একটি অপ্রেমের গল্প পর্ব-৩৫+৩৬

0
27

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৫।

গান শেষ করে অয়ন অমিতের হাত থেকে রঙিন কাগজে মুড়ানো একটা ছোট্ট প্যাকেট অন্বিতার দিকে বাড়িয়ে দেয়। যথাসম্ভব মুখে হাসি টেনে বলে,

‘আপনার উপহার। নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।’

অন্বিতা স্মিত হেসে সেটা গ্রহণ করে ধন্যবাদ জানায়। মাহির ক্ষীণ হেসে বলে,

‘আপনি বেশ সুন্দর গান করেন।’

অয়ন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হাসল। বলল,

‘ধন্যবাদ।’

শশী বিরক্তিকর বদনে চেয়ে দেখছিল সব। কেন যেন একটা সূক্ষ্ম সন্দেহ চিত্তজুড়ে আলোড়ন করল। সে সরু চোখে কিছুক্ষণ অয়নকে দেখে তাকাল মাহিরের দিকে। বলল,

‘আমাদের বোধ হয় এবার উঠা উচিত।’

মাহির আর অন্বিতা শশীর দিকে তাকায়। অন্বিতার চোখে মুখে অস্পষ্ট বিমুখতা। এই মেয়ে চলে গেলেই পারত, একে বসে থাকতে কে বলেছে। কথাটুকু মনে গিলেই সে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘আপু, আপনার অসুবিধা হলে আপনি মামাকে নিয়ে আগে চলে যেতে পারেন। আমরা আরো কিছুক্ষণ পর ফিরব।’

শশী ক্ষুব্ধ হলেও প্রকাশ করল না। ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলে বলল,

‘এটা আবার কেমন কথা, অন্বিতা? শ্বশুরবাড়ির সবাইকে বিদায় দিয়ে তুমি তোমার হাজবেন্ডের সাথে একা ফিরবে? এমন কখনও হতে দেখেছ?’

‘আমি আপনার অসুবিধার কথা ভেবেই বলছিলাম। আপনার থাকতে ইচ্ছে না করলে তো আর আমি জোর করতে পারিনা।’

শশীর ক্রোধ বাড়ল। অপমানে লাগল তার। রোষপূর্ণ চোখে অন্বিতার দিকে তাকাতেই মাহির বলল,

‘হ্যাঁ শশী, তোর অসুবিধা হলে চলে যা। আমরা কিছুক্ষণ পরে আসছি।’

ফুঁসতে আরম্ভ করল শশী। অহমিকায় এহেন আঘাতে চোখ মুখ দৃঢ় হয়ে উঠল তার। তাও ক্ষান্ত করল নিজেকে। কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘না না, আমার অসুবিধা নেই। তোমাদের সাথেই যাব।’

অন্বিতা কপাল কুঁচকায়। বিড়বিড় করে আওড়ায়,

‘বড্ড ছ্যাচড়া!’

অমিত প্রসঙ্গ পাল্টাল। প্রসন্ন গলায় বলল,

‘অন্বিতা, আপনার উপহার তো আপনি পেয়ে গেলেন। এবার কি আমরা উঠতে পারি?’

অন্বিতা অপ্রস্তুত খানিক। কিছু একটা বলতে উশখুশ করছে যেন। আবার ভাবছে, এমনটা করা উচিত হবে না। চিন্তা হলো, মাহির স্বাভাবিক ভাবে নিবে কি-না। তাও সাহস করল সে। মাহিরের দিকে চেয়ে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘মাহির, আমি একটু অয়নের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে।’

অন্বিতার এমন অনুরোধে মাহির চিন্তায় পড়ে অচিরাৎ। অয়নের সাথে অন্বিতার আলাদা কী কথা থাকতে পারে, সেই প্রশ্নে মস্তিষ্ক সজাগ হয় তার। একপলক দেখে নেয় অয়নকে। যে চুপচাপ বসে তাকিয়ে আছে মেঝের পানে। অন্বিতা ইতস্তত, চিন্তিত। মাহির ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিবে তো? আবার ভুল বুঝে বসবে না তো?

সদ্য বিয়ে করা তার লাল টুকটুকে বউয়ের এহেন এক অযাচিত আবদার মাহির ফেলতে পারল না। খানিকটা ভড়কালেও পরক্ষণেই মৃদু হেসে বলল,

‘ঠিক আছে, কথা বলে এসো।’

অন্বিতা অয়নের পানে দৃষ্টি ফেলল। বিব্রত সে। তাও অনুনয়ের সুরে বলল,

‘অয়ন, আপনার সাথে আমার কথা আছে। আমার সাথে আসুন, প্লিজ।’

আচমকা এমন কিছু আশাতীত ছিল। অয়ন ফ্যালফ্যাল করে চাইল। একবার দেখল অন্বিতাকে আবার দেখল মাহিরকে। অন্বিতাকে খানিক অপ্রতিভ দেখালেও মাহির নিরুত্তাপ। অয়ন কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তার উপর এখানে অন্বিতার স্বামী বর্তমান। নিজের সদ্য বিয়ে করার স্বামীর সম্মুখে এমন কিছু চাইবে সেটা অয়নের ধারণাতে ছিল না। অন্বিতা ফের বলল,

‘কী হলো? আপনি কি কথা বলতে ইচ্ছুক নন?’

এই পর্যায়ে খানিক মাথা ঝাঁকিয়ে অয়ন বলল,

‘জি, চলুন।’

অন্বিতা উঠে দাঁড়াল। অয়নও গেল তার পেছন পেছন। অন্বিতার রুমের বারান্দায় গিয়ে থামল পা যুগল। বসার ঘরের সবাই বেশ অবাক হয়ে বসে আছে। আভা, অমিত ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও বাকি সবার জন্য ব্যাপার খানা ব্যাপক চিন্তার। শশী তো রীতিমত নিজের মনে সাজিয়ে ফেলল পুরো গল্প। কিছু না জেনে, না বুঝে এই ঘটনার আদ্যোপান্ত ইতিহাস বুঝে ফেলল যেন। খালামনি, আসিয়া বেগম, মাহিরের মামা তাঁরাও খানিকটা চিন্তিত। অন্বিতা অয়নের সাথে কী কথা বলতে ঐ রুমে গেল, এই এক চিন্তা’ই মাথায় বিচরণ চালাচ্ছে তাঁদের।

বারান্দায় দাঁড়াতেই প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় অপর পাশের বারান্দাটা। অয়ন দেখছে সেটা। অন্বিতা একপলক অয়নকে দেখে সেই বারান্দার দিকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,

‘জানেন, ঐ বারান্দায় বসে একটা ছেলে আমাকে প্রতি সন্ধ্যায় গান শুনাত। তবে এখন আর শোনায় না। তার কী হলো বলুন তো? সে কি আমার সাথে অভিমান করেছে?’

বেদনাবিধু চক্ষুযুগল নিয়ে অন্বিতাকে দেখল অয়ন। ঠোঁট উল্টে বলল,

‘হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।’

কিঞ্চিৎ হাসল অন্বিতা। বলল,

‘সে আপনার মতোই দারুণ গান গায়। আপনার মতোই চমৎকার গলা তার।’

অয়ন নিস্তব্ধ, নির্বাক চেয়ে থাকে। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। অন্বিতা নিজে থেকেই বলল,

‘শুনেছি, সে না-কি আবার আমাকে পছন্দও করে।’

এবার ঊর্ধ্বশ্বাস ফেলে অয়ন। জলদগম্ভীর স্বরে বলে,

‘ভালোও বাসে।’

চমকে তাকাল অন্বিতা। এতক্ষণ চেয়ে থাকলেও অয়ন চোখ সরিয়ে নেয় চট করে। ঐ চোখে চোখ পড়লে যে বুকটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাবে। সেই রক্তাক্ত জখম বুক সামলানোর সাধ্যি তার নেই। অন্বিতা নিশ্বাস ফেলল সন্তর্পনে। বিমর্ষ কন্ঠে বলল,

‘কিন্তু আমি যে তাকে ভালোবাসি না।’

ত্বরিত হাসল অয়ন। বলল,

‘সে জানে।’

অন্বিতা নিষ্পলক চেয়ে বলল,

‘তাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি।’

‘সে কষ্ট পায়নি।’

‘সত্যি বলছেন?’

উদ্বেগ দেখাল অন্বিতা। অয়ন হেসে অভয় দিয়ে বলল,

‘জি।’

মাথা নুয়াল অন্বিতা। নিজের বিষন্ন মনকে ধাতস্ত করে বলল,

‘আমি কারোর দুঃখের কারণ হতে চাই না। তাই আপনাকে আজ ডেকেছি, কারণ আজ কথা না বললে আর কখনোই কথা হতো না। আর কখনোই আমি আপনার সম্মুখে দাঁড়াতে পারতাম না।’

থামল অন্বিতা। অয়নের নিবিষ্ট চাহনি তার অভিমুখে। যেন অন্বিতার কথার সুর বুকে ঝংকার তুলছে তার। মনে হচ্ছে সময় এখানে থামুক, আর অন্বিতা এভাবেই বলতে থাকুক। কী চমৎকার অনুভূতি। এক পল থেমে অন্বিতা ফের বলতে শুরু করে,

‘মাহিরের সাথে আমার সম্পর্কটা আদ্যোপান্ত হিসেব করলে পাঁচ বছর। তার মধ্যে তিন বছরের প্রেম, দুই বছরের বিচ্ছেদ। আমাদের তিন বছরের প্রেমের পর যখন দুই বছরের বিচ্ছেদ ঘটল সেই দুই বছরের এক রাতও নিশ্চিন্তে আমি ঘুমাতে পারিনি। এমন এক রাতও যায়নি, যে রাতে ওর জন্য আমার বুকে ব্যথা উঠেনি। দুজন দুই মেরুতে থাকা স্বত্ত্বেও একে অপরের সাথে জুড়ে ছিলাম প্রতিটা মুহুর্ত। না মাহির না আমি, কেউ কাউকে ভুলতে পারিনি। মাহিরের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ যখন বন্ধ, যখন মনে হয়েছে, মাহির আমায় ভুলে গিয়েছে আর ফিরে আসবে না, তখনও আমি ওর স্মরণেই দিন কাটিয়েছি। ও ব্যতিত অন্য কারোর কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। আর যখন ও এল, সবটা সামলে নিতে চাইল, তখন বেমালুম ভুলে গেলাম সমস্ত অভিমান, রাগ, ক্ষোভ। ওকে নিজের করে পাওয়ার যে বিতৃষ্ণা ওর আঁড়ালে ছিল, সেটা ও সামনে আসতেই আরো প্রকট হলো যেন। তাও নিজের আত্মসম্মান ধরে রাখতে তা প্রকাশ করিনি। তবে লাভ হয়নি খুব একটা, সেই হার মানতে হলো। হৃদয়ের কাছে হার মানল মস্তিষ্ক। সব যুক্তি ভেঙে গুড়িয়ে গেল। মিলিয়ে গেল সব রাগ, ক্ষোভ, বিদ্বেষ। শুধু একটাই কথা মনে হলো, মাহির আমাকে ভালোবাসে আর আমি ওকে; এই কথার উপর যেন আর কোনো সত্যি নেই।’

দম ফেলল অন্বিতা। গলাটা কেমন যেন ধরে এসেছে। পাশের মানুষটার প্রতিক্রিয়া সে অবগত নয়। অন্বিতা সেই প্রতিক্রিয়া জানার জন্যই তাকাল তার দিকে। দেখল তার পরিশ্রান্ত দৃষ্টি আকাশপানে। অন্বিতা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে ফের বলল,

‘আপনি নিঃসন্দেহে চমৎকার পুরুষ। যত্ন করে, আগলে রেখে ভালোবাসতে জানেন। আপনাকে যে পাবে সে সৌভাগ্যবতী। তাই বাকি ভালোবাসাটুকু সেই সৌভাগ্যবতীর জন্য জমিয়ে রাখুন।’

অয়ন তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই ঢোক গিলল অন্বিতা। একবার নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ‘মানুষটা কি কাঁদছে?’ না না, তার তো চোখ শুকনো। তবে দেখে কেন মনে হচ্ছে, সে কাঁদছে? অন্বিতা ভেবে পায় না। অয়ন আর্তস্বরে বলল,

‘আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা ছিল তা সবটুকু নিংড়ে একজনকেই দিয়ে দিয়েছি। এখন সেখানে এক বিশাল শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।’

অন্বিতার হৃদয় ভার হলো। বড্ড মায়া হলো মানুষটার জন্য। ভালোবাসার দহনের যন্ত্রণা সেও জানে, বোঝে। তাই তো এর মুখাপেক্ষী কোনো সান্ত্বনাবাণী পাচ্ছে না সে। অয়ন সামনে তাকাল ফের। নিজ মনেই বলল,

‘যদি প্রথমে জানতাম, তার হৃদয় অন্য কারোর অধীনে তবে আমিও আমার হৃদয়ের আলোড়ন থামিয়ে দিতাম, জোর করে আটকে রাখতাম। তবে যতদিনে জেনেছি, ততদিনে আমার হৃদয়ের কাহিল অবস্থা। প্রথম প্রেমের দাবানলে বেহাল দশা তার। চেষ্টা করেছি খুব, সামলাতে পারিনি। রাতে বুকে জ্বললে গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেতাম। আমার বেসামাল বেহায়া হৃদয় তখন হেসে বলত, “বোকা, প্রেমানলের জ্বালা কি আর গ্যাস্ট্রিকের ঔষধে যায়?”

এইটুকু বলে নিজ মনেই হাসল অয়ন। তারপর প্রসন্ন গলায় অন্বিতাকে বলল,

‘আজ আপনি না বললেও আমি আসতাম। আমাকে তো আসতেই হতো, অন্তত আপনার প্রশান্তিময় স্নিগ্ধ মুখের আমেজটুকু দেখার জন্য। প্রিয় মানুষকে নিজের করে পাওয়ার খুশিটুকু বোঝার জন্য। আর কিছু না হোক, শেষবারের জন্য একটা গান শুনানোর জন্য হলেও আসতে হতো। চিন্তা করবেন না, পৃথিবীর গতি কারোর জন্য থেমে থাকে না। আমিও থেমে থাকব না। এই প্রেমানলের উত্তাপ বাড়ুক বা কমুক, আমি আমার মতো ঠিক সয়ে যাব সব। আপনি নিশ্চিন্ত মনে সংসার সাজান। দোয়া করব, পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আপনার সংসারে এসে ধরা দেয়।’

চোখ বুজে নিঃশ্বাস ছাড়ল অন্বিতা। সবটুকু শুনে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত সে। তাও বলল,

‘নিজের জীবন গুছিয়ে নিবেন। আর এক মনের সমস্ত ভালোবাসা একজনের জন্য ঢেলে দেওয়ার পরেও যদি কিছু আংশিক থাকে তবে সেইটুকু রেখে দিন যত্ন করে। নিশ্চয় একদিন কেউ এসে সেই আংশিক অংশটুকু পরিপূর্ণ করবে। তার জন্য অপেক্ষা করুন।’

নির্মল হেসে মাথা নাড়াল অয়ন। বোঝাল, সে অপেক্ষা করবে। অথচ বক্ষস্থলের কম্পন বলল, “হয়তো কখনও আর দ্বিতীয় কেউ আসার সুযোগও পাবে না।”

চলবে….

#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৬।

‘তাহলে সেই ব্যক্তি অমিত নয় অয়ন?’

চোখ তুলে তাকাল অন্বিতা। সদ্য কান্নায় ভেজা পিঙ্গলবর্ণ চোখে চেয়ে কিঞ্চিৎ হাসল মাহির। অন্বিতার এক হাত টেনে নিজের মুঠোয় ভরল। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল,

‘এই যে ধরেছি, পৃথিবীর আর কোনো শক্তি এই বন্ধন ছিন্ন করতে পারবে না।’

বিষাদ সিন্ধু চিত্ত জুড়ে এক টুকরো স্বস্তির ঢেউ আছড়ে পড়ল। অন্বিতা অপর হাত এগিয়ে রাখল তাদের হাত জোড়ার উপর। প্রশ্ন করল,

‘সত্যি তো?’

মাহির ঠোঁট চেপে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘তিন সত্যি।’

অন্বিতা পরম আবেশে তার মাথা হেলিয়ে দেয় মাহিরের বাহুতে। মাহিরের হাত যুগলের মাঝে এখনও তার হাত। অন্বিতা পরিশ্রান্ত স্বরে বলল,

‘অয়ন আমাকে পছন্দ করতেন। আমাকে এটা দুইদিন আগে অমিত জানিয়েছেন।’

মাহিরের মাঝে তেমন ভাবান্তর এল না। অন্বিতাকে সে পেয়ে গিয়েছে একেবারের জন্য। মেয়েটা এখন কেবল’ই তার অধিকার। কেউ চাইলেই তা হরণ করতে পারবে না। তাই কে পছন্দ করল বা না করল তাতে তার কিছু যায় আসে না। সে জানে, অন্বিতার জীবনে তার বাবার পর এখন সবথেকে প্রিয় পুরুষ তার স্বামী। এই স্থান কখনও দ্বিতীয় কেউ নিতে পারবে না। অন্বিতার হাতে আলতো হাত বুলিয়ে সে বলল,

‘তোমার কি আফসোস আছে?’

মাথা তুলে চকিতে তাকাল অন্বিতা। ভীত সুরে বলল,

‘আফসোস? কীসের আফসোস?’

অন্বিতার ভয়ার্ত, চুপসানো মুখ দেখে হাসল মাহির। মনের মধ্যে তার বিশ্বাসের দৃঢ়তা বাড়ল। প্রসন্ন গলায় বলল,

‘অয়ন ভালো ছেলে। কয়দিনের পরিচয়ে আমার তাই মনে হয়েছে। ও তোমাকে পছন্দ করে সেটা ওর কোনো ব্যবহারে আমি বুঝতে পারিনি। তবে আজ তুমি আলাদা কথা বলতে চাওয়াতে আমি ব্যাপারটা টের পেলাম।’

অন্বিতা ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আমি শুধু উনাকে বুঝিয়েছি, আর কিছুই না।’

মাহির এগিয়ে এসে অন্বিতার ললাটে গভীর চুম্বন এঁটে দিয়ে বলল,

‘তোমাকে আমি বিশ্বাস করি, অন্বি। তাই আর এত জড়তা দেখাতে হবে না।’

মাহিরের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ব্রীড়ায় আরক্ত হলো অন্বিতা। চোখ নামিয়ে ফের মাহিরের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলল,

‘আমি তোমার এই বিশ্বাস আজীবন অক্ষুন্ন রাখব। তবে আপনার বোন শশী, সে তো ব্যাপারটা ঘোলাটে করতে চাইবে।’

‘চিন্তা করো না। আমি সামলে নিব সব।’

অন্বিতা মুচকি হেসে চোখ বুজল। মনে ভীষণ শান্তি অনুভূত হচ্ছে। সুখ সুখ আমেজ যেন চারদিকে। মাহির পাশে হেলান দিয়ে বসে তার প্রিয়তমার স্ত্রীর অস্তিত্ব অনুভব করছে। চিত্ত জুড়ে বয়ে চলছে অদ্ভুত শিহরণ। কত বিধ্বস্ত রাত, কত মুমূর্ষু দিন কাটিয়ে আজ এক হয়েছে তারা। এবার খুঁটি বসিয়েছে শক্ত করে, যেন ঝড় কিংবা ভূমিকম্প, কোনোকিছুতেই সেই খুঁটির অস্তিত্ব না সরে।

মাহিরের গাড়ির পেছনে আরেকটা গাড়ি যাচ্ছে। সেটাতে শশী। চিন্তা শক্তি সমস্ত খুইয়ে দিচ্ছে একটা ঘটনার বিবরণ সাজাতে। অন্বিতা কেন অয়ন নামের ছেলেটাকে আলাদা ডাকল? কী কথা বলল তারা দুজন? মাহির কেন কিছু বলল না? সামান্য প্রতিবেশীর সাথে এমন কী কথা থাকতে পারে তার? শশী চঞ্চল চোখে রাস্তায় তাকায়। উফ, বাসায় কখন যাবে। মা’কে সব না বলা অবধি শান্তি পাচ্ছে না সে।

___________

পেছন পেছন হেঁটে যেতেই হঠাৎই থমকাল। পা থামিয়ে দিল আভা। খানিকটা ঘাবড়ে একটু সরে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকাল অয়ন। ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি, বেরিয়ে আসুন।’

একটা বৈদ্যুতিক খুঁটির পেছনে লুকিয়ে ছিল আভা। অয়নের কথা শুনে জিভ কাটল। কাচুমাচু করে বেরিয়ে এল সে। অয়ন আপাদমস্তক দেখল তাকে। জলদগম্ভীর স্বরে শুধাল,

‘আপনি অন্বিতার বান্ধবী না?’

আভা ত্বরিতে মাথা দুলায়। কুঁচকানো ভ্রু সোজা করে অয়ন। অন্বিতার বিদায়ের পর অমিত বাসায় চলে গেলেও সে আর যায়নি। মন মেজাজ ঠিক নেই বলে রাস্তার পাশে হাঁটছিল। আর তখন থেকেই মনে হচ্ছিল কেউ একজন অনুসরণ করছে তাকে।

সে গুমোট স্বরে বলল,

‘আমাকে ফলো করছিলেন কেন?’

আভা নতমস্তকে হাত কঁচলাচ্ছে। অস্থির অস্থির লাগছে তার। ঠোঁট কামড়ে একবার অয়নকে দেখে আবার চোখ নামায়। বিরক্ত হচ্ছে অয়ন। সে উত্তর না পেয়ে হাঁটা ধরে। আভার সংবিৎ ফেরে তখন। ছুটে যায় অয়নের কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘একটা কথা ছিল।’

পা থামায় অয়ন। আভার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে,

‘কী কথা?’

আভা আমতা আমতা করে বলে,

‘আপনার ফেসবুক আইডি’টা একটু দেয়া যাবে?’

কপালে ভাঁজ পড়ে অয়নের। সন্দিগ্ধ চোখে আভাকে দেখে। আভা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে। অয়ন স্বাভাবিক গলায় বলে,

‘আমার ফেসবুক নেই।’

বড়ো বড়ো চোখে তাকায় আভা। বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলে,

‘এই যুগে এসে আপনার ফেসবুক নেই? কী আশ্চর্য!’

অয়ন উত্তর না দিয়ে আবার হাঁটতে উদ্যত হয়। আভা ফের তাকে আটকে বলে,

‘হুয়াট’স অ্যাপ আছে নিশ্চয়?’

‘না।’

অয়নের স্বাভাবিক জবাবে অস্বাভাবিক বিরক্ত হলো আভা। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,

‘ফোন নাম্বার আছে তো, না-কি সেটাও নেই?’

অয়ন তপ্ত গলায় শুধায়,

‘এসব দিয়ে আপনার কী কাজ?’

ধমক দিল না-কি? আভার চোখ মুখ ম্লান হলো। সে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘আপনার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য।’

‘আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাওয়ার কারণ?’

আভা উত্তর পেল না এবার। যোগাযোগ রাখতে চাওয়ার কারণ অনেক। তবে সেসব এই ছেলেকে এখনই বলা যাবে না। তাই ছোট্ট করে শুধু বলল,

‘এমনি।’

‘উপযুক্ত কারণ ছাড়া আমি অপরিচিত কাউকে আমার ফোন নাম্বার দিই না।’

আভা উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘আমি অপরিচিত নয়। আমি অন্বিতার একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড।’

‘অন্বিতার বেস্ট ফ্রেন্ড অন্বিতার পরিচিত, আমার না। আসি।’

ফের হাঁটা ধরল অয়ন। মুখ ভার হলো আভার। হৃদয় ব্যথিত হলো সূক্ষ্ম ছ্যাঁকায়। চোখে মুখে উপচে পড়া দুঃখ নিয়ে বলল,

‘আপনার নাম্বার আমি নিয়েই ছাড়ব।’

অয়ন শুনতে পেল কি-না কে জানে। সে আর ফিরে তাকাল না। আভাও চলে গেল বিপরীত পথে।

__________

অনিচ্ছা, অসম্মতিকে এক কোণে দমিয়ে রেখে জিনিয়া বেগম অন্বিতা আর মাহিরকে বরণ করে ঘরে তুললেন। মুখে তার কৃত্রিম হাসি আর কারো নজরে না পড়লেও অন্বিতার নজরে ঠিকই পড়ল।

নতুন বউ জুড়ে যেমন হৈ চৈ, হুল্লোর, উত্তেজনা, চঞ্চলতা থাকে এই বাড়িতে তা তেমন একটা নেই। বিয়ে বাড়িটা ম্লান। অন্বিতার শ্বশুরবাড়ির মানুষ বলতে আজ আছে মাহিরের দাদু, ফুপি, ফুপাতো বোন আর মামা। ঘরের কাজের লোকেরা একটু ব্যস্ত হলেও তেমন আড়ম্বরতা দেখাচ্ছে না। অন্বিতাকে ঘিরে নেই কোনো আয়োজন। জিনিয়া বেগম যে বরণ করে রুমে গিয়েছেন আর আসেননি। তার পেছন পেছন গিয়েছে শশীও। বসার ঘরে সোফায় দাদু, মামা, অন্বিতা আর মাহির বসা। কাজের লোকেরা নাস্তা এনে সাজিয়েছে। অন্বিতার মধ্যে ঠিক বউ বউ জড়তাটা কাজ করছে না। এই বাড়িতে আগেও একবার এসেছিল। সেদিন এসেছিল প্রেমিকা হিসেবে। আর আজ এসেছে বউ হয়ে। বসার ঘরে ডানের খালি দেয়ালে বড়ো ছবিখানার দিকে তাকাল সে। ঠোঁট কোণে ঝুলাল অমায়িক হাসি। ছবিতে মাহিরের মা বাবা। শুনেছে, মাহির খুব ছোটবেলায় মা বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছে। মা’র পক্ষে মামা আর বাবার পক্ষে দাদু, ফুপিকে ছাড়া সে তার এই জীবনে আর কাউকে চেনে না। এই মানুষগুলোই বড়ো করেছে তাকে। বিশেষ করে দাদু। ছোট থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া অবধি মানুষটা ঠায় তার পাশে ছিল।

নিগূঢ়, নিষ্পলক চোখে ছবিটা একটুক্ষণ দেখে মলিন হাসল অন্বিতা। ভাবল, “আজ এই দুজন মানুষ বেঁচে থাকলে হয়তো তাদের বিয়েটা আরো চমৎকার হতো। চমৎকার হতো তাদের সংসার জীবন।”

মামা চশমাটা চোখে ঠেলে বললেন,

‘মাহির, অন্বিতাকে নিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।’

মাহির মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। অন্বিতার দিকে চেয়ে বলল,

‘চলো।’

কেন যেন লজ্জা পেল অন্বিতা। সে এখন মাহিরের রুমে যাবে, যে রুমটা আজ থেকে তারও। অযথা লজ্জা পাওয়া বদনে উঠে দাঁড়াল সে। শম্বুক গতিতে এগুলো মাহিরের পেছন পেছন।

চলবে…..