একঝাঁক জোনাকি পর্ব-১৬

0
132

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ১৬
নিহান বিল পে করবার জন্য পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করে টাকা দিতেই যাবে হঠাত ব্যাগটা নিচে পরে গেলো।নিহান ব্যাগটা তুলতেই যাবে নিহানকে বাধা দিয়ে অনিমা বলল,

“আমি তুলছি।”

নিচু হয়ে হাঁটু মুড়ে ব্যাগটা হাতে নিতেই ব্যাগের সামনের পকেটে নিজের ছবি দেখে অবাক হয়ে গেল।ছবিটা এখনকার না।অনেক আগের।ছোটবেলার দশম শ্রেনিতে পড়াকালীন।অনেকক্ষন হয়ে যাবার পরও অনিমার কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে নিচু হয়ে তাকাতেই দেখল অনিমা ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে।কি করবে না করবে ভেবে ছো মেরে ব্যাগ নিয়ে নিলো।হঠাত এমনভাবে নিয়ে যাবার জন্য অনিমা উপরে তাকালো।নিহান ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে বিল পে করছে।উঠে দাঁড়িয়ে রইল।বিল পে করা শেষে পিছন ফিরতেই অনিমাকে দেখে বলল,

“চলুন!”

অনিমাও বাধ্য মেয়ের মতো দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।নিহানের ভ্রু কুচকে এলো অনিমার বিহেভিয়ার দেখে।ওর প্রশ্ন করার কথা!করল না কেন?মনে হয় গাড়িতে গিয়েই বলবে।দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজার লক খুলতেই অনিমা সিটে বসে পরল।নিহানও তেলের বোতল গাড়ির পিছনে রেখে সামনে এসে বসলো।

“আপনার মানিব্যাগে আমার ছবি আসলো কিভাবে?”

যা ভেবেছিলো তাই হয়েছে।গাড়িতে এসেই জিজ্ঞেস করেছে।জিহ্বা দিয়ে ঠোটটাকে ভিজিয়ে বলল,

“আমি চাই আপনি নিজে সেটা খুজে বের করেন।”

“মানে?আমি কি করে জানব ছবিটা….”

“বললাম তো আপনি জানেন ছবিটা কি করে আমার কাছে আছে।আমি চাই আপনি মনে করেন ছবিটা কেন আমার কাছে আছে।কি করে আসলো?কে দিয়েছে?এই সম্পূর্ণ বিষয়টা আপনি খুঁজে বের করবেন।”

নিহান আর কিছু না বলে গাড়ি চালানো শুরু করলো।অনিমা অবাক হয়ে নিহানের দিকে তাকিয়ে আছে।সব কথাগুলো ওর এলোমেলো লাগছে।ও কি করে জানবে ওর ছবি নিহানের কাছে কেন?ও কি কাওকে এই ছবি দিয়েছিলো?কিন্তু কবে?মনে করতে পারছেনা কেন?হুট করে মাথা চেপে বসল অনিমা।ব্যাথায় চোখ মুখ খিচকে ফেলেছে সে।নিহান গাড়ি চালাচ্ছিলো।হঠাত অনিমাকে ছটফট করতে দেখে সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে অনিমার দিকে ঝুকে বলল,

“কি হয়েছে?এমন করছেন কেন?”

মাথা ধরেই বলল,

“জানিনা।আমি মনে করার চেষ্টা করছিলাম হঠাত মাথা ব্যাথা করে উঠলো।সহ্য করতে পারছিনা।”

“আপনি ব্রেনের উপর অতিরিক্ত চাপ দিয়ে ফেলেছেন।আপনি এখনি এতকিছু ভাবছেন কেন?আমি তো বলিনি এখনি ভেবে বলতে।সময় নিন।যত সময় লাগে নিন।নিজের উপর এভাবে প্রেসার দিয়ে নয়।এখন মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলুন।মনে করুন কিছুই বলিনি আপনাকে।ছবির ব্যাপারটা ভুলে যান।রেস্ট নিন।বাসার কাছেই এসে পরেছি প্রায়।”

কথা শেষ করতে না করতেই গাড়ির কাছের নকের শব্দে নিহান অনিমার থেকে সরে এসে কাচ খুলতেই একটা লোক বলল,

“কি ভাই?রাস্তার মাঝখানে এভাবে গাড়ি থামিয়ে রাখার মানে কি?পুরো রাস্তা আপনার জন্য জ্যাম হয়ে আছে।”

নিহান পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখল আসলে পুরো রাস্তা একটার পর একটা গাড়ি লেগে লাইন হয়ে আছে।

“দুঃখিত। আসলে এভাবে জ্যাম লেগে যাবে বুঝতে পারিনি।”

“যত্তসব আজাইরা পাবলিক!”

বিড়িবিড় করতে করতে চলে গেলো।নিহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি চালানো শুরু করলো।বাসার কাছে আসতেই গাড়ি থেকে নেমে অনিমার কাছে এসে বলল,

“এখনো মাথা ব্যাথা করছে?”

“হালকা।”

“হেঁটে যেতে পারবেন?”

“হুম।”

গাড়ি থেকে নেমে বাসায় গিয়ে বিছানায় বসে পরলো।নিহান অনিমার সামনে এসে বলল,

“এক গ্লাস শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি?খেলে ভালো লাগবে। ”

অনিমা মাথা নাড়ালো।নিহান যাবার সময় হঠাত খেয়াল করল ঘরের ফ্যানের সুইচ চালু নেই।ফ্যানের সুইচ চালু করে কিচেনে চলে গেল। কিছুক্ষন পর এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত এনে অনিমার দিকে এগিয়ে দিলো।অনিমা এক নিঃশ্বাসে পুরো শরবতটা খেয়ে ফেলল।খালি গ্লাসটা নিয়ে ফিরে যেতেই অনিমা ক্লান্ত স্বরে বলল,

“বাসায় তেল থাকা সত্তেও আপনার তেল কিনার কারনটা আমি জানি।”

নিহান তড়িৎগতিতে অবাক হয়ে অনিমার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

“আপনি দেখার আগেই আমি সোহানকে দেখেছি।আর আপনি চেয়েছিলেন আমি যেন না দেখি সেজন্যই তেল কিনার জন্য আবার হাসপাতালের দিকে ফিরে গিয়েছিলেন।আপনি হয়তবা ভেবেছেন আমি সোহানকে দেখলে পাগলামি করব,খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিব,কান্নাকাটি করব।আগেরবারের মতো তাই না?”

নিহান কোন উত্তর দিলো না।অনিমা আবারও বলা শুরু করলো,

“অই মানুষটার জন্য কান্না করার কোন মানে হয় না।ওর জন্য কান্না করা মানেই হলো বোকামি।”

“কিন্তু আগেরবার তো কান্না করেছিলেন!”

“সোহানের জন্য কান্না করেছিলাম সে কথা আপনাকে কে বলল?”

নিহান অবাক হয়ে বলল,

“সোহান আপনার সাথে দেখা হবার পরেই তো কান্না করছিলেন।খাওয়া দাওয়া করেন নি।”

“আমি সোহানের জন্য কান্না করিনি।আমি জাস্ট আমার বাচ্চাটার কথা ভেবে কান্না করেছি।ও যদি বড় হয়ে জানতে পারে ওর বাবা এমন তাহলে ও কতোটা পরিমান কষ্ট পাবে সেটা ভেবে কান্না করেছি।অই মানুষটার জন্য কান্না করার কোন প্রশ্নই আসেনা।আপনি জানেন আমি কেন সোহান বলার সাথে সাথেই সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি।একটুও চেষ্টা করিনি থাকার?কারন আমি আগেই ওর চাল চরন,কথা বার্তা,ব্যবহারে বুঝে গিয়েছিলাম ও অন্য নারীর প্রতি আসক্ত।আগে থেকেই নিজে প্রস্তুতি রেখেছিলাম যাতে অই মানুষটার সামনে আমাকে কান্না করতে না হয়।হাত জোড় করে ভিক্ষা করতে না হয় ওর সাথে থাকার জন্য। ”

নিহান কথাগুলা শুনে ধীর পায়ে অনিমার সামনে এসে দাঁড়ালো।হাটু মুড়ে বসে বলল,

“আপনি কোন চিন্তা করবেন না অনিমা।আমি বাচ্চাটাকে কোনদিনও সোহানের কথা জানতে দিব না।একজন ভালো বাবা হতে যা যা করা লাগে সব করব আমি। বাবার স্নেহ ভালোবাসার অভাব কোনদিন বুঝতে দিব না।কোনদিন বুঝতে দিব না যে আমি ওর বায়োলজিকাল ফাদার নই।সোহানের থেকে,সব রকম বিপদ আপদ থেকে ওকে রক্ষা করব আমি।একটা আচড়ও লাগতে দিব না ওর গায়ে।প্রমিস করলাম আপনাকে।আপনি এসব নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না।”

অনিমা মাথা নাড়ালো।নিহান হেসে খালি পানির গ্লাসটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

দেখতে দেখতে প্রায় ৩মাস কেটে গেলো।আর ১ দিন পর অনিমার অপারেশন।নিহান ১ দিন আগে থেকেই সবকিছুর ব্যবস্তা করা শুরু করেছে।অফিস থেকেও ছুটি নিয়ে এসেছে অনিমা।অনিমা বিছানায় বসে ছিল আর নিহান সব প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গুছাচ্ছিলো অন্য রুমে বসে।হঠাত অনিমার চিৎকার শুনে হাতে থাকা কাপড় ফেলে দৌড়ে রুমে যেতেই দেখল অনিমা পেটে হাত রেখে কাতরাচ্ছে।

“কি হয়েছে অনিমা?পেটে ব্যাথা করছে?”

অনিমা মাথা নাড়লো।নিহান কি করবে না বুঝে বলল,

“আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।হাঁটতে পারবেন?”

নিহান অনিমাকে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে আসলো।গাড়িতে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি চালু করতে করতে বলল,

“একটু সহ্য করুন।কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা পৌছে যাব।”

.
.
ডাক্তার বাচ্চা ঠিক আছে কিনা পরিক্ষা করার জন্য আল্ট্রা করালো।রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলল,

“বাচ্চার অবস্থা ঠিক নেই।এই অবস্তায় বাচ্চা আর মা দুজনেরই ঝুঁকি আছে।দুজনেই বাঁচতে পারে আবার যেকোন একজনও বাঁচতে পারে।সঠিক করে আমরা বলতে পারছিনা।”

কথা গুলা শুনে নিহানের সারা গা শিউরে উঠলো।কোন যত্নের তো কমতি রাখেনি সে।সবসমই নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছে সে।তাহলে এমনটা কেন হলো?এমন হবার তো কোন কথা ছিলো না।

“আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করুন।আমি চাই বাচ্চা মা দুজনেই যাতে বাঁচে।”

“চেষ্টা তো করবোই।আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।পেসেন্টের অবস্তা খুবই খারাপ।যেকোন ডিসিশন নিত্র হতে পারে আপনার।হয় আপনার স্ত্রী নাহয় আপনার বাচ্চা।”

“আমি কোন অপশন চাই না।আমার দুইজনকেই লাগবে।”

ডাক্তার অবাক হয়ে বলল,

“নিজে একজন ডাক্তার হয়ে আপনি অন্য একজনকে এই কথা কিভাবে বলেন?আপনার তো বুঝা উচিত সিচুয়েশনটা।”

নিহান কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।অনিমাকে এখন অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।নিহান দৌড়ে গিয়ে অনিমার কাছে গিয়ে দাড়ালো।

“আপনি কোন চিন্তা করবেন না অনিমা।সবকিছু ঠিকঠাক আছে।আমি আপনার জন্য ওয়েট করছি।বাচ্চাটাকে দেখার জন্য ওয়েট করছি।কিচ্ছু হবে না আপনাদের।আমি কিছু হতে দিব না।আপনি জাস্ট ফিরে আসেন আমার কাছে।আমি আর কিছু চাই না।প্লিজ ফিরে আসবেন। যেভাবেই হোক। আপনাকে আসতে হবে আমার কাছে।আপনাদের দুইজনের জন্য আমি এখানে ওয়েট করছি।”

নিহানের গলা কাঁপছে।সব কথা গলায় দলা পাকিয়ে আসছে।নিহানের কথা শুনে অনিমা কিছুই বুঝল।শুধু মাথা নাড়লো।নার্সরা অনিমাকে ট্রেতে করে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো।দরজা বন্ধ হবার আগ পর্যন্ত নিহান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।অনিমা যাবার পর নিহান জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,

“কিচ্ছু হবে না অনিমার।সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।ডাক্তার তো বলেছেই দুজনের বাঁচার চান্স আছে।তাহলে এত চিন্তা কেন করছি আমি?কিছুক্ষন বাদেই অপারেশন শেষ হবে।আর তখন আমি দেখব অনিমা আর বাচ্চাটাকে।ওয়েট করা আমার আর কিছুই করার নেই।”

চার পাঁচটা শ্বাস নেবার পরও নিহান নিজেকে আটকাতে পারলো না।চোখ থেকে পানি গাল বেয়ে পরল।কান্না করতে করতে ফ্লোরে বসে পরল।

“কিছু হবে না।”

বিড়বিড় করতে করতেই কান্না করতে লাগলো।পকেটে ফোন বেজে যাচ্ছে,ওর সামনে দিয়ে সবাই তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। কেওই নিহানের কান্না করার কারন খুজে পাচ্ছে না।নিহানের সেদিকে কোন খেয়াল নেই।ও শুধু প্রার্থনা করছে যেন দুইজনেই সুস্ত ভাবে ওর কাছে ফিরে আসে।

নিহানকে ফোনে না পেয়ে নিহানের মার মাথায় চিন্তা ভর করলো।ও তো কোনদিন এমন করে না।যতই ব্যস্ত থাকুক। ফোন রিসিভ করে।তাহলে আজকে কি হলো?ফোন কেন ধরছেনা?কোন বিপদ আপদ হলোনা তো?যাবার সময় কেন বলল নিহানের জন্য দোয়া করতে?ও যা চায় তাই যেন হয়?

ভাবতে ভাবতে সোফায় বসে পরলেন।

চলবে….