একজোড়া আগুন পাখি পর্ব-৪২ (সমাপ্তি পর্ব→(০৬ অংশ) )

0
5

#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা

সমাপ্তি পর্ব —( ৬ষ্ঠ অংশ)

আনায়া তড়িঘড়ি করে এদিক সেদিক ছুটছে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মেহমান যাদের আসার কথা ছিল, তাদের কেউ আর আসছে না। লোকারন্যে পরিপূর্ণ হলরুমটাও ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে শুরু করে। আপাতত সবাই বাবুশকার জন্য অপেক্ষায়।সে চলে এলে আর একটুও সময় নষ্ট করবে না। নিজেরাই নিজেদের মতো করে বার্থডেটা সেলিব্রেট করে নেবে। কিন্তু সন্ধ্যায় আসার কথা সেই বাবুশকার আসতে এতো দেরি—যেন কোনোভাবেই তাদের বোধগম্য নয়। এতে তারা কিছুটা হতাশও হয়। এরইমধ্যে আবার আনায়া খেয়াল করে দেখে রেহানও আশেপাশে কোথাও নেই। প্রথমে বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও, পরক্ষণেই রোজের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে যে—রেহান নাকি তাদের বলডান্স চলাকালীন সময়েই এখান থেকে তার নিজস্ব কাজের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে তা রোজ ঠিক জানেনা।

এসব শুনে আনায়া কিছুটা অবাক হয়। এই মূহুর্তে রেহান আবার কোথায় চলে গেল? সে কিছুটা বিরক্ত হয়েই অনবরত কয়েকবার রেহানকে ফোন করে। কিন্তু প্রতিবারই ফোন সুইচঅফ দেখায়। এতে আনায়া নিত্যন্তই বিস্মিত। কাছেই হাস্যজ্জ্বল মুখে দাড়িয়ে থাকা কেনীথকে যেন, কথাটা বলতে চেয়েও বলল না। এদিকে কেনীথই শেষমেশ তাকে কিছুটা চিন্তিত দেখে তার দিকে আসে।

—“কি রে! এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেনো?”

আনায়া কিছু বলে না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, জায়গাটা কেমন যেন শুনশান লাগছে। সে কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,

❝অরিন কোথায়? জায়গাটা কেমন যেন নিমিষেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছে,তাই না?❞

আনায়ার অভিব্যক্ততে কেনীথের কপাল কুঁচকে যায়। আশেপাশে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে, পুনোরায় তার দিকে তাকায়।

—“তারা! কিছু কি হয়েছে?…অরিন তো রোজের সাথে।”

এরই মাঝে আচমকা আনায়ার ফোন বেজে ওঠে। সে তা চেক করতে গিয়ে দেখে একটা অপরিচিত নাম্বার। আনায়া আরো কিছুটা ঘাবড়ে যায়। কেনীথের দিকে ইতস্তত চাহনিতে তাকাতেই, কেনীথ চোখের ইশারায় আশ্বাস দিয়ে, কলটা রিসিভ করতে বলে। আনায়াও খুব একটা সময় না নিয়ে কলটা রিভিস করে কানে ধরে।

এরমধ্যেই আবার আনায়ার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়৷ কেনীথ আনায়ার দিকে তাকাতেই দেখে, আনায়া অনবরত কাঁপছে।কেনীথের দিকে নিস্তেজ চাহনিতে তাকায়।তার ঠোঁটও কাঁপতে থাকে। কিন্তু কোনো শব্দ বেরোয় না। কেনীথ কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরেই বলে,

❝কি হয়েছে? কে ছিল ফোনে?❞

আনায়া শুরুতে কিছু না বললেও, পরক্ষণেই অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,

❝ইনায়াদের নাকি… এক্সিডেন্ট হয়েছে।❞

আনায়া কথাটা বলতেই ঠোঁট চেপে কেঁদে ওঠে। তার মাথায় কাজ করছে না এসব কি হচ্ছে। এদিকে বিস্ময়ে কেনীথ কি ছেড়ে কি করবে তাই বুঝে উঠতে পারছে না। হঠাৎ একসাথে এতোকিছু… সব সাজানো পরিকল্পনা! কিন্তু কে করছে এসব?

___________

আচমকা বাহিরে এক বিকট আওয়াজে সকলে আকস্মিক চমকে ওঠে। বাড়ির ভেতর হতে কেউই বুঝতে পারেনা, আচমকা একটা কিসের শব্দ হলো। কেনীথ আনায়া একে অপরের দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকায়। আনায়ার শরীর চলছে না। কিন্তু মন বলছে আরো অনেক খারাপ কিছু হতে চলেছে। চোখে মুখে অবাধ ভয়-শূন্যতা গ্রাস করেছে। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে সামলে নেবার।

এবারও কেনীথ একটুও সময় নষ্ট করে না। সে ছুটে চলে যায় বাড়ির বাহিরে। তার পেছন পেছন ছুটে যায় আনায়াও। এরপর আবারও এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। চারপাশে তীব্র ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত। অনেকগুলো গার্ড মাটিতে পড়ে পড়ে রয়েছে। অল্প কয়েকজন কালো পোশাকধারী গার্ডের বেশে লোকজন দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের মুখেই বিশেষ ধরনের মাক্স। এই ধোঁয়ায় তাদের কিছুই হচ্ছে না। তবে কেনীথ-আনায়া সহ বাকিদের কাশতে কাশতে জান যাওয়ার উপক্রম। কেনীথ এই পরিস্থিতি দেখে আনায়ার উদ্দেশ্য বলে,

❝তারা! তারা প্লিজ তুই ভেতরে যা।❞

কেনীথের কথা শোনার মতো পরিস্থিতিতে আনায়া নেই। তার গা ততক্ষণে গুলিয়ে উঠেছে। তবুও যথাসাধ্য চেষ্টায় গাউনের সাহায্য মুখটা চেপে ধরল। এদিকে কেনীথ কয়েকজন গার্ডের উদ্দেশ্যে বলল,

❝এখানে এসব কি হচ্ছে? এগুলো কিসের ধোঁয়া?❞

তবে আশ্চর্যের বিষয়,কেনীথ এতো তীব্র হুংকা”রের পরও আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কেউই কোবো সাড়া দেয় বা। তারা স্থবির, নির্জন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। যেন কোনো অশরীরী ছায়ার অধীনে,মুখে কৃত্রিম ভয়ের মুখোশ পড়ে, চোখে নিরুত্তাপ নির্লিপ্তিতা নিয়ে সেজে রয়েছে।

কেনীথ স্থির হয়ে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার দেখে গার্ডদের দিকে। কেউ এক চুলও নড়ে না। আনায়ার চোখ ততক্ষণে বিস্ফারিত, দম আটকে আসা শ্বাসে আর বিষাক্ত ধোঁয়ায় সে অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে যেন বাতাস হঠাৎ করেই ভারী হয়ে উঠেছে।শব্দহীন, চাপা অসহনীয়তায় তাকে মুড়িয়ে দিয়েছে।

❝এভাবে সব দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। শুনতে পাচ্ছিস না?❞

কেনীথের দৃষ্টি অগ্নিকাণ্ডের ন্যায় জলন্ত। কন্ঠস্বরের হুঙ্কারে যেন দেয়াল কেঁপে ওঠে। তবুও কারো চেহারায় ন্যূনতম উদ্বেগের ছায়া নেই। এই নিরবতা, এই উদাসীনতা যেন কোনো এক অজানা অন্ধকার ভবিষ্যতের পূর্বাভাস হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।

রাতের আকাশে চাঁদের আলো মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দূরে কোথাও অদৃশ্য কুকুরের ডাকে এক বিভীষিকাময় নিস্তব্ধতা চেপে বসছে চেতনার ওপর। আনায়া ফিসফিস করে বিস্ময়ের চাহনিতে একঝলক চারপাশটা দেখার পর, সংশয়ের স্বরে বলে ওঠে,

❝কেনীথ, এরা… এরা সবাই অস্বাভাবিক। এদের চোখ… এদের মুখ, এরা… আমার কোনোকিছুই ঠিক লাগছে না। এদেরকেও না৷❞

কেনীথের ধৈর্য চরমে পৌঁছে যায়। আনায়ার হাত একবার শক্ত করে চেপে, আশ্বস্ত করার পর সে পুনোরায় ক্ষি’প্ত হয়। প্রচন্ড ক্রোধ নিয়ে একপ্রকার তেড়ে গিয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক গার্ডের দিকে। এটাই সেই বক্স নিয়ে আসা গার্ডের মাঝে একজন। একে তখন থেকেই তার গড়বড়ে লাগছে। কেনীথ তার স্যুটের কলার চেপে ধরে, দানবীয় শক্তিতে তাকে প্রায় মাটিতে আছড়ে ফেলতে চেয়েও,সামলে নেয়। যেন সম্পূর্ণ ক্ষো”ভের তীব্রতা একবারেই প্রকাশ পায়। একইসাথে উম্মাদের ন্যায় চেঁচিয়ে বলতে লাগল,

❝তুই বোবা নাকি? তুই কানে শুনতে পাস না? বাবুশকাদের এক্সিডেন্ট হয়েছে,ওখানে লোক পাঠিয়েছিস? এরা সবাই একই বিহেভ কেনো করছে? বল এসব কে করাচ্ছে তোদের দিয়ে? ছাড়ব না আমি, বিশ্বাস কর! একেকটাকে জ্যান্ত মাটিতে গেঁড়ে রাখব।❞

সেই গার্ড একদম স্তব্ধ। ঠোঁট সামান্য কাঁপন, কিন্তু শব্দ করে না। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ…এক বিকট ধাতব শব্দ। যেন অদৃশ্য কারো হাত হতে ছুটে আসা লোহার প্রহার—কেনীথের মাথায় কিছু একটা প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে।এতটাই শক্ত যে মুহূর্তেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়তে নিয়েও, নিজেকে সামলে নেয়। তার শক্ত হাতে ধরা গার্ড মাটিতে পড়ে যায়। কেনীথ চোখে অন্ধকার দেখে পেছনে ফিরতে গিয়ে… দেখা মাত্রই ই স্তব্ধ হয়ে যায়।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাভেল। পরনে পার্টি ড্রেসের আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। নেভী ব্লু কালারে হুডি আর কালো প্যান্ট। খুবই চিরচেনা তার পোশাকাশাক। তবুও যেন সব অচেনা। সবকিছুই নতুন। তার হাস্যজ্বল অভিব্যক্তি কেনীথকে অকল্পনীয় ভাবনার মাঝে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমাগত।

কেনীথের নজর গিয়ে ঠেকে তার হাতের দিকে। একটা শক্তপোক্ত মোটা রড বেয়ে কিঞ্চিৎ এক-দুই ফোটা র*ক্ত নিস্পৃহ ঘাসের উপর পরল। কেনীথ পুনোরায় নজর সরিয়ে পাভেলের দিকে তাকায়। তার চোখজোড়া হতে বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। এদিকে পাভেল যেন কেনীথের অভিব্যক্তিতে নিমিষেই প্রশান্তির হাসিতে মুচকি হেসে ফেলে। ডান হাতের সাহায্যে মাথার ওপর হতে, হুডির টুপিটা একটানে সরিয়ে নেয়। নিমিষেই দৃশ্যমান হয় একঝাক এলোমেলো কোঁকড়ানো চুলের। সে বিস্তৃত মুচকি হেসে কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,

❝হ্যালো ব্রো! ওয়াটস্ আপ!❞

চারপাশে নির্জনতা, কেনীথ আনায়ার চোখেমুখে বিস্ময়ের তীব্র আভাস। যেন সবকিছুই আজ দুঃস্বপ্ন। এরইমাঝে পাভেল আবারও নাটুকে ভঙ্গিতে বলে ওঠে,

❝এত শোরগোল করছো কেন, বিগ ব্রো? তোমার আদেশ এখন আর কেউ শুনবে না। কারণ রাজ্যের মঞ্চে চরিত্রটা যে বদলেছে, ভাই। এবার থেকে খেলাটা আমার।❞

কেনীথের মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু চোখে আগুন জ্বলছে দৃঢ়ভাবে। তার কঠোর দৃষ্টি ঠিকরে পড়ে পাভেলের মুখে।অবিশ্বাস, প্রতারিত হবার যন্ত্রণা, আর ভয়ানক ঝড়ের গর্জন একসাথে ফুটে ওঠে তার চাহনিতে।

এদিকে আনায়া সম্পূর্ণ স্তব্ধ। তার কণ্ঠে কোনো আর্তনাদ নেই।কেবল দৃষ্টিশূন্য স্তব্ধ হৃদপিণ্ডে জমে থাকা ভয় নিয়ে সে দাঁড়িয়ে সে। চারপাশের ধোঁয়া ধীরে ধীরে কমে এলেও, তার ভেতরটা যেন উগ্রে আসছে পাভেলের দিকে তাকিয়ে তার ঠোঁট ফিসফিস করে উঠলেও কোনো শব্দ বের হয় না। সবকিছুই যেন দুঃস্বপ্নের মতো লাগে। কেনীথের কাছে ছুটে যাবার মতোও শক্তি জোগায় না তার।

এদিকে পাভেল তার হাতের লোহার রডটাকে আঙুলে সুনিপুণ দক্ষতার সাহায্য ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত করে, ফিঁচকে হেসে ওঠে। চোখে প্রশস্ততা, অথচ তাতে উন্মত্ততা নেই—বরং তার চোখ দুটি যেন পুরাতন কোনো বিদ্বেষের জমাট অভিশাপে জ্বলে উঠেছে।

কেনীথ জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, দু-পা এগিয়ে যায় পাভেলের দিকে। তার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়ছে র*ক্তের ফোঁটা। তবুও তার দৃষ্টি কঠোর—অপরিবর্তনীয়। সে চিৎকার করে উঠতে পারত, গর্জে উঠতে পারত যেমন করে একদা বীরেরা করে, কিন্তু সে তা করেনি। কারণ পাভেলের চোখজোড়া, তির্যক হাসি কিংবা অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট বুঝে গিয়েছে—এ খেলাটা বহু আগেই শুরু হয়েছিল।

❝তুই… কবে থেকে?❞

কেনীথের কণ্ঠ থেমে থেমে আসে। পাভেল বিস্তৃত মুচকি হেসে কেনীথের দিকে এগিয়ে আসে। কেনীথের দৃঢ় রক্তিম চোখের দিকে চোখ রেখে আবারও রুক্ষ হেসে বলে,

❝তুই যখন থেকে আমাকে ভাই ভাবিস—তখন থেকেই।❞

এই কথাটা যেন হাজার তীক্ষ্ণ ছুরির ন্যায় কেনীথের ভেতর ছুরিকাঘা”ত করে। বুকের মধ্যে গর্জে ওঠে ঘৃ”ণা, আঘাত, আর অন্ধ বিস্ময়ের বিস্ফো”রণ। সে দাঁড়িয়ে রেগে পাভেলের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে।কিন্তু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আরও দু’জন মুখোশধারী গার্ড এসে তার কাঁধে জোরে চাপ দেয়। তার প্রতিরোধ যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়।

—“জা’নো’য়া’র! কি ভেবেছিস, এসব করে বাঁচতে পারবি? তুই ভাবতেও পারছিস না, তোর কপালে কি আছে।❞

কেনীথের কথায় পাভেল তাচ্ছিল্যের সাথে তির্যক হাসে। খানিকটা গা দুলিয়ে বলে ওঠে,

❝রিয়েলি? উফ ব্রো! এই মূহুর্তে তোমার নিজের চিন্তা করার দরকার। তা না করে…তেজ কমে তোমার তাই না?

যাই হোক, বলো তোমার শেষ ইচ্ছে কি? তুমি আমার এতো খেদমত করেছো। ছোট ভাই ভেবে দাসের মতো সম্মোধন করেছো। আমারও তো উচিত, বড় ভাইকে জীবনের শেষ সময়ে স্পেশাল কিছু গিফট দেওয়া। বলো তোমার কি চাই? আজ আমি অনেক খুশি, তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।❞

—❝কেনো করছিস এসব? কি চাই তোর?কে কে আছে তোর সাথে? কবে থেকে এই খেলা শুরু করেছিস? ❞

❝আরেহ!আরেহ! একসাথে এতো প্রশ্ন? কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দেই বলোতো?”

—❝পাভেল, আমার মেজাজ… ❞

কেনীথের কথা শেষ হবার পূর্বেই, পাভেল পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে থুথু ফেলে বলে ওঠে,

❝তোর মেজাজে আমি থুথু ফেলি। কি ভেবেছিস? সারাজীবন আমি তোর দাস হয়ে থাকব? এই, সব কিছুতে তোর মতো আমারও অধিকার ছিল, তবে আমি কেনো শুধু শুধু তোর দাস… ❞

কেনীথ পাভেলের ব্যবহারে আশ্চর্য। চোখ মুখ রাগের রক্তিম আভায় ঢেকে গিয়েছে। সে তীব্র কঠিন স্বরে বলে উঠল,

❝বা*স্টা*র্ড! এতো বড় স্পর্ধা হয় কি করে তোর? ভেবেছিস এসব করে তুই ছাড় পেয়ে যাবি? বিশ্বাস কর, তোকে আমি জ্যান্ত অবস্থাতেই কুকুর দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়াব।❞

কেনীথ একইসাথে তার সাথে আশেপাশের লোকজনদের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখার পর বলল,

❝তোদের সবাইকে আমি জ্যান্ত, মাটিতে গাঁড়ব।বিশ্বাসঘাতকতার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাবি তোরা।❞

কেনীথের হুঙ্কারে পাভেল গা দুলিয়ে হেসে ফেলল।

—❝উফ ব্রো! এই অবস্থাতেও তোমার এতো তেজ? এসব আসলে তোমাকে দিয়েই সম্ভব।❞

এরইমাঝে আনায়া এবার অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,

❝পাভেল ভাই, আমার বোন কোথায়? বাবুশকা কোথায়? ওরা তো আপনার সাথে ছিল তাই না? বাবুশকাকে আনার জন্য তো আপনার সাথে ইরাও ছিল? ওরা কোথায়? কি করেছেন আপনি ওদের সাথে?❞

আনায়ার কথা শুনে পাভেল বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে,

❝তাদের গন্তব্য যেখানে, তারা এখন সেখানে।❞

—❝মানে?❞

আনায়ার ঘাবড়ানো কন্ঠস্বরে পাভেল আবারও মুচকি হেসে বলে,

❝এতোক্ষণে তো ম”রে যাবার কথা। চিন্তা নেই, খোঁজ খবর নিয়ে আমি আপনাকে সঠিক আপডেটটা দিয়ে দেব,মাই ক্রিমসুইট ভাবি।❞

এই বলতে না বলতেই, সে গার্ডদের চোখের ইশারায় কোনোকিছুর ইঙ্গিত দেয়। এবং তৎক্ষনাৎ গার্ডগুলো আনায়াকে ধরতে আসে। আনায়া ঘাবড়ে গেলে, কেনীথ আরো ক্ষিপ্ত হয়। এতোক্ষণ পাভেলের হেলাফেলা কথাবার্তা সহ্য হলেও,এখন সবকিছুকে ধ্বং”স করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কেনীথের উগ্রতায় আরো তিন-থেকে চারজন গার্ড এসে তাকে শক্তভাবে চেপে ধরলো। কেনীথ চোয়াল শক্ত করে, হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,

❝পাভেলললল!❞

কেনীথের কথায় পাভেল খানিকটা মৃদু হেসে বলে,

❝নট যাস্ট পাভেল! আ’ম সের্গেই পাভেল হান্স অর এস.পি.হান্স—দ্য সিইও অব হান্স কাম্পানি।❞

—–

এই গল্পের সূচনা হয় বহু বছর পূর্বে। লুসিয়ার প্রথম কিংবা প্রাক্তন স্বামী — সের্গেই পেত্রিন হান্স। যার নামের সংক্ষিপ্ততেই মূলত এস.পি.হান্স নামক ভয়ং”কর এক কোম্পানির উৎপত্তি হয়েছিল৷ শুরুটা ভালোর উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠলেও, কালের ক্রমান্বয়ে তা ধীরে ধীরে ভয়ান’ক অধিপত্যে রূপান্তরিত হয়। যার শুরুটা করে লুসিয়াস ছেলে নিকোলাই হান্স। আর শেষটা এখন হান্স কোম্পানির বর্তমান ও একমাত্র মালিক এস.পি.হান্স কিংবা সের্গেই পাভেল হান্সের কাছে।

ব্যাপারটা বিস্ময়ের হতে পারে। কিন্তু সত্য তো এটাই যে, সারাজীবন কেনীথের ছোট ভাই সরূপ পাভেলই মূলত—কেনীথের নানী লুসিয়ার বড় ছেলে নিকোলাই হান্সের একমাত্র ছেলে।

তখন পেত্রিন হান্স মা’রা গিয়েছে। ছেলে নিকোলাই নিজের মতো করে জীবন গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। তবুও যেন সে তীব্র ছন্নছাড়া অগোছালো জীবনে জর্জরিত। যে ছেলের মা থেকেও নেই, সে আর কি-ই বা নিজেকে গুছিয়ে নেবে। এরইমাঝে তার জীবনেও সঙ্গী হয়ে এক সাধারণ ঘরের সুন্দরী রমণী। অল্পদিনের পরিচয় ও ভালোবাসা তাদের জীবনের গতিবিধিই যেন একদম বদলে যায়। খুব বেশি সময় নেয় না নিকোলাই।নিজেকে গুছিয়ে নিতে, সেই সুন্দরী নারীকেই বিয়ে করে এক সুন্দর জীবন গড়ার চেষ্টা করে। একবছর হতে না হতেই, তাদের জীবন আলো করে এক ফুটফুটে ছেলে সন্তানের আগমন হয়। বাচ্চা ছেলেটির কোঁকড়ানো চুলগুলো ছিল নিকোলাইের বাবা পেত্রিনের মতো। অবশ্য সে তার নিজের ছেলের মাঝে, সম্পূর্ণ ভাবে তার বাবাকেই দেখতে পেতো।

নিকোলাই বরাবরই তার বাবাকে প্রচন্ড ভালোবেসে এসেছে। আর সে কারনেই হয়তো বাবার নামের সাথে নাম মিলিয়ে, একমাত্র ছেলের নাম রাখে এস.পি.হান্স (S.P. Hans) কিংবা ❝সের্গেই পাভেল হান্স❞।

তবে তার জীবনটাও খুব বেশি সুখকর হয়না। অল্পদিনের মাঝেই এক কঠিন অসুখে সে তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলে। এদিকে ছেলেও তার একদম ছোট। অথচ সে তখন মানসিক ভাবে আরো বিধ”স্ত। চারপাশের কোনো কিছুই যেন মেনে নিতে পারছে না।

পাভেলের তখন সবেমাত্র বুঝ হতে শুরু করেছে। হাসিখুশি থাকা বাচ্চাটার আচমকা মা ম’রার শোক যতটা না গভীর ছিল, তার চেয়েও বেশি কঠিন ছিল নিজের মানসিক ভাবে অসুস্থ বাবার কাছে সেই অল্পবয়সেই নানান টর্চারের সম্মুখীন হওয়া। শুরুতে পাভেল প্রচন্ড কান্নাকাটি করতো,নিজের বাবার অদ্ভুত বিহেভিয়ারকেই ভয় পেতে শুরু করে। তার বাবার উল্টোপাল্টা আদেশক্রম কিংবা অত্যাচার সবকিছুই অল্প বয়স হতে সহ্য করতে থাকে। তবে সে এটাও বুঝতে পারে যে, তার বাবা তাকেই হয়তো নিজের এক্সপেরিমেন্টের বিষয়বস্তু ভাবছে। এবং খুব শীঘ্রই তাকে শেষ করেও ফেলবে। কিন্তু তার সেই অল্প বয়সে করার মতো কিছুই ছিলনা। তার আত্নীয় স্বজন বলতে পৃথিবীতে রয়েছে কিনা তাও তার অজানা।

এভাবে আরো কয়েকটা বছর পেরিয়ে যায়। পাভেলের যখন প্রায় ছয়-সাত বছর — নিজের বাবার সকল ভয়ানক পাগলামির সাথে সে অভ্যস্ত…তখন প্রথমবারের মতো লুসিয়ার সাথে তার দেখা হয়। যদিও তখন সে জানত না,কে এই নারী। তবে তার বাবার কাছ হতে একপ্রকার জোর করেই তাকে সে নারীটি নিজের সাথে করে রাশিয়ায় নিয়ে আসে। অথচ তার বলা কিংবা বোঝার কিছুই নেই। একদিকে নিজের বাবার অত্যচার আর পাগলামির কার্যক্রম হতে মুক্তি পেয়ে যেমন আনন্দ হচ্ছিল, তেমনি লুসিয়া ও তার জগতের প্রতি বেড়ে চলেছিল তার নানান আগ্রহ।

আর শুরুতেই তাকে তার বড় ভাই হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় কেনীথের সাথে। তাকে বলা হয়, শুধুমাত্র কেনীথের জন্যই তাকে সেই জার্মান হতে এই রাশিয়ায় নিয়ে আসা হয়েছে। যথারীতি তাকে যা যা বলা হয়, সে তা-ই বিশ্বাস করে। কেনীথকে শুরুতে কিছুটা অদ্ভুত লাগলেও, একটা সময় পাভেল তার জন্য পাগল হয়ে যায়। যত যাই হোক না কেনো, সে ভুলেও কেনীথের সঙ্গ ছাড়ে না। ওদিকে রোজ নামের একটা বোন পেয়ে সে-ও প্রচন্ড খুশি।

তবে আরো কয়েকটা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই, আবারও সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়৷ বহুবছর পর নিকোলাই একদিন তার সাথে দেখা করতে আসে। শুরুতে পাভেল তার বাবার সাথে দেখা করতে রাজি না হলেও,শেষমেষ সাক্ষাৎ করতে গিয়ে যখন বাবার আবেগঘন রূপ দেখে—তখন নিমিষেই যেন সে সবকিছু ভুলে যায়। আর এই ফাঁকেই শেষবারের মতো নিকোলাই কিছু বিষবাষ্পে ন্যায় কথাকে তার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়। প্রথম বারের মতো পাভেল তার নিজস্ব অস্তিত্বকে খুঁজতে শুরু করে।

তার যেন বিশ্বাসই হয় না, এই লুসিয়া তার নিজের দাদি। নিজের সম্পূর্ণ পরিচয়টাই যেন তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগতে শুরু করে। একইসাথে মনের মধ্যে তখন হতে গড়তে শুরু করে নানান হিসেব-নিকেশ। এতোদিন সবাইকে ভালো লাগলেও তখন তার সবার প্রতিই এক সুক্ষ্ম ক্ষোভ জমতে শুরু করে।

ওদিকে কেনীথ তখন নিজেই মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। নিজ চোখে বাবা মায়ের নৃশংস মৃত্যুতে তার সবকিছুই এলেমেলো। আচরণে অদ্ভুত গাম্ভীর্য,রাগ, ক্ষোভের ছাপ। যথারীতি কাউকে মন হতে পছন্দ থাকলেও,তার বহিঃপ্রকাশ করতে সে নারাজ। যেমনটা হয় পাভেলের ক্ষেত্রে। দুজনেই তখন উঠতি বয়সের ছেলেপেলে। দুজনেই নিজেদের নানান চিন্তাভাবনায় মগ্ন। কেনীথ তখন অল্পতেই রেগে যায়। পাভেলকে নিজের ছোট ভাই হিসেবে মানলেও, ব্যবহারের রুক্ষতায় বরাবরই পাভেল প্রচন্ড বিরক্ত। একইসাথে তার চিন্তা ভাবনাও পরিবর্তন হতে থাকে। নিজেই নিজের হিসেব কষতে শুরু করে।

লুসিয়া তার দাদি হয়। লুসিয়ার সবচেয়ে বড় ছেলের একমাত্র ছেলে সে। ওদিকে কেনীথ তার মেয়ের ঘরে ছেলে। সম্পর্কে কেনীথের নানী। অথচ লুসিয়া সহ এখানের সবাই কেনীথকে বেশি আদর করে। সবাই সবসময় তার দেখভাল করে। যেন কোনো রাজ্যের মহারাজা। অথচ তার সাথে সকলের ব্যবহার এক দাসের মতো। লুসিয়া তার নিজের দাদি হবার পরও তাকে কিভাবে অন্য নাতীর জন্য দাস বানিয়ে নিয়ে আসে?

একে তে বাড়ন্ত বয়স, ওদিকে আবার বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার নানান কুপরামর্শ। লুসিয়ার নিষেধ থাকা স্বত্বেও পাভেল তার বাবার সাথে লুকিয়ে দেখা সাক্ষাৎ করত। কারণ সে লুসিয়া তাকে রাশিয়াতে নিয়েই এসেছিল, তার বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার হাত থেকে বাঁচাতে। সে-ও তাকে নিজের নাতী কেনীথের মতোই ভালোবাসতো, কিন্তু আর্তেমের জন্য কোথাও না কোথাও গিয়ে এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা তেমন হতো। কেননা আর্তেমকে লুসিয়া, পাভেলের পরিচয় সম্পর্কে কিছুই জানায়নি। এবং নিকোলাইয়ের যে ঘরে ছেলে সন্তান হিসেবে পাভেল এসেছে, তাও সে জেনেছি পাভেলের জন্মের কয়েকবছর পর। কিন্তু তার এতো কিছুর পরও, সে কারোরই মন রাখতে পারেনি।

যে বাবা তার কাছে ছিল সবচেয়ে ঘৃণিত, তখন তার কাছে সে-ই প্রিয় হতে শুরু করে। একইসাথে তার সুস্থ মস্তিষ্কও তখন ধীরে ধীরে বিকৃত হতে শুরু করে। তবে তা ধীরে ধীরে,এক ঠান্ডা মাথার কৌশলী বিকৃত মস্তিষ্ক হিসেবে।

এভাবেই এক বিশ্বাসঘাতকের জীবন বেড়ে চলে।সবার মাঝে আজীবন স্বাভাবিক ভালোমানুষির বেশে সেজে থাকা পাভেল, আদতে কত বড় কলাকৌশলের পরিকল্পনা সাজাচ্ছিল, তা কেউই কখনো বুঝতে।

বছরের পর বছর যায়, কেনীথ-পাভেল একই সাথে বড় হতে শুরু করে। কেনীথের দুনিয়া যখন নানান পাপ কর্মের মাঝে আদ্যেপান্তে মিশে গিয়েছে, তখন সেসবের চেয়ে কোনো অংশে পাভেলের পাপের ভাগটাও কম নয়। বরং তা আর সবার চেয়ে বহু গুণে বেশি৷

সে যেমন একইসাথে কেনীথের হয়ে কাজ করত। তেমনি নিজ স্বার্থে তার বাপ-দাদার কোম্পানি তথা এস.পি.হান্স-এ নিজের বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন বাবার পরিকল্পনা অনুযায়ী সে কাজ করতে শুরু করে। দিনে দিনে তার পরিকল্পনা হয়ে ওঠে, তার বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার চেয়েও ভয়নাক।

ছোট বেলায় মা-হারা ছেলে তার, নিজের বাবার এক্সপেরিমেন্ট উপকরণ হিসেবে যা যা টর্চার সহ্য করেছে,তাতে সে বাচ্চা প্রতি এমনিতেই এক সুক্ষ্ম ক্ষোভকে নিজ অন্তরালে পুষতে শুরু করেছে। অতঃপর বাবার মতো, তারও পরিকল্পনা মোতাবেক তাদের কোম্পানি চালানোর মূল উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় নবজাতক বাচ্চাদের।

তাদের পরিকল্পনা ছিল সাজানো গোছানো। পাভেল তার বাবার সাথে মিলেই সবসময় কোম্পানি বিষয়ক নানান আলোচনা করে ডিসিশন নিতো। তবে কিছু হুটহাট সিদ্ধান্ত গুলো কখনো কখনো অপরিপক্ক হতো। যার ফলস্বরূপ নানান সময়ে অনেক মানুষের জীবনও পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

এই যেমন,পাভেলের একদম শুরু থেকেই নজর পড়েছিল আর্তেমের এতো বড় সাম্রাজ্যের উপর। বিশেষ করে যখন, আর্তেম অসুস্থতায় মারা যায় আর লুসিয়া সবকিছুর দেখভাল করতে শুরু করে। তবে এই আর্তেমের মৃত্যুর পেছনে আরো এক ঘটনা রয়েছে। সবার জানামতে এটি শুধু বার্ধক্যজনিত রোগের কারণে মৃত্যু হলেও,তা পুরোপুরি সত্য নয়। আর্তেমের অসুস্থতার খবর শুনে, নিকোলাই নানান বিষক্রিয়া জাতীত মেডিসিন—যা সহজেই প্রযুক্তি কিংবা উপসর্গের মাধ্যমে নির্নয়যোগ্য নয়—তা পাভেলের মাধ্যমে কৌশলে আর্তেমকে দেওয়া হতো। যার ফলে সে সময়ের তুলনায়, খানিকটা দ্রুতই পৃথিবীর মোহ ত্যাগ করেন।

আর্তেমের প্রতি এক সুক্ষ্ম ক্ষোভ হতেই মূলত নিকোলাই এর এই পদক্ষেপ। পাশাপাশি আর্মেতের কাছ থেকে সবসময় এক দাসের মতো সম্মোধন পেয়ে, পাভেলও প্রচন্ড অপছন্দ করত আর্তেমকে। যে কারণে প্রথম পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা তাদের পথের কাটাকে সরিয়ে দেয়।

এছাড়া তারা ভেবেছিল, লুসিয়া এসবের অংশীদার হিসেবে হয়তো তার ভাগের পুরো অংশটাই নিকোলাই কিংবা পাভেল পাবে। পাভেলের অল্প বয়সী মনের মাঝে এমন আশাকে সর্বপ্রথম তার বাবাই জাগ্রত করে। দুজনে মিলে নানান সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

কিন্তু একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন পাভেল আর্তেমের সকল প্রোপার্টির ডকুমেন্টস নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করে, তখন সে জানতে পারে আর্তেম তার সকল প্রোপার্টি-পাওয়ার কেনীথকে দিয়ে গিয়েছে— একইসাথে এক বিশেষ পদ্ধতিতে। যার ফলে কেনীথকে মে’রে কিংবা জোর জবরদস্তি করেও এই সম্পত্তি, ক্ষমতা তারা সেই মূহুর্তে পাবে না।

এর পরেই শুরু হয়, বাবা-ছেলের ধ্বং”সাত্মক খেলা। কোম্পানি হোক কিংবা প্রোপার্টি, সবকিছুই তারা নিজেদের করে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে৷ আবারও তারা নতুন পরিকল্পনা সাজায়৷ কেনীথের বন্ধু কিংবা ভাই রূপে সে সর্বদা তার পাশে থাকে—তেমনি পরিকল্পনা মোতাবেক তার বাবা জার্মানিতে থেকে কোম্পানির শাখা প্রশাখাকে বিস্তৃত করার কাজে লেগে থাকে৷ অবশ্য পাভেল দূরে দূরে থেকেও সবসময় দু-দিকটাই সামলে নিতো।

এদিকে আর্তেম মৃত্যুর পূর্বেই হয়তো বিশেষ কিছু টের পেয়েছিল। লুসিয়ার ব্যক্তিগত পুরোনো ঘটনাগুলো সবসময় গোপন করার জন্য, সে তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারত না৷ যথারীতি ছেলের ঘরে এক মেয়ে সন্তান—রোজ,আর মেয়ের ঘরে একমাত্র ছেলে কেনীথ ব্যতীত সে আর কাউকেই নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে পায়নি। আর এতে সবচেয়ে বেশি যোগ্য মনে হয়েছে কেনীথকে।

তাই সে তার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী তার পুরো প্রোপার্টিস,অ্যাসেটস, পাওয়ার, এভ্রিথিং কেনীথের নামে করে দেয়।এবং সেটা পস্টহিউমাস ট্রান্সফার অব ওউনারশিপ এগ্রিমেন্টে।যার ফলে কেনীথ তৎক্ষনাৎ সবকিছুর মালিক হতে পারেনা। কেননা তিনি তার এগ্রিমেন্টে নিদিষ্ট করে সময়টাও উল্লেখ করে গিয়েছেন। আর্তেম দিমিত্রির সত্তর বছর কিংবা কেনীথের এই জন্মদিনেই মূলত সে সকল প্রোপার্টির মালিকানাধীন হবে। কিন্তু তার পূর্বে যদি কেনীথের কোনো ক্ষতি হয় কিংবা মারা যায়। সেক্ষেত্রে এ সকল সম্পত্তি কেউই কখনোই নিজের করে নিতে পারবে না এবং আর্তেমের সাম্রাজ্য পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।

কিন্তু এসব নিজের নামে করার একটি মাত্র উপায় হলো, আজকের জন্মদিনে কেনীথ সবকিছুর প্রকৃত মালিকানার অধিকার পাওয়ার পর—যদি সে কাউকে তার নিজের সবকিছু অন্য কারো নামে স্বইচ্ছায় লিখে দেয়, তবেই তা কেনীথ ব্যতীত অন্য কেউ ভোগ করতে পারবে।

আর এই সুযোগটার জন্যই এত বছর ধরে, ঠান্ডা মাথায় অপেক্ষা করছিল পাভেল হান্স এবং তার বাবা নিকোলাই হান্স।

আর আর্তেমও জানতো যে, লুসিয়ার ছেলে নিকোলাইের কোনো ছেলে সন্তান রয়েছে। আর তার বিশেষ খেদমত করছে লুসিয়া নিজে। অথচ সেই ছেলেই যে, তার নাতী কেনীথের ছোট ভাই রূপে থাকা পাভেল—সে তা লুসিয়ার বুদ্ধিমত্তার কারণে একবারও বুঝতে পারেনি।

আর লুসিয়ার চিন্তাভাবনা ছিল বরাবরই স্বাভাবিক। সে দুজন নাতীকেই সমান ভালোবাসতো বিধায়,দুজনকেই নিজের কাছে রাখত সর্বদা। অথচ সে-ও শুরুতে বুঝতে পারেনি, জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সে পাভেলকে তাদের কাছে এনেই করে ফেলেছে। বিশেষ করে যে কেনীথের জন্য পাভেলকে ছোট ভাই রূপে এনেছিল, সেই পাভেলই কেনীথকে শেষ করার জন্য,আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে থাকে৷

পাভেল ও তার বাবার পরিকল্পনা মোতাবেক, সবকিছু ভালই চলছিল। তবে পাভেল নিতান্তই ঠান্ডা মস্তিষ্কের ব্যক্তি হলেও, তার বাবা ছিল সর্বদা উগ্র স্বভাবের। যে কারণে সে সবাইকে শেষ করে দিতে পারলেই, ভাবতো তার সকল পরীক্ষা কল্পনা সফল হবে।

এই দ্বিমতের জন্য একটা সময় পর হতে, পাভেল এবং তার বাবার মাঝে এক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। পাভেল চেয়েছিল তার পরিকল্পনার সাহায্যে সবকিছু ধীরে ধীরে নিজের আয়ত্তে আনবে। কিন্তু তার বাবা উগ্র হয়ে উঠেছিল। সে সবকিছু জানার পরেও বারবার চাইছিল, কেনীথকে অতি দ্রুত সরিয়ে দিয়ে যেন, সবকিছু তাদের আয়ত্তে নেওয়া যায়। কিন্তু পাভেল খুব ভালো করে জানত, এমনটা হলে আর্তেমের পাওয়ার প্রপার্টির একাংশ তারা ভোগ করতে পারবেনা। বরং চোখের সামনে সবকিছু ধ্বং”স হতে দেখতে হবে।

যে কারণে বাবা ছেলে দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়৷ নিকোলাই বিভিন্ন সময় নানান ভাবে, কেনীথকে মারার জন্য লোক পাঠাতো, বিভিন্ন ভয়ানক এক্সিডেন্ট ঘটানোর চেষ্টা করত। কিন্তু প্রতিবারই পাভেল আপন ভাইয়ের ন্যায় কেনীথকে নিকোলাইয়ের সকল পরিকল্পনা হতে জানে বাঁচিয়ে। অথচ তার সরলতা অভিব্যক্তি এমনই ছিল যে, না কখনো কেনীথ কিছু তার সম্মন্ধে টের পেয়েছে,আর না টের পেয়েছে বাকিগণ। যারা যারা তাদের দুজনকে চিনতো, সকলেই তাদের দুজনকে আপন ভাই-ই ভাবতো। অথচ সাদাসিধা মুখোশের আড়ালে কত ভয়ংকর পরিকল্পনা সাজিয়ে রেখেছিল পাভেল—তা কেউই কখনো টের পায়নি।

আনায়ার এক্সিডেন্ট এর পর সাত বছর কেনীথের নজর হতে গায়েব থাকার, পরিকল্পনায় সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে পাভেল। আনায়াকে সরানোর পরিকল্পনা তার বহু আগে থেকেই ছিল। সে সব সময় চাইত, কেনীথ একা থাকুক। সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করুক। তার বিপদে আপদে সে ব্যতীত যেন অন্য কেউ পাশে না থাকে। কিন্তু যখনই জানতে পারল কেনীথ আনায়াকে পেয়েছে এবং নিজের করে চাইছে—তখনই যেন তার মস্তিষ্কের পরিকল্পনার কার্যক্রমে তীব্র বিঘ্ন ঘটে।

যদি কোনো তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সঙ্গী এসে কেনীথের জীবনকে পুরোপুরি পাল্টে দেয়, কেনীথের জীবন যদি আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন তো তার কোনো পরিকল্পনাই আর কার্যকর হবে না । এতদিনের অপেক্ষা, এত দিনের প্রচেষ্টা, সবকিছু ভেস্তে যাবে।

যে কারণেই মূলত সে আনায়াকে শুরু হতেই অপছন্দ করতো। কিন্তু আনা সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজখবর নেয়ার পর, সে বুঝতে পারে এই মেয়ে তার খুব বেশি একটা ক্ষতি করবে না। তবুও সে যথাসাধ্য সতর্ক থাকে। কেনীথের চিন্তাভাবনাকে আরো বিগড়ে দিয়ে, আনায়াকে আনায়কের সম্পূর্ণ মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তোলে। যেন কখনোই সে তার পথে, কোনো নতুন কাটা হয়ে না দাঁড়ায়।

কিন্তু একটা না একটা সংশয় তার মনের মধ্যে ছিলই। পাভেল কিংবা তার বাবার পরিকল্পনা কখনো সুস্পষ্ট ছিল না। তাদের বিকৃত মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনায় সব সময় এক সংশয় ঘুরপাক খেতো। যে কারণে তারা,চেয়েও কখনো স্থির থাকতে পারতো না।

যথারীতি কেনীথের প্রথম পদক্ষেপ সরূপ,আনায়াকে তার পুরনো বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর—পাভেলও তার পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন আনে। ইনায়াকে যখন কেনীথ একটি সুরক্ষিত আশ্রমে রাখার চিন্তা ভাবনা করে, তখন তারও সুযোগ হাতছাড়া করে না পাভেল।

ইনায়ার সম্পূর্ন দায়িত্ব ছিল পাভেলের উপরে। এমনকি কেনীথের সব কিছুর দায়িত্বই ছিল পাভেলের উপর। যে কারণে সে তার সকল কাজ, খুব ভালো ভাবেই করে ফেলতে পারতো। এখানেও সে তার অপরিপক্ক পরিকল্পনা মোতাবেক, কেনীথের অগোচরে একটি কাজ করে ফেলে।

ইনায়াকে আশ্রম থেকে গায়েব মূলত পাভেলই করেছিল। তার মস্তিষ্কে নিদিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আনায়াকে কিছু করার আগে, সে তার পরিবারকে শেষ করতে চেয়েছিল। যেন পরবর্তীতে সব দোষে কেনীথকে দোষী সাবস্ত করে হলেও, আনায়ার নজরে যেন কেনীথ সবসময় খাবারই থাকে। তাদের দু’জনের সম্পর্কের মিল যেন কখনোই না হয়।

এছাড়া ইনায়াকে সে তার নিজস্ব আরেকটি কাজে লাগিয়ে ফেলে। তাদের কোম্পানির বাংলাদেশী শাখায় বিশ্বস্ত ও কার্যকর মানুষের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেভাবে তারা কাউকে কাজে লাগাতে পারছিল না। তখন তারা ইনায়াকেই নিজেদের হাতিয়ার বানায়।
তাকে আশ্রম থেকে সরিয়ে নিজেদের আস্তানায় নেওয়ার পর—তার ওপর শুরু হয় নানান শারীরিক ও মানসিক নি”র্যাতন। অত্যাধিক পরিমানে ড্রাগস দেওয়া কিংবা অমানবিক মা”রধর— কোন কিছুই বাদ থাকেনা।

ইনারার মতো তেজী স্বভাবের মেয়ে, সহজেই যে কারো কাছে হার মানবে না, এটাই স্বাভাবিক। সেও যথারীতি,নিজের সর্বোচ্চ জেদ খাটাতে শুরু করে। তাতে পাভেলসহ সকল কর্মী তার প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়। একই সাথে তার ওপর নির্ম”ম, অত্যাচারও বাড়িয়ে দেয়। ইনায়া ঠিকমতো খাবার খেতে না চাওয়ায়, একটা সময় পর হতে তাকে খাবার দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়। অল্প পরিমাণে খাবারের সাথে, অত্যাধিক পরিমাণে ড্রাগ*স্—তাকে জোর করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো বা ইনজেকশন এর মাধ্যমেও, নানান নেশাদ্রব্য তাকে দেওয়া হতো। এভাবে অনেকটা সময় যাওয়ার পর, ইনায়াও ধীরে ধীরে অত্যন্ত মানসিক ভাবে বিকৃত মস্তিষ্কের হতে শুরু করে।

একই সাথে, পাভেল ইনায়াকে তার প্ল্যানের অপশন বি বানানোরও চিন্তাভাবনা করে। যেনো কোনো এক সময় তার প্রয়োজনে, ইনায়া-ই কেনীথের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। যার ফলে সে ইনায়ার মন-মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলার জন্য, কেনীথের সম্পর্কে নানান কটুকথা সহ, ইনিয়েবিনিয়ে তার জীবন,পরিবার ধ্বংসের সবকিছুর জন্য কেনীথকে দায়ী করে। আর এদিকে ইনায়া ততদিনে তাদের হাতের পুতুল। তারা যেভাবে চাইছে, ইনায়া সেভাবেই চলছে।

অবশ্য এইসকল ঘটনায় পাভেল বরাবরের মতোই এক ক্লিন ইমেজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে পুরো গেইমটা খেলে গিয়েছে। ইনায়ার সামনেও কখনো স্ব-সম্মুখে সাক্ষাৎ করেনি সে। তার সকল কাজ সে, তার লোকজন দিয়েই সবসময় করিয়েছে।

এদিকে প্রায় আরো কয়েকটা বছর যাবার পর যখন ইনায়া নিজেই এক যান্ত্রিক পুতুলের মতো সবকিছু করতে শুরু করেছে। ততদিনে পাভেলের পরিকল্পনা হতে ইনায়া হয়ে যায় এক ঐচ্ছিক বিষয়বস্তু। তার দিক হতে পাভেলের ধ্যান প্রায় সরে গিয়েছে। সে ব্যস্ত কোম্পানি সামলাতে। একইসাথে আনায়ার মৃত্যুতে বিধ্বস্ত হওয়া কেনীথের পাশে থেকে তাকেও একপ্রকার নিজের হাতের পুতুল তৈরির প্রচেষ্টায়।

আর এই সময়ের মাঝেই ইনায়া নিজেই এক ঠান্ডা মস্তিষ্কের সাইকোপ্যাথ সরূপ দানবে পরিণত হয়। তার যখন যা ইচ্ছে তাই করতে থাকে। রোহান বয়সে তার খুব বেশি একটা বড় ছিল না। তবে তাদের অল্প দিনের সাক্ষাৎ এ, রোহান আর ইনায়ার মাঝে একটা ভালো বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর ইনায়া তখন তার বিকৃত মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা অনুযায়ী, রোহানকে নিজের সাথে রাখার সিন্ধান্ত নেয়। তবে তার এই পদক্ষেপেও পাভেলের আদেশ বাঁধা সাধে। পাভেল এবার রোহানকেও নিজের কাজে লাগাতে চায়। কোনো প্রয়োজন ব্যতীতই তাকে ইনায়ার আদেশ ক্রমে, একদিন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ করে রোহানকে তুলে নিয়ে আসা হলেও — পাভেলের নির্দেশে পরবর্তীতে তার উপরও চলে ইনায়ার চেয়েও ভয়ংকর সব নির্মম অত্যাচারের পাশাপাশি কিছু সাইকোলজিক্যাল ও ফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট।

মূল কথা, পাভেল ও তার বাবা তাদের আশেপাশে অহেতুক যাকে পেয়েছে তাকেই নিজেদের খেলার বলি বানিয়েছে। এইসময় অবশ্য ইনায়ার কিছুই করার থাকেনা। সে যেহেতু বাংলাদেশের হান্সদের শাখার প্রধান পরিচালক অলিভারের সাথে কাজ করে,এক প্রয়োজনীয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে—তাই ইনায়া তখনও পাভেলের প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু রোহানের সাথে কিছু করতে গেলে—ইনায়া বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে বিধায়…সে তাকেই কিছুদিনের জন্য সম্পূর্ণ সেন্সলেস করে বদ্ধ ঘরে আঁটকে রাখে। কখনো অত্যধিক ড্রাগস্ কিংবা কখনো সেন্সলেস করার ইনজেকশন—প্রযোজন ভেদে যখন যা করা যায়, তাই করা হয়েছে।

এদিকে রোহানের উপর করা নিকোলাই এর সকল এক্সপেরিমেন্টই বৃথা যায়। নানান ইলেকট্রিক শক্, নিত্যনতুন মেডিসিন সহ নানান জিনিসে প্রযোগে সে শেষমেশ এক অকেজো পন্যের ন্যায় তাদের কাছে বিবেচিত হয়। রোহানের মস্তিষ্ক ততদিনে আর সবার মতোই বিকৃত। কিন্তু তাকে এমনি এমনি ফেলে দিলে তো আর হয় না। তাই পাভেল, রোহানকেও কোনো একটা কাজে লাগানোর পায়তারা করে। ফলাফল সরূপ, রোহানকে বানায় নরখাদক।

দিনের পর দিন বদ্ধ ঘরে আঁটকে রাখার পরও তাকে না খেতে দেওয়া সহ, নানান শারিরীক টর্চার করা হতো। একে তো বিকৃত মস্তিষ্ক, তার মাঝে না খেয়ে দেয় ফর্সা সুগঠনের ছেলেটা ততদিনে রোগা-সোগা কঙ্কালসারে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তাতেও যেন সেই পিশাচদের মন ভরে না। অত্যধিক মারের ফলে সৃষ্ট ক্ষততে,সময়ের সাথে সাথে ঘা-পুঁচ হয়ে একটা সময় সমস্ত শরীর পঁচে যেতে শুরু করে। একইসাথে বহুদিন অনাহারে থাকার পর তাকে খেতে দেওয়া হতো পরিত্যক্ত, অকা”র্য কিংবা মৃ”ত বাচ্চাদের না”রী ভুঁ”ড়ি কিংবা কচি মাং”সের ছোট্ট ছোট্ট দেহ।

শুরুতে ইনায়ার বিকৃত মস্তিষ্কেও ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগত। সে যেন এসব সহজেই মেনে নিতে পারত না। প্রচন্ড অস্থিরতা কাজ করতো নিজের মাঝে। তবে এটার সলিউশন হিসেবেও অলিভার তার নিজের দায়িত্ব পালন করে। যখনই ইনায়া তার কাজ ব্যতীত, অস্থির কিংবা উগ্র হয়ে উঠতো—তখনই তাকে কঢ়া ডোজের ড্রাগস্ দেওয়া হতো। ফলাফল সরূপ, আবারও ইনায়া তাদের হাতের পুতুল।

তবে ইনায়ার মনে কেনীথকে নিয়ে শুরুতে বিরূপ ধারণা ঢুকিয়ে দেওয়ার পর যেন, পাভেল এতে নিজেই ফেঁসে যায়। তার বাবা নিকোলাই এর মতো, ইনায়াও সবসময় চাইত কেনীথের ভয়ং”কর মৃত্যু হোক। এদিকে পাভেল একহাতে এতোকিছু সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে, ওদিকে ইনায়া নিজেই উগ্র হয়ে বারবার কেনীথকে মারার জন্য তাদেরই লোকচক্ষুর ফাঁকে নানান পরিকল্পনা চালাচ্ছে। শতবার চেষ্টা করেও যেন, পাভেলের আদেশক্রমে—অলিভার তাকে দমাতে পারছে না।

তবে সবকিছুর শেষেও, বরাবরের মতো পাভেল কেনীথের কাছে একজন ভালোমানুষ হয়েই থেকে যায়। আনায়ার বাবার মৃত্যুর ফুটেজ ইনায়াকে দেওয়া, কিংবা ইনায়াকে আশ্রম থেকে সরানোর পাশাপাশি আনায়াকে রাশিয়ায় পাঠানো—সবকিছুই সে সুকৌশলে ঠান্ডা মাথায় করে ফেলে।

এদিকে আনায়াকে রাশিয়ায় পাঠানোর উদ্দেশ্যটাও ছিল সাধারণ। সেরাতে হসপিটাল হতে আনায়ার পালিয়ে যাওয়াটা ছিল অপ্রত্যাশীত। পাভেলের পরিকল্পনা মোতাবেক, সন্তানহারা মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত আনায়া তখন তার বিষয়বস্তুর বাহিরে। তাকে নিয়ে পাভেলের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। একইসাথে আনায়ার অসুস্থ হয়ে সন্তান নষ্ট করাতে তার কোনো মাথাব্যথা না থাকলেও,যথারীতি সুযোগ বুঝে আনায়ার অপরিপক্ক সন্তানের দেহাবশেষকে হসপিটাল থেকে গায়েব করে সে সহজেই নিজেদের কোম্পানিতে পাচার করে দেয়। কেননা,নবজাতক বাচ্চাদের প্লাজমা কিংবা ভ্রুন— যেকোনো অংশই তাদের জন্য প্রয়োজনীয়। যেটার সুযোগও পাভেল হাতছাড়া করেনি। এছাড়া মূলত এই বিষয়টির পরিপ্রেক্ষিতে, আনায়া জার্মানিতে হান্সদের ল্যাবের স্ক্রিনে নিজের নামের পাশে অস্পষ্ট কিছু তথ্য দেখেছিল৷ কেননা, হান্স কোম্পানির সকল তথ্যই তারা সংরক্ষণ করে রাখত। কিন্তু আনায়া তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি।

তবে এতোকিছুর মাঝেও পাভেল বারংবার একেকটার পর একেকটা ভুল করে গিয়েছে। অবশ্য এতে শেষমেশ তার কোনো ক্ষতি না হলেও, নির্দোষ জীবনগুলোর শেষ হয়েছে ঠিকই । নয়তো কারো সাজানো গোছানো জীবন ধ্বং”স হয়েছে। যথারীতি আনায়াকে দুর্বল ভেবে রাশিয়ায় পাঠানোটাও তার জন্য একটা মস্ত বড় ভুল ছিল। অবশ্য তার করারও কিছু ছিল না, লুসিয়ার কথামতো সে কখনোই আনায়ার কোনো ক্ষতি করতে পারত না। এমনিতেও তার কাছে সে অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল—তার পথে বাঁধা হবার মতো কোনো সংশয় নেই। একইসাথে কেনীথের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে লুসিয়া তার কোনো ক্ষতিও হতে দেবে না। যদি সে এমন কিছু করে, তখন লুসিয়াই আবার তার রাস্তায় বিঘ্নতা ঘটাবে। সবমিলিয়ে পাভেলকে এই বিষয়ে লুসিয়ার অবাধ্য হয়েই, নতুন ঝামেলার সৃষ্টি হবে বিধায়—সে লুসিয়ার কথামতো আনায়াকে রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেয়।

এদিকে লুসিয়া যে পাভেলের সম্পর্কে সব কিছু জানতো, এমনটা নয়! পাভেল তার নাতী হওয়ার পাশাপাশি যে, আর্তেমের সম্পত্তির ভাগীদার হতে চায়—এটা সে স্পষ্টভাবেই জেনেছিল। সে রাজিও ছিল, তার নিজের অংশটুকু পাভেলকে দিতে। কিন্তু বিপত্তি তখন বাধে, যখন সে পাভেলের কাছ থেকে এটাও জানতে পারে যে—আর্তেম তার সবকিছুর মালিকানার অধিকার কেনীথকে দিয়ে গিয়েছে। যথারীতি এখানে তার আলাদাভাবে কিছু করার ছিল না। কিন্তু নাতী হিসেবে পাভেলের জোরাজুরিতে সে চেয়েছিল, পাভেল সম্পর্কে কেনীথকে সবকিছু জানিয়ে দিতে। পাভেল কেনীথের এতো দিনের সম্পর্ক। কেনীথ নিশ্চয় তার নিজের প্রোপার্টির একাংশ পাভেলকে দিয়েই দেবে।

নাতীদের নিয়ে লুসিয়ার চিন্তাভাবনা ছিল সরলসোজা। কিন্তু পাভেল যে মূলত কি চাইছে, তা বোঝামাত্রই সে হতবিহ্বল হয়ে যায়। তার এতো চেষ্টার পরও, পাভেল যে তার বাবার মতো হবে—তা সে কল্পনাতেও আশা করেনি। যদিও তিনি তখনো পাভেলদের পুরো পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পেরেছিল, তার নাতী কেনীথ ও আনায়ার জীবন সন্নিকটে। পাভেল আর তার বাবা যে কোনো সময় যা কিছু করতে পারে। কিন্তু ততদিনে যে সে-ও পাভেলের কাছে কোনো এক বিশেষ কারণে দায়বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এতো বড় মাফিয়া হয়েও, তার দূর্বলতা জন্য সে কিছুই করতে পারেনি।

কেনীথকে পুরোপুরি বাঁচাতে গেলে, রোজের জীবন ধ্বংস হবে। আবার রোজের জীবনের জন্য সে,কেনীথকেও অবজ্ঞা করতে পারেনা। সবমিলিয়ে চলছিল এক নিদারুণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব। পাভেল যে একা নয়, তার পাশাপাশি আরো এক বিশেষ ব্যক্তি তাদের পুরো জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। তার উর্ধ্বে গিয়ে, সে নিজেও চেয়ে কিছু করতে পারবে না।

এতোকিছুর মাঝে সে শুধু পাভেলের কাছে তার নাতী-নাতনীদের জীবন হাতজোড় করে ভিক্ষা চাওয়া ব্যতীত আর কিছুই করতে পারেনি। সে বিশেষ কারণে লুসিয়া এতোটাই দায়বদ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, সে কোনোভাবেই কেনীথকে পর্যন্ত এইসকল বিষয়ে জেনেও জানাতে পারেনি। হয়তো কেনীথের একটি পদক্ষেপে তারা বেঁচে গেলেও, হয়তো রোজের জীবন সংশয়ে রয়ে যাবে।

এসব ব্যতীতও আরো নানান ঘটনা ঘটেছে। যেমন হুট করে, ইনায়ার পরিকল্পনা সফল হওয়া। কেনীথকে তাদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে মা’রার চেষ্টা। এসবই ছিল পাভেলের জন্য অকল্পনীয়। কেনীথের কিছু হলে, তার কপালে একআনাও জুটবে না। যে কারণে কেনীথকে সে সর্বদা সোনার হরিণ ভেবে, নিজের জানের চেয়ে বেশি দেখভাল করেছে। কিন্তু শেষমেশ যখন ইনায়া কেনীথের সেই হাল করে ছাড়ল—তখন যেন তা-ই পাভেলের জন্য প্রচন্ড ক্রোধের সৃষ্টি করে।

সে নিজের ক্রোধের দরূন ইনায়াকেই সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করে। ফলাফল সরূপ, সবার সামনে সে-রাতে তাদের আস্তানায় দেরিতে পৌছে যখন আনায়াকে দেখতে পেল তখন…ঠিকই তার ভালোমানুষি দেখিয়ে, আনায়ার সাথে মিলে ইনায়া,কেনীথ আর রোহানকে হসপিটালে নেওয়া সহ, তাদের জন্য সকল অস্থিরতা — সবই তার নিত্যদিনের অভিনয়ের অংশ। কেননা পরবর্তীতে সে-ই তার লোকদের হসপিটালে পাঠিয়ে রোহান আর ইনায়াকে বিষ দিয়ে মা*রার চেষ্টা করে। যাতে ইনায়া অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও, একটি নির্দোষ প্রাণ—রোহানের হৃৎস্পন্দন সারাজীবনের জন্য থেমে যায়।

জানের পর জান নেওয়াটা তাদের কাছে কিছুই না। তেমনি রোহানের জীবনটাও ছিল পাভেল কিংবা তাদের লোকজনের কাছে অপ্রয়োজনীয়। উল্টো সে বেঁচে থাকলে, কিংবা কখনো সুস্থ হয়ে উঠলে তাদের পথেই কাটা হবে।আর এভাবনাতেই ইনায়া আর রোহানকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিল সে। একইসাথে কেনীথের বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করে, তার কেবিনেও নাটকীয় ভাবে ধ্বংসযজ্ঞে চিহ্ন রেখে যায়। যেন এই ঘটনা নিয়ে বিশেষ কারো সন্দেহ না থাকে। আর পাভেল বরাবরের মতো তার ঘটানো সকল ঘটনায় যেভাবে অনুপস্থিত থেকে, পরবর্তীতে নিজেই সাধুবেশে সকলের সামনে হাজির হয়েছে—সেদিনও ঠিক তাই ঘটে।

তবে ইনায়া বেঁচে যাওয়ায় সে তার পরিকল্পনা আবারও পরিবর্তন করে। এবার সে আর ইনায়াকে মা”রার জন্য কোনো অতিরিক্ত সময় নষ্ট করে চায়না। সে চাইলেই ইনায়াকে সরিয়ে দিয়ে তখন নিজের রাস্তা ক্লিয়ার রাখতে পারত। কিন্তু সবমিলিয়ে অনেক কিছু চিন্তাভাবনা বিবেচনার পর সে সিদ্ধান্ত নেয়, ইনায়াকে আপাতত জীবিত রেখেই নিজের রাস্তা সাফ করবে। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে সবার সাথে সাথে ওকেও সরিয়ে দেওয়া যাবে।

আর ঠিক এই ভাবনা থেকেই সে তার পরবর্তী খেলাটা খেলে। ইনায়ার সব দায়িত্বই, আনায়া পাভেলের কাছে দিয়েছিল। কারণ তখন তারা জার্মানিতে এস, পি, হান্সের কোম্পানির অভিজানে…যথারীতি সেই সময়টুকুতে পাভেল তার লোকজন দিয়ে, ইনায়ার যথাসাধ্য ভালো ট্রিটমেন্টের ব্যবস্তা করে।

কিন্তু পরবর্তীতে যখন আনায়া-ইনায়াকে নিয়ে কানাডায় চলে যায়।এবং ইনায়ার আরো ভালোমতো ট্রিটমেন্ট শুরু করে—কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তার কোনো উন্নতি হয় না। এসবও মূলত পাভেলের সাজানোর পরিকল্পনার খেলা। ইনায়াকে যে ডক্টর ট্রিটমেন্ট করেছিল, সে পাভেলেরই লোক ছিল। যথারীতি ইনায়াকে পুরোপুরি সুস্থ হবার মেডিসিন না দিয়ে, তাকে জ্যন্ত লা-শ বানানোর চিকিৎসা দেওয়া হয় তাকে। এবং পরবর্তীতে যতজন ডক্টর তার ট্রিটমেন্ট করেছে, সকলেই ছিল পাভেলের কেনা লোকজন। ফলাফল সরূপ,জীবনের গল্পের শেষপর্যায়ে এসেও ইনায়া পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি।

অবশ্য যে ব্যক্তি নিজের স্বার্থ আত্মসাৎ এর জন্য,নিজের বাবাকেই নিজ হাতে খুন করে — বুলেটের পর বুলেট ছুঁড়ে, বাবার বুককে ঝাঁঝরা করে দেয়। সে ব্যক্তির দ্বারা এতোসব কিছু অসম্ভব মনে হলেও, অসম্ভব নয়।

গল্পের শেষটায় পাভেল নিজ স্বার্থেই, জার্মানির দুর্গে গোলাগুলিতে সুযোগ বুঝে, পেছন থেকে তার বাবাকে গুলি করে। কেননা বিকৃত মস্তিষ্কের বাবার হাত ধরেই তার খেলাটা শুরু হলেও, নানান সময়ে তার মতামতের বিপরীতে গিয়ে নিকোলাই হান্সের সকল পদক্ষেপই ছিল তার কাছে বিরক্তিকর। একটা সময় গিয়ে, বাবা ছেলের মাঝেই সুক্ষ্ম এক দ্বন্দ্ব চলতে শুরু করে। তার নিকোলাই এর কাছে বিশেষ কিছু না হলেও, সে চাচ্ছিল নিকোলাইও তার রাস্তা থেকে সরে যাক। তাহলে পরবর্তীতে পুরো এস.পি.হান্স কোম্পানিতে তারই রাজত্ব চলবে। সে যা চাইবে, করবে— তাই হবে। কিন্তু তার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এমনটা হবে না। কারণ এক রাজ্যে কখনো দুই রাজার রাজত্ব চলতে পারেনা৷

যথারীতি এক কাপুরুষের ন্যায় সে পিঠপিছে দাঁড়িয়ে সকল খেলার পাশাপাশি,তার বাবাকেও সে রাতে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়। আর বরাবরের মতো ভালো সেজে যায়,কেনীথ আনায়ার কাছে।

অবশ্য এটাকে পাভেলের সিগনেচার বিশেষত্বই বলা চলে। তার বোকা-সোকা হয়ে চলাফেরা করা কিংবা ঠান্ডা মাথায় শুরু থেকে পুরো গেইম খেলাটা—কোনো বীর পুরুষের পরিচয় বহন করে না৷ বরং সে ইতিহাসের আর পাঁচটা বিশ্বাসঘা”তক কাপুরষের জন্য দৃষ্টান্ত উদাহরণ। বারবারই পেছন হতে আঘাত করে, নিজের পথের কাটা সরিয়ে দেওয়াটা তার ব্যক্তিত্বের অন্যতম বিশেষত্ব। যেমনটা সে বরাবরই করে এসেছে। কখনো বাংলাদেশে তাদের আস্তায়, সুযোগ বুঝে পেছন হতে ইনায়াকে গুলি করা কিংবা অলিভারকে অপ্রোয়জনীয় ভেবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। আবার কখনো নিজের বাবাকেই চিরদিনের মতো শেষ করে দেওয়া। সবটাই করেছিল সে, এক কাপুরুষের ন্যায় পিঠপিছ থেকে আঘাত হানবার মতো করে।

আর সর্বশেষে এই বার্থডে পার্টিটা ছিল এক ব্ল্যা”ডি ট্র্যাপ। নিজের এতোদিনের পরিকল্পনার সফল হবার আনন্দ উদযাপনের জন্যই যেন, পাভেল আনায়াকে দিয়ে এই এতোবড় বার্থডে পার্টির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে যেসকল অতিথিদের আসার কথা ছিল, তারা মূলত কেউই আজ আসেনি। কারণ পাভেল চায়নি এমনটা। সে তার প্ল্যান মতো বেশিরভাগ অতিথিদের নিমন্ত্রিত করেনি কিংবা সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে, নিমন্ত্রনের পর পরবর্তীতে সবাইকে জানিয়ে বিষয়টা নিমন্ত্রণটা ক্যান্সেল করে দেয়। এভাবেই পদে পদে সে তার পরিকল্পনার পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যখন যা ঠিক মনে হয়েছে তাই করেছে। আর শেষপর্যন্ত রয়ে গিয়েছে সবার কাছে, এক সাধাসিধা অবলা ছেলে হিসেবে। কিন্তু খেলে গিয়েছে নানান সব ভয়ানক খেলা।

আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, যে কেনীথ আনায়া জানে এস.পি.হান্সকে তারা অনেক বছর আগেই ধ্বংস করে দিয়েছে—তা আজও দিনের পর দিন একইভাবে চলছে।হান্স ইন্ডাস্ট্রির ধ্বংস কখনোই হয়নি। লোকচক্ষুর অগোচরে তা এখন আরো কঠোর নিরাপত্তা, ও নিরাপদ আশ্রয়ে— আগের চেয়ে আরো বেশি ভ”য়ানক সকল কার্যক্রমের মাধমে এগিয়ে চলেছে। যেহেতু সবকিছুর মতো এসবের দায়িত্বও কেনীথ পাভেলকে দিয়েছিল—ফলাফল সরূপ, পাভেল তাকে বরাবরের মতো যা মিথ্যে ডকুমেন্টস ও তথ্য সাজিয়ে বলেছে,কেনীথ তা-ই বিশ্বাস করেছে। দিনশেষে আজ তার মাথা হতে এই ব্যাপারটাই সরিয়ে দিয়েছে পাভেল। এভাবেই দিনের পর দিন পাভেল, পুরো খেলায় নিজের একেকটা দান খুব নিখুঁত ভাবে দিয়েছে। ভুল করলেও,তাতে বেশি পস্তাতে হয়নি। সবকিছু ব্যলেন্স করেই আজ সে সফল।

অথচ এখন পর্যন্ত কেউই জানে না, এই ভয়ংকর খেলার শুরু মাত্র হয়েছে। যেটার শেষ কোথায়, কার হাতে, তা আজ রাতেই নির্ধারিত হবে। কেননা, আজ রাতের বিশেষ অতিথির আগমন তো এখনো ঘটেইনি। যার অপেক্ষা নিশ্চিত পাভেল নিজেই করছে।

_________

—❝কি ব্রো! নাম শুনে অবাক হলে?❞

কেনীথ আনায়ার চোখের মুখে তীব্র বিস্ময়ের ছাপ। কেনীথের ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। সে বিস্ময়ের চাহনিতে পাভেলের দিকে তাকিয়ে। এরইমাঝে পাভেল বিস্তৃত মুচকি হেসে বলে ওঠে,

❝হুম,ঠিকই শুনেছো। যে এস.পি.হান্সকে তোমরা মৃত হিসেবে জেনেছো, তারই একমাত্র নাতী ওরফে আমিই দ্বিতীয় এস.পি.হান্স। সে সের্গেই পেত্রিন হান্স ছিল,আর আমি সের্গেই পাভেল হান্স।

মূল কথায়, আমি তোমার প্রিয় বাবুশকার প্রথম স্বামীর ঘরের একমাত্র নাতী। সে হিসেবে, তুমি আমি ভাই-ভাই বলা চলে।ঐ দাদি-নানী আরকি।এক হিসেবে সবাইকে বাবুশকাই বলা হয়।❞

কেনীথ আনায়ার বিস্ময়ের মাঝেই পাভেল একেরপর এক সত্যি বলতে শুরু করে। শুরু থেকে শেষ অব্দি তার করা প্রত্যেকটা কুকর্ম সম্পর্কে প্রচন্ড গর্বের সহিত জানায়। আর কেনীথ আনায়া শুধু এক নাগারে তার কর্মের কথা শুনতে থাকে।

❝যাস্ট এই কয়েকটা প্রোপার্টি, পাওয়ারের জন্যই তোর এতোকিছু…?❞

—❝তোমার কাছে সামান্য হতে পারে। আমার কাছে নয়। বহু কষ্টের ফল আমার।❞

কেনীথ রাগ মিশ্রিত কন্ঠে তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,

❝বিশ্বাসঘাতকতাকে কষ্টের ফল বলছিস? কাপুরষ, জানোয়ার একটা।”

পাভেল গা দুলিয়ে বিস্তৃত হাসে। একহাতে কোঁকড়ানো চুলগুলো হাতের সাথে নাড়িয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

❝যত যাই বলো না কেনো, আজ আমি খুব খুশি।❞

—❝তুই কি ভেবেছিস, তুই এসব করলেই আমি তোকে সবকিছু দিয়ে দেব? আমি মরে যাব, এই সবকিছু ধ্বং”স হবে। তবুও তো তোকে আমি এসবের একাংশও দেব না। তোর মতো জানো”য়ার সফল হোক তা আমি কখনোই চাই না।❞

কেনীথের তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে পাভেল এবার বিস্তৃত হো হো করে হেসে বলে ওঠে,

❝সিরিয়াসলি? তুমি তো দেখছি এখনো কিছুই বোঝোনি। ব্রো! তোমাকে আর কোনো কষ্ট করতে হবে না। সব কষ্ট আমি করে ফেলেছি।❞

কেনীথ সন্দিহান চাহনিতে পাভেলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ওমনি পাভেল হেসে বলে,

❝আজ সকালে দুষ্টু মিষ্টি কথা বলে পেপারস্ এ সাইন করিয়ে নিলাম না? বিশ্বাস করো, খেলাটা ওখানেই শেষ করে দিয়েছো তুমি। ওটা তোমার এতোসব প্রোপার্টির ডকুমেন্টস ছিল। কোনো আলাদা পার্টি, ইন্ডাস্ট্রিরও নয়।❞

এই বলেই সে, কেনীথের দিকে এগিয়ে আসে। হাত থেকে রডটা ফেলে দিয়ে, কেনীথের এলোমেলো চুলে হাত নাড়িয়ে দিয়ে বলে,

❝বড় ভাই! পৃথিবীর মানুষ, বড়ই নিষ্ঠুর।জীবনে কাউকেই এতোটাও অন্ধবিশ্বাস করা উচিত নয় যে—শেষ বেলায়, সেই তোমার সবকিছু ধ্বংস করে দেয়।❞

চলবে______________