ত হাতে খিঁচে বলে ওঠে,

“তখন ওমন রুড ব্যবহার করার জন্য সরি।”

ম্যাকবুক জানালা দিয়ে ফেলে, এখন বলছে তখনকার রুড ব্যবহারের জন্য সরি? নিমিষেই যেন কেনীথের মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। সে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে আনায়াকে দূরে সরাতে নিলে, আনায়া আবারও কেনীথকে শক্ত করে নিজের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখে। এবার তার একহাত চলে যায় কেনীথ ঘাড়ের পেছনের চুলের মাঝে। চুল আর ঘাড় খামচে ধরে কেনীথের মাথা নিজের দিকে এগিয়ে আনে। অতঃপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে কঢ়া স্বরে বলে,

“এই যে, এতো কিসের রাগ তোমার,হ্যাঁ? সরি বলেছি না আমি?”

—“তোর সরি, তুই-ই খা!”

দু’জনের মাঝে এখন নীরব যু’দ্ধ চলছে। কেউই জোরে কোনো কথাবার্তা বলছে না, কেননা বিছানায় অরিন এখনো ঘুমে রয়েছে। ও একবার উঠে গেলে তা কারোর জন্যই ভালো হবে না। কিন্তু কেনীথ কিংবা আনায়া—কেউই এতো সহজে হার মানার লোক নয়। দুজনেই দুজনের জেদেই আঁটকে রয়েছে। কেনীথ এবার আনায়ার দুবাহু শক্ত করে চেপে ধরে সরাতে চাইলে, আনায়া পাশে হাত সরিয়ে, টেবিল থেকে একটা ফাউন্টেন পেন শক্ত হাতে তুলে নেয়। অতঃপর তা সরাসরি কেনীথের বুকের বা পাশে চেপে ধরে, অনবরত হিসহিসিয়ে কঢ়া-চাপা স্বরে বলে উঠল,

“এ্যাই! একদম চুপচাপ থাকো নাহলে…একবার যদি মেয়ে উঠে যায়, তবে সোজা চিবিয়ে খাব।”

চলবে_________________