#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
সমাপ্তি পর্ব (৫ম অংশ)
“ঠিক এতোটাই ভালোবাসি। আই লাভ ইউ, জলহস্তি!”
আকস্মিক এহেন কাজে কেনীথ আর নিজেকে সামলাতে পারল না। দাঁত খিঁচে, হাতের বাঁধন শক্ত করল।মনে হচ্ছে, গলার মাংস যেন উঠে গিয়েছে। কেনীথ দাঁত খিঁচেই হিসহিসিয়ে বলতে লাগল,
“কাজটা একদম ঠিক করলি না, ঠ্যাংওয়ালা চেংরী! দেখিস আমি এটার শোধ কিভাবে নেই ৷ ইচ্ছে তো করছে এখুনি…থাক, আপাতত পার্টিটার জন্য মাফ করলাম৷ বাদ বাকিটা রাতে দেখে নিচ্ছি।”
আনায়া এবার আর কিছু বলে না বরং খানিকটা মাথা উঁচিয়ে কেনীথের গলাটা দেখতেই নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত হয়। দাঁত গুলো সব মাংসে ডেবে যাওয়ায়, তীব্র দাগ হয়ে রয়েছে। খানিকটা র’ক্তের ফোঁটাও ঝড়ছে৷ আনায়া হাত দিয়ে ছুঁতে নিলে ,কেনীথ ব্যাথায় নড়েচড়ে ওঠে৷ সেই সাথে আনায়াও খানিকটা নরম হয়ে যায়।
—“আ…..হ!”
—“ব্যাথা করছে?সরিইইই।”
আনায়া এতোক্ষণ পর এসে,মুখ তুলে— কেনীথের মুখোমুখি হলো। কেনীথের ব্যাথাতুর চেহেরার দিকে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে রয়েছে আনায়া। রাগ, কান্না সবমিলিয়ে চেহেরার হাল পুরো বেহাল। কেনীথের ওর দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে৷ দুজনের মাঝে দূরত্ব একদমই ক্ষীণ।
“আমার আরো কিছু বলার আছে।”
কেনীথ আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলে,
“হুম বল।”
আনায়া যতবারই কিছু বলার জন্য উদ্বেগ হয়, ঠিক ততবারই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে। কেনীথের তার হাভভাবে অনেকটাই আন্দাজ করে ফেলে।
—“সরি, কিন্তু তোর আর ইনায়ার কথা আমি অনেকটাই শুনেছি। ঐ মূহুর্তে—আমাদের বারান্দায় ছিলাম আমি।”
কেনীথের কথা শোনামাত্রই আনায়া কিছুটা থমকায়। পরবর্তীতেই কিছুটা সময় নিয়ে আবার বলে,
“কি করব আমি? এসব কেনো হচ্ছে?”
কেনীথ আনায়ার অস্থিরতা এবং কাঁদো কাঁদো চেহেরার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। ভারী শ্বাস ফেলে কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে বলে,
“কি করতে চাইছিস?”
আনায়া কিছু না বলে, কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলা উচিত মাথায় আসছে না।
—-“তোর মাঝে কি চলছে আমায় বলতো? আমি কিন্তু তোকে আগেও বলেছিলাম, যদি আমার কাছে আসতে হয় তবে পুরোপুরি আসতে হবে। তোর কাছে কিন্তু সুযোগ ছিল। আমি তোর জন্য সব রাস্তাই খোলা রেখেছিলাম।”
কেনীথের কথা শেষ হতে না হতেই, আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে,
“অন্তত তুমি আমায় ভুল বুঝো না। তুমি কেনো এমন বিভেব করছো?”
কেনীথ হতাশায় খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
—-“তো কি চাইছিস? কি বলব আমি? আমার আর বলার কি আছে?”
—-“আহ্,ভাল্লাগছে না আমার৷ কিছু তো করো। আমি তো চাইনা এমন কিছু হোক।”
—-“তো কি চাইছিস তুই? আমাদের বিয়ে যেমন তেমন করে হয়েছে, সে কাহিনি বাদ ৷ তাই বলে…অরিন বড় হচ্ছে। আর তুই এতোবছর পর এসে এই কাহিনি তুলছিস। ইট’স ঠু মাচ,আনায়া।”
কেনীথের চোখমুখ কিছুটা বিরক্ততে কুঁচকে গিয়েছে।এদিকে আনায়া অস্থির হয়ে উঠেছে।
—-“কি আজব। আমি কি একবারও বলেছি, আমি ওকে…”
—“একটু আগে বললি আমায় ভালোবাসিস। সত্যি করে বল তো, সত্যিই ভালোবাসিস নাকি শুধু মুখে এমনটা বলছিস।”
—-“ভালো না বাসলে, এতোগুলো বছর তোমার সাথে থাকি আমি? সেধে গিয়ে তোমার বাচ্চার মা হতাম আমি? সবসময় কি তুমিই আমার কাছে এসেছো? আমি নিজে কখনো যায়নি?”
—-“তবে ইনায়া যখন বারবার জিজ্ঞেস করল, তখন প্রতিবার উত্তরে ‘জানি না’ কেনো বললি?”
—-“আহ্, শেষে তো আবার ঠিকই বললাম তোমাকেই ভালোবাসি।”
—-“তাহলে সমস্যাটা কি?”
—-“জানিনা, ডাক্তার দেখাও আমার। ভাল্লাগে না।”
কেনীথ কিছুটা কপাল কুঁচকে বলে,
“কিসের ডাক্তার দেখাব? পাগলের?”
—-“আমাকে তোমার পাগল মনে হয়? নিজে ট্রিটমেন্ট করো। ইনায়াও এটাই বলেছে।”
—-“কি আজব, আমি ডক্টর ছাড়া কিসের ট্রিটমেন্ট দেব? ইরা কেমন ট্রিটমেন্টের কথা বলেছে?”
আনায়া এই পর্যায়ে এসে কিছুটা থমকায়। কিছু না বলে, অনবরত চোখ পিটপিট করে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেনীথ কপাল কুঁচকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করতেই, মূহুর্তেই চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“ছ্যাহ্! কি দিনকাল পড়ল। হাঁটুর বয়সী শা’লীও কিনা এখন, এসব পরামর্শ দিচ্ছে।”
আনায়া কেনীথের অভিব্যক্তিতে ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে থাকে। ওমনি কেনীথ আবারও বলে,
“আচ্ছা শোন, আমায় এটা বল যে তোর এসব কনফিউশান মাথার মধ্যে কবে থেকে ঘুরছে ? এসব কি শুরু থেকেই… এতোদিন আমাকে জানাসনি…”
—-“আরেহ শুরু থেকে না। আগে তো ওর কথা মাথাতেই আসতো না। কিন্তু… কিন্তু… ”
—-“কিন্তু ইদানীং এই প্রবলেম হচ্ছে, তাই তো?”
—-“হুম। কেনো হচ্ছে? আমি তো চাইছি না এমন কিছু হোক?”
কেনীথ খানিকটা সময় কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,
“তারা! ইদানীং তোর একটু বেশিই মুড সুইং হচ্ছে না রে?”
আনায়া কিছু না বলে, চোখ পিটপিট করে নিজেও কিছু একটা ভাবতে শুরু করে। এদিকে কেনীথ আবারও বলে,
“এতো টেনশনের কিছু নেই৷ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা কর। নিজেকে বোঝার চেষ্টা কর। দেখবি আর কোনো সমস্যা নেই।”
—-“কিন্তু তুমি…”
—-“আমি কি?… ফাস্ট লাভের প্রতি মানুষের এট্র্যাকশন বরাবরই অনেক বেশি থাকে। সত্যি কারের ভালোবাসলে নাকি সহজে তা পুরোপুরি ভুলে যাওয়াও সম্ভব হয়না। তোর আর রেহানের বিষয়টা কেমন ছিল তা তুই-ই ভালো জানিস। যেখানে আমি ছিলাম তৃতীয়পক্ষ।… আহ্, আর কি বলব। তুই আমার কাছেই এসেছিস, এসবের জন্য সলিউশন নিতে!”
আনায়া কেনীথের বিরক্তি ও হতাশাগ্রস্ত হাভভাবে, ঠোঁট উল্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই,ইতস্তত স্বরে বলে উঠল,
“জেলাস?”
কেনীথের আনায়ার দিকে নিরেট চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
“হওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়? বিশ্বাস কর আনায়া, ঐ হতচ্ছাড়া রেহান যদি… যাস্ট একটু, ওর মাঝে যাস্ট একটু ভেজাল দেখতে পেতাম—ওই উছিলাতেই আমি ওকে শেষ করে দিতাম। কিন্তু শা’লা হতচ্ছাড়া— এতো ভালোমানুষ কিভাবে হয়েছে কে জানে।”
—-“ও না হয় ভালো। কিন্তু আমি তো ভালো না।আমাকে কিছু করতে ইচ্ছে হয়না?”
কেনীথ আনায়া কথায়,বিরক্তিতে নিমজ্জিত চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
“তোর কি মনে হয়, বুড়ো বয়সে তোর এতো পাগলামি আমি এমনি এমনি সহ্য করি? বিশ্বাস কর, আমার মেয়েটা না থাকলে ভালো আর মন্দ নেই। আমি তোদের দুজনকেই, এতোদিনে মেরে নর্দমায় ফেলে আসতাম। দুদিন বাদে বাদে তোর এতো মুড সুইং আমার কোনোমতেই সহ্য হয়না।”
—-“আহ্,এতো রেগে যাচ্ছো কেনো? ভাল্লাগছে না।”
—-“আমার রাগ করাটা কি স্বাভাবিক নয়?”
আনায়া কিছু বলে না। তাকে নিশ্চুপ হতে দেখে,কেনীথ ভারী শ্বাস ফেলে আবারও বলে,
” শোন তারা,তুই শুধু আমার। শুধুই আমার। তোর মাঝে বিন্দু পরিমাণেও—আমি ব্যতীত অন্য কেউ থাকু, তা আমি চাইনা। আমি প্রচন্ড অসহ্য রকমের হলেও, শুধু তোরই হতে চাই। আর আমি ম’রে গেলেও, তোকে আমার হয়েই থাকতে হবে। এই শেষ বারের মতো বললাম, কথাটা যেন মাথায় থাকে।”
—–“হুম। আর কখনো এমন হবে না,পাক্কা!”
—-“না হলেই ভালো, নয়তো দেখিস আমি…”
আনায়ার এবার কিছুটা বিরক্ত লাগে। হুট করেই তার মুড চেঞ্জ হয়ে যায়। বললই তো আর কখনো এমন হবে না। তবে এতো কেনো কথা শোনাতে হবে। আনায়া আর ধৈর্য ধরতে পারেনা। কেনীথের কথা শেষ হবার পূর্বেই সে দু’হাতে কেনীথের গাল চেপে ধরে। কেনীথের অভিব্যক্তি থমকে যেতেই,আনায়া তার চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে। অনেকটা সময় নিয়েই, চুমু খাওয়ার পর আনায়ার তার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে বলে,
“ভালোবাসি জলহস্তী। অনেক অনেক ভালোবাসি। আর রাগ করোনা। ভিপি বেড়ে যাবে—এমনিতেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছো।”
আচমকা এহেন ঘটনায়, কেনীথ আনায়ার দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রয়েছে। আর আনায়ার অভিব্যক্তিতে তার কুঁচকে যাওয়া কপালও মিলিয়ে যায়।একইসাথে কিছুটা ঢোক গিলে, কেশে ওঠে।
—-“সব ঠিক আছে। কিন্তু এই নামটা চেঞ্জ করলে হয় না? আমি না তোকে কত সুন্দর সুন্দর নামে ডাকি।”
কেনীথের কথায় আনায়া ফিক করে হেঁসে ফেলল। দু’হাতে কেনীথের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,
—-“নাহ,আমার খলিজা। আমি তোমায় জলহস্তী বলেই ডাকব। এতে তুমি আমায় মে’রে নর্দমায় ভাসিয়ে দিলেও,আমার কিছু আসে যায় না।”
আনায়ার কথায় কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। খানিকটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আলতোস্বরে আওড়ায়,
“যা তোমার মনে চাহে—ঠ্যাংওয়ালা চেংরী! বাই দ্য ওয়ে, তোর সাথে আমার একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলার ছিল।”
—-“হুম বলো।”
—-“তোর সমবয়সী পৃথিবীর সব মেয়েই কি তোর বোনের মতো?”
কেনীথের এহেন প্রশ্নে আনায়া শুরুতে কিঞ্চিৎ থমকায়। পরক্ষণেই স্বাভাবিক স্বরে বলে,
“হুম, কিন্তু হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
—-“না মানে, যদি আমি আরেকটা বিয়ে করি।তবে তুই কি ওকেও—তোর বোনের মতোই ভাববি?”
—“এ্যাই! এসব কথাবার্তার মানে কি?”
—-“প্লিজ, তুই আগেই এতো রাগ করিস না।”
—“রাগ করব না মানে? আগে তাড়াতাড়ি বলো ঘটনা কি?”
—-“শুন না! আমি না একটা পেয়েছি৷”
আনায়া কাঁদো কাঁদো স্বরে, বিস্ময়ের চাহনিতে বলে,
কি পেয়েছো তুমি?”
—-“রাশিয়ান! একদম পিওররর রাশিয়ান।”
—-“সত্যি?”
আনায়ার অভিব্যক্তিে কেনীথ আরে সিরিয়াস হয়ে ওঠে।যদিও ঠোঁটের কোণায় বারংবার ফুটে ওঠা তীর্যক হাসিকে, দমিয়ে রাখার চেষ্টা সে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছে।
—-“হুম! বিশ্বাস কর,ও তোর চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। আর একটুও ঝগড়াও করে না। দেখিস, ও তোর বরকে অনেক ভালোবাসবে।”
আনায়া কিছু বলে না। শুধু এক মনে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে।
—“কি হলো! আমার কথা বিশ্বাস হলো না তোর?”
আনায়া খানিকটা ভারী শ্বাস ফেলে, প্রচন্ড আত্নবিশ্বাসী স্বরে বলে,
“ঐ রাশিয়ান পার্সিয়ান যাই হোক না কেনো, বউ সাজিয়ে যদি আমার সামনে এনেও দাঁড় করাও। তবুও আমি বিশ্বাস করব না।”
—-“”বাহ! আমার প্রতি এতো বিশ্বাস? যদি সত্যি সত্যি আরেকটা বিয়ে করে ফেলি?”
—“এমন দুঃসাহস করে দেখ না, শুধু একবার! আপনাকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে শুধু বাড়ি ছাড়া নয়, পুরো দুনিয়া ছাড়া করব।আর বাকি রইল আপনার রাশিয়ান… ওই ছেমড়িকে যদি আমার কামের বেডি বানিয়ে, দুনিয়ার সব কাজ করাতে করাতে শাঁকচুন্নির মতো চেহেরা না বানিয়েছি, তবে আমার নামও আনায়া শিকদার কেনীথ না!”
—“আনায়া শিকদার কেনীথ? বাহ্! এটা কি আমার ফিমেল ভার্সন?”
—-“তার চেয়েও বেশি কিছু।আরেকবার এসব ফালতু মজা করতে দেখেছি শুধু! বিয়ের শখ সারাজীবনের মতো মিটিয়ে দেব।”
কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেসে,গম্ভীর্যের সাথে বলে,
“ভালোবাসা তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তোর প্রতি আমার আসক্তি চিরন্তন। ইউ ক্যান হেইট মাই ওভারপসেশন, বাট ইউ কান’ট এস্কেপ ইট। ইভেন ইফ আই লেট ইউ গো, ইউ আর স্টিল মাইন—তারা মাই ব্লাডডড।”
—–“পাপাআআআআ,মাম্মামমমমম কোথায় তোমরা? আমি সেই কখন থেকে…”
প্রচন্ড অস্থিরতার সহিত অরিন রুমের ভেতরে ঢুকপ পড়ে। গলায় ঝুলে রয়েছে ছোট্ট একটা ক্যামেরার স্ট্যাপ৷ হাতে তার সেই কালো ও লাল রাঙায় মোড়ানো ক্যামেরা। কিন্তু আচমকা কেনীথ আনায়াকে এহেন অবস্থায় দেখে সে কিছুটা থমকে যায়।
এদিকে অরিনের আওয়াজ শোনামাত্রই, কেনীথ অপ্রস্তুত হয়ে কেশে ওঠে। আনায়াকে ঠেলে দূরে সরাতে নিলে, আনায়া তার থেকে সরে না গিয়ে উল্টো ওভাবেই জাপ্টে কেনীথকে জড়িয়ে ধরে থাকে। কেনীথ কিছুটা বিস্ময়ের সাথে আওড়ায়,
“তোর কি হুঁশ আক্কেল দিনে দিনে কমে যাচ্ছে? আরেহ উঠ, আরো কতক্ষণ… ”
আনায়া কেনীথের কথাকে পাত্তা না দিয়ে, উল্টো কেনীথের ঘাড়-গলা আরো শক্ত ভাবে আঁকড়ে নিয়ে বলে,
“হুম,সব হুঁশ আক্কেল জুস বানিয়ে খেয়ে ফেলেছি।”
এই বলেই সে অরিনের দিকে ফিরে তাকায়। ওমনি অরিন কিছুটা অবাক স্বরে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, নাকের ডগায় নেমে আসা চমশাটা ঠেলে দিয়ে বলে,
“আচ্ছা, তোমরা কি মা’রামা’রি করছো? আমি কি পরে আসব?”
—-“নাহ, মাম্মাম। এদিকে এসো। একদম স্পাইডার গার্ল…না, নাহ, তুমি তো তোমার পাপার লেডিবাগ। তাই লেডিবাগের মতো উড়ে এসো।”
এই বলেই আনায়া বিস্তৃত হেসে ফেলে। এদিকে কেনীথ এই মা মেয়ের পাগলামিতে আর কিছুই বলে না। আনায়া হতে এক হাত ছেড়ে দিয়ে, অরিনের দিকে ইশারা করে বলতে লাগে,
“সাবধানে এসো…”
—-“ইয়েএএএএএএএ”‘
কেনীথের কথা ঠিকঠাক সম্পূর্ণও হয়না।বরং এর পূর্বেই অরিন তার ক্যামেরার ফিতেটা গলা হতে খুলতে খুলতেই সোজা দৌড়ে বিছানায় চড়ে যায়। অতঃপর ক্যামেরাটা পাশে রেখেই সোজা ঝাপিয়ে পড়ে কেনীথ আনায়ার উপর। ঠিক আনায়ার ন্যায় একইভাবে। কেনীথের পাশাপাশি আনায়াও অরিনকে ঝাপ্টে নিজেদের সাথে জড়িয়ে নেয়। এতোক্ষণ বউয়ের বিশাল বড় জামার আদলে চাপা পড়ে থাকা কেনীথও, এখন একইভাবে মেয়ের পাগলামিতেও হেড়ে যায়। আনায়া ও অরিনের কপালে একটা চুমু একে দিয়ে বলে,
“পাগলি গুলো, মা-মেয়ে সব একরকম।”
কেনীথের কথা শুনে, আনায়া আর অরিন একইসাথে খিলখিল করে হেসে ওঠে। এদিকে কেনীথের মনের অজান্তেই আওড়ায়,
—” টু ফ্লেমস। ওয়ান হার্ট। ফরএভার বার্নিং ইন মি।”
একইসাথে মনে মনে আরো বলতে শুরু করে,
“জীবনের অনেকগুলো যুদ্ধ আমি একা লড়েছি। গায়ের ক্ষত সারলেও, ভেতরের কিছু ক্ষত এমনও রয়েছে… যেগুলো কাউকে দেখাইনি।কিন্তু আজ… এই বিছানায়, এই বদ্ধ ঘরে, এই দুই পাগলি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুঝি—জীবনের সবচেয়ে বড় বিজয় আমি এখানেই পেয়েছি।”
এদিকে এরইমাঝে অরিন আর আনায়া দুজন নিজেদের মাঝে কথা বলে, একটা ছোট করে ফ্যামিলি ফটো নেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছে। কেননা তাদের রুমে আনায়ার প্রেগন্যান্সির সময়, কেনীথের তোলা তাদের দুজনে একটা বড়সড় পিক রয়ে গেলেও। তাদের তিনজনের একত্রে এমন বিশেষ মূহুর্তের ছবি নেই বললেই চলে।তাই আর দেরি না করে দ্রুত, অরিন তার ক্যামেরটাকে ভালোমতো সেট-আপ করে — দু’জনে কেনীথের বুকের দুপাশে শুয়ে, তাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে। এবং টাইমার অনুযায়ী সময় হতেই, অরিন জোর স্বরে বলে ওঠে,
“পাপা-মাম্মাম, স্মাইল প্লিজ!”
নিমিষেই তিনজনের বিস্তৃত হাসিমুখর একটা অনবদ্য দৃশ্য আলোকচিত্রের বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। এবং কেনীথ প্রচন্ড প্রশান্তির সাথে মনে মনে আবারও আওড়ায়,
“আই ডোন’ট ফিয়ার ডেথ এনিমোর। বিকজ ইন দিস লাইফ, আই’ভ ট্রুলি লিভড — উইথ মাই ব্লাড অ্যান্ড আওয়ার লিটল লেডিবাগ।”
________________
কেনীথের কোলে অরিন। আর তার পাশে আনায়া৷ দু’জন করিডোর পেরিয়ে চলেছে—গন্তব্য নিচতলায়। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। অথচ এখনো তারা নিচেই পৌছায়নি। এদিকে এরইমাঝে আচমকা আশ্চর্যজনক ভাবে, চারপাশের সকল আলো নিভে যায়। এতে কেনীথ অনেকটাই অবাক হয়। এইখানে ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ার তো কোনো মানেই নেই।
কেনীথের পাশাপাশি অরিনও কিছুটা অবাক স্বরে বলে ওঠে,
“পাপা,এটা কি হলো?”
কেনীথ আলতোস্বরে বলে,
“চিন্তা করো না। আমি এখুনি ফোনের… ”
এই বলতে না বলতেই, কেনীথ নিজের ফোনটা বের করতে গিয়ে দেখে, সে ফোন রুমেই ফেলে এসেছে।
—-“এই তারা! তোর ফোনের ফ্ল্যাশটা অন কর তো। আর এখানকার লোকজন গুলোই বা গিয়েছে কোথায়?”
কেনীথের কথা শুনে আনায়া পাশ থেকে বলে,
“আহ্,আমিও তো আমার ফোনটাও রুমে ফেলে এসেছি। আচ্ছা চলো, এভাবেই না হয় যাই।”
—“এই অন্ধকারের মাঝে কিভাবে যাবি? সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলেও বিপত্তি।”
—-“তুমি কি এইজন্য ভয় পাচ্ছো?”
—-“গাধী, আমি তোর কথা বলছি।”
—-“আমাকে নিয়ে চিন্তা না করলেও চলবে৷ তুমি আছো তো পাশে। কোনো সমস্যা হবে না।”
কেনীথ আর কথা বাড়ায় না। আনায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে, আঁধারেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। সাবধানে পা বাড়িয়ে, সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার পর আচমকাই কেনীথ টের পায় — আনায়া অকস্মাৎ তার থেকে হাত ছাড়িয়ে, ছুটে অন্ধকারের কোথাও মিশে গিয়েছে। কেনীথ ওর কাজকর্মে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে, উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
“হেই ব্লাড,সাবধানে!”
কে শোনে কার কথা। আনায়া আশেপাশের কোথাও নেই। অন্ধকারে কেনীথ সম্পূর্ণ নিশ্চুপ রইলেও, অরিন কয়েকবার আনায়াকে ডেকেও কোনো লাভ হয় না। অন্ধকারে অরিনের ডাকে সাড়া মেলে না। চারদিকে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। এরইমাঝে —একটা বিকট শব্দে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই চারপাশের সমস্ত আলো একসাথে জ্বলে ওঠে। সেই আলোর ঝলকানিতে কেনীথ ও অরিন এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখ খুলতেই সামনে যা দেখে, তাতে তাদের মুখে নীরব বিস্ময়ের ছায়া। উপর হতে অনবরত গোলাপের পাপড়ি ঝড়ছে। তারা সুদ্ধ চারপাশ, গোলাপের পাপড়িতে ঢেকে যাওয়ার উপক্রম।
নিচতলার পুরো হলরুমটা এক ঝলমলে রাজপ্রাসাদের ন্যায় সাজানো—ঝাড়বাতি, রঙিন লাইট, সোনালি-লাল রঙের বড়বড় ক্যান্ডেল, তাজা গোলাপে সাজানো দেয়াল, লাল-কালো বেলুন-রিবনে সাজানো স্টেজ। আর বিশাল এক বার্থডে কেক,সবমিলিয়ে মনোমুগ্ধকর এলাহী এক আয়োজন। মেঝের উপর ছড়ানো গোলাপ পাঁপড়ি যেন তাদের রাজপথ হয়ে উঠেছে।
আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে—আনায়া। মুখে শয়তানির মুচকি হাসি, চোখে দুষ্টুমির দীপ্তি। পাশে সারি ধরে দাঁড়িয়ে পরিবারের বাকি সদস্যরা। ইনায়া,রোজ,রেহান,পাভেল আর সার্ভেন্টরা। অরিন আর কেনীথের বিস্ময়ের মাঝেই,সবাই একসাথে সমস্বরে বলে ওঠে,
“হ্যাপি বার্থডে ভিকে! হ্যাপি বার্থডে অরিন!”
আচমকা এই সারপ্রাইজে কেনীথ খানিকক্ষণ কিছু বলতেই পারে না। ওর কোলে থাকা অরিন আন্দাজে হাততালি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে,
“ইশেএএএএ,পাপা! আজ আমাদের বার্থডে,তাই না?”
কেনীথ অরিনকে নিয়েই, ধীরে ধীরে আনায়ার দিকে এগিয়ে যায়। চোখে এক অনুচ্চারিত কৃতজ্ঞতা।
“সিরিয়াসলি? এতোকিছু করেছিস?”
আনায়া হালকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে,
“এসব আমার একার কাজ নয়।আমরা সবাই মিলে এসব করেছি। তবে অন্ধকারে হাত ছেড়ে পালানোর আইডিয়াটা ছিল আমার। চমক না দিলে —কিসের জন্মদিন? তাও আবার ভ্যাম্পায়ার কেনীথ আর তার ছোট্ট লেডিবাগের বার্থডে বলে কথা। ”
কেনীথ আলতোভাবে হাসে। দীর্ঘদিন পর তার মুখে এমন এক গভীর, নিঃশব্দ হাসি ফুটে ওঠে।যেটা শুধু ঘনিষ্ঠজনই চিনতে পারে। কেনীথ আর অরিনের জন্মদিবস একই দিনে। কেনীথ আগে কখনো নিজের জন্মদিন বিশেষ ভাবে সেলিব্রেট করেনি। বেশিরভাগ সময় ভুলেই গিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে অরিনের বার্থডে এর সাথে তার বার্থডে মিলে যাওয়ায়—সে আর চেয়েও কখনো এই দিনের কথা ভুলতে পারেনি। এবারও তার ব্যতীক্রম নয়। গত দুবছর বিশেষ কিছু কারণবশত এই দিনটা সেলিব্রেট করার মতো সুযোগ তাদের হয়নি। যে কারণে আনায়া সহ সবাই ভেবে নিয়েছে, কেনীথ হয়ত এই দিনের কথা ভুলেই গিয়েছে। আর এই সুযোগেই তারা সবাই প্ল্যান করে এই সারপ্রাইজের আয়োজন করেছে।
কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। দুদিন আগে থেকেই সবার অদ্ভুত বিহেভিয়ারেই সে সবকিছু আন্দাজ করে ফেলে। আর সে এটাও ভালো মতোই জানত, আজ ইনায়ার নয় বরং তার মেয়ে আর তার জন্মদিন। আনায়া সহ প্রত্যেকেই পুরোদমে এতোকিছু করেছে শুধু তাদের সারপ্রাইজ দেবার জন্য। সেক্ষেত্রে কেনীথ আগ বাড়িয়ে সবার প্ল্যান ভেস্তে দেওয়াটা মোটেও ঠিক হতো না। তাই কেনীথ সবটা বুঝেও, না বোঝার ভাণ করে গিয়েছে।
কেনীথ অরিনকে নিচে নামিয়ে দেয়। আশেপাশে সবাই তখন অরিনকে নিয়ে মেতে ওঠে। এদিকে কেনীথ এই সুযোগে আনায়ার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। আনায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে সে বলে,
“তুই সত্যিই একটা মহারাণী।”
আনায়া মুচকি হেসে বলে,
“আর তুমি আমাদের মহারাজা… অ্যান্ড দ্য কিং অফ মাই হেলমেটেড হার্ট!”
এদিকে অরিনের উচ্ছ্বসিত কন্ঠস্বরে বলে ওঠে,
““দিস ইজ দা মোস্ট স্পেশাল বার্থডে অব মাই লাইফ। আই উইল নেভার ফরগেট দিস ডে।”
ওর প্রাণবন্ত উচ্ছ্বাসে সকলেই বিস্তৃত মুচকি হেসে ওঠে।
______________
চারপাশে সকলের আনাগোনায় মুখরিত। বাড়ির ভেতর হতে বাহির, সর্বত্র নানান সাজসজ্জায় আলোকিত। অরিন মনের আনন্দে এদিক সেদিক নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে। আজ তার আনন্দের সীমা নেই। এরইমাঝে ছোট্ট করে একটা এনাউন্সমেন্ট হয়ে যায়। কেক কাটতে আরো অনেকটা দেরি রয়েছে। কেননা, তার পূর্বেই আরো এক বিশেষ ব্যক্তির আজকের আয়োজনে উপস্থিত হওয়াটা আবশ্যক। আর সে হলো লুসিয়া কিংবা সবার প্রিয় বাবুশকা। তার সন্ধ্যারাতেই এখানে আসার কথা ছিল। তবে মাঝপথে কিছু ত্রুটি থাকায়, তার আসতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।
এই ভাবনাতেই, বর্তমান সময়টুকু ফেলে না রেখে সকলেই হলরুমে একত্রিত হতে থাকে। আলো একটু ম্লান করে দেওয়া হয়, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে নরম সুরের একটি গান। সবার চোখে মুখে উচ্ছ্বাসের ছায়া। জোড়ায় জোড়ায় সবাই স্লো বলরুম ডান্সে অংশ নেয়।ঘুরছে, হাসছে, নিজেদের মতো করে মুহূর্তটাকে আঁকড়ে ধরছে।
এদিকে, অরিন ঠিকমতো নাচ জানে না।কিন্তু সে থেমেও থাকে না। তার মুখভর্তি হাসি, চোখে খাঁটি আনন্দ। আশেপাশে সবাই নিজদের মতো পার্টনার খুঁজে নাচছে দেখে, সে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে সেসব দেখতে লাগল। এখানে জুটি বলতে বিশেষ কাউকে তার চোখে পড়ল না। ইনায়া আর রোজ দুজন গল্পের ভঙ্গিতে একসাথে নাচছে। সেটা নাচ বললে ভুল হবে। তারা শুধু গানের সুরে পায়ে পা মেলাচ্ছে। ওদিকে পাভেল আর রেহান তখন কাউন্টার টেবিলের আশেপাশে দাঁড়িয়ে নরমাল ড্রিংকস খেতে খেতে চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করছে।বাহিরের আরো কিছু অতিথিদের আসার কথা রয়েছে। মূল অনুষ্ঠান তাদের আসার পরেই শুরু হবে। অরিন সহ বাকিরাও এটাও জানে। তবে অরিন এই মূহুর্তে খুঁজছে তার বাবা মা-কে। আজ বেশিরভাগ বাড়ির ভেতরের সার্ভেন্টগুলোরও আর সবার মতো সেজেগুজে আয়োজনে অংশ নিয়েছে। এতোগুলো মানুষ রয়েছে, সবার পার্টনারও রয়েছে অথচ সে যাদের খুঁজছে তারাই নেই?
অরিন কিছুটা হতাশ হলো। নিজে নিজেই ভিড়ের মাঝে মিশে না গিয়ে, একা একাই সবার থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ায়। নিজের গাউন উঁচিয়ে ধীরে ধীরে এলোমেলো ভাবে সবার মতো পা মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করে। এতো মানুষের ভিড়েতে অরিনের অস্তিত্বটুকু নেই বললেই চলে। এরইমাঝে আচমকা কেনীথ তার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে। মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
“পাপার সঙ্গে এক রাউন্ড চলবে?”
অরিন মাথা উঁচিয়ে, কেনীথকে দেখতে পেয়েই— খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়।অরিন তার বাবার দুই পায়ের ওপর নিজের ছোট পা দুটো রেখে দাঁড়ায়। হাত দুটো কেনীথ আলতোভাবে ধরে।এদিকে অরিন কিছুটা কাঁচুমাচু মুখে বলে,
“এই রুপাঞ্জেল! তুমি কিন্তু বেশি নড়াচড়া করবে না।নয়তো আমি পড়ে যাব।”
নিমিষেই কেনীথের মুখের অভিব্যক্তি বদলে, হাসোজ্জল মুখটা মিইয়ে যায়। কেনীথ খানিকটা হতাশায় নিমজ্জিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“আহ্ লেডিবাগ! দয়া করো, তবুও আমায় এই নামে ডেকো না।”
—-“কেনো রুপাঞ্জেল পাপা! আমার তো এই নামটা অনেক পছন্দ। ”
অরিন জানে তার বাবা এই নামটাতে বিরক্ত। আর সে এই বিরক্তিতেই যেন বেশি মজা পায়। যে কারণে কেনীথের সকল কথা মেনে নিলেও,অরিন কখনো কেনীথের এই নামে না ডাকার অনুনয় মানতে নারাজ। কেনীথ আর কথা বাড়ায় না। মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে, ধীরে গতিতে ঘুরতে থাকে নাচের ভঙ্গিতে। একইসাথে মনে মনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আওড়ায়,
“মায়ে ডাকে জলহস্তী। মেয়ে ডাকে রুপাঞ্জেল। এই দিন দেখান জন্যই কি দুনিয়ায় এসেছিলাম?”
এদিকে অরিন অরিন বাবার জুতোর ওপর দাঁড়িয়ে, নিজেকে যেন রাজকন্যা মনে করে। সে মাথা উঁচিয়ে চারপাশে তাকায়, আর গর্বের সঙ্গে বলে ওঠে,
“দেখো সবাই, আমি আমার বাবার সঙ্গে নাচছি!”
চারপাশে থাকা সকলে তাদের দিকে তাকায়। প্রত্যেকেই মুচকি হেসে ওঠে, কেউ কেউ তালি দেয়। মুহূর্তটাকে ক্যামেরায় ধরে রাখতে চায় কেউ কেউ। আর কেউ শুধু দাঁড়িয়ে দেখে—কারণ এমন দৃশ্য তো বারবার আসে না। পুনোরায় সকলেই আবার নিজেদের মাঝে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
এদিকে অরিন মাথা উঁচিয়ে, কেনীথের উদ্দেশ্যে আবারও বলে,
“এই রুপাঞ্জেল! শুনো তোমাকে আমার কিছু…”
—“আগে আমায় এই নামে ডাকা বন্ধ করো। নয়তো তোমার কোনো কথা শুনব না। এবং আমি তোমাকে টুপ করে ফেলে দেব।”
কেনীথের সম্পূর্ণ অভিব্যক্তিই অরিনের কাছে প্রচন্ড হাস্যকর লাগল। সে খিলখিল করে হেসে উঠে বলে,
“হাহ্, রুপাঞ্জেল। মিথ্যে বলা কিন্তু ঠিক না। আমি জানি, আমার পাপা কখনো এমনটা করবে না।”
এবার কেনীথ খানিকটা ভ্রু উঁচিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“ওহ রিয়েলি? তোমার পাপা তোমায় ফেলবে না ঠিকই, কিন্তু রুপাঞ্জেল তো তোমায় ফেলতে পারে, তাই না?”
নিমিষেই অরিনের চোখমুখ চুপসে যায়।কিছুটা গম্ভীর্যের সাথে ভারী শ্বাস ফেলে; হাতের কব্জি দিয়ে চশমাটা ঠেলে উঁচিয়ে নিয়ে বলে,
“হুঁশ, রুপাঞ্জেল। দুচটুমি না করে ঠিকঠাক হয়ে নাচো। নয়তো আমার পাপার লেডিবাগ তোমাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে।”
অরিনের কথা শুনে কেনীথের আর কিছু বলার নেই। সেও কিছুটা ভারী শ্বাস ফেলে,মেয়ের সুবিধা মতো পায়ে পা মেলায়। এদিকে কি যেন ভেবে, অরিন বলে ওঠে,
“পাপা! তোমার ফায়ার বার্ড কোথায়?”
—-“তোমার মাম্মাম?…তাকে তো আমিও কোথাও দেখছি না।”
কেনীথ আশেপাশে একবার কাঁধ ঘুড়িয়ে দেখে — নাহ,আশেপাশে কোথাও আনায়ার দেখা নেই। এরইমধ্যে তারা দুজন নাচও থামিয়ে দিয়েছে। দু’জন ভিড় থেকে কিছুটা দূরের কোণায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশের চকচকে লাইটগুলোও নিভিয়ে, পূর্বেই ডিম লাইটগুলো জ্বালানো হয়েছে। সবাইকে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে না তো ঠিকই, কিন্তু কেনীথ আনায়াকে খুঁজে পাবে না এমনটা তো হয়না।
কেনীথ আনায়ার খোঁজে যাবার পূর্বে—কিছু একটা ভেবে নিয়ে থেমে দাঁড়ায়। পরক্ষনেই অরিনের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে। অতঃপর অরিনের নরম দু’বাতে আলতোভাবে নিজের হাত দুটো রাখে। অরিন তার বাবার ভাবগতিকে কিছুটা অবাক হয়। তবে কিছু বলে না। কেনীথ অরিনের চোখে চোখ বলে,
“লেডিবাগ, মা আমার। কিছু কথা বলব, মনোযোগ দিয়ে শুনবে!”
অরিন কেনীথের অভিব্যক্তিতে সম্পূর্ণ স্তব্ধ স্বরে বলে,”হু।”
—“তুমি অরিন—আলোকস্নাতা কন্যা।কিন্তু তোমার শিরায় আমার মতোই অন্ধকার প্রবাহিত।ভুলে যেও না, প্রয়োজন পড়লে আলোও বিষাক্ত হতে জানে।
হ্যাঁ,আমি চাইনা কখনো তুমি আমার মতো হও। কারণ আমি চাই,প্রয়োজনে তুমি আমার চেয়েও ভয়া”নক-ধ্বং”সাত্মক হও।”
অরিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পাপা আজ এসব কেমন কথা বলছে। আগে তো কখনো এসব বলেনি। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে—কেনীথ ও তার অভিব্যক্তি। এদিকে কেনীথ ঠোঁট ভিজিয়ে কিছুটা অস্থির স্বরে আবারও বলে,
“অরিন, মা আমার। জীবনের মহাসংগ্রামে অবিচল সংকল্পই হবে তোমার অস্ত্রশস্ত্র; লঘুচেতনার স্রোত যেন কখনো প্রবাহিত না হয় অন্তরাত্মায়।
অন্ধকারে যখন নিভৃতে বাজবে হিংস্রতার সুর।তখন তুমিই হবে সেই আগুন পাখি—যে নির্ভয়ে দহন করবে শত্রুপ্রদীপের গর্জন।
আমি জানি, আমার সব কথাই হয়তো তোমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। হয়তো অনেক কিছুই এখন বুঝতে পারছ না। প্রয়োজনও নেই এখনই সবকিছু বোঝার। শুধু তোমার বাবার এই কথাগুলো সবসময় স্বরণে রাখার চেষ্টা কোরো। পরবর্তীতে হয়তো এসবই সময়ের সাথে কাজে লেগে যাবে।”
—-“পাপা! তুমি কি কোথাও চলে যাবে?”
কেনীথ আলতোভাবে হাসে। কিছুটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পুনোরায় আওড়ায়,
“স্নেহপ্রসূ মেয়ে আমার,পৃথিবীতে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয়। তুমিও না, আমিও না। এবং স্মরণে রেখো—বাবাও একমাত্র আশ্রয় নয়।বাবা এক অবিনাশী বর্ম,যার অন্তরালে যুদ্ধ হয় শান্ত। কিন্তু প্রয়োজনবশত সেই বর্মই পরিণত হয় নৃশং”স প্রলয়ে।”
কেনীথ অরিনের দু’হাত মুঠো করে চুমু খায়। এদিকে অরিনের চোখজোড়া আকস্মিক ঝলঝল করে উঠছে। যদিও সে তার বাবার বেশিরভাগ কথাই বুঝঝে না, তবে খুব করে মনে হচ্ছে—একটা বাজে কিছু হতে চলেছে। কেনীথ অরিনের এহেন অবস্থায়, আরো খানিকটা কোমল স্পর্শে তাকে আঁকড়ে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। অতঃপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে আওড়ায়,
“কাঁদছো কেনো বোকা মেয়ে? তোমার নিজরেই নিজের জন্য লড়তে হবে। এমনও সময় আসতে পারে, যখন তোমার আশেপাশে কেউ থাকবে না। তোমার এই বাবাও না৷ তখন কি করবে তুমি? ভয় পাবে? কাঁদবে?… কখনো না৷ তুমি এই ভিকের মেয়ে। অন্যরা তোমায় ভয় পাবে, কিন্তু তুমি না। শ*ত্রুরা তোমার আগুনে ঝলসে যাবে, কিন্তু তুমি কখনোই তাদের সামনে নিজের চোখের জল ফেলে দূর্বল হবে না।”
অরিন এরইমাঝে কিঞ্চিৎ ফুপিয়ে ওঠে। তবে সে তার বাবার কথা মতো চোখের জল ফেলে না। এদিকে কেনীথ আবারও বলে,
“তুমি আগুন পাখি হবে, অরিন।এই পৃথিবীর গা ছুঁয়ে চলা নরম পালক নয়—তোমার শিরায় বইবে জ্বলন্ত অঙ্গারের রক্ত।
ভাঙবি, পোড়াবি, উড়বি… কিন্তু থামবি না।তোর কান্না হবে নিঃশব্দ বিস্ফোরণ—আর তোর হাসি?
হাজার বছরের বিদ্রোহের ন্যায় গর্জে উঠবে।
মনে রাখিস, আলো যদি তোকে আলিঙ্গন না করে।
তুই নিজেই আগুন জ্বালিয়ে আলো হবি।কারণ তুই কোনো গল্পের দুঃখিনী কন্যা না। তুই হচ্ছিস সেই কাহিনির শেষ পৃষ্ঠা—যেখানে সব কিছু ছাই হয়ে যায়।শুধু আগুন পাখির ছায়া রয়ে যায় আকাশে।”
____________________
আনায়া হলরুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে, এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি দিয়ে কাউকে খুঁজছে। চোখমুখে এক অদ্ভুত হাসি জ্বলজ্বল করছে। নিজের ভেতর দমিয়ে রাখা উচ্ছ্বাস যেন কোন মতেই, কমছে না। আনায়া তার প্রত্যাশিত ব্যক্তিকে কোথাও না দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো। হতাশায় পা বাড়িয়ে সামনে এগোতে যাবে—তৎক্ষনাৎ দুটো বলিষ্ঠ হাতের মাঝে আবদ্ধ হয়ে যায়।
আনায়ার বুঝতে বাকি নেই, তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি কে। সে তা স্পষ্ট আন্দাজ করতেই বিস্তৃত মুচকি হাসে। এদিকে কেনীথ পেছন হতে আনায়াকে আরেকটু শক্তভাবে জাপটে জড়িয়ে নেয়। আনায়ার কাঁধে নিজের চোয়াল ঠেকিয়ে মোহনীয় কন্ঠে বলে,
“বউউউউউ!”
আনায়া কিছুটা বিস্তৃত মুচকি হাসে। কেনীথ দিকে না তাকিয়েই বলে,
“বলো খলিজা।”
আনায়ার অভিব্যক্তিতে কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ফেলে। পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে,আনায়ার গলায় নাক ঘষে বলে ওঠে,
“ভাল্লাগে না।”
আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়। কেনীথ দিকে কিছুটা অবাক চোখে, ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাতেই, সে বিস্তৃত মুচকি হাসে। আনায়াকে আরেকটু শক্তভাবে জড়িয়ে, কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আয় না করি ফষ্টি নষ্টি। একটু নোনতা, একটু মিষ্টি। ট্যাং, ট্যাং, ট্যাং….”
—“বেশি তিড়িংবিড়িং করলে, ভে*ঙ্গে দেব ঠ্যাং।”
আনায়ার কথা শুনে নিমিষেই কেনীথের ফুরফুরে মেজাজ মিইয়ে যায়। এদিকে চারপাশে এতো এতো মানুষজনের দিকে, একবার চোখ বুলিয়ে নেয় আনায়া। এতো মানুষের মাঝেও, এই লোকের উত্তে*জনা কমে না। আনায়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,কেনীথ কাঁধের কাছে আলতোভাবে ঘুষি মে”রে বলে,
“অসভ্য লোক! এবার তো একটু সভ্য হোন।”
কেনীথ আনায়ার কথায়, একটুও পাত্তা না দিয়ে— আনায়ার দুহাত ধরে নিজের কাছে টেনে নেয়। অতঃপর নিজের মতো করে, মনের বিরহে নাটুকে ভঙ্গিতে গাইতে শুরু করে,
“ও বউ!
কেনো আমার কাছে, আসো না!
ও বউ!
তুমি আমায় কি ভালো বাসো না?
ও বউ!
চলো ঝগড়া মারামারি, ভুলে যাই তাড়াতাড়ি,
ইতনা গুচ্ছা কিউ?
তুমি কেনো এতো বোকা সাজো,
আমায় একটু বুঝো।
শোনা না!
আই লাভ ইউ…ও বউ!”
কেনীথের ভাবভঙ্গি, অভিব্যক্তিতে আনায়া কিঞ্চিৎ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এদিকে কেনীথ এতক্ষণে আনায়াকে সামনে হতে আগলে জড়িয়ে রেখে, দু-চারবার তার ঠোঁটে-কপালে চুমু খেয়ে নিয়েছে।
—“কবে শুধরাবেন আপনি? বয়স কি আপনার বাড়ছে, নাকি কমছে? এতো এলোমেলো কাজকর্ম করেন কিভাবে?”
কে শোনে কার কথা। কেনীথ আনায়ার পুরো অভিব্যক্তিকে ফেলে রেখে, আবারও নিজের মতো গাইতে শুরু করে,
“এলোমেলো ইচ্ছে যত,
ভালোবেসেছি তারই মতো।
ডুবে আছি আজও তোরই প্রেমে,
জীবন সঁপেছি তোরই নামে।”
আনায়া আবারও হতাশ হয়। একে এতো বলেও কোনো লাভ নেই। আবার এটাও বুঝতে পারছে না, এই লোক হুটহাট এতো কেনো খুশি হয়ে উড়ছে। সে কি কোনোকিছু বুঝে গিয়েছে?আনায়ার চিন্তাভাবনার মাঝেই, কেনীথ আনায়ার দিকে অপলক চেয়ে থাকতে থাকতেই ব্যাথাতুর অভিব্যক্তিতে গেয়ে ওঠে,
“প্রথম দেখাতেই আমি প্রেমে পড়েছি তোমার।
দু চোখে আন্ধার দেখি, ঘুম আসেনা আমার।
রাত্রি বেলা, শুয়ে শুয়ে….
শুধু ভাবি আমি, কি করে পাব তোকে।”
কেনীথ শুধু আনায়াকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে, এসব উল্টোপাল্টা কাজ করে টাইম পাস করছে। তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দকর বিষয় হলো, কারণে অকারণে আনায়াকে বিরক্ত করা। তবে এবার কেনীথের সাথে সাথে আনায়াও তাল মেলায়।
“না প্রথম দেখাতে, ভালোবাসিনি আমি।
তবে ধীরে ধীরে জাগল, এই অনুভূতি।
আমি সারাদিন ভেবে—এই ভাবে, যায় আমার রাত পেরিয়ে।
দুনিয়া ভাবুক যা, ভাবার আছে তা।
তবে আমি তো ভাবব, শুধু তোমাকে।”
হুট করে আনায়ার এই পরিবর্তনে কেনীথ কিছুটা অবাক হয়। কপাল কুঁচকে আনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
“ঘটনা কি? হুট করেই এতো খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেনো?”
কেনীথের অভিব্যক্তিতে আনায়া নিমিষেই, নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর হয়।
—“কোথায় ওতো খুশি খুশি…ও কিছু না।”
—-“উহু, ঘটনা তো ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না? এতোক্ষণ কোথায় ছিলি তুই?”
—“কি আজব? এতোক্ষণ ওয়াশরুমে ছিলাম আমি।তুমি কি এখন আমায় সন্দেহ করছো?”
কেনীথ আনায়ার দিকে চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান চাহনিতে তাকায়। পরক্ষণেই কি যেন একটা ভেবে নিয়ে বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে,
“হেই ব্লাড, চল ছাঁদে যাই।”
—“এতো রাতে ছাঁদে? কোনো বিশেষ প্রয়োজন?”
—-“বিশেষ প্রয়োজনই বটে। দেখ আশেপাশে সবাই যার যার মতো নাচে ব্যস্ত। আমার লেডিবাগও রোজের সাথে। আর কোনো টেনশন নেই। চল আমরা ছাঁদে যাই।”
কেনীথ এহেন অদ্ভুত উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তিতে আনায়া চোখমুখ কুঁচকে যায়। কেনীথের কলারের আশেপাশটা দু’হাতে ঠিক করে দিতে দিতে—ভ্রু উঁচিয়ে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনার মাথায় কি চলছে, ভিকে মশাই?”
আনায়ার দিকে কেনীথ অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে, তীর্যক মুচকি হাসে। দু’হাতে আনায়ার কোমড় জড়িয়ে বলে,
“তুমি যা ভাবছো তাই!”
নিমিষেই আনায়ার চোখমুখ চুপসে যায়। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলে,
“অসভ্য একটা!”
—-“কিসের অসভ্য?…ছ্যাহ, তুমি ভালোবাসা বুঝলে না প্রিয়।”
—-“রাখুন আপনার ভালোবাসা। ওসব কচুর ভালোবাসা। কখন কোথায় সুযোগের অসৎ কাজটা সেরে ফেলতে হবে—এটাই আপনার ধান্ধা।… ধান্ধাবাজ কোথাকার।”
—–“ছিঃ, এভাবে আমার ভালোবাসার মূল্যায়ন করলি? তবে ঠিক আছে।”
—-“কি ঠিক আছে?”
আনায়ার তীক্ষ্ণ প্রশ্নে কেনীথ আবারও নাটুকে ভঙ্গিতে দু’লাইন গায়,
“বলব না গো,আর কোনোদিন। ভালোবাসো তুমি মোরে।”
কেনীথের অভিব্যক্তিতে আনায়া ফিক করে হেঁসে ফেলে। কেনীথ কলার পুনোরায় ঠিক করে দিয়ে বলে,
“ভিকে মশাই,আগামী দশ মাসের জন্য প্রস্তুতি নিন।”
“কিসের প্রস্তুতি?”
—-“এই যে আপনার, হুটহাট উথলিয়ে পড়া উত্তেজনাগুলোকে—দমিয়ে রাখার প্রস্তুতি।”
আনায়ার অভিব্যক্তিতে কেনীথের কপাল খানিকটা কুঁচকে যায়। কথাবার্তার ধরনে ভিন্নকিছু আন্দাজের প্রচেষ্টা চালায়। এদিকে কেনীথের ভাবগাম্ভীর্যের মাঝেই আনায়া বিস্তৃত মুচকি হাসে। কেনীথ কলার ছেড়ে, দু’হাতে ঘাড় গলা পেঁচিয়ে নেয়। পা দুটো খানিকটা উঁচু করে, কেনীথের মুখোমুখি হয়ে বলে,
“আচ্ছা, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন তো— কি দেখছন?”
কেনীথ অপলকভাবে আনায়ার চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,
“তোমার চোখে আকাশ আমার,
চাঁদ উজ্জ্বল পূর্নিমা।
ভেতর থেকে বলছে হৃদয়,
তুমি আমার প্রিয়তমা।”
কেনীথের কন্ঠস্বরে আনায়া ফিক করে বিস্তৃত হেসে ফেলে। পরক্ষণেই কেনীথের কানের কাছে মুখ এনে, ফিসফিসিয়ে আওড়ায়,
“মিস্টার ভিকে, কংগ্রাচুলেশনস! আবারও বাপ হতে চলেছেন আপনি।”
আনায়ার এহেন কথায়, কেনীথ কিছু সময়ের জন্য থমকায়। পরক্ষণেই নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়ে,আনায়ার মুখোমুখি হয়ে বিস্ময়ের সাথে বলে ওঠে,
“সত্যি?”
আনায়া বিস্তৃত মুচকি হাসে। আলতোভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ওঠে,
“বার্থডে গিফট পছন্দ হয়েছে?”
আনায়া আর কিছু বলার সুযোগ পায়না। বরং তার পূর্বেই,কেনীথ আনায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে—ওষ্ঠে ওষ্ঠ মিলিয়ে দেয়। আচমকা এহেন ঘটনায়, আনায়া অকস্মাৎ হতভম্ব হলেও,তার কিছু করার থাকেনা। তাদের এদিকটায় কিছুটা অন্ধকার হওয়ায়, কারো নজরও তাদের দিকে পড়ে না। তবে কেনীথের খানিকটা হুঁশ ফিরতেই সে আনায়াকে ছেড়ে দেয়। আনায়ার সাথে সাথে কেনীথও আজ হাঁপিয়ে ওঠেছে। তার ভেতরের তোলপাড় করে দেওয়া অনুভূতিটা যে ভিন্ন। কেনীথের অস্থিরতায় আনায়া কিছুটা অবাক চোখে তাকায়।
এদিকে কেনীথ আনায়ার ডান হাতটা ধরে, নিজের বুকের বা’পাশে ঠেকিয়ে বলে,
“এই দেখ, হার্টবিট এতো ফাস্ট চলছে—যেন দৌড়াচ্ছে।”
আনায়া নিজেকে স্বাভাবিক করে, আলতোভাবে হাসে।
—–“সাবধান মিস্টার! আগেরবার প্রেগন্যান্সির কথা মনে আছে তো? সবটা কিন্তু আপনাকেই সামলাতে হবে।”
—-“কোনো সমস্যা নেই মহারানী। আমার বাচ্চাকাচ্চা সব আমার মতোই নম্র,ভদ্র, শিষ্টাচার হবে। তাই এই দুটো কেনো, আমি হাজারটা বাচ্চার বাপ হতেও রাজি।”
কেনীথের কথায় আনায়া চোখ-মুখ কুঁচকে বলে,
“হাজারটা বাচ্চা কি মুখের কথা? আমার আর বাঁচতে হবে না!”
আনায়ার কথায় কেনীথ বিস্তৃত মুচকি হেসে, খানিকটা নাটুকে ভঙ্গিতে, গাম্ভীর্যের সাথে আনায়ার মাথার উপর হাত বাড়িয়ে বলে,
“আসো মেয়ে, তোমায় দোয়া দেই। দুইজোড়া ফুটবল টিমের জননী হও।”
—-“তা পীর বাবা কেনীথ উল্লাহ উদ্দিন সলিমুল্লাহ! শুধু দুইজোড়া কেনো? চার জোড়ার দোয়া দিলে হয় না?”
—-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই। শুধু চার নয়, তুমি মেয়ে চৌদ্দ জোড়া ফুটবল টিমের জননী হও৷ জোরছে বলো আমিন৷”
কেনীথের পাশাপাশি আনায়াও তাল মিলিয়ে, শেষমেশ দু’জনেই একসাথে খিলখিল করে হেসে উঠল। এদিকে কেনীথ কি যেন ভেবে নিয়ে বলে,
“আমাকে আগে বলিসনি কেনো? এই বার্থডের জন্য লুকিয়েছিলি?”
—“আরেহ্ না, লুকাতে যাব কেনো। আমি জেনেইছি তো আজ। বলতে গেলে একটু আগে।”
আনায়ার নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিতে কেনীথের কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,
“এই জন্যই কি তবে…তোর ওসব উল্টোপাল্টা মুড সুইং এর কাহিনি… ওহ গড,এখন থেকেই এসব শুরু হয়ে গিয়েছে?”
কেনীথের অভিব্যক্তিতে আনায়া খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে হেসে, ইতস্ততভাবে বলে,
“কি করব, তুমি তখন মুড সুইং এর কথা বলছিলে বিধায় আমার একটু খটকা লাগে। আর একটু আগে টেস্ট করিয়ে দেখি সত্যি সত্যি… ”
আনায়ার ভাবভঙ্গিতে কেনীথ ভারী শ্বাস ফেলে। আনায়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে, তার গালের দুপাশে আলতোভাবে হাত রেখে কিছুটা অস্থির স্বরে বলে,
“বউ আমার,দুই বাচ্চার মা হয়ে যাচ্ছিস। কবে বোধবুদ্ধি হবে তোর? এসবও আগে আমারই আন্দাজ করতে হয়?”
আনায়া অপ্রস্তুত ভাবে কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
“হে হে, কি করবে বলো? তোমারই তো বউ বাচ্চা। সামলে নিও একটু, হ্যাঁ!”
কেনীথ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই আবার অস্থিরতার স্বরে বলে ওঠে,
“সে না হয় বরাবরের মতোই সামলে নেব। তবে একটা স্পষ্ট করে বলছি, একদম মাথায় গেঁথে নে।”
—-“কি কথা?”
—-“যতই মুড সুইং হোক, যতই যাই হোক না কেনো। তোর সব বাচ্চার বাপ শুধু আমিই হব, ঠিক আছে? আশেপাশে তাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
তোর ১ম বাচ্চার বাপও যেমন আমি, তেমনি ১০০০ তম বাচ্চার বাপও ঠিক আমিই হব। মনে থাকে যেন।”
—-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু… তাহলে কি ১০০১ তম বাচ্চার বাপ অন্য কেউ হবে?”
এহেন পরিস্থিতিতেও আনায়ার এমন মশকরায় কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। দাঁত খিঁচে, চোখ রাঙিয়ে বলে,
“আনায়া!”
আনায়া খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। ওদিকে কেনীথ কিছুটা হতাশ হয়ে বলে,
“খিদে পেয়েছে? কিছু খাবি?”
—-“হয়েছে,এখন থেকেই এতো ব্যস্ত হতে হবে না।”
—-“কি খাবি তা বল।”
—-“কিছুই না।”
—-“তবে তুই এখানেই থাক, আমিই গিয়ে কিছু একটা নিয়ে আসছি।”
—“আরেহ বললামই তো… ”
কে শোনো কার কথা। কেনীথ নিজের মতো চলে যেতে নিলে, পেছন থেকে আকস্মিক আনায়া ডেকে ওঠে,
“ভিভান ভাইয়া!”
আকস্মিক এ কথা শুনে, কেনীথ তৎক্ষনাৎ বিস্ময়ের সাথে পেছনে ফিরে তাকায়। আনায়ার মিটমিট করে হাসতে থাকা নির্বিকার অভিব্যক্তিতে, কেনীথের আশ্চর্যের সীমা থাকেনা।
—-“এটা কি বলে ডাকলি তুই আমায়?”
—-“কি আবার, ভিভান ভাই!”
—-“সিরিয়াসলি, তারা! এসব আবার কেমন মশকরা ?”
আনায়া মিটমিট করে হেসে বলে,
—-“মশকরা কেনো হতে যাবে, ভিভান ভাইয়া!”
—–“হোয়াট দ্য হেল, আমি তোর কোন জনমের ভাইয়া?”
—-“এই জনমের ভাইয়া, ভিভান ভাইয়া। প্রাণের ভাইয়া, জানের ভাইয়া।ছাইয়া ছাইয়া, আমার ভাইয়া।”
—-“উফ তারা,যা গিয়ে রেস্ট কর। মাথাটা সত্যি সত্যি গিয়েছে তোর। সাথে এখন আমার মাথাও খেতে আসছিস।”
—-“মাথা কেনো খাব ভিভান ভাইয়া। তুমি না আমার জন্য কি যেন আনতে…. ”
—-“চুপ থাক, একদম চুপ থাক।”
—-“আহা, এতো কেনো রাগ করছেন ভিভান ভাইয়া। আগে আমার কথা তো শুনুন।”
এবার কেনীথ কিছুটা শান্ত হয়। আনায়া ইচ্ছে করে যে এসব কাহিনি করছে তা সে ভালোই বুঝতে পারছে। কিন্তু কেনো যেন মেজাজ কোনো মতেই ঠান্ডা হচ্ছে না। তবুও সে দাঁত চেপে,শান্ত স্বরে বলে,
“বল কি বলবি?”
হুট করেই কেনীথের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক দেখে আনায়ার কপাল কুঁচকে যায়। কিছু একটা ভেবে নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,
“বেটা বজ্জাদ, মচকাবে তবুও ভাঙবে না।”
কিন্তু মুখে সে বিস্তৃত হেসে বলে,
“ভিভান ভাইয়া, আমার বাচ্চারা কি আপনাকে মামা ডাকবে?”
এবার আর কেনীথের মেজাজ ঠিক থাকে। দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে,
“এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে। কান ধরে এখনই পানিতে চুবাব।”
—“হা হা, এখন কেন বেশি হচ্ছে। যখন নিজে আমাকে জ্বালাতে আসেন, তখন হুঁশ থাকে না?”
—-“ভাগ এখান থেকে। কথা বলবি না আমার সাথে।”
—-“”আচ্ছা ভিভান ভাইয়া।”
—-“ভালো হয়ে যা, তারা। ভালো হতে কিন্তু টাকা লাগে না।”
—-“হুঁশ! আমার সোয়ামির অনেক টাকা৷ তাহলে যে জিনিসে টাকা লাগে না, তা কেনো আমি হতে যাব?”
—-“কে তোর সোয়ামি?”
—-“কেনো আপনি।”
কেনীথ কিছুক্ষণ আনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকার পর। গোমড়ামুখে স্থান ত্যাগ করে নিলে, পেছন থেকে আনায়া আবারও বলে,
“আরেহ ভিভান ভাইয়া, দাঁড়াও একটু।”
কেনীথ থামছে না বিধায়,আনায়া এক প্রকার ছুটে গিয়ে কেনীথের হাত টেনে পেঁচিয়ে বলে,
“ওহে আমার সোয়ামি, এতো রাগ করতে নেই৷ একটু দাঁড়াও, কথা আছে তোমার সাথে।”
কেনীথ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কিছুই বলে না। কেনীথের অভিব্যক্তিতে আনায়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,
“একটু ঐ দিকটা দেখো তো!”
আনায়ার কথা শুনে, কেনীথ কপাল কুঁচকায়। তার ইশারা মতো সামনে তাকাতেই চোখে পড়ে এক চমৎকার দৃশ্য। ইনায়া পাভেল একসাথে নাচের তালে পায়ের সাথে পা মেলাচ্ছে। কেনীথ একঝলক তাদের দেখে নিয়ে, পাশে ফিরে আনায়াকে দেখে। ওমনি আনায়া বিস্তৃত হেসে বলে,
“সুন্দর না?”
কেনীথ সন্দিহান স্বরে বলে,
“কি চলছে তোর মাথায়।”
আনায়া মুচকি হেসে বলে,
“যা চলছে তোমার মাথায়।”
এই বলেই আনায়া মুচকি হেসে ফেলে। পরক্ষণেই বকতে শুরু করে,
“জানো, ইনায়া আজ বলছিল। এ বাড়ি ছেড়ে চলে ্যাবে।”
—-“কোথায় যাবে ও?”
—-“জানি না। বলছিল, আমাদের সাথে থাকলে নাকি ও পুরোপুরি পাগল হয়েই একদিন ম’রে যাবে।”
—-“হাহ্, ও তো এমনিতেই পাগল। নতুন করে পাগল হবার কি আছে?”
—-“এ্যাই, খবরদার আমার বোনকে নিয়ে কিছু বলবে না। ও পাগল হলে, তুমি কি তবে?”
—-“কি বলতে চাইছিস,আমরা সবাই পাগল। আর তুই একাই ভালো।”
—-“আহা, সব সময় আমার পেছনেই কেনো লাগতে আসো বলোতো?একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা বলছি, মন দিয়ে শোনো।”
—-“হুম, বল।”
—-“ইনায়ারও বয়স হচ্ছে, ওদিকে পাভেল ভাইয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বড় ভাই-বোন হিসেবে, এই দুটোর সেটিংস ফিটিংস করিয়ে দিলে হয় না?”
এইটুকু বলেই আনায়া চোখ পিটপিট করে কেনীথের দিকে তাকায়। কেনীথ একপলক তার দিকে তাকানোর পর, পুনোরায় ইনায়া আর পাভেলকে দেখে। দু’জন প্রচন্ড ব্যবধানে ও সংকোচে নেচে চলেছে।
—-“কথাটা মন্দ নয়। পাভেলও আজ সকালে, মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলেছে। বয়স তো আর কম হয়নি। ব্যবস্তা একটা করাই যায়।”
এটা শোনা মাত্রই, আনায়া খুশিতে প্রায় লাফিয়ে উঠবে। ওমনি কেনীথ কিছুটা ধমকে বলে,
“আস্তে লাফালাফি কর। আমাদের ডিসিশনে কাজ হবে না। ওদেরও নিজস্ব সিন্ধান্তের একটা ব্যাপার রয়েছে।”
—“হুম, তা তো অবশ্যই।”
—-“অবশ্য ভালোই হবে। ইনায়া যে জিনিস না…! বেচারা পাভেল গাধাটার জীবন তেজপাতা হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে তবে।”
কেনীথ হেসে হেসে কথাটা বলে ফেললেও, আনায়া বিস্ময়ের চাহনিতে তার দিকে তাকায়। নিমিষেই কেনীথ থতমত খেয়ে যায়।
—“এক সেকেন্ড, কি বোঝাতে চাইছো তুমি? আমার বোনের সাথে বিয়ে হলে পাভেল ভাইয়ের জীবন তেজপাতা হবে? হ্যাঁ,আমার বোন রাগচটা, পাগল। তাই বলে এখনো তুমি তাকে এতোটাই খারাপ ভাবো?”
—-“আরেহ এতো সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? আমি কখন বলেছি, ইনায়া খা’রাপ। বিয়ের পর তো সবারই জীবন ওই যা-তা তেজপাতই হয়।”
—-“তা মানে আমার জন্য আপনার জীবনও…?”
—-“মিথ্যে বলে আর কি করব। সত্যিটা তুইও জানিস।”
কেনীথের নির্বিকার অভিব্যক্তিতে আনায়া বিস্ময়ের চাহনিতে, কঢ়া স্বরে বলে ওঠে,
“আপনাকে তো আমি…ঠাডা পড়ুক। বেশি বেশি ঠাডা পড়ুক। আমারও দেখার ইচ্ছে আছে। আমার চেয়ে কত ভালো বউ আপনার কপালে জোটে।”
কেনীথ আনায়ার অভিব্যক্তিতে শয়তানি হাসিতে তির্যক হেসে বলে,
“ঠাডা পড়লে, তোমায় সুদ্ধ পড়ুক বউউউ।
_________
প্রায় রাত দশটা পেড়িয়ে এগারোটা বাজতে চলল তবুও বাবুশকার এখনো আসার কোনো নাম নেই। বাকি মেহমানদের কথা তো না হয় বাদই দেওয়া যায়। সবমিলিয়ে কেনীথ আনায়া দুজনেই কিছুটা অবাক। এখনো কেনো বাবুশকা আসছে না, তাই কেউ বুঝে উঠতো পারল না। আরো দেরি করলে, কেক কখন কাটবে? অন্তত রাত বারোটার আগে তো কাটতেই হবে।
এমন পরিস্থিতিতে কেনীথ খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে, লুসিয়া তার ব্যক্তিগত কিছু প্রয়োজনে মাঝ রাস্তা হতেই আবারও আশ্রমে ফিরে গিয়েছে। এতে সে কিছুটা অবাক হয়। তবে পরবর্তীতে জানে যে, লুসিয়া আবারও তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। কিন্তু মাঝ রাস্তায় এসে নাকি আবার এক সমস্যা হয়েছে। ঘটনা কোথায় থেকে কোথায় যাচ্ছে, কেনীথের বোধগম্য নয়। আর সে বেশি একটা বুঝতেও চাইল না। দ্রুত পাভেলকে ডেকে লুসিয়াকে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এদিকে আবার আনায়া কিছু একটা ভেবে পাভেলের সাথে ইনায়াকেও পাঠায়। তার আগ বাড়ি এক কাজ করার উদ্দেশ্যটা কেনীথের জানা। তাই সে আর কিছু বলে না।
পাভেল আর ইনায়া বাড়ি থেকে বেড়িয়েছে। দু’জন বিস্তৃত উদ্যান পেরিয়ে রাস্তার প্রান্তে নিজেদের গাড়ির কাছে আসে। দু’জনেই কাজের তাগিদে ছুটে চলেছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। এমন পরিস্থিতিতে আচমকা,তড়িঘড়িতে ইনায়া ছোট একটা পাথরের সাথে পা বাঁধিয়ে হোঁচট খেতেই—পাভেল শক্তভাবে তার হাত আঁকড়ে ধরে। আচমকা তার অভিব্যক্তিতে ইনায়া কিছুটা অবাক হলেও নিজেকে সামলে নেয়। ওদিকে পাভেল উদ্বিগ্নতার সাথে বলে ওঠে,
“এ্যাই, ঠিক আছো তুমি?”
ইনায়া কিছু না বলে মাথা ঝাকায়। ওমনি পাভেল বিস্তৃত হেসে ভারী শ্বাস ফেলে। তবে তার এসব বিহেভিয়ার ইনায়ার কাছে কিছুটা অদ্ভুত লাগল। কিন্তু সে এসবে পাত্তা না দিয়ে, পুনোরায় এগিয়ে নিজেদের গাড়ির কাছে আসে। কিন্তু সেই মূহুর্তে আচমকা আবারও এক বিপত্তি বাঁধে। পাভেলের কাছে একটা ফোন আসে। সে ফোনটা রিসিভ করে, কারো সাথে কথা বলতে শুরু করে। একই সাথে তার চোখমুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। যা ইনায়ার চোখে স্পষ্ট ধরা দেয়। এছাড়া ফোনে কারো সাথে রাগারাগি করাটাও ইনায়ার নজরের অগোচর হয়না। সে শুধু চুপচাপ সব লক্ষ করে। পাভেল লোকটা মন্দ নয়। তারও বেশ ভালোই লাগে। তবুও কিছু পুরোনো খটকা রয়েছে তার মনে। যার উত্তর সে আজও পায়নি, আর না সে কখনো তার এই প্রশ্নগুলোকে গোছাতে পেরেছে। এরইমাঝে পাভেল ফোনটা কেটে দিতে দিতেই, খানিকটা জোর স্বরে বিরক্তির সহিত বলে,
“বাস্টা”র্ডগুলো, আজকের দিনেও লাইফটা হেল বানিয়ে ছাড়বে।”
তার কথা শুনে,ইনায়া এবার ধীর স্বরে আগ বাড়িয়ে বলে,
“কোনো সমস্যা?”
ইনায়ার দিকে তাকিয়ে পাভেল শান্ত হয়। তবে তার অস্থিরতা কমছে না।
—“তেমন কিছু না। তবে তোমায় একটা সাহায্য করতে হবে।”
—-“জ্বী, বলুন। কি করতে হবে?”
—-“আ…তুমি কি একাই বাবুশকাকে আনতে যেতে পারবে?”
ইনায়া শুরুতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও, পরক্ষণেই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
—-“কোনো সমস্যা হবে না তো?”
—-“নাহ, সমস্যা নেই। কিন্তু আপনি হঠাৎ… ”
—-“আ’ম সরি, তোমাকে কষ্ট করতে হতো না। তবে আমি তোমার সাথে এই মূহুর্তে যেতে পারছি না। আমাদের পেছনে কয়েকজন… আচ্ছা ওসব বাদ দেও। আপাতত আজকের দিনে ভাইকে এসব নিয়ে আমি কোনোরকমের স্ট্রেস দিতে চাইনা। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই একবার যেতে হবে।”
—-“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি না হয় বাবুশকাকে আনতে যাচ্ছি। আপনি আপনার কাজে যান।”
ইনায়ার কথায় পাভেল স্বস্তিতে ভারী শ্বাস ফেলে। তবে ইনায়ার সাথে না যেতে পারার একটা মৃদু আফসোসের ছাপও যেন তার অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠে। কিন্তু দুজনে বেশি একটা সময় নষ্ট না করে, দু’জনে ভিন্ন দুই গাড়িতে নিজেদের গন্তব্যে রওনা দেয়। তবে যাবার পথে পাভেল আবারও একটা তীক্ষ্ণ দায়িত্ববোধ প্রকাশে,ইনায়ার উদ্দেশ্য বলে,
“সাবধানে যেও, কোনো সমস্যা হলে আমায় ফোন কোরো।”
_________
ইনায়া চুপচাপ গাড়ি ড্রাইভ করছে। তার পাশে চুপটি করে সাদামাটা পোশাকে বসে রয়েছে লুসিয়া। বহুদিন পর তার বাড়ি ফেরা হবে। অরিন হবার পর হতে তার বাড়ির প্রতি একটা ভিন্ন টান জন্মেছে। তবে কোনো মতেই আশ্রমের নিয়ম কানুন ও তার ব্যক্তিগত সিন্ধান্তের বশে সে, বেশি একটা সময় বাড়িতে সবার সাথে থাকার সুযোগ পায়না। পুরো আন্ডারগ্রাউন্ডে রাজত্ব করা এই প্রভাবশালী নারীর, এহেন দশাও যেন এক আশ্চর্যজনক দৃষ্টান্ত উদাহরণ।
দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। মাঝেমধ্যে অবশ্য দু-একটা কথাও হয়েছে। বাড়িতে সবাই কেমন আছে, অরিনের কি অবস্থা, তার কি অবস্থা — মোটামুটি সকল প্রশ্নের উত্তর ইনায়া ভালোভাবেই দিয়েছে।
রাত অনেকটা হয়েছে বিধায়, গাড়ির স্পিডটাও এখন অনেক বেশি। রাতের নির্জনতায় চারপাশের যানযটের ভোগান্তি নেই। দু-একটা বড়বড় গাড়ি আশেপাশে দিয়ে সাই সাই করে ছুটে চলেছে। এদিকে লুসিয়া আবারও হাসি মুখে, ইনায়ার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি তোমার বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছো?”
আচমকা ইনায়ার বিয়ের প্রসঙ্গে ইনায়া কিছুটা অবাক হলো । আজ সবাই কেনো তার বিয়ে নিয়ে পড়েছে। তবে সে খুব বিশেষ প্রতিক্রিয়া না করে, হালকা মাথা নাড়িয়ে বলে,
“জ্বী, নাহ।”
লুসিয়া কিছুক্ষণ সময় নিয়ে, কিছু একটা ভেবে বলে।
—-“একা একা আর কতদিন থাকবে। তোমার নিজেরও উচিত, তোমার বোনের মতো একটা পদক্ষেপ নেওয়ার। সংসার জীবনের ইচ্ছে নিশ্চয় তোমারও রয়েছে!”
ইনায়া আলতোভাবে তির্যক মুচকি হাসে। দীর্ঘ ভারী শ্বাস ফেলে আওড়ায়,
“নাহ, যতদূর জানি। বিয়ে নামক, এই বন্ধনটা অন্যসকল সম্পর্কের চেয়ে ভিন্ন। আর আমি চাইনা, আমার জন্য কারো জীবন ন”ষ্ট হোক।”
ইনায়ার অভিব্যক্তিতে লুসিয়ার ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। সে নিজের মতো করে, কিছু একটা ভাবতে শুরু করে। নিমিষেই তার চোখে-মুখেও এক অদ্ভুত অন্ধকার ছায়া নেমে আসে। সে দীর্ঘ ভারী শ্বাস ফেলে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে, তার উদ্দেশ্যে বলে,
তবে কি এভাবেই থাকবে সারাজীবন?”
—-“নাহ।”
—-“তাহলে কি চাও তুমি?’
ইনায়া সম্মূখ হতে নজর সরিয়ে, একপলকের জন্য পাশে ফিরে লুসিয়ার দিকে তাকায়। কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে জবাব দেয়,
“মৃত্যু!”
আর ঠিক তৎক্ষনাৎ এক ঝড় সবকিছুকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়।ইনায়ার কণ্ঠনিঃসৃত উচ্চারণ যেন ভবিষ্যতে অশ্রুত সংকেত। লুসিয়ার দৃষ্টিপথ ত্বরিতে সম্মুখাকাশে স্থির হয় আর ঠিক সেই মুহূর্তেই—আকাশপটে উদিত হয় দুয়াধ্বস্ত মহাক্রন্দন।
সম্মুখদিক হতে এক বহুভারসঞ্চিত, বৃহৎকায় ভারবাহী ট্রাক—তুষারাচ্ছাদিত রাত্রির স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে। শূন্যালোকিত শীতার্ত রোডপথ ছিন্ন করে।ধাবিত হতে থাকে— অসংকেতিত, অবিনম্র।ইনায়ার দুই কর্ণপথে তখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তারই কণ্ঠস্বর,“মৃত্যু…!”
আর সেই প্রতিধ্বনির সঙ্গে সংগতি রেখেই, পরবর্তী মুহূর্তে,প্রচণ্ড প্রহারের নি’ক্ষি’প্ত গর্জনে
‘চূর্ণবি’চূ’র্ণ হয়ে পড়ে তাদের গমনপথ।এক তীব্র, তীক্ষ্ণ ধাতব সং”ঘর্ষে… গাড়ির সম্মুখভাগ উন্মোচিত হয়ে, র’ক্তবর্ণ অ’গ্নিকু’ন্ডে রূপান্তরিত হয়।
ধাতব খণ্ড বিখণ্ড,বায়ুমণ্ডলে ছিন্ন চিৎকার।রক্তিম স্পর্শে চিত্রিত জানালা।ভ্রাম্যমাণ ছায়ার নিচে মুখ থুবড়ে পড়া ভবিষ্যৎ।গাড়িটি দুই দফা উল্টে
তুষারসিক্ত খাদপথে পতিত হয়।একপাশে জ্বলতে থাকে গ্যাস ট্যাঙ্কের অগ্নিশিখা।অপরপাশে নিঃসন্দেহে নিথর—লুসিয়ার চেহারা।
ইনায়া, আধখোলা চোখে রক্তসিক্ত দৃষ্টি ফেলে
দিগন্তলিপিতে। যেখানে আজ নিমিষেই ‘জীবন’ শব্দটি অদৃশ্য হতে চলেছে। তার ঠোঁট কিঞ্চিৎ কাঁপে, কিন্তু কণ্ঠ ফেটে বলে না কিছুই। র*ক্তাক্ত হয় সমগ্র দেহ। শুধু শ্বাসে বয়ে চলে,একটিই দ্বিধাময় প্রশ্ন,
“এই কি তবে মুক্তি? নাকি শাস্তির এক অনন্ত বিন্যাস?”
তৎক্ষণাৎ,কারো পদশব্দ!তুষার চাপা ধ্বনির মধ্যে ভেসে আসে কারোর নির্বাক আগমন।কাঁচের ভাঙা প্রতিচ্ছবিতে প্রতিফলিত হয়, কালো পোশাকে আবৃত এক অস্ত্রধারীর আগমন। ভাঙা স্তুপের মাঝে নিষ্ক্রিয় হতে চলা দুটো প্রাণকে ফেলে রেখে, আগুন্তকঃ তির্যক হেসে কাউকে ফোন করে অস্ফুটে আওড়ায়,
“ট্রেইলার’স্ ডান। টাইম ফর দ্য রিয়াল শো।”
চলবে।