একমুঠো রোদ্দুর পর্ব-৩১

0
18

#একমুঠো_রোদ্দুর
#পর্বঃ৩১
#আদওয়া_ইবশার

শেষ বিকেলে পেখমে আবৃত গায়ে গোধূলির আবির মিশিয়ে নীড়ে ফেরা পাখিরা মিষ্টি সুরের কলতানে বিদায় জানিয়েছে হেমন্তকে। দূর থেকে ভেসে আসছে শীতের আগমনী বার্তা।আকাশের গাঢ় নীলিমা ঢাকা পরেছে স্নিগ্ধ কুয়াশার চাদরে। পাতাঝরা জীর্ণ গাছের ডালপালা গুলো শিহরিত হচ্ছে দখিনা বাতাসে ভেসে আসা শীতের শিরশিরে পরশে।ধীরে ধীরে ম্লান হচ্ছে দিনের আলো, দীর্ঘ হচ্ছে রাতের পরশ। হেমন্তের বিদায়ী সুর শীতের আগমনী বার্তার সাথে মিশে গিয়ে জরাজীর্ণ প্রকৃতিকে মুড়িয়েছে নতুন এক আবেশে। সেই আবেশ গায়ে মাখিয়ে শীত শীত মিষ্টি ঘ্রাণ নিঃশ্বাসের সাথে টেনে নিয়ে হৃদয় শীতল করতে ব্যস্ত এক এলোকেশী। সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। উত্তরে বাতাসের সাথে হুড়মুড়িয়ে শীত নামছে যান্ত্রিক শহরের বুকে। এলোকেশী রমণীর বন্ধ চোখের পাপড়ি যুগল মৃদু কাঁপছে শীতের তিব্রতায়। গায়ে সুতির শাড়িটা ছাড়া শীত নিবারণের গরম বস্ত্র বলতে কিচ্ছু নেই। তবুও নিজেকে গরম পোশাকে আবৃত করার কোনো তাড়া নেই। আছে শুধু প্রকৃতির সাথে মিশে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

“তুমি কী নিজের ভালোটা কোনো কালেও বুঝবেনা? এই ভর সন্ধ্যায় কোন নির্বোধ এতো শীতে এভাবে গরম কাপড় ছাড়া বাইরে ঘুরে? তোমার এই গাফিলতির কারণে যদি আমার মেয়েটার ঠাণ্ডা লাগে খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।”

হঠাৎ পিছন হতে ভেসে আসা পুরুষালী গম্ভীর সুরের ধমকে আপাতমস্তক কেঁপে ওঠে অন্যমনষ্ক দৃষ্টি। তড়িৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পায় ফর্মাল ড্রেসআপে এক শ্যাম পুরুষ দাঁড়িয়ে। দৃঢ় চোয়ালের মুখটাই স্পষ্ট বিরক্তি লেপ্টে আছে। অপ্রসন্ন নজরে তাকিয়ে তার দিকেই। এই উত্ত্যক্ত শ্যামকালো চেহারা, অপ্রসন্ন চোখ দুটোই তাকিয়ে নির্মল হাসে দৃষ্টি। যে মায়াময়, নির্মল হাসির দিকে তাকিয়ে পুরো দিনের অবসাদ ভুলতে সক্ষম হয় রক্তিম। ক্লান্ত দেহের ভাজে ভাজে ছড়িয়ে পরে প্রশান্তি। মসৃণ হয় বিরক্তিতে কুঁচকানো কপালদ্বয়। চক্ষুদ্বয়ের বিরক্তিমাখা চাহনি নিমিষে পাল্টে সেখানে জড়ো হয় এক রাশ মুগ্ধতা। নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখে হৃদমোহিনীর ওষ্ঠপুটে ছড়িয়ে থাকা মিষ্টি হাসি। দৃষ্টি এগিয়ে আসে নিরবে প্রিয়তম অর্ধাঙ্গের সন্নিকটে। প্রফুল্লচিত্তে জানতে চায়,

“কখন এসেছেন?”

“যখন আপনি চোখ বন্ধ করে বোয়াল মাছের মতো মুখ হা করে ঠান্ডা গিলছিলেন তখন এসেছি।”

কথার তালে রক্তিমের অদ্ভূত মুখের ভঙ্গিমায় উচ্ছাসিত কিশোরীর ন্যায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে দৃষ্টি। ফের সেই হাসিতে বাঁধা পরে রক্তিমের মুগ্ধ নজর। ভালো লাগার এক মন কেমন করা অনুভূতিতে বুকের ভিতর ছলকে ওঠে। হাত বাড়িয়ে দৃষ্টির কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুল গুলো আলতো পরশে কানের পিঠে গুজে দিয়ে কোমল স্বরে জানতে চায়,

“রোদসী কোথায়?”

দেড় মাস আগের এক স্নিগ্ধ, নির্মল ভোরকে সাক্ষী রেখে তাদের কোল আলো করে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান এসেছে। যার আগমনে প্রথম সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে নতুন করে হাসতে শিখেছে দৃষ্টি, রক্তিম। সেই সাথে বদলেছে অনেক কিছুই। সময় বদলানোর কারিগর। মানুষ হোক, প্রকৃতি হোক কিংবা পরিস্থিতি। সময়ের চাকায় চড়ে সবই বদলায়। মানবজীবন দুঃখের পর সুখের সন্ধান পায়, প্রকৃতি পায় নতুন রূপ, বদলে যায় পরিস্থিতি।

“ফুপির কোলে চড়ে বড়ো বড়ো চোখ করে ড্রয়িং রুমের জিনিস গুলো দেখছে আর মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছে একটু বড়ো হয়ে হাঁটতে শিখে সবার আগে আমার শখের কোন জিনিসটা ভাঙবে।”

বলতে বলতে আবারও হেসে ওঠে দৃষ্টি। রক্তিম নিজেও সিগারেটে পোড়া কালচে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে। দুহাতে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় তার আঁধার জীবনে এক ফালি রোদ্দুর নিয়ে আসা দৃষ্টি নামক অত্যন্ত সরল, সাধারণ অথচ এক ঐন্দ্রজালিক মায়ার অধিকারী মেয়েটাকে। ঘন,কালো কেশরাশীতে শুষ্ক ঠোঁট ডুবিয়ে ভালোবাসার শুদ্ধতম পরশ আঁকে।

****
শিকদার মঞ্জিলের হলরুম থেকে ভেসে আসছে কিছু জোড়া কন্ঠের প্রাণখোলা হাসির আওয়াজ। আজ আবারও বাঁধভাঙ্গা আনন্দ ছড়িয়ে পরেছে বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে। নব প্রাণের আগমনে সমস্ত দুঃখ বিসর্জন দিয়ে আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে শিকদার মঞ্জিল। বেদনার ছাপ বিলীন হয়ে হাসি ফুটেছে প্রতিটা মানুষের মুখে ছোট্ট রোদসীকে কেন্দ্র করে। ইতির কোলে রক্তিম-দৃষ্টির দেড় মাসের মেয়ে রোদসী। তার মাথার কাছেই বসে ইতির মেয়ে অহি সমানতালে বকবক করে যাচ্ছে। প্রাণপণ চেষ্টা তার আদুরে ডাকে বোনের সাড়া পাবার। কিন্তু ছোট্ট রোদসী বোনের শত আদুরে ডাক উপেক্ষা করে ব্যস্ত ছোট ছোট চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সিলিং দেখতে। বোনের এমন উপেক্ষা সইতে না পেরে দুঃখে, কষ্টে বারবার গাল ফুলাচ্ছে অহি। ছলছল চোখে রেহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করছে,

“নানুমণি! দেখো, বোন আমার দিকে তাকায়না। এতো ডাকছি, আদর করছি তবুও শুনেনা।”

অহির ফুলো গালে অভিমানী সুরে করা অভিযোগে তৎক্ষণাৎ রেহানা বেগম, ইতি, কাকলির মা হেসে ওঠে। যা দেখে অহির অভিমান গাঢ় হয় আরও। অভিমানে মুখ ফিরাতেই দেখতে পায় সদর দরজায় দাঁড়িয়ে তার আদরের সবথেকে বড়ো একটা অংশ। তড়িৎ মুখে হাসি ফুটিয়ে মামা বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে ছুটে যায়।জড়িয়ে ধরে দুহাত প্রসারিত করে। রক্তিম মুচকি হেসে কোলে তুলে নেয় আদরের ভাগ্নিকে। কপালে স্নেহের চুম্বন আঁকে। মামার আদর পেয়ে অহির অভিমানগুলো আশকারা পায়। নাক ফুলিয়ে ন্যাকি কান্নার সুরে বলে,

“বোন আমার সাথে কথা বলেনা মামা।”

মাত্র দেড় মাসের বাচ্চা মেয়ের উপর আনা এমন অভিযোগ শুনে না হেসে পারেনা রক্তিম। হাসিমুখেই আদুরে সুরে বলে,

“বোন তো অনেক ছোট মা! বড়ো হয়ে যখন কথা বলতে শিখবে তখন দেখবে সারাদিন তোমার সাথে গল্প করবে।”

অহির মনঃক্ষুন্ন হয়। অসন্তোষ বদনে বলে,

“এতো ছোট বোন হাসপাতাল থেকে কেন কিনে আনলে মামা? আর একটু বড়ো বোন আনলেই তো আমার সাথে এখনই কথা বলতে পারত।”

মেয়ের সরল মনের অভিযোগ শুনে গা কাঁপিয়ে শব্দ করে হাসে ইতি। বোনের হাসিমাখা মুখের দিকে নিরবে তাকিয়ে রক্তিম মনে মনে শুধায়,
“এভাবেই হাসিখুশি থাকিস আজীবন। ভাই যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন বুক দিয়ে আগলে রাখব তোদের। আর কখনো কোনো বেঈমান, বিশ্বাসঘাতকের ছায়া পরতে দিবনা তোর উপর।”

গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে রক্তিম অহিকে কোলে নিয়েই এগিয়ে যায় ইতির দিকে। উদ্দেশ্য তাদের অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া জীবনে নতুন করে এক মুঠো রোদ্দুর নিয়ে আগমন ঘটা রোদসী নামক নরম, তুলতুলে, পুতুলের মতো দেখতে আদুরে প্রাণটাকে এক নজর দেখে পিপাসিত পিতৃ হৃদয় শীতল করা। রক্তিমকে বাচ্চার দিকে এগোতে দেখেই রেহানা বেগম কড়া সুরে হুশিয়ারী দেয়,

“খরবদার নোংরা শরীরে আমার নাতনীর কাছে আসবিনা তুই। সারাদিন বাইরে ঘুরে শরীরে হাজারটা জীবাণু নিয়ে প্রতিদিন তোর আলগা আদর মারানো ঢং দেখতে ইচ্ছে হয়না আমার। কতদিন বলব গোসল না করে একদম ছুঁবিনা ওকে?”

কিন্তু কে শুনে কার কথা? মায়ের বারণ উপেক্ষা করেই রক্তিম মেয়ের আদুরে মুখের কাছে ঝুঁকে কপালে আলতো পরশ বুলাই। সাথে সাথে হাইহাই করে ওঠে রেহানা বেগম। সমানতালে বকতে থাকে ছেলেকে। রক্তিম কিছুই হয়নি এমন একটা ভান করে মায়ের বকাবকি উপেক্ষা করে অহিকে কোলে নিয়েই রুমের দিকে পা বাড়ায়।

__________

‘এক বাপের এক পোলা যেগুলা ভালো হয় সেগুলা হয় দুধে ধোয়া তুলসী পাতা, আর যেগুলা খারাপ হয় সেগুলো একেবারে চুতরা পাতা(বিচুটি পাতা)।’

বহুকাল পর মায়ের এই কথাটা আজ খুব করে স্মরণ হচ্ছে সাদেক সাহেবের। নিজের জীবনেই দেখতে পারছে মায়ের কথার সত্যতা। মায়ের যে কথা শুনে এক সময় সব ভাই-বোনেরা মিলে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো আজ সেই কথায় নিজের জীবনে এভাবে ফলে যাবার দুঃখে, কষ্টে কপাল চাপড়াতে হচ্ছে সাদেক সাহেবের। ছেলে-মেয়ে দুটোকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল, আশা ছিল। পড়ালেখা করে আপাদমস্তক মানুষ হলেও প্রকৃত রূপে হয়েছে মিনিটে মিনিটে বাবা-মায়ের প্রেশার হাই করে ফেল হাড়ে বজ্জাত। তবুও মেয়েটা যেমনই হোক ভালোবেসে বিয়ে করে হাজার বাঁধা, বিপত্তি পার করে সুখে সংসার করছে। কিন্তু ছেলেটা! ঠিক এই জায়গায় এসেই সাদেক সাহেবের যত দীর্ঘশ্বাস। কত আশা ছিল, ছেলেটাকে বিয়ে করিয়ে লাল টুকটুকে একটা বউ আনবে ঘরে। বছর ঘুরতেই ঘর আলো করে নাতি-নাতনী আসবে। তাদের নিয়ে হেসেখেলে শেষ বয়সে জীবনের নতুন স্বাদ গ্রহণ করবে। কিন্তু সে আশার গুড়ে সর্বদা বালি ঢেলে বেয়াদবটা বিয়ের নাম-গন্ধ ভুলে শুধু চোর, ডাকাতের পিছনে ছুটছে। যতবার ছুটিতে বাড়ি আসছে ততবার ধরেবেঁধে পাত্রী দেখতে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এক জায়গাতেও নাক উঁচু তেদড়টার মেয়ে পছন্দ হয়না। সবসময় একটা না একটা খুঁত খোঁজে বের করবেই। মেয়ে বেশি ফর্সা হলেও তার সমস্যা, একেবারে কালো হলেও সমস্যা, বেশি লম্বা হলেও সমস্যা,খাটো হলেও সমস্যা, বেশি স্মার্ট উচ্চশিক্ষিত হলেও সমস্যা, আবার স্কুল পড়ুয়া হলেও সমস্যা। তার শুধু সমস্যা আর সমস্যা। অতসী মেয়েটা কত ভালো ছিল! নম্র, ভদ্র, মিষ্টি একটা মেয়ে। গুরুজনদের কিভাবে সম্মান করতে হয় মেয়েটা জানে। কিভাবে অন্যের বিপদে পাশে থাকতে হয় তাও জানে মেয়েটা। বাবা-মা’ও কত ভালো মনের মানুষ! মেয়েটা বোধহয় বাবা-মায়ের থেকেই ওই পরোপকারী গুণটা পেয়েছে। সেই এতো ভালো,ভদ্র,গুণী মেয়েটাকেও বেয়াদবটা রিজেক্ট করে দিয়েছে। এই কষ্টই তো সাদেক সাহেবের এখনো শেষ হয়নি। এর মাঝেই একটু আগে আবার দৃষ্টি ফোন করে জানিয়েছে অতসীর বাবার কোনো এক দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের ছেলের জন্য না কী আজ তাকে দেখতে আসবে। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। লাখ টাকার সেলারি। দেখতেও না কী চমৎকার সুপুরুষ। অতসীর বাবা আগেই ছেলেকে দেখেছে। আজকে দেখতে এসে যদি ছেলে পক্ষের মেয়ে পছন্দ হয়ে যায় তবে না কী একেবারে বিয়ে পড়িয়ে রাখবে। পরে কোনো এক সময় দুই পরিবার দিন-তারিখ ঠিক করে বড়ো করে অনুষ্ঠান করে তুলে নিয়ে যাবে। কথাটা শোনার পর থেকেই সাদেক সাহেবের বুকের ব্যথা বেড়েছে। বিছানায় পরে হাপিত্তেশ করতে করতে বারবার দিলশান আরাকে বলছে,

“দিলনা দিলশান, তোমার বেয়াদব ছেলে আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিলনা। আজ যদি আমি অকালে মরে যাই তবে এর জন্য তোমার ছেলে দায়ী থাকবে। অতসী মেয়েটাও হাতছাড়া হয়ে গেল। গেল গেল, সব শেষ হয়ে গেল। আমার দাদা হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।”

দিলশান আরা নিজেও খবরটা শোনার পর থেকে অল্পস্বল্প মনোকষ্টে ভুগছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মেয়েটার চালচলন, আচার-ব্যবহার। নিঃসন্দেহে এই মেয়ে আদর্শ বউ হবার যোগ্য। যে যোগ্যতা টুকু আজকাল সব মেয়ের মাঝে থাকেনা। এমন ভালো একটা মেয়ে হাতছাড়া হয়ে গেলে কার আবার কষ্ট লাগবেনা? তবে সাদেক সাহেবের এহেন আচরণ একটু বেশি বেশিই মনে হচ্ছে। কেমন বাচ্চাদের মতো করছে! স্বামীর এহেন আচরণে দিলশান আরা তেক্ত বিরক্ত হয়ে অল্প ধমকে ওঠে,

“চুপ করবেন আপনি? সবকিছুতেই আপনার বাড়াবাড়ি।”

বউয়ের ধমকে দমে যাবার বদলে সাদেক সাহেব উল্টো ফুঁসে ওঠেন। শোয়া থেকে ওঠে বসে সমান তালে ধমকে বলেন,

“তুমি কি বুঝবে আমার কষ্ট? রাস্তাঘাটে তো দিন-রাত তোমার চলতে হয়না। চলতে হয় আমার।চোখের সামনে দেখতে হয় আমার সব বন্ধুবন্ধব নাতি নিয়ে বাজার করতে যায়, হাঁটতে যায়। এসব দেখে আমার বুঝি কষ্ট হয়না? আর কত লোকে যে কত কথা বলে জানো তুমি? কেউ কেউ তো হাসতে হাসতে মজার ছলে ঠিক জায়গায় ইট ছুঁড়ে দেয়।মুখের উপর বলে দেয়, “ভাইজান, ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে দেখেছেন আপনার ছেলের অন্য কোনো সমস্যা আছে কী না? না হলে এতো করে বলার পরও বিয়ে কেন করছেনা? সময় থাকতে থাকতে ভালো একটা ডাক্তার দেখান। অন্যথায় ভবিষ্যতে পস্তাবেন।” আমারও ইদানিং মনে হয় তোমার ছেলের সত্যিই কোনো সমস্যা আছে দিলশান। না হলে শয়তানটা বিয়ে কেন করবেনা? এতো এতো মেয়ের মাঝে একটাও কেন পছন্দ হবেনা ওর?”

স্বামীর অতিরিক্ত কথায় দিলশনার আরা অতিষ্ঠ হয়ে কটমট দৃষ্টিতে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওঠে যায় সেখান থেকে। এই লোকের সামনে থাকলে নির্ঘাত ওনি আজ পাগল হবে। স্ত্রীর এমন উপেক্ষায় সাদেক সাহেবের দুঃখ দ্বিগুণ হয়। অসহায় বদনে কতক্ষণ বসে থেকে দুঃখবিলাস করার মতো কাউকে না পেয়ে শেষমেশ ফোন লাগায় দিহানের কাছে। যে হতচ্ছাড়ার জন্য আজ ওনার এই হাল সেই হতচ্ছাড়াকেই না হয় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া যাক। প্রথমবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে দিহান ফুর্তিবাজ সুরে জানতে চায়,

“ভালো আছো বাবা?”

“রাখ তোর ভালো থাকা বেয়াদব! যার তোর মতো একটা কুলাঙ্গার ছেলে থাকে তার কী আর ভালো থাকার কোনো অপশন থাকে?”

“আরেহ! আমি আবার কী করলাম?”

বাবার কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে জানতে চায় দিহান। সাদেক সাহেবের কন্ঠস্বর এবার অসহায় ঠেকে।

“কী করিসনি সেটা বল। তোর জন্য প্রেশার হাই করে,বুকের ব্যথা বাড়িয়ে আজ আমি মরতে যাচ্ছি।”

“প্রেশার হাই হলে বুকের ব্যথা বাড়েনা বাবা। তাছাড়া তোমার হার্টেরও কোনো প্রবলেম নেই। মনে হয় এসিডিটির কারণে বুকে ব্যথা হচ্ছে। একটা গ্যাস্ট্রিকের টেবলেট খেয়ে নাও ব্যথা কমে যাবে।”

মেজাজ হারিয়ে সাদেক সাহেব এবার চ্যাঁচিয়ে ওঠে উচ্চস্বরে,

“হারামজাদা, বলেছি তোকে আমাকে ডাক্তারি জ্ঞান দে? হ্যাঁ রে,তোর কী একটুও লজ্জাশরম নেই? তোর বয়সী সব ছেলে বিয়ে করে দুই-তিনটা বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে। তোর জুনিয়র ইমরান, সেও এক বাচ্চার বাপ। বিগত তিন বছরে তোর জন্য যতগুলো পাত্রী দেখেছি খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওরাও কেউ দুই বাচ্চার মা কেউ এক বাচ্চার মা। বাদ ছিল শুধু অতসী মেয়েটা। আহারে, কত ভদ্র, নরম দিলের মেয়েটা! আজ শুনলাম তারও বিয়েটা হয়ে যাবে হয়ে যাবে ভাব। আর তুই! তুই আজও একা একটা কলাগাছ। আজীবন সেই কলাগাছই থেকে যাবি। যে কলাগাছের কখনো কোনো ডালপালা গজায়না। না হয় বীজ থেকে নতুন কোনো কুড়ি। বাপ হয়ে আর ঠিক কিভাবে কোন ভাষায় লজ্জা দিলে তুই গায়ে মাখবি বল তো!”

“এতো ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে দুই লাইনের ছোটগল্পকে উপন্যাস না বানিয়ে সারাংস বলো। আমি অন ডিউটিতে। হাতে সময় কম।”

“অতসীকে আজ দেখতে আসবে। পছন্দ হয়ে গেলেই বিয়ে পড়িয়ে ফেলবে।”

গলার তেজটা কমে আসে সাদেক সাহেবের। কিন্তু দিহান যখন স্বাভাবিক সুরে বলল,

“তো, আমি কি করতে পারি?”

ঠিক সেই মুহূর্তে তেজটা হুড়মুড়িয়ে ফিরে আসে। খাট কাঁপিয়ে বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। গলার রগ ফুলিয়ে চ্যাঁচায়,

“কী করতে পারি মানে? যেভাবেই হোক এই বিয়ে আটকাবি তুই। কান খুলে শুনে রাখ হারামজাদা, এই মেয়েও যদি হাতছাড়া হয় তবে তোকে তেজ্য করব।”

বাবার ফাঁপা হুমকিতে শব্দ করে শরীর দুলিয়ে হাসে দিহান। ফোনের এপাশে থেকে ছেলের হাসির শব্দ শুনে এবার অত্যাধিক রাগে দিশাহারা হয় সাদেক সাহেব। চোখ-মুখ কঠিন করে শক্ত একটা গালি দিতে নেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে দিহান হাসি থামিয়ে শীতল সুরে বলে,

“চিন্তা করোনা। বিয়ে হবেনা।”

চলবে…..