একঝাঁক জোনাকি পর্ব-২৯

0
159

#একঝাঁক_জোনাকি
#ইশরাত_জাহান_অধরা
#পর্বঃ২৯

অনিমা অরিনকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।নিহানের পিছু পিছু ঢুকলো চেম্বারের ভিতর।
ডাক্তার শ্রেয়া নিহানকে দেখেই বলল,

“আরে নিহান আপনি এখানে?”

“হ্যা বাচ্চাকে নিয়ে এসেছি।টিকার জন্য! ”

শ্রেয়া অবাক হয়ে বলল,

“বাচ্চা!কার বাচ্চা?’

নিহান মুচকি হেসে বলল,

” আমার!আর উনি হচ্ছে আমার ওয়াইফ মিসেস অনিমা শাহরিয়ার!”

“এটা কিন্তু ঠিক না।আপনি আমাদের কাওকেই দাওয়াত দেননি!”

“পরিস্থিতিটাই এমন ছিল দাওয়াত দেওয়ার মতো সময় পাইনি!”

শ্রেয়া অনিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“ভাবি ভালো আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ! আপনি?”

“আমিও!”

“টিকা দেওয়া শেষ করেন!ওর টিকার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।”

“আচ্ছা আমি দেখছি নার্সকে সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি।”

“নার্সকে না আপনি নিজে টিকা দিন!তাহলে ভরসা পাবো।”

“কিন্তু আমার তো আরও রোগী….”

“প্লিজ!”

“আচ্ছা।আমিই টিকা দিব ওকে।”

.
.

“ইঞ্জেকশন ইনটেক তো?ব্যবহার করা না তো?”

এই নিয়ে সাত নম্বর প্রশ্ন করলো নিহান।শ্রেয়া যখনই ইনজেকশন দিতে যাবে তখনই নিহান কোন না কোন প্রশ্ন করেছে।যেমন তুলা পরিষ্কার কিনা!কোন ইনফেকশন হবে কিনা ইত্যাদি!শ্রেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,

“ডা.নিহান আমি এইমাত্র আপনার সামনে ইনজেকশনের প্যাকেট খুললাম!তাহলে এটা ব্যবহার করা হয় কিভাবে?আর তাছাড়া আপনি তো জানেন আমরা ইনজেকশন দেওয়ার পর সিরিঞ্জ ডাস্টবিনে ফেলে দেই।”

“জানি বাট সিউরিটির জন্য জিজ্ঞেস করছিলাম।”

শ্রেয়া আর কিছু না বলে ইঞ্জেকশন দিতেই যাবে আবারও নিহান বলল,

“ব্যাথা পাবে না তো?”

শ্রেয়া এবার রাগী চোখে একটা শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো।ঠান্ডা গলায় বলল,

“ইঞ্জেকশন যেহেতু দিব সেহেতু হালকা হলেও তো ব্যথা পাবে!আপনি যত বড় ডাক্তার দিয়েই ইনজেকশন দেওয়ান না কেন!”

নিহান বুঝল শ্রেয়া রেগে গেছে যা ওর কথার ধরন দেখেই বুঝা যাচ্ছে।ছোটবেলা থেকেই ইঞ্জেকশনকে চরম লেভেলের ভয় পায় সে।ডাক্তার হয়েও এ পর্যন্ত৷ কাওকে নিজ হাতে ইঞ্জেকশন দিতে পারেনি।অন্য ডাক্তার অথবা নার্সকে দিয়ে কাজ সারিয়েছে।এক কথা বলতে ইনজেকশনে ওর ফোবিয়াই আছে বলে ধরা যায়।যেমন অরিন ওর কোলে তবুও ওর হাত কাঁপছে অথচ এখনো অরিনকে ইঞ্জেকশন দেওয়াই হয় নাই!অনিমা পাশ থেকে সবটা দেখছে।নিহানের কাধে হাত রেখে বলল,

“অরিনকে ইঞ্জেকশন দিতে দিন।ভয় পাবেন না!কিছু হবে না ওর!”

নিহান অনিমার দিকে চোখ তুলে তাকালো।শান্ত হলো হৃদয়।মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।যেন এই মুহুর্তে ইঞ্জেকশন থেকে সব চিন্তা, ভয়, আতংক সবকিছুই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে কিংবা দৌড়ে পালিয়ে গেছে নিহানের থেকে অনিমার কথা শুনে!মনে সাহস নিয়ে বলল,

“আপনি আপনার কাজ করুন!”

শ্রেয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইঞ্জেকশন নিয়ে এগিয়ে গেলো অরিনের দিকে।এটা দেখে নিহান অরিনের চোখ হাত দিয়ে ঢেকে রাখলো।সাথে নিজের চোখগুলোও খিচে বন্ধ করে রাখলো।কিছুক্ষন বাদেই অনিমা বলল,

“শেষ! এবার চোখ খুলুন!”

নিহান অবাক হয়ে প্রথমে অরিনের দিকে তাকালো। নিহানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।হয়তবা নিহানের করা ব্যবহারগুলো অরিনের ছোট্ট ব্রেন বুঝতে পারেনি।নিহান টানা পাঁচ মিনিট প্রখর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অরিনের দিকে কান্না করার অপেক্ষায়। কিন্তু নিহানের অপেক্ষাকে বৃথায় ফেলে অরিক কাঁদার বদলে হাসি দিলো একটা।নিহান অবাক হয়ে বলল,

“ও কান্না করলো না কেন?ইঞ্জেকশন দেন নি?”

শ্রেয়া হেসে বলল,

“দিয়েছি। তবে আপনার মেয়ে বোধহয় তার বাবার করা কান্ড দেখে হেসে দিয়েছে।”

.
.
” দেখলেন?আমার মেয়ে পুরো আমার মতো হয়েছে!ইঞ্জেকশনকে ভয়ই পায়না!”

অনিকা ঠোট টিপে হাসলো।কে ইঞ্জেকশন ভয় পায় আর কে পায়না সেটা সে একটু আগেই বুঝে গিয়েছে।

“আপনি হাসছেন কেন?”

“কিছুনা এমনি!”

“আচ্ছা আপনি তো দেখেছেন না অরিন আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে!নাকি আমি ভুল দেখেছি?”

“নাহ আপনি ভুল দেখেন নি।অরিন আপনার দিকে তাকিয়ে হেসেছে!”

নিহান আফসোসের স্বরে বলল,

“ইশ অরিনের হাসিটা ক্যাপচার করে রাখা উচিত ছিলো ফোনে!মেয়েটা এমন জায়গাত এসে হাসলো।বাসায়ও তো হাসলে পারতো তাইলে ছবি তুলতে পারতাম।দুর!”

“সমস্যা নেই।পরেরবার যখন হাসবে তখন আপনার জন্য ছবি তুলে রাখব!”

“যাইহোক আপনি যাবেন কিভাবে?”

“নিচে গাড়ি রাখা আছে। ”

“বাহ!বেশ ভালো করেছেন।আমার কিছু কাজ ছিলো।নইলে সাথেই যেতাম!”

“সমস্যা নেই।আপনি আপনার কাজ সেরে আসুন।”

.
.
অনিমা কেবল অরিনকে দুধ খাইয়ে ঘুম পারাচ্ছিলো।আর রহিমা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলো।

“আপা!এইডা কি?”

অনিমা ঘুরে তাকালো রহিমার হাতের দিকে।অইদিনের ডাইরিটা!কোথায় ছিলো এটা?এতোদিন অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি।ভেবেছে নিহান হয়তবা এটা অন্য জায়গায় রেখে দিয়েছে।ডাইরিটা হাতে নিয়ে বলল,

“কোথায় পেলেন এটা?”

“আলমারির তলে ছিলো।এইমাত্র বাইর করলাম।এইডা মনে নিহান ভাইয়ের জিনিস। অনেকবার উনারে এডার মধ্যে লিখতে দেখছি!”

“আচ্ছা আপনি কাজ করুন।আমি নিহান আসলে উনাকে দিয়ে দিব।”

“আমার ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ।আমি যাই?”

“আচ্ছা যান।”

রহিমা যেতেই অনিমা ডাইরিটার দিকে তাকালো।কালো ছোট ডাইরি।মলাটে আবার বেধে রাখার বেল্ট আছে।এই ডাইরিতে কি আছে?নিহান প্রায় সময় ডাইরি নিয়ে কি করতো?উনার প্রাক্তন প্রেমিকা সম্পর্কে লিখতো বুঝি?মনের সব দুঃখ, কষ্ট,অভিমান, রাগ এগুলাই কি জমা করে রাখতো এই ডাইরিতে?
অনিমা মলাটের বেল্টটা খুললো।হঠাত মস্তিষ্ক হানা দিলো। কি করছে সে?অন্য একজনের পার্সোনাল ডাইরি খুলে পরছে?এতোটা অধঃপতন কবে কোন সময় হলো তার?না না! এভাবে অন্য কারোর জিনিসে হাত দেওয়া উচিত না!কিন্তু মন বলছে কি হবে দেখলে?ওর তো অধিকার আছে দেখার!আর তাছাড়া অই মেয়েকে দেখতে অনেক ইচ্ছা করছে যাকে একজন পুরুষ ১৫ বছর ধরে ভালোবেসে এসেছে।তাও কিনা নিহানের মতো মানুষ!মনকেই প্রাধান্য দিলো অনিমা।উপরের কভার খুলতেই দেখলো স্কেচ করা ছবি আঁকা!একটু ভালো করে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলো।এগুলো তো ওর ছোটবেলার ছবি!নিহান কিভাবে ওকে ছোটবেলা থেকে চিনে?বাসের সিটে কানে ইয়ারফোন গুজে চোখ বন্ধ করে গানগুলাকে অনুভব করা অনিমার মুহুর্ত!ছাদের গাছগুলোতে পানি দেবার মুহুর্ত!হাটু ভাজ করে তাতে মুখ গুজে কান্না করার মুহুর্ত!হাসতে থাকার মুহুর্ত সবগুলার ছবি নিহান এঁকে রেখেছে এখানে।কয়েক পেজ উল্টাতেই দেখলো ছোটদের মতো গোটা হাতের লেখা তাতে।লেখাটায় চোখ বুলালো।

“আমি আপনাকে মিস করছি অনিমা!”

লেখাটা পড়তেই ভ্রু কুচকে এলো।পরের পেজ উল্টাতেই দেখলো,

“আপনি বলেছিলেন আমাকে এই ডাইরিতে যাতে আমি আমার সব আনন্দকর মুহুর্তগুলো লিখি।পরবর্তীতে দেখা হলে যেন আপনাকে দেই।কিন্তু আমি আনন্দকর মুহুর্ত গুলো মন করতে পারছিনা।আপনি বলেছিলেন চোখ বন্ধ করলে যেই মুহুর্তটা চোখের সামনে ধরা দিবে সেটাই সব থেকে আনন্দের মুহর্ত। আমি চোখ বন্ধ করলেই বারবার আপনার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভাসে।তাহলে কি ধরে নিব আমার সবথেকে আনন্দকর মুহুর্তগুলো আপনার সাথে কেটেছে?যারকারনে অন্যান্য আনন্দকর মুহুর্ত চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে না!”

“অনিমা আপনি কি জানেন আপনি আমার লাইফে একঝাঁক জোনাকির মতো ছিলেন?আমি যেসময়ই বিপদে পরতাম আপনি এসে বাঁচাতেন আমায়।সাহায্য করতেন।ভীতু আমিটাকে সাহসী করে তুলেছেন আপনি।আমার ডাক্তার হবার পিছনে বাবা মার পর আপনার অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশি।আপনি হয়তবা অবাক হচ্ছেন কথাটা শুনে তাই না?আচ্ছা বেশ আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।বাবা মার ঝগড়ার মধ্যে আমি যখন বেড়ে উঠছিলাম তখন আমার মাঝে একটা সত্ত্বাও বেড়ে উঠছিলো।স্বার্থপর,পাথরের মতো কঠিন,রাগী মনের,চুপচাপ স্বভাবের সত্ত্বা।আর তারপরই আমার জীবনে আপনার আগমন ঘটলো।আপনার আগমনটা ঝড়ের থেকেও প্রখর শক্তিশালী ছিল।ঝড় সবকিছু উড়িয়ে নেবার পর হালকা হলেও থেকে যায় সেসব জিনিসের অস্তিত্ব যা সে উড়িয়ে নিয়েছে। আপনার আগমনও ঝড়ের মতো আমার সেসব বাজে অভ্যাসকে আমার থেকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে।একটা কনাও আমার মাঝে নেই সেইসব অস্তিত্বের!আর আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন একজন ডাক্তার হতে হলে তাকে আগে কোমল স্বভাবের মানুষ হতে হয়।রোগীদের রোগ সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হবার জন্য তাকে আগে রোগীর সাথে ভালোভাবে মিশতে হয়।আমি যদি আগের মতো থাকতাম তাহলে আমার কাছে একটা রোগীও আসতো না!বেয়াদপ ভেবে চলে যেতো।আপনি আমার সেসব মূহর্তের সাক্ষী যেসব মুহুর্ত আমি আপনি ছাড়া আর কারোর সাথে ভাগাভাগি করতে চাই না।আপনি যেমন আমাকে সবরকম পরিস্থিতিতে সাহায্য করেছেন,আমার পাশে থেকেছেন,আমার মনে সাহস জুগিয়েছেন তেমনি করে যদি সম্ভব হয় তাহলে আমিও আপনার পাশে থাকবো।সাহায্য করব,আপনার মনে সাহস জুগাবো। এরজন্য যদি সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে আমাকে যুদ্ধ করতে হয় আমি এতে রাজি!শুধু আপনি আমার পাশে থাকবেন।যেকরেই হোক আপনাকে খুঁজে বের করব আমি।যেকরেই হোক!”

“আমি আমার কথা রেখেছি।আপনাকে খুঁজে বের করেছি।১৫ বছর আগের চেহারা আর এখনের চেহারায় খুব বেশি তফাত না থাকলেও আগের মতো এখন আপনার চেহারায় চঞ্চল ভাবটা নেই।কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছেন আপনি!চেহারায়ও খুশির ছাপ নেই ঠিক আগের মতো!আমি জানি না এর কারন কি তবে আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে আগের মতো হাসিখুশি রাখব!রাখার চেষ্টা করব!চঞ্চলতা ফিরিয়ে না আনতে পারলেও ঠোটের কোণে হাসি তো আনতে পারব!আমি জাস্ট সেই মুহুর্তটার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনার হাসি দেখার জন্য। অনেক মিস করছি আপনার হাসিটাকে।”

“আমাকে একটু ভালোবাসলে কি হয় অনিমা?আপনি জানেন আমি আপনার মায়ায় আটকে গেছি। আমি চাই চিরকাল এভাবে আপনাতে আসক্ত হতে!আপনাতে ডুব দিতে।আপনি আমার মায়ায় কবে পরবেন?কবে আমাকে ভালোবাসবেন?”

অনিমা লেখাটা পড়ে স্তব্দ হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষন।ডাইরির বাকি পেইজগুলাও উল্টালো।আরও অনেক কিছু লেখা। আর সেটা অনিমাকে নিয়েই।ঘুমন্ত অরিনকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো।বসা থেকে উঠে কয়েক পা এগিয়ে ডাইরিটা যেখানে ছিল সেও ড্রয়ারে রেখে দিলো।ইশ কি বোকা সে!মাহিরকে চিনতেই পারেনি।অথচ মাহির ঠিকই চিনে নিয়েছে তাকে! আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এতদিন সে নিজেকে নিয়েই হিংসা করছিলো?নিজেকে নিজেই বকছিলো?রাগে মাথার দুই হাত দিয়ে মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করতে লাগলো।

“কি হয়েছে অনিমা আপনি এমন করছেন কেন?”

কথাটা শুনেই অনিমা সামনে তাকাতেই দেখল নিহান দাঁড়িয়ে আছে অনিমার দিকে তাকিয়ে।

“শরীর খারাপ লাগছে আপনার?”

অনিমা কয়েক পা এগিয়ে গেলো নিহানের দিকে।চোখে চোখ রেখে বলল,

“কিছুনা এমনিই!মাথা ব্যাথা করছিলো!”

“মাথা ব্যথা করছে?জ্বর এলো নাকি?”

বলেই অনিমার কপালে হাত ছুয়ালো।

“কই না তো!টেম্পারেচার ঠিকই আছে।”

“আপনি যান ফ্রেশ হোন।আমার মাথা ব্যথা একটু পরেই চলে যাবে।”

“সিউর?”

“হুম। নইলে পেইন কিলার খেয়ে নিব!”

নিহান তার জামা কাপড় আলমারি থেকে বের করে ওয়াশরুমের৷ উদ্দেশ্যে রওনা হলো।হঠাত পিছন থেকে অনিমা বলে উঠলো….
চলবে…..