#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১৫
অনিমা হাঁটতে হাঁটতে একবার নিহানের দিকে তাকালো।নিহান খুশি মনে সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে।অনিমা কিছু একটা ভেবে চিন্তে বলল,
“আপনি আমাকে আপনার হাসপাতালে নিয়ে যান নি কেন?”
অনিমার কথা শুনে নিহান ভ্রু কুচকে বলল,
“মানে?আপনার কথাটা বুঝিনি!একটু ক্লিয়ার করে বলুন।”
“আপনি চাইলেই আল্ট্রাসনোগ্রাফিটা আপনার হাসপাতালে করাতে পারতেন তা না করে আপনি অন্য একটা হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন!কারনটা জানতে পারি? ”
“আপনার কথা ঠিক।আমি চাইলেই আপনাকে আমার হাসপাতালে নিয়ে চেক আপ করাতে পারতাম।কিন্তু হাসপাতালের কম বেশি সব ডাক্তারই আমাকে চিনে।ওরা জানে আমি এখনো বিয়ে করিনি।পাত্রী খুঁজা হচ্ছে আমার জন্য। এখন আমি যদি আপনাকে চেকাপের জন্য নিয়ে যাই তখন ওরা প্রশ্ন করবে।”
“আর ওদের প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে নেই তাই তো?”
“মোটেও না!আমি যে আমার জন্য আপনাকে নিয়ে যাইনি বিষয়টা তা না।আপনাকে ওরা বিভ্রান্তিতে ফেলবে বলেই নিয়ে যাইনি।আমি চাইনি আপনাকে ওরা কোনভাবে হ্যারেসম্যান্ট করার সুযোগ পাক।”
নিহানের কথা শুনে অনিমার মন খারাপ হয়ে গেলো।লোকটা ওকে নিয়ে এত চিন্তা করে কিন্তু ও কিনা নিহানকে কি না কি ভেবেছিলো?খারাপ লাগছে নিজের কাছে।
“আপনার প্রশ্ন বা কৌতুহল কি আমি ক্লিয়ার করতে পেরেছি?”
“হুম।”
নিহান হেসে সামনের দিকে এগুলো।একটু আগাতেই হঠাত সামনে তাকিয়ে এক কাপলের দিকে নজর গেল নিহানের।একটু ভালো করে দেখতেই বুঝল ছেলেটা সোহান।নিহান সাথে সাথে পিছনে তাকালো।দেখল অনিমা মাথা নিচু করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে।তারমানে অনিমা এখনো সোহানকে দেখেনি।দেখতে দেওয়া যাবে না।মোটেও না।ভেবেই অনিমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।নিহানকে হুট করে সামনে দাঁড়াতে দেখে অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।আরেকটু হলেই ঢাক্কা লাগতো বড় সড়ো।এভাবে হুট করে কেও সামনে এসে দাঁড়ায়?অবাক কন্ঠে বলল,
“সামনে দাঁড়ালেন যে?”
নিহান এখন কি উত্তর দিবে?কিছু একটা বলা লাগবে।যেভাবেই হোক এখান থেকে অনিমাকে সরাতে হবে।নইলে সোহানকে দেখে আবার আগেরবারের মতো খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিবে।নাহ্!কিছু তো একটা বলতেই হবে।কিন্তু কি বলবে?অনিমা এখনো উত্তরের আশায় নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে।
“তেল!”
অনিমা ভ্রু কুচকে বলল,
‘তেল মানে?”
“তেল মানে বাসায় তেল নেই।আসার সময় একটা দোকান দেখলাম!চলুম অইখান থেকে তেল কিনে আনি।”
“তেল তো বাসার সামনের দোকান থেকেও কিনা যাবে।এখান থেকেই কেন?”
“এখানের তেল অরজিনাল হয়।কোন ভেজাল নেই।বাসার সামনের তেলগুলা সব দুই নাম্বার।”
“দুই নাম্বার?”
“হ্যা! তাঁড়াতাঁড়ি চলুন।দেরি হয়ে যাবে নইলে।”
নিহানের সব কথা অনিমার মাথার উপর দিয়ে গেছে।কোন কিছুই বুঝতে পারে নি সে।কিন্তু না যেয়ে উপায়ও নেই।ভেবেই বলল,
“চলুন।”
নিহান অনিমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল সোহান আর মেয়েটা আইস্ক্রিম খাচ্ছে।শান্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল।কিন্তু ওদেরকে দেখতে বিরক্ত লাগছে কেন?এমন তো নয় ও জীবনেও কাপল দেখেনি।আর দেখেও কোনদিন বিরক্ত আসেনি।তাহলে ওদের ক্ষেত্রে কেন বিরক্ত লাগছে।অনিমার জন্য?বোধ হয়।অনিমাকে কষ্ট দিয়েছে দেখেই মনে হয় ওদের উপর রাগ হচ্ছে নিহানের।বিরক্ত হচ্ছে দেখে।
“পিছনে তাকিয়ে কি দেখছেন?”
“কিছুনা!”
অতীত,
অনিমা রাতের বেলা ঘরের সব কাজ শেষ করে ছাদে এসেছিলো কাপড় মেলতে।ঘরের সব কাজ শেষ করে কাঁপড় ধুতে ধুতে রাত হয়ে গেছে।হাতে বালতি নিয়ে ছাদের দিকে এগুচ্ছে আর ভয়ে বুক কাঁপছে।এই রাতের বেলা ছাদে যাওটাই সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার।এত ভয় পাওয়ার কি আছে?ছাদে কি বাঘ না ভাল্লুক আছে যে খেয়ে ফেলবে?ভুত আত্মা বলতে কিছু হয় না।হুদাই ভয় পাচ্ছে সে।এত বড় মেয়ে কিনা ভুতের ভয়ে ছাদে যেতে ভয় পাচ্ছে ছিহ!বড়ই লজ্জাজনক ব্যাপার।কিছুই হবে না।ভেবে নিজেকে শান্ত করে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলো।ছাদের দরজা খুলে বালতিটা মাটিতে রেখে মনে মনে বলল,
“ব্যাস!কয়েকটা কাঁপড়।মেলতে বেশি একটা দেরি হবে না!৫ মিনিটেই হয়ে যাবে।ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।”
ভেবে একটা জোরে শ্বাস নিয়ে একটা কাপড় বালতি থেকে নিয়ে মেলতেই যাবে হঠাত আবছা আলোয় কারোর ছায়া দেখে চমকে উঠলো অনিমা।নাহ চিৎকার দেওয়া যাবে না।আশেপাশের বিল্ডিং থেকে আসা হালকা আলো দিয়ে জাস্ট ছায়ার মতোই দেখা যাচ্ছে।মনে মনে সাহস নিয়ে ওড়নার গিট্তু থেকে টর্চলাইট টা বের করল।ভেবেছিল টর্চলাইট ছাড়াই বুঝি কাঁপড় মেলে চলে আসবে।কিন্তু এখন টর্চ লাইটটাই কাজে এসেছে।ভাগ্যিস নিয়ে এসেছিলো টর্চ লাইটটা।নইলে কি যে হতো।টর্চের লাইট জ্বালিয়ে বুকে সাহস নিয়ে ছায়াটার দিকে নিক্ষেপ করতেই দেখল মাহির বসে আছে।এত রাতে ছাদে মাহিরকে বসে থাকতে দেখে অনিমার ভ্রু কুচকে এলো।কিছুটা সামনে গিয়ে দেখলো সত্যিই মাহির।
“মাহির!”
মাহির একবার মাথা উচু করে অনিমার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বসে রইল হাঁটু মুড়ে।
“এত রাতে এখানে কি করছো?”
মাহির কোন উত্তর দিলো না।একভাবেই বসে রইল।অনিমা একটু ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো।ছেলেটা কাঁপছে। কিন্তু এখানে তো কোন বাতাস নেই বা শীতকাল না যে কাঁপবে।যে গরম পরেছে এমন একটা আবহাওয়ায় শীতে কাঁপার কোন মানেই হয় না!তবে কি ভয়ে কাঁপছে?কিন্তু কিসের?এখন প্রশ্ন করলে কোন উত্তরই পাওয়া যাবে না।পরে প্রশ্ন করা লাগবে।
“আচ্ছা তোমার কোন উত্তর দিতে হবে না।আমি এখানে কাপড় শুকাতে এসেছিলাম।কিন্তু অন্ধকারে কাপড় মেলতে পারছিনা।তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?জাস্ট এই লাইটটা ধরে রাখলেই হবে।”
মাহির অনিমার হাত থেকে লাইটটা নিলো।অনিমা হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। আমি তাহলে কাঁপড় মেলছি।”
বলেই সামনে এগিয়ে গেল।বালতি থেকে পরে যাওয়া কাপড়টা ঝেড়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিলো।মাহির অনিমার দিকে লাইট তাক করে ধরে আছে।অনিমা মাহিরের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে আরেকটা কাঁপড় ঝেড়ে দড়িতে ঝুলিয়ে দিল।মাহির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে।দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না।লাইটের আলোয় অনিমার মুখে থাকা হালকা পানির ঝাপটা চিকচিক করছে।মাহিরের শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম।কোনমতে মাহির মাথাটাকে নিচু করল অনিমার থেকে চোখ ফিরিয়ে।একটা শ্বাস নিয়ে আবার সামনে তাকাতেই দেখল অনিমা একটা চাদর মেলার চেষ্টা করছে কিন্তু বড় হওয়ায় মেলতে পারছেনা।মাহির হাতে থাকা লাইটা ভালো ভাবে সেট করলো যেন দেখা যায়।এগিতে গেলো অনিমার দিকে।
“আপনি একা পারবেন না।আমাকে দিন।”
মাহিরের কথা শুনে অনিমা হেসে বলল,
“আমি এত বড় মেয়ে হয়েই পারছিনা।আর তুমি অইটুকু পিচ্চি হয়ে পারবে?”
“আপনি অর্ধেক ধরুন আর আমাকে অর্ধেক দিন তাহলেই তো হয়ে যায়।”
অনিমা মাথা নেড়ে মাহিরের হাতে দিলো চাদরের দুই কনা।আর নিজেও চাদরের দুই কনা ধরল।
“এখন চাদরটা ঝাড়ব।রেডি তুমি?”
“হুম।”
“আমি ৩ বলার সাথে সাথে ঝাড়বে ঠিক আছে?”
মাহির মাথা নাড়ালো।অনিমা ৩ পর্যন্ত গুনার সাথে সাথে দুইজন চাদরটা ঝাড়লো।চাদরে থাকা পানি দুইজনের মুখে ছিটকে পরল।অনিমা হেসে দিলো মাহিরের চোখে মুখ পানি পরার পর মুখের এক্সপ্রেসন দেখে।মাহির চোখ মুখ পুরাই খিচে ফেলেছে পানি পরায়।অনিমার হাসির শব্দে চোখ মেলে তাকাতে অনিমার হাসি দেখা নিজেও হেসে ফেলল।মাহিরকে হাসতে দেখে অনিমা বলল,
“দেখেছো তোমাকে হাসাতে পেরেছি!”
কাঁপড় মেলা শেষে ছাদ থেকে নিচে নেমে বাসার সামনে গিয়ে মাহিরকে টাটা দিতে যাবে এমন সময় মাহিরের বাসার ভিতর থেকে ভাংচুরের আওয়াজ শুনে মাহিরের দিকে তাকাতেই দেখল মাহির আবারও ভয়ে কাঁপছে।বাসার ভিতর থেকে মাহিরের বাবা মার ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে।অনিমার বুঝতে বাকি রইলো না মাহিরের ছাদে থাকার কারন।মাহিরকে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে।মাহিরকে ভয়ে কাঁপতে দেখে অনিমা মাহিরের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“চলো তোমাকে ট্রিট দেই!যেহেতু তুমি আমাকে আজকে সাহায্য করেছো।’
“আমার ট্রিট লাগবে না।”
“কোন কথা শুনব না। ”
.
.
দোকান থেকে দুইটা আইসক্রিম কিনে একটা আইস্ক্রিম মাহিরের হাতে ধরিয়ে দিলো।দুইজন মিলে সামনে থাকা একটা বেঞ্চে বসে পরল।মাহির আইসক্রিমে এক কামড় দিয়ে অবাক হয়ে বলল,
“বাহ!আইসক্রিমটা মজা তো!”
“আমার ফেবারিট। এর আগে এই আইসক্রিম খাও নি?”
“নাহ!”
“তাহলে কি আইসক্রিম খেতে?”
“আমি এর আগে কোনদিন আইসক্রিমই খাইনি।”
অনিমা অবাক হয়ে বলল,
“কোনদিন না?আজকেই ফাস্ট?”
“হুম।”
“কেন?”
“আমার আম্মু কোনদিন কিনে দেয়নি।আম্মু বলেছে আইসক্রিম খেলে নাকি ঠান্ডা লাগে।তাই খাইনি।”
মাহিরের কথা শুনে অনিমার মন খারাপ হয়ে গেলো।
“এরপর থেকে যখন আইসক্রিম খেতে মন চাইবে আমাকে বলবে কেমন?”
“আচ্ছা।একটা কথা বলব?”
“হুম?”
“আমাকে আপনার একটা ছবি দিবেন?”
“কেন?”
“বলেছিলাম না এই শহর থেকে যেকোন সময় চলে যেতে পারি?তাই ভবিষ্যতে যদি কাজে লাগে…”
“আচ্ছা!পরে ভেবে দেখব দেওয়া যায় কিনা।এখন আইসক্রিম খাও গলে যাবে।”
বর্তমান,
নিহান বিল পে করবার জন্য পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করে টাকা দিতেই যাবে হঠাত ব্যাগটা নিচে পরে গেলো।নিহান ব্যাগটা তুলতেই যাবে নিহানকে বাধা দিয়ে অনিমা বলল,
“আমি তুলছি।”
নিচু হয়ে হাঁটু মুড়ে ব্যাগটা হাতে নিতেই ব্যাগের সামনের পকেটে নিজের ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল।ছবিটা এখনকার না।অনেক আগের।ছোটবেলার দশম শ্রেনিতে পড়াকালীন।নিহান অনিমাকে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতে ছো মেরে ব্যাগ নিয়ে নিলো।
চলবে….