একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪২ (সমাপ্তি পর্ব→(০১ অংশ) )

0
7

#একজোড়া_আগুন_পাখি
(#তুশকন্যা)

সমাপ্তি পর্ব→(০১ অংশ)

রাতের শেষপ্রহর পেরিয়ে সকালের আলো ধীরে ধীরে পৃথিবীর গায়ে উপচে পড়ছে। সূর্যের সোনালি আভা জানালার ওপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে; রুমের ভেতরে প্রবেশের ব্যাকুলতা নিয়ে। কিন্তু ভারী মখমলের পর্দা তার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে, যেন এই মুহূর্তে বিশেষ কারো ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো নিত্যন্তই অনুচিত।

বিছানায় উপর হয়ে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে,ঘুমিয়ে আছে কেনীথ। সম্পূর্ণ পিঠ তার উন্মুক্ত। কাঁধ পর্যন্ত বড় বড় চুলগুলো বালিশের ওপরে এলোমেলো ভাবে পড়ে রয়েছে। নিঃশ্বাসের প্রতিটি ওঠানামায় বুকের পাঁজর হালকা দুলে উঠছে।এক হাত লুটিয়ে আছে বিছানার পাশে, অন্য হাত অনায়াসে মাথার উপর ফেলে রাখা। কম্বলের এক অংশ কোমরের নিচ পর্যন্ত সরে এসেছে।

শিশিরের হালকা সোঁদা গন্ধ মিশে গিয়েছে বাতাসে। কিন্তু কেনীথের ঘুমের অতল গহ্বরে এতটাই নিমজ্জিত যে, এই সুবাস কিংবা সকালের আগমনের কোনো বার্তাই, তার চেতনার দরজায় কড়া নাড়তে পারছে না। নিঃশব্দে ঘুমিয়ে থাকা মুখশ্রীতে একরকম নিষ্পাপ প্রশান্তি খেলা করছে, যেন এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এই শান্তির ঘুম আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ক্ষীণ, মিষ্টি কন্ঠস্বর ঘরের নীরবতা ভাঙ্গিয়ে কেনীথের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটালো।

—“পাপা! পাপা! পাপা! উতো,উঠো,জলদি উতো। ও পাপা উঠো না উতো।”

কেনীথের শান্তির ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলেও এই পরিচিত মিষ্টি কন্ঠস্বর খুব সহজেই চিনে ফেলায়, সে মোটেও বিরক্ত হলো না ঠিকই; তবে অত্যাধিক ঘুমে আচ্ছনতার সহিত ক্লান্তস্বরে আড়মোড়া করে বলে উঠলো,

“হেই লেডিবাগ! বিরক্ত করো না। আরেকটু ঘুমাতে দেও মাম্মাম।”

কেনীথ চোখ বুঁজে থাকা অবস্থায় খেয়াল করলো কিছুক্ষণের ন্যায় সবকিছু যেন পুনোরায় নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। সেও ক্ষণিকের জন্য ঘুমের দুনিয়ায় প্রবেশ করার পূর্বেই অনুভব করে, তার পিঠ এবং কাঁধের কাছে ছোট ছোট দুটো হাত দিয়ে প্রচন্ড অস্থিরতার সাথে ঝাঁকানো হচ্ছে। কেনীথের বুঝতে বাকি রইল না যে, তার এই নাছোড়বান্দা মেয়ে তাকে এক্ষুণি ঘুম থেকে উঠিয়েই ছাড়বে।

—“ও পাপা, কত্ত সকাল হয়ে গিয়েছে। এবার তো উঠে পড়ো। আঙ্কেল এসেছে,আঙ্কেল। আঙ্কেলের সাথে দেখা করতে হবে তো!”

কেনীথ নিজের কুঁচকে থাকা চোখ মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে ফিরে তাকায়। তার হাঁটুর সমান উচ্চতার একটি ছোট্ট পুঁচকে মেয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। পরনে লাল টুকটুকে ভেলভেট লং গাউন…যা হাঁটু ছাড়িয়েছে। মাথায় একঝাঁক কালচে লাল রাঙা চুলগুলো কোমড় ছুঁয়েছে। টকটকে ফর্সা ত্বক, গোলগাল চেহেরার মাঝে বড়সড় কালো রংএর চশমা। যে চশমার দরূন ছোট্ট মুখটা আরো বেশি ছোট্ট দেখাচ্ছে। তবে অনেকটা জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার, চেরির মতো গাল দুটো ফুলে লাল টুকটুকে হয়ে আছে। যা দেখামাত্রই কেনীথ আলতোভাবে মুচকি হাসল।

কেনীথ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি তার এই লেডি বাগটা আদতে হয়েছেটা কার মতো? বাপ হলো সে, মা হলো আনায়া। অথচ চুল,ড্রেসআপ আর হাভভাব দেখে মনে হবে এটা যেন পুরোপুরি রোজের কার্বন কপি। তবে ফোলা ফোলা গাল, সুদীর্ঘ পাপড়ি যুক্ত চোখজোড়া কিংবা চেহারার শেইপ দেখে মনে হয় এটা তার এটম বো”ম বউ আনায়াই। চাপা রাগ, জেদটাও অবশ্য আনায়ার মতোই। যখন শান্ত তখন রোজ, তখন ক্ষি”প্ত তখন আনায়া। এছাড়া তার চঞ্চলতায় কখনো মনে হবে ছোট্ট বেলার সেই ইনায়া; যা আকস্মিক গম্ভীর রূপ ধারণ করে ফেলে। তবে এসবের মাঝে কেনীথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এই মেয়ে যদি কারো মতো হয়, তবে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভাগটা হবে তার নিজরই। অর্থাৎ অরিনের বুদ্ধিমত্তা কিংবা শান্ত ঘাতকের ন্যায় চতুরতায় সম্পূর্ণ কেনীথ… কিংবা এরচেয়েও বেশিকিছু। কেনীথ কিছু তো একটা স্পেশাল অনুভব করে তার এই একমাত্র কলিজার টুকরো সরূপ মেয়ের মাঝে। তবে শেষমেষ মেয়ের এতোসব রূপের কথা ভাবতে ভাবতেই কেনীথ মুচকি হেসে মনে মনে আওড়ায়,

“এটা মানুষের বাচ্চা, না গিরগিটি!”

তবে এই মূহুর্তে অরিনের মোটেও নিজের বাবার হাভভাব পছন্দ হলো না। সে কখন থেকে বলে যাচ্ছে ঘুম থেকে উঠতে, অথচ তার বাবা এখন জেগে জেগে তার দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো মুচকি মুচকি হাসছে।

—“পাপা আমি কিন্তু এখন রেগে যাবো। তুমি এভাবে হাসছো কেনো? আমি চলে যাবো কিন্তু!”

—“আর পাঁচ মিনিট ঘুমাতে দেওয়া যায় না,লেডিবাগ?”

—“নাহ যায় না। আঙ্কেল এসেছে, তার সাথে দেখা করব আমি। আর আমি তোমাকে ছাড়া যেতে চাই না।”

—“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু কোন আঙ্কেল এসেছে…পাভেল তো এখানেই…”

—“আরে পাভলু আঙ্কেল কেনো, রেহান আঙ্কেল এসেছে। ফুপা এসেছে ফুপা।”

কেনীথ এবার নড়চড়ে উঠল। এতোক্ষণ উপর হয়ে শুয়ে ছিলো, এবার উল্টো ঘুরে সরাসরি বিছানায় পা ঝুলিয়ে মাথা নিচু করে বসল। অতঃপর অরিনের দিকে তাকিয়ে, কপাল কুঁচকে বলল,

“রেহান?”

অরিন নাকের ডগার কাছে নেমে আসা চশমাটা, হাতের তালু দিয়ে ঠেলে… মাথা ঝাকিয়ে বলল,

“হুম, হুম, চলো এবার।”

কেনীথ খানিকটা সময় কিছু একটা ভেবে নিয়ে, দুহাতে এলোমেলো চুলগুলো পেছনে ঠেলতে গিয়ে টের পায়,আজও তার চুলগুলো আর আস্ত নেই।

—“আবারও?”

কেনীথের তাকানোতে মূহুর্তেই ছোট্ট মুখটা চুল আর চশমার আদলে যেন ঢেকে গেল। অদ্ভুত দুষ্টামিতে নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাতেই সেখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেনীথের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। তবে পরবর্তী কিছু সময়ের মাঝে নিমিষেই, সেই লুকাতে চাওয়া মুখটা দৃঢ় আত্মবিশ্বাসী হয়ে… মুখ উঁচিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

“তোমায় অন্নেক সুন্দর লাগছে পাপা! একদম ডিজনি প্রিন্সেস রূপাঞ্জেলের মতো।”

এই বলতে না বলতেই, অরিন তার লাল রাঙা গাউনের একপাশের কিনারাটা খানিক উঁচু করে তুলে ধরে। দুবার গোল গোল ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত হয়ে পুরনোয় একই জায়গায় চুপচাপ স্থির হয়ে দাঁড়ায়। ওদিকে কেনীথ মেয়ের কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাতেই, অরিন তার ভারী চশমার ফ্রেমটা একটু উপরে ঠেলে দিয়ে, তড়িঘড়ি করে বলে উঠল,

“সত্যি বলছি পাপা। যদিও তোমার চুলগুলো কিছুটা ছোট, তবে তুমি চুলগুলো আরেকটু বড় করলে একদম রূপাঞ্জেল হয়ে যাবে। আমিও তখন অনেক অনেক ক্লিপ এনে তোমার চুলে লাগিয়ে দেবো। বাগানের সব ফ্লাওয়ারস্ও লাগাবো, ওক্কে পাপা!”

কেনীথ জেগে থাকুক কিংবা ঘুমিয়ে, অরিনের সবসময়ের সবচেয়ে প্রিয় কাজ তার বাবার মাথায় নিজের শতশত ছোট ছোট হেয়ার ব্যান্ড, রং-বেরঙের ক্লিপ দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা। হ্যাঁ,অরিনের কাছে ব্যাপারটা এক্সপেরিমেন্ট করার মতোই। সে নিজে কখনো এতোসব ক্লিপ,ব্যান্ড নিজের চুলে ব্যবহার করেও না কিংবা করাটা তার পছন্দও নয়। তবে শুধুমাত্র কেনীথের চুলে নিজের ইচ্ছেমত সাজাবে বলে সে আলাদা ভাবেই এতোসব ক্লিপ,ব্যান্ডের জোগাড় করে রেখেছে। কেনীথও আর কি করবে, এই বয়সে এসে মেয়ের এইটুকু ইচ্ছেতে সঙ্গ না দিতে পারলে, তার আর কি-ই বা করার আছে।

কেনীথ ছোট্ট করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। মেয়ের দিক থেকে মুখ সরিয়ে আশেপাশ খুঁজে কালো রংএর টিশার্ট খুঁজে বের করে,তা দ্রুত পড়তে নিলেই অরিন আবারও বলে উঠল,

“পাপা, সাবধানে! নচটো যেন না হয়। লেফট সাইড… এখনো বাকি রয়েছে।”

কেনীথও চুপচাপ সাবধানের সাথেই টিশার্টটা পড়ে নিয়ে, ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। মুখ ধুতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতেই হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। ডান পাশের চুলের পুরোটায় পঞ্চাশটারও বেশি কালারফুল ক্লিপ,ব্যান্ড লাগান। বামপাশটা অবশ্য এখনো এই নি”র্যাতন থেকে নিস্তার পেয়ে আছে। কেনীথ পুনোরায় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে ভেবেও কূল পায় না,যে কেনীথের সামনে কাকপক্ষীও অবাধ্য থাকতো, আজ তার এই অবস্থা।

—“কি একটা কপাল নিয়ে জন্মেছিলাম। বউ এটম বো’ম হলে, মেয়ে আমার মি’সাইল। ওহ্,শালীও আবার কম কিসে। অবশ্য ব্যাপারগুলো মন্দ নয়। এমন জীবন পাওয়াটাও ভাগ্যের বিষয়।”

শেষমেষে এ কথা শেষে,ফিঁচকে হেসে ফ্রেস হয়ে কেনীথ রুমে এলো । তবে আশেপাশে কোথাও অরিনকে না দেখে ওকে ডাকতে নিলেই, বারান্দা থেকে আওয়াজ এলো,

“পাপা আমি এখানে। একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”

এই বলতে না বলতেই কিছুক্ষণের মাঝেই অরিন কয়েকটা লাল টুকটুকে গোলাপ নিয়ে এলো। যা দেখামাত্রই কেনীথ বলে উঠল,

“হেই লেডিবাগ, কি করেছো এটা। হাতে কাঁটা বিঁধবে তো!”

—“কিচ্ছু হবে না পাপা। আমি তোমার মেয়ে।”

কেনীথ অরিনের কথায় কিছুসময়ের জন্য চোখ ছোট করে, পুনোরায় স্বাভাবিক স্বরে বলল,

“কিন্তু তুমি এসবের করবে টা কি? ফুল ছেঁড়া কিন্তু ঠিক নয় মাম্মাম।”

—“আমি জানি পাপা,কিন্তু আমি তো এগুলো নষ্ট করব না। রেহান আঙ্কেলকে দেবো, তাই নিয়ে এলাম।”

কেনীথ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, খানিকটা কপাল কুঁচকে বললো,

“আজ হঠাৎ রেহান এসেছে কেনো?”

—“কেনো তুমি খুশি হওনি?”

কেনীথ কিছুটা কেশে উঠলো। মায়ের মতো মেয়ের এমন এক ধাপ বেশি বোঝাটা তার পছন্দ নয়। তবে পরবর্তী স্বাভাবিক স্বরেই বলল,

“হবার-ই বা কি আছে।”

কেনীথের এহেন উত্তর অরিনের কাছে অস্পষ্ট লাগল। ঠিকঠাক বুঝতে না পারায় কপাল কুঁচকে বলে উঠল,

—“মানে?”

—“কিছু না, চলো।”

এই বলতে না বলতেই কেনীথ অরিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই, অরিন কেনীথের কোল থেকে সোজা পিঠে চড়ে বসে। একহাত কেনীথের গলায় পেঁচিয়ে অন্যহাতের ফুলগুলো সাবধানে শক্ত ভাবে ধরে। কেনীথও মেয়েকে শক্ত করে ধরে, খানিকটা ঝুঁকতেই… অরিন ফুল ধরে রাখা হাতটা উপরের দিকে উঁচিয়ে, জোর স্বরে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল,

“আমার সিংহ ঘোড়া! চলো এবার ভ্রুম ভ্রুম।’

অরিনের কথা শুনে কেনীথ হেসে বলে,

“লেডিবাগ, তোমায় এসব কে শেখায় বলো তো?সিংহ-ঘোড়া না, ওটা পাগলা ঘোড়া হবে। আর ভ্রুম ভ্রুম করে গাড়ি চলে, সিংহ-ঘোড়া নয়।”

—“হ্যাঁ,আমি জানি কিন্তু তাতে কি?আমারটা হচ্ছে সবচেয়ে ইউনিক। বাকিদেরটা পাগলা ঘোড়া কিন্তু তুমি আমার সিংহ ঘোড়া।”

অরিনের কথায় কেনীথ পুনোরায় মুচকি হাসে। এই বয়সে এতো কথা কিভাবে বলে সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না। যদিও মাঝেমধ্যে একটা দুটো শব্দ অস্পষ্ট হয়ে যায়। তবে সে নিজেই তো কত বড় হয়েও ঠিকঠাক কথাই বলতো না। অবশ্য আনায়া আবার এমনই ছিলো। এই ভেবেই কেনীথ মনে মনে আওড়ায়,

“মায়ের মতোই হয়েছে, বিচ্ছু একটা।”

পরক্ষণেই আবার অরিনের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“আমার এটম বোম কোথায়?”

—“আহ্,মাম্মাম… সে তো কাজে প্রচুর ব্যস্ত।”

—“কাজ না ছাই, সব জানা আমার।”

—“নাহ, মাম্মাহ সত্যিই কাজে ব্যস্ত। কেনো তুমি জানো না যে আজ আমাদের এই প্যালেসে একটা ইভেন্ট রয়েছে। এইজন্যই তো সবাই নিচে অনেক কাজ করছে।”

কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে বলে,

“কিসের ইভেন্ট?”

—“তা তো ঠিক জানি না। শুধু মাম্মাম বলেচে আজ একটা ইভেন্ট আছে, আর আজকে অনেক গেস্ট আসবে। কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু বলেনি।”

—“ওহ,এইজন্যই তবে রেহান এসেছে।”

—“হুম,আর ইভেন্টটা হয়তো ফুপি আর আঙ্কেলের… কিছু একটা…৷ মাম্মামকে তো জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু সে তো কিছু বললোই না, উল্টো রেগে আছে।”

—“কিহ্,রেগে আছে কেনো? কি করেছো তুমি?”

—“ওফ্,পাপা! আ’ম এ গুড গার্ল। তবে আমি কেনো এমন কিছু করতে যাব, যাতে মাম্মাম রাগ করে। করেছে তো তুমি!”

—“আমি? আমি আবার কি করেছি। আমি তো এইমাত্রই ঘুম থেকে উঠলাম।”

—“এটাই তো! নিচে সবাই কাজ করছে, আর তুমি এখানে ঘুমাচ্ছো।তুমি কি জানো, মাম্মাম তোমায় সেই কখন থেকে ডাকছে।”

—“কিহ্,কাজ সেরেছে্। তোমার মাম্মাম সেই কখন থেকে ডাকছে আর তুমি আমায় এখন বলছো? আগে বলতে পারোনি?”

—“তাতে কি হয়েছে, তুমি কি মাম্মামকে ভয় পাও?”

দুষ্ট ভঙ্গিমায় বলা অরিনের কথা শুনে, কেনীথ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল,,

“হাহ্! তোমার মাম্মামকে ভয় পাবো—তাও আমি? প্রশ্নই ওঠে না। তবে তোমার মাম্মাম হলো আমার এটম বোম। যা একবার ব্লাস্ট হলে আর ভয় পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। কারণ ভয় পাওয়ার জন্য আগে জানটা থাকাটা জরুরী।”

—“হি হি হি….”

—“আমি মোটেও হাসির কিছু বলিনি।এখন চলো জলদি।”

—“হি হি হি…”

—“আবার হাসে!”

—“হি হি হি…”

—“কি কান্ড! দাঁত খুলে পড়ে যাবে তো লেডিবাগ, থামো এবার!

কেনীথের কোনো কথাতেই যেন অরিনের হাসি থামছে না।পিঠের উপর কি যেন ভেবে অনবরত হেসেই চলেছে। শেষমেশ কেনীথ ছোট্ট করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে, দ্রুত চলতে লাগে, নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আর এদিকে অরিন মনের সুখে গাইতে লাগল,

“এগিয়ে যাই সামনে,
আসবে বাঁধা জীবনে।
পাপা থাকলে নেইকো ভয়,
বিশ্বটাকে আমি করব জয়।”

____________

সাদা টিশার্টের উপর ডার্ক ব্রাউন কালারের জ্যাকেট। কালো রংএর প্যান্টের সাথে কালো রংএর জুতো। একদম পরিপাটি হয়েই হাজির হয়েছে রেহান। চেহারার বিস্তৃত হাসি ঝুলে রইলেও এক নিস্তব্ধ মলিনত্ব বিরাজমান।

—“আআআঙ্কেল…”

রেহানকে দেখামাত্রই কেনীথের পিঠ থেকে নেমে, দুহাত ছড়িয়ে দৌড়ে রেহানের কাছে এসে পৌঁছায় অরিন। আর তার পেছন পেছন আসতে লাগল কেনীথ। এদিকে অরিনকে দেখামাত্রই রেহান আরো বিস্তৃত হেসে ওকে কোলে তুলে নিতেই অরিন বলে উঠল,

“হাহ্, কত্তোদিন পর এলে বলোতো? তুমি জানো, আমি তোমায় কত্ত মিস করেছি।”

এতোবছরে বহু কিছুই পাল্টেছে। সাথে সকলের জীবন যাত্রার ধরনও। গত কয়েকবছর থেকে কেনীথ তার পরিবার নিয়ে রাশিয়াতেই নিজেদের প্রাসাদ সমতুল্য বাড়িতে বসবাস করছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য বাংলাদেশে যাওয়া হয়েছে তাদের, তবে সেটা খুবই কম। রাশিয়াতে মোটামুটি রেহান ব্যতীত বাকি সকলেই একসাথে থাকে। রেহান তার কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় দেশে নয়তো ইউএসে থাকে।তবে মাঝেমধ্যেই ছোট বড় প্রয়োজন কিংবা পারিবারিক ইভেন্টে রাশিয়াতে আসা হয় তার।আর এতোদিনে অরিনের সাথে তার অত্যন্ত ভালো একটা বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছে।

—“আয় হায়, কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে মামুনীটা। কেমন আছেন আপনি?”

—“আমি তো অনেক অনেক ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, সেটা বলো।”

—“আমিও অনেক অনেক ভালো আছি। এক মিনিট, আপনার জন্য কিছু একটা এনে…”

রেহান নিজের কথা অসম্পূর্ণ রেখেই, নিজের জ্যাকেটের ভেতরের পকেট থেকে দুটো বড় সাইজের চকলেট বের করে। অতঃপর সেটা অরিনকে দিতেই অরিন রেহানের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

”বাল্‌শোয়ে স্‌পার্সিবা, তুমি কত্তো ভালো ফুপ্পা। এক মিনিট, আমারও তোমায় কিছু দেওয়ার আছে।”

[বাল্‌শোয়ে স্‌পার্সিবা→অনেক ধন্যবাদ]

—“আয় হায়, আমার জন্যও? তবে দেও তো দেখি।”

রেহানের কথায় অরিন বিস্তৃত হাসে। অতঃপর রেহানের ঘাড়ের পেছনে ঝুলিয়ে রাখা হাতের ফুলগুলো সামনে এনে… রেহানের উদ্দেশ্যে বলে,

“এই নেও…এগুলো হলো রোজ। আর আমার ফুপিও রোজ। কিন্তু রোজ ফুপি এখন ক্যাসেলে নেই, তাই তুমি আপাতত এই রোজ গুলোই নিতে পারো।এগুলো আমার পক্ষ থেকে।”

অরিনের কথায় রেহান মুচকি হাসে। নিচে নেমে আসা চশমাটাকে আলতোভাবে ঠেলে দিয়ে, কপালে ছোট্ট করে চুমু একে দিয়ে বলে,

“অনেক বড় হও মা। একদম মানুষের মতো মানুষ হও।”

—“হুম, হুম, আমি তো একদিন অনেক বড় হবো। একদম পাপার মতো।”

অরিনের কথায় রেহান আনমনে রুক্ষ হেসে আঁড়চোখে একবার কেনীথের দিকে তাকায়। তার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েই কেনীথ দুজনের কথা-আলাপ শুনছে। তবে রেহানের তাকানো কিংবা রুক্ষ হাসি কোনোটাই কেনীথের দৃষ্টির অগোচর হলো না। বরং এতে তার নিজের ঠোঁটেও কিঞ্চিৎ বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। এরই মাঝে অরিন পুনোরায় বলতে লাগল,

“আচ্ছা ফুপা তুমি…”

—“ফুপা নয়,মামা বলো লেডিবাগ, মামা!”

রেহানের সাথে অরিনের খুনসুটির মাঝেই এবার ফোড়ন কাটে কেনীথ। কেনীথের নির্বিকারে বলা কথা শুনে রেহান ওর দিকে তাকাতেই,কেনীথ নিজের নজর সরিয়ে অরিনের দিকে ফেরায়। ওদিকে অরিন বলতে লাগল,

“কিন্তু পাপা, ফুপির বর তো ফুপাই হয়। মাম্মাম তো আমাকে এটাই বলেছিল ।”

—“তোমার মাম্মাম ঠিকই বলেছে। কিন্তু সে তোমায় এটা বলেনি যে,তোমার রেহান আঙ্কেল তোমার মাম্মামের ভাই হয়। সে ক্ষেত্রে তোমার মাম্মামের ভাই তো তোমার মামাই হবে, তাই না?”

কেনীথের কথা শুনে অরিন অনেকটাই অবাক হলো। সে বিস্ময়ের সাথে বলতে উঠল,

“আ…এটা কি সত্যি? আমাকে তো এটা কেউ বলেইনি। আঙ্কেল তুমি কি সত্যি মাম্মামের ভাই হও?”

কেনীথের এমন পাগলামি দেখে আর অরিনের প্রশ্নের কি জবাব দিবে, তা রেহান ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। সে প্রায়ই শুনেছে যে পৃথিবীতে খারাপ মানুষ গুলোই নাকি অন্যদের পুরো জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েও… নিজেরা খুব সুখে শান্তিতেই জীবন অতিবাহিত করে। এর জলজ্যান্ত উদাহরণ যেন কেনীথ।

তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটার যে কেনীথ সবটুকু ছিনিয়ে নিয়ে তাকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়েছে।তবুও এই নিয়ে কেনীথের মাঝে অনুশোচনা তো দূরের কথা, সেই কেনীথ আজ হাস্যরসের খেলায় মত্ত। মেয়ে,পরিবার নিয়ে তার কত আহ্লাদ। সবসময় কঠর ব্যাক্তিত্ব নিয়ে থাকা মানুষটাও আজ মেয়ের আহ্লাদে মেতে, অদ্ভুত সাজে দিব্যি স্বাভাবিক থেকে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। কে বলবে এই হাসিখুশি লোকটাও মানুষের বেশে সেজে থাকা একটা অমানুষ,পি”চাশ। কেউ কি করে এতো তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে যেতে পারে? কি করে এতো স্বাভাবিক থাকতে পারে? কই সে তো আজও সবকিছু ভুলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হতে পারেনি। তবে কি সে কেনীথের মতো অমানুষ নয়?

নিজেকে এতোসব প্রশ্ন করে শেষমেশ তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে মনে মনে আওড়ায়,

“অমানুষ হওয়াটা হয়তো উচিত ছিলো। আফসোস আমার, আমি তা হতে পারিনি। হলে হয়তো আজ এভাবে মুখ বুঁজে সব না ভুলেও.., ভুলে থাকার অভিনয়টা করতে হতো না।”

মনে মনে যতটুকু ক্ষোভ জেগে উঠেছিলো তা অরিনের দিকে নজর পড়তেই নিমিষেই হারিয়ে গেল। রেহান পুনোরায় সবকিছু মাথা থেকে সরিয়ে বিস্তৃত মুচকি হেসে বলল,

“তোমার পাপা ভুল বলেনি। তোমার যদি ইচ্ছে হয়,তবে এখন থেকে তুমি আমায় মামা বলেও ডাকতে পারো।”

—“হি হি কি মজা। এখন তো আমার একটা মামাও হয়ে গেল।”

অরিনের সাথে সাথে কেনীথও কিঞ্চিৎ তীর্যক হাসে। বিষয়টা কেমন যেন তার কাছে মজা লেগেছে। তবে তার বিস্তৃত বাঁকা হাসি নিমিষেই কিছুটা মিইয়ে যায়…, হঠাৎ আনায়ার দিকে নজর পড়তেই। বুকে হাত গুঁজে সাদা রংএর কিচেন এপ্রোন পড়ে, গম্ভীর্যের সাথে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে… তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে আনায়া। ডান হাতে তার কাঠের খুন্তি। হাভভাব দেখে মনে হচ্ছে বেজায় বিরক্ত এবং ক্ষি’প্ত সে। তবে কেনীথ মোটেও এসবে পাত্তা দিলো না। বরং অরিনের উদ্দেশ্যে বলল,

“চলো লেডিবাগ, বাহির থেকে ঘুরে আসি। সকাল বেলা একটু হাঁটাহাঁটি করা ভালো।”

এই বলেই কেনীথ রেহানের কোল থেকে অরিনকে কোলে তুলে নিয়ে বাহিরে যেতে লাগল। একবার পিছনে ফিরে তাকানোর ইচ্ছে জাগলেও, পিছনে ফিরে আর রেহান-আনায়াকে দেখা হলো না। বরং কিসব ভেবে যেন আকস্মিক বাঁকা হাসিতে মেতে উঠেল।

_________

অনেকক্ষণ আশপাশ সবকিছু ঘোরাঘুরি করার পরও কেনীথ জানতে পারল না যে আজ এখানে কিসের আয়োজন করা হচ্ছে। যাকেই জিজ্ঞেস করছে সেই বলছে কিছু জানে না। সব নাকি তার এটম বোমা বউ জানে। এসব দেখে কেনীথ অনেকটা বিরক্তও হলো। এরই মাঝে অরিন বলতে লাগলো,

“পাপা, ক্ষিদে পেয়েছে।”

—“ক্ষিদে পেয়েছে? কেনো সকালে খাওনি তুমি? এই আনায়াটা সারাদিন…”

—“আরে শুনো,তুমি রাগ করো না।মাম্মাম অনেক জোর করেছিলো খাওয়ানো জন্য। কিন্তু আমি জেদ করে খাইনি। বলেছি তুমি ঘুম থেকে উঠলে এরপরই তোমার সাথেই খাবো।”

যদিও বা কেনীথ কিছুটা রেগে গিয়েছিলো তবে নিমিষেই সেই রাগ পানি হলো, অরিনের দুষ্টমি ভঙ্গিতে ইতস্তত হয়ে বলা কথাগুলো শুনে। সেই সাথে ভাবতে লাগলো, সকালে আনায়ার ওমন ভাবভঙ্গিকে পাত্তা না দিয়ে, হালকাতে নেওয়াটা, মোটেও উচিত হয়নি তার। কাহিনিতে কিছু তো একটা তালগোল পেকেছে।

—“ক্ষিদে তো আমারও পেয়েছে কিন্তু আজ কপালে খাবার জুটবে কিনা সন্দেহ আছে। তুমি যে সকাল সকাল কি গ্যাঞ্জাম পাকিয়েছো তা হয়তো নিজেও জানো না। তবে নেক্সট টাইম যাই হোক না কেনো,অবশ্যই তোমার মাম্মাম যখন যা বলবে,তার সব কথা শুনবে।”

অরিন নিমিষেই বিস্তৃত হেসে বলল,

“ওক্কে পাপা।”

—“গুড গার্ল।”

কেনীথ আর অরিন দুজনে মিলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। আশেপাশে কোথাও আনায়াকে দেখতে না পেয়ে দুজনে কিচেনের দিকে এগোতে লাগল। গিয়েই দেখল রান্নাঘরে যেন পুরো এলাহি আয়োজন। আনায়া সহ দশ থেকে বারোজন সার্ভেন্ট, শেফ প্রত্যেকেই যেন রান্নার কাজে মরিয়া হয়ে উঠেছে।আর এসব যেন সোজা কেনীথের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। যতদূর বুঝেছে, এসব কিসের আয়োজনের প্রস্তুতি তা একমাত্র আনায়া ছাড়া আর কারো কাছ হতে জানা আর সম্ভব নয়। তবে তার বউয়ের হাভভাব আর কাজের ভাবভঙ্গিতে তো মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি পুরো এটম বোম হয়ে ফুলে রয়েছে। কেনীথ নিজের কোলে থাকা অরিনের দিকে তাকাতেই, অরিন কেনীথের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বলল,

“পাপা! তুমি কি ভয় পাচ্ছো?”

কেনীথ খানিকটা কেশে উঠে বলে,

“এভাবে বলতে নেই, লেডিবাগ। তোমার পাপা কাউকে ভয় পায় না।”

কেনীথের কথার প্রতিত্তোরে অরিন কিছু বলল না। বরং খানিকটা মুচকি হেসে ফেলল। এদিকে কেনীথ অরিনের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকাতেই আচমকা খানিক আঁতকে উঠল। তার কেশে ফেলার শব্দে শেফ, সার্ভেন্ট প্রত্যেকেই তার দিকে ঘুরে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। কেনীথও ক্ষনিকের ন্যায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ভাবতে লাগল আজ হচ্ছেটা কি এখানে। সবাই এমন অদ্ভুত আচরণ কেনো করছে, আর সেই বা কেনো এমন তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।

কেনীথ সবকিছু ছাড়িয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে। শক্ত চোখে প্রত্যেকের দিকে নজর বুলাতেই, প্রত্যকেই পুনোরায় নিজেদের কাজে ব্যস্ত হলো। তবে এসবের মাঝে কেনীথের চোখ পড়ে আনায়ার দিকে। তার থেকে খানিকটা দূরে একধ্যানে নিজের কাজে ব্যস্থ সে। পেছন ঘুরে থাকায় কেনীথ ওর চেহারার ভাবগতিকটা ঠিক বুঝতে পারল না। তবে সবার মাঝে আনায়া একাই যেভাবে আটা ময়দার ডো বেলছে…, তাতে কেনীথের মনে হলো আনায়া যেন পুরো আস্ত মানুষকেই বেলুনী দিয়ে পিষছে।

কেনীথ একবার সবার দিকে তাকিয়ে দেখে,যে যার কাজে ব্যস্থ। এই ফাঁকে কেনীথ অরিনকে সাথে নিয়ে আনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। আনায়ার কিছুটা ফাঁকে দুজন সার্ভেন্ট কাজ করছিল। কিন্তু কেনীথ যেতেই দুজনে কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে, সেখান থেকে সরে যেতে নিলে আনায়া গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

“নিকোভো নে প্রোসিলা উখোদিত।” (আমি কাউকে যেতে বলিনি।)

আনায়ার কথা শুনে যে যার মত পুনোরায় নিজের কাজে চুপচাপ লেগে পড়েছে। অন্যদিকে অরিন কেনীথের কানে ফিসফিস করে বলে,

“পাপা! মাম্মাম তো সত্যি সত্যি তোমার এটম বোম হয়ে আছে।”

কেনীথও পিছন ফিরে থাকা আনায়াকে দেখতে দেখতেই ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়,

“তাই তো দেখছি।”

এবার অবশ্য কেনীথ আর বেশি একটা সময় নেয় না। গলা খাকিয়ে নিরেট কন্ঠে দৃঢ়তার সাথে বলে,

“অরিন আর আমার ক্ষিদে পেয়েছে। খাবার নিয়ে জলদি রুমে আয়।”

কেনীথের কথায় আনায়ার কোনো হেলদোল হলো না। সে একইভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছে গম্ভীর্য পূর্ণ ভঙ্গিমায়। কেনীথের বুঝতে বাকি নেই আজ আর এভাবে কাজ হবে না। তবুও গম্ভীর কণ্ঠে শক্ত গলায়, ধমকের স্বরে বলে উঠল,

“কি বলেছি, কথা কানে যায়নি? খাবার নিয়ে জলদি উপরে আয়। ক্ষিদে পেয়েছে আমাদের।”

কেনীথের ধমক স্বরের আওয়াজে আশেপাশের প্রত্যেকেই মোটামুটি কেঁপে উঠলেও একমাত্র আনায়ারই যেন কোনো নড়চড় নেই। যে ভঙ্গিমায় কাজ করছে তো,করেই চলেছে। এবার কেনীথ কিছুক্ষণ চুপচাপ পাশ থেকে দাড়িয়ে আনায়ার ভাবভঙ্গি দেখে। অতঃপর অরিনের দিকে তাকিয়ে কানে কানে বলে,

“লেডিবাগ, একটা হেল্প করো। তুমি সবাইকে নিয়ে বাহিরে চলে যাও। আমি একটু পর সব ম্যানেজ করে চলে আসবো। আর একটু দেখো তো, তোমার ইনা আন্টি আর ফুপি কোথায়।”

—“আচ্ছা পাপা, আমি গিয়ে এখনোই তাদের খুঁজে বের করছি।”

এই বলেই অরিন কেনীথের কোল থেকে ত্বরিত নিচে নামে। অন্যদিকে কেনীথ পুনোরায় গলা খাকিয়ে কেশে উঠতেই, প্রত্যেকে ঘুরে তার দিকে তাকায়। কেনীথও একই মূহুর্তে গম্ভীর্যের সাথে চোখের ইশারায় সবাইকে বাহিরে যেতে বলে।এবং অরিন সহ সকলেই একমুহূর্ত দেরি না করে কিচেন থেকে বেড়িয়ে পড়ে। সবাই চলে যেতেই কেনীথ গিয়ে কিচেনের দরজাটা বন্ধ করে দেয়। অতঃপর ধীর গতিতে আনায়ার একদম কাছে এসে দাঁড়ায়। তবে হুট করেই রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে,

“এভাবে রেগেমেগে বোম হয়ে ফুলে আছিস কেনো? সাহস একটু বেশিই বেড়ে গিয়েছে, তাই না? কথা বললে কানে যায় না তোর?”

সাধারনত আনায়ার রাগের সময় কথা না বললে কেনীথ এই ধরনের কথাবার্তা বলে। যার ফলে আনায়া শুধু কথা কি বলবে, উল্টো আরো ক্ষি”প্ত হয়ে পুরো কেনীথের দিকে তেড়ে আসে। কিন্তু আজ আনায়ার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখায় কেনীথ কিছুটা অবাক হলো। এতো রেগে থাকার কারণটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কেনীথ এবার আচমকা পেছন থেকে আনায়ার পিঠের সাথে ঘেঁষে দাঁড়াতেই আনায়া চাপা স্বরে বলে উঠল,

“দূরে সরুন।”

—“কেনো?”

কেনীথের মৃদু আওয়াজে আনায়া পুনোরায় একদম নিশ্চুপ হলো। সেই সঙ্গে ময়দার ডো টাকে আরো জোরে জোরে বেলতে শুরু করল। যা দেখমাত্রই কেনীথ খানিকটা মুচকি হেসে বলতে লাগল,

“এই ময়দার ডো-টা কি আমি? যেভাবে বেলার নাম করে ওটাকে পিষে যাচ্ছিস, দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।”

এবারও একই কাহিনি। আনায়া নিজের কাজ একই ভাবে করে যাচ্ছে। কেনীথের কোনো কথাকেই যেন আর পাত্তাই দিচ্ছে না। কেনীথ এবার কিছুটা মুচকি হেসে আচমকা আনায়ার কাঁধের উপর নিজের চোয়াল ঠেকায়। নিমিষের মাঝেই আনায়া কিছু সময়ের স্তব্ধ হয়ে যায়। এতে কেনীথ আরো কিছুটা বিস্তৃত হেসে, নিজের বাম হাতটা আনায়ার পেটের কাছে এনে, সাপের লেজের ন্যায় পেচিয়ে ধরে। আনায়ার কাছে মূহুর্তেই সম্পূর্ণ আবহটাই রুদ্ধশ্বাসে পরিণত হয়। এরইমাঝে কেনীথ আনায়ার কানের একদম কাছে মুখ এগিয়ে, ফিসফিস করে হাস্কি স্বরে বলে উঠল,

“হেই ব্লাড!এভাবে এতো রেগে আছিস কেনো? আমি কি আবার কিছু করেছি? এতো রাগ কিন্তু ঠিক না বউ। এভাবে যদি সবসময় বউ-ই রেগে থাকে তবে আমার মতো নিরীহ-নিষ্পাপ প্রাণীটার কি হবে বল তো?”

আনায়া এই পর্যায়ে এসে না চাইতেও খানিকটা কেঁপে উঠল। যা টের পাওয়া মাত্রই কেনীথ ঠোঁট কামড়ে শব্দহীনভাবে হেসে ফেলে। আনায়া নিজেকে কোনো মতো সামলে, নিজের কাজে ব্যস্ত হতে নিল, কেনীথ এবার তাতেও বাঁধা সাঁধে। আনায়াকে আরেকটু বিব্রত করতে এবার ওর রুটি বেলতে নেওয়া ডান হাতটার উপরে নিজের ডান হাতটা অত্যন্ত নিপুণ কৌশলে বসাতেই, আনায়া এবার সম্পূর্ণরূপে থেমে যায়। আনায়া চুপচাপ দাঁত খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলেও কেনীথ আনায়ার থেমে যাওয়াতে পুনোরায় কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগল,

“থেমে গেলে কেনো? একটু আমিও করে দেখি, বউয়ের সাথে সাথে নিজেই নিজেকে এভাবে পিষে-বেলে ফেলার, অনুভূতিটা ঠিক কেমন হয়।”

একে তো কেনীথের গরম নিশ্বাস প্রতিনিয়ত ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। আর তারই মাঝে আবার কিছুক্ষণ পরপর কেনীথের চাপ দাঁড়ির খোঁচায় গলা-ঘাড়ে প্রতিনিয়ত ঘর্ষণের সৃষ্টি। সবমিলিয়ে আনায়ার পরিস্থিতি যখন রুদ্ধশ্বাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন আনায়া কেনীথের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর লক্ষে জোরে নড়েচড়ে উঠল। তবে এতে কেনীথ আরো একধাপ এগিয়ে…আনায়ার ডান হাতটা ধরে ওর পেটের কাছে এনে শক্ত করে চেপে ধরল। সেই সাথে আনায়া বাম হাত দিয়ে কেনীথের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নিতে চাইলে, কেনীথ সেটাও খপ করে ধরে আনায়ার পেটের মাঝে পেঁচিয়ে চেপে ধরে। এখন আনায়ার ময়দা মাখা দুটো হাতই, কেনীথের শক্ত হাতের বাঁধনে আটকা পড়ে রয়েছে।

আনায়া এই পর্যায়ে এসে মোচড়ামুচড়ি করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি চাপা স্বরে বলতে লাগল,

“বাড়াবাড়ি হচ্ছে এবার, ছাড়ুন আমায়।”

—“হোক বাড়াবাড়ি, ছাড়বো না আমি৷”

—“কি চাইছেন আপনি?”

—“তোকে।”

কেনীথের কথা শুনে আনায়ার আর কিছু বলল না। চুপচাপ জোর করে হলেও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কেনীথ আনায়াকে আবারও জিজ্ঞেস করে,

“এবার বল, কি করেছি আমি। এতো রেগে আছিস কেনো?”

কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হবার পরেও, আনায়া কোনো উত্তর না দেওয়ায়, কেনীথ এবার অদ্ভুত দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে ।আচমকা কাঁধ থেকে চোয়াল সরিয়ে আনায়ার গলা আর ঘাড়ের কাছে নিজের খোঁচা খোঁচা ছোট দাঁড়ি দিয়ে অনবরত ঘর্ষণ দেওয়া শুরু করলে, আনায়া প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে নড়তে শুরু করে। কিন্তু কেনীথ তার হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই আনায়া সম্পূর্ণ মূর্তির ন্যায় স্তব্ধ হয়ে যায়। ততক্ষণে আনায়া আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয় বলে উঠল,

“আহ্ ব্যাথা পাচ্ছি।”

কেনীথ চাপা স্বরে বলে,

“আরো দেবো ব্যাথা,কথা বলিস না কেনো?”

—“এটা রান্নাঘর, দয়া করে অসভ্যতা করবেন না।”

—“বউয়ের সাথে অসভ্যতা করবো না তো, তবে কি শালীর সাথে…ওহ্ সরি। আই মিন, বউয়ের সাথে অসভ্যতা করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট জায়গার প্রয়োজন হয় না। যেথায় শুনশান নীরবতা রবে, সেথায় বউয়ের সাথে অস”ভ্যতা করতেই হবে।

—“বি’রক্ত করবেন না, যান এখান থেকে।”

—“কথা বলিস না কেনো, তা বল আগে।”

—“বলবো না আমি কথা৷”

—“কেনো বলবি না?”

—“ইচ্ছে হয়েছে তাই।”

—“এসব ইচ্ছে আমার কাছে গ্রহণ যোগ্য নয়।”

—“না হলে নাই, আমি কথা না বললে কার কি এসে যায়?”

—“কার কি এসে যায় মানে? তুই কথা না বললে আমি ঝগড়া করবো কার সাথে? আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসবে। তখন আমি বাঁচবো কিভাবে?আমি তো ম’রেই যাবো।”

—“ম’রা এতো সোজা না। এসব ঢং-এর আবেগে কেউ ম’রে না।”

—“কি বললি! আমার ফিলিংস তোর কাছে ঢং-এর আবেগ মনে হয়? সত্যিই সাহস একটু বেশিই হয়েছে,তাই না?বেশি বেশি করলে মে”রে একদম তক্তা বানিয়ে ছাড়ব!”

—“তবে মারুন না, না করেছে কে? মে’রেই ফেলুন একেবারে, তবে বেঁচে যাই আমি।”

এই পর্যায়ে এসে কেনীথ খেয়াল করে দেখলো আনায়ার ক্ষিপ্ত স্বরটা আচমকা ভেজা মনে হচ্ছে। একমুহূর্তও দেরি না করে কেনীথ তার নিজের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে আনায়াকে একটানে সামনে দিকে ফিরিয়ে দেখে…, আনায়ার চোখের কোণায় জল এসে ভীড় জমিয়েছে। রাগের ক্ষি”প্ততায় ফর্সা গাল গুলো ফুলে রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আনায়ার এহেন অবস্থা দেখে কেনীথ ওর বাহুজোড়া আলতো হাতে ধরে খানিকটা টেনে নিয়ে, নিজের সাথে একদম মিশিয়ে নেয়। অতঃপর আনায়ার কপালে সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে, অনেকটা কাতর স্বরে বলে উঠল,

“কি হয়েছে বউ, কাঁদছিস কেনো? কি করেছি আমি? আজ এমন কেনো করছিস? আমি ঘুম থেকে দেরিতে উঠেছি, তাই এতো রাগ? বল কি করতে হবে, সব করে দিচ্ছি।”

কেনীথের কথার প্রতিত্তোরে আনায়া সিক্ত গলায় চাপা স্বরে বলে,

“এসব কিছুই না।”

—“তবে বল, কি হয়েছে?”

—“বললামই তো কিছু হয়নি।”

—“সত্যি বলছিস তো?”

—“হুম।”

কেনীথও আর এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে না। যদিও জানে কিছু না কিছু ঘাবলা তো রয়েছে কিছু এখন আর জোর করে লাভ নেই। পরবর্তীতে ধীরেসুস্থে কাহিনি জানা যাবে। এই ভেবে কেনীথ আনায়ার বাহু জোড়া ছেড়ে দিয়ে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া একফোঁটা জল আলতোভাবে আঙ্গুল দিয়ে মুছে দেয়।এরপর কপালে আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে মুচকি হেসে বলে,

“বয়স বাড়ছে, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। হার্টও দিনে দিনে দূর্বল হয়ে পড়ছে। কখন যে হুটহাট দুনিয়া ছাড়তে হয়—জানা নেই। আর এখন যদি এই বয়সে এসেও বউয়ের রাগের আতংক নিয়ে বাঁচতে হয়, তবে আর এই জীবন থেকেই বা কি লাভ!”

কেনীথের অসহায়ত্বের দুষ্টুমি চেহেরায় আনায়া আকস্মিক শব্দহীনভাবে হেঁসে ফেলল।নিমিষেই দুইগালে ছোট বড় দুটো টোলের দেখা মেলে। এবং ওর হাসিতে কেনীথও বিস্তৃত হেসে বলে উঠল,

“যাক, এইবার হাসি ফুটেছে তবে। বাঁচা গেল।”

আনায়াও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,

“এবার ছাড়ুন আমায়। অনেক কাজ বাকি রয়েছে।”

আনায়ার মুখে ছাড়ার কথা শুনে কেনীথ আনায়াকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বলে,

“কিসের কাজ! সব কাজ পড়ে হবে। আগে আমার আর আমার মেয়ের খাবারের ব্যবস্থা কর। স্বামীর খেয়াল না হয় রাখিস না, তাই বলে নিজের একমাত্র মেয়েরটাও খেয়াল রাখবি না?”

নিমিষেই আনায়ার মুখের ভাবভগতিক বিগড়ে যায়। চোখমুখ শক্ত করে বলতে লাগল,

“এবার কিন্তু সত্যি সত্যি মেজাজ খারাপ হচ্ছে। মেয়ে কি আমার একার নাকি? বাপ হয়েছো কি শুধু পড়ে পড়ে ঘুমানোর জন্য?”

—“ওই, মোটেও আমার ঘুম নিয়ে খোঁটা দিবি না।সারারাত অকাজ করে ঘুমাতে দিবি না তুই! আর দোষ হবে আমার?”

—“ফালতু কথা বললে, এখনোই খুন্তি দিয়ে পেট ফুটো করে দেব। মেয়েকে বানিয়েছো নিজের মতো বদের হাড্ডি। একটা কথা বললে,শোনে না। সকালে খাবারের জন্য কত জোর করলাম। আপনার মেয়ের এক কথার শেষ কথা, তার প্যাপ্যার সাথে খাবে। ওদিকে তার প্যাপা প্যাপা ওয়ালা বাপ যে উল্টে পড়ে নাক ডেকে ঘুমিয়েই তাল পায় না,সেটা কে বলবে। আমি কি সারাদিন কাজকর্ম ছেড়ে ওর পেছন পেছন খাবার নিয়ে ঘুরে বেড়াব?”

কেনীথ আনায়ার কথা একমনে শুনতে শুনতে ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগল। শেষমেষ আনায়াকে আরেকটু রাগিয়ে দিতে বলে উঠল,

“প্রয়োজন পড়লে না হয়,তাই করবি।তোর আর কাজ কি!”

—“ওহ্, আমার আর কাজ কি?আমার তো কোনো কাজই নেই। সারাদিন শুয়ে-বসে ঘুমিয়ে কাটাই। সব কাজ তো আপনিই করেন। ঠিক আছে, আমার আর এখানে থাকার কি দরকার। চলে যাবো আমি, দরকার নেই আর আমার এখানে থাকার। থাকেন আপনি আর আপনার মেয়ে।”

কথা বলতে বলতেই আনায়া হাত ছোটাছুটি করতে নিলে কেনীথ তড়িঘড়ি করে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“হয়েছে হয়েছে, এবার তো থাম। মাফ চাইছি, আর এসব বলব না। কাল থেকে ঠিক ভালো হয়ে যাবো।”

—“আপনার কাল আর কোনোদিন আসবে না৷”

—“আচ্ছা কালকেরটা না হয় কাল দেখে নেব। কিন্তু আমাকে এখন এটা বল যে, আজ এতসব আয়োজন কিসের জন্য? যাকেই জিজ্ঞেস করছি সেই বলছে জানে না। অরিনও বলছিল তুই বলেছিস আজ কোনো ইভেন্ট রয়েছে। কিন্তু কিসের ইভেন্ট?… ওই এক মিনিট, আজ আমাদের ম্যারেজ এনেভার্সিরি নয় তো?… কিন্তু ওটা যে কবে ছিলো তাই তো জানি না। নতুন করে বিয়ে-শাদিও তো আর করা হয়নি। তবে…”

কেনীথের কথা শেষ হবার পূর্বেই আনায়া তড়িঘড়ি করে ইতস্ততভাবে বলে উঠল,

“ওসব আপনার এখন না জানলেও চলবে। সময় এলে ঠিকই জেনে যাবেন। আপনি যান, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

হুট করে আনায়ার এহেন পরিবর্তনে কেনীথ কপাল কুঁচকে ফেলল।

—“ঘটনা কি বলতো? আমার কাছ থেকে কি লুকাচ্ছিস?”

আনায়া নিজেকে স্বাভাবিক করল। চোখ-মুখ শক্ত করে বলতে লাগল,

“আপনার কাছে কিছু লুকিয়ে আমার কি লাভ? আমার কথা বিশ্বাস করলে করুন, নয়তো নয়।”

—“নিজেকে এতো বেশি চালাক ভাবিস না বউ।”

—“ভাবিও না আমি। যাই হোক, কাহিনি হলো আজকে ইনায়ার জন্মদিন। তাই এতো আয়োজন।”

—“কিহ্, আজকে আমার একমাত্র শালী সাহেবার জন্মদিন। সত্যি বলছিস তো?”

—“মিথ্যে বলার কি আছে। এখন কি আমার কোনো কথাই আপনার বিশ্বাস হয় না?”

—“হওয়ারই বা কি আছে।”

—“মানে? কি বলতে চাইছেন?”

—“আরে থাম, রেগে যাচ্ছিস কেনো। এমনিই বললাম। ইরা তো আমাদের সাথে থাকছে শুরু থেকেই। কিন্তু এর আগে তো কখনো ওর বার্থডে…”

—“শুধু ওর কেনো, কারোরই তো কিছু করা হয়নি। এতোদিন সময় সুযোগ হয়নি, এবার হয়েছে। আশাকরি আগামীতেও সবকিছু এভাবেই স্বাভাবিক হবে।”

—“হুম, তবে আজ কিসের ইভেন্ট এটা কেউ বলতে পারছে না কেনো?”

—“আমি ছাড়া কেউ জানলে তো! ইরাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছি। কাউকে বলিনি কারণ, ইরা কোনো ভাবে কিছু বুঝতে পারুক, তা চাইনি।”

—“ওরেহ্, তবে এই ব্যাপার৷”

—“এখন যান। এগুলো গুছিয়ে রেখে এখনই খাবার নিয়ে আসছি।”

এই বলতে না বলতেই আনায়া পিছনে ফিরে কাজে লেগে পড়ে। অন্যদিকে পেছন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনায়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কেনীথ। কিছুক্ষণ সময় একইভাবে অতিবাহিত হবার পর, কেনীথ পুনোরায় একদম আনায়ার কাছে গিয়ে, পিঠ ঘেঁষে দাঁড়ায়। আচমকা এহেন কান্ডে, আনায়া কাজ থামিয়ে পাশে তাকিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,

“কি হলো, আরো কিছু করতে হবে?”

কেনীথ নির্বিকারে উত্তর দেয়,”নাহ।”

আনায়াও চুপচাপ পুনোরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিতেই, কেনীথ এক অদ্ভুত কাজ করে ফেলল। আনায়া খোঁপা করা মাথা থেকে হেয়ার স্টিকটা একটানে খুলে ফেলে। মূহুর্তেই এক ঝাঁক চুল গড়িয়ে কোমড় ছাড়াল।

—“আরে কি করছো!”

—“আহ্ সরি।এখনোই ঠিক করে দিচ্ছি।”

আনায়া বিস্মিয়ের সাথে খানিকটা রাগান্বিত হয়ে, পেছনে ফিরে আরো কিছু বলার আগেই কেনীথ তড়িঘড়ি করে বিষয়টা সামলে নেয়। সে আদতে কি করতে চাইছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না। তবে আপাতত আলতো হাতে চুলগুলো পেঁচিয়ে,মুড়িয়ে একটা সাধারণ খোঁপা বানিয়ে, তাতে কাঠিটা গুঁজে দেয়।একইসাথে আলগা চুলে কয়েকবার আলতোভাবে মুখ গুঁজে খানিকটা শুঁকে নেওয়ার পর,মনে মনে আওড়ায়,

“স্বামীকে বশে রাখার কায়দা এসব। আধ-পাগল থেকে পুরো পাগল বানিয়ে ছাড়বে।”

তবে সেখান থেকে কেনীথ মোটেও সরে না। বরং পুনোরায় আনায়ার কাঁধে চোয়াল ঝুলিয়ে, কামুক স্বরে বলে উঠল,

“শোন না! চল রুমে যাই।”

এই বলেই কেনীথ আলতোভাবে গলায় ঠোঁট ছোঁয়ায়। আনায়া খানিকটা সময় কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর নিমিষেই শান্ত মেজাজ ক্ষি”প্ত হতেই, কেনীথ তা আন্দাজ করে আনায়াকে পেছন থেকে দু’হাতে পেঁচিয়ে ধরে।

—“দিনের বেলায় পাগলামি শুরু করেছেন? ছাড়ুন আমায়, ভালো হবে না কিন্তু!”

—“আহ্,তারা! তুই না দিন দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছিস।”

কেনীথের অসহায়ত্বের কন্ঠে আনায়া অবাক স্বরে বলে উঠল,

—“কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি,মানে? এখন আর আমায় মনে ধরে না, তাই না? রাস্তা ঘাটে আবার কাকে পেয়েছেন শুনি? কেমন দেখতে সে? আমার থেকেও অনেক সুন্দরী ? এক দেখাতেই মন গলেছে, নাকি আরো কিছু দেখে এসেছেন?”

—“দেবো এক কানের নিচে। তোরা সব মেয়েদেরই ওই এক সমস্যা। একধাপ বেশি বুঝিস। ছিহ্! কি সব কথাবার্তা।”

—“তবে এতো সাধু না সেজে, সরাসরি বলুন না কি বলতে চাইছেন?”

—“এই যে এটাই মূল সমস্যা। অকারণে রেগে বোম হয়ে যাস। আগে কত সুন্দর নরম সোজা ছিলি। যেভাবে…”

—“যেভাবে উঠতে বলতেন, সেভাবে উঠতাম। যেভাবে বসতে বলতেন, সেভাবে বসতাম। আপনার ইচ্ছেতেই গুনে গুনে পা ফেলতাম। শ্বাসও নিতাম গুনে গুনে। কত্ত ভালো ছিলাম তাই না?”

কেনীথের কথা শেষ হবার পূর্বেই তাতে ফোঁড়ন কেটে আনায়ার বলা কথাগুলো শুনে, কেনীথ হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবার আনায়াকে জড়িয়ে ধরা হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে কেনীথ চলে যেতে নিলে, আনায়া আচমকা খপ করে হাতদুটো টেনে নিয়ে… পেছনে ফিরে কেনীথের মুখোমুখি হলো। কেনীথের চুপসে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,

“পুরোনো কথা আর টানতে চাই না। আমাদের জীবনটা আর সবার মতো স্বাভাবিক নয়। তবে এতে হতাশ হবারও কিছু নেই। ভাগ্য আর কর্ম আমাদের যে পথে নিয়ে এসেছে, আমাদের সে পথ ধরেই এগোতে হবে। পেছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ তো আমাদের নেই। তবে হ্যাঁ,আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আমাদের মেয়ের জন্য হলেও বাকি জীবনটাকে স্বাভাবিক করার। সঙ্গে আপনার জন্যও না হয় কিছুটা পরিবর্তন হলাম।”

কেনীথ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনার পর বিস্তৃত মুচকি হাসে। অতঃপর আনায়ার কপালে আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলোকে, ফু দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগল,

“প্রয়োজন নেই। তুই যেমন আছিস তেমনই থাক। আমার ব্লাড, ফায়ার বার্ড, মহারানী,রেড কালারের শাঁকচুন্নি আর এটম বোম্ব হয়েই… উফ! টকটকে রসালো চেরিও তো রয়েছে।…হায়ে…! আমায় কি পাগল করলি রে তুই বউ! যখন তখন দেখলেই তোকে টুপ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

কেনীথের কথায় আনায়া বিস্তৃত হেসে ফেলল। কিন্তু বেশি কিছু বলল না। নয়তো এই টপিক আরো এগোতে লাগলে, তার আধ-পাগলা বর এখানেই উলটোপালটা কিছু করে ফেলবে।

কেনীথের চুলের দিকে আনায়ার নজর পড়তেই,সে বলে উঠল,

“আজও চুলের এই অবস্থা?”

—“আপনার গুনধর মেয়ের কর্ম।”

—“এখন আমার গুনধর মেয়ে?”

—“তা নয়তো কি! বিচ্ছুর বাচ্চা বিচ্ছু। আমি ভেবে পাইনা তোরা মা-মেয়ের এতোকিছু থাকতে আমার চুলের সাথেই কেনো এতো শ’ত্রুতা। ছোট বেলায় তুই আমার চুলের সাথে যুদ্ধ করতি,এখন তোর মেয়ে।”

—“তাতে কি, আমি না হয় যুদ্ধ করে তোমার সাধের চুল ছিঁড়ে ফেলতাম। কিন্তু আমার মেয়ে তো আর তা করছে না। ও তো তোমায় রূপাঞ্জেল বানাচ্ছে। ভাবা যায়!…শেষমেষ মানুষ মে’রে কলিজা কাঁপানো মাফিয়া-রকস্টার ভিকে কিনা,মেয়ের জন্য হলো ডিজনি প্রিন্সেস রূপাঞ্জেল! এই খবর নিউজ-মিডিয়া জানলে, ওদের সারা বছরের হেড লাইন বানিয়ে ছাড়বে।”

—“হায় হায়! আসলেই তো, ভাবাই যায় না এসব।”

বিরক্তির সাথে রসিকতায়,চোখ ছোট ছোট করে কেনীথ কথাটা বলতেই, আনায়া ফিক করে হেসে ফেলল।

—“থাক মন খারাপ করো না। মেয়ের জন্য এটুকু করাই যায়।”

—“হাহ্, তাও ঠিক। মা-মেয়ে দুজনের জন্যই এইটুকু সহ্য করাই যায়, ব্যাপার না!”

কেনীথও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কথাটা বলতে বলতেই, আনায়া তড়িঘড়ি কাজে লেগে পড়ে। সাথে ব্যস্ততার স্বরে বলতে শুরু করে,

“অনেক হয়েছে এসব। এখন দরজাটা খুলে, তাড়াতাড়ি ওদের ভেতরে পাঠিয়ে দেও। অনেক কাজ বাকি রয়েছে।”

কেনীথ বিস্তৃত হেসে বলে,

“আচ্ছা ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আসবি কিন্তু!”

কেনীথ এই বলে চলে যেতে নিয়েছিল তো ঠিকই, কিন্তু আচমকা যাওয়ার পথে এক বিতিকিচ্ছিরি কাহিনি ঘটিয়ে ফেলল। আনায়ার কাছ থেকে সরে যেতে যেতেই স্বভাবগত কারণে, আনায়ার মাথার পেছনে আলতোভাবে হাত দিয়ে টোকা দিতে গিয়ে তা জোরে লেগে যায়। যার ফলে আনায়া নিজের ভারসাম্য হারাতেই পাশে থাকা ময়দার বাটিটা ছিটকে পড়ে। সেই সঙ্গে আনায়ার মুখ সহ আশেপাশে সব জায়গায় ময়দা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ায়, সম্পূর্ণ আবহটাই এক বিতিকিচ্ছিরি কাহিনিতে পরিণত হয়।

এদিকে কেনীথ যখন শব্দ শুনে পুরো হতভম্ব হয়ে পেছন ফিরে তাকাল, তখনই নজরে এলো আনায়ার বিস্ফো”রকের ন্যায় ক্ষি’প্ত মুখশ্রী। পুরো চুল, মুখ থেকে শুরু করে জামাকাপড় সব জায়গায় ময়দা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেখে রয়েছে। আনায়ার এহেন অবস্থা দেখে শুরুতে কেনীথ না চাইতেও হেসে ফেলল। তবে যেইমাত্র আনায়ার রক্ত গরম চোখ জোড়া নজরে এলো, তখনই কেনীথ ইতস্ততভাবে বলতে চায়,

“হেই ব্লাড…আ’ম সরি…সরি আমি ইচ্ছে…”

—“কিসের ব্লাড? আমি মানুষ, তোমার টলটলে র’ক্ত না! আর তোমার সরি তুমি খাও।”

কেনীথের কথা আর সম্পূর্ণ হলো না, বরং তার আগেই আনায়া পাশ থেকে একটা ছুরি নিয়ে কেনীথের দিকে তেড়ে আসতে লাগলো। যা দেখামাত্রই কেনীথ কোনোমতে পিছিয়ে যেতে যেতে পেছনে থাকা টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে যেতেই,আনায়া শক্ত হাতে ছুরি ধরে কেনীথ বুকের কাছে ঠেকায়।

—“আহ্, এতো বড় শাস্তি? সাবধানে! আমার কিছু হলে কিন্তু তুই কাঁদবি।”

আনায়া ছুরিটা কেনীথের বুক থেকে সরিয়ে, পাশেই টেবিলের উপর পড়ে থাকা ক্যাপসিকামের উপর সরোজে আঘাত করতেই, তা দুখণ্ড হলো। সেই সঙ্গে আনায়া ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠল,

“নাহ,কাঁদবো না আমি!”

কেনীথ ওর কান্ডে চোখমুখ খানিকটা খিঁচে নিয়ে হাত দুটো খপ করে ধরে ফেলল।

—“হাত ছাড়ো, নয়তো আরো বেশি খারা…”

কেনীথ আনায়ার কথায় হাত ছেড়ে দেয়… সেই ফাঁকে কেনীথ দৌড়ে সেখান থেকে সরে আসতে নিলে, আনায়াও পেছন পেছন তাড়া করতে শুরু করে। দুজনের এমন ইদুর বিড়ালের মতো ছোটাছুটিতে রান্নাঘরের জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে আরো বিতিকিচ্ছিরি কাহিনির সৃষ্টি হয়। কেনীথ যতই উল্টোপাল্টা দৌড়াচ্ছে, ততোই জিনিসপত্রের সাথে ধাক্কা খেয়ে তা ভাঙ্গাচুর হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে আনায়ার রা”গ, মে”জাজ, ক্ষো”ভও প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। কিন্তু কোনো মতেই কেনীথ দরজা খুলে বাহিরে যাওয়ার সুযোগটুকু আর পাচ্ছে না। শেষমেষ কেনীথ উপায় না পেয়ে হুট করে দাঁড়িয়ে যায়। এবার সোজা আনায়ার দিকে তেড়ে এসে ওকে খপ করে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। এবং হাতে থাকা ছুরিটা সাবধানে ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। তবে এরমাঝে আনায়ার রাগের মাথায়,মোচড়ামুচড়িতে কেনীথ ব্যালেন্স হারিয়ে টেবিলের সাথে জোড়ে ধাক্কা খাওয়ায়, আনায়াকে নিয়েই সোজা নিচে আছড়ে পড়ে। সেই সঙ্গে আরো এক গন্ড”গোল বাঁধে যখন… ওদের ধাক্কাতে টেবিলের উপর থাকা ময়দা-আটার বৈয়াম উল্টে পড়ে গিয়ে, সোজা ওদের মুখ সহ সারা শরীরে নি”ক্ষিপ্ত হয়।

এখন পুরো মুখে একগাদা সাদা ময়দা আটা মাখিয়ে ফ্লোরে পড়ে রয়েছে কেনীথ। আর তার উপরে পড়ে আছে আনায়া। আনায়ার চুল আর পিঠ সহ, সব জায়গায় আটা ময়দার স্তুপ। ভাগ্য ভালো বৈয়াম গুলো মাথার উপর পড়েনি। তবে একটা এসে আনায়ার কোমড়ের কাছে পড়ায় আনায়ার খানিকটা ব্যা”থাও লেগেছে।

এদিকে কেনীথ তার চোখের উপর পড়ে থাকা একগাদা আটা ময়দার জন্য চোখ খুলতে পারছে না। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রয়েছে। যেই না একটু মাথাটা এপাশ ওপাশ করে ঝাড়া দিয়ে চোখ মেলে তাকাল, ওমনিই আনায়ার র”ক্তগরম চোখ আর ক্ষি*প্ত চেহেরার মুখোমুখি হয়ে কিঞ্চিৎ ঢোক গিলল। মনে প্রাণে জানান দিচ্ছে, আজ আর বাঁচার কোনো উপায় নেই। তবুও কেনীথ ইতস্ততভাবে বলতে লাগল,

“বউ এবারের মতো মাফ করে দে। আমি কাল থেকে পাক্কা ভালো হয়ে যাবো। সত্যি বলছি আমি, আর এমন ভুল কখনো হবে না।”

এসব বলার পরও যখন আনায়ার কোনো বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটে না। বরং রণমুর্তির ন্যায় একইভাবে কেনীথের দিকে ক্ষি”প্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আর ঠিক তখনই কেনীথ আকস্মিক ঠোঁট ভিজিয়ে টুপ করে আনায়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে, ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠল,

“লেট মি বি অনেস্ট…বেব! ইউ লুক সো ইরেসি’স্টিবল রাইট নাও। লাইক আ ডিলি’শিয়াস স্ন্যাক…এন্ড আই ক্যান্ট ওয়েট টু ডিভাউয়ার ইউ। ইফ ইউ আর রেডি, আই উডন্ট মাইন্ড টেকিং আ বাইট অর… টেস্টিং ইউ। আই থিংক উই শুড গেট স্টার্টেড।”

এই মূহুর্তে কেনীথের এহেন কথা শোনার পর আনায়া পুরো কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় স্তব্ধ হয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইল। এখন তার ঠিক কিভাবে রিয়েক্ট করা উচিত, আনায়া ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে কেনীথের নিমিষেই জেগে ওঠা ফুরফুরে মেজাজকেও সে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দিল না। বরং আচমকা ক্ষি”প্ততায় দু’হাতে কেনীথ গলা চে’পে ধরল। কেনীথ খানিকটা কেশে উঠতেই আনায়া চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলল,

“আ…ছাড়বো না আমি আপনাকে।”

—“সমস্যা নেই, এভাবেই সারাজীবন তোর সাথে চিপ”কে থাকতেও রাজি আছি।”

—“সারাজীবনের তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি আপনাকে এক্ষুণি শে’ষ করে ফেলবো।”

—“কাবুল হে, আমি আমার বউয়ের হাতে ম’রতেও রাজি।”

—“তুই গু খা!”

আনায়ার সাথে সাথে এবারও কেনীথেরও মাথা বিগড়ে গেল। সে কোনমতে উল্টে আনায়াকে নিজের নিচে ফেলে দেয়।আনায়া নিজেকে ছাড়াতে কেনীথের চুল টেনে ধরলে, কেনীথও উল্টো আনায়ার চুল টেনে ধরে। এরপর শুরু হয় বদ্ধ রান্নাঘরে দুই পাগলের খামচাখামচি আর চুলোচুলি।

—“গু খা!”

—“তুই গু খা!”

—“তুই খা শালা!”

—“তুই খা শালী।”

—“ঠাডা পড়ুক তোর উপর।”

—“পড়লে দুজন সুদ্ধ পড়ুক।”

এভাবে কখনো কেনীথ উল্টোপাল্টা বকছে, তো কখনো আনায়া। অথচ কারোরই থামার নাম নেই। এমনটা নতুন নয়। এমনকি এসব তাদের দাম্পত্য জীবনের অগোচরের বিষয়বস্তুও নয়। এখন এই বাড়ির দূরদূরান্তরের গার্ডগুলোও পর্যন্ত, তাদের এই চুলোচুলি সম্পর্কে জেনে গিয়েছে। যে দুইজন তিনবেলার মাঝে দু’বেলাই চিপকে চিপকে থাকবে, আবার সেই দুজনই এভাবে দিনের আর এক বেলা চুলোচুলি না করে তাদের দিন পূর্ণ করবে না।

অবশ্য লোকচক্ষুর আড়ালে বাড়ির সকল সদস্য কিংবা সার্জেন্টের মাঝে এই নিয়ে ভালোই চর্চা হয়। কেউ কেউ তো খুঁজে বের করতে চায় তাদের চুলের রহস্য…কেননা এতো চুলোচুলির পরও তাদের চুল এখনো আস্ত কিভাবে রয়েছে তাই তাদের বুঝে আসে না। আবার কেউ কেউ এদের বিশেষ এক নামও দিয়েছে। শুরুতে সবাই এদের ফায়ার বার্ডস্ নামে চিনলেও, পরবর্তীতে যখন তখন হুটহাট এদের অদ্ভুত চুলোচুলি করতে দেখে, সকলে নাম দিয়েছে “এ পেয়ার অফ ক্রেইজি বার্ডস”; সংক্ষেপে যাদের সবাই বলে ক্রেইজি বার্ডস্।

চলবে_____________