#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
সমাপ্তি পর্ব (৩য় অংশ)
মধ্য দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়াবে তবুও থেমে নেই কারো কাজকর্ম। যে যার কাজে নিত্যান্তই ব্যস্ত। একই সাথে আনায়ার এখনো গোসলেরও সুযোগ হয়নি। কাজের চাপে পুরো হাঁপিয়ে উঠেছে। সেই সাথে পরনে থাকা সাদা গাউনটাও কেমন যেন ময়লা হয়ে গিয়েছে। আর এখন এসেছে বাহিরে কাজগুলোর দিকে নজর দিতে। আনায়া আশপাশ ঘুরে ঘুরে যখন কাজের দিকে নজর বুলাতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময় তার নজর পড়লো কেনীথের দিকে। দূর থেকে কালো থ্রি কোয়াটার সর্ট প্যান্ট আর টিশার্ট পড়ে হেলে দুলে আসছে। কেনীথ আনায়াকে দেখামাত্রই ইশারা করে হাত নাড়াল। আর এটা দেখে আনায়া আকস্মিক কপাল কুঁচকে ফেলল। কেনীথের হাভ ভাব দেখে কোনো কিছুই তার সুবিধার মনে হচ্ছে না।
আনায়া দ্রুত নিজের জায়গা থেকে সরে যেতে নেওয়ার পূর্বেই কেনীথ এসে আনায়ার সামনে হাজির হলো। একইসঙ্গে আশেপাশের সব গার্ডকে ইশারায় চলে যেতে বলায় তারাও দূরে অতিদ্রুত সরে যায়।
—“কি হলো, আমাকে দেখে পালাচ্ছিস কেনো?”
আনায়া কপাল কুঁচকে বলল,
—“পালাতে যাবো কেনো। মেয়েকে কোথায় রেখে এসেছো?”
—“মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। কারণ আমি এখন তার মায়ের সাথে ফ্লার্টিং করব।”
—“ফাউল কথা না বলে দূরে সরো। মেজাজ কিন্তু এমনিতেই বিগড়ে আছে।”
—“এইজন্যই তো এলাম। আপনার মেজাজে ঘি মশল্লা ঢালতে।”
আনায়া প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে কেনীথের রসিকতায় ভরা চেহেরাটা দেখে। অতঃপর আর কোনো প্রতিক্রিয়া না করে সেখান থেকে চলে যেতে নিলে, কেনীথ আনায়ার হাত ধরে ফেলে। আনায়া পেছনে ফিরে গরম চোখে তাকাতেই,কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেসে হেঁচকা টানে আনায়াকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আনায়াও দাঁত পিষে পিষে বলতে শুরু করে,
“সারাদিন শুয়ে-বসে কাটাও। খাবারটাও খাইয়ে…পারলে গিলিয়ে দিতে হয়। এইজন্যই বলে অতি সুখে ভুতে কিলায়। তা আপনার কি ইবলিশ শয়তান, মস্তিষ্কে গিয়ে কৃমি হয়ে কিড়মিড় করছে?”
কেনীথ আনায়ার কথায় পাত্তা না দিয়ে পাশে ফিরে তাকায়। পানির পাইপের দিকে নজর পড়তেই আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
“গোসল করিসনি এখনো?”
—“সেই সৌভাগ্য কি হয়েছে আমার।”
—“চল তবে একসাথে গোসল করি।”
আনায়ার চোখমুখ কুঁচকে যায়।
—“দেবো এক আছাড়।”
—“দিয়ে দেখ শুধু একবার।”
আনায়া এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলল না। কেনীথের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতেই বলতে লাগল,
“দয়াধর্ম করে এবার মাফ করেন আমাকে। পারলে নিজেও গিয়ে ঘুমান। একটু হলেও শান্তি পাই তবে।”
—“তুই শান্তিতে থাকলে আমার ঘুম হবে না। অন্যকিছু চাওয়ার থাকলে বল।”
কেনীথের নির্বিকার কথাবার্তা শুনে আনায়া গরম চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবং কেনীথের ধরে রাখা হাতটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে লাগল। কিন্তু খুব বেশিদূর একটা যেতে পারল না। বরং এর আগেই পেছন থেকে কেনীথ পাইপ দিয়ে ওর পুরো শরীরের উপর পানি ছিটাতে শুরু করে। নিমিষেই বৃষ্টির ন্যায় ঝড়তে থাকা পানিতে আনায়া ভিজে পুরো একাকার হয়ে যায়।একই সাথে সারাদিনের ক্ষি’প্ত মেজাজও যেন সর্বোচ্চ পর্যায় সীমা অতিক্রম করে। আনায়া এদিক ওদিক দৌড়ে পানি থেকে যতই বাঁচার চেষ্টা করছে, কেনীথও যেন উঠেপড়ে ওর পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। শেষমেশ আনায়া আর পালানোর চেষ্টা না করে উল্টো কেনীথের দিকে তেড়ে এলো। এতে কেনীথ উল্টোপাল্টা দৌড়াতে শুরু করলে আনায়া কোনোমতে কেনীথের কাছে পৌঁছেই ওকে ধাক্কা দিয়ে খানিকটা কাদামাটির মাঝে ফেলে দেয়। এবং কেনীথের হাত থেকে পানির পাইপটা পড়ে যেতেই— আনায়া তা তুলে নিয়ে সোজা কেনীথের মুখ বরাবর ধরে।
এদিকে কেনীথ তার চোখেমুখে, গায়ে— লাগাতার পানির স্রোত সামলাতে না পেরে যেথায় পুরো হাঁপিয়ে গিয়েছে।সেথায় আনায়া ওর এহেন অবস্থা দেখে যেন কলিজা ঠান্ডা করা শান্তিতে মেতে উঠেছে।যা কেনীথের বিন্দুমাত্রও সহ্য হলো না। তাই সে আচমকা আনায়ার পা-টা ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকেও নিজের পাশে ফেলে দেয়।
এরপর শুধু হয় দুজনে কাঁদাপানিতে মাখামাখির যু”দ্ধ। একসাথে কাঁদার মধ্যে যেমন মাখামাখি করছে তেমনি কেনীথ এই অবস্থার মাঝেও পাইপ দিয়ে নিজেদের উপর আনমনে পানি ফেলছে। অন্যদিকে আনায়া পারলে তো কেনীথকে ওখানেই গলা চেপে শেষ করে দেয়। কিন্তু এতোকিছুর মাঝেও যেন কেনীথের হাসি-তামাশা বন্ধ হচ্ছে না।
—-“আহ্,শয়তান! ছাড়ব না আমি আপনাকে।”
—“হেই ব্লাড! চল আমরা প্রেমে পড়ি।”
এই অবস্থার মাঝেও কেনীথের এমন রং তামাশা যেন, আনায়ার সর্বত্রকে জ্বা’লিয়ে দেয়। চোখমুখ খিঁচে চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“ঠাডা পড়ুক!”
কেনীথ আনন্দের সহিত খিলখিল করে হেসে বলে,
“পড়লে দুজন সুদ্ধ পড়ুক।”
আনায়া কেনীথের বুকের সাথে লেপ্টে কাঁদা পানির মাঝে শুয়ে রয়েছে। কেননা কেনীথই তাকে য়ক্ত করে জাপ্টে, জড়িয়ে ধরে রেখেছে। দু’জনের পুরো শরীরের সর্বাঙ্গীণে কাঁদা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেখে গিয়েছে। দেখতেও দুজনকে র’ক্তে মাং’স গড়া মানুষের চেয়ে, সদ্য তৈরি ভেজা মাটির পুতুল মনে হচ্ছে। অথচ কেনীথের থামবার কোনো নাম নেই। সে যেন নিজের উল্লাসে মেতে উঠেছে। আনায়া যেদিকে অনবরত কাঁদা থেকে ওঠার চেষ্টা করছে,সেদিকে কেনীথ ততই তাকে বারংবার খিঁচে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে। আনায়া এদিকে বিরক্তিতে সম্পূর্ণ অস্থির হয়ে গিয়েছে। ওদিকে কেনীথ পাইপটাকে আকাশের দিকে উঁচিয়ে রেখেছে। যার ফলে বৃষ্টির ন্যায় পানি ঝড়ে তার সারা শরীরকে আরো ভিজিয়ে দিচ্ছে। আনায়া পাইপটাকে ধরতে চাইলে, কেনীথ তা এদিক ওদিক সরিয়ে আবহকে আরো বিতিকিচ্ছিরি বানিয়ে ফেলছে। সবশেষে তার উল্লাসে মেতে ওঠা হাসি যেন থামছেই না।
ওদিকে আবার দোতলার বারান্দা থেকে, পাহাড় সমান জমে থাকা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে, অপলক তাকিয়ে রয়েছে রেহান আর রোজ। দু’জনের চোখেই নিস্তব্ধতা। মুখে ঝুলছে এক অদ্ভুত মলিন হাসি। দুজনের গল্প আলাপকালে যখন আনায়া আর কেনীথের এইসব কারবার শুরু হলো ,তখন থেকেই দুজনকে দূর হতে দেখছে তারা। সবশেষে আনায়া আর কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, দুজনে আড়ালে নিজেদের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিস্তৃত মুচকি হাসল।
____________
আনায়া দ্রুত কাঁদা থেকে উঠে,কোনোমতে নিজেকে ধুয়ে নিয়ে রুমে চলে এসেছে। এরপর সরাসরি গোসল করতে বাথরুমে চলে যেতে নিলে কেনীথ এখানে এসেও বিপত্তি বাঁধায়। আনায়ার পেছন পেছন কেনীথ নিজেও ছুটে আসে। এরপর আনায়া যখন বাথরুমের দরজা লাগাতে নিয়েছে, ঠিক সেই মূহুর্তেই কেনীথ জোর করে বাথরুমে ঢুকে গিয়ে, নিজেই দরজা লাগিয়ে দেয়।
—“হা…আ….হাহ্! তোমার সমস্যাটা কি? আজ আমার মাথা খেতে উঠে পড়ে লেগেছো কেনো?”
আনায়ার এতো রাগের মাঝেও কেনীথ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“ছিঃ বউয়ের মাথা কেউ খায় নাকি? খায় তো…”
—“যাস্ট শাট আপ, বের হয়ে যাও বলছি।”
আনায়ার ধমকে যেন কেনীথের মন আরো খুশিতে নেচে উঠল। প্রচন্ড ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আনায়ার কাছে গিয়ে, ওর কোমড় এক হাতে টেনে নিয়ে, নিজের কাঁদা মাখা শরীরের সাথে মিশিয়ে নেয় । একটু আগেই নিজেকে কোনমতে ধুয়ে পরিষ্কার করে এসেছিল আনায়া, আর যা এখন পুনোরায় খারাপ করে দিয়ে কেনীথ দিব্যি হেসে যাচ্ছে। আনায়ার কাছে কেনীথের এমন অসময়ের হাসি পুরো বি’ষের মতো লাগল। জীবনটা পুরো ঝালাপালা করে দিয়েছে তার৷
—“এটা কি করলে? এইমাত্র কাঁদা পরিষ্কার করে এসেছিলাম। আর তুমি…ইয়্যাউ।”
—“ভালোই হলো, চল এখন দুজনে একসাথে গোসল করে পরিষ্কার হয়ে নেই।”
—“দূরে সরো আমার। তোমার আশেপাশেও আর আমি নেই। তুমি আগে পরিষ্কার করে নেও। এরপর আমি গোসল সারবো। এখন আমি চললাম!”
আনায়া এই বলেই চলে যেতে চাইলে, কেনীথ আনায়াকে আরো নিজের কাছে টেনে আঁকড়ে ধরে। অতঃপর নিজের কাঁদা মাথা হাত, আনায়ার গাল-গলার কাছে রেখে,তার মাথাটাও নিজের মুখোমুখি টেনে এনে, কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলতে লাগল,
“চলে যাবি বললেই তো হয় না,মাই ফায়ার বার্ড। তোর জন্য আমার গায়ে কাঁদা লেগেছে। তাই এখন আমাকে গোসলও তুই করাবি।”
—“আমার জন্য কাঁদা লেগেছে মানে? আগ বাড়িয়ে ইবলিশের মতো নাচতে নাচতে আমার কাছে কে এসেছিল প্রথমে? আমার ভুত নাকি আপনি? আবার এই বুইড়া বয়সে পানির পাইপ নিয়ে লাফালাফি কে করেছিল? আমি না তুমি? এখন বলো, সব দোষ আমার?”
—“সব দোষ তোর না হলেও, কাঁদার মাঝে ধাক্কা তো তুই দিয়েছিলি আমায়।”
—“আমি তো পানি থেকে বাঁচার জন্য তোমায় ধাক্কা দিয়েছিলাম। এখন এতো জায়গা থাকতে কাঁদার মধ্যে মুখ ধুবড়ে পড়লে, সে দোষও আমার?”
—“ধাক্কা কেনো দিলি? সে কথা বল।”
—“ধাক্কা দিয়েছি বেশ করেছি। এবার তো শুধু কাঁদার মাঝে মাখামাখি হয়েছে। এর পরের বার আবার এমন কিছু করলে, সোজা কাঁদার মধ্যে চু”বিয়ে মা”রবো।”
—“আহ্,আসছে আমার দিমাগওয়ালি, বাহুবলী। একবার তুলে নিয়ে আছাড় দিলে, নাম নিশানাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ মেডামের কথার কি ঝাল।”
—“দিয়ে দেখো না শুধু একবার!”
—“তবে এই নে!”
আনায়ার কথা শেষ হতে না হতেই কেনীথ আনায়াকে পাজকোলে তুলে নিয়ে সোজা পানি ভর্তি বিশাল বড় বাথটাবের মাঝে ছেড়ে দেয়। ধপ করে উপর থেকে নিচে, পানি ভর্তি বাথটাবে পড়ায়, আনায়া কোমড়ে খানিকটা ব্যাথাও পেলো। ব্যথিত চোখে কেনীথের দিকে তাকাতেই, কেনীথ নিমিষেই খানিকটা নরম স্বরে বলে উঠল,
“কি হলো, ব্যাথা পেয়েছিস?”
—“ব্যাথা দিলে তো ব্যথা পাবোই। সকাল থেকে না খেয়ে,সারাদিন কাজকর্ম করেও কূল পাচ্ছি না। আর আপনি আমার জীবন ঝালাপালা করতে মরিয়া হয়ে উঠছেন।”
আনায়া ব্যথিত স্বরে এটুকু বলতেই বাথটাব থেকে উঠতে নিলে কোমড়ের ব্যাথায় আর উঠতে পারল না।বরং পুনোরায় ধপ করে নিচে বসে পড়ল। বুঝতে আর বাকি নেই, ব্যাথাটা ভালোই লেগেছে।আর এটা দেখা মাত্রই কেনীথ আনায়ার কাছে ছুটে এলে, আনায়া ওকে দূরে ঢেলে দিয়ে খানিকটা অভিমানী কন্ঠে বলতে লাগে,
“হয়েছে আর কিছু করতে হবে না। যদি একটু দয়া মায়া হয় তবে তাড়াতাড়ি নিজের কাজ সেরে চলে যান। এইটুকু সময় একা থাকতে দিন আমায়।”
আনায়ার কথা আর ওর দূরে ঢেলে দেওয়াতে, কেনীথও আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। মূহুর্তেই তার নিজের ফুরফুরে মেজাজেও এক বিশাল গাম্ভীর্যের ছায়া নেমে এসেছে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে কেনীথ দ্রুত গোসল সেরে পরিষ্কার হয়ে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। ওদিকে আনায়া কেনীথের হাভভাব আর কাজকর্ম দেখে শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।
আনায়া নিজেও তার গোসল সেরে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। মাথায় সাদা তোয়ালে প্যাছানো আর পরনে ধূসর রংএর লং কূর্তি। কোমড়ে এখনো হালকা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে বিধায়, কোমড়ে একহাত ঠেকিয়ে রেখে দিয়েছে। কিন্তু সে রুমে প্রবেশ করে দেখল— ভিন্ন চিত্র। তাকে দেখামাত্রই কেনীথ তার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“এখনো ব্যাথা আছে?”
আনায়া কেনীথের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”হুম।”
কেনীথ ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
—“গিয়ে বিছানায় বস, আমি আসছি।”
আনায়া কেনীথের কথামতো বিছানায় বসতেই, কেনীথ একটা পেইন রিলিফ স্প্রে এনে ওর পাশে বসে পড়ে। কেনীথের হাভভাব বোঝা মাত্রই আনায়া বলে উঠল,
“প্রয়োজন নেই এসবের। আমি করে নেব।”
কেনীথের গম্ভীর্যের সাথে বলল,
“কথা কম বলে,জামা তুলে যেখানে ব্যাথা পেয়েছিস—তা বের কর।”
কেনীথের গাম্ভীর্য পূর্ণ ভাবসাব দেখে আনায়া মনে মনে মনে মুখ ভেঙ্গিয়ে আওড়ায়,
“আহাহ্! ব্যাথাও দেবে উনি, ভাবও দেখাবে উনি।”
—“মনে মনে যত গালি দেওয়ার, তা পরে দিস। আগে স্প্রে টা লাগিয়ে নে।”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া খানিকটা কেশে উঠল। অন্যদিকে কেনীথ আর আনায়ার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই ওকে ঘুরিয়ে বসিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে জামার একপাশটা তুলে কোমড়ের দিকে নজর বুলাতেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়। হুট করে এই মেজাজ বিগড়ে রাগটা তার নিজের উপরই হয়।আনায়ার কোমড়ের একটাপাশ ফুলে লাল থেকে নীলাক্ত বর্ন ধারন করেছে। কেনীথ হাত দিয়ে আলতোভাবে ছুঁতে নিলেই আনায়া ব্যাথায় চোটে অস্ফুটস্বরে শব্দ করে উঠল। কেনীথ আর দেরি না করে সাথে সাথে,সেই জায়গায় বেশি করে স্প্রে করে দিয়ে আলতো হাতে মালিশ করে দিতে লাগে। একইসঙ্গে খানিকটা অস্ফুটস্বরে বলে, “সরি।”
আনায়াও চুপচাপ মুচকি হেসে বলল,”ইট’স ওকে,জলদি ঠিক হয়ে যাবো আমি।”
কেনীথ আরো কিছুক্ষণ মালিশ করে দেওয়ার পর আনায়ার মাথা থেকে তোয়ালেটা খুলে নিয়ে, নিজ হাতে খানিকটা সময় ধীরে ধীরে মুছে দেয়।আনায়া বাঁধা দিলেও, তা কোনো মতেই শোনে না সে। নিজের মতো তোয়ালে দিয়ে চুল মুছে দেওয়ার পর, নিজ হাতে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে বাকি চুলগুলোও শুকিয়ে নেয়। এই কাজটা কেনীথ শখ করেই হোক, কিংবা আনায়ার সাথে জোড়াজুড়ি করে হলেও, নিজেই করে থাকে। শুধু আনায়া নয়, অরিনকেও গোসল করে দেওয়ার পাশাপাশি নিজ হাতে চুলের যত্ন নেওয়ার কাজে কেনীথ বরাবরই দায়িত্বশীল।
সবশেষে আনায়াকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কেনীথ হাত ধুয়ে এলো। আনায়া গোসলে থাকতেই প্লেটে খাবার সাজিয়ে রুমে এনে রেখে দিয়েছে । আর এখন বসে বসে সেই খাবার নিজ হাতে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত সে। যদিও সারাদিন না খেয়ে থাকার পর এখন আর একটুও খাওয়াতে রুচি আসছে না আনায়ার। কিন্তু কেনীথের জোড়াজুড়িতে কিছু করতেও পারছে না। এরই মাঝে আনায়া খেতে একটু বাহানা খুঁজলে, কেনীথ জোরে ধমক দিতেই আনায়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
“ধমক দেও কেনো। খেতে পারছি না তো কি করব?”
—“সারাদিন এই কাজ, সেই কাজের বাহানা দিয়ে খাবি না। আর এখন খাইয়ে দিচ্ছি তাও হজম হচ্ছে না?”
—“আহ্, রেগে যাচ্ছো কেনো?সারাদিন লাফিয়ে লাফিয়ে আমায় বিরক্ত করলে তুমি। আর এখন রাগ ঝাড়ছোও তুমি?”
—“তো কি করব? আমি না হয় বিরক্ত করেছি, কিন্তু নিজের আর মেয়ের খাবারটা সময়মতো ঠিকঠাক খেয়েও নিয়েছি। অবশ্য তোর থেকে আর কি আশা করা যায়, যে মেয়ে নিজের স্বামী সন্তানের খাবার দিতে দিতে সকাল থেকে দুপুর গড়ায়, সে নিজের খাবার সময়মতো খাবে কোন দুক্কে।”
আনায়া এবার চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“একদিনই তো এমন হয়েছে, এখন এটার জন্য কি সারাজীবন খোঁটা দেবে? আর আমি তো কাজই করেছি। তবুও এতো রাগারাগি করছো কেনো?”
—“ওই! দেবো এক চটকানা। এমন ভাবে বলছিস যেন আমি তোকে কখনো সেঁধে কাজ করতে বলেছি। বারবার বলি,বাড়িতে এতো সার্ভেন্ট রয়েছে, প্রয়োজন হলে আরো কয়েকজনকে নিয়ে আসব। কিন্তু নাহ! আপনাকে তো নেচে-গেয়ে নিজেই লাফিয়ে লাফিয়ে সব কাজ করতে হবে। আমার কথাকে কবে দাম দিয়েছেন আপনি?”
—“আরেহ্, এমন কেনো করছো। শুধু সার্ভেন্টকে দিয়ে সব কাজ হয় নাকি! তোমার বউ কোনো বিদেশিনী নয় যে, শুধু পায়ের উপর পা তুলে সার্ভেন্ট দিয়ে ভুংভাং কাজ করিয়েই শান্ত থাকবে। ওসব আমাকে দিয়ে হবে না,বাঙালী মেয়ে আমি। আর যাই হোক,সংসার করতে হলে ওসব সার্ভেন্টের ভরসায় আমি চলতে পারব না।”
—“আনায়া! তুই তোর মন মরজি যত ইচ্ছে তত কাজ কর। আমার তো তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমাকে তোর পছন্দ না, তাই আমার খেয়াল রাখিস না, ইট’স ওকে। কিন্তু নিজের মেয়ের…আচ্ছা ঠিক আছে। মেয়ের খেয়ালও না হয় আমিই রাখলাম। কিন্তু অত্যন্ত নিজের খেয়ালটা তো ঠিকঠাক রাখ! যতদিন বেঁচে আছি ততদিন না হয়, এভাবে রেগে ধমকে হলেও এসব আমিই করলাম। কিন্তু যখন আমি থাকব না তখন কি করবি? এভাবেই দিনের পর দিন কাজের বাহানা দিয়েই— না খেয়েই পড়ে থাকবি?”
—“কি আজব, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো! হঠাৎ থাকা, না থাকার প্রশ্ন কেনো উঠছে?”
—“শয়তান হোক বা মানুষ, জগতের কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সেক্ষেত্রে একদিন আমাকেও সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই বলছি, আর সবার পাশাপাশি নিজের দিকেও একটু নজর দে। নিজের ভালো থাকায় দায়িত্বশীল হো।”
এই পর্যায়ে এসে আনায়া একমনে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে তার একগাল খাবার অথচ তা না চিবিয়ে, কেনীথের পানে নিজের বিক্ষিপ্ত চাহনি নিক্ষেপ করে বসে রয়েছে। এদিকে ওর অদ্ভুত চাহনি দেখে কেনীথ নিজের গাম্ভীর্যতা ছাড়িয়ে, বিস্তৃত মুচকি হাসিতে মেতে উঠল।
—“কি হলো ম্যাম, এই শেষ সময়ে এসে হঠাৎ আমার প্রেমে পড়লেন নাকি?”
কেনীথের চেহেরায় বিস্তৃত হাসি ঝুললেও, আনায়ার চোখজোড়ায় আকস্মিক জল এসে ভীড় জমিয়েছে।
—“আরেহ কি হলো, কাঁদছিস কেনো?”
—“তুমি আর কখনো এসব কথা বলবে না। অন্তত আজকের দিনে তো না-ই।”
—“কেনো কি হয়েছে আবার।”
—“জানি না।
—” সকাল থেকেই মনে হচ্ছে তুই আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছিস।আমার সবকিছু স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আনায়া সত্যি করে বল, ঘটনা অন্যকিছু হলে আমায় নিরদ্বিধায় বল ,প্লিজ।”
—“এসব কিছুই না। শুধু তুমি আর কখনো ওসব কথা বলবে না।”
—“আচ্ছা ,আচ্ছা ঠিক আছে। আর কখনো এসব কথা বলব না। আমি যেখানেই যাই না কেনো, তোকে সাথে নিয়েই যাবে।”
—“হুম।”
—“সত্যি সত্যি যাবি আমার সাথে?”
—“অবশ্যই! তোমায় একা ছাড়লে যদি— অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে ভেগে যাও, তখন আমি কি করব?”
—“আনায়া,আমি মৃত্যুর প্রসঙ্গে বলেছি।”
—“আমিও তাই বলেছি।”
—“পাগলী একটা!”
কেনীথ গা দুলিয়ে কথাটা হেসে বলতেই, আনায়া চোখ ছোট ছোট করে বলল,
“শুধুমাত্র এই সাইকো ভিকের জন্য।”
_________
বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। প্রত্যেকেই আগামী আয়োজনের জন্য উদ্দীপ্ত। যে যার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এদিকে বহুক্ষণ আগেই কেনীথকে কাপড় গুছিয়ে দিয়ে তৈরি হতে বলে গিয়েছে আনায়া। তবে সে তড়িঘড়ি করে রুমে আসতেই দেখল এখানে কাহিনি তো সম্পূর্ণই ভিন্ন। কেনীথ একদমই তৈরি না হয়ে,জামা কাপড় গুলো কোনমতে বিছানায় ফেলে রেখে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগী হয়ে, কিছুটা একটা করছে।
আনায়া কপাল কুঁচকে কেনীথের কাছে যেতেই দেখে, কেনীথ ঘাড় বাঁকিয়ে উলোটপালোট করে নিজের চুলগুলো দেখছে। এমন সময়ে কেনীথের এহেন নির্বিকার ভাবভঙ্গিতে আনায়া বেজায় বিরক্ত হলো।
—“সেই কখন বলে গিয়েছি রেডি হতে।অথচ তুমি তো দেখছি, মেয়েদের মতো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে,চুলে সিঁথি কেটে ঢং করতে ব্যস্ত।”
আনায়ার তিক্ত কথায় কেনীথ বিশেষ কোনো গুরত্ব না দিয়ে, নিজের কাজ চালিয়ে যেতে যেতেই আনমনে বলে উঠল,
“দেখ, কতগুলো চুল পেকে গিয়েছে আমার। পুরো সাতটা পাঁকা চুল খুঁজে পেয়েছি।”
কেনীথের হাভভাব আর কথার সুরে এবার আনায়াও কিছুটা শান্ত স্বরে বলে,
“তাতে কি হয়েছে?”
কেনীথ ভুত দেখার ন্যায় বিস্ময়ের সাথে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
” তাতে কি হয়েছে মানে! আরে আমার চুল পেকে যাচ্ছে। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! এই নিয়ে আমার চেয়ে তো,তোর বেশি চিন্তা হওয়ার কথা। দুদিন বাদে যখন লোকে বলবে,’ঐ দেখ, চেংরী মেয়ের বুড়ো জামাই।’ তখন তোর খারাপ লাগবে না?”
আনায়া কেনীথের কথার ভঙ্গিমায় চোখ ছোট ছোট করে বলে উঠল,
“মোটেও না, এতে খারাপ লাগার কি আছে? তুমি যা আছো, যেমন আছো,তাই আমার জন্য পারফেক্ট।আর এখন চুল পাকলেই মানুষ বুড়ো হয় না। অল্প বয়সে অতিরিক্ত টেনশন করলে একটু আধটু চুল পেকেই যায়।
আর এমনিতেও, তখন না খুব মরণ নিয়ে ভাষণ দিলে। দুদিনের দুনিয়ায় আর কদিন-ই বা টিকবে। এখন আবার বুড়ো হওয়া নিয়ে এতো আফসোস কেনো?”
আনায়ার তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা শুনে, কেনীথ খানিকটা দিকে কপাল কুঁচকে তাকায়। পরবর্তীতে গা ছাড়া ভঙ্গিতে নির্বিকারে বলতে লাগে,
“এতো তাড়াতাড়িও মরার ইচ্ছে নেই আমার। আমার দুইজোড়া ফুটবল টিম বানানো বাকি।আর আমি বুড়ো হলেও, তুই তো এখনো দিব্যি চেংরী হয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছিস। দেখা যাবে আমি মরতে না মরতেই পঁচা মশা মাছি এসে তোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। আর তুই মশা-মাছি গুলো না তাড়িয়ে,ওগুলোর সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছিস।আর যাই হোক, আমি মরে গেলেও ওসব সিন সহ্য হবে না আমার।”
আনায়া ভ্রু উঁচিয়ে বললো,”তা এই মশা-মাছিগুলো কে শুনি?”
—“তুই যা ভাবছিস তাই!”
আনায়া খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।—“সবাইকে নিজের মতো ভাবা বাদ দেও। ভদ্রতার খাতিরে হলেও, দু’একটা কথা না বললেই নয়।”
—“আরেহ বাহ্! আমি তো কিছু বললামই না৷ তাতেই…”
কেনীথ বাঁকা হেসে কথাটা বলতেই আনায়া বাজখাঁই গলায় বলে উঠল,
“গু খাই না আমি৷”
—“তা আমি কখন বললাম, তুই গু খাস!”
—“দেখো আমার মেজাজ খারাপ করো না। সারাদিন অনেক জ্বালিয়েছো এবার অন্তত মাথাটা ঠান্ডা করতে দেও।”
—“ফ্রিজে বরফ আছে, নিয়ে আসব?”
কেনীথের রসিকতায় আনায়া নিজের রাগটা কোনো মতে সামলে নিয়ে বলল,
“নাহ! বেশি একটা সময় নেই, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নেও। এটুকু করলেই চলবে।”
—“তা এটা এভাবে বলার কি আছে, আমি তো এমনিতেও রেডি হতেই যাচ্ছিলাম।”
এই বলেই কেনীথ তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে লাগলে, আনায়া বলে উঠল,
“আবার গোসল করবে নাকি? সকালে করেছো একবার, বিকেলের দিকে এসেও… একদিনে এতো গোসল করলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে!”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে,
“তুই চাইলে শুধু সকাল, বিকাল,দুপুর কেনো,মধ্যেরাতেও আমি—নিজেকে গাঙ্গে ভাসাতে রাজি আছি, তারা মাই ব্লাড!”
কেনীথ তার কথা সম্পূর্ণ করেই, আনায়ার উদ্দেশ্য ঠোঁট কামড়ে হেসে, বাম চোখ মা’রে। ওমনি আনায়া তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
“পাপ হয়েছে আমার—জিজ্ঞেস করায় ৷ মাফ করে দিয়ে,এখন নিজের কাজ করুন। তবে এখন গোসল করতে যাবেন না। ঠান্ডা লাগলে কিন্তু আমি তখন সেবাযত্ন করতে পারবো না।”
—“তা পারবি কেন, পারবি তো শুধু মেজাজ দেখিয়ে চিল্লাতে!”
—“তা আমার কোনো শখ-আবেগের কোনো ফ্যাক্টরি নেই যে,কেউ জেনে-বুঝে অসুখ ধরিয়ে আনবে। আর আমি রাত-দিন তার সেবাযত্ন করব।”
—“হয়েছে, দয়া করে যেটুকু করেন সেটুকুই অনেক। এমনিতেও আমি গোসল করতে নয়, ফেইস ওয়াশ দিয়ে মুখ ধুতে যাচ্ছি। যত যাই হোক,একমাত্র শালী সাহেবার বার্থডে পার্টি বলে কথা।”
কেনীথের কথায় আনায়া মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল,
“দিনে দিনে যে তোমার কিসের এতো অধঃপতন হচ্ছে, নিজেও বুঝতে পারছি না।মেয়ে হয়েও আমার ততটা রূপচর্চার খেয়াল থাকে না, যতটা তোমার আছে।”
—“ঠিকই বলেছিস, তুই এসবের কি বুঝবি। তুই আবার কোনো মেয়ে নাকি!”
—“আমি মেয়ে না মানে? আমাকে কি তোমার গোঁফওয়ালা হিটলার মনে হয়?”
—“তা কেনো মনে হবে। তুই গোঁফওয়ালা হিটলারের চেয়েও বেশি কিছু।”
এই বলতে না বলতেই কেনীথ সরাসরি ওয়াশরুমে ছুটে গিয়ে, দরজা লাগিয়ে দেয়। যার ফলে আনায়ার আর রাগের বশে কিছু বলা-করার সুযোগও হয় না। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু একটা মনে পড়তেই, তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমের দরজা গিয়ে শব্দ করে বলতে লাগল,
“ওগো শুনছো!”
—“হ্যাঁ গো বলো!”
আনায়া বেখেয়ালিতে ওভাবে ডেকে ফেললেও, ভেতর থেকে ঠিকই কেনীথের রসিকতার আওয়াজ এলো।সেই সাথে নিমিষেই আনায়ার মেজাজও বিগড়ে গেলো।তবে কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে পুনোরায় জোড় গলায় বলে উঠল,
“আর যাই করো, আমার ফেইস ওয়াশ কিন্তু ইউজ করবে না। ওটা একদম নতুন…নষ্ট করলে দেখো, কি করি তোমার।”
—“ঠিক আছে, আমি তোর ফেইস ওয়াশ-ই ইউজ করবো।বেশি করে নিয়ে, ঘষে ঘষে মাখব। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ,মাই ডিয়ার খলিজা!”
_____
কেনীথ রুমে এসেই সবার প্রথমে নিজের হাতের তোয়ালেটা আনায়ার মুখ বরবার ছুঁড়ে মারল। হুট করে এমন কিছু হওয়ায়, আনায়া নিজেও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। তবে মুখ থেকে তোয়ালেটা সরিয়ে কেনীথের দিকে নিজের রাগান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করতেই, কেনীথ যেন তা মুচকি হেসেই উড়িয়ে দেয়।
আনায়া আর নতুন করে কেনীথের সাথে লাগতে চায় না। এই লোক সর্বক্ষণে তার সাথে ঝামেলা করার পায়তারা করে। এর সাথে যত বেশি নাচা যায়, এ তত বেশিই নাচায়। আনায়া গিয়ে গম্ভীর মুখে কেনীথ হাতে জামা কাপড় গুলো ধরিয়ে দিতেই কেনীথ বলে উঠল,
“পড়িয়ে দে না!”
আনায়া কিছু বলে না। , বিরক্তিতে চোখ ছোট ছোট করে থাকায়,কেনীথ পুনোরায় বলে ওঠে,
“আচ্ছা ঠিক আছে, আমিই পড়ে নিচ্ছি।”
এই বলেই কেনীথ কালো রংএর ফর্মাল পার্টি স্টাইলের প্যান্ট আর ডার্ক রেড কালারের একটা শার্ট পড়ে নেয়। তবে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখতেই চোখ,কপাল কুঁচকে ফেলে। পাশে ফিরে আনায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,
“এগুলো কি পড়তে দিয়েছিস। এমন দেখা যায় কেনো?”
আনায়া বিরক্তিতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, কেনীথের সামনে গিয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। বুকের ওপরের দিকের দুটো খোলা বোতাম ঠিকঠাক লাগিয়ে দিতে থাকে।
—“সবসময় ওই এক কালো রংএর টিশার্ট, প্যান্ট,হুডি, জ্যাকেট না পড়ে মাঝেমধ্যে এসব পড়েও একটু দেখা উচিত।”
কেনীথ কিছুটা অনিশ্চয়তার সাথে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ভালো লাগছে?”
আনায়া মুখ উঁচিয়ে কেনীথের কুঁচকে থাকা মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর আনমনেই মুচকি হেসে বলে উঠল,
“একদম সিনেমার নায়ক লাগছে।”
—“বাহ্,আজ এতো ভালো কমপ্লিমেন্ট?”
—“ভালোকে তো ভালো বলবোই।”
এই বলেই আনায়া দূরে সরে যেতে নিলে, কেনীথ আনায়ার কোমড় পেচিয়ে নিজের কাছে টানে। আনায়া খানিকটা চোখ গরম করলেও কেনীথ তাতে পাত্তা না দিয়ে মুচকি হাসে। নিমিষেই আনায়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
“ব্যর্থ জীবনকেও, আজ সার্থক মনে হচ্ছে। এখন তো ম”রেও শান্তি।”
কেনীথের কথা বলার ভঙ্গিমা কিংবা তার অর্থ খুব বেশি একটা পরিষ্কার ছিলো না আনায়ার জন্য। তবে আজ এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। আনায়া জানে না, তার এই একই অজানা অনুভূতিটা কি কেনীথরও হচ্ছে কিনা? আনায়া কিছু বলতে নিবে এর আগেই অরিন দৌড়ে রুমে প্রবেশ করে। সেই সাথে কেনীথও আনায়াকে ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়।
অরিনের পরনে অনেকটা ঘেড় যুক্ত কালচে লাল আর কালোর সংমিশ্রণের একটা প্রিন্সেস গাউন। যা লম্বায় ঠেকেছে একদম পায়ের পাতা অব্দি। এছাড়া জুতো জোড়াও গাঢ় লাল রং-এর। দূর হতে দেখতে আস্ত ডার্ক চেরীর মতো লাগছে। রুমে প্রবেশ করা মাত্রই অরিন জামার কোণা উঁচিয়ে গোল গোল ঘুরতে লাগল।
—“পাপা, মাম্মাম! দেখো, দেখো, আমায় কেমন লাগছে?”
—“আস্তে লেডিবাগ, পড়ে যাবে।”
কেনীথের কথা শোনা মাত্রই অরিন থেমে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। অমনি আনায়া গিয়ে অরিনকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু একে দিয়ে বলে,
“ফুপি সাজিয়ে দিয়েছে?”
—“হুম, হুম, সুন্দর লাগছে না?”
আনায়া বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে উঠল,
“শুধু সুন্দর নয়, অন্নেক অন্নেক সুন্দর লাগছে।”
অরিন নিমিষেই আনায়ার গালে চুমু দিয়ে, নিজের চশমাটা হাত দিয়ে ঠেলে ঠিকঠাক করে নেয়। সেই সাথে মাথা উঁচিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেনীথের উদ্দেশ্যে বলতে লাগে,,
“তুমি বললে না তো পাপা, আমায় কেমন লাগছে?”
পাশ থেকে কেনীথ এসে অরিনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে, বিস্তৃত নাটুকে ভঙ্গিতে হেসে বলে,
“হায়! হায়! মাম্মাম তো আজ লেডিবাগ থেকে সোজা আস্ত চেরিতে কনভার্ট হয়ে গিয়েছে। কি মুশকিল! এখন তো তোমাকে লুকিয়ে রাখতে হবে।নয়তো এত্তো সুন্দর চেরিটাকে তো যে কেউ তুলে নিয়ে যাবে।”
কেনীথের কথায় অরিন গা দুলিয়ে হেসে ফেলল। নিমিষেই হাসির তালে ছোট্ট ছোট্ট দাঁত গুলো দৃশ্যমান হলো।
—“আমি ভ্যাম্পায়ার কেনীথের মেয়ে—কেনায়া। আর ভ্যাম্পেয়াররা কখনো কাউকে ভয় পায় না। উল্টো সবাই এদের ভয় পায়। তাই আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সাহস কেউ করবে না। নয়তো ভিকে তাদের সবাইকে শেষ করে ফেলবে।”
অরিনের কথা শুনে কেনীথ প্রশান্তির দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
“এই ভিকে-কে আর কেউ না বুঝুক—আমার মেয়ে ঠিকই বুঝেছে।”
কেনীথ যে কথাটা খানিকটা আনায়াকেও খোঁচা দিয়ে বলেছে তা আর আনায়ার বুঝতে বাকি নেই। তবে এতে সে কোনো প্রকার রেগে না গিয়ে হেসে ফেলল। সেই সাথে অরিনকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলতে লাগল,
“অনেক হয়েছে আর দেরি করা যাবে।তোমাদের রেডি করিয়ে, আমাকেও তো রেডি হতে হবে।”
এই বলতে না বলতেই আনায়া দ্রুত গিয়ে কালো রংএর ব্লেজারটা এনে কেনীথকে পড়িয়ে দিতে লাগল। অতঃপর কেনীথ আর অরিনকে বিছানায় বসিয়ে একসাথে দু’জনের চুল ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে দিতে লাগে। যদিও অরিন চুলে কিছুই করতে চায়নি বিধায় আনায়া শুধু আরেকবার চিরুনী করে দেয়। অন্যদিকে কেনীথের চুলগুলোর পেছনের অর্ধেকটা মেসিবান করে দিয়ে বাকিটা খোলা রাখে।
সামনের ছেড়ে রাখা চুলগুলো ঠিকঠাক করে চিরুনী করে দিয়ে আনায়া নিজের কাজের সমাপ্তি ঘটায়। এরপর দুজনকে চোখের সামনে বসিয়ে,নিজের কোমড়ে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁধ এপাশওপাশ করে— ওদের খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেনীথ আর অরিনও চুপচাপ আনায়ার কাজে বাগড়া না দিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। আনায়ার পরীক্ষণ শেষ হলে কোমড় থেকে হাত সরিয়ে,স্বস্তিতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিস্তৃত হেসে বলে,
“একদম পারফেক্ট!”
সেই সঙ্গে অরিন আর কেনীথও হাঁফ ছেড়ে দিয়ে, দুজনে একসাথে বলে উঠল,
“থ্যাংক্’স গড।”
________
অরিন আর কেনীথ তো পার্টির জন্য পুরোপুরি তৈরি। কিন্তু প্রায় অনেকক্ষণ হয়ে এলেও, আনায়ার কোনো খোঁজখবর মিলল না। সেই যে কতক্ষণ আগে তৈরি হতে চলে গিয়েছে অথচ এখন পর্যন্ত তার আসার কোনো নাম গন্ধও নেই। অরিন আর কেনীথ দুজনে অপেক্ষা করতে করতে এখন রুবিক্স কিউব নিয়ে সোফায় খেলতে বসেছে। দুজনেই খানিকটা ঝুঁকে গিয়ে,নিজের হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে, রুবিক্স কিউব মেলানোর খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে। এমনই সময় আনায়া তাদের সামনে এসে বলে,
“কেমন লাগছে!”
আনায়ার কথা শুনে দুজনেই নিজেদের নজর রুবিক্স কিউব হতে সরিয়ে, মাথা উঁচিয়ে আনায়ার দিকে তাকায়। হুবহু অরিনের মতো ডার্ক রেড কালারের বিশাল বড় ভেলভেট গাউন পড়ে আনায়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আনায়ার গাউনটাও পায়ের পাতা অব্দি ছুঁয়েছে। গাউনের নিচের অংশটুকু খানিকটা কালচে আর উপরের টুকু গাঢ় লাল। মূলত লাল-কালো দুটোর কম্বিনেশনে পুরো গাউনটা ডিজাইন করা।
আনায়াকে দেখে অরিন আর কেনীথ দুজনেই পুরো বিস্ময়ের সাথে আকস্মিক সোফা হতে উঠে দাঁড়ায়।অরিন কেনীথের উদ্দেশ্য বিস্ময়ের সুরে বলে ওঠে ,
“উফ! পা…পা! আজ তো মাম্মাম, ফায়ার বার্ড থেকে পুরো ফায়ার এঞ্জেল হয়ে গিয়েছে।”
কেনীথ কিছু বলল না। বরং অপলক আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। ওদের এহেন প্রতিক্রিয়ায় আনায়ার কিছুটা ইতস্ততবোধ হলো। চুপচাপ ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে রয়। তবে অরিন সকল নীরবতা ভাঙ্গিয়ে পুনোরায় কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে,
“পাপা! এতো সুন্দর মাম্মামটাকে তুমি কোথায় পেয়েছিলে?…আমি তো চোখই ফেরাতে পারছি না।”
—“তিনি আমার বহু সাধনার ফল। সুন্দর না হয়ে উপায় আছে!”
আনমনে কথাটা বলতেই কেনীথ খানিকটা কেশে উঠল। সেই সঙ্গে আনায়াও অনেকটা অস্তিত্ব হয়ে উঠেছে। সবকিছু সামলে নিতে তড়িঘড়ি করে বলল,
“কেনায়া মাম্মাম, এদিকে আ…আসো…”
আনায়া অরিনকে ডেকে নিয়ে কাজের বাহানায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অরিনও চুপচাপ আনায়ার কাছে যেতেই, আনায়া একটা ব্রেসলেট বের করে দেয়। ব্রেসলেটের চেইনটা গোল্ডেন কালারের আর তার মাঝে ডার্ক রেড কালারের কিছু ছোট স্টোন বসানো। ব্রেসলেটটা অরিনকে পড়িতে দিতে দিতেই আনায়া বলতে লাগল,
“সুন্দর না! পছন্দ হয়েছে?”
—“ওয়াও…কত্ত সুন্দর এটা। অনেক পছন্দ হয়েছে আমার।”
এটুকু বলেই অরিন আনায়ার গালে টুপ করে চুমু খেলো।আনায়াও অরিনের দুগাল আর কপালে চুমু একে দিতেই অরিন বলল,
“মাম্মাম, আমি এটা ফুপি আর ইনু মামুনীকে দেখিয়ে নিয়ে আসি?”
—“আচ্ছা, ঠিক আছে যাও।”
আনায়ার অনুমতি পেতেই, অরিন দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। আনায়াও ব্যস্ততার সাথে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলো বাঁধতে লাগে। সামনের চুলগুলো সহ, ছোট ছোট চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে সাধারণ একটা মেসিবান করে নেয়। কানে তার একজোড়া চেরি রিং।গলায় কেনীথের দেওয়া সেই রেড ডায়মন্ডের চেরি নেকলেস। এছাড়া সাজগোজ বলতে আর তেমন কিছুই নেই।
এরই মাঝে কেনীথ এসে আনায়ার পেছনে দাঁড়াতেই,আনায়ার কার্যক্রম থেমে গিয়ে, আয়নায় প্রতিবিম্বে কেনীথের দিকে তাকায়। কেনীথও খানিকটা মুচকি হেসে বলে ওঠে,
“এই চেরির সাইজটা কিন্তু একটু বেশিই বড়।”
কেনীথের কথার অর্থ বুঝতে আনায়ার সমস্যা হলো না। বরং সে খানিকটা নার্ভাস হয়ে যায়। পেছনে ফিরে সরে যেতেই কেনীথ বাঁধা দেয়। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে, একটা ডার্ক রেড কালারের লিপস্টিক বের করে। বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে লিপস্টিকের ক্যাপটা ফেলে দিয়ে — আনায়ার গলার পাশে ও ঘাড়ের কাছে বাম হাত রেখে, তার মাথাটা খিঁচে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে। কেনীথের নেশাতুর চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গেলে। এতে কেনীথ খানিকটা তির্যক হেসে, একদম আনায়ার নিকটে গিয়ে নিজের মুখ ঠেকায়। আনায়ার শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে যায়। চোখজোড়া নিভু নিভু। কেনীথ বেশি একটা সময় নষ্ট না করে আনায়ার ঠোঁট আলতোভাবে লিপস্টিক লাগিয়ে দেয়। আনায়াও আর কোনো বাঁধা দেয়না।
তবে তাকে স্বইচ্ছায় কেনীথের লিপস্টিক লাগানোর ব্যাপারটা তার ঠিক বোধগম্য হলো না। কেনীথ তো মোটেও তার লিপস্টিক লাগানো পছন্দ করেনা। যে কারণে, আনায়া সাজগোজের মাঝে যা একটু লিপস্টিক ব্যবহার করত—এখন সপটাও করেনা।
কেনীথ আনায়াকে ছেড়ে দিতেই, আনায়া নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নেয়। নাহ,লিপস্টিক একদম ঠিকঠাক লাগিছে। কালার শেডটাও যথেষ্ট ভালো। তবে আনায়া কেনীথের দিকে খানিকটা কপাল কুঁচকে বলল,
“ঘটনা কি? আজ হঠাৎ নিজে লিপস্টিক লাগিয়ে দিলে যে? তোমার না, আমার লিপস্টিক দেওয়াতে কত সমস্যা! দেখতে ভালো লাগেনা৷ আমি নাকি এমনিতেই সুন্দর। তা এখন আর আমায় সুন্দর লাগে না? হঠাৎ এতো কুৎসিত হয়ে গেলাম যে,আজ তোমায় নিজে থেকে…”
—“চুপ থাক ছাগল! সবকিছুতেই ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করিস কেন?”
আনায়া নিমিষেই ফুঁসে ওঠে। চোখ রাঙিয়ে বলে,
“বেশি হচ্ছে কিন্তু!”
—“কিসের বেশি হচ্ছে। আমার মন চেয়েছে,তাই তোকে আজ নিজ থেকে লিপস্টিক পড়িয়েছি। এতে তোর এতো কিসের সমস্যা।”
—“সমস্যা তো আমার নয়। আপনার হবার কথা। এখন চুমু খেতে…আ…মানে… ওসব আকাম করতে সমস্যা হবে না?”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল।নির্বিকারে লিপস্টিকের কিছু অংশ কামড়ে খেয়ে নিতেই, আনায়ার চোখমুখ কুঁচকে যায়। ওদিকে কেনীথ লিপস্টিক চিবিয়ে খেতে খেতে বলে ওঠে,
—“তারা মাই ব্লাড! ডোন্ট ওয়ারি,ইট’স এডিবল।”
এই বলেই কেনীথ হেসে ফেলল। পুনোরায় আবারও বলে উঠল,
“আজ বিশেষ দিন। তাই স্পেশালি নিজের জন্য এটা এনেছি।”
আনায়া কিছুটা ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“নিজের জন্য?”
কেনীথ নির্বিকারে হেসে বলে,
“অবশ্যই! স্পেশাল নাইটে, বউকে চিপায় নিয়ে গিয়ে, খেতে হবে স্পেশাল লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট। অন অফ মাই মোস্ট ফেবারিট—চেরি ব্লাস্ট,উম্মাহ!”
কেনীথের এহেন অভিব্যক্তিতে আনায়া চোখ-মুখ কুঁচকে যায়। কেনীথের বুকের বা পাশে সোজরে ঘুষি মে’রে বলে,
“অসভ্য,জলহস্তি একটা!
কেনীথ শুরুতে খানিকটা কপাল কুঁচকে, পরবর্তীতে নির্বিকারে হেসে বলে,
” শুধু তোর জন্যই—মাই ঠ্যাংওয়ালা চেংরী।”
আনায়া আর কিছু না বলে কিছুক্ষণ চোখমুখ কুঁচকে চুপচাপ থাকার পর, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এর সাথে এই মূহুর্তে কথার প্যাচে জড়ানোর কোনো মানে নেই। ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা পারফিউম হাতে তুলে নিয়ে,পুনরায় পেছন ফিরে কেনীথের মুখোমুখি হয়। আবহটাকে সহজতর করতে আনায়া স্বাভাবিক ভাবে কেনীথের গায়ে পারফিউম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এমন রক্তের গন্ধ তোমার কেনো ভালোলাগে, আমি তা আজও বুঝে উঠতে পারিনি। ব্লাড পারফিউম… এটা কোনো পারফিউমের ফ্র্যাগরেন্স হলো?”
কেনীথ খানিকটা কপাল কুঁচকে নিয়ে বলে,
“কেনো,আমার কাছে তো ভালোই লাগে।”
—“যতসব উদ্ভট জিনিসই তো তোমার ভালো লাগে।”
—“তাহলে তো, তুই নিজেও উদ্ভট।”
—“মানে?”
—” আমার তো তোকে একটু বেশিই ভালো লাগে। এবং আমি তো তোকে ব্লাড বলি,তাই না?”
আনায়া খানিকটা কপাল কুঁচকে বলল,
“আচ্ছা, দুনিয়াতে এতো কিছু থাকতে তুমি আমায় ব্লাড কেনো বলো? লোকে কত সুন্দর সুন্দর নাম রাখে…হার্ট, সুইটহার্ট, হার্টবিট। এতো সব নাম থাকতে শেষে ব্লাডই কেনো?”
কেনীথ আনায়ার ছেড়ে রাখা কপালের আলগা চুলগুলো—ফু দিয়ে উড়িয়ে,মুচকি হেসে ভাবুক ভঙ্গিতে বলতে লাগল,
“ইন মাই ওপিনিয়ন,ব্লাড ইজ দ্য মোস্ট ইউনিক পার্ট অব দ্য বডি। সুইটহার্ট, হার্টবিট, হার্ট—এসব তো ভালোবাসা প্রকাশে সামান্য কিছু কমন ওয়ার্ড মাত্র। হ্যাঁ,হার্ট ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। কিন্তু ব্লাড ছাড়া কিন্তু সেই হার্টও অচল। তাই ব্লাড…ইট হিট’স ডিফারেন্ট। এটা একবার যদি কারো সাথে মিশে যায়—তবে তা আর আলাদা করা যায় না। তেমনি তুইও আমার ব্লাডের মতো। যা আমার মধ্যে সর্বদা প্রভাহিত হচ্ছে। তুই আমার সর্বস্বে মিশে আছিস। তুই ছাড়া আমি সর্বাঙ্গীণ অসম্পূর্ণ।”
আনায়ার কাছে কেনীথের অভিব্যক্তি কেমন যেন উদ্ভট লাগল।মনে মনে ভাবলো,কেনীথ মানুষ হিসেবেও যেমন উদ্ভট, তেমনি তার কাজকর্ম, চিন্তাধারা, কথাবার্তাও উদ্ভট। আর কেনীথ হয়তো আনায়ার এই বিষয়টা ভালোই বুঝতে পারল। তাই কিছুটা মুচকি হেসে দু’হাতে আনায়ার কোমড় পেঁচিয়ে, নিজের কাছে খানিকটা টেনে নেয়। সেই সাথে আনায়াও তার হাতদুটো কেনীথের কাঁধের দু’পাশের আলতোভাবে রাখে। এদিকে কেনীথ আনায়ার চোখে চোখ রেখে অকপটে বলতে লাগল,
“ভালোবাসার প্রতি মানুষের সাধারণ আকর্ষণ একান্তভাবে হৃদয়ের প্রতি, কারণ হৃদয় একটি স্পন্দিত অস্তিত্ব।যা আবেগের প্রতীক।অথচ আমি তোকে ‘রক্ত’ বলে আখ্যায়িত করি, কেননা রক্ত শুধু এক প্রগতি নয়, এটি জীবনধারণের অবিচ্ছেদ্য উপাদান; শরীরের অস্তিত্বের মূল স্রোত।
রক্তের লাল রং এক নিত্যপ্রবাহিত আগুনের ন্যায় জ্বলন্ত অনুভূতি—উত্তাপ আর তীব্রতার প্রতিচ্ছবি। ভালোবাসাও তেমন উত্তাল, গভীর আর সর্বগ্রাসী। রক্ত যেমন শরীরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে থাকে। তেমন ভালোবাসাও শুধু মনে নয়, অস্তিত্বের প্রতিটি পরতে গেঁথে থাকে।
এবং রক্ত শুধু উষ্ণতা বা প্রবাহ নয়, এটি ত্যাগেরও প্রতীক। কেউ যেমন ভালোবাসার জন্য নিজের সর্বস্ব দিতে পারে, তেমনই রক্ত তার প্রতিটি কণা দিয়ে শরীরকে বাঁচিয়ে রাখে।হৃদয় একদিন থেমে যেতে পারে, কিন্তু ভালোবাসা যদি রক্তের মতো হয়। তবে তা শরীর, মন, আত্মার প্রতিটি শিরায় চিরকাল বহমান রয়।”
কেনীথের প্রত্যেকটা কথা আনায়া প্রচন্ড মনোযোগী হয়ে শুনল। পুরো সময়টায় তার অমনোযোগী হওয়ার যেন কোনো সুযোগই ছিলো না৷ মনে মনে বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল,
“আগে জানতাম এই লোক কথাই বলতে পারে না। পরে জানলাম ইনি আমাকে জ্বালানো ব্যতীত,আর তেমন ভালো কোনো কিছুই বলতে পারে না। অথচ এখন কিভাবে এতো সুন্দর গুছিয়ে কথা বলল?”
আনায়া মনের ভাবনা কাটিয়ে,কেনীথের চোখে চোখ রেখে অস্ফুটস্বরে বলে,
–“এতো সাহিত্যিক হলে কিভাবে?”
—“বউয়ের জন্য পুরুষ মানুষ মাস্টার শেফ থেকে শুরু করে বিউটি আর্টিস,কাজের লোক,ঝাড়ুদার পর্যন্ত হয়ে যায়, সেখানে আমি না হয় একটু সাহিত্যিক হলাম। তাতে ক্ষতি কি?”
আনায়া চুপচাপ কেনীথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।এবং সে কিছু বলছে না বিধায় কেনীথ আবারও বলে,
“এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি কথাগুলো খুব সাধারণ ভাবেই বলেছি। এখন কারো গবর মাথায় এটুকু না ঢুকলে আমার আর কিছু বলার নেই।”
এই পর্যায়ে এসে আনায়া, কেনীথের নির্বিকার কথায় ক্ষিপ্ত হলো। কেনীথ আদতে বোঝাতে চাইছে টা কি? আনায়া রাগে দাঁত খিঁচে কেনীথের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে,সোজা দু’হাতে কলার টেনে নিয়ে বলে ওঠে,
“মানে…কি বোঝাতে চাইছো?”
—“বিউটি উইথ আউট ব্রেইন।”
পুনোরায় কেনীথের নির্বিকার কথা শুনে, আনায়া আরো রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল,
“এ্যাই! কি বোঝাতে চাইছো তুমি? আমার ব্রেইন নেই?”
—“সরি, ভুল হয়েছে। বিউট উইথ গবর ব্রেইন হবে।”
আনায়ার মুখের ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। এই লোক এতো অসহ্যকর কেনো। এতো নির্বিকারে এসব কথা অকপটে বলার পরও দিব্যি হেসে চলেছে। চেহেরা থেকে গা জ্বালানো হাসি যেন সরছেই না। আরো কত মেজাজ কন্ট্রোল করে ধৈর্য ধরবে। আনায়া আর সহ্য করতে না পেরে হাত ছোটাছুটি করে বলতে লাগল,
“ছাড়ুন আমায়। সারাদিনের মেজাজ পুরো একবারে খারাপ করে ছেড়েছেন। এখন আমার মেজাজ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত খবরদার আমার আশেপাশে আসবেন না। ছাড়ুন বলছি!”
কেনীথ আনায়ার কারবার দেখে কোনো মতে ওকে শক্ত হাতে সামলিয়ে বলল,
“আরে আরেহ…কি করছিস! ঠিক আছে,তোর কথাই থাক। তোর মেজাজ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত তোর আশেপাশেও যাবো না আমি। তবে আমার প্রাপ্য পাওনাটুকু, আমায় না দিলে—তোকে ছাড়বোও না আমি।”
আনায়া নিজেকে খানিকটা শান্ত করে, কপাল কুঁচকে বলে,
“কিসের প্রাপ্য পাওনা?”
—“মেয়ে গুনে গুনে তিনটা পেয়েছে। সেক্ষেত্রে মেয়ের বাপ হিসেবে তো আমার আরো বেশি পাওয়া উচিত।”
কেনীথের ইনোসেন্ট ভঙ্গিতে বলা কথাটা আনায়ার কাছে ঠিক বোধগম্য হলো না। কপালটা আরো খানিকটা কুঁচকে ফেলল।
—“কিসের তিনটা…মেয়ে..পেয়েছে…”
সবসময় আমিই কেনো চুমু খাব। কখনো কখনো তুইও তো আমায় সেধে কিংবা জোর করে হলেও একটা দুটো চুমু খেতেই পারিস। আমি কিন্তু কখনোই কিছু মনে করব না।”
কেনীথের সহজ স্বীকারোক্তিতে আনায়া কিছুটা ভড়কে যায়। ইতস্তত চোখে নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে। নাহ্, এখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কেনীথের দু’হাতের শক্ত বাঁধনে আঁটকে রয়েছে। এদিকে আনায়ার এহেন হাবভাব দেখে কেনীথ ওকে আরো শক্ত ভাবে নিজের কাছে মিশিয়ে নেয়। আনায়া পা জোড়া এই পর্যায়ে এসে খানিকটা শূন্যে উঠে গিয়েছে।সেই সাথে আনায়ার শ্বাস-প্রশ্বাসেও এখন যেন বেগ পেতে হচ্ছে। আর এমন রুদ্ধশ্বাস আবহতে আনায়া কেনীথের হাস্যজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আরো বেশি বিচলিত হলো। আদতে এই মূহুর্তে কি করা উচিত তা বুঝতে পারল না। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীর আওয়াজে বলে উঠল,
“মাথাটা একটু নিচু করুন।”
এই কথা শুনে কেনীথ যেন সম্পূর্ণ বিস্মিত। অস্ফুটভাবে বিস্ময়ের সাথে বলে উঠল,
“আজ এই নিরামিষ নারীর এতো উন্নতি!”
—“না হয়ে আর উপায় আছে? আমি কিনা জোর করে চুমু দেব, আর উনি কিনা এতে কিছু মনে করবে না। আহা! কত সুশীল সাধু বর আমার৷”
আনায়া রম্যকথায় কেনীথ ঠোঁট কামড়ে বিস্তৃত হাসে। সেই সাথে মাথাটা খানিকটা নিচু করতেই, আনায়া কেনীথের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। তবে এরপর আর কেনীথের পাগলামি থেকে আনায়া নিস্তার পেলো না। কেনীথ তার হাতের বন্ধনে আনায়াকে পুরো শূন্যে তুলে নিয়ে আকস্মিক ওষ্ঠে ওষ্ঠ মিলিয়ে, এক অদ্ভুত পাগলামিতে মেতে ওঠে। আনায়াকে শূন্যে তুলে নিয়ে কেনীথ অনবরত গোল গোল ঘুরতে লাগে। নিমিষেই আনায়ার বিশাল ঘের যুক্ত গাউনটা ফুলে চারপাশে মিলিয়ে যায়। তবে পুরো দীর্ঘ সময়টাতে কেনীথ একটিবারের জন্যও আনায়ার ঠোঁট ছাড় না।বরং একহাতে কোমর পেঁচিয়ে আনায়াকে শূন্য তুলে নেওয়ার পাশাপাশি, অন্যহাতে আনায়ার মাথার পেছনে রেখে, শক্ত ভাবে আঁকড়ে রাখে। এদিকে আকস্মিক এই পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে আনায়ার দমবন্ধ হওয়ায় সম্পূর্ণ হাঁপিয়ে ওঠে। নিজের হাত দুটো কেনীথের গলায় পেঁচিয়ে, ঘাড়ের সাথে মুষ্টি বদ্ধ করে আঁকড়ে ধরে।
যখন আনায়ার প্রায় জান যায় যায় অবস্থা—সেই মূহুর্তে এসে কেনীথ আনায়া ঠোঁট ছেড়ে দেয়। একই সাথে ঘুরন্ত অবস্থা হতে নিজেদের থামিয়ে নেয়। এদিকে আনায়া অনবরত হাঁপিয়ে চলেছে। শক্তভাবে কেনীথের গলা আঁকড়ে ধরা আনায়ার হাত জোড়া এখন নিস্তেজ হয়ে, কেনীথের কাঁধের কাছে পড়ে রয়েছে। তবে কেনীথের শক্ত হাতের বন্ধনে এখনো তার অবস্থান শূন্যে। অন্যদিকে কেনীথও প্রতিনিয়ত কিছুটা ভারী নিশ্বাস ফেলছে।এবং আনায়ার দিকে অদ্ভুত চাহনিতে অপলক তাকিয়ে থেকে বিক্ষিপ্ত স্বরে বলে,
“হেই ব্লাড চল,আমরা প্রেমে পড়ি।”
আকস্মিক এ কথার প্রতিত্তোরে আনায়া কি বলবে বুঝল না;দুপুর বেলাও সেই একই কথা বলেছে।আনায়া তবুও খানিকটা কপাল কুঁচকে, বিক্ষিপ্ত নিশ্বাসের সঙ্গে বলতে লাগল,
“কিসব বলছো, পাগল হয়ে গিয়েছ?”
—“হয়তো বা, আবার না! তবে এবার তোর প্রেমে পড়ে পুরো পাগল হতে চাই।”
আনায়া আর কিছু বলল না। বরং এলোমেলো নিশ্বাসের পাশাপাশি, এলোমেলো চোখের পলক ফেলে অবাক চোখে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইল। এদিকে কেনীথ পুনোরায় বলে উঠল,
—“কি হলো, প্রেমে পড়বি আমার?”
—“কিন্তু… ”
—“কোনো কিন্তু নয়, হ্যাঁ অথবা না। তুই আমার প্রেমে পড়বি, আর আমি তোকে অনেক ভালোবাসব।”
কেনীথের এহেন পাগলামি কথাবার্তা,অভিব্যক্তি সবই যেন আনায়ার কাছে অজ্ঞাত। এই কেমন কেনীথকে দেখছে সে। এমন পাগলামি তো কখনো কেনীথ করে না। এদিকে আনায়ার বিস্ময়ের মাঝে কেনীথ আবারও বলতে লাগল,
“এবার আর কোনো ঝামেলা চাই না। এইসব কিছু ছেড়ে দিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো আমরা। অরিন, রোজ, ইনায়া,পাভেল, তুই-আমি সবাই মিলে অনেক সুখে-শান্তিতে থাকব।”
এইবার আনায়া কিছুটা ঢোক গিলে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে শুরু করে,
“এতো সহজে এসব ছেড়ে দিতে পারবে? এতো বড় সাম্রাজ্যের অধিপত্য ছেড়ে, দূরে সরতে পারবে?”
আনায়ার কথায় কেনীথ খানিকটা মুচকি হেসে বলে,
“এইসব তো আমি কখনো চাইনি, তারা! এটা আমার মায়ের পারিবারিক সাম্রাজ্য । যা বহু বছর আগে মা নিজেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, শুধুমাত্র একটা স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচার আশায়। আমাকেও তো সে কখনো এসবের সপ্ন দেখায়নি।
আমার বাবা মা চেয়েছিলো আমিও যেন আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচি। কিন্তু ভাগ্য আর বাবা মায়ের করুণ পরিণতি তা হতে দেয়নি। আমার ধ্বং’সা’ত্মক হয়ে ওঠার পাশাপাশি আমার নিজ জীবনও ধ্বং”স হয়েছে। কিন্তু এখন আমার একটা মেয়ে রয়েছে। আমি অন্তত এটা চাই না যে, ওর জীবনটাও আমার মতোই নষ্ট হোক।”
আনায়া খেয়াল করলো কেনীথের অভিব্যক্তি,চাতকের ন্যায় চাহনি—সর্বক্ষেত্রে আকাশস্পর্শী হতাশা, কোমলতা, নিদারুণ আকাঙ্খা।
—“তুমি যা বলছো তা ঠিক আছে। তবে যতটা সহজ ভাবে বলছো,ততটাও সহজ নয় এসব। এটা পাপের রাজত্ব, চারপাশে আমাদের সব শত্রুরা ওঁত পেতে বসে রয়েছে। ওরা সুযোগ পেলেই আমাদের চিরতরে শেষ করতে চাইবে।”
—“তবে চল আমরা একসাথে মরে যাই। এরপর আমরা নতুন করে জন্মাব। একদম রূপকথার সেই ফিনিক্স পাখির মতো। তখন আবার আমরা নতুন করে একে অপরের প্রেমে পড়ব। আমাদের কোনো শত্রুও থাকবে না, কেউ পথে বাঁধাও হবে না। আর আমরাও সবার চেয়ে অনেক দূরে চলে গিয়ে,সুখে শান্তিতে সংসার করব।”
এতোক্ষণ কেনীথের সব কথা আনায়া প্রচন্ড সিরিয়াস হয়ে শুনতে থাকলেও এবার তার মনে হলো এসব কেনীথের মশকরা ছাড়া আর কিছুই নয়।নয়তো এই লোক সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গিয়েছে। আনায়া কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলতে লাগল,
“রাখো তোমার আলাপ। পাগল হয়ে গিয়েছো পুরো।”
এই বলেই আনায়া নিজেকে কেনীথের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে নিলে, কেনীথ খানিকটা মুচকি হেসে বলল,
“আগে বল,আমার প্রেমে পড়বি কিনা?”
আনায়া কিছুটা ভাবুক ভঙ্গিতে বুকে হাত গুঁজে বলল,
“ভেবে বলব!”
—“কখন?”
—“সঠিক সময় এলে।”
___________
আনায়া একদম রেডি হয়ে একবার ইনায়ার রুমে এলো। রুমের মাঝে কোথাও ইনায়াকে দেখতে না পেয়ে ওকে ডাকতে ডাকতেই বারান্দায় চলে যায়। তখনই নজরে পড়ে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা ইনায়ার দিকে। একমনে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে রয়েছে মেঘে ঢাকা চাঁদের দিকে। পরনে কালো রংএর একটা লং পার্টি গাউন। কাঁধ পর্যন্ত চুলগুলো ছেড়ে রাখা।
আনায়া শুরুতে অনেক বেশি প্রফুল্লচিত্তে ছুটে এলেও, ইনায়ার হাবভাবে সে কিছুটা মিইয়ে যায়। খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার দিকে এগিয়ে আসে। অতঃপর পেছন থেকে ইনায়ার কাঁধে হাত রেখে অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“ইরা!…মন খারাপ?”
ইনায়া কিছু বলে না। একই ভঙ্গিতে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আকাশের পানে। আনায়া আবারও আড়ালে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইনায়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে গ্রিলের উপর রাখা ইনায়ার হাতের উপর— নিজের হাতটা রাখে। এই পর্যায়ে ইনায়া খানিকটা চমকে উঠে পাশে ফিরে তাকায়। আনায়া বুঝতে পারল, সে যে এখানে এসেছে তা ইনায়া এতোক্ষণ বুঝতেই পারেনি। যা এইমাত্র সে টের পেয়েছে।
ইনায়ার ভেতরে যে ভয় জন্মেছে, তা কোনো হঠাৎ সংঘটন নয়। তা জমেছে ধীরে ধীরে, স্তরেস্তরে— বহুদিনের চুপ থাকা রক্তমাখা ইতিহাসের নিচে। একদিন যে হাত নিঃসঙ্কোচে শিশুর গলা চেপে ধরেছিল, আজ সেই হাত কাঁপে—শুধু একটি শিশুর নিঃশব্দ হাঁটার শব্দে। চিকিৎসা ইনায়াকে সুস্থ করেনি, বরং জাগিয়ে দিয়েছে এক অপরিণামদর্শী মনকে।যা এতদিন ঘুমিয়ে ছিল নিঃসংবেদনার মোড়কে।
থেরাপির পর ধীরে ধীরে সে বুঝতে শেখে, প্রতিটি শিশুর চোখই মূলত তার অতীতের আয়না…সেই ছোট্ট ইনায়াকে মনে করিয়ে দেয়। যে সর্বদা ভালোবাসা চেয়েছিল, অথচ ভালোবাসার বদলে পেয়েছিল নিপীড়ন, নিঃস্বতা আর নিস্তব্ধ ঘৃ’ণা। এক নৃ”শংস অতীত। ছায়া হয়ে আশেপাশে ফেরা কিছু দানবের অদৃশ্য হানা। সেই ব্যর্থ শৈশব আর অতীতের ছায়া ফিরে আসে শিশুদের মাঝে।আর ইনায়া নিজেরই প্রতিফলন দেখে তাদের চোখে।
শিশুদের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা ছিল শীতল, নিরুত্তাপ—একটি মাংসখেকো শিকারির ন্যায়।কিন্তু চিকিৎসা যখন ধীরে ধীরে তার ভেতরের তলানিতে জমে থাকা গ্লানিকে জাগিয়ে তোলে, তখনই শুরু হয় এক নীরব অভ্যুত্থান—নিজের মধ্যে নিজেকে দেখার ভয়। যে ছোট ছোট চোখ একসময় কাঁদত তার কারণে, সেই চোখগুলোই এখন যেন ইনায়ার ভিতরকার অপরাধবোধের আয়না হয়ে দাঁড়ায়।
তারা তাকে শিখিয়ে দেয় স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে, ব্যথাকে চিনতে এবং নিজেকে দোষী হিসেবে কল্পনা করতে। শিশুদের কণ্ঠ, দৌড়, এমনকি হালকা নিঃশ্বাস—সবকিছুই এখন তার মস্তিষ্কে বিপদের সংকেত হয়ে বাজে। শিশুদের সামনে গেলে তার মনে হয়, আবার কি সেই পুরোনো মনস্টারটি তার ভেতরে জেগে উঠবে?
এ যেন এক নিঃশব্দ আতঙ্ক।নিজেরই রক্তমাখা ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়া, যার সাক্ষী হয় এখন বাচ্চারা। এখন শিশুরা আর তার শিকার নয়, বরং তার বিচারক। তার চোখে তারা যেন প্রতিকারের প্রতীক। যাদের ভয়ে ইনায়া আর নিজের চোখে তাকাতে পারে না। একসময় যে নিষ্ঠুরতায় সে আনন্দ খুঁজে পেত, আজ সে-ই তার মস্তিষ্কে রচিত হয়েছে ভয় ও লজ্জার কেন্দ্রবিন্দুতে। এই ভয় আসলে একটানা রক্তচাপা অপরাধবোধ।বিকৃত আত্মপরিচয়ের প্রতিবিম্ব এবং পুনরায় দা’নবে পরিণত হওয়ার আ’শঙ্কার এক অনন্য সংমিশ্রণ।যেখানে প্রতিটি শিশু তাকে তার নিজের ছায়ার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।
ইনায়া পাশে ফিরে নিস্তব্ধ চাহনিতে আনায়ার দিকে তাকিয়ে রইল।আনায়া খানিকটা মুচকি হেসে বলতে লাগল,
“একা একা কি ভাবছিস?…মন খারাপ?”
ইনায়া এবারও কিছু বলল না। বরং একমনে আনায়ার দিকে নিস্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে থাকে। ইনায়ার এই স্বভাব ভঙ্গিমা আনায়ার কাছে নতুন না। অনেকটা বছর তো হয়ে এলো, নিজের এই লাশের মতো বেঁচে থাকা বোনটাকে প্রতিনিয়ত অজানা কষ্টে পুড়তে দেখছে সে। আর প্রতিবারের মতোই সবকিছু বুঝেও চুপচাপ থাকতে হচ্ছে। এছাড়া করারই বা কি রয়েছে। জেনে বুঝে হোক কিংবা বিকৃতি মস্তিষ্কে…পাপের ভাগীদার হিসেবে তো কেউ কারো থেকে কম না। ইনায়া যা করেছে তা নিয়ে আনায়া নিজেও অবগত রয়েছে। কিন্তু সেসময়ের পরিস্থিতি কিংবা ইনায়ার মানসিক অবস্থা তো আর স্বাভাবিক ছিলো না। সবমিলিয়ে দোষ কিংবা শাস্তিটা কেমন হওয়া উচিত আনায়া তা জানে না।
তবে সেসব কিছু যদি ক্ষণিকের জন্যও ভুলে সামনের দিকে তাকানা যায় তবে—আনায়া তার একমাত্র প্রাণবন্ত চঞ্চল বোনটাকে খুব মিস করে। কখনো ভাবতেও পারেনি, সেই ইনায়া আর আজকের ইনায়ার মাঝে এতো আকাশা পাতাল তফাত হবে।
এরই মাঝে আনায়া খেয়াল করল ইনায়ার চোখ হতে জল গড়িয়েছে। আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে ইনায়ার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ওকে খানিকটা কাছে টেনে নিয়ে বলে উঠল,
“ইরা…বোন আমার, কাঁদছিস কেনো?”
ইনায়া আকস্মিক আজ আনায়াকে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরল। আনায়া এতে যেন অনেকটাই বিস্মিত। ইনায়া কখনো এমন বিহেভ করে না। হ্যাঁ,প্রতিনিয়ত সে নিজের কাজের গিল্টি ফিল করে। এখনো পুরোনো সব ঘটনা তার কাছে ট্রমা হয়েই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু ইনায়া তো কখনো নিজের অনুভূতির প্রকাশ করে না। ও তো সহজে কাউকেই কিছু বলে না।
আনায়াও ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে স্তব্ধ কন্ঠে উঠল,
“প্লিজ বল কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? কোনো কিছু হয়েছে?”
ইনায়া খানিকটা সময় কিছু বলে না। তবে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ইনায়া অনেকটা ফুঁপিয়ে বলতে লাগল,
—“আপু, আমি আর বাঁচতে চাই না৷ আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। অভিশপ্ত লাগে এই জীবন।”
“আনায়ার বুকের ভেতরটা আচমকা ধক করে উঠল। ইনায়ার কণ্ঠের অসহায়ত্ব, তার ফুঁপিয়ে ওঠা, বুকের গভীরে জমে থাকা হাহাকার—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন আনায়াকে গ্রাস করতে লাগল। আকস্মিক একফোঁটা জল গড়িয়ে ইনায়ার কাঁধে পড়ে। আনায়া শক্ত করে বোনকে আঁকড়ে ধরে, যেন ইনায়ার ভেতরের সমস্ত অন্ধকার নিজের ভেতর টেনে নিতে পারবে।
কিছুক্ষণ এভাবেই অতিবাহিত হবার পর আনায়া নিজেকে খানিকটা সামলে নেয়। ইনায়ার মুখটা দু’হাতে ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। ইনায়ার চোখের কোণে জমে থাকা কান্নাগুলো চকচক করছে। ঠোঁটটা অনবরত কাঁপছে।যেন সে নিজের ভেতরের সমস্ত কিছু উগরে দিতে চাচ্ছে, অথচ পারছে না। এই মূহুর্তে আনায়া খানিকটা ভারী নিশ্বাস ফেলে ধীর কণ্ঠে বলতে লাগলো,
“ইরা, এমন কথা আর একবারও বলবি না। আমি শুনতে চাই না এসব কথাবার্তা । তোকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকব, বল? আমরা তো একসঙ্গে চলতে শিখেছি, লড়তে শিখেছি! তাহলে এখন কেন পিছু হটছিস? কেনো নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবছিস?”
ইনায়া কেবল তাকিয়ে রইল আনায়ার দিকে, তার চোখে তীব্র যন্ত্র’ণা। ভাঙা স্বর—হতাশায় পরিপূর্ণ কন্ঠে বলে ওঠে,
“তুই জানিস না, আপু। জানিস না,আমি প্রতিটা দিন কীভাবে বেঁচে থাকি। আমার শ্বাস নিতে প্রচন্ড কষ্ট হয়। মনে হয় কেউ যেন আমার গলা চেপে ধরে রেখেছে। আমি খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, নিজের ছায়াটাকেও সহ্য করতে পারি না। আমার নিজের এই অস্তিত্বটাই বোঝা মনে হয়!”
আনায়ার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে জানে ইনায়ার কষ্ট মিথ্যে নয়। কিন্তু এই দুঃখের সাগরে ডুবে যেতে দেওয়া যায় না। নিজেকে শেষ করে দেওয়াটা কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না।
— “তুই কী ভাবিস, আমি কিছু বুঝি না? আমি সব বুঝি, ইরা! সবটা জানি আমি। কিন্তু তোর এই দুঃখের সাগরে ডুবে থাকলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে? তুই এখন ম*রে গেলে কি অতীতের সব ভুলগুলো ঠিক হয়ে যাবে? উত্তর দে!”
ইনায়া এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অতঃপর কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি জানি, কিছুই ঠিক হবে না। কিন্তু আমি আর পারছি না, আপু। প্রতিটা রাত যখন ঘনিয়ে আসে, মনে হয় সেই ভয়ংকর মুহূর্তগুলো আবার ফিরে আসছে। আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই আমার র”ক্তে ভেজা হাত, শুনতে পাই সেই করুণ আর্তনাদ! আমি তো আর আগের ইনায়া নেই… আমি একটা অভি’শাপ!”
আনায়া চোখে পানি চিকচিক করলেও, ঝাঁঝাল কন্ঠে পুনোরায় বলে উঠল,
-“তোর যা হয়েছে, তার দায় কি শুধু তোর একার? আমরা সবাই জানতাম, পরিস্থিতি তোর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। তুই যা করেছিস, সেটা পরিস্থিতির কারণেই করেছিস! তাহলে কেন নিজের জীবনকে শেষ করার কথা ভাবছিস?”
ইনায়া হতবাক হয়ে আনায়ার দিকে তাকায়।—“তুই বলছিস যেন আমার কোনো দোষই নেই! আমি কি কোনো ভুল করিনি? ভুল কেনো, আমি তো পাপ করেছি।”
আনায়া গলার স্বর নরম করে, গভীর শ্বাস নিয়ে বলতে লাগল,
—“হ্যাঁ,ভুল করেছিস…পাপ করেছিস তুই। আমিও করেছি। আমরা সবাই করেছি। কিন্তু ভুল করলেই কি শাস্তি হিসেবে নিজের জীবন শেষ করে দিতে হবে?… তাহলে আমরা তো সবাই মরে যেতাম!”
ইনায়া এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। আনায়া তাকে কাছে টেনে নিয়ে, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ।অতঃপর আনায়া তার কপালে চুমু একে দিয়ে বলে,
“আমি আছি, ইরা। যতদিন আমি আছি, ততদিন তোকে একা ম”রতে দেব না। আমরা একসঙ্গে এগোব, এই দুঃস্বপ্নগুলোকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেব। কিন্তু সবার প্রথমে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। এতো সহজে আমরা হার মানতে পারি না। ”
—“…………
—” তুই জানিস ইরা! একটা সময় আমিও ভাবতাম সব ছেড়ে চলে যাব। এই অভিশপ্ত জীবনে বেঁচে না থেকে ম”রে যাওয়াই শ্রেয়। আমার এখনো এমনটা মনে হয়, এই দুনিয়ায় আমার থাকার কোনো মানেই নেই। কিন্তু জানিস, কেন আমি আজও সবকিছু মেনে বেঁচে রয়েছি!”
ইনায়া চোখ বন্ধ রেখেই মাথা নাড়ল। সেই সাথে আরো খানিকটা ফুঁপিয়ে উঠতেই, আনায়া আবারও বলতে লাগল,
“কারণ আমি জানতাম, আমি যদি হেরে যাই, তাহলে এই পৃথিবীটা জিতে যাবে। আমি চাইনি পৃথিবীর দেওয়া ক্ষতচিহ্নগুলো আমায় শেষ করে দিক। আমি চেয়েছিলাম নিজেই নিজের গল্পের পরিণতি লিখতে। তুইও পারবি, ইরা। তোকে পারতেই হবে!”
ইনায়া একটু সরে আনায়ার চোখের দিকে তাকায়। তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে, কান্নার দাগ স্পষ্ট। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলতে থাকে,
“কিন্তু আমি পারি না, আপু… আমার সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি আর স্বাভাবিক হতে পারব না। আমি জানি না, আমি কে… আমি কী!…শুধু এটুকু অনুভব করি আমার ভেতরে শুধু অন্ধকার!শুধুই অন্ধকার!”
আনায়া গভীর শ্বাস ফেলল।
—“তুই অন্ধকার নস, ইরা। তুই শুধু ক্লান্ত। তুই যা করেছিস, সেটা হয়তো ভুল ছিল,কিন্তু সেটা তো তুই একা করিসনি! পরিস্থিতি তোকে বাধ্য করেছিল।তোর মস্তিষ্ক বিকৃত ছিল। তবে কেনো শুধু নিজেকেই দোষারোপ করছিস। আর এখন নিজেকে শেষ করে দিয়ে কি সেই পরিস্থিতিকে জিতিয়ে দিতে চাস?”
ইনায়া কিছু বলল না। শুধু আনায়ার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। আনায়াও আলতো করে হাত ধরে বলতে লাগল,
“তুই যদি সত্যিই বাঁচতে না চাস, তাহলে আমি তোকে জোর করব না।আমি জানি তুই যথেষ্ট ম্যাচিউর। কিন্তু তুই যদি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকিস, তাহলে আমি তোর সবসময় পাশে থাকব। আমরা একসঙ্গে সব ঠিক করে তুলব, ইরা। যাস্ট আমার প্রতি আরেকটু ভরসা রাখ। নিজেকে আরো বেশি স্ট্রং কর। দেখবি আমারাও আর সবার মতো স্বাভাবিক হয়ে বাঁচতে পারব। এসব অন্ধকারের জগৎ থেকে বহু দূরে সরে যাব।”
ইনায়া কয়েক সেকেন্ড কিছু বলল না, যেন আনায়ার কথাগুলো মনের ভেতর গভীরভাবে গেঁথে নিচ্ছে। তারপর খুব আস্তে করে, প্রায় ফিসফিস করে বলতে লাগল,,
“আমার এখনো খুব ভয় করে, আপু…”
আনায়া হালকা হেসে বলে,
“ভয় পাবি না। আমি তোর সঙ্গে আছি, সব সময়— সব পরিস্থিতিতে আমাকে তোর পাশে পাবি।”
ইনায়া চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকায়। তার হাতের চাপটা একটু শক্ত হলো। এতোদিনের নিজের ভেতরের টানাপোড়েনের মাঝে এই প্রথমবার মনে হলো, অন্ধকারের মাঝেও একটা ক্ষীণ আলো হয়তো রয়ছে। খুব ছোট্ট, খুব দুর্বল—কিন্তু রয়েছে।
কিছুক্ষণ সময় নীরবে অতিবাহিত হবার পর আনায়া ইনায়া দুজনেই স্বাভাবিক হলো। ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যা রাতের অন্ধকারের সূদুরে তাকায়। চারপাশে বিস্তৃত জায়গা জুরে নানান রকমের আলো দিয়ে সুসজ্জিত রূপে সাজানো। পার্টির আয়োজন পুরোটাই হয়তো সম্পূর্ণ। ইনায়ার আনমনে এসব ভাবার মাঝে আনায়ার কিছু একটা মনে পড়তেই অনেকটা বিস্তৃত মুচকি হেসে বলতে লাগল,
“জানিস ইরা,কেনীথ আমায় আজ কি বলেছে?…ও এখন চাইছে আমাদের সবাইকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো বাঁচবে। তুই ভাবতে পারছিস! ও এই পুরো সাম্রাজ্য…সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছে।”
আনায়ার উৎসুক চেহারার দিকে ইনায়া অপলক তাকিয়ে রইল। যেন কিছু বলতে চাইছে তবে বলাটা উচিত কিনা জানে না। আনায়াও যেন বিষয়টা খানিক আন্দাজ করতে পারল। এরইমাঝে ইনায়া খানিকটা দ্বিধা নিয়েই শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“আপু! আজ একটা সত্যি কথা বলতো। আমাদের প্রত্যেকের এমন জরাজীর্ণ জীবনের জন্য তুই কাকে দায়ী করিস?”
আনায়ার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে নিত্যন্তই চুপ করে রয়েছে। ইনায়া এতে কিঞ্চিৎ রুক্ষ হেসে বলল,
“তুই না বললে বরং আমি বলি৷… উত্তরটা হলো ভিকে।”
আনায়া স্বাভাবিক রইল। অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ যেন আগে থেকেই উত্তরটা তার জানা। তবুও অস্ফুটস্বরে বলল, “হয়তো।”
ইনায়া পুনোরায় মুচকি হেসে আনায়ার মেঘে আচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবারও বলে ওঠে,
“তুই কখনো ভেবেছিস, তোর এই জীবনে ভিকে না থাকলে কী হতো?”
আনায়া এবার একটু রুক্ষ হেসে জবাব দেয়,
“আমি আর তুই হয়তো এতদিনে মরে যেতাম।”
— “আর বেঁচে থাকাটাই তো আমাদের সবচেয়ে বড় শাস্তি, তাই না?”
আনায়া পুনোরায় নিশ্চুপ।ইনায়ার কথাটা মিথ্যে বয়। কেনীথের জন্য যেমন তাদের জীবন ধ্বং”স হয়েছে। তেমনি ধ্বং”স হবার পর, তাদের এই বিধ্বস্ত অগোছালো পাপের জীবনে, কেনীথের ছায়া না থাকলে বহু আগেই হয়তো খুব সহজে তাদেরও চিরতরে শেষ হয়ে যেতে হতো। আনায়ার ভাবনার মাঝে, ইনায়া এবার একটু এগিয়ে আসে তর কাছে।
—“আপু, তুই কি ভিকে কে ভালোবাসিস? সত্যি করে বলবি!
আনায়া একটু থমকে যায়। কয়েকবার চোখের পলক ঝাপটায়। ইনায়া হতে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
“আমি জানি না।”
— “তুই কি ওকে ঘৃণা করিস?”
আনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল।— “আমি সেটাও জানি না।”
ইনায়া এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল,
“তাহলে তুই কেনো আজও ওর সাথে আছিস?”
আনায়া চোখ বন্ধ করে ভারী নিশ্বাস ফেলে,নরম স্বরে বলতে লাগে,
“আমি সত্যিই এসবের কিছু জানি না । ও হয়তো আমার শেষ আশ্রয়, হয়তো আমার শেষ অভিশাপ। সঠিক কারণ… আমি জানি না। এই প্রশ্নের উত্তর আমি, বহুবার খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। তবে আমি হয়তো আর কখনোই কেনীথকে ছাড়তেও পারবো না।”
কেনীথের উপস্থিতি আনায়ার জন্য এক অভিশাপের মতো, আবার আশ্রয়ের মতোও। ওর জন্যই আনায়া, ইনায়া সহ সবার জীবন এত জটিল, এত বিভ্রান্তিকর।
কেনীথও জানে, আনায়া হয়তো কখনোই তাকে স্বাভাবিকভাবে ভালোবাসবে না। খুব সামান্য হলেও,একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েই যাবে তাদের মাঝে। তেমনি আনায়াও জানে, কেনীথ এবং সে কখনোই একে-অপরকে ছাড়তেও পারবে না। এই টানাপোড়েনের মধ্যে তাদের বাকি জীবন কেটে যাবে।
একদিকে আনায়া, যে একসময় সবকিছু সামলে রাখত। আজ সে নিজেই জানে না, সে কী করতে চায়।অন্যদিকে কেনীথ, যে সব জানে,সব বোঝে,তবুও কিছু বলে না। সাথে কিছু বদলায়ও না। যেন সে নিজেই এই মায়াজাল তৈরি করেছে, আর ধীরে ধীরে এর ভেতর সবাইকে আঁটকে ফেলেছে।
আবারও দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। দুজনেই অপলকভাবে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। হাত দুটো রেলিং এ মুঠো করে রাখা। এরমই মাঝে ইনায়া কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠল,
“তুই কি কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখিস, আপু?
আনায়া স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দেয়,
“হুম, প্রতিদিন দেখি৷”
—” কী দেখতে পাস?”
আনায়া খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
” একটা মুখ… যা একসময় আমার ছিল।
ইনায়ার কৌতুহলী স্বরে বলে,
” এখন নেই?
—“না, নেই। আমি একদিন নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে হারিয়েছি, আর কেনীথ সেদিন হতে আমায় নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছে।”
—“এই নিয়ে, তুই কি ওকে দোষারোপ করিস?”
—” জানি না। যদি দোষারোপ করতে চাই, তাহলে প্রথমে নিজেকেই করব। কারণ আমিই ওকে আমার পৃথিবী হতে দিয়েছিলাম।”
–“তোর সব কিছু শেষ করে দেওয়া লোকটা তোর পৃথিবী?”
আনায়া খানিকটা আলতো হেসে বলে,
—“ভিভান শুধু আমার পৃথিবী নয় — সে আমার ধ্বং”সও।”
চলবে______
–