#একটি_অপ্রেমের_গল্প
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৬০।
রাত করে বাড়ি ফেরায় পরদিন ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হয় তারার। মুখ ধুয়ে নিচে নামে সে। ডাইনিং এ দেখে তাহমিরকে। তাহমির পাউরুটিতে সবেই কামড় বসিয়েছিল। তারাকে দেখে মুখ থেকে সেটা হটিয়ে বলে উঠে,
‘মা, মহারাণী ভিক্টোরিয়া উঠেছেন। তার নাস্তার ব্যবস্থা করুন, দয়া করে।’
ভ্রু কুঁচকে চেয়ার টেনে বসল তারা। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘তোর সমস্যা কী বল তো? সবসময় আমার সাথে কেন লেগে থাকতে হবে?’
‘তোমার আর আমার দূরত্ব দেখেছ, না হলেও চার ফুট তো হবেই। তাহলে লেগে থাকলাম কোথায়?’
তারা রোষপূর্ণ সুরে বলে,
‘ভীষণ বেয়াদব হয়েছিস তুই। ফুপিকে বিচার দিলে, তারপর বুঝবি।’
চেয়ারে গা এলিয়ে বসে তাহমির। চোখ সরু করে কপট হাসে। বলে,
‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’
‘ফুপিইইই, তোমার ছেলে…’
হুমড়ি খেয়ে এসে তারার মুখ চেপে ধরে তাহমির। ভয় তো সে কেবল মুখে পায় না, মনে মনে মা’কে যমের মতো ভয় পায়। মায়ের সামনে যেখানে বাবাই ভয়ে ভেজা বেড়াল সেখানে সে তো সামান্য কাক।
‘আমি বলেছি বলেই চেঁচিয়ে উঠবে?’
তারা এক ঝটকায় তাহমিরের হাত সরায়। বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘থাপ্পড় মেরে সব দাঁত ফেলে দিব, বেয়াদব। আর একবার বেয়াদবি করলে তোর সব গুমোট ফাঁস করে দিব কিন্তু।’
‘ক-কী বলবে তুমি?’
তাহমির ভয়ে ভয়ে বলল। তারা অকপটে বলল,
‘টেস্ট পরীক্ষায় যে দুই সাবজেক্টে ফেল করেছিস সেটা কিন্তু এখনও ফুপা ফুপি জানেন না। বলব না-কি, হু হু?’
ভ্রু নাচাল মৌমি। তাহমিরের মুখটা খাওয়া আমের আঁটির মতো চুপসে এল। বলল,
‘তুমি আমাকে এভাবে ভয় দেখাতে পারো না।’
‘আর লাগতে আসবি আমার সাথে?’
‘আমি লাগি কোথায়? শুধু একটু দুষ্টুমি করি।’
‘সেটাও করতে পারবি না। একেবারে ভালো ছেলে হয়ে থাকবি, মনে থাকবে?’
ভদ্র ছেলের ন্যায় উপর নিচ মাথা নাড়ে তাহমির। তারপর তার জায়গায় গিয়ে বসে। তারা জানে, এসব কেবল সাময়িক। একটু পরেই মাথার ভেতর কিরা’টা নড়ে উঠলেই আবার শুরু হবে তার বদমাশী।
বিকেলের দিকে তারার ভীষণ ইচ্ছে হলো, সে রাবাদের বাড়িতে যাবে। কিন্তু নিয়ে যাবে কে? বাবা বাড়ি নেই, নার্সিংহোমে। তাইভিদও একই জায়গায়। শশী গিয়েছে বাইরে। আসিয়া বেগম ঘুমাচ্ছেন। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। তারা ঠোঁট উল্টে বসে বসে ভাবল, কাকে নিয়ে যাবে। আচম্বিত মনে পড়ল, জিনিয়া বেগমের কথা। তিনি তো এসময় বই পড়েন। তাঁকেই পটাতে হবে। তবে একা গেলে কাজটা খানিক কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে বিধায় সে তাহমিরকেও রাজি করাল তাতে।
জিনিয়া বেগম প্রথমে রাজি হতে চান না। একে তো তাঁর বই পড়ার ব্যাঘাত ঘটবে, উপরন্তু মাহির, শশীও রাগ করতে পারে। তবে পরক্ষণেই মাহির শশীকে ফোন দিয়ে তারা রাজি করিয়ে ফেলায় তিনি আর বারণ করতে পারেন না। তৈরি হয়ে তিন জন বেরিয়ে পড়ে। তারা সাথে করে তার মায়ের ডায়েরিটা নিয়ে যায়।
আভা তাদের দেখে ভীষণ খুশি হয়। সাদরে গ্রহণ করে। রাবা ছুটে আসে তারা আর তাহমিরের কাছে। এই দুজনকেই তার খুব পছন্দ। তাহমির, তারাও রাবাকেও খুব আদর করে। রাবা তাদের হাত টেনে বলে,
‘চলো, আমার নতুন বার্বি ডলটা দেখবে। বাবা কিনে দিয়েছে।’
‘দাঁড়াও মা, ভাইয়া আপুদের আগে নাস্তা করতে দাও।’
আভা পথ আটকে বলল। রাবা তাদের হাত ছেড়ে বলল,
‘আচ্ছা, তোমরা নাস্তা করো। আমি আমার বার্বি ডলটাকে এখানেই নিয়ে আসি।’
এই বলে সে ছুটে গেল তার পুতুলঘরে।
রাবার সাথে তাহমির খেলছে। জিনিয়া বেগম টিভি দেখছেন বসে বসে। আভা রান্নাঘরে কাজ করছে টুকিটাকি। তারা আসে সেখানে। জিজ্ঞেস করে,
‘মনি, বন্ধু কখন বাসায় আসবে?’
‘এই তো চলে আসবে, মা।’
‘জানো, আমি বন্ধুর জন্য আজ একটা জিনিস এনেছি?’
আভা পানির কল বন্ধ করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল,
‘তাই? কী এনেছ?’
‘বন্ধু এলেই দেখতে পাবে।’
আভা হেসে বলে,
‘বেশ।’
অয়ন এল সন্ধ্যার পর। বাড়িতে এসে তারা আর তাহমিরকে দেখে চিত্ত প্রফুল্ল হলো তার। তারা তাকে দেখে ছুটে আসে। অয়ন কাঁধের ব্যাগটা সোফায় রেখে তারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
‘কখন এসেছ, মা?’
‘বিকেলে।’
‘ওহ, বন্ধুকে বলোনি কেন কল দিয়ে? তাহলে তো বন্ধু আরো আগেই চলে আসতাম।’
‘না, তুমি তো কাজ করছিলে, তাই বিরক্ত করিনি।’
অয়ন হেসে তারার গাল টেনে বলে,
‘ওরে আমার পাঁকা বুড়ি, সব বুঝে।’
‘হু। এবার তুমি যাও তো, ফ্রেশ হয়ে এসো। তোমাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে।’
‘কী?’
‘আগে ফ্রেশ হয়ে এসো। তারপর দেখাব।’
অয়ন মাথা হেলিয়ে জিনিয়া বেগমের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে উপরে গেল। তারা আবার গিয়ে বসল রাবার সাথে খেলার জন্য।
অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে, অয়ন নিচে আসছে না বলে তারা’ই তার রুমে যায়। দরজায় টোকা দিয়ে বলে,
‘আসব, বন্ধু?’
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল অয়ন। তাই শুনতে পায় না তারার ডাক। তারা আবারও ডাকে। কোনো সাড়া নেই। মন খারাপ করে শেষবারের মতো আরেকবার ডাকে সে। এবার কাজ হয়। অয়ন দরজা মেলে। তারাকে বাইরে দেখে হেসে বলে,
‘বোকা মেয়ে! বলেছি না বন্ধুর রুমে আসতে অনুমতি নিতে হবে না।’
‘বাবা বলেছে, নিতে হবে। আমি বাবার কথা অমান্য করি না।’
অয়ন তৃপ্ত হলো। মাহির একা হাতে কী সুন্দর করে মানুষ করছে মেয়েটাকে। যেন মেয়েটার মাঝেই তৈরি করছে অন্বিতার এক আস্ত প্রতিচ্ছবি।
তারা ডিভানে গিয়ে বসল। পাশে হাত রেখে বলল,
‘এখানে এসে বসো।’
অয়ন তার পাশে বসল গিয়ে। তারা তার ব্যাগ খুলল। ডায়েরিটা বের করে হাতে দিল অয়নের। অয়ন থমকাল প্রথমে। হতভম্ব, নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল ডায়েরিটার দিকে। এটা তো সেই ডায়েরি, যেটা সে অন্বিতাকে উপহার দিয়েছিল তাদের বিয়েতে। ডায়েরিটা এখনও কত সুন্দর, চকচকে তকতকে। কোথায় ছেঁড়া, ফাটা নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব যত্নে আগলে রাখা হয়েছে। অয়ন তারার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘এটা তুমি কোথায় পেলে, মা?’
‘মায়ের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে ছিল। খুলে দেখো।’
‘একজনের ডায়েরি অন্যজন খুলতে নেই।’
‘তুমি তো অন্যজন নও, এই ডায়েরির মালিক।’
অয়ন ফ্যালফ্যাল করে চাইল। তারা বলল,
‘এটা তো তুমিই মা’কে উপহার দিয়েছিলে। সেই হিসেবে এই ডায়েরির মালিকানার খাতায় তোমার নামও আছে। তাই নির্দ্বিধায় খুলতে পারো।’
অয়ন দুটানায় পড়ল কী করবে। অন্বিতার ডায়েরি, খুলে পড়া আদৌ ঠিক হবে তো। তবে তারার তাগাদা’ই সে সাহস পেল। খুলল ডায়েরিখানা। প্রথম দু পাতার পরেই সেই পরিচিত লেখা, তার’ই লেখা, “অন্বিতা, আপনি আপনার সুখটুকু কলমের টানে এখানে তুলে রাখবেন। দোয়া করি, এমন হাজারো ডায়েরির পাতা ফুরিয়ে গেলেও আপনার সুখ যেন কভু না ফুরায়।”
অয়নের হাত হালকা কাঁপে। তারা বলে,
‘তুমি সুখ লিখতে বলেছিলে না? দেখো, ডায়েরির প্রতি পাতা ভরতি করে আমার মা সুখ লিখেছে।’
পরের পাতা উল্টায় অয়ন। অন্বিতার হাতের সুন্দর লেখা। অয়ন হাত দিয়ে স্পর্শ করে তা। ঢোক গিলে। লেখাগুলো পড়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়। সত্যিই, অন্বিতা তার সুখ লিখেছিল। তার আনন্দ, খুশি, উল্লাস, সবটুকু লিখেছিল সে। অয়ন তাকে পছন্দ করত, এই কথাটুকুও লিখতে ভুলেনি। অয়নের অবচেতন মন ভেবে নেয়, এটাও অন্বিতার সুখের অংশ। মিথ্যে বুঝিয়ে মনকে সে সান্ত্বনা দেয়। নিজে নিজেই খুশি হয়। সবটা ডায়েরি পড়ে না। বন্ধ করে তারার হাতে তুলে দেয়। তারা জিজ্ঞেস করে,
‘আমার মায়ের কবর দেখতে যাও না কেন?’
বাচ্চাটার প্রশ্নের কী জবাব দিবে অয়ন ভেবে পায় না। ছোট্ট মেয়ে, কোন জবাবে কী প্রভাব পড়বে সেটা নিয়েও চিন্তিত সে। তাই গা বাঁচাতে কেবল বলল,
‘সময় করে যাব একদিন।’
‘ষোল বছরে একদিনও সময় হয়নি?’
অয়ন জোরপূর্বক হাসে। বলে,
‘যাব, কয়দিন বাদে।’
‘এতদিন তবে কেন গেলে না?’
অয়ন জবাব দিতে পারে না। মেয়েটা ভীষণ চতুর। তাকে এটা ওটা বলে ভুলানো যায় না। তারা নিজ থেকেই আবার বলল,
‘তুমি আসলে ভয় পাও, আমার মা’কে ওভাবে দেখার সাহস নেই তোমার। মা’কে ভালোবাসতে কি-না।’
অয়ন আঁতকে উঠে। এইটুকু মেয়ে এসব জানল কী করে। ডায়েরির কোনো পাতায় তার ভালোবাসার কথা উল্লেখ নেই, তবে? তারা হেসে বলে,
‘অবাক হচ্ছো কেন, বন্ধু? আমি মানুষের চোখ দেখলেই বুঝি সব। শুনো বন্ধু, মানলাম তুমি আমার মা’কে ভালোবাসো। কিন্তু তুমি জানো, তোমার সেই ভালোবাসা আমার বাবার চেয়ে বেশি নয়। আর আমার বাবার চেয়ে বেশি আমার মা’কে কেউ কোনোদিন ভালোবাসতে পারবেও না। এত ভালোবাসার পর আমার বাবা যেখানে মায়ের সব অবস্থা মেনে নিতে পারছে, তবে তুমি কেন পারবে না? তুমি কেন এত ভয় পাবে?’
চলবে….