একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-১১

0
163

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।

‘বিয়ের মুডে থাকলেই হবে।’

অন্বিতা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘আমি “না” করলে এই বিয়ে কখনোই হবে না।’

‘আমি জানি, তুমি “না” করবে না।’

‘কেন করব না? তিন বছর আগে যা ঘটেছিল, একই ঘটনা আবার যে পুনরাবৃত্তি হবে না, তার কী নিশ্চয়তা?’

মাহির এগিয়ে এল। অন্বিতার দুই হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে বলল,

‘ওয়াদা করছি, আর একটুও কষ্ট দিব না তোমায়।’

অন্বিতা ঢোক গিলল। রাশভারী স্বরে বলল,

‘তোমাকে যে আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘শুধু একবার বিশ্বাস করো, একবার।’

মাহিরের চোখে মুখে অনুশোচনা। অন্বিতা ঘোর দ্বিধায় পড়েছে। আরেকটা সুযোগ কি দেওয়া উচিত? এই চিন্তা মস্তিষ্কে উঁকি দেওয়া মাত্রই, স্নায়ুগুলো সজাগ হয়ে চট করে সংকেত পাঠিয়ে জানায়, “এই মানুষটাই সেদিন আর সবার মতোই তোর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল; তুই কি তাকে এত সহজেই ক্ষমা করে দিবি?” পরক্ষণেই নিজেকে আবার পাহাড়ের ন্যায় দৃঢ় করে ফেলে অন্বিতা। ভাবে, একবার গলে দেখেছিল, মানুষ পা মাড়িয়ে গিয়েছে; আর গলা যাবে না তাই।

এতসব ভাবনার মাঝেই অস্থির, অস্পষ্ট চোখের দৃষ্টিতে কিছু একটা আটকে গেল তার। বারান্দা গলিয়ে রুমের ভেতর থেকে আসা একটা দৃশ্য। গিটার নিয়ে স্কাউচে বসা ছেলেটা; অন্বিতার পরিচিত ঠেকছে। অন্বিতা চোখ সরু করে। জানলা আর বারান্দার গ্রিল টপকে আসা প্রতিচ্ছবিতে তার মুখটা স্পষ্ট নয়। তবে সে দেখতে পাচ্ছে মানুষটাকে। গিটারের এই সুরও চেনা তার।

অন্বিতার অমন মনোযোগী, গভীর দৃষ্টি দেখে মাহির সেদিকেই চাইল। তবে দেখল না কিছুই। জিজ্ঞেস করল,

‘কী দেখছ এভাবে?’

স্তম্ভিত হলো অন্বিতা। বলল,

‘ক-কই, কিছু না তো।’

মাহির অন্বিতার গালে হাত রেখে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘তবে ঐদিকে কী দেখছ?’

গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল অন্বিতা। বলল,

‘কিছু না।’

‘বললে না তো কিছু? আরেকবার কি বিশ্বাস করা যায় না?’

অন্বিতার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জলদগম্ভীর স্বরে বলল,

‘বিশ্বাস যে ঠুনকো জিনিস না, মাহির। তুমি যেভাবে আমার বিশ্বাসে আঘাত করেছ, তারপর আমি কী করে আবার তোমায় বিশ্বাস করব? আমার যে এখন ভয় হয়।’

‘ওয়াদা করেছি তো, শুধু আর একটা সুযোগ দাও।’

অন্বিতা কিছু বলার আগেই একটা সুর ভেসে এল,

“আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস ।
যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো”

‘কে গাইছে?’

মাহির বিস্ময়াবিষ্ট সুরে প্রশ্ন ছুড়ল। অন্বিতা তাকে দেখিয়ে বলল,

‘ঐ বাসায় একজন ব্যাচেলর থাকেন, দারুণ গান করেন উনি।’

ভ্রু কুঁচকে সেদিকেই তাকায় মাহির। জিজ্ঞেস করে,

‘সেই ব্যাচেলর, যে তোমাকে তার গাড়িতে করে আমার নার্সিংহোমে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল? অমিত দে?’

অন্বিতা চমকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘তুমি এতকিছু জানো কী করে?’

‘তোমার সাথে সংযুক্ত সবকিছুই আমাকে জানতে হয়। বাই দ্য ওয়ে, এটাও মোটেও দারুণ গান না। আমিও এর থেকে ভালো পারি।’

অন্বিতা রগড় সুরে বলল,

‘তবে একটা গেয়ে দেখাও।’

মাহির হেসে মাথা ঝাঁকাল। তারপর গলা ঝেড়ে টান দিল সুরে,
সে দুই লাইন গাইতেই দেখল অপর বারান্দাতে একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে গিটার, তার গানের সুরের সাথে মিলিয়ে গিটার বাজাচ্ছে। অন্বিতা খেয়াল করল ছেলেটাকে। আজ সে নিশ্চিত, এতদিন সে এই ছেলের’ই গান শুনে এসেছে। কী চমৎকার তার গিটার বাজানো, কী চমৎকার তার ভাবমূর্তি। অন্বিতা নিষ্পলক তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ কী ভেবে আবার মাহিরের দিকে চাইল। মাহিরও ছেলেটাকে অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আর গাইছে। অন্বিতা খেয়াল করল, সে মাহিরকে দেখে এখনো যেভাবে মুগ্ধ হয়, অন্যকাউকে দেখে ঠিক একই ভাবে মুগ্ধ হতে পারে না আর। কী আশ্চর্য!

মাহির গান শেষ করতেই ছেলেটি হাত তালি দেয়। চমৎকার হেসে বলে,

‘আপনি তো খুব ভালো গান করেন।’

মাহির হেসে জবাবে বলল,

‘আপনিও খুব দারুণ গিটার বাজান।’

‘আমার ভাইয়ের থেকে শেখা। আমার ভাইও খুব চমৎকার গান করেন?’

অন্বিতা চট করে প্রশ্ন করল,

‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় আপনি গান করেন না?’

ছেলেটা মৃদু হেসে বলল,

‘না না, আমি তো আজ’ই ভাইয়ের বাসায় এলাম। বোধ হয় ভাই করেন।’

অন্বিতা ছোট্ট করে বলল,

‘ওহ, আপনার ভাই ভালো গান করেন।’

ছেলেটি হেসে বলল,

‘ভাইয়ের হয়ে ধন্যবাদ। আপনারা তাহলে কথা বলুন, আমি ভেতরে যাই।’

ছেলেটি ভেতরে চলে গেল। মাহির ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,

‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঐ ছেলের ভাই গান করে?’

অন্বিতা তার দিকে চেয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, একদিনও বাদ যায় না।’

‘ওহ, তার প্রশংসা তো খুব সুন্দর করতে পারলে, তাহলে আমি কী দোষ করলাম?’

‘তুমিও ভালো গান।’

‘এইটুকুই? বুঝেছি, শুধুমাত্র ফরমালিটি।’

অন্বিতা কিছু বলার আগেই মাহিরের ফুপি সেই রুমে এলেন। ডাকলেন,

‘মাহির, অন্বিতা, কোথায় তোমরা?’

বারান্দা থেকে ভেতরে এল দুজন। মাহির জিজ্ঞেস করল,

‘ডেইট কি ফিক্সড হয়েছে, ফুপি?’

‘হ্যাঁ, আগামী মাসের সাত তারিখ।’

এক মাসের ব্যবধান শুনে মাহির হতাশ হলো। বলল,

‘এক মাস পর কেন? এই মাসেই কি ডেইট ফেলা যেত না?’

ফুপি হাসলেন। বললেন,

‘বাবা, তোর তো দেখছি খুব তাড়া। অন্বিতা আমার ভাইপো কে একেবারে পাগল করে ছেড়েছে।’

বিরক্ত হলো অন্বিতা। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘আপনার ভাইপো আগ থেকেই পাগল ছিল, আমি তাকে পাগল বানাইনি।’

ফুপি ক্রূর হেসে বললেন,

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আচ্ছা চলো, বসার ঘরে চলো এখন।’

সব কথাবার্তা পাকাপাকি করে তারা প্রস্থান ঘটালেন। অন্বিতা আর রা করেনি। ইচ্ছে জাগেনি আর। জানে না, ভবিষ্যতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে; মাহিরকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়ে আদৌ ঠিক করেছে কি-না, সেটাও নিয়েও যথেষ্ট দ্বিধায় আছে সে।

আপাতত ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তার অযাচিত মনে উঁকি দিচ্ছে যতসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা। পাশের বিল্ডিং এর এই ছেলেটাকে তার কাছে বেশ রহস্যময় লাগছে। মনে হচ্ছে যেন, ছেলেটা ইচ্ছে করে তার কাছে নিজেকে ধরা দিচ্ছে না। কিন্তু কেন? এমন নয় যে ছেলেটা তার পূর্ব পরিচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে। বাবার পর এক মাহির ব্যতিত আর দ্বিতীয় কোনো পুরুষের সাথে তার কোনো আলাপ নেই। তাই এই অজ্ঞাত ছেলে আর যায় হোক, কোনোভাবেই তার পূর্ব পরিচিত হতে পারে না।

আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ কিছু একটা দেখে চমকায় অন্বিতা। মনের প্রশ্নরা সব জট পাঁকিয়ে ফেলে। কী আশ্চর্য! বারান্দায় একটা কালো রঙের বোর্ড; সেখানে আবার সাদা অক্ষরে লেখা, “বিয়ে করছেন?”

অন্বিতা হতভম্ব, হতবাক। প্রশ্নটা কি তাকেই করল? কিন্তু কেন? কোনোভাবেই এই কেন’র উত্তর পাচ্ছে না অন্বিতা। অনেক ভেবেও না। এতে চিন্তারা ডানা মেলল। প্রসারিত হলো তাদের মাত্রা। অনেকক্ষণ সেদিকে একই ভাবে তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে এল সে। নিজেকে বোঝাল, এসব নিয়ে আর ভাবা যাবে না। ঐ ছেলে কে না কে, তাকে নিয়ে এত ভাবার কী আছে? মস্তিষ্ক বুঝলেও মন বোঝে না, মনের বেহায়া তাড়নায় কোনোরকমে বিকেল কাটিয়ে সন্ধ্যায় আবারও বারান্দায় গেল সে। তবে এবার আগের থেকেও দ্বিগুণ মাত্রায় অবাক হলো।

চলবে….