একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-২২+২৩

0
14

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২২
#আদওয়া_ইবশার

এক ছিল রাজকন্যা। যার বাবার ছিলনা তথাকথিত কোনো রাজ প্রাসাদ। তবুও সে ছিল বাবার আদরের রাজকন্যা। একটু একটু করে হেসে-খেলে বড়ো হচ্ছিলো। জীবনের কোনো জটিলতা বাঁধা হয়নি কখনো তার বেড়ে উঠায়। প্রজাপতির মতো স্বতস্ফূর্তভাবে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো সেই রাজকন্যার জীবনে হুট করে মুঠো বন্দী প্রেম নিয়ে আগমন ঘটে এক রঙিলা বসন্তের। যে বসন্তে রাজকন্যা খোঁজ পায় এক বিষাদপুড়ের রাজপুত্রের। মুখচোরা, ভীষণ বদমেজাজি, একরোখা দুষ্ট রাজপুত্রের প্রেমে বিভোর হয়ে ভুলে যায় রাজকন্যা ভবিতব্যের কথা। ভাবেনা এই বিষাদপুড়ের রাজপুত্র তাকে শুধুই বিষাদের জলে স্নান করাবে। নব্য প্রেমে রাজকন্যার উড়ো উড়ো মন বাস্তবতা ভুলে মজে যায় প্রেম নেশায়।বাস্তবতা ছাড়িয়ে স্বপ্ন দেখে অসাধ্যকে সাধন করার।নিজের সুখের জীবন বিসর্জন দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় রাজপুত্রের রঙহীন জীবনটাকে নিজের প্রণয় রঙে রাঙিয়ে দিবে। কিন্তু মানব জাতির ভাবনা অনুযায়ী কী আর সহজে সব চাওয়া পূর্ণতা পায়? রাজকন্যার এই সহজ-সরল চাওয়াটাও ভীষণ জটিলতায় ছেয়ে যায়। দুঃখী রাজপুত্রের জীবনে সুখ আনতে গিয়ে প্রতি পদে পদে নিজেকে ডুবায় দুঃখের সাগরে। এরপরও রাজকন্যা নিজ সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর। রাজপুত্রের আঁধারে নিমোজ্জিত জীবনে সে আলোর সঞ্চার করবেই।সৃষ্টিকর্তা বোধহয় একটা সময় সদয় হয় রাজকন্যার প্রতি।বহুল আরাধনার পর পাষান রাজপুত্রের পাথুরে হৃদয়ে ভালোবাসার ফুল ফোটাতে সক্ষম হয়। শুরু হয় ছোট্ট এক সুখের সংসার।সুখে-দুঃখে বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল দুজনের দিন গুলো। রাজপুত্র মুখে ভালোবাসার বর্হিঃপ্রকাশ ঘটাতে কার্পণ্য করলেও কোনো অভিযোগ ছিলনা রাজক্যার। উল্টো তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়াটাই চরম সৌভাগ্য মনে করে সুখী ছিল সে। কিন্তু সুখ জিনিসটা কী আর চিরস্থায়ী হয় কারো জীবনে? সে তো হয় দুদিনের অথিতি। রাজকন্যার জীবনেও সুখটা দীর্ঘস্থায়ী হলনা। ফের হুট করেই তার সুখের ঘরের চালায় ঝুমঝুমিয়ে নেমে আসে দুঃখের বর্ষণ। ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাকে দুঃখের অতলে। প্রথমে প্রাণপ্রিয় স্বামী হাজতবাসী হয় মিথ্যে খুনের মামলায়। সেই শোক সামলে উঠতে না উঠতেই অতি আদরের কলিজার টুকরো সন্তান নিখোঁজ। এই এতো এতো দুঃখের মাঝে ডুবতে ডুবতে সেই রাজকন্যার কী আর হাতরে কূল খোঁজে পাবার কথা? সে আজ জনমদুঃখী, কপালপুড়ি চরম অসহায় এক নারী। যার তিন কূলে সব থাকতেও কিছুই নেই। স্বামী, পুত্র শোকে আজ সে হাসপাতালে শয্যাশায়ী।দুই চোখ খুলে চকচকে দুনিয়াটা দেখার বিন্দু মাত্র স্পৃহা নেই তার মাঝে। স্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছেনা দেখেই ভীষণ অনীহায় শুধু নিশ্বাস নেওয়া।

অচেতন হয়ে হাসপাতালের বিছানায় মরার মতো পরে আছে দৃষ্টি।ডান হাতের ক্যানোলায় স্যালাইন চলছে। কিছুক্ষণ পরপর চেতনা ফিরে আসলেও কাঁদতে কাঁদতে আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। একটু আগেও চেতনা ফিরে পেতেই বুক চাপরে করুন নিনাদে ভারী করে রেখেছিল চারপাশ। হাসপাতালের নিঝুম রাতের স্তব্ধ পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো এক অসহায় মায়ের আর্তনাদ। ডাক্তার জানিয়েছে এমন চলতে থাকলে পেটের বাচ্চাটাকে টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পরবে। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ওকে থামাতে হবে। বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হলে মানসিক সকল চাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে তাকে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কার সাধ্যি তাকে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার?

রাত বারোটা ছুই ছুই ঘড়ির কাটায়। ৩০৪ নাম্বার কেবিনের সামনে বিমর্ষ বদনে বসে আছে দিলশান আরা, সাদেক সাহেব, অতসী। মেয়ের পরিণতির কথা ভেবে এক নাগারে আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে যাচ্ছে দিলশান আরা। পুরুষ মানুষ অতি সহজে কাঁদেনা দেখেই বোধহয় সাদেক সাহেবের চোখ দুটো এখনো শুষ্ক। অসহায় মায়ের করুন আর্তনাদের বিপরীতে ঠিক কী বলে শান্তনা দেওয়া যায় জানা নেই অতসীর। শুধু চুপচাপ দিলশান আরাকে আকরে ধরে মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে যাচ্ছে। খুব করে চাইছে কিছু একটা মিরাকেল ঘটে যাক এই মানুষ গুলোর জীবনে। দুঃখের দিন গুলো শেষ হয়ে এক মুঠো রোদ্দুরের পিঠে চড়ে সুখ আসুক। চোখের কোণের কান্না মুছে ফুটে উঠোক প্রত্যেকের ঠোঁটের কোণে প্রফুল্ল হাসি। দিলশান আরার কন্নাভেজা মুখ থেকে নজর সরিয়ে হঠাৎ সামনে তাকাতেই অতসী দেখতে পায় এক ক্লান্ত পরাজিত সৈনিকের ন্যায় করিডোর দিয়ে হেঁটে আসছে দিহান। সাথে সাথে ওঠে দাঁড়ায় অতসী। দ্রুত কদমে এগিয়ে যায়। দিহানের মুখোমুখি হয়ে ভীষণ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,

“রোদ্রিকের কোনো খোঁজ পেলেন?”

অন্যমনস্ক হয়ে হাটতে থাকা দিহান হঠাৎ সামনে কাউকে দেখতে পেয়ে কিছুটা চমকায়। চমকিত মুখেই কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে অতসীর কৌতূহলী মুখের দিকে। মেয়েটা অপেক্ষায় তার মুখ থেকে কিছু একটা শোনার। অন্যদিকে দিহান ব্যস্ত নিজ মনের ভাবনা গুলো মিলানোয়। এই মেয়েটা এতো কেন অস্থির তার বোনের পরিবার নিয়ে? সন্ধ্যায় যখন তার মুখে জানতে পারল রোদ্রিক নিখোঁজ তখন ঠিক কতটা কেঁদে বুক ভাসিয়েছে দিহান নিজ চোখে দেখেছে। পরপর দৃষ্টির অসুস্থতার কথা জেনে আগেপিছে কিছু না ভেবেই দিহানের কাছে বায়না ধরেছে তাকে হাসপাতালে দিয়ে যাওয়ার জন্য।এসব কিজন্য করছে মেয়েটা? শুধুই কী রোদ্রিকের হোম টিউটর বলে? কই অন্য কারো হোম টিউটর তো তাদের ছাত্রের পরিবারের দুঃখের সময়ে এতোটা সাপোর্টিভ হয়না! সবাইকে ছাড়িয়ে তবে কেন এই মেয়ে এতো উদারতা দেখাচ্ছে? ওর মনটা ভীষণ কোমল এজন্যই? না কী নিজেকে যেমনটা প্রকাশ করছে সে তার পুরোই বিপরীত! কোনোক্রমে কী এই মেয়ের হাত থাকতে পারে রোদ্রিকের কিডন্যাপিং এর পিছনে? আজকাল তো অধিকাংশ মানুষ মুখোশধারী হয়। তারা উপরে দেখায় এক রূপ আর ভিতরে থাকে আরেক রূপ।এই অতসী মেয়েটারও কী দুটো রূপ থাকতে পারেনা?

“যেদিন আপনি দায়িত্ব নিলেন রোদ্রিককে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার সেদিনই কেন রোদ্রিক কিডন্যাপ হলো?কোনোভাবে এর পিছনে আপনার সম্পৃক্ততা নেই তো!”

অতসী স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে দিহানের মুখের দিকে। ভুলে যায় কিছু বলতে। শুধু অবিশ্বাস্য নয়নজোড়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেই যায় দিহানের কঠোর মুখটা। এই অবিশ্বাস্য ভাবনাটা কিভাবে এলো এই লোকের মাথায়? অতসীকে সে এতোটাই খারাপ ভাবে? সে মানছে, দিহানের সাথে সে সর্বদা বাজে আচরণ করে। তাই বলে এতোটাই খারাপ অতসী যে একটা বাচ্চা কিডন্যাপিং এর পিছনে তাকে সন্দেহ করবে?

“আপনি আমাকে এতোটা খারাপ ভাবেন?”

কন্ঠে অঘাত বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে অতসী। বিপরীতে দিহান চোখ-মুখ শক্ত রেখেই দিরাজ গলায় উত্তর দেয়,

“আপনাকে ভালো ভাবার আলাদা কোনো কারণ আছে কী? কান খুলে একটা কথা শুনে রাখুন, আমার ভাগ্নের নিখোঁজ হবার পিছনে ভুল করেও যদি আপনি দায়ী হয়ে থাকেন খোদার কসম আমার হাত থেকে আপনি নিস্তার পাবেন না। দুধ-কলা দিয়ে পোষা অনেক কালসাপ দেখেছি আমি। যে কালসাপ এক পর্যায়ে অবিশ্বাস্যভাবে মুনিবের ঘাড়েই ছোবল বসাই। এতো উদারতা কেন দেখাচ্ছেন আমাদের সাথে? কী প্রয়োজন আপনার আগ বাড়িয়ে আমার বোনের পরিবারের পাশে থাকার?শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চেষ্টা করছেন না তো আবার?”

“দিহান!পাগল হয়ে গেছিস তুই? কাকে কি বলছিস? তুই দেখছিস না মেয়েটা প্রথম থেকেই এই পরিবারের জন্য কী কী করছে? সব কিছু দেখার পরও কিভাবে ওকে সন্দেহ করিস? যেখানে মেয়েটার প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞ থাকার কথা,সেখানে তুই কী না এমন অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করছিস?”

সাদেক সাহেব দূর থেকে ছেলের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে ছুটে এসে ধমকে ওঠেন। দিহান যে মেয়েটার সাথে এমন কর্কশ ভাষায় কথা বলবে ওপর ভাবনায় ছিলনা। ছেলের এমন আচরণে লজ্জায় মরি মরি অবস্থা সাদেক সাহেবের। ছেলেকে ধমকে পূণরায় অতসীর বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত কন্ঠে বলে ওঠেন,

“ওর কথায় কিছু মনে করোনা মা। একের পর এক অনাকাঙ্খিত ঘটনায় এর মাথা নির্ঘাত নষ্ট হয়ে গেছে। আর না হয় পুলিশের চাকরি করে করে নিজের মাইন্ডটাকেও ক্রিমিনাল মাইন্ড বানিয়ে ফেলেছে। চোখে মোটা পর্দা পরেছে তো তাই যাকেই দেখছে তাকেই সন্দেহ করে বসছে। বলা যায়না দুদিন পর হয়তো আমি যে বাপ এটা ভুলে আমাকেও সন্দেহের তালিকায় ফেলে দিবে।”

“একদম বাজে কথা বলবেনা বাবা। তোমাদের সবথেকে বড়ো সমস্যা কী জানো? আবেগ বেশি তোমাদের। আবেগের তাড়নায় তোমরা শত্রুকেও বন্ধু ভেবে কোলে বসিয়ে রাখো। কোন প্রমাণের ভিত্তিতে এতো জোর দিয়ে বলছো তুমি এই মেয়ে নির্দোষ? সে যদি জড়িত নাই থাকে, তবে কেন হঠাৎ করে তার এতো শখ হলো রোদ্রিককে স্কুলে দিয়ে আসতে? আর শখ যখন হলোই তবে নিজ দায়িত্বে আবার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার শখ কেন হলনা? দুলাভাই জেলে যাবার পর থেকে রোদ্রিকের স্কুলে যাওয়া বন্ধ রেখেছে শুধুমাত্র তার নিরাপত্তার কথা ভেবে। সেখানে এই মেয়ে কেন পন্ডিতি করে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল ওকে? আজ যদি রোদ্রিক বাড়ির বাইরে না বের হতো তবে ঘটতো এমন একটা ঘটনা?”

ভীষণ খ্যাপাটে হয়ে চড়া গলায় জবাব দেয় দিহান। অতসী শুধু বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে দিহানের শক্ত মুখের দিকে। দুচোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পরে উষ্ণ জলের ধারা। বহুকষ্টে বোবা মুখে শব্দ ফুটিয়ে বলে,

“বিশ্বাস করুন, আমি শুধু রোদ্রিকের ভালোর জন্যই ওকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাড়ির এমন অস্বাভাবিক পরিবেশে বাচ্চা ছেলেটা সর্বক্ষণ থাকলে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পরবে। এমনিতেই বেশিরভাগ সময় বলতো তার পাপ্পা তাকে ভালোবাসেনা, তার কাছে আসেনা। স্কুলে যে সময় টুকু ও থাকতো সহপাঠিদের সাথে হাসিখুশি থাকতো। এটা ভেবেই আমি ওকে স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা। তাছাড়া ওকে কিডন্যাপ করাই কাউকে হেল্প করে আমার কী লাভ? শুধু শুধু কেন আমাকে এতো বড়ো আপবাদ দিচ্ছেন?”

“অতসী মা, ওর হয়ে আমি তোমার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি তো তোমার বাবার বয়সী তাই না বলো!ক্ষমা করে দাও এই বুড়ো বাবাকে। ও সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। ওর কথা তুমি ধরোনা তো।”

সাদেক সাহেব যত যায় বলোক, এতো বড়ো একটা মিথ্যে অপবাদ শোনার পর অতসীর পক্ষে সম্ভব স্বাভাবিকভাবে বিষয়টা উড়িয়ে দেওয়া? শুধু অতসী কেন? কারো পক্ষেই হয়তো সম্ভব না। ঐ এক বিয়ের কথা উঠার পর থেকে লোকটার সাথে তার যখনই দেখা হচ্ছে কোনো না কোনোভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করেই যাচ্ছে। কেন? কী অপরাধ অতসীর? বিয়েতে অমত করেছে এটাই অপরাধ? তবে তো বলা যায় সমান অপরাধী দিহান নিজেও। সেও তো না কী বোনের কাছে সরাসরি বলেছে তার পক্ষে অতসীকে বিয়ে করা সম্ভব না। তবে কেন বারবার লোকটা এমন করে? কী সুখ পায় অতসীকে কাঁদিয়ে? দুহাতে চোখের জল মুছে নাক টেনে অতসী নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বড়ো বড়ো দুটো দম নিয়ে বলে,

“আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন আঙ্কেল। আমার আসলেই এটা ভাবা উচিৎ ছিল, রোদ্রিক আমার আপন কেউ না। ওর উপর কোনো অধিকার আমার নেই। আমি সত্যিই অনধিকার চর্চা করে ফেলেছি। যেটা জঘন্যতম অপরাধ। সেই অপরাধের ফলস্বরূপ আজকের এই অপবাদটুকু আমি মুখ বুজে মেনে নিলাম। ধরে নিলাম এটাই আমার জঘন্য অপরাধের শাস্তি। আজকের পর থেকে আমি আর কখনো আপনাদের পরিবারের কোনো বিষয়ে অনধিকার চর্চা করবনা। সাথে এটাও ভুলে যাব রোদ্রিক নামক কোনো বাচ্চাকে আমি কখনো পড়িয়েছি। ভালো থাকবেন। আর পারলে আমার মতো এতো বড়ো অপরাধিকে ক্ষমা করে দিবেন।”

আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়না অতসী। ছুটে বেরিয়ে আসে হাসপাতাল থেকে। পিছন থেকে সাদেক সাহেব, দিলশান আরা বারবার ডেকে থামতে বলে। কারো কোনো কথায় শুনেনা অতসী। এক ছুটে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে নিস্তব্ধ রাতের পরিবেশ দেখে একটু থমকায়। ভাবনায় পরে এতো রাতে একা একা বাসা অব্দি নিরাপদে যেতে পারবে তো? কিছু সেকেন্ড ভেবে সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ডায়াল করে বাবার নাম্বারে। যত রাতই হোক বাবা অবশ্যই তাকে নিতে আসবে। হাসপাতাল থেকে বাসার দূরত্ব খুব বেশি হলে বিশ মিনিট। এটুকু পথ বাবা আসতে আসতে সে না হয় হাসপাতালের ওয়েটিং জোনে অপেক্ষায় থাকবে। পার্কিং এরিয়ার এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোন কানে ঠেকাতেই পিছন থেকে আচমকা কেউ শক্ত করে হায় ধরায় অজানা ভয়ে,আতঙ্কে মৃদু চিৎকার করে ওঠে অতসী। সাথে সাথে ভেসে আসে পরিচিত গম্ভীর এক কন্ঠস্বর,

“রাত অনেক হয়েছে। নাটক বন্ধ করে ভিতরে চলুন। আপনাকে হাসপাতালে আমিই নিয়ে এসেছি, সুতরাং এই মুহূর্তে আপনি আমার রেসপন্সিবলিটি।জেদ দেখিয়ে কোনো একটা অঘটন ঘটিয়ে যদি ভেবে থাকেন আমাকে ফাঁসাবেন তবে বলব অহেতুক ভাবনা বাদ দিন।”

হুট করেই যেন অতসীর মাথায় খুন চেপে বসে। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো দিহানের কলার চেপে ধরে ঝাকিয়ে বলে ওঠে,

“কী পেয়েছেন কী আমাকে? কাঠের পুতুল? যখন যেভাবে মন চাইবে সেভাবেই অপমান করবেন আর আমি বোবা হয়ে আপনার সবটা অপমান মুখ বুঝে হজম করে নিব? এতোটাই আত্মসম্মানহীন আমি? আপনি উঁচু তলার মানুষ দেখে আপনার ভীষন আত্মসম্মান আর আমি মধ্যবিত্ত দেখে আমার বিন্দু পরিমাণ আত্মসম্মান নেই? যারা অহেতুক অন্যকে কথায় ছোটো করে সুখ পায় তাদের কী বলে জানেন? কাপুরুষ। আমার চোখে আপনি একটা কাপুরুষ। আমার দেখা সবথেকে জঘন্য পুরুষ আপনি। আপনাকে আমি ঘৃণা করি। এই যে আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন! জাস্ট ঘৃণায় বমি আসছে আমার। চলে যান আমার সামনে থেকে। ভুল করেও আর কখনো যদি আমার হাত ধরার চেষ্টা করে থাকেন, তবে খুন করে ফেলব একদম।”

অত্যাধিক রাগে থরথর করে কাঁপছে অতসী। মুখ দিয়ে ফুসফুস শব্দ বের হচ্ছে। অতিরিক্ত কান্নার দরুন চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। দিহানের কাছে একদম অপ্রকৃতস্থ ঠেকছে এই মুহূর্তে মেয়েটাকে। হতবুদ্ধি হয়ে কতক্ষণ নিজের কলার আর অতসীর বিধ্বস্ত মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে পরাজয় স্বীকার করার ন্যায় নিচু স্বরে বলে,

“অতসী! অতসী প্লিজ শান্ত হোন। আ’ম স্যরি। সব দোষ আমার। আমার সত্যিই আপনাকে এভাবে জাজ করা উচিৎ হয়নি। আসলেই মাথা ঠিক ছিলনা আমার। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন আমাকে! একটা মাত্র বোন আমার। সেই বোনটার আজ এতো গুলো দিন যাবৎ চোখের সামনে করুন পরিণতি দেখেও ভাই হয়ে কিছু করতে না পারাই এমনিতেই ডিপ্রেস’ড আমি। আবার চারটা দিন যাবৎ রাত-দিন দুলাভাইয়ের কেস নিয়ে ছুটতে হয়েছে। সেটার বিহিত করতে না করতেই এখন আবার রোদ্রিক কিডন্যাপ। আমি দিশাহারা। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডার্স্ট্যান্ড!”

দিহানের এমন কোমল রূপের সাথে আজই প্রথম পরিচয় অতসীর। কী ভীষণ নরম হয়ে কথা গুলো বললো!এভাবে বললে কেউ কখনো মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে? সর্বদা গম্ভীরর্যতার খোলসে আবৃত দেখা মুখটা হঠাৎ এমন অচেনা কোমলতায় ছেয়ে যাওয়ায় আশ্চর্য হয়ে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকে অতসী। অপলকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায়। মনে হয় গভীর এক মায়ার জাল বিছানো ঐ মুখটাই। যে মায়ার জালে অল্প অল্প করে আটকে যাচ্ছে অতসী। দখিনা দমকা হওয়ার সাথে হুট করেই যেন মাথায় চাপা খু’নি রাগটা কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেছে। রাগের হলকা ফোটা চোখ দুটোর চাহনি বদলে গিয়ে সেখানে জড়ো হয়েছে এক রাশ মুগ্ধতা। অতসীকে শান্ত হতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে দিহান। রাতের তারাখসা আকাশের দিকে মুখ তুলে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে পূণরায় ফিরে তাকায় অতসীর মুগ্ধতা ভরা চোখ দুটোই। দৈবাৎ তার দৃষ্টি জোড়াও আটকে যায় গভীর মুগ্ধতা নিয়ে তাকে দেখতে থাকা ঐ দৃষ্টি জোড়ায়। সেকেন্ড গড়ায়, মিনিট গড়ায়। দুজন দুজনার চোখের ভাষায় একে অন্যকে বুঝে নিতে এতোটাই ব্যস্ত, ভুলে যায় স্থান, কাল, সময়ের কথা।

****
পুরো শহরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়ে গেছে র‍্যাব এবং বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্র‍্যাঞ্চ এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের যৌথ অভিযানে। উপরমহল থেকে একের পর এক চাপ আসতে শুরু করেছে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপর। প্রথমে সাবেক এমপি রক্তিম শিকদার খুনের দায়ে গ্রেফতার হলো। যখনই কেসের সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে একটু একটু সত্য সামনে আসতে শুরু করল ঠিক তখনই আবার রক্তিম শিকদারের একমাত্র ছেলে নিখোঁজ। বিষয়টা মোটেও কাকতলীয় না। এর পিছনে যে বড়োসড়ো কোনো রাঘববোয়ালের হাত আছে এটা কম-বেশি সকলেরই ধারণা। ইতিমধ্যে এই ঘোরতর ষরযন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে জনগণ।রক্তিমের দলের ছেলেপেলে সহ সাধারণ জনগণ মিলে রাস্তায় নেমেছে মিছিল নিয়ে। অন্যদিকে স্কুল ছাত্র ছোট্ট রোদ্রিকের নিখোঁজ সংবাদে পুরো দেশের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক উদ্বিগ্ন নিজেদের সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে। একটা স্কুলে যদি স্টুডেন্ট’স নিরাপদ না থাকে তবে কোন নিশ্চয়তাই সন্তানদের স্কুলে পাঠাবে অভিভাবক? বিষয়টা এখন শুধু সাভারেই সীমাবদ্ধ নেই। পুরো দেশে তোলপাড় লাগিয়ে দিয়েছে ।সাধারণ জনগণ একবার খ্যাপাটে হয়ে উঠলে তাদের দমানো অসম্ভব প্রায়। জনগণকে শান্ত রাখার জন্য হলেও এই মুহূর্তে দুটো কেসের প্রতিই প্রসাশনের সু-দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনো গাফিলতি করার সুযোগ নেই। পাগলা ষাঁড়ের মতো হয়ে আছে র‍্যাব এবং পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। যেখানে যেভাবে যাকে সন্দেহভাজন পাচ্ছে তাকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে। রোদ্রিকের স্কুলের শিক্ষক থেকে শুরু করে সিকিউরিটি গার্ড কাউকেই তদন্তের সাপেক্ষে এটিইউ এর কার্যালয়ে তুলে নিতে বাদ রাখেনা। সহজভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল কথা বের করতে না পারলে সরাসরি রিমান্ড জারি করছে। বর্তমানে সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে আছে রোদ্রিকের স্কুলের দারোয়ান হারুন মিয়া। যেদিন এবং যে সময়টাই রোদ্রিক নিখোঁজ হয় ঐ সময় হারুন মিয়া দারোয়ানের দায়িত্বে ছিল। তার কাছেই স্টুডেন্ট কার্ড দেখিয়ে প্রতিটা অভিভাবককে নিজেদের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে হয়েছে। যদি এমনটাই হয়ে থাকে তবে অবশ্যই হারুন মিয়ার জানার কথা রোদ্রিক কার সাথে গিয়েছে। তবে হতাশার বিষয় এটাই ঐদিনের পর থেকে কাকতলীয়ভাবে হারুন মিয়াও নিখোঁজ। হারুন মিয়ার পরিবারের সমস্ত খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে দিহান ইমরানকে। র‍্যাবের দুজন ঊর্ধ্বতন অফিসারের সাথে বর্তমানে রোদ্রিকের কেস নিয়েই জরুরী একটা আলোচনায় বসেছে দিহান। প্ল্যান চলছে কিভাবে কিভাবে তারা কেসটার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে। আজ দুদিন হয়ে গেছে বাচ্চা ছেলেটা নিখোঁজ। এতো এতো নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়েও কোনো খোঁজ মিলেনি। জানা নেই কারো রোদ্রিকের বর্তমান পরিণতির কথা। ছেলেটাকে আদও দেশের মাটিতে সুস্থ অবস্থায় রেখেছে কী না কিচ্ছু জানেনা কেউ। তবে দেশের প্রতিটা বর্ডার এরিয়া সহ, এয়ারপোর্ট, নৌ পথ, সড়কপথ সকল জায়গায় কড়া চেকপোস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাতে কোনোভাবেই রোদ্রিককে নিয়ে কিডন্যাপার গ্যাং দেশ ছাড়তে না পারে।

চলবে….

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৩
#আদওয়া_ইবশার

হারুন মিয়াকে দিহানের টিম আটক করেছে রাজেন্দ্রপুর নিজ বাড়ি থেকে। ধরা পরার ভয়ে শহর ছেড়ে ঘটনার দিনই পালিয়ে এসেছিল নিজের গ্রামে। ভেবেছিল কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকলে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবেনা তার। টানা আট ঘন্টা উল্টো ঝুলিয়ে বেধড়ক পিটানোর পর মুখ খুলেছে হারুন মিয়া। স্বীকার করেছে সে নিজেই সাহায্য করেছে রোদ্রিককে কিডন্যাপ করতে। তবে আসল কিডন্যাপার কে বা কারা এই সম্পর্কে কিছুই জানেনা সে। তার সাথে শুধু ফোনের মাধ্যমে এক আগুন্তকের কথা হয়েছিল, ঠিক এগারোটা চল্লিশ মিনিটে স্কুলের সামনে একটা সিএনজি আসবে,ঐ সিএনজিতে রোদ্রিককে উঠিয়ে দিতে পারলেই পুরষ্কার হিসেবে সে পাবে দেড় লক্ষ টাকা। টাকার লোভ সামলাতে না পেরে এমন জঘণ্য একটা অন্যায় কাজে নিজেকে জড়িয়েছে হারুন মিয়া। সব শুনে দিহান পূণরায় খ্যাপাটে ষাঁড়ের মতো এলোপাথাড়ি পিটানো শুরু করে। বারবার বলতে থাকে,

“শালা শুয়োরের বাচ্চা! মাত্র দেড় লক্ষ টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেলি? কাজটা করার আগে একবারও ভাবলিনা লোভের পরিণতি কী হতে পারে? একবারও এটা মনে হলোনা,এই বাচ্চার জায়গায় তোর বাচ্চা থাকলে কেমন হতো? টাকার প্রয়োজন তোর না?একটা বাচ্চার জীবনের থেকে টাকার মায়া বেশি তোর কাছে?এমন অবস্থা করব তোর, যাতে আমৃত্যু টাকার কথা শুনলেই কলিজা কাঁপে। জানে মারবনা তোকে। যে অপরাধ করেছিস এটার জন্য ফাঁসিও হবেনা। সর্বোচ্চ দুই-তিন বছরের জেল হবে।”

এলোমেলো দম ফেলছে দিহান। পুরো শরীর ঘামে ভিজে ঝবঝবে হয়ে আছে। হাতের লাঠিটা ইমরানের দিকে ছুড়ে দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে হুকুম দেয়,

“যতক্ষণ পযর্ন্ত একটা হাড়’ও আস্ত থাকবে ঠিক ততক্ষণ কিন্টিনিউয়াস পেটাবে।কোনো থামাথামি নেই।চিৎকার করতে করতে কলিজা ফেটে মরে গেলেও এক বিন্দু পানি দিবেনা। কথা ক্লিয়ার?”

“ইয়েস স্যার।”

তটস্থ হয়ে উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে সাই জানায় ইমরান। সাথে সাথে সেল থেকে বেরিয়ে যায় দিহান।হারুনের কল রেকর্ড চেক করে ঐ আগুন্তকের নাম্বার জোগাড় করে সমস্ত ইনফর্মেশন কালেক্ট করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়না। রেকর্ড অনুযায়ী ঐ নাম্বারের মালিক মৃত। কথাটা শোনার সাথে সাথেই ভীষণ চটে যায় দিহান। এক প্রকার ধমকের সাথে চেচিয়ে ওঠে,

” মালিক মৃত না কী জীবিত এটা জানতে চেয়েছি আমি আহাম্মক? কল রেকর্ড, লোকেশন এভরিথিং ইনফর্মেশন আমার চাই। রাইট নাও। তৌকীর!ঐ হারামখোরের মুখ থেকে সিএনজি ড্রাইভারের পরিচয় বের করতে বলো ইমরানকে। জাস্ট পনেরো মিনিট সময় দিবে।এর মাঝে স্বীকার না করলে আজীবনের জন্য জবান বন্ধ করে দিবে। বাকী যা হয় আমি দেখে নিব।”

“স্যার হারুনের সাথে যে নাম্বার দিয়ে কিডন্যাপার ঐদিন যোগাযোগ করেছে সেই নাম্বারে ঐদিনের মোট আটত্রিশটা কল রেকর্ড পাওয়া গেছে। তিনটা নাম্বার থেকে পরপর কল গুলো এসেছে। হতে পারে নাম্বার তিনটার মালিক’ই কিডন্যাপিং এর সাথে জড়িত। দুটো নাম্বার আনট্রেসবল হলেও একটার লোকেশন দেখাচ্ছে এই মুহূর্তে নেত্রকোণা মহিশাল জমিদার বাড়ির আশপাশ।”

কাল বিলম্ব না করে টিম নিয়ে নেত্রকোণার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে দিহান। নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে ফরেনসিক ল্যাবের সামনে দিয়ে যাবার সময় তাকে দেখেই ভীষণ উদ্বিগ্নতার সাথে ছুটে আসে মিলি। তাড়াহুড়ো ভঙ্গিতে একটা ফাইল দিহানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে,

“বড়ো একটা গুড নিউজ আছে। ডাক্তারের স্টেটমেন্ট অনুযায়ী সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ শাহীন ভুঁইয়ার হৃদরোগের কারণে মৃত্যু হয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্ট ও সেটাই প্রমাণ করছে।লাশের শরীরে যে ছুরির আঘাত গুলো পাওয়া গেছে সব গুলো আঘাত করা হয়েছে ওর মৃত্যুর ঠিক সাড়ে তিন ঘন্টা পর।মানে আনুমানিক রাত নয়টার দিকে কেউ ইচ্ছে করে লাশের গায়ে ছুরি দিয়ে আঘাত করে সম্পূর্ণ ঘটনাটাকে খুন বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য নাটকটা হয়তো সাজিয়েছিল। এরপর কোনোভাবে হয়তো রক্তিম শিকদারের পার্টি অফিসের বিশ্বস্ত কোনো লোককে হাত করে ওনাকে কড়া ডোজের ড্রাগস দিয়ে অচেতন করে সেই সুযোগে লাশটা ওনার রুমে নিয়ে গিয়ে ছুরির গায়ে, লাশের গায়ে হাতের ছাপ বসিয়েছে অত্যন্ত সুকৌশলে। আমার মনে হয় এর পিছনে মাস্টারমাইন্ড যেই থাকুক সেই একই লোক রোদ্রিককে কিডন্যাপ করেছে। আর করেছেও হয়তো এটা ভেবেই যে, রোদ্রিকের কিডন্যাপিং নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে যাব এই ফাঁকে রক্তিম শিকদারের কেসটা পিছিয়ে যাবে। মূল কালপ্রিট এই সুযোগে হয়তো গা ঢাকা দেওয়ার প্ল্যান- প্রোগ্রাম’ও করে ফেলেছে। আই হোপ রোদ্রিকের কেসটা নিয়ে এগিয়ে গেলেই আমরা দুটো কেসেই সহজে সলভ করতে পারব।”

অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় মিলির প্রতিটা কথা শুনে দিহান কিছুক্ষণ হাতে থাকা ফাইলটা উল্টেপাল্টে দেখে স্বাভাবিক স্বরে বলে,

“তোমার এখন আর একটা কাজ করতে হবে মিলি।মিতালী সাহার সাথে কথা বলে কোর্টে রক্তিম শিকদারের কেসের পরবর্তী শুনানির সময় কমিয়ে আনার একটা আবেদন করতে বলো।”

“কিন্তু আমাদের হাতে এই মুহূর্তে যে প্রমাণ আছে সেটা রক্তিম শিকদারকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও মূল কালপ্রিট কে সেটা তো প্রমাণ করছেনা দিহান! সময় যেহেতু আছেই আমাদের হাতে তবে অর্ধেক কাজ ফেলে রেখে অযথা সময় কমিয়ে এনে ঝামেলা বাজিয়ে রাখার কি প্রয়োজন?”

“আমার বোনটা এভাবে আর কিছুদিন থাকলে হয়তো একেবারেই শেষ হয়ে যাবে মিলি। চোখের সামনে প্রতি মুহূর্তে একমাত্র বোনটাকে ধুকে ধুকে মরতে দেখার যন্ত্রণা যে কতটা ভয়াবহ তা এই মুহূর্তে আমি ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবেনা। রোদ্রিককে খোঁজে পেতে পেতেই যদি দুলাভাই ছাড়া পেয়ে যায় তবে হয়তো একটু হলেও সে মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি পাবে। অন্তত একটা আশার আলো তো দেখবে! তাছাড়া রক্তিম শিকদার নামক ঐ মানুষটা ছাড়া আমার পাগল বোনকে সামলানোর সাধ্যি কারো নেই। তুমি একটু দ্রুত যোগাযোগ করো মিতালী সাহার সাথে।”

****

আকাশ গুমরে বৃষ্টি পরছে।সন্ধ্যা নামার আগেই বৃষ্টির তোরে চারিদিকে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। দুই হাত দূরেও সবটা আবছায়া অন্ধকার। রাস্তাঘাটে মানুষজনের কোনো অস্তিত্ব নেই। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়েই দিহানের টিম সহ র‍্যাবের দুটো টিম পৃথকভাবে নেত্রকোণার মহিশাল জমিদার বাড়ি চারপাশ থেকে ঘেরাও করেছে। পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ির চতুর্দিক ঘন ঝোপঝাড়ে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।পেলেস্তার খসে গিয়ে দেয়ালে গজিয়েছে বিভিন্ন পরজীবী গুল্ম উদ্ভিদ। ভিতরের কামরা গুলো মাকড়সার জালে প্যাঁচানো। কতক্ষণ পর পর হঠাৎ হঠাৎ কোথা থেকে যেন বড়ো বড়ো বাদুর উড়ে এসে আবার হুট করেই লুকিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছন্দময় শব্দ ছাপিয়ে খুব কাছ থেকেই কোনো এক জন্তুর করুন আর্তনাদ ভেসে আসছে।গা ছমছমে কেমন যেন একটা ভূতুড়ে পরিবেশ। জায়গাটা দেখেই বুকটা কেঁপে ওঠে দিহানের। এই পরিবেশে স্বাভাবিক একটা সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকেই একা ফেলে রাখলে ভয়ে মানুষটা হয়তো হার্ট ফেল করে মারা যাবে। সেখানে যদি রোদ্রিককে সত্যি সত্যি এখানে রাখা হয় তবে বাচ্চা ছেলেটার না জানি কী অবস্থা! ঠিক আছে তো রোদ্রিক? যত সময় যাচ্ছে ততই অস্থিরতা বাড়ছে দিহানের। শক্ত হাতের মুঠোয় ধরে রাখা পিস্তলটা বারবার ফসকে পরতে চাইছে। মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়েছে পুরো শরীরে। ঠোঁট ফাঁক করে বড়ো বড়ো দুটো নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করে সন্তর্পণে পা বাড়ায় ভিতরের দিকে। পিছন পিছন এগিয়ে আসে নিশ্চুপে পুরো টিম। প্রায় পনেরো মিনিট সুকৌশলে পরিত্যক্ত বাড়ির চারপাশে টহল দিয়েও সন্দেহভাজন কিছু না পেয়ে র‍্যাবের দুজন অফিসারের কমান্ডে একে একে সকলেই ভিতরে প্রবেশ করে। তন্ন তন্ন করে সব জায়গায় খোঁজ চালিয়ে শেষ পযর্ন্ত জঙ্গলের শেষ প্রান্তে মূল জমিদার বাড়ি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছোট্ট একটা কুড়েঘরে রোদ্রিকের স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম, আইডি কার্ড পাওয়া যায়। সাদা স্কুল ড্রেসের শার্টটা একদম পরিষ্কার।রক্ত বা অন্য কোনো দাগের চিহ্ন নেই কোথাও। যেটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পায় সকলে এই ভেবে বাচ্চাটা বোধহয় ঠিক আছে। রোদ্রিকের জিনিস গুলো যেহেতু এখানে পাওয়া গেছে সেহেতু রোদ্রিককে অবশ্যই এখানে এনে রেখেছিল কিডন্যাপার। হয়তো পরে কোনোভাবে পুলিশ, র‍্যাবের আসার খবর পেয়ে সরে গিয়েছে। আর না হয় এখানেই কোথাও গা ঢাকা দিয়েছে। জিনিস গুলো নিয়ে কুড়েঘর থেকে বেরিয়ে ঝুপঝাড় মারিয়ে জমিদার বাড়ির পিছনের দিকে যেতেই হঠাৎ তীব্র পঁচা দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগে সকলের। দুর্গন্ধে টিকে থাকা দায়। নাড়িভুঁড়ি প্যাচিয়ে বমি আসার উপক্রম এক একজনের। দুর্গন্ধের উৎস খোঁজতে গিয়ে ঝুপের আড়াল থেকে মুখ বাঁধা একটা বস্তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় র‍্যাবের টিম।বস্তাটা সামনে আনতেই দুর্গন্ধের তীব্রতাও বাড়ে।ভেবে পায়না কেউ কী এমন পচনশীল জিনিস থাকতে পারে যার থেকে এতো তীব্র দুর্গন্ধ বের হচ্ছে? কৌতূহলী হয়ে একজন কনস্টেবল রুমাল দিয়ে নাক-মুখ শক্ত করে বেঁধে বস্তার মুখ খুলতে উদ্যত হয়। পুরো টিমের উৎসুক নজর এদিকেই। মুহূর্ত ব্যবধানে মোটা লাইলেন দড়ির বাঁধন খুলে উন্মুক্ত করা হয় বস্তার মুখ। সাথে সাথে বেরিয়ে আসে পচে ফুলেফেপে উঠা এক বীভৎস গলাকাটা দেহ। এমন অনাকাঙ্খিত এক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে উপস্থিত প্রত্যেকে তৎক্ষণাৎ আতঙ্কিত হয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। বাকহারা হয়ে নির্নিমেশ তাকিয়ে থাকে মুখ-চোখের কোনো চিহ্ন না থাকা অত্যন্ত কুৎসিত দেখতে অর্ধ গলিত দেহটার দিকে। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় বৃষ্টির পানিতেই হাঁটু গেরে বসে পরে দিহান। মন-মস্তিষ্ক জুড়ে কেমন যেন একটা ভোতা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। যে অনুভূতিটা একটু একটু করে তার পুরো শরীর অসাঢ় করে দিচ্ছে। মনটা বারবার চেঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, এটাই তার আদরের ভাগ্নে রোদ্রিক। ফুলের মতো পবিত্র, ফুটফুটে সেই রোদ্রিকেরই এই কুৎসিত চেহারা।বাচিয়ে রাখলনা অমানুষগুলো মাসুম বাচ্চাটাকে। এই ছোট্ট দেহটাই কত শত আঘাতের চিহ্ন!ভীষণ স্নিগ্ধ আদুরে চেহারাটা কত বীভৎস! দিহানের হুট করে মনে হচ্ছে,থেতলে যাওয়া অর্ধগলিত ভীষণ কুৎসিত দেখতে এই মুখটা তার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে আদুরে কন্ঠে অভিযোগ করছে,

“মামা! আমাকে ওরা খুব কষ্ট দিয়েছে। ওরা যখন আমাকে মেরেছে আমি খুব কেঁদে তোমাকে ডেকেছি, পাপ্পাকে ডেকেছি, মাম্মাকে ডেকেছি। তোমরা কেউ আসোনি মামা।দেখো ঐ পচা মানুষ গুলো আমার সুন্দর মুখটাকে কী ভয়ংকর বানিয়ে দিয়েছে! আমাকে মেরে ফেললো ওরা। তোমরা কেউ ঐ রাক্ষস গুলোর হাত থেকে আমাকে বাঁচালেনা। একটুও ভালোবাসোনা তোমরা আমায় তাইনা মামা! যদি ভালোবাসতেই তাহলে কী আর আমাকে এতো কষ্ট দিতে পারতে?”

চারদিক থেকে কথা গুলো যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো দিহানের কানের কাছে। পাগল করে ফেলছিল তাকে বারবার ঐ কান্নাভেজা অতি আপন,আদুরে বাচ্চা কন্ঠটা। শেষ পযর্ন্ত সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ কান চেপে চিৎকার করে ওঠে দিহান। তার এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ক্যাপ্টেন দিদার জড়িয়ে ধরে আশ্বাস দিয়ে বলে,

“অফিসার প্লিজ কন্ট্রোল ইউর সেল’ফ। আপনি অন ডিউটিতে আছেন। যদিও আমরা সবাই আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি, কিন্তু তবুও কিচ্ছু করার নেই আমাদের। প্লিজ একটু শান্ত হোন। আর এখনই কোন প্রমাণের ভিত্তিতে এতোটা শিওর হচ্ছেন এটাই রোদ্রিক? অর্ধ গলিত চেহারা দেখে কিছু বোঝার উপায় আছে? এমনও তো হতে পারে এটা অন্য কোনো বাচ্চার লাশ! জায়গাটা দেখছেন না কেমন ভয়ংকর!এখানে নিশ্চয়ই অনেক আগে থেকেই এসব কারবার ঘটে।”

_________

দীর্ঘ তিন মাস মিথ্যে মামলার দায়ে বন্দী জীবন পার করে অবশেষে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে সাভার এক আসনের সাবেক এমপি রক্তিম শিকদার। এটিইউ এর ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের সুষ্ঠ তদন্তের সাপেক্ষে উচ্চ আদালতে প্রমাণিত হয়েছে শাহীন ভুঁইয়ার স্বাভাবিক মৃত্যুটাকে তারই আপন বড়ো ভাই কাদের ভুঁইয়া কুটিল বুদ্ধি খাটিয়ে খুনের পুরো নাটকটা সাজিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছে রক্তিম শিকদারকে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জের ধরেই এমন একটা গর্হিত অপরাধ করতে একটুও পিছুপা হয়নি কাদের ভুঁইয়া। ছোট ভাইয়ের মৃত দেহটাকে নিজ স্বার্থে কাজে লাগিয়ে পরিচয় দিয়েছে বিকৃত মনষ্কের। আদালত প্রাঙ্গন থেকেই কাদের ভুঁইয়াকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। স্বাভাবিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত সময় দিয়েছে দুইদিন।কাদের ভুঁইয়ার সাথে এই অপরাধে যে বা যারা জড়িত আছে সবাইকে খোঁজে বের করে এরপর মূল বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। সব ঠিকঠাক হবার পরও কেমন যেন পরিস্থিতি সমস্তটাই অস্বাভাবিক ঠেকছে রক্তিমের কাছে। আজ তার কেসের চূড়ান্ত রাই অথচ তার বাড়ির কেউ আসেনি। না এসেছে দৃষ্টি না এসেছে মেহেদী আর না দিহান। পার্টির ছেলে গুলোও সব আজ ভীড় করেনি আদালতে। একমাত্র জাবিরকে ছাড়া এখন পযর্ন্ত কাউকে চোখে পরেনি রক্তিমের। জাবিরের মুখেও আজ রক্তিমের জয়ের আনন্দ নেই। ছেলেটা কেমন যেন অনুভূতিশূণ্য হয়ে আছে। আশেপাশের মানুষজও কেমন তার দিকে করুণার নজরে তাকিয়ে আছে! মনটা ভীষণ কু-ডাকছে রক্তিমের। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে গিয়েও বারবার বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এমনটা তো হবার কথা ছিলনা। আর কেউ না আসুক, অন্তত দৃষ্টির তো আসার কথা আদালতে! সে তো এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বাড়িতে স্থির বসে থাকার মেয়ে না! তবে কেন আসলনা? আর মানুষজনই বা কেন তাকে এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে? সে জেল খেটে বেরিয়েছে দেখে?বারবার এই প্রশ্ন গুলো মনে জাগ্রত হলেও উত্তর জানার মতো কাউকে খোঁজে পাচ্ছেনা রক্তিম। দম বন্ধকর এক পরিস্থিতিতে পরে ভীষণ ছটফটে ভঙ্গিতে জাবিরের সামনে এসে রক্তিম জানতে চায়,

“কী হয়েছে জাবির?”

অন্যমসষ্ক জাবির হুট করে রক্তিমের প্রশ্নে কিছুটা থমকায়। ফ্যালফ্যাল নয়নে কিছু পল তাকিয়ে থাকে রক্তিমের চিন্তিত মুখপানে। পরপর নিজেকে সামলে নিয়ে ধীমি স্বরে বলে,

“কিছুই হয়নি ভাই। তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলুন আপনি।”

“আমি বোকা না জাবির। একদম মিথ্যে বলবিনা আমার সামনে। বল কী হয়েছে? বাকিরা কেউ আসেনি কেন আজকে? বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো?”

ভীষণ অধৈর্য হয়ে উচ্চ স্বরে ধমকে কথা গুলো বলে ওঠে রক্তিম। ছটফট করে জাবির।কিছু বলতে গিয়েও বারবার নিজেকে সামলায়। ধরা গলায় অস্থিরচিত্তে বলে,

“ভাই! ভাই প্লিজ আপনি আগে বাড়ি চলুন। সব জানতে পারবেন। আমাকে মেরে ফেললেও আমি কিচ্ছু বলতে পারবনা এই মুহূর্তে।”

জাবিরের এমন আচরণে রক্তিমের কপালে সন্দেহের ভাজ প্রবল হয়। বুঝে নেয় কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। তবে সেটা কী? মনটা পূণরায় দ্বিগুণ অস্থিরতায় ছেয়ে যায়। ভীষণ অধৈর্য, অস্থির মন নিয়ে রওনা হয় চিরচেনা শিকদার মঞ্জিলের দিকে।

চলবে….