#একজোড়া_আগুন_পাখি
#তুশকন্যা
পর্ব— সমাপ্তি (৭ম অংশ)
❝বড় ভাই! পৃথিবীর মানুষ, বড়ই নিষ্ঠুর।জীবনে কাউকেই এতোটাও অন্ধবিশ্বাস করা উচিত নয় যে—শেষ বেলায়, সেই তোমার সবকিছু ধ্বংস করে দেয়।❞
কেনীথের মেজাজ আর ঠিক থাকে না। সে আক্রোশে পা দিয়ে পাভেলের উরুর মাঝ বরাবর সজোরে আঘা”ত করে। তৎক্ষনাৎ যেন পাভেলের জান পাখি উড়ে যাবার উপক্রম। সে নিজেকে ব্যাথার চোঁটে সামলাতে না পেরে, পা-জোড়া কুঁচকে তীব্র রাগান্বিত চাহনিতে কেনীথের দিকে তাকায়। কিন্তু তার আগেই কেনীথ তাকে ধরে রাখা গার্ডদের এক ধাক্কায় সরিয়ে, মাটিতে ফেলে দিয়ে পাভেলের দিকে তেড়ে যায়। যা দেখমাত্রই পাভেলের জান যায় যায় অবস্থা। সে আর যাই হোক, কেনীথের শক্তির সাথে পারবে না এটা জানা কথা। সে আঁতকে পেছনের দিকে সরে যেতে নিলে, ধপাৎ করে মাটিতে পড়ে যায়। একইসাথে চেঁচিয়ে ওঠে,
❝গাধাগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস? ধর এটাকে! ওরেএএএ আমায় মে’রে… ❞
এ বলতে না বলতেই, কেনীথ এসে তাকে ধরতে নিলেই,তড়িঘড়ি করে আশেপাশের সবগুলো বলিষ্ঠ দেহের বডিগার্ড কেনীথকে আটকানোর সর্বচ্চ চেষ্টা করে। কেনীথ এতে আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পেছনে ফিরে যাকে হাতের কাছে পাচ্ছে, তাকেই নিজের সর্বশক্তিতে ক্ষ”তবি”ক্ষত করছে। তবে খানিকটা সময় যেতে না যেতেই আকস্মিক গুলির শব্দে চারপাশের সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেনীথের সর্বস্বরূপে থমকে দাঁড়ায়।
পাশে ফিরে তাকাতে না তাকাতেই, আচমকা তার সামনে ঢাল রূপে দাঁড়িয়ে থাকা আনায়া হেলে নিচে পড়ে যেতে নেয়। কেনীথের মস্তিষ্ক খানিকটা সময়ের ন্যায় সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়।সবকিছু ছাড়িয়ে সে আনায়াকে পড়ে যাওয়া হতে কোনোমতে দুহাতে আগলে জড়িয়ে ধরে।
আনায়ার চোখের দু-কিনায়ার জমে থাকা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। কেনীথ তার দিকে স্তব্ধ চাহনিতে তাকিয়ে। আনায়ার পিঠে রাখা হাত তার—লাল তরলে ভিজে গিয়েছে। কেনীথ একপলক সামনে তাকিয়ে দেখে, পাভেল তাদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে বিস্তৃত হাসি। হাতে থাকা কালো রাঙা পিস্তল তাদের দিকে তাক করা।
—❝কি হলো? সব তেজ শেষ হয়ে গেলো?❞
পাভেলের তাচ্ছিল্যের স্বর কেনীথের কানে পৌঁছায় না। বরং সে পুরোপুরি বুঝে ওঠার পূর্বেই পরপর আরো দুটো গুলি এসে কেনীথ বাহু ও কাঁধ বারবার বিদ্ধ হয়। এতে পাভেল আরো বিস্তৃত ভাবে মুচকি হাসে।
কেনীথ যখন গার্ডদের বেধরে পেটাতে ব্যস্ত,ঠিক সেই সুযোগে পাভেল তার পিস্তল বের করে তৎক্ষনাৎ কেনীথের দিকে তাক করে। যা দেখামাত্রই আনায়া বিস্ময়ে ছুটে গেলেও, ফলাফল বিপরীত হয়। কেননা ততক্ষণে পাভেল ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলছে। যে কারণে শুরুতে কেনীথের গায়ে গুলি না লেগে—লেগে যায় আনায়ার পিঠে।
এবার কেনীথ আর আনায়াকে ধরে রাখতে পারেনা। পাভেলের নির্দেশে কেনীথকে লোকজন সজোরে চেপে ধরে, দূরে সরিয়ে নিতে চায়। কিন্তু কেনীথ সেসবে তোয়াক্কা না করে, আনায়ার নিস্তেজ শরীরটা নিয়ে হাটু গেঁড়ে নিচে বসে পড়ে।
—❝এই আনায়া! তুই এমন কেনো করছিস? এ বউ, উঠে যা প্লিজ। তোর কিছু হলে আমি শেষ হয়ে যাব।❞
আনায়া নিস্তেজ শরীর ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। চোখজোড়া ক্রমশই বন্ধ হয়ে আসে। আনায়া কিঞ্চিৎ ঢোক গেলে, নিজেকে যথাসাধ্য সামলানোর চেষ্টা। কেনীথকে কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না। এই কষ্টে তার নিমিষেই চোখ বেয়ে পানি ঝড়ে। চারপাশটা ক্রমশই ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,
❝মাফ করে দিয়ে দিও। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। সবটাই অসমাপ্ত রয়ে গেল। মাফ করে দিও আমায়৷❞
আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতেই, কেনীথ তড়িঘড়ি করে অস্থির হয়ে ওঠে। আনায়ার গালে হাত চেপ্টে , দু’হাতে তাকে আগলে নেয়। হাতের একপাশটায় দুটো গুলি লাগায়, সে হাত যেন অবশ হয়ে এসেছে। তবুও কেনীথ প্রচন্ড অস্থিরতা সাথে বলে,
❝পাগল হয়ে গিয়েছিস? কিচ্ছু হবে না তোর। ঐ পাভেল! ভাই তোর যা যা লাগবে আমি সবকিছু দিয়ে দেব। প্লিজ ওকে বাঁচা। ওর কিছু হলে আমি ম”রে হবে যাব।❞
পাভেল সহ সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পাভেলের কাছে বিষয়টা কেমন যেন অতিরিক্ত। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে, নিজের পিস্তল দিয়ে কপাল চুলকিয়ে নেয়। এদিকে আনায়া আবারও কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
❝আমার মেয়েটা!…ও অনেক ছোট। তুমি ছাড়া ওর… আর কেউ নেই। আমি জানি না আমার কি হবে। হয়তো আমাদের সন্তানটা আর পৃথিবীতে… মাফ করে দিও আমায়। আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো।❞
এই বলতে বলতেই আনায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। মাথাটা তার আরো ভার হয়ে আসে। কেনীথের কাতর চেহেরাটাও ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়।
—❝কিচ্ছু হবে না তোর। কেনো এসব কথা বলছিস?❞
আনায়ার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। সে অস্ফুটস্বরে আবারও আওড়ায়,
❝শুনছো…!❞
কেনীথ অস্থির হয়ে,আনায়াকে আরো শক্ত ভাবে আঁকড়ে বলে ওঠে,
❝হুম, বল… ❞
আনায়া ঠোঁট ভিজিয়ে, জোরে জোরে শ্বাস ফেলে আওড়ায়,
❝ভালোবাসি,জলহস্তী! ভীষণ ভালোবাসি।❞
এই পর্যায়ে কেনীথের চোখ বেয়ে পানি পড়ে। ওদিকে আনায়ার দম যেন ফুরিয়ে এসেছেন। সে শেষবারের মতো আবারও বলার চেষ্টা করে,
❝অরিন কোথায়? প্লিজ,ওদের বলে শেষবারের মতো একটিবার আমার মেয়েটাকে দেখার…❞
আনায়ার কথা আর সমাপ্ত হয়না। বরং তার পূর্বেই সে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যায়। এদিকে কেনীথ এ দেখে যেন পাগল প্রায় অবস্থা। অনবরত আনায়ার গা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগে,
❝এ তারা! না, না, এভাবে আমায় ফেলে যেতে পারিস না তুই। ওই কথা বলসি না কেন? তোর কিছু হলে আমি কিভাবে বাঁচব? আমি না তোকে বলেছিলাম, আমরা অনেক দূরে চলে যাব। সবার থেকে দূরে। ওখানে আমরা শান্তিতে একটা ছোট্ট সংসার গড়ব। তুই আর আমি সারাদিন ঝগড়া করব, মারামারি করব।আমাদের অনেকগুলো বাচ্চাকাচ্চা হবে। তুই আমাকে এভাবে ফেলে গেলে, এসব তবে কি করে সম্ভব হবে? তারা উঠে যা প্লিজ। কথা বল!”
এইসবকিছুই যেন পাভেলের কাছে প্রচন্ড বিরক্তিকর ঠেকল। সে খানিকটা বিরক্ত নিয়েই বলে উঠল,
❝ব্রো! তোমার কাহিনি তারাতাড়ি শেষ করো। এখন এভাবে বলে লাভ আছে? দেখো, হয়তো ম”রে গিয়েছে।❞
—❝যাস্ট শাটআপ। ওর কিচ্ছু হয়নি। হতে দেব না আমি। আমার মেয়েকে কি করেছিস? আমার লেডিবাগ কোথায়?❞
কেনীথের কথায় শুরুতে কেনীথ খানিকটা বিরক্ত হলেও, অরিনের কথা শোনা মাত্রই বিস্তৃত হেসে বলল,
❝লেডিবাগ? আ…অরিন মামুনি যে কোথায়…❞
কেনীথ চোখ তুলে, পাভেলের দিকে ক্ষিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে বলে,
❝হেলাফেলা করিস না পাভেল৷ বল অরিন কোথায়? ওর সাথে কি করেছিস তুই?❞
—❝ছিঃ, আমি কি ওর সাথে কিছু করতে পারি? যত যাই হোক, আমি ওর কি যেন…পাভলু আঙ্কেল। শ্লার বেটি, আমার নামটাকেও খেয়ে দিয়েছে।❞
পাভেলের উল্টোপাল্টা কথাকে কেনীথ গায়ে লাগায় না। সে আবারও অচেতন আনায়ার পালস্ চেক করতে থাকে। প্রচন্ড ধীরে ধীরে চলছে। একইসাথে সেও তীব্র অস্থির হয়ে উঠছে। এবার কেনীথ করুন স্বরে পাভেলের উদ্দেশ্য বলে,
❝এ পাভেল। ভাই আমার, ও-কে প্লিজ হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্তা কর। তোর সব রাগ ক্ষোভ তো আমার প্রতি, তাই না? তবে মেরে ফেল। আমি কিচ্ছু বলব না,আমার তোকে নিয়ে আর কোনো অভিযোগ নেই। শুধু আমার লেডিবাগ আর ব্লাডকে তুই বাঁচিয়ে রাখ।❞
পাভেল কেনীথের অভিব্যক্তিতে খানিকটা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,
❝আরেহ বাহ, তুমি তো দেখছি গিরগিটির মতো মিনিটে মিনিটে নিজের রূপ পাল্টাচ্ছো।❞
কেনীথ পাভেলের কথাকে তোয়াক্কা না করে, আবারও বলে,
❝পাভেল! ওর পালস্ স্লো হয়ে আসছে। এভাবে থাকলে যখন-তখন বাজে কিছু হয়ে যাবে। ওর ভেতর আরো একটা নতুন প্রাণ…তারার কিছু হলে আমার সন্তানটাও পৃথিবীর আলো দেখতে পারবে না। প্লিজ তুই কিছু একটা কর।❞
এবার পাভেল ভাবে খানিকটা অবাক স্বরে বলে,
❝নতুন প্রাণ মানে…কবে আবার কি হলো? তারমানে এ তো আরো এক ঝামেলা।❞
এই বলেই সে হেসে ফেলল। এদিকে কেনীথ এবার দৃঢ় কন্ঠে বলে,
❝কি চাইছিস তুই? পেপার্সে তো সাইন করিয়ে নিসেছিস। এরমানে এখন সবকিছুই তোর। তবে আর কি চাস তুই? যা চাইবি, তাই দেব। বল কি চাস?❞
পাভেল খানিকটা নাটুকে ভঙ্গিতে ভাবুক স্বরে বলে,
❝উমমমমম! আর কি চাই আমার? আআআ…নাহ! আমার আর কিচ্ছু চাইনা। কিন্তু,কিন্তু…❞
—❝তাহলে কেনো এতো হেলাফেলা করছিস? প্লিজ তুই…❞
কেনীথের কথা আর সম্পূর্ণ হয়না। বরং তার আগেই আচমকা গুলির শব্দে চারপাশের সম্পূর্ণ আবহ লোম-হর্ষক হয়ে ওঠে৷ অকস্মাৎ কি থেকে কি হয়ে যায়, কেউই বুঝে উঠতে পারে না। কিন্তু নিমিষেই পাভেলর সমস্ত দেহ যেন অসার হয়ে আসে। সে হেলে পড়তে পড়তেই আচমকা পেছনে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করে। ওমনি চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় তার জন্য এক অকল্পনীয় দৃশ্য।
মাথার একটা পাশ ফেটে গিয়ে এখনো র*ক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অথচ চোখমুখে তার সে কি এক হিং’স্রতা। তরুনীর স্তব্ধ চাহনি, বিধ্ব”স্ত দেহ। হাতের কালো পিস্তল তাক করা পাভেল বরাবর। এই মূহুর্তে ইনায়াকে যেন সে কখনোই প্রত্যাশা করেনি। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
তবে সে কিছু করার পূর্বেই, ধুম করে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। তখনই ইনায়ার পাশ হতে নজরে আসে রেহানকে। তাকে দেখে পাভেল যা বোঝার বুঝে যায়। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতেও তার চোখেমুখে তীব্র ক্ষো-ভ জেগে ওঠে। মাথাটা যেন চিড়চিড় করতে শুরু করে। আক্রোশে হাতের কাছেই পড়ে থাকা রিভলবারের দিকে নজর পড়লে, সে আপ্রাণ চেষ্টা করে তা নেওয়ার চেষ্টা করে। রিভলবারটা হাতের নাগালে পেতেই, তার মুখাবয়বে বিস্তৃত হাসি ফুটে ওঠে৷ তবে তা নিয়ে কাউকে লক্ষ্য করে শুট করার ইচ্ছেটা যেন তার জন্য দুঃস্বপ্ন হয়েই রয়ে যায়।
যেই না পাভেল রিভলবারটা তুলতে যাবে, ওমনি তার হাত শক্ত বুটের চাপায় নিষিক্ত হয়। নিমিষেই হাতের হাড়গোড় যেন ভেঙে আসে তার। সে ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে, মাথা উঁচিয়ে দেখতেই—কেনীথের বিস্তৃত হাসিমাখা মুখটা দৃশ্যমান হয়। ঠোঁটের কোণায় অদ্ভুত এক বাঁকা হাসি।শক্ত হাতে একটা কুড়াল ধরা। ধারালো চকচকে ফালায় আলোর প্রতিফলন তার চোখে এসে লাগে। এরইমধ্যে কেনীথ ঘাড় ঘুরিয়ে, একপলক ইনায়া-রেহানকে দেখার পর, বিস্তৃত বাঁকা হেসে পাভেলের উদ্দেশ্যে আওড়ায়,
❝ গাধা একটা!❞
এই বলা মাত্রই সে পাভেলের হাত হতে নিজের পা-টা সরিয়ে নেয়। ইনায়াদের উদ্দেশ্য বলে,
❝বাবুশকা ঠিক আছে?❞
ইনায়া শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝায়, সব ঠিক আছে। এরইমাঝে পাভেল আবারও এক বোকামি করে বসে।আর এটাই যেন তার জীবনের শেষ ভুল হয়। নিজের হাতটা ছাড়া পেতেই সে ত্বরিত রিভলবারটা তুলে দাঁড়াতে যাবে… ঠিক তৎক্ষনাৎ কেনীথ তা টের পেতেই—কুড়ালোর ধারালো ফালায় ছিন্ন করে দেয় এক জ্যান্ত মানুষ মাথা। নিমিষেই চারপাশটা স্তব্ধ হয়ে যায়। একটা জ্যান্ত মানুষের আস্ত মাথা, ঘাড় হতে ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়ে বিস্তৃত ঘাসের বুকে। পাভেলের মাথাহীন দেহটা নিমিষেই মাটিতে আছড়ে পড়ে। তার র*ক্ত গিয়ে ছিটকে কেনীথ গায়ে মুখে লাগে। কেনীথ কুড়াল ধরা হাতের কব্জি দিয়ে ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা র*ক্ত খানিক মুছে ফেলে নির্লিপ্ততায়৷ একইসাথে বিড়বিড়িয়ে আওরায়,
❝বহুদিন পর। ভেবেছিলাম আর এভাবে হাত র*ক্তাক্ত করতে হবে না। কিন্তু আফসোস, তুই আর আমায় ভালো হতে দিলি না।❞
ওদিকে এসব দৃশ্য দেখে ইনায়ার মাঝে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া না হলেও, রেহানের যেন ভেতরটা উগ্রে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। তবুও সে নিজেকে যথাসাধ্য চেষ্টায় সামলে নেয়। এদিকে কেনীথ পাভেলের ছিন্ন মাথাটাকে পা দিয়ে উল্টিয়ে এদিক সেদিক করে বলে,
❝খেলাটা তুই ভালোই খেলেছিস। এতো বছরেও কিচ্ছু টের পাইনি। তবে যতই চেষ্টা করিস না কেনো, তুই যে আসলেই একটা গাধা ছিলি তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। গুড বাই, সের্গেই পাভেল হান্স ওরফে গাধা হাঁদারাম!❞
এই বলা মাত্রই পাভেলের মাথা বরাবর নিশানা করে সজোড়ে পা দিয়ে শট দিতেই—তা তীব্র গতিতে ছিটকে সামনের বড়সড় এক গাছের সাথে বারি খায়।নিমিশেষই থেঁতলে যায় তার মুখাবয়ব। যা দেখে রেহান খানিকটা সময়ের জন্য চোখ বুঁজে নিলেও, কেনীথ তা দেখে কিঞ্চিৎ বাঁকা হাসে। অতঃপর সে দ্রুত আনায়ার কাছে গিয়ে, তাকে মাটি হতে পাজকোলে তুলে নেয়। গাড়ির দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতে যেতেই,পুনোরায় সে থমকায়। পেছনে ফিরে রেহান আর ইনায়ার উদ্দেশ্যে বলে,
❝ইরা! গাধাটার যথাযথ ব্যবস্তা করার দায়িত্ব তোমায় দিলাম। আর রেহান তুমি রোজ আর লেডিবাগকে নিয়ে এসো৷❞
এইটুকু বলতে না বলতেই, পরক্ষণেই আবার সে পাভেলের দেহটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ায়,
❝শালা আমার বার্থডে টা তো খেলোই—এতো বছর পর একমাত্র মেয়ের বার্থডে টা করতে চাইলাম,তাও ঠিকঠাক করতে দিলো না। সাধেই কি এটাকে গাধা বলতাম। যাক, অবশেষে আপদ বিদেয় হয়েছে।❞
__________
সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট একটি গ্রামের ফার্ম হাউসে এক বড়সড় ভিনদেশী পরিবারের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রায় বছর খানেক
হলো তারা এইখানে বসবাস করছে। পরিবারটিতে একজন বৃদ্ধ নারী,একজোড়া দম্পতি,তাদের ছেলেমেয়ে, বোন কিংবা স্ত্রীর প্রাক্তন—সকলে মিলে একত্রে এই পরিবারে বসবাস করে। গ্রামটা যথেষ্ট নিরিবিলি হওয়ায়, তাদের সাথে গ্রামের বাকি পরিবারের মেলামেশাটা খুবই ক্ষীণ। একইসাথে গ্রামের লোকজনের কাছে এই পরিবারটা খানিক রহস্যময়ও বটে।
প্রায় অনেকটা সকাল হয়ে গিয়েছে। তবুও সুইজারল্যান্ডের এই ছোট্ট গ্রামটির আবহ যেন বড়ই চমৎকার। চারপাশে গাছগাছালিতে ঘেরা বড়সড় ফার্ম হাউজে অবস্থানরত পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যই নিজেদের কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত। যে যার নির্দিষ্ট কাজে সময় অতিবাহিত করছে।
পরনে সাদামাটা ঢিলেঢালা প্লাজো,আর টপস্ পড়া একটা মেয়ে বড়সড় কাঠের উপর বসে রয়েছে। হাতে থাকা বড়সড় দুটো ধারালো চকচকে চা’পা’তিকে বারংবার ঘর্ষণ দেওয়ায় তা বিদঘুটে এক শব্দে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অথচ মেয়েটির চোখেমুখে অভিব্যক্তি একদম নির্লিপ্ত। যেন এসব তার নিত্যদিনের কাজ।
মেয়েটির সামনে একটা বড় গাছের একটুকরো গোড়া। তার উপর রাখা কিছু শক্ত ফ্রোজের মাংসের পিন্ড। এগুলোই তাকে ঠিকঠাক মতো কাটতে হবে। কেননা তার পাশে দাঁড়ানো দুটো বড়সড় কালো রঙের কুকুর খুবই ক্ষুদার্থ। কুকুর দুটো দেখতে যথেষ্ট হিংস্র আর ভয়ানক মনে হলেও, আদতে এরা এই গম্ভীর স্বভাবের মেয়েটির কাছে কিছুই না।
মেয়েটির তীক্ষ্ণ চাহনি, কাঁধ পর্যন্ত কালো কুচকুচে চুল,মাথায় শক্ত করে বাঁধা রুমাল কিংবা তার পরিপূর্ণ নিস্তব্ধ অভিব্যক্তি নিত্যন্তই যে কাউকেই আতংকিত করে তুলবে। মেয়েটি কথা খুবই অল্প বলে। কারণ তার স্বাভাবিক কন্ঠস্বরও গ্রামের যে কাউকে আতংকিত করে তোলে। আর তাকে সবাই চেনে একনামে— তা হলো ❝ ইনা ❞।
বহু বছর আগে যে ইনায়া ভয়ংকর এক রূপের ইনা পরিচয়ে পরিণত হয়েছিল,আজ আবারও সেই ইনায়া ‘ইনা’ পরিচয়েই এই গ্রামে বসবাস করছে। আর তার এই কুকুরদুটো হলো কেনীথের সেই একাকিত্বের সঙ্গী কেনেল ও ক্লারা। তবে কেনীথ আর আগের মতো একা নেই। তার আজ বড়সড় পরিবার রয়েছে,সন্তান রয়েছে। তার দিনের সবটুকুই এখন এদের ঘিরে।তাই কেনেল,ক্লারাকে সময় দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তার আর নেই। আর এই কারণেই, কুকুর দুটো এখন ইনায়া কিংবা ইনার সঙ্গী।
ইনায়া মাংসগুলো খুব নিখুঁত ভাবে ছোট ছোট টুকরো করে, নিজ হাতে কেনেল আর ক্লারাকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাঝে তারাদুজন একটু তাড়াহুড়ো করলে, ইনায়া চোখ রাঙ্গায়। নিমিষেই আবার তারা দুজন চুপচাপ হয়ে যায়।
এদিকে ইনায়ার থেকে খানিকটা কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছে কেনীথ। পরণে সাদামাটা পোশাকআশাক—কালো রঙের একটা টিশার্ট আর প্যান্ট। চুলগুলো আজও সেই ঘাড় অব্দিই রয়ে গিয়েছে। খুব বেশি পরিবর্তন নেই তার মাঝে। তবে বর্তমানে তার অভিব্যক্তি কিছুটা ভিন্ন। একজন অপরিপক্ক বাবার ন্যায় করছে সে নানা রকমের আচরণ। কোলে তার ছয়মাসের এক শিশু। মাথার চুলগুলোও হুবহু তার মতোই খানিকটা হালকা কোঁকড়ানো। দেখতেও ডার্ক কফি ব্রাউন কালারের। তবে কেনীথের মতো ঘাড় অব্দি চুল না হলেও, বাচ্চা ছেলেটির চুলগুলো একটু বেশিই সিল্কি। ফর্সা গোলগাল চেহেরা, তবে চোখেমুখে যেন বাঁধভাঙ্গা কান্না আসার উপক্রম।কিন্তু কেনীথের অদ্ভুত কার্যকলাপ আর রাগ-বিরক্তির অভিব্যক্তিতে সে কাঁদতেও ভয় পাচ্ছে।
—❝উফ! কাঁদিস কেন বাপ? মেরেছি তোকে? বকা দিয়েছি? কিছুই তো করিনি? তাহলে কেন কাঁদতে চাইছিস? তোর মা যদি এসে দেখে তোর এই হাল—বিশ্বাস কর, আমায় জানে মে’রে ফেলবে।❞
কেনীথের কথা বাচ্চাটার কাছে বোধগম্য নয়। সে খুব করে কাঁদতে চাইছে। চোখজোড়া ফুলে গিয়েছে, চোখে জল ছলছল করছে। এই মূহুর্তে তার মাকে চাই। যথারীতি সে আর অপেক্ষাও করেনা। কেনীথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই, হুট করে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এতে কেনীথ পুরো অপ্রস্তুত হয়ে যায়৷ এই চিৎকার আনায়ার কান অব্দি গেলেই সর্বনাশ। রূপকথার ডাইনির মতো, ঝাড়ু ছাড়াই উড়ে এসে কেনীথকে ধুমিয়ে একগাদা কথা শোনাবে। শেষে কেঁদে কেটে বলবে, কেনীথ তার ছেলেকে নিজের ছেলেই মনে করে না। নয়তো জগতের কোন বাপ তার এইটুকু ছেলেকে হুটহাট কাঁদায়?
কেনীথ এবারও তড়িঘড়ি করে, বাচ্চাটিকে কোলের মাঝেই নাচাতে লাগল। একইসাথে করূন স্বরে অনুনয় করে আওড়ায়,
❝কাইরাভ! আব্বা আমার৷ এভাবে কাঁদে না। বাবা তো তোমায় ভালোবাসে তাই না? অনেক অনেক ভালোবাসে। তাহলে এভাবে কাঁদছো কেনো?❞
কেনীথের কথায় এবার কাইরাভ আচমকা থেমে যায়। পিটপিট করে কেনীথের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই ফুঁপিয়ে শ্বাস ফেলে। ওর এহেন হাল দেখে, কেনীথ আদুরে ভঙ্গিতে নাকে নাক ঘেঁষে কপালে আলতোভাবে চুমু খায়। পরক্ষণেই বিস্তৃত হেসে বলে,
❝সাব্বাশ! এই না হলো আমার বাপ।❞
মুখে এহেন কথা বললেও, মনে মনে আওড়ায়,
❝শুকরিয়া বাপ, তোর মায়ের ক্যাচ ক্যাচ থেকে বাঁচিয়ে দিলি।❞
তবে এটা সে মুখে বলবে না। কারণ কেনীথ খেয়াল করেছে, আশ্চর্যজনক ভাবে কাইরাভ তার মায়ের কথা অর্থাৎ আনায়ার নামে কিছু শুনলেই কেঁদে ওঠে। এই বয়সেই মায়ের প্রতি এমন অভিব্যক্তি তাকে অবাক করে। অবশ্য মাঝেমধ্যে সে নিজেও অরিনের অবস্থান বিবেচনা করে বলে,
❝মায়ের এমন গুণধর পুত্রের চেয়ে, আমার লেডিবাগই ঠিক আছে।❞
তবে এসব নিছকই তার মুখের কথা। বাস্তবে সে তার দু-সন্তানের জন্যই পাগল। অবশ্য দু-সন্তান বললে ভুল হবে। তার আরো একটা সন্তান রয়েছে। যে অরিন কিংবা কাইরাভের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
কেনীথ কাইরাভকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ইনায়ার দিকে এগিয়ে যায়।ইনায়াকে মাংস কেটে কেনেল ক্লারাকে খাওয়াতে দেখে বিস্তৃত মুচকি হাসে। কেলেন ক্লারা কখনো সে ব্যতীত অন্য কারো কাছে বাধ্য ছিল না। তবে এখনকার চিত্র পুরোই ভিন্ন। তার চেয়েও বেশি বাধ্য তারা দুজন ইনায়ার কাছে। কেনীথ ভালো করেই বুঝে গিয়েছে, এরা তাদের সুনির্দিষ্ট মালিকের হাতেই পড়েছে।
কেনীথকে আচমকা নিজের কাছে দেখে, ইনায়া মাথা উঁচিয়ে একপলক কেনীথ আর কাইরাভকে দেখে। বাবার কোলে চুপটি বসে, তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সে। ইনায়া একপলকের বেশি তাদের দেখার প্রয়োজন মনে করে না। ওদিকে কেনীথ তার অভিব্যক্তিতে কিঞ্চিৎ মুচকি হেসে, কাইরাভের কানে ফিসফিসের বলে,
❝ইনা আন্টি সিরিয়াস মুডে আছে। মোটেও কাঁদবে না, ঠিক আছে?❞
কেনীথের কথা শুনে কাইরাভ তার দিকে চোখ পিটপিট করে চেয়ে থাকে। পরক্ষণেই আবার ইনার দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে আওড়ায়,
❝আ! আ!… ❞
কাইরাভ দুহাত উঁচিয়ে ইনায়ার দিকে ঝুঁকছে। অর্থাৎ সে তার কাছে যেতে চাইছে। যা দেখে কেনীথ কিছু বলার আগেই, ইনায়া না দেখেই বলল,
❝সরি কাইরাভ, এই অবস্থায় তোমাকে নেওয়া সম্ভব না।❞
ইনায়ার এহেন কথায় কাইরাভ কি বুঝল কে জানে, তবে তৎক্ষনাৎ সে কেনীথের দিকে কাঁদো কাঁদো চাহনিতে ঠোঁট উল্টে চেয়ে রইল। যা দেখা মাত্রই কেনীথ বলল,
❝ বাবা, আন্টি কাজ করছে তো।❞
কাইরাভকে এইটুকু বলেই, পরক্ষণেই আবার ইনায়ার উদ্দেশ্যে কিঞ্চিৎ চাপা স্বরে বলল,
❝শা’লী সাহেবা আমার। মধু খাবে মধু? তুমি বললে সুইজারল্যান্ডের বেস্ট মধু আনার ব্যবস্তা করব। তবুও বেশি বেশি মধু খেয়ে হলেও—মুখে একটু রস ঝড়াও।❞
কেনীথের কথা শুনে, ইনায়া নির্বিকারে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। কিছু না বলে, কিঞ্চিৎ বাঁকা হাসতেই, কেনীথ আবারও কিছুটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
❝আমি মোটেও হাসির কিছু বলিনি। তোমার হাবভাবে আমার ছেলে ভয় পায়।❞
—❝ভয় পাওয়া ভালো।❞
ইনায়া নির্বিকারে এটুকু বলেই, পুনোরায় মাথা ঘুরিয়ে নিজের কাজের মনোযোগী হয়৷ ওমনি কেনীথ কিঞ্চিৎ ভারী শ্বাস ফেলে বলে,
❝আমার ছেলে,আমাকে ভয় পেলেই চলবে।❞
—❝কেনো? মেয়ে ঘটিত সমস্যা এড়াতে?❞
ইনায়াকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। অবশ্য কেনীথ-আনায়া একসাথে কথা বলতে নিলে, তাদের টুকটাক অনেক কথাবার্তাই হয়ে যায়। কখনো চলে মশকরা, আবার কখনো কথার দ্বন্দ্ব। এভাবেই চলছে তাদের নতুন জীবন। যেখানে ইনায়াও মাঝেমধ্যে আর সবার মতো স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
তবে ইনায়াকে এমন প্রশ্ন করতে দেখে, কেনীথ কিঞ্চিৎ মুচকি হাসে। কাইরাভের নাকের সাথে আদুরে ভঙ্গিতে নাক ঘেঁষে বলে,
❝এড়িয়ে যাবার তো প্রশ্নই ওঠে। বাপ হিসেবে আমি অনেক দয়াল। ভবিষ্যতে এমন কিছু হলে, ছেলেকে কষ্টই করতে দেব না। প্রয়োজনে ছেলের বউকে তুলে আনতে হলে—সে দায়িত্ব আমার।❞
—❝শুধু ছেলের ক্ষেত্রেই এমন নাকি মেয়ের ক্ষেত্রেও…?❞
—❝এই কয়েকটাই ছেলে-মেয়ে আমার। এখানেও বৈষম্য করার মতো মহাপা-প আমি করতে চাই না। ছেলের ক্ষেত্রেও যা, আমার লেডিবাগের ক্ষেত্রেও তা।❞
কেনীথের কথা শুনে, ইনায়া আবারও তাদের দিকে তাকায়। পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
❝আরেহ্ বাহ্!❞
আবার দুজনের মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা জমে। এদিকে কেনীথের নজর এবার মাংসের দিকে পড়ে। ওমনি তার কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়।পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে,
❝ঐ গাধাটার মাংস এখনো শেষ হয়নি?❞
কেনীথের কথা শুনে ইনায়া নির্বিকারে জবাব দেয়,
❝না,আরো কয়েক টুকরো ফ্রিজে আছে। দেখতে চিকনা-চাকনা মনে হলেও, গাধাটা বেঁচে থাকতে খেয়েছে ভালো।❞
ইনায়া কথাটা বলে, তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে ফেলতেই, কেনীথও হেসে ফেলে। পরক্ষণেই আবার কি যেন মনে হতেই বলে,
❝জানো ইরা, বেটা মরার আগে তোমার গুনধর বোন,এর সাথে তোমার ফিউচার প্ল্যানিং করেছিল। এখন ভাবছি বেটাকে বাঁচিয়ে লাভই হতো।❞
—❝হু,কথাটা মন্দ নয়। ওদিন একবারেই শেষ হয়েছে। বেঁচে থাকলে হয়তো,আমার কল্যাণে তিলে তিলে শেষ হতো।❞
—❝আরেহ্ বাহ! নিজের ঢোল নিজেই পেটাচ্ছ?❞
—❝কি আর করার, দুনিয়ায় কেউই তো কারো না।❞
নিজেদের কথাগুলো শেষ হতেই, দুজনে একইতালে হেঁসে উঠল। ওদিকে কাইরাভ শুধু চেয়ে চেয়ে দুজনকে দেখছে। অথচ কিছুই বুঝতে পারছে না।
পাভেল দুনিয়ার মোহমায়া ত্যাগ করেছে প্রায় বছর খানেক হলো। সেরাতে কেনীথের একটি পদক্ষেপেই তার জীবনের ইতি ঘটে। একইসাথে তার সকল পরিকল্পনারও। তবে এতো বছরের পথচলায় কেনীথ কখনো তার আসল খেলা ধরতে না পারলেও, শেষ মূহুর্তে বুঝেছিল ঠিকই। হয়তো তা পাভেলের একটু অসাবধানতার পরিকল্পনার জন্য, কিংবা কেনীথকে সম্পূর্ণ হালকাতে নেওয়াই তার কাল হয়ে দাঁড়ায়।
কেনীথের কাছে পাভেল যখন পেপার্স সাইন করাতে আসে, তখন বেখেয়ালিতে হলেও সে পেপার গুলোতে নজর বুলিয়েছিল। অথচ পাভেল তাকে পুরোটা সময় নানান বোকা-বোকা,মজার কথাবার্তা বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু তখন যেন তা বহু দেরি হয়ে গিয়েছে। কেনীথও না বোঝার অভিনয় করে, ব্যাপারটা কাটিয়ে দেয় তো ঠিকই—তবে পরক্ষণেই সে তার পদক্ষেপ গ্রহন করে।
টুকটাক অনেক সন্দেহই হতো তার৷ তবে কোনো সন্দেহই জোড়ালো ছিল না বিধায়,সে পাভেলকে নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি। কিন্তু শেষ দিনে, সে তার সন্দেহ অনুযায়ী সকল বিষয়ে পাভেলের ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেঁটে দেখতে শুরু করে। এসব সে নিজে করেনি,বরং এসবের জন্য সে তার লোকজনকে ব্যবহার করেছে। তারমাঝে একজন ছিল রেহান নিজেই। রেহান মাঝেমধ্যেই রাশিয়ায় আসত—এটা নিছকই কোনো কারণ নেই। সময়রে সাথে সাথে লুসিয়া আর রেহানের মাঝে গোপন অনেকগুলো ডিল হয়। এরমাঝে সে রোজকে তার সাথে বিয়ে দেয়। তবে এটার কারণও যথেষ্ট ধোঁয়াশা। কিন্তু এছাড়াও সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য থাকে, তা হলো তাদের গোপন এজেন্ট হিসেবে আর্তেমের সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য কাজ করা।
এটা শারিরীক বল দ্বারা নিরাপত্তার কোনো বিষয়বস্তু নয়। এখানে রেহান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নেতিবাচক ব্যক্তির প্রভাব হতে বাড়ির সদস্যের বাঁচাতে কাজ করতো। আর লুসিয়ার কাছ থেকেও এটাও জেনেছিল যে, পুরো খেলার মেইন কালপ্রিট মূলত পাভেল। এবং লুসিয়ার কথামতো সে একটি স্বাভাবিক ব্যক্তির ন্যায়, পাভেলের হয়ে সাধারণ কাজগুলো করতে থাকে। যেন সরাসরি পাভেলের কাছ থেকে কোনো ইনফরমেশন না পেলেও, পাভেলের লোকজনের কাছে বিশস্ত হয়ে মোটামুটি সকল প্রকার ইনফরমেশন জানতে পারে। আর এভাবেই চলতে থাকে তাদের কার্যকলাপ।
এদিকে কেনীথ যখন পাভেলের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করতে করতে একের পর এক ধোঁয়াশাময় তথ্যের সন্ধান পায়—তখন সে সবচেয়ে বেশি অবাক হয় রেহানের নাম দেখে। অতঃপর কিঞ্চিৎ সময় নষ্ট না করে সে, ঐ দিনই রেহানের সাথে আলাদা ভাবে কথা বলে। এদিকে রেহানও আন্দাজ করেছিল,সেদিন কিছু একটা পাভেল করবে। আর সেজন্য তখন সে কেনীথকে মোটামুটি যা যা বলার তাই-তাই বলে দেয়। পাভেল কে?কিংবা তার আসল পরিচয় ও উদ্দেশ্য।
এক দিনে আচমকা এতোকিছু জানার পর যেন তার বিস্ময়ই কাটছে না।কিন্তু সে সময় আর এসব কিছু নিয়ে পড়ে থাকারও সময় নেই। কেনীথ চাইলেই শুরুতেই কিছু একটা করে পাভেলকে জব্দ করতে পারব,কিন্তু সে তা না করে নীরবে নিজের চাল চালে। কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া নয়। সে দেখতে চেয়েছে, এই পাভেল এতোবছর কষ্ট করার পর শেষ অব্দি ঠিক কি করে।
কেননা তার প্রোপার্টির একটা বড় অংশ যে রোজ আর অরিনের নামে,তা সে ব্যতীত আর কেউই জানেনা। এটা সে কেনীথ কোনো বিশেষ কারণ ব্যতীতই করেছিল। যার দরূন পাভেল চেয়েও ওদিন সব প্রোপার্টি নিজের করতে পারেনি আর পারতও না।
কেননা পাভেল তার লক্ষ্য পূরনে অতিব্যস্ত রইলেও, কেনীথ ঠান্ডা মাথায় মূল কার্যালয়ে সবগুলো পেপার সাবমিট হবার পূর্বেই নিজের লোক দিয়ে এলার্ট করে দেয়। আর এতে সাহায্য করে রেহান। নয়তো এখানে কেনীথ নিজেও জানে না, সে যাদের নিজের লোক ভাবছে তাদের মাঝে কতটুকু অংশ পাভেলের।
অতঃপর শেষমেশ তাই হয় যা তার পরিকল্পনায় ছিল।কিন্তু ইনায়া আর লুসিয়ার এক্সিডেন্টের ব্যপারটা তাদের বুঝতে বেশি দেরি হয়ে যায়। পাভেল আর ইনায়া যখন বাড়ি ছাড়ে, তারপর পরই রেহান খবর পায় পাভেল এদের শেষ করে ফেলতে চাইছে। তাই সে একটুও সময় নষ্ট করে, শুধু কেনীথকে জানিয়েই বলডান্স চলাকালীন সময়েই সে জায়গা ত্যাগ করে— ইনায়াদের কাছে পৌঁছায়।
তবুও তার যেতে যেতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। সে পৌঁছানোর আগ মূহুর্তেই ইনায়াদের ভয়াবহ এক্সিডেন্ট হয়। কিন্তু সেখানে ইনায়া আর লুসিয়া ব্যতীত আরো এক আগুন্তকঃ এর দেখা মেলে। সে অবশ্য পাভেলরই লোক ছিল, যথাযথ নিউজ তার কাছে পৌঁছানোর জন্য। আর যেই না মাত্র সে ব্যক্তি পাভেলকে ফোন করে মিশন সাকসেস হওয়ায় নিউজটা জানিয়ে দেয়,ওমনি পেছন হতে সুযোগ মতো রেহান তাকেই শেষ করে দেয়।
রেহান সেই নির্দিষ্ট স্থান হতে খানিকটা দূরেই জঙ্গলের পাশেই অবস্থান করছিল। যার দরূন সেই ব্যক্তি কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তার কাহিনি শেষ হয়ে যায়।আর ওদিকে পাভেল ভাবে তার পরিকল্পনা হয়তো সম্পূর্ণ হয়েছে।অথচ সে মূহুর্তে তার সবকিছুই ভেস্তে গিয়েছে।
এদিকে ইনায়ার অবস্থা তুলনামূলক ভালো থাকলেও, লুসিয়ার অবস্থা নিমিষেই খারাপ হতে থাকে। ইনায়ার জ্ঞান থাকলেও, লুসিয়া তখন অজ্ঞান। যার দরূন তাকে সরাসরি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ইনায়া প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্টটুকু নিয়েই রেহানের সাথে চলে আসে। এবং পথযাত্রায় রেহান তাকে একে একে পাভেলের সম্পর্কে সব কিছু বলতে থাকে। আর ইনায়াও সবকিছু নিজের মতো হিসেব মিলিয়ে বোঝে—তাদের সবার জীবনের সবকিছু ধ্বংসের কারণ কেনীথ নয় বরং পাভেল।আর তার এই বেহাল অবস্থার জন্যও সেই দায়ী। অতঃপর এই আক্রোশ হতেই, শেষমেশ তারা যথাসময়ে কেনীথের ওখানে উপস্থিত হয়। এবং পাভেলের গল্পের সমাপ্তি ঘটে।
তবে মৃত্যুর পরও তার সাথে ভালোর কিছুই হয়নি। আজও তার দেহের প্রতিটা অংশ টুকরো টুকরো কেনেল ও ক্লারা নামক দুটো কুকুরকে খাওয়ানো হচ্ছে। অবশ্য তার জীবনদশায় কর্মের ফল হিসেবে এইটুকু প্রযোজ্য।
–
এসকল ঘটনার পরপরই কেনীথ সহ সকলের জীবনযাত্রা নিমিষেই পাল্টে যায়। সুইজারল্যান্ড এই গ্রামেই, লুসিয়ার নিজস্ব ও গোপনীয় একটি ফার্ম হাউজ ছিল। যা সম্পর্কে বিশেষ কারোরই কোনো ধারণা নেই। এক কথায় এটি জনসাধারণের মাঝে একটা গুপ্ত জায়গা। আর তারাও নতুন পরিকল্পনা মোতাবেক সবকিছু ছেড়ে এখানে চলে আসে। তবে এর মানে এই নয় যে, আর্তেমের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছে গিয়েছে। এতো বড় সাম্রাজ্য তো এখনও চলছে, আর তা কেনীথদের বিশস্ত লোকেদের মাধ্যমেই। কিন্তু সবশেষে তারা পৃথিবীর সামনে সেজে রয়েছে, চারপাশের আর সকল সাধারণ মানুষের ন্যায়৷
–
ইনায়া আর কেনীথের কথোপকথনের মাঝেই রোজ বাড়িতে প্রবেশ করে। সাধারণ এক বেশভূষায়—সাধারণ ফেব্রিক্সের কালচে রঙের একটা গাউন পড়ে। এবং তার সাথে আসে প্রানবন্ত অরিন। লাল টুকটুকে গাউন পড়ে রোজের হাত ধরে হেঁটে আসছে। এবং রোজের আরেকপাশ রয়েছে একটি নয়-দশ বছর বয়সী বাচ্চা ছেলে। ভীষণ ফর্সা ত্বক,গম্ভীর তার অভিব্যক্তি,পরণে কালো রঙের প্যান্ট আর জ্যাকেট।
বাড়িতে প্রবেশ মাত্রই সে জ্যাকেটের ক্যাপটা একহাতে পেছনের দিকে ঠেলে দিতেই, প্রচন্ড সিল্কি ও কাঁধ সমান চুল দৃশ্যমান হয়। সবমিলিয়ে ছেলেটিকে বাচ্চা বলাই দায়। বেশভূষায়,চালচলনে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তির ন্যায়।
তারা মূলত রোজের সাথে তাদের নিজস্ব দোকানে গিয়েছিল। এই গ্রামে তাদের ছোট্ট একটি দোকানও রয়েছে। যা মূলত পরিচালনা করে রেহান।,তার বর্তমান কাজই মূলত এটা। সারাদিন দোকানেই বসে বসে কাটিয়ে দেয়। অবশ্য এভাবে তার জীবনও ভালোই কাটছে। কেননা সে চেয়েও এখন আর ভিন্ন কোনো দেশে গিয়ে থাকতে পারবে না। কেননা পাভেল ও আর্তেমের সাম্রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে, সে-ও শত্রুদের কাছে কেনীথদের মতোই বিবেচিত। সুযোগ পেলেও তার জীবনও শেষ—এটাই যেন নিশ্চিত।
সবমিলিয়ে সকলের সামনে আর পাঁচটা পরিবারের মতোই চলছে তারা। তবে এটাও যেন এক পরিকল্পনা। কেননা তাদের আয়ের উৎস দোকান আর অবসরে কেনীথের শখের বসে কাঠ কাটাকে দেখানো হলেও, বাস্তবে সব অর্থই আসছে তার অফুরন্ত সম্পত্তি হতে।
○
রোজ অরিনের জন্য হালকা স্ন্যাকস্ আনতে গিয়েছিল। একইসাথে গ্রামটাও অল্প পরিসরে তারা ঘুরে দেখে এসেছে। অরিন বাড়িতে প্রবেশ করে যখনই কেনীথ আর কাইরাভকে দেখল,ওমনি সে কেনীথের কাছে দৌড়ে এগিয়ে যায়।
—❝পাপাআআআ! ভাইয়াআআ।❞
অরিন কেনীথের কাছে পৌছাতেই, কেনীথ কাইরাভকে একহাতে নিয়ে থাকা অবস্থাতেই—অন্যহাতে অরিনকে কোলে তুলে নেয়। তৎক্ষনাৎ তাকে দেখেই কাইরাভ খিলখিল করে হেসে ওঠে। তাকে হাসতে দেখে অরিনও হেসে ফেলে। ওর গাল দুটো আলতোভাবে, কপালে চুমু খেয়ে বলে,
❝জানো ছোট্ট ভাইয়া আজ কি হয়েছে?❞
কাইরাভ কিছু বলতে না পারলেও, সে অরিনের অভিব্যক্তিতে প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে মাথা ঝাকায়। ওমনি অরিন কাইরাভ আর কেনীথের উদ্দেশ্য বলে,
❝আমরা যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন রাস্তায় একটা বুড়ো দাদু আমাকে আর এ্যাশ ভাইয়াকে ক্যান্ডি দিয়েছে।❞
এই বলেই সে, তার গাউনের পকেট থেকে একটা পিংক কালারের সাধারণ ক্যান্ডি স্টিক বের করে কাইরাভের হাতে ধরিয়ে দেয়। ওদিকে তার কথা শুনে কেনীথের কপাল যেন কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। এই জায়গায় আসার পর তারা আর সবার মতো স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করলেও, গ্রামের কারো সাথেই তাদের তেমন যোগাযোগ বা কথাবার্তা হয় না। কিংবা কেউ পরিচতও নও।
কেনীথকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে, রোজ নিজেই মুচকি হেসে বলল,
❝আঙ্কেলটা বেশ বয়স্ক ছিলেন। ওদের দুজনকে দেখে নিজে থেকেই দুটো ক্যান্ডি দিয়ে গিয়েছে। অবশ্য এ গ্রামের সকলেই বেশ আন্তরিক।❞
রোজের এ কথা বলার উদ্দেশ্য—কেনীথ যেন বেশি চিন্তিত না হয়। কারণ ব্যাপারটা স্বাভাবিক। যা বোঝামাত্রই কেনীথেরও কপালের ভাজ মিলিয়ে যায়। সেও মুচকি হেসে বলে,
❝যদিও অপরিচিত কারো কাছ থেকে কখনো কিছু নেওয়া ঠিক না। তবে দাদু যেহেতু দিয়েছে, সেক্ষেত্রে নেওয়াই যায়৷❞
কেনীথের সম্মতিতে অরিনও যেন বেশ খুশি হয়। তবে রোজের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে অর্থাৎ রোজের নিজের ছেলে এ্যাশ—একটা শব্দও করে না। বরং চুপচাপ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। অবশ্য সে সবসময় এমন চুপচাপ গম্ভীরই থাকে।
______
এই ফার্ম হাউজে মোটামুটি অনেক ধরনের গবাদিপশু রয়েছে। গরু, ছাগলের পাশাপাশি আনায়া কিছু হাঁস, মুরগী,কবুতরও পালে। সাদা সাদা হাঁসগুলো আবার অরিনের বেশ প্রিয়। তার অবসরের খেলার সাথী সেগুলো।
অরিন একটা সাদা রঙের হাঁস নিয়ে খেলা করছে। অন্যদিক হাতে একটা বই নিয়ে প্রচন্ড মনযোগী হয়ে,চুপচাপ পরিত্যক্ত টায়ারের উপরে বসে বসে রয়েছে এ্যাশ। এখানে কারোর সাথে সে তেমন কথাবার্তা বলে না। এমনকি রোজের সাথেও না। সকলের সাথে তার পরিচয় অল্পদিনের। আর বেশি কথা বলতে তার বিরক্ত লাগে। তবে একজন রয়েছে যার সাথে সে আগ বাড়িতে কথা বলে। আর সে হলো ইনায়া। যে ইনায়াকে সকল বাচ্চার অপছন্দ গম্ভীর স্বভাবের জন্য,এ্যাশের কাছে সেই ইনায়াই প্রিয়।
অরিন কি করছে না করছে, সেদিকে এ্যাশের কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই। আর থাকার কথাও না। ইনায়া যেমন তার সবচেয়ে পছন্দের একজন ব্যক্তি। তেমনি অরিন হলো তার সবচেয়ে অপছন্দের। অরিনের অতিরিক্ত কথাবার্তা কিংবা চঞ্চলতা তার পছন্দ নয়। সবই যেন তার কাছে অপ্রয়োজনীয় লাগে।
ওদিকে অরিন তাকে ছাড়া দুদণ্ড সময় অতিবাহিত করতে পারে না। যতক্ষণ সম্ভব, সে এ্যাশের সাথেই থাকে। এ্যাশ দুনিয়ার যে প্রান্তেই যাকুক না কেনো, ঘুরতে ঘুরতে সে ওখানেই যাবে। এই যেমন, এ্যাশ খানিকটা সময় হলো নিরিবিলিতে এসে বই পড়তে নিয়েছিল৷ কিন্তু অরিন ঠিকই কোলে করে একটা হাঁস নিয়ে তার কাছে হাজির হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত সে এ্যাশের বই পড়া দেখে, তার সাথে কথা বলে বিরক্ত করতে চায়নি । তবে এ্যাশ তার সামনে অথচ সে সারাক্ষণ চুপ থাকতে পারবে, এমনটাও হতে পারে না। যথারীতি কিছুক্ষণের মাঝেই সে এ্যাশের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
❝ ভাইয়া,একটা কথা বলি?❞
এ্যাশ বইয়ের দিকে তাকিয়েই গম্ভীর স্বরে বলে,
❝ না। ❞
—❝প্লিজ,বলি না? শুধু একটা কথা বলব।❞
এ্যাশ এবার আর কিছুই বলে না। বরং অরিন নিজে থেকেই বলতে থাকে,
❝তুমি জানো? আমার পাপার না একটা বিগ ড্রিম রয়েছে।❞
এ্যাশ যেন এবার অরিনের কথায় কিছুটা আগ্রহী হয় না। তবে তা বুঝতে না দিয়ে, শুধু মাথা উঁচিয়ে তার দিকে তাকায়৷ ওমনি অরিন প্রচন্ড হাসিমুখে বলে ওঠে,
❝আমার পাপার ড্রিম হলো, সে নাকি দুইটা ফুটবল টিম বানাবে।❞
অরিনের কথায় এ্যাশের কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। সে কিছুটা সন্দিহান স্বরে বলে,
❝ফুটবল টিম? কিন্তু মামু তো ফুটবল খেলে না।❞
—❝কে বলেছে, পাপা ফুটবল খেলে না! সবাই যখন ঘুমিয়ে যায়, তখন পাপা আর মাম্মাম লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের ভেতর ফুটবল খেলে৷❞
অরিনের এতো আত্নবিশ্বাসী অভিব্যক্তিতে, এ্যাশ কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হেসে বলে,
❝ মিথ্যে কথা, ফুটবল কখনো ঘরের ভেতর অল্প জায়গায় খেলা সম্ভব নয়৷❞
এ্যাশের কথা শুনে অরিনের কপাল কুঁচকে যায়। চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায়। তার কোলে হাঁসটা এখনো চুপচাপ বসে বসে তাদের দুজনকে দেখছে। এদিকে অরিন এ্যাশের উদ্দেশ্যে কিছুটা বিরক্তির স্বরে আওড়ায়,
❝হুঁশ, বেশি বোঝে তুমি৷ পাপা আমাকে এই কথা নিজে বলেছে।❞
—❝তবে তোমার পাপা মিথ্যে বলেছে।❞
এ্যাশের এহেন নির্বিকার কথা শুনে অরিন আচমকাই রেগে গিয়ে বলে,
❝নাহ! আমার পাপা কখনো মিথ্যে বলে না।❞
এ্যাশ তার দিকে নির্বিকারে তাকিয়ে দেখে ভারী শ্বাস ফেলে। অতঃপর একটা কথা না বলেই, সোজা বইয়ের পাতায় নজর ফেলে। তার অভিব্যক্তি এমন যেন,এই মূহুর্তে অরিনকে বোঝানো আর অবুঝকে বোঝানো এক সমান।
এদিকে অরিন যেন এতেই ঘাবড়ে যায় নিমিষেই। এ্যাশ তো এমনিতেই তার সাথে কথা বলতে চায় না। আর যদি এখন সেই রেগে থাকে, তবে তার সাথে কথা হবে কি করে? নিমিষেই সে নমনীয় স্বরে বলে,
❝এশু ভাইয়া, বলছিলাম যে…❞
—❝আমাকে এ্যাশ বলে ডাকবে নয়তো যাস্ট ভাইয়া৷ এমন উল্টোপাল্টা নামে মোটেও ডাকবে না।❞
এ্যাশের গম্ভীর অভিব্যক্তিকে অরিন বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে বলে,
❝আমি তো এশু বলেই ডাকব। এটাই আমার ভালো লাগে।❞
এ্যাশ পুনোরায় চুপ হয়ে বইয়ে মনোযোগ দেয়। কোনো কিছুতেই সে অতিরিক্ত তর্ক করে না। এদিকে অরিন আবারও বলে,
❝আচ্ছা শোনো, আমার একটা ইমপটেন কথা বলার ছিল।❞
—❝ইটস্ ইম্পর্ট্যান্ট, নট ইমপটেন।❞
—❝হু জানি আমি। একটুই তো ভুল হয়েছে, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা আমি আমার আসল কথা বলি।❞
এ্যাশ পুনরায় চুপ, ওদিকে অরিন কিছুটা হতাশ হয়ে পুনোরায় উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে,
❝আমরা দুজন যখন বড় হবো, তখন আমরা বিয়ে করব।পাপা দুইজোড়া ফুটবল টিম বানাবে, আর আমরা চারজোড়া। ঠিক আছে?❞
—❝না, ঠিক নেই। আমি তোমাকে বিয়ে করব না।❞
নিমিষেই অরিনের মনখারাপ হয়। খানিকটা ঠোঁট উল্টে বলে,
❝কিন্তু কেনো?❞
—❝কারণ তোমাকে আমার পছন্দ নয়।❞
মুখের সামনে নির্বিকারে এমন কথায় ,অরিন আরো বেশি হতাশ হয়ে বলে,
❝আচ্ছা তুমি এমন কেনো বলোতো?❞
—❝সরি, আমি এমনই।❞
—❝আমাকে তোমার সত্যিই পছন্দ নয়, তাই না?❞
—❝হুম।❞
নিমিষেই অরিন কিছু একটা ভাবতে লাগে। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বলে ওঠে,
❝কিন্তু আমার তো তোমাকে অনেক পছন্দ।তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। জানো,তোমার ঐ গাল দুটো অনেক বেশি সুন্দর। একদম আমার এই হাঁসের পাছার মতো।❞
এই বলেই অরিন কোলের মধ্যে উল্টো ঘুরে বসে থাকা, হাঁসের পশ্চাতে একটা সজোরে চ’ড় মারে। ওমনি হাঁসটা “প্যাক” “প্যাক” শব্দে আওয়াজ করে ওঠে। এদিকে অরিনের এহেন কথা শুনে এ্যাশ বিস্মিত। সে প্রানবন্ত হাসিতে হাস্যজ্জ্বল অরিনের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। শেষে কিনা, হাঁসের পশ্চাতের সাথে তার গালের তুলনা?
চলবে_________