#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩১
সুমি নাস্তা পাঠিয়ে দেওয়ার পর, তা টেবিলে রেখে রাযীন নিজের রুমে ঢুকলো। শশী তখনও ঘুমে বিভোর। রাযীন, শশীর মাথায় হাত বুলালো। ওর গা অনেক গরম হয়েছে। জ্বরটা বেশ ভালোই উঠেছে বোঝা যাচ্ছে। ওর মাথায় বুলাতে বুলাতে বলল,
‘শশী, ওঠো।’
ঘুম ঘুম কন্ঠে শশী বলল,
‘আরেকটু রাযীন। আমার খুব মাথা ঘোরাচ্ছে।’
‘হুঁ বুঝতে পারছি জ্বরের কারণে এমন হচ্ছে। এখন উঠে কিছু খেয়ে নাস্তা করো তারপর ওষুধ খাও। নয়তো শরীর আরও খারাপ করবে।’
‘প্লিজ রাযীন, আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।’
‘পায়ের ব্যথা কি একটু কমছে?’
‘মনে তো হয় না। মনে হচ্ছে আরও ফুলে গেছে।’
রাযীন, শশীর পায়ের কাছে বসল। পায়ের আঙুলগুলো দেখা যাচ্ছে, ফুলে লাল টসটসা হয়ে আছে। রাযীন নিচু হয়ে শশীর পায়ের আঙুলে চুমো খেলো। শশীর ঘুম উড়ে গেলো। ভাঙা গলায় বলল,
‘তোমার কি আমাকে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য আর কোনো টেকনিক জানা নেই?’
মৃদু হেসে রাযীন বলল,
‘যখন জানা টেকনিকই এমন জাদুর মতো কাজ করে, তখন কে নতুন টেকনিক আবিষ্কার করে বলো?’
শশী উঠে বসার চেষ্টা করল। রাযীন ওকে সাহায্য করল। শশী, রাযীনের কাঁধে মাথা দিয়ে বলল,
‘রাযীন আমি ইতিপূর্বে কখনও এত অসুস্থ হইনি। আমার একদম ভালো লাগছে না।’
শশীর, অসুস্থতার ভাঙা ভাঙা কন্ঠটা রাযীনের খুব ভালো লাগছে। কেমন একটা আদর আদর ভাব কথায়। রাযীন ওর মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
‘জলদি সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘হুঁ।’
‘ওয়াশরুমে যাবে?’
‘হুঁ।’
‘চলো নিয়ে যাচ্ছি।’
শশী ফ্রেশ হবার পর রাযীন নাস্তা নিয়ে আসল। নাস্তায় সুমি পরোটা, ভাজি, ডিম আর সুজির হালুয়া দিয়েছে। শশী অর্ধেক পরোটা হালুয়া দিয়ে খেলো, আর একটুও খেলো না। ওষুধ খেয়েই শশী আবার শুয়ে পড়ল। ওর জ্বরটা বাড়ছে, সাথে মাথা যন্ত্রণাও। রাযীন ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
‘শশী!’
‘হুঁ ঘন্টা দুই একা থাকতে পারবে?’
‘কেন? কোথাও যাবে?’
‘হ্যাঁ অফিসিয়্যাল কিছু কাজ ছিলো সেটা সারতে হবে। তারপর বাজার করতে হবে। আজ রাতে বাসায় অনেক মেহমান থাকবে।’
‘কারা?’
‘আমাদের পরিবারের প্রায় সবাই আসবে। তারা আসতে আসতে অবশ্য সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে।’
‘তাহলে তো রান্নার সব এখনই ঘুছিয়ে নিতে হয়।’
‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি টেনশন নিও না। রান্না সুমি আপা আর আমি করব। আর হেল্প করবেন নাজমা খালা। খালাকে বলেছি আজ ঘর পরিষ্কার পর মশলা টশলা সব ঘুছিয়ে রাখতে। কিছু কাটাকুটাও করে দিয়ে যাবে। আমার সব কাজ করে ফিরতে ঘন্টা দুই তো লাগবেই। পারবে ম্যানেজ করতে? আমি অবশ্য সুমি আপাকে বলেছি, তোমাকে একটু পর পর এসে দেখে যেতে। কি পারবে?’
‘তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে যাও। আমি ম্যানেজ করতে পারব।’
‘সত্যি তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা আমি তাহলে গেলাম। দরজা বাইরে থেকে লক করে চাবি আপার কাছে দিয়ে যাব। নয়তো তোমার দরজা খুলতে কষ্ট হবে। আর কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে কল করবে।’
‘আচ্ছা।’
রাযীন যেতেই শশী আবার ঘুমিয়ে পড়ল। শরীর এত খারাপ লাগছে যে, ঘুম ছাড়া কিছু মাথায় আসছিলো না। এর মধ্যে সুমি একবার এসে দেখে গেছে। শশীর মাথা ব্যথা করছিলো বলে গল্প করতে বসেনি। যাবার সময় বলে গেছে যাতে কিছু লাগলে সুমিকে কল দেয়।’
শশী প্রায় আড়াই ঘন্টা ঘুমালো। ঘুম ভাঙার পর দেখে রাযীন তখনও ফেরেনি। এদিকে প্রস্রাবের প্রচন্ড চাপ পেয়েছে। না গেলেই না। শশী, সুমিকে কল করতে নিয়ে দেখে চার্জবিহীন মোবাইলটা বন্ধ হয়ে আছে। মনে পড়ল, গতকাল সকালে চার্জ দিয়েছিলো। তারপর রাতে ঘুমানোর সময় যে চার্জ দিবে তা মনে ছিলো না। এদিকে প্রসাবে তলপেট ব্যথা করছে। শশী খুব সাবধানে পা নামালো। বাম পায়ে ভর দেয়ার মতো সাহস হচ্ছে না। প্রচন্ড ব্যথা করছে। তবুও এক পায়ে ভর দিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু কয়েকপা এগোতেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। শশী এখন আর কোনো সাপোর্ট ছাড়া উঠতে পারছে না। চুপ করে কিছুসময় ওখানেই বসে রইল।
রাযীনও কেবল এসেছে। বাজারগুলো রান্নাঘরে রেখে নিজের রুমে ঢুকতে দেখে শশী চুপচাপ ফ্লরে বসে আছে। রাযীনের ভয়ানক রাগ হলো। তবুও বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
‘এখানে কী করছো?’
‘ওয়াশরুমে যেতে চাচ্ছিলাম।’
রাযীন কিছুই বলল না। শশীকে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল। তারপর ওকে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে বলল,
‘তোমাকে বারবার বলেছিলাম না যে, পায়ে কোনো প্রেশার দিবে না। তাহলে আমার কথা শুনলে না কেন?’
‘রাযীন, আমার বাথরুমে যাওয়াটা জরুরি ছিলো।’
রাযীন সাথে সাথে টেবিলের উপর থেকে টিভিটা উঠিয়ে একটা আছাড় মারল। কয়েকটা ফুলদানি ভেঙে ফেলল। তারপর বলল,
‘জরুরি ছিলো তো বিছানায় করতে। আমি পরিষ্কার করতাম। পায়ে কেন প্রেশার দিলে? আর তোমার ফোন কোথায়? সেটা অফ কেন? কতবার কল করেছি। তুমি দরকার হলে সুমি আপাকে কল করে ডাকতে। যে ফোন প্রয়োজনে ব্যবহার হয় না, সে ফোন রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। রাযীন বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে, সেটাও ভেঙে ফেলল। তারপর বলল, তোমার সুস্থ থাকাটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু তুমি তো আমার কোনো কথা গায়েই লাগাও না।’
শশী ভয়ে, আতঙ্কে কোনো কথাই বলতে পারল না। হতভম্ব হয়ে রাযীনের কান্ড দেখছিলো! যদিও ও রাযীনের এ রূপটা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলো। মিতু আগেই বলেছিলো, তারপরও অন্যের কাছ থেকে শোনা আর নিজে মুখোমুখি হওয়ার মাঝে বিস্তর ফারাক। অভিমানে শশীর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। শশী চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর আপন মনে কাঁদতে লাগল। রাযীন নিজেকে শান্ত করতে অন্য রুমে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর সুমি খাবার দিতে এসে দেখল মেইন দরজা খোলা। সুমি ভিতরে ঢুকে খাবার টেবিলে রেখে রাযীনের রুমে এলো। রুমের এ অবস্থা দেখে সুমি, শশীকে জিজ্ঞেস করল,
‘রুমের এ অবস্থা কেন? কী হয়েছে শশী?’
‘কিছু না আপা, আপনার ভাইকে জিজ্ঞেস করেন প্লিজ। আমার কাছে কিছু জানতে চাইবেন না আপা প্লিজ।’
শশী অন্য দিকে ঘুরে কাঁদতে লাগল। এই ফাঁকে সুমি টুপ করে নিজের ফোনে ওদের রুমের কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। তারপর মুখের রহস্যময় হাসিটা বহু কষ্টে চেপে বলল,
‘আচ্ছা তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর বিষয় তোমরাই সলভ করো। অামার ঢোকা ঠিক হবে না। খাবার তোমাদের টেবিলে রেখে গেলাম। প্লিজ খেয়ে নিও।’
শশী মনে মনে বলল,
‘আজ আর খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।’
প্রায় আধাঘন্টা পর রাযীন রুমে আসল। রুমের সবকিছু নিজেই পরিষ্কার করতে নিলো। হাতে গ্লাভস পরে কাচের টুকরোগুলো খুব সাবধানে তুলল। তারপর ঝাড়ু নিয়ে পুরো রুমটা তিনবার ভালো করে ঝাড়ু দিলো, যাতে রুমে কোনো কাঁচের টুকরো না থাকে।
তারপর বাথরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে বের হলো। দুপুরে শশীর শরীরটা একটু মুছে দেয়া দরকার, ওর ড্রেস চেইঞ্জ করা দরকার। নয়তো শরীর আরও খারাপ লাগবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকলে মানুষের শরীর খারাপ থাকলেও মনটা ভালো লাগে। আর মন ভালো থাকলে শরীর দ্রুত সুস্থ হয়। তাই অসুস্থ হলেও সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা উচিত।
রাযীন, শশীর কাছে গিয়ে বলল,
‘চলো তোমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাই। শরীর মুছে ড্রেসটা পাল্টে নিবে। তারপর খেতেও তো হবে দুইটার বেশি বাজে।’
শশী বেশ রাগ করে বলল,
‘কোনো প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। আজকে আমার বাবা-মাও আসবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি তাদের সাথে ফরিদপুর চলে যাবো। এই অসুস্থ অবস্থায় তোমার বিরক্তি আর রাগের কারণ হতে চাই না। সুস্থ হলে তারপর ফিরব কিনা ভেবে দেখবো?’
রাযীনের বুকটা ধক করে উঠল। মনে মনে বলল,
‘শশীকে বোধ হয় অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম। শালার মাঝে মাঝে কী যে হয় আমার, অল্পতেই রেগে যাই, তারপর হুদাই ভাঙচুর করি। আমি নিজেও জানি, আমার এ অভ্যাসটা খারাপ কিন্তু রাগ উঠলে কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না।’
রাযীন, শশীর হাত ধরল। শশী হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিলো। রাযীন উঠে দাঁড়িয়ে কান ধরে বলল,
‘এই দেখো,কান ধরেছি, উঠবস করছি প্লিজ রাগ করো না জানপাখি।’
শশী চোখের পানি মুছে কঠিন কণ্ঠে বলল,
‘একদম ঢঙ করবে না। যাও খেয়ে নাও আপা খাবার দিয়ে গেছেন।’
‘তুমি খাবে না?’
‘না।’
‘চেইঞ্জও করবে না?’
‘না।’
রাযীন লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘বুঝেছি।’
রাযীন জোর করে শশীকে কোলে তুলে নিলো। বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
‘হয় নিজে ফ্রেশ হয়ে চেইঞ্জ করো, নয়তো আমি ভিতরে ঢুকে তোমার কাপড় পাল্টে দিব। তখন কিন্তু বিষয়টা অন্য দিকে যাবে।’
শশী রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
‘আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়লাম তো।’
রাযীন বাইরে থেকে বলল,
‘তার চেয়েও বড় পাগল। আর পাগল শুধু শশীর জন্য।’
শশী দরজা খুলে নিজের ওড়নাটা রাযীনের মুখ বরাবর ছুড়ে মারল। তারপর রেগে বলল,
‘আমার ড্রেস দাও।’
রাযীন ওড়নাটা কাঁধে ঝুলিয়ে মৃদু হাসল। তারপর শশীকে একটা কুর্তি আর প্লাজো দিলো। শশী কুর্তিটাকে আবার রাযীনের মুখে ছুড়ে মেরে বলল,
‘এটার গলা অনেক বড়। তাছাড়া এটা স্লিভলেস। বাড়িতে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি, বাবা-মা সবাই আসবে আর আমি স্লিভলেস পরে ঘুরব?’
‘তো মুখে কেন ছুড়ে মারলা?’
‘রাগ শুধু তোমার একার নাই। এরপর কথা বাড়ালে, সাবান, মগ, বালতি, শাওয়ার সব ছুড়ে মারব।’
রাযীন মৃদু হেসে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শশীর একদম কাছে গিয়ে বলল,
‘দেখি তো তোমার রাগ কোথায় থাকে? শশী কোনোমতে নিজেকে সামলে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাযীন, শশীকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে বলল,
‘মেয়েদের রাগ নাকি ঠোঁটে থাকে। আমি কি একটু টেস্ট করে দেখব?’
শশী, রাযীনের পেটে চিমটি কেটে বলল,
‘উল্টা পাল্টা কিছু বললে বা করলে, তুলে আছাড় মারব।’
রাযীন এবার শব্দ করে হেসে বলল,
‘যাকে নিয়ম করে ছয়বেলা তুলে আমার ওয়েট লিফটিং হয়ে যাচ্ছে, আসছে সে আমাকে তুলে আছাড় মারবে। এই তুলোর পুতুলটা, তুমি রাগলেও আমার আদর আদর লাগে। আই লাভ ইট।’
শশী কী বলবে ভাবছে। মনে মনে বলল,
‘এ ছেলেকে কিছু বলে লাভ নেই। তারচেয়ে এখন হার মেনে নেই। তারপর বলল, আমাকে চেইঞ্জ করতে দাও। যাও বের হও আর বের হয়ে আমার ড্রেস দাও।’
‘হার মেনে নিলা?’
‘পা ভাঙা না থাকলে দেখিয়ে দিতাম।’
‘ওকে তোমার সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।’
তারপর শশীর কানের লতিতে ছোট্ট করে চুমো আঁকল। শশীর পুরো শরীর কেঁপে উঠল। রাযীন বলল,
‘চেইঞ্জ করে বের হও। পাকনামি করে কাপড় ধুতে যাবে না। আমি ধুয়ে দিব।’
শশী কাপড় পাল্টে বের হবার পর রাযীন গোসল করতে ঢুকল। গোসল করে বের হয়ে মাথা মুছছে ও। খালি গা, শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি। শশী হা হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
‘লজ্জা করে না, একটা মেয়ের সামনে এভাবে খালি গায়ে থাকতে?’
‘তোমার লজ্জা করে না একটা ছেলেকে এমন হা হয়ে দেখতে? তা-ও যখন ছেলেটা অর্ধনগ্ন।’
‘না করে না, কারণ ছেলেটা আমার স্বামী।’
‘আমারও লজ্জা করে না কারণ মেয়েটা আমার বউ।’
দু’জনেই শব্দ করে হাসল। শশী বলল,
‘রাযীন কাছে আসো।’
রাযীন, শশীর কাছে এসে বসল। শশী, ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রাযীনও, শশীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কী হলো?’
‘রাযীন তোমার শরীর কী ঠান্ডা! ভালো লাগছে জড়িয়ে ধরতে।’
‘আর তোমার শরীর কী গরম! আমি জ্বলে যাচ্ছি তোমার দহনে।’
‘মজা নিচ্ছো?’
‘আরে না সত্যি তোমার শরীর খুব গরম। জ্বরটা বোধ হয় বাড়ছে আবার।’
‘হয়তো। রাযীন কিছু কথা বলি।’
‘চেইঞ্জ করে নি।’
‘না এভাবেই জড়িয়ে থাকো আমার ভালো লাগছে।’
রাযীন শক্ত করে শশীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘বলো।’
‘রাগ করবে নাতো?’
‘না।’
‘যা বলবো, ঠান্ডা মাথায় শুনবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘প্রমিজ।’
‘পাক্কা প্রমিজ।’
‘আজ তুমি কত টাকার জিনিস ভেঙেছো?’
‘রাযীন চুপ?’
‘টিভিটার দামই তো লাখের উপরে। তারপর দামি দামি ফুলদানি, মোবাইল। সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক টাকার জিনিস তুমি ভেঙেছো?’
‘রাযীন চুপ।’
‘টাকাগুলো এভাবে অপচয় করা কি তোমার ঠিক হয়েছে?’
রাযীন, শশীর দিকে তাকালো। শশী, রাযীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘প্লিজ আমার চোখের দিকে তাকিও না। তোমার চোখে তাকালে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। কথাগুলো গুলিয়ে ফেলি। তুমি এভাবেই আমায় জড়িয়ে থাকো।’
রাযীন ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘শশী, আসলে আমার যখন রাগ উঠে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমার সহজে রাগ হয় না। আবার মাঝে মাঝে হুটহাট ছোটো ছোটো বিষয়েও মাথায় প্রচন্ড রাগ চেপে যায়। তখন রাগ একদম নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমি যাতে রাগের বশে, নিজের প্রিয় মানুষগুলোকে আঘাত করে না বসি বা কটু কোনো কথা না বলি, সে কারণে জিনিসপত্র ভাঙচুর করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করি। সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি এগুলো ঠিক না। পরে নিজ মনে খুব অনুশোচনা হয় কিন্তু কী করব বলো? যখন রাগ হয় তখন মাথায় কিছু থাকে না।’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শশী বলল,
‘রাযীন তুমি কয়েকমুহূর্তে দেড় লাখ টাকা নষ্ট করলে। অথচ কত নিম্ন মধ্যবিত্ত, কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার আছে যারা এক বছরেও দেড় লাখ টাকা আয় করতে পারে না। কত বাচ্চারা একবেলা পেট পুরে খেতে পারে না। না খেতে পেরে, খুদার যন্ত্রনায় কাঁদে। জানো আমি যখন পার্ট টাইম হিসাবে একটা এনজিওতে জব করতাম, তখন দেখেছি মানুষ কত অসহায়! তুমি খুব ধনী পরিবারের সন্তান। অভাব তুমি বুঝবে না। তুমি যে টাকার জিনিস ভেঙেচুরে নষ্ট করো, সে টাকাগুলো তুমি কোনো সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের দিতে পারো।’
‘আমরা প্রতি মাসেই আমাদের লাভের একটা অংশ বিভিন্ন অনাথআশ্রমে দেই।’
‘সেটা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। তবে তারপরও তুমি সেটা দিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে পারবে না। তুমি রাগের বশে অপচয় করছো। রাগকে তুমি নিয়ন্ত্রণ করো, রাগ যাতে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে! আজ থেকে তুমি রাগ করে কোনো জিনিস ভাঙলে আমি বুঝবো, তুমি আমাকে একটা করে আঘাত করছো।’
‘কি আজে বাজে কথা বলছো? পণ্য আর তুমি কি এক? তোমাকে আমি কখনো আঘাত করতে পারব না।’
‘তাহলে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করো।’
‘চেষ্টা করব। সত্যি চেষ্টা করব।’
শশী কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর দুষ্টু হেসে বলল,
‘আচ্ছা শোনো যদি তুমি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারো, তবে প্রতিবার রাগ নিয়ন্ত্রণ করার পর একশটা করে ভালোবাসাময় চুমো পাবে।’
রাযীন দুষ্টু হেসে বলল,
‘আমি এখন রাগ করেছি, বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণও করেছি, দাও আমার একশ চুমো।’
শশী, রাযীনের গাল টেনে বলল,
‘সবসময় খালি দুষ্টু কথা। বাদর একটা।’
‘এখন খাবে?’
‘হুম।’
‘বসো আমি খাবার নিয়ে আসছি।’
‘আনতে হবে না। তুমি আমাকেই খাবার রুমে নিয়ে চলো।’
‘ওকে। তবে শার্টটা পরে নি।
ঠোঁট টিপে হেসে শশী বলল,
‘খালি গায় থাকোনা ভালোই লাগছে।’
তারপর রাযীনকে একটা চোখ মারল শশী। রাযীন হেসে বলল,
‘শশী দিন দিন তুমি বড্ডো দুষ্টু হচ্ছো।’
‘তোমার কাছ থেকেই শিখছি। যেমন স্বামী তার তেমন স্ত্রী।’
রাযীন হেসে শার্ট পরে শশীকে কোলে তুলে বলল,
‘দুষ্টুপাখিটা আমার।’
চলবে….
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩২
খাবার পর রাযীন, শশী রুমে যেতেই নিবে, তখন দরজায় বেল বাজল। রাযীন, দরজা খুলে দিতে দেখল দুজন ডেলিভারিম্যান এসেছে। রাযীন যা যা ভেঙেছিলো সব আবার অর্ডার করে কিনে নিয়েছে। শশীর বিষয়টা বিরক্তিকর লাগল। ডেলিভারিম্যানরা যাবার পর শশী রাগ করে বলল,
‘এরেই বলে টাকার গরম। ধনী বাপের ফুটানি পোলা।’
রাযীন মুখ গোমড়া করে বলল,
‘সরি বলেছি তো? প্রমিজও করেছি এরপর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করব। তারপরও কেন কথা শোনাচ্ছো?’
‘একশবার শোনাবো। যতদিন মনে পড়বে ততদিন শোনাব।’
রাযীন, শশীকে কোলে তুলে বলল,
‘তা না হয় শোনাবে, এখন রুমে চলো একটু রেস্ট নিবে। আমার একটু দুষ্টুমিষ্টি কাজও আছে।’
‘মাইর দিব।’
‘আচ্ছা বাবা রেস্ট নিও।’
‘সারাদিন তো তা-ই করছি।’
‘ফিলিং বোর?’
‘ভীষণ?’
রাযীন, শশীকে সহ সোফায় বসে, এক হাত দিয়ে ওকে সামলে। অন্য হাতে ওর পেটে, কোমরে সুরসুরি দিতে লাগল। শশী হাসতে হাসতে বলল,
‘রাযীন স্টপ।’
‘তোমার বোরনেস কাটাচ্ছি।’
‘লাগবে না কাটানো। ছাড়ো।’
দু’জনেই শব্দ করে হাসতে লাগল। তখন রোমিসা বলল,
‘ভাইয়া ভাবির বোধ হয় সুরসুরি বেশি ছেড়ে দে বেচারিকে।’
রাযীন আনমনে বলল,
‘আচ্ছা।’
তারপর সামেনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে যায়। কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ হা হয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাযীন বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘মা তোমরা কখন এলে।’
মিতু বলল,
‘সেটা পরে বলছি আগে শশীকে কোল থেকে নামা। এতজন বড় মানুষের সামনে বউ কোলে নিয়ে বসে আছিস লজ্জা করছে না?’
রাযীন তাড়াহুড়ো করে শশীকে বসাতে গিয়ে উল্টা ওর পায়ে ব্যথা দিয়ে ফেলল। শশী, রাযীনের কাঁধে কিল মেরে বলল,
‘ব্যথা লাগছে রাযীন।’
‘উপস সরি সরি।’
এদিকে হাসি, নূর ইসলামের চোখে মুখে আনন্দ দেখা যাচ্ছে। তাদের মেয়ে যে খুব সুখে আছে, তা তার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। রাযীন, শশী সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলো। মিতু, শশীর পাশে বসতে বসতে বলল,
‘কিরে শশী এই হনুমানটা তোর পা ভেঙেই শান্ত হলো?’
‘না না মা ও কেন ভাঙবে? আসলে আমি-ই বেখেয়ালে পড়ে গেছিলাম।’
রাযীন ওর মাকে বলল,
‘মা, তুমি না বললে সন্ধ্যার পর আসবে? তাহলে এখন তো কেবল চারটা বাজে।’
মিতু রাগ করে বলল,
‘সবাই চলেন গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, সন্ধ্যার পর আসব। কোথায় ভাবলাম তোরা খুশি হবি।’
শশী বলল,
‘মা আমরা অনেক খুশি হয়েছি।’
‘তোকে বলিনি, ঐ হুনুটাকে বলছি। ঐ গাধা তুই দরজা লক করে নিবি না?’
রাযীন বলল,
‘কিছু জিনিস অর্ডার করেছিলাম। মাত্র ডেলিভারিম্যান দিয়ে গেল। তখন দরজা ভেজিয়ে রেখেছিলাম। লক করতে ভুলে গেছিলাম।’
‘আচ্ছা তুই এখন সাইড হ আমাকে শশীকে দেখতে দে। মেয়েটার চোখ মুখ বসে গেছে। নিশ্চিত তুই ওর খেয়াল রাখিসনি।’
‘আপনার বউমাকেই জিজ্ঞেস করেন তার খেয়াল রাখি কিনা?’
হাসি বেগম এসে শশীর পাশে বসল। ওর শরীরের অবস্থা জিজ্ঞেস করল।’
শশী বলল,
‘মা, আমি ভালো আছি। মা বড় ভাইয়া-ভাবি আসেনি?’
‘নারে। লিপি তো আসার জন্য খুব চাইছিলো কিন্তু সাহিরের পরীক্ষা চলছে। আর সাজ্জাদের কাজের খুব প্রেশার। ওরা দুজন কয়েকদিন পর এসে তোকে দেখে যাবে।’
শিহাব, শশীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘কিরে বাচ্চা নিজের খেয়াল রাখতে পারিস না? পা ভেঙে তবে শান্ত হলি।’
শশী হাসল শুধু।
রাযীন সবাইকে বলল,
‘সবাই কত লম্বা জার্নি করে এসেছেন। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিন।’
রাযীন সবাইকে রুম দেখিয়ে দিচ্ছে।
রেনু, শশীর পাশে বলল,
‘আমরা তো তোমাকে দেখতে এসেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, তোমরা এমনি ভালো ছিলে। উল্টো আমরা এসে তোমাদের বিরক্ত করলাম।’
শশী, ভীষণ লজ্জা পেল।
মিতু সবাইকে রুম দেখিয়ে দিলো। হাসি বেগম, নূর ইসলামকে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ! মেয়েটা অনেক সুখে আছে। রাযীন খুব খেয়াল রাখে। দেখছো মেয়েটার চোখ মুখ থেকে খুশি উপছে পড়ছে।’
নূর ইসলাম বললেন,
‘সত্যি এত আনন্দ লাগছে মেয়ের সুখ দেখে। আল্লাহ কারও নজর না লাগাক। রাযীন সত্যি খুব ভালো ছেলে। লিপি সত্যি বলেছিলো রাযীন, শশীর খু্ব খেয়াল রাখবে।’
‘তুমি তো প্রথমে রাজী হচ্ছিলে না।’
‘সে তো রাযীনদের অবস্থা দেখে। রাযীনরা অনেক ধনী।’
হাসি বেগম খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘তো আমরা কি গরীব নাকি?’
‘গরীব না তবে রাযীনের তুলনায় আমাদের তেমন কিছু নেই।’
‘এত তুলনা করলে কি চলে? তাছাড়া আমরা তো প্রস্তাব নিয়ে যাইনি। তারাই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো। তারাই জোর দিচ্ছিল বিয়ের জন্য। আর সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহ চেয়েছেন ওদের বিয়ে হোক। সেখানে তুমি আমি বাঁধা দিলেও বিয়েটা হতো।’
‘হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক বলেছো। এখন আল্লাহর কৃপায় ওরা সবসময় ভালো থাকলেই হয়।’
‘সেটাই।’
সবাই যখন ফ্রেশ হচ্ছিল, রাযীন তখন সবার জন্য নাস্তা অর্ডার করে এনে নিজেই পরিবেশন করতে নিলে মিতু হাত থেকে নিয়ে বলল,
‘আমি করছি।’
শশী পাশে বসা ছিলো। বলল,
‘মা আমি কিছু হেল্প করি?’
‘জি না। আপনি চুপচাপ ভদ্রমেয়ের মতো বসে থাকেন।’
‘মা কাল থেকে তো বসেই আছি। আরও একমাস নাকি বসে থাকতে হবে। এমন বসে থাকতে গেলে তো আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’
‘সারাদিন বসে কেন থাকবি? আমার ছেলেটাকে জ্বলাবি। প্রচুর জ্বালাবি। শোন যে বউ তার জামাইরে জ্বালায় না তারে বউ বলে না। বউদের প্রধান কাজ তার বরদের প্রচুর জ্বালানো। জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দেওয়া।’
‘ভেবে দেখেন মা, পরে কিন্তু আপনি বলতে পারবেন না, আমার ছেলেকে এত কেন জ্বালাস?’
‘আরে নো টেনশন। ও ছোটোবেলা থেকে আমায় যে জ্বালান জ্বালাইছে তার শোধ তোকে তুলতে হবে। উঠতে বসতে দৌড়ের উপ্রে রাখবি। বউরা, বরদের যত দৌঁড়ের উপ্রে রাখে বররা তত সোজা থাকে।’
হাসি বেগম, মিতু আর শশীর কথা শুনে হেসে বলল,
‘তা বেয়ান বেয়াইরে আপনি বুঝি দৌড়ের উপর রাখেন?’
মিতু হেসে বলল,
‘অবশ্যই বেয়ান। সেই অধিকার আমার শাশুড়ি মা আমাকে দিয়েছিলেন, আমি আমার পুত্রবধূকে দিচ্ছি। তারপর রাযীনের দিকে তাকিয়ে বলল, জানেন বেয়ান এই ছেলেকে আপনারা যত ভদ্র জানেন তত ভদ্র না। এক নাম্বারের বাদর। ওরে যদি শশী ঠিক করতে না পারে তাহলে শশীর খবর আছে।’
রাযীন বলল,
‘মা তুমি তোমার পুত্রবধূকে শিখিয়ে দিচ্ছ যাতে তোমার ছেলেকে জ্বালায়? তুমি কি সত্যি আমার মা? আমার সন্দেহ হচ্ছে! চেহারায় না মিললে নিশ্চিত ভাবতাম আমি বাবার ছেলে, তোমার না।’
মিতু, রাযীনের কান ধরে বলল,
‘বদ ছেলে যা সামনে গিয়ে বস। তোর বাবা, শ্বশুর, শিহাবের কাছে।’
‘তোমাকে হেল্প করি। তাছাড়া রান্নাও তো করতে হবে।’
মিতু বলল,
‘রান্না আমি আর সুমি মিলে করে নিব।’
হাসি বলল,
‘বেয়ান আমি আর রেনুও হেল্প করি।’
‘না না বেয়ান। সে কী কথা? আপনি চেয়ারে বসুন। শশী তুই বরং রেনুর সাথে গল্প কর।’
শশী বলল,
‘মা আমিও কিন্তু হেল্প করতে পারি। আপনার ছেলে আমার জন্য একটা ইলেট্রিক হুইলচেয়ার এনেছে। এখন ঘরে ঘুরে বেড়াতে সুবিধা হবে।’
‘তুই বরং ঘরে ঘুরেই বেড়া। আমি সব সামলে নিব।’
সবার নাস্তা করার পর মিতু, শশীর রুমে আসল। হাসি, রেনুও তখন শশীর রুমে ছিলো। মিতু, শশীর হাতে একটা গহনার বক্স দিয়ে বলল,
‘দেখ তো পছন্দ হয় কিনা?’
শশী বক্সটা খুলে বলল,
‘ওয়াও মা। কি প্রিটি দেখতে নেকলেসটা!’
‘এটা তোর জন্য কিনেছিলাম। ভেবেছিলাম তোরা ফরিদপুর গেলে দিব। এখন তো এলাম, ভাবলাম নিয়ে যাই।’
‘ওয়াও মা। কিন্তু এটা কি রিয়াল ডায়মন্ড এর?’
‘হ্যাঁ।’
‘মা তাহলে তো এটা অনেক দামি।’
‘তোর চেয়ে না। তুই আমার রাযীনের জন্য সবচেয়ে দামি। সে কারণে তোর চেয়ে দামি কোনো কিছু না।’
শশীর চোখ ভিজে উঠল। তারপর বলল,
‘লাভ ইউ মা।’
‘লাভ ইউ টু বাচ্চাটা।’
মিতু হাসির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘সরি বেয়ান আপনার জন্য আপাতত কোনো উপহার আমার কাছে নেই।’
হাসি বেগম বলল,
‘বেয়ান আপনি আমার মেয়েকে যে ভালোবাসা দিচ্ছেন, এর চেয়ে বড় উপহার আর কী হতে পারে।’
‘বেয়ান আমার ঘরের সবাই শশীকে খুব ভালোবাসে এবং বাসবে। তার কারণ জানেন কী?’
হাসি বলল,
‘কী?’
‘রাযীন। আমার রাযীন আপনার শশীকে পাগলের মতো ভালোবাসে। আমার ছেলেটা কখনও আমাদের কাছে তেমন কিছু চায়নি। তবে যেদিন শশীকে বিয়ে করতে যাবে, সেদিন আমাদের বসিয়ে বলল, তোমরা সবাই জানো, আমি শশীকে কতটা ভালোবাসি। তোমরা আমাকে যতটা ভালোবাসো, ততটা ভালো শশীকেও বাসবে। যেদিন দেখবো শশীর প্রতি তোমাদের ভালোবাসা কমে গেছে, আমি বুঝবো আমার প্রতিও তোমাদের ভালোবাসা কমে গেছে। আর আমাদের ঘরে রাযীনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে ধরা হয়।’
হাসি অবাক হলো। তারা জানতো না, রাযীন, শশীকে এত ভালোবাসে। হাসি বলল,
‘আমাদের শশী ভাগ্যবতী।’
‘আমার রাযীনও। তবে প্রকৃত ভাগ্য তো আপনাদের ভালো, যে রেনুর মতো এতো সুন্দরী মেয়েকে পুত্রবধূ হিসাবে পেয়েছেন। সত্যি বলছি বেয়ান, রেনুর মতো সুন্দরী মেয়ে আমি কখনও দেখিনি। কোনো মেয়ে এত অদ্ভুত সুন্দর হতে পারে আমার ধারণা ছিলো না।’
রেনু লজ্জা পেয়ে বলল,
‘আন্টি আপনি বেশি বেশি বলছেন।’
‘না রেনু সত্যি বলছি। আমি তোমার মতো এত অদ্ভুত সুন্দরী মেয়ে কখনো দেখিনি। তোমাকে দেখলে মনে হয়, আল্লাহ অনেক যত্ন করে তোমায় বানিয়েছিলো। আমার তো মনে হয়, তোমাকে পরী বানাতে চেয়েছিলো তারপর আল্লাহ ভাবলেন, এই মেয়েটাকে বরং পৃথিবীতে রাখি, মানুষ দেখুক, আমি চাইলে কত সুন্দর করে মানুষ বানাতে পারি। যদিও আল্লাহর সৃষ্টি সব কিছুই সুন্দর কিন্তু বহু সৃষ্টি চোখ ধাঁধানো সুন্দর। তুমি তাদের মধ্যে।’
রেনু এত লজ্জা পেলো যে, ওর ফর্সা গাল গোলাপি হয়ে গেল। হাসি বেগম কিছুই বলল না। মিতু বলল,
‘আমি চুলায় গরুর গোস্ত রেখে আসছি। বেয়ান আপনারা গল্প করেন। আমি আসছি।’
মিতু যেতেই শশী বলল,
‘দেখলা ভাবি আমি সত্যি বলতাম তোমার মতো সুন্দরী মেয়ে সচারাচার চোখে পড়ে না।’
রেনু হাসল। হাসি বেগম বললেন,
‘হ্যাঁ বেয়ান সত্যি বলেছেন তোর ভাবি সত্যি চোখ ধাঁধানো সুন্দর।’
তার কথায় রেনু বেশ অবাক হলো। তিনি শশী, রেনুকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে বলল,
‘শশী তুই খুশি তো এ বিয়েতে।’
‘অনেক খুশি আমি মা। রাযীনের মতো জীবনসঙ্গী পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। আর তারচেয়েও বড় কথা রাযীনের পরিবারের প্রতিটা মানুষ অসম্ভব ভালো। আমি সত্যি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ মা আমাকে এমন একটা পরিবার দেয়ার জন্য।’
হাসি শশীকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমো খেয়ে বলল,
‘দোয়া করি, এভাবেই সুখী হও। আচ্ছা শোন তোরা দু’জন এত বড় ফ্লাট নিলি কেন? কতগুলো রুম। দু’জন মানুষ দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট নিলেই তো পারতি?’
‘মা এই পুরো বিল্ডিংটা রাযীনদের।’
হাসি বেগম চোখ বড় করে বলল,
‘কী?’
‘হ্যাঁ মা। এখানের প্রতিটা ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। শুধু সুমি আপার ফ্ল্যাটটা তাদের। তাদের বলতে আমার শ্বশুর, তার বড় ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে ফ্ল্যাটটা উপহার দেন। কারণ সুমি আপার বর চট্টগ্রামের। এখানেই জব করেন। প্রথমে নাকি আমার শ্বশুর সুমি আপার বিয়েতে ফরিদপুর কিছু জমি লিখে দিতে চেয়েছিলেন। পরে সুমি আপা নাকি বলেছিলেন, ছোট আব্বু আমার জমি লাগবে না। আমরা তো ফরিদপুর থাকব না, তুমি বরং আমাকে চট্টগ্রাম একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে দাও। তো আমার শ্বশুর তার করা বিল্ডিং থেকেই একটা ফ্ল্যাট সুমি আপাকে রেজিট্রি করে দিয়ে দেন। একটা ফ্ল্যাট নিজেদের জন্য রাখেন বাকিগুলো ভাড়া দেয়া। এই জমিটা আমার শ্বশুর তার যুবক বয়সে কিনেছিলেন। বছর দশেক আগে এখানে দশতলা একটি ভবন তৈরী করে। প্রতিটা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে দেয়।’
‘শশী, রাযীনরা এত ধনী তুই মানিয়ে নিতে পারবি তো?’
‘মা রাযীন বা ওর পরিবারের সাধারণ চাল চলনে কী মনে হয় ধনী বলে ওরা অহংকারি? বা ওদের সাথে মানিয়ে নেয়া যাবে না?’
‘না। তেমন না।’
‘মা আমার শ্বশুরকে প্রায়ই রাযীনকে বলতে শুনি, রাযীন যত টাকাই আয় করো না কেন, সবসময় মনে রাখবে তুমি মাটির মানুষ। তোমার পা যেনো সবসময় মাটিতে থাকে।
৪০!!
“আজকের ব্রেকিং নিউজ।”
ফরিদপুরের বিশিষ্ট্য ব্যাসায়ী রায়হান রহমানের ছেলে, রাইয়্যান রাযীনকে হত্যার চেষ্টা। আর এ হত্যার চেষ্টার দায়ে আটক তারই স্ত্রী সানজিয়া আরেফিন শশী।”
খবরটা পড়ে সজল বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। আর ওঠার কারণে ওর হাতে লেগে পাশে থাকা চা’য়ের কাপটা নিচে পড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
চলবে….