#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৩।
সময় এখন দ্বারপ্রান্তে। দুই কী তিন দিন আছে হয়তো অন্বিতার ডেলিভারির। মেয়েটার আজকাল মন ভালো থাকে না। কিছু একটা নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করে। তার দেখভালের জন্য এই সময়টাতে মাহিরও তার নার্সিংহোম থেকে ছুটি নিয়েছে। অন্বিতাকে সে চোখের আঁড়াল হতে দেয় না। তাও কী জানি কী হয়েছে, রাত হলেই মেয়েটা কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। মাহির বোঝে, হয়তো ভয় আর দুশ্চিন্তা থেকে এমন করে। সে বোঝায় অন্বিতাকে। তার কথা শুনে সে কিছুক্ষণ থ মেরে থাকলেও একটু পরেই আবার শুরু হয় এসব।
সকালেই মন ভালো করার জন্য অন্বিতার জন্য এক বক্স আইসক্রিম এনেছে মাহির। তবে একটা আইসক্রিমও তাকে ধরতে দেয়নি। বলেছে, দুই দিন পর তার ছেলে মেয়েকে সাথে নিয়ে যেন এই আইসক্রিম খায়। অন্বিতা তার সেই কথা শুনে হাসে। জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার বাচ্চারা বুঝি পৃথিবীতে এসেই আইসক্রিম খাওয়া শুরু করবে?’
মাহির তখন আপ্লুত সুরে বলে,
‘তাদের মা খেলেই তাদের খাওয়া হয়ে যাবে।’
____________
পেটে হাত রেখে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে আছে অন্বিতা। মাহিরের কাজকর্মে সে হতভম্ব, হতবাক। এই ছেলে এক ঘর পুরো খেলনায় ঠেসে দিয়েছে। রুমে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু নেই। আজও আবার এক কার্টুন এনেছে। অন্বিতা আর দাঁড়াতে পারল না। চেয়ারে বসল শ্লথগতিতে। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘খেলনার দোকান দিয়ে ক্ষান্ত হওনি, এখন কি গোডাউন দিতে চাও?’
মাহির খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখছে। অন্বিতার কথা শুনে হাসে সে। মনটা আজকাল তার ভীষণ ফুরফুরে। এই তো আর দুটো দিন, তারপরে কোল জুড়ে দু’টো ছোট্ট তুলতুলে পুতুল নিয়ে সে বাড়িময় ঘুরবে। তাদের নরম গালে ভালোবাসার পরশ আঁকবে। এতসব খেলনা নিয়ে খেলতে বসবে। সেসব ভেবে তার যেন আর তর সইছে না।
জবাবে সে বলল,
‘পারলে তাই করব।’
অন্বিতা কপাল কুঁচকে বলল,
‘একদম না। অতিরিক্ত খেলনা কিনে টাকা অপচয় করার কোনো মানে হয় না। এমনিতেই ওদের অনেক খেলনা হয়ে গিয়েছে, আর একটাও কিনবে না।’
মাহির খেলনা রেখে অন্বিতার সমীপে হাঁটু ভাঁজ করে বসল। তার ভরাট পেটের দিকে চেয়ে বলল,
‘দেখেছিস, তোদের মা কী কিপ্টে! আমাকে দুটো খেলনা কিনতে দেয় না।’
‘দুটোর কথা বলে বলে আজ পুরো ঘর তুমি ভরিয়ে ফেলেছ।’
‘তাতে কী? আমার বাচ্চাদের জন্য আমি আরো খেলনা কিনবে। তুমি একদম বাঁধা দিবে না।’
অন্বিতা মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই লোককে বুঝিয়ে লাভ নেই। ইদানিং সে নিজেও বাচ্চা হয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা পৃথিবীতে আসার আগেই তাদের জন্য আলমারি ভর্তি জামা কিনেছে। সেদিন তো পাগলামির মাত্রা ছাড়িয়ে ছিল সে। হুট করেই দুটো স্কুল ব্যাগ নিয়ে হাজির হয়। অন্বিতার চক্ষু কপালে। হতভম্ব হয়ে শুধায়,
‘তুমি স্কুল ব্যাগ কেন এনেছ?’
মাহির তখন মাথা চুলকে হেসে বলে,
‘না মানে, আসার পথে ব্যাগগুলো খুব পছন্দ হয়েছিল। তাই নিয়ে এলাম। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করলে তো ব্যাগ লাগত’ই, তাই আগেই কিনে নিয়ে এসেছি।’
অন্বিতার সেই কথা শুনে মাথায় হাত। বাচ্চারা কবে বড়ো হয়ে স্কুলে যাবে, সেই চিন্তায় কি-না বাচ্চাদের বাপ এখনই স্কুল ব্যাগ নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করছে!
.
বিভাবসুর পতন ঘটেছে। সেই অবসাদে ম্রিয়মান হয়েছে দিনের আলো। পাখিরা নীড়ে ফিরেছে আরো কয়েক পল আগেই। আজ অনেক দিন পর শশী আর তাইভিদ এসেছে এই বাড়িতে। সন্ধ্যাখানা তাদের আগমনে মুখরিত। জিনিয়া বেগম ব্যস্ত জামাইয়ের সমাদরে। সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে অন্বিতা তার রুমে গিয়ে বসেছে। শশীও এসেছে তার সাথে একটু গল্প করতে। অন্বিতার পেটে হাত রেখে সে বলে,
‘আমার মামুনিরা কেমন আছে?’
অন্বিতা প্রসন্ন হেসে জবাব দেয়,
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আপু।’
‘যাক, আর দুটো দিন। তারপরেই তারা আমার কোলে।’
এই বলে শশী হাসল। অন্বিতাও হাসল তার তালে। বলল,
‘আপনি কেমন আছেন, আপু?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।’
অন্বিতা তখন মুচকি হেসে বলল,
‘একটা আবদার রাখতে হবে।’
‘কী আবদার, বলো?’
‘আমার বাচ্চাদের জন্য বন্ধু আনার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কিন্তু আপনাদের। আর সেটা যেন খুব শীঘ্রই হয়।’
অন্বিতার কথার মানে বুঝতে পেরে খানিকটা লজ্জা পেল শশী। বলল,
‘ওসব পরে ভাবা যাবে। আগে আমার মামুনিরা সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসুক।’
আরো কিছুক্ষণ কথা হয় তাদের। এর মাঝেই জিনিয়া বেগম শশীকে ডাকেন। শশী উঠে যায়। বিছানায় একাই শুয়ে থাকে অন্বিতা।
বসার ঘরে তাইভিদের সাথে কথা বলছে মাহির। নার্সিংহোমে যাওয়া হয়না বিধায় তাইভিদের সাথে বেশ অনেকদিন পরেই তার দেখা। ছেলেটা আগের তুলনায় বেশ সুদর্শন হয়েছে। শরীরে মাংস হয়েছে বেশ। মাহির তাকে আগাগোড়া পরখ করে হেসে বলে,
‘আমার বোন তাহলে আপনাকে বেশ যত্নেই রাখছে।’
জুসের গ্লাস’টা ঠোঁট থেকে সরিয়ে তাইভিদ অবাক চোখে চাইল। বলল,
‘হঠাৎ এই কথা?’
‘বেশ সুদর্শন লাগছে কিন্তু।’
তাইভিদ সলজ্জ হাসে। তা দেখে মাহির হেসে বলে,
‘মেয়েদের মতো লজ্জা পাচ্ছেন দেখছি।’
‘এভাবে এর আগে আমাকে কেউ সুদর্শন বলেনি তো, তাই একটু লজ্জা পাচ্ছি।’
মাহির পুনরায় কিছু রগড় সুরে বলার আগেই ভেতর থেকে বিকট শব্দের এক চিৎকার এল। আচমকা চিৎকারে বসার ঘরে ছুটে এল সবাই। মাহির আর তাইভিদ উঠে দাঁড়াল। সবাইকে একবার পরখ করতেই আঁতকে উঠল মাহির। রুদ্ধশ্বাস ফেলে বলল,
‘অন্বিতা।’
ছুটে যায় সে। ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে ওয়াশরুমের দরজার কাছটায় চিৎ হয়ে পড়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে অন্বিতা। তার পায়ের কাছটায় রক্তের স্রোত। আচানক মাহিরের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সে বুঝতেই পারছে না, কী দেখছে। বাড়ির বাকি সদস্যেরা হন্তদন্ত হয়ে অন্বিতাকে উঠানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার ভারী শরীরের ভর ছেড়ে দেওয়ায় কেউ উঠাতে পারছে না। মাহির এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। অন্বিতার মুখটা ক্রমশ আরক্ত হচ্ছে। ব্যথায় মেয়েটার জীবন যাচ্ছে যেন। শশী চেঁচিয়ে বলে,
‘মাহির, দাঁড়িয়ে আছো কেন? অন্বিতাকে তুলো। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।’
হুঁশ ফিরে মাহিরের। ছুটে যায় অন্বিতার কাছে। তাইভিদ ততক্ষণে যায় গাড়ি বের করতে। অন্বিতার নিশ্বাস আটকে আসছে। সাদা মেঝেতে লাল রক্ত দেখে দম যেন ফুরিয়ে আসছে তার। মাহিরকে কাছে পেয়ে ক্ষীণ সুরে শুধু বলল,
‘আমার বাচ্চাগুলো কি বাঁচবে না, মাহির?’
মাহির উত্তর দিতে পারল না। অন্বিতার হুঁশ আছে কি-না বলা মুশকিল। এরপর আর কোনো কথা বলেনি সে। পুরো বাড়ি রক্তে মাখামাখি হলো। অতঃপর নার্সিংহোমে নেওয়া হলো তাকে।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অসাড়, মূঢ় হয়ে বসে আছে মাহির। সে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে বেমালুম। উপর দিকে চেয়ে কী যে দেখছে, সে’ই জানে। জিনিয়া বেগম আর অন্বিতার মা আসিয়া বেগম দুজনেই নামাজে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ’র কাছে মেয়ের সুস্থতা কামনায় কেঁদে কেটে ব্যাকুল তাঁরা। শশী দাদুকে নিয়ে এক কোণে বসা। অসুস্থ দাদুর লাঠি কাঁপছে ঠকঠক। চোখের সাদা পাপড়িগুলো ভিজে আছে। একবার অসহায় চোখে তাকাচ্ছেন নাতির দিকে আবার তাকাচ্ছেন অপারেশন থিয়েটারের দিকে।
কিছুক্ষণ বাদেই ভেতর থেকে তীক্ষ্ণ এক কান্নার স্বর এল। সম্বিত ফিরল সকলের। আকুল চোখে দরজার দিকে তাকাল মাহির। শশী মাহিরের দিকে চেয়ে হেসে বলল,
‘মাহির, তোমার বাচ্চাদের কান্না শুনছো?’
অমাবস্যা কেটে পূর্ণিমার দেখা পেল মাহির। ঠোঁটে ফুটল কিঞ্চিৎ তৃপ্তির হাসি। অস্থিরতা বাড়ল ভীষণ। বাচ্চাদের আর অন্বিতাকে দেখার জন্য মন চনমনে হয়ে উঠল তার।
নার্স বেরিয়ে আসে। সাদা তোয়ালে পেঁচানো তার হাতে এক ছোট্ট পুতুল। মাহির ছুটে আসে তার কাছে। নার্সের কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে খুব করে আদর করে তাকে। দাদুকে নিয়ে শশীও উঠে দাঁড়ায়। আদুরে বাচ্চাটার লাল লাল গালে চুমু দেয়। খুশ মেজাজে বলে,
‘আমি মা আর আন্টিকে নিয়ে আসি।’
শশী তাঁদের আনতে যায়। মাহির নার্সের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার ওয়াইফ আর আরেকটা বাচ্চা কেমন আছে?’
চলবে….
#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৪।
আচমকা পরিবেশ কেমন যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে। প্রচন্ড ঝড় উঠেছে বাইরে। বেগতিক বাতাসে গাছগুলো ভেঙে পড়ার উপক্রম। আকাশ চিড়ে দেখা মিলছে স্ফুলিঙ্গের। আচানক কী হলো? কেন বাতাবরণ ভয়ংকর হলো এত? তবে কি তারা জানান দিচ্ছে কিছু মানুষের মনের ভেতরকার ঝড়? সেই ঝড়ের সাথেই পাল্লা মেলাতেই কি এত আয়োজনে নেমেছে তারা?
আই সি ইউ রুমের বাইরে নিরুত্তাপ দাঁড়িয়ে মাহির। চোখ মুখের দৃষ্টি শান্ত, নীরব। ছেলেটার ভেতরে কী চলছে তা বোঝা মুশকিল। তবে এইটুকু বোঝা যাচ্ছে, প্রকৃতির ঝড়ের চেয়েও মনের ঝড়ে বেহাল দশা তার। পাশ থেকেই শোনা যাচ্ছে এক ছোট্ট পুতুলের বিদঘুটে চিৎকার। জন্মের পর প্রথম আহারের জন্য বাচ্চাটা ছটফট করছে। আসিয়া বেগম পায়চারি করছেন তাকে কোলে নিয়ে। কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা। আভা সামনে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
‘আন্টি, আমি কোলে নিব?’
আসিয়া বেগম বিমর্ষ সুরে বললেন,
‘মায়ের কোল খুঁজছে বাচ্চাটা।’
আভা ঠোঁট চেপে কান্না দমিয়ে রাখে। ছোট্ট তুলতুলে শিশুটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘আল্লাহ, তোমার দিকে চেয়ে যেন একটু দয়া করেন।’
আসিয়া বেগম ক্রন্দনরত সুরে বললেন,
‘মেয়েটার জ্ঞান ফিরে যখন তার আরেক মেয়ের কথা জানতে চাইবে, তখন আমি কী জবাব দিব?’
আসিয়া বেগম নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। আভা সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পায় না। সে নিজেই তো এসব মেনে নিতে পারছে না। তার বান্ধবীর এমন করুণ দশা কেন হলো? কেন মেয়েটা এক সন্তান হারিয়ে আই সি ইউ তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে, কেন? সে নিজেকেই বোঝাতে পারছে না যেখানে, সেখানে আর অন্য কাউকে কী বোঝ দিবে?
তাইভিদ মাহিরের পাশে এসে দাঁড়াল। একবার তাকাল কাঁচ ভেদ করে ভেতরে। অক্সিজেন সহ নানান চিকিৎসা সামগ্রীর বহরে অন্বিতাকে দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো। একপল সেদিকে চেয়ে আবার চাইল মাহিরের দিকে। ঢোক গিলে বলল,
‘বাচ্চাটাকে কি ফ্রিজিং রুমে রাখব, স্যার? এভাবে বাইরে আর কতক্ষণ থাকবে?’
মাহির জবাব দেয় না কোনো। হয়তো কান অবধি কথাখানা প্রবেশ করেনি। সে পুনরায় একই প্রশ্ন করার আগে শশী এসে বলল,
‘মাহির এখন কিছু বলার মতো অবস্থাতে নেই, তাইভিদ। আপাতত ওকে ফ্রিজিং রুমেই রাখতে হবে।’
এই কথা শুনে আসিয়া বেগম সেখানে ছুটে এলেন। অস্থির হয়ে বললেন,
‘তোমরা কী বলছো এসব? আমার ছোট্ট নাতনিটাকে ঐ ঠান্ডা বরফের রুমে রাখবে? ওর তো কষ্ট হবে। আমার মেয়ে জানতে পারলে আমার উপর রাগ করবে খুব।’
শশীর কান্না পায় ভীষণ। কিন্তু সে কাঁদে না। সবাই একসাথে ভেঙে পড়লে সব সামলাবে কে। সে আসিয়া বেগমকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘আজকের রাতটুকু থাকুক, আন্টি। কালকে অন্বিতা সুস্থ হয়ে উঠলে ওর সিদ্ধান্তেই সব হবে।’
আসিয়া বেগমের ঠোঁট কাঁপছে। শরীরও কাঁপছে উনার। মাথা হেলিয়ে ক্ষীণ আওয়াজে বললেন,
‘আচ্ছা।’
তারপর তিনি গিয়ে বসলেন একটা চেয়ারে। কোলের বাচ্চাটা এখন ঘুমাচ্ছে। মা’র বিষাদে কাঁদতে কাঁদতে এবার অভিমানে ঘুম দিয়েছে সে। হয়তো মনে মনে পণ করেছে, মা ডাকা না অবধি আর চোখ খুলবে না।
নার্সিংহোমের দক্ষিণ পাশের বড়ো বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। বাইরের ঝড় এখন থেমেছে। তবে বৃষ্টি বহাল আছে এখনও। সোডিয়ামের আলো চুইয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চমৎকার লাগছে বেশ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে অয়ন। এমনটা তো না হলেও পারত। এই পৃথিবী এত নিষ্ঠুর কেন হলো? মেয়েটার জন্য মায়া হলো না একটুও? তার এত সুখ এক নিমিষেই ছিনিয়ে নিল? অয়ন ভেবে পায় না, এসব ভাবলে দম বন্ধ লাগে তার। অন্বিতার মেয়েটাকে যতবার দেখেছে, ততবার’ই অন্বিতার মুখ ভেসে উঠেছে তার দৃশ্যপটে। সেই একই নাক, তীক্ষ্ণ চোখ, রক্তিম ঠোঁট, যেন অন্বিতার মুখটা কেউ বসিয়ে দিয়েছে। বাচ্চাটাকে দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে তার, যখন মনে হয় তার’ই মতো আরেকটা বাচ্চা মৃত। এই অমোঘ সত্য কী করে মেনে নিবে অন্বিতা? সব শোনার পর সে আদৌ বেঁচে থাকবে তো?
ফোনটা বেজে উঠে। হাতে নিয়ে দেখে অমিতের কল। অয়ন রিসিভ করে।
‘কিরে দোস্ত, অন্বিতার এখন কী অবস্থা?’
‘কোনো উন্নতি নেই।’
‘কী বলছিস! আর ওর মেয়েটা, ওকে কে দেখছে?’
‘আছে, আন্টি, আভা, অন্বিতার শ্বশুরবাড়ির মানুষজন; বাচ্চাটাকে দেখার জন্য সবাই আছে। তবে জানিস, মাহিরকে দেখার মতো কেউ নেই। একসময়ে সবচেয়ে হিংসে করা ছেলেটার উপর আজ আমার বড্ড মায়া হচ্ছে। কেমন অসহায় হয়ে চেয়ে আছে অন্বিতার আই সি ইউ রুমের দিকে। ওর ভেতরটা নিশ্চয় ছারখার হয়ে যাচ্ছে, তীব্র যন্ত্রণায় বুকে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু কাউকে বলতে পারছে না! কেন এমন হলো, বলতো? কেন সৃষ্টিকর্তা ওদের এত কষ্ট দিচ্ছেন?’
অয়নের গলা ধরে আসে। অমিত বুঝতে পারে, অয়নও ঠিক নেই। সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
‘হয়তো এটা সৃষ্টিকর্তার পরীক্ষা, নয়তো কোনো ভুল না করা স্বত্ত্বেও অমন ফুলের মতো মেয়েটা কেন এত কষ্ট পাবে?’
‘জানিস, অন্বিতার বাচ্চাটা না পুরো ওর মতো দেখতে। সেকি কান্না তার, পুরো নার্সিংহোম গরম করে ফেলেছে।’
‘মা’কে খুঁজছে বাচ্চাটা।’
‘হ্যাঁ, কেউ থামাতে পারছিল না। কী করে পারবে বল, মায়ের অভাব কি আর অন্য কেউ পূরণ করতে পারে?’
অমিত আফসোস করে বলল,
‘মা অসুস্থ না হলে আমি এক্ষুনি চলে আসতাম। আমার এখানে বসে থেকে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’
‘দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। বরং সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া কর, অন্বিতা যেন ঠিক হয়ে যায়।’
______________
বাইরে মৃদু আলো। বিভাবসু উঁকি ঝুঁকি মারছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখোরিত চারদিক। নার্সিংহোমে এখন জিনিয়া বেগম আর দাদু ব্যতিত সবাই আছে। দাদু অসুস্থ বিধায় তাঁকে এক প্রকার জোর করেই জিনিয়া বেগমের সাথে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে।
চোখ লেগেছিল সবার। তবে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে মাহির। দু চোখের পাতা এক পলের জন্যও এক করতে পারেনি সে। পুরোটা সময় এক ধ্যানে আই সি ইউ রুমের দিকেই চেয়েছিল। যেন মন বলছিল, এই বুঝি অন্বিতা চোখ খুলবে, এই বুঝি মাহির বলে ডাকবে তাকে। কিন্তু তাকে আশাহত করে তেমন কিছুই হয়নি।
তারদিকে কফির গ্লাসটা এগিয়ে দেয় অয়ন। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে অয়নের দিকে তাকায় মাহির। মলিন হেসে অয়ন মাহিরকে ইশারায় কফিটা নিতে বলে। তবে নিরুত্তাপ থাকে মাহির। কফি নেয় না। অয়ন আই সি ইউ রুমের দিকে তাকায় একবার। ভোরের আলো ফুটলেও ঐ রুমটা আগের মতোই ঝাপসা, ঘোলাটে। সে প্রলম্বিত শ্বাস টেনে বলল,
‘আরো অনেক কিছু সামালাতে হবে। এখনই এত ভেঙে পড়লে কী করে হবে, বলুন?’
মাহির জবাব দেয় না। অয়ন কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘অন্বিতাকে খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
মাহির ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তার অমন ব্যাকুল দৃষ্টি দেখে যুতসই জবাব পেয়ে যায় অয়ন। মুচকি হাসে। বলে,
‘মেয়েটাও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। ধরে নিন, এটা আপনাদের ভালোবাসার পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে গেলে নিজেকে যথেষ্ট শক্ত রাখতে হবে, ভেঙে পড়া যাবে না একদম।’
‘আমার একমাত্র শক্তি অন্বিতা। ওকে ছাড়া আমি এক জীবন্ত লাশ বৈ আর কিছুই না।’
ডাক্তারের মুখে স্ত্রী সন্তানের বিভৎস অবস্থার কথা জানার পর সেই যে মুখে কুলুপ এঁটেছিল মাত্র’ই সেই কুলুপ ছুটেছে মাহিরের। এইটুকু কথা শুনেও অয়ন খুশি হয়। বলে,
‘দেখবেন, আপনার শক্তি আরো মজবুত হয়ে আপনার জীবনে ফিরে আসবে।’
‘সত্যি বলছেন?’
কেমন বাচ্চাদের মতো করে জানতে চাইল মাহির। যেন একটু ভরসা খুঁজছে। ডাক্তারের কাছেও কোনোরূপ ভরসা না পেয়ে ছেলেটা দিশেহারা হয়ে পড়েছে একেবারে। তাই অয়নের এইটুকু কথাতেই যেন প্রগাঢ় ভরসা খোঁজার চেষ্টা চালাল সে।
চলবে….