একঝাঁক জোনাকি পর্ব-০১

0
178

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ০১

নিজের স্বামীর মোবাইলের ওয়েলপেপারে অন্য মেয়ের ছবি দেখে স্তব্দ হয়ে গেল অনিমা।ওর মাথায় যেন আকাশ ভেংগে পরেছে।কি করে এমনটা করল সোহান ওর মাথাটাতেই আসছে না।এর মধ্যেই সোহান এসে বলল,

“খিদে পেয়েছে৷ খাবার দাও।”

বলে অনিমার হাতে মোবাইল দেখেই তড়িৎগতিতে মোবাইলটা নিয়ে নিল সে।রাগী কন্ঠে বলল,

“আমার মোবাইল আমার পারমিশন ছাড়া ধরেছো কেন?”

অনিমা শান্ত কন্ঠে বলল,

“টাইম দেখার জন্য।জানোই তো আমাদের বাসার ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।আর আমারও কোন মোবাইল নেই।বাসায় মোবাইল বলতে একটাই আছে৷ তোমারটা!তাই তোমার মোবাইলটা ধরতে বাধ্য হলাম।”

অনিমার মুখে এমন শান্ত কথা শুনে ঘাবড়ে গেল সোহান।এই মুহূর্তে কোন মেয়ের মুখে শান্ত কথা মানায় না।কোন মেয়েই তার স্বামীর ওয়েলপেপারে অন্য মেয়ের ছবি দেখে শান্ত থাকতে পারে না।সেখানে অনিমা কি করে শান্ত আছে তাই ভেবে পাচ্ছেনা সোহান।

“তোমার কি শরীর খারাপ?অসুস্ত তুমি?এত শান্ত আছো কি করে?”

অনিমা কিছু না বলে হাসলো শুধু।সোহান অনিমার চোখের কোণে হালকা পানি দেখতে পেল।মেয়েটা এরকম একটা মুহুর্তে কি করে হাসছে তাই বোধগম্য হচ্ছে না তার। তবে কি অতি শোকে পাগল হয়ে গেল অনিমা?
এসব ভাবতে ভাবতেই অনিমার কন্ঠ শুনতে পেল সোহান।ভাত খাবার জন্য ডাকছে।সোহান চেয়ার টেনে বসে বলল,

“তোমার কাছে কিছু কথা আছে আমার।”

“বলো।”

“আসলে আমি একটা মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছি।জানি এটা অন্যায়।কিন্তু আমি নিজেকে থামাতে পারিনি।নিজের অনুভূতিগুলোকে আটকে রাখতে পারি নি৷ তাই…..”

সোহানের কথা শেষ হবার আগেই অনিমা বলল,

“তাই আমার কাছে ডিভোর্স চাচ্ছো? সমস্যা নেই আমি দিয়ে দিব।”

“তোমার আমার উপর কোন ক্ষোভ নেই?”

অনিমা হেসে বলল,

“ভালোবাসা তো কোন অপরাধ না।আমি চাই না শুধুমাত্র আমার কারনে কারোর ভালোবাসা অপূর্ণ থাকুক।যে যেতে চায় তাকে চলে যেতে দেওয়াই উচিত।আটকে রেখে কোন লাভ নেই।”

বলেই চলে যেতে নিলে সোহান বলল,

“ভাত খাবে না?”

“নাহ,খিদে নেই আমার।”

বলেই রুমে এসে দরজা আটকে খাটে শুয়ে পরল।ও বুঝতে পারছে ওর চোখে পানি আটকে আছে।খুব করে কান্না আসছে ওর।বুকে রক্তক্ষরন হচ্ছে মনে হচ্ছে কেও ছুড়ি দিয়ে বারবার আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলছে।কষ্টগুলা গলার কাছে ঢলা পাকিয়ে আসছে।সোহান তার সাথে এমন কেন করল?

সোহান সকালে উঠে অনিমার ঘরের সামনে গিয়ে দেখল দরজা খোলা।কালকে রাতে ওরা দুজন আলাদা রুমে ঘুমিয়েছে।অনিমা উঠল কখন?আর উঠলেও ওকে দেখল না কেন ভাবতে ভাবতেই রুমে প্রবেশ করে টয়লেটের সামনে গিয়ে দেখল অনিমা আছে কিনা।নাহ নেই।কোথায় গেল মেয়েটা?ঘর থেকে বের হতেই যাবে এমনসময় খাটের পাশের টেবিলে কাগজ দেখতে পেল।কাগজটা খুলতে দেখল,

“আমি চলে যাচ্ছি।এই সংসারে আমার আর কোন অধিকার নেই।চিন্তা করো না ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিও।সাইন করে দিব।আর আমার সামনে এসো না কোনদিন।ভালো থেকো!”

হাতে ব্যাগ নিয়ে রাস্তার ধারে হাঁটছে অনিমা।আনমনে ভাবতে ভাবতে কখন রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে বুঝতে পারেনি সে।যখন বুঝতে পারল তখন দেখল সামনে তাকাতেই দেখল একটা ট্রাক ওর দিকে স্বজোরে এগিয়ে আসছে।এখনই বুঝি ওর জীবনের অধ্যায় সম্পন্ন হবে?আচ্ছা সোহান কি আমার মৃত্যুর খবর পেয়ে মন খারাপ করবে নাকি খুশি হবে?নিশ্চয়ই খুশি হবে।ভাবতেই ভাবতেই গাড়িটা খুব কাছে এসে পরতেই কেও একজন হাত টেনে সাইডে নিয়ে আসল।টাল সামলাতে না পেরে দুইজনেই রাস্তায় পরে গেল।অনিমা সামনে তাকাতেই একটা অচেনা লোকের দেখা পেল।কিন্তু বেশিক্ষন দেখতে পারল না চোখের সামনে সবকিছু আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যেতে লাগল।আর তারপর সব অন্ধকার!
জ্ঞান ফিরে চোখ খুলতেই সামনে সেই আবার অচেনা মানুষটাকে দেখতে পেল।শুয়া থেকে উঠতে যেতেই লোকটা বাধা দিয়ে বলল,

“উঠবেননা না প্লিজ!আপনার হাতে সেলাইন চলছে।”

অনিমা হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সেটা।
লোকটা আবার বলতে শুরু করল,

“একটু দেখে শুনে হাঁটবেন তো!আমি না থাকলে কি হতো আপনাদের আল্লাহই জানে!”

অনিমা ভ্রু কুঁচকে বলল,

“আমাদের মানে?”

লোকটা অবাক হয়ে বলল,

“আপনি জানেন না?আপনি একা না আপনার গর্ভে একজন আছে।১ মাস হয়েছে আপনি অন্তঃসত্ত্বা।আমি বুঝে পাই না আপনাকে আপনার হাজবেন্ড এরকম একটা সময়ে একা ছাড়লো কিভাবে?এইরকম একটা সময়ে তো দেখে শুনে রাখতে হয়।নাকি আপনার পরিবারের কেও আপনার মতো জানেনা যে আপনি প্রেগন্যান্ট! ”

লোকটার কথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না।কানে শুধু বাজছে সে ১ মাসের অন্তঃসত্ত্বা!এখন এই বাচ্চাকে কি করবে সে?এই বাচ্চাকে নিয়ে কই যাবে?সোহানের কাছে ফিরে যাবে?নাহ এ হয় না।ওর বাড়ি থেকে একেবারের জন্য চলে এসেছে সে।তাহলে বাচ্চাটাকে কি এর্বোশেন করিয়ে ফেলবে?কিন্তু বাচ্চাটার তো এতে কোন দোষ নেই।এমনোটা না যে বাচ্চাটা অবৈধ।তাহলে কিসের ভিত্তিতে সে মেরে ফেলবে বাচ্চাটাকে?একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে সে সামান্য ওর বাবা নেই বলে মেরে ফেলবে?নাহ!বাচ্চাটাকে সে নিজের হাতে লালন পালন করবে।বড় করবে। কিন্তু সোহান যদি পরবর্তীতে বাচ্চাটার উপর অধিকার দেখায়?নাহ!সোহানের ছায়া পরতে দেবে না সে।আগলে রাখবে নিজের কাছে।

“এইযে হ্যালো মিস!কথা বলছেন না কেন?কি এত ভাবছেন?

লোকটার কথা শুনে চিন্তার জগত থেকে বেরিয়ে আসল অনিমা।

“বিল কত এসেছে?”

“বিল নিয়ে আপনার কোন টেনশন করতে হবে না।আমি আপনার থেকে কোন ফি নিব না।জাস্ট সেলাইনই লেগেছে আপনার চিকিৎসায়। সবচেয়ে বড় কথা সেলাইনটা হাসপাতালে ফ্রি। তাই আপনাকে কোন টাকা দেওয়া লাগবে না।”
অনিমা বুঝতে পারল যে লোকটা একজন ডাক্তার।

“তাহলে আমি আসি?”

“হুম এখন আপাতত আপনি সুস্ত।আপনি আসতে পারেন।”

অনিমা বেড থেকে উঠে চলে যেতে নিলেই পিছন থেকে লোকটা বলে উঠল,

“আমি জানিনা আপনার লাইফে কি হয়েছে আর জানতেও চাই না।তবে বুঝতে পারছি খারাপ কিছুই ঘটেছে।তবে মনে রাখবেন জীবনে যত খারাপ কিছুই ঘটে যাক না কেন আপনি এখন আর একা নন।আপনার মাঝে আরেকটা প্রান বেড়ে উঠছে।তার কথা ভেবে হলেও আশা করি আত্মহত্যার মতো পদক্ষেপ নিবেন না।আত্মহত্যা কোনকিছুর সমাধান নয়।বরং তখন আম যদি আপনাকে না বাঁচাতাম তাহলে আপনি মারা যেতেন।আপনার মাঝে যে আরও একটা প্রান বড় হচ্ছে সেটা না জেনেই নিজেকে সহ অই প্রানটাকে খুন করে ফেলতেন। তাই বলছি আত্মহত্যা কোনকিছুর সমাধান নয় আশা করি আপনি নিজের আর নিজের বাচ্চার জন্য সাবধান থাকবেন।বাচ্চার কথা ভেবে হলেও অইরকম বাজে ডিসিশন নিবেন না।”

অনিমা কিছু না বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসল।রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেটে হাত রেখে ভাবল,
আমি কিনা অই লম্পটটার জন্য নিজেকে আর নিজের বাচ্চাকে শেষ করে দিতে চাইছিলাম!নাহ!আমাকে বাঁচতে হবে।এই বাচ্চাটার জন্য হলেও আমাকে বাঁচতে হবে।বাচ্চাটাকে একমাত্র অবলম্বন করে নিয়ে বাঁচবে সে।

অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসল সে।আজকে তার ছোট বোন তিথিকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে।মা কড়া করে বলে দিয়েছেন রুম থেকে এক পা ও বের না হতে।কারন তারা যদি জানেন বড় বোন আর বড় বোনের হাজবেন্ড আলাদা থাকে তাহলে বিয়েটা ভেংগেও দিতে পারেন।পাত্র অনেক ভালো, উচ্চশিক্ষিত, ভদ্র,নম্র।এমন যোগ্য পাত্রকে তারা হাতছাড়া করতে চান না।
অনিমা দরজা আটকে ঘরেই বসে ছিল হঠাত তার পানির পিপাসা পেল অনেক । অনেকক্ষন নিজেকে আটকে রাখল৷ ভাবল ওরা গেলেই পানি খেতে যাবে।পরক্ষনেই ভাবল চুপি চুপি নিয়ে আসলে তো কোন সমস্যা হবে না।এই ভেবে দরজা খুলে টেবিলে সামনে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে এক ঢোকে সব পানি খেয়ে পিছনে ফিরতেই মাকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল।

নিহান পাত্রী দেখতে এসেছে। সোফায় বসে আছে সে।পাত্রী মাথায় লম্বা ঘোমটা দিয়ে শরবত নিহানের দিকে এগিয়ে দিতেই ভুলক্রমে শরবতটা নিহানের শার্টের উপর পরে যায়।
পাত্রী অর্থাৎ তিথি সরি বলতে যেতেই নিহান বলে উঠে,

“ইট’স ওকে।ওয়াশরুমটা কোনদিকে?”

তিথি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিতেই নিহান বেসিনের সামনে যেয়ে শার্টটা টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করছিল।হঠাত জোরে কথা বলার শব্দ শুনে ফ্রেশ হয়ে একটু সামনে যেতেই অনিমার কান্নারত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল।চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না যে এই মেয়েটাই অই হাসপাতালের মেয়েটা।যাকে সে এক্সিডেন্ট হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিল।কিন্তু তিথির মা এভাবে উনাকে বকছেন কেন?বোধগম্য হয় না নিহানের।

“তোকে না বললাম বাইরে না আসতে? তুই কি চাস না আমার মেয়েটার বিয়ে হোক!নিজে তো অপয়া। যেখানে যাস সর্বনাশ ঘটিয়ে তবেই ছাড়িস।নিজের হাজবেন্ডকে আটকে রাখতে পারলি না আর এখন আমার মেয়ের বিয়ে ভাংগার পরিকল্পনা করছিস?”

তিথির মার মুখে এমন কথা শুনেই নিহান পিছন থেকেই বলে উঠল,

“আন্টি!আপনি এ যুগে বসবাস করেও অপয়া, অলক্ষী এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন?”

নিহানের কন্ঠ শুনেই অনিমা আর তিথির মা দুজনে
চমকে পিছনে তাকালো।

“উনার হাজবেন্ড উনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে এতে তো উনার কোন দোষ নেই।তাহলে কেন উনাকে অপয়া বলছেন?আর উনি উনার নিজের বোনের কাছে থাকবে এতে বিয়ে না হবার সাথে সম্পর্কটা কোথায়?আমি তো এটা বুঝতে পারছি না।”

তিথির মা একটু হেসে বললেন,

“দেখো বাবা তুমি ভুল ভাবছো।আমি কথাটা অইভাবে বলিনি।আমি জাস্ট ওকে একটু শাসন করছিলাম।আসলে মাথায় একটু সমস্যা আছে তো ওর তাই যেতে মানা করছিলাম।যদি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে!”
নিহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার বাবা ওকে ডাকল।বাবার ডাক শুনে নিহান বলল,

“আন্টি আপনি আসেন আর উনাকেও সাথে নিয়ে আসেন।কিছু কথা আছে আমার।”

বলেই নিহান চলে গেল ড্রয়িংরুমের দিকে।তিথির মা আর অনিমা আসতেই নিহানের বাবা তিথির মাকে বললেন,

“তাহলে বিয়ের তারিখটা ঠিক করে ফেলি।আমাদের আপনার মেয়েকে অনেক পছন্দ হয়েছে।আজকালকার যুগে এমন ভদ্র মেয়ে পাওয়া যায় না।তাই আমরা চাচ্ছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সারিয়ে নিতে।এমন লক্ষী মেয়ে হাতছাড়া করতে চাচ্ছি না।”

তিথির মা হেসে বললেন,

“আলহামদুলিল্লাহ!আমাদের কোন অসুবিধে নেই।”
নিহানের মা নিহানের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এতে তোর কোন আপত্তি নেই তো?”

উত্তরে নিহান যা বলল তাতে ঘরের উপস্তিত সবাই অবাক হয়ে তাকাল নিহানের দিকে।
চলবে…..

চলবে।