একদিন নববর্ষা -৩৩
অদ্রিজা আশয়ারী
____________
ভালোবাসা ব্যাপার টাই বড় বেশি জটিল। কে কাকে ভালোবাসে, কতটা ভালোবাসে কিংবা আদতেই ভালোবাসে কিনা… এই সত্যের ব্যাপারে ষোলোআনা ওয়াকিবহাল হয় না কেউ।
যার সান্নিধ্য জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত আমরা কামনা করি। হয়তো সেই সান্নিধ্যে থাকার প্রয়াসকেই অন্য নামে আমরা সঙ্গায়িত করি ভালোবাসা হিসেবে। কিন্তু নিপাট ভালোবাসা বোধহয় এই সমস্ত মানবিক নিয়ম মেনে চলে না। ভালোবাসার দুর্বোধ্য রসায়নে মানবতার কোনো বালাই নেই। ভালোবাসা ততক্ষণ ভালোবাসে না, যতক্ষণ না সেই ভালোবাসার জন্য আমরা দাসত্ব বরণে স্বীকৃত হই। সেজন্যই হয়তো হৃদয়ের একক প্রকোষ্ঠে আমরা খুব বেশি লোককে ঠাই দিতে পারি না একসঙ্গে । আমাদের হৃদয় তো শুধুমাত্র একটি সত্ত্বাকে ভালোবাসার উপযোগী করেই গড়া। যে সত্ত্বা এই সমস্ত ভালোবাসার কারিগর।
সেই সত্ত্বাকে অন্তরে ঠাই দেয়ার পর আর যা কিছু কে আমরা ভালোবাসা বলি সেসব আসলে শুধুই মায়া। যা সেই অদ্বিতীয় সত্ত্বারই দান করা অনন্য এক নিয়ামত।
নাব্য চিন্তিত। আল্লাহ প্রদত্ত সেই মায়া আদৌও কি সে ধারণ করতে পেরেছে বর্ষার জন্য? যে মায়া সে তার মা-বাবা, বোন, দাদি আর…..হয়তো গরানবনের সেই বর্ষা কেও করে।
সে মায়া কি ওর অনাগত সন্তানের মা বর্ষার জন্য তার আছে? এর উত্তর নাব্য সত্যি জানে না। আর জানে না বলেই ওর মন এত উদ্রিত হয়। দ্বিচারিতার মতো জঘন্য অপবাদের কালীমা ওর গায়ে লাগুক কখনো চায় না নাব্য। অথচ ওর মনের আনাচে-কানাচে.. কোথাও যে আজও পুরনো সেই বর্ষার জন্য কিছু একটা রয়ে গেছে.. তা সে স্পষ্ট অনুভব করে। এই স্থিতিহীন অনুভুতির কি নাম সে দেবে?
নাব্য আলগোছে ওর বা পার্শ্বে তাকায়। কম্বল জড়িয়ে বর্ষা গুটিসুটি মেরে শুয়ে, ডুবে আছে ঘুমের অতলে। ওকে খুব বেশি ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। ওর হাতের মুঠোয় একটা দলা পাকানো সাদা রুমাল। রুমালের অধিকাংশ র’ক্তের লালিমায় রাঙানো। বর্ষার এই অজানা অসুখটা আজকাল নাব্যের একটা বড় দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ে অসময়ে বর্ষার নাক, গলা দিয়ে র’ক্ত আসে। ডক্টরের শরণাপন্ন হয়েও এর কোনো সমাধান মেলেনি। ডক্টর বলেছে এতে গর্ভকালীন কোনো বড় সমস্যা দেখা দেবে না। কিন্তু তবুও নিশ্চিত হতে পারছে না কেউ।
এই কয়েকদিনেই বর্ষার ওজন সাত কেজি কমেছে।
লো ব্লাড প্রেশার, অসহ্য শারিরীক যন্ত্রণা। তার সঙ্গে সবসময় বমি আর নাক, গলা দিয়ে নিয়মিত এই র’ক্তক্ষরণ ওকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে।
___________________________
সবে অগ্রহায়ণের শুরু। ঢাকা শহরে কোনো কালেই শীতটা জাঁকিয়ে পড়েনা। তবে এবার শীতের প্রকোপ অন্যসময়ের চেয়ে কিছুটা বোধহয় বেশি৷ পূর্ব মুখী বারান্দায় বেতের দোলনায় পা মুড়ে বসে সকালের রোদ পোহাচ্ছে বর্ষা। দোলনাটা স্থির থাকছে না এক মুহূর্তের জন্য। খুব ক্ষীণ ভাবে দুলছে।
সেই দোলনার গায়ে হেলে, রোদ্দুরে সরু হয়ে আসা চোখ মেলে, হাতে থাকা কফির কাপের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় সে। কতদিন পেড়িয়ে গেল চা-কফি কিছুই খাওয়া হয়না ওর। আজকের কফিটা নাব্য নিজে তৈরি করে দিয়ে গেছে। নাব্যের তৈরি কফি সবসময় সেরা। কিন্তু তবুও এক চুমুকের বেশি মুখে রোচেনি।
আজকাল প্রায় সারাটা দিন একক- নিঃসঙ্গ কাটে বর্ষার। নিতিন নিজের মতো ব্যাস্ত থাকে। অনেক গুলো সিড়ি ভাঙতে হবে, এই ভয়ে দাদির কাছেও বর্ষার যাওয়া হয়ে ওঠে না খুব একটা।
কফির কাপে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই অকস্মাৎ কেঁদে ফেলে বর্ষা। সকালের সোনালী রোদ্দুরে, ওর গৌড়বর্ণ মুখে, অশ্রুবিন্দু টা হীরকখন্ডের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে হঠাৎ! সে ব্যাপারে সম্পুর্ন বেখেয়াল, ভাবনায় নীরন্ধ্র আচ্ছন্ন মেয়েটা চুপচাপ রোদে মুখ করে কাঁদতে থাকে। কান্নাটা এখন ওর নৈমিত্তিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। যখন-তখন, কারণে অকারণে আজকাল কাঁদে সে। তবে এখনকার মতো কান্নার একটা ক্ষুদ্র কারণ খুঁজে বার করে। নিতিনের সঙ্গে ওর সখ্যতার অন্তরায় ঘটেছে। নিতিন ওকে এড়িয়ে চলে আজকাল। সারাদিন নিজের ঘরে, রুদ্ধদারের ওপাশে কিছু একটা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে নিতিন। বর্ষার সঙ্গে দেখা হলে দু’চারটা বাক্য বিনিময় শেষে ফের নিজ আবর্তে ফিরে যায়।
সকল ক্লান্তি আর আলস্য ঝেড়ে ফেলে, গায়ে জাফরানি রঙা কা’শ্মীরি শাল জড়িয়ে বেতের দোলনা ছেড়ে উঠে আসে বর্ষা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ধীর পদক্ষেপে সিড়ি ভেঙে নামতে শুরু করে। উদ্দেশ্য দাদির ঘর।
দাদির ঘরে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে দাদির মুখে পুরনো দিনের গল্প শুনে সময় কেটে যায় ওর। মাঝে মাঝে নিতিনের হাসির ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এসে ওর কানে বাড়ি খায়। এই ঘরটা থেকে খুব বেশি দূরে নয় নিতিনের ঘর।
বৃদ্ধ বয়সে কথা বলার বাতিকের সঙ্গে আরও একটি বাতিক আপনাতেই এসে আশ্রয় নেয় দেহে। যখন তখন ঝিমুনির বাতিক। পুরনো দিনের কথা বলতে বলতেই দাদি একসময় ঝিমুতে শুরু করেন। সেদিকে আড়চোখে লক্ষ্য করে, দাদিকে বুঝতে না দিয়ে সাবধানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে বর্ষা। নিতিনের ঘরের যত কাছাকাছি যেতে থাকে, কারো সঙ্গে খোশগল্পে মগ্ন নিতিনের হঠাৎ হঠাৎ রিমঝিম হাসির শব্দ তত তীক্ষ্ণ হয়ে আসতে থাকে ওর কানে।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে নিতিন। কথাগুলো চাপা স্বরে বললেও খানিক পর পর সে বেশ উচ্চস্বরে খিলখিলিয়ে হাসছে।
–‘নিতিন ‘ দরজায় দাঁড়িয়ে নাম ধরে ডেকে, বর্ষা সেখানেই অপেক্ষা করে।
কান থেকে ফোন নামিয়ে নিতিন মুহুর্তে ঘুরে তাকায়। ওকে কেমন বিব্রত দেখায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে, ফোনটা বিছানায় ছু’ড়ে অপ্রতিভ হেসে বর্ষার কাছে আসে।
–‘ ভাবি তুমি এখানে? নিচে আসতে গেলে কেন? একটু বাদে আমিই তো যাচ্ছিলাম ওপরে। ‘
–‘ না এমনি। একা একা ভালো লাগছিল না। দাদির সঙ্গে একটু গল্প করতে এসেছিলাম। কিন্তু… ‘
–‘কথার মাঝখানেই দাদি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই না?’
বর্ষা কিছু না বলে হাসল। নিতিনের মুখটা হঠাৎ খেয়াল করে বলল,
–‘তুমি কি করছিলে নিতু পাখি? তোমাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে। প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় সেজেছিলে বুঝি?’
নিতিন পিঙ্গল ঠোঁটে ফিচেল হাসল,
–‘এই একটু লিপস্টিক লাগিয়েছিলাম। তুমি বুঝে ফেললে? তারমানে তো বাকি সবাইও বুঝবে। তাহলে তো আর দেয়াই যাবে না!’
–‘ কেন? কেউ বুঝুক সেটা চাওনা বুঝি? তাহলে আর লিপস্টিক দেয়া কেন?’
–‘এমনিই!’
রাফিয়া রান্নাঘর থেকে চেঁচালেন, ‘নিতিন, তুই স্কুলে যাবি না?’
–‘ যাচ্ছিই। ইশশ্! দেখেছো স্কুলে যাবার কথাটা একদম ভুলে বসেছিলাম! তুমি বসো ভাবি আমি স্কুলের জন্য তৈরি হই।’
–‘ না নিতিন পাখি। ভালো লাগছে না। ওপরে চলে যাব।’
বর্ষা নিশব্দে ওপরে চলে এলো। এতো বড় ঘরটাতেও ওর দমবন্ধ লাগে আজকাল। শরীর যখন ভালো থাকে, দিনের বেশিরভাগ সময় ওই মস্ত খোলা বারান্দায় সময় কাটায় সে।
বেতের দোলনার সম্মুখে, কার্নিশ ঘেঁষে বিছানো মেট্রেসের ওপর পাতা শতরঞ্জিতে বসল বর্ষা। সেখানে বসেই কিঞ্চিৎ সময় পর দেখল নিচে ড্রাইভার সাহেদ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। পরিপাটি সাজগোছ করে নিতিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে এল খানিক পর। বাহ্যিক সাজপোশাকে নিতিনের অকস্মাৎ এই বিশেষ খেয়াল, বর্ষার মনোযোগ কেড়ে নিতে বাধ্য হলো।
বর্ষা বুঝল। নিতিনের দুরন্ত মনে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে। ওর ডানায় রঙিন প্রলেপ পড়েছে। আজকাল আর স্থির থাকছে না ওর উড়ু মন!
এশার সালাত শেষ করে উঠতেই বর্ষা অনুভব করল ওর নাক দিয়ে ফের রক্ত গড়াচ্ছে। নাকে রুমাল চেপে ধরল সে। এই অসুখের কোনো আলাদা যাতনা নেই। নাকে কিংবা গলায় সামান্যতম যন্ত্রণাও কখনো হয়না ওর। কিঞ্চিৎ সময় পর আপনাতেই রক্তপ্রবাহ টা থেমে গেল। কিন্তু যেন কিছু একটা রেখে গেল মাথার ভেতর। হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো ওর। বর্ষা জানে এই যন্ত্রণা টা এবার আস্তে আস্তে পুরো মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়বে। একসময় নেমে আসবে দুচোখে, মুখের পেশিতে। এভাবে আস্তে আস্তে সর্বাঙ্গে….। বর্ষা বিছানায় শুয়ে ব্যাথার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
রাত্তিরে সেদিন একটু আগে আগেই ফিরল নাব্য।
ও ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে আঁচল দিয়ে নাক চেপে ধরল বর্ষা। নাব্য ভ্রুকুটি করে কাছে এগিয়ে এলো।
-‘কি হলো? ‘
-‘আপনি স্মোক করেছেন?’ ধীর গলায় চাপা ক্রোধে শুধাল বর্ষা।
মিথ্যেটা নাব্যের ঠিকমতো আসে না। যুতসই একটা উত্তর দিতে না পেরে সেজন্য নাব্যের ঈষৎ রাগ হলো। প্রশ্নটা এড়িয়ে বলল,
-‘মুখ ঢাকলে কেন? আমাকে দেখে কি বমি পাচ্ছে তোমার?’
-‘আপনাকে দেখে না। সিগারেটের গন্ধে বমি পাচ্ছে আমার। আপনি কি কখনো এই বিষাক্ত অভ্যেস টা ছাড়বেন না?’
-‘ এখন খাইনি তো। অনেকক্ষণ আগে একটা খেয়েছিলাম। আচ্ছা আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।’
নাব্য বাথরুমে যাওয়ার পর শোয়া থেকে উঠে বসে দুহাতে মাথা চে’পে ধরল বর্ষা। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা। তার মাঝে এখন আবার বমি পাচ্ছে। এর দায় সম্পুর্ন নাব্যের। সে নিজের সাথে সাথে ঘরে একরাশ সিগারেটের বাজে গন্ধ না নিয়ে এলে এমন হতো না।
নাব্য শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে দেখল বর্ষা অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বসে আছে। ভয়ে ভয়ে পাশে গিয়ে বসে বর্ষার মাথায় আলতো করে হাত রাখল সে,
-‘কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে? বিকেলে মেডিসিন নিয়েছিলে?’
প্রতুত্তর না করে বর্ষা এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিল।
-‘সরুন আপনি। দূরে গিয়ে বসুন।’
-‘কেন? এখনো সিগারেটের গন্ধ নাকে লাগছে তোমার। ইম্পসিবল! আচ্ছা আগে বলো তো, শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে ? ফের ব্লিডিং হয়েছিল? এই বউ, কি হলো তোমার?’
-‘ যা খুশি তাই হোক! আমি ম’রি কিংবা বাঁচি তাতে আপনার কি? আপনার জীবনে কি আমার কোনো আবশ্যকতা আছে? নেই তো! থাকলে আমার কথারও একটা দাম থাকত অন্তত।’ কথা বলতে বলতেই বরাবরের মতো অশ্রুবিন্দু জমতে শুরু করলো বর্ষার চোখে।
নাব্য একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওর পাণে। কেন যেন বর্ষার এসব আচরণে ওর চরম বিরক্তি এলো আজ। সারাদিন পরিশ্রম শেষে ঘরে ফিরে এসব নাকিকান্না দেখতে কারোরই ভালো লাগে না বোধহয়! অন্যসময় বর্ষা কাঁদলে ওর জন্য খানিক হলেও মায়া হয়। আজ শুধুই রাগ হচ্ছে!
-‘দেখো বর্ষা, বললাম আর ছেড়ে দিলাম। ব্যাপার টা এতো সহজ নয়। আমি চেষ্টা করছি। খুব শীগ্রই ছেড়ে দেব।’
-‘দিনে পনেরো-বিশটা বেনসন না খেলে মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। এ-ই কি তাহলে আপনার সিগারেট ছেড়ে দেবার নমুনা? ‘
-‘এসব তোমায় কে বলল?’
-‘ যে করেই হোক আমি জেনেছি।’
-‘ বর্ষা বলো আমায় কে বলেছে? ‘
-‘রশুভাই।’
-‘রশুকে তুমি কোথায় পেলে?’
-‘আমি পাইনি। নিতিনকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছি?’
-‘নিতিন জিজ্ঞেস করেছে!’
-‘হ্যাঁ করেছে। আমি বলেছিলাম তাই করেছে। কেন আমার কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিলেন বুঝি? ‘
অযাচিত রাগটা দমনের চেষ্টার পরও বেশ কঠোর শোনাল নাব্য গলা,
-‘ শোনো বর্ষা, আমাকে অবিশ্বাস করে আমার সেক্রেটারিকে এসব ব্যাপারে টেনে এনে তুমি ছোট মনের পরিচয় দিয়েছ এবং অবশ্যই ভুল কাজ করেছ। আর স্ত্রী হয়েছ বলেই আমার ব্যাক্তিগত সকল অভ্যেস, বদঅভ্যেস নিয়ে তোমাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি। সেটা তুমি নিশ্চয়ই বোঝো। অন্তত এতটুকু আশা বোধহয় আমি করতে পারি তোমার কাছ থেকে। তাই না?
আজকের পর থেকে কখনো আমার ব্যাক্তিগত প্রসঙ্গে কথা বলবে না তুমি।’ কথা শেষ করে পাশের লাইব্রেরি রুমে চলে গেল নাব্য। চেয়ার টানার শব্দ শুনে বর্ষা বুঝল নাব্য লিখতে বসেছে।
সেখানেই পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে নাব্যের বলা কথাগুলো বর্ষা পুনরাবৃত্তি করতে লাগল মনে মনে।
সেই শুরু থেকে, সবকিছু উজার করে ভালোবেসেছে সে নাব্যকে। অথচ আজও নাব্যের আচরণে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, এখনো কতটা আগন্তুক সে নাব্যের পৃথিবীতে!
___________________________
নির্জন দুপুর। মধ্যাহ্নের শেষ বেলা। রাবেয়া মঞ্জিল প্রগাঢ় তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। পায়ের হিল জুতো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে, ডানে-বায়ে একবার নজর বুলিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুট দিল নিতিন। ঘরে পৌঁছে দোর বন্ধ করে সবার আগে লিপবাম লাগিয়ে ঠোঁটের গাঢ় খয়েরী ম্যাট লিপস্টিক ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দ্রুত মুখ ধুলো। বাথরুম থেকে ফিরে গোলাপি রঙা কটন স্লিকের ঝকঝকে দামি জামাটার পরিবর্তে সুতির সর্ট গাউন গায়ে জড়ালো। অতঃপর খোলা চুলে ক্লিপ আটকে চোখ রাখল আরশিতে। নাহ! ওকে দেখলে এবার আর ভ্রুকুটি করবে না আম্মা। সন্দিহান স্বরে জানতে চাইবে না এত সাজগোজের কারণ!
তবুও অকারণে নিতিনের বুক ধুকপুক করতে লাগল। জীবনের প্রথম স্কুল ফাঁকি দিয়ে আজ প্রণয় অভিসারে গিয়েছিল সে। রাফিয়া কে নিতিন বাঘের মতো ভয় পায়। সুযোগ টা হাতে পেয়েছে সকাল সকাল রাফিয়া ভাইয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পর।
দোর খুলে একটা গান গুনগুন করতে করতে নিতিন সিড়ি ভেঙে ওপরে উঠে সোজা নাব্যের ঘরের দরজায় গিয়ে থামল। বারকয়েক কড়া নেড়ে বর্ষা ঘুমোচ্ছে ভেবে ফিরে এসে ঢু মা’রল দাদির ঘরে। দাদি ঘুমোচ্ছে। পায়ের কাছে বসে কাছে রিনা নামের কাজের মেয়েটি দাদির পা মালিশ করছে।
-‘রিনাবু, আম্মা এখনো ফেরেনি?’
-‘না।’ উত্তর শুনে একটা স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে নিতিন ফের জিজ্ঞেস করল,
-‘ভাবির কাছে গিয়েছিলে? ‘
জোরে কথা বললে দাদির ঘুম ভেঙে যেতে পারে। রিনা তাই বিছানা ছেড়ে উঠে নিতিনের কাছে সরে এলো। অধৈর্য চাপা গলায় বলল,
-‘ভাবির মতিগতি তো কিছু বুঝতাছি না আপা মণি। সক্কাল সক্কাল খালাম্মা, ভাইজান বাইরইয়া গেলো গা। হের পরে আপনেও বাইরে গেলেন। আমি তখন নাস্তা নিয়া ভাবিরে ডাকবার গেসিলাম। ভাবি দোর খুলল না। বারোডার সময় ফল কাইটা নিয়া গেলাম। তখনো দোর না খুইলা ভিতর থাইকাই ফিরায়া দিল। এখন ভাত নিয়া গিয়াও ফিরা আইলাম।’
-‘কি বলছো তুমি রিনাবু? তারমানে ভাবি সকাল থেকেই না খেয়ে আছে!’
-‘মনে হয় রাইত থাইকাই। কাল রাইতেও ভাবি ভাত খায় নাই।’
নিতিন আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ফের ছুটল দোতলার উদ্দেশ্যে।
দরজায় শব্দ করে ডেকে চলল বর্ষাকে। বিপরীত দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে একসময় নিতিন বাধ্য হয়ে কল করল নাব্যকে। সব শুনে নাব্য শুধু বলল,
-‘তুই অপেক্ষা কর। আমি আধঘন্টার মধ্যে আসছি।’
আধঘন্টার কথা বললেও পঞ্চাশ মিনিটের আগে বাড়ি পৌছানো সম্ভব হলো না নাব্যের পক্ষে। বাইরে তখন বিকেলের শেষ আলোয় চারদিক ভীষণ মৃদুতায় ঝলকাচ্ছে।
নাব্য এসে কালবিলম্ব না করে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে দরজা খুলল। দরজা খোলার পর ভেতরে তাকিয়ে ওরা ভাইবোন থমকে গেল মুহুর্তের জন্য।
বারান্দার দরজার কাছে বর্ষা মাটিতে পড়ে আছে। মুখ আর নাক থেকে প্রবাহিত র’ক্ত জমে গিয়ে ততক্ষণে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। সেই কালচে বর্ণের সরু একটা রেখা নাক থেকে গড়িয়ে ওর গলায় গিয়ে থেমেছে। দীর্ঘক্ষণ মেঝেতে পড়ে থাকায় ঠান্ডা হয়ে গেছে সারা গা।
নিতিন কয়েক পা এগিয়ে ভীত চোখে বর্ষার পানে তাকিয়ে কান্না জুড়ে দিল। নাব্য দৌড়ে গিয়ে বর্ষার মাথাটা কোলে তুলে নিল। গালে কয়েকবার মৃদু চাপড় দিয়ে অনবরত ডাকতে লাগল,
-‘বর্ষা, এই বর্ষা… চোখ খোলো। আমি সত্যি আর কোনোদিন স্মোক করবো না৷ প্রমিজ। এই মেয়ে….চোখ খোলো….বর্ষা…’
বর্ষার নাকে কাছে হাত রেখে নিশ্বাসের গতি পরীক্ষা করে ওকে দ্রুত মাটি থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে ওর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিল। চোখ-মুখে পানির ছিটা দিয়ে নিতিন আর রিনাকে নির্দেশ করল হাত পায়ে তেল মালিশ করার জন্য।
নাব্য, নিতিন আর রিনার বুকের হাতুড়ি পেটা থামিয়ে একসময় চোখ মেলল বর্ষা।
নাব্য পরিস্থিতি ভুলে ওদের সামনেই বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কপালে, মাথায় অজস্র চুম্বন করে বলল,
-‘তোমার জেদের কাছে হার মানছি। আর কোনোদিন স্মোক করবো না।’
সেদিনের মতো ব্যাপার টা সেখানেই সমাপ্ত হলো। রাফিয়া কে জানানো হলো না কিছুই।
তার ঠিক এক মাস পর। এক সকালে। নাব্য সবে ফ্যাক্টরি তে এসে নিজের চেম্বারে বসেছে। কর্মচারী এসে জানালো একজন ভদ্রমহিলা দেখা করতে এসেছেন নাব্যের সঙ্গে। নাব্য ভ্রু কুঞ্চিত করল। দায়সারা গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘কি নাম?’
-‘মিসেস বর্ষা সোবহান’
চলবে……….।
একদিন নববর্ষা -৩৪
অদ্রিজা আশয়ারী
__________
–‘আমি এখন কারোর সঙ্গে দেখা করবো না বলে দাও।’
অকস্মাৎ নাব্যের এই গম্ভীর অভিব্যক্তি দেখে লোকটি দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে মাথা নেড়ে চলে গেল।
নাব্য কাজে মন দেয়ার অভিপ্রেতে ডেস্কের বা-পাশে রাখা ফাইল গুলো থেকে একটা নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল। কয়েক মিনিট পর বুঝল অকারণে পৃষ্টাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে সে। একটি শব্দও মাথায় ঢুকছে না! ততক্ষণে অবশ্য কর্মচারীটি আবার ফিরে এসেছে। নাব্য ভ্রুকুটি নিয়ে ওর দিকে তাকাতেই মাথা নিচু করে বলল,
–‘ চলে যেতে বলার পরও উনি যেতে চাচ্ছেন না। বলছেন জরুরি দরকার। কথা না বলে যাবেন না।’
নাব্য মুহুর্তকাল ভাবল। অফিসে শত কর্মচারীদের সামনে সে এমন কিছু করতে চায় না, যাতে সকলের মনোযোগ ওদের দিকে পড়ে, একটা সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেলে বলল,
–‘ দশ মিনিট পর আসতে বলো।’
সামনের লোকটি প্রস্থানের পর দু’হাতে মাথা চে’পে ধরে, চোখ বন্ধ করে বসে রইল সে। অনুভব করল ওর হৃদপিণ্ডটা ভয়ানক ভাবে লাফাচ্ছে। বক্ষ পিঞ্জরে হা’না দিয়েছে নিদারুণ অভিঘাত। নাব্যর কষ্ট হচ্ছে, ভেতর টা হাসফাস করছে একটু স্বস্থির নিশ্বাস ফেলার জন্য। একটা সিগারেট খেতে পারলে ভালো হত। কিন্তু বর্ষাকে কথা দিয়েছে সে। আর কখনো সিগারেট ছোঁবে না। বর্ষার কথা মনে পড়তেই নাব্যর মনে হলো এখন যদি বর্ষার কাছে ফিরে যাওয়া যেত তাহলে হয়ত এই ব্যাথা জুড়াতো! বর্ষা ওকে জড়িয়ে নিত পেলব ভালোবাসার নিঃসীম আবেশে। তখনি প্রথম বারের মতো নাব্য উপলব্ধি করল, ওর জীবনে বর্ষা এক পশলা প্রশান্তির নাম। সে বর্ষাকে ভালো বাসুক কিংবা না-ই বাসুক। বর্ষা চিরকাল ওকে গাছের মতো একপাক্ষিক ভাবে ছায়া, আশ্রয় দিয়ে যাবে। চোখের নিমিষে কেটে গেল দশ মিনিট।
আর কিছু ভাববার অবসর মিললো না। দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। সঙ্গে সঙ্গে একটা পরিচিত ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল নাব্যর বেরঙ অফিসঘর।
ক্ষয়ে যাওয়া চিন্তাশক্তির, বিবশ মস্তিষ্কটা নাব্যর অজ্ঞাতে ওকে দরজার দিকে ফিরতে বাধ্য করল।
সেদিন রাতের শহরে, হাইওয়ের পাশে যখন রাহিলের পাশে বর্ষাকে দেখেছিল সে। জমকালো আভিজাত্যের বিমোহণ আভা ঘিরে ছিল বর্ষাকে। রাতের নিয়ন আলোয় দেখেছিল বর্ষার ফিরোজা রঙা কটন জর্জেট শাড়ির আঁচল মাটি ছুঁয়েছে। মুখে প্রসাধনীর আধিক্য। কানে ঝলমল করছে হিরের দুল, হাতের অনামিকায় একখানা জ্বলজ্বলে হিরের আঙ্গটি। ফিনফিনে ঠোঁটে খয়েরী লিপস্টিক। ওর দামী পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে।
অথচ আজ! বর্ষার আড়ম্বরহীন সাজপোশাক নজরে পড়বার মতো! গায়ে খুব সাদামাটা ছাইরঙা সুতির শাড়ি। মাথার চুলগুলো আলগোছে খোঁপায় আটকানো। মুখ পুরোপুরি প্রসাধনহীন!
নাহ! আজ কিংবা সেদিন। ওর আভরণ যাই হয়ে থাকুক না কেন। এই বর্ষাকে নাব্য চেনে না। গরানবনের বর্ষাকে গরানবনেই সেদিন দা-ফন করে এসেছিল সে। যেদিন বসির শেখের মুখে শুনেছিল বর্ষার অন্যের স্ত্রী বনে যাওয়ার গল্প! আজ ওর সামনে যে মানবী দাঁড়িয়ে আছে তার একটাই পরিচয় নাব্যর কাছে। রাহিল সোবহানের স্ত্রী!
বর্ষা ডেস্কের অন্যপাশে বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। ততক্ষণে নাব্য নিজের হালভাঙা মনটাকে সামলে নিয়েছে অনেকখানি। তবুও সতর্ক থাকলো সে। বুকের ভেতর যে ঝড় উঠেছে কোনোভাবেই যেন তার আঁচ টের না পায় বর্ষা। মূর্তিমান বর্ষাকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে ফাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নাব্য গম্ভীর মুখে বলল,
–‘ কি বলার আছে বলে দ্রুত বেরিয়ে যাও।’
–‘নাব্য!’ বর্ষার স্বরে আকুতি ঝরে পড়ল।
ওর মুখে নিজের নামটা আজ কেন যেন বিশ্রীরকম অসহ্য শোনাল নাব্যের কানে।
নাব্য মুখ না তুলে ফাইলের পাতায় মনোযোগী হল।
কিয়ৎক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে রইল বর্ষা। আহত গলায় বলল,
–‘ কেমন আছো নাব্য? আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আমার দিকে একটু তাকালেও কি আজ অশুচি হয়ে যাবার ভয় করছো?’
নাব্য ঝট করে একবার চাইল বর্ষার দিকে। প্রায় দীর্ঘ নয় মাস পর এত কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করল বর্ষার সেই সুতীক্ষ্ণ কমনীয় মুখখানি। ওর অগ্নিশিখার ন্যায় প্রাঁজল রূপ এক বিন্দুও কমেনি। সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যাপার নাব্যের খেয়াল হলো। গরানবনে যে বর্ষার শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিশেল কথামালা ওকে বারবার বিমুগ্ধ করত। সে বর্ষার কথায় আজ একটিও অশুদ্ধ শব্দ নেই।
-‘কেনো এসেছো?’
নাব্যর প্রশ্নটা এড়িয়ে ওর চাহুনি লক্ষ্য করে বর্ষা বলল,
-‘এতো ঘৃণা জমেছে তোমার চোখে আমার জন্য? অথচ একসময়…. ‘
-‘পুরনো কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। কেন এসেছো সেটা বল। তারপর বেরিয়ে যাও।’ ওর কথাগুলো বেশ রুক্ষ শোনালো এবার।
বর্ষা নিরস্ত হলো। মূল কথায় আসবার আগে মাথাটা নিচু করল ক্ষানিকের জন্য। তারপর যখন মাথা ওপরে তুললো তখন ওর চোখের কোল ভর্তি জল। গলার স্বর সঙ্গিন।
-‘ এই শহরে রাহিলের বাড়ি ছাড়া আমার আর কোনো আশ্রয় নেই। ওই বাড়ির চৌকাঠ মাড়ালে পুরো পৃথিবীটাই অচেনা আমার কাছে।
আমি জানি গরানবনে সেদিন রাহিলের সঙ্গে আমাকে দেখার পর তোমার মনে আমার জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে না। কিন্তু তবুও এই অচেনা শহরে একমাত্র তোমাকেই আমি বিশ্বাস করতে পারি! আর কাউকেই যে আমি চিনি না!
নাব্য, কথাগুলো তোমার কাছে হাস্যকর শোনাতে পারে কিন্তু আমার জন্য গূঢ় বাস্তব। রাহিল আমাকে একরকম ছেড়ে দিয়েছে। ডিভোর্স দেবে খুব শীগ্রই। ওর বাচ্চাদের মা হিসেবে নাকি একেবারেই অনুপযুক্ত আমি! আমার রূপের সুধা সম্পুর্ন আস্বাদন শেষে এতোদিন পর নিজের সন্তানদের জন্য ভাবুক হয়ে উঠেছে সে আজ। সদ্য সতেরো তে পরা আমি যে ওর সাত ও নয় বছরের বাচ্চাদের জন্য মা হিসেবে কতটা অযোগ্য সেটা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ও আমাকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলতে চেয়েছে।
নাব্য, তুমি জানতে চাইবে না কেন সেদিন আমি তোমার জন্য অপেক্ষা না করে রাহিলকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম?’
উত্তরে নাব্য কিছু একটা বলতে চাইছিল।
বর্ষা ওর স্বর কে ছাপিয়ে বলে উঠল,
-‘আজ শুধু আমার বলার দিন। আমি বলব, তুমি শুনে যাবে..।
ষোলো বছর বয়সটা বোধহয় খুব বেশি নয়। এখন, এই শহরে এসে বুঝতে পারি। এখানে ষোলো বছর বয়সের একটা মেয়েকে ছেলেমানুষ ভাবে সবাই। অথচ গরানবনে, আমার ষোলো বছরের ক্ষুদ্র জীবনে আমি কি কি না সয়েছি!
আমার সম্পর্কে তুমি কতটা জানতে নাব্য? খুব বেশি কিছু না অবশ্যই। ছোট বেলা থেকে অসংখ্য বার আমি নর-হায়নাদের আক্র’মণের শিকার হয়েছি। প্রতিবার কোনো না কোনো ভাবে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছি।
নাব্য, বসির শেখ কতটা জ’ঘন্য লোক সেটা তোমার কল্পনারও অতীত। টাকার প্রতি ওর নেশা আফিমের মতো ভয়ংকর। বাবা হয়েও সে আমাকে টাকা আয়ের মাধ্যম বানাতে চেয়েছিল। আমার বয়স বারো’তে পড়তেই আমাকে সে ব্যাবসার পথে নামাতে চেয়েছিল। পারেনি শুধুমাত্র আমার মায়ের জন্য।
তারপর সুযোগ মিললো আমাকে কুঠিবাড়ি কাজে পাঠিয়ে। সেখানেও আমি প্রতিবার শেষ মুহুর্তে কোনো না কোনো অলৌকিক উপায়ে বেঁচে গেছি! মনে হতো যেন আল্লাহই বিশেষ ভাবে আমার জন্য বাঁচার পথগুলো তৈরি করে দিতেন!
তুমি, রাহিল সোবহান গরানবনে যাবার পর বসির শেখ সেবার ভেবেছিল যে করেই হোক তোমাদের ফাঁদে ফেলবে। আমার শরীর বিকিয়ে টাকা আয়ের যে ব্যাবসা সে শুরু করতে চেয়েছিল তার প্রথম কাস্টমার হবে তোমরাই। অথচ তোমরা দুজনেই সেসব ছেড়ে আমাকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলে। বসির শেখ আবারও হতাশ হলো এবং ভয়ংকর খে’পে গেল। কিন্তু রাহিল এসব পেশাদার ব্যাপারে তোমার চেয়ে বেশি বুদ্ধি রাখে। সে জানতো বসির শেখের সঙ্গে ভালো কথায় কাজ হবে না। তাই সে সরাসরি টাকার প্রস্তাব করল।
টাকার অঙ্ক শুনে বসির শেখের আর কিছু ভাববার রইল না। পারলে তখনি আমাকে রাহিলের হাতে তুলে দেয়।
কিন্তু তোমার কথা ভেবে আমি বেঁকে বসলাম। বসির শেখ আমাকে হু’মকি দিল আম্মাকে খু-ন করার। ততদিনে অবশ্য আম্মা এমনিতেও আধমরা হয়ে পড়েছিল আম্মার গোপন অসুখটার জন্য। ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছিল আম্মার। ততদিনে শেষ পর্যায়ে চলে গেছিল আম্মার অসুখটা। সম্পুর্ন বিনা চিকিৎসায় ভুগে। বসির শেখ যখন হু’মকি দিল আম্মাকে শেষ করে দেয়ার তখন আর আগেপিছে কিছু ভাবার সময় ছিল না আমার।
নাব্য, আমার আর কোনো পথ খোলা ছিলনা। আমি বাধ্য হয়েছিলাম। রাহিলের সঙ্গে সুখী হবার অভিনয় করতে হতো আমাকে প্রতিনিয়ত। আম্মার কথা ভেবে। কারণ আমার বিরুদ্ধে করা রাহিলের প্রতিটি অভিযোগের রোষ বসির শেখ আম্মার ওপর মেটাত।
সেসব দিন শেষ হয়ে এসেছে। রাহিলও এখন প্রণয়ের ঘোর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। আম্মাও মারা গেছে দু-মাস আগে। বর্ষনকে আমি নিজের কাছে নিয়ে এসেছি। এখন আমারও আর কোনো পিছুটান নেই। গরানবন এখন শুধুই ধূসর স্মৃতি আমার জন্য…।
যাইহোক….অনেক কথা বলে ফেললাম। তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখীত। আমি যে কথাটা বলতে এসেছি তার আগে এই বিস্তর ভূমিকা’টার প্রয়োজন ছিল। এখন গোড়ার কথায় আসি।
আমাকে তুমি ঘৃণা করো জানি। তার যথেষ্ট কারণ উপস্থিত।
তবে তুমি সৎ। মানুষ হিসেবে আদর্শ। তোমার সঙ্গে কাটানো মুহুর্ত গুলো বারবার সেকথাই মনে করিয়ে দেয়। তাই তোমার কাছে একটা আর্জি নিয়ে এসেছি। আমি জানি চাইলেই তুমি সেটা পারবে।
আমার বয়েস মাত্র সতেরো। শিক্ষাগত কোনো যোগ্যতা নেই বললেই চলে। শুধু ছোট-বড় অগণিত অভিজ্ঞতার ঝোলা ভর্তি গল্প আছে। যা আমাকে সতেরো’তে সাতাইশের সমান দূরদর্শিতা দান করেছে।
আমার একটা কাজ দরকার। যেকোনো কিছু হলেই চলবে। গরানবনে ফিরে যাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই। বসির শেখ আমাদের জন্য হয়তো কবর খুঁ’ড়ে বসে আছে। বর্ষন ওর নিজের রক্ত হলেও চিরকাল ওকেও আমাদের মতো পর ভেবে এসেছে সে।
বর্ষনকে নিয়ে এই শহরে থাকার মতো আমার একটা আশ্রয় দরকার। যার জন্য টাকা প্রয়োজন। আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দাও নাব্য। অন্তত যেন বর্ষন কে নিয়ে দুবেলা খেয়ে-পড়ে এই শহরে বেঁচে থাকতে পারি!’
নাব্য স্বরহীন অবিশ্বাস্য চোখে বর্ষাকে দেখল। সে মনেপ্রাণে চাইছে বর্ষার বলা কথাগুলো মিথ্যে হোক। কারণ এসব কথা সত্য হিসেবে মেনে নিলে অঘোষিত দহন যন্ত্রণা মুহুর্তে ওকে গ্রাস করে নেবে একটা দীর্ঘ সময়ের জন্য! বা হয়তো চিরকালের জন্যই!
অনলে পুড়তে পুড়তে গোটা হৃদয়টাই আজ রঙহীন ধূসর ওর। আর জ্বলেপুড়ে ছাই হতে চায় না সে। দীর্ঘ সময় পেড়িয়ে যাবার পরও নাব্য কিছু বলছে না দেখে বর্ষা এবার ক্লান্তিপূর্ণ নিশ্বাস ফেলে বলল,
-‘হয়তো তুমি আমাকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছো না। এতোকিছুর পর সেটাই স্বাভাবিক। তুমি ভাববার জন্য সময় নাও নাব্য। আমি পরে আবার আসব। আজ আসি।’
বর্ষা চলে গেল। নাব্য উদভ্রান্তের মতো সেখানে বসে রইল। ওর ভাবনাগুলো খেই হারিয়ে ফেলেছে। যেন মস্তিষ্কের স্নায়ু গুলো ঝাঁকিয়ে নড়বড়ে করে দিয়েছে কেউ। আর কিছু ভাববার মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই। বেল টিপে একজন লোককে ডেকে নাব্য জড়ো গলায় বলল,
-‘ যতক্ষণ আমি না ডাকব কাউকে এলাউ করবে না এখানে। সে যেই হোক।’
_______________
আমার ফিঁকে নীল আকাশে, সফেদ-শুভ্র মেঘেদের ভিরে যখন সবে পূর্বাহ্নের সূর্যটা কিরণ দিতে আরম্ভ করেছিল, তখনি! অকস্মাতে ঘটল কালবৈশাখী ঝড়ের আগমণ! লণ্ডভণ্ড করে দিল আমার শান্ত নীলাভ আকাশ, সেখানে গর্জে উঠল সহস্র কালো মেঘের বজ্রনাদ! আবারো খেই হারিয়ে ফেললো মন। ভেঙেচুরে গুড়িয়ে গেল আমার ‘শুভ্র মেঘে ঢাকা এক টুকরো নীল আকাশের স্বপ্ন ‘।
একটা কথা কি জানেন? কখনো কখনো আগুনে পোড়ার চেয়ে আগুনের পাশ ঘেঁষাটা বেশি ভয়ংকর। কারণ যখন আগুনের মাঝ বরাবর কাগজ ধরা হয়,আগুন তাকে পোড়াতে সময় নেয়। কিন্তু আগুনের পাশে ধরলে মুহুর্তেই তা ছাই হয়ে যায়।
আমার যেন তাই হলো! বর্ষার প্রতারণা তিলে তিলে আমার বুকে যে তীব্র ঘৃণার সঞ্চারণ করেছিল৷ এক ঝলক দৃষ্টির বিনিময় আর ওর অসহায়ত্বের কথার রেশে সেসব নিমিষেই কোথায় হারিয়ে গেল। অনেক হাতড়েও বুকের ভেতর কোথাও আর বর্ষার জন্য একবিন্দু ঘৃণার অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না আমি!
ব্যাপার টা বোধগম্য হবার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ ভীতি আমাকে আঁকড়ে ধরলো। সংকুচিত হয়ে পড়ল আমার অন্তঃকরণ। আমি চাই না ওর প্রতি আমার ঘৃণা কাটুক! কারণ এই ঘৃণাই আমাকে সুখী থাকতে শিখিয়েছে।
মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় আর বুকে সহস্র বজ্র নিনাদ নিয়ে আমি সে’রাতে বাড়ি ফিরলাম।
ঘড়ির কাঁটা পৌনে বারো’তে পৌঁছেছে। ওপরের ঘরের ভিরানো দরজা খুলতেই অন্ধকার আমাকে আচ্ছন্ন করে নিল। হাতড়ে বাতি জ্বাললাম৷ ডিভানে হেলে ঘুমিয়ে আছে বর্ষা। সামনের ছোট টেবিলে খাবার ঢেকে রাখা। চোখে আলো পড়তেই ঘুম ভেঙে উঠে বসল সে। তখনো পুরোপুরি তন্দ্রা কাটেনি, ওর কপালে কয়েকটা দুশ্চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়ে উঠল।
-‘এতো দেরি করে ফিরলেন যে? ফোনও বন্ধ রেখেছেন। কতো চিন্তা হচ্ছিল আমার…..
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন৷ আমি খাবার দিচ্ছি।’
-‘তুমি খেয়েছো?’
-‘না আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ওভাবেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি…’
রাগে জ্বলে উঠলাম আমি
-‘আমার জন্য বসে থাকতে তোমাকে আমি আগেও নিষেধ করেছিলাম। এরপরও তুমি অপেক্ষা করে বসেছিলে কেন?
এখন কি এসব আহ্লাদীপনার সময় বর্ষা? তুমি কি জানো না এসময় খাওয়া, ঘুম নিয়ে এই অনিয়ম কতটা ক্ষতিকর তোমার জন্য?
বারোটা বাজে। এরপর তুমি মেডিসিন কখন নেবে? শোনো বর্ষা, তুমি যদি ভেবে থাকো এসব করে আমার এটেনশন সিক করবে তাহলে ভুল ভাবছো। এসব আদিখ্যেতার কোনো বিশেষ মূল্য নেই আমার কাছে। আর কখনো না খেয়ে বসে থাকবে না তুমি আমার জন্য।’
বর্ষার তন্দ্রা কেটে গেছে। সে পলকহীন আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ও বোধহয় ভাবেনি এই সামান্য ব্যাপারে আমি এতো রেগে যাব। একসময় মাথা নিচু করে খাবার গোছানোয় মনোযোগ দিল সে। আমি ওর সামনে থেকে সরে এলাম। শেষ মুহুর্তে দেখলাম ওর চোখের কার্ণিশে অবাধ্য জল চিকচিক করছে।
চলবে……
একদিন নববর্ষা -৩৫
অদ্রিজা আশয়ারী
___________
সেদিনের পর খুব শীগ্র আবার আসবে বললেও শীগ্রই বর্ষার আগমন ঘটল না। নাব্যর শান্ত, সহজ জীবনে একটি উত্তাল তরঙ্গ বইয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল সে বেশ কিছুদিনের জন্য। তারপর অনেকগুলো দিন পেড়িয়ে, প্রায় বিশ দিন পর এক সকালে বর্ষা ফের নাব্যর অফিসে এসে হাজির।
বর্ষার মুখ থমথমে। ওর হাত আঁকড়ে ধরে পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে বর্ষন। দেখে মনে হয় যেন নিজ অধিকারেই আজ সে এখানে এসেছে। নাব্য কিছু না বলে অপেক্ষা করল। বর্ষার দ্বিতীয় বার আসার ব্যাপার টা অফিসের অনেক ঘনিষ্ঠ লোকেরা, যাদের সঙ্গে নাব্যর পারিবারিক পরিচয় আছে, তারা কেউ ভালো চোখে নিচ্ছে না।
বর্ষনকে নিয়ে নাব্যর মুখোমুখি টেবিলের অন্যপাশে চেয়ার টেনে বসল বর্ষা। নাব্য কিছু বলছে না দেখে একসময় নিরবতা ভেঙে সে কথা বলল,
-‘কাল রাতে রাহিলের সঙ্গে অফিশিয়ালি ডিভোর্স হয়েছে আমার। ও বলেছিল সকাল পর্যন্ত ওর বাড়ি থাকতে দেবে। তারপর বেরিয়ে যেতে হবে।
সেদিনের মতো আজও শংকা নিয়ে সিএনজি দিয়ে তোমার অফিসে এসেছি। এর আগে কোনোদিন একা গাড়িতে চড়িনি আমি। তোমার অফিস সম্পর্কে টিভিতে কিছুটা শুনেছিলাম। তারপর সেদিন এখানে এসে খোঁজ করতেই অফিস পেয়ে গেলাম। আমাকে তুমি নির্লজ্জ ভাবতে পারো। এতকিছুর পরও আজ তোমার কাছে এসেছি একটু আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু আজ তোমার সাহায্য ছাড়া সত্যিই আমাদের কোন পথ খোলা নেই।
আমি জানি না এরপর আমরা কোথায় যাব। কোথায় গেলে একটু আশ্রয় পাব।’ কথা শেষে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল বর্ষা।
নাব্য দ্বিধান্বিত। এই মুহুর্তে কিরকম প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত জানা নেই ওর। হয়তো মুখের ওপর বলে দেয়া উচিত,
-‘বেরিয়ে যাও আমার অফিস থেকে। গো টু হেল। আই ডোন্ট কেয়ার।’
কিন্তু নাব্য অমন ধাতুতে গড়া নয়। সম্পর্ক টা আজ যত তিক্তই হোক। একটা মেয়েকে অসহায় জেনেও ঘাড় ধা’ক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারবে না সে। এ কাজ করতে ওর বিবেকে বাঁধবে।
কিঞ্চিৎ সময় পর সে হঠাৎ কিছু না বলে উঠে চলে গেল। বর্ষা ভাইকে নিয়ে নিশ্চুপ বসে রইল। বর্ষন নিমিষহারা চোখে তাকিয়ে আছে। যে নাব্য গরানবনে ওদের সঙ্গে সদাসর্বদা খুনসুটিতে মেতে থাকতো। আজকের নাব্যর সঙ্গে শুধু চেহারাটা ছাড়া তার কোনো মিল নেই।
ওর ছোট্ট জীবনে, সেও বোনের মতো অনেক কঠিন পরিস্থিতি সয়েছে। মায়ের মৃত্যু, বাবার হিং’স্রতা আর এখন বোনের অবিরাম দুঃখ। সে জানে না কেন রাহিলের ওই সুন্দর বাড়িটা থেকে ওদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বর্ষনের শিশুসুলভ কোমলপ্রাণ আজ বিদ্ধস্ত অনুভুতির জরাজীর্ণ হাহাকারে পূর্ণ। কাঁদতে ভুলে গেছে সে।
নাব্য ফিরল প্রায় ঘন্টা পেরোনোর পর। এর মাঝে একজন স্টাফ এসে ওদের জন্য খাবার ও পানি রেখে গেছে। ওগুলো সেভাবেই পড়ে রইল। বর্ষন শুধু হাত বাড়িয়ে একটা কমলা নিয়ে নিজের কাছে রাখল। কাল রাত থেকে ওর পেটে দানাপানিও পড়েনি।
একসময় নাব্য এসে বিনা ভূমিকায় বলল,
-‘আমার ব্যাবসা টা এক্সপার্ট-ইমপোর্টের। তোমাকে দেবার মতো এখানে তেমন সুবিধাজনক কোনো কাজ নেই। তবে অন্য এক জায়গায় চেষ্টা করছি আমি। আশা করি হয়ে যাবে। আমার একজন বন্ধুর গার্মেন্টসের পাশাপাশি একটি ছোট বুটিক হাউজ আছে। সেখানে তুমি কাজ পেতে পারো। ওদের নির্দেশ মতো ঘরে বসে সেলাই করবে। তারপর ওরাই এসে সেগুলো নিয়ে যাবে। তোমাকে বাড়তি কোনো চাপ নিতে হবে না। বাড়ি থেকেও বেরুতে হবে না।
আর…যাত্রাবাড়ীর ওদিকে এখানের একজন কর্মচারীর একটি একতলা বাড়ি খালি পরে আছে। এখন থেকে তোমরা সেখানেই ভাড়া থাকবে। রশু তোমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। বাকি যা-কিছু দরকার রশুই ব্যাবস্থা করে দেবে। ‘
কিছু ব্যাপার নাব্য আড়াল করে গেল। বন্ধুর গার্মেন্টসে অনায়েসে বর্ষাকে একটা চাকরি দেয়া যেত। কিন্তু নাব্যর সম্মানে বাঁধছিল। যাকে এককালে ভালোবেসেছিল আজ পরিস্থিতির কারণে তাকেই গার্মেন্টস কর্মী হতে দেবে সে! এদিকে বর্ষার শিক্ষাগত কোনো যোগ্যতা নেই বললেই চলে। তাই আপাতত বুটিক হাউজের কাজটির চেয়ে সম্মানজনক কোন কিছু তার দ্বারা ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি।
বর্ষা অপলক চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। নাব্য এতটা করবে ওদের জন্য, আশা করে নি সে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘নাব্য, তোমার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকব। তুমি আজ আমাদের ভেসে যাওয়া থেকে__’
-‘রশু, ওদের নিয়ে যাও।’ ওর কথার মাঝখানেই গমগম করে উঠল নাব্যর স্বর। বর্ষা নিরব হলো। বুঝল, নাব্যর মনে ওর বরাদ্দ আসন থেকে অনেক আগেই ছিটকে পড়েছে সে। আজ যা-কিছু নাব্য করছে সেসব শুধুই মানবতার খাতিরে…
______________
জীবন মানেই প্রতি মুহুর্তে যু-দ্ধ করে যাওয়া। অন্যের বিরুদ্ধে যু-দ্ধ, কখনো কখনো আবার নিজের বিরুদ্ধেও। নিজের প্রবৃত্তির বিরু-দ্ধে এই ল-ড়াইয়ের একটা আলাদা নাম আছে। একে বলে নফসের বিরুদ্ধে ল-ড়াই। যারা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যু-দ্ধ করে নিজের নফসের বিরুদ্ধে। কখনো কখনো তারাও পরাভূত হয়। শয়তানের ধোঁকায় কবলিত হয় নিজের অজান্তে।
সেখানে নাব্য তো কোন ছার! যার নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গভীর ভাবনা নেই। নিজ নফসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মনন এখনো তৈরিই হয়নি! আক্ষরিক অর্থেই যে এখনো বেখবর নিজের ভেতরের এই দ্ব’ন্দ্ব সম্পর্কে। সে এই ল-ড়াইয়ে জয়ী হবে এমনটা ভাবাও অন্যায়।
নাব্য শিখেছিল চিরকাল সহজ কে সহজ করে দেখতে। নিজের কথা বলবার সময় লোকে নয়ভাগ আড়ালে রেখে, সবচেয়ে সহজ এবং বিশ্বাসযোগ্য বাকি একভাগ প্রকাশ করে। সেটুকু দেখেই কাউকে বিশ্বাস করে ফেলা চরম বোকামি। অথচ নাব্য এতকাল তাই করে এসেছে। কখনো কখনো এর জন্য চড়া মাশুল গুনতে হয়েছে ওকে। কিন্তু তবুও এই সহজাত প্রবৃত্তি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে নি।
বর্ষার মুখে ওর দুঃখ গাঁথা শুনে। ওর বর্তমান জীবনের দুর্ভোগ নাব্যকে গভীর ভাবে স্পর্শ করল। যার ফল সরূপ বর্ষাকে উদ্ধার করার জন্য উদ্রিত হয়ে পড়ল সে। নিজের মনকে বোঝাল। সে শুধুই একজন আশ্রয়হীন নিঃস্বকে সাহায্য করছে। এর বেশি কিচ্ছু নয়।
বলা যায়, আরো একবার ফাঁদে পা ফেলল নাব্য। বর্ষা এবার রূপে নয়। ওকে মোহাচ্ছন্ন করল নিজের অসহায়ত্ব দেখিয়ে। বর্ষাকে আলাদা একটা ভাববার মতো জগত তৈরি করে দিয়েছিল নাব্য। যেখানে ছিল জীবন গুছিয়ে নেবার স্বাধীনতা, বুটিক হাউজের কাজ, একটা ছা-পোষা মধ্যবিত্ত বাড়ি, বর্ষনের পড়ালেখা থেকে…… সবকিছু। কিন্তু যেকোনো ছোট বড় সমস্যার অজুহাতে এরপরও সে সবার আগে নাব্যর অফিসে এসে হাজির হতে থাকল। রশুর ধারণা বর্ষা ভীষণ রকম নির্লজ্জ ধরনের একটি মেয়ে। ওর মতে নবুদার দোষ একটাই। নবুদা এই মেয়েকে কঠোর ভাষায় রুখ-তে পারে নি। যেটা ওর প্রথম দিনই করা উচিত ছিল।
যখন এই মেয়েটি বর্ষনের স্কুল সংক্রান্ত ঝামেলা বা এরকম তুচ্ছ কিছুর অজুহাতে এখানে আসে এবং স্ব-দর্পে সকলের সামনে দিয়ে হেটে নাব্যর অফিস ঘরে ঢুকে যায়। রশুর তখন ইচ্ছে করে ওকে গ-লা ধা-ক্কা দিয়ে বের করে দিতে। কিন্তু নবুদার কথা ভেবেই কিছু করা হয়ে ওঠে না ওর।
এভাবে দিন গড়াচ্ছিল। নাব্য বুঝল না। নিজের অজান্তে সে কিভাবে আবারও জড়িয়ে যাচ্ছে বর্ষার সঙ্গে। আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে অন্ধকারময় এই ঘুর্ণির আবর্তে…।
_____________
কিছু একটা বদলে গেছে! এক লহমায় নয়। ধীরে ধীরে। বর্ষা আজ হঠাৎ উপলব্ধি করতে পারছে, নাব্য আর আগের মতো নেই। একসময় নাব্যর রাগ পূর্ণ স্বরেও অনুরাগ ঝরে পড়ত। সে অনুরাগ আড়াল হলেও বর্ষা টের পেত। কিন্তু এখন নাব্যর সকল আচরণ লৌকিক।
প্রয়োজন হীন একটি বাড়তি কথাও সে বলে না। বর্ষা ভাবতে চেষ্টা করে কোথায় ভুল করেছে সে। ওর কোন অপরাধের সাজা দিচ্ছে নাব্য?
একসময় নাব্য ওর চুল আঁচড়ে দিত, শাড়ির কুঁচি ঠিক করত, সকালে কাজে যাবার আগে রোজ নিজের হাতে ওকে খাইয়ে দিত।
ছুটির দিনগুলোতে ওরা ধানমন্ডি লেকের পাড়ে হাটতে যেত অথবা ছাদে বসে একসঙ্গে বই পড়ে বিকেল টা পাড় করত। বর্ষার অনর্গল কথাতেও নাব্য বিরক্ত হতো না কখনো। অনাগত সন্তান নিয়ে ওদের দুজনেরই কত স্বপ্ন ছিল। বর্ষা বলত, ‘আমাদের বাবু ছোট বেলা থেকেই মাদ্রাসায় পড়বে। বড় হয়ে প্রসিদ্ধ আলেম বা আলেমা হবে।’
নাব্য চাইত তার ঠিক উল্টো। ছেলে হলে পাইলট, মেয়ে হলে ঔপন্যাসিক। এই নিয়ে নিত্য ঝগড়া বাঁধতো ওদের। ঝগড়ার এক পর্যায়ে বর্ষা তার অ’স্ত্র প্রয়োগ করত। কান্না জুড়ে দিয়ে। নাব্য হার মানতো। কিন্তু পরের দিন ফের একই প্রসঙ্গ উঠত। আবারো ওরা ঝগড়া করত। আবারো ফ্যাচফ্যাচ কাঁদত বর্ষা।
এখন নাব্যকে দেখলে সেসব দিন সত্যিই কখনো এসেছিল কিনা সন্দেহ জাগে বর্ষার মনে। কিভাবে এতো বদলে যায় একটা মানুষ!
আজকাল খানিকক্ষণের হাটাচলাতেও বেশ ক্লান্তি অনুভব করে বর্ষা। প্রায় প্রতি সকালে বিছানা থেকে মেঝেতে পা ফেলতে ভয়ানক কষ্ট হয়। যন্ত্রণায় একসময় মনে হয় পা ফেটে র’ক্ত বেড়িয়ে আসবে। আগে বর্ষা রোজ রোজ ঘুম ভেঙে কাঁদতো এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে। তখন ওর কান্নাটাকে নাব্য গুরুত্ব দিত।
ওকে নানান ভাবে শান্ত করার চেষ্টা করত। ফুলে যাওয়া পায়ে মালিশ করে, ওয়াটার ব্যাগ ধরে.. ব্যাথা উপশমের হাজার চেষ্টা করত সে। ধরে ধরে হাটতে সাহায্য করত। এইতো কিছুদিন আগেই….
অথচ এখন! বর্ষার দিকে ফিরে তাকানোরও যেন সময় নেই ওর। কিভাবে যেন বর্ষারও সয়ে গেছে এই প্রকাশ্য অবহেলা গুলো। পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা সত্ত্বেও আজকাল সকালে বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে সে আর কাঁদে না। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে। একটা সময় ব্যাথা কিছুটা কমে এলে একাই উঠে পড়ে।
শীতকালে ভোর গুলো আসে একটু বিলম্বে। ফজরের সালাতের পর কখনো ঘুমায় না বর্ষা। নাব্যও কিছুটা বাড়তি সময় পায় লেখালেখির জন্য। আজ ফজরের পর, মাসনূন আমল আর কিছুক্ষণ কুরআন পড়া শেষে আবার শুয়েছিল বর্ষা। ঘুমোয় নি। কুয়াশার বেড়াজাল ভেঙে ওর বিছানায় সকালের প্রথম রোদেরা এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল। শুয়ে শুয়ে সেই নরম সুন্দর, উষ্ণ আলো দেখছিল সে। বারান্দা পেড়িয়ে সে আলো এসে পড়ছে ঘরের প্রতিটি কোণে। অদ্ভুত সুন্দর সব চিত্র তৈরি করছে৷ বারান্দার বোগেনভিলিয়ার সিঁদুর লাল রঙে, রূপের ছটা লেগেছে রোদের আলো পড়ে। কসমস ফুলগুলো সকালের কবোষ্ণ হাওয়ায় কাঁপছে তিরতির।
একসময় লেখালেখি মুলতবি রেখে লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এল নাব্য। তৈরি হয়ে নিচে গিয়ে নাস্তা করে ফ্যাক্টরির উদ্দেশ্য বেরিয়ে যাবার আগে আবারও ওপরে এলো কিছু কাগজপত্র ও সেলফোন টা নেবার জন্য।
রিনা বর্ষার জন্য ডিম সেদ্ধ আর কিছু খেজুর রেখে গেছিল। বর্ষা সেসব কিছু ছুঁয়ে দেখে নি। ও বসে অপেক্ষা করছিল। নাব্য বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পেছন থেকে বলল,
–‘চলে যাচ্ছেন?’
–‘হ্যাঁ। ‘
–‘একটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন আমায়?’
নাব্য নিরব রইল।
পায়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও বর্ষা উঠে দাঁড়ালো। নাব্যর সামনে এসে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎক্ষন।
–‘নিজের অজান্তেই আমি কি কোনো ভুল করেছি? আপনি কেন এভাবে সবসময় এড়িয়ে চলছেন আমায়?’
–‘এড়িয়ে যাচ্ছি কেন বলল? জানো নিশ্চয়ই কতটা চিন্তিত থাকতে হয় কাজ নিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেশ কয়েক বহর পণ্য খালাস করা হবে আজ। ঢাকায় বসে সেসবের খবর রাখা কঠিন। এই নিয়ে আজকাল বেশ ব্যাস্ত থাকতে হচ্ছে। ‘
–‘আপনি মিথ্যে বলছেন। কিছু একটা হয়েছে। কি হয়েছে আমাকে বলুন। আমার ভুল থাকলে নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা করবো আমি।’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পরম স্নেহে ওর মাথায় হাত রাখল নাব্য। সাথে সাথে নাব্যর গায়ে মাথা হেলিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল বর্ষা।
–‘কিছু হয়নি বললাম তো। অকারণে এত ভাবছো তুমি। সময় মতো খাবার আর মেডিসিন নিও। আসছি আমি।’
ওর কপালে আলতো চুমু এঁকে নাব্য বেরিয়ে গেল। শেষ সময়ে ওকে সালাম জানিয়ে জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইল বর্ষা। সে আজ খুশি হতে পারেনি। অরবে, ওর মনে কোথায় যেন একটা শংকা বিরাজ করছে। মন ওকে বারবার কোনো একটা খারাপ ব্যাপারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। শত চেষ্টা করেও শান্ত থাকতে পারছে না সে। বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।
বর্ষা জড়ো পায়ে হেটে আবার বিছানায় বসে পড়ল। আজকাল একটু দুশ্চিন্তা করলেই হাত-পা অবশ হয়ে আসে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। এখনো তাই হচ্ছে। জানে না কেন অকারণ এত অস্থির হচ্ছে ওর মন। তখন একটি হাদিস মনে পড়ল। নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের জন্য ‘ইস্তেগফার’ (ক্ষমা প্রার্থনা) আবশ্যক করে নেবে, আল্লাহ তাকে সব দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবেন, সব সংকীর্ণতা থেকে উদ্ধার করবেন এবং তাকে এমনভাবে জীবিকার ব্যবস্থা করবেন যা তার চিন্তার বাইরে।’
আর কিছু না ভেবে মনে মনে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ পড়া শুরু করল বর্ষা। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এলো ওর মন।
বর্ষা খাবারের দিকে চেয়ে রইল অসহায়ের মতো। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কিন্তু ভয়ে খেতে পারছে না। আজকাল খেতে গেলেই বমি হয়। এখন ফের খেলেই বমি শুরু হয় যদি। তবে সেটা একেবারে রক্তবমিতে গিয়ে গড়াবে। এর পাশাপাশি রোজ রোজ নাকের এই রক্তক্ষরণ তো আছেই। গত কিছুদিন ধরে কেবল এই খেজুর আর পানি খেয়ে সে দিন কাটাচ্ছে।
ক্লান্তিতে নিষ্পেষিত হয়ে উঠেছে ওর জীবন। জীবনের কোথাও আর একটু স্বস্তি নেই। এতসব জ্বালা যন্ত্রণা নিয়ে আর কতদিন বাঁচতে পারবে সে। জানা নেই ওর।
___________
নিতিনকে নিয়ে রুটিন চেকআপের জন্য বর্ষা ডক্টরের কাছে এসেছে। ফেরার পথে নিতিনের মাথায় পোকা নাড়া দিল। হঠাৎ জেদ জুড়লো শপিংয়ে যাবে। বর্ষার বারণ সত্ত্বেও গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে নতুন গন্তব্যের দিকে ছুটল।
একটা বেশ সৌখিন বেবিশপের সামনে এসে গাড়িটা থামল। দেখে বর্ষা চোখ বড় বড় করে বলল,
-‘এই নিতু, এখানে, এই বেবিশপে কি কাজ তোমার?’
-‘ভাবি তুমি কথা বলো না তো। চুপচাপ আমার সঙ্গে চলো।’ নিতিন যেন আদেশ করল। আজ বেশ উত্তেজিত সে। ডক্টরের ওখানে আজকে বর্ষার আল্ট্রা করানো হয়েছিল। তখন নিতিন প্রথমবারের মতো নিজ চোখে মনিটরে ছোট্ট আগন্তুকের মুভমেন্ট দেখেছে। তারপর থেকে বাচ্চা নিয়ে অনর্গল কথা বলে চলেছে। ছেলে হলে কি নাম রাখবে আর মেয়ে হলে কি নাম। ছোট বেলা থেকে বাচ্চা সবসময় ওর সঙ্গেই ঘুমোবে। ওকে কি বলে ডাকবে না ডাকবে…।
বর্ষা বিহ্বল হয়ে কথা শুনতে শুনতে ওর সঙ্গে গেল। ভেতরে গিয়ে এতো এতো বাচ্চাদের জিনিস দেখে এদিক-সেদিক ছুটে নিতিন বর্ষা থেকে আলাদা হয়ে পড়ল। বর্ষা ক্লান্ত ছিল। তাই নিতিনের পেছনে ছোটা বাদ দিয়ে ও নিজের মতো হাটতে লাগলো। এভাবেই হয়তো আবার নিতিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। চারদিকে বাচ্চাদের এতো ছোট ছোট জামা, জুতো, খেলনা। দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে ওর।
বেবি শপের সামনেটা কাঁচ দিয়ে ঘেরা। তাই ভেতর থেকেও বাইরের ব্যাস্ত নগরী দেখা যায়। সন্ধ্যার আগ মুহুর্ত। সকলের ঘরে ফেরার তাড়া বেশ। বড় সড়কটায় তীব্র যানজট। মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে। যন্ত্রযান গুলো যে যার জায়গায় স্থির।
একটা গোলাপি রঙা মেয়ে বাবুর জামা বর্ষার খুব পছন্দ হলো। হাতে নিয়ে দেখছিল সে। হঠাৎ কাঁচের ওপাড়ে চোখ পড়ল। চোখ ফিরিয়ে নিলেও বিদ্যুতের ঝলকানির মতো আবারও সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ফিরতে বাধ্য হলো সে।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পেরিয়ে গেল বর্ষা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। কাঁচের বাইরে, যানজটে আটকা পড়া সবচেয়ে নিকটতম গাড়িটির দিকে। ভেতরে উপস্থিত মানব-মানবীর ওপর দৃষ্টি পড়ার মাত্রই পুরো পৃথিবী থমকে গেছে ওর চোখে।
চলবে……।