একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-২৬+২৭

0
22

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৬।

বসার ঘরে সোফাটায় ধপ করে বসল শশী। মন মেজাজ ঠিক নেই তার। তাকে দেখা মাত্রই উৎফুল্ল চিত্তে ছুটে এল তার মা জিনিয়া বেগম। মেয়ের পাশে বসে আহ্লাদের সহিত বললেন,

‘কেমন আছিস, মা?’

শশী ক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘এতদিন ভালোই ছিলাম। তবে এখন নেই।’

জিনিয়া বেগমের হাসিটা মিইয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলেন,

‘কেন, কী হয়েছে, মা?’

‘আসার পথে তোমার আদরের ভাতিজার নার্সিংহোমে গিয়েছিলাম, ও এমন ভাবে আবাকে অবজ্ঞা করে চলে যেতে বলল যেন আমাকে ও চেনেই না। ওর সহকারী আমার উপর হাসছিল, মা। রাগে আমার শরীর জ্বলছে এখন। আমাকে কেন তুমি এখানে আসতে বললে বলো তো?

জিনিয়া বেগম মুখ কালো করলেন। তপ্ত স্বরে বললেন,

‘না আসলে তো খেলা হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। আগামী মাসেই মাহিরের সাথে ঐ অন্বিতার বিয়ে। তারপর বুঝতে পারছিস কী হবে? মাহির আর মাহিরের সম্পত্তি দুটোই তোর হাত ছাড়া হবে।’

অমর্ষ গলায় শশী উত্তর দিল,

‘লাগবে না আমার। না মাহিরকে, আর না ওর সম্পত্তিকে।’

জিনিয়া বেগম আঁতকে উঠে বলললেন,

‘এসব কী বলছিস? তুই না মাহিরকে পছন্দ করিস?’

‘সেজন্য ওকে কম কনভিন্স করার চেষ্টা করেনি। সে প্রথম থেকেই ঐ অন্বিতাকে নিয়েই পড়েছিল। আমাকে পাত্তা দেয়নি কখনও। তাই বিদেশ গিয়ে আমি অন্য একটা সম্পর্কে জড়িয়েছি।’

জিনিয়া বেগম কপাল কুঁচকে বললেন,

‘বিদেশে ওসব বিলাতিদের দিয়ে সংসার হয় না। ওসব বাদ দিয়ে, মাহিরকে কীভাবে বশে নিবি সেটা ভাব। এত রূপ যৌবন দিয়ে কী হবে, যদি না একটা ছেলেকে প্রেমে ফেলতে পারিস।’

শশী সোফায় মাথা এলাল। ক্লান্ত স্বরে বলল,

‘পরে ভাবব সব। খুব খিদে পেয়েছে। তুমি ডাইনিং-এ খাবার দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

‘ঠিক আছে, যা।’

________________

রুম জুড়ে পায়চারি করছে অন্বিতা। শশী আসবে শোনার পর থেকেই অস্থিরতা বেড়েছে তার। প্রথম যেদিন শশীকে দেখেছিল, সেদিন’ই শশী নানা কায়দা’ই ছোট করেছিল অন্বিতাকে। ঝামেলা হবে বিধায় অন্বিতা কোনো জবাব দেয়নি। তারপথ ঐ ঘটনার পর সবার সামনে শশী তাকে চরিত্রহীন বলেছিল। সেসব সে কোনোদিন ভুলবে না। তবে এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার সকল দুশ্চিন্তা কেবল মাহিরকে ঘিরে। যদিও তার মাহিরের উপর অগাধ বিশ্বাস, তাও শয়তানের চাল তো বোঝা মুশকিল।

সে এই দুশ্চিন্তার ভার সইতে না পেরে মাহিরকে কল দেয়। দুইবারের মাথায় কল রিসিভ হয়।

‘হ্যালো!’

‘হ্যাঁ, বলো অন্বি।’

‘কোথায় তুমি?’

‘গাড়িতে। বাসায় যাচ্ছি।’

‘ওহ আচ্ছা, যাও।’

‘কী করছো তুমি? মন ভালো হয়েছে?’

অন্বিতা ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে। আর মন ভালো! উল্টো দুশ্চিন্তা বেড়েছে যেন। তাও মাহিরকে আশ্বস্ত করতে বলল,

‘হ্যাঁ।’

‘ঠিক আছে, আমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কল দিব।’

‘আচ্ছা।’

অন্বিতা ফোন কেটে বিছানায় বসল। মাহির তাকে শশীর কথা বলল না কেন? শশী যে এসেছে, সেটা কি সে জানে না? অবশ্যই জানে। তার গাড়ি গিয়ে যেহেতু শশীকে এনেছে তারমানে সে জানে সব। তাহলে তাকে কেন কিছু বলল না? অন্বিতা নাক মুখ কুঁচকে ফেলল। এসব অযাচিত দুশ্চিন্তায় সে বিরক্ত হচ্ছে এখন।

রাতে খেয়ে দেয়ে বিছানায় শোয়া মাত্রই মাহিরকে কল দিল অন্বিতা। কল রিসিভ হলো। প্রশ্ন ছুড়ল অন্বিতা,

‘কল দিবে বলেও আর কল দাওনি কেন?’

মাহির কিঞ্চিৎ হেসে বলে,

‘অপেক্ষা করছিলে না-কি?’

‘হ্যাঁ।’

‘স্যরি, দাদু এসেছিলেন। উনার সাথে কথা বলতে গিয়ে আর খেয়াল ছিল না।’

‘শুধু দাদু’ই এসেছেন? আর কেউ আসেনি?’

‘আর কে আসবে?’

‘কিছু জানো না তুমি?’

আচনক প্রশ্ন করায় মাহির কিছু ঠাহর করতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,

‘কী জানব?’

‘শশী যে এসেছে, সেটা জানো না?’

মাহিরের এতক্ষণে টনক নড়ে। পরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘হ্যাঁ, জানি তো। কিন্তু তুমি কী করে জানলে?’

‘তুমি যেমন আমার ব্যাপারে সব খবরা-খবর আগে থেকে পেয়ে যাও, তেমনি আমিও পাই।’

মাহির হাসল। বলল,

‘বাহ! আমার পিছে গোয়েন্দা লাগিয়েছ?’

‘কেন, ভয় হচ্ছে?’

‘ভয় তারা পায়, যাদের মাঝে মিথ্যা আছে। আমার মাঝে কোনো মিথ্যা নেই, ভয় কেন পাব?’

‘যাক, তা হলে তো ভালোই। তবে শশী হঠাৎ কেন এল বলো তো?’

‘আমি শিওর জানি না কিছু। হয়তো আমাদের বিয়ে উপলক্ষে এসেছে।’

‘বিয়ের আরো দুই সপ্তাহ বাকি।’

‘হ্যাঁ, এই দুই সপ্তাহ আমার কাছে দুই যুগ লাগছে।’

অন্বিতা সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘শশী কোথায় এখন?’

মাহির হাসল ঠোঁট চেপে। মেয়েটা ভারী জ্বলছে। তাকে আরেকটু জ্বালানোর জন্য মিথ্যে বলল সে।

‘এই তো আমাদের বাড়িতেই।’

অন্বিতা চট করে শোয়া থেকে উঠে বসল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘তোমাদের বাড়িতে কেন? ওর বাড়ি নেই?’

‘এটা কেমন কথা? এটাও তো ওর বাড়ি।’

অন্বিতার রাগ হয়। সে নাক মুখ কুঁচকে বলল,

‘ঠিক আছে তবে, ওকেই ঐ বাড়িতে রাখো। আমার আর ঐ বাড়িতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। রাখছি।’

‘আরে শুনো, রাগছো কেন?’

‘না, রাগব কেন? এই শশী ফশীর জন্য আমি মোটেও রাগব না। আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাব এখন। রাখো।’

‘এই রাতেও খালা বোধ হয় চুলায় কিছু বসিয়েছেন। আমি যেন কেমন পোড়া পোড়া একটা গন্ধ পাচ্ছি।’

এই বলে শব্দ করে হেসে ফেলে মাহির। অন্বিতা রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে,

‘তুমি ভীষণ অসভ্য, মাহির। আমি সারাদিন কত দুশ্চিন্তা করেছি, জানো?’

হাসি থামাল মাহিল। ক্ষীণ সুরে শুধাল,

‘কেন? আমার উপর বিশ্বাস নেই?’

‘আছে।’

‘তাহলে কীসের দুশ্চিন্তা? তুমি আমায় বলেছিলেন না, আমার অনুপস্থিতে যেখানে তোমার মনে কেউ জায়গা করতে পারেনি সেখানে আমার উপস্থিতিতে সেটা অসম্ভব। আমার ক্ষেত্রেও তো তাই। তোমার অনুপস্থিতি আমাকে আর আমার ভালোবাসাকে যেখানে টলাতে পারেনি সেখানে এখন সেটা একেবারেই অসম্ভব। এইটুকু বিশ্বাস আমার উপর করতেই পারো।’

অন্বিতা মন খারাপ করে বলে,

‘তোমাকে তো বিশ্বাস করি। তবে ঐ শশীর উপর আমার একটুও বিশ্বাস নেই। ও ভীষণ চতুর মেয়ে, ওর থেকে তুমি দূরে দূরে থাকবে।’

‘এত এত চিন্তা থেকে বাঁচার এখন একটা’ই উপায় আছে।’

‘কী?’

‘চলো, কাল’ই বিয়ে করে ফেলি। আমার আর ধৈর্য্যে কুলোচ্ছে না।’

অন্বিতা হাসে। বলে,

‘ধৈর্য্য ধরো। ধৈর্য্যের ফল মিষ্টি হয়।’

‘আমার মিষ্টি ফল লাগবে না, তিতা হলেও চলবে।’

অন্বিতা মাথা চাপড়ে বলল,

‘আমি কাকে কী বোঝায়? আচ্ছা, শুয়ে পড়ো। কাল দেখা হচ্ছে। শুভ রাত্রি।’

‘শুভ রাত্রি।’

ফোন সাইড টেবিলে শুয়ে পড়ল অন্বিতা। মাহিরের কথা ভেবে মিটিমিটি হাসছে সে। এখনও সে ঠিক আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। দুষ্ট, অসভ্য আর অভদ্র একটা ছেলে। বয়স কী কম হলো, অথচ আচার আচরণ এখনও সেই কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের মতোই।

_____________

সকাল সকাল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিল অন্বিতা। সেখানে পৌঁছেই রিসেপশনে গিয়ে দেখল, অমিতকে। তাকে দেখে মিষ্টি হেসে এগিয়ে এল সে। জিজ্ঞেস করল,

‘কেমন আছেন?’

তাকে দেখে চমৎকার হাসল অমিত। বলল,

‘ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। চেকআপের জন্য এসেছেন?’

‘জি।’

‘ওহ আচ্ছা। চেকআপ করান তবে, আমি আমার ডেস্কে যাই।’

‘ঠিক আছে।’

অন্বিতা চলে যেতেই অয়ন একটা টোকেন নিয়ে এল। অমিতের হাতে দিয়ে বলল,

‘তোর সিরিয়াল নাম্বার।’

অমিত সেটা হাতে নিতে নিতে হেসে বলল,

‘অন্বিতার সাথে দেখা হয়েছে।’

পাশের সিটে বসল অয়ন। ঘড়িতে টাইম দেখতে দেখতে বলল,

‘নাচ।’

‘নাচব কেন?’

‘অন্বিতার সাথে দেখা হয়েছে সেই খুশিতে।’

অমিত হেসে বলল,

‘তা ভালো বলেছিস। এই খুশিতে নাচা’ই যায়।’

অয়ন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,

‘তুই আর মানুষ হলি না।’

‘আর যাই হই, তোর মতো রোবট তো আর হয়নি।’

অমিতের কথার বিপরীতে কিঞ্চিৎ হাসে অয়ন। বলে,

‘রোবট’ই ভালো। অন্তত, মানুষের মতো কষ্ট তো আর পেতে হবে না।’

অমিত কিছু বলার আগেই তাদের ডাক পড়ে। কথাটুকু গিলে উঠে দাঁড়ায় সে। অয়নকে সাথে নিয়ে ভেতরে যায় অতঃপর।

চলবে…..

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৭।

ডেস্কে বসে রোগী দেখছিল অন্বিতা। হঠাৎই চোখ গেল তার দরজার কাছে। মাহিরের সহকারী সেখানে দাঁড়ান। সে অন্বিতাকেই দেখছে চঞ্চল চোখে। অন্বিতা ভ্রু কুঁচকায়, উনি কি কিছু বলতে চান। রোগী বেরিয়ে যেতেই অন্বিতার তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,

‘কিছু বলবেন?’

সহকারী আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচু সুরে বলল,

‘স্যারের যে একজন কাজিন আছে সেটা আপনি জানেন, ম্যাডাম?’

‘হ্যাঁ, জানি তো। কেন?’

‘উনি কাল এখানে এসেছিলেন। আজও এসেছেন। স্যারকে বিরক্ত করছেন খুব। কিন্তু স্যার এখানে আছেন বিধায় ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতেও পারছেন না। দুঃখিত, তবে ঐ মেয়েটার ব্যবহার আমার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।’

অন্বিতা চিন্তায় ডুবল। কাল শশী এখানে এসেছিল, অথচ মাহির তাকে এই কথা জানায়নি। সে কপালের ভাঁজ সোজা করে বলল,

‘আপনি এসব আমাকে কেন বলছেন?’

সহকারী কাচুমাচু করে বলে,

‘ম্যাডাম, আপনি স্যারের হবু স্ত্রী। তাই আমার মনে হলো আপনাকে জানানো উচিত ব্যাপারটা।’

অন্বিতা ঠোঁট চেপে খানিক ভেবে জানতে চাইল,

‘উনি এখন কোথায়?’

‘কে?’

‘স্যারের কাজিন।’

‘স্যারের কেবিনেই আছেন।’

‘ঠিক আছে, আপনি যান।’

সহকারী চলে এল সেখান থেকে। অন্বিতা পরিশ্রান্ত বদনে এগিয়ে গেল মাহিরের কেবিনের দিকে। দরজায় নক করে বলল,

‘আসব, স্যার?’

অন্বিতার গলা পেয়ে মাহির চমকায়। মেয়েটা এই কেবিনে শশীকে দেখে রেগে যাবে না তো? সে কিছু বলার আগেই ভেতর থেকে শশী বলল,

‘পরে আসুন, মাহির এখন বিজি আছে।’

মাহির কপাল কুঁচকে তাকায়। সন্তপ্ত গলায় বলে,

‘আমি বলেছি তোকে, আমি বিজি?’

শশী পুনরায় উত্তর দেওয়ার আগেই অন্বিতা দরজা ঠেলে প্রবেশ করে। শশী ঘুরে তাকায়। অন্বিতাকে দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় তার। তাও মুখে মেকি হাসি টেনে বলল,

‘আরে অন্বিতা দেখছি, কেমন আছো?’

অন্বিতা চমৎকার হাসল। বলল,

‘ভীষণ ভালো। আপনি কেমন আছেন?’

‘ভালো আছি। তোমার কী ভাগ্য বলো, এত হসপিটাল থাকতে মাহিরের হসপিটালেই ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পেলে।’

অন্বিতা প্রসন্ন হেসে জবাবে বলল,

‘মাহির নিজেই সব ব্যবস্থা করেছে, আমাকে কোনো কষ্ট’ই করতে হয়নি।’

শশীর মুখটা চুপসে যেতে নিয়েও চুপসালো না। বলল,

‘বাহ, তাহলে তো ভালোই।’

‘আপনাকে দেখে কিন্তু আমি বেশ খুশি হয়েছি। আফটার অল, আপনি আমার একমাত্র ননদ।’

শশী কোনোরকমে হাসল। বলল,

‘আমারও তোমাকে দেখে ভালো লাগেছে।’

অন্বিতা এবার তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মাহিরের দিকে চাইল। বলল,

‘মাহির, আমার একটা হেল্প লাগবে; তুমি কি একটু আসতে পারবে?’

মাহির আশ্চর্যান্বিত। অন্তত হাসাপতালে থাকা অবস্থাতে অন্বিতা তাকে কখনও তুমি বা নাম ধরে ডাকেনি। শশীকে দেখিয়ে যে সে এসব করছে এটা আর বোঝার বাকি নেই। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,

‘হ্যাঁ, চলো।’

‘সেকি, তুমি চলে গেলে আমি কার সাথে কথা বলব?’

‘তুই বাসায় যা শশী। আমি এখানে কাজ করতে এসেছি, তোর সাথে কথা বলতে নয়।’

‘কিন্তু আমার তো তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।’

‘সেসব পরে শোনা যাবে। তুই এখন যা।’

এই বলে মাহির অন্বিতার সাথে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ল। কেবিনে একা বসে রইল শশী। রোষানলে জ্বলছে সে। মাথার ভেতর ধপ ধপ করছে। মাহিরের এই অবজ্ঞা তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না। কী আছে ঐ মেয়ের মাঝে, যা তার নেই? বরং ঐ মেয়ের চেয়ে সে অধিক সুন্দরী। লন্ডনের ধনী পরিবারের ছেলেরা তাকে পাওয়ার জন্য পথ চেয়ে থাকে, অথচ সে সব ছেড়ে এখানে এসেছে এই ছেলেকে পটানোর জন্য। সে রাগে টেবিলের উপর জোরে চাপড় মেরে উঠে দাঁড়ায়। পেছন ঘুরতেই এক হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে শরীর আরো জ্বলে উঠে তার।

মাহিরের সহকারীর ঠোঁটের কোণে ঝুলছে নিরুপম হাস্যরেখা। শশী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,

‘ঐ অন্বিতাকে আপনি ডেকে এনেছেন, তাই না?’

ছেলেটি সহসা মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘জি।’

‘আপনার ভীষণ সাহস। কিন্তু খবরদার আমার সাথে লাগতে আসবেন না।’

‘আপনার সাথে কোথায় লাগলাম? আমি তো কেবল ভাল্লুকের কাছ থেকে মৌচাককে বাচাচ্ছি।’

শশী নাক মুখ শক্ত করে কুপিত স্বরে বলল,

‘আপনি আমায় ভাল্লুক বলছেন?’

সহকারী ভ্রু নাচিয়ে বলে,

‘কী করে বুঝলেন?’

শশী দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘দুদিনের ভেতরে যদি আমি আপনাকে চাকরি থেকে বের না করেছি তবে আমার নামও শশী না।’

সহকারী হেসে বলল,

‘তবে আজ থেকেই নতুন নাম ভাবতে থাকুন। অল দ্য বেস্ট।’

এই বলে চলে আসে সে। শশী নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে ক্রোধকে সংযত করে। অন্বিতা পরে, আগে এই ছেলেকে দেখতে হবে।

অন্বিতা মাহিরের দিকে একটা ইসিজি’র রিপোর্ট দিয়ে বলে,

‘এই রিপোর্টে কী সমস্যা আমি বুঝতে পারছি না, আপনি বুঝিয়ে দিন।’

মাহির ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

‘একটু আগেও “তুমি” করে বলছিলে।’

‘হ্যাঁ, আমার যখন যা খুশি ডাকব। আপনার কোনো সমস্যা আছে?’

মাহির ঠোঁট চেপে মাথা ঝাঁকাল। বোঝাল, তার কোনো সমস্যা নেই। তারপর রিপোর্ট’টা দেখতে লাগল মনোযোগের সহিত। অন্বিতা মাথায় অন্য কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে নিজেকে ধাতস্ত করতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,

‘কালও শশী এখানে এসেছিল, অথচ তুমি আমায় বলোনি।’

মাহির রিপোর্টের উপর চোখ রেখেই বলল,

‘ও জরুরি কেউ নয় যে, বলতে হবে।’

‘মাহির, আমার ওকে পছন্দ না।’

‘আমারও না।’

অন্বিতা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,

‘তাহলে ওকে ধমক দিয়ে কেন এখান থেকে যেতে বলো না? এত নরম গলায় কথা বলো কেন?’

ফাইল রেখে অন্বিতার দিকে চাইল মাহির। কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,

‘এটা আমার কাজের জায়গা, অন্বি। আমি আজ ওর উপর রাগ দেখালে, ও এখানেই সিনক্রিয়েট শুরু করত। তখন এসব কে সামলাতো বলো তো?’

অন্বিতা মুখ গোমড়া করে বলল,

‘অন্তত এই নার্সিংহোমে যেন না আসে, এইটুকু তো বলতেই পারো।’

মাহির সরু চোখে চেয়ে বলে,

‘এত হিংসে তোমার?’

অন্বিতা কপাল কুঁচকে বলল,

‘তোমার চেয়ে কম।’

‘আমি কখন হিংসে দেখালাম।’

‘ভালো সাজবে না একদম। আমি অমিতকে চিনতাম বলে তুমি তাকে একদিন আগেই রিলিজ দিতে চেয়েছিলে। কী ভেবেছ, আমি কিছু বুঝিনা?’

মাহির মাথা চুলকে হাসল। বলল,

‘তা তো একটু থাকবেই। তুমি যেভাবে অমিতের জন্য অস্থিরতা দেখাচ্ছিলে, আমি তো চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।’

‘আজও কিন্তু উনি হাসপাতালের এসেছেন, চেকআপের জন্য। শশী এখানে থাকলে আমিও উনার সাথে বসে বসে গিয়ে গল্প করব।’

‘কী ফাজিল মেয়ে! জুনিয়র হয়ে সিনিয়রকে হুমকি দাও। এই অপরাধে তোমাকে আমি কী শাস্তি দিতে পারি, ধারণা আছে?’

অন্বিতা ফাইলটা নিতে নিতে বলল,

‘হ্যাঁ, আছে। এবং তাই এরপর থেকে আমি আরও বেশি করে তোমায় হুমকি দিব।’

এই বলে ফাইল নিয়ে হাঁটা ধরল। মাহির ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘এই মেয়ে, রিপোর্ট নিয়ে কোথায় যাচ্ছো? আমি ঠিক ভুল বলেছি কিছু?’

অন্বিতা ফিরে চাইল। হেসে বলল,

‘রিপোর্টে সব ঠিক আছে, ঐটুকু আমি বুঝি।’

এই বলে আবারও হাঁটা ধরল সে। তার কথা শুনে হাসল মাহির।

ডেস্কে বসে আছে অন্বিতা। রোগী নেই এখন। তখনই সেখানে এসে উপস্থিত হয় অমিত আর অয়ন। তাদের দেখে প্রসন্ন হাসে অন্বিতা। বলে,

‘চেকআপ করেছেন?’

‘জি।’

অমিত উত্তর দিল।

‘এখন সুস্থ আছেন তো?’

‘একেবারে। তবে সমস্যা এখন আমার বন্ধুকে নিয়ে।’

অমিতের কথা শুনে অন্বিতা অয়নের দিকে তাকায়। অয়ন আমতা আমতা করে বলে,

‘ন না, আমার কোনো সমস্যা নেই।’

‘আলবাত আছে। তুই বস এখানে।’

অয়নকে অমিত জোর করে চেয়ারে বসাল। তারপর অন্বিতার দিকে চেয়ে চিন্তিত সুরে বলল,

‘ওর আজকাল খুব বুকে ব্যথা হয়। এই ব্যথার ভীষণ যন্ত্রণা। ঔষধ খেলেও কমে না। ওকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি আমি।’

অমিতের কথা শুনে অয়ন তার দিকে শাণিত চোখে চাইল। অন্বিতা জিজ্ঞেস করল,

‘বুকের ঠিক কোন জায়গায় ব্যথা বলতে পারবেন?’

অয়ন কাচুমাচু করছে। অমিত তার বুকের বাম পাশে হাত রেখে বলে,

‘এখানে ব্যথা। ভীষণ ব্যথা, সেই ব্যথায় ওর রাতে ঘুম হয় না।’

অন্বিতা হাসল। বলল,

‘ব্যথা আপনার, অথচ ব্যাখ্যা দিচ্ছে আপনার বন্ধু।’

অয়ন অস্বস্তিতে পড়ল যেন। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘দুঃখিত, আমার কোনো ব্যথা নেই। আসছি।’

সে চলে যেতে নিলেই অমিত তাকে টেনে ধরে। মেজাজ দেখিয়ে বলে,

‘আজ চিকিৎসা নিয়েই যেতে হবে তোর।’

চলবে….