একঝাঁক জোনাকি পর্ব-০৮

0
171

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ০৮

সোহান অনিমাদের বাড়ির সোফায় বসে আছে।অনিমার মা এক গ্লাস শরবত এনে টেবিলের উপর রাখল।এমনেতেই যা গরম পরেছে ঠান্ডা শরবত দেখে সে নিজেকে সামলাতে পারলো না।এক ঢোকে পুরো গ্লাস খালি করে টেবিলের উপর খালি গ্লাসটা রেখে বলল,

“আমাকে ডেকেছিলেন কেন?আমি যা বলার অনিমাকে বলে দিয়েছি।সে কি আপনাদের বলেনি কিছু?”

“হ্যা বলেছে।”

“তাহলে আমার এত মূল্যবান টাইম নষ্ট করার মানে কি?আপনি জানেন আমি আজাইরা বসে থাকি না।কত কাজ থাকে আমার।আমি সেই কাজ ফেলে এখানে এসেছি।”

“শান্ত হও বাবা!এত অল্পতেই রেগে গেলে হয় নাকি।শুনো তোমাকে যে কথা বলতে ডেকেছি সেটা তোমার এবং আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ”

“কিসের জন্য ডেকেছেন সেটা যদি বলতেন তাহলে অনেক উপকার হতো!তাড়াতাড়ি বলেন!আমার কাজ আছে।”

অনিমার মার অনেক রাগ হলো সোহানের উপর।ইচ্ছা করছে সোহানের গালে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে কড়া কয়েকটা কথা শুনাতে।একেতো অনিমার সাথে চিট করছে তার উপর এখন বড় বড় গলায় কথা বলছে।ধমক দিচ্ছে।মনে হচ্ছে যেন দোষটা ও করে নাই অনিমা করছে।কিন্তু এমন একটা সময় নিজেকে রাগতে দিলে হবে না।ঠান্ডা রাখতে হবে মাথা।ঠান্ডা রাখলে তো ওরই লাভ।মেয়ের বিয়ে ডাক্তারের সাথে হবে।এর থেকে বড় লাভ কি আর আছে? নাহ রেগে গেলে হবে না।ভেবে নিজেকে দমিয়ে নিলেন।একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“অনিমা যে প্রেগন্যান্ট তা কি তুমি জানো?”

সোহান প্রথমে অবাক হলো। কই অনিমা তো এই কথা বলেনি।নিজেকে সামলিয়ে বলল,

“তো?অনিমা প্রেগন্যান্ট আমি কি করব?ওর সাথে এখন আমার কোন সম্পর্ক নেই। ডিভোর্স হয়ে গেছে আমাদের।আর ওর থেকে মতামত নিয়েই হয়েছে।নিজ ইচ্ছায় আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।কোন জোড়াজোড়ি করিনি আমি।তাহলে এখন আমাকে এসব জানাচ্ছেন কেন?”

অনিমার মা হাসলো।ছেলেটা এত বোকা কেন?ভেবে আরেকটু হেসে সামনের টেবিল থেকে চায়ের কাপটা এক চুমুক দিয়ে বলল,

“তুমি যে কথাগুলা বলছ সেটা আমিও জানি।আমিও জানি যে অনিমা নিজ ইচ্ছায় তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।কোন ফোর্স করোনি সাইন করাতে।কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই জানো প্রেগন্যান্ট অবস্তায় বিবাহিত দম্পতির মাঝে কোন প্রকার ডিভোর্স হয়না।ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী তোমরা এখনো আলাদা হওনি!অনিমা নিহাত ভালো শান্ত শিষ্ট মেয়ে বলে তোমাকে কিছুই বলেনি।কিন্তু ওর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে থাকলে তোমার করা অন্যায় মেনে নিতো না কোনদিন।”

“আপনি আমাকে এখন এসব কথা কেন বলছেন?আমি তো জানতাম না ও প্রেগন্যান্ট!এতে আমার দোষ কোথায়?”

“জানতে না এখন তো জেনেছো!আমি চাইছি তুমি অনিমাকে মেনে নাও।আবার ফিরিয়ে নাও।এটলিস্ট বাচ্চাটা হওয়ার আগ পর্যন্ত।বাচ্চাটা হয়ে গেলে তোমরা আলাদা হয়ে যেও।”

“মানে?এসব কি বলছেন?আমি যাকে ভালোবাসি তার কি হবে?কয়দিন বাদেই আমরা বিয়ে করব।”

“তোমার ভালোবাসার মানুষের কি হবে সেটা আমি কি করে জানবো?আমি আমার ডিশিসন জানিয় দিয়েছি।আর তুমি যদি তা না মানো তাহলে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো।আমাকে অনিমার মতো নরম মনের ভেবো না।দুনিয়া উল্টে গেলেও আমি যা বলি তাই করি।তোমার ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হবে না।”

“আমি অনিমার সাথে দেখা করতে চাই।ও কোথায়?যা কথা বলার আমি ওর সাথে বলব।”

“ওকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তো তোমার!আমি কি করে জানবো?”

সোহান ভ্রু কুঁচকে বলল,

“মানে?অনিমা কি এই বাসায় নেই?”

“না।”

“কেন?ওর তো এ বাসাতেই থাকার কথা ছিলো।”

“ছিলো!বাট ও চলে গিয়েছে।”

“আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

সবকথা শুনে সোহান রেগে বলল,

“আপনারা একজন অচেনা ছেলের সাথে কিভাবে যেতে দিলেন অনিমাকে?”

“আমাদের কি দোষ অই ছেলে হাত ধরে নিয়ে গেছে। জোর করে।অনিমারও যাবার কোনই ইচ্ছা ছিলো না।”

“অই ছেলের চেম্বারের ঠিকানা, বাসার ঠিকানা দিন।নিশ্চয়ই অনিমাকে নিজের বাসাতে রেখেছে।”

“নাহ্!ও নিজের বাড়িতে অনিমাকে রাখলে ওর মা বলতো আমাকে।আমি সিউর নিহান ওকে ওর বাড়িতে তুলেনি।অন্য কোন জায়গায় রেখেছে।”

“তাও দিন।ওর মা-বাবার জানা উচিত যে উনার ছেলে জোর করে অন্যের মেয়েকে নিজের কাছে আটকে রেখেছে।আমি জানাবো উনাদের।”

“তোমার যা মন চায় করো।”

সোহানের হাতে ঠিকানা দিতেই সোহান বেরিয় পরল।অনিমার মা হেসে মনে বললেন,

“এখন আমার মেয়ের বিয়ে কেও আটকাতে পারবে না।নিহানের সাথেই ওর বিয়ে হবে।অনিমা,খুব ভেবেছিলি একটা ডাক্তার, বড়লোক ছেলেকে নিজের বশে এনে বিয়ে করে ফেলবি।তোর সব আশায় আমি এক বালতি পানি ঢেলে দিলাম।তোর বাচ্চাটা হবার আগ পর্যন্ত সোহান তোকে মেনে নিতে নিতে তিথির সাথে নিহানের বিয়েটা হয়ে যাবে।আর বিয়েটা হয়ে গেলে সোহান যদি তোকে লাথি দিয়ে বেরও করে দেয় তাহলেও আমার কিছুই আসবে যাবে না।জাস্ট কয়েকটা মাস!আহারে!তোর আর সুখের মুখ দেখা হলো না।যেই দুঃখী কপাল নিয়ে জম্মেছিস সে দুঃখী কপাল নিয়েই সারাজীবন থাকা লাগবে তোর!তোর দুঃখে আমার এত কান্না পাচ্ছে কেন?”

ভেবেই হাসতে লাগলেন।
.
.
অতীত,

অনিমা স্কুল শেষে কোচিং করে বাসায় ফিরছিলো।এই কোচিংটাও না কেন যে স্কুল ছুটির পরপরই ক্লাস করায় কে জানে?এত কি এনার্জি থাকে?টানা ৫ ঘন্টা ক্লাস করে কোচিংয়ের জন্য আবার ১ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা লাগে।তখন মিস ছোট ক্লাসের মেয়েগুলাকে পড়ান।ওদের ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়েই যাদের বাসা কোচিংয়ের কাছাকাছি তারা বাসায় গিয়ে অই এক ঘন্টায় খেয়ে দেয়ে,ড্রেস চেঞ্জ করে রেস্ট নিয়ে ক্লাস করতে আসে।কিন্তু অনিমার বাসা একটু দুরে হওয়ায় বাসায় গিয়ে আর রেস্ট নেওয়া হয়না।সরাসরি স্কুল শেষ করেই কোচিংয়ের জন্য বসে থাকে ওয়েটিং রুমে।সেই ক্লাস শেষ করেই আস্তে ধীরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো অনিমা।হাতে একটা ছাতা।বৃষ্টি পরছে।চারদিক বৃষ্টিকে আবছা হয়ে আছে।হাতের কাছে একটা টাকাও নেই যে রিকশা করে যাবে।হাঁটতে হাঁটতেই একটা ফোঁপানো আওয়াজ পেলো।মনে হচ্ছে সামনের গলিটার ভিতর থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে।অনিমার ভ্রু কুঁচকে এলো।কয়েক পা এগিয়ে গেলো। দুই কদম হেঁটেই থামিয়ে নিলো নিজেকে।কি করতে যাচ্ছিলো সে?এই বৃষ্টির মধ্যে একা একটা মেয়ে হয়ে সামান্য কান্নার আওয়াজ শুনে গলির ভিতর ঢুকতে যাচ্ছিলো?যদি ফাঁদ হয় এটা?ওকে বোকা বানানোর জন্য। এখনকার যুগে কাওকেই বিশ্বাস করতে নেই। ভেবেই নিজেকে সামলিয়ে পিছনে ফিরর যাবার জন্য পা বাড়াতেই আবারও কান্নার আওয়াজ কানে এলো।আচ্ছা ও যা ভাবছে তা যদি না হয়?যদি সত্যিই কারোর সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাহলে?সামান্য সন্দেহের জন্য, নিজের ভালোর জন্য একজনের যদি ক্ষতি হয়ে যায়?নাহ,গিয়ে দেখা উচিত।খারাপ কিছু হলে বা কারোর ফাঁদ হলে তা থেকে বেরিয়্র আসার ক্ষমতা অনিমার আছে।ভেবেই বুকে ফুঁ দিয়ে মনে সাহস জুগিয়ে গলির দিকে এগিয়ে গেলো।গলির কাছাকাছি আসতেই উঁকি দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখল একটা ছেলেকে ঘিরে বাকি ৪,৫ জন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।মাঝে থাকা ছেলেটা ভয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।আর বাকি ছেলেগুলা তা দেখে মজা নিচ্ছে।অনিমা আড়াল থেকে বেরিয়ে ধমক দিয়ে বলল,

“কি হচ্ছে কি এখানে?”

অনিমার কন্ঠ শুনে ছেলেগুলা অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

“আপু”
আমাদের ব্যাপার আমাদেরকে সলভ করতে দিন।প্লিজ আমাদের মাঝে আসবেন না।”

“আমি তোমাদের মাঝে আসব না।আসতেও চাইনি।কিন্তু একটু আগে দেখলাম পুলিশ গাড়ি করে এদিকেই আসছে।যদি ওরা দেখে তোমরা মিলে একটা ছেলেকে অত্যাচার করছো তাহলে কিন্তু জেলে নিয়ে যাবে তোমাদের। মা -বাবা ডাকাবে।সেটাকি খুব বেশি ভালো হবে?”

“সত্যি বলছো ?”

“হ্যা!বিশ্বাস না হলে ওয়েট করতে পারো।যখন আসবে তখন আমাকে কিছু বলতে পারবে।তোমাদের বড় বোন হিসেবে জাস্ট আমার দায়িত্ব পালন করলাম।”

ছেলেগুলা অনিমার কথা শুনে দৌড়ে পালিয়ে গেল।অনিমা ওদে দৌড় দেখে হেসে সামনে তাকাতেই দেখল ছেলেটা মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে।ভয়ে কাঁপছে।অনিমা কয়েক পা এগিয়ে ছেলেটার দিকে হাত বারিয়ে দিয়ে বলল,

“কোন ভয় নেই!ফাজিলগুলা চলে গেছে।উঠো!”

ছেলেটা মাথা উচু করে অনিমার দিকে তাকালো।চোখে মুখে এখনো ভয়ের ছাপ উপস্তিত।অনিমাকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।অনিমা হেসে হাটু মুড়ে নিচু হয়ে বলল,

“ওরা তোমার কিছু করতে পারবে না।আমি এসে গেছি পিচ্চি।উঠো।যেভাবে বৃষ্টিতে ভিজছো ঠান্ডা লেগে যাবে তো!আর তোমার মুখে রক্ত লেগে আছে কেন?ওরা কি তোমায় মেরেছে?”

ছেলেটি কোন উত্তর দিলো না।চুপচাপ তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে।অনিমা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

“আচ্ছা বলতে হবে না তোমায়। আমার হাত ধরে দাঁড়াও।”

ছেলেটা অনিমার হাত ধরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

“পুলিশ কি সত্যিই আসছে এদিকে?”

চলবে…..