#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৩৪
# WriterঃMousumi_Akter.
ঘড়িতে সকাল নয়টা বেজে ১০ মিনিট।অনবরত ফোন বেজেই চলেছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙল।চোখ পুরোপুরি খুলতে পারলাম না,ঘুমে চোখ এঁটে ধরছে।মাথাও কেমন যেন ভারী হয়ে আছে।ভোর রাতে রিসোর্ট থেকে ফিরে ঘুমিয়েছি।রিসোর্টের কথা মনে হতেই মনে পড়ে গেল কাল রাতের ঘটনা।কী সাংঘাতিক লজ্জাকর ছিল সেই মুহূর্ত! ভেবেই আবারও লজ্জা লাগছে আমার।মুহূর্তের মাঝেই ঠোঁটজুড়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসির ছড়াছড়ি বয়ে গেল আমার।পাশে তাকিয়ে দেখি ওনি উদাম শরীরে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছেন। একটা হাত আমার পেটের উপর দিয়ে আমাকে আবদ্ধ করে রাখা।এই মানুষটার মাঝে এত আবেগ,এত অনুভূতি, এত রোমান্স আছে বুঝতেই পারিনি!আচ্ছা! এসব না থাকার-ই বা কারণ কী?এসব থাকাই তো স্বাভাবিক।ওনার প্রফেশনের সাথে জুড়ে দেওয়া ট্যাগ অত্যন্ত সম্মানজক।ওনি একজন লেকচারার,মানে শিক্ষক।শিক্ষক বলেই যে তার মাঝে প্রেম ভালবাসা, রোমান্স এসব থাকবে না এমন তো কোনো নিয়ম নেই।ওনি কম বয়সে লেকচারার হয়েছেন।ওনাকে বুড়ো ভাবারও কারণ নেই।
ফোনের রিংটোন থামছেই না।কী অসহ্য!কে এত সকালে ফোন দিচ্ছে!ওনি ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন, ‘সারাহ!প্লিজ স্টপ দ্যা ফোন।’ বলেই বালিশ টেনে নিয়ে কানের উপর চেপে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করছেন।ওনার ঘুম ঘুম কণ্ঠেও যেন একটা নেশালো ভাব আছে।আমাকে কেমন নেশা ধরিয়ে দিল।কাউকে ভালো লাগলে বুঝি তার সব-ই ভালো লাগে!
ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে ছোঁয়ার নাম্বার।ফোন রিসিভ করে বললাম, ‘ডা -য় – নি মহিলা!এত ভোরে কী জন্য ফোন দিচ্ছিস?তোর জন্য আমার সব শেষ হয়ে গেল।’
‘এত ভোর! সিরিয়াসলি? তোর ওই হাড় কিপ্টা জামাই-এর কী একটা ঘড়িও নেই সারাহ?শোন,তোর জামাইরে রাস্তায় বসায় দেব। ফুটো প্লেট দিয়ে।মানুষ যে চারআনা করে দিবে তাই দিয়ে ঘড়ি কিনে দেবো।’
‘আবার জামাই নিয়া পড়লি ক্যান সাত সকালে?’
‘তোর কোনো টাইম সেন্স নেই এই জন্য বললাম।সাড়ে নয়টা বাজে।আর তুই বলছিস এত্ত ভোর?’
‘ওহ! বেজে গেছে না?’
‘ওয়েট,এত বেলা করে ঘুমোচ্ছিস কেন?নিশ্চয়ই সারারাত পড়ালেখা করেছিস?কী-রে সারাহ তুই তো বিশাল পড়ছিস!এত পরিমান বই পড়িস আর আমাদের এসে বলিস,” কিচ্ছু পড়িনিরে আমারে একটু দেখাস।”যাইহোক বেইবি এইবার কিন্তু তোর মারাত্মক ভালো রেজাল্ট হবে, দেখে নিস।’
‘আমি সারারাত বই পড়েছি?’
‘তা ছাড়া কী?’
‘একজন বিবাহিত মেয়ে কী করে বোঝো না?’
‘সমস্যা কী? তোর জামাই তো আনরোমান্টিক।তোকে তো আর ডিস্টার্ব করে না।একটা চুমু দিয়েছে এখনো?’
‘আল্লাহর ওয়াস্তে আর আনরোমান্টিক কইস না। আমি মাফ চাই।ফোন দিছিস ক্যান তাই বল।’
‘দ্রুত রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়।’
‘কাল পরীক্ষা! আজ কই যাব?’
‘পরীক্ষা তো কী!এত পড়ে কী হবে?’
‘যাবি কই?’
‘আমি আর তন্ময় ঘুরতে যাব।বাসায় বলেছি তোর সাথে ঘুরতে যাচ্ছি।এখন তুই না গেলে হবে?’
‘বাহ!আমার নাম ভাঙিয়ে আর কতকাল খাবি তুই?না জানি কবে তোর ফ্যামিলি থেকে আমারে জু ”তা মা” রে।’
‘তুই রেডি হয়ে নে আগে।’
‘না ছোঁয়া, প্লিজ রাগ করিস না।আমার শরীর ভালো লাগছে না।তাছাড়া আজ একটা বিশেষ দিন।আমি যেতে পারব না।’
‘বিশেষ দিন!কীসের?’
‘কিছু না! তুই যা ঘুরে আয়।’
‘শোন,বাই এনি চান্স আমার বাসা থেকে যদি তোকে ফোন দেয় তাহলে বলবি আমি তোর পাশে আছি।ওকে?’
‘ওকে।’
বিছানা ছেড়ে উঠতেই চোখ গেল তন্ময়ের দেওয়া ফটোফ্রেমের দিকে।দু’ঠোঁটে মৃদু হাসি চলে এলো।কাল যে ওনার বুকে মাথা রেখে দু’জনে জলাশয়ে পা ডুবিয়েছিলাম সেই ছবি।ওনি কি কাল রাতেই ওই রিসোর্ট থেকেই ছবি প্রিন্ট করিয়ে এনেছেন!কী দারুণ লাগছে দেখতে!বিশেষ করে ওনাকে বেশি সুন্দর লাগছে।ওনি অনিমেষ চেয়ে আছেন আমার মুখশ্রীতে।ছবিতে হাত বুলিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলাম।ওনাকে এত কিউট লাগছে;একটা চুমু না দিলেই নয়।
ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বাইরে গেলাম।শাশুড়ির ভাতিজি জিনাত এসেছে।দু’জনে বসে কী সামালোচনা করছে জানি না।গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনাত।শাশুড়ি নিচে বসে বড়ো একটা গামলায় চাল নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।সাইডেই দাদু বসে আছেন।দাদুর খুব কাশি হয়েছে।তরী নেই যে ভোরে উঠেই আগে কার কী সমস্যা সেটা দেখবে।ইশ!উচিত ছিল দাদুর জন্য আদা চা বানানো।রোশান স্যারও আদা চা ছাড়া খান না।আজ থেকে ওনার খুব যত্ন নিতে হবে।সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় আসেন।নিজের চা নিজেই করে খাচ্ছেন।আমাকে কখনো বলেনও না।নিজের কাপড় নিজে ধুয়ে নেন।আমারও উচিত ওনার সেবাযত্ন করা।শাশুড়ি ঠিকভাবে রান্না করেন না।ওনি বেশিরভাগ টাইম-ই বাইরে খাচ্ছেন আবার আমার জন্যও খাবার নিয়ে আসছেন।এতে ভালোর ভালো কিছুই হচ্ছে না।আজ থেকে রান্নার দিকে খেয়াল দিতে হবে।আমি কিচেনের দিকে গেলাম।গ্যাসে পানি গরম করতে দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।দাদু বারান্দায় বসে কাশছেন।কফ বাইরে ফেলতে গিয়ে বারান্দায় পড়ে গেল।
জিনাত নাক সিটকে বলল,
”ছিঃ!পরিবেশ-ই নষ্ট।এইভাবে কেউ ফ্লোরে কফ ফেলে?ফুপি এইসব সহ্য করো কীভাবে?চোখের সামনে এসব কিন্তু সহ্য করা যায় না।হাউ ডিসগাস্টিং!আমি কতদিন ভাত খেতে পারব না তার ঠিক নেই!দেখেই বমি পাচ্ছে আমার!”
শাশুড়ি দাদুর দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্তির সাথে বললেন,”আচ্ছা বাবা আপনার কি কোনো আক্কেল নেই?এত দামি ঘরবাড়িতে আপনি এসব কীভাবে ফেলেন?এটা কি আপনার আগের কালের মাটির ঘর?আপনার জন্য বাড়ির পরিবেশ-ই নষ্ট।দুনিয়ায় আরও বুড়ো মানুষ আছে কেউ আপনার মতো পি – শা – চ না।”
জিনাত আরও বেশি মুখ সিটকে বলল,
“ফুপি ওনার আয়ু আছে বলতে হয়।ওনার বয়সী কেউ বেঁচে নেই।দাদুর থেকে আরও অনেক কম বয়সী মানুষ কিন্তু মা** রা গেছে।আর কতদিন তোমাদের জ্বালাবে তার ঠিক নেই!”
দাদুর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।কাতর কন্ঠে বলল,
“আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি বউমা।বুঝতে পারিনি।বাইরে ফেলতে গেছিলাম ভেতরে পড়ে গিয়েছে।”
‘আপনি তো আপনার মেয়ের বাড়ি গিয়েও কিছুদিন থেকে আসতে পারেন বাবা।না মানে আপনার প্রতি দায়িত্ব কি শুধু আপনার ছেলের একার-ই?জমি তো ভাগ করে ঠিকই মেয়ের অংশ মেয়েকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।দু’দিন যান দেখবেন দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিবে।বেশিরভাগ মানুষ তো বৃদ্ধকালে মেয়ের বাড়ি গিয়েই থাকে।আপনার জন্য কি আপনার মেয়ের বাড়িতে একবেলা ভাতও জোটে না?’
জিনাত বলল, “ফুপি ওনাকে খেতে দেওয়ায় উচিত নয়।ওনি কিন্তু ইচ্ছা করে সারাহকে রোশান ভাইয়ার সাথে বিয়ে দিয়ে এনেছেন।ওনি জানেন ফার্নিচার,গহনা,টাকা এসব দিবে বললেই তুমি রাজি হয়ে যাবা।ওনার প্লান-ই ছিল তোমাকে টাইট দেওয়া।এইজন্য সারাহ’র মতো উৎশৃংখল বেয়াদপ-বেপরোয়া একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে।আর তরীরও ছেলে নিয়ে বাইরে থাকার মতো এত সাহস কিন্তু হতো না ।মেইন কালপ্রিট এই বুড়ো।আজকে আমার সাথে রোশান ভাইয়ার বিয়ে হলে কী তোমার কপালে এত দুঃখ হতো?”
‘বিয়ে হয়েছে তাতে কী?আমার ছেলে কি পঁচে গিয়েছে?তরীকে বিদায় করেছি সারাহকেও বিদায় করে দুই ছেলের আবার বিয়ে দেব।’
এক কাপ চা হাতে নিয়ে এগিয়ে এলাম।দাদুর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে বললাম, ‘দাদু আদা চা।খেয়ে ফেলুন দেখবেন একদম সুস্থ হয়ে গিয়েছেন।’
দাদু চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, ‘তোর ফুফু শাশুড়িকে একটু ফোন কর তো।আমি একটু বেড়াতে যাব।’
‘কোথাও যাওয়া হবে না আপনার দাদু।আপনি ছাড়া আমার ভালো লাগবে না।’
‘শোন আসব।তোর পরীক্ষা শেষ হোক ততদিন একটু ঘুরে আসি।অনেক দিন মেয়েটাকে দেখি না।সেই তোর বিয়েতে এসছিল।আর আসেনি।’
‘দাদু আমারও মনে হচ্ছে আপনি কিছুদিন ফুপি বাড়ি গিয়ে থাকলে কিছু মানুষকে জব্দ করতে আমার সুবিধা হতো।’
এর-ই মাঝে ওশান বাইক নিয়ে বাইরে থেকে এসে বলল,
‘আম্মা চা দাও।’
জিনাত বলল, “ফুপি আমারও চা খেতে মন চাচ্ছে।”
শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “সারাহ সবাইকে চা দাও।”
দিচ্ছি বলে গ্রিল দিয়ে বাইরে থু থু ফেলতে গিয়েই সেটা পড়ল জিনাতের মুখে।জিনাত কেমন রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে!মুহূর্তের মাঝে চেঁচামেচি শুরু করে বলল, ”তুমি আমার মুখে থুথু ফেললে কেন?”
আমি ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বললাম,
“তুমি গ্রীল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছো কেন?আমি গ্রীল দিয়ে বাইরে ফেলতে গেছি তোমার মুখে পড়ছে।আমি কী করব?আমি ইনোসেন্ট আমার কোনো দোষ নেই।’
‘এক্ষুনি আমার মুখ থেকে থুথু পরিষ্কার করো।আজ কিন্তু বাড়াবাড়ি রকম কিছু একটা হয়ে যাবে।’
‘পারব না। কী করবে তুমি?’
‘পারবে না মানে? মগের মুলুক পেয়েছ?তুমি না তোমার ঘাড় পারবে!’
‘ততক্ষণে শুকিয়ে যাচ্ছে তোমার গালে।’.
‘আমি আবার বলছি পরিষ্কার করো।’
‘কেন পরিষ্কার করব?আমার পথের সামনে এসে তুমি দাঁড়িয়েছ?আমার পথে যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আমি তাকে ছাড় দিতে পারি না আপু।,’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’
‘এই যে গ্রিল আর আমার মধ্যে ছিলে।থু থু খেলে।’
‘তোমার মতো বেয়াদব আর ফালতু মেয়ে দুনিয়াতে নেই!’
‘বাই দ্যা রোড জিনাত আপু,ফ্লোরে কাশি পড়াতে তো তোমার দারুণ ঘৃনা লাগল।এখন মুখে থু থু লাগল।কী করবে?মুখ কে**টে ফেলবে?কে*টে* ফেলা-ই উচিত। কারণ অনেক ঘৃণা বলে কথা!’
‘তুমি ফ্লোরের সাথে আমার মুখের তুলনা করছো?’
‘নিজেই বুঝে নাও।এবার বলো কবে মরবে আপু তুমি?তোমার চল্লিশা খাব কবে?’
‘হোয়াট? এই মেন্টাল মেয়ে কী-সব বলছো?’
‘তোমার থেকে কম বয়সী অনেকে মারা গিয়েছে,সেই হিসাবে দীর্ঘায়ু তোমার।এতদিন কীভাবে বেঁচে আছো?বিশেষ কোনো শক্তি পেয়েছ?দৈব পাওয়ার?’
চলবে,,?
#একটি_নির্জন_প্রহর_চাই
৩৫
#WriterঃMousumi_Akter.
‘তোমার থেকে কম বয়সী অনেকে মারা গিয়েছে,সেই হিসাবে দীর্ঘায়ু তোমার।এতদিন কীভাবে বেঁচে আছো?বিশেষ কোনো শক্তি পেয়েছ?দৈব পাওয়ার?’
কথাটা আমি টেনে টেনে বলে বাঁকা হাসলাম।আমি যে ওনাকে অপমান করতেই বলেছি ওনি সেটা বুঝতে পেরেছেন।আমার দিকে অগ্নি চোখে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
”ফুপি দেখলে এই মেয়েটা কেমন বেয়াদব।কী-সব বলছে।এতো ডিরেক্ট আমার মৃত্যু কামনা করছে!”
আমিও মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছি।কিছু বলুক যোগ্য জবাব আমার রেডি আছে।শাশুড়ি আমাকে কিছু বলার আগেই বললাম,
”জিনাত আপু আহা!তোমার ফুপিকে টানছো কেন এখানে?যা বলার আমাকে তুমিই বলো না।”
‘সারাহ তোমার মাঝে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই।তুমি কি মানুষ না অন্য কিছু?একটা মানুষ হয়ে কীভাবে অন্য আরেকটা মানুষের মৃত্যু কামনা করতে পারো?’
‘কেন? আমি কি কোনো পির,ওলি-আউলিয়া? যে আমার মুখের কথা ফলে যাবে তাই তুমি এত উত্তেজিত হয়ে পড়ছো।তুমি যে এতক্ষণ দাদুর আয়ুষ্কাল নিয়ে কথা বললে তখন কি নিজেকে খুব ভালো একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল তোমার?শোনো আপু আমি বেপরোয়া হতে পারি; কিন্তু অমানুষ নই।তাছাড়া তোমার তো চরিত্রেরও ঠিক নেই।এখনও রোশান ভাইয়ার অপেক্ষায় আছো? অন্যর জামাই নিয়ে টানাটানি করে নিজেকে মানুষ বলে মনে করো?রোশানকে নিয়ে টানাটানি করতে আসলে আমি তোমাকেই টানাটানি করে ছি** ড়ে ফেলব।ওনি আমার মানে আমার।যতক্ষণ আমি জীবীত আছি ওনি আমার।আমি মরে গেলেও ওনি আমার।ইহকাল-পরকাল,সব কালেই ওনি আমার।আমি অত ভাল নই বুঝলে যে জীবনে কোনো ঝড় আসলে বলব, ‘ওগো আমি তো মরেই যাব তুমি আরেকটা বিয়ে করে নিয়ো, একা থেকো না।আমি স্রেফ বলে দেব যদি আমি মরার পরে বিয়ে করেন তাহলে আমার আত্মা এসে শান্তিতে সংসার করতে দেবে না।’
আমার কথা বোধহয় একটু বেশিই সাংঘাতিক শোনাল।জিনাত আপু কেমন বড়ো বড়ো চোখে তাকালেন আমার দিকে।রাগী চোখে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বলল,
”সারাহ মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ! তুমি কিন্তু একটু না অনেক বেশি বলছো!ভেবো না আমি তোমাকে কিছু বলব না!ছিঃ!মানুষের মুখের ভাষা এমন হয়!”
‘আরে ইংলিশ আপ্পা আবার ইংলিশ বলছেন।আপনার না উচিত ছিল রোশান নয় ওশানের পিছে লাগা।তাহলে এতদিন কাজের কাজ হতো।রোশানের তো চরিত্রে কোনো সমস্যা নেই। নিজের এমন সুন্দরী,গুনবতি, ঝ*গ*রু*টে বউ রেখে অন্যর দিকে নজর দেবে না।ওশানের চরিত্রে অনেক সমস্যা আছে।তুমি একবার বললেই রাজি হয়ে যাবে।এতদিনে বিয়ে হয়ে ওশানের সন্তানের মা হয়ে যেতে পারতে।এত্ত পরিশ্রম করা লাগত না।’
‘কীহ!কী বললে?তুমি ভাবলে কীভাবে?আমি একটা ম্যারেড ছেলের সাথে!আমাকে এত্ত সস্তা লাগে তোমার?এত্ত ন্যারো মাইন্ডেড কেন তুমি?’
‘তাই নাকি?বিবাহিত পুরুষের প্রতি এত ঘৃণা তোমার?ওশান বিবাহিত সমস্যা আর রোশান,ওনি কি অবিবাহিত ?’
শাশুড়ি এবার অতিরিক্ত রেগে গিয়ে বললেন,
”সারাহ! তোমার মা-বাবার কাছে আজ ফোন দেব আমি।কী শিক্ষা দিয়েছেন তোমাকে? শ্বশুর বাড়ি এসে গুরুজনদের সাথে অশান্তি করতে কী তোমার মা-বাবা শিখিয়ে দিয়েছেন?”
‘এখানে মা -বাবা টানছেন কেন আম্মা!আপনি আমার গুরুজন তাই বেশি কিছু বলব না।আপনিই না কিছুক্ষণ আগে বলছিলেন, দাদুকে তার মেয়ের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসতে?তো আপনার তো মেয়ে নেই?আপনার এমন দিন আসলে কার বাড়িতে গিয়ে থাকবেন?একটা বয়স্ক মানুষকে এমন অপমান করলেন কীভাবে?’
ওশান পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে বলল, ”আম্মা চা কী পাওয়া যাবে?না-কি এসব নাটক দেখে যেতে হবে?কতদিন ঠিকভাবে চা-নাস্তা পাওয়া যায় না এ বাড়িতে।তরী যাওয়ার পরে একদিনও ঠিকভাবে খাওয়া হয়নি আমার।আর যাইহোক তরী আমার খাবার তিনবেলা গুছিয়ে রাখত।’
শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”যাও ওশান আর জিনাতকে চা দাও।”
‘আপনার ছেলে অত্যাচার করে বউ তাড়াবে আর আমি তার চা বানিয়ে খাওয়াব।যেখানে আমি আপনাদের রান্না করেই খাওয়াচ্ছি না সেখানে চা খাওয়ার আশা করাটা একটা বিলাসিতা মাত্র!’
এর-ই মাঝে রোশান স্যার রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।গায়ে গেঞ্জির হাতা ভরতে ভরতে এসে বললেন,
”আম্মা এ বাড়িতে কী শান্তিতে ঘুমানোও যাবে না?বাড়িটা হাট বাজার বানিয়ে ফেলছো না?সমস্যা কী তোমাদের?এটা কোনো সভ্য মানুষের বাড়ি?”
‘বাবা সারাহ আমার সাথে যে ব্যবহার করছে তা বলতে চাচ্ছি না।ছেলে মানুষ করেছিলাম কী এই দিন দেখার জন্য?সামান্য চা দিতে বলায় সারাহ যা যা বলল!’
জিনাত আপু বলল, ”রোশান ভাইয়া এটা কী বিয়ে করেছেন আপনি?এতো আমার মৃত্যু কামনা করছে।”
ওনি বিরক্ত চোখ-মুখ নিয়ে ওনার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ”আমাকে এখন কী করতে হবে আম্মা?না মানে তুমি আমাকে নালিশটা ঠিক কী জন্য দিচ্ছো?আর আমার কী করা উচিত বলে মনে হচ্ছে?”
‘বাবা এই মেয়ে আমাকে যাচ্ছে তাই অপমান করে যাচ্ছে।তুমি এর বিচার করো না বলেই এত সাহস বেড়েছে।’
‘চা কেন দিবে সারাহ।ও কি এ বাড়িতে জিনাত আর ওশানের চা বানাতে এসেছে?তুমি যদি ভেবে থাকো তোমার কথায় ওশানের মতো বউ-এর সাথে খারাপ ব্যবহার করব এটা ভুল ধারণা।যে তিনবেলা যত্ন করত তাকে তো মা-ছেলে মিলে তাড়িয়েছ।এখন যত্নের আশা করো কীভাবে?তুমি যদি তরীকে আগলে রাখতে তাহলে আজ আমার ওয়াইফ তোমাকে কিছু বললে আমি তার যোগ্য বিচার করতাম।আর জিনাত তুমি বাড়িতে যাওয়া আসা করো ভালো কথা।কিন্তু সারাহ তোমার হুকুমের গোলাম নয়।নেক্সট টাইম যদি ও-কে কিছু বলো ও তোমকে মারলেও আমি শুনতে আসব না।আমি সবটা শুনেছি আর শুনেই এসেছি এখানে।’
জিনাত আর কিছুই বলার সুযোগ পেল না। শাশুড়ি ও বেশি একটা হুকুম চালাতে পারে না বড় ছেলের প্রতি।দাদু মিটিমিটি হাসছেন।আমি রান্নাঘরে প্রবেশ করে চা গরম করে রোশান স্যারের জন্য ঢেলে নিয়ে রুমে গেলাম।রুমে গিয়ে দেখি ওনি রুমে নেই।আমি এদিক-সেদিক উঁকি দিয়ে দেখলাম কিন্তু কোথাও নেই ওনি।হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম।আমি ওয়াশ রুমের দরজায় থাকা ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিতেই ওনি সাথে সাথে দরজা খুলে আমাকে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেলেন।আর একটু হলে প* রা* ণ উড়ে যেত।ইশ কী ভ–য় টা-ই না পেয়েছি!মাথার উপর পানি পড়ছে।শরীরে আচমকা পানি পড়তেই কেমন শিরশির করে উঠল।সামনে তাকিয়ে দেখি শ্যামসুন্দর পুরুষের পরনে টাওয়াল।খালি গায়ে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছেন,ঠোঁটের কোনে দুষ্টু হাসি।ওনি ওনার দুই হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছেন।ওনার হাত সরানোর চেষ্টা করছি কিন্তু ব্যার্থ হচ্ছি।আমি যতচেষ্টা করছি ওনি তত শক্তভাবে আমাকে ধরছেন।প্রায় ভিজে গিয়েছি।ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমার লজ্জা লাগছে ছাড়ুন আমাকে।ভিজে যাচ্ছি কিন্তু।’
ওনি আমাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বার্থডে গিফটটা এখনও পেলাম না কিন্তু?দাও ছেড়ে দিচ্ছি।’
‘কী অসভ্য কথা-বার্তা!ছাড়ুন আগে।’
‘আগে দাও তারপর ছাড়ছি।’
‘কী দেব?’
ওনি আমাকে এবার রীতিমতো চমকে দিলেন।কিছু না বলে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে ঠোঁট ডুবিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ‘চুমু দাও।’
ইয়া মাবুদ এই মানুষ টা এত নির্লজ্জ!লজ্জায় এখনি ম* রে যাব আমি।যে ভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আর হুট হাট চুমু দিচ্ছে তাতে বেশিক্ষণ লাগবে না অজ্ঞান হতে।ওনার হাত থেকে রক্ষা পেতে বললাম, ‘পরে দেব ছাড়ুন এখন।’
‘এই দারুণ মোমেন্ট রেখে পরে?’
‘হ্যাঁ পরে এখন আমার লজ্জা লাগছে।ছাড়ুন এবার।’
‘না ছাড়ব না।’
‘বললাম না দেব?’
‘টাইম বলো।’
‘আমার কিন্তু পড়া বাকি অনেক।কিছুই পড়িনি।এভাবে ধরে রাখলে ফেল করব।’
ওনি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তুমি এখানেই থাকো।একবারে গোসল শেষ করে বের হও।আমি তোমার ড্রেস নিয়ে আসছি।’
ওনি ভেজা শরীরেই বেরিয়ে গেলেন।কিছুক্ষণ পর এসে দরজায় উঁকি দিয়ে আমার ড্রেস দেওয়ার সময় বললেন, ‘সারাহ!তোমাকে আজ যে রুপে দেখলাম, ট্রাস্ট মি! আমি খু**ন হয়ে যাব।’
ওনার এই কথাটায় যেন আমি নিজেই খু**ন হয়ে গেলাম।ওয়াশ রুমের ওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে লজ্জারাঙা মুখটা লুকালাম ওনার থেকে।
আমি ড্রেস চেঞ্জ করে বেরিয়ে এসে দেখি ওনি কমন ওয়াশরুম থেকে গোসল শেষ করে ট্রাউজার পরে মাথার চুল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করলেন।আমি চুপ করে চেয়ার টেবিলে পড়তে বসলাম।মন বড়োই অস্থির আমার।”উড়ো চিঠি”পেইজে ওনাকে নিয়ে একটা চিঠি লিখি দিয়ে এসেছি।তারা সেটা ওনাকে মেনশন করেই পোস্ট দিয়েছে।ওনি কখন দেখবেন সেই অপেক্ষায় আছি।ওনি ফোন নিয়ে বিছানায় বসলেন পা মেলে বালিশ হেলান দিয়ে।ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছেন মনোযোগ দিয়ে।বিভিন্ন মানুষ ওনাকে মেনশন দিয়েই যাচ্ছে।আমি পড়ার ফাঁকে খেয়াল করছি কে কি কমেন্ট করছে।
ওনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”আচ্ছা তুমি কি জানো কে আমাকে চিঠি দিয়েছে?”
আমি সরল মুখভঙ্গীতে বললাম, ”কই না-তো?”
‘শিওর তুমি নাহ?’
‘নাহ!আমি চিঠি লিখতে পারি না।’
‘ওহ আচ্ছা!যেই লিখুক তার অনুভূতি প্রকাশের ধরণ টা সুন্দর। ‘
‘তাই?’
‘হুম বাট এখন আমাকে চিঠি লিখে লাভ কী?বিয়ের আগে যদি লিখত তাহলে ভেবে দেখা যেত।’
‘বিয়ের আগে লিখলে কী ভেবে দেখতেন?’
‘ভেবে দেখতাম যে এত সুন্দর চিঠির মালিককে বিয়ে করলে নিশ্চয়ই রেগুলার এমন দারুণ দারুণ সব চিঠি পাব।এক বাক্যে বিয়ে করে নিতাম।’
বই খুব জোরের সাথে বন্ধ করে ওনার দিকে ঘুরে বসে বললাম, ”কেন খুব আফসোস হচ্ছে?”
‘তা হচ্ছে একটু।’
‘তাহলে যান এখনই গিয়ে বিয়ে করুন।”
‘হুম আমিও সেটাই ভাবছিলাম কিছুক্ষণ আগে।’
‘কী ভাবছিলেন? ‘
‘বিয়ের কথা।এত সুন্দর চিঠি যে লিখেছে তাকে বিয়ে করা-ই যায়।’
রেগে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ওনি চট জলদি উঠে এসে আমার হাত টেনে ধরে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে বললেন, ”যার অনুভূতি প্রকাশ এত সুন্দর তাকে একবার নয় একশ বার বিয়ে করতে রাজি আমি।চিঠিটা যে তোমার সেটা খুব ভালো করেই জানি আমি।’
সাথে সাথেই আনন্দে চোখ-মুখ স্নিগ্ধ হয়ে উঠল আমার ।চিঠিটা ছিল,
প্রিয় শ্যামসুন্দর পুরুষ,
কখনো আমার হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিক গতিবিধি লক্ষ্য করেছেন,যখন আমি আপনার আশেপাশে থাকি?আপনি কাছাকাছি এলে কেন জানি আমার হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে বেড়ে যায়।আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই,যদি আপনি সেই ঢিপঢিপ শব্দ শুনে ফেলেন!আপনি নিজেও জানেন না, আপনার প্রতি আমার অনুভূতি কী ভয়ানক!কতটা সুন্দর মানব আমার চোখে সেটা আপনি জানেন না। আপনি যে অনিন্দ্যসুন্দর। আমার শ্যামসুন্দর আপনি।আপনি যখন একপলক আমার দিকে তাকান,আমার পৃথিবী যেন থমকে যায়।কখনো হঠাৎ স্পর্শে আমি আবেশে জড়িয়ে যাই।বলতে পারেন কি যাদু আছে আপনার মাঝে যা আমায় ক্ষণে-ক্ষণে আপনার প্রতি মোহাবিষ্ট করে রাখে!আপনার হাসি আমার হৃদয়ে ভালবাসার ঢেউ সৃষ্টি করে,আমি ভেসে যাই সে ঢেউ-এ।আপনি যে পুরোটাই অভিনব।আমার স্বপ্নের শ্যামপুরুষ।আপনাকে ভেবে কতশত রাত আমার স্বপ্নের মতো কেটে যায় জানেন প্রিয়তম?আপনি প্রেমময়, আমি সেই নেশায় আসক্ত।আপনি যে অনিন্দ্যসুন্দর।ভালবাসার অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ করতে হয় জানি না আমি,শুধু জানি আমি আপনাতে বিভোর, আমি আপনার নেশায় ডুবে যাই,আমি আপনাতে নিজেকে খুঁজে পাই।ভালবাসি! ভীষণ!ভীষণরকম প্রিয়!আপনি আমার! একান্তই আমার!আপনাকে পাওয়ার দাবি আমার আজন্মকাল শ্যামসুন্দর পুরুষ।
আপনি আমার এক জীবনের সাধনা।আপনাকে পাওয়ার দাবি মৃ*ত্যু*র পরেও আমি ছাড়ব না!
ইতি
আপনার প্রনয়ীণী।
চলবে,,?