#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩৫
প্রচন্ড কষ্টে রেনু কলটা কেটে দিলো। শিহাব আবার কল করল। রেনু রিসিভ করল না। শিহাব পর পর কয়েকবার কল করে রেনুকে না পেয়ে শশীকে কল করল। শশী কল রিসিভ করতেই বলল,
‘হ্যালো শশী, তোর ভাবির কী হয়েছে?’
‘জানি না, ভাই। তবে খুব কান্না করছে?’
‘কেন?’
‘জানি না। কিছুক্ষণ আগে বোধ হয় তার মামার সাথে কথা বলছিলেন। আমি অবশ্য পুরোটা শুনিনি বা কিছু বুঝিওনি তবে খুব কান্না করছিলো তার সাথে।’
‘আচ্ছা ফোনটা রেনুকে নিয়ে দে।’
‘আচ্ছা তাহলে একটু অপেক্ষা কর।’
শশী সাবধানে বিছানা থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসল। এখন ও কারো সাপোর্ট ছাড়াই নিজে নিজে উঠতে বসতে পারে। পায়ের ব্যথাটা আগের চেয়ে অনেক কম। নেই বললেই চলে। শুধু ভাঙা স্থানটায় চিনচিনে একটা ব্যথা হয়। তবে শশী ম্যানেজ করে নিতে পারে। পায়ে প্রেশার দেয়া ছাড়াই হুইল চেয়ারে উঠতে বসতে পারে। শশী, রেনুর রুমের সামনে গিয়ে দরজায় দুটো টোকা দিলো। রেনু চোখ মুছে নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। কিন্তু রেনু এতটা ফর্সা যে, হালকা কাঁদলেও ওর চোখ মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। সে কারণে চেয়েও লোকের কাছ থেকে নিজেকে লুকাতে পারে না। রেনু দরজা খুলল। রেনুর দিকে তাকাতেই শশী ভয়াবহ চমকে গেলো। চোখ মুখ লাল হয়ে ফুলে গেছে।
শশী, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ভাবি, রাগ করো না একটা কথা বলি? কান্না করার পর তোমার মুখ অসম্ভব লাল হয়েছে। তারপরও তোমাকে দেখতে সত্যি মোহময়ী লাগছে। কেউ কাঁদলে তাকে এত সুন্দর লাগতে পারে আমার জানা ছিলো না!’
রেনু মলিন হাসল। শশী বলল,
‘যা-ই হোক তুমি দুঃখ বিলাস করো আর ভাইয়ার সাথে কথা বলো আমি গেলাম।’
শশী, রেনুর হাতে ওর ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। রেনু ফোনটা কানের কাছে নিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ বলেন?’
‘রেনু আর ইউ ওকে? কোনো সমস্যা হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?’
‘না কোনো সমস্যা হয়নি?’
‘তাহলে কাঁদছো কেন?’
‘ঢঙের ঠ্যালায়। আপনারা সবাই মিলে আমাকে কষ্ট দিয়েছিলেন। বাইরের মানুষ তাদের কথার কারণে বাইরে টিকতে দিতো না, ঘরের মানুষ ঘরে টিকতে দিতো না আর আপনি আর মামা মিলে বিয়ে হতে দিতেন না। তিন বছরে, না আপনি আমাকে বিয়ে করে, না ঐ নরক থেকে উদ্ধার করেছিলেন আর না অন্য কাউকে করতে দিয়েছিলেন! যখন দেখলেন নিজের বয়স বেড়ে যাচ্ছে তখন যত বুদ্ধি খাটালেন। এর আগে বুদ্ধি খাটালে হয়তো যন্ত্রণা কিছুটা কম হতো। কিন্তু আপনি কী করলেন? সবার মতো আপনার আর মামার কারণেও আমি কম কষ্ট পাইনি। জীবনটা আমাকে শুধু কষ্টই দিয়ে গেল। যখনই সুখ আসে সে আবার পালিয়ে যেতে চায়। আমাকে আপনি আজ আর কল করবেন না।’
রেনু কলটা কেটে শশীর ফোন ওকে দিয়ে বলল,
‘শশী, তোর ভাইয়া কল করে আমাকে চাইলেও আর আমাকে দিবি না।’
‘ভাবি কিছু হয়েছে?’
‘কষ্ট আমার জীবনে নতুন কিছু না শশী! এরা আমার নিঃশ্বাসের একটা অংশ হয়ে গিয়েছে। পরে তোকে সব বলব।’
শশী আর কথা বাড়ালো না। বুঝতে পারছে রেনুর মনটা ভালো নেই। তাই বলল,
‘আচ্ছা।’
রাত সাড়ে বারোটা,
রেনুর দরজায় টোকা পড়ল। রেনুর চোখে কেবল ঘুমটা এসেছিলো। ভাবল হয়তো শশী। দরজা খুলে রেনু রীতিমতো বিস্মিত! কারণ দরজার সামনে শিহাব দাঁড়িয়ে আর পাশে দাঁড়িয়ে শশী, রাযীন মিট মিট হাসছে। রেনুর ঘুম পুরোপুরি উড়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বলল,
‘আপনি এ সময়?’
শিহাব, শশীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘বাচ্চা আমার খুব খিদা লাগছে। জলদি খেতে দে তারপর সবাইকে যা বলার বলব।’
রাযীন হেসে বলল,
‘ভাইয়া আমাদের তো যা বলার বলেছেন, এবার ভাবিকে বলেন। শশী চলো ভাইয়ার খাবার ব্যবস্থা করি। ততক্ষণে ভাইয়া ফ্রেশ হয়ে নিক।’
রাযীন, শশী চলে গেল। শিহাব কিছু না বলে বাথরুমে ঢুকে গেল। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে, ব্যাগ থেকে ট্রাউজার, টি শার্ট বের করে নিয়ে আবার বাথরুমে ঢুকে গেলো। জিন্স, শার্ট খুলে ট্রাউজার, টি শার্ট পরে বের হলো। রেনু আবার বলল,
‘আপনি এত রাতে এখানে কীভাবে?’
‘আমার খুদা পেয়েছে। খাবার পর আপনার সকল প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি।’
খাবার পর রাযীন, শশী নিজেদের রুমে ঘুমাতে গেল। রেনুও, শিহাবের পিছু পিছু ওরা যে, রুমে ঘুমাবে সে রুমটায় ঢুকল। শশী, রাযীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘দেখছো আমার ভাই কত্ত রোমান্টিক! ভাবিকে কত্ত ভালোবাসে! ইস বউ একটু রাগ করায় কয়েক ঘন্টায় ফরিদপুর থেকে সোজা কক্সবাজার চলে আসছে।’
রাযীন হেসে বলল,
‘এতে তো সরকারকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার যে, প্রায় প্রতিটা বিভাগে এয়ারপোর্ট করেছেন। নয়তো আর এত কম সময়ে বউয়ের রাগ ভাঙাতে আসা লাগত না। আর রোমান্টিকতার কথা বলছো? ম্যাডাম পৃথিবীর মোস্ট রোমান্টিক বরটা তোমার। সো শুকরিয়া আদায় করো।’
শশী হেসে বলল,
‘আসছে, নিজের প্রশংসা নিজে করতে।’
রাযীন, শশীকে কোলে তুলে বলল,
‘আজ তোমাকে রোমান্সের নতুন একটা অধ্যায় শিখাব চলো।’
রেনু চুপ করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। শিহাব লাইট বন্ধ করে, ড্রিম লাইট জ্বালিয় রেনুর পাশে শুয়ে ওকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কী হয়েছে রেনু?’
রেনু শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘কিছু না।’
‘এত রাগ করে আছো কেন?’
‘এমনি।’
‘প্লিজ বলো? আমি কী কোনো ভুল করেছি?’
‘আমার এখন কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না।’
‘তাহলে পরে বলবে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে এখন ঘুমাও।’
রেনু ফিসফিস করে বলল,
‘নাহ।’
‘তাহলে?’
রেনু শিহাবের দিকে ঘুরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বুকে নাক ঘষতে লাগল। শিহাব মৃদু হেসে বলল,
‘কী চাই?’
‘আপনার ভালোবাসা?’
‘কতটা?’
‘যতটা আপনার হৃদয়ে আছে।’
শিহাব মৃদু হাসল।
সকালে ঘুম ভাঙার পর, রেনু চোখ মেলে দেখল, শিহাব ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে রেনু বলল,
‘কী হলো এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘তোমাকে দেখছি।’
‘কেন নতুন দেখছেন?’
‘তোমাকে আমার কাছে প্রতিদিন নতুন মনে হয়।’
রেনু হাসল। তারপর শিহাবের নগ্ন বুকে মুখ লুকালো। শিহাব বলল,
‘শরীর, মন দুটোই ঝরঝরে হয়েছে ম্যাডাম?’
রেনু এত লজ্জা পেলো যে শিহাবের বুকে জোরে একটা কামড় বসালো। শিহাব উফ শব্দ করে বলল,
‘রেনু মন ভালো হয়েছে?’
মৃদু স্বরে রেনু বলল,
‘হুঁ।’
‘কাল কি খুব কষ্ট হচ্ছিল?’
‘হ্যাঁ ভীষণ।’
‘এখন কি কষ্টটা কম মনে হচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। আপনি কাল এমন করে কেন এলেন?’
‘গতকাল বিকালে তুমি যা রাগ দেখালে তারপর না এসে উপায় ছিলো?’
‘ছুটি ম্যানেজ করলেন কী কিরে?’
‘করেছি কিছু বাহানা দিয়ে। তবে শনিবার সকালে অফিসে থাকতে হবে।’
আমরা ফরিদপুর কবে ফিরছি?’
‘শুক্রবার বিকালে। আজ সারাদিন তোমাকে নিয়ে ঘুরব। তুমি যেখানে যেতে চাইবে নিয়ে যাব।’
‘কক্সবাজারের অনেক জায়গা আমি শশী, রাযীন ভাই ঘুরে দেখেছি। লাবনী বীচ, সুগন্ধা বীচ, কলাতলি বীচ, হিমছড়ি, মহেশখালী, মেরিন রোড, রামু বৌদ্ধবিহার সব ঘুরে দেখেছি।’
‘আঁ তাহলে আমি কোথায় নিয়ে যাব? কক্সবাজারের প্রায় সব জনপ্রিয় স্থান তো তোমার ঘোরা শেষ।’
‘সেন্টমার্টিন নিয়ে চলো।’
শিহাব ঢোক গিলে বলল,
‘আমার পানি ভীতি আছে। সমুদ্রের ঐ ঢেউ ঠেলে আমি আমি যেতে পারব না। সরি।’
রেনু হেসে বলল,
‘ওহ মিস্টার শিহাব, তাহলে ভয়ও পায়? সাঁতার জানেন?’
‘ইয়ে মানে না।’
‘ওহ হো। তারমানে সাতারও জানেন না। এখন যদি আমার ভালোবাসার সমুদ্রে ঠেলে ফেলে দেই, তাহলে উঠবেন কী করে?’
শিহাব, রেনুর নাকে নাক ঘষে বলল,
‘সে সমুদ্র থেকে আমি কখনও উঠতে চাইবো না। আমি সেই সমুদ্র মাঝেই নিজের জন্য ঘর বানাবো।’
রেনু অনেকক্ষণ হাসল। তারপর বলল,
‘শুধু আমার রাগ ভাঙাতেই এত দূর এলেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘এত ভালোবাসেন?’
‘হ্যাঁ। তোমার রাগটা আমার জন্য কঠিন শাস্তি স্বরূপ। আমি সে শাস্তি সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া তোমাকে নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছিল।’
‘কেন?’
‘জিয়া আমাকে কল করেছিলো। তোমার সাথে হওয়া অনেক কথা বলেছেন। তুমি যাবে না বিয়েতে?’
‘নাহ।’
‘তোমার সব সিদ্ধান্ত-ই আমি মানব। তবে তার আগে আমার কিছু কথা শোনো?’
‘বলেন?’
‘আমার মতে তোমার যাওয়া দরকার।’
‘কেন?’
‘এখন তুমি আগের রেনু নও। তোমার কথা বলার মতো শক্ত একটা স্থান হয়েছে। বিয়েতে যাবার পর, তোমাকে কেউ সামান্য বাজে কথা বললেও, তুমি তার মুখের উপর কড়া জবাব দিবে। সোজা কথা কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না। যে যেমন কথা বলবে, সে তেমন তার জবাব পাবে। তারপর তোমাকে কে কী বলে সেটা আমি দেখব। দ্বিতীয় রিজন হলো, তোমার বাবা আমার বাবার কাছে কল করে, দাওয়াত করেছেন। বাবাও যাবেন বলে ওয়াদাও করেছেন। এখন তোমার বোনের বিয়েতে তুমি না গেলে, আমার পরিবারের লোক কী করে যাবে? তোমার পরিবার, তোমার উপর কতটা অন্যায় করেছে তা কিন্তু তারা জানেন না। আমার মতে এসব জানানোও ঠিক হবে না। শুধু শুধু তোমার পরিবারের প্রতি একটা নেগেটিভ ভাবনা তৈরী হবে বাবা-মায়ের মনে। তুমি মানো বা না মানো দুটো পরিবারই এখন আমাদের। তাদের সম্মানের খেয়াল আমাদেরই রাখতে হবে।’
রেনু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘আচ্ছা যাব। তবে বিয়ের দিন দুপুরে বাকি অতিথিরা যে সময় যাবে, আমারাও তেমন সময় যাবো। কয়েকঘন্টা থেকে চলে আসব। এরচেয়ে বেশি থাকার জন্য আপনি আমাকে রাজী করাতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা।’
শুক্রবার বিকালে, রেনু, শিহাব চলে গেল। শশীর খুব খারাপ লাগছে। ঘরে আবার ওর একা থাকতে হবে। রাযীন সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে। আর ও ঘরে একা একা বিষন্নতায় সময় কাটায়। রেনু ওকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু রাযীনের সময় হবে না। সামনের মাসে একসাথে ওরা ফরিদপুর চলে যাবে।
৪৩!!
রেনু বিয়েতে যাবার জন্য তৈরি হবে বলে ভাবছে। কিন্তু কোন শাড়িটা পরবে ভাবছে। তখন হাসি বেগম রুম আসল। রেনু তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘মা কিছু বলবেন?’
তিনি একটা লাল রঙের বেনারসি আর কিছু গহনা ওর বিছানায় রেখে বলল,
‘এগুলো আজ বিয়েতে পরবে।’
রেনু উৎফুল্ল চোখে শাড়িটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। গহনার বক্স খুলে দেখল বেশ বড় এবং ভারী একটা সীতা হার। রেনু আমতা আমতা করে বলল,
‘মা এটা কি স্বর্ণের?’
‘হ্যাঁ। নকল গহনা আমার পছন্দ না। বহু বছর পূর্বে আমি দুই ছেলের বউ এর জন্য একই রকম দেখতে সব গহনা বানিয়ে রেখেছি। তোমাকে বাকি গহনা দিলেও এটা দেওয়া হয়নি। আজ বিয়েতে এটা পরবে। লিপিও পরবে। তোমরা দুই বউ আজ এক রঙে সাজবে। আর তুমি সবসময় এত সাদাসিদে থাকো কেন? ঘরের বউরা সেজেগুজে না থাকলে ভালো লাগে না। সুন্দর মানুষ তুমি, সবসময় সেজেগুজে থাকলে কত ভালো লাগবে।’
রেনুর এত ভালো লাগল যে, খুশিতে হাসি বেগমে জড়িয়ে ধরল। হাসি বেগম নিজের কঠিন্য বজায় রেখে বলল,
‘হয়েছে হয়েছে তৈরী হয়ে নাও। তোমরা আজকালকার মেয়েরা তৈরী হতো সারাদিন সময় নাও।’
রেনু মুচকি হাসল তার কথায়।
চলবে…
#একদিন_বিকালে_সকাল_হয়েছিলো
লেখকঃ শারমিন আক্তার সাথী
পর্বঃ ৩৬
রেনু তৈরি হয়ে শিহাবের সামনে আসলো। শিহাব হা হয়ে তাকিয়েই রইল। শিহাবের ওমন হা হয়ে তাকানোতে রেনুর খুব লজ্জা লাগছে। রেনু মনে মনে বলল,
‘ইশ! মানুষটা কেমন বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছে। লজ্জায় আমার সারা শরীর কাঁপছে। এমন র্নিলজ্জভাবে কেউ তাকায়!’
রেনু, শিহাবের পেটে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘তাহলে কীভাবে তাকাবো?’
‘তাকানোর প্রয়োজন কী?’
‘মানুষ সুন্দরের দিকেই তো তাকায়। তাছাড়া আমি তো বাইরের কারও দিকে নয়, বরং নিজের স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছি।’
‘তাতে এভাবে তাকানো লাগবে কেন?’
‘কীভাবে?’
‘মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই উল্টা পাল্টা ভাবে দেখছেন।’
শিহাব হাসল। তারপর রেনুর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
‘মাশাআল্লাহ আমার ঘরের নূর তুমি। ঘরটা আজ আরও আলোকিত। তার আলোয় আমার ঘর, মন ঝলমল করছে। ইশ রেনু, মানুষ দেখতে এত সুন্দর কী করে হয়!’
রেনু আবারও লজ্জা পেল। শিহাব বলল,
‘আজ তো তোমাকেই নতুন বউ লাগছে।’
রেনু লজ্জা পেয়ে বলল,
‘সাজ কি বেশি গর্জিয়াস হয়ে গেছে?’
‘রেনু, তুমি সাজছো কোথায়? তুমি শুধু শাড়ি আর অলংকার পরেছো। তবে চোখের কাজলটায় সত্যি মানিয়েছে তোমায়। আর ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক না দিয়ে, গাঢ় লাল লিপস্টিক দিতে তাহলে পুরো ম্যাচিং ম্যাচিং হতো।’
‘এই না না। আমার লাল রঙের লিপস্টিক পছন্দ না। গোলাপি রঙের লিপস্টিকই আমার পছন্দ।’
‘আচ্ছা এখন না হয় গোলাপি লিপস্টিক পরো, তবে রাতে কিন্তু আমাকে লাল লিপস্টিক দিয়ে দেখাবে।’
তারপর রেনুর কানে কানে কিছু একটা বলল। লজ্জায় রেনুর কান গরম হয়ে গেল, গাল আরও লাল হয়ে গেল। রেনু শিহাবের বুকে কিল দিয়ে বলল,
‘দিন দিন আপনি অসভ্য হচ্ছেন। মুখের লাগাম কমে যাচ্ছে।’
‘আজব তো! নিজের ভালোবাসার স্ত্রীর কাছে লজ্জা রাখলে, মুখে লাগাম রাখলে, লাগামহীন হবো কার কাছে?’
‘চুপ।’
‘রেনু, আজ বসের এক গাদা বকা খেয়ে, নেওয়া অামার আজকের ছুটিটা বৃথা যায়নি।’
‘কেন?’
‘চোখের সামনে সাক্ষাত অপ্সরী দাঁড়িয়ে। তার দর্শন করলাম, তাকে জড়িয়ে ধরলাম, এই বোনাস কম কী?’
রেনু হাসল। শিহাব বলল,
‘তবে শালার বস আমাকে শর্ত দিছে, আজকের কাজ আগামী শুক্রবার গিয়ে করতে। মানে আগামী শুক্রবার আর ছুটি পাব না। একবার সাইড বিজনেসটাকে ঠিকভাবে দাঁড় করাই, তারপর চাকরি আর বস দুজনকেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব। নিজে ব্যবসা করব, নিজের মতো পরিচালনা করব।’
‘ভাইয়া কী বললেন ব্যবসার ব্যাপারে?’
‘ভাইয়া তো বললেন মাস ছয়ের মধ্যে বেশ ভালোভাবেই দাঁড়িয়ে যাবে ব্যবসাটা। তারপর দুই ভাই মিলে নিশ্চিন্তে ব্যবসা করব। পরিবারকে সময় দিব। চাকরি, বাকরি বাদ।’
‘ততদিন বসকে মানিয়ে চলুন জনাব।’
‘তা তো চলতেই হবে।’
‘এখন চলুন সবাই অপেক্ষা করছে।’
শিহাব-রেনু বাইরে আসল। রেনুকে দেখে হাসি বেগম ছোটো খাটো ধাক্কা খেলেন। মনে মনে বললেন,
‘এই মেয়েটা কয়েক বছর আগে কেন আমার ছেলের বউ হলো না? তাহলে তো আর ওর প্রতি আমার বিরূপ মন্তব্য থাকত না। সব মা-ই তার ছেলের জন্য পুতুলের চেয়েও সুন্দর বউ চায়। আমার শিহাবের কপালে জীবন্ত পুতুল জুটছে। যে হাঁটে চলে, কথা বলে। মেয়েটা এত সুন্দর যে, একবার তাকালে চোখ ফেরাতে মন চায় না। মনে হয়, সবসময় সামনে বসিয়ে তাকিয়ে থাকি। এ মেয়ে বিয়েতে গেলে তো মানুষজন অন্য কারো দিকে তাকাবেই না।
হাসি বেগমের কথাই সত্যি হলো। বিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর পর থেকে রেনুর দিক থেকে কেউ চোখ ফেরাতে পারছে না। রেনু আগে থেকেই অসম্ভব সুন্দর ছিলো কিন্তু বিয়ের পর, শিহাবের অনেক ভালোবাসা আর অনেক যত্ন পেয়ে ওর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রেনুর মা, তানজিলা ওকে ডেকে বলল,
‘কিরে আজ এলি, তা-ও দুপুরবেলা? তোকে তো কয়েকদিন আগে আসতে বলেছিলাম। ফোন করলাম কী সব বাহানা দিলি।’
‘মা, আমি তো ফরিদপুর ছিলাম না। শক্রবার গভীর রাতে ফিরেছি। শনিবার, শিহাবের অফিস ছিলো। তাছাড়া এত লম্বা জার্নি করে আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছিলো।’
‘তা বুঝলাম কিন্তু আজ তো সকাল সকাল আসতে পারতি?’
‘ওমা সে কী কথা মা? তোমার মেঝো মেয়ের বিয়েতে আমার ছাঁয়া পর্যন্ত পড়তে দিলে না, আর তোমার ছোটো মেয়ের বিয়েতে আমাকে আনার জন্য এত পাগল হলে। তোমার ছোট মেয়ের ক্ষতি হবে না মা?’
তানজিলার মুখটা চুপসে গেল। তারপরও বলল,
‘জানিস তোর বাবা তোর উপর খুব রাগ করেছেন।’
রেনু তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘এ আর নতুন কী?’
রেনুর শরীরে স্বর্ণের অনেক গহনা দেখে তানজিলা আর রুমি জিজ্ঞেস করল,
‘এগুলো কি স্বর্ণের?’
রেনু বলল,
‘হ্যাঁ।’
তানজিলা বলল,
‘কে দিলো শিহাব?’
‘হ্যাঁ শিহাব, আমার জা, শাশুড়ি। এই বড় সীতা হারটা আমার শাশুড়ি আজ সকালে, আমাকে উপহার দিলেন। কানের দুল জোড়া জা দিয়েছেন, আর গলার ছোট নেকলেসটা, হাতের চুড়িগুলো, আংটিগুলো বিয়ের পর শিহাব এনে দিয়েছে। এছাড়াও আমার আরও অনেক স্বর্ণের গহনা আছে।’
রেনু, রুমির চোখে স্পষ্ট হিংসা দেখতে পাচ্ছে। রেনু ওকে জ্বালাতে বলল,
‘জানিস রুমি তোর ভাইয়া যখন তখন আমার জন্য উপহার কিনে আনেন। বেশির ভাগই দামি উপহার। স্বর্ণ ওর খুব পছন্দ। তাই স্বর্ণের জিনিসই বেশি আনেন। বিয়ের পর আমাকে অনেক স্বর্ণের গহনা উপহার দিয়েছেন। আমার শাশুড়িও ছেলের দুই বউয়ের জন্য অনেক গহনা গড়িয়ে রেখেছিলেন। সেসব আমাদের দুই বউকে কিছুদিন আগে ভাগ করে দিয়েছেন। তাতে একেকজনের ভাগে দশ ভরির উপরে গহনা পড়ছে।’
রুমি বলল,
‘মা যে বলল, তোর শাশুড়ি তোর সাথে কথা বলেন না।’
‘সে তো আগে বলত না। এখন তো ভীষণ ভালোবাসেন। আর তাকে-ও বা দোষ দিয়ে কী লাভ বল? যেখানে তোরা আমার নিজের পরিবার হয়ে, তিন বছরেও মানতে পারিসনি আমি রিয়াজুলের (রেনুর প্রথম স্বামী) মৃত্যুর জন্য দায়ী না! সেখানে আমার শাশুড়ির আমাকে মানতে তিন মাস তো লাগবেই বল। তা রুমি তুই এমন পাথুরে নকল গহনা কেন পরেছিস? তোর বোনের বিয়ে বলে কথা, স্বর্ণ পরবি না? এসব দেখতে কেমন সস্তা সস্তা লাগছে।’
রুমি কিছু তুতলে বলল,
‘ইয়ে মানে আমার পাথুরে গহনা ভালো লাগে।’
রেনু ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘ওহ।’
রেনু আজ মনে মনে ঠিক করেই এসেছে যে, আজ এতদিনকার অপমানের কিছুটা হলেও জবাব দিবে। তাই বলল,
‘তা তোর জামাই নতুন চাকরি নিয়েছে শুনলাম।’
‘বাহ।’
রুমি বেশ বড় গলায় বলল,
‘মাসে চল্লিশ হাজার বেতন পায় মামুন। অনেক বড় পদে চাকরি করে।’
রেনু তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
‘মাত্র চল্লিশ হাজার? শিহবের তো মাসিক আয় নিম্নে আড়াই লাখ তিন লাখের উপরে। চাকরি থেকে যা পায় তো পায়, সাইড বিজনেস থেকেও বেশ রোজগার করে।’
রুমির মুখটা ছোটো হয়ে গেল। রেনু আরেকটু মজা নিতে হেসে রুমিকে বলল,
‘দেখ তোর বর আর আমার বর একসাথে দাঁড়িয়ে। শিহাবের বগলের নিচে পড়ে আছে তোর জামাই। এত শুকনা কেন? একটু খাইয়ে দাইয়ে মোটাতাজা কর।’
রুমি কী বলবে ভেবে পেলো না। তাছাড়া রেনুর মজার ছলে রুমিকে সবার মধ্যে বসে কথাগুলো বলছে। রুমিও রেনুকে ছোটো করতে বলল,
‘বয়সেও তো মামুন তোর জামাইর চেয়ে কত ছোটো।’
রেনু হাসল। তারপর বলল,
‘রুমি আজকাল বয়সটা কোনো ম্যাটার না। ম্যাটার করে পুরুষের মানসিকতা আর সামর্থ্যের দিক থেকে। শিহাবের মানসিকতার কথা কী বলব? অতিরিক্ত উন্নত মানসিকতার কেউ না হলে বিধবা মেয়েকে বিয়ে করে, তাকে রানীর মতো রাখে? তাছাড়া তাকে তুইও বহু বছর যাবত-ই চিনিস। বাকি রইল সামর্থ্যের ব্যাপার টাকা পয়সা, সম্পত্তির দিক থেকে তো মাশাআল্লাহ।’
রুমির এত রাগ হচ্ছে, রাগের চোটে রেনুর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
‘আপা খালি টাকা পয়সা থাকলেই হয় না। মেয়েদের অন্য অনেক সুখ লাগে। তোর জামাইর যা বয়স, তাতে সেটা দিতে পারে?’
রেনুও সবার দিকে তাকিয়ে সৌজণ্যতার হাসি হেসে, রুমির কানের কাছে গিয়ে ও-ও ফিসফিস করে বলল,
‘তোর দুলাভাই বিছানায়ও কিন্তু কোনো পঁচিশ বছরের যুবকের থেকে কম যায় না।’
রুমির মুখটা একদম চুপসে গেল। রেনুর পূর্বের কথার সাথে সহমত পোষন করে ওর চাচাতো ভাইয়ের বউ বলল,
‘রেনু ঠিক বলেছে। শিহাবকে তো আমরা কত বছর যাবত দেখছি। সত্যি চমৎকার মানুষ। দেখতেও মাশাআল্লাহ রাজপুত্রের চেয়ে কম না। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হলেও, তাকে দেখতে এতটাই ইয়াং মনে হয় যে, প্রথম দেখায় যে কেউ তাকে ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের যুবক ভাববে। তার উপর ধন সম্পদও অনেক। রেনুর কপাল সত্যি রাজ কপাল। নয়তো ওমন অতীত থাকার পরও কেউ এত ভালো ঘরে যেতে পারে? রেনুর সুখের কথা আমাদের এলাকায় সবার মুখে মুখে। সবাই-ই বলে এত বছর মেয়েটাকে আল্লাহ কষ্ট দিলেও, এখন সব পুষিয়ে দিচ্ছেন। রেনু দোয়া করি এভাবেই সুখে থাক।
রেনুর আরেক ভাইয়ের বউ বলল,
‘রেনু, তোদের দু’জনার যে বাচ্চা হবে তা দেখতে ধারণার বাইরে সুন্দর হবে। তুই যেমন দেখতে সুন্দর, শিহাব ভাই তেমন দেখতে সুন্দর, লম্বা, চওড়া। তোদের সন্তান তো, দুজনার সৌন্দর্য পেয়ে সেরা হবে।’
কথাগুলো শুনে রেনু তৃপ্তির হাসি হাসল। মনে মনে বলল,
‘রুমি তোকে খোঁচাতে, সবার মাঝে ছোটো করতে আমার খারাপ লাগছে ঠিক-ই কিন্তু তোরা বিগত বছরগুলোতে অামার সাথে যা খারাপ ব্যবহার করেছিলি, তার একটু হলেও জবাব আজ দিতে পেরেছি। অদ্ভুতভাবে তোর ভিতরের জ্বলন দেখে আজ আমার খুব ভালো লাগছে। এটাকে পৈশাচিক আনন্দ বলে। এটা উপভোগ করা ঠিক না। তবুও আজ প্রথম এমন পৈশাচিক আনন্দ পেয়ে আমার ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।’
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে রেনু, ওর বাবার কাছে কিছু না বলেই শিহাবের সাথে চলে এসেছে। ওর শ্বশুর বাড়ির বাকি লোক তো দুপুরে খাবার পরই চলে গেছে। শিহাব-রেনুর, থাকার কথা ছিলো কিন্তু রেনু, কৌশলে শিহাবকে নিয়ে চলে এলো।
শিহাব গাড়ি চালাচ্ছে, রেনু শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ধন্যবাদ।’
‘কেন?’
‘এমনি।’
‘এমনি কেউ ধন্যবাদ দেয়?’
‘সব কারণ জানতে হয় না।’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ রইল,
‘শিহাব?’
‘হ্যাঁ।’
‘একটা রেস্টুরেন্ট দেখে গাড়ি থামান। আমার প্রচন্ড খুদা পেয়েছে।’
‘কী খাবে?’
‘পোলাউ, রোস্ট, গরুর গোস্ত, কাবাব, ফিরনী, মিষ্টি, বিয়ের যত খাবার আছে সব।’
‘রিয়েলী?’
‘হ্যাঁ।’
‘এখন এতসব খেতে পারবে?’
‘হ্যাঁ পারব। কারণ আমি দুপুরে কিছু খাইনি। সকালে বাড়ি থেকে নাস্তা করে বের হয়েছিলাম। তারপর কিছু খাইনি।’
শিহাব বেশ অবাক হয়ে বলল,
‘কী? কেন? আমার সাথে খেতে বললাম বললা, লিপি ভাবি আর মায়ের সাথে খাবে।’
‘তাদের কাছে বলেছি আমার বোনদের সাথে খাবো।’
‘তাহলে খাওনি কেন?’
‘যেদিন থেকে আপনাকে বিয়ে করে ঐ বাড়ি ছেড়েছি সেদিন থেকে ঐ বাড়ির খাবার নিজের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি?’
শিহাব অত্যন্ত অবাক হয়ে বলল,
‘কী?’
‘হ্যাঁ। শিহাব মনে আছে আমাদের বউভাতের দিন, যখন নাইয়োরি নিতে এলো, তখন সমাজ রক্ষার্থে সেদিন বিকালে আমি গেলাম ঠিকই এবং আপনাকে অনেক বলে পরেরদিন সকালে চলে এসেছিলাম।’
‘সেদিন কিন্তু আমি আপনাদের বাড়ি থেকে দুপুরে খেয়ে গেছিলাম, আর পরের দিন এসে দুপুরে আবার আপনার বাড়ির-ই ভাত খেয়েছিলাম। আমার বাড়ির অন্ন আমি নিজের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছি।’
‘কেন?’
আগে আমাকে খাওয়ান তারপর বলছি। আমার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।
রেস্টুরেন্টে যাবার পর রেনু তেমন কিছু অর্ডার করল না। শুধু এক প্লেট মাটন কাচ্চি আর ফিরনী অর্ডার করল। দুই লোকমা মুখে দেওয়ার পর বলল,
‘জানেন শিহাব, এই অন্ন আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে। বিধবা হওয়ার পর আমি নিজ ইচ্ছায় পেট ভরে কখনও খেতে পারিনি। আমার মাকে আপনি অনেক ভালো জানেন, সম্মান করেন, আশাকরি আমার কথাগুলো শোনার পরও, তার প্রতি আপনার তেমনই সম্মান বজায় থাকবে!
বিধবা হবার পর আমার প্রতি সবার কেমন যেনো নেগিটিভ মনোভাব তৈরী হলো। কেন তৈরী হলো তা আমি আজও বুঝতে পারি না। সবার চোখে কাটা হয়ে গেছিলাম আমি। কেন জানি আমি যা-ই করতাম সবার কাছে তা অপছন্দ হতো।
মা-ও তাদের মধ্যে একজন ছিলেন। মা আমার থেকে তার স্নেহের আঁচল সরিয়ে কঠিন রূপ ধারণ করলেন। আমি নিজের ঘরে, নিজ হাত দিয়ে কিছু খেতে পারতাম না। মা আজে বাজে কথা শোনাত। প্রায়ই বলত স্বামী খেয়ে পেট ভরেনি? এখনও এত খাচ্ছিস?
রুমি, রোমনার প্রতি মায়ের ভালোবাসা আরও বাড়ল। খাবারের সিংহভাগটা সবসময় ওদের ভাগে জুটত। দেখা যেতো মাছের বা মাংসের দুটো পিচ থাকলে মা ওদের দু’জনকে দিয়ে আমাকে বলত অন্য কিছু দিয়ে খেয়ে নে।
শিহাব, কখনো মরিচ পোড়া দিয়ে ভাত খেয়েছেন? খেয়ে দেখবেন ভালো লাগবে। তিন বছরে আমি বহুবার খেয়েছি। তরকারি কম থাকলে আমার কপালে শুকনা পোড়া মরিচ অথবা কাঁচা মরিচটাই জুটত। বাড়ির পোষা কুকুরকেও মানুষ যতটা মূল্য দেয় আমি ততটাও মূল্য পাইনি।
জানেন শিহাব, শীতের দিনে দুধ চিতই পিঠা আমার খুব পছন্দের। তো গতবার শীতে ভয়ে ভয়ে মাকে গিয়ে বললাম, মা দুধ চিতই পিঠা বানাবে? আমার খেতে ইচ্ছা করছে। মায়ের বোধ হয় আমার প্রতি দয়া হয়েছিলো, তিনি পিঠা বানালেন। আমি শিল পাটায় চাল বেটে দিয়েছিলাম। পিঠা বানিয়ে রাতে মা ভিজিয়ে রাখলেন। বিধবা হওয়ার পর খাবার জন্য এত খোটা শুনেছিলাম যে, নিজ হাত থেকে ঘরের খাবার নিয়ে খেতে ভয় পেতাম। সকালে আমি না খেয়েই বাচ্চাদের পড়াতে নিয়েছিলাম। এগারোটায় সবার পড়া শেষ করে আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম,
‘মা খিদা লাগছে।’
মা বলেছিলেন,
‘রাতের ভাত আছে সেটা খা।’
আমি খুব ধীর কণ্ঠে বলেছিলাম,
‘মা পিঠা নেই?’
মা বলেছিলেন,
‘তোর জন্য রেখেছিলাম কয়েকপিচ কিন্তু এই মাত্র রোমনার বান্ধবী আসছে। রোমানা তার জন্য সেগুলো নিয়ে গেছে। তোকে পরে একদিন আবার বানিয়ে দিব।’
আমি চুপ করে চলে এসেছিলাম সেদিন। মা জানতেন দুধ চিতই আমার সবচেয়ে পছন্দের। কিন্তু আমার জন্য এক পিচও রাখেননি। এরকম বহু ঘটনা আছে শিহাব।’
রেনু কাঁদছে, অশ্রুগুলো ওর গাল বেয়ে প্লেটে পড়ছে। শিহাব হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছতে নিলে, রেনু বলল,
‘চোখের পানি খাবার অভ্যাস আমার আছে শিহাব। বিগত তিন বছরে আমার বাড়িতে আমি একটা কাজের মেয়ের মতো মূল্যও পাইনি। বাবা তো আমার সাথে কথাই বলতেন না। আবদার করা, অভিমান করা ভুলেই গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে খিদা সহ্য হতো না, বারবার পানি খেতাম। তারপর যখন কোচিং-এ বেশ ক”জন বাচ্চা আসা শুরু করল, তখন দেখতাম নিজের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা বেশি থাকে। সেই টাকা দিয়ে বিস্কুট কিনে রাখতাম। যখন খুব খুদা লাগত তখন খেতাম। গত তিন বছরে বাইরের মানুষের কথার চেয়েও বেশি আঘাত আমার পরিবার আমায় দিয়েছিলো। এ কথা অবশ্য বাইরের কেউ কখনও টেরও পায়নি।
এমন পরিস্থিতিতে অনেক মেয়েই হয়তো সু*ই*সা*ইড করত, আমিও বেশ কয়েকবার মরতে চেয়েছিলাম। ফ্যানের সাথে শাড়িটাও বেঁধেছিলাম অনেকবার কিন্তু ঝুলে পরার সাহসটা আর হয়েছিলো না তখন। কষ্টের হলেও জীবনটাকে ভালোবাসতাম। সবচেয়ে বেশি ভয় হতো আল্লাহকে। ভাবতাম এ জীবনে তো কষ্টের সীমা নেই, আ*ত্য*হ*ত্যা করে কি ঐ জীবনটাকেও নষ্ট করব? এসব ভেবে আর পারিনি নিজেকে শেষ করতে।’
রেনুর কথাগুলো শুনে কষ্টে শিহাবের বুকটাও আটকে যাচ্ছে। ওরা রেস্টুরেন্ট এর ফ্যামিলি কেবিনে বসা। যার কারণে বাইরে থেকে ওদের কেউ দেখছে না। শিহাব এতক্ষণ অন্য সাইডে বসে রেনুর কথা শুনছিলো। এবার রেনুর সাইডে এসে রেনুর কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘এত কষ্টে ছিলে রেনু?’
‘শিহাব, মা আমাকে ২১ বছর অনেক ভালোবাসা দিয়েছিলো কিন্তু গত তিন বছরে যা কষ্ট দিয়েছেন তার কারণে পিছনের একুশ বছরের মধুর স্মৃতি আমি ভুলে গেছি।’
‘কিন্তু রেনু বাইরে থেকে আমি যখন খোঁজ নিতাম তখন তো সবাই বলতো তোমার বাড়িতে তুমি ভালো আছো?’
তাচ্ছিল্য হেসে রেনু বলল,
‘একটা কথা আছে, নদীর এপারের লোক বলে, ঐ পাড়েই বুঝি সব সুখ। এ পাড়ে বসে যেমন ঐ পাড়ের লোকদের দুঃখ বোঝা যায় না। তেমনি একটা পরিবারে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আমরা এমন অনেক মানুষকে দেখি, যারা বাইরে সবার সামনে নিজেদের কত সুখী প্রদর্শন করে কিন্তু ভিতরে ভিতরে তারা প্রচন্ড দুঃখি। অনেক লোক পাবেন যা প্রদর্শনে বিশ্বাস করে না, অথচ তাদের সংসারে সুখ উঁপচে পড়ে।
রেনুরা বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণ পর রেনুর বাবা রেনুকে কল করলেন,
চলবে….