#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
সমাপ্তি পর্ব — (৪র্থ অংশ)
—“ভিভান শুধু আমার পৃথিবী নয়, ও আমার ধ্বং”সও।
—” তাহলে তুই ওকে ছেড়ে দিচ্ছিস না কেনো?
—“মানুষ সবসময় শিকল ভেঙে মুক্ত হতে পারে না। কিছু কিছু শিকল এতটাই গভীরে বসে যায় যে— সেগুলো ভেঙে ফেলতে গেলে নিজেকেই শেষ করতে হয়।”
—“তো তোর কি মনে হয়, তুই ওর সাথে থেকে, প্রতিনিয়ত ওর সংসারের জন্য খাটাখাটুনি করে আজ তুই সুখী?”
—“এটা কেমন প্রশ্ন?”
—“সরি, কিন্তু তুই সত্যি বলবি? জানতে চাই আমি।”
আনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“সুখ বলে কিছু নেই, ইনায়া। আমরা শুধু মানিয়ে নেই।”
ইনায়া ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
—“মানিয়ে নিচ্ছিস?…কেন? এতো কেনো মানিয়ে নিতে হবে? রোজও বলেছে, বাঁচতে হলে মানিয়ে নিতে হবে। এভাবে আর কত সবকিছু মানিয়ে নেব?”
আনায়া বোনের এমন তিক্ততা দেখে,খানিকটা হেসে বলল,
“সব প্রশ্নের উত্তর হয় না।”
—“কিন্তু তোর উত্তরগুলো আমাকে আরও প্রশ্নে ফেলে দিচ্ছে, আপু! আমি তোর ছোটবেলা থেকে সব জানি। আমি জানি কেনীথ কী করেছে, তোর জীবনটা কেমন ছিল আর এখন কেমন রয়েছে। আমি জানি তুই কেনীথকে ক্ষমা করিসনি, অথচ আজও তার পাশেই আছিস। এটা কেমন ভালোবাসা?
—“জানি না, ইনায়া… এটা ভালোবাসা কি না, সেটাও জানি না।
—” তাহলে কী? সব প্রশ্নের উত্তরে এতো জানি না, জানি না আর সহ্য হচ্ছে না আমার। একটা মানুষের জন্য সব শেষ হয়ে গেলো। সবার জীবন ধ্বংস হলো এরপরও… কেনীথ কি তোর কাছে কোনো শাস্তি? তুই কি কেবল ওর বাধ্য হয়ে আছিস?”
ইনায়া শুরুতে অনেকটা রেগে গেলেও পরবর্তীতে নিজেকে শান্ত করল। অন্যদিকে আনায়া ওর পাগলামিতে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলল,
—“বাধ্য হওয়া মানে যদি প্রতিদিন নিজের অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে হ্যাঁ। আমি বাধ্য।”
—“ভালোবাসিস কিনা তাও জানিস না, ঘৃণা করিস কিনা সেটাও জানিস না। আবার বলিস, কখনো ওকে ছাড়তেও পারবি না। এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে বেঁচে আছিস কিভাবে?”
—“তুই কি চাইছিস সেটা আমায় বলতো? এতো সিনক্রিয়েট তো কখনো করিস না। কিছু হয়েছে?”
আনায়ার সন্দিহান কন্ঠস্বরে ইনায়া যেন অবাক হলো। তাচ্ছিল্যের সাথে রুক্ষ হেসে অস্থির হয়ে বলতে লাগল,
—“হাস্যকর!…হ্যাঁ,আমি কখনো এসব করি না কিন্তু আজ করছি। বিরক্ত লাগে আমার সবার এতো ভালোমানুষি দেখে। তাও আবার ঐ কেনীথের জন্য। সবাই কেনো এতোকিছু হওয়ার পরও সব ভুলে স্বাভাবিক রয়েছে? কেনো সবাই ভুলে গিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বিষাক্ত জীবনের জন্য একমাত্র ঐ ভিকে দায়ী।”
—” কারণ ও আমাকে সহ সবাইকে নিজের মায়াজালে গেঁথে ফেলেছে। আমি চাই বা না চাই, ওর অস্তিত্ব আমার ভেতরে ঢুকে গিয়েছে বহু আগেই। ওর ছায়া থেকে বের হতে পারব না আমি।”
—“এসব যাস্ট আবেগের কথা। তোরা কেউ চাইছিস না তাই পারছিস না।”
—“এরমানে বলতে চাইছিস, তুই ওর মায়াজাল থেকে মুক্ত? তবে এতোকিছুই যখন বলছিস, তবে না হয় আমরা যা পারছি না তা তুই করে দেখা। পারবি ওকে শেষ করতে? পারবি? যদি তুই এটা পারিস, তবে আমি প্রমিজ করছি।আমি নিজে তোকে সাহায্য করবো।”
—“হ্যাঁ,অবশ্যই পারবো! কিন্তু…”
—“কিন্তু কি ইনায়া! থেমে গেলি কেনো?”
ইনায়া নিজেও জানে সে আকস্মিক থেমে কেনো গিয়েছে।আর এই কিন্তুর পরিবর্তে সে বলবেটা কি? ওদিকে আনায়া তার স্তব্ধ চেহারার দিকে তাকিয়ে আকস্মিক হেসে ফেলল। সে যেন জানতো এমনটাই হওয়ার ছিলো।
—“কিন্তু! কিন্তু! কিন্তু! এই কিন্তুর মায়াজালেই ফেঁসে রয়েছি আমরা। যা থেকে আজও বের হতে পারিনি। আর তুইও পারবি না।”
—“………..
—“আচ্ছা, ধরলাম তোর জীবনটা ন”ষ্ট হয়েছে শুধুমাত্র কেনীথের জন্য। কিন্তু তুই পাগল হয়ে নিজেও তো কম অন্যায় করিসনি।কতগুলো নিষ্পাপ প্রা”ণ নিয়েছিস, তা হয়তো তুই নিজেও জানিস না। একটা স্বাভাবিক ছেলে রোহান…ওর জীবনটাও শেষ হয়েছে শুধুমাত্র তোর জন্য। শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কষ্ট হতে পারে কিন্তু এটাই বাস্তব। রোহান আর পৃথিবীতে নেই। তুই ভাবতে পারছিস! একটা সুস্থ স্বাভাবিক ছেলে শুধুমাত্র তোর কারণে ন’র’খাদকে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু এতে তোর দোষটা কোথায়? তুই তো স্বাভাবিক ছিলি, তোর জীবনটাও একদম স্বাভাবিক ছিলো। তবে এর জন্য সম্পূর্ণ রূপে দায়ীটা কে? যার জন্য তোর পরিবার ধ্বংস হয়েছে,নিজের বাবার নৃ”শংস মৃত্যুর ফুটেজ নিজ চোখে দেখতে হয়েছে। যার জন্য সবমিলিয়ে তুই একটা সাইকোতে পরিণত হয়েছিলি, সেই ব্যক্তিটা কে? নিশ্চয় কেনীথ, তাই না?
তবে কেনীথের স্বাভাবিক জীবন থেকে একটা ভয়ং”কর সাইকোপ্যাথে পরিণত হওয়ার পেছনে কে দায়ী? ও কি এমনি এমনি সাইকো হয়েছিল?নাকি পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হবার কাল হতেই ও ওমন ছিলো? কোনোটাই তো না।
শোন ইনায়া, দুনিয়ায় কেউ আপনা-আপনি কিংবা জন্মগতভাবে খারাপ-ভালো হয়ে জন্মায় না। পরিস্থিতি, জীবন, মানুষ, দুনিয়া,অতীত— আমাদের নিজস্ব পথে নিয়ে যায়। এমনটা কেনীথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তোর মতো ও নিজেও ওর বাবা মায়ের মৃত্যু নিজ চোখে দেখেছে। সেটা কোনো ফুটেজ নয় বরং লাইভ টেলিকাস্ট ছিলো। তুই তো ছোটবেলা থেকেই তেজী,জেদি স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু কেনীথ তো ওমন ছিলো না। মা বাবার আঁচল ছায়ার বড় হওয়া দুর্বল,ভীতু ছেলেটা এতোটা খারাপ কি এমনি এমনি হয়ে উঠেছিল? মোটেও না! এরজন্য একমাত্র দায়ী ছিলো কিন্ত আমাদেরই বাবা। সেই সাথে হয়তো আমিও।”
ইনায়া চুপচাপ আনায়ার কথা গুলো শোনে। আসলেই তো, এখানে তার করার বা বলার কি আছে? জীবনের হিসেবে এতো কেনো গড়মিল? কোনোমতেই যেন এসবের সঠিক হিসেব মেলানো যাচ্ছে না। এরইমাঝে আনায়া আবারও বলে ওঠে,
“তুই আবার এটা ভাবিব না যে, যার জন্য আমাদের সবার জীবন নরকে পরিণত হয়েছে তার হয়ে সাইগানা করছি। এমনটা মোটেও না। তবে ক্যালকুলেশন করতে বসলে, তোর আর কেনীথের গল্পটা কিন্তু সেই একই। শুধু সময়কালটা ভিন্ন৷তবে তোকে মেনে নিতে পারলে,ওকে কেনো পারব না?”
আনায়া এটুকু বলেই আকস্মিক ভারী নিশ্বাস ফেলে।ইনায়া চেয়েও সে কখনো কঢ়া কথা বলতে পারেনা।তাতে আচমকাই ইনায়া অদ্ভুত সব আচরণ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে অবস্তার ক্রমশই অবনতি ঘটে।যার ফলে সে অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে যায়।এইজন্য বরাবরই আনায়াকে
ব্যাপারে কিছুটা সতর্ক থাকে। অন্যদিকে ইনায়া একদম স্তব্ধ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে, অনবরত কিছু না কিছু ভেবেই চলেছে। একটা সময় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলতে লাগল,
“জানিস, আমি ভাবতাম ভালোবাসা হয় দুইভাবে—হয় কেউ পাগলের মতো ভালোবাসে, নয়তো কেউ একেবারেই ভালোবাসে না। কিন্তু তোর আর ভিকের মাঝে একটা অদ্ভুত—বোধগম্যহীন সম্পর্ক আছে। যেখানে ভালোবাসা আছে, অথচ নেই। যেখানে তুই হয়তো ওকে ঘৃণা করিস, অথচ ছাড়তে পারিস না।”
আনায়া মৃদু হেসে বলল,
” আমি নিজেও বুঝতে পারি না, ইনায়া। যখনই ওর মুখ দেখি, মনে হয় ওর সব ভুল আমি কখনো ক্ষমা করবো না… কিন্তু যখন ও কাছে থাকে না, আমার মনে হয়, কিছু একটা হারিয়ে গেছে। এটা কেমন যন্ত্রণা, আমি জানি না।”
—“তুই আসলে কি চাস বলতো?”
” হয়তো আমি চাই, ওকে অনুভব না করতে। আমি চাই, ওর জন্য আমার হৃদয়ে কোনো জায়গা না থাকুক। আমি চাই, ওর ছায়াটা আমাকে আর তাড়া না করুক।”
—” কিন্তু তুই পারছিস না, তাই তো?”
—“হুম! ও আমাকে ভালোবাসে। প্রচন্ড ভালোবাসে। নিজের মতো করে… ভয়ংকর, ধ্বং”সাত্মক এক ভালোবাসা তার। আর আমি… আমি শুধু সেই ভালোবাসার ভেতর আটকে গিয়েছি, বের হওয়ার দরজাটাই যে খুঁজে পাই না।”
—“তবে তোর কি মনে হয়। এই যে বছরের পর বছর ওর সাথে থাকছিস, দিনরাত যে ওর সংসার করছিস। তুই কি ভিকে কে একটুও ভালোবাসিস না? নাকি ওর প্রতি তোর ঘৃণা বোধ থেকেই, এটা স্বীকার করতে চাস না। আমার তো এটাই মনে হচ্ছে।”
আনায়ার দৃষ্টি দূরের অন্ধকার আকাশের দিকে।ইনায়ার প্রশ্নে না চাইতেও আকস্মিক ঢোক গিললো।কিছুটা সময় ভেবে নিয়ে বলতে লাগল,
—” ভালোবাসা কি শুধু প্রশান্তি আর আনন্দের হয়, ইনায়া? যদি তাই হয়, তাহলে না! আমি কেনীথকে ভালোবাসি না।
—“কি বোঝাতে চাইছিস?”
—” আমি কেনীথকে অনুভব করি। আমার নিঃশ্বাসে,আমার শিরায়, আমার অস্তিত্বের প্রতিটা ছায়ায়। আমি ওকে অনুভব করতে চাই না, কিন্তু পারি না। আমি ওকে ঘৃণা করতে চাই, কিন্তু আমার ঘৃণাটাও ওর প্রতি টান হয়ে যায়। আমি ওকে ত্যাগ করতে চাই, কিন্তু প্রতিবার ওর থেকে পালাতে গিয়ে দেখি, ওই পথের শেষেও কেনীথ-ই দাঁড়িয়ে রয়েছে।”
—” আচ্ছা, তুই কখনো বুঝতে চেয়েছিস ভিকে তোকে কেন ভালোবাসে?
—“ও যা করে, সেটা কি ভালোবাসা?
ইনায়া চোখ ছোট করে বলল,
“তুই কী মনে করিস?
—” কেনীথের ভালোবাসা আগুনের মতো। ও যা ছোঁয়, পুড়িয়ে দেয়। ও যা চায়, ধ্বংস করে পায়। ওর ভালোবাসায় যত্ন নেই, কোমলতা নেই, শুধু একধরনের উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা আছে, যা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে।”
—“এরপরও এমন ভালোবাসা থেকে তোর পালাতে ইচ্ছে হয় না?”
আনায়া কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল। ইনায়া তাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা গুলো কেনো বলছে তা হয়তো কিছুটা তার জানা। অবশ্য তারা দু’জন একত্রিত হলে এমন অসম্পূর্ণ প্রশ্ন উত্তরের খেলা প্রায়ই হয়। দুজনেই যে সঠিক উত্তর গুলো খুঁজে বের করতে চায়। কিন্তু যেখানে প্রশ্ন গুলোই ধোঁয়াশা, সেখানে উত্তর গুলোই বা কিভাবে স্বচ্ছ হতে পারে।
—“পালানো! সম্পর্কের এতোবছর পর এসব কথার কোনো মানে নেই। তবে শুরুতে আমি বহুবার পালাতে চেয়েছি, ইনায়া। কিন্তু প্রতিবার মনে হয়েছে, আমি শুধু ওর কাছ থেকে পালাচ্ছি না,বরং আমি আমার নিজের একটা অংশ ফেলে যাচ্ছি। আমি দূরে গিয়েও ওকে অনুভব করেছি, ওর অস্তিত্ব আমার প্রতিটা শ্বাসে মিশে আছে।”
—” ভিকের ভালোবাসা না হয় ধ্বং”সাত্বক, তবে তার প্রতি তোর ভালোবাসাটা কেমন?”
—“আমার ভালোবাসা… জানি না, এটা আদৌ ভালোবাসা কি না। হয়তো এটা একটা অভিশাপ। আমি কেনীথকে একই সাথে চাই,আবার চাই না। আমি ওকে একই সাথে ঘৃণা করি আবার ওর স্পর্শেই আশ্রয় খুঁজি। আমি ওর ধ্বং”সের জন্য অপেক্ষা করি, আবার ওর অনুপস্থিতিতে শূন্যতা অনুভব করি। একটা সুক্ষ্ম দ্বিধাবোধ সর্বক্ষণ আমার মাথায় ঘুরপাক, কিন্তু তার কোনোকিছুই আমার বোধগম্য নয়।”
ইনায়া খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলল।
–” একটা সম্পর্কে এতো কিছুই যদি অজানা হয় তবে, আদোও এসব ভালোবাসা নাকি ভয়?”
আনায়া চোখ বুজে বলে উঠল,
” দুটোই! কেনীথ ভালোবাসতে জানে না, সে ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয়, গ্রাস করে, দখল করে ফেলে। ওর ভালোবাসার ওজন এত বেশি যে তার নিচ হতে, আমি কখনোই মুক্ত হতে পারব না। আর চাইও না।”
ইনায়া ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আদোও আর কি বলার আছে, তা তার জানা নেই।
—“তুই কি কখনো চেয়েছিস, কেনীথ তোকে সাধারণভাবে ভালোবাসুক? স্বাভাবিক মানুষের মতো?
—“কেনীথ কি স্বাভাবিক? নাকি আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক? ওর ভালোবাসা শ্বাসরুদ্ধকর, ভয়ং”কর। ও যখন আমায় দেখে,তখন আমি তার চোখে আকাশস্পর্শী উন্মাদনা খুঁজে পাই। যেন আমি তার অস্তিত্বের শেষ সীমানা।”
ইনায়া খানিকটা থেমে, পুনোরায় বলে উঠল,
“তুই কি ওকে কখনো ক্ষমা করতে পারবি? তুই চাইলে কিন্তু এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হলেও হতে পারে।”
আনায়া চোখ নামিয়ে উত্তর দেয়,
“ক্ষমা হলো একপ্রকার সান্ত্বনা । আমি সত্যিই জানি না, আমি ওকে কখনো পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারবো কিনা। ওর প্রতি আমার রাগ, ঘৃণা, দুঃখ কিংবা মায়া—সবকিছু মিলিয়ে আমি নিজেই বুঝতে পারি না, আমি ওর কী হতে চাই।”
—“তাহলে তোদের এই সম্পর্কটা কী,এর কি আদোও কোনো নাম আছে? আমার তো মনে হয় না।”
আনায়া কিছুটা থমকে যায়। ইনায়ার কথাটা তো ভুল নয়। তবে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে ওঠে,
—“আমরা একে অপরের অভিশাপ, আবার একে অপরের আশ্রয়। আমরা একে অপরকে শেষ করে দিই, আবার একে অপর ছাড়া বাঁচতেও পারি না।”
—“তোদের এই গল্পের পরিনতি যে কি হবে, আমি কল্পনাতে ভাবতে পারছি না।”
ইনায়ার হতাশাজনক কথার সুরে আনায়া খানিকটা রুক্ষ হাসল। অতঃপর এক অদ্ভুত শিহরনে জেগে ওঠে বলতে লাগল,
“আমাদের গল্পের শেষটা হয়তো সুখের হবে না, ইনায়া। কেনীথ আমাকে শেষ করে দেবে, কিংবা আমি কেনীথকে। নয়তো আমরা দুজনেই একসাথে শেষ হব।”
(চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে আসে। আনায়ার কথায় ইনায়া ভ্রু কুঁচকে ফেলে। দূরে রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়, আর ইনায়া বুঝতে পারে—এই সম্পর্কের আসলেই কোনো নাম নেই। ভালোবাসা, ঘৃণা, দখল, শাস্তি,মায়া—সবকিছু একসাথে মিশে একাকার। আনায়া নিজেও জানে না, সে কেনীথকে ভালোবাসে কি না, কিন্তু সে এটুকু জানে—কেনীথ ছাড়া তার অস্তিত্বও অসম্পূর্ণ।
আনায়া শেষবারের মতো,দূর আকাশের পানে তাকিয়ে আবারও বলতে লাগল,
“জানিস ইরা! আমার না মাঝেমধ্যে নিজের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।”
আনায়ার কথা শুনে ইনায়া বিস্ময়ের চাহনিতে তার দিকে তাকায়। কিন্তু আনায়ার চোখ অন্ধকার আকাশের পানে হতে সরে না।
—“হঠাৎ এমনটা মনে হবার কারণ?”
আনায়া আলতোস্বরে জবাব দেয়। চাহনি তার অন্ধকারে আকাশে হলেও, ধ্যানটা তা অন্য কোথাও।
—“জানিনা! আজ রেহান এসেছে। মাঝেমধ্যেই ও আসে।”
আচমকা রেহানের প্রসঙ্গ ওঠায়, ইনায়া কিছুটা চমকায়।বিস্ময়ের সাথে বলে,
“এক সেকেন্ড! তুই কি এখনোও রেহানকে…আর এইজন্যই কি তোর আর ভিকের সম্পর্কটা…?”
আনায়া আকাশের পানে হতে চোখ সরিয়ে, স্তব্ধ চোখে ইনায়ার দিকে তাকায়।ইনায়া তাতে আরো বিচলিত হয়।
—“এভাবে তাকিয়ে না থেকে,কিছু বল। এখন আমার ভিকে-কে নয়, বরং তোর উপরেই সন্দেহ হচ্ছে।
আনায়া ইনায়ার কথায় কিছুটা আলতো হেসে বলল,
“কেমন সন্দেহ হচ্ছে তোর?”
ইনায়া কিছুটা ঘাবড়ে যায়।শুরুতে কিছুটা ইতস্তত হলেও পরবর্তীতে জোর গলায় বলে,
“হ্যাঁ,আমি ভিকে-কে পছন্দ করিনা। চেয়েও আর সবার মতো ওকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারিনা। কিন্তু এরমানে এই নয় যে, আমি তোকে এসব উল্টোপাল্টা বিষয়ে সাপোর্ট করব। তোদের একটা মেয়ে রয়েছে। ওর ভবিষ্যৎ কি? যদি ভিকে-কে নিয়ে তোর এতোই সমস্যা ছিল,তবে ওই বাচ্চাটাকে কেনো পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিস? রেহান ভাই তো তোর জন্য সবসময় অপেক্ষা করে গিয়েছে, কেনো তার কাছে না গিয়ে ভিকের কাছে পড়েছিলি? এসবের মানে কি?এতোদিন কি অভিনয় করেছিস? আমি তো জানতাম, আমি পাগল।কিন্তু এখন তো আমার তোকেই ঠিক লাগছে না। তুই কি রেহান ভাইকে এখনো ভালোবাসিস?”
—“একবারও কি আমি বলিছি, আমি রেহানকে ভালোবাসি?”
—“তবে হঠাৎ তার কথা কেনো তুলছিস?আবার বলেছিস তোর নিজের চরিত্র নিয়ে…”
ইনায়ার কথা শেষ হবার পূর্বেই আনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে আওড়ায়,
“এটাই তো সমস্যা। একদিকে বলছি ভিভানকে আমি ভালোবাসি না। আবার ওকে ছাড়া থাকতেও পারব না। এরমানে আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু রেহান কেনো মাঝে চলে আসছে?”
আনায়ার অভিব্যক্তিতে ইনায়ার চোখমুখ কুঁচকে যায়। বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে,
“তুই কি আমার মাথা খাওয়ার জন্য এসেছিস? এতোক্ষণ জিজ্ঞেস করলাম ভিকে-কে ভালোবাসিস কিনা। ততক্ষণ বললি, কিচ্ছু জানিসওনা, বুঝিসও না। এখন শেষমেশ এটাই বলছিস যে, তুই ভিকে-কেই ভালোবাসিস। আবার এটা বলছিস যে, রেহান ভাই নাকি তোদের মাঝে চলে আসছে।সে কখন তোদের মাঝে এলো?আচ্ছা, তোর কাহিনি কি,পরিষ্কার করে বলতো?”
আনায়ার কিছুক্ষণ ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,থেমে থেমে নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে বলতে লাগল,
“বুঝতে পারছি না। রেহান আমার ফাস্ট লাভ৷ মানুষ তার প্রথম ভালোবাসাকে ভুলতে পারেনা। তাকে আমি ভুলিনি, এটা ঠিক। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে আজ আর স্বপ্ন দেখি না।”
ইনায়া চোখ সরিয়ে নেয়, তারপর নিচু স্বরে বলে,
“তাহলে সমস্যা কোথায়? ভিকে আছে,তোর একটা স্থির সংসার জীবনও আছে, একটা সন্তানও আছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, সামনে হয়তো আরো হবে।”
—-“সমস্যা হচ্ছে, আমার ভেতরের টানাপোড়েনে। আমি যখন রেহানকে দেখি, একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে। মনে হয়, আমি যেন কোনো অপূর্ণ গল্পের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি—যার শেষটুকু বলা হয়নি। অথচ ভিভান… সে আমার পাশে রয়েছে। প্রতিটা দিন, প্রতিটা রাত। আমি ওর ছায়া হয়ে বেঁচে আছি—কখনো তার সন্তানের মা হয়ে, কখনো সঙ্গী হয়ে। অথচ ভেতরে ভেতরে আমি ঠিক জানি না। আমার সেই আমি’টা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।”
ইনায়ার কণ্ঠে কঠোরতা মিশে যায়।কিছুটা বিরক্তি নিয়েই নিরেট স্বরে বলে,
“তুই এই কথা এখন বলছিস? তোর এই দ্বিধা, এই ভাঙাচোরা আবেগ… সবকিছুর দায় কি শুধু পুরনো কোনো মানুষকে দেখার জন্য? তাহলে তোদের সম্পর্কটায় কোথাও গভীরতা ছিল না?শুধু শুধু এতোগুলোদিন মানিয়ে নেবার নামে, অভিনয় করেছিস?”
“আহ্,আমি তা বলছিনা। ভিভানকে আমি ভালোবাসি। হয়তো খুব গভীরভাবেই।নাহলে এতোগুলো বছর নিশ্চিয়—স্বইচ্ছায় আমি ওর সংসার করতাম না। তার প্রতিটা অভ্যাস, তার অসংলগ্ন কথাবার্তা, এমনকি তার বিরক্তি—সবকিছু আমার কাছে বাস্তব, স্পর্শযোগ্য। কিন্তু আমার ভেতরের একধরনের আবেগ, একধরনের ক্লান্তি… মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ভেতরে আর কেউ বাস করে।যাকে আমি চিনতে পারছি না। কিছু তো একটা গোলামাল রয়েছে।”
ইনায়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে ধীরে বলে,
“তুই কী নিজের সঙ্গে লড়ছিস, না তোর ভালোবাসার সঙ্গে?”
—“”দুটোর সঙ্গেই।আমি চাই না, কেউ আমার অনুভুতিগুলোকে ভুল ব্যাখ্যা করুক। রেহানকে নিয়ে আমার মধ্যে আর কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। কিন্তু তার উপস্থিতি আমাকে বারবার নিজের ভেতরটাকে, প্রশ্ন করতে শেখায়—আমি আজ যা হয়েছি, তা কি আমি হতে চেয়েছিলাম?”
ইনায়া এবার একটু নরম হয়ে বলে,
“আর এই প্রশ্ন তোর আর ভিকের প্রতি ভালোবাসাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে?আর এটাই মূল সমস্যা, তাই তো?”
আনায়া কিছুটা থেমে গিয়ে, সময় নিয়ে বলে,
“নাহ,ভিভানের প্রতি আমার ভালোবাসা কখনো প্রশ্নবিদ্ধ না। কিন্তু আমি নিজেই এখন নিজের কাছে স্পষ্ট না। হয়তো সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো না। আমি জানি না।”
ইনায়া একটু চুপ করে থাকে, তারপর মৃদু গলায় বলে,
“শোন, মানুষ সবসময় পরিষ্কার উত্তর পায় না।এটা সবসময় তোরাই বলিস। কিন্তু কখনো কখনো নিজের ভেতরের এইসব দ্বন্দ্বই ভালোবাসাকে আরও গভীর করে তোলে—যদি সেটা পালিয়ে না গিয়ে, সামনে গিয়ে বোঝা যায়। তুইও চেষ্টা কর, কিছু তো একটার খোঁজ পেয়েই যাবি।”
আনায়া মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে। যেন বুঝে যাচ্ছে, আবার যেন কিছুই বুঝছে না। কিছুটা সময় নিয়ে পুনোরায় বলে,
“যদি না পাই?”
আনায়ার এমন অবুঝের মতো কথা শুনে, ইনায়া প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তবে ম’রে যা!”
ইনায়ার কথা শুনে আনায়া কিছুটা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইনায়া তাতে আরো কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে,
“কি? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? আমি নিজে এক পাগল। মাথার তার এতোবছরেও জোরা লাগাতে পারিনি। আর তুই এসেছিস তোর সব পাগলামি আলাপ নিয়ে। হয় তোরা জামাই বউ মরে যা। নয়তো আমাকে এখান থেকে সরানোর ব্যবস্তা কর। মরার আগে তোরা সব পাগলের সাথে থপকে আধমরা হবার ইচ্ছে নেই আমার।”
ইনায়ার কথাবার্তায় আজ অদ্ভুত ভাবে পুরোনো ইনায়ার সাদৃশ্যতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিছু ছেলেমানুষী আর কিছু তেজী কথা৷ এদিকে আনায়া হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। ওমনি ইনায়া আরেকটু সময় নিয়ে বলল,
“শোন! ভিকে-কে বল, তোর ট্রিটমেন্ট করতে।”
—-“কিসের ডাক্তার দেখাব? আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছি?”
—-“আমি কি একবারও বলেছি, ডাক্তার দেখানোর জন্য?তোর জামাইকে বল, তোর ট্রিটমেন্ট করতে।”
—“কি আজব, আমার বর কি কোনো ডাক্তার নাকি? ও বেটা গান গেয়ে আর মানুষ মে’রেই জীবন পার করেছে। সে আমার কি ট্রিটমেন্ট করবে।”
আনায়ার অবুঝের মতো কথাবার্তা শুনে ,ইনায়া আরো বেশি বিরক্ত হলো।
“উফ! বুঝিস না কেনো, আমি ওসবের কথা বলেছি।”
—-“কোন সব…?” আনায়া শুরুতে কিছুটা অবুঝের মতো করে বললেও,পরবর্তীতে চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“ছিহ্ ইরা! আমি তোর বড়বোন। কি বলছিস, একটু তো খেয়াল রাখ।”
ইনায়া চোখ ছোট ছোট করে, নিমজ্জিত স্বরে নির্বিকারে বলে,
“আর কি বলব? তোর আসলেই ওসবের আরো ভালো ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন। নয়তো এখনোও তোর এসব সমস্যা আসে কোথায় থেকে? চিন্তা করিস না। বছর বছর তিন চারটা করে বাচ্চা নে। দেখবি সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। আর পারলে আমাকে এখান থেকে সরানোর ব্যবস্তা কর।”
—-“কোথায় যাবি তুই? বিয়ে করবি?”
—-“যাস্ট শাটআপ। নিজে বাঁচি না, আরো আসছে আমার বিয়ে নিয়ে। ম’রতে তো দিবি না, তাই যে জায়গায় গিয়ে বাঁচব, তার ব্যবস্তাই করে দে।তবুও আমি এখানে এত্তো গুলো পাগলের সাথে থাকব না।”
আনায়ার তার কথা শুনে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।ওদিকে ইনায়াও আড়ালে ভারী শ্বাস ফেলে,অন্ধকার আকাশের পানে তাকিয়ে,মনে মনে আওড়ায়,
“”মৃ’ত্যু চাই। এক ভয়ং”কর মৃত্যু—এই অভি’শপ্ত জীবন হতে মু্ক্তি চাই। আমি না থাকি—তবুও সবাই ভালো থাকুক।”
____
হঠাৎ ইনায়ার রুমে অরিন চলে এলে ওর আওয়াজ শুনে দু’জনেই স্বাভাবিক হয়ে বারান্দা হতে ভেতরে চলে আসে। আনায়া বিস্তৃত মুচকি হেসে অরিনের সামনে যেতেই অরিন বলতে উঠল,
মাম্মাম, তুমি এখানে! ইনু মামুনি কোথায়?”
অরিনের কথার মাঝেই ইনায়া তার সামনে আসে। তবে খানিকটা ভীত হয়ে। যেন অরিনকে দেখেই তার অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছে। নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। ইনায়ার বর্তমানে সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হলো ছোট বাচ্চা। সে বাচ্চাদের সামনে নিজেকে অতি নগন্য ভাবতে শুরু করে। যেন তার সবচেয়ে বড় ভয় এসকল বাচ্চারা। প্রতিরাতে কিংবা প্রতিক্ষণে সে নিজের পূর্ববর্তী কাজের জন্য অনুতপ্ত। কখনো নিজেকে বাচ্চাদের জন্য অভিশপ্ত মনে হয়, তো কখনো কল্পনায় কিংবা ভ্রমে বাচ্চারা ভয়ানক রূপে তাকে শেষ করতে আসে। আজও ইনায়া সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। যদিও এখানে একমাত্র অরিন ব্যতীত আর কোনো বাচ্চা নেই, কিন্তু ইনায়ার কাছে এই অরিনই সবচেয়ে বড় আতং”ক। যে কারণে সে অরিন থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। এক অজানা ভয়ে সে আজও বিশ্বাস করে, সে অরিনের জন্য ক্ষ”তিকারক। সে অরিনের আশেপাশে থাকলে নিশ্চিত তার ক্ষ”তি হবে। এমন নানান অহেতুক ভয় আ”তংক তার পিছু নিয়ে বেড়ায়।
ইইনায়ার হাবভাবে আনায়ার বুঝতে বাকি নেই যে ঘটনা কি। সে খানিকটা সময় ইনায়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকার পর দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এবং অরিনের উদ্দেশ্য বলতে লাগে,
“মাম্মাম, তোমার ফুপি কি তার রুমে?”
—“হুম, ফুপি বলেছে ব্রেসলেটটা অনেক অনেক সুন্দন। লাভ ইউ মাম্মাম, আমাকে এতো সুন্দর একটা গিফট দেওয়ার জন্য।”
আনায়া খানিকটা মুচকি হাসল। খানিকটা সময় চুপ থাকার কর অরিনের উদ্দেশ্য বলল,
“তোমার মামুনিকে দেখিছো?”
—“নাহ, এখনো দেখানো হয়নি। এইজন্যই তো এখানে এলাম।”
—“আচ্ছা, তবে তুমি তোমার মামুনিকে দেখাও। কিছুটা গল্প করো, আমি তোমার ফুপির সাথে এক্ষুনি দেখা করে আসছি।”
আনায়া কথাটা বলতেই অরিন নিরদ্বিধায় খুশি মনে রাজি হয়ে আনায়াকে সম্মতি জানায়৷ ওদিকে ইনায়া খানিকটা ভীতু চোখে আনায়ার দিকে তাকাতেই, আনায়া তার দৃঢ় চোখের ইশারায় বোঝায় যে, কিছুই হবে না। সে যেন স্বাভাবিক থাকে।
আনায়া এটা প্রায়ই করে। ইনায়াকে সবার সাথে সহজতর তখনই হবে যখন সে অরিনের সাথে একদম নিরদ্বিধায় মিশতে পারবে। বাচ্চাদের প্রতি তার ভয় কাটাতে পারলেই সবকিছু ঠিক হওয়ার আশা করা যায়।
আনায়া খুব বেশি একটা সময় নেয় না। দুজনকে একা ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর সোজা চলে আসে রোজের রুমে। কাজের ব্যস্ততায় রোজের সাথে তার সারাদিনে একবারও কথা হয়নি। এমনিতেই মেয়েটা চুপচাপ একা একা থাকে।আর আনায়া খুব ভালো করেই জানে, আজকের দিনের মর্মার্থ রোজের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার ভেতরের নৈঃশব্দ্য ঢাকা অনুভূতি হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না, এমনকি তারও বোঝার সক্ষমতা নেই। কিন্তু ওকে একেবারে নিঃস্ব হয়ে থাকতে দেওয়াটা উচিত নয়। এতো বড় পরিবার, হয়তো একবারে না হোক।ধীরে ধীরে প্রত্যেকে যদি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে তবে হয়তো সবার জীবনটাও আবার স্বাভাবিক হবে।
রোজ তার লম্বা গাউনটা পেট পর্যন্ত উঁচিয়ে রেখেছে। আয়নার সম্মূখে নির্বিকার ও স্তব্ধ চাহনিতে সে নিজেকে দেখছে। চোখেমুখে শূন্যতা। নজর তার নিজের তলপেটে— একটা পুরোনো ও বিস্তৃত লম্বা কাটা সেলাইয়ের দিকে। যার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। রোজ ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়। তলপেটে একহাত রেখে দীর্ঘ ভারী শ্বাস ফেলে।
তবে আচমকাই কিছু একটার কথা মনে পড়তেই সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে যায়। গাউনটা নিচে নামিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নেয়।
সকালের চিঠির খামটা এখনো খুলে দেখা হয়নি। সেটা এখনোও বারান্দাতেই পড়ে রয়েছে। রোজ নিমিষেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। তখন রেহানের সাথে অনেক কথা হলেও, কি যেন ভেবে সে আর রেহানকে চিঠিটা দেখায়নি।
রোজ চিঠিটা দ্রুত বারান্দা থেকে খুঁজে এনে রুমে আসে। তবে খামটা খুলতে নিতেই তার গলা শুকিয়ে আসে। আগে কখনো এমনটা হয়নি। তবে আজ আশ্চর্যজনক ভাবে তার এটা খোলার মোটেও সাহস যোগাচ্ছে না। যেন মনে হচ্ছে, নিশ্চয় চিঠিতে থাকা বার্তাটা মোটেও ভালো কিছু হবে না।
রোজের হাত মৃদু কেঁপে উঠল। তবুও সাহস করে রুমের ক্যান্ডেলগুলোর সামনে গিয়ে, চিঠির খামটা খুলে ফেলে। নিমিষেই একটা কালো রাঙা ভাজ করা কাগজ বের হয়ে আসে। রোজ কাঁপা কাঁপা হাতে ভাজটা খুলতেই আকস্মিক চমকে ওঠে। সাদা ও লাল রাঙের মিশ্রণে স্পষ্ট ভাবে লেখা,
“𝕴’𝖒 𝖈𝖔𝖒𝖎𝖓𝖌—𝖒𝖞 𝖗𝖊𝖉 𝖗𝖔𝖘𝖊”
—V
এই ছোট্ট লাইনটির এককোণায় ‘—V’ লেখাটিই যেন রোজের জন্য সবচেয়ে বড় আতং”কের। সে লেখাটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, অকস্মাৎ ঢোক গেলে। নিমিষেই গলা শুঁকিয়ে যায়। হুট করেই কাগজটা প্রচন্ড আক্রোশে এলোমেলো ভাবে হাতের তালু দিয়ে পি’ষে চেপে ধরে। তীব্র অস্বস্তির সাথে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,
“ও কেনো আসছে? এসবের মানে কি? কি চাইছে ও? আমার সবকিছু শেষ করে ফেলার পরও কেনো ও শান্ত হচ্ছে না। আর আজই বা কেনো—কোন উদ্দেশ্য আসতে চাইছে?”
এরইমাঝে আচমকা কারো হেঁটে আসার শব্দে, রোজ নিজেকে সামলে নেয়। দ্রুত কাগটা ফুলদানির পেছনে ফেলে দিয়ে, নিজে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে স্বাভাবিক হয়ে বসার চেষ্টা করে।
এদিকে আনায়া খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে, দরজা ঠেলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। ঢুকতেই দেখে রোজ ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আয়নায় একমনে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে। শীতল তার চাহনি, নির্বাক তার অভিব্যক্তি। তবে আনায়ার উপস্থিতি অনুভব করতেই রোজ উঠে এসে আনায়ার দিকে এগিয়ে আসে। বিস্তৃত মুচকি হেসে আনায়ার উদ্দেশ্য বলল,
“অসম্ভব সুন্দর লাগছে তোমায়।”
অনেকটা কাচলে লাল রং-এর ভেলভেট গাউন। খুব বেশি ফ্লাফি হয়। হালকা ঘের যুক্ত তবে তা পার্টি গাউন।লাল রাঙা হালকা কার্লি চুলগুলোও ছেড়ে রাখা৷ মুখে প্রসাধনী বলতে কিছুই নেই৷ একদম সাদামাটা তবুও কতটা অসাধারণ।তবে এসবের মাঝেও আনায়া রোজের অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়াতে কিছুটা অবাক হয়। একমনে তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর , বিস্তৃত হেসে বলল,
“শুকরিয়া।”
—“সব এ্যারেঞ্জমেন্ট শেষ?”
আনায়া শীতল কন্ঠে উত্তর দেয়, “হুম।”
দু’জনের মাঝে খানিকটা সময় নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। নীরবতার কাটিয়ে রোজ বলে উঠল,
“কিছু বলবে?”
আনায়া রোজের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“হুম।”
—“হুম,বলো তবে…”
আনায়া খানিকটা সময় আবারও চুপ রইল। ওদিকে রোজ তার দিকে শান্ত চোখে চাতকের ন্যায় তাকিয়ে। আনায়া কি এমন বলবে, যার জন্য এতো কেনো দ্বিধা।
—“এ কথা তোমায় আগেও জিজ্ঞেস করেছি আমি। তবে উত্তর পাইনি কখনো।”
আনায়ার অভিব্যক্তিতে রোজ খানিকটা মুচকি হাসে।
—“যে প্রশ্নের সঠিক উত্তর নেই, তা আমি তোমায় কি করে দেই, বলো তো?”
—“সঠিকটার প্রয়োজন নেই, তুমি এমনি বললেই চলবে।”
—“আজ হঠাৎ, আবার কেনো এই পাগলামি করছো, বুঝতে পারছি না।”
আনায়া কিছু বলল না। চুপচাপ রোজের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে রইল৷ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
—“কেনীথকে আজও অনেক বেশি ভালোবাসো,তাই না?”
রোজ খানিকটা সময় আনায়ার চাতক চাহনির দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর শীতল কন্ঠে স্বাভাবিক ভাবে বলল,
—“যদি বলি হ্যাঁ,তবে কি কষ্ট পাবে?”
—“নাহ, কখনোই কষ্ট পাবো না।”
—“তবে কি খুশি হবে?”
রোজের সহজ প্রশ্নে আনায়া থমকে যায়। সে কিছু বলে না।ওদিকে ওর চুপ থাকা থেকে রোজ হেসে বলল,
“এসব পাগলামি ছাড়ো,আনায়া! আমার অনুভূতিতে কিছু আসে যায় না। ওটা পূর্বেও যেমন ছিলো এখনও তেমন রয়েছে। আর শত চেষ্টা করলেও, তা কখনো বদলাবেও না৷”
—“এতোটা কিভাবে কেনীথকে ভালোবাসতে পারো? এমন তো নয় যে তুমি ওর সম্পর্কে কিছুই জানো না, তুমি তো সবটাই জানো।”
—“তাকে জানি বলেই তো, আজও তার প্রতি আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্রও বদলায়ি। মিথ্যা বলবো না, চেষ্টা করেছি। বহুবার চেষ্টা করেছি আমি—তার প্রতি আমার অবাধ্য ভালোবাসাকে ভুলে যেতে, কিন্তু পারিনি। শুরুতে নিজেকে অনেক বেহায়া মনে হতো। পরে ভেবে দেখলাম, আমার এই বৃথা চেষ্টা করাটাই যে ভুল।
যদি আমি তাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোইবাসি,তবে সর্বকালে… মৃত্যুর আগপর্যন্ত ভালবাসা উচিত। নয়তো ভালোবাসা নামক মহৎ শব্দের প্রতি সম্মানটুকুই বা আর কোথায় রইল।”
—“তোমাকে দেখে আমি বারংবার আশ্চর্য হই৷ শুধুমাত্র একতরফা ভালোবাসায় কিভাবে কেউ কাউকে এতোটা ভালোবাসতে পারে।”
—“কাউকে ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে এমন তো নয়৷ ভালোবাসা কোনো শর্ত নয়, কোনো জোর-জবরদস্তি নয়। ভালোবাসা হলো সেই অমৃত, যা কাউকে শুধু নিজস্ব ইচ্ছা ও অনুভূতির ভিত্তিতে দেয়া হয়—কোনো প্রতিদানের আশায় নয়। তুমি তাকে ভালোবাসবে, কিন্তু সে তোমাকে কখনো ভালোবাসবে না—এটাও হতে পারে। একতরফা ভালোবাসায় সব সময় চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেনে চলে না। এখানে ভালোবাসা চাওয়ার কোনো অধিকার নেই, তবে এতে সম্মান একটি মৌলিক অধিকার।”
রোজের দৃঢ় কন্ঠের প্রত্যেকটা শব্দ আনায়াকে অবাক করে। এতো কেনো আশ্চর্যময় এই পৃথিবী। কত রকমের বিচিত্র সব মানুষ। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আনায়ার কাছে এখন সবই নতুন লাগে। সে নিজের প্রশ্ন, দ্বিধা নিয়েই এখানে এসেছে।সে জানে, রোজের সাথে কথা বললে, সে তাকে এমন কিছু তো বলবে যে—তার সকল দ্বিধাদ্বন্দ একেবারেই নিঃশেষ হবে।
আনায়া কিছুটা নির্বাক হয়ে রোজের কথা শুনছিল। তার ভেতরে এক অজানা অনুভূতি ঘুরপাক খাচ্ছে। রোজ তার দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে এসে দৃঢ় কন্ঠে বলতে লাগল,
“”একতরফা ভালোবাসা আসলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম। তুমি যা অনুভব করো, সেটি অন্য কেউ কখনোই বোঝে না। তুমি তাকে চাও, কিন্তু কখনোই সে তোমাকে চায় না। এটা যেন একটা একপেশে যুদ্ধ। যেখানে শুধু তুমি নিজের অনুভূতিকে অনুভব করতে পারো, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারো না।”
আনায়া গম্ভীরভাবে বলল,
—“এমন বিষাদময় ভালোবাসা তোমায় কষ্ট দেয় না, রোজ?”
রোজ এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে। শ্বাস টেনে নিয়ে মুচকি হেসে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, দেয়। অনেক বেশি কষ্ট দেয়। একতরফা ভালোবাসায়…যখন তুমি জানো,কখনোই কিছু বদলাবে না। তখন তা এক তীব্র কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তার পরেও, আমি জানি যে আমার ভালোবাসা যদি নির্দ্বিধায় এবং শর্তহীন হয়, তবে তার মাঝে এক ধরনের মুক্তি রয়েছে। যে ভালোবাসা অন্য কাউকে নির্ভরশীল করে না, সে ভালোবাসায় এক ধরনের অমূল্য শক্তি থাকে। যদিও তাতে কষ্টের পরিমাণটা খুব বেশি, তবুও সেটিই জীবনের এক অমূল্য অধ্যায় হয়ে ওঠে।”
আনায়া কিছুটা ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,
“”তাহলে তুমি কেনো এই কষ্ট ভোগ করো? কেনো নিজেকে একতরফা ভালোবাসায় আটকে রাখো?নাহ,আমি তোমায় কেনীথের থেকে দূরে সরে যাওয়া কিংবা…এসব কিছুই বলছি না। তা তুমিও খুব ভালো করেই জানো।
রোজ! তোমার জীবনটা এখনো অনেক সুন্দর রয়েছে,এভাবে আর নিজেকে কত শেষ করে দেবে? প্লিজ তুমি অন্তত স্বাভাবিক হও। চোখের সমানে সবাইকে এতো বিষাদের সাগরে ডুবতে দেখে আমার আর ভালো লাগে না। প্লিজ তুমি অন্তত এসব থেকে বেড়িয়ে এসে স্বাভাবিক হও। তোমার এই বিষাদময় একতরফা ভালোবাসা থেকে কেনো বের হতে পারছো না?”
রোজ মাথা নিচু করে হাসল। আনায়ার কথাগুলো যেন তার কাছে হাস্যকর মনে হলো। ঠিক কি কারণে তা যেন এক অজানা রহস্যই রয়ে গেলো।
“কারণ, আনায়া! একতরফা ভালোবাসা আমাকে প্রতিনিয়ত নতুন এক উপলব্ধি দেয়। আমার অনুভূতিগুলোর মধ্যে আমি সত্যিকারের নির্ভীকতা খুজে পাই। এবং আমি জানি, ভালোবাসা কখনো শুধুমাত্র পরিণতির জন্য নয়। যখন কোনো কিছু কিছুতেই পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, তখন সে ভালোবাসা হয়ে ওঠে অমৃত। তাতে কষ্ট থাকে, তবে তার মধ্যেও যে এক অমর শান্তি রয়েছে।”
আনায়া কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবল, অতঃপর অস্থির হয়ে বলে উঠল,
“তোমার কাছে সুযোগ রয়েছে অথচ তা কাজে লাগাতে চাইছো না। আমাদের জীবনের গল্পটা শুরু থেকেই বাজে,আমরা চাইলেও কেউ মুক্ত হতে পারব না। কিন্তু তুমি আঁটকে রয়েছে এই একতরফা অনুভূতিকে নিয়ে। নাহ, আমি তোমার এই অনুভূতিকে সম্মান করি। কিন্তু এমন যন্ত্রণাকে সারাজীবন বয়ে বেড়ানোটা কি জরুরী?
আনায়ার অস্থিরতায় রোজ কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল। ভারী নিশ্বাস ফেলে শীতল কন্ঠে বলতে লাগল,
“”যন্ত্রণাই সত্যিকারের ভালোবাসার প্রথম পাঠ। যন্ত্রণায় আমরা সবচেয়ে বেশি শিখি। একতরফা ভালোবাসায় তুমি শিখবে কীভাবে নিজেকে ছাড় দিতে হয়, কীভাবে অগাধ ভালোবাসা পেতে না পেলেও নিজের মধ্যে একটি পরিপূর্ণতা অনুভব করতে হয়। তারপর, তুমি বুঝবে, ভালোবাসা কখনোই শর্তের মধ্যে নয়, সেটি আত্মার মর্মের গভীরে থাকে।”
—“………………
—“একতরফা ভালোবাসা হলো অমোচনীয় এক যন্ত্রণা। অন্যসকল ভালোবাসার মতো হয়তো সহজতর তো নয়। তবে, এর গুরুত্বটাও কিন্তু অনেক। কারণ,এ ভালোবাসা আমাদের শিখিয়ে দেয়, মানুষের ভিতরে নিখাঁদ অনুভূতির গুরুত্ব কী। এতে তোমার আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা, সহানুভূতি ও আবেগের গভীরতা বেড়ে যায়।
একতরফা ভালোবাসায়, আমরা শুধু নিজের অনুভূতির প্রতি আত্মসমর্পণ করি।যা কখনো কখনো অন্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। কিন্তু সেটা আমাদের জীবনের এক গূঢ় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, ভালোবাসা কখনোই অভ্যন্তরীণ শান্তি পাওয়ার জন্য নয়। বরং তা নিজের আত্ম-অনুসন্ধান।”
আনায়া কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে রোজের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মাথায় ঢুকছে না, রোজ আর রেহান দুজনেই কেনো একইরকম বিহেভ করছে।সবাই যদি এমন নিজ নিজ জায়গায় দৃঢ় থেকে বাকি সবকিছুর প্রতি গা-ছাড়া ভাবে বাঁচতে থাকে, তবে সবকিছু স্বাভাবিক হবে কি করে!
—“তোমরা কেউই বুঝতে পারছো না। যে যার মতো পাগলামি করছো। রেহানও নাকি চলে যাচ্ছে… তোমাদের দুজনের এখন একটা সম্পর্ক হয়েছে। কেনো এটাকে স্বাভাবিক করতে চাইছো না। অন্তত এভাবে হাল ছেড়ে না দিয়ে কিছুটা তো চেষ্টা করতেই পারো।”
রোজ এবার বুঝতে পারলো আজ আবারও তার পাগলামির মূল কারণ কি। রেহানের বিষয়টা নিয়েই ওর এতো পাগলামি। এছাড়া ভেবেছে আজকের দিনটায় হয়তো সে কোনো বিশেষ অনুভূতির মাঝে আঁটকে রইবে।
আনায়ার নজর পাশে সরে যায়। সবমিলিয়ে ওর ভাবভঙ্গিতে কেমন যেন অস্থিরতা বিরাজমান।রোজ খানিকটা সময় নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল,
“তবে তুমি কেনো আজও স্বাভাবিক হতে পারছো না?”
রোজের কথা শুনে আনায়ার পাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে ওর দিকে তাকাল। সে কিছু বলতে নিয়েও যেন আর বলল না। ওদিকে রোজ আবারও বলল,
“কি হলো! বলো কেনো তুমি আজও কেনীথের সাথে তোমার সম্পর্কটাকে স্বাভাবিক করতে পারোনি?”
—“রোজ আ..মি…”
—“আনায়া! তোমার আর রেহানের সম্পর্কটা আদতে কেমন ছিলো, তার কিছুটা হলেও তো আমার জানা রয়েছে। রেহানকে যতটুকু দেখেছি, বুঝেছি সে তোমায় আজও প্রচন্ড ভালোবাসে, সেই সাথে অত্যাধিক সম্মানও করে। এই সম্মানটা তোমাদের পবিত্র ভালোবাসার জন্যই। আর আমি এটাও জানি, তুমিও আজও রেহানকে ততটাই ভালোবাসো যতটা সে তোমায় বাসে। অথচ তোমরা এতোটাই কঠোর ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী হয়েছো যে, তোমাদের হাজারো অবাধ্য অনুভূতি সেই ব্যক্ত্বিতের সমানে একদম ফিঁকে।”
ঘরজুড়ে থমথমে নীরবতা। বাতাস পর্যন্ত যেন দম আটকে রেখেছে নিজেকে। আনায়া চোখে শূন্যতা।রোজ ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু তার মুখের রেখাগুলো কঠিন, কণ্ঠে প্রচণ্ড তীক্ষ্ণতা।
—“কি হলো, ভুল বলেছি আমি?”
আনায়া কোনো উত্তর দেয় না।রোজের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। শান্ত স্বভাবের মেয়েটাও কিছুটা ক্ষিপ্ত স্বরে বলতে লাগল,
“এভাবে চুপ থেকে লাভ নেই, আনায়া! তুমি আজও তোমার জীবনকে এই দোটানার বেড়াজালে আটকে রেখেছো।কিন্তু এতে কখনোই কিছু স্বাভাবিক হতে পারে না। তোমার একটা সংসার রয়েছে! আর সবচেয়ে বড় সত্য—তোমার একটা সন্তান রয়েছে।”
(আনায়া চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়।কিন্তু তবু কিছু বলে না। রোজ আরো এক ধাপ এগিয়ে আসে, কণ্ঠে তার প্রচণ্ড দৃঢ়তা।
— “তোমার সন্তান কিন্তু তোমার একার নয় আনায়া। তার কিন্তু বাবা রয়েছে। সেই মানুষটা, যার সাথে আজ তোমার সম্পর্ক দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে ঝুলছে। সে তোমার সন্তানের রক্তের বন্ধন! তুমি কি একবারও ভেবে দেখেছো, তোমার এই নির্লিপ্ততা শুধু তোমাকে নয়, তোমার সন্তানকেও আহত করছে?”
আনায়া চোখ নামিয়ে ফেলে।তার সম্মুখে ছেড়ে রাখা চুলের আড়ালে মুখের ক্লান্ত ছায়া লুকিয়ে যায়। কিন্তু রোজ পিছু হটে না, তার কণ্ঠে ধিক্কার জ্বলে ওঠে। প্রত্যেকেই যেন এক অজানা আগুনের উত্তাপে ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম হলো, সবাই শুধু একে অপরকে বাঁচাতে চাইছে। কিন্তু নিজের বেলায় রয়ে যাচ্ছে নির্বিকার।
— “তুমি কি জানো, তুমি একজন স্বার্থপর? তুমি শুধু তোমার দোটানা, তোমার কষ্ট, তোমার অনুভূতির জালে জড়িয়ে আছো! কিন্তু সেই মানুষটার কথা একবারও ভাবোনি, যে তোমার জন্য প্রতিটি দিন নিঃশব্দে সহ্য করছে! কেনীথ তোমাকে ভালোবেসেছে, এখনো বাসে! প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে। কিন্তু তুমি! তুমি কি তাকে বোঝার একবারও চেষ্টা করেছো?”
আনায়ার হাতের আঙুল কেঁপে ওঠে, কিন্তু সে চুপ। চুপ করে থাকা ব্যতীত তার বলার আছেই বা আর কি। আনায়া নিজেও তো এসবের কিছু বুঝ উঠতে পারেনি কখনো। যতবারই হিসেব নিকেশের খাতা নিয়ে বসেছে, ততবারই সবকিছু ঘুরপাক খেয়েছে এই ভেবে যে গল্পের শুরুটা ঠিক কোথায় থেকে করা উচিত। আর শেষটাই বা কোথায় রয়েছে।আনায়ার নির্লিপ্ত ভাবগতিকে রোজের রাগ যেন আরও বেড়ে যায়।
— “ভালোবাসা কি শুধু পাওয়া আর না পাওয়ার গল্প? ভালোবাসা মানে শুধু আবেগ না, আনায়া! বোঝাপড়া, দায়িত্ব, ত্যাগ—এসবের নামই ভালোবাসা! তুমি কি ভেবেছো, সম্পর্ক শুধু অনুভূতির জন্য টিকে থাকে? সংসার কোনো স্বপ্ন কিংবা ছেলেখেলা নয় , যে চাইলে ভেঙে ফেলবে!”
(আনায়া এবার মুখ তুলে তাকায়, তার চোখে জল চিকচিক করছে। কিন্তু রোজ নরম হয় না, তার কণ্ঠে দৃঢ়তার আগুন এখনো দাউদাউ করে জ্বলছে।
—“তুমি চাইলেও সত্য বদলাবে না, আনায়া! তুমি চাইলেও কেনীথ তোমার জীবনের একটা অধ্যায় হয়ে থাকবে! তাকে ফেলে দূরে যেতে চাইলেও পারবে না! একদিন হয়তো খুব দেরি হয়ে যাবে, আর তখন এই দ্বিধা, এই প্রশ্ন, সবটাই তোমার গলার কাঁটা হয়ে থাকবে! তুমি কি সত্যিই সেদিনের জন্য অপেক্ষা করছো?”
আনায়ার মুখ শক্ত হয়ে আসে, চোখেমুখে এক অজানা তীব্রতা। কিন্তু রোজের কথা শেষ হয়নি। সে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলে, যেন অনেক দিনের জমে থাকা ক্ষো’ভ এখন বিস্ফো’রিত হয়েছে।
—“তুমি হয়তো ভাবছো, কেনীথ কখনো তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেনি! কিন্তু বলো তো, তুমি কি কখনো তাকে বোঝার চেষ্টা করেছো? তুমি কি একবারও থেমে তাকিয়েছো তার চোখে? না, তুমি শুধু পালিয়ে গিয়েছো! কিন্তু সম্পর্ক থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না, আনায়া!একদিন পালাতে পালাতেই অবশিষ্ট জীবনটাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
আনায়া কিছু বলার জন্য ঠোঁট খুলে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। রোজ তাকিয়ে থাকে এক মুহূর্ত, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেছনে সরে আসে। ঘরটা আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়— শুধু বাতাসের হালকা শোঁ শোঁ শব্দ ব্যতীত।
রোজ গভীর দৃষ্টিতে আনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে একরাশ বোধের ঝলক, অথচ ঠোঁটে শান্ত দৃঢ় হাসি। অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে হালকা কণ্ঠে বলল,
“তুমি কি জানো? মানুষ যা বোঝে না, তাকে ভয় পায়। আর যা ভয় পায়, তার প্রতি জন্ম নেয় একধরনের বিতৃষ্ণা। কিন্তু কখনো কখনো সেই বিতৃষ্ণাই আমাদের শেকল পরিয়ে দেয়।”
আনায়ার ভ্রু কুঁচকে যায়। রোজ মৃদু হাসে, কণ্ঠে অদ্ভুত স্থিরতা রেখে বলে,
“তুমি কি তাকে ঘৃণা করো?”
আনায়ার ভেতরের চলমান ঝড়ের মাঝে এটি যেন আরো অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন। একই প্রশ্ন তাকে ইনায়াও করেছে, কিন্তু সে কোনো যথাযথ উত্তর দিতে পারেনি। আনায়া জানে, এখনও সে তা পারবে না। সে দ্রুত চোখ নামিয়ে ইতস্ততভাবে বলল,
আমি জানি না… আমি বুঝতে পারি না। এর উত্তর নেই আমার কাছে। আমি জানি না কিছু।”
আনায়ার কথা শুনে রোজ খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলল,
“সামান্য প্রশ্নের উত্তরটাও তুমি এতো বছরেরও জানতে পারোনি। বুঝতেও পারোনি কিছু। অথচ আমায় বলো তোমার কঠিনের চেয়ে কঠিনতর প্রশ্নের উত্তর দিতে! তোমার এসব পাগলামি, সত্যিই হাস্যকর আনায়া।”
রোজের তাচ্ছিল্যের কথায় আনায়া এবারও কিছু বললো না। রোজের তাচ্ছিল্য মাখা হাসি মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। সেই সাথে রোজ দৃঢ়ভাবে পুনরায় বলতে লাগল,
“না! তুমি চেষ্টা করো না বলেই, তুমি জানো না। তুমি পারতে, যদি তোমার অনুভূতিগুলো স্পষ্ট হতো। তুমি কেনীথকে ভালোবাসতে পারো না, আবার ঘৃণাও করতেও পারো না।এই মাঝখানের অমীমাংসিত দোলাচল তোমাকে ধ্বং’স করছে। কেনো এটা জেনেও, বোঝার চেষ্টা করছো না?”
আনায়ার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো। তবুও এবার খানিকটা দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল,
“চেষ্টা করিনি বলছো! বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তবু পারিনি। বলো, আমি কি করব? পারছি না তো সব স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে। দিনের পুরোটা সময় আমার তাকে ঘিরে হলেও, একটা ক্ষুদ্রাংশ মূহুর্ত আমার সবকিছুকে এলোমেলো করে দেয়। এমনটা কেনো হচ্ছে?”
রোজ এবার ধীর আওয়াজে বলে,
“ভালোবাসার গভীরে যাবার আগে তুমি নিজেকেই কি কখনো বোঝার চেষ্টা করেছো, আনায়া?”
আকস্মিক এই প্রশ্নে, আনায়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।ওদিকে রোজ স্থির গলায় আবারও নলতে লাগল,
“ভালোবাসা মানে গ্রহণ করা, আবার কখনো কখনো নিজেকে মুক্ত করে দেওয়াও। তুমি কেনীথকে ঘৃণা করো, কারণ সে তোমার অতীতকে বি”ষাক্ত করেছে, তোমার জীবন পরিবার ধ্বং”সের মূল কারণ। আবার তুমি তাকে ভালোবাসতে পারো, কেননা তার বর্তমান তোমাকে স্পর্শ করতে পেরেছে।
কিন্তু জানো, ভালোবাসা কখনো শুধু অতীতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না।ভবিষ্যতের ওপরও গড়ে ওঠে। তুমি যদি কেনীথের হাত ধরতে চাও, তবে অতীতের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নাহলে তুমি কেবল একটা ক্ষতচিহ্ন হয়ে বেঁচে থাকবে—না জীবিত, না মৃত।”
—“সবকিছু এতোটাও সহজ নয় রোজ। আমি চাইলেও সেসব ভুলতে পারিনা। যত চেষ্টাই করি না কেনো, ওর প্রতি বিদ্বেষ আমার কখনোই পুরোপুরি নিঃশেষ হয় না।কিন্তু আমি ওকে পুরোপুরি ঘৃণা করতেও পারি না। দিনশেষে একটা কিন্তু—থেকেই যায়।”
রোজ হাসল,কিন্তু সেই হাসির গভীরেও এক ধরনের বেদনা লুকিয়ে। কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার বলল,
“আমি চাই তুমি নিজেকে ভালোবাসো, আনায়া! ভালোবাসা মানে কেবল অনুভব নয়, ভালোবাসা মানে মুক্তি। কেনীথ হয়তো তোমার জীবনে ঝড় হয়ে এসেছিল, কিন্তু ঝড়ের পরেও কি আকাশ চিরকাল কালোই থেকে যায়? মানুষ যদি প্রকৃতিকে ক্ষমা করতে পারে।তবে মানুষকেও,ক্ষমা করতে শেখা উচিত।”
আনায়া একদৃষ্টিতে রোজের দিকে তাকিয়ে থাকল। সে কি আদোও পারবে, কেনীথের প্রতি জমে থাকা বিষাক্ত ধোঁয়াশা সরিয়ে, বর্তমান সত্যিটাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতে? নাকি সেও আর সকলের মতো ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আনায়া আর এখানে বেশি একটা সময় থাকতে চাইল না। নিজেকে দূর্বল অনুভব হচ্ছে। আপাতত পার্টির আগে আর এসবের ট্রেস নিতে চায় না সে।
এদিকে আনায়ার চলে যাওয়াতে রোজেরও কোনো বাঁধা ছিলো না।তবে তার যেন আরো কিছু বলার আছে। আনায়া চলে যাওয়ার উদ্দেশ্য কিছু বলতে নিবে সেই মূহুর্তে রোজ আবারও বলে উঠল,
“তুমি কেবল তোমার নিজের যন্ত্রণাটাই দেখতে পাও, তাই না আনায়া? কিন্তু কেনীথের কষ্টের একটুও দেখতে পাও না?”
আনায়া কিছুসময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। রোজের এবারের কন্ঠস্বরে দৃঢ়তার পাশাপাশি এক অদ্ভুত অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। আনায়ার কপাল খানিকটা কুঁচকে যায়। তবে রোজ না থেমে আবারও বলে,
“আচ্ছা তুমি কি ভাবো, কেনীথ একদম নিখুঁত? না, সে নিখুঁত নয়। পৃথিবীতে কোনোকিছুই একদম নিখুঁত হতে পারে না। মানুষের জীবনের পথচলায় স্বাভাবিক ভাবে হাজারো ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে, এবং চিরকাল তা হতেই থাকবে। তার অতীত ততটাই অন্ধকার, যতটা তুমি তাকে ঘৃণা করো। কিন্তু তার মানে কি আজও সে একটুও পরিবর্তন হয়নি? সে কি আর তোমার ভালোবাসার যোগ্যও না?”
আনায়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল,
“ভালোবাসার যোগ্যতা কি শুধু সময় ঠিক করে দেয়, রোজ! নাকি কিছু কাজ থাকে, যা কোনোদিন ক্ষমা করা যায় না।”
—“ক্ষমা করা যায় না? তাহলে কি তুমি নিজেও এসব হতে মুক্ত? নিজেও কি কোনোদিন ভুল করোনি?”
— “হ্যাঁ,করেছি। কিন্তু আমি কেনীথের মতো অবুঝ হয়ে, কোনোদিন কারও জীবন নষ্ট করিনি, রোজ!”
(রোজ এবার কিছুটা থমকে যায়, কিন্তু তার চোখের আগুন নিভে না। সে ধীরে ধীরে বলে, যেন প্রতিটি শব্দ আনায়ার মনে গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতে চায়। আর সেই সাথে আনায়াও যেন আকস্মিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। না চাইতেও, দুজনের কথার ছন্দে এক নীরর সংঘ’র্ষ ঘটে যায়।
— “ওহ, তাই নাকি! তাহলে বলো, আনায়া… তুমি তোমার সন্তানের জীবন নষ্ট করছো না?তোমার কি মনে হয়, তোমাদের এমন দোলাচলের সম্পর্কের মাঝে, অরিনের ভবিষ্যৎ কি খুব একটা ভালো হবে? নাকি তুমি ভাবছো, সারাজীবন তুমি ওর সামনে শুধু অভিনয়ই করে যাবে?
আর বললে, তুমি নাকি কেনীথের মতো অবুঝ হয়ে কারো জীবন নষ্ট করোনি। তবে তুমি কি কেনীথের জীবন নষ্ট করোনি? সে প্রতিটি মুহূর্তে তোমার অপেক্ষায থাকে, হয়তো যদি একটিবার তুমি সব ভুলে তার জীবনে স্বাভাবিক হয়ে ফেরো। শুধুমাত্র এই একটি আশায়। তবুও তুমি তাকে বোঝার চেষ্টা করোনি। তুমি তাকে একটুও সুযোগ দেওনি! এটা কী কম যন্ত্রণা?”
আনায়া এবার মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেন এ কথাগুলো শুনতে চায় না। কিন্তু কেনীথের প্রসঙ্গ শুনেই তার ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আকস্মিক সব গুলিয়ে ফেলে। রোজ এবার এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগল,
“তুমি জানো!কেনীথ রাতে ঘুমাতে পারে না। মাঝরাতের পুরোটা সময় সে না ঘুমিয়ে কাঁটায়। ভাবছো, আমি এসব কি করে জানি। আমি অন্ধ নই,আনায়া। আমার রুমের বারান্দা থেকে তোমাদের বারান্দার সবটাই দেখা যায়। এমন কোনো রাত নেই যে, তাকে দেখিনি প্রচন্ড ছটফটানি নিয়েও একা-একা পুরো রাতটা কাঁঁটাতে। শুধু ভোর হলেই দেখেছি, আবার স্বাভাবিক হয়ে তাকে ঘরে ফিরতে। সে তো প্রচন্ড খারাপ। তবে তার কিসের এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব, কিসের এতো যন্ত্রণা,তা বোঝো তুমি? কখনো বোঝার চেষ্টা করেছো? আমি দূর থেকেও সবটা দেখতে পারছি অথচ তুমি তার কাছে থেকেও অন্ধ হয়ে বসে রয়েছো।
জানো! সে আজও নিজের ওপর ঘৃণা নিয়ে বেঁচে আছে। সে আজও বিশ্বাস করে, সে তোমার ভালোবাসার যোগ্য নয়! আর তুমি? তুমি সেই বিশ্বাসটাই সত্যি করে তুলেছো, আনায়া!”
আনায়ার চোখ এবার চকচক করে ওঠে। সর্বস্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যেন এক মুহূর্তে একাধিক অনুভূতি তাকে ছুঁয়েছে তাকে। কিন্তু সে শক্ত হয়ে থাকে, মুখের অভিব্যক্তি বদলায় না।
—“আমি জানি তুমি কিছুই বলতে পারবে না। অবশ্য বলার বিশেষ কোনো প্রয়োজনও নেই। তুমিই নিজেই কখনো সময় নিয়ে এসব ভেবে দেখো। উত্তর খোঁজার চেষ্টা করো। তবে আজ যেভাবে আমার সামনে চুপচাপ রয়েছো, এভাবে বাকি জীবনটাও বাঁচতে চাইলে, পারবে না তুমি৷ কখনোই পারবে না। চোখের সামনে নিজ সহ প্রত্যেককে ধ্বং”স হতে দেখবে তুমি।”
—“……….
—“তুমি সম্পর্ক থেকে পালাতে চাইছো, তাই না? কিন্তু পালিয়ে কখনো ভালোবাসা পাওয়া যায় না, আনায়া। ভালোবাসা লড়াইয়ের মতো হয়। একবার এর জালে আঁটকে গেলে, পেছনে ফেরার উপায় থাকে না। তুমি পেছনে ফিরতে চেয়েছো, কিন্তু কেনীথ কখনো পিছু হটেনি। সে আজও তোমার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে, দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু হয়তো একদিন সে আর দাঁড়াবে না। তখন তুমি কি করবে? কোথায় যাবে, আনায়া?”
আনায়া একদম নিশ্চুপ। খুব ধীরে সে চোখ বন্ধ করে। যেন কিছুটা বোঝার চেষ্টা করছে, আবার হয়তো বোঝার ভয় পাচ্ছে। রোজ এবার গভীর শ্বাস নেয়, তার চোখে মিশে থাকে ক্লান্তি আর একরাশ তিক্ততা।
— “যদি তাকে সত্যিই ঘৃণা করতে, তাহলে এতদিনে তাকে ভুলে যেতে পারতে, আনায়া।সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে পারতে। নতুন করে সম্পর্কে একটা নড়বড়ে ভিত্তি বসাতে না। কিন্তু তুমি পারোনি। কারণ তুমি জানো, ভালোবাসা কখনো একেবারে ফুরিয়ে যায় না… শুধু নিজেকে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু আর কতদিন লুকিয়ে রাখবে?”
আনায়া এবারও কিছুই বলে না। রোজ কিছু একটা ভেবে হেসে,হালকা স্বরে বলে উঠল,
“যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি, সে আমাকে কখনো ভালোবাসবে না, এটা আমি জানি। অথচ তবু আমার ভালোবাসা,তার প্রতি অটল। কারণ ভালোবাসা মানে চাওয়া নয়। ভালোবাসা মানে দেওয়াও নয়। ভালোবাসা মানে অনুভব করাও।
অতচ তুমি কখনোই তোমাদের সম্পর্কটাকে অনুভব করতে চাওনা। আচ্ছা তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো,আমি তাকে এতোটা ভালোবাসার পরও সে আমার ভালোবাসার দিকে কখনো ফিরে তাকায়নি। বোঝেনি আমার ভালোবাসার মর্ম, অথবা বুঝতে চায়নি। কেনো চায়নি? আমি শুধু তার বোন হই, এটা ভেবে? সেক্ষেত্রে ইনায়ার সাথে সাথে তুমিও তো তার…।
আমার জানা মতে, তোমাদের বিয়েটা হয়েছিলো অনেক ছোটবেলায়। কেনীথ নিজেও তখন ছোট। শুধুমাত্র কি সেই সম্পর্কের তাগিদেই, সে আজ পর্যন্ত অন্যকোনো মেয়েকে নিজের মনে জায়গা দেয়নি? শুধুমাত্র একটা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে এতো স্যাক্রিফাইস? সে তো খারাপ, দশ বারোটা মেয়ে অনায়াসে তার মনে জাগয়া নিতে পারত। তবে কেনো এমন কিছু হয়নি। নাকি এসবের পেছনে বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে, যার মর্ম তুমি আজও বোঝোনি।
কেনীথ আজপর্যন্ত শুধুমাত্র একজনকেই ভালোবেসেছে,আর সেটা হলে তুমি! হ্যাঁ, একমাত্র তুমিই সে, যার জন্য আজ পর্যন্ত অন্যকোনো মেয়ে তার মনে জায়গা পায়নি। কখনো অনুমান করেছো, এই ভালোবাসার পরিধিটা ঠিক কতটুকু?
তুমি নিজেও কিন্তু জানো,কেনীথ কোনো স্বাভাবিক মানুষ নয়। তবে আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবেই। বললে না যে , আমি তার সবকিছু জানার পরও কেনো তাকে আজও এতোটা ভালোবাসি। কারণ আমি কেনীথের আদ্যপ্রান্ত সবটাই জানি। তার পুরো ছোটবেলাটা নিজের চোখে দেখেছি। যা তুমি দেখতে পাওনি। তুমি শুধু তার হিং”স্রতাই দেখেছো। সে হিং”স্র হবার আগ পর্যন্ত একজন অন্তত ভালোমানুষ হিসেবেই আমি তাকে অনুভব করেছি। বাবা মা ব্যতীত, ওতো বড় একটা ট্রমা নিয়ে কতটা অসহায় হয়ে বেঁচে থাকতো, তা আমি নিজ চোখে দেখেছি। সর্বস্ব দিয়ে অনুভব করেছি। আমি চাইলেও কোনোদিন তাকে তোমাদের মতো করে ঘৃণা করতে পারবো না।এটা আমাকে দিয়ে কখনোই সম্ভব নয়।”
এতোক্ষণ ক্ষিপ্ত স্বরে বলতে থাকা রোজও কেমন শীতলতায় কেঁপে উঠল।না চাইতেও একফোঁটা জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল। সে খুব দ্রুত তা মুছে ফেলে। অন্যদিকে আনায়ার চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে। চোখে জল এসে ভীড় জমিয়েছে। এসব কেমন অনুভূতি আনায়া জানেও না, বোঝেও না। রোজ পুনোরায় নিজেকে শক্ত করে বলতে লাগল,
—“মূল্য দেও আনায়া! মূল দেও! সময় থাকতে সময়ের মূল্য দেও। যে তোমায় এতোটা ভালোবাসে তার কদর করো। একবার চিরতরে হারিয়ে গেলে গেলে তাকে আর ফিরে পাবে না। তখন এতো ঘৃণা, ক্ষোভ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব কার জন্য রইবে? কি করবে এসবের?কোন কাজে লাগবে এসব?
আমার জীবনটা না হয় ধ্বং”স হয়ে গিয়েছে। আমি চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছি। পাপে পাপে পরিপূর্ণ জীবন আমার। কোনোদিন চাইলেও আর আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো না।অবশ্য আমার জীবনটা স্বাভাবিক ছিলোই বা কবে!
তবে যাই হোক, তুমি প্লিজ আর তাকে অবহেলা করো না। এবার অন্তত তাকে একটু বোঝো। তার অফুরন্ত ভালোবাসার একটু হলেও কদর করো।”
আনায়া এই পর্যায়ে এসে কেঁদে ফেলেছে। না চাইতেই ওর চোখের জল গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে শুরু করেছে। রোজ ওর এহেন অবস্থা খানিকটা থমকে যায়। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে স্থির কন্ঠে বলল,
–আনায়া! আমি চাই,তুমি আগে নিজেকে ভালোবাসো। আর যখন তুমি সত্যিই নিজেকে বুঝবে, তখন তুমি বুঝতে পারবে—তোমার হৃদয়ে কেনীথের জন্য আদোও কোনো জায়গা রয়েছে কি না।আর থাকলেও তা ঠিক কতটুকু।”
আনায়া দু’হাতে চোঝের জল মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। রোজ জানে, আনায়ার ভিতরের দেয়াল হয়তো এত সহজে ভাঙবে না, কিন্তু অন্তত তাতে একটুখানি ফাটল ধরেছে। নীরবতা এবার আর ভারী মনে হয় না, বরং এক অজানা উত্তরের অপেক্ষায় থাকে।
রোজ তার দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো বলল,
“সময় থাকতে বুঝে নাও, আনায়া। নাহলে সময় একদিন তোমাকে বুঝিয়ে দেবে, কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি যদি কেনীথকে সত্যি বুঝতে চাও, তবে তাকে ঘৃণা নয়। বরং ঘৃণার ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসতে শেখো।”
___________________
আনায়া কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে রোজের রুম থেকে বেড়িয়ে, নিজের রুমে কাছে এলো। চোখমুখ তার লাল হয়ে খানিকটা ফুলে রয়েছে।আনায়া রুম এসে দেখে, কেনীথ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছে। মাথা বিছানার দেওয়ালে ঠেকানো। পা দুটো লম্বা করে একসাথে মিলিয়ে রাখা। সেই সাথে একটা রুবিক্স কিউব দু’হাতে নিয়ে,অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে দ্রুত গতিতে ঘুরিয়ে পেচিয়ে তা মেলানোর চেষ্টা করছে। আনায়া দূর থেকে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। এরপর সরাসরি কেনীথ সামনে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“শুনছেন!”
কেনীথ নিজের কাজে ব্যস্ত থেকে, আনায়ার দিকে না তাকিয়েই নিরেট কন্ঠে বলে উঠল,
“হুম বল!”
কেনীথের এমন অবহেলা আনায়ার মোটেও পছন্দ হলো না। বরং প্রচন্ড অসহ্য লাগল। আনায়া খানিকটা ক্রন্দন এবং রাগান্বিত স্বরের মিশ্রে বলল,
“আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।”
কেনীথ এবারও আনায়ার দিকে তাকালো না।বরং নির্লিপ্ত স্বরে নির্বিকারে বলল,
“পড়ে বলিস।”
—“কিসের পড়ে…আমি আপনাকে এখনই বলতে চাই আর আপনি বলছেন পড়ে?”
—“হুম, আপাতত শুনতে চাচ্ছি না৷ সঠিক সময় এলে বলবি।”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া রেগে পুরো বো’ম। রক্তিম চেহেরা আরো বেশি লাল হয়ে উঠল। এখন যেন ইচ্ছে হচ্ছে সরাসরি কান্না করে দিতে। অস্থির সত্তা আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠেছে।
“এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে! আপনি জানেন, আমি আপনাকে কি বলব?”
কেনীথ এবারও রুবিক্স কিউব ঘোরাতে ঘোরাতে নির্বিকারে উত্তর দেয়,”হুম!”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া যেন সম্পূর্ণ থমকে যায়।রাগ, কষ্ট নিমিষেই মিইয়ে গিয়ে শান্ত হয়ে ওঠে। আনায়া খানিকটা অবাক হয়ে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে বেশিক্ষণ একইভাবে থাকতে পারে না। কিসব যেন ভাবতেই আনায়া সম্পূর্ণ নিজেকে ভঙ্গুর অনুভব করে। চোখ থেকে পানি পড়ে মুখের সাথে লেপ্টে যায়। সে আর একমুহূর্তও দেরী না করে সোজা কেনীথের উপর আছড়ে পড়ে, জড়িয়ে ধরে। আকস্মিক এ ঘটনায় কেনীথ হতভম্ব হয়ে যায়। হাত থেকে রুবিক্স কিউবটা নিচে পড়ে যায়। সেই সাথে কেনীথ বুঝতে পারে যে আনায়া কাঁদছে। তার চোখের পানি কেনীথের ঘাড়ের কাছে লেপ্টে যাচ্ছে। কেনীথ নিজেকে তটস্থ করে নিজের হাত দুটো আলতোভাবে আনায়ার পিঠের উপর রাখে।
আনায়ার সম্পূর্ণ জামাটা, এমন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে, কেনীথ নিজেই প্রায় পুরোপুরি তার নিচে ঢাকা পড়েছে। আনায়ার অনবরত ফুঁপিয়ে ওঠা,কেনীথ একদম স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে। যদিও তার কান্নায় কোনো শব্দ নেই। এবং আনায়া সম্পূর্ণ ভাবে নিজের মুখ কেনীথের গলার কাছে লুকিয়ে রেখেছে।
কেনীথ একহাত শক্ত করে আনায়ার কোমড় পেচিয়ে ধরে।অন্যহাত পিঠের উপর বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
“কি আজব, হঠাৎ এভাবে কাঁদছিস কেনো?”
আনায়া কোনো উত্তর দেয় না বরং তার ফুঁপিয়ে কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়। কেনীথ এবার কিছুটা মজার ছলে বলল,
“এভাবে কাঁদলে তো, সব মেক-আপ উঠে যাবে। এতো টাকা পয়সা দিয়ে মেক-আপ কেনার পর যদি এভাবে কান্না করেই নষ্ট করিস, তবে আমাকে তো একদিন ভিক্ষার থালা নিয়ে পথে বসতে হবে।”
এবার আনায়া কান্নার মাঝেই অস্ফুটস্বরে কঢ়া গলায় জবাব দেয়,
—“আমি কোনো মেক-আপ করিনি।”
—“উফ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার বউ তো আবার আগুন সুন্দরী। তার তো কোনো মেকআপ-ই লাগে না।”
আনায়ার এহেন প্রসংশায় পাত্তা না দিয়ে, ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
“কথা ঘুরাবে না! যখন জানোই আমি তেমন মেকআপ ইউজ করি না, তবে কেনো বললে, আমার মেকআপের জন্য তোমাকে থালা নিয়ে পথে বসতে হবে?”
এমন সিচুয়েশনেও আনায়ার ঝগড়া বাঁধানোর ভাবভঙ্গিতে কেনীথ ঢোক গিলল। সে নিজে সবকিছু মজার ছলে করলেও, তার বউ তো পুরো আস্ত বোম। ইদানীং সবকিছুই কেনো যেন সিরিয়াসলি নেয়। অবশ্য এতে কেনীথের শয়তানি করতেও আরো বেশি মজা লাগে।
—“আরেহ,বললামই তো। ভুলে গিয়েছিলাম আমি।”
—“ভুলে যাওয়ার কি আছে? আমাকে তোমার বউ মনে হয় না?”
—“আরেহ,ভুলে যাওয়ার সাথে বউয়ের কি সম্পর্ক…আই মিন…”
—“আছে,অবশ্যই আছে।আমাকে নিজের বউ ভাবলে, অবশ্যই আমার সবকিছু তোমার জানতে হবে। কখনোই কোনোকিছু ভোলা যাবে না। আরেকটা বিষয়, মেকআপ ইউজ না করার পরও যখন বলেছো,আমার মেকআপের জন্য তোমার পথে বসতে হবে। তবে ঠিক আছে, এতোদিন মেকআপ ইউজ করিনি তবে এখন থেকে করব। দুনিয়ার সব এক্সপেন্সিভ মেকআপ, বস্তা ভরে ভরে কিনে নিয়ে আসব৷
টাকা পয়সা খরচ না করি না দেখেই এসব কথা শুনতে হয়। এবার দেখো, তোমার টাকা পয়সা যা আছে সব শেষ করে ফেলব। এরপর যদি দুজন মিলে থালা নিয়ে পথে বসতে হয়, তবে তাই করব।”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ জোরে হেসে ফেলল। এদিকে আনায়া নিজেও বুঝতে পারছে না, সে কোন কাজে এসেছিলো আর এখন কি করছে। নিজের পাগলামিতে নিজেই কিছুটা বিরক্ত হলো। তবুও কেনীথের হাসিতে যেন তার মাথা আবার বিগড়ে গেল। দু’হাতে কেনীথ ঘাড়, গলা পেঁচিয়ে রাখা বন্ধনটা আরো শক্ত করল।
—“খবরদার হাসবে না! ”
আনায়ার মৃদু হুমকিতে কেনীথ কোনোমতে নিজের হাসি থামিয়ে নেয়। সেই সাথে আনায়ার পিঠ কোমড় শক্তভাবে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে। অতঃপর শান্ত স্বরে বলে উঠল,
“এবার বল তো কি হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলি?”
আনায়া কোনো জবাব দেয় না। উল্টো কেনীথের গলায় মুখটা আরেকটু লুকিয়ে খানিকটা ফুঁপিয়ে ওঠে। এবার কেনীথ কিছু একটা ভেবে বলল,
“তবে কি বলতে চেয়েছিলি তা বল!”
—“এখন কেনো বলবো! আপনি না জানেন আমি কি বলতে চাই।”
—“হ্যাঁ,তা জানি কিন্তু আসলেই মিলছে কিনা তা দেখা উচিত।”
—“বলবো না আমি কিছু।”
—“প্লিজ বল, নয়তো চিন্তায় ম’রেই যাবো আমি।”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া খানিকটা রেগে যায়। সেই সঙ্গে আকস্মিক কান্না করে ওঠায় কেনীথ হতভম্ব। সে এমন কি বলবো যে হঠাৎ আবারও কাঁদছে। কেনীথ এবার আনায়ার মাথার পেছন আর ঘাড়ের কাছে হাত রেখে নিষ্ক্রিয় স্বরে বলে উঠল,
“তারা মাই ব্লাড! এভাবে কাঁদছিস কেনো? কি হয়েছে বল আমায়।”
আনায়া নিজের বাঁধনটা আরো শক্ত করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
“আরেকবার যদি শুনেছি,এসব মরার কথা বলতে তবে আমি… আমি আপনাকে নিজ হাতেই মে”রে ফেলব।”
—“আ…একদিন তো সবাইকেই…”
—“একদিনেরটা সেইদিন দেখা যাবে। আপাতত তার আগে আমি এসব শুনতে চাই না। আপনাকে বাঁচতে হবে। আমার জন্য বাঁচতে হবে। আমাদের সন্তানের জন্য বাঁচতে হবে। ফুটবল টিমের জন্য জন্য বাঁচতে হবে। অনেক কাজ বাকি, এতো তাড়াতাড়ি ম”রা যাবে না আপনার।”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ কিছুটা কেশে উঠল। নিজেকে খানিকটা তটস্থ করে মুচকি হাসতে হাসতে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলল,
” উহুম…উহুম..এই তারা! তুই কি হুঁশে আছিস? কিসব বলছিস মাথায় আছে?”
—“কি বলেছি?”
আনায়া সহজ প্রশ্ন কেনীথ আবারও খানিকটা কেশে ভণিতা করে বলল,
“তেমন কিছু না অবশ্য, ঐ আরকি ফুটবল টিম। তোর যে এটা এখনো মনে রয়েছে, এটাই তো অনেক।”
কেনীথের নির্বিকার কথা শুনে আনায়ার হুঁশ ফিরল। আনায়া নিজেকে খানিকটা তটস্থ করে ইতস্তত ভাবে অস্বস্তি নিয়ে বলল,
“স..সরি,মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে।”
আনায়ার অস্বস্তিতে কেনীথ যেন, শয়তানি করার আরো বড় সুযোগ পেয়ে গেল। খানিকটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে লাগল,
“আরে, কিসের সরি। তুই তো কাজের কথাই বলেছিস। একদম ঠিক বলেছিস,আরো অনেক কাজ বাকি। কেবল একটা হয়েছে, ফুটবল টিম বানাতে আরো দশটা লাগবে। তবেই না হবে, আমাদের পারফেক্ট ফুটবল টিম। এরপর আরো একটা ফুটবল টিম বানাতে হবে। একজোড়া আগুন পাখির দুইজোড়া ফুটবল টিম,বাহ্ বাহ্!ভাবতেই গর্বে আমার কলিজা ফুলে উঠছে।
না নাহ, কোনোমতেই আমার এতো তাড়াতাড়ি ম”রা চলবে না। অনেক কাজ এখনো বাকি রয়েছে। আচ্ছা, তুই যদি চাস তবে আজকের পার্টিটা কোনোমতে ক্যান্সেল করা যায় না? না মানে, যদি এখন থেকেই শুরু করি, তবে বাকি একুশটা হতে কিন্তু বেশি সময় লাগবে না।”
আনায়া শুধু চুপচাপ কেনীথের কথাগুলো শুনল। আর কথা শেষ হওয়া মাত্রই পেছন থেকে ছেড়ে রাখা চুল খামচে ধরে টান দেয়। কেনীথ ব্যাথায় খানিকটা চেঁচিয়ে বলে ওঠে,
“আ…হ! ঠ্যাংওয়ালা চেংরী, ছাড় আমায়!”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া তো চুল ছাড়লোই না, উল্টো আরো শক্ত করে চুল টেনে ধরতেই কেনীথ বলল,
“মাফ কর, বউ আমার। প্রমিজ করছি, আর কখনো এসব কথা বলবো না। সোজা করে দেখাব। নো টাইম টু ওয়েস্ট।”
কেনীথের মশকরায় আনায়া থামল না বরং আরো বেশি জোরে চুল টেনে ধরতেই কেনীথ চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“তোর অত্যাচারেই আমার জীবন শেষ হবে। ছোট বেলার অভ্যাস এখনো বাদ যায়নি তোর। এমনিতেই চুল পেকে যাচ্ছে, আর এখন তুই…যাহ,আরো জোড়ে জোড়ে টান। টেনেটুনে সব চুল ছিঁড়ে ফেল। এমনিতেই দুদিন বাদে ম”রে যাব,ম”রার আগে বউয়ের অত্যাচারে টাকলা হয়ে ম”রলে একটু দুক্ক হবে, কিন্তু ব্যাপার না! আমি সয়ে নেবো।”
এবার আকস্মিক আনায়া কেনীথের চুল ছেড়ে দেয়। এবং একদম নরম ভাবেই মিইয়ে যায়, যা কেনীথ ভালো ভাবেই টের পায়। আনায়া পুনরায় একদম চুপচাপ হয়ে যাওয়ায়, কেনীথ কিছু বলতে উদ্বিগ্ন হলে, সেই মূহুর্তে আনায়া শীতল কন্ঠে বলে ওঠল,
“ভালোবাসি!”
এ কথায় শুনে,কেনীথ আকস্মিক অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে উঠে। হাতের বাঁধন শক্ত রেখে নরম স্বরে বলল,
“কি?”
—“আপনাকে!”
কেনীথ আর কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। একদম স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ওদিকে আনায়া এখনো কেনীথের গলার কাছ থেকে মুখ তোলেনি। উল্টো কেমন যেন কেনীথের সাথে মিইয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যাওয়ার পর কেনীথ খানিকটা স্বাভাবিক হলো। সেই সঙ্গে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“আবার বল,কি বললি বুঝতে পারেনি।”
আনায়া এতে খানিকটা বিরক্ত হলো।
—“বুঝতে পারেননি, তবে শুনতে পেয়েছেন তো!”
—“নাহ,আবার শুনতে চাই।”
কেনীথের নির্বিকার কথায়, আনায়া বিরক্তি নিয়ে খানিকটা চুপ থাকার পর, পুনরায় শান্ত স্বরে বলে,
“ভালোবাসি আপনাকে!”
—“কতটা? ”
—“অনেক বেশি।”
—“কতটা অনেক বেশি?”
আনায়া এবার অনেকটাই বিরক্ত। এমন পরিস্থিতিতেও এসব মজা কে করে! এই ক্ষোভে হুট করেই একটা কাজ করে বসে। কেনীথের গলার কাছে আচমকা জোড়ে কামড় বসিয়ে, সোজা মাংসে দাঁত ডাবিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“ঠিক এতোটাই ভালোবাসি। আই লাভ ইউ, জলহস্তী!”
চলবে______