একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-২৯+৩০

0
14

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ২৯
#আদওয়া_ইবশার

দিলশান আরা ব্যস্ত হাতে রান্নাঘর সামলাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে ড্রয়িং রুমের দেয়ালে টানানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়ের হিসেবটাও দেখে নিচ্ছে। আজকে প্রথম পিরিয়ডেই ক্লাস আছে ওনার। গভীর রাত পযর্ন্ত মেয়ের সাথে মন ভুলানো গল্প করে ঘুমাতে গিয়েছে দেরীতে। ফলস্বরূপ একটু বেলা করেই ঘুম ভেঙেছে। এখন পরতে হয়েছে বেকায়দায়।ইচ্ছে ছিল দৃষ্টির পছন্দ অনুযায়ী সকালের নাস্তায় ভুনা খিচুড়ি আর গরুর মাংস ঝাল ঝাল করে কষাবে। কিন্তু সময় স্বল্পতায় সেটা আর হয়ে উঠলনা। সহজ পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিয়েছে রুটি আর সবজি ভাজি। চুলাই সবজি বসিয়ে ব্যস্ত হাতে রুটি বেলছিল দিলশান আরা। ঠিক সেই মুহূর্তে কলিং বেল বেজে ওঠাই ত্রস্ত বেলুনি হাতেই ছুটে গিয়ে দরজা খুলে চোখের সামনে রক্তিমকে দেখে ভীষণ চমকায়। এলোমেলো বেশভুশা, উষ্কখুষ্ক চুল, বিধ্বস্ত চেহারায় এক হাতে দেয়ালে ভর রেখে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে রক্তিম। দিলশান আরা অবাক চোখে কতক্ষণ জামাতাকে পরখ করে হতবম্ভ হয়ে বলে,

“তুমি!এতো সকাল সকাল কিভাবে এলে?”

শাশুড়ির প্রশ্নে ধীরগতিতে চোখ দুটো খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রক্তিম।নিস্তেজ সুরে উত্তর দেয়,

” ভোরে রওনা দিয়েছি। জ্যাম ছিলনা রাস্তায়।”

উত্তরটা দিলশনা আরা’র খুব একটা মনঃপুত না হলেও রক্তিমের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা দেখে পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেনা। একপাশে সরে এসে নিরবে জায়গা করে দেয় ঘরে ঢোকার। ভিতরে ঢুকেই রক্তিমের তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো ব্যস্ত হয় কাউকে খোঁজতে।কাঙ্ক্ষিত মানুষটার হদিশ না পেয়ে দ্বিধান্বিত কন্ঠেই শাশুড়ির কাছে জানতে চায়,

“দৃষ্টি কোথায়?”

দিলশান আরা তখনো চোখে-মুখে অগাধ বিস্ময় নিয়ে রক্তিমের দিকেই তাকিয়ে। দেখছে তার ছটফটানি, অস্থিরতা, কাউকে দেখার জন্য চোখে-মুখে উপচে পরা আকুলতা। রক্তিম জবাব না পেয়ে ফের অস্থির চিত্তে প্রশ্ন করে,

“দৃষ্টি কোথায় মা?”

দিলশান আরা এবার একটু অস্বস্তিতে পরে যায়।

“রুমে আছে।” কোনোমতে জবাব টুকু দিয়ে চপল পায়ে রান্নাঘরে ছুটে। রক্তিম নিজেও আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ায়না।ব্যকুল হয়ে ছুটে দৃষ্টির রুমের দিকে। মনে হয় যেন একটু দেরী হলেই দৃষ্টি নামক এক মায়া কন্যাকে দেখতে না পাওয়ার তুমুল তৃষ্ণায় মৃত্যু হবে তার।

জানালার কাছে উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি। দেখছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কিভাবে নিবিড় আলিঙ্গনে মিশে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতির সাথে। দেখছে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে ভিজে চুপচুপে দুটো শালিক পাখি কিভাবে একে অপরের সাথে মিশে গিয়ে উষ্ণতা বিনিময় করছে। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, সবুজ প্রকৃতি আর জোড়া শালিকের সন্ধিক্ষণ দেখতে দেখতে দৃষ্টির উদাস মন মস্তিষ্ক জুড়ে তখন একটা মানুষের কথা ভেবে হাহাকারে ছেয়ে যায়। সেই মানুষ, যে মানুষটার ভাবনায় বিভোর থেকেই দৃষ্টির রাত নামে, আবার রাত শেষে সোনালী সকাল হয়। আচ্ছা! দিবা-নিশি যার ভাবনায় মজে থাকে তনুমন তার কী কখনো মনে পরে দৃষ্টির কথা? হয়তো পরেনা। যদি পরতো তবে কী আর এতোগুলো দিন কেটে যাবার পরও একটাবার খোঁজ না নিয়ে থাকতে পারতো? ভাবতে ভাবতে প্রকৃতির বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে দৃষ্টির চোখ দুটো থেকেও জল গড়িয়ে পরে। যে জলের সাথে মিশে যায় দৃষ্টির না বলা অভিযোগ, অভিমান,অনুরাগের কথা।

” শক্ত করে একটু জড়িয়ে ধরবে আমায়?”

হঠাৎ খুব নিকটে অতি প্রিয় সেই কন্ঠ,সেই মানুষটার অস্তিত্ব টের পেয়ে ভীষণ চমকে কান্না ভুলে স্থির জমে যায় দৃষ্টি।প্রথমে মনের ভ্রম ভেবে বিষয়টা উড়িয়ে দিতে চেয়েও কৌতূহলী মনটাকে দমাতে না পেরে তীব্র আশা নিয়ে পিছন ফিরে তাকায়। দেখতে পায় তার অতি প্রিয় সেই কঠোর মানুষটা করুণ রূপে দাঁড়িয়ে । সর্বদায় তেজোদ্বীপ্ত থাকা চোখ দুটো আজ কী ভীষণ নিরীহ লাগছে! শক্ত চোয়ালের মুখটা কেমন অসহায় ঠেকছে! এই রক্তিমকে তো দৃষ্টি চিনেনা। কখনো তো দেখেনি তার প্রিয় পুরুষটার এমন ভঙ্গুর রূপ। সহসা দামাল হাওয়ার মতোই নতুন করে এক পশলা দুঃখ এসে দৃষ্টির বুকের ভিতরটা দখল করে নেয়। মুচড়ে ওঠে হৃৎপিন্ড নামক ভীষণ সংবেদনশীল পেশিতন্তুটা। থমকে যাওয়া কান্নাটা গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে তুমুল বিদ্রোহ শুরু করে ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে ঐ শক্তপুক্ত বুকটাই মাথা রেখে জানতে, কী এমন দুঃখ ঐ বুকে লুকিয়ে আছে?যে দুঃখ এক লহমায় তার পাষাণ পুরুষটার এমন বেহাল দশা করে দিয়েছে? কিন্তু পারেনা।বুকের ভিতর গজিয়ে উঠা নিরব অভিমানের শেকড় আকরে ধরে পা দুটো। বাধ্য করে প্রাণ পুরুষের এই আকুল আবেদন পরিত্যাগ করতে।নিরবে শুধু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরে অভিমানী অশ্রুকণা। অপেক্ষায় চেয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় রক্তিম ধৈর্য্যচ্যুত হয়। অস্থির হয়ে এগিয়ে এসে দূরত্ব ঘুচিয়ে স্ববেগে মিশিয়ে নেয় বুকের সাথে। দৈবাৎ কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। এই স্পর্শ, এই শরীর, এই পরিচিত নেশাধরা ঘ্রাণ ঠিক কতদিন পর পেল সে? আর এই বুকটা! যে বুকটাতে মাথা না রাখলে একটা সময় তার শান্তির ঘুম হতনা, সেই বুকে ঠিক কতদিন হলো সে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমায়না? ভাবতে ভাবতে দৃষ্টির নিরব কান্নার রূপ পরিবর্তন হয়। কাঁপা হাতে রক্তিমের শার্ট আকরে ধরে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে শব্দ করে। দৃষ্টির মাথাটা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রক্তিম কাতর সুরে বলে ওঠে,

“”শেষ বারের মতো একটা সুযোগ দিবে আমায়?”
কথা দিচ্ছি আর কখনো কোনো দুঃখ এসে ছুঁতে দিবনা। দিবনা কোনো অভিযোগ করার সুযোগ। তুমি যা চাইবে যেভাবে চাইবে ঠিক সেটাই হবে। তবুও আমাকে বাঁচার শেষ একটা সুযোগ দাও প্লিজ! মরে যাচ্ছি আমি দৃষ্টি। একটু সুখের অসুখে প্রতি মুহূর্তে মরছি।বড্ড পাগল পাগল লাগে নিজেকে।মনে হয় একটু একটু করে কোনো এক গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।যে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরে আসার কোনো পথ নেই। আমার গভীর আঁধারে ছেয়ে যাওয়া জীবনে এক মুঠো রোদ্দুরের সন্ধান দিয়ে নতুন করে আবার আঁধারে ডুবিওনা প্লিজ!একবার সব হারিয়ে বাঁচতে পারলেও এবার আর পারবনা। ক্লান্ত আমি। সেই সাথে সব হারিয়ে নিঃস্ব। একটু করুণা করে আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল হিসেবে থেকে যাও প্লিজ!আমি বাঁচতে চাই দৃষ্টি। একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতা চাই। তোমার সাথে হাজারটা ভোর দেখতে চাই। তোমার স্বপ্নের সেই ছোট্ট সুখের সংসারটা পরিপূর্ণ সুখ দিয়ে সাজাতে চাই। বলো,দিবে একটা সুযোগ আমায়?”

রক্তিমের এক একটা আহাজারি দৃষ্টির বুকের ভিতর তীব্র ঝড়ের সৃষ্টি করে।সহ্য হয়না সর্বদা দেখে আসা কঠোর চিত্তের মানুষটার এহেন অসহায় রূপ। সে চেয়েছিল রক্তিম নরম হোক, একটু নরম সুরে ডাকুক তাকে। স্বীকার করুক মুখে তার জীবনে দৃষ্টির প্রয়োজন। তবে আজ কেন সহ্য হচ্ছেনা? কেন হৃদয়ে এতো জ্বালাপোড়া রক্তিমের এই সহজ স্বীকারোক্তিতে? কেন বারবার মনে হচ্ছে এই মানুষটাকে এমন রূপে মানায়না? সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, অভিমান কেন এই মানুষটার কাতর সুর শুনেই লেজ গুটিয়ে পালালো? সে তো মনে মনে শক্ত প্রতিজ্ঞা করেছিল এই নিষ্ঠুর,পাষন্ডটা তার বিরহে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরলেও সে গলবেনা। পই পই করে সুদ তুলবে এতো গুলো বছর তাকে কষ্ট দেওয়ার।কিন্তু হলো কই? মনটা কেমন দুমুখো আচরণ করে এখনই গলে বরফ হয়ে গেছে! হাওয়ায় ভেসে গেছে নিজ মনে করা সমস্ত প্রতিজ্ঞা, অভিমান,অভিযোগ। সাধে কী আর দৃষ্টি বলতো রক্তিম নামক এই বদ পুরুষটা তাকে বশ করেছে! ভালোবাসা নামক জাদুবলে একেবারেই দৃষ্টিকে তার হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলেছে। রক্তিম জবাব না পেয়ে আকুল হয়ে দৃষ্টির মাথাটা বুক থেকে সরিয়ে দুহাতের আজলায় নিয়ে ফের জানতে চায়,

“এই! বলো দিবে শেষ একটা সুযোগ? যাবে আবার আমার ঘরে? ঐ ঘরটা তোমার অভাবে নিষ্প্রাণ হয়ে আছে দৃষ্টি। ঐ বিশাল ঘরে তুমি নামক অক্সিজেনের অভাবে আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ভীষণ হাঁসফাঁস লাগে। বলো, বলো যাবেনা আমার সাথে? আমি আর রাজনীতি করবনা। যে ব্যবসা আছে এটাই করব মন দিয়ে। এক সন্তানকে হারিয়েছি। যে আসতে চলেছে তাকে আর হারাতে দিবনা। খুব যত্ন করে নিজের জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখব। দেখবে ওর আগমনে আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে। তুমি যেমন এক মুঠো রোদ্দুর দিয়ে আমার অন্ধকার জীবন আলোকিত করেছিলে, আমাদের এই সন্তানও ঠিক সেভাবেই মুঠো ভর্তি আলো নিয়ে আসবে আমাদের জীবনে। আমরা আবার হাসব সুখের হাসি।কারো নজর পরতে দিবনা সেই হাসিতে। যেই নজর দিতে আসবে তাকেই কে টে টু ক রো টু ক রো করে নদীতে ভাসিয়ে দিব ঐ বেঈমান মেহেদীর মতো।”

শেষ কথাটা শুনে আৎকে ওঠে দৃষ্টি। অবাক নজরে তাকিয়ে থেকে অবশেষে মুখ খুলে ,

“কী বলছেন এসব? পাগল হয়ে গেছেন? কী করেছেন মেহেদী ভাইয়ের সাথে? কিসের বেঈমানির কথা বলছেন আর কাকে কে টে টু ক রো টু ক রো করেছেন?”

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে দৃষ্টি। অজানা এক শঙ্কায় বুকটা তার কাঁপছে তুমুল বেগে।জবাবের আশায় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রক্তিমের মুখের দিকে। ততক্ষণে রক্তিমের মাঝে থাকা সমস্ত অস্থিরতা গায়েব। হুট করেই বদলে যায় পাগলাটে আচরণ। ভীষণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,

“গত দুটো রাত এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। ঘুমাবো আমি। বিকেলের আগে ডাকবেনা। একদম নিজের সংসারে ফিরে যাবার জন্য রেডি হয়ে ডেকে তুলবে আমায়। রিমেম্বার ইট।”

আবার! আবার শুরু হয়ে গেছে সেই আগের ত্যাড়ামো। এই লোক দৃষ্টিকে এতো সহজে শান্তিতে বাঁচতে দিবে? দৃষ্টির আগেই বোঝা উচিৎ ছিল গাঁধা শত পেটালেও যেমন ঘোড়া হয়না, তেমন জনম ত্যাড়া রক্তিম শিকদার জীবনে হাজারটা উষ্টা খেয়েও সোজা হবেনা। কী সুন্দর মাত্র একটু আগের কথা ভুলে এখনই চিরায়ত স্বভাবে ফিরে এসেছে! রাগে-দুঃখে ফের দৃষ্টির চোখ দুটো সিক্ত হয়। থরথর করে কাঁপে সর্বাঙ্গ। জেদ চাপে মাথায়, আজকে যে করেই হোক এই ঘাড় ত্যাড়ার ত্যাড়ামো স্বভাব পরিবর্তন করে পেট থেকে সঠিক কথা বের করবেই। এই গর্হিত অপরাধে যদি নিষ্ঠুর, বর্বর লোকটা তার টুটি চেপে ধরে তবুও সে পিছুপা হবেনা। পূর্ণ স্ত্রীর অধিকার আজ সে ফলাবেই।

“যতক্ষণ খুশি ঘুমান। প্রয়োজনে ঘুমাতে ঘমাতে জাহান্নামে চলে যান।কোনো বাঁধা দিবনা।কিন্তু আগে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিন। না হয় খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।”

ভীষণ জেদি স্বরে কথা গুলো বলে দৃষ্টি। রক্তিম দৃষ্টির এমন ছেলেমানুষি জেদ দেখে একপেশে হাসে। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতে গিয়েও দেয়না। বিছানার কাছটাই দাঁড়িয়েই পুরুষালী লম্বা হাতের বরাতে কাছে টেনে নেয় একটু দূরে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে থাকা দৃষ্টিকে। তড়িৎ গভীর আশ্লেষে নিজের রুক্ষ পুরুষালী ওষ্ঠাধর চেপে ধরে দৃষ্টির কোমল ওষ্ঠে। বহুদিন, বহুদিন পর ভীষণ পরিচিত, বড্ড প্রিয় পুরুষালী ঠোঁটের সেই গভীর ছোঁয়ায় দৃষ্টির তনুমন অজানা এক শিহরণে ছলকে ওঠে। ভুলে বসে পারিপার্শ্বিক সমস্ত চিন্তাভাবনা।সময় গড়ানোর সাথে সাথে তীব্র থেকেও তীব্র হয় রক্তিমের স্পর্শ। যে স্পর্শে দৃষ্টি খোঁজে পায় তার দুঃখ ভোলার মন্ত্র। একে অপরের দেহের উষ্ণতায় মিশে গিয়ে সমস্ত বেদনা, রাগ, ক্ষোভ, মান-অভিমান ভুলে হারিয়ে যায় ভালোবাসার এক অন্য জগতে। যে জগতে ভোরের শিশিরের পিঠে চড়ে আবির্ভাব ঘটে একরাশ ভালোবাসার। জোৎস্না ঝরা রাতের আকাশের রূপালী আলোর মতোই ঝরে পরে রাশি রাশি সুখ। যেখানে থাকেনা কোনো হারানোর বেদনা, না পাওয়ার যন্ত্রণা। থাকে শুধুই মুঠো মুঠো ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।

চলবে..

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ৩০
#আদওয়া_ইবশার

ভারী শরীর নিয়ে ইদানিং চলাফেরা করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে দৃষ্টির। হাত-পায়ে পানি এসেছে। শারীরিক যন্ত্রণায় সর্বক্ষণ ছটফট করে। প্রতিটা রাত কাটে নির্ঘুম।গতরাতেও এক ফোঁটা ঘুম হয়নি। রক্তিম নিজেও পুরো রাত জেগে অন্তঃসত্ত্বা বউয়ের সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। দৃষ্টির হাজার বারণ উপেক্ষা করে হাত-পা মালিশ করে দিয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। উদ্গ্রীব হয়ে বারবার জানতে চেয়েছে,

“বেশি খারাপ লাগছে? চলো ডাক্তারের কাছে চলে যাই!মাঝ রাত তো কি হয়েছে? ডিউটি ডাক্তার তো থাকবে!”

দৃষ্টি তখন দুচোখ উপচে পরা বিস্ময় নিয়ে শুধু নিরবে তাকিয়ে দেখেছে রক্তিমের অস্থিরতা। মনে মনে হিসেব কষতে ব্যস্ত হয়েছে, মানুষটার মাঝে ঠিক কতটুকু পরিবর্তন এসেছে! হ্যাঁ,আগের রক্তিম শিকদার দৃষ্টির প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল ছিল। তবে তার সেই যত্নটুকু ভাটা পরে যেতো তার গুরুগম্ভীর আচার-আচারণ, কথার ভাজে। বাঃহিক দিকে কখনো প্রকাশ করতনা দৃষ্টির অসুখে তার অস্থিরতা। ঠিক যেমন ভালোবাসার অনুভূতি লুকিয়ে রাখতো যত্ন করে বুকের ভিতর, তেমন করেই লুকিয়ে রাখতো প্রেয়সীর অসুস্থতায় সৃষ্ট দুশ্চিন্তাটুকুও। ঐ দৃঢ়, কঠোর চোয়ালের মুখটাই এখন দৃষ্টি যতবার তাকায় ততবার নিজের জন্য ভালোবাসা খোঁজে পায়। তীক্ষ্ণ চোখের চাহনি জানান দেয় সেই ভালোবাসার গভীরতা ঠিক কতটা অতল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা সময় দৃষ্টির চোখের বিস্ময় ভাব কেটে গিয়ে জড়ো হয় একরাশ মুগ্ধতা। বুকের ভিতর ছলকে ওঠে সুপ্ত বাসনা গুলো পূর্ণতা পাবার বাঁধভাঙ্গা খুশিতে। সেই খুশিটুকু কান্না হয়ে গলার কাছটাই দলা পাকিয়ে রোধ করে কন্ঠস্বর। ভুলে বসে সমস্ত শারীরিক ব্যথা, যন্ত্রণা। ভালোবাসা নামক এক মিঠে যন্ত্রণায় হাঁসফাঁস করে কান্নার ঢোক গিলে কাঁপা স্বরে বলে,

“বন্ধ করুন তো এসব।দীর্ঘ আট বছরে আপনার গম্ভীর স্বরে বলা ধারালো কথায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, অভ্যস্ত আপনার সেই নির্লিপ্ত অভিব্যক্তিতে। এতো গুলো বছর পর হুট করে এই রূপ একদম হজম হচ্ছেনা আমার। মনে হচ্ছে যে একরোখা, বদমেজাজি, মারমুখো, পাষাণ রক্তিম শিকদারকে ভালোবেসেছি আমি সেই রক্তিম শিকদারকে হারিয়ে ফেলেছি।”

দৃষ্টির কথায় রক্তিম ঠোঁট বাকিয়ে অল্প হাসে। হাসিমুখেই দৃষ্টির মুখোমুখি ঝুঁকে শীতল সুরে ফিসফিসিয়ে বলে,

“অথচ এটাই চাইতে তুমি। অভিযোগও ছিল এটার জন্যই। তবে এখন কেন মানতে কষ্ট হচ্ছে?”

“কষ্ট না, ভয় হচ্ছে। আমার গভীর ঘুমে দেখা যদি কোনো সুন্দরতম স্বপ্ন হয় এটা? ঘুম ভাঙতেই যদি দেখি সব সেই আগের মতোই আছে? আমার বহুল আরাধনার পর একান্ত নিজের করে পাওয়া প্রাণ পুরুষটা সেই আগের রূপেই যদি ধরা দেয় আমার কাছে? তবে যে এই মূহুর্তে পাওয়া সুখের থেকে দুঃখের বোঝাটাই ভারী হবে বেশি। এর থেকে বরং
আপনি সেই আগের মুখচোরা রক্তিম শিকদার’ই হয়ে যান।এতো ভালোবাসা এতো আহ্লাদের প্রয়োজন নেই আমার। আপনার অপ্রকাশিত ভালোবাসাতেই অভ্যস্ত হয়ে আজীবন অভিযোগহীন থেকে যাব।”

বিপরীতে কপালে উষ্ণ চুম্বন এঁকে ভীষণ নরম সুরে রক্তিম বলে,

“বলেছিনা আর কখনো কোনো কষ্ট এসে ছুঁতে দিবোনা? তবে কেন এতো ভয়? ভরসা নেই আমার প্রতি?”

দৃষ্টি তখনো মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকিয়ে দেখতে ব্যস্ত তার প্রাণ পুরুষকে। সেভাবে তাকিয়ে থেকেই উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে সাই জানায়। যে মানুষটা তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে মিশে আছে তাকে কিভাবে অবিশ্বাস করবে সে?

সকালের এক ফালি মিঠে রোদ্দুর জানালার ফাঁক গলিয়ে চোখে-মুখে এসে পরতেই ঘুম ভাঙ্গে দৃষ্টির। প্রথমে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে পাশ ফিরে আর একটু ঘুমানোর পাইতারা করলেও রক্তিম অফিসে যাবে ভাবনাটা মাথায় আসতেই হুড়মুড়িয়ে ওঠে যায়। এখন না উঠলে দেখা যাবে বদ লোকটা তাকে ঘুমের মাঝে রেখেই চম্পট দিবে। এদিকে সকাল সকাল প্রাণ পুরুষের মুখটা এক নজর দেখতে না পাওয়ার মনোকষ্টে সারাটা দিন ছটফট করে মরতে হবে তাকে। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম ঘুম ফোলা চোখ দুটো মেলে তাকাতেই রক্তিমকে ঘরে পরা নরমাল পোশাকে ডিভানে বসে থাকতে দেখে চমকায় যায় দৃষ্টি। একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে ভড়কে গিয়ে পূণরায় তাকায় রক্তিমের দিকে। হতবাক হয়ে জানতে চায়,

“নয়টা বেজে গেছে! এতো বেলা পযর্ন্ত ঘুমালাম আমি! আর আপনি এখনো এভাবে বসে আছেন কেন? অফিসে যাবেন না? লেট হচ্ছে তো!”

“যাবনা দেখেই রেডি হয়নি। ডক্টরের কাছে যাব একটু পর। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেড়ে রেডি হতে হবে। সাবধানে ওঠে পরো।”

এগিয়ে এসে দৃষ্টিকে দুহাতে আগলে ধরে ভীষণ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দেয় রক্তিম। বিপরীতে দৃষ্টির চোখে-মুখে ছেয়ে যায় একরাশ বিরক্তি। বাসি মুখটা বিরক্তিতে একেবারে তেতো হয়ে আসে। মেজাজটাও কেমন হুট করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চ্যাঁচিয়ে ওঠে কিছুটা জুড়েই,

“সি-সেকশনের ডেট আরও পনেরোদিন পর। এখন গিয়ে করবটা কী?”

দৃষ্টির আচমকা চ্যাঁচানোতে রক্তিমের মেজাজটাও বিগড়ে যায়। কঠোর চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েও দমিয়ে নেয় নিজেকে। নিজ মনেই প্রবাদ গুণে, “একদম রাগ দেখানো যাবেনা। শান্ত হয়ে ভীষণ নরম সুরে কথা বলতে হবে। না হলে এই মেয়ে আবারও তোকে ভালোবাসতে না পারার অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।” পরপর ফুঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বুঝানোর সুরে বলে,

“মানলাম সি-সেকশনের ডেট পনেরো দিন পর। কিন্তু এখন গেলে তো আর কোনো জেল-জরিমানা হবেনা তাইনা? তাছাড়া আজকেই তো সি-সেকশনের জন্য চলে যাচ্ছিনা। যাব নরমাল চেকআপ এর জন্য। তোমার প্রবলেম গুলো বললে নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা নিবেন ডাক্তার। এভাবে রাত জাগলে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে প্রেশার যদি একদম কমে যায়? পরে তো সিজারে অসুবিধা হবে। এর থেকে ভালো না আজকে গিয়ে একবার দেখা করে আসি? একটু বুঝো আমার কথাটা প্লিজ!”

রক্তিমের এই রাগ নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক সুরে তাকে মানানোর চেষ্টা দেখে দৃষ্টির হুট করেই বিরক্তি-রাগ সব হাওয়ায় ভেসে গিয়ে পেট ফেটে হাসি আসে। মনে মনে ভাবে, আহারে! বেচারা সিংহ কিভাবে বউয়ের পাল্লায় পরে ম্যাঁউ ম্যাঁউ করা বিড়াল হয়ে গেল! কোনোমতে হাসি চেপে মুখটা গুমরা করে জবাব দেয়,

“আচ্ছা ঠিক আছে। এতো করে যখন বলছেন যাওয়ায় যায়।”

সাথে সাথে ঠোঁট ফাক করে রক্তিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

________

প্রকৃত অর্থে কাউকে ভালোবাসলে সেই মানুষটাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে পরে। ‘ভালোবাসা’ ছোট্ট একটা শব্দ। এই ছোট্ট একটা শব্দই মানব জাতিকে দেয় স্বর্গীয় সুখ। আবার কখনো কখনো দেয় অবর্ণনীয় বেদনা। যে বেদনা তিলে তিলে নিঃশেষ করে একটা মানুষকে। ভুলিয়ে দেয় জগতের মায়া, জীবনের মায়া। ঠিক যেমন ভুলে বসেছে ইতি। আজ প্রায় দুই মাস হতে চলেছে মেহেদী নিখোঁজ। জলজ্যান্ত মানুষটা হুট করে এভাবে কোথায় হারিয়ে গেল জানা নেই কারো। আদৌ বেঁচে আছে কী না তাও জানা নেই। তবুও প্রাণপ্রিয় স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় প্রতিনিয়ত প্রহর গুণছে ইতি। দিন শেষে সে ফিরে আসবে, এই আশায় বুক বেঁধে তীর্থের ন্যায় চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটোও আজ ভীষণ ক্লান্ত। শশুর, শাশুড়ি থেকে শুরু করে অন্য সব আত্মীয়দের মতো নিজের মনটাও বারবার দোষমনি করে বলছে,সে ফিরবেনা। মিথ্যে আশায় আর বুক বাঁধিস না। ফেরার হলে কী আগেই ফিরতনা? জানেনা সে, ঘরে তার প্রেয়সী অপেক্ষমাণ? বাবা পাগল মেয়েটা যে বাবাকে না দেখে দুটো দিনও থাকতে পারেনা! সবই তো জানে সে। এরপরও ফিরছেনা। তবে কেন ঐ নিষ্ঠুরের জন্য এতো অপেক্ষা তোর?’ অবচেতন মনের এহেন ভাবনায় অবর্ণনীয় এক যন্ত্রণায় দুলে ওঠে ইতির অন্তরাত্মা। বুকে চাপা কষ্ট নামক এক খন্ড বরফ বিরহ নামক দহনের উত্তাপে গলে কান্না হয়ে ঝরে দুচোখ বেয়ে। বিরহ যন্ত্রণা ঠিক কতটা অসহনীয় তা কিছুটা হলেও জানান দিতেই অশান্ত হৃদয়ে এক বিরহিনী চিৎকার করে কাঁদে পাগলের মতো।

চারিদিকে তখন সাঁঝক বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। কাছের-দূরের মসজিদ গুলো থেকে সমস্বরে ভেসে আসছে সুমধুর আজানের ধ্বনি। সেই সুমধুর ধ্বনির সাথেই খুব কাছ থেকে ভেসে আসা এক দুঃখিনীর করুণ রোদনে কেঁপে ওঠে শিকদার মঞ্জিলের প্রতিটা মানুষ। দৃষ্টি তখন সবেমাত্র রক্তিমের সহায়তায় ওজু করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। এর মাঝেই ইতির চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়ায় দুজনেই। দৃষ্টির প্রফুল্ল হৃদয়টাই ঝুপ করেই এক ফালি দুঃখ এসে ঘাপটি মেরে বসে। সিক্ত হয় চোখ দুটো। ছলছল চোখেই রক্তিমের দিকে তাকিয়ে ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে বলে,

“আমাদের জীবন এতো অদ্ভূত কেন? কেন এই জীবনে একসাথে সবাই সুখী হতে পারেনা? এক আকাশের নিচে থেকেও কেন কেউ অত্যাধিক সুখে আত্মহারা আবার কেউ অসহনীয় দুঃখে মৃতপ্রায়? সৃষ্টিকর্তার এ কেমন নিয়ম?”

জবাব দেয়না রক্তিম। নিরবে দৃষ্টিকে জায়নামাজে বসিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় ইতির রুমের দিকে। চাপিয়ে রাখা দরজাটা অল্প ফাঁক করতেই আদরের বোনের বিধ্বস্ত রূপ দেখে আৎকে ওঠে কঠোর হৃদয়।পুরুষালী চোখ দুটো হঠাৎই বড্ড জ্বালাপুড়া করে। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে ভীষণ অপরাধি মনে হয়। মনে পরে নিজের হাতেই কিভাবে এতো আদরের বোনের সুখটাকে বিনষ্ট করেছে। পরপর মন বলে, সে কোনো অপরাধ করেনি। বরং বাবা হয়ে সে যদি নিজের সন্তানের খুনিকে এই পৃথিবীর বুকে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দিতো তবে সেটাই হতো সন্তানের প্রতি করা তার চরম আপরাধ। তাছাড়া যে মানুষ ছোট্ট একটা ফেরেস্তারূপী বাচ্চাকে ভালোবাসতে পারেনা সে কিভাবে তার বোনকে ভালোবাসবে? নিরাপরাধ এক মাসুম বাচ্চার খুনি কখনো কাউকেই ভালোবাসতে পারেনা। স্বার্থের লোভে হয়তো কোনোদিন ঐ বেঈমানটা তার বোনকেও মেরে ফেলতে একবার ভাবতনা। কথা গুলো ভেবে মনের কোণে সদ্য উঁকি দেওয়া অপরাধবোধটুকু নিঃশেষ করে লম্বা দম টেনে এগিয়ে যায় বোনের কাছে। পাগলের মতো মেঝেতে লুটিয়ে কাঁদতে থাকা বোনটাকে ভীষণ যত্নে আগলে নেয় বুকে।নিরবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডুবে যায় দুই মাস আগের সেই বর্ষণমুখর ঘুটঘুটে আঁধার রাতের স্মৃতিতে।

***
সময়টা তখন ফজরের আগ মুহূর্ত। আকাশ তখনও ব্যস্ত অঝোর ধারায় বর্ষণ নামিয়ে ধরণী ভাসাতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের আলোও ম্রিয়মাণ। ধলেশ্বরী নদীর পাশে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে মেহেদী। মা’রের আঘাতে সৃষ্ট শরীরের ক্ষতস্থান গুলোই বৃষ্টির ফোঁটা পরতেই মনে হচ্ছে কেউ যেন মরিচ ঢলে দিয়েছে। চোখ-মুখ কুঁচকে দাঁতে দাঁত পিষে ব্যথাটুকু হজম করে ভারী মাথাটা উপরে তুলে তাকায়। বৃষ্টির ছটার কারণে স্পষ্ট চোখ মেলে তাকাতেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে রক্তিম শীতল চোখে অনিমেষ দেখছে মেহেদীকে। দাঁড়ানোর ভঙ্গিমাও বড্ড স্বাভাবিক। মেহেদীর অসাঢ় মস্তিষ্কে তখন থেকেই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রুকন মিয়াকে থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও তাকে কেন এখানে আনা হয়েছে? তবে কী তার সাথে খারাপ কিছু করার প্ল্যান চলছে? ভাবতে ভাবতে অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করে মেহেদী,

“প্রতিশোধ নিবি?”

ঠোঁট বাঁকিয়ে অল্প বিস্তর হাসে রক্তিম। দুহাতে ভেজা চুল গুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে আসে মেহেদীর দিকে। এক হাঁটু মুড়ে মুখোমুখি বসে শীতল সুরে বলে,

“প্রতিশোধ! ধুর বোকা! বন্ধুত্বে প্রতিশোধ বলে কোনো শব্দ আছে না কী? তুই আমার বিশ্বাসের এতো বড়ো প্রতিদান দিলি। বিনিময়ে আমাকেও তো তোকে কিছু দিতে হবে তাই না? ঐ যে গিভ অ্যান্ড টেক! ঐটাই।”

রক্তিমের এই স্বভাবের বাইরে গিয়ে হাসি, ঠান্ডা সুরের কথায় মেহেদী বুঝে তার সাথে খারাপ কিছুই হবে। এটুকু বোঝার ক্ষমতা যে বন্ধুত্বের অধিকারে অনেক আগেই আদায় করে নিয়েছে সে। সুন্দর এই পৃথিবীর মায়া সহজে কেউ ছাড়তে চায়না। ব্যতিক্রম মেহেদীও হয়নি। মৃ’ত্যু ভয়ে কুঁকিয়ে ওঠে মনটা। ভিতরে ভিতরে অশান্ত হয়ে উঠলেও বাঃহিক দিকে শান্ত রাখে নিজেকে। ফিচেল হেসে বলে,

“আমার কিছু হলে তোর আদরের বোনের কী হবে? ভেবেছিস কথাটা?”

জবাব দেয়না রক্তিম। শীতল দৃষ্টিকে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে থেকেই হাত বাড়ায় দিহানের দিকে। ভীষণ উৎফুল্লতার সাথে হেসে দিহান এগিয়ে আসে। রক্তিমের বাড়িয়ে রাখা হাতে একটা প্লাস তুলে দিয়ে আমুদে স্বরে বলে,

“অল দ্যা বেস্ট।”

কালবিলম্ব না করে রক্তিম উঠে গিয়ে পূণরায় মেহেদীর পিছনে আরাম করে পিচঢালা রাস্তায় পা ছড়িয়ে বসে। একটু সময় নিয়ে মেহেদীর নখ উপরে ফেলা হতা-পায়ের আঙুল গুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। পরপর কনিষ্ঠ আঙুলের ডগায় থেতলানো মাংসের সাথে অল্প বেরিয়ে আসা চিকন শিরাটা প্লাস দিয়ে টেনে বের করে নিয়ে আসে। সাথে সাথে মেহেদীর গগনবিদারী চিৎকারে ভারী হয় চারপাশ। রক্তিমের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে হিংস্রতা। কঠিন হয়ে ওঠে চোখের দৃষ্টি। চাপা ক্রোধে ফুঁসে ওঠে বলে,

“ভাই হিসেবে সব জেনেও কিভাবে তোর মতো এক বি ষ ধ র সাপের সাথে আমার বোনকে আ মৃ ত্যু থাকতে দেই? এর থেকে বরং বাকী জীবনটা না হয় সে বিধবা পরিচয়েই বাঁচল! একদম দুশ্চিন্তা করিস না। ইতুকে ভুলেও জানতে দিবনা তোর বিশ্বাসঘাতকতার কথা। আর না জানতে দিব তোর শেষ পরিণতির কথা। ভুল মানুষকে ভালোবাসার যন্ত্রণা যে কতটা তীব্র তা তো আমি জানি। সব জেনেশুনে কিভাবে আমার বোনটাকেও সেই যন্ত্রণার সারথী হতে দেই?”

বলতে বলতে বাকী হাত-পায়ের আঙুলের শিরা গুলোও ঠিক একইভাবে একটা একটা করে টেনে তুলে রক্তিম। একটু বাঁচার আশায়, এই ন র ক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মেহেদী। তার এক একটা চিৎকার, একটু বাঁচার জন্য ছটফটানি রক্তিমের অশান্ত হৃদয়ে অদ্ভুত এক শান্তি এনে দেয়। চাপা আনন্দে চকচক করে ওঠে হিংস্র চোখ দুটো। অসহনীয় যন্ত্রণায় একটা সময় রোধ হয়ে আসে মেহেদীর কন্ঠস্বর। গলা দিয়ে শুধু অস্ফুট গোঙানির শব্দ বের হয়। নিভে আসে চোখ দুটো। কাত হয়ে ঢলে পরে রাস্তায়। রক্তিম ঝুঁকে মেহেদীর নিস্তেজ মুখের নিকটে গিয়ে বলে,

“থেমে গেলি কেন? ব্যথা কমে গেছে?”

বলতে বলতে প্লাস রেখে পাশ থেকে দিহানের রেখে যাওয়া একটা পেরেক আর হাতুরি তুলে নেয়। তড়িৎ ছুটে আসে দিহান। রসাত্মক হেসে বলে,

“মাই ডিয়ার দুলাভাই, ওয়েট! আমি হেল্প করছি।”

কথা শেষ করেই হাঁটু ভেঙ্গে বসে পরে দিহান। হাসতে হাসতেই একহাতে চেপে ধরে মেহেদীর চোয়াল। অন্য হাতে সজোড়ে জিহ্বা টেনে বের করে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে আমুদে ভঙ্গিতে চোখ নাচায়। হাপাচ্ছে রক্তিম। বড়ো বড়ো দুটো দম ফেলে খুনে চোখে তাকায় মৃ ত্যু ভয়ে গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে মেহেদীর দিকে। বাম হাতে থাকা পেরেকটা জ্বিভের মাঝে রেখে ডান হাতে হাতুরি দিয়ে পেরেকের মাথায় স্বজোরে আঘাত করতেই কলিজা কাঁপানো চিৎকার করে মেহেদী সর্বশক্তিতে ছিটকে সরে যায় একটু দূরে। জ্বিভের ডগায় পেরেকটা তখনও আটকে। সেভাবেই মরন যন্ত্রণায় রাস্তায় গড়াগড়ি খায় মেহেদী। অদ্ভূত শব্দ বের হয় মুখ দিয়ে। তার এই ছটফটানিও যেন রক্তিমের হৃদয়ে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা প্রতিশোধের আগুন একটুও নিভাতে সক্ষম হয়না। বরং দাও দাও করে জ্বলে ওঠে নতুন উদ্যমে এটা স্মরণ হতেই, এই মুহূর্তে মেহেদী যেমন ছটফট করছে ঠিক এভাবেই তো রোদ্রিক ছটফট করেছিল যন্ত্রণায়।কিন্তু দয়া হয়নি পশু গুলোর। একটুও দয়া হয়নি। তৎক্ষণাৎ সর্বাঙ্গ অত্যাধিক ক্রোধে চিরবিরিয়ে ওঠে রক্তিমের। খ্যাপা ষাঁড়ের ন্যায় গর্জে ওঠে হাতে থাকা হাতুরি দিয়েই সর্ব শক্তিতে পরপর চারটা আঘাত করে মেহেদীর মুখে। সাথে সাথে নাক-মুখ, কপাল ফেটে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসা তাজা রক্ত মিশে যায় বৃষ্টির পানির সাথে। একদম নিথর হয়ে আসে মেহেদীর দেহ। ততক্ষণে দেহ ছেড়ে তার প্রাণ পাখিটা উড়াল দিয়েছে অজানায়। তবুও ক্ষান্ত হয়না রক্তিম। শান্ত হয়না অশান্ত হৃদয়। পাগলের মতো এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে। পরপর কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে ছুটে যায় গাড়ির কাছে। পিছনের সিট উল্টাতেই বেরিয়ে আসে ধারালো রাম-দা। সেটা হাতে নিয়ে ফের ছুটে গিয়ে এক কুপে মেহেদীর নিথর দেহটা থেকে আলগা করে দেয় মাথাটা। সাথে সাথে এক দলা উষ্ণ, তরল রক্ত এসে আচরে পরে রক্তিমের চোখে-মুখে। এই মুহূর্তে তাকে একটা হিংস্র পশুর থেকেও কোনো অংশে কম মনে হচ্ছেনা। যেন কোনো এক রক্তপিপাসু বহুদিন তৃষ্ণার্ত থাকার পর শিকারের সন্ধান পেয়ে ঝাপিয়ে পরেছে তৃষ্ণা মিটাতে। মেহেদীর গলাকাটা রক্তে রঞ্জিত দেহটার দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে রক্তিম। হাত থেকে রাম-দাটা ছুড়ে ফেলে শরীর ছেড়ে বসে পরে সেখানেই। কতক্ষণ থম ধরে বসে থেকে হুট করেই শরীর কাঁপিয়ে শব্দ করে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে ওঠে,

“আজ থেকে বহু বছর আগে যে রক্তিম শিকদার মিথ্যে খুনের দায়ে ছিটকে পরেছিল তার পরিবার পরিজন থেকে, হারিয়েছিল স্বপ্নের পেশা। সেই রক্তিম শিকদার আজ সত্যিই খুনি শিকদার। স্বার্থক আজ অতীতে করা আমার প্রতি সমস্ত অবিচার।”

দিহান এতোক্ষন ভীষণ আমুদে ভঙ্গিতে সবটা দেখে গেলেও রক্তিমের শেষের এই হিংস্র রূপটা ভড়কে দেয় তাকে। ভয় ধরিয়ে দেয় মনে রক্তিমের রক্তমাখা হিংস্র চেহারা, অপ্রকৃতিস্থের ন্যায় হাসি। গভীর একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রক্তিমকে টেনে তুলে গাড়িতে বসিয়ে ইমরানকে নিয়ে মেহেদীর প্রাণহীন দুই টুকরো হওয়া দেহটা ভাসিয়ে দেয় ধলেশ্বরী নদীর বুকে। সেই বর্ষণমোখর আঁধার রাতে ধলেশ্বরীর তীরেই মুছে যায় মেহেদী নামক এক চরম বিশ্বাসঘাতকের অস্তিত্ব। রক্তিম, দিহান, ইমরান এই তিনজন মানুষ বাদে সকলের অজানা থেকে যায় সে রাতের গল্প। সবাই জানে হুট করেই মেহেদী নিখোঁজ। হয়তো বন্ধুর রাজনৈতিক শত্রুতার জের ধরে আর না হয় ব্যবসায়ীক সূত্র ধরেই কেউ দায়ী তার নিখোঁজ হবার পিছনে।

চলবে…..