#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৭(প্রথম অংশ)
#আদওয়া_ইবশার
সময় এবং পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। দায়িত্বজ্ঞানহীন একটা মানুষকে মুহূর্ত ব্যবধানে করে দেয় প্রখর দায়িত্ববান। বদলে দেয় গোটা মানুষটার জীবন চিত্র। এই মুহূর্তে যার জীবন্ত প্রমাণ দৃষ্টি। একটা সময় ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের কন্যা। যার দিন গুলো কেটে যেতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে হেসেখেলে, দুষ্টুমি করে। বয়স যখন ঠিক আঠারোতে তখনই হুট করে দখিনা বাতাসের মতোই প্রণয় এসে ছুঁয়ে দেয় তাকে। অষ্টাদশীর হৃদ মাজারে বসতী গেড়ে বসে এক ছন্নছাড়া,উদ্ভ্রান্ত, পথহারা পথিক। সেই একরোখা, বদমেজাজি প্রণয় পুরুষটার মন মন্দীরে নিজের নাম লেখাতে অষ্টাদশীর সে কী পাগলামি! এক প্রকার পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে প্রণয় পুরুষের মন না পেয়েও তিন কবুলে আপন করে নিয়েছিল তাকে। নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল,এই ছন্নছাড়া,বেপরোয়া মানুষটাকে নতুন করে বাঁচার মানে শিখাবে। জানাবে, দেখাবে জীবন কতটা সুন্দর। তার এই কঠিন যুদ্ধের একমাত্র সঙ্গী অসীম ভালোবাসায় একটা সময় ঠিক মানুষটাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। একটু একটু করে ঐ কঠোর হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে। যে বীজ থেকে ছোট্ট একটা চারাগাছ অঙ্কুরিত হয়ে ডালপালা গজাতে শুরু করেছিল সবে।কারো সন্তান থেকে নিজেও হয়ে ওঠেছিল এক সন্তানের মা। বিগত আট বছরের তার এই পথচলাটা কখনো ছিল সরল রেখার মতোই ভীষণ সরল আবার কখনো ছিল বক্ররেখার মতোই আঁকাবাঁকা। তবুও কখনো হার মেনে পিছিয়ে আসেনি। কখনো মুখেও উচ্চারণ করেনি, আমি হাঁপিয়ে গেছি। তার এই অদম্য প্রাণশক্তি আর ভালোবাসার জুড়েই বোধহয় আজ সে এই ঘোর বিপদে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। কাদা মাটির মতোই ভীষণ নরম এবং সরল মনটা আজ এক অদম্য শক্তিবলে ঠাসা।যে শক্তিবলেই প্রতি মুহূর্ত মনের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে দৃষ্টি সামলে নিচ্ছে নিজেকে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভাঙা মনের হদিস কাউকে না দিয়ে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে একা হাতে আগলে রাখছে প্রাণ পুরুষের প্রাণের মানুষ গুলোকে। নিজেকে ব্যস্ত রাখছে নানান কাজে। একটু বিরতী পেলেই যে সুবর্ণ স্মৃতি গুলো মনের দুয়ারে হানা দিয়ে তাকে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। শক্ত মনটাকে ভঙ্গুর করতে উঠেপরে লাগে নাজুক কিছু স্মৃতি। নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হয়। প্রকৃতির শুদ্ধ বাতাসটাও মনে হয় দহনের তীব্র বিষে জর্জরিত। দিলশান আরা শুধু অবাক নেত্রে মেয়েকে ঘুরে ঘুরে দেখে। বিহ্বল হয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় প্রশ্ন করে,
“তুই ঠিক আছিস তো মা?”
মায়ের মুখে প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকায় দৃষ্টি। পরমুহূর্তে ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসি টেনে হৃদয়ের ভাঙাচোড়ার গল্পটাকে সন্তর্পণে লুকিয়ে রেখে জবাব দেয়,
“আমি ঠিক আছি মা। তোমার মেয়ে ঠিক না থাকলে তার বাচ্চা গুলোর কী হবে বলো তো? আমার শাশুড়ির কী হবে? আসার পর থেকেই তো দেখছো মানুষটা ছেলের শোকে একদম বিছানা নিয়েছে। এই মানুষ গুলোকে দুহাতে আমাকে আগলে নিতে হবে। ওদের না সামলে আমি কীভাবে অপদার্থের মতো নিজের কষ্টটাকে জাহির করি বলো তো? আপাতত আমার কষ্ট গুলো আমার মাঝেই চাপা থাক। যার জন্য আমার হৃদয়ে ঝড়ের সৃষ্টি, তার জন্যই যত্ন করে সামলে রেখেছি ঝড়টাকে। সবাই তার অনুপস্থিতিতে শোকে কাতর। আমি না হয় একটু ব্যতিক্রম হয়ে তার উপস্থিতিতেই কাতর হলাম।একমাত্র ঐ মানুষটা ছাড়া যে তোমার শোকাহত মেয়েকে সামলানোর সাধ্যি কারো নেই মা।”
দিলশান আরার চোখ দুটো ঝাপসা হয়। মেয়ের বেদনার্ত হাসিমাখা মুখের কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিধ্বংসী কষ্টের একটু হলেও আচ পায় মাতৃহৃদয়। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।
পুত্রশোকে রেহানা বেগমের অবস্থা ভীষণ করুণ। একটু আগেও কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরেছে। নিজের দুঃখটাকে, চিন্তাটাকে সন্তর্পনে দৃষ্টি একপাশে লুকিয়ে রেখে শাশুড়িকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন করে ত্রস্ত ওয়াশরুম থেকে বালতি ভরে পানি এনে রেহানা বেগমের মাথায় ঢালতে শুরু করেছে। দিলশান আরা, কাকলির মা হাত-পা ঢলে গরম করার চেষ্টা করছে। দরজার পাশে নানার কোলে চড়ে রোদ্রিক আতঙ্কিত মুখে চুপচাপ তাকিয়ে আছে রেহানা বেগমের নিথর মুখটার দিকে। মিনিট পনেরো গড়াতেই কলিং বেলের শব্দ শুনে দৃষ্টি ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাকলির মা’কে বলে,
“দরজাটা খুলে দাও। ডাক্তার এসেছে বোধহয়।”
কালবিলম্ব না করে কাকলির মা ছুটে যায় দরজা খুলতে। ডাক্তার এসেছে ঠিক, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে অতসীও এসে উপস্থিত হয়েছে শিকদার মঞ্জিলে। স্যোসাল মিডিয়ার বদৌলতে এই পরিচিত বাড়িটার সমস্ত খবর পেলেও স্বশরীরে এসে একটু খোঁজ নেওয়ার স্পৃহা দমাতে পারেনি। যত যায় হোক, রোদ্রিককে পড়ানোর সুবাদে হলেও এই পরিবারের মানুষ গুলোর সাথে তার সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যে সম্পর্কের জের ধরে মানুষ গুলোর জন্য অদৃশ্য এক মায়ার টান সৃষ্টি হয়ে গেছে অতসীর মনে। শিকদার মঞ্জিলে পা রেখেই ডাক্তার দেখে অতসী ভেবে নেয় দৃষ্টির বোধহয় কিছু হয়েছে। মেয়েটা মনে হয় স্বামীর এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারেনি। অল্প বয়সী একটা মেয়ে, তার উপর স্বামীর প্রতি অঘাত ভালোবাসার জন্ম হৃদয়ে। এই মেয়েটা কিকরেই বা ঠিক থাকবে এমন একটা পরিস্থিতিতে? ভাবনা গুলো অতসীর মস্তিষ্কে হানা দিতেই আর একটা ভাবনা তৎক্ষণাৎ যুক্ত হয়। দৃষ্টি তো অন্তঃসত্ত্বা,এই শরীরে অতিরিক্ত চিন্তা নেওয়ার ফলে গর্ভের বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? রক্তের সম্পর্ক, সামাজিক আত্মীয়তার বন্ধন না থাকা সত্বেও কথা গুলো ভাবতেই অতসীর বুক কেঁপে উঠে। অবচেতন মনে সৃষ্টিকর্তার নিকট আর্জি জানায়, “হে আল্লাহ একটু রহম করো। সব যেন ঠিক হয়ে যায়। এমন একটা ঘোর বিপদে মাসুম বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি যেন না হয়। বাচ্চাটা তো এখনো দুনিয়াতেই আসেনি। ওকে তুমি এই পাপিষ্ঠে ভরা দুনিয়ার নোংরা খেলার কারণে কষ্ট দিওনা।”
বিরবির করে একমনে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে অতসী দ্রুত সিড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠে। রেহানা বেগমের রুম ডিঙিয়ে দৃষ্টির রুমের দিকে যেতে নিলেই দেখতে পায় এই রুমেই সবাই জটলা পাকিয়ে আছে। ভিতরে প্রবেশ করে বুঝতে পারে দৃষ্টি না বরং এক মা পুত্রশোকে কাতর হয়ে বিছানায় পরে আছে। এই মানুষটার জন্যও অতসীর ভীষণ মায়া হয়। শিকদার পরিবারের পরপর দুজন মানুষ রাজনীতিতে জড়িত থাকায় এই পরিবারের মোটামুটি সব কিছুই পুরো সাভারবাসীর কাছে স্পষ্ট। সবাই জানে রক্তিমের অতীত সম্পর্কে। ছোট ছেলের হত্যার দায়ে মা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়ে বড়ো ছেলেকে ঠিক কিভাবে দূরে ঠেলেছিল এই কথাও কারো অজানা নই। এই একটা পরিবার কত গুলো বছর যাবৎ ভাঙা-গড়ার ভিতর দিয়েই যাচ্ছে! একের পর এক দুঃখের সারথী হচ্ছে পরিবারের প্রতিটা মানুষ। তবুও মানুষ গুলো জীবন যুদ্ধে এক পাও পিছিয়ে যাচ্ছেনা। অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যতের দিকে। তবুও সৃষ্টিকর্তা কেন বারবার এই পরিবারটাকেই এতো কষ্টের মাঝে ফেলে? সৃষ্টিকর্তার এ কেমন বিচার? পরম করুণাময় কেন একটু মুখ তুলে তাকায়না মানুষ গুলোর দিকে?
চলবে…..
#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৭(শেষ অংশ)
#আদওয়া_ইবশার
রেহানা বেগমের অবস্থা গুরুতর। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে হসপিটালাইজ করা হয়েছে। সিটিস্ক্যান রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানিয়েছে হেমোরেজিক স্ট্রোক করেছে। হেমোরেজিক স্ট্রোকের ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলো ফেটে গিয়ে রক্তপাত হওয়াই জ্ঞান হারিয়েছে। দৃষ্টি, সাদেক সাহেব,দিলশান আরা তিনজনই আতঙ্কিত মন নিয়ে রেহানা বেগমকে নিয়ে ছুটেছিল হাসপাতালে। কিছুক্ষণ পর খবর পেয়ে নাহিদ, ইতি ছুটে আসে। সকলের মুখেই স্পষ্ট বিষাদের ছায়া। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেহ গুলো বল হারিয়ে মৃতপ্রায় মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে আইসিইউ রুমের সামনে। কতক্ষণ পরপর ডুকরে কেঁদে উঠছে ইতি। একেতো প্রাণপ্রিয় ভাইটা খুনের দায়ে হাজতে। সেই শোকে মায়েরও আজ করুণ পরিণতি। বাঁচবে কী না এই আশাও এখনো ডাক্তার দেয়নি। যদিও ভাগ্যক্রমে বাঁচে তবুও বোধহয় বাকী জীবনটা পঙ্গুত্বকে বরণ করে চলতে হবে। বিধাতা তাদের এ কোন অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখিন করল জানা নেই কারো। আদও তাদের জীবনের এই গভীর অন্ধকার সময়টা কেটে গিয়ে ভোরের নতুন আদুরে প্রকৃতির মতো স্নিগ্ধ সুন্দর একটা দিন আসবে কী না এও জানা নেই কারো। এরপরও বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ গুলো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কায়মনোবাক্যে মহান রাব্বুল আলামিনের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে সুন্দর একটা দিনের প্রত্যাশায় আছে। বুকের ভিতরের কোথাও একটা নিভু নিভু প্রদীপ শিখা এখনো জ্বলছে। এই প্রবল আত্মবিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভরসা করে গভীর দুঃখের মাঝেও দিশা না হারানো মানুষ গুলোর জীবনে নিশ্চয়ই খুব বেশি দিন সৃষ্টিকর্তা এই দুঃখ রাখবেনা। ওনি যে ভীষণ দয়ালু ,পরম করুণাময়। একমনে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ইতির কান্নামাখা মুখটার দিকে নির্লিপ্ত নজরে তাকিয়ে দৃষ্টি এমন সব আকাশ -কুসুম ভাবনায় ব্যস্ত।খুব শিগগিরই সব ঠিক হয়ে যাবে, মনটাকে বারবার এমন বোঝ দেওয়ার পরও এই মুহূর্তে নিজেকে শক্ত রাখাটা ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছে। শরীরটা ভেঙ্গে আসছে। ইচ্ছে করছে এখানেই শরীর ছেড়ে শুয়ে পরতে। চোখে শত রাজ্যের ক্লান্তি। যেন কতকাল ঘুমায়না! হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে ভাবনা জগত থেকে বেরিয়ে আসে। ঘাড় কাত করে দেখতে পায় দিলশান আরা ফোন বাড়িয়ে রেখেছে। মায়ের দিকে প্রাশ্নাত্বক নজরে তাকাতেই দিলশান আরা বলেন,
“অতসী ফোন করেছে। কথা বলবে তোর সাথে।”
অসুস্থ শাশুড়ির চিন্তায় এতোক্ষন মস্তিষ্ক থেকে রোদ্রিকের চিন্তা একদম বেরিয়ে গিয়েছিল দৃষ্টির। ছেলেটাকে একা বাড়িতে অতসী আর কাকালির মায়ের ভরসায় রেখে এসেছে। মানুষ দুজন রোদ্রিকের পরিচিত হলেও বাচ্চা ছেলেটা যে এখনো মা আর দাদিকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। না জানি তাদের দুজনের একজনকেও না পেয়ে কতটা কেঁদেছে! নিজেদের বিপদের একটা বোঝা ঐদিকে অতসী মেয়েটার উপরও চাপিয়ে দিয়ে এসেছে। সব কিছুই মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিল। বড়ো বড়ো দুটো দম ফেলে দৃষ্টি নিজেকে কিছুটা শান্ত করে। ফোন হাতে নিয়ে কোলাহল থেকে একটু দূরে গিয়ে লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“অতসী, আমি ভীষণ দুঃখিত বোন। আসলে এমন একটা গুরুতর পরিস্থিতিতে আমি তোমার বাড়ি যাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। উল্টো স্বার্থপরের মতো রোদ্রিকের দায়িত্ব দিয়ে আসলাম তোমার হাতে। এখন তো সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। একা যেতে হবেনা তোমার। আমি ড্রাইভার কাকুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওনি তোমাকে সেইফলি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
ডান কানে ফোন চাপিয়ে অতসী ঠোঁট কামড়ে দৃষ্টির কথা গুলো শুনে তড়িৎ বলে ওঠে,
“আপু প্লীজ, আপনি এতো ব্যস্ত হবেননা। আমার কোনো অসুবিধা হয়নি। রোদ্রিক বা আপনারা কেউ কী আমার অপরিচিত? আমি নিজে থেকেই তো রোদ্রিকের সাথে থেকে গেছি। আপনাদের এমন বিপদ দেখেও স্বার্থপরের মতো কিভাবে চলে যাই? আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না আপু। বাড়িতে ফোন করে সব বলে দিয়েছি। আজ রাতটা আমি রোদ্রিকের সাথেই থাকব। বাড়ির দিক নিয়ে আপনি আর টেনশন করবেনা। আন্টির এখন কী অবস্থা সেটা বলুন। আমি ওনার খোঁজ নিতেই ফোন করেছি।”
কথা গুলো দৃষ্টির শরীরটায় যেন এক লহমায় ভীষণ স্বস্তি দেয়। কাকালির মা’কে এমনিতেই খুব একটা ভরসা করতে পারেনা বাড়ির কেউ। টুকটাক যেটুকু কাজ করে সেটাতেও ওনি হাজারটা ঝামেলা বাধিয়ে ফেলে। আর রোদ্রিককে তো এক মুহূর্তের জন্যও সামলাতে পারেনা। ছেলেটাকে বাড়িতে রেখেই এসেছে দৃষ্টি একমাত্র অতসীর ভরসায়। তবুও অতসীর দিকটা ভেবে তাকে বাড়ি যাবার কথা মুখে বললেও মনে মনে ভীষণ চিন্তায় ছিল, যদি সে চলে যায় তবে ছেলেটার কী হবে? হাসপাতালের এই পরিস্থিতিতে ওকে এখানে এনেও রাখা যাবেনা। এদিকে এমন একটা গুরুতর রোগীর পিছনে তিন-চারজন মানুষ লাগবেই। ইতি এমনিতেই দিশাহারা মায়ের শোকে। তাকে সামলিয়েই কূল পাচ্ছেনা মেহেদী। বাকী আছে শুধু দিলশান আরা, সাদেক সাহেব। এই দুজনকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলে অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে দৃষ্টি ভীষণ বিপদে পরে যাবে। কতক্ষণ পরপর এই রিপোর্ট, ঐ টেস্ট, মেডিসিন এসবের জন্য বাইরে দৌড়াতে হচ্ছে সাদেক সাহেবকে। দিলশান আরা’কে প্রয়োজন জ্ঞানহারা মৃতপ্রায় হয়ে বেডে পরে থাকা শাশুড়ির যত্নে। কারো এই মুহূর্তে বাড়ি যাবার পরিস্থিতি নেই। এমন একটা সূচনীয় মুহূর্তে মেয়েটা ভীষণ উপকৃত করেছে তাকে। অতসীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় দৃষ্টির চোখ দুটো ভিজে উঠে। ধরা গলায় জবাব দেয়,
“হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়েছে। জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু অবস্থা এখনো তেমন সুবিধার না। ডাক্তার কোনো ভরসা দিতে পারছেনা।মস্তিষ্কের অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়াই ইলেকট্রিকাল এক্টিভিটি পরিবর্তন হয়ে কতক্ষণ পর পর এপিলেন্সি হচ্ছে। ভালো মানুষটার কী থেকে কী হয়ে গেল! এক বিপদের মাঝে এতো বড়ো বিপদটা আল্লাহ না দিলেও পারতেন।জানিনা আল্লাহ সহায় হবেন কী না। আমি আর নিতে পারছিনা এসব। একের পর এক অঘটন আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। আল্লাহ আমাকে কোন জনমের শাস্তি দিচ্ছে কিচ্ছু জানিনা।”
দৃষ্টির হাহাকার মিশ্রিত কথা গুলো অতসীর হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। এই সুন্দর পরিবারটার কষ্টের গল্প শুনে বুকের ভিতরটা গুমরে উঠে। ভেবে পায়না অতসী ঠিক কী বলে শান্তনা দিবে এই ভঙ্গুর মেয়েটাকে। ভীষণ অস্তস্থিতে গাট হয়ে শুধু এটুকু বলে,
“হতাশ হবেননা আপু। আল্লাহকে ডাকুন। ওনি যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। আপনি প্লীজ নিজেকে শক্ত রাখুন। একটু নিজের দিকেও খেয়াল রাখুন। এতো চাপ নিবেননা। অন্তত পেটের বাচ্চাটার কথা ভেবে ভালো থাকতে হবে আপনাকে।”
বাচ্চার কথাটা শুনে আপনাতেই দৃষ্টির বা হাতটা উদোর স্পর্শ করে।থমকায় কিছু মুহূর্ত। শেষবারের মতো দৃষ্টি বোধহয় কোনো একটা খুশির সংবাদ হিসেবে এই বাচ্চাটার আগমনের কথায় শুনেছিল রক্তিমের মুখে। সেদিন কী ভীষণ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল রক্তিমকে!ঐ কঠোর ধাচের মুখটাই এক অন্যরকম দ্যুতি ছিল। মৃনুষটার যে শাণিত চোখ দুটো সর্বক্ষণ আগুন ঝরায় সেই চোখ দুটোও হেসেছিল ঐদিন।পরিবারের প্রতিটা মানুষের মুখেই ছিল প্রশান্তির হাসি। কিন্তু সেই হাসিটা আর দীর্ঘস্থায়ী হলনা। নিমিষেই কালো মেঘে ডেকে গেল শিকদার মঞ্জিলের হাসিখুশি চিত্রটা। নেমে এলো একরাশ অন্ধকার। যে অন্ধকারে একে একে মুখ থুবড়ে পরতে হচ্ছে পরিবারের প্রতিটা মানুষকে। কথা গুলো স্মরণ হবার পাশাপাশি দৃষ্টির মনটা এক মুহূর্তের জন্য ভেবে নেয়, তবে কী এই বাচ্চাটা তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছে? পর পর নিজেই নিজের এমন হীন ভাবনায় স্তব্ধ হয়। এসব কী ভাবছে সে? যে প্রাণটা এখনো দুনিয়ার আলোটুকুই দেখিনি মা হয়ে সেই প্রাণটাকে কিভাবে দৃষ্টি এমন দোষারোপ করতে পারে? অধিক শোকে পাগল হয়ে গেল না কী সে? নষ্ট মস্তিষ্ক এসব কেমন ভাবনা ভাবছে? ছিহ্ ছিহ্! নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে অনুসূচনায় দগ্ধ মনে পেটে হাত বুলিয়ে বিরবির করে,
“মা’কে ক্ষমা করে দিস সোনা। তোর বাবার শোকে মায়ের মাথাটা একদম গেছে। বিশ্বাস কর, স্বাভাবিক মস্তিষ্কে মা তোকে নিয়ে কখনোই এমন ভাবতোনা। তুই অন্তত একটু বুঝিস আমার কষ্টটা। আমাকে বোঝার মানুষটা যে আমার চোখের আড়ালে। তাকে ছাড়া আমি একটুকুও ভালো নেই। বেঁচে থাকাটাও মনে হচ্ছে ভীষণ কষ্টসাধ্য।”
ফিনাইলের উটকো গন্ধে হুট করে নাড়িভুঁড়ি প্যাচিয়ে বমি আসে দৃষ্টির। মাথাটাও কেমন চক্কর দিয়ে উঠে। চোখের সামনে সব অস্পষ্ট হতে শুরু করে। হাত ফসকে ফোনটা পরে যায় মেঝেতে। নিস্তেজ শরীরটা লুটিয়ে পরতে চায়। রেহানা বেগমের খবর পেয়ে অন ডিউটি থেকেই পাগলের মতো ছুটে এসেছে দিহান। তৃতীয় তলায় লিফট থেকে নামতেই অদূরে বোনকে টলতে দেখে দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে। দুগালে হালকা চাপর দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে ডেকে ওঠে,
” এই আপু! আপু, কী হয়েছে তোমার? খারাপ লাগছে? আপু, শুনতে পারছোনা আমার কথা? এই, আপু!”
দৃষ্টির এমন পরিস্থিতি দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পরিবারের বাকী সদস্য গুলোও ছুটে আসে। মেয়ের বেহাল দশায় শব্দ করে কেঁদে ওঠে দিলশান আরা। সাদেক সাহেব দিহান মিলে ধরানরি করে একটা কেবিনে নিয়ে শুইয়ে দেয় অর্ধচেতন দৃষ্টিকে। মেহেদী ছুটে ডাক্তারের খোঁজে। অল্পক্ষণের মাঝেই ডাক্তার এসে চেকআপ করে জানায়,
” শরীর ভীষণ দূর্বল। প্রেগনেন্ট অবস্থায় এমনিতেই মানসিক চাপ কম রাখতে হয়। সেখানে ওনি একের পর এক টেনশন নিয়েই যাচ্ছে। ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া হচ্ছেনা। প্রেসার একদম লো হয়ে পরেছে। এমন চলতে থাকলে কিন্তু মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে।”
উপস্থিত প্রতিটা মানুষের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরেছে। একের পর এক কো-ইন্সিডেন্সে দিশাহারা প্রত্যেকে। অধিক শোকে কাঁদতেও যেন ভুলে গেছে মানুষ গুলো। আর কত? ঠিক আর কত বিপদের সম্মুখীন করে সৃষ্টিকর্তা তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিবে?
চলবে…..
#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ১৮
#আদওয়া_ইবশার
দৃষ্টির জ্ঞান ফিরেছে অনেক্ষণ। তবে শরীর ভীষণ দূর্বল। স্যালাইন চলছে। এক রোগীকে নিয়ে এসে নিজেই রোগী হয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে ভীষণ অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। গর্ভে থাকা ফিটাসটার কথা ভেবে অস্বস্তিতে ছেয়ে যাওয়া মনটা আবার গুমরে মরছে। বাচ্চাটাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা ভাবতে না ভাবতেই এমন একটা বিপদ হুমড়ি খেয়ে পরল। তবে কী দৃষ্টির মনোকথায় আল্লাহ অসন্তুষ্ট হয়ে এমন একটা বিপদের সম্মুখীন করল? আচ্ছা, বাচ্চাটার আবার কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? অনাগত সন্তানের মায়ায় মাতৃহৃদয় আবেগে আচ্ছন্ন। সেই হৃদয়টাই আবার সন্তানের বিপদের আশঙ্কায় ভীত। কী যে এক দুর্বিসহ যন্ত্রণায় আচ্ছাদিত এক একটা সেকেন্ড! এই বিপদের সময়টা এতো দীর্ঘ কেন? কেন ফুরিয়ে যায়না চোখের পলকেই? তলপেটে হাত রেখে হঠাৎ ফুপিয়ে ওঠে দৃষ্টি। বাঁধ ভাঙ্গে আক্ষিজল। দিলশান আরা ছুটে এসে মেয়ের মাথার কাছে বসে নিজেও কাঁদে। আলতো হাতে মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে বলে,
“খারাপ লাগছে মা? কাঁদছিস কেন এভাবে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল আমায়। ডাক্তার ডাকব?”
দিহান,সাদেক সাহেব, ইতি, মেহেদী সকলেই আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে দৃষ্টির কান্নাভেজা মুখের দিকে। তীব্র যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে দৃষ্টি তড়পাতে তড়পাতে জবাব দেয়,
“আমার বাচ্চা। মা, মা আমার বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে মরে যাব আমি।রোদ্রিকের পাপাকে কী জবাব দিব আমি? তুমি জানোনা মা, ওর আসার খবরে আমার থেকেও বেশি খুশি ঐ মানুষটা। আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্টের সম্মুখীন করছে মা? কেন এতো বিপদে ফেলছে? আমার যে আর সহ্য হচ্ছেনা। কী করলে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাব আমি? কিভাবে মুক্তি পাব এই অভিশপ্ত জীবন থেকে?”
দিলশান আরা মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে কান্নামাখা স্বরেই আশ্বস্ত করেন,
“বাচ্চার কিচ্ছু হবেনা। তুই একটু শান্ত হো মা। দেখ, তুই যদি এভাবে কাঁদিস তবে কিন্তু সত্যি সত্যিই বাচ্চাটার ক্ষতি হবে। বাচ্চা সুস্থ রাখতে হলে সবার আগে তোকে সুস্থ থাকতে হবে। তুই না আমার লক্ষী মা! এমন অবুঝের মতো করিস না মা।একটু শান্ত হো। সব ঠিক হয়ে যাবে। উপরে একজন আছেন। ওনি সব দেখছেন। দেখবি আল্লাহ খুব শিগগিরই এই বিপদ থেকে তোকে পরিত্রাণ দিবেন।”
মায়ের কথা গুলো নিছক মিথ্যে শান্তনা মনে হয় দৃষ্টির। অবুঝ মনটা কিছুতেই শান্ত হয়না। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
“আমার ফোনটা একটু দাও তো মা। রোদ্রিকের সাথে একটু কথা বলব। আমার এতোটুকু ছেলেটা কিভাবে আমাকে ছাড়া থাকবে আজকের রাতটা? ও নিশ্চয়ই আমাকে না পেয়ে খুব কান্না করছে।”
ফোনের কথা কারোর খেয়ালে ছিলনা। সবাই ব্যস্ত ছিল দৃষ্টিকে নিয়ে। এখন মনে পরতেই দিহান বেরিয়ে যায় খোঁজতে। যে করিডোরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি কথা বলছিলো ফোনটা ঐখানে নেই। আশেপাশেও কোথাও খোঁজে পায়নি। শেষমেশ রিসিপশনে গিয়ে বিস্তারিত বলতেই তারা জানায় একজন ওয়ার্ডবয় একটা ফোন পেয়ে রিসিপশনে জমা দিয়েছে। সঠিক তথ্য প্রমাণ দিয়ে রিসিপশনিস্টের থেকে ফোনটা উদ্ধার করে হাপ ছেড়ে বাঁচে দিহান। দৃষ্টির কেবিনের দিকে হাঁটা ধরতেই হুট করে রিংটোন বেজে ওঠে। স্ক্রীনে ইংরেজিতে গুটা গুটা অক্ষরে লেখা “Atoshi” নামটার দিকে কতক্ষণ সরল নজরে তাকিয়ে থাকে দিহান। একবার দুইবার রিং হতে হতে একটা সময় কল কেটে যায়। মুহূর্ত ব্যবধানে আবারও ফোন আসে একই নাম্বার থেকে। ছোট্ট একটা ঢোক গিলে বৃদ্ধাঙ্গুলে স্লাইড করে কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকায়। জ্বিভের ডগায় শুকনো খরখরে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে নেয়। কিন্তু অপর প্রান্তের অধৈর্য ব্যক্তিটা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ভীষণ অস্থিরচিত্তে বলে ওঠে,
“হ্যালো আপু! আমার কথা শুনতে পারছেন? কী হয়েছে ওখানে? লাইনে থেকেও কথা বলছিলেন না কেন? কল কেটে আবার মিনিমাম নব্বইটা কল দিয়েছি রিসিভও করেননি। সব ঠিক আছে তো? আন্টির কিছু হয়নি তো? হ্যালো!”
মেয়েটার উদ্বিগ্নতা ছাপিয়ে দিহানের মনে সর্বপ্রথম যে ভাবনাটা আসে সেটা হলো, “অতিরিক্ত বাচাল”। অসভ্যের মতো শুধু নিজেই বলে যাচ্ছে। অন্যকে আর বলার সুযোগ দিচ্ছেনা। উত্তর দেওয়ার সুযোগটাই যদি না দেয় তবে এতো প্রশ্ন কেন করছে? একটু ধীরস্থির ভাবে, ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বললেই তো হয়। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে দিহান গম্ভীর সুরে বলে,
“আমি, আমি দিহান। আপু একটু উইক হয়ে পরেছে। প্রেসার লো। ঐসময় মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিল সাথে ফোনটাও মেঝেতে পরে গিয়েছিল। ওয়ার্ডবয় পেয়ে রিসিপশনে জমা দিয়ে দেয় ফোন। এইমাত্র রিসিপশন থেকে উদ্ধার করলাম।”
ফোনের অপর প্রান্ত হতে অনাকাঙ্খিত কন্ঠস্বর ইথারে ভেসে আশায় হতচকায় অতসী। মুহূর্তপল চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে উদ্বিগ্নতার সাথে আবারও বলে ওঠে,
“এখন কেমন আছেন আপু? বড়ো কোনো বিপদ হয়নি তো?”
“তেমন কোনো বিপদ হয়নি।শরীর অতিরিক্ত দূর্বল। স্যালাইন চলছে।তবে ডাক্তার জানিয়েছে এভাবে চললে বড়োসড় বিপদ হতে দেরী নেই। যাইহোক, রোদ্রিক কী করছে? আপু কথা বলতে চাচ্ছে ওর সাথে।”
একমনে ড্রয়িং খাতায় মনের মতো রং নিয়ে আঁকিবুকি করতে থাকা রোদ্রিকের দিকে এক পলক তাকায় অতসী। ক্ষীণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। একটু আগেই ছেলেটা মায়ের কাছে যাব বাইনা ধরে কেঁদেকেটে অস্থির হয়েছে। কোনোমতে সামলাতে না পেরে অবশেষে রং পেন্সিল দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছে অতসী।
“এখানেই আছে। রং দিয়ে ড্রয়িং খাতায় আঁকিবুকি করছে।”
“কেঁদেছিল?” চিন্তিত ভঙ্গিতে জানতে চায় দিহান। অতসী সত্যিটাই জানিয়ে দেয়,
“কেঁদেছিল একটু আগে। তবে এখন রং, পেন্সিল পেয়ে শান্ত।”
দুজনের কেউ আর কোনো কথা খোঁজে পায়না। নিরবতায় কেটে যায় অনেকটা সময়। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে থাকা অতসী না পারে কল কেটে দিতে আর না পায় বলার মতো কোনো কথা খোঁজে।
***
মিতালী সাহা টিমের দুজন সদস্যকে নিয়ে রক্তিমের পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দুতালা ভবনের পুরোটাই পুলিশ সিল করে দিয়েছে।মূল ফটক থেকে শুরু করে ভিতরের প্রতিটা কোণায় কোণায় কড়া পাহারায় পুলিশের একটা টিম নিয়োজিত। আসার পর থেকেই মৌন থেকে ঠাই দাঁড়িয়ে চারপাশে শুধু নজর বুলিয়ে যাচ্ছে মিতালী সাহা।
“ম্যাম! আমরা ভিতরে যাব?”
লিগ্যাল রিসার্চার ওবায়েদ হাসানের প্রশ্নে কিছুটা বিরক্তি ভাব ফুটে ওঠে মিতালী সাহার চেহারায়। কপালে ভাজ ফেলে ভীষণ অনিহা নিয়ে বলেন,
“এতো অস্থির হচ্ছো কেন? ভিতরে যাবার থেকেও এই মুহূর্তে যেখানে আছো এখান থেকেই আমরা কোনো সমাধান পেয়ে যেতে পারিনা?”
ওবায়েদ কথা না বাড়ালেও জুনিয়র অ্যাডভোকেট তাপসী বলে,
“কিন্তু ম্যাম এটা আদৌ সম্ভব? আপনার মনে হয় আমরা এই কয়দিন এই কেসটার পেছনে কম সময় ব্যয় করেছি বা বেশি গুরুত্ব দেইনি? পুরো সাভার চষে বেরিয়েছি। কিন্তু কোথাও এমন কোনো ক্লু খোঁজে পেলাম না যার উপর আন্দাজ করে গভীরে ঢুকতে পারব। আমার তো এখন মনে হচ্ছে রক্তিম শিকদার সত্যি সত্যিই খুনটা করেছে। তা না হলে এভাবে সব প্রমাণ ওনার বিরুদ্ধে চলে যেতনা।”
” কিনারায় দাঁড়িয়েই যদি চোখের আন্দাজে নদীর গভীরতা মেপে ঝাপ দাও, তবে নিজেকে বাঁচাতে কতটুকু সক্ষম হবে তুমি? ধরো আমার বাসা বনানী। কিন্তু আমি সাভার এসে বাসার নাম,নাম্বার সবটাই সঠিক বলে বাসাটাকে খোঁজে বেড়াচ্ছি। যদি আমি বনানী না গিয়ে আজন্মকাল এই সাভারেই বাসাটা খুঁজি আমি সফল হবো কখনো? তোমাদের আমি কী বলব বলো তো!দিন দিন কী বুদ্ধি সব হাঁটুর নিচে নেমে যাচ্ছে সবার? গাধার মতো পানির উপর বালি না খোঁজে মগজটাকে কাজে লাগিয়ে বালি খুড়ে পানি খুঁজার চেষ্টা কর।”
ঝাঝালো, তেজোদ্বিপ্ত স্বরে কথা গুলো বলে থমথমে ভঙ্গিতে পার্টি অফিসের অপজিটে এগিয়ে যায় মিতালী সাহা।পিছন পিছন কাচুমাচু মুখ করে ছুটে পাঁচ সহকারী। রক্তিমের পার্টি অফিসের সামনের অংশটা মেইন রোড হলেও পিছনের দিকটা ফাঁকা একটা মাঠ। মাঠের পশ্চিমে পার্টি অফিসের পিছনের অংশ আর ঠিক উত্তরে একটা কওমী মাদ্রাসা। মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে গিয়ে থেমে যায় মিতালী সাহা। তীক্ষ্ম নজরে কতক্ষণ মাদ্রাসা আর পার্টি অফিসের দূরত্বটা আন্দাজ করে ধীর,গম্ভীর স্বরে আদেশ করে,
“একটু খোঁজ নিয়ে দেখো, রাতের বেলায় মাদ্রাসায় কোন শিক্ষক থাকেন। আর চারপাশে কোনো সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে কী না একটু দেখে নাও।”
মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে ওবায়েদ হাসান সেদিকে অগ্রসর হয়। বাকিদের নিয়ে মিতালী সাহা উল্টো ঘুরে এগিয়ে যায় পার্টি অফিসের দিকে। এর মাঝে মেহেদীও এসে উপস্থিত হয় সেখানে।
“সময়ের মূল্য যারা দিতে জানেনা, তাদের জীবনে কখনো উন্নতি সাধন হয়না মেহেদী সাহেব।”
মিতালী সাহার শ্লেষাত্মক কথার কারণ বুঝতে পেরে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসে মেহেদী। কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
“হাসপাতালে দুজন রোগী একসাথে। তার উপর আমার ওয়াইফ শাশুড়ির এমন সিচুয়েশন মানতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেছে। ওকে সামলে আসতে একটু দেরী হয়ে গেল। স্যরি ফর দ্যা লেট।”
“ইট’স ওকে। লেট’স গো ইনসাইট!”
“শিওর।”
যে জিনিসটার জন্য প্রায় আধ ঘন্টা পুলিশের সাথে তর্কবিতর্ক করে মিতালী সাহা পুরো টিম নিয়ে ক্রাইম স্পটে ঢুকলো, তন্নতন্ন করে সবকিছু খোঁজেও সেটার হদিস পাওয়া যায়নি। ব্যর্থ হয়ে এক একজন মিতালী সাহার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেদী পুরোটা সময় নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের কার্যক্রম দেখে গেছে। আগ বাড়িয়ে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি, সেও নিজে থেকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনি। কিন্তু এখন উপস্থিত প্রতিটা মানুষের হতাশায় জর্জরিত মুখ দেখে আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলনা। একটু নড়েচড়ে মিতালী সাহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়,
“আমি কী কোনো হেল্প করতে পারি আপনাদের? যেহেতু রক্তিম আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। এই অফিসেও ওর সাথে আমার অগাধ বিচরণ ছিল। আমার মনে হয় একটু হলেও হয়তো আপনাদের হেল্প করতে পারব।”
কিছুটা সময় নিয়ে মিতালী সাহা গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
“এই রুমে একটা হিডেন ক্যামেরা ছিল। সেটা কোথায় আপনি জানেন?”
কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নাড়িয়ে সাই জানায় মেহেদী। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুমের পূর্বপাশে অসংখ্য বইয়ে ঠাসা সেলটার কাছে।সেলফের দ্বিতীয় তাকের এক কোণে ছোট্ট একটা ফুলদানিতে কিছু আর্টিফিশিয়াল রেইন লিলি রাখা আছে।ঐ ফুল গুলোর ফাক থেকেই ছোট্ট একটা ডিভাইস বের করে আনে মেহেদী। সেদিকে তাকিয়ে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ তাজ্জব বনে যায়। এতোক্ষন পর্যন্ত চারজন মানুষ এই সেলফ থেকেই একের পর এক বই সরিয়ে, উল্টেপাল্টে খোঁজে কাল ঘাম ঝরিয়ে ফেলেছে। অথচ একটাবারও কারো মাথায় আসেনি এই ফুলদানির পিছনেই থাকতে পারে ক্যামেরাটা।মিতালী সাহা নিজেও হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহেদীর দিকে। তবে অন্যদের থেকে ওনার অবাক হবার কারণটা বোধহয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটার প্রমাণ দিতেই তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেহেদীর পানে তাকিয়ে মিতালী সাহা প্রশ্ন করে বসে,
“ক্যামেরাটা যে এখানে রাখা আপনি জানেন কিভাবে?”
এক পলক মিতালী সাহার থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে মেহেদী স্মিত হেসে ডিভাইসটা ওবায়েদ হাসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“একটু আগেই বললাম ম্যাম, রক্তিম আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। ছোট বেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি দুজন। স্কুলে মারামারি থেকে শুরু করে মানুষের ফল গাছের ফল চুরি করে খেয়েছি দুজন ভাগাভাগি করে। কখনো আমরা একে অপরের ক্রাইম পার্টনার, কখনো ওয়েল উইশার, আবার কখনো দুই দেহে এক প্রাণ হয়েই থেকেছি। ওর এমন কোনো কথা বা কাজ নেই যা আমার অজানা, আবার আমারও এমন কিছু নেই যা সেটা জানেনা।যেখানে আমরা দুজন একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ খোলা বই, সেখানে এই ছোট্ট একটা ডিভাইসের কথা আমার অজানা থাকবে কিভাবে?
চলবে….