একদিন দেখা হয়েছিল পর্ব-০৫

0
1

#একদিন_দেখা_হয়েছিল
নাজনীন আক্তার
পর্ব-৫

আমি দ্রুত জানালার ধারে যেয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। সত্যিই একটা আবছায়া দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু অবয়ব দেখে ঠিক চিনতে পারছি না। কে দেখা করতে আসবে এমন লুকিয়ে-চুরিয়ে! মনের মধ্যে একজনের নাম ভেসে আসলেও, মনের কথায় ঠিক পাত্তা দিলাম না। আবার উড়িয়ে দিতেও পারলাম না! তাই যাব কী যাবনা ভাবতে ভাবতেই বাগানের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম!

আজ পূর্ণিমা। আকাশজুড়ে এক আভিজাত্যপূর্ণ জ্যোৎস্নার রাজত্ব। যেন চাঁদ আজ তার পূর্ণ সৌন্দর্যে নিজেকে উন্মোচিত করেছে। নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে ঝরে পড়ছে স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার সোনালি ছোঁয়া, ধীরে ধীরে আলোকিত করে দিচ্ছে গোটা বাগান। এই বাগান আমাদের অনেক শখের। মা-চাচীরা মিলে বাগানটা করেছে। আমাদের রেস্ট করার জন্য এখানে বসার ব্যবস্থাও আছে। মন খারাপ হলেই আমি এখানে আসি। কিন্তু আজ এই বাগানে কে এসেছে! একটু সামনে যেতেই একজনের ছায়া দেখছি। ধীরে ধীরে অজানা মানুষটার অবয়বও আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে এলো।

কাব্য! তাকে দেখে আমি স্থির হয়ে এলাম। কেমন ভোঁতা এক অনুভূতি অনুভব করছি। কাতর চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু মুহূর্তেই আমার দৃষ্টি শক্ত হয়ে এলো। রাত বারোটার বেশি বাজে। কালকে আমার বিয়ে। সে আজ কেন এসেছে? আরও রাতের গভীরে! নাকি আমার দুর্বলতার খোঁজ পেয়ে বিয়ের আগে আমাকে নতুন করে আঘাত দিতে এসেছে! আমি চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,

“রাত বারোটায় চোরের মতো এক বাড়ির বাগানে এসেছেন। আবার বাড়ির মেয়েকে ডেকে এনেছেন। আপনার উদ্দেশ্য খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না।”

তিনি আমার কথা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ক্রোধের ছায়াও স্পষ্ট। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে আমার হাতের কব্জির উপরের দিকে ধরলেন। নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরেছেন। আমি টু শব্দ না করে তার চোখের দিকে তাকালাম।

-হঠাৎ বিয়ে করতে রাজী হলে কেন?

-রাজী না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।

-কিছুদিন আগেও এই চোখে অন্যকারও জন্য ভালোবাসা দেখেছি আমি। একজনকে ভালোবেসে অন্যকাউকে বিয়ে করা অন্যায়।

-সেই ন্যায়-অন্যায় আমি বুঝে নেব। পুরোটাই আমার ব্যপার। এতে নাক গলানোর অধিকার আপনার নেই।

এবার তার কণ্ঠ নরম হয়ে গেল। তিনি হতাশার সুরে বললেন,

-মনা, তুমি কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারোনি? কেন সেদিন তোমাকে যত্ন করে বাড়ি পৌঁছে দিলাম, কেন মীরাজের সাথে যেতে বারণ করেছি, কেন সবসময় গ্রামে সাবধান থাকতে বলেছি, কেন সেদিন তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারিনি! কিছুই কি বোঝোনি?

-একবার ভালোবাসা দেখিয়ে আরেকবার সেই ভালোবাসার অস্তিত্ব অস্বীকার করাকে ভালোবাসা বলে না। সেদিন পুকুর পাড়ে আপনি কিছুই স্বীকার করেননি। তবে আজ কেন এসেছেন? চলে যান আমার বাড়ি থেকে। আর কোনোকিছু পরিবর্তন করা সম্ভব না। কাল আমার বিয়ে।

বহুকষ্টে কথাগুলো বলে তার হাত ছাড়িয়ে আমি দৌঁড় দিলাম। কাল বিয়ে, আর আজ অন্য কোনো অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। সে কেন এতদিন আসেনি? কী বাঁধা ছিল তার? সেই বাঁধা ডিঙিয়ে কেন আসতে পারল না সে? চোখের পানি লুকিয়ে আমি দৌঁড়ে যেতে নিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কিছু কথা ভেসে আসলো।

“আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি মনা। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছি সেদিনই নিজের মনের মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। প্রথম দেখায় প্রেম! এটাতেও ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। সেদিন ট্রেনের দেখায় কিন্তু প্রথম নয়। তারও বহুআগে তোমাকে দেখেছি। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। তোমার চোখে পানি দেখলে আমার বুকে ব্যথা হয়। মনে হয় ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তোমাকে হাসতে দেখলে আমি পৃথিবীর সব সুখ অনুভব করতে পারি। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না। একদমই চলবে না।

কথাগুলো বলতে বলতে তিনি মাটিতে বসে পরলেন। তার চোখে আমি স্পষ্ট পানি দেখছি। আমার মনও নরম হয়ে এলো। এমন তীব্র অনুভূতির প্রকাশ। আমি আবার ভেঙে পড়লাম। আর কোনোভাবেই কান্না আটকাতে পারলাম না। হঠাৎ মাটিতে বসে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।

-মনা, সবকিছুর ভিতরে আমি পিষে যাচ্ছি। আমার যেমন পরিবার ছাড়াও চলবে না। তেমন তোমাকে ছাড়াও চলবে না। আবার তুমি তোমার পরিবার থেকে দূরে থাকো, এটাও চাই না আমি। এক নারীকে চোখের সামনে দিনের পর দিন দেখেছি। পরিবার থেকে দূরে থেকে সারাটাজীবন কী ভীষণ যন্ত্রণা অনুভব করেছেন তিনি! সেই একই যন্ত্রণা তুমি পাও এটাও চাইনি আমি। কিন্তু আর নয়, সবার সামনেই আমি তোমাকে নিজের করে নিব। আমার ভালোবাসার পরীক্ষা সবার সামনে দিব। তোমার পরিবারের মানুষদের বারবার করা ভুলের জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে হারাতে দিব না।

আমি অবাক হলাম। আমার পরিবারের ভুল মানে! আর এত আশঙ্কা তিনি কেন করছেন! আমার বাবা বরাবর আমাদের মতামতের দাম দিয়েছেন। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন। বিয়ের ব্যপারেও আমাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

-আমার পরিবারের মানুষের ভুল মানে? আমার পরিবারকে আপনি চেনেনই না। তাই এমন কথা বলেন কীভাবে!

– তোমার পরিবারের মানুষদেরকে আমার থেকে ভালো আর কে চিনে? প্রত্যেককে চিনি। বরং তুমিই আমার থেকে কম চেনো।

আমি অবাক হলাম। কী বলছেন তিনি এসব। চোখের পলক কয়েকবার ফেলে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছি। হঠাৎ তিনি আমার কাছে এসে নরম স্পর্শে আমার দুইহাত ধরলেন। ধীর কণ্ঠে বললেন।

– একটা গল্প শুনবে মনা? খুব বেশি সময় নেব না। কিন্তু আজকে গল্পটা না বলতে পারলে আর কখনই বলা হবে না। আমার সারাজীবন আফসোসেই শেষ হয়ে যাবে। একটু কি শুনবে মনা?

———————————

কুসুমপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার “খান পরিবার”। সম্মানে, শিক্ষায়, অর্থে অন্য সব পরিবার থেকে আগানো। সেই পরিবারের এক ছেলে কলেজের টিচার হয়ে ঢাকায় যেয়ে বসবাস শুরু করেন। তার তিন ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটির জন্মের সময় তার মা মারা যান। কিন্তু এতে মেয়েটির কদর কিন্তু এক বিন্দুও কমে না। বরং সে বাবা আর তিন ভাইয়ের চোখের মণি হয়ে ওঠে। তার নামও রাখা হয় “নয়নতারা”। খান পরিবার তাকে রাজকন্যার মতো করে বড় করতে থাকেন। মেয়েটিও ছিল বাবা আর তিন ভাইয়ের ভক্ত। কিন্তু হয়তো বড় ভাইয়ের একটু বেশিই ভক্ত ছিল।

ধীরে ধীরে তারা চার ভাইবোনই বড় হতে থাকে। ভাইয়েরা একসময় পরিবারের দায়িত্ব নিতে থাকেন। তাদের বাবাও অবসরপ্রাপ্ত হয়ে বাড়িতেই বেশি সময় কাটান। নয়নতারার বিয়েও ঠিক করেন আরেক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে যায়। এমনসময় তাদের গ্রামে এক বিয়ের দাওয়াত পরে। নয়নতারার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে। তারা হৈহৈ করতে করতে বিয়েতে অংশ নিতে যান। বেশকিছুদিন গ্রামে থাকেনও। সেসময় নয়নতারার পরিচয় হয় সুরুজ নামক এক যুবকের সাথে। সুরুজ মির্জা! তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। আর এই বন্ধুত্বই ধীরে ধীরে প্রণয়ের দিকে এগিয়ে যায়। একদিকে বিয়ের দিনও ঠিক অন্যদিকে নয়নতারা সুরুজের জন্য নতুন অনুভূতি অনুভব করতে থাকেন।

তাই ঢাকায় ফেরত যেয়েই বিয়েতে না করে দেন। এদিকে মির্জা পরিবারও সম্মানে, শিক্ষায় অনেক আগানো। কিন্তু খান পরিবারের সাথে তাদের আগে থেকেই জমি-জায়গা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। এতেও হয়তো নয়নতারার বাবা মেনে নিতেন। কিন্তু ওইযে বিয়ে ঠিক। কথা দিয়ে ফেলেছেন তিনি। তিনি বিয়ের তারিখ আরও এগিয়ে দেন। তার মতে নয়নতারা অন্যায় করেছেন। বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে যাবার পরও অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছে। এ কাজ ভীষণ অন্যায়ের। তাই তিনি নয়নতারাকে বিয়ে পর্যন্ত বাড়িতেই বন্দী করে ফেলেন। কিন্তু নয়নতারা পারেনি নিজের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিতে। তাই কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে সব ফেলে বিয়ের দিনই পালিয়ে যান। সারা গ্রামে ছড়িয়ে পরে এ কথা। রবিউল খানের মেয়ে কীনা পালিয়ে গেছে!

কাব্যের সব কথা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। কিন্তু হঠাৎ চমকে উঠলাম। অবাক দৃষ্টিতে কাব্যের দিকে তাকালাম। কাব্য আমার দৃষ্টি দেখে হালকা হাসলেন।

-নিজের দাদুর নাম শুনে অবাক হচ্ছো? হ্যাঁ, তোমার দাদু রবিউল খানের মেয়ে। তোমার বাবা সবুর খান, চাচা মুকুল খান, কামাল খানের একমাত্র বোন নয়নতারা খান। মির্জা বাড়ির বউ এখন তিনি। আর আমি তার একমাত্র সন্তান কাব্য মির্জা।

(চলবে)