একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-২৫

0
14

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৫
#আদওয়া_ইবশার

নিস্তব্ধ, নিরব নিশীথে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে ঠাই দাঁড়িয়ে রক্তিম। দৃষ্টি তার অদূরে রোদ্রিকের কবরের দিকে। পুরুষালী ভীষণ রুক্ষ চোখ দুটোই নোনাজলে টুইটম্বুর।এই বুঝি চোখের পল্লব ঝাপ্টালেই কপোল বেয়ে গড়িয়ে পরবে অবাধ্য অশ্রুকণা।কিন্তু পুরুষদের যে কাঁদতে নেই!তাই তো প্রাণপণ চেষ্টা বেহায়া অশ্রুকণাকে শাসিয়ে দমিয়ে রাখার।পাষাণ খেতাম পাওয়া বুকটাই সে কী যন্ত্রণা!মনে হচ্ছে কোনো এক বিষপোকা অনবরত বুকের ভিতর কামড়ে বিষ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। যে বিষ মিশে যাচ্ছে একটু একটু চেষ্টা শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায়।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। অনুভূত হচ্ছে প্রকৃতির বাতাসে মিশে থাকা অক্সিজেনটুকুও বিষাক্ত। যার দরুন ঠিকঠাক নিঃশ্বাসটুকু নেওয়া হয়ে উঠছে দূর্বিসহ। কী যে এক অসহনীয় যন্ত্রণা মন-মস্তিষ্ক দুইয়ে জুড়ে!এই যন্ত্রণার থেকে বোধহয় মৃত্যু ভালো।

“কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।”

রাতের নৈশব্দতা ছাপিয়ে হুট করে পিছন থেকে কারো আওয়াজ পেয়ে এলোমেলো রক্তিম ভীষণ চমকায়।তড়িৎ পিছন ফিরে আলো-আঁধারের লুকোচুরি খেলায় স্পষ্টত দেখতে পায় দিলশান আরা তার দিকে উৎসুক নজরে তাকিয়ে। পরপর চোখ দুটো বন্ধ করে বড়ো বড়ো দম নিয়ে নিজেকে স্থির করার প্রয়াস চালায় রক্তিম। দিলশান আরা জামাতার এমন অস্থির দশা দেখে কিছুটা চিন্তিত সুরে জানতে চায়,

“অসুস্থ বোধ করছো?”

“ঠিক আছি আমি। আপনি বলুন।”

গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক সুরে উত্তরটা দিতে চেষ্টা করে রক্তিম। তবুও কন্ঠ কাঁপে তার। দিলশান আরা ঠিক বুঝতে পারে, এই চাপা স্বভাবের মুখচোরা ছেলেটা একদম ঠিক নেই। বুকের ভিতর পাহাড়সম কষ্ট নিয়েও কী নির্দ্বিধায় বলছে, “ঠিক আছি আমি!” একটাবার কারো সাথে মনের চাপা কষ্টের কথা খুলে বলছেনা। এভাবে বুঝি একের পর এক কষ্ট বুকে চেপে রেখে মানুষ বাঁচতে পারে?পাগল পাগল লাগেনা নিজেকে? মনে হয়না এই পৃথিবী বড্ড বিষাদময়? এই ছেলেকে সৃষ্টিকর্তা কোন মাটি দিয়ে গড়েছে? কিভাবে হজম করছে একের পর এক আঘাত? দুচোখ উপচে পরা বিস্ময় নিয়ে দিলশান আরা দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে রক্তিমের মুখটাই। পরপর চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠেন,

“আমি মানছি তোমার সাথে আমি কখনো অন্যসব শাশুড়িদের মতো ভালো আচরণ করিনি। সবসময় তোমার অতীত দিয়ে তোমাকে বিচার করেছি, এবং সেই মোতাবেক অনেক খারাপ আচরণও করেছি। যা হয়তো তোমার প্রাপ্ত না। কিন্তু এরপরও আমি বলব, আমার জায়গা থেকে আমি ঠিক। কারণ পৃথিবীর সব বাবা-মায়ের নিজের সন্তান নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। যেমনটা আমারও ছিল। দৃষ্টির জন্মের পর থেকেই স্বপ্ন দেখতাম মেয়েকে পড়ালেখা করিয়ে বড়ো ডাক্তার বানাবো। একটা সময় বিয়ের যোগ্য হলে সু-পাত্র দেখে বিয়ে দিব। সু-পাত্র বলতে অবশ্য আমিও অন্য সব বাবা-মায়ের মতোই কোনো বিসিএস ক্যাডার কিংবা অন্য বড়ো কোনো সরাসরি কর্মকর্তাকেই ভাবতাম। বাবা-মায়েরা সর্বদা চায় তার সন্তান সুখে থাক। সেই চাওয়া থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল উচ্চবিলাশী। কিন্তু ভাগ্য বলেও যে কিছু একটা থাকে এটা আমার রঙিন স্বপ্নে বিভোর মনটা হয়তো ভুলে গিয়েছিল। খোঁজে নিল আমার মেয়ে নিজের সুখ নিজের মতো করেই। তাও সেটা আবার তোমার মতো একটা সময় লোকাল গুন্ডার ট্যাগ পাওয়া ছন্নছাড়া, বদমেজাজি ছেলের মাঝে। মানতে খুব কষ্ট হয়েছিল আমার। একটা সময় মেয়ে ভালো আছে দেখে সবটা মেনে নিলেও তোমার সাথে সম্পর্কটা কিছুতেই সহজ হলনা। মুখে মুখে তোমার সাথে যত খারাপ আচরণই আমি করি না কেন, তাই বলে যদি এটা ভেবে থাকো আমি তোমার খারাপ চেয়েছি তবে বলব তুমি ভুল। বাবা-মা যতই খারাপ হোক কখনো সন্তানের অমঙ্গল চায়না। যেখানে আমার সন্তানের জীবন তোমার সাথে জড়িত সেখানে আমি তোমার খারাপ কিভাবে চাইতাম?”

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে একটু থামে দিলশান আরা। রক্তিম শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে অদূরে। নিরবে শুনে যাচ্ছে শাশুড়ির প্রতিটা কথা। তার অভিব্যক্তিহীন মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে দিলশান আরা ফের বলতে শুরু করেন,

“সে যাইহোক। আমার কথা আর না বলি। তুমি আমাকে যেমনই ভাবো ভাবতে পারো। আসল কথা যেটা বলতে এসেছি সেটা হলো, দৃষ্টির আজকের আচরণে তুমি কষ্ট পেওনা। মানছি আমি ও অনেক খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে তোমার সাথে। তুমিও মুখে স্বীকার না করলেও এটা সত্য একটু হলেও কষ্ট পেয়েছো ওর কথায়। কিন্তু বিশ্বাস করো ও কথা গুলো একদম মন থেকে বলেনি।আমার মেয়ে তো সে, আমি সবথেকে ভালো জানি তাকে। আজ আমার এটুকু স্বীকার করতেও কোনো আফসোস নেই আমার মেয়ে তার স্বামীকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে।তোমার জন্য ওর মাঝে আমি যে আকুলতা দেখেছি তা এর আগে কখনো কারো জন্য দেখিনি।সন্তান হারানোর বেদনা কতটা তীব্র তা আমি জানিনা। কারণ আল্লাহ তায়ালার অশেষ মেহেরবানিতে আমার কোল এখনো পরিপূর্ণ। কিন্তু ভাগ্যের কি খেল দেখো! আমাকে ছাড়িয়ে আমার মেয়েটা সন্তান হারানোর তীব্র যন্ত্রণা পেয়ে গেছে। ও তো মা! দশ মাস দশ দিন যে ছেলেটাকে পেটে ধরেছে, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে শারীরিক যন্ত্রণায় সেই ছেলের এমন করুণ মৃত্যুতে আমার মেয়েটা মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙ্গে পরেছে।ও একদম ঠিক নেই রক্তিম। ওর কথা ধরে যদি তুমি এখন কষ্ট পাও তবে এটা হবে তোমার বোকামি। হ্যাঁ, এটাও ঠিক তুমিও সন্তান হারিয়ে আমার মেয়ের মতোই কষ্টে আছো। কিন্তু সবার সহ্য ক্ষমতা তো এক না। তুমি মেন্টালি অনেক স্ট্রং একজন মানুষ। তোমার এতটুকু জীবনে তুমি যা সহ্য করেছো এসব হয়তো অন্য কেউ কখনো সহ্য করতে পারতোনা। আমার মেয়েটা তো একদমই পারতনা। মেয়েটা আমার ভীষণ আবেগি রক্তিম। ছোট বেলা থেকে খুব আদরে বড়ো করেছি তো। কখনো কোনো কষ্ট পেতে দেইনি। তাই এই বয়সে এসে হুট করে এমন কষ্ট পেয়ে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। ওর হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। তুমি ওর অসুস্থ মস্তিষ্কের কোনো কথা মনে রেখোনা প্লিজ!”

বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন দিলশান আরা। তখনও রক্তিম ঠাই দাঁড়িয়ে। না আছে কোনো নড়চড় আর না দেয় কোনো জবাব। দিলশান আরা রক্তিমের এমন নির্লিপ্ততা দেখে ভেবে নেয় হয়তো সে দৃষ্টির প্রতি ক্ষুব্ধ। ওনার কোনো বোঝ রক্তিমের মনে প্রভাব ফেলেনি। হতাশ হয়ে কাঁদতে কাঁদতেই চলে যেতে নেয় দিলশান আরা। তৎক্ষণাৎ রক্তিম পিছনমুখী হয়েই শীতল সুরে বলে ওঠে,

“আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?”

থেমে যায় দিলশান আরার পায়ের গতি। জিজ্ঞাসু নজরে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,

“কি?”

প্রলম্বিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রক্তিমে ধীরগতিতে ফিরে তাকায় শাশুড়ির দিকে। শান্ত সুরে বলে,

“দৃষ্টিকে কিছুদিনের জন্য আপনাদের সাথে ময়মনসিংহ নিয়ে যান। ও ট্রমাটাইজড হয়ে আছে।
ওখানে রেখে ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে কিছুদিন কাউন্সিলিং করালে আমার মনে হয় ওর জন্য ভালো হবে।এই পুরো বাড়ি জুড়ে রোদ্রিকের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।এখানে থাকলে ও এই ট্রমা থেকে কিছুতেই বের হতে পারবেনা। দিন দিন হয়তো ওর মেন্টাল পজিশন আরও খারাপ হয়ে পরবে। যত দ্রুত সম্ভব ওর কাউন্সিলিং প্রয়োজন।”

“আর তুমি!”

শাশুড়িকে নিজের জন্য চিন্তিত হতে দেখে রক্তিম ক্লিষ্ট হাসে। ভীষণ অবহেলার সহিত বলে,

“আমার কই মাছের জান।কই মাছ যেমন ডাঙায় উঠে ছটফট করলেও একেবারে মরেনা, আমারও এতো সহজে কিছু হবেনা। আমাকে নিয়ে অযথা টেনশন করবেন না।”

“আমার শেষ একটা আবদার রাখবে?”

দিলশান আরার এহেন কথায় প্রশ্নাত্মক নজরে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় রক্তিম। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে দিলশান আরা ভীষণ নমনীয় স্বরে বলেন,

” রাজনীতি থেকে ফিরে আসো। তুমি মানো তো, আজকের তোমাদের এই পরিণতির জন্য একমাত্র দায়ী তোমার এই রাজনীতি? হাত জোর করে অনুরোধ করছি তোমাকে রক্তিম। দয়া করে এই রাজধানীর নোংরা খেলা থেকে ফিরে আসো। দেখবে সুন্দর একটা জীবন পাবে। যে জীবনে আপন মানুষ হারানোর কোনো ভয় থাকবেনা। থাকবেনা নিজের চরিত্রে কলঙ্ক লাগার কোনো ভয়। দিন শেষে দুমুঠো ডাল-ভাত খেয়ে নির্ভেজাল একটা জীবন উপভোগ করতে পারলেও এই জীবনের স্বাদ বড্ড মধুর হয়। কারণ এই ডাল-ভাতের জীবনে হারানোর কোনো ভয় থাকেনা। না থাকে মানসিক টানাপোড়ন। আজ তোমার লাখ লাখ টাকা আছে, খ্যাতি আছে, পুরো সাভারবাসী তোমাকে এক নামে চিনে। যেখানেই যাও মানুষ তোমায় মাথায় নিয়ে নাচে। কিন্তু লাভ কী এতে যদি তোমার পারিবারিক জীবনেই সুখ না থাকে? তোমার এই নাম, এই খ্যাতি, এই অর্থ-সম্পদ পেরেছে তোমার সন্তানকে বাঁচাতে? পারেনি। উল্টো আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী শুধুমাত্র তোমার এই নাম-যশ, খ্যাতি। অন্তত আমার মেয়েটার কথা ভাবো রক্তিম। এই সেই দৃষ্টি, যে দৃষ্টি আজ থেকে আট বছর আগে শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবেসে নিজের সুখের রাজপ্রাসাদ ছেড়েছে, তোমাকে নিয়ে সুন্দর একটা জীবন কাটাবে বলে। কিন্তু ভাগ্য দোষে মেয়েটা আমার তোমার ঘরে পা রাখার পর থেকেই একের পর এক দুঃখের সাথী হচ্ছে। এবার অন্তত ওকে একটু সুখ দাও।এতোটা নিষ্ঠুর হওনা আমার অবুঝ মেয়েটার প্রতি।”

জবাব দেয়না রক্তিম।মৌনতায় কেটে যায় কয়েকটা মুহূর্ত। দিলশান আরাও জবাবের আশায় থাকেনা। ওনার যতটুকু সাধ্যি ছিল ওনি বুঝিয়েছে। রক্তিম অবুঝ না। না সে ছোট কোনো বাচ্চা। যথেষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন একজন সুস্থ মানুষ সে। কিসে নিজের ভালো হবে যথেষ্ট বোঝার ক্ষমতা আছে। এরপরও যদি নিজের ভালো নিজে না বুঝে তবে হাজার মানুষ বলে-কয়েও তাকে সঠিক পথে আনতে পারবেনা। এখন শুধু দেখার পালা, রক্তিমের শেষ এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হয়। এতো কিছুর পরও কি সে রাজনীতিটাই বেছে নিবে,না কী সুন্দর,সাধারণ,স্বাভাবিক একটা জীবন?

_______

পূর্বালোকে প্রজ্বলিত প্রভাকরের মিঠে আলোয় ভোরের ফুরফুরে আবহাওয়া অল্প অল্প করে বিলীন হচ্ছে।ইদানীং ভোর রাতের পর থেকে শিরশিরে ঠান্ডা অনুভূত হলেও একটু একটু করে দিন বাড়ার সাথে সাথে উত্তপ্ত সূর্যালোকের অত্যাধিক তাপদাহে হাঁসফাঁস করে মানব প্রাণ। গাছের একটা পাতাও যেন নড়তে চায়না। এতো তীব্র গরমে উত্তপ্ত চোলার কাছে দাঁড়িয়ে সামান্য ভাতটুকু ফোটানোও দায়।এরপরও ঠিক নিয়ম করে পরিবারের মেয়ে-বউ বাহারী স্বাদের নানান পদের রান্না করে আপনালয়ের মানুষ গুলোর উদরপূর্তী করাতে পিছুপা হয়না। সেই ভোর থেকে শুরু হয় তাদের রসুই ঘরে গরম হাড়িতে খুন্তি চালানো। এরপরও থাকেনা তাদের কোনো অভিযোগ। যেন তাদের জন্মই শত কষ্ট হলেও আপন মানুষদের মুখরোচক রান্না করে খাওয়ানো। তবে অভিযোগের কথা আসবে কেন?

ঘুম থেকে উঠতে আজ একটু দেরী হয়ে গেছে অতসীর।লোডশেডিং এর যন্ত্রণায় রাতে ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। বাসায় থাকা আইপিএসটাও ঝুপ বুঝে কোপ মারার মতো কান্ড ঘটিয়েছে।গতকাল হুট করেই ব্যাটারির সমস্যা দেখা দিয়েছে।সার্ভিসিং এর জন্য নিয়ে গিয়েছে বাবা গতকালই। কিন্তু সাথে সাথে ঠিক করে আনা সম্ভব হয়নি। এই গরমে কী আর ফ্যান ছাড়া এক মুহূর্ত টিকা যায়? পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়াই অতসীর চোখে-মুখে বিরক্তির লেশ ফুটে আছে।গুমড়া মুখে এলোমেলো চুল হাত খোপা করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ায়।শিউলী বেগম একমনে চুলাই থাকা হাসের মাংস কষাতে কষাতেই জানতে চায়,

“যাবি কখন?”

“আটটা কী সাড়ে আটটার দিকে বের হবো। বেশিক্ষণ তো আর লাগবেনা যেতে। তোমার রান্না কতদূর হলো?”

“মাংসটা হয়ে গেলেই সব কমপ্লিট। তুই একেবারে গোসল সেড়ে রেডি হয়ে নে।”

“এতো তাড়াতাড়ি রান্না কমপ্লিট! কিভাবে সম্ভব?”

ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চায় অতসী। ততক্ষণে শিউলী বেগমের মাংস কষানো শেষ। পর্যাপ্ত ঝোল দিয়ে ঢেকে মেয়ের দিকে তাকায়। ঠেস দিয়ে বলেন,

“আপনার মতো নবাবের বেটি তো আর আমি না। তাই আমার সকালও আপনার মতো সাতটায় হয়না। আমার সকাল হয় ভোর পাঁচটায়। সেই ভোর থেকেই আপনার ফরমাশ অনুযায়ী সব রান্নার যোগাড়পাতি শুরু করেছি। এবার দয়া করিয়া নবাবের বেটি খাবার গুলো পৌঁছে দিয়ে আমাকে রেহাই দিন।”

মায়ের নাটকীয় ভঙ্গিমায় কথা বলার ধরণে গাল ফুলায় অতসী। মিনমিনে স্বরে বলে,

“সবসময় দেরী করে উঠি না কী? রাতে কেমন গরম ছিল দেখোনি? এই গরমে ঘুমানো যায়? ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়েছি, তাই একটু দেরি হয়েছে উঠতে। এজন্য তুমি এভাবে কথা শুনাবে আমাকে?”

“আমার ভুল হয়ে গেছে মা জননী। মাফ করবেন? এবার যান গিয়ে রেডি হোন। ওরা কিন্তু চলে যাবে! পরে ফাঁকা বাড়িতে খাবার নিয়ে গিয়ে তুই পিকনিক করিস একা একা।”

আর কথা বাড়ায়না অতসী। ত্রস্ত রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। দৃষ্টি আজ চলে যাবে ময়মনসিংহ। এখন পযর্ন্ত ঐ বাসার মানুষ গুলোর রান্না করে এক বেলা খাওয়ার মানসিকতা হয়নি। প্রতিবেশী, আত্মীয়র বাসা থেকেই প্রতি বেলা রান্না করে খাবার দিয়ে যাচ্ছে।অতসী নিজেও দুদিন রান্না করে নিয়ে গিয়েছে। দিলশান আরা, সাদেক সাহেব এবার গেলে সহজে যে আর আসতে পারবেনা এটা জানে আতসী। ওনারা দুজনই কর্মজীবি মানুষ। এরপরও মেয়ের দূর্দিনে নিজেদের কাজ ফেলে এতো গুলো দিন থেকেছে। খাওয়া-দাওয়া কোনো কিছুর ঠিকঠিকানা ছিলনা। শুধু সুস্থ থাকতে হবে বিধায় দু মুঠো খেয়েছে এই যা। এই দুজন মানুষকে অতসীর ভীষণ ভালো লাগে। উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত পরিবারের হয়েও মানুষ গুলোর মাঝে বিন্দু মাত্র অহংকার নেই। তাদের ছেলের জন্য আনা সম্বন্ধ অতসী নাকচ করেছে এটা জানার পরও কত সুন্দর অতসীকে আপন করে নিয়েছে!তাদের পরিবারের একজন হয়েই পাশে থাকতে দিয়েছে এই বিপদে। মানুষ দুজন আজ চলে যাবে দৃষ্টিকে সাথে নিয়ে সেজন্যই অতসী ভেবেছিল আজকে তাদের জন্য কিছু ভালো মন্দ রান্না করে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিবে। এই পরিস্থিতিতে তো আর দাওয়াত করে বাসায় এনে খাওয়ানো যায়না। কারো দাওয়াত রাখার মানসিকতাও নেই। এই ভাবনাতেই শিউলী বেগমকে গতকালই সকাল সকাল রান্না করে রাখার কথা বলে দিয়েছিল।আধা ঘন্টার মাঝেই রেডি হয়ে দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে শূণ্য মুখেই খাবার নিয়ে বেরিয়ে পরে অতসী। মা’কে আশ্বস্ত করে যায় এই বলে, ঐ বাড়িতে তাদের সাথে সেও খেয়ে নিবে। সকাল সকাল জ্যাম না থাকাই অল্প সময়েই শিকদার মঞ্জিলে পৌঁছে যায় অতসী। কলিং বেল চেপে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করতেই ঐপাশ থেকে দরজা খুলে দেয় কেউ। চোখ তুলে তাকিয়ে অতসী দেখতে পায় মিলির হাস্যজ্জ্বল মুখ।

“হেই কিউটি! হাউ আর ইউ?”

চলবে….