একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-০৫

0
17

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ৫
#আদওয়া_ইবশার

“কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে কখনো রাতের বেলায় বাইরে থাকে? থাকলেও সেই মেয়েকে পথচারীরা ভুল ক্রমেও ভদ্র ঘরের মেয়ে হিসেবে বিবেচনা করেনা। কোনো এক অভদ্র, উশৃঙ্খল,বস্তি ঘরের মেয়ে হিসেবেই বিবেচনা করে তাকে।”

অতসীর নিরবতা সহ্য করতে না পেরে দমিয়ে রাখা রাগটা মাথাচারা দিয়ে ওঠে দিহানের। ক্ষুব্ধ স্বরে বলে ওঠে মুখে যা আসে তাই। হুট করে ধেয়ে আসা কথার বাণটা এবার বড্ড গায়ে লাগে অতসীর। অচল মস্তিষ্ক সচল হয় সহসায়। তৎক্ষণাৎ সে নিজেও দিহানের দিকে দু পা এগিয়ে এসে তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে ঝাঝালো সুরে বলে ওঠে,

“একদম পরিবার তুলে কথা বলবেন না। কী জানেন আমার পরিবার সম্পর্কে আপনি? আমার পরিবার সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনেও তাদের তুলে আমাকে অপমান করে ভেবেছেন নিজেকে খুব রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে হিসেবে প্রমাণ করে ফেলেছেন? কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনার এই নিচু মানসিকতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে যে, আপনার বাবা-মায়ের শিক্ষার ঘাটতি আছে। তারা শুধু টাকা ঢেলে আপনাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছেন। পারিবারিক মূল্যবোধ এক বিন্দুও শিখাতে পারেনি।তা না হলে, কারো সম্পর্কে কোনো কিছু না জেনে এভাবে কথা বলতে পারতেন না।”

হাপাচ্ছে অতসী। অতিরিক্ত রাগে দুচোখ উপচে জল গড়াচ্ছে অনর্গল। ঠোঁট দুটোই তিরতির কাঁপন ধরেছে। তার তেইশ বছরের জীবনে বোধহয় এই প্রথম কেউ পরিবার তুলে এতো বড়ো একটা অভিযোগ তুলল। তাও সেই ব্যক্তি, যে কী না পাত্র হিসেবে একদিন আগেই তাকে দেখে এসেছে। ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে অতসীর, এরকম নিচু মানসিকতার একটা বদ্ধ উন্মাদের সাথে তার বিয়ের কথা উঠেছিল। সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিল দেখেই বোধহয় বিয়ের কথা এগোনোর আগেই আজ তার স্বরুপ অতসীর সামনে প্রকাশ পেয়ে গেছে।

দিহান হতবাক হয়ে তাকিয়ে অতসীর মুখপানে। অবাক নেত্রে দেখে যাচ্ছে অতিরিক্ত রাগে তার কেমন পাগলপ্রায় দশা। কতক্ষণ আগেও ভয়ের চোটে কেঁদেছে মেয়েটা, এখন আবার কান্নার দরুন চোখ-মুখ কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। অবাকতার চরম পর্যায়ে গিয়ে দিহান ঐ কান্নারত রাগী মুখটার দিকে তাকিয়েই থাকে। একটা সময় তার বিচক্ষণ গভীর চোখ দুটো আবিষ্কার করে, কান্নার মাঝেও মেয়েটার চেহারায় এক অন্যরকম দ্যুতি ছড়িয়ে আছে। তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট আর ক্ষণেক্ষণে ফুলে উঠা নাকের ডগায় তাকিয়ে মনে হচ্ছে,এই মুহূর্তে তার সামনে সেদিনের দেখা স্বল্পভাষী, কথায় কথায় বিরক্তিতে কপাল কুঞ্চিত করা গুরুগম্ভীর অতসী নই। বরং অল্পতেই কেঁদে সাগর বানিয়ে ফেলা বাচ্চা স্বভাবের এক আদুরে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্বাভাবিক মুখের থেকেও দিহানের কাছে কান্নারত মুখটা বড্ড আদুরে লাগছে। মেয়েটা যে একটু আগে তার পারিবারিক শিক্ষার উপর আঙুল তুলেছে, এটা যেন তার মাথাতেই ঢুকেনি। ঢুকলে কী আর এমন ঘোরলাগা চোখে চেয়ে থেকে কান্নার মাঝে লুকিয়ে থাকা আদুরে ভাব খোঁজে বেড়াতো? দিতনা পাল্টা জবাব? দিহানকে কোনো প্রতিবাদ করতে না দেখে বিস্মিত ইমরান। হা করে তাকিয়ে থাকে মুখে কুলুপ এটে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকা দিহানের দিকে। খানিক পর সে নিজেই প্রতিবাদী সুরে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে থাকা মেয়েটাকে ধমকে ওঠে,

“অ্যাঁই মেয়ে, কার সাথে এভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলছো তুমি? জানো ইনি কে?”

অতসী দুহাতে চোখ মুছে শক্ত মুখে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই দিহান ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি সুরে ইমরানের উদ্দেশ্যে বলে,

“তোমাকে মাতব্বরি করতে বলেছি?”

দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে না জানায় ইমরান। দিহান পূণরায় প্রশ্ন করে,

“তো আগ বাড়িয়ে পন্ডিতি করতে আসছো কেন? এখানে স্বয়ং আমি উপস্থিত আছি। আমাকে না ডিঙিয়ে নিজের সীমায় থাকো। আর তুমি কী হ্যাঁ? ওনাকে চেনো তুমি? অপরিচিত কাউকে প্রথম দেখাতেই তুমি সম্বোধন কতটুকু যৌক্তিক?”

ঘূ’র্ণি’ঝড় কোন দিক থেকে এসে কোনদিকে মোড় নিল? বেয়াদব মেয়েটা মুখের উপর অপমান করল অথচ কথা শুনতে হলো ইমরানকে! অপমানে ইমরানের মুখভঙ্গি থমথমে হয়ে যায়। কাচুমাচু মুখ করে “স্যরি স্যার” বলে পিছিয়ে গিয়ে আড় চোখে দেখে নেয় অতসীকে। দিহান শাণিত নজরে ইমরানকে কতক্ষণ দেখে নিয়ে দৃষ্টি ফেরায় অতসীর দিকে। জহুরি নজরে তাকে পরখ করে গমগমে স্বরে বলে ওঠে,

“মেয়েদের এতো তেজ থাকতে নেই। এতে বিপদ বাড়ে। আজকের পর থেকে কাউকে আঙ্গুল উঁচিয়ে কথা শোনানোর আগে ভেবে নিবেন, আপনি একজন মেয়ে। অন্যথায় আপনার কপালে আমি এখনই শনির নাচন দেখতে পাচ্ছি।”

পরপর অতসীর মুখপানে দৃষ্টি স্থির রেখেই ইমরানকে ডেকে ওঠে,

“ইমরান!”

“জ্বি স্যার।”
হতচকিয়ে সাথে সাথে সাড়া থেয় ইমরান। দিহান ধিরে ধিরে অতসীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছন ফিরে হাঁটা ধরে হুকুম ছুড়ে,

“নিজ দায়িত্বে ওনাদের সাভার পৌঁছে দিয়ে কার্যালয়ে ফিরবে।গাড়ি রেখে যাচ্ছি আমি।”

“জুতো মেরে গুরুদানের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা যেতে পারব। বস্তির ছেলেমেয়েরা একা একাই চলাফেরা করতে পারে।”

অতসীর তাচ্ছিল্য সুরের জবাব দিহানের কর্ণকোহরে পৌঁছাতেই হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পিছুমুখী হয়েই ক্ষোরদ্বার আওয়াজে বলে ওঠে,

“একা চলাচল করতে পারেন কী না, তা আমাদের জানার বিষয় না। যেহেতু কো-ইন্সিডেন্টলি আপনি আমাদের অভিযানে জড়িয়ে গেছেন, সেহেতু আপনাকে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দেওয়া এই মুহুর্তে আমাদের কর্বত্য। এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের প্রতিটা সদস্য ব্যক্তিগত ভাবে যেমনই হোক না কেন, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের দায়িত্ব পালনে তারা তৎপর। সো প্লিজ, কো-অপারেট।”
_______

রাতে রোদ্রিককে পাশে বসিয়ে পড়াতে হয় দেখে দৃষ্টি প্রতিদিন রাতের রান্নাটা বিকেলেই সেড়ে রাখে। কিন্তু আজ তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অতসী প্রতিদিন বিকেলে রোদ্রিককে পড়াতে আসে। কোনোদিন সে ঘন্টা ধরে পড়ায়না। বিকেলে তার অন্য কোনো কাজ না থাকাই রোদ্রিকের সাথেই কাটিয়ে দেয়। কোমল, নিষ্পাপ প্রাণটার সাথে তার বিকেলটা খুব চমৎকার কাটে। সেই ফাঁকে দৃষ্টি রাতের রান্নাটুকু শেষ করে নেয়। কিন্তু আজ অতসী না আসায় হয়ে ওঠেনি। হুট করে রেহানা বেগমেরও প্রেশার বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তারের প্রেসক্রাইব অনুযায়ী মেডিসিন নিয়ে দিনের অর্ধভাগ ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন তিনি। রোদ্রিক আজ দাদি, মিস কারো সান্নিধ্য না পেয়ে স্কুল থেকে আসার পর ইচ্ছেমতো জ্বা’লিয়েছে শুধু মা’কে। কখনো বায়না ধরেছে তার সাথে খেলতে হবে, আবার কখনো তার কৌতূহলী বাচ্চা মস্তিষ্কে জড়ো হওয়া হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। মাঝে তো আবার তার খাওয়া, গোসলের ঝামেলা আছেই। এতো বড়ো হবার পরও এখনো তার খাওয়া, গোসল নিয়ে টালবাহানা। এই এক ছেলেকে সামলাতে গিয়েই দৃষ্টির আজ নাজেহাল অবস্থা। ছেলের অতিরিক্ত দুষ্টুমিতে বিরক্ত হয়ে কখনো একটু চোখ রাঙানি দিলেই গলা ছেড়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলেছে। রক্তিমকেও আজ কম জ্বা’লায়নি রোদ্রিক। মায়ের থেকে যতবার ধমক খেয়েছে, ততবার কতক্ষণ ফ্লোরে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদে ঠোঁট ফুলিয়ে মায়ের কাছেই আবদার জুড়েছে,

“পাপ্পাকে ফোন দাও।”

দৃষ্টিও প্রতিবার রোদ্রিকের আবদার অনুযায়ী রক্তিমের নাম্বারে ডায়াল করে ছেলের হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। এমনটা করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছেলের আবদার রক্ষা ছিলনা। মূলত সে চেয়েছিল ফোনের মাধ্যমে হলেও পা’ষা’ণটাও একটু সহ্য করুক ছেলের জ্বা’লা’তন। মা হয়েছে দেখে কী তার একারই এতো ঠেকা ছেলের সব জ্বা’লা’তন সহ্য করা? এসবের চক্করে পরে দৃষ্টির রান্না সহ কোনো কাজই হয়ে ওঠেনি। একটু আগে রেহানা বেগম কিছুটা সুস্থবোধ করাই ওঠে এসে নাতিকে নিয়ে গেছেন নিজের রুমে। দাদির পাশে বসে রোদ্রিক এখন ব্যস্ত পুরো দিনে মা তাকে কয়বার ধমক দিয়েছে সেই নালিশ করতে। এই ফাঁকে দৃষ্টি হাপ ছেড়ে ত্রস্ত রান্নাঘরে ছুটে। ড্রয়িং রুম পাড় হয়ে রান্নাঘরে যাবার পথেই দেখতে পায় কাকলির মা সোফায় পা গুটিয়ে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। দৃষ্টি পায়ের গতি সচল রেখেই চড়া গলায় কাকলির মা’কে বকে ওঠে,

“হ্যাঁ, এটাই করো। পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে সিরিয়াল দেখে কূ’ট’নামি শিখো, আর আমি একা একা খেটে মরি। সারাদিন দেখেছো ছেলের জ্বা’লা’য় এক দন্ড কাজ করতে পারিনি, রান্নার কিছুই যোগাড় হয়নি এখনো তবুও রান্নাঘরে না গিয়ে বসে গেছো সিরিয়াল দেখতে। আসুক রোদ্রিকের বাপ বাসায়, বলব এই মাসের তোমার বেতনটা যেন আমাকে দেয়। সারাদিন খেটে মরব আমি আর মাস শেষে চকচকে হাজার টাকার নোট নিবে তুমি! এটা আর হচ্ছেনা।”

দৃষ্টির এতো গুলো কথাতেও কোনো ভাবান্তর হয়নি কাকলির মায়ের। বরং আর একটু আয়েস করে বসে পান খাওয়া দাঁত গুলো বের করে হেসে বলে ওঠে,

“আইচ্ছা। ভাইজানরে তাইলে এইটাও কইয়া দিয়েন, এহন থেইকা আপনার লাইগা কিনা শাড়ি-গয়না গুলান যেন আমারে দিয়া দেয়।”

দ্রুতগতিতে চলা পা দুটো রান্নাঘরের মুখে এসে তৎক্ষণাৎ থামিয়ে দেয় দৃষ্টি। পিছন ফিরে তির্যক নজরে কাকলির মায়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কেন? আমার শাড়ি-গয়না তোমাকে দিবে কেন? এমনিতে গয়না না দিলেও প্রতি বছর শাড়ি-কাপড় কী তোমাকে কম দেওয়া হয়?”

“হেল্লাই না তো। আপনে যে কইছুইন, আমার বেতন আপনে নিয়া নিবেন, এল্লাই আমিও আপনের শাড়ি-গয়না নিয়া নিমু। দুইজনার কাটাকাটি হইয়া যাইবো তাইলে।”

দন্তপাটি বের করে মুখ ভরে হেসেই জবাব দেয় কাকলির মা। তৎক্ষণাৎ তেতে ওঠে দৃষ্টি।ছেলের য’ন্ত্র’ণায় এমনিতেই মে’জাজ খারাপ, আবার এই মহিলার রসের কথায় মাথায় যেন ধাউ ধাউ করে আ’গু’ন জ্ব’লে ওঠে দৃষ্টির। আগের থেকেও গলা চড়ে ওঠে তার। ঝাঝালো সুরে ধমকে বলে ওঠে,

“শুধু শাড়ি-গয়না নিবে কেন? জামাই আর ছেলে কী দো’ষ করেছে? তাদেরকেও নিয়ে নাও। বুড়ো বয়সে হ্যান্ডসাম একটা জামাই পাবে, সাথে ফ্রি ছেলে। এমন ভাগ্য কয়জনের হয়?”

তড়িৎ সোফা থেকে দুই লাফে নেমে গিয়ে গালে হাত চেপে কাকলির মা অবাক কন্ঠে বলতে থাকে,

” নাউযুবিল্লাহ, তওবা, আস্তাগফিরুল্লাহ! কী কন এইসব বউমণি? হেতে আমার ভাইজান, আপনের জামাই। হেতেরে আমার জামাই কইতে আপনের জি’হ্বা উ’ল্টা’য়না? কাকলির বাপ আমারে থুইয়া আরও দুই বিয়া করনের পরও হেরে আমি মন থেইকা জামাই মানি। আর এইসব পা’পিধা’পি কথা কইয়া ফেরেশ্তাগোর লানত লইবেননা, লগে আমারেও জা’হা’ন্না’মে ঠেলবেন না।”

দৃষ্টি কটমট নজরে কতক্ষণ কাকলির মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে সহসা ডাইনিং থেকে পিরিচ নিয়ে ফ্রিজ খুলে দুটো মিষ্টি তুলে ধেয়ে যায় কাকলির মায়ের সামনে। এক হাতে মিষ্টির পিরিচ আর অন্যহাতে কাকলির মা’কে টেনে পূণরায় সোফায় বসিয়ে কোলের উপর পিরিচটা রেখে দাঁতে দাঁত পিষে হাসি হাসি মুখ করে বলে,

” নাও মিষ্টি খাও আর সিরিয়াল দেখো। প্লেটের মিষ্টি শেষ হয়ে গেলে ফ্রিজ খুলে আরও নিয়ে এসো। আজ থেকে তোমার কাজ এটাই। ধরে নিতে পারো আমার মুখের উপর কথা বলার শাস্তি। একদম আমার রান্নাঘরে পা বাড়ানোর দুঃসাহস করবেনা। করলেই ডিরেক্ট রোদ্রিকের পাপার কাছে গিয়ে বলব, তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও।”

পূণরায় তেজ দেখিয়ে ধুপধাপ পদধ্বনি তুলে দৃষ্টি চলে যায় রান্নাঘরে। কাকলির মা তার যাবার পানে তাকিয়ে মনে মনে হেসে কুটিকুটি হয়ে ভাবে,

“আহা!শাস্তি যুদি এত্তো মিঠা অয় তাইলে তো বেদ্দপ মন চায় খালি খালি বউমণির মুখের উপরে কতা কইতে।”

রক্তিম আজ একটু দ্রুতই সব কাজ দলের ছেলেদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরেছে। মায়ের প্রেশার বেড়েছে শুনেছে আগেই। একা হাতে দৃষ্টি ছেলেকে সামলে ঘরের কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে, কিছুটা বুঝতে পেরেই তার তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরা। ভাদ্র মাসের তালপাকা গরমে গায়ের শুভ্র পাঞ্জাবীটা ঘামে ভিজে একেবারে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টায় গা চিড়বিড় করা অসহ্য রকম গরম। রক্তিমকে ভিতরে আসতে দেখেই লাফিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে টিভি বন্ধ করে দেয় কাকলির মা। কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে রুমের একপাশে। রক্তিম তার দিকে এক পলক তাকিয়ে পাঞ্জাবীর টপ বোতাম খুলে সোফায় গা এলিয়ে জানতে চায়,

“ঘরে বেল আছে না?”

“হ আছে।”

“দশ-এগারো জনের জন্য বেলের শরবত করো।”

“এই এক কলসি শরবত কেডায় খাইবো? আপনের পেডে রা’ক্ষ’স ঢুকছে নি ভাইজান?”

এতো জনের জন্য শরবত করার কথা শুনে যারপরনাই অবাক কাকলির মা। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে প্রশ্নটা করেই ফেলে অবাক মুখে। অল্প বিশ্রামের আশায় সবে চোখ দুটো বন্ধ করেছিল রক্তিম। এর মাঝে কাকলির মায়ের এহেন কথায় চট করে চোখ দুটো খুলে ঝাড়ি মেরে বলে ওঠে,

“বেশি কথা বলবেনা একদম। যা বলেছি তাই করো।”

“ইট্টু আগে বউ ধমহাইলো এহন আইছে জামাই ধমহাইতে। আইজ আমার ধমহা ধমহা কফাল। কোন বা’ন্দি’র ঝির মুখ দেইহা যে ঘুমতে উঠছিলাম, হেই বা’ন্দি’র ঝির চুলের গুছি ধইরা দুইটা টান দিতে পারলে মনের জ্বা’লা মিটতো।”

বিরবির করতে করতে রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরোতে গিয়েও আৎকে ওঠে পা পিছিয়ে নেয় কাকলির মা। দৃষ্টির একটু আগের বলা কথাটা স্মরণে রেখে ভিতরে না গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই উঁকিঝুঁকি মেরে ডেকে ওঠে দৃষ্টিকে,

“বউমণি! ভাইজান আইছে, কইছে দশ-এগারো জনের খাওনের মতো বেলের শরবত করতে।”

তার উচ্চকন্ঠের আওয়াজ রক্তিমের কানে বারি খায়। সহসা মেজাজ বিগড়ে যায়। খ্যাঁকিয়ে বলে,

“শরবত বানানোর কথা কাকে বলেছি আমি? তোকে না কী দৃষ্টিকে? নিজের ফরমাশ অন্যজনের কাঁধে ঝুলাচ্ছিস কেন? পাঁচ মিনিটের ভিতর শরবত নিয়ে আসবি, আর না হয় আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হবি। দ্বিতীয়বার এই বাড়িমুখো হলে তোর পা হাঁটুর নিচ থেকে ভে’ঙ্গে দিব আমি।”

এমন গলার কাছে শ্বাস আটকে আসা ধ’মক শুনেও দৃষ্টির হু’ম’কির কথা মাথায় থাকে না কী? সুরসুর করে রান্নাঘরে ঢুকে একে একে প্রয়োজনীয়তা জিনিস গুলো হাতের কাছে এনে ত্রস্ত শরবত বানানোর কাজে লেগে পরে। কাজ শেষ করে একে একে বারোটা গ্লাসে ঢেলে রক্তিমের সামনে নিয়ে যেতেই চারটা গ্লাস ট্রে থেকে নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রেখে রক্তিম পূণরায় আদেশ ছুড়ে,

“একটা তুই খাবি, বাকী সাতটা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড সহ যারা যারা আছে সবাইকে দিয়ে আয়।”

হা হু মুখে কোনো আওয়াজ না করেই তড়িৎকর্মা হয়ে কাকলির মা ছুট লাগায় বাইরে। কোনোমতে জমের মুখ থেকে তার পালাতে পারলেই হয়। কিন্তু সেই সুযোগ আর হল কই তার? মিনিট গড়াতে না গড়াতেই পা’গলা ষাঁ’ড় ‘কাকলির মা’ বলে হু’ঙ্কার ছুড়েছে। অদৃশ্য হাতে নিজের কপাল চাপড়ে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকতেই সেন্টার টেবিলে থাকা গ্লাস তিনটা দেখিয়ে রক্তিম পূণরায় আদেশ জারি করে, একটা দৃষ্টিকে, একটা মা’কে আর একটা রোদ্রিককে দিয়ে আসতে। হু’কুম জারি শেষ করে বসা থেকে ওঠে লাফিয়ে সিড়ি ভেঙ্গে চলে যায় নিজ রুমের দিকে। কাকলির মা অসহায় মুখে শরবতের গ্লাস হাতে দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতেই সে শ্লেষাত্বক হেসে বলে ওঠে,

“এজন্যই বলে মানুষ শ’ক্তের ভক্ত, নরমের য’ম। খুব তো মুখে মুখে তর্ক করছিলে এতোক্ষন, এখন কেন ভেজা বিড়াল হয়ে গেছো? পারলেনা মুখের উপর না বলে দিতে?”

চলবে….