একটি শব্দ পর্ব-০২

0
81

একটি শব্দ
লাবিবা আল তাসফি
(২)

লম্বা সিরিয়াল পেড়িয়ে চেম্বার থেকে বের হতে হতে প্রায় দুপুর গড়িয়েছে। রাস্তার মোড়ে সবজির ভ্যান। বেশ টাটকা সবজি রয়েছে। সাকিব সবজি পছন্দ করে। সেটা যে কোনো সবজি হতে পারে। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সে আবার বেশ সচেতন। নুপুর ভ্যানের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে। পুতুলকে বলে,

‘কোনো সবজি লাগবে বাড়িতে?’

‘না। পাঁকা কলা শ্যাষ হইছে। হেইতা কেনেন।’

‘এখানে তো কলা নেই। চল সামনে দেখি।’

নুপুর এগিয়ে যায়। প্রতিদিন রাতে সাকিব অল্প কিছু ভাত দুধ কলা দিয়ে খাবে। এটা নাকি তার ছোট বেলার অভ্যাস। মানুষ এক অভ্যাস কিভাবে এতদিন ধরে রাখতে পারে? নুপুরের তো এক খাবার পরপর দু তিনদিন খেলে প্রায় মাস খানেক আর তা ছুঁতেও মন চায় না।
নুপুর কলা নিয়ে দোকানীকে টাকা দেওয়ার সময় পুতুলের চাপা গলায় বলা কথা শুনতে পেল,

‘এরেই কয় দুধ কলা দিয়া কাল সাপ পোষা! আমি হইলে দুধের সাথে বিষ দেতাম, বিষ!’’

নুপুরের কানে কথাটা গেলেও সে কৌশলে এড়িয়ে যায়। কথাগুলো সাকিবকে উদ্দেশ্য করে বলা তা বুঝতে বাকি নেই তার। তাছাড়া পুতুল যেন নুপুরকে শোনানোর জন্যই ওভাবে বললো।

৪.
রোজকার মতো আজও বেশ রাত করে ঘুম ভাঙল নুপুরের। পাশেই সাকিব গভীর ঘুমে মগ্ন। শান্ত রাতে সাকিবের নিঃশ্বাসের ধ্বনি অনেক জোরালো শোনাচ্ছে। নুপুর বেশ কিছুক্ষণ চুপটি করে শুয়ে থাকে। চোখ বন্ধ করে রেখে পুনরায় ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম তাকে পুরোপুরি বিদায় জানিয়েছে। নুপুর বিছানা ছেড়ে ওঠে। শাড়ির আঁচল গায়ে পেঁচিয়ে শব্দহীন পায়ে হেঁটে খোলা বারান্দায় যায়। তাদের ফ্লাটটা চার তলার ওপর। সামনে খোলামেলা ছোট মাঠ। বারান্দায় দাঁড়ালে ফুরফুরে বাতাসে শরীর মন শীতল হয়ে আসে। নুপুর আবেশে চোখ বন্ধ করে।

‘চা খাবে?’

পাশ থেকে শান্ত ছোট কথাটা শুনতেই চমকে ওঠে নুপুর। সাকিব তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দু হাত রেলিংয়ে ভর দিয়ে তার পানেই চেয়ে আছে। দূরের ল্যাম্পপোস্টটার মৃদু আলোতে সাকিবের শ্যাম মুখখানা স্পষ্ট। নুপুর সাকিবের কথার উত্তর না দিয়ে চিন্তিত গলায় শুধায়,

‘ভুম ভেঙ্গে দিলাম বুঝি? স্যরি! ঘুমাতে চলো।’

নুপুর ফের রুমের পানে যেতে গেলে সাকিব এক হাতে আলতো করে নুপুরের শাড়ির আঁচল ধরে রাখে। মৃদু গলায় বলে,

‘ভোর হতে বেশি বাকি নেই। চা খেতে খেতে ভোর হতে দেখতে মন্দ লাগবে না। কি বলো?’

সাকিব প্রশ্নটা নুপুরের চোখে চেয়ে থেকে করলো। নুপুর সেই চোখকে ফেরাতে পারলো না। ভালো লাগায় বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটুকু মিইয়ে গেল। নুপুর খানিক হেসে বললো,

‘বেশ তবে। আমি চা করে আনছি।’

সাকিব নুপুরের আঁচলের কোনাটা আরো শক্ত করে ধরলো। নুপুর তা দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই সাকিব বললো,

‘চা আমি বানাচ্ছি। তুমি বরং তারা গোনো। আমি ফিরলে জানাবে কতগুলো হয়েছে!’

নিতান্তই ছেলেমানুষী কথা! নুপুর বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সাকিব মোটেও রসিক টাইপের নয়। তাদের সম্পর্কের এত বছরেও সাকিব কখনো মজা করে একটা কথা বলেনি। না বলেছে অন্যসব প্রেমিকদের মতো আকাশ থেকে চাঁদ, তারা এনে দেওয়ার কথা। এদিক থেকে ভাবতে গেলে সাকিব ছিল নুপুরের খুব কাছের একজন ভালো বন্ধু। যার সাথে থাকলে নুপুর কিছু সময়ের জন্য তার কষ্টকে ভুলে থাকতে পারতো। তাদের প্রেম সিমাবদ্ধ ছিলো ভার্সিটির ক্যান্টিন আর লাইব্রেরীতে। অন্যদের মতো কখনো পার্কে বেড়াতে যাওয়া হয়নি। একসাথে বসে গল্প করতে করতে বাদাম খাওয়া হয়নি। এসবকিছু বিয়ের পরেও হয়নি। সাকিব সর্বদা ব্যস্ত মানুষ। ছুটির দিনগুলোতে বাসায় থাকলে পুরোটা সময় সে বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে রাখে। নুপুর সাকিবের এই রূপের সাথেই পরিচিত। কিন্তু আজকাল কিছু ব্যতিক্রমতা নুপুরকে অবাক করে দেয়। নুপুরের আনন্দ হওয়ার কথা হলেও নুপুর এসবে মোটেও আনন্দিত হতে পারে না। ভয়, চিন্তা সব এসে জড়ো হয়। হৃৎপিণ্ডটা তীব্র শব্দ করে ছুটতে শুরু করে। মনটা বারবার অনুনয় করে বলতে থাকে,
‘আমার কিচ্ছু চাই না। শুধু সে আগের মতোই থাকুক। তার পরিবর্তন চাই না আমি।’

যেন সাকিব পরিবর্তন হলে এমন কিছু ঘটবে যা নুপুরের এই ক্লান্ত হৃদয় সহ্য করতে পারবে না।
বিয়ের পর এই প্রথম সাকিবের হাতে বানানো চা খাচ্ছে নুপুর। চা অত্যন্ত তিতো হয়েছে। নুপুর তবুও দ্বিতীয় বারের মতো চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ালো। সাকিব পূর্বের মতোই শীতল চোখে বাহিরের অন্ধকারের পানে চেয়ে আছে। সে কি ভাবছে তা বোঝার উপায় নেই। চায়ের কাপটা রেলিংয়ের উপর রাখা। ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হয়েছে। নুপুর তার চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিতে দিতে সাকিবকে পর্যবেক্ষণ করছে।

‘আমার মা কে দেখবে?’

সাকিবের কথায় নুপুর চমকে তাকায়। আলতো করে মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। সাকিব ফোন বের করে একটা ছবি নুপুরের সামনে ধরে। ছবিতে থাকা মহিলাটি বেশ বৃদ্বা। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। মাথার প্রায় অর্ধেক চুল সাদা। সত্যি বলতে নুপুর এই প্রথম তার শ্বাশুড়িকে দেখেছে। সাকিবের পরিবার থেকে কেউ নুপুরকে মেনে নেয়নি। ওমন চাল চুলোহীন মেয়েকে কে বা বাড়ির বউ করতে চাইবে? সাকিবের বাবা বিয়ের পরদিন কল করে জানিয়েছে সে যেন বউকে নিয়ে গ্রামে পা না রাখে। সাকিব তার বাবার কথা ফেলেনি। সে কখনোই নুপুরকে তাদের সামনে নিয়ে যায়নি। নুপুর অবশ্য প্রথম দিকে বার কয়েক বলেছিল তাকে নিয়ে যেতে। সে দরকার হলে বাবা মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইবে। সাকিব রাজি হয়নি। শক্ত মুখে বলেছে,

‘কোন ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবে? যদি ভুলের প্রসঙ্গ আসে তবে ভুল আমি করেছি। এখানে তোমার ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন আসে না।’

এর প্রতিউত্তরে নুপুর বলার মতো কিছু খুঁজে পায়নি। আর না কখনো এ বিষয়ে কথা বলার সাহস পেয়েছে। পরিবারের কথা উঠলেই সাকিবের শীতলতা বেড়ে যায়। এই চার বছরেও নুপুর তার শ্বশুর বাড়ির পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেনি। কেবল জানে গ্রামে সাকিবের ছোট ভাইকে নিয়ে সাকিবের মা বাবা থাকেন। বেশ কিছু ফসলের জমি থাকায় তাদের থাকা খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। তবুও সাকিব মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তার বাবার একাউন্টে ট্রান্সফার করে। তবে এই চার বছরেও ভদ্রলোক সেখান থেকে এক পয়সা খরচ করেনি।

নুপুর এই প্রথম তার শ্বাশুড়িকে দেখে বুঝলো সাকিব মোটেও তার মায়ের মতো হয়নি। তাদের চেহারায় কোনো মিল নেই। না আছে চোখের মিল। সাকিবের চোখ টলটলে পানির মতোই সরল। অন্যদিকে তার মায়ের চোখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলমলে। নুপুরের চোখ ছলছল করে। একবার যদি সে মা বলে ডাকতে পারত! একটা মা পাওয়ার স্বাদ কি সে কখনো পাবে না?

নুপুরকে কাঁদতে দেখে সাকিব বলে,

‘আমি আমার মায়ের মতো হইনি। তাই না? আমরা দু ভাইয়ের কেউ তার মতো হইনি। দুজনি বাবার চেহারা পেয়েছি। গায়ের রংটাও বাবার। মায়ের এটা নিয়ে যে কত আফসোস ছিলো! তারপর আমাদের একটা বোন হলো। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতেই হয়তো আল্লাহ ওকে পাঠিয়েছিল। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বোনটা পুরোপুরি মায়ের কপি ছিল। আমাদের বয়সের গ্যাপ ছিলো প্রায় পনেরো বছরের মতো। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের বেশ আদরের ছিলো ও। ওর বয়স যখন পাঁচ তখন একদিন সকালে ওকে রেখে আমরা তিনজন বাজারে যাই। মা রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। আমাদের পিছু পিছু যেতে গিয়ে মটোরগাড়ির সাথে অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমাদের আদরের বোনটা সেদিন বিদায় নেয়। ওকে না নিয়ে যাওয়ার অপরাধ বোধে আমি মায়ের চোখে তাকিয়ে কোনো কথা বলতে পারিনি আর কখনো। এজন্য বিয়ের পর আমাকে গ্রামে পা রাখতে মানা করলে আমি জোর দিয়ে বলার মতো কথা খুঁজে পাইনি। তুমিও কি মনে করো আমি স্বামী হিসেবে দুর্বল, অযোগ্য?’

নুপুর তৎক্ষণাৎ ডানে বায়ে মাথা নাড়ে। তার চোখ ভিজে এসেছে। মানুষটা তার শীতলতার পেছনে এত কষ্ট জমা করে রেখেছে তা হয়তো সে কখনোই জানতে পারত না। এ ক্ষেত্রে নুপুর ও কি স্ত্রী হিসেবে অযোগ্য নয়?

কিছুক্ষণের মাঝেই রাতের আঁধার চিরে আলো উঁকি দিতে শুরু করে। কান্নাকাটি শেষে ক্লান্ত হয়ে নুপুর ঘুমিয়ে পড়েছে সাকিবের কাঁধে মাথা রেখে। চোখ দুটো ফুলে টমেটোর রঙ ধরেছে। সাকিব আলতো হাতে নুপুর মাথা নামিয়ে তাকে তার কোলে শুইয়ে দেয়। ততক্ষণে আকাশে দিনের আলো ফুটে গেছে। এই তো আর কিছু সময়ের মাঝেই পাখিদের ঝাঁক বেড়াতে বের হবে। কিচকিচ শব্দ তুলে গান গাইবে। চারদিকে ছড়িয়ে দিবে সকাল হবার খবর।

৫.
‘আইজকেও ভাইজানরে দেখছি। আমার চক্ষু একদিন ভুল দেখবার পারে কিন্তু দুইদিন না। এই পুতুলের চোখ কুনোদিন মিত্যা কিছু দেখে না।’

‘পুতুল তোকে এসব নিয়ে বকবক করতে মানা করেছি। বেশি পাকা কথা ভালো না। প্রয়োজন ছাড়া একটা বাড়তি কথা বলবি না তুই।’

‘আচ্চা আপনেই কন, ভাইজানের হাতের ড্যানায় একটা কাটা দাগ আছে না? কন, আছে না?’

‘আছে। তো?’

‘সেইডাই তো কতা। আমি কেমনে জানলাম এই কাটা দাগের কতা? ভাইজানরে আমি কুনোদিন জামা ছাড়া দেখিনাই। দেখছি? দেখলেন তো! এই পুতুলরে বিশ্বাস না কইরে পারবেন না। পুতুল সত্য ছাড়া মিত্যা কয় না।’

‘তোকে আমি সত্য মিথ্যা কোনোটাই বলতে বলিনি। দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখ। কাজে মন দে।’

নুপুরের কথায় পুতুল ফুঁসে ওঠে। রাগ দেখিয়ে বলে,

‘আপনে এমন বলদ ক্যান কন তো? পাগল ও নিজের ভালো বোজে। আপনে বোজলেন না। আপনের জন্যি বুকটা ছলকায় তাই আপনেরে সত্যটা জানাইলাম। নয়তো আমার ঠেকা পরে নায়।’

নুপুর পুতুলের কথার জবাব দিলো না। আজকাল নুপুর বোঝে না সে নিজে কি চায়। সাকিবকে বিশ্বাস করবে নাকি পুতুলের বলা কথাকে যাচাই করে দেখবে। সে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আজকাল তার মনে সন্দেহের দানা সৃষ্টি হয়েছে। সে চাইলেও কেন যেন চোখ বন্ধ করে পুতুলের বিরোধীতা করতে পারে না। কেন পারে না? কারণ সাকিবের ছোট খাটো পরিবর্তন গুলো তাকে বিরক্ত করছে? হয়তো। কিংবা সাকিবের প্রতি তার বিশ্বাসটা আগের মতো নেই এমনটাও হতে পারে।নুপুর ঠিক জানে না কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক। ঠিক বেঠিক জাজ করার শক্তিটুকুও যেন তার নেই।

‘পুতুল তুই আর কোন‌ কোন বাড়িতে কাজ করিস?’

‘ঐ করি আরো তিন জায়গায়। মাজেদা খালা আরো একটা কাজ ঠিক করবার কতা কইছে। ঐডা হইলে আপনের বাড়ির কাজ ছাইড়া দিতাম।’

‘কেন? আমি কি খারাপ মানুষ?’

‘আপনে খারাপ হইলে কাজ ছাড়া লাগতো না। কিন্তু সমেস্যা হইলো আপনে মেলা ভালা মানুষ। এই জগতে ভালা মানুষের বাড়িতে কাজ কাম কইরা শান্তি নাই। মনে কুনো শান্তি নাই।’

পুতুলের কথা শুনে নুপুর মলিন হাসে। বুকের উপর ভার অনুভব করে। তার জীবনের শান্তিটুকু তাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল?

চলবে…..