একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-২৭+২৮

0
142

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৭
#আদওয়া_ইবশার

একটা সময় রক্তিমের কাছে আসার জন্য যে মেয়েটার মাঝে ছিল শত শত পাগলামি, আজ সেই মেয়েটার মাঝেই তার থেকে দূরে সরে যাবার ব্যস্ততা শুধু নিরবে দেখে যায় রক্তিম। অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারেনা। কথারা সব মনের মাঝেই চাপা থাকে। ব্যাগেজ গুছানোর ফাঁকে দৃষ্টি এক পলক তাকিয়ে দেখে নিরব রক্তিমকে। ফের নজর হটিয়ে মন দেয় নিজের কাজে। মিনিট দুইয়েকের মাঝেই সম্পূর্ণ রেডি হয়ে বের হতে নেয় রুম থেকে। ঠিক সেই মুহূর্তে শক্ত পুরুষালী হাতের বাঁধনে আটকা পরে দৃষ্টির কোমল ডান হাত। ভীষণ চমকে থেমে যায় পা জোড়া। তড়িৎ ফিরে তাকায় রক্তিমের নির্লিপ্ত মুখের দিকে। মনে ক্ষীণ আশা জাগে, এই বুঝি পাষন্ডটা ব্যকুল চিত্তে বলবে,
“এই মেয়ে! আমাকে ছেড়ে কোথায় যাবে তুমি?”

সেদিন ঝোঁকের বশে সন্তান হারানোর বেদনা সইতে না পেরে বড়ো গলায় চলে যাবে বলে দিলেও প্রকৃত সত্য এটাই, দৃষ্টির বেহায়া মন বারবার চাইছে রক্তিম তাকে আটকাক। জনম জনম যদি তার কষ্টেও কেটে যায়, তবুও সে এই পাষন্ডটাকে সাথে নিয়ে বাঁচতে চায়। ভালোবাসা মানুষকে যতটা না আত্মসম্মান দেয়, তার থেকেও বেশি বেহায়া হতে বাধ্য করে।দৃষ্টিও এই পাথুরে হৃদয়ের মানুষটাকে ভালোবেসে চরম বেহায়া হয়েছে। যার কারণে এতো এতো কষ্টের পরও নির্লজ্জ মন এখনো কাঁদে এই পাষাণের জন্য। চলে তো যাচ্ছে সে, কিন্তু পারবে এই মানুষটার চিন্তায় একটা দিনও শান্তিতে থাকতে?

“ডাক্তার রুনার সিরিয়াল দেওয়া আছে। যাবার আগে একবার চেকআপটা করে যেও।এমনিতেই অনেক হেলাফেলা হয়েছে। সময় মতো চেকআপ হচ্ছেনা অনেক দিন।”

দৃষ্টি চেয়েছিল মানুষটা আজ অন্তত মুখে স্বীকার করুক, তার জীবনে দৃষ্টি ঠিক কতটা জুড়ে আছে। প্রচণ্ড অধিকার খাটিয়ে তাকে বুকের মাঝে ঝাপটে ধরে জোর গলায় বলুক, “কোথাও যেতে দিবনা তোমাকে।ঠিক এভাবেই জড়িয়ে রাখব আমৃত্যু নিজের সাথে।” কিন্তু হলনা এর কিছুই। উল্টো নিষ্ঠুরের মতো শুধু বাচ্চার কথা ভেবে দৃষ্টির তৃষ্ণার্ত হৃদয়টাই দুঃখ বাড়িয়েছে দ্বিগুণ। অবহেলা নামক বিষ কাঁটার অসহনীয় আঘাতে কোমল মনে সৃষ্টি করছে একের পর এক তাজা ঘা। বছরের পর বছর মিথ্যে আশা দিয়ে শান্ত রাখা হৃদয়ে হুট করেই আজ প্রবল বেগে আচড়ে পরছে বেদনার জলোচ্ছাস। ব্যথিত হৃদয়টা আজ খুব করে চাইছে বাঁধনহারা হতে। হাঁসফাঁস করছে চিৎকার করে পুরো বিশ্বকে জানান দিতে, “এই নিষ্ঠুর,স্বার্থপর লোকটা এতো গুলো বছরেও আমায় একটুও ভালোবাসেনি। দিনের পর দিন এক মরিচিকার পিছনে ছুটেছি আমি।” চিৎকার করে মনের দুঃখটাকে প্রকাশ করতে না পেরে দৃষ্টি ভিতর ভিতর ছটফটিয়ে মরে। ভীষণ পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। রক্তিম তাকিয়ে দেখে দৃষ্টির এই অস্থিরতা, ছটফটানি। কিন্তু একটুও বিচলিত হয়না। বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক সুরে জানতে চায়,

“কী হয়েছে?এমন করছো কেন?”

রক্তিমের এই জিজ্ঞেসাটুকু হুট করেই দৃষ্টির মস্তিষ্কে রাগ চাপিয়ে দেয়। তীব্র ক্রোধে ফুঁসে ওঠে আচমকা হেচকা টানে ছাড়িয়ে নেয় রক্তিমের বাঁধন থেকে নিজের হাত। দাঁতে দাঁত পিষে চেঁচিয়ে ওঠে,

“অনেক হয়েছে। অনেক দেখেছি আমাকে নিয়ে আপনার ব্যস্ত হবার নাটক। এবার অন্তত বন্ধ করুন এই ভন্ডামি। অসহ্য হয়ে গেছি আমি। একদম সহ্য হচ্ছেনা, না আপনাকে আর না আপনার এই নাটককে। ঐদিন বলেছিলাম না আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল আপনাকে ভালোবাসা! আজকে আবারও বলছি, আপনার মতো এমন একটা ভন্ড, হৃদয়হীনকে ভালোবাসা আমার চরম ভুল ছিল।যে ভুলের মাশুল আমাকে গুণতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।”

“শুরু থেকেই বলে এসেছি আমি খারাপ।ভীষণ খারাপ।বারবার সতর্ক করেছি আমাকে ভালোবেসে কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবেনা। তখন কী বলেছিলে মনে নেই?এমনটাই বোধহয় বলেছিলে, তোমার একার ভালোবাসা দিয়েই সুখে থাকবে আমার সাথে। আমার সাথে আমার সমস্ত খারাপ গুণ গুলোকেও ভালোবাসবে। কখনো কোনো অভিযোগ করবেনা। তবে আজ কেন এই কথা? এক জীবন থাকার প্রতিজ্ঞা করে এক যুগ পার হবার আগেই হাঁপিয়ে গেছো?”

নিজের মাঝে থাকা চাপা রাগটাকে সংবরণ করার প্রয়াস চালিয়ে অত্যন্ত শীতল ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে রক্তিম।পরপর পিছনমুখি হয়ে দুহাতে মাথার চুল খামচে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে। ভিতরে জমে থাকা কষ্ট গুলো বিধ্বংসী ঝড় হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে বারবার। ইচ্ছে হচ্ছে সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে সব ধ্বংস করে দিতে। তবে যদি অশান্ত মনটা অল্প শান্তির আভাস পায়। সেই বিধ্বংসী ঝড়টুকু দমিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করেও শেষ পযর্ন্ত ব্যর্থ হয় রক্তিম। বাধ ভাঙ্গে ধৈর্যের।দৈবাৎ পিছন ফিরে দৃষ্টির একটা হাত ভীষণ আক্রোশে চেপে ধরে। কন্ঠে ক্রোধের অগ্নিমর্শা জ্বালিয়ে বলে ওঠে,

“আচ্ছা!আমাকে একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করো। আমার প্রতি তোমার এই অভিযোগ গুলো ঠিক কিসের উপর ভিত্তি করে? আমি অন্য আট-দশটা স্বামীর মতো সবসময় মুখে ভালোবাসি বলে ফেনা তুলতে পারিনা এজন্য? না কী তোমাকে নিয়ে বছর বছর ঘুরতে যেতে পারিনা,সময় দিতে পারিনা এজন্য? যদি কারণ এটাই হয়ে থাকে, তবে বলব তুমি জানতে না আমি কেমন? সব জেনে ভালোবাসোনি আমাকে? ভালোবাসি কথাটা মুখে বললেই কী ভালোবাসা যায়? ভালোবাসি না বলে কাউকে ভালোবাসা যায়না? তোমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা কী আমি জানিনা। তবে আমার কাছে ভালোবাসা মানে মুখে ভালোবাসি না বলেও অপর মানুষটাকে প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করানো ভালোবাসার গভীরতা। আমার মাথায় হাত রেখে বলো তো, গত আট বছরে একবারও আমার কোনো কাজে এক বিন্দু ভালোবাসা খোঁজে পাওনি তুমি? তোমাকে ভালো রাখার জন্য কিচ্ছু করিনি আমি? তবে আর কাকে ভালো রাখার জন্য এতো ব্যস্ততা আমার? আচ্ছা যাও, মেনে নিলাম আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসিনা। কিন্তু তুমি! তুমি তো ভালোবাসো আমাকে। আমার জন্য নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে পযর্ন্ত গিয়েছো। আমার এতো এতো অত্যাচার, উপেক্ষা সহ্য করেও থেকে গেছো আমার জীবনে। কিন্তু কী লাভ এতো ভালোবেসে যদি আমার মনটাকে পড়তেই না পারো? হ্যাঁ, বিয়ের পর থেকে ভীষণ যত্নে রেখেছো আমাকে। কখন কী খাব, কী পরব সবটা খেয়াল রেখেছো। একটু অসুস্থ হলেই ছটফট করেছো আমার সুস্থতার জন্য। কিন্তু আমার শারীরিক অসুস্থতায় তুমি যতটা ছটফট করেছো, তার এক বিন্দু ছটফট কী আমার মনের অসুখে করেছো?একবার জানতে চেয়েছো আমার হৃদয়ের কষ্ট গুলোর কথা? তুমি যেমন সন্তান হারিয়েছো, তেমন আমিও সন্তান হারিয়েছি। রোদ্রিক আমারও প্রথম সন্তান ছিল। ওর মুখ থেকেই আমি প্রথম বাবা ডাক শুনেছি। এই দুহাতের আঙুলে ওর ছোট্ট দুটো হাতের আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি। রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকে চিন্তা করেছি ওর সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ কিভাবে করব। আমার সেই ছেলেটা কিডন্যাপ হলো জেলে থেকে আমি এই খবরটাও জানতে পারলাম না। তিন মাস জেলখানার মানসিক, শারীরিক অত্যাচার সহ্য করে বাড়িতে এসে পেয়েছি আমার সেই আদরের সন্তানের বীভৎস লাশ। এরপর আমার মানসিক অবস্থা ঠিক কেমন হতে পারে একটাবার চিন্তা করেছো তুমি? একটাবার জানতে চেয়েছো আমার বুকে ঠিক কতটা কষ্ট চেপে আছে? চাওনি। উল্টো আমি যখন তোমার কথা ভেবে নিজের কষ্টটাকে তুচ্ছ করে ছুটে গিয়েছি তোমার কাছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তুমি কি করলে? আমার ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাওয়া হৃদয়টাকে আবার ভাঙলে নতুন করে। সরাসরি নিজের সন্তানের খুনি বানিয়ে দিলে। কথাটা বলতে তোমার একবারও বুক কাঁপলনা! শুধু এটুকুতেও থেমে যাওনি, চড়া গলায় ঘোষণা দিলে আমার মতো খুনির সাথে এক ছাদের নিচে আর থাকবেনা। এই একই কাজটা যদি আমি করতাম? প্রথম যেদিন থানায় দেখা হয় বলিনি আমি, রোদ্রিককে আমি ছাড়া পাবার আগ পযর্ন্ত বাড়ি থেকে বের হতে দিবেনা? তবুও দিয়েছো। দিয়েছো দেখেই ওরা সুযোগ পেয়েছে আমার ছেলেকে কিডন্যাপ করার। আজ যদি রোদ্রিক বাসার বাইরে না যেতো তবে হয়তো এই দিনটা আসতনা। এই ইস্যু ধরে কী আমি পরতাম না এটা বলতে, তোমার জন্য আমার ছেলে খুন হয়েছে! আমার ছেলের মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী!কিন্তু বলিনি। সবটা নিজের ভাগ্য বলে এখনো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায়।অথচ তুমি!”

তীব্র আক্রোশের সাথে কথা গুলো বলে রক্তিম এক ঝটকায় দৃষ্টির হাতটা ছেড়ে পিছিয়ে আসে দুই পা।বুক চিরে বেরিয়ে আসে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস।নিজের প্রতি নিজেই তাচ্ছিল্য হেসে পূণরায় বলে ওঠে,

“শালার কপাল আমার!কপালটাই যেখানে বারবার দুশমনি করে সেখানে কাকে কী বলব?”

দৃষ্টি কান্না ভুলে বিস্ফোরিত নেত্রে দেখে যায় রক্তিমের এই রূপ। বহু বছর আগের সেই বেপরোয়া, ভীষণ বদমেজাজি রক্তিম শিকদার আজ যেন আবারও তার সামনে দাঁড়িয়ে। তবে মানতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার প্রতি করা রক্তিমের এই একটা অভিযোগ,”সে কখনো রক্তিমের মনের হদিশ রাখেনি।”

“আমি আপনাকে কখনো বোঝার চেষ্টা করিনি? কখনো জানতে চাইনি আপনার মনের খবর?”

কন্ঠে অগাধ বিস্ময় নিয়ে জানতে চায় দৃষ্টি।বিপরীতে রক্তিম প্রসঙ্গ পাল্টে নিজেকে শান্ত করে অত্যন্ত স্বাভাবিক সুরে বলে,

“যেতে দিচ্ছি বলে এটা ভেবোনা একেবারে মুক্তি দিচ্ছি।আমরা দুজনই একের পর এক ঝামেলার মুখোমুখি হয়ে মেন্টালি আনস্টেবল।এই সিচুয়েশনে দুজন একসাথে থাকলে এমন ছোটখাট বিষয়ে বারবার ভুল বোঝাবুঝি হবেই। আই থিংক এর থেকে ভালো হবে দুজন কিছুদিন নিজের মতো করে আলাদা থাকি।যেদিন তোমার মনে হবে আমার সাথে থাকতে পারবে সেদিন নির্দ্বিধায় চলে এসো। তোমার ঘর, তোমার সংসার আজীবন তোমরই থাকবে। আর একটা কথা, অনুরোধ করে বলছি, দয়া করে বাচ্চাটার কথা ভেবে নিজের প্রতি যত্ন নিও।”

রক্তিমের থেকে সঠিক জবাব না পেয়ে দৃষ্টির মনের রাগ-ক্ষোভ গুলো একটু একটু করে বিলীন হয়ে সেখানে জড়ো হয় পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের মতোই একরাশ অভিমান।সেই মনের কোণে জড়ো হওয়া অভিমান থেকে অল্প কিছু ঝরে পরে অশ্রুকণা হয়ে। কন্ঠ রোধ হয় বোবা কান্নায়।এক রাশ নিরব অভিমানকে সঙ্গী করেই মন খারাপের পসরা সাজিয়ে দৃষ্টি বিদায় নেয় শিকদার মঞ্জিল থেকে।

______

তিমিরাচ্ছন্ন নিস্তব্ধ রাত। বিশালতার উপমায় শীর্ষে থাকা মাথার উপরের বিস্তর শামিয়ানা জুড়ে আজ আর এক চাঁদকে কেন্দ্র করে তারাদের মেলা বসেনি।বিপরীতে পুরো আকাশটাকে দখলে নিয়েছে ছাই রঙা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘমালা।চারিদিকে দূর্বার গতিতে ক্ষণিকের জন্য আলোরন ছড়িয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ। বাতাসের গতি বেড়েছে। তীব্র ঝড়ো হাওয়ায় ধুলোটে পুরো শহরময়। বিগত দিন গুলোর অসহনীয় গরমে ঝিমিয়ে পরা প্রকৃতির বুকে প্রলয়ঙ্কারি ঝড় আসার পূর্বাভাস। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে হাত-পা ছড়িয়ে ছাদের এক কোণে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে রক্তিম।পা দুটো ঝুলছে র‍্যালিং এর বাইরে। উদাস দৃষ্টিজোড়া নিবদ্ধ বিধ্বংসী ঝড়ের পূর্বাভাস জানান দেওয়া সুদূর আকাশপানে। মস্তিষ্ক জুড়ে চলছে স্মৃতির বিচরণ। অতীত নামের কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া কিছু মিষ্টি-মধুর ঘটনা ভেসে উঠছে বারবার মানসপটে। যার সর্বত্র জুড়ে বিরাজমান দৃষ্টি নামক অতি সাধারণ এক মেয়ে আর ছোট্ট একটা আদুরে বাচ্চা। সেই সূচনা লগ্ন থেকে আজ এই পযর্ন্ত ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র থেকেও অতি ক্ষুদ্র ঘটনা গুলো দখল করে নিয়েছে রক্তিমের পুরো মস্তিষ্ক।সাথে ভীষণ বাজেভাবে পুড়াচ্ছে পাথুরে খেতাব পাওয়া হৃদয়টাকে। ধনুকের ন্যায় তীক্ষ্ম চোখ দুটোর কুচকুচে কালো মণির আশপাশ রক্তাভ। পাষন্ড বুকটার সাথে চোখ দুটোও অত্যন্ত বিশ্রীভাবে জ্বলছে। অনুভূত হচ্ছে কেউ বুঝি শুকনা মরিচ বেটে ঢলে দিয়েছে।হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া থেমে গিয়ে ঝুমঝুম শব্দ তুলে বড়ো বড়ো বৃষ্টিফোঁটা পরতে শুরু করেছে।প্রকৃতির সাথে একটু একটু করে অতি উৎসাহে ভিজিয়ে দিচ্ছে রক্তিমের উষ্ণ শরীরটাকে শীতল জলের ধারা। তুমুল বর্ষণের আক্রোশের স্বীকার হয়ে দৈবাৎ রক্তিম আঁখি পল্লব বুজে নেয়। পরপর বুক চিরে বেরিয়ে আসে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস। সাথে বুঝি মিশে যায় বৃষ্টির জলের সাথে দু ফোঁটা পুরুষালী রুক্ষ চোখের উষ্ণ জল।এই বৃষ্টি জলের সিক্ত ছোঁয়ায় উষ্ণ দেহ বরফশীতল হলেও এখনো কেন থামছেনা হৃদয়ের দহন? কেন হৃদয়পুরি এখনো এতো উত্তপ্ত? ভেবে আবারও এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রক্তিমের যন্ত্রণাকৃষ্ঠ বুক চিরে। মৌনতায় নিশ্চল হয়ে থাকা ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে আচমকা ভীষণ আক্ষেপের সাথে আনমনে বলে ওঠে,

সে এসেছিল চুপিচুপি শেষ প্রহরে,
নিঃশব্দে পদধুলি ফেলেছিল আমার রংহীন শহরে।
আমার ধূসর হৃদয়টা রাঙিয়েছিল তার প্রণয় আবিরে।
আমি বিমূঢ় হয়ে দেখেছিলাম তাকে,
নিভৃতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আমার শূণ্য ভূবনে।
সে এসেছিল শেষ বিকেলের আপার্থিব মায়া ছড়িয়ে এক পাতাঝরা বসন্তে,
ভালোবাসার ছন্দে আমার প্রাণহীন জীবনে প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে।
সে এসেছিল ভীষণ খরতাপে,
ধু ধু মরুপ্রান্তে যখন আমি মৃতপ্রায়,,
ভালোবাসার জাদুর ছোঁয়ায় আমার খরাপ্রবল জীবনে,
ঝুমঝুম ছন্দে বারিধারা নামিয়েছিল।
ছাতক পাখির ন্যায় এক বিন্দু বৃষ্টির আশায় মুখিয়ে থাকা আমার হৃদয়টা সেদিন,
রিমঝিম বৃষ্টির ছন্দে নেচেছিল তুমুল আনন্দে।
আমার অনুর্বর জীবনে সজীবতার ছোঁয়া দিয়ে
হুট করেই সে হারিয়ে গেল কোনো এক অচিনপুরে।
অথচ কথা ছিল, আমৃত্যু সে পাশে থাকবে
আমার প্রণয়ের পরিপূরক হয়ে।

নিস্তব্ধ, নিরব বর্ষণমোখর রাতের আঁধারেই মিশে যায় রক্তিম নামক এক অত্যন্ত বদমেজাজি, স্বার্থপর,নিষ্ঠুর পুরুষের শক্ত খোলসে ঢাকা হৃদয়ের গভীর আর্তনাদ। ভীষণ আত্মকেন্দ্রীক,
মুখচোরা, চাপা স্বভাবের মানুষ গুলোর বুকে চেপে থাকা বেদনার লহর কিংবা বাধভাঙ্গা খুশির জয়গান সর্বদা বুঝি এভাবেই আড়াল থাকে! মনের কথা গুলো অন্যের কাছে তুলে ধরতে তাদের যত দ্বিধা। তারা নিজ মনে পুড়বে, তীব্র হৃদয় দহনে ভিতর ভিতর ছটফটিয়ে মরবে। অথচ বাঃহিক দিকে নিজেকে দেখাবে ভীষণ নির্লিপ্ত।

বৃষ্টির গতি বাড়ছে। সেই সাথে বেড়েছে বাতাসের বেগ। তীব্র ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ছোট ছোট ডালপালা ভেঙ্গে উড়ে এসে পরছে ছাদে। ধীরগতিতে শোয়া থেকে ওঠে টলতে টলতে রুমে যায় রক্তিম। মাথাটা ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে। শরীরটাও কেমন ম্যাজম্যাজ করছে। নাক-মুখ দিয়ে গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। জ্বরটা বোধহয় এসেই পরল।এমনিতেই অল্প বৃষ্টির ছোঁয়া পেলেই ছোট বেলা থেকেই তীব্র জ্বরে ভুগতে হয় তাকে। এর মাঝে আজ আবার এতোক্ষন পযর্ন্ত একটানা ভিজেছে।কোনোমতে ভেজা কাপড় পাল্টে খালি পেটেই একটা প্যারাসিটামল খেয়ে কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পরে রক্তিম।চোখ দুটো বন্ধ করতেই বন্ধ চোখের তারাই ভেসে ওঠে ঝাপসা কিছু স্মৃতি। সেই রাতটাও ছিল বর্ষণমোখর। জরুরি একটা মিটিংয়ে আটকে গিয়ে মাঝ রাতে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরেছিল রক্তিম।বৃষ্টিতে ভেজার ফলে সে রাতেও তীব্র জ্বরের প্রকোপে পরতে হয়েছিল তাকে। তার জ্বরে তপ্ত মলীন মুখটা দেখে দৃষ্টির সে কী কান্না! ছোট বাচ্চার মতো ভীষণ যত্নে পুরোটা রাত নিজের শরীরের উষ্ণতায় আগলে রেখেছিল রক্তিমের জ্বরে পোড়া শরীরটাকে।এক বিন্দু ত্রুটি রাখেনি রক্তিমের যত্নে। সেদিনের মতো আজও ঠিক একই ভাবে জ্বরতপ্ত রক্তিম। অথচ দৃষ্টি নামক সেই ভীষণ মায়াময় মেয়েটা পাশে নেই তার। কেউ নেই আজ রক্তিমের উত্তপ্ত কপালটাই অল্প ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিতে।দেখতে দেখতে আজ এগারো দিন পার হয়ে গেছে দৃষ্টি শিকদার মঞ্জিলে নেই।এই এগারো দিনে দৃষ্টির পক্ষ থেকে রক্তিমের জন্য না এসেছে কোনো ফোনকল আর না এসেছে কোনো ক্ষুদেবার্তা। অথচ রক্তিম ঠিক টের পেয়েছে প্রতি বেলা রেহানা বেগমের সাথে, ইতির সাথে কথা হয় দৃষ্টির। দূরে থেকেও অসুস্থ শাশুড়ির সমস্ত দিকে নজর রাখছে। অথচ রক্তিমের বেলায় আজ সে বড্ড উদাসীন।ঐদিন রক্তিম নিজের মনের কথা তাকে জানিয়ে দেওয়ার পরও একটাবার সে জানতে চাইনি, এই ভঙ্গুর হৃদয়ের মানুষটা কী হালে আছে। নারী মন অভিমানী হয়। তাই বলে এতো অভিমান? কাউকে তীব্রভাবে ভালোবাসলে বুঝি তার থেকে এতোদিন পযর্ন্ত অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রাখা যায়? কথা গুলো ভেবে ভেবে রক্তিমের কঠোর হৃদয়টাতেও এক পশলা অভিমান এসে ভীড় জমায়।সেই অভিমানী মনটায় আবার হাঁসফাঁস করে একটাবার তার হৃদয়চারিনীর সান্নিধ্য পেতে। খুব করে চায়, একটু এসে বসুক দৃষ্টি তার পাশে। গভীর ভালোবাসা মিশিয়ে অল্প পরশ বুলিয়ে দিক জ্বরে পোড়া কপালটাতে। তীব্র অধিকার খাটিয়ে বকুক কেন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছে সেই ইস্যুতে। পূর্ণতা পায়না রক্তিমের এই চাওয়া গুলো। মনের কোণে জেগে উঠা সুপ্ত বাসনা গুলো বড্ড অবহেলায় পরে রই মনের এক কোণেই। কেউ জানতেও পারেনা তার বিরহে কোনো একটা মানুষ এই মাঝ রাতে ছটফটিয়ে মরছে। অভিমানী মনে আকাশ-কুসুম ভাবতে ভাবতে একটা সময় একটু একটু করে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় রক্তিমের ক্লান্ত দেহ।মিনিট গড়াতে না গড়াতেই হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে ওঠাই ভীষণ চমকে কাচা ঘুম ভেঙ্গে যায় রক্তিমের। কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে স্থির করে বেড সাইট টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিতে নিতে কল কেটে যায়। মুহূর্ত ব্যবধানে পূণরায় কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে এতো রাতে দিহানের নাম্বার দেখে রক্তিমের মনে কিছুটা ভয়ের দানা বাঁধে। অবচেতন মন ভাবে দৃষ্টির কিছু হলনা তো!চিন্তিত মনেই ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ইথারে ভেসে আসে দিহানের গম্ভীর গলার আওয়াজ,

“এক বহুরূপী জানোয়ার জালে আটকা পরেছে। এড্রেস ম্যাসেজ করে দিচ্ছি। দেখতে চাই দ্রুত চলে আসুন।”

চলবে…..

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৮
#আদওয়া_ইবশার

সদ্য নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের তৃতীয় তলায় একটা কামরায় টিমটিমে আলো জ্বলছে। পুরো কামরা জুড়ে আসবাব বলতে দুটো কাঠের চেয়ার। যে দুটো চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে দুজন যুবককে।শারীরিক আঘাতে কাহিল যুবক দুজনই অচেতন। মাথা হেলে আছে হাঁটুর সাথে। বাহিরে তখনও অবিরাম ধারায় বৃষ্টি পরছে।পিনপতন নিরব পরিবেশে শুধু শোনা যাচ্ছে হুটহাট বজ্রপাতের তীব্র আওয়াজ।রক্তিম প্রশ্নাত্মক নজরে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিহানের দিকে। জ্বরতপ্ত শরীর তার বৃষ্টির পানিতে ভিজে জবজবে। দিহানের থেকে ঐ খবর পেয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা তোয়াক্কা না করেই ছুটে এসেছে এই ঝড়-বাদল মাথায় নিয়েই। ভিতরটা তীব্র উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছে। মন যা বোঝার বুঝে গেছে।হয়তো এই দুজনের মাঝেই কেউ তার ছেলের খুনি।কিন্তু সাহস হচ্ছেনা এগিয়ে গিয়ে মুখটা দেখার। কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে এই ভাঙচুরের খেলায় মত্ত হৃদয়টা আবার ভাঙবে। হয়তো খুব বাজে ভাবেই ভাঙবে। দিহান এক পলক রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বেঁধে রাখা যুবক দুজনের দিকে। হাত দুটো উপরে তুলে গা ঝারা দিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে যায় তাদের দিকে।

“ইমরান!”

নজর সেদিকে স্থির রেখেই উচ্চ স্বরে হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে ডেকে ওঠে দিহান। তৎক্ষণাৎ বাইরে থেকে ছোট্ট একটা বালতি হাতে ছুটে আসে ইমরান।ধোয়া উঠা গরম পানি বালতিতে। ইমরান একবার বালতির পানির দিকে তাকিয়ে পরপর দিহানের দিকে তাকায়। অসহায় কন্ঠে বলে,

“স্যার!গরম পানি এটুকুই জোগাড় করতে পেরেছি। কারেন্ট নেই। আশেপাশে কোনো চায়ের স্টল’ও খোলা নেই। তবুও কাফি গিয়েছে দেখতে কোথাও পায় কী না।কোনটার গায়ে ঢালব এটুকু?”

“আগে বিয়াই সাহেবের আপ্পায়নের ব্যবস্থা করো। আত্মীয় রেখে অনাত্মীয়কে কেন যাব এতো যত্ন করতে?”

বাঁকা হেসে দিহান কথাটা বলতেই তুমুল উৎসাহে ইমরান এগিয়ে গিয়ে বালতি ভর্তি গরম পানি পুরোটা ঢেলে দেয় একজনের গায়ে। তৎক্ষণাৎ মুখ দিয়ে গোঙানির অস্ফুট শব্দ করে নড়েচড়ে ওঠে যুবক। সেকেন্ড গড়াতে না গড়াতেই সেই অস্ফুট গোঙানির শব্দ আর্ত চিৎকারে পরিণত হয়।শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হওয়া জখম গুলোতে গরম পানি পরাই মনে হচ্ছে কেউ বুঝি এসিড ছুড়ে দিয়েছে। পিটপিট চোখ মেলে তাকিয়ে ব্যথাতুর মুখটা উপরে তুলতেই স্পষ্ট হয় চেহারা।ক্ষীণ আলোয় অতি পরিচিত এক মুখের আদল চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ভীষণ চমকে দুই পা পিছিয়ে যায় রক্তিম। চোখে-মুখে অবিশ্বাস নিয়ে ঠাই তাকিয়ে থাকে তীব্র ব্যথায় কুঁচকে রাখা ঐ মুখটার দিকে।এই মুহূর্তে নিজের চোখ দুটোকেও বিশ্বাস করতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে রক্তিমের। কেমন যেন মনে হচ্ছে সব মিথ্যে। এই পৃথিবী,এই পৃথিবীর মানুষ,একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা সব কিছুই মিথ্যে। আর না হয় সব তার গভীর ঘুমে দেখা কোনো দুঃস্বপ্ন। হাঁসফাঁস করে ওঠে রক্তিম। ভারী হয় নিঃশ্বাসের গতি। অসহনীয় এক পীড়ায় কতরাতে কাতরাতে বিরবির করে, “সব মিথ্যে। সব মিথ্যে,সব।”

দিহান রক্তিমের এই অসহায় অবস্থা দেখে ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভীষন তাচ্ছিল্যতার সাথে বলে,

“মায়ের পেটের ভাই যেখানে চরম বিশ্বাস ঘাতকতার প্রমাণ দেয়, সেখানে বন্ধু কোন ছাই!ছোট্ট একটা জীবনে এতোবার ঠকে যাওয়ার পরও এখনো কাউকে এতো অন্ধ বিশ্বাস কিভাবে করতে পারেন?”

জবাব দেয়না রক্তিম।অবিশ্বাস্য নজরে এখনো তাকিয়ে ঐ মুখের দিকে। বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে তৃষ্ণার্ত গলাটা ভেজানোর ব্যর্থ প্রয়াস করে। শক্তপোক্ত শরীরটা ভেঙ্গে আসছে। মাথাটাও কেমন ঝিমঝিম করছে। জ্বরটা কী বেশি বেড়েছে? না কী এই আকষ্মিক ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে এই এমন বেহাল দশা? ভেবে ভেবে দিশা হারিয়ে আবারও ছটফটিয়ে ওঠে রক্তিম। বড়ো বড়ো দুটো নিঃশ্বাস ফেলে নিশ্চল পা দুটো বহুকষ্টে টেনে নিয়ে যায় সামনের দিকে। মুখোমুখি হয় আপন জনের তালিকায় শীর্ষে রাখা সেই মুখোশধারী বেঈমানের। কিছু পল ঐ ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে।পরপর দুহাতে মুখটা আগলে ধরে কাতর সুরে বলে,

“এই,এই মেহেদী! বল সব মিথ্যে। দিহান তোর নামে যা যা বলেছে সব মিথ্যে তাইনা! তুই এমনটা করতেই পারিসনা আমার সাথে। তুই তো আমার সেই বন্ধু যে আমার সবথেকে খারাপ সময়ে আমার পাশে থেকেছে। যেই সময়টাই আমি আমার জন্মদাতা মা-বাবা’কেও পাশে পাইনি ঐ সময়টাই তুই পাশে ছিলি। আমার অন্ধকার জীবনে একমাত্র আলো ছিলি তুই। আমার প্রতিটা নির্ঘুম রাতের সাথী তুই, আমার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসের সাথী তুই।তুই এমনটা করতে পারিসনা। এভাবে আমার বিশ্বাস ভাঙ্গতে পারিসনা।শুধু একবার বল সব মিথ্যে!”

নিভু নিভু চোখ দুটো মেলে রক্তিমের অসহায় মুখটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহেদী। পরপর চোখ-মুখ বিকৃত করে নেয় হঠাৎ পিছন থেকে কেউ মাথার চুল টেনে ধরায়।

“লাইন বাই লাইন, প্রথম থেকে শেষ পযর্ন্ত সবটা বল। খোদার কসম,একটু উল্টাপাল্ট বললেই তোর কলিজা কেটে আমি হাতে নিয়ে নিব।”

দিহানের শীতল গলার হুমকিতে চমকে উঠে মেহেদী।ব্যাথায় জর্জরিত চোখে-মুখে ফুটে উঠে আতঙ্ক। মাত্র তিন ঘন্টায় দিহান নিজের যে পাশবিক রূপ দেখিয়েছে তাতে নিশ্চিত কোনো জ্যান্ত মানুষের কলিজা কেটে হাতে নেওয়াটা এই ছেলের কাছে এক চুটকির ব্যাপার।বিগত তিন ঘন্টার অমানুষিক অত্যাচারের স্বীকার হয়ে মেহেদী নিজের মৃত্যু কামনা করতেও ভুলেনি। ভয়ার্ত সেই মুহূর্তটার কথা মনে পরতেই এখনো তার রুহ কাঁপছে। দুই হাতের নখ থেকে শুরু করে দুই পায়ের প্রতিটা নখ নিষ্ঠুরের মতো প্লাস দিয়ে তুলে নিয়েছে দিহান হাসতে হাসতে। প্রতিটা আঙুলের ডগা থেকে এখনো রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পরছে।ঐ সময়টাই প্রতিটা সেকেন্ড মনে হয়েছে এই বুঝি মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলো সে।এখনো টনটনে ব্যথায় অসাঢ় হয়ে আছে হাত-পা। ইলেকট্রিক শকের কারণে চোখের সামনে সবকিছু অস্পষ্ট মনে হচ্ছে। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুকের ভিতরটা। হাপিয়ে যাওয়া স্বরে বহুকষ্টে মেহেদী রক্তাক্ত ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,

“বলব, সব বলব। তার আগে একটু পানি দাও। মরে যাচ্ছি আমি তৃষ্ণায়।”

মুহূর্তেই দিহানের চোখ-মুখ কঠোর হয়ে উঠে। মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয় হাত দুটো।শক্ত চোয়ালে অত্যন্ত ঠান্ডা সুরে বলে ওঠে,

“ঠিক এভাবেই আমার আদরের ভাগ্নেটা তোদের কাছে একটু পানির জন্য আবদার করেছিল। বিপরীতে যেন কী দিয়েছিলি?”

বলতে বলতে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ছুটে এসে এক হাতে মেহেদীর চোয়াল চেপে ধরে অন্য হাতে চেপে ধরে কন্ঠনালী।নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ডাঙায় উঠা কই মাছের মতোই ছটফট করে মেহেদী। ভয়ঙ্কর রূপে গর্জে ওঠে দিহান আবারও,

“এই বল কী দিয়েছিলি পানির বদলে? বল বল কী খাইয়েছিলি আমার ভাগ্নেকে?’

রক্তিম স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে দেখে দিহানের পাগলামি আর শুনে যায় মেহেদীর যন্ত্রণাকাতর এক একটা আর্তনাদ। তার কাছে এখনো সব কিছু কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে। দিহানের হিংস্র হাতের কবলে পরে নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মেহেদীর চোখ দুটো যখন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম ঠিক সেই মুহূর্তে চেয়ার সহ মেহেদীকে এক প্রকার ছুড়ে ফেলে পিছিয়ে আসে দিহান। তৎক্ষণাৎ মেহেদীর করুণ আর্তনাদে ভারী হয় আশপাশ। মুখ হা করে বড়ো বড়ো দম নিয়ে কাল বিলম্ব না করে মেহেদী বলতে থাকে,

“সব সব আমি করেছি। রক্তিমকে মিথ্যে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠিয়েছি আমি। রোদ্রিককেও আমিই মেরেছি।ক্ষমতা, টাকা আর প্রতিপত্তির লোভে অন্ধ হয়ে সব কিছু করেছি আমি।”

কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে রক্তিম তাকিয়ে শুনে মেহেদীর সরল স্বীকারোক্তি।পরপর ভীষণ শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় তার দিকে। হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরে মেহেদীর মুখের কাছে। শান্ত নজরে তাকিয়ে অত্যন্ত শীতল সুরে জিজ্ঞেস করে,

“কেন করেছিস এমন? কেন ভাঙলি আমার বিশ্বাস? টাকা, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি বন্ধুত্বের কাছে হেরে গেল কেন শেষ পযর্ন্ত?”

যন্ত্রণা ভুলে হঠাৎ অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেসে ওঠে মেহেদী। তীব্র রোষানলে ফেটে চিৎকার করে বলে ওঠে,

“আরে কিসের বন্ধুত্ব হ্যাঁ? এইসব বালের বন্ধুত্বের দুহাই দিতে আসবিনা একদম। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা আমি খুব ভালো করেই জানি। জানি দেখেই যে সময় তোর পাশে কেউ ছিলনা ঐ সময় আমি ছিলাম তোর পাশে ঠিক তোর ছায়া হয়ে। কিন্তু লাভ কী হলো? এই প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিতে গিয়েই শালার ভবিষ্যৎ করলাম অন্ধকার। যার খেসারত গুণতে হচ্ছে আজ আমার।”

বহুকষ্টে বেদনায় জর্জরিত শরীরটা টেনে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে মেহেদী।চোখ দুটো বন্ধ করে বারকয়েক ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফের ধীরে ধীরে বলতে থাকে,

“আমি বেঈমান ছিলাম না। আর না ছিলাম অকৃতজ্ঞ বন্ধু।পরিস্থিতি আমাকে বেঈমান, অকৃতজ্ঞ বানিয়েছে। একটা কথা শুনিসনি, লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়! আমাকে শুধু অন্ধই করেনি। সাথে বানিয়েছে অমানুষ। অতীতের আমির সাথে এই আজকের আমির তুলনা করিসনা রক্তিম। অতীতে যে মেহেদী তোর ঢাল হয়ে তোর পাশে ছিল সেই মেহেদীর কোনো লোভ ছিলনা। ছিল বন্ধুত্বের এক রাশ শুদ্ধতম ভালোবাসা। স্রেফ বন্ধুত্বের এক অমোঘ মায়ার টানেই পুরো সমাজ তোকে খারাপ বললেও তখন আমি তোর সঙ্গ ছাড়তে পারিনি। উল্টো তোকে সঙ্গ দিতে গিয়ে ভাবতে ভুলে গেলাম নিজের ভবিষ্যতের কথা। হয়ে গেলাম বাপ-মায়ের কাছেও তাদের অবাধ্য সন্তান। যার পরিণাম হিসেবে বঞ্চিত হলাম পারিবারিক ব্যবসা থেকেও। বাবার ধারণা আমাকে ব্যবসার দায়িত্ব দিলে সব একদিনে নিলামে তুলব। আমাকে ঢিঙিয়ে আমার ছোট ভাই হয়ে উঠল বাড়ির কর্তা। নিজের খরচের জন্য একটা টাকা নিতে হলেও ছোট ভাইয়ের থেকে চেয়ে নিতে হতো। এর থেকে লজ্জার আর কিছু আছে বল? সেই লজ্জা ঘুচাতে খুব প্রয়োজন ছিল একটা চাকরির। কিন্তু ঐ যে তোর পিছনে ঘুরে ঘুরে ভবঘুরে, ছন্নছাড়া জীবনটাকে আপন করে নিলাম! এখন কী আর এই জীবনে ধরাবাঁধা নিয়মে চাকরি করা সম্ভব? ধৈর্য্য নেই কারো গোলামি করার। চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং এ ফোকাস করলাম। ভালোই ইনকাম হচ্ছিলো। মোটামুটি বেশ পরিচিতি লাভ করে নিলাম মাত্র কয়েক বছরে এই সাইটে। তোর কাছ থেকে চেয়ে নিলাম ভালোবাসার মানুষটাকে। এই পযর্ন্ত সব ভালোই চলছিলো। কিন্তু হুট করে তোর সাথে ব্যবসা করার সিদ্ধান্তটা নিয়েই যা ঝামেলা বাঁধানোর ফেললাম বাঁধিয়ে। একটু একটু করে যে সম্বলটুকু জমা করেছিলাম সব ইনভেস্ট করে দিলাম তোর সাথে ব্যবসায়। মনে আছে তো প্রথম ইনভেস্টের টাকা সব মার গিয়েছিল?এরপরও তুই হাল ছাড়িসনি। বলেছিলি নতুন করে আবার শুরু করবি। ব্যবসায় লাভ-লস থাকবেই। কিন্তু আমার হাতে তখন আর এক পয়সাও ছিলনা ইনভেস্ট করার মতো। লজ্জায় সেই কথা তোকে বলতেও পারিনি। ভেবেছি যদি ভাবিস টাকার জন্য তোর বোনকে আমি কষ্টে রাখছি? কিন্তু তবও তুই কিভাবে যেন বুঝে গেলি তখন আমার পকেট ফাকা। বললি এ যাত্রায় আমার কোনো ইনভেস্ট লাগবেনা। কথাটা আমার ভীষণ সম্মানে লাগে। মনে হয় তুই বঝি করুণা করছিস আমাকে। মানতে না পেরে বাবার কাছে টাকা চাই। কিন্তু বাবা সরাসরি নিষেধ করে দেয় কোনো টাকা দিতে পারবেনা। বাবার না শুনে সেদিন আমার যতটা কষ্ট লেগেছিলো এতোটা কষ্ট এর আগে কখনো পাইনি। নিজ মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সেদিন, যে টাকার জন্য নিজ পিতার কাছে এতো অবহেলা আমার জীবনে আর যায় করি না কেন এই টাকা আমি ইনকাম করেই ছাড়বো। সেদিনের পর থেকেই মাথায় ঘুরছিলো শুধু টাকা আর টাকা। খোঁজে বেড়াচ্ছিলাম একটা সুযোগ যে সুযোগ আমার ভাগ্য বদলে দিবে রাতারাতি। সৃষ্টিকর্তার কী খেলা দেখ, পেয়েও গেলাম খুব সহজেই সেই সুযোগ।মনে আছে তোর, প্রথম যখন এমপি পদ পেয়েছিলি তখন আসলাম তালুকদার নামের একজন লোক পাঠিয়েছিল তোর কাছে একটা অফার দিয়ে?”

ঘাড় কাত করে হুট করে ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে রক্তিমের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা জানতে চায় মেহেদী। কপাল কুঁচকে মনে মনে রক্তিম অতীতের হিসেব কষতেই স্মরণে আসে সেই ঘটনা।বাংলাদেশের কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী আসলাম তালুকদার।যার নেটওয়ার্ক পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে। বর্ডার সীমান্ত এলাকা আর সমুদ্র পথে চোরাইভাবে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা, ফ্যান্সিডিল, আইস,হেরোইন,কোকেন ম্যাথামফেটামিল,এলএসডি, এক্সট্যাসি,গাঁজা মরফিন,ওপিয়াম,ফেনটানিল,কেটামিন
সহ দামি দামি মাদক দ্রব্য এনে পুরো দেশে সাপ্লাই দেয়। দেশ জুড়ে নিশ্চিন্তে মাদক ব্যবসা চালানোর জন্য লাখ লাখ টাকা উপহারস্বরুপ দিয়ে হাতের মুঠোয় রাখে বড়ো বড়ো রাজনৈতিক নেতাদের। রক্তিম তখন সাভার এক আসনের নব নির্বাচিত এমপি। তাকে হাত করে সাভারে নিশ্চিন্তে মাদক ব্যবসার প্রসারের জন্য মোটা অংকের টাকা দিয়ে আসলাম তালুকদার লোক পাঠিয়েছিল রক্তিমের পার্টি অফিসে। সর্বদা নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ানো রক্তিম লোক গুলোর মুখে অর্ধ কথা শুনেই তুমুল গন্ডগোল বাধিয়ে দেয় সেদিন। এক একটাকে মনের খায়েশ মিটিয়ে আচ্ছামতো পিটিয়ে আধমরা করে ধরিয়ে দেয় পুলিশের হাতে। কিন্তু আফসোস! এমপি সাহেবের চোখে ধুলো দিয়ে পুলিশ লোক গুলোকে সেদিনই জেল থেকে সলিসালামতে মুক্তি দেয়। পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট যেখানে আসলাম তালুকদারের নামে উঠে আর বসে সেখানে রক্তিমের কথায় সেই সাগরেদ আসলাম তালুকদারের লোককে কে জেলে আটকে রাখবে? নতুন নতুন কাজের চাপে রক্তিম নিজেও ভুলে যায় কিছুদিনের মধ্যে এই কথা। চাপা পরে যায় পুরো ঘটনা খুব সহজেই। আজ বহুদিন পর মেহেদীর মুখে সেই আসলাম তালুকদারের কথা শুনে হতবাক হয় রক্তিম। ফের অবিশ্বাস্য দৃষ্টি ফেলে মেহেদীর মুখের দিকে।রক্তিমের মুখের অভিব্যক্তি দেখে ক্রুর হাসে। ফের বলতে শুরু করে,

“ঠিক ধরেছিস। রাতারাতি কোটিপতি হবার সুযোগটা আসলাম তালুকদারই দেয় আমাকে। অবশ্য আমি নিজেই লুফে নেই এতো চমৎকার একটা অফার। আসলাম তালুকদার খুব ভালো করেই জানতো আমি তোর ডান হাত, বাম হাত দুটোই। সেই বিশ্বাসেই পুরো সাভার এরিয়ার দায়িত্ব সহজেই দিয়ে দেয় আমার হাতে। আমিও টাকার লোভে মজে গিয়ে অতি সহজেই তোর অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ কাজে লাগিয়ে চালিয়ে যাই এই কাজ। কাজটা খুব কঠিন কিছু ছিলনা। খুবই সিম্পল, যখন যে যে এলাকায় মাদক সাপ্লাই চলতো ঐ এলাকাটা নিজ দায়িত্বে একটু প্রশাসনের আড়ালে রাখতাম। দিন শেষে বিনিময়ে পেতাম লাখ লাখ টাকা। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল কিছুদিন পেরোতেই। শালার এলাকার আন্ডা বাচ্চা থেকে শুরু করে জোয়ান বুড়ো সব একসাথে মাদকাসক্ত হয়ে উঠতে লাগল। ব্যাপারটা একটু একটু করে সবার চোখেই ধরা পরল। তুইও বুঝে গেলি তোর শহরেই কেউ ঘাপটি মেরে বসে নিশ্চিন্তে এই ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। তোর তো আবার দয়ার শরীর। ভীষণ ন্যায়বাদী এমপি মানুষ। তুই কী আর সব জেনেও এভাবে যুব সমাজকে ধ্বংস হতে দিবি? শুরু করলি আমার কাজে একের পর এক ব্যাঘাৎ ঘটানো। ততদিনে আমিও টাকার মোহে অন্ধ যতটা তার থেকেও দ্বিগুণ আসক্ত ড্রাগসের নেশায়। এই দুই নেশা একটু একটু করে বানিয়ে দিল আমাকে পুরো মানুষ থেকে অমানুষ। ইতি যাতে টের না পায় আমার ড্রাগস এডিকশনের কথা সেইজন্য ব্যবসার বাহানা দিয়ে ঘাটি বাধলাম অফিসেই। সপ্তাহে একদিন মন চাইলে বাড়িতে যেতাম না হয় থাকতাম ওখানেই। তুই’ও রাজনীতি সামলে আর অফিসমুখো হতিস না। ব্যবসা তো এভাবে সেই কবেই লাল বাত্তি জ্বালিয়েছে। কিন্তু তোকে জানিয়েছি রমরমা ব্যবসা। চারিদিকে শুধু লাভ আর লাভ। আসল লাভের টাকা তো আসতো আমার এই লুকোচুরির ব্যবসা থেকেই। সেটার টাকা থেকেই তোকে দিয়ে হিসাব বুঝাতাম ব্যবসার। যাইহোক সেই কথা, কোথায় যেন ছিলাম? ওহ হ্যাঁ, আমার শান্তির মাদক সাপ্লাই এ বাঁধা হয়ে উঠলি তুই। দিন যত যাচ্ছিল ততই তোর কাজ বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে উঠেছিল। শেষ অবধি না পারছিলাম কিছু করতে আর না পারছিলাম সহ্য করতে।বুঝতে পরলাম এভাবে চলতে থাকলে আমার ধ্বংস নিশ্চিত। যে পথে পা দিয়েছি মৃত্যু ছাড়া সেই পথ থেকে ফিরে আসার না ছিল উপায় আর না ছিল তোকে থামানোর কোনো সহজ পদ্ধতি। তাই বাধ্য হয়ে হাত মিলিয়েছিলাম কাদের ভুঁইয়ার সাথে। ডিল হয়েছিল সে এমপি হলে আমার রাস্তা ক্লিয়ার। তাই তোকে সড়ানোর জন্য প্ল্যানমাফিক কাদের ভুঁইয়ার ছোট ভাইয়ের লাশের গায়ে ছুরির আঘাত করে তোকে কফির সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে খুনের নাটক সাজিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই প্ল্যানেই সাকসেসফুল হব। কিন্তু ঐ মিতালী সাহার কুটিল বুদ্ধির কাছে যখন দেখলাম সব বাজিমাত তখন প্ল্যান বি হিসেবে টার্গেট করলাম রোদ্রিককে। কিন্তু বিশ্বাস কর, বাচ্চা ছেলেটাকে মারার কোনো প্ল্যান আমার ছিলনা। আমাদের প্ল্যান ছিল, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যদি তুই আবার হাইকোর্টে রিট করে ইলেকশনে দাড়াস! তাই রোদ্রিককে কিডন্যাপ করে তোকে হুমকির মুখে রেখে ইলেকশনের আগ পযর্ন্ত ওকে আটকে রাখব। কোটি টাকা খরচ হলেও ইলেকশনে তোর বিপরীতে লড়ব আমি। কোনোমতে ইলেকশনটা শেষ হলেই রোদ্রিককে মুক্তি দিয়ে দিব। কিন্তু চার‍দিন যেতে না যেতেই সব প্ল্যান ভেস্তে দিল এই মা’***।”

পাশেই অচেতন হয়ে থাকা সিএনজি ড্রাইভার রুকন মিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ-মুখ বিকৃত করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিটা দিয়ে মেহেদী দম নেয়। নিরবে পুরো ঘটনা শুনে রক্তিম মেঝেতে শান্ত দৃষ্টি রেখে ঠান্ডা স্বরে প্রশ্ন করে,

“কী করেছে ও?”

ক্ষীণ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হাপিয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে মেহেদী পূণরায় বলতে থাকে,

“শালা মদনকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম প্ল্যান মাফিক সব হাতের মুঠোয় আসার আগ পযর্ন্ত রোদ্রিককে স্কুলের সামনে থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকতে। টাকা যা লাগে সব দিব। বারবার বলেছিলাম রোদ্রিকের যেন কোনো কষ্ট না হয়। কিন্তু কে জানতো শালা স্যাডিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ?বাচ্চাদের শারীরিক আঘাত করে এই পাগল তৃপ্তি পায়। না জেনেই শিয়ালের কাছে মুরগি তুলে দিলাম। মাত্র চারদিনেই ছেলেটাকে শেষ করে দিয়েছে।”

স্যাডিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার একটি মনস্তাত্বিক রোগ। এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা থাকে। রুকন মিয়ার পাস্ট হিস্ট্রি ঘেটে যতদূর জানা গেছে ছোট বেলা থেকেই ও এই ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত। যার মাশুল গুণতে হয়েছে নিষ্পাপ রোদ্রিককে। বাচ্চা ছেলেটাকে হাতের কাছে পেয়ে রুকন মিয়া নিজের বিকৃত মনষ্কের পৈশাচিক প্রবণতা দমাতে না পেরে তিলে তিলে মেরেছে। চারটা দিন ছোট্ট রোদ্রিককে শারীরিক মানসিক অত্যাচারে একেবারে দুনিয়া থেকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।পাশবিক অত্যাচারে মরন যন্ত্রণায় কাতর রোদ্রিক যখন রুকন মিয়ার কাছে একটু পানির জন্য আহাজারি করেছিল তখন এই অমানবিক বিকৃত মস্তিষ্কের রুকন মিয়া বাচ্চা ছেলেটাকে পানির বদল দিয়েছিল নিজের প্রস্রাব। তৃষ্ণার্ত রোদ্রিকের বুকটা তখন খরাপ্রবল জমিনের মতোই চৌচির এক বিন্দু পানির জন্য। বাচ্চা ছেলেটা নিজের তৃষ্ণা নিবারণে তখন ঐ প্রস্রাবকেই অমৃত মনে করে পান করেছিল। শুধু এটুকুই না, রোদ্রিকের ছোট্ট দেহে যতক্ষণ প্রাণপাখিটা ছিল ততক্ষণ পযর্ন্ত ভয়ানক পদ্ধতি অবলম্বন করে একটু একটু করে নিঃশেষ করেছে ছেলেটাকে। উত্তপ্ত শিক ঢুকিয়েছে জিহ্বের ডগায়, কন্ঠনালীর ঠিক মাঝ বরাবর। দুই হাত-পায়ের প্রতিটা নখ প্লাস দিয়ে তুলে নিয়েছে। সমস্ত শরীরে লোহা গরম করে সুচ ফোটানোর মতোই ফুটিয়েছে, আবার সেগুলো টেনে টেনে তুলেছে। রোদ্রিকের বাচার জন্য ছটফটানি, এক একটা আর্ত চিৎকারে হয়তো তখন সৃষ্টিকর্তার আরশ পযর্ন্ত কেঁপেছে। কিন্তু কাঁপেনি রুকন মিয়ার নিষ্ঠুর হৃদয়। উল্টো আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল রুকন মিয়া। রোদ্রিকের এক একটা আর্তনাদে শীতল হয়েছিল মানুষ রূপী অমানুষ রুকন মিয়ার পাশবিক হৃদয়।

নিজের ছেলের এমন করুণ মৃত্যুর বর্ণনা শোনার পর এবার আর রক্তিমের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না। কেমন যেন এক খন্ড বরফের ন্যায় জমে আছে রক্তিম। দৃষ্টি এখনো মেঝেতেই নিবদ্ধ। মিনিট পাঁচেক কেটে যায় পিনপতন নিরবতায়। দিহান নিজেও প্রতিক্রিয়াহীন শান্ত নজরে তাকিয়ে রক্তিমের দিকে।দেখার অপেক্ষায় সব জানার পর রক্তিম ঠিক কেমন আচরণ করে। তবে অবাক হয় মিনিট দশেক কেটে যাবার পরও রক্তিমের নির্লিপ্ততায়। ভয়ানক রাগ হয় এই মানুষটার প্রতি। মনে প্রশ্ন জাগে, কেমন বাবা সে? ছেলের খুনিকে চোখের সামনে দেখেও কিভাবে ঠিক রাখছে নিজেকে? অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই এতোক্ষনে রক্তারক্তি কান্ড ঘটিয়ে ফেলতো। রক্তিমের কাছেও দিহান ঠিক এমন কিছুই আশা করেছিল। বিপরীতে একরাশ হতাশা, রাগ, ক্ষোভ ছাড়া কিছুই পেলনা। রাগে চিরবিরিয়ে দিহান ইমরানের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে আদেশ ছুড়ে,

“গাড়িতে তুলো দুটোকেই। এখানে রেখে আর তামাশা করে কোনো লাভ নেই।”

আদেশ পাওয়া মাত্রই ইমরান ব্যস্ত ভঙ্গিতে দুজনকে নিয়ে বেরিয়ে যায় কামরা থেকে। রক্তিম তবুও নির্লিপ্ত। দিহান এক পলক সেদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যতার সাথে বলে ওঠে,

“এখানে বসে থেকে মশা মারা ছাড়া আর কোনো কাজ হবেনা। তার থেকে বরং বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুম দিন। ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদারে নিশ্চয়ই খুব ভালো ঘুম হবে। শরীরটাও চাঙা হবে। পরদিন সকালে আবার ফুরফুরে মন-মেজাজে পার্টির কাজে যোগ দিতে পারবেন।”

“কষ্ট করে আমাকে ড্রাইভ করে বাসা পযর্ন্ত দিয়ে আসতে পারবে?বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছি বোধহয়। মাথাটা ভারভার লাগছে। মনে হয়না সেইফলি ড্রাইভ করতে পারব?”

আশ্চর্য!এই লোক এখনো নিজের সেইফটির কথা ভাবে কিভাবে? দিহান যতটুকু জানে অতি শোকে মানুষ পাথর হয়। কিন্তু এই লোকের তো একদম ব্রেইন শার্প হয়ে গেছে। মস্তিষ্ক সুস্থ্য না থাকলে এভাবে নিজের চিন্তা করে?

আকাশ এখনো অবিরাম ধারায় কেঁদে যাচ্ছে। মনে হয়না এই বৃষ্টি আগামী সাত দিনেও থামবে। জনজীবন একেবারে তিতিবিরক্ত করে তবেই বোধহয় খ্যান্ত হবে আকাশের ক্রন্দন।এই অহেতুক কান্না কেন আকাশের? কী দুঃখ তার? মনুষ্য জাতির মতো তো তাকে সর্বদা জীবনের জটিল সমীকরণ মিলাতে হয়না। ছুটতে হয়না বাঁচার তাগিদে অহর্নিশ।তবে কোন দুঃখে এতো উদাস হয়ে কাঁদে সে? ড্রাইভ করতে করতে আপন মনে কথা গুলো ভাবে দিহান। পরপর নিজের এই অহেতুক ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয়ে কপাল কুঁচকায়। কী সব আবোলতাবোল, মাথামন্ডু ছাড়া ভাবনা ভাবছে সে? বিগত দিন গুলোর একের পর এক প্রেশারে মাথাটা বোধহয় একেবারে গেছে তার। এই কেসটা সফভ হলেই লম্বা একটা ব্রেক নিতে হবে। না হয় দেখা যাবে দুদিন পর তার স্থান হবে পাবনায়।

“তোমার এই চার বছরের চাকরি জীবনে সবসময় কী ন্যায়ের পথে থাকতে পেরেছো? কখনো প্রশ্রয় দাওনি অন্যায়কে?”

নিরবতার জাল ছিঁড়ে হঠাৎ রক্তিমের গমগমে স্বরে করা প্রশ্নে কিছুটা চমকায় দিহান।চমকিত নজরেই ঘাড় কাত করে ফিরে তাকায় রক্তিমের উদাস মুখের দিকে। ফের সামনের দিকে তাকিয়ে দক্ষ হাতে ড্রাইভ করতে করতেই মলিন হেসে জবাব দেয়,

“এমন কোনো মক্কার খেজুর নেই যে এই প্রফেশনে এসে নিজেকে অনেস্ট দাবি করবে। কোনো না কোনো এক সময় ঠিক জীবনের ভয় আর না হয় চাকরি বাচিয়ে রাখার তাগিদে হলেও নীতির পথ ছাড়তে হয়। উপর মহলের ভোলাভালা অতি সৎ আর আদর্শবান লেবাসধারী শালা গুলোর হুকুম মানতে গিয়ে কতবার যে মিথ্যেকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যে বলে চালিয়েছি তার কোনো হিসাব নেই।সত্যি কথা বলতে এই প্রফেশনের সাথে জড়িত মানুষদের মুখেই শুধু নীতিকথা মানায়। আদতে সবথেকে বেশি অন্যায় এদের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার থেকে শুরু করে ছোটখাট চাদাবাজদের সাথেও প্রতি সপ্তাহে এদের মোলাকাত হয়।”

“আজকে তাহলে আর একটু নীতি ভাঙতে পারবে?বিনিময়ে যা চাইবে তাই পাবে।”

তৎক্ষণাৎ গাড়ির ব্রেক কষে বিস্ফোরিত নজরে রক্তিমের নির্লিপ্ত মুখের দিকে তাকায় দিহান। সেই মুহূর্তে রক্তিম নিজেও জালানার কাচ গলিয়ে অন্ধকারে নিবদ্ধ থাকা চোখ দুটো দিহানের দিকে স্থির করে। চোখে চোখে কিছু একটা কথা হয় দুজনের। মিনিট গড়াতে না গড়াতেই দিহানের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে জয়ের হাসি।ভীষণ খুশমেজাজে পূণরায় গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে,

“আমার বোনের সুখ ছাড়া বিনিময়ে কিছুই চাওয়ার নেই আপনার থেকে।”

চলবে….