একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-০১

0
30

#একমুঠো_রোদ্দুর
#সূচনা_পর্ব
#আদওয়া_ইবশার

“ভালোবাসাহীন সংসারে কখনো সুখী হওয়া যায়?”

বিয়ের জন্য দেখতে আসা পাত্রীর মুখে আচমকা এমন প্রশ্নে ভীষণভাবে চমকায় দিহান। তড়িৎ মস্তিষ্কে জড়ো হয় কিছু অযাচিত ভাবনা। সেই ভাবনা গুলোকে প্রাধান্য দিয়েই মন বলে, নির্ঘাত এই মেয়ের কোনো প্রেমঘটিত সম্পর্ক আছে। না হয় প্রথম সাক্ষাতেই কোন পাগল এমন প্রশ্ন করে? মন-মস্তিষ্কের ভাবনা গুলোকে নিজের মাঝেই দমিয়ে রেখে দিহান পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে স্মিত হাস্যে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে,

“আপনার বাবা-মায়ের কী প্রেমের বিয়ে?”

প্রশ্নের বিপরীতে পাল্টা প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় অতসী। অসন্তুষ্ট বদনে দৃষ্টিপাত করে দিহানের দিকে। শক্ত মুখে জবাব দেয়,

“না। ওনাদের পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে। এমনকি দাদির মুখে শুনেছি, বিয়ের আগে বাবা-মা একে অপরের ছবিও দেখেনি।”

জবাবে অধর ছড়িয়ে চমৎকার হাসে দিহান। অতসী বিরক্তি ভুলে অবাক নেত্রে তাকিয়ে দেখে, কৃষ্ণ বর্ণের শক্ত পুরুষালী মুখের কোমল হাসি। এই লোক সম্পর্কে অতসী যতদূর জেনেছে, বাংলাদেশ পুলিশের এন্টিটেরোরিজম ইউনিটের একজন সদস্য সে।তার বোকা মনের ভাবনা ছিল, যারা হাতের তালুতে মৃত্যু নিয়ে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসীদের সাথে জীবন বাজি রেখে লড়াই করে, তারা কখনো হাসতে জানেনা।জানে শুধু শক্ত মুখে অস্ত্র চালাতে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে অতসীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাডিশনাল এসপি তাহমিদ সারোয়ার দিহান তার বোকা মনের ভাবনা গুলোকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিচ্ছে। বলিষ্ঠ দেহের ভাজে ভাজে গম্ভীর্যতার স্পষ্ট ছাপ নিয়েও মুক্ত ঝরা হাসি হাসতে থাকা যুবকের দিকে অবাক নেত্রে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন এক ঘোরের মাঝে তলিয়ে যায় অতসী। চোখ-মুখের অবাক, বিস্ময় ভাব একটু একটু কেটে গিয়ে জড়ো হতে শুরু করে অল্প পরিসরে মুগ্ধতা। সেই মুগ্ধতার আবেশটুকু গাঢ় হবার আগেই দিহানের কথায় হুশ ফিরে অতসীর। তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফেরায় অন্যদিকে।

“আচ্ছা! তা, আপনার বাবা-মা কী দাম্পত্য জীবনে সুখী না?”

এই লোক কোন কথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে? ভেবে আবারও বিরক্তির উদ্যোগ সৃষ্টি হয় অতসীর মাঝে। কপাল কুঁচকে বলে,

“আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব এখনো পাইনি।”

“কিন্তু আমি তো আপনার প্রশ্নের জবাবটাই দিচ্ছি। তফাৎ শুধু এটুকুই, সোজাসুজি না দিয়ে প্রেকটিক্যালি বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমার প্রশ্নের উত্তরটা দিন, এখানেই আপনার প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।”

হেয়ালিপনা সর্বদায় অপছন্দনীয় অতসীর। অথচ এই লোক সেই শুরু থেকেই তার সাথে হেয়ালি করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে লোকটাকে তার ভীষণরকম অসহ্য লাগছে। হাসি দেখে যেটুকু মুগ্ধতা এসে ঘিরে ধরেছিল, সেটা কেটে গেছে এক লহমায়। বোঝা হয়ে গেছে, এই লোক হয়তো সোজা জবাব দিতে জানেনা। না হয় এমন একটা সহজ প্রশ্নের উত্তরে এতো ধাঁধার সৃষ্টি করবে কেন? ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রেখে অতসী জবাব দেয়,

“আমার দেখা হ্যাপী কাপলদের মধ্যে অন্যতম আমার বাবা-মা। জন্মের পর থেকে কখনো তাদের মধ্যে কোনো প্রকার ঝগড়া হতে দেখিনি। মাঝেসাজে বাবা যদি কখনো কিছু নিয়ে রেগে যেতো, তবে মা চুপ থাকতো। আবার কখনো মা রেগে গেলে, বাবা চুপচাপ মায়ের অভিযোগ গুলো মেনে নিতো। দিন শেষে ঠিক আবার তারা হাসি মুখে একসাথে চায়ের আড্ডায় বসতো। এখনো এই ধারা অব্যাহত।”

“পেয়েছেন আপনার প্রশ্নের উত্তর? এরপরও যদি আমার মুখে শুনতে চান, তবে বলছি। আমাদের আশপাশে একশোর মাঝে নব্বইটা বিবাহ’ই কিন্তু পারিবারিক ভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। বিয়ের পর দিব্যি তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে সুখের সংসার করছে। তাদের মাঝে যদি ভালোবাসা, মায়া না জন্মাতো, তবে কী তারা সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারতো?”

“আমি তো এটা জানতে চাইনি। জানতে চেয়েছি ভালোবাসাহীন সংসারে সুখী হওয়া যায় কী না।”

এ তো মহা মুশকিলে পরা গেল!এই মেয়ের মনে চলছেটা কী? নিম্নোষ্ঠ কামড়ে ভাবুক নজরে কতক্ষণ অতসীর উদাস মুখের দিকে তাকিয়ে দিহান হাস্যজ্জ্বল মুখটাকে গম্ভীর করে জবাব দেয়,

“ভালোবাসাহীন সংসার কেন হবে? বিয়ে এক পবিত্র বন্ধন, যে বন্ধনে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার রহমত বর্ষিত হয়। দুটো মানুষ যতই অচেনা, অপরিচিত হোক না কেন, বিয়ের পর তারা ঠিক একে অপরের প্রতি মায়ার টান অনুভব করে। আর সেই টান থেকেই সৃষ্টি হয় ভালোবাসা। তবে হ্যাঁ, যদি বিয়ের আগেই মনে একজনকে পোষে রেখে অন্যজনের নামে কবুল বলেন, তবে সেটা ভিন্ন বিষয়। মনটা আগেই অপাত্রে দান করে ফেললে ভালোবাসাহীন সংসার তো হবেই, সেই সংসারে অশান্তিরও কোনো কমতি থাকবেনা।”

নিরব অতসী কথা গুলো শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়না। দিহানের গম্ভীর মুখের থেকে দৃষ্টি হটিয়ে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। এই ফাঁকে দিহান খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে, তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্ভূত মেয়েটাকে। গতকাল বিকেলে কর্মস্থল থেকে সাত দিনের ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে দিহান। বাড়িতে পা রাখতে না রাখতেই শুরু হয় বাবা সাদেক সাহেবের মেয়ে দেখতে যাওয়া নিয়ে তোড়জোড়। মেয়ে তাদের পূর্ব পরিচিত। দিহান না দেখলেও বাকী সবাই আগে থেকেই মেয়েকে চিনে, তার একমাত্র ভাগ্নের হোম টিউটর অতসী ইবনাত। বাবা-মায়ের বড়ো মেয়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্রী। তাছাড়া দেখতেও সুন্দর। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা না হলেও চেহারা, উচ্চতা, দৈহিক গড়নে বিয়ের বাজারে যোগ্য পাত্রী হিসেবেই বিবেচিত অতসী। পারিবারিক অবস্থানও যথেষ্ট ভালো। বাবার অঢেল অর্থ থাকা সত্বেও অনার্সে এডমিশনের পর থেকেই তুখোর আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন অতসী টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালায়। তার ভাষ্যমতে, নিজের খরচ নিজে চালানোর মাঝে অন্যরকম একটা আনন্দ পাওয়া যায়। নিজেকে কখনো কারো প্রতি বোঝা মনে হয়না। অতসীর এই মনোভাবের কারণেই একমাত্র ভাইয়ের বউ করার জন্য দৃষ্টির মেয়েটাকে ভীষণ মনে ধরে। আস্তেধীরে অতসীকে যাচাই-বাচাই করে নিজের পছন্দের কথাটা বাবা-মায়ের কানে তুলে। দিলশান আরা, সাদেক সাহেব কাল বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ প্রস্তাব রাখে অতসীর বাবা খালেদ ভুঁইয়ার কাছে।পাত্র এটিইউ এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেখে প্রথমেই রাজি হয়নি খালেদ ভুঁইয়া। গোপনে ছেলের স্থায়ী ঠিকানা ময়মনসিংহ খোঁজখবর নিয়ে ছেলে সম্পর্কে, ছেলের বাবা-মা সম্পর্কে পজেটিভ ফিডব্যাক পাবার পরই, আয়োজন করে মেয়ে দেখতে আসার জন্য অনুমতি দেয়। এতো কিছু ঘটে যাবার পরও কিছুই জানতনা দিহান। গতকাল বাড়ি আসার পরই প্রথম বাবার মুখে শুনেছে, তাদের মেয়ে পছন্দ হয়ে গেছে, এবার দিহান সচোক্ষে দেখে হ্যাঁ বললেই শুভকাজ সেড়ে ফেলবে। বাবা-মা, বোনের মুখে একদিনেই মেয়ের সম্পর্কে এতো এতো গুণকীর্তন শুনেছে দিহান, শেষ পযর্ন্ত নিজের মনেও ভীষণ কৌতূহল জাগে মেয়েটাকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু এখানে এসে মেয়ের এমন আচার-ব্যবহার দেখে দিহান যারপরনাই অবাক হয়ে ভাবছে, বাবা-মা,বোন কিভাবে তার জন্য এমন একটা বেলেহাজ মেয়ে পছন্দ করল?

স্বাভাবিকভাবেই কোনো মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসলে লাজ রঙে রাঙা থাকে কনের মুখ। লজ্জা আর নার্ভাসনেসে পাত্রীর কায়া জুড়ে থাকে এক অন্যরকম দ্যুতি। অজানা শিহরণে ঢিপঢিপ সুর তুলে কাঁপতে থাকা বুকে জুবুথুবু হয়ে লজ্জালু মুখ পুরোটাই লুকিয়ে ফেলে ঘুমটার আড়ালে। কিন্তু এই মেয়ের ভাবগতি পুরোটাই ভিন্ন। লজ্জার পরিবর্তে পুরো মুখ জুড়ে তার বিরক্তির ছড়াছড়ি। ভোতা মুখ করে কপাল কুঁচকে সটান দাঁড়িয়ে আছে। দিহান আর এক মুহূর্ত না ভেবে ধরে নেয় মেয়েটার কোনো ছেলের সাথে গভীর প্রেমের সম্পর্ক আছে। না হয় পাত্রের সামনে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করার কোনো মানেই হয়না।
একে বিয়ে করলে দেখা যাবে,বিয়ের পর সে কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলেই মেয়ে ভাগবে প্রেমিকের সাথে। এই মেয়েকে বিয়ে করা অসম্ভব, অসম্ভব, অসম্ভব। পাত্রী এখানেই ক্যান্সেল। দিহানকে শূলে চড়ালেও সে এই প্রস্তাবে আর ঢোক গিলবেনা। বউ নিয়ে তার বহু স্বপ্ন। পুরো যৌবনের প্রেম যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে,বিয়ের পর বউকে উজার করে দিবে বলে। এই স্বপ্ন আর জমিয়ে রাখা প্রেম গুলো সে ভুলেও অপাত্রে দান করবেনা।

অন্যমনষ্ক দিহানের আকাশ-কুসুম ভাবনার মাঝেই চিলেকোঠার দরজার আড়াল থেকে অল্প মাথা বের করে ছোট্ট রোদ্রিক মামাকে ডেকে ওঠে,

“মামা! আমার মিসের সাথে তোমার এতো কিসের কথা? এখনো আসছোনা কেন? আর দেরী করলে আমরা কিন্তু তোমাকে রেখেই চলে যাব।”

শেষ কথাটুকু হুমকির সুরে বলে রোদ্রিক চোখ পাকিয়ে তাকায় দিহানের দিকে। ভাগ্নের এমন বড়দের মতো শাসন করার ব্যর্থ প্রয়াস দেখে শরীর দুলিয়ে হেসে ওঠে দিহান। তার সেই হাসির শব্দে অতসী আবারও বাইরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকায় দিহানের দিকে। ঠিক সেই মুহুর্তে দিহান নিজেও ফিরে তাকায় অতসীর দিকে। দুজনের দৃষ্টির মিলন ঘটে বোধহয় কিছু মুহূর্ত। অতসীর বেশিক্ষণ সাহস হয়না, ঐ পুরুষালী গভীর চোখ দুটোতে তাকিয়ে থাকার। কেমন যেন অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরে তাকে। অতসীকে তড়িৎ নজর সড়াতে দেখে পূণরায় ঠোঁট এলিয়ে হাসে দিহান। নিচু সুরে বলে,

“আসছি, ভালো থাকবেন।”

বলতে বলতে রোদ্রিকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ দুই হাতে এক ঝটকায় কোলে তুলে নেয় তাকে।

****
বহুদিন পর শিকদার মঞ্জিল আজ একাধিক মানুষের হাসি-গল্পে মুখরিত। ড্রয়িং রুমে ঝমঝমাট চায়ের আড্ডা জমিয়েছে রেহানা বেগম, সাদেক সাহেব, দিলশান আরা। পাশেই রোদ্রিকের সাথে দুষ্টুমিতে মেতে উঠেছে দিহান। কতক্ষণ পরপর রোদ্রিকের বাচ্চা সুরের খিলখির হাসি ঝঙ্কার তুলছে চারপাশে। আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছে পুরো বাড়ি। রান্নাঘরে কাকলির মায়ের সাথে দ্রুত হাতে রাতের রান্না শেষ করছে দৃষ্টি। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখছে ড্রয়িং রুমের হাস্যজ্জ্বল পরিবেশ। এতো এতো সমাগম আর ব্যস্ততার মাঝেও দৃষ্টির কী যেন একটা নেই নেই মনে হচ্ছে। মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে বারবার। রক্তিম সেই সকালে বেরিয়েছিল, এখন পযর্ন্ত ফিরে আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই যেন রক্তিম দৃষ্টির ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। কথা ছিল সেও আজ দৃষ্টিদের সাথে অতসীকে দেখতে যাবে। কিন্তু সাহেব জনসেবায় এতোই ব্যস্ত, তাদের সাথে পাত্রী দেখতে যাবে দূরের কথা, যেতে পারবেনা এই কথাটাও ফোন করে একবার বলতে পারেনি। শেষ দুপুর পযর্ন্ত তার অপেক্ষায় বসে থেকে পরবর্তীতে তাকে ছাড়াই অতসীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরুতে হয় সবাইকে। সেই কবে, কখন দুজন একান্তে বসে মন খুলে দুটো কথা বলেছিল, মনে পরেনা দৃষ্টির। সে ভেবেছিল, তাদের সাথে যেতে না পারলেও হয়তো আজ বাড়িতে মেহমান থাকায় অন্যদিনের তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে। কিন্তু দৃষ্টির ভাবনাটাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে পুরো দিন পাড় করেও রক্তিম দেখা দেয়নি। রান্না প্রায় শেষের দিকে রেখে রুমে ফিরে যায় দৃষ্টি। ফোন হাতে নিয়ে রক্তিমের নাম্বারে ডায়াল করে। পরপর দশটা কল দেবার পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়না রক্তিমের। অষ্টাদশী কন্যার অবুঝ মনের মতো দৃষ্টির পরিণত মনটাও অভিমানে ফুলফেপে ওঠে। বিমূঢ় হয়ে ঠাই বসে থাকে বিছানায়।

“তোমার সাথে কিছু কথা ছিল আপু।”

হঠাৎ দিহানের ডাকে তড়িৎ নিজেকে সামলে নেয় দৃষ্টি। যথাসম্ভব চোখ-মুখ স্বাভাবিক করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দিহানকে বলে,

“ভিতরে আয়। ঐখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবি না কী?”

“ভাইয়া ফোন ধরছেনা?”

রুমের ভিতর প্রবেশ করতে করতে দিহান জানতে চায়। গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃষ্টি স্মিত হেসে মাথা নাড়ায়,

“উঁহু। জনাব এখন ভীষণ ব্যস্ত। বউ-বাচ্চা, সংসারের দিকে খেয়াল রাখার সময় আছে না কী তার? বাদ দে ঐসব কথা। তুই বল, কী কথা আছে আমার সাথে? সিরিয়াস কিছু ?”

বোনের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে আলগোছে মুচকি হাসে দিহান। বিছানার একপাশে হাত-পা ছেড়ে শুয়ে পরে ঠাট্টার সুরে বলে,

“তোমাকে আগেই বলেছিলাম, এই গুন্ডার প্রেমে পড়োনা। লাইফ পুরো ত্যানাত্যানা হয়ে যাবে। শুনলেনা আমার কথা। এখন বুঝো কেমন লাগে।”

ভাইয়ের কথায় সাথে সাথে খ্যাপাটে আচরণে দৃষ্টি ধাপধাপ কিল বসিয়ে দেয় দিহানের দুই বাহুতে।

“তোরা মা-ছেলে হাত ধুয়ে আমার স্বামীর পিছনে লেগে থাকিস কেন সবসময়? কখনো দেখেছিস ওকে গুন্ডামি করতে?”

বলিষ্ঠ দুহাতে বোনের আক্রমণাত্মক হাত দুটো আকরে নেয় দিহান। হাসতে হাসতে শোয়া থেকে ওঠে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে বলে ওঠে,

“আমরা গুন্ডামি করতে না দেখলেও, তুমি তো ঐ গুন্ডার ফাইটিং স্কিল দেখেই কপুকাত হয়েছিলে। অস্বীকার করতে পারবে এই কথা?”

“ঐসব বিয়ের আগের ঘটনা। এর মাঝে আট বছর চলে গেছে।মানুষ সবসময় এক রকম থাকে না কী?”

“বাঃহিক দিক থেকে মানুষ পরিবর্তন হলেও ভিতরে ভিতরে তার পুরোনো স্বভাবটাই বেঁচে থাকে। আগেই ছিল গুন্ডাদের মতো চালচলন, এখন আবার করে রাজনীতি। খোঁজ নিয়ে দেখো দৈনিক কয়টার হাত-পা গুড়ো করে গাছের সাথে উল্টো ঝুলিয়ে রাখে। এমনিতেও রাজনীতিবিদ এক একটা গুন্ডাদের থেকে কোনো অংশে কম না।”

গম্ভীর মুখে বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে কথা গুলো বলে দিহান। ভাইয়ের দিকে পিটপিট নজরে তাকিয়ে দৃষ্টি ঠ্যাস মেরে জবাব দেয়,

“এক বাচ্চার মা হয়ে গেছি। বুড়ো বয়সে এখন স্বামীর দোষ-গুণ বিচার করে কোনো লাভ নেই। এমনিতেও ঐসব রাজনীতি করতে গেলে একটু আধটু মারপিট করে হাত শক্ত রাখতেই হয়। এসব চিন্তা সাইডে রেখে তুই তোর কথা ভাব। তুই যে একটা আগাগোড়া মানুষ রুপি বাঁদর, এটা কী তোর কোর্সমেটরা জানে? আমি মাঝে মাঝে ভীষণ অবাক হয়ে ভাবি, তোর মতো একটা নাচনেওয়ালা বাঁদর কীভাবে পুলিশের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ইউনিটে চাকরি পেল? সাথে ইদানিং এটাও ভাবি, অতসীর মতো একটা শান্ত-শিষ্ট মেয়েকে তোর মতো বাঁদরের গলায় ঝুলালে না জানি বিয়ের দুদিনের মাথাতেই বেচারিকে পাবনায় শিফট হতে হয়।”

অতসী, নামটা শুনতেই দিহান একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে।ফাজলামি রেখে মুখ ভঙ্গি সিরিয়াস করে বলে,

“ফাজলামি বাদ, সিরিয়াস কথায় আসি! ঐ মেয়েকে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না।”

চলবে….