এক‌দিন বিকা‌লে সকাল হ‌য়ে‌ছি‌লো পর্ব-৩৩+৩৪

0
491

#এক‌দিন_বিকা‌লে_সকাল_হ‌য়ে‌ছি‌লো
‌লেখকঃ শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩৩

রা‌তের খাবার ‌খে‌য়ে কিছুক্ষণ গল্প টল্প ক‌রে সবাই ঘুমা‌তে গে‌ল। রাযীন‌দের ফ্ল্যা‌টে মোট চারটা বেডরুম। একটা রাযীন-শশীর, একটায় রেনু-শিহা‌বকে শু‌তে বলল। একটায় মিতু, হা‌সি বেগম আর রো‌মিসা ঘুমা‌লো। বা‌কিটায় নূর ইসলাম এবং রায়হান সা‌হেব ঘুমা‌লেন।

‌বিছানায় শু‌য়ে হা‌সি বেগম মিতু‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল,
‘‌বেয়ান কিছু ম‌নে না কর‌লে একটা কথা জি‌জ্ঞেস ক‌রি?’
‘‌নিঃসং‌কো‌চে জি‌জ্ঞেস করুন বেয়ান।’
‘আপনার বয়স কত হ‌বে?’
‘আপনার ধারণাম‌তে কত?’
‘স‌ত্যি বল‌তে বেয়ান আপনার চেহারা দেখে বয়স ধরা যা‌চ্ছে না। ম‌নে হ‌চ্ছে ত্রিশ বা পঁয়‌ত্রি‌শের বে‌শি না।’
মিতু হে‌সে বলল,
‘অতটাও কম না বেয়ান। আমার বয়স চুয়াল্লিশ বছর। আমার বি‌য়ে হয় স‌তে‌রো বছর বয়‌সে। আঠা‌রোতে রাযীন আমার কো‌লে। রাযী‌নের তো এখন প‌ঁচিশ বছর বয়স। মাস দুই পর ছা‌ব্বি‌শে পা দি‌বে।’
‘আপ‌নি দেখ‌তে খুব সুন্দর বেয়ান।’
রো‌মিসা, মিতু‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘আ‌ন্টি, আমার মা না‌য়িকা‌দের চে‌য়েও সুন্দর আর স্মার্ট।’
হা‌সি হে‌সে বল‌লেন,
‘তা তোমার মা‌কে দেখ‌লেই বোঝা যায়।’
‌মিতু হে‌সে বল‌লেন,
‘‌বেয়ান, আপ‌নিও মাশাআল্লাহ।’

হা‌সি বলল,
‘‌বেয়ান, এত অল্প বয়সে রাযীন এত বড় ব্যবসা সামলা‌চ্ছে কী ক‌রে?’
‘আস‌লে ব্যবসা এখনও আপনা‌দের বেয়াই-ই সামলায়। রাযীন তা‌কে হেল্প ক‌রে। ভা‌সি‌র্টি‌তে পড়াকালীন সময় থে‌কেই ও অফিস যা‌চ্ছে, ওর বাবা‌কে টুকটাক হেল্প করত। তারপর গ্রাজু‌য়েশন কম‌প্লিট করার পর, ওর বাবার কাজ কমা‌নোর জন্য নি‌জেও অফিস যাওয়া শুরু কর‌ছে। ব্যবসার কাজ শিখ‌তে শিখ‌তে মাস্টার্সও শেষ ক‌রে‌ছে। ধী‌রে ধী‌রে ব্যবসাটা গু‌ছি‌য়ে নি‌চ্ছে। এত বড় ব্যবসা সামলা‌নোর জন্য ও এখনও অনেক ছো‌টো। ওর বাবা, ওকে সহ‌জে করা যায় এমন কাজগু‌লো আপাতত দি‌চ্ছে। ধী‌রে ধী‌রে ব্যবসার ভার দি‌চ্ছে ওকে। সব একসা‌থে দি‌লে তো‌ ও সামলাতে পার‌বে না। সে কার‌ণে আস্তে ধী‌রে ব্যবসার ভার দি‌চ্ছে। যা‌তে ওর সহন শ‌ক্তি বা‌ড়ে, ব্যবসা সম্প‌র্কে বুঝ ব্যবস্থা বা‌ড়ে। আর ছে‌লেও আমার আলহামদু‌লিল্লাহ খুব মেধাবী। অল্প‌তেই সব শি‌খে নেয়। ত‌বে ও ওর বাবার পরামর্শ ছাড়া অফি‌সিয়্যাল কো‌নো কাজ করে না, ‌কিংবা ব্যবসা‌য়িক কো‌নো সিদ্ধান্ত-ও নেয় না। যে, কো‌নো কাজ কর‌তে গে‌লে আগে ওর বাবা‌কে জানায়, তার সা‌থে আলোচনা ক‌রে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়।’
‘বাহ্! শু‌নে বেশ লাগল।’
তারা দুই বেয়ান গল্প কর‌তে লাগল। রো‌মিসা দু’জনার মা‌ঝে খুব বোর হ‌চ্ছে। ম‌নে বলল,
‘দু’জন মা‌য়ের সা‌থে ঘুমা‌নো মুখের কথা না! আই মিস মাই উডবি হা‌বি।’
রো‌মিসা চু‌পি চু‌পি কা‌নে ইয়ার-প্লাগ গু‌ঁজে ঘু‌মি‌য়ে পড়ল।

৪০!!
রেনু,শিহাব‌কে বলল,
‘আপনার মন ভা‌লো হ‌য়ে‌ছে?’
‘স‌ত্যি বল‌তে না।’
‘‌কো‌নো সমস্যা?’
‘‌সেই অতীত আমার বর্তমা‌নে প্রভাব ফেল‌ছে।’
‘একটা কথা ব‌লেন?’
‘ব‌লো?’
‘আপ‌নি এত‌দিন তো মু‌ক্তির কথা বল‌লেন না বা টেনশনও কর‌তে না। তাহ‌লে হঠাৎ এমন কী হলো যে, আমার কা‌ছে সব কন‌ফেস কর‌লেন?’
‘আমা‌দের বাচ্চার মিসক্যা‌রেজ।’
‘মা‌নে?’

দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে শিহাব বলল,
‘আমা‌দের সন্তা‌নের মিসক্যা‌রেজ হওয়ার পর থে‌কেই ম‌নে হ‌চ্ছে, হয়‌তো মুক্তির অনাগত সেই সন্তা‌নের অভিশা‌পেই আমার বাচ্চা পৃ‌থিবীতে আসার আগেই মৃত্য‌ু বরণ করল। হয়‌তো আমার পা‌পের ফল তু‌মি আর আমা‌দের অনাগত সন্তান পে‌লে। সে‌দিন মু‌ক্তি‌কে গ্রহণ না কর‌লেও, অন্য ভা‌বে বুঝা‌তে পারতাম। ওর সা‌থে খারাপ ব্যবহার না ক‌রে, অন্যভাবে ওকে হেল্প কর‌তে পারতাম। তা‌তে হয়‌তো ও আত্মহন‌নের ম‌তো কাজ কর‌তো না। হয়‌তো ও আর বাচ্চাটা বেঁ‌চে থা‌কতো।’

‌রেনু খা‌নিকটা রে‌গে বলল,
‘‌দিস ইজ টু মাচ শিহাব!’
‘‌কেন?’
‘আপনা‌কে এতো ক‌রে বোঝা‌নোর পরও আপ‌নি এ কথা বল‌ছেন? একটা কথা ব‌লেন, আপনার বা আমার পা‌পের ফল আমা‌দের সন্তান কেন ভোগ কর‌বে? একথা কখনও শু‌নে‌ছি ব‌লে ম‌নে হ‌চ্ছে না। যার যার পা‌পের ফল সে-ই ভোগ করবে। আপনার পা‌পের ফল একটা নিষ্পাপ বাচ্চা কেন ভোগ কর‌বে? আর সে তো পৃ‌থিবী‌তে আস‌তেই পা‌রে‌নি। আল্লাহর য‌দি তা‌কে দেয়ার হ‌তো, ত‌বে শত চেষ্টা ক‌রেও আপ‌নি তার পৃ‌থিবী‌তে আসা আটকা‌তে পার‌তেন না। সে হোক মু‌ক্তির সন্তান কিংবা আমার আপনার সন্তান। সৃ‌ষ্টিকর্তা তার বুঝ ম‌তো পৃ‌থিবী‌তে কাউ‌কে পাঠান। আবার তার ইচ্ছা‌তেই পৃ‌থিবী থে‌কে নি‌য়ে নেন। সবটা মহান সৃ‌ষ্টিকর্তার ইচ্ছ‌া। এ জন্য প্লিজ এ বা‌জে কথাগু‌লো আর বল‌বেন না।’
‘আচ্ছা বল‌বো না।’
‘শুধু এই কার‌ণেই আপনার অতীত আমা‌কে বল‌লেন?’
‘না। আরেকটা কারণ আছে।’
‘কী কারণ?’
‘নওশীন।’
‘নওশীন! মু‌ক্তির বোন?’
‘হ্য‌াঁ।’
‘সে কী ক‌রে‌ছে?’
‘নওশীন আমা‌কে থ্রেট ক‌রে‌ছে আমার সংসার ও ভাঙ‌বে।’
‘‌কেন?’
‘ও মু‌ক্তি আর আমা‌র বি‌য়ের কথা জা‌নে বাট ডি‌ভোর্স, মুক্তির চিটা‌রি, রু‌মেল সা‌হেব এদের কথা জা‌নে না। কারণ সে সময় ও দে‌শে ছি‌লো না। ও খুব ভা‌লো ছাত্রী ছিলো। স্কলারশীপ পে‌য়ে লন্ড‌নে চ‌লে যায়। সেখা‌নেই পড়া-লেখা, বি‌য়ে সব ক‌রে এবং সে‌টেল হয়। মু‌ক্তির এক‌সি‌ডেন্ট করা এবং সেখা‌নে আমার উপস্থিত থাকা এবং আমারও এক‌সি‌ডেন্ট হওয়া সেসব কার‌ণে ও ভা‌বে মু‌ক্তি আমার কার‌ণে মারা গে‌ছে। সে‌দিন নওশী‌নের সা‌থে যোগা‌যোগ হওয়ার পর আমি ওর সম্প‌র্কে টুকটাক খোঁজ নিয়েছি। মাসখা‌নিক আগে ও দে‌শে ফি‌রে‌ছে। দে‌শে ফি‌রেই আমার খোঁজ কর‌তে ফ‌রিদপুর এসে‌ছে। ফ‌রিদপুর নওশী‌নের ভীষণ অপছ‌ন্দের স্থান। কারণ ওর প্রাক্তন প্রে‌মিকও ফ‌রিদপু‌রের। সে কার‌ণে এ শহর ওর ভীষণ অপছ‌ন্দের। তবুও ও আমা‌কে খুঁজ‌তে এসে‌ছে। কিন্তু সে‌দিন যখন তোমার সা‌থে দেখা হ‌লো, ও তখন থে‌কে ভাবল, ওর বোন বেঁ‌চে নেই ত‌বে আমি কেন সু‌খে সংসার কর‌ছি। ও চে‌য়ে‌ছি‌লো আমি মু‌ক্তির শো‌কে কাতর হ‌য়ে সারাজীবন একা কাটাই। কিন্তু ও যখন দেখ‌লো, আমি তোমার সা‌থে সু‌খে আছি সেটা মে‌নে নি‌তে পা‌রে‌নি। তাই আমা‌কে মে‌সেজ ক‌রে হুম‌কি দি‌য়ে‌ছে আমার সংসার ও ভাঙ‌বে।’

সব শু‌নে দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে রেনু বলল,
‘এ কার‌ণেই ব‌লে আগের হাল যেম‌নে চ‌লে, পিছ‌নেরটা তেমন চ‌লে। বড়বোন ছি‌লো উচ্ছাকাঙ্ক্ষী আর ছো‌টো বো‌নের নাটবল্টু ডিলা সংকীর্ণমন‌া। মা‌নে ওর বোন মারা গেছে ব‌লে আপ‌নি বি‌য়ে না ক‌রে সারা‌জীবন হায় হ‌ায় কর‌বেন? এটা কেমন ল‌জিক? যেখা‌নে পুরুষ মানুষ বউ মরার দুই-তিন মা‌সের মাথায় বি‌য়ে‌ ক‌রে, সেখা‌নে আপ‌নি ওর বোন মরার প্রায় বা‌রো-তে‌রো বছর পর বি‌য়ে ক‌রে‌ছেন। তারপর কী কর‌তে হ‌বে? ওর অসভ্য বো‌নের ছ‌বি মাথ‌ায় নি‌য়ে নাচ‌তে হ‌বে? না‌কি বু‌কে তার নাম খোদাই ক‌রে প‌থে প‌থে পাগলের ম‌তো‌ ঘু‌রে ঘু‌রে গান গাই‌তে হ‌বে? আর আপ‌নি ওকে মু‌ক্তির আসল রূপটার কথা কেন বল‌ছেন না?’
‘আ‌মি বল‌লে ও মান‌বে না। ও আমার কথা মো‌টেও বিশ্বাস কর‌বে না?’

রেনু কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল,
‘আপনা‌দের বি‌য়ে, ডি‌ভোর্স, মু‌ক্তির লুচ্চা‌মির কথা আপ‌নি ব্য‌তিত আর কে জা‌নে?’
‘মু‌ক্তির বেস্ট ফ্রেন্ড মা‌হিন।’
‘তাহ‌লে মা‌হিন বল‌বে নওশীন‌কে।’
‘মা‌হিন বল‌তে চায় না। ও চায় না ওর মৃত বন্ধু‌কে কেউ ঘৃণা করুক।’
‘‌যে সা‌ধের বন্ধু তার জন্য এত দরদ। আপনার কা‌ছে মাহিনের ফোন নাম্বার আছে?’
‘আছে।’
‘এত বছর পর ফোন নাম্বার কী ক‌রে যোগাড় কর‌লেন?’
‘নওশীন হুম‌কি দেয়ার পর, ভয় পে‌য়ে গেছিলাম। মা‌হিনও আমা‌দের সা‌থেই মাস্টার্স ক‌রে‌ছি‌লো। বহু ক‌ষ্টে ভা‌র্সি‌টির পুরা‌নো রে‌জিস্ট্রার থে‌কে একটা ফোন নাম্বার পাই। লা‌কি‌লি সেটা মা‌হি‌নের বাবার নাম্বার ছি‌লো এবং চালু ছি‌লো। তার কাছ থে‌কে মা‌হি‌নের নাম্বার পে‌য়ে‌ছিলাম। মা‌হিন‌কে ফোন ক‌রে ব‌লে‌ছিলাম যা‌তে নওশীন‌কে বোঝায়। কিন্তু সে নারাজ বোঝা‌তে।’
‘আচ্ছা আপ‌নি নাম্বারটা উঠি‌য়ে কল দি‌য়ে আমাকে দিন।’
‘তু‌মি কী কথা বল‌বে?’
‘‌সেটা আমি ভে‌বে দেখব।’

রাত বা‌রা‌টার সময় কা‌রো কল পে‌য়ে বিরক্ত নি‌য়ে কল রি‌সিভ করল মা‌হিন। রেনু কল রিসিভ করার পর প্রথমে সালাম দি‌লো।’
‘হ্যা‌লো! আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
‘মা‌হিন সা‌হেব বল‌ছেন?’
‘‌জি। আপ‌নি কে?’
‘খুব বিপ‌দে প‌ড়ে কল করলাম।’
‘প‌রিচয় দি‌লে খু‌শি হতাম?’
‘আমার নাম রেনু।’
‘‌কোন রেনু?’
‘আ‌মি শিহাবের স্ত্রী। আপনার বান্ধুবী মু‌ক্তির সা‌থে যার সম্পর্ক ছি‌লো সেই শিহা‌বের স্ত্রী।’

মা‌হি‌নের ঘুম পু‌রোপ‌ু‌রি উড়ে গেল। রুম থে‌কে বাই‌রে গি‌য়ে বলল,
‘এত রা‌তে আপনার ফোন! জরু‌রি কিছু?’
‘‌জি খুব জরুরি।’
‘বলুন?’
‘নওশীন আপু আমার সংসার ভাঙার জন্য উঠে প‌ড়ে লে‌গে‌ছে। দয়া ক‌রে আপ‌নি তা‌কে স‌ত্যিটা ব‌লে দিন। দেখুন মু‌ক্তি আপা তো মারা গে‌ছে। চাই‌লেও সে ফির‌বে না। কিন্তু কিছু না জানার কার‌ণে নওশীন আপা আমার সংসা‌রে আগুন লাগা‌বে। মু‌ক্তি আর শিহা‌বের বি‌য়ে, ডি‌ভো‌র্স এবং বা‌কি ঘটনা কেউ জা‌নে না, আপ‌নি ছাড়া। নওশীন আপা শুধু বি‌য়ের কথা জা‌নে। শিহাব আগেই আমা‌কে সব খু‌লে ব‌লে‌ছে।
দেখুন আপ‌নি য‌দি নওশীন আপা‌কে সব খু‌লে না ব‌লেন, তাহ‌লে আমার সংসার ভে‌ঙে যা‌বে। আমার শ্বশুর অসুস্থ মানুষ তি‌নি এসব শুন‌লে সহ্য ক‌রতে পার‌বে না, হয়‌তো ম‌রে যাবে। আপ‌নি একজন মৃত মানু‌ষের সম্মান রাখ‌তে একজনার সংসার ভাঙ‌তে পার‌বেন? আমার শ্বশুর‌কে মৃত্য‌ু‌র মু‌খে ঠে‌লে দি‌তে পার‌বেন? আর মু‌ক্তি আপার সি‌ক্রেট আপ‌নি তো বাই‌রের কাউ‌কে নয় বরং তার ছো‌টো বোন‌কে বল‌বেন। সে নিশ্চয়ই সে কথা দু‌নিয়া‌কে ব‌লে বেড়া‌বে না? এতে মু‌ক্তি আপার সম্মানহানী হ‌বে না, বরং আমার প‌রিবারটা বেঁ‌চে যা‌বে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আমার কথাগু‌লো ভে‌বে ‌দেখ‌বেন।
আমি আপনার চে‌য়ে বয়‌সে অনেক ছো‌টো। আপনার ছো‌টো বো‌নের বয়সী। আপ‌নি নিশ্চয়ই চাই‌বেন না আপনার ভু‌লে আপনার ছো‌টো বো‌নের ম‌তো কারও সংসার ভে‌ঙে যাক? প্লিজ আমার কথাগু‌লো ভে‌বে দেখ‌বেন।’

মা‌হিন এতক্ষণ ম‌নো‌যোগ দি‌য়ে রেনুর কথা শুনছিলো। তারপর বলল,
‘আ‌মি চাই না আমার কার‌ণে ক‌‌ারও সংসার-ই ভাঙুক কিংবা কারও প্রাণহানী হোক। আমি নওশীন‌কে সবটা খু‌লে বল‌বো।’
‘বড় উপকার কর‌লেন ভাই।’

‌রেনু কলটা কে‌টে শিহাবের ‌দি‌কে তাকাল। শিহাব এতক্ষণ হতভম্ব হ‌য়ে রেনুর কথা শুন‌ছিলো। তারপর বলল,
‘‌তোমার তো অসম্ভব বু‌দ্ধি রেনু!’
‘মা‌ঝে মা‌ঝে কথার মারপ্যা‌চেও মানুষ‌কে কাবু ক‌রা যায়।’
‘‌সেটাই তো দেখলাম।’
‘এখন নওশী‌নের নাম্বারটা ফো‌নে তুলে দিন। শিহাব ওর ফো‌নে নওশী‌নের নাম্বার দি‌লো। রেনু শিহা‌বের ফোন থে‌কে নওশীন‌কে মে‌সেজ করল,
“নওশীন আমার সংসার ভাঙার আগে দয়া ক‌রে মু‌ক্তির বেস্ট ফ্রেন্ড মা‌হি‌নের সা‌থে কথা ব‌লে নিও। তারপর য‌দি তোমার ম‌নে হয়, আমার সংসার ভ‌াঙা উচিত, তো তু‌মি ভে‌ঙো। আমার কো‌নো আপ‌ত্তি থাক‌বে না।”

—শিহাব

‌মেসেজ সেন্ড হবার কিছু মুহূর্ত পরই রিপ্লাই আসলো, “Ok”।

‌রেনুর উপ‌স্থিত বু‌দ্ধি‌ দে‌খে শিহাব রী‌তিমত বাকরুদ্ধ। শিহাব, রেনু‌কে বলল,
‘‌রেনু তুমি জাস্ট অসাধারণ! জাস্ট অসাধারণ।’
‌রেনু মৃদু হাসল। তারপর বলল,
‘‌শিহাব কিছু চাই‌বো আজ দি‌বেন?’
‘তু‌মি যা চাই‌বে তাই দি‌বে‌া।’
‘আ‌মি কিছু‌দিন চট্টগ্রাম থাক‌তে চাই।’
‘এখন কীভা‌বে থাকব ব‌লো? আমার বস‌ তো ছু‌টি দি‌বেন না।’
‘আপ‌নি না শুধু আমি একা থাকব‌।’
‘মা‌নে?’
‘‌শিহাব বিগত কিছু‌দিন যাবত, আমার শারীর এবং ম‌নের উপর দি‌য়ে বহু ঝড় গে‌ছে। আমি নি‌জে‌কে কিছুদিন সময় দি‌তে চাই। একা‌ন্তে কিছুদিন কাটা‌তে চাই। আমা‌দের সম্পর্কটা‌কে আগের ম‌তো স্বাভা‌বিক কর‌তে হ‌লে, এখন আমা‌দের কিছু‌দিন একে‌ অপ‌রের থেকে দূ‌রে থাকাই শ্রেয় ব‌লে আমি ম‌নে ক‌রি।
আমি শশীর সাথেও কথা ব‌লে‌ছি। ও তো খু‌শিম‌নে রাজি হয়ে‌ছে।’
‘‌কিন্তু রেনু এখা‌নে থাক‌বে?’
‘এখা‌নে থাক‌লে অনেকগু‌লো স‌ু‌বিধা আছে। যেমন: আমরা একে অপরের থে‌কে দূ‌রে থে‌কে নি‌জেরা নি‌জে‌দের সা‌থে সময় কাটা‌তে পারব। নি‌জেরা নি‌জে‌দের মনের কথাটা বুঝব। দূরে থাকার কারণে আমরা একে অপর‌কে মিস করব, ফ‌লে একে অপ‌রের প্র‌তি বিশ্বাস-ভা‌লোবাসা বাড়‌বে। আবার নি‌জে‌দের সম্পর্ক নি‌য়ে ভে‌বে বুঝ‌তে পারব ঠিক কীভা‌বে সু‌যোগ দি‌লে আমা‌দের সম্পর্কটা আগের চে‌য়ে সুস্থ সুন্দর স্বাভা‌বিক হ‌বে।
শিহাব, মা‌ঝে মা‌ঝে ভা‌লোবাসার মা‌ঝে দূরত্ব সম্পর্ক খারাপ ক‌রে ন‌া বরং ভালোবাসা বা‌ড়ি‌য়ে সম্পর্ক আরও মজবুত ক‌রে। আর সব‌শেষ কথা শশীরও খেয়াল রাখ‌তে পারব। রাযীন সা‌হেব কত‌দিন ঘ‌রে থাক‌বে, তারও তো কাজ আছে। আর আমারও কক্সবাজার ঘু‌রে দেখা হ‌বে। আপ‌নি নাহয় ক‌দিন পর এসে আমা‌কে নি‌য়ে গে‌লেন।’
‘‌কিন্তু রেনু।’
‘‌প্লিজ শিহাব, না কর‌বেন না। আমি দূরত্ব বজায় রাখ‌তে আমা‌দের বা‌ড়িও যে‌তে পারতাম। কিন্তু সেখা‌নের মানু‌ষের খোঁচা‌নো কথা আমা‌কে মান‌সিভাবে খুব‌ অশা‌ন্তি দেয়। ঘ‌রে-বাই‌রে সব জায়গায়ই তা‌দের কথা শুন‌তে শুন‌তে আমি ত্যক্ত বিরক্ত। প্লিজ শিহাব, বাবা-মা‌কে রাজী করান। আর না কর‌বেন না।’

‌শিহাব, রেনু‌কে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘‌তোমা‌কে ছাড়া এত‌দিন থাক‌বো কী করে?’
‘একটু ম্যা‌নেজ ক‌রে নিন। ক‌’দিনপর যখন কা‌ছে আস‌বেন তখন হয়‌তো সম্পূর্ণ নতুন এক রেনু‌কে পা‌বেন। যে বুক ভরা ভা‌লোবাসার ঢালা সা‌জি‌য়ে আপনার জন্য অপেক্ষা কর‌ছে।’
‌শিহাব আর না কর‌তে পারল না। রজি হয়ে গেল রেনুর কথায়। ভে‌বে দেখ‌লো, ‘আস‌লেই রেনুর কথায় যু‌ক্তি আছে। মা‌ঝে মা‌ঝে দূরত্ব ভা‌লোবাসা স‌ত্যি বাড়ায়।’

৪১!!
রাযীন, শশী‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে ব‌সে আছে। শশী বলল,
‘আমার বিরক্ত লাগ‌ছে এখন।’
‘‌কেন?’
‘এই পা‌য়ের প্লাস্টার, সারা‌দিন ব‌সে থাকা, তোমা‌কে বারবার বিরক্ত করা।’
‘আ‌মি কী ব‌লে‌ছি আমি বিরক্ত হ‌চ্ছি।’
‘জা‌নি তু‌মি বিরক্ত হ‌চ্ছো না। কিন্তু আমার সব‌কিছু অসহ্য লাগ‌ছে।’
‘মুড সুইং হ‌চ্ছে না‌কি? তোমার ডে‌ট তো এখনও সপ্তাহ দুই বাকি।’
‘মুড সুইং হ‌চ্ছে না, অসহ্য লাগ‌ছে।’
‘আ‌মা‌কে কী কর‌তে হ‌বে?’
‘আরও শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রো।’

রাযীন মৃদু হে‌সে শক্ত ক‌রে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে শশীর গলায় নাক ঘষ‌তে ঘষ‌তে বলল,
‘আর কিছু?’
শশী, কিছুক্ষণ চ‌ুপ থে‌কে বলল,
‘আই…!’
তারপর চুপ হ‌য়ে গেল। রাযীন, শশী‌কে নাড়া দি‌য়ে বলল,
‘কী হলো ব‌লো?’
‘নাহ কিছু না।’
‌কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর শশী বলল,
‘রাযীন!’
‘হ্যাঁ।’
‘একটু আদর করবা?’
রাযীন বেশ চম‌কে উঠল। তারপর শশীর সাম‌নে এসে, ওর চো‌খের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বল‌ল,
‘কী বলল‌া?’
শশী লজ্জায় চোখ বন্ধ ক‌রে বলল,
‘‌কিছু না, কিছ‌ু না।’
রাযীন, শশী হাত ধ‌রে বলল,
‘নাহ ব‌লো।’
‘বললাম তো কিছু না। যাও ঘুমাও।’

রাযীন, শশীর কপা‌লের সা‌থে নি‌জের কপাল ঠে‌কি‌য়ে বলল,
‘কতটু‌কো আদর চাই?’
শশী ফিস‌ফিস ক‌রে বল‌ল,
‘একটুখা‌নি ছোট আদর।’
রাযীন দুষ্ট‌ু হে‌সে বলল,
‘‌ছোট আদর কাহা‌কে ব‌লে।’
শশী বিছানায় শু‌য়ে, লজ্জায় বা‌লি‌শে মুখ লু‌কি‌য়ে বলল,
‘আ‌মি জা‌নি না।’
রাযীন, শশী‌কে কা‌ছে টে‌নে নি‌লো। তারপর কপা‌লে, গা‌লে, চো‌খে, গলায়, ঠো‌ঁটে অনেকগু‌লো আদর দি‌য়ে বলল,
‘হ‌য়ে‌ছে না‌কি আরও চাই।’

শশী লজ্জায় কথাও বলতে পার‌ছি‌লো না। এদি‌কে রাযী‌নের পাগল করা স্প‌র্শে শরী‌রটা হাল ছে‌ড়ে দি‌য়ে‌ছে। ‌চোখ বন্ধ ক‌রে, শশী ফিস‌ফিস ক‌রে বলল,
‘আর কিছু চাই না। তুমি আর আমার দি‌কে তাকা‌বে না। নয়তো তোমার চাহনী‌তে আজ আমার মরন হ‌বে।’
শশী চোখ বন্ধ ক‌রে রইল। রাযীন বুঝ‌তে পা‌রছে, শশী ওকে ভা‌লো‌বে‌সে ফে‌লে‌ছে কিন্তু প্রকাশ কর‌তে পার‌ছে না কো‌নো কার‌ণে। রাযীন ম‌নে ম‌নে বলল,
‘আ‌মি অপেক্ষা করব সেই ক্ষ‌ণের যে, ক্ষণে তু‌মি আমায় ভা‌লোবা‌সি বল‌বে। আমি জা‌নি সে‌দিন বেশি দূ‌রে নয়! শুধ‌ু তোমার বলার অপেক্ষা, আমার হৃদয় উজার করা ভা‌লোবাসা পে‌তে তোমা‌কে একটুও অপেক্ষা কর‌তে হ‌বে না। রাযীন, শশীর দি‌কে তা‌কি‌য়েই রইল। শশীর চোখ পিট‌পিট কর‌ছে, ঠোঁট নড়‌ছে। নীল র‌ঙের ড্রিম লাই‌টের মৃদু আলোয় কী সুন্দর দেখা‌চ্ছে ওকে! অপূর্ব মোহময়ী লাগ‌ছে। রাযীন গভীরভা‌বে শশী‌কে নি‌জের বু‌কে টে‌নে নি‌লো।

সকালবেলা নাস্তার পর সবাই ফ‌রিদপুর ফেরার জন্য তৈরী হ‌লো। কেউ-ই থাক‌তে পারবে না। শুধু রেনু ক’‌দিন থা‌কবে। শিহাব, শশী মি‌লে হা‌সি বেগম‌কে রাজী করি‌য়ে‌ছে। তি‌নি অবশ্য ম‌নে ম‌নে খু‌শি হ‌য়ে‌ছেন এটা ভে‌বে যে, শশী‌কে নি‌য়ে তার চিন্তা করতে হ‌বে না! রেনু‌কে তি‌নি যতই অপছন্দ করুক না কেন, তি‌নি জানে রেনু খুব ভা‌লো মে‌য়ে। এবং রেনু, শশীর খেয়াল খুব ভা‌লো ক‌রে রাখ‌বে। মূলত শশীর কথা ভে‌বেই হা‌সি বেগম রেনু‌কে রে‌খে যে‌তে রাজী হ‌য়ে‌ছেন।

যাবার পূ‌র্বে শিহাব, রেনু‌কে আড়‌া‌লে টে‌নে নি‌য়ে গি‌য়ে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘‌রেনু এখনও বল‌ছি চ‌লো। আমি একা কীভা‌বে থাকব?’
রেনু খা‌নিক ক‌ঠিন হ‌য়ে বলল,
‘মা‌য়ের বু‌ড়োখোকা ব‌লে কী? এত বড় ছে‌লে না‌কি বউ ছাড়া থাক‌তে পার‌বে না। ব‌লি বা‌ড়ি‌তে কি আপ‌নি একা থাক‌বেন? বা‌ড়ির সবাই থা‌কবে না?’
‘বা‌ড়ির সবাই তো আমার বউ না?’
‌রেনু হে‌সে বলল,
‘‌কেন বউ বা‌ড়ি‌তে থাকা খুব প্র‌য়োজন?’
‘অবশ্যই। বউ ছাড়া বা‌ড়ি‌তে থাকা কত যন্ত্রণার তু‌মি বুঝ‌বে না।’
‘‌শিহাব আপনার কথা শু‌নে ম‌নে হ‌চ্ছে আপনার বয়স বাইশ বছর।’
‘দে‌খো কথায় কথায় বয়‌সের খোটা দি‌বে না। আমি মন থে‌কে নি‌জে‌কে বাইশ বছ‌রের য‌ুবক মা‌নি।’

‌রেনু শব্দ ক‌রে হে‌সে বলল,
‘আচ্ছা বুঝলাম। এখন যান তো। ক’‌দিন পর এসে নি‌য়ে যা‌বেন আমা‌কে।’
‘‌শিওর?’
‘এখন কিন্তু রাগ হ‌চ্ছে খুব।’
‘ও‌কে ওকে রাগ ক‌রো না।’
‌শিহাব, রেনুর কপা‌লে চু‌মো খে‌য়ে, জড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘ভা‌লোবা‌সি।’
‘আ‌মিও।’
শশী ‌পিছন থে‌কে বলল,
‘আ‌মিও তো‌দের খুব ভা‌লোবা‌সি।’
‌রেনু, শিহা‌বের থে‌কে নি‌জে‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে বলল,
‘তু‌মি কখন এলে?’
‘যখন তোমরা দূরত্ব হ‌বে ব‌লে, একে অপ‌রের দহ‌নে জ্বল‌ছি‌লে তখন। শশী, শিহাব‌কে বলল, ভাই মাত্র তো ক‌’দিন। এই ক‌’দিনের বিরহ সহ্য কর না। দূরত্ব ভা‌লোবাসা বাড়ায়।’

‌রেনু, শিহাব হাসল। সবাই বিদায় নি‌য়ে চ‌লে গে‌ল। রেনুরও মন খারাপ লাগ‌ছে কিন্তু শিহাব‌কে সেটা ব‌ুঝতে দি‌চ্ছে না। রেনু ম‌নে ম‌নে বলল,
‘আমার স‌ত্যি কিছু সময় চাই শিহাব। আপনার সম্প‌র্কে সব‌কিছু জে‌নে সহ‌জে সব মে‌নে নি‌লেও, আমি আমার মনটা‌কে সহ‌জে মানা‌তে পার‌ছি না। আমার মনের সব কিছু গু‌ছি‌য়ে নি‌তে সময় লাগ‌বে। সে কার‌ণে এখন দূরত্বটা খুব জরু‌রি।’

সবাই চ‌লে যাবার পর রেনু, শশী‌কে বলল,
‘রাযীন ভাই‌ কি এখন অফিস যা‌বে?’
‘সবাই‌কে এগি‌য়ে দি‌য়ে আসুক তারপর জি‌জ্ঞেস কর‌ছি। ভা‌বি হুইল চেয়া‌রে বসার পর থে‌কে নি‌জে‌কে পঙ্গু পঙ্গু মনে হ‌চ্ছে।’
‘‌ছি এগু‌লো কী বল‌ছো?’
‘ভা‌বি চা খাওয়া‌বে? সকাল থে‌কে চা খাই‌নি।’
‘আচ্ছা ব‌সো নি‌য়ে আস‌ছি।’
‘আ‌মিও আস‌ছি রান্নাঘ‌রে। তু‌মি খুঁ‌জে পা‌বে না কোনটা কোথায়?’
‘আচ্ছা।’

শশী, রেনু চা বানা‌চ্ছে। তখন রাযীন এসে বলল,

চল‌বে…

#এক‌দিন_বিকা‌লে_সকাল_হ‌য়ে‌ছি‌লো
‌লেখকঃ শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩৪

রান্নাঘ‌রে টুং টাং শব্দ আর কথার আওয়াজ শু‌নে রাযীন সেখা‌নে গেল। গি‌য়ে দে‌খে শশী আর রেনু চা বানা‌চ্ছে। শশী, রযী‌নকে দে‌খে বলল,
‘চা খা‌বে?’
‘‌দি‌তে পা‌রো।’
‘তু‌মি জা‌নো না, ভা‌বি কত ভা‌লো চা বানায়! তার হা‌তের চা খে‌লে তার ফ্যান হয়ে যা‌বে।’
‘তাহ‌লে তো খে‌তেই হয়।’

রেনু তিনকাপ চা বা‌নি‌য়ে নি‌য়ে বসার রু‌মে বস‌লো। রাযীন চা’‌য়ে চুমুক দি‌য়ে বলল,
‘ওয়াও ভা‌বি, স‌ত্যি চমৎকার চা বানান।’
রেনু বেশ লজ্জা পেল। শশী বলল,
‘ভা‌বি আমা‌কেও এমন ক‌রে চা বানা‌নো শি‌খি‌য়ে দি‌য়ে যা‌বে।’
‌রেনু বলল,
‘আচ্ছা।’
রাযীন বলল,
‘চা ভা‌লো তখন হয়, যখন চা পাতা, চি‌নি, দুধ সব‌কিছু পার‌ফেক্ট‌লি প‌রিমাণ ম‌তো দেওয়া হয়। ঠিক কি-না ভা‌বি?’
‌রেনু বলল,
‘হ্যাঁ।’
শশী বলল,
‘রাযীন, তু‌মি অফিস যা‌বে?’
‘না এখন না গে‌লেও হ‌বে। দুপু‌রে খাবার পর যা‌বো।’
‌রেনু বলল,
‘এগা‌রোটা‌তো বা‌জে। আমি রান্নাটা ব‌সি‌য়ে দি।’

রাযীন বলল,
‘ভা‌বি ব‌সেন। উতলা হওয়ার কিছু নাই। আমি অল‌রে‌ডি দুপু‌রের খাবার অর্ডার ক‌রে‌ছি। ঠিক একটার সময় দিয়ে যা‌বে। আপনা‌কে এখা‌নে রান্নার জন্য তো রাখা হয়নি। কাজ তো মে‌য়েরা তার সংসা‌রে সারাজীবনই ক‌রে। এ কার‌ণে কোথাও যখন কো‌নো মে‌য়েরা বেড়া‌তে যায়, তখন সেই বা‌ড়ির লোক‌দের উচিত তা‌কে দি‌য়ে কো‌নো কাজ না করা‌নো। বেড়া‌তে যায় মানুষ রিলাক্স হ‌তে, নি‌জে‌কে একটু বিশ্রাম দিতে। সেখা‌নে গিয়েও য‌দি কাজ কর‌তে হয়, তাহ‌লে কেমন হয় ব‌লেন? আপ‌নি যত‌দিন এখা‌নে থাক‌বেন আপনার প্রথম কাজ হ‌চ্ছে নি‌জে‌কে সময় দি‌বেন, রিলাক্স কর‌বেন, ফাঁ‌কে ফাঁ‌কে আমি যখন থাকব না, তখন শশীর সাথে একটু সময় কাটা‌বেন। আর মা‌ঝে মা‌ঝে তিনজন মি‌লে আড্ডা দিব।’

রেনু হে‌সে বলল,
‘‌সে না হয় বুঝলাম কিন্তু রোজ রোজ হো‌টে‌লের রান্না খাওয়‌া ঠিক হ‌বে না।’
‘‌রোজ নয় শুধু আজ। কাল থে‌কে পারমা‌নেন্ট কা‌জের লোক পে‌য়ে গেছি। নাম রুমা।’
‘তবুও আমি যত‌দিন থাকব, রান্নাটা আমিই করব। আমার রান্না কর‌তে ভা‌লো লা‌গে।’
‘আচ্ছা তাহ‌লে রুমা আপা সব ক‌রে দি‌বে, আপ‌নি শুধু রান্না কর‌বেন। বা‌কি কো‌নো কাজ কর‌তে পার‌বেন না। শশীর কো‌নো কাজও না। শশীর জন্য আমি একাই য‌থেষ্ট। কি শশী ঠিক বললাম তো?’
শশী হে‌সে বলল,
‘একদম ম‌নের কথা বল‌ছো। আর তু‌মি সময় ক‌রে ভা‌বি‌কে নি‌য়ে ঘুর‌তে যা‌বে।’
‘হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা তিনজনই ঘুর‌তে যা‌বো।’
‘আ‌মি কীভা‌বে যা‌বো?’
‘‌কেন রোজ ছয়‌বেলা টয়‌লেটে কীভা‌বে নি‌য়ে যাই? তেমন কো‌লে ক‌রে নি‌য়ে যাব।’
‘হা হা তুমি পাব‌লিক প্লে‌সে আমা‌কে কো‌লে করে ঘুর‌বে?’
‘না হয় ঘুরলাম, প্রব‌লেম কী? নি‌জের বউ কো‌লে নি‌য়ে পাবলিক প্লে‌সে ঘুর‌লেও কার বা‌পের কী?’
শশী হে‌সে বলল,
‘হ‌য়ে‌ছে। গাড়ির পিছ‌নে হুইল চেয়ারটা নি‌য়ে নিও ত‌বেই হ‌বে।’

রাযীন, শশী, রেনু তিনজ‌নেই হাসল। শশী, রেনু‌কে বলল,
‘ভা‌বি তু‌মি কতদূর লেখা পড়া ক‌রে‌ছো? স‌রি ভা‌বি তোমার সা‌থে সম্পর্ক খারাপ থাকায় তোমার সম্প‌র্কে কিছুই জা‌নি না।’
‘আ‌রে সমস্যা নেই। আমি ইং‌রেজীতে অনার্স কম‌প্লিট ক‌রে‌ছি।’
শশী অব‌‌াক হয়ে বলল,
‘ই‌রেজীতে?’
‘হ্যাঁ।’
‘‌তোমার সি‌জি‌পিএ কত?’
‘3.51.’
‘রি‌য়েলী?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভা‌বি তুমি তো ত‌বে অনেক ভা‌লো ছাত্রী ছি‌লে। মাস্টার্স ক‌রে‌ছো?’
‘নাহ গতবার ফর্ম পূরণ ক‌রি‌নি।’
‘‌কেন?’
‘এম‌নি।’
‘এটা কোনো কথা? এম‌নি এম‌নি কেউ কো‌নো কারণ ছাড়া পড়ালেখা ছা‌ড়ে?’

‌রেনু কিছুক্ষণ চ‌ুপ ক‌রে রইল। তারপর বলল,
‘শশী, তোমার ম‌তো আমার জীবনটা স্বাভা‌বিক ছি‌লো না। আমাকে সব কিছুর জন্য সংঘর্ষ কর‌তে হ‌য়ে‌ছে অনেক। আমার যখন প্রথম বি‌য়ে হয় তখন আমি অনার্স ২য় ব‌র্ষে ফাইনা‌লে ছিলাম। বি‌য়ের ক‌’দিন পরই পরীক্ষা শুরু হয়। কিন্তু বি‌য়ের মাত্র এক সপ্তা‌হের মাথায়, বিধবা হওয়ার পর কেউ আমার পড়ালেখার প‌ক্ষে ছি‌লো না। আমা‌কে তো কেউ পরীক্ষাই দি‌তে দি‌বে না ক‌রে। শুধ‌ু ছো‌টো মামার কার‌ণে পড়া‌লেখা হ‌য়ে‌ছে। তি‌নিই আমার খরচ চালা‌তেন। তা-ও ছো‌টো মা‌মি বিষয়টা নি‌য়ে প্রায়ই ঝা‌মেলা করত।
আমার নি‌জের বাবা-মা-ই যেখা‌নে আমা‌কে বুঝ‌তে পা‌রে‌নি, সেখা‌নে মা‌মি, চা‌চি‌দের কী বল‌বো? ছো‌টো মামা ফরম পূর‌নের টাকা দি‌তেন, বই কি‌নে দি‌তেন। বা‌কি প্রাই‌ভেট পড়ার টাকা, আমি নি‌জে বাচ্চা‌দের প্রাই‌ভেট প‌ড়ি‌য়ে যোগাড় করতাম।
আমার প্রথম স্বামী মরা যাব‌ার পর বাবা আমার স‌া‌থে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। তারও সবার ম‌তো ধারণা ছি‌লো আমি অপয়া।’

শশী, রাযীন চ‌ুপ ক‌রে রেনুর কথা শুন‌ছে। রেনু বলল,
‘জানো আমার প্রথম স্বামী যেদিন মারা গেল, সে‌দিন তা‌কে হস‌পিটাল থে‌কে সোজা তা‌দের বা‌ড়ি নি‌য়ে গেল। আমি ঐ প্রথম নি‌জের শ্বশুর বা‌ড়ি যাই। আমার শাশু‌ড়ি সবার ম‌ধ্যে ব‌সে আমা‌কে একটা চড় মে‌রে ব‌লেছি‌লেন, আমার কার‌ণেই না‌কি তার ছে‌লে মারা গে‌ছে। তারপর তি‌নি এবং তার মে‌য়েরা মি‌লে আমা‌কে যে সব কথা ব‌লে‌ছি‌লেন, ওর চে‌য়ে য‌দি কা‌নে কেউ গলিত গরম সীসা ঢে‌লে দিতো তা-ও কষ্ট কম হ‌তো।
তা‌দের এত নোংরা কথা শু‌নেও আমার বাবা-মা কো‌নো প্র‌তিউত্তর ক‌রেন‌নি সে‌দিন। তা‌দের খারাপ কথায় আমার যতটা না খারাপ লেগে‌ছি, তার‌চে‌য়ে বে‌শি খারাপ লে‌গে‌ছি‌লো আমার বাবা-মা এর চ‌ুপ থাকা‌তে। বাবা সেই যে আমার সাথে কথা বন্ধ করলেন, আর কথা বল‌লেন তোমার ভাইয়ার সা‌থে বি‌য়ের দিন। জীবন আমা‌কে বহু কষ্ট দি‌য়ে‌ছে।
সৌন্দর্য সবার জন্য আর্শীবাদ হ‌লেও আমার জন্য অভিশাপ হ‌লো। প্রাই‌ভেট পড়া‌তে গে‌লে অনেক বাচ্চা‌দের বাবার, চাচার কিংবা ভাই এর কুন‌জ‌রে প‌ড়ে‌ছি। বিধবা হবার কার‌ণে তারা যে‌নো আরও বে‌শি সু‌যোগ নি‌তে চাই‌তো। বড় ক‌ষ্টে নি‌জে‌কে হেফাজ‌তে রে‌খে‌ছিলাম। যখন দেখলাম বাচ্চাদের বা‌ড়ি গি‌য়ে পড়া‌নো রিক্স তখন ছো‌টো মামা‌কে বললাম, বা‌ড়ি‌তে একটা কো‌চিং খু‌লে দি‌তে। সেখা‌নে শুধু ক্লাস এইট পর্যন্ত বাচ্চা‌দের পড়াতাম। কারণ ক্লান টে‌নে পড়া ছে‌লেরাও আমা‌কে নোংরা প্রস্তাব দি‌য়ে‌ছি‌লো। আমার বা‌ড়িটা আমার জন্য নরকখানা ছি‌লো। আমি শুধু কো‌নোম‌তে ঐ বা‌ড়িটা থে‌কে বের হ‌তে চে‌য়ে‌ছিলাম।
তোমার ভাইয়া যখন প্রস্তাব পাঠা‌লেন তখন আমার না করার অনেক রিজন থাকা স‌ত্ত্বেও, আমি না ক‌রি‌নি কারণ আমার বা‌ড়িটা আমার কা‌ছে নর‌কের ম‌তো ছি‌লো। তোমার ভাইয়া আমা‌কে সেখান থে‌কে ম‌ুক্ত ক‌রে‌ছেন। স‌ত্যি বলতে বর্তমা‌নে আমার এ পৃ‌থিবীতে সব‌চে‌য়ে ভা‌লোবাসার য‌দি কেউ থা‌কে সেটা তোমার ভাইয়া। যেখা‌নে আমার বাবা-মা-ই আমা‌কে বো‌ঝে‌নি, আমার ক‌ঠিন সময় আমা‌কে সা‌পোর্ট ক‌রে‌নি, সেখা‌নে তোমার ভাইয়া আমা‌কে বু‌ঝে‌ছে, সা‌পোর্ট কর‌ছেন, ভা‌লোবাস‌ছে পাগ‌লের ম‌তো। এখন তু‌মিই ব‌লো, ‌যেখা‌নে আমার গ্রাজু‌য়েশন কম‌প্লিট করাটাই এত টাফ ছি‌লে‌া, সেখা‌নে মাস্টার্স করার কথা ভাবাও ছি‌লো বিলসিতা মাত্র।’

রেনুর চোখ‌ থে‌কে অশ্রুরা ঝরে পড়‌ছে। কান্না কর‌ছে শশীও। শশী একটু নিচু হ‌য়ে রেনুর পা ধরতে গি‌য়ে বলল,
‘ভা‌বি তু‌মি একটু আগাও আমি তোমার পা ধ‌রে ক্ষমা চাইব।’
‘‌ছি! ছি! শশী কী বল‌ছো এসব?’
‘নাহ ভা‌বি স‌ত্যি বল‌ছি, আমিও তোমার সা‌থে কম অন্যায় ক‌রি‌নি। কম কথা শুনাই‌নি তোমা‌কে। একজন শি‌ক্ষিত মে‌য়ে হ‌য়ে চরম মুর্খ, জা‌নোয়া‌রের ম‌তো কথা ব‌লে‌ছি। প্লিজ ভা‌বি আমা‌কে ক্ষমা ক‌রে দাও।’

শশী বাচ্চা‌দের ম‌তো কাঁদ‌তে লাগল। রাযীন, শশীর মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে রেনু‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল,
‘ভা‌বি ওকে ক্ষমা ক‌রে দিন। ও অনেক আগে থে‌কেই নি‌জের ভুল বুঝ‌তে পে‌রে পস্তা‌চ্ছে। প্রায়ই আমা‌কে খুব আফ‌সোস ক‌রে আপনার কথা ব‌লে।’
‌রেনু, শশীর হাত ধ‌রে বলল,
‘পাগলী একটা। তোর উপর রাগ তো আমার সে‌দিনই প‌ড়ে গে‌ছে যে‌দিন তুই ফোন ক‌রে স‌রি ব‌লে‌ছি‌লি। তাছাড়া স‌ত্যি বল‌তে তো‌দের কথায় আমার ততটা খারাপ লাগত না। কারণ এর চে‌য়ে বহু কটু নোংরা কথা আমি আমার প‌রিবার থে‌কে শু‌নে‌ছি। আমার নি‌জের মা-ই আমা‌কে যেসব কথা ব‌লে‌ছেন, সে অপেক্ষা তো‌দের কথা কিছু ছি‌লো না।
শশী কখ‌নো খেয়াল ক‌রে দে‌খে‌ছিস, আমি আমার বা‌ড়ি‌তে কল কম কেন ক‌রি? তা‌দের সা‌থে আমার যোগা‌যোগ কম কেন? বি‌য়ের পর মে‌য়েরা বাবার বা‌ড়ি যাওয়ার জন্য পাগল থা‌কে, সেখা‌নে আমি কেন আমার বা‌ড়ি যেতে চাই না? আস‌লে তা‌দের কাছ থে‌কে এত কথা শু‌নে‌ছি, এত কষ্ট পে‌য়ে‌ছি যে, নি‌জের প‌রিবার‌কে ছেড়ে আস‌তে কষ্ট তো হয়-ই-‌নি বরং ঐ বা‌ড়ি থে‌কে বের হ‌য়ে আমি বহু বছর পর প্রাণ ভ‌রে নিঃশ্বাস নি‌য়ে‌ছিলাম।
আমি সৃ‌ষ্টিকর্তার কা‌ছে সবসময় চাই ঐ বা‌ড়ি‌তে যে‌নো আমা‌কে পার‌তে সা‌ধ্যে না নেয়। য‌দিও কখ‌নও এমন হয় ঐ বা‌ড়ি‌তে আমা‌কে বরাব‌রের ম‌তো চ‌লে যেতে হবে, সে‌দিন যে‌নো আমার লাশটাই তা‌দের কা‌ছে পৌঁছায়। তা‌দের তীক্ষ্ণ কথার কা‌ছে তোদের কথা কিছু ছিলো না শশী। তা-ও তুই যে‌দিন ফোন ক‌রে ক্ষম‌া চাই‌লি আমি সব ভু‌লে গেলাম। তুই তো শুধু শিহা‌বের একার বোন না, আমারও ছো‌টো বোন।
আমার নি‌জের ছো‌টো বোন রু‌মি তো আমার সা‌থে ঠিক ম‌তো কথা পর্যন্ত বলত না। যখন ওর বি‌য়ে হ‌লে‌া, সে বি‌য়েতে আমার প্র‌বেশ নি‌ষিদ্ধ ছি‌লো। ওর বি‌য়ের ক‌দিন আমা‌কে আমার রুমটায় বদ্ধ অবস্থায় থাক‌তে হ‌য়ে‌ছি‌লো। সবার ধারণা ছি‌লো আমার ছায়া পড়‌লে রু‌মির জীবনও নষ্ট হ‌য়ে যা‌বে। নি‌জের বোন‌কে তো বো‌নের মতো পেলাম না, তুই না হয় বোন হ‌য়ে থা‌কিস।’

শশী কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বল‌ল,
‘ভা‌বি এইটু‌কু বয়‌সে তু‌মি কত কষ্ট সহ্য ক‌রে‌ছো? তোমার কথা শু‌নে আমার ভিতরটা কেমন যেনো কর‌ছে! ম‌নে হ‌চ্ছে ক‌ষ্টে ভিতরটা আট‌কে যা‌বে।’
‌রেনু, রাযীন‌কে উদ্দেশ্য ক‌রে বলল,
‘রাযীন ভাই, শশী‌কে প্লিজ রু‌মে নি‌য়ে গি‌য়ে শান্ত ক‌রুন। এই পাগল‌কে আমি শান্ত কর‌তে পারব না।’

রাযীন, মাথা নে‌ড়ে সায় দি‌লো। রাযীন, শশী‌কে নি‌য়ে বিছানায় বসা‌লো। শশী, ওকে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বলল,
‘রাযীন আমি খুব খারাপ ছিলাম না‌?’
রাযীন, শশীর চোখ ম‌ুছতে মুছ‌তে বলল,
‘‌নি‌জের ভুল বুঝ‌তে ‌পে‌রে অনুতপ্ত হ‌লে সেটা আর ভুল থাকে না।’
‘না রাযীন আমার নি‌জে‌কে ভীষণ খারাপ ম‌নে হ‌চ্ছে।’
রাযীন গভীরভা‌বে শশী‌কে জ‌ড়ি‌য়ে ধ‌রে বলল,
‘আর কান্না ক‌রো না। ভা‌বি তো বল‌লেন, তোমার উপর তার রাগ নেই।’
‘আমার ভিতর থে‌কে এত কষ্ট হ‌চ্ছে যে, বোঝাতে পারব না।’
‘‌ঠিক আছে ত‌বে কান্না করে মন হালকা ক‌রো।’
এ‌দি‌কে রেনুও রু‌মে এসে খুব কাঁদ‌লো। নি‌জের অতীত ভু‌লে থাকার খুব চেষ্টা ক‌রে কিন্তু অতীত হ‌চ্ছে বর্ষাকা‌লের ঝড়ো হাওয়ার মতো কিছুদিন পর পর এসে সব না‌ড়িয়ে দি‌য়ে যায়।

দুপু‌রে খাবার সময়,
রাযীন বলল,
‘আজ কক্সবাজার সমুদ্র কূল থেকে বেশ খা‌নিকটা দূ‌রে থাকার পরও একট‌ুর জন্য পা‌নি‌তে ভে‌সে যাই‌নি। দুই রমনী কান্নার যে প্র‌তি‌যোগিতায় নে‌মে‌ছি‌লেন তা‌তে কে জিতত বা হারত তা জা‌নি না, তবে আমি ডুবতাম শিওর।

রাযী‌নের কথা শু‌নে রেনু, শশী দুজ‌নেই হাসল। খে‌তে খে‌তে শশী বলল,
‘ভা‌বি মাস দুই পর তো আমা‌দের রেজাল্ট দি‌বে। তারপর মাস্টার্স‌ের ভর্তির ফর্ম ফিলাপের ডেট পড়‌বে। তু‌মিও তখন আমার সা‌থে ফরম‌ফিলাপ করব। দু’জন একসা‌থে পোস্ট গ্রাজু‌য়েশন করব।’
‘‌কিন্তু শশী এখন বি‌য়ের পর পড়া‌লেখার ঝা‌মেলা সামলা‌তে পারব?’
রাযীন বলল,
‘‌তো আপনার ননদ কোথাকার অবিবা‌হিত মে‌য়ে? সেও তো বিবা‌হিত। সে পার‌লে আপ‌নি কেন পার‌বেন না?’
শশী বলল,
‘হুঁ রাযীন ঠিক বল‌ছে। ভা‌বি তু‌মি ভাইয়া বা প‌রিবা‌রের টেনশন ক‌রো না।’
‘‌তোর ভাইয়ার টেনশন ক‌রি না। তি‌নি তো বি‌য়ের ক‌য়েকদিন পরই আমায় ব‌লে‌ছি‌লেন পোস্ট গ্রাজু‌য়েশন করার কথা। ব‌লে‌ছি‌লেন ক‌লেজে যোগাযোগ রে‌খো কখন ভ‌র্তির ডেট প‌ড়ে, আমি তোমা‌কে ভ‌র্তি ক‌রি‌য়ে দিব। আমিই না ক‌রে‌ছিলাম।’

শশ‌ী বলল,
‘ভাইয়া যখন রাজী তখন তোমার কী সমস্যা?’
‘মা-বাবা কি রা‌জি হ‌বেন?’
শশী হে‌সে বলল,
‘ভা‌বি এটা ঠিক মা তোমায় তেমন পছন্দ ক‌রেন না। কিন্তু তি‌নি মে‌য়েদের পড়া-‌লেখার‌ ক্ষে‌ত্রে ভীষণ প‌জে‌টিভ মন্তব্য পোষণ ক‌রেন। তু‌মি জা‌নো, লি‌পি ভা‌বি যখন আমা‌দের বা‌ড়ির বউ হ‌য়ে আসেন তখন তি‌নি কেবল ইন্টার দ্বিতীয় ব‌র্ষে পড়‌তেন। তারপর বি‌য়ের পর এইচএসসি পরীক্ষা দেন। সাজ্জাদ ভাইয়া তা‌কে অনা‌র্সে পড়া‌নোর তেমন প‌ক্ষে ছি‌লো না কিন্তু মা তা‌কে ধম‌কে ঠিক ক‌রে ফে‌লে‌ছি‌লেন। মা নি‌জে‌ ভা‌বি‌কে ভা‌র্সি‌টি‌তে ভ‌র্তি ক‌রে‌ছি‌লেন। তারপর ভা‌বি এমএ ও কম‌প্লিট ক‌রেন। মা সবসময় ব‌লেন, চাক‌রি করা না করা প‌রের কথা কিন্তু প্র‌তিটা মে‌য়ের শি‌ক্ষিত হওয়াটা খুব জরু‌রি। তু‌মি য‌দি মা‌কে ‌তোমার পড়ার ইচ্ছার কথা ব‌লো, ত‌বে তি‌নি রাগ কর‌বেন না উল্টা খু‌শি হ‌বেন। আর আমার বিশ্বাস শীঘ্রই মা-ও তোমা‌কে খুব পছন্দ কর‌বেন।’
‘‌কিন্তু শশী।’
‘বুঝতে পে‌রে‌ছি ভয় পা‌চ্ছো তো? আচ্ছা আমি-ই মা‌কে ব‌লল। তোমার কিছু বলা লাগ‌বে না।’
‌রেনু মলিন হাসল শুধু।

৪২!!

দেখ‌তে রেনুর চট্টগ্রা‌মে বা‌রো‌দিন কে‌টে গে‌ল। ইদা‌নিং রেনু শিহাব‌কে ভয়াবহ মিস কর‌ছে। শিহা‌বের অবস্থাও খারাপ। পার‌লে কান্না ক‌রে রেনুর বির‌হে। শিহা‌বের অবস্থা দে‌খে হা‌সি বেগম, লি‌পিকে বলল,
‘‌লি‌পি?’
‘হ্যাঁ মা।’
‘‌রেনু‌কে ফোন করে আস‌তে বল।’
‘‌কেন মা?’
‘‌শিহা‌বের অবস্থা দেখ‌ছিস আজকাল? নি‌জের খেয়াল রাখা তো ছে‌ড়েই দি‌য়ে‌ছে। খাওয়া ঘুম তো অর্ধেক বন্ধ কর‌ছে। এখন পার‌লে পাগল হ‌য়ে রাস্তায় দৌড়ায়। এমন বউ পাগল ছে‌লে জীব‌নে দেখ‌ছিস কখনও?’

লি‌পি হেসে বলল,
‘মা আমা‌দের রাযীনও কিন্তু সেইম বউ পাগল। রাযীন আর শিহাব ভাই এর ম‌ধ্যে অদ্ভুত মি‌ল আছে!’
হা‌সি হাস‌তে হাস‌তে বলল,
‘তাহ‌লে দুই পাগল‌কে এক পাগলা গার‌দে ভ‌রে রাখ। আমার মাথা থে‌কে বোঝা কমুক। আর রেনু‌কে আমি আসার কথা কিছু বল‌তে পার‌ছি না। বল‌লে হয়‌তো ভাব‌তে পা‌রে, আমার মে‌য়ের বাসায় থা‌কে ব‌লে আস‌তে বল‌ছি। তুই বলনা। শিহা‌বের এই পাগলা‌মি তো আর নেয়া যা‌চ্ছে না। ঠিক ম‌তো খা‌চ্ছে না, ঘুমা‌চ্ছে না। গতকাল দেখলাম অফিস যা‌চ্ছে অথচ চুলে চিরুনী পর্যন্ত ক‌রে‌নি। শা‌র্টের ইন এক পাশ থেকে বের হওয়‌া। রেনু আর ক‌দিন দূ‌রে থাক‌লে ছে‌লে র্নিঘাত পাগল হ‌য়ে যা‌বে। তারচে‌য়ে বরং পাগ‌লের পাগলা‌মি ব‌ন্ধের ওষুধ বা‌ড়ি আনার ব্যবস্থা কর।’

‌লি‌পি হাস‌তে হাস‌তে পেট চে‌পে ধরল। তারপরও ওর হা‌সি বন্ধ হ‌চ্ছে না। হা‌সি বেগম বল‌লেন,
‘হা‌সিস না তো। রাগ লাগছে আমার। সব পাগল ছে‌লে-মে‌য়েগুলান আল্লাহ আমার কপা‌লেই দি‌ছে। তাও কপাল ভা‌লো আল্লাহ পাগলগুলার সঙ্গী হিসা‌বে ভা‌লো মানুষ‌দের দি‌য়েছেন। নয়‌তো এই পাগলদের অত্যাচা‌রে ক‌বে জা‌নি আমিই পাগল হ‌য়ে যেতাম।’
এদি‌কে লি‌পি শব্দ ক‌রে হাস‌তেই আছে। হা‌সি বেগম ওকে ধমক দি‌য়ে থামা‌লেন। লি‌পি এবার মুখ বন্ধ ক‌রে হাস‌ছে। ঠিকম‌তো হাস‌তে না পে‌রে হা‌সির দরুন ওর সারা শরীর কাঁপ‌ছে। হা‌সি বলল,
‘আর হা‌সিস না তো। যা রেনু‌কে কল ক‌রে আস‌তে বল। নয়তো ঐ পাগলটা‌কে বল নি‌জের বউ‌কে নি‌য়ে আস‌তে। আমার হ‌য়ে‌ছে যত জ্বালা!’

হা‌সি বেগম রা‌গে গজগজ কর‌তে কর‌তে চ‌লে গে‌লেন। লি‌পি হাস‌তে হাস‌তে রেনু‌কে কল করল। রেনু কল রি‌সিভ ক‌রে সালাম দি‌লো,
‘আসসালামু আলাইকুম ভা‌বি। কেমন আছে?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদু‌লিল্লাহ ভা‌লো। ত‌ুই? ‘
‘আলহামদু‌লিল্লাহ্।’
‘‌শিহা‌বের সা‌থে কথা হ‌য়ে‌ছে?’
‘দুপুরে হ‌য়ে‌ছি‌লো। এরপর রা‌তে বা‌ড়ি গি‌য়ে কল কর‌বে বলল। কেন কিছু হ‌য়ে‌ছে?’
‘‌তোমার বর তো, তোমার বিহ‌নে দেবদাস হ‌য়ে গে‌ছেন।’
‌রেনু হে‌সে বলল,
‘কতটু‌কো ভাবি? শাহরূখ খা‌নের ম‌তো হ‌য়ে‌ছে? ম*দ টত খায়?’
‌রেনু হাস‌তে হাস‌তে বলল,
‘অবস্থা যা‌ দেখ‌ছি তা‌তে, তা হ‌তে বে‌শি সময় লাগ‌বে না!’
‘বাহ্! বেশ তো! ত‌বে তাই হোক।’
‌লি‌পি, রেনু দু’জ‌নেই শব্দ ক‌রে হাসল। হা‌সি থা‌মি‌য়ে রেনু বলল,
‘আর কষ্ট দিস না বেচারা‌কে। ‌বেচারার চেহারা স‌ত্যি বেচারা বেচারা হ‌য়ে গে‌ছে।’
রেনু হাসল। বলল,
‘আজ কী বার ভা‌বি?’
‘বুধবার।’
‘তোমার দেবর‌কে ব‌লো শুক্রবার এসে যে‌নো নি‌য়ে যায়। তার তো শুক্রবার ছু‌টি।’
‘আচ্ছা।’

‌লি‌পি কল কাটার পর রেনুর ফো‌নে আরেকটা কল আসল। রেনু ফোন তু‌লে দেখল ওর বাবা হা‌মিদ কা‌জীর কল। খা‌নিকটা ভয় পেল রেনু। কারণ ওর বাবা ওকে কল ক‌রে না কখনও। বি‌য়ের পর যে কয়বার কথা হ‌য়েছে, সে কয়বার ওর মা‌য়ের ফোন থে‌কে কিংবা শিহাবের ‌ফোন থে‌কে কথা ব‌লে‌ছে। কথা বল‌তে, কুশল বি‌নিময় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। রেনু ভাবল,
‘ইনি আবার কেন কল করল? কো‌নো সমস্যা হ‌য়ে‌ছে না‌কি?’
রেনু কল রি‌সিভ ক‌রে সালাম দি‌লো,
‘আসসালামু আলাইকুম বাবা।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?’
‘ভালো। আপ‌নি?’
‘‌ভা‌লো। তু‌মি না‌কি চট্টগ্রাম? শিহাব বলল।’
‘‌জি। নন‌দের বাসায়।’
‘তারা ভা‌লো আছে সবাই?’
‘‌জি।’
‘ফ‌রিদপুর আস‌বে ক‌বে?’
‘ক‌’দিন পর।’
‘কালই চ‌লে আসো।’
‘‌কেন?’
‘রোমানার বি‌য়ে ঠিক হ‌য়ে‌ছে।’

রোমানা, রেনুর সব‌চে‌য়ে ছো‌টো বোন। রেনুরা তিন বোন শুধু। রেন‌ু, রু‌মি, রোমনা। তিন-জন বোনই পিঠাপি‌ঠি। রেনুর চে‌য়ে দুই বছ‌রের ছো‌টো রুমি আর রু‌মির চে‌য়ে দেড় বছ‌রের ছো‌টো রোমন‌া। রেনু খা‌নিকটা ভয় পে‌লেও বলল,
‘বাবা রোমনার বয়স তো বে‌শি না।’
‘‌বি‌য়ের জন্য তার ঠিক বয়স। বি‌শে পা দি‌লো আর কত বড় হ‌বে? মে‌য়েদের তাড়াতা‌ড়ি বি‌য়ে দেয়া ভা‌লো।’
‘আপ‌নি যা ভা‌লো ম‌নে ক‌রেন।’
‘র‌বিবার বি‌য়ে। তু‌মি শিহাব‌কে নি‌য়ে তিন-চার দিন আগেই চলে আসবে। তোমার শ্বশুর বা‌ড়িও ব‌লে‌ছি তারাও সবাই আস‌বেন। তোমার নন‌দের নাম্বারটা আমা‌কে দাও। তা‌কেও ব‌লে দিব।’

রেনুর অনেক কিছু বল‌তে ইচ্ছা কর‌ছি‌লো কিন্তু ও ওর বাবা‌কে এত ভয় পায় যে, বলার সাহস-ই হ‌লো না। রেনুর বাবা কল কাট‌তেই রেনু জিয়া‌কে কল ক‌রে বলল,
‘মামা তোমার সা‌থে কথা আছে। নি‌রি‌বি‌লি কোথাও যাও তো?’
‌জিয়া বলল,
‘‌ফোন দি‌য়ে কোথায় আমার কুশল জি‌জ্ঞেস কর‌বি? তা না ফটফট কথা বল‌ছিস।’
‘তু‌মি আগে আমার কথা শো‌নো।’
‘বল।’
‘‌তোমার দুলাভাই মা‌নে আমার বাবা‌কে বল‌বে, আমি রোমানার বি‌য়ে‌তে যে‌তে পারব না।’
‘‌কেন?’

‌রেনু কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর বলল,
‘মামা আমি কিন্তু আমার অতীতটা ভু‌লি‌নি। রু‌মির বি‌য়ের সময় দি‌নের পর দিন আমা‌কে সবাই রু‌মে বন্ধ ক‌রে রে‌খে‌ছি‌লো যা‌তে ওর ওপর আমার ছায়াও না প‌ড়ে। তাহ‌লে আজ কেন রোমানার বি‌য়ে‌তে যাব? আমি যাব না।’
‘অতীত আঁক‌রে ধ‌রে ব‌সে থা‌কে কী হয় সোনামা? তুই আমার মি‌ষ্টি মা। ওসব ছো‌টো খা‌টো কথা ম‌নে রা‌খে না পা‌খি। এসব ছো‌টো ছো‌টো ক‌ষ্টের অতীত ভু‌লে যে‌তে হয়।’
‘‌মো‌টেও ছো‌টো খা‌টো কথা না মামা। আর কোন কোন বিষাদ অতীত ভুলব মামা? আমার জীবনে তো তার অভাব নেই! তিনটা বছর আমার জীবনটা‌কে সবাই মি‌লে বিষের থে‌কে বিষময় ক‌রে তু‌লে‌ছি‌লো। আমি য‌দি তখন আত্মহত্যা ক‌রে ম‌রে যেতাম, তখন হয়‌তো সবাই খুশি হ‌তো। ভাবত আপদ গে‌ছে।
আমার ছো‌টো বো‌নের বি‌য়ে হ‌য়ে‌ছে। সেখা‌নে আমা‌কে কেউ যে‌তে দেওয়া তো দূ‌রে থাক, কেউ আমা‌কে সারা‌দিন, সারারাত খে‌তে পর্যন্ত দেয়‌নি। সারা‌দিন, সারাটা রাত অভুক্ত অবস্থায় রু‌মে ব‌সে কেঁ‌দে‌ছিলাম। বা‌ড়ির একটা কুকুর‌কে মানুষ যতটা ভা‌লোবাসা, মূল্য দেয়, ততটাও আমা‌কে কেউ দেয়‌নি।
বি‌য়ের প‌রের দিন সকা‌লে তু‌মি আমার রু‌মে এসে জি‌জ্ঞেস ক‌রে‌ছি‌লে, কিছু খে‌য়ে‌ছি কিনা? আমি তখন চো‌খের পা‌নি ফেলা ছাড়া কিছুই বল‌তে পা‌রিনি। তুমি সে‌দিন, সকা‌লে ভাত আর বি‌য়ের বে‌ঁচে যাওয়া ডাল নি‌য়ে আমা‌কে দি‌য়ে‌ছি‌লে। আমার ছো‌টো বে‌ানের বি‌য়ে ছি‌লো অথচ আমি সেখান থে‌কে ব‌র্জিত ছিলাম। সেখান থে‌কে একটু খাবারও আমার নসী‌বে জো‌টে‌নি। আচ্ছা মামা সে‌দিন তো অনেক ভিখা‌রি‌কেও খাই‌য়ে‌ছি‌লে, আমাকে কি তা‌দের একজনও ম‌নে ক‌রো‌নি তোমরা?’

‌জিয়া চো‌খের কোণ মুছে বলল,
‘আর ব‌লিস না মা। আমি সে‌দিন বি‌য়ের ঝামেলায় তোর কা‌ছে যে‌তে পা‌রি‌নি।’
‘তু‌মি না হয় আমার মামা? বি‌য়ের ঝা‌মেলায় আমার কথা ম‌নে ছি‌লো না। কিন্তু আমার নি‌জের মা, আমার বাবার কি একবারও আমার কথা ম‌নে প‌ড়ে‌নি? না‌কি তা‌দের জন্য আমি মৃত ছিলাম? আমার নি‌জের বোন দুটোওতো একবার আমা‌কে ডাকতে পারত? তারাও ডা‌কে‌নি। অথচ ওদের আমি কত ভা‌লোবাসতাম।

‌রেনু কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে বলল,
‘মামা বি‌য়ে তোমরা তোমা‌দের পছ‌ন্দে আমা‌কে দি‌লে, সেই লোক দূর্ঘটনায় মরল, কিন্তু দোষী, অপয়া, অলক্ষী আমি হলাম। কেন? সেই লোক‌কে কি আমি মে‌রে‌ছিলাম? না‌কি তা‌কে আমি গা‌ড়ির নি‌চে ঠে‌লে দিয়ে‌ছিলাম? তবুও সবাই মি‌লে আমা‌কে দোষী করে আমার জীবনটা‌কে নরক বা‌নি‌য়ে দি‌য়ে‌ছি‌লে।
মামা তু‌মিও আমার সা‌থে কম অন্যায় ক‌রো‌নি। বিধবা হওয়ার পরও যখন শিহাব বি‌য়ের প্রস্তাব দি‌য়ে‌ছি‌লো, তোমার উচিত ছি‌লো আমা‌কে বি‌য়ে দি‌য়ে দেওয়া। অন্তত তোমাদের প‌রিবা‌রের ঐসব শারী‌রিক, মান‌সিক যন্ত্রণা থে‌কে মু‌ক্তি পেতাম। মামা আমি কিছু ভু‌লিনি। কখনও ভুলবও না। বা‌জে ছে‌লেরা আমা‌কে বা‌জে কথা ব‌লে‌ছি‌লো, আমি মা‌কে ব‌লে‌ছিলাম, মা‌ তা‌দের বিরু‌দ্ধে কিছু না ব‌লে, আমা‌কে শলার কু‌চি দি‌য়ে মে‌রে, কি সব নোংরা কথা ব‌লে‌ছি‌লো তু‌মি জা‌নো না। ওসব নোংরা কথা কো‌নো মা তার মে‌য়েকে ব‌লে না! মা আমা‌কে প‌তিতা‌দের কাতা‌রে না‌মি‌য়ে ফে‌লে‌ছিলেন সে‌দিন।
মামা আমি তোমাদের প‌রিবার থে‌কে দূ‌রে থাক‌তে চাই। মামা তু‌মি আমার জন্য অনেক ক‌রে‌ছো, অনেক। অনেক উপহার দি‌য়ে‌ছো। ত‌বে তোমার দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার ছি‌লো শিহাব। ঐ মানুষটা‌কে পে‌য়ে নি‌জে‌কে এখন সুখী ম‌নে হ‌চ্ছে। আমি আমার বাড়ির ছাঁয়া থে‌কেও দূ‌রে থাক‌তে চাই। দেখা যা‌বে ঐ বা‌ড়ি গে‌লে সবাই মি‌লে এটা ওটা ব‌লে শিহা‌বের মন বিষি‌য়ে দি‌য়ে‌ছে। এত ক‌ষ্টের পর আমি একটু সু‌খের মু্খ দে‌খে‌ছি, এই সুখটা হারা‌লে আমি আমার প্রাণটা হা‌রি‌য়ে ফেলব। আমি আসব না তোমা‌দের বা‌ড়ি।’

‌রেনু কলটা ‌কে‌টে কান্না কর‌তে লাগল। ম‌নে ম‌নে বলল,
‘যাব না ঐ বা‌ড়ি। কেন যা‌বো? একটা সময় তা‌দের কা‌ছে আমি কুকু‌রের চে‌য়েও অধম ছিলাম। আজ আর তা‌দের কা‌ছে যে‌তে চাই না।’
অ‌নেক্ষণ যাবত রেনু অনেক কথা ভাবল। নি‌জের অতী‌তের স্মৃ‌তিগু‌লো ম‌নে প‌ড়ে মন‌কে ভারী থে‌কে ভারী ক‌রে দি‌চ্ছিল। সবার প্র‌তি অভিমান হ‌চ্ছিল খুব। তখন কল করল শিহাব। রেনু আর নি‌জের রাগ অভিমান ধ‌রে রাখ‌তে পারল না। সব উগ‌ড়ে দি‌লো শিহা‌বের উপর। বলল,
‘আমার জীবনটা এত ক‌ষ্টের হওয়ার পিছ‌নে কোথাও না কোথাও আপ‌নিও দায়ী। সবাই মি‌লে আমা‌কে পুতুল ভে‌বে নি‌য়ে পুতুল খে‌লে‌ছেন। আমি তো মানুষ না সবার জন্য কা‌ঠের পুতুল ছিলাম মাত্র।’

চল‌বে…