#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_১১
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
ছুটির দিন ছাড়া এই বাড়িতে প্রত্যেকটা সকাল কাটে হুড়োহুড়িতে৷ পুষ্পি নিজে নাস্তার পুরোটা করে, শাশুড়ী চাইলেও তাকে কিচ্ছু করতে দেয় না। যেহেতু সে কলেজের জন্য রান্নাটা করতে পারে না, তাই কাটাকুটি করে রেখে যায়। শ্বশুর সকালে দুইবার চা খায় তাই তাকে দুবার চা বানিয়ে দেয়৷ মুনমুনকে ঘুম থেকে ডেকে দেয়। নাশতা করায়৷ মাঝেমধ্যে কিছু স্পেশাল টিফিন বানিয়ে সাথে করে দিয়ে দেয়।
সংসারের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর রাখে। বলা বাহুল্য সংসারের মধ্যমণিও সে।
সেই পাঁচটায় ওঠে আর নয়টার কাছাকাছি সময়ে তার হুড়োহুড়ি থামে। তারপর নিজ রুমে আসে। রুম গোছায়। বারান্দার গাছগুলোতে পানি দেয়।
শাহরিয়ারের কি লাগে, না লাগে সেদিকে নজর দেয়।
রোজকার মতো শাহরিয়ার পুষ্পিকে ডাকল, “এই পুষ্প….পুষ্প? একটু এদিকে আসবা? আমার সাদা শার্টটা একটু খুঁজে দিবা প্লিজ!”
পুষ্পি বারান্দার কাছগুলোতে পানি দিচ্ছিল। শাহরিয়ারের ডাক শুনে রুমের ভেতর এলো। শাড়ির আঁচল ভাজ করে কাঁধের উপর রাখে। শাহরিয়ার পুষ্পির দিকে চেয়ে ভারি নিশ্বাস ফেলে।
পুষ্পি চুলগুলো হাত খোপা করে বলে,
“আচ্ছা সরুন, খুঁজে দিচ্ছি।”
শাহরিয়ার সরে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে, হাত দিয়ে ভেজা চুল গোছ করতে করতে গুন গুন করতে লাগে,
“ছিল ভাবে ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল,
তুমি বাতাসে উড়ালে ভীরু অঞ্চল।
ওই রূপের মাধুরী মোর সঞ্চয়ে রেখেছি,
দূর হতে তোমারে দেখেছি,
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি!
আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি,
আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি!
বাজে কিনিকিনি রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি!
হু..হুহু..তোমারে দেখেছি…..”
পুষ্পি এই প্রথম শাহরিয়ারের কন্ঠে গান শুনল। লোকটা দূর্দান্ত গায় তো! পুষ্পি চোখ দুটো ছোট করে শাহরিয়ারের দিকে চায়। শাহরিয়ারও আয়নার ভেতর থেকে পুষ্পির দিকে চায়। চোখে নাড়িয়ে মিটিমিটি হাসে। যার অর্থ দাঁড়ায়, “কি ব্যাপার? কী দেখো?”
পুষ্পি মুখ বাঁকায়। শার্টটা শাহরিয়ারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নিন আপনার শার্ট।”
শাহরিয়ার শার্ট তো নেয়-ই, সেই সাথে পুষ্পির হাত টেনে তাকেও সামনে নেয়। বলে, “কালো শাড়ি পড়ে, চুল খোপা করে, আমার সামনে ঘুরঘুর করবা না।”
বোকা পুষ্পি, শাহরিয়ার প্রেম ধরতে পারে না। উল্টো প্রতিক্রিয়া করে বলে, “আমার যেন খুব শখ কারো সামনে ঘুরঘুর করতে! নিজেই ডাকলেন! দুমুখো মানুষ একটা। দেখি ছাড়ুন তো….”
শাহরিয়ার মুখ টিপে হাসে। হাসলে চোখ দুটো ছোট হয়ে আসে মানুষটার। খোঁচাখোঁচা দাড়ি গুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “ছেড়ে দিব? আচ্ছা, দিলাম ছেড়ে। বউয়ের আবদার কি অমান্য করতে পারি?”
পুষ্পি খানিক মুগ্ধই হলো বোধহয়। নিজের এমন আকস্মিক মুগ্ধতায় নিজেই লজ্জা পায়৷ হাত ছাড়া পেতে দূরে সরে আসে। কি যে হয় তার মাঝে মাঝে! মনেহয়, পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর মানুষটাই তার স্বামী! এ কেমন মুগ্ধতা। তবে পার্থক্য হলো শাহরিয়ার অকপটে বলে, পুষ্পি তা পারে না। মনেহয় না কখনো পারবে!
পুষ্পি আজকেও শাহরিয়ারের সাথে গেল না। সে গেল শাহরিয়ার যাওয়ার আরো ঘন্টা খানেক পর। কলেজে তার দুই-তিনজন মেয়ের সাথে ভাব হয়েছে। তবে বেশি ভাব জমেছে, তাহুরা নামক একটা মেয়ের সাথে। মেয়েটার চলাফেরা, আচার-আচরণ সব কিছুই খুব দ্রুত মুগ্ধ করে ফেলে পুষ্পিকে। সবচেয়ে ভালো লাগে কারণ মেয়েটা খুবই আল্লাহ ভীরু। নিজ প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে দশ পারা কোরআন মাজিদ মুখস্থ করে ফেলেছে! কথাটা প্রথম শুনে পুষ্পি খুব আশ্চর্য হয়েছিল।
কিন্তু তার বাসা থেকে সে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সহযোগিতা পায় না শুনে অবাক হওয়ার পাশাপাশি ব্যথিতও হয়েছে। এত বাধার মাঝেও মেয়েটার কি দৃঢ় মনোবল!
পুষ্পি গিয়ে তাহুরার পাশে বসল। ক্লাসে স্যার চলে এসেছে ততক্ষণে। তাহুরাকে অস্বাভাবিক ঠান্ডা দেখে পুষ্পি ফিসফিসিয়ে জানতে চাইল, “কিছু হয়েছে?”
তাহুরা প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে জানায়, “বাসায় তার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। বিয়ে করতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু সেই পরিবারের মানুষগুলোও যদি নিজ পরিবারের মানুষদের মতো বাধা সৃষ্টি করে, সে জন্য ভয় হচ্ছে।”
পুষ্পি আশ্বাস দেয়, “এমন কিছুতেই হবে না। আল্লাহ নিশ্চয়ই উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি তোমার মতো মেয়েকে কিছুতে অমন কঠিন পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার ফেলবেন না, ইনশাআল্লাহ।”
পুষ্পির আশ্বাস পেয়ে তাহুরার মন অনেকখানি শান্ত হয়। সে ভরসা খুঁজে পায়। জীবনে সৎ সঙ্গের অত্যান্ত প্রয়োজন। সৎ সঙ্গ জীবনে আশির্বাদ স্বরূপ।
.
পুষ্পির বিয়ের আট মাস চলে। এই আট মাসে যেন পুষ্পির পুরো আদলই বদলে গেল। যে মেয়ে আগে দশ কথায় রা করত না, সে মেয়ে আজকাল খুব বেশি বাকপটু হয়ে উঠেছে। শাহরিয়ার একটা কথা বললে, একটু পিঞ্চ মারতে চাইলে, খুব কাটকাট কথা শুনিয়ে দেয় বিপরীতে। তবে তার এই বাকপটু স্বভাবটা কেবল শাহরিয়ারের সাথেই। অন্যকারো সাথে না। নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে মান অভিমান চলেই। শাহরিয়ার যত সামলে নিতে চায়, পুষ্পি তত একরোখা হয়ে থাকে। সম্ভবত শাহরিয়ারের প্রশ্রয়ে সে কেবল এই মানুষটার কাছেই আহ্লাদী হয়ে ওঠার সুযোগ পায়।
পুষ্পি একটু রেগে যেতে চাইলেই শাহরিয়ার বারবার বলে, “ঠান্ডা হও, ঠান্ডা হও! এদিকে আসো, ফু দিয়ে দেই৷”
পুষ্পি আরো রাগ দেখিয়ে বলে,”দূরে সরুন। কাছে আসবেন না। সরুন বলছি। খারাপ মানুষ একটা।”
শাহরিয়ার হেসে দিয়ে অবাধ্য হয়। বলে, “খারাপ মানুষ, না? আসো, দেখাচ্ছি কেমন খারাপ মানুষ।”
পুষ্পির নখের আচরে হাত ছিলে রক্ত বেরিয়ে যায়। তাও মানুষটা বাধ্য-পুরুষ হয় না। ছিলে যাওয়া হাত ধরে পুষ্পি অনুতপ্ত হয়। রাগ ভুলে কয়, “ইশ! কতখানি ছিলে গেল! ইচ্ছে করে এমন করিনি। দেখি হাতটা।”
শাহরিয়ার এতেই তুষ্ট হয়ে যায়। আদর করে বলে, “কিছুই হয়নি। কত আঘাত তোমার লাগে, কিছু তো বলো না। আমার বেলায় এত বিচলিত হতে হবে না৷ হাত ধরেছ, ওতেই সব ব্যথা গায়েব!”
এমন করেই দিন যায়, দিন আসে। পুষ্পি তার মনের মাঝেই লুকিয়ে রাখে শাহরিয়ারকে নিয়ে জন্মানো সেই অনুরাগ, অভিমান, দ্বিধা! এই দীর্ঘ সময়েও সে শাহরিয়ারকে বুঝতেই দেয়নি মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা এই অভিযোগ। যখন মনে পরে তখন একটু মুডসুইং হয়, একটু অভিমানী হয়ে বসে থাকে, তবে মনের কথা মনেই রাখে।
শাহরিয়ার প্রায়শই বলে ফেলে, “কি যে হয় তোমার মাঝে মাঝে। পেত্নী-টেন্তী ভর করে নাকি আমার সুন্দরী বউ এর উপর? ও আল্লাহ! কালকেই পানি পড়া আনতে হবে।”
পুষ্পি রাগের মাঝেও হেসে ফেলে। এমন কেন মানুষটা! একটু রেগে থাকতে দেয় না, অভিমানী হতে দেয় না!
শ্বশুর-শাশুড়ির সাথেও সম্পর্কের ভিত ক্রমশ মজবুত হয়। শ্বশুর-শাশুড়ির দুষ্ট-মিষ্টি ঝগড়ার পাশাপাশি তাদের দুজনের দুজনের প্রতি মহব্বত দেখে মন ভরে ওঠে। মাঝে একদিন সাবেরী খাতুন আকস্মিক অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর হাসনাত সাহেবের সে কি দিশেহারা অবস্থা। সারা রাত নির্ঘুম কাটায় জায়নামাযে বসে। অস্থির হয়ে বাড়ির এমাথা থেকে ওমাথা পায়চারি করে।
এক ফাঁকে পুষ্পিকে জানায়, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আর কখনোই তোমার শাশুড়ীর সাথে ঝগড়াঝাটি করব না। মানুষটাকে এমন দেখতে একদমই ভালো লাগছে না আমার।”
যদিও তাঁর এই সিদ্ধান্ত দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। সুস্থ হওয়ার পর দুদিন না যেতেই যেই লাও সে কদু।
এমনই যাচ্ছিল দিন। একদিন ভরদুপুরে এক যুবকের আগমন ঘটল শাহরিয়ারের বাড়িতে। কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রঙ। আউলা-ঝাউলা চুল। হাস্যজ্বল মুখ। বয়স একুশ-বাইশ হবে বড়োজোর। হাতে নানাপদ গ্রাম্য খাবার।
পুষ্পিকে দেখতে পেয়েই উৎফুল্ল হয়ে উঠল ছেলেটা। ভাবি ভাবি করে দেওয়ানা হয়ে গেল মূহুর্তের মাঝে। পুষ্পি প্রথমে চিনল না, না চেনারই কথা। ছেলেটার ব্যাপারে জানতে পারল, সাবেরী খাতুন আসার পর। তারা দুজন আলিঙ্গন করে ভাব বিনিময় করল। সাবেরী খাতুন খানিক আবেগীও হয়ে উঠল। জানতে চাইলেন, “আমার ভাইটা কেমন আছেরে, বাপ? আর ভাবী? শরীরটা ভালো দুইজনের?”
পুষ্পি জানতে পারল, ছেলেটার নাম শাফিন। শাহরিয়ার আর মুনমুনের মামাতো ভাই৷ ছেলেটাকে দেখে খুব সহজেই ধারণা করা যাচ্ছে, দূরন্ত ছেলে।
শাফিন সাবেরী খাতুনের প্রশ্নের জবাবে বলল, “তাঁরা কেমন আছে তা জানতে হইলে গ্রামে যাইতে হইবো। কবে যাইবা কও? আমি কিন্তু এবার তোমগোরে না নিয়া যামু না। ডিসিশন ফাইনাল। ভাবীরে ছাড়া তো জিন্দেগীতেও যামু না। তোমরা না গেলে নাই, খালি ভাবীরে নিয়া যামু না।”
শেষের কথাটা বলেই পুষ্পিকে প্রশ্ন করল, “কি কও ভাবী?”
পুষ্পি কিছু না বলে হাসল কেবল।
সাবেরী খাতুন শাফিনের বাহুতে চাপর মেরে বলল, “বদমাইশ ছেলে! এখনও সেই আগের মতোই আছিস।”
শাফিন ভাবের সহিত বলে, “একছের, ঝকঝকা-ফকফকা। নো চেইঞ্জ।”
পুষ্পি এবারও হাসে। ভালো ফাজিল তো।
শাফিন এবার পুষ্পিকে জিজ্ঞেস করে, “ভাবী? তোমার নাম কী? নামটাই তো জানলাম না।”
শাফিনের প্রশ্নে ছোট্ট করে জবাব এলো, “পুষ্পি।”
শাফিন বিস্ময় নিয়ে বলল, “মানে ফুলের মতো সুন্দর? মাই গড! তোমার সাথে তোমার নাম মিল্লা গেল কেমনে?”
বলে নিজেই হেসে ফেলে।
সেই মূহুর্তেই প্রবেশ ঘটে মুনমুনের। চেনা মানুষকে মেয়েটা প্রথমে চিনতে পারল না। না চেনার কারণ দীর্ঘ সময় পর সাক্ষাৎ। এর মাঝে সাবেরী খাতুন গ্রামের বাড়ি গেলেও শাহরিয়ার আর মুনমুনের যাওয়া হয়নি বহুকাল। সাত বছরের ব্যবধানে দুজনেরই ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে, তাও শাফিনই চিনল প্রথমে। মুখে বিস্তর হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, “আরেহ! মুন এক এ মুন, মুন দুগুনে মুনমুন! কত্ত বড়ো হইয়া গেছিস তুই!”
সাবেরী খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ও ফুফু! তোমার মেয়ে এমন হুট কইরা বড়ো হইয়া গেল কেমনে!”
মুনমুন আশ্চর্যই হলো বটে। বিস্ময় নিয়ে আঙুল তুলে বলল, “শাফিন ভাই?”
শাফিনের মুখের হাসির রেখা আরো দীঘল হয়।
মুনমুন কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে, “তুমি কেন আসছো? শিওর আমাকে জ্বালাতে৷ একদমই আমার নাম ভেঙাবা না।”
শাফিন মুখ বাঁকিয়ে বলে, “হাহ! তোর মতো পুচকিরে আমি ভয় পাই ভাবছিস? ছোট বেলার কথা ভুলে গেছিস? একবার যে গেছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, ভুলে গেছিস?”
সাবেরী খাতুন বললেন, “তোরা দুইটায় এত বছর পরও ঠিক হলি না!”
শাফিন আর মুনমুনের সম্পর্ক দা-কুমড়া টাইপ। ছোট বেলাতেও দুজন একত্রে হলেই মারামারি বেজে যেত। খোঁচাত প্রথমে শাফিন তবে মারামারি শুরু করতো মুনমুন। দুজনের বিন্দুমাত্রও বনে না। মুনমুন কেবল মাত্র শাফিনের কারণেই গ্রামের বাড়ি যেতে চাইত না।
হাসনাত সাহেব আর শাহরিয়ার বাড়ি ফেরার পর পুরো বাড়িটাই সেদিন রমরমা হয়ে উঠল। এবং ঠিক করল, মানসিক প্রশান্তির জন্যে হলেও এবার সকলের একটু ঘুরাঘুরির প্রয়োজন আছে সত্যি। আর ঘুরাঘুরির জন্য গ্রামের বাড়ির চাইতে প্রশান্তি কোথাও নেই। সবাইকে সময় দেয়া হলো দুদিন। দুদিনের মাঝেই সকলেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়ার জন্য বলা হলো।
(চলবে)……