#একটা_বসন্ত_বিকেলে
#অরনিশা_সাথী
|২১|
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আট মাসের উঁচু পেটটা দেখছে আয়াত। আগের থেকে দেখতে বেশ গুলুমুলু লাগছে। শ্রাবণ পেছন থেকে আয়াতকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“ওভাবে দেখো না তো আমার বউয়ের নজর লেগে যাবে।”
শ্রাবণের কথায় আয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকালো। লোকটা কিসব উল্টাপাল্টা বলছে। আয়াত বললো,
–“আমার নজর আমার উপর লাগবে?”
–“উঁহু, আমার বউয়ের উপর লাগবে।”
–“ছাড়ুন তো, আপনার এসব কথাবার্তা শোনার টাইম নাই আমার। ঘুমাবো আমি।”
–“সে তো আমিও ঘুমাবো, চলো।”
শ্রাবণ আয়াতকে ধরে বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। আয়াত বললো,
–“আমি কি বাচ্চা? আপনারা আমাকে সবসময় এভাবে ধরাধরি করে হাঁটান কেন? আমি একা হাঁটতে পারি তো।”
–“তুমি বাচ্চা না, তবে তোমার পেটে আমার বেবি আছে। হাঁটার সময় বেখেয়ালি ভাবে যদি কোথাও ব্যথা পাও তখন? তখন তো আমার বউ বাচ্চা দুজনেরই কষ্ট হবে।”
আয়াত তপ্ত শ্বাস ফেললো। এই লোকের সাথে কথায় পেরে উঠবে না ও। তাই আর বেকার বেকার কথা বাড়ালো না।
–
ক্লাস শেষে সবেই ক্লাস থেকে বের হলো রাফিয়া। ভ্যাপসা গরমে তড়তড় করে ঘামছে। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে মুখটা মুছে নিলো। বাসায় যাবে এখন৷ দু মাস হলো আয়াত ক্লাসে আসছে না। এই ভারী শরীর উঁচু পেট নিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করাটা টাফ ব্যাপার। যেদিন খুব বেশি ইমপোর্টেন্স ক্লাস হয় সেদিনই ক্লাসে আসে আয়াত। আর নয়তো রাফিয়ার থেকে সব নোটস নিয়ে রাখে। আয়াত না আসাতে রাফিয়াও এখন ক্লাস শেষে ভার্সিটিতে বেশি সময় কাটায় না। তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে। আজও ব্যতিক্রম নয়। মাঠের মাঝ বরাবর আসতেই রাফিয়ার ক্লাসমেট তাইফ রাফিয়ার পথ আটকায়। রাফিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কিছু বলবা তাইফ?”
তাইফ সম্মতি সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
–“একটু সাইডে আসো, কথা আছে আমার।”
রাফিয়া তাইফের সাথে বড় বকুল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। দূর থেকে শান ব্যাপারটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এগিয়ে গেলো রাফিয়াদের দিকে। তাইফ একটা গোলাপ ফুল রাফিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“আই লাভ ইউ রাফিয়া।”
তাইফের মুখে ভালোবাসি কথা শুনে রাফিয়া বেশ একটা অবাক হলো না। তাইফ যখন ওকে এখানে নিয়ে এসেছে রাফিয়া তখনই কিছুটা আন্দাজ করেছিলো। এদিকে শানের কপালের রগ ফুঁটে উঠলো। তাইফের উপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে শানের। রাফিয়া কিছু বলার আগেই শান গিয়ে রাফিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তাইফকে বললো,
–“ও তোমাকে ভালোবাসে না, সুতরাং পিছু নেওয়া বন্ধ করো। শি ইজ অনলি মাইন।”
শানের এরকম কথা শুনে রাফিয়া চমকে তাকালো ওর দিকে। ছেলেটা কি বলছে? শান আর কিছু না বলে রাফিয়াকে টানতে টানতে সেখান থেকে নিয়ে আসলো। রাফিয়া তখনো অবাক চোখে শানকে দেখছে। শান সাধারণত ওর সাথে এরকম কোনো ব্যবহার করেনি যাতে রাফিয়া বুঝবে শান ওকে ভালোবাসে। তাই হুট করে শানের এরকম কথাতে বেশ অবাক হয়েছে ও।
–
ব্যালকোনিতে বসে একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আয়াত৷ এতক্ষণ সানিয়া মেহরাব আয়াতের সাথে বসেই জমিয়ে আড্ডা দিয়ে গেছে। অনেকটা সময় বসে থাকার ফলে উনার ব্যাক পেইন উঠেছে যার কারণে নিজের ঘরে চলে গেছেন রেস্ট নিতে। আয়াতের এখন মোটেও ভালো লাগছে না। কেন ভালো লাগছে না ও সেটাও জানে না। রুমে চলে এলো আয়াত। বালিশের পাশ থেকে ফোন তুলে ভিডিও কল করলো শ্রাবণের নাম্বারে। কিছুক্ষণ রিং হতেই রিসিভ করলো শ্রাবণ। আয়াত গোমড়া মুখে বললো,
–“আমার বিয়ে করা বর বাসায় আসবে কখন?”
আয়াতের কথায় মুচকি হাসলো শ্রাবণ। ঘড়িতে সময় দেখে বললো,
–“এই তো আর তিন/চার ঘন্টা পর। কেন বলো তো?”
–“উঁহু তিন/চার ঘন্টা পর না, আপনি এখনই বাসায় আসুন। ভালো লাগছে না আমার। মন খারাপ হচ্ছে, কিন্তু কেন হচ্ছে জানি না আমি।”
এক শ্বাসে কথাগুলো বললো আয়াত। শ্রাবণ বললো,
–“আচ্ছা তাহলে আমার বিয়ে করা বউয়ের মন খারাপ? তো কি করলে তার মন ভালো হবে?”
আয়াত কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“আপাতত আপনি বাসায় আসুন, তারপর ভেবে বলবো কি করলে মন ভালো হবে।”
–“আচ্ছা আসছি, তুমি ডেকেছো আমি না এসে পারি?”
শ্রাবণের কথায় মৃদু হাসলো আয়াত। তারপর আবার বললো,
–“আমার জন্য চকলেটস আর বোম্বাই মরিচের ঝালমুড়ি নিয়ে আসবেন কিন্তু।”
শ্রাবণ হেসে সম্মতি জানালো। তারপর লাইন কেটে দিলো। আয়াত বসে বসে ভাবতে লাগলো কি করা যায়? পরমূহুর্তেই ভাবলো শ্রাবণের জন্য নাস্তা বানাবে। ও তো কিছুক্ষণের মাঝেই চলে আসবে। এইটুকু সময়ে যা বানানো যায় তাই বানাবে। নয়তো শ্রাবণ এসে ওকে রান্নাঘরে দেখলে আস্ত রাখবে না। শান আর সানিয়া মেহরাবের থেকেও লুকিয়ে যেতে হবে। নয়তো এ দুজনও বেশ বকাবকি করবে ভারী পেট নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে রান্নাঘরে গিয়ে রান্না করলে।
আয়াত নিচে নামার আগে একবার শান আর সানিয়া মেহরাবের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো। সানিয়া মেহরাব চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর শান কম্পিউটারে কিছু করছে। আয়াত রিল্যাক্স মুডে ধীর পায়ে নিচে নেমে কিচেনে চলে গেলো। আয়াত আগেই ফোন করে সার্ভেন্টদের জানিয়ে রেখেছিলো হোয়াইট সস পাস্তার জন্য সবকিছু রেডি করতে। সেই মোতাবেক সবকিছু রেডি করেই রাখা আছে। আয়াত গিয়ে রান্না শুরু করতে গেলেই একজন সার্ভেন্ট আয়াতকে কিচেনে দেখে বললো,
–“বউমণি তুমি কিচেনে এসেছো কেন? বড় ম্যাম আর স্যারেরা যদি জানে তুমি রান্না করেছো তাহলে আমাদের চাকরি থেকে বের করে দিবে।”
আয়াত সার্ভেন্টকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
–“চিন্তা করবেন না তো। কেউ কিচ্ছু জানবে না, সকলে আসার আগেই আমি রান্না শেষ করে নিজের ঘরে চলে যাবো। আপনি শুধু পাস্তাটা সবার ঘরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।”
–“আমি রান্না করে নিচ্ছি, তুমি উপরে যাও বউমণি।”
আয়াত কারো কোনো কথা শুনলো না। নিজের মতো করে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সার্ভেন্ট হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আয়াতের রান্না দেখছে।
রান্না শেষ করে সবেই ঘরে এসে বসলো আয়াত। ঘেমে গেছে পুরো। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখমুখে পানি দিয়ে বিছানায় এসে বসলো। এমন সময় শ্রাবণ ঘরে ঢুকলো। শ্রাবণ এসে ফ্রেশ হয়ে আয়াতের কাছে গিয়ে বসলো। ওর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
–“এখনো মন খারাপ বউ?”
আয়াত একগাল হেসে বললো,
–“উঁহু, এখন মন ভালো হয়ে গেছে। আমার চকলেটস?”
কথাটা বলেই হাত বাড়ালো আয়াত। শ্রাবণ মুচকি হেসে বেড সাইড টেবিল থেকে চকলেট বক্স দিলো আয়াতের হাতে। চকলেটস পেয়ে আয়াতের চোখমুখে খুশির ঝলক দেখা গেলো। এমন সময় দরজায় নক করলো একজন সার্ভেন্ট। শ্রাবণ ঘরে আসতে বললো৷ ট্রে-তে করে এক বাটি পাস্তা এবং এক বাটিতে ঝালমুড়ি দিয়ে গেলো সে। আয়াত পাস্তার বাটি শ্রাবণের হাতে দিয়ে নিজে ঝালমুড়ির বাটি হাতে নিলো। প্রথম চামোচ শ্রাবণের মুখের সামনে ধরতে শ্রাবণ বিনাবাক্যে খেয়ে নিলো। শ্রাবণ পাস্তার বাটিটা ঢাকা দিয়ে রেখে দিলো। আয়াত খেতে খেতে মাঝে মধ্যে শ্রাবণকে খাইয়ে দিচ্ছে, শ্রাবণও কোনো টু শব্দ না করে খেয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ করে আয়াতের চোখ শ্রাবণের দিকে পড়তেই আয়াত চমকে উঠলো। শ্রাবণের চোখমুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। আয়াতের খেয়াল হলো শ্রাবণ আয়াতের মতো তেমন একটা ঝাল খেতে পারে না। আয়াত আমতা আমতা করে বললো,
–“স্য্ স্যরি আমি মানে, আসলে খেয়াল ছিলো না আপনি ঝাল____”
আয়াতকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই শ্রাবণ আয়াতের দুই গাল ধরে এক ঝটকায় আয়াতের ঠোঁট জোড়া দখল করে নিলো। আয়াত চোখ বড় বড় করে শুধু দেখলো শ্রাবণকে। অতঃপর নিজেও রেসপন্স করা শুরু করলো। শ্রাবণ আয়াতকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
–“ঝালের পরে যদি এরকম মিষ্টি পাওয়া যায় তাহলে এরকম ঝাল খেতে আমি সর্বদা প্রস্তুত।”
–“অসভ্য লোক একটা, সময় পেলেই শুধু অসভ্যতামি করা তাই না?”
–“সেরকম ভাবে আর অসভ্যতামি কোথায় করছি বউ? এখন তো এইটুকু দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি। বাই দ্যা ওয়ে, আমার বিয়ে করা বউয়ের পারফর্মেন্সও কিন্তু বেশ ভালো। আই লাইক ইট।”
আয়াত চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই শ্রাবণ মৃদু শব্দ করে হাসলো। আয়াত পাস্তার বাটি আবারো শ্রাবণের হাতে দিয়ে বললো,
–“ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, এটা শেষ করুন।”
শ্রাবণও আয়াতকে এক চামোচ খাইয়ে দিয়ে নিজে এক চামোচ খেলো। মুখে দিয়েই বুঝতে পারলো এটা আয়াতের রান্না। চোখ রাঙিয়ে বললো,
–“কতবার বারণ করেছি এতগুলো সিড়ি বেয়ে নিচে নামবে না আর কিচেনে তো যাবেই না। তুমি তবুও আমার কথা কেন শুনো না বলো তো?”
–“আমার ইচ্ছে করছিলো কিছু রান্না করে আপনাকে খাওয়াতে৷ কি করতাম আমি?”
গোমড়ামুখে কথাটা বললো আয়াত। শ্রাবণ আয়াতের ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আর বেশি কিছু বলতে পারলো না। মনোযোগ দিলো খাওয়ায়।
–
সেদিন ভার্সিটি থেকে ওভাবে টেনে নিয়ে আসার পর থেকেই রাফিয়া শানকে ইগনোর করছে। শান অনেক চেষ্টা করার স্বত্তেও রাফিয়া কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না শানকে। রাফিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আয়াতের রুমের দিকে যাচ্ছিলো। এমন সময় শান রাফিয়ার হাত ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দেয়। শান এগোতে থাকে রাফিয়ার দিকে। আর রাফিয়া পিছিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় রাফিয়ার। শান ওর সামনে দাঁড়িয়ে রাফিয়াকে আটকে ওর গাল বরাবর দেয়ালে হাত রাখলো। রাফিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে একবার শানের হাতের দিকে তাকালো। ওর এখন বড্ড ভয় লাগছে। ছেলেটা হুট করেই এমন আচরণ করছে কেন ভেবে পায় না রাফিয়া। শান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“ইগনোর করছিস কেন তুই আমাকে?”
–“আমার ইচ্ছে। সেটা তোকে বলবো কেন?”
রাফিয়ার প্রশ্নে শানে রেগে গেলো। মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“তোর ইচ্ছে মাই ফুট।”
রাফিয়া দুহাতে ঠেলে শানকে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। না পেরে বললো,
–“যেতে দে আমাকে। অসভ্যের মতো আমাকে এভাবে আটকে রেখেছিস কেন?”
শান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“ছেড়ে দিবো, আগে বল আমায় ইগনোর করছিস কেন?”
–“তুই সেদিন আমাকে তাইফের সামনে থেকে টেনে নিয়ে আসলি কেন? আর আসার আগে ‘শি ইজ অনলি মাইন’ এটা বলে আসলি কেন ওকে? কি ভাবলো ও?”
–“যা সত্যি তাই বলেছি। আর তাইফের চিন্তাভাবনা নিয়ে তোর এত মাথা ব্যথা কেন?”
–“বাহ রে ও যে আমায় প্রপোজ করলো? এক্সেপ্ট করবো তো আমি। তোর উল্টাপাল্টা কথার জন্য আবার যদি ভুল বুঝে আমাকে তখন?”
রাফিয়ার এমন কথায় শানের রাগ তড়তড় করে বেড়ে উঠলো। রাগান্বিত স্বরে বললো,
–“ফের যদি এই কথা মুখে আনিস আই সোয়্যার, খুন করে ফেলবো তোকে।”
–“তোর এত লাগছে কেন? তাছাড়া তোর কথা শুনতে বাধ্য নই আমি, পথ ছাড়।”
শান এবার শক্ত করে রাফিয়ার দুই বাহু চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“আই লাভ ইউ ইডিয়ট, বুঝিস না এটা?”
শানের মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনে রাফিয়ার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি ফুঁটে উঠলো। বাঁকা হেসে বললো
–“এই কথাটা বলতে এত সময় লাগলো তোর গাধা?”
শান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো রাফিয়ার কথায়। রাফিয়া শানকে জাপ্টে ধরে বললো,
–“আই লাভ ইউ টু।”
চলবে~