একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-১০+১১

0
19

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১০
#আদওয়া_ইবশার

কাক ডাকা ভোরে সাদেক সাহেব মসজিদ থেকে ফিরে আবারও ঘন্টাখানেক ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখনই রক্তিমের কল। এতো সকাল সকাল জামাতার ফোন পেয়ে কিছুটা বিচলীত সাদেক সাহেব। মনে শঙ্কা কাজ করে, কোনো বিপদ-আপদ হলো না তো! কালবিলম্ব না করে কল সিরিভ কানে ঠেকাতেই ইথারে ভেসে আসে রক্তিমের ভরাট কন্ঠস্বর,

“আসসালামু আলাইকুম। আপনার মেয়ে অসুস্থ। দেখতে চাইছে আপনাদের। ইচ্ছে হলে এসে দেখে যাবেন।”

বিপরীতে সাদেক সাহেবকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দেয় রক্তিম। হতভম্ব হয়ে সাদেক সাহেব কতক্ষণ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। কাল রাতেও তো মেয়ের সাথে কথা হলো। তখন জানিয়েছিল রক্তিমকে বলে এসে কিছুদিন থেকে যাবে। এর মাঝেই আবার কী হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে ছুটে যায় রান্নাঘরে।

“দিলশান, ঝটপট রেডি হয়ে নাও তো। ঢাকা যাব আমরা।”

চুলায় মাত্রই চায়ের পানি বসিয়েছিল দিলশান আরা। এরমাঝে স্বামীর মুখে এমন জরুরী ভিত্তিতে ঢাকা যাবার কথা শুনে কপাল কুঁচকে নেয়। জিজ্ঞাসু নজরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“হঠাৎ ঢাকা কেন?”

“দৃষ্টি না কী অসুস্থ। রক্তিম ফোন করেছিল।”

মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে যেকোন মা-বাবার পক্ষেই স্বাভাবিক থাকা অসম্ভব হয়ে পরে। যাবার কথা বললেই তো আর চলে যাওয়া যায়না। বাড়িতে আর কোনো মানুষ নেই। সবকিছু গুছগাছ করে রেখে বেরুতে হবে। কিন্তু এমন একটা খবর শোনার পর আর দিলশান আরার হাতে যেন কোনো কাজই উঠছেনা। গোছাতে গিয়ে আরও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে সাদেক সাহেব রক্তিমকে আরও কয়েকবার কল করেছিল। কিন্তু কল তুলেনি রক্তিম। পরবর্তীতে রেহানা বেগমের নাম্বারে কল দেবার পর রেহানা বেগম জানায় রাতের দিকে দৃষ্টি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পরেছে। তাদের বের হতে হতে ভোরের আবছা অন্ধকার কেটে তখন চারদিকে সোনা রোদের লুটুপুটি খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। ছয় ঘন্টা জার্নির পর শিকদার মঞ্জিলে পৌঁছায়। দৃষ্টি তখন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে। তার পাশেই রোদ্রিক বসে। নিজের ছোট্ট হাতে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কান্না সুরে বলছে,

“আমি আর দুষ্টুমি করবনা মাম্মা। পঁচা অসুখকে চলে যেতে বলো প্লিজ!”

চোখ বুজে সেভাবে শুয়ে থেকেই দৃষ্টি ছেলেকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর টেনে নেয়। দিলশান আরা দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়ের মলিন মুখটা দেখেই চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ছুটে এসে শিয়রে বসে মাথায় হাত রেখে বলেন,

“কী হয়েছে তোর আম্মু? কাল রাতেও না কথা বললি!তখন বললিনা কেন অসুখের কথা?”

তড়িৎ চোখ মেলে পাশে মা’কে দেখতে পেয়ে রোদ্রিককে ছেড়ে ওঠে বসে দৃষ্টি। রোদ্রিক ঝাপিয়ে পরে নানার কোলে। দৃষ্টি মায়ের সাথে মিশে গিয়ে অসুস্থ স্বরে বলে,

“তখন ভালো ছিলাম মা, তাই কিছু বলিনি। তাছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। এসিডিটির জন্য মনে হয় একটু পেট ব্যথা আর বমি হয়েছে। এতেই তোমাদের জামাইয়ের অস্থিরতার শেষ নেই। ঐ মাঝ রাতেই হাসপাতালে নিয়ে গেছে।”

মেয়ের মুখে অপছন্দের লিস্টে থাকা জামাইয়ের গুণগান শুনে অসহ্য লাগে দিলশান আরা’র। দৈবাৎ মুখে বিরক্তির রেশ টেনে ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে,

“একদম শাক দিয়ে মাছ ডাকার চেষ্টা করবিনা বলে দিচ্ছি। ওর যদি এতোই তোর প্রতি টান থাকতো, তবে এভাবে অসুস্থ হতিনা। দেখেছিস শরীরের কী হাল করেছিস? ঐ শয়তানটার চোখে বিধে তোর এমন হাল? দয়া-মায়াহীন বর্বর একটা! যে কী না ঘরের বউয়ের যত্নই নিতে জানেনা, সে না কী আবার করে জনসেবা!”

নাতিকে বুকের সাথে চেপে ধরেই মেয়ের পাশে বসে মাথায় আদুরে হাতের পরশ বুলিয়ে সাদেক সাহেব স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন,

“আহা দিলশান! এখন এসব নিয়ে কথা বলার সময়?মেয়েটা অসুস্থ। আর কথা বাড়িয়োনা তো।”

স্বামীকে কড়া সুরে কিছু বলার ইচ্ছে থাকলেও সেই মুহূর্তে ঠান্ডা শরবতের গ্লাস আর নাস্তার ট্রে হাতে রুমে প্রবেশ করা কাকলির মায়ের পিছনে রেহানা বেগমকে আসতে দেখে দমে যায় দিলশান আরা।কুশল বিনিময় শেষ করে জানতে চায় কী থেকে কী হলো, ডাক্তার কী বলল। রেহানা সবটাই একে একে খুলে বলে। বেশ কিছুদিন ধরেই না কী তিনি লক্ষ্য করতেন দৃষ্টি কেমন মনমরা হয়ে থাকে। একটুতেই কাকলির মায়ের সাথে চেঁচামেচি শুরু করে। শরীরটাও ভেঙ্গে আসছিল। কিন্তু অসুস্থ বোধ করছে কী না এটা হাজার বার জানতে চাওয়ার পরও মেয়েটা ওনার কাছে একবারও বলেনি তার শরীর খারাপ বা কোনো কিছু। রক্তিমও তার হাবভাব দেখে দুদিন ধরে বলছে ডাক্তারের কাছে যেতে। কিন্তু দৃষ্টি বেঁকে বসে। কোনো ডাক্তার-ফাক্তার দেখাবেনা সে। বাড়ি গেলেই তার সব রোগ সেড়ে যাবে। তার এমন একঘেয়েমি আর বাপের বাড়ি যাবার কথা শুনে রক্তিম গতকাল একদফা রাগারাগিও করেছে। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। এরপর গত রাতে হুট করেই ঘুমের মাঝে চিনচিন পেট ব্যথায় অস্থির হয়ে ঘুম ছুটে যায় দৃষ্টির।শরীরটাও উত্তপ্ত ছিল। জেগে ওঠার কতক্ষণ পরই আবার গড়গড়িয়ে মুখ ভরে বমি করে দেয়। ঐ রাতেই রক্তিম দৃষ্টির কোনো কথা আমলে না দিয়ে হাসপাতালে ছুটে তাকে নিয়ে। কিছু টেস্টের জন্য ইউরিন আর ব্লাড স্যাম্পল রেখে ডাক্তার দৃষ্টির বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে নরমাল কিছু মেডিসিন প্রসক্রাইব করে। বাকীটা আজ বিকেলে বলেছে রিপোর্ট দেখে শিওর হয়ে ট্রিটমেন্ট শুরু করবে।

***
দুপুরের দিকে দলীয় একটা মিটিং শেষ করে তাড়াহুড়ো করে রক্তিম পার্টি অফিস থেকে বেরুতে নেয়। এখান থেকে সরাসরি ক্লিনিকে যেতে হবে তাকে। রিপোর্ট নিয়ে পুরো দিনটাই রক্তিমের ভীষণ চিন্তায় কেটেছে।কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা।টেবিলের উপরে রাখা ফোনটা হাতে নিতেই দেখতে পায় ফোনের নিচে ভাজ করা ছোট্ট একটা চিরকুট। একবার দেখে চোখ সরিয়ে নিয়েও কী ভেবে যেন কাগজটা হাতে তুলে নেয়। ভাজ খুলতেই স্পষ্ট হয় গুটা গুটা অক্ষরে লেখা,

” কোনটা বেশি প্রিয় শিকদার সাহেব, জীবন না কি ক্ষমতা? জীবনের প্রতি যদি এক বিন্দু মায়াও থেকে থাকে, তবে আশা করি এবার নমিনেশন পত্র জমা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন।”

নিরবে কতক্ষণ চিরকুটের লেখা গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে সেটা পূণরায় ভাজ করে বুক পকেটে রেখে দেয় রক্তিম। চিরকুটটা যেন স্রেফ একটা চিরকুটই। অথচ এতে যে সরাসরি তাকে নির্বাচন থেকে না সরে দাঁড়ালে মে’রে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে, এটা যেন নিতান্তই একটা কৌতুক। এমনভাবেই গা ঝাড়া দিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে রক্তিম বেরিয়ে আসে পার্টি অফিস থেকে। তবে মস্তিষ্কের নিউরন গুলো তুমুল ব্যস্ত এই ভাবনাতেই,পার্টি অফিসের এতো কড়া সিকিউরিটির ভেতর কে বা কারা সরাসরি তার ডেস্কে এসে এমন হুমকিবার্তা রেখে গেল? অফিসের এতো গুলো ছেলেপেলে বা সিকিউরিটি গার্ড কারো চোখেই সন্দেহজনক অপরিচিত কাউকে চোখে পরলনা? ভাবনা গুলো নিজের মাঝে রেখেই এই সম্পর্কে কাউকে কিছু না জানিয়ে রক্তিম সরাসরি হাসপাতালে এসে পৌঁছায়।দৃষ্টির সমস্ত রিপোর্ট দেখে ডাক্তার মুচকি হেসে রক্তিমের চিন্তিত চেহারাটার দিকে দৃষ্টিপাত করে খুশমেজাজে জানায়,

” কংগ্রাচুলেশন্স মিস্টার শিকদার। ইউ আর গোয়িং টু বি ফাদার ভেরি সুন।”

রক্তিমের চিন্তিত মস্তিষ্ক হুট করে এমন একটা খুশির সংবাদে এক মুহুর্তের জন্য সমস্ত ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দেয়।সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াহীন ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে ডাক্তারের মুখের দিকে। কী বলে এই ডাক্তার?সে দ্বিতীয়বারের মতো বাবা হতে যাচ্ছে? সত্যিই কী আজ এমন অনাকাঙ্খিত এক খুশির সংবাদ পাবার ছিল তার? অথচ মনটা তো ছিল তুমুল ভয়ে আচ্ছন্ন। প্রিয় নারীর হুট করে নেতিয়ে পরাই সব কিছুই ছিল বিষাদগ্রস্থ। এতো দুশ্চিন্তার ভীড়ে এমন একটা খুশির সংবাদ পেয়ে রক্তিমের কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ? কিছুই ভেবে পাচ্ছেনা সে। ভদ্রতার খাতিরে হলেও যে ডাক্তারের কথার পৃষ্ঠে তাকে কিছু বলতে হবে এই বোধটুকুও লুপ পেয়েছে। বুকের ভিতরটা তুমুল উচ্ছাসে ফেটে পরছে। ছলকে ছলকে উঠছে পুরো শরীরের রক্ত। নাম না জানা ঠিক এই অনুভূতিটাই তো হয়েছিল যখন প্রথম বাবা হবার সংবাদ জানতে পেরেছিল সে। আজ দ্বিতীয়বারের মতো সেই একই অনুভূতি। একটুও পরিবর্তন হয়নি। ইচ্ছে করছে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পুরো শহরবাসীকে জানাতে, “তোমরা সবাই শুনো। আমি বাবা হতে যাচ্ছি আবারও।” কিন্তু কী আশ্চর্য! মুখ ফুটে ডাক্তারকেও একটা কথা বলতে পারছেনা। গলার কাছেই যেন সব কথারা নিরব অবরোধে আটকে আছে।নিজেকে সামলাতে বহুক্ষণ সময় নেয় রক্তিম। ভিতরে তুমুল আনন্দের হিড়িক নিয়েও বাঃহিক দিকে নিজেকে সম্পূর্ণ গম্ভীরতার আড়ালে লুকিয়ে রেখে রক্তিম জানতে চায়,

” কিন্তু ডক্তর, ওর হঠাৎ এমন আচরণ গুলো একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আমার। আই নো, প্রেগন্যান্সি টার্মে অনেক সিম্পটমস দেখা দেয়। বাট এগুলো তো প্রথম বাচ্চার সময় ছিলনা। কাল রাতে তো আপনাকে সবটাই বলেছি। একটুতেই কেমন খিটখিটে আচরণ করে, মনমরা হয়ে থাকে। আর পেটে ব্যথাটা?”

“প্রেগন্যান্সি সিম্পটমস একেক সময় একেক ধরনের হয়ে থাকে। ফার্স্ট বেবির সময় যে সিম্পটমস গুলো ছিল সেসবই যে এখনো থাকবে এমন কোনো কথা নেই। আবার একেক জনের একেক রকম সিম্পটম দেখা যায়। এগুলো নরমাল বিষয়। টেনশনের কোনো কারণ নেই। আপনার ওয়াইফের ছয় সপ্তাহ চলছে। পেটের ব্যথার যে বিষয়টা এটাও অনেকের ক্ষেত্রে তিন-চার মাস পযর্ন্ত হয়ে থাকে। ভ্রুণ ফিটাসে পরিণত হলে আস্তে আস্তে দেখবেন সবটাই কেটে যাবে। আর বাকী বিষয়টা যেহেতু দ্বিতীয়বার বাবা হচ্ছেন আশা করি বুঝবেন এই পুরো জার্নিতে একটা মেয়ে কতটা সেন্টেটিভ হয়ে ওঠে। খেয়াল রাখবেন টেনশন ফ্রি থাকে যেন। প্রেগন্যান্সি রুলস গুলো মেনে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া সব কিছু ঠিকঠাক রাখবেন। আশা করি কোনো মেজর প্রবলেম হবেনা।”

ডাক্তারের সাথে আলোচনা শেষ করে বুকের ভিতর অবিরাম ছুটতে চাওয়া সুখের পায়রাটাকে সন্তর্পণে দমিয়ে রেখে বাড়ি ফিরে রক্তিম। ড্রয়িং রুমে তখন জম্পেশ চায়ের আড্ডা বসিয়েছে রেহানা বেগম, দিলশান আরা, সাদেক সাহেব, দৃষ্টি। রোদ্রিক মেঝেতে বসে তার পাপ্পার নতুন কিনে দেওয়া রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি নিয়ে খেলাই ব্যস্ত। অপরদিকে কাকলির মা ভীষণ মনযোগের সাথে সিরিয়াল দেখায় ব্যস্ত। সদর দরজাটা হাট করে খোলা।যেটা দেখেই রক্তিমের খুশি খুশি মেজাজে অল্প ভাটা পরে। বাড়ির চারপাশে যেদিন থেকে কড়া সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেদিন থেকে এরা যেন ভুলেই গিয়েছে দরজা লাগানোর বিষয়টা। রক্তিমের হাজার বুঝানোতেও এদের কোনো হেলদুল নেই। শশুর-শাশুড়ির দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই গমগমে সুরে ধমকে ওঠে রক্তিম,

“আস্ত এক ডাকাতদল এসেও যদি সব লুট করে নিয়ে যায় এরপরও তো মনে হয় কারো কোনো হুশ থাকবেনা সেদিকে। কতদিন বলতে হবে মেইন দরজা বন্ধ রাখার কথা?”

তৎক্ষণাৎ উৎসব উৎসব আমেজে পূর্ণ ড্রয়িং রুমটা নিরবতায় ছেয়ে যায়। নিস্ফল তাকিয়ে থাকে সকলে রক্তিমের মুখের দিকে। দৃষ্টি আড়চোখে একবার বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে আবারও রক্তিমের থমথমে মুখের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে দিলশান আরা তাচ্ছিল্য স্বরে বলে ওঠেন,

“যে ছেলে বাসায় আসতে না আসতেই ষাঁড়ের মতো চিল্লাচিল্লি শুরু করে, সে না কী আবার তোর খুব খেয়াল রাখে!এই তার নমুনা!ঘরে যে অসুস্থ বউ রেখে বাইরে গেছে সেই ধ্যান আছে বলে তো মনে হচ্ছেনা।থাকলে অবশ্যই সবার আগে এসে বউয়ের খোঁজ নিত।এভাবে গুন্ডাদের মতো আচরণ শুরু করতনা।”

ততক্ষণে রোদ্রিক ঝাপ দিয়েছে বাবার কোলে। কে কাকে কী বলছে, এসব দেখার সময় তার নেই। রক্তিম কোণা চোখে শাশুড়িকে একবার দেখে নেই। ছেলের কপালে চুমু দিয়ে ঝলমলে চুল গুলো এলোমেলো করতে করতে বলে,

” খোঁচাখোঁচি স্বভাবটা এবার ছাড়ুন। দ্বিতীয়বারের মতো নানি হতে যাচ্ছেন। এখনো এমন হিংসুটে আচরণ মানায় আপনার সাথে?”

বলা শেষে দৃষ্টির দিকে এক নজর তাকিয়ে ছেলেকে কোলে নিয়েই ধুপধাপ পা ফেলে উপরে ওঠে যায়। ড্রয়িং রুমে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ বিস্ফুরিত নজরে তাকিয়ে থাকে তার যাবার পানে। সকলেই হতভম্ব।দৃষ্টি বিহ্বল হয়ে একবার তাকায় রক্তিমের যাবার পানে আর একবার তাকায় নিজের উদোরে। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে সর্বপ্রথম সাদেক সাহেব মুখ ভরে হেসে বলে ওঠেন,

“আলহামদুলিল্লাহ।”

চলবে…

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১১
#আদওয়া_ইবশার
নব প্রাণের আগমনী বার্তায় উল্লাসে মেতে উঠেছে শিকদার মঞ্জিল। রেহানা বেগম দুই মেয়ে সহ কাছের যত আত্মীয় আছে ইতিমধ্যে সবার কাছেই পৌঁছে দিয়েছে বার্তাটা। চোখে-মুখে তার উপচে পরছে আনন্দধারা।এভাবেই নতুন প্রজন্মের আগমনে শিকদার মঞ্জিল আবারও আগের মতো প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠবে।ছোট ছোট নাতি-নাতনি গুলো ঘুরে বেড়াবে পুরো বাড়ি জুড়ে। ওনার বৃদ্ধ বয়সের একমাত্র খোশগল্পের সঙ্গী হবে তারা। জীবন থেকে নেওয়া কিছুটা সত্য ঘটনা আর বাকীটা মনের মতো কল্প কাহিনী জুড়িয়ে অবসরে নাতি-নাতনিদের গল্প শুনাবে। শেষ বয়সে এসে একাকিত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যস্ত থাকবে তাদের নিয়েই। এর থেকে বড়ো আনন্দের আর কিছু হতে পারে? অন্যদিকে কাকলির মা নিজ দায়িত্বে পুরো এলাকায় বার্তাটা পৌঁছে দিয়েছে ঢোল পেটানোর মতো করেই। সাভার এক আসনের এমপি রক্তিম শিকদার আবারও বাবা হতে যাচ্ছে খবরটা যেন বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পরেছে সর্বত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতেও চর্চা শুরু হয়ে গেছে এসব নিয়ে। দলীয় নেতাকর্মী সহ পরিচিত মহলের প্রত্যেকেরই একের পর এক ফোনকল রিসিভ করে শুভেচ্ছাবার্তা শুনতে শুনতে কয়েক ঘন্টাতেই রক্তিম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।এক ফাঁকে রক্তিম ফোন রেখে ওয়াশরুমে ঢুকেছিল গোসলের জন্য। দুই মিনিট কোনোমতে শেষ হতে না হতেই ওয়াশরুমের দরজায় কড়াঘাত দৃষ্টির,

“ফোন এসেছে আপনার। তাড়াতাড়ি আসুন।”

প্রচণ্ড পরিমাণে মেজাজ খারাপ হয় রক্তিমের। এই আতেল গুলোর কারণে কী এখন সে বাবা হয়েও শান্তিতে থাকতে পারবেনা? এ কেমন জীবন রে ভাই! সে বাবা হচ্ছে ভালো কথা, কিন্তু ঐসব নেতাফেতাদের এমন আহ্লাদে আটখানা হবার মানে কী? একেই বোধহয় বলে, যার বিয়ে তার খোঁজ নেই পাড়া-পরশীর ঘুম নেই।গায়ে মাত্রই সাবান লাগিয়েছিল রক্তিম। চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে ধমকে জবাব দেয়,

” এখন কী আমি শান্তিমতো গোসলটাও করতে পারবনা?না কী ওয়াশরুমে আসলেও ফোন নিয়ে আসতে হবে?”

ঠোঁট উল্টায় দৃষ্টি। অবুঝের মতো বলে,

“আমি কী জানি?”

একই নাম্বার থেকে লাগাতার কল আসতেই থাকে আসতেই থাকে। রিংটোনের শব্দে অধৈর্য হয়ে দৃষ্টি আবারও চ্যাঁচিয়ে বলে,

“কোনো জরুরি ফোন হবে হয়তো। আপনি দরজাটা খুলুন, আমি রিসিভ করে লাউডে দিয়ে আপনার সামনে ধরি। কথা বলে নিন।”

রক্তিম কোনো জবাব না দিয়েই খুট করে দরজাটা খুলে দাঁড়ায়। কোমরে টাওয়াল পেচানো। মাথা থেকে পা অব্দি শ্যাম্পু আর বডি ওয়াশের ফেনায় মাখো মাখো।ফিক করে হেসে ওঠে দৃষ্টি। রোদ্রিককে ডেকে জোরে বলে ওঠে,

“কই রে রোদ্রিক, দেখে যা আমাদের ওয়াশরুমে একটা কিউট সাদা ভূত এসেছে।”

চোখ পাকিয়ে তাকায় রক্তিম। মুখে হাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে দৃষ্টি কল রিসিভ করে স্পিকারে দিয়ে রক্তিমের মুখের কাছে ধরে। ঐ পাশের ব্যক্তিটা যেন অধীর আগ্রহে রক্তিমের ফোন রিসিভ করার অপেক্ষাতেই ছিল। সে কিছু বলার আগেই ইথারে ভেসে আসে শুভেচ্ছাবার্তা,

” অভিনন্দন এমপি সাহেব।”

এটুকু শুনেই মেজাজ চটে ওঠে রক্তিমের। ফাজলামি পেয়েছে এরা?শুভেচ্ছাবার্তা জানানোর জন্য এভাবে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছিল? এক পলক ফোনের স্ক্রীনে তাকিয়ে নাম্বারটা দেখে নেয় রক্তিম। অপরিচিত একটা নাম্বার। ভয়েসটাও মনে হচ্ছেনা এর আগে কখনো শুনেছে। কেমন বাচ্চা বাচ্চা স্বর। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির ফোনকল নই বুঝতে পেরে রক্তিম প্রস্তুত হয় জোরালো এক ধমকে কিছু কঠিন কথা শুনাতে। কিন্তু এবারও তার বলার আগেই ঐপাশ থেকে ভেসে আসে,

“আপনার বাবা হবার সংবাদে আমি যেমন খুশি তেমন একটু চিন্তিতও বটে। না জানি বাচ্চাটা পৃথিবীতে এসে বাবার মুখটা দেখতে পায় কী না। ব্যাপারটা ভীষণ দুঃখের বুঝলেন এমপি সাহেব, একটু বুঝে-শুনে সামনের দিকে আগাবেন। আমি বাপু বুঝিনা, বাবা হবার মতো ইয়াং বয়সে অযথা কেন রাজনীতির মতো নোংরা খেলাই জড়ালেন? এই বয়সটা বউ-বাচ্চা নিয়ে ফুর্তি করে কাটানোর কথা ছিল। অথচ তা না করে কন্টিনিউয়াসলি যমদূতকে ইশারায় ডাকছেন। ভেরি ব্যাড।”

এমন খুশমেজাজী, শীতল হুমকিতে একটুও বিচলীত দেখায়না রক্তিমকে। বরং বিরক্তিতে মুখে ‘চ’ বর্গীয় উচ্চারণ করে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে,

“ঘুমানোর আগে কি এখনো ডাইপার পরে ঘুমাস? আমি ভেবে অবাক হচ্ছি, এমন একটা নেংটু বাচ্চাকে আমার পার্সোনাল কনট্রাক্ট নাম্বার কোন নির্বোধ দিল? বাপ হবার সংবাদ শুনে মনটা ফ্রেশ আছে আজকে, তাই তোকে ফ্রিতে একটা এডভাইস দিচ্ছি। ভালো করে শুনে রাখ, পরবর্তীতে কারো সাথে এমন হুমকি হুমকি খেলা খেলতে চাইলে সবার আগে বাংলা সিনেমা গুলো দেখে নিস। নাটক-সিনেমায় হাজার হাজার হুমকিমূলক ডায়লগ আছে। ঐগুলো দেখলেও অন্তত একটু কিছু শিখতে পারবি। বাকীটা পরবর্তীতে আমিই শিখিয়ে দিব সময় করে। এখন ফোন রাখ। অলরেডি এক বাচ্চার বাপ হয়ে গেছি, আরেক বাচ্চা আসছে। তোর মতো বাচ্চার সাথে বালুভাত খেলার বয়স অনেক আগেই পাড় করে এসেছি। তাই আপাতত কোনো ইন্টারেস্ট পাচ্ছিনা।”

ঐপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ খিকখিক হাসির আওয়াজ ভেসে আসে। এক কন্ঠ না, একাধিক কন্ঠের উচ্চস্বরের হাসির আওয়াজ। রক্তিম বিরক্ত হয়ে নিজেই হাত বাড়িয়ে কল কেটে দেয়। মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় দৃষ্টির বিস্ফুরিত আক্ষিদ্বয় কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। মুখ জুড়ে ছড়িয়ে আছে চাপা ভয়। রক্তিম বুঝতে পারে, এই ফাঁপা হুমকিতেই মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। ডাক্তার আজই তাকে শতর্ক করল, দৃষ্টিকে যেন সর্বদা চিন্তামুক্ত রাখে, অথচ আজই তাকে এমন একটা বিশ্রী ব্যাপারের সম্মুখিন করলো। হুমকি নামক হাস্যকর বাক্য শুনানো ঐ লেজকাটা বিড়ালটার উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে রক্তিমের। ইচ্ছে করছে ফোনের মাঝে ঢুকেই ব্যাটার দুই গালে তার শক্ত হাতের কয়েকটা আদর দিয়ে আসতে। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে রক্তিম দৃষ্টির দিকে শান্ত নজরে তাকায়। অত্যন্ত কোমল স্বরে বলে,

“বি নরমাল দৃষ্টি। ঐসব কিছু উঠতি বয়সী কলেজ পড়ুয়া ছেলেপেলেরা করে। এরা ভাবে এসব করে বড়ো বড়ো নেতা-কর্মীদের নাকানি-চুবানি খাওয়াবে। দেখবে কালকেই এটাকে খোঁজে বের করে থাপড়িয়ে মুখের নকশা পাল্টে মাথা থেকে শয়তানি বুদ্ধি নামিয়ে দিব।”

দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়না। বরং আরও আশ্চর্য হয় এমন সরাসরি হুমকি শুনেও রক্তিকে নির্বিকার দেখে। তার চোখ-মুখের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ফোনের কথা গুলো সে স্রেফ মজার ছলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দৃষ্টি পারছেনা তার মতো স্বাভাবিকভাবে সবটা মেনে নিতে। ভয়ে জুবুথুবু অন্তরাত্মা। অশান্ত হচ্ছে হৃৎপিন্ডের গতি। কেমন যেন এক অজানা শঙ্কায় বুকটা আৎকে আৎকে উঠছে। ভীষণ উদগ্রীব হয়ে দৃষ্টি বলে,

“এটাকে আপনার এমন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার মনে হচ্ছে? কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের আর খেয়ে কাজ নেই যে, তারা আসবে আপনার মতো এমপি-মন্ত্রীদের ফাঁপা হুমকি দিয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনতে! এর আগেও এমন ফোনকল এসেছিল? স্পষ্ট করে বলুন আমাকে।”

রক্তিম নিস্পলক তাকিয়ে দেখে দৃষ্টির আতঙ্কিত কায়া। পরপর চাপা স্বরে ধমকে বলে,

“কী সব আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঢুকাচ্ছো? কোন সিচুয়েশনে আছো ভুলে গেছো সে কথা? তোমার এসব ফালতু টেনশনের জন্য আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হোক আমি চাইনা। একদম মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো এসব।”

দৃষ্টি অনঢ়। শক্ত কন্ঠে পূণর্বার জানতে চায়,

” আগেও এমন কোনো হুমকির সম্মুখিন হয়েছেন কী না বলুন। তিল পরিমাণ কোনো সত্য আমার থেকে লুকালে ভালো হবেনা বলে দিচ্ছি।”

দৃষ্টির এমন নাছোড়বান্দা আচরণ দেখেও রক্তিম দুপুরের ঘটনাটা চেপে যায়।ঠোঁট গোল করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পরাজয় স্বীকার করার ভঙ্গিমায় বলে,

“এটাই প্রথম। আগে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এবার দয়া করে এসব দুশ্চিন্তা বাদ দাও। স্থির হয়ে বসো গিয়ে। আমি গোসলটা শেষ করে আসছি।”

দৃষ্টির মন শান্ত হয়না।মাথায় জট পাকিয়ে যায় ঐ কথা গুলোই।মনটা কেমন অস্থিরতায় ছেয়ে যায়। মহামূল্যবান কিছু একটা হারিয়ে ফেলার তীব্র ভয় নামক একটা পোকা এসে বাসা বাঁধে মন-মস্তিষ্ক দুইয়েতেই। কোনো কিছুতেই শান্ত হয়না অশান্ত হৃদয়টা। ঘরময় পাইচারি করে অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টায়। কিন্তু লাভ কিছুই হয়না। বরং সময়ের সাথে সাথে ভয়টা যেন আরও পাকাপুক্তভাবে গেড়ে বসে তার মাঝে। গোসল শেষে রক্তিম বেরিয়ে এসে দৃষ্টির এমন অস্থিরতা দেখে যারপরনাই বিরক্ত। চোখ গরম করে ধমকে ওঠে কঠোর স্বরে,

“হচ্ছেটা কী এসব? আমার কথা কানে যায়না তোমার? শেষবারের মতো বলছি, তোমার এসব ফালতু টেনশনে আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হলে ফল ভালো হবেনা।”

রক্তিমের ধমক,রাগ কিছুই দৃষ্টিকে শান্ত করতে সক্ষম হয়না। বরং সেই অস্থির চিত্তেই রক্তিমের সামনে এসে বলে,

“এখুনি দিহানকে ফোন করুন। সব খুলে বলুন ওকে।ও ঠিক কিছু একটা ব্যবস্থা করবে।”

রক্তিম বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,

” কী মনে হয় তোমার? অসহায় আমি? এটুকু একটা নরমাল বিষয় আমি নিজে হ্যান্ডেল করতে পারবনা?”

“আশ্চর্য! এসব কোন ধরনের কথা বলছেন আপনি?দিহানের কাজই তো উগ্রবাদ, সন্ত্রাস, জঙ্গিদের খোঁজে বের করা। সেখানে ওকে না জানিয়ে আপনি কি করবেন?পলিটিক্যাল পাওয়ার দিয়ে সব হয়ে যায়?”

“কী হয় আর কী হয়না সেটা আমি দেখে নিব। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে বলিনি।”

“ভাবতে বলেননি দেখে আমিও ভাববনা? আপনার মতো এতো বড়ো কলিজা আমার নেই। আমার ভয় আছে, আপন মানুষ হারানোর ভয়। যে মানুষটাকে হাজার পাগলামির পর নিজের করে পেয়েছি সেই আরাধ্য মানুষটাকে হারিয়ে আমি নিশ্চয়ই ভালো থাকতে পারবনা।আমার সামনে এভাবে আমার স্বামীকে কেউ মে’রে ফেলার হুমকি দিয়ে যাবে আর আমি নিশ্চিন্তে হাত গুটিয়ে বসে থাকব, এতোটা পাষাণ হৃদয় আমার এখনো হয়নি।একবার বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ! ব্যাপারটা আপনি যতটা সহজ ভাবছেন হতে পারে এর থেকে দ্বিগুণ ভয়ংকর। দিহানকে না জানান, আপাতত থানায় একটা ডায়েরি করে রাখুন।”

বলতে বলতে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে দৃষ্টি। পূণরায় রক্তিমের কাছাকাছি এসে দুই গালে হাত রেখে তাকে মানানোর চেষ্টায় বলে,

“আপনি ভয় পাননা মানলাম। ভাবতে হবেনা আপনার কথা।কিন্তু একবার আমার কথা ভাবুন, মায়ের কথা ভাবুন,রোদ্রিকের কথা ভাবুন। আর যে আসছে, তার কথাটাও একবার ভাবুন প্লিজ! আপনার কিছু হয়ে গেলে আমাদের কী হবে? আপনার চুল পরিমাণ কোনো ক্ষতিও আমাদের কারো পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। একটু বোঝার চেষ্টা করুন প্লিজ, প্লিজ!”

রক্তিম অপলক তাকিয়ে দেখে যায় দৃষ্টির কান্নাভেজা মলিন মুখ, তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে করা পাগলামি। দৃষ্টির এই ভয়, এই অস্থিরতাটুকু কেন জানি এই মুহূর্তে রক্তিমের হৃদয়ে ভীষণ প্রশান্তি দিচ্ছে। স্বার্থপরের মতো অন্যরকম এক ভালো লাগায় মনটা পুলকিত হচ্ছে এই ভেবে, তাকে হারানোর ভয় অন্য কারো হৃদয়ে অশান্ত ঝড়ের সৃষ্টি করেছে। মেয়েটা কাঁদছে শুধুমাত্র তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। সামান্য একটা ফোনকলের হুমকিতেই যদি ওর এই অবস্থা হয়, তবে রক্তিমের কিছু হয়ে গেলে সে কতটা ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে? এই ভয়,অস্থিরতা চোখের অশ্রু কোনোটাই মিথ্যে না। সবটাই বড্ড আগ্রাসী হয়ে রক্তিমকে জানান দিচ্ছে, তার জন্য কারো হৃদয়ে ভালোবাসার আস্ত এক আকাশ আছে। তাকে ছাড়া সে শূণ্য। এই ভালোবাসার মায়াডোর ছেড়ে রক্তিম কোথায় যাবে? ধীরগতিতে রক্তিম দৃষ্টিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। সন্তর্পণে কপালে এঁকে দেয় ভালোবাসার শুদ্ধতম পরশ। পরপর বর্ষার জলে পরিপূর্ণ টলটলে দীঘির মতো দৃষ্টির সুগভীর চোখ দুটোতে রুক্ষ ঠোঁটের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে মুছে দেয় বিষাদের অশ্রুকণা। কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির রেখা টেনে ফাজলামি সুরে বলে,

“ছয়-সাতটা বাচ্চার বাপ হবার আগে যাচ্ছিনা কোথাও। স্বয়ং যমদূত আসলেও তাকে অনুরোধ করে বলব, আপনি আর কয়েকটা বছর পরে আসুন ভাই। আমার বউ-বাচ্চা রেখে ম’রতে পারবনা আমি। তাছাড়াও আমার এখনো ঘরভর্তি বাচ্চার শখ পূরণ হয়নি। ঠিক আছে!”

চলবে…..