একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-২১+২২

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২১
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। সাথে কিশোরী কন্ঠে ডাক, “ভাবী, জলদি আহো। বিরাট ঘটনা ঘইটা গ্যাছে।”
পুষ্পি শাহরিয়ারকে ছেড়ে দাঁড়ায়। দ্রুত চোখ মুছে মুখ স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালায়৷ শাহরিয়ার ভ্রু দু’খানি একটু উঁচিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। দু হাত বুকে বেঁধে বড্ড খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “দরজা কি খুলব গিন্নি? আপনার অশ্রু বিসর্জন কি হয়েছে? পরে না আবার লোকে বলে বসে, ওহে পাপিষ্ঠ পুরুষ! এমন পূন্যবতী বউকে কাঁদাও, তোমাকে তো ঘার ধাক্কা দিয়ে এই গ্রহ হতে বিতারিত করা উচিৎ!”

শাহরিয়ারের কথা শেষ হতে হতেই পুষ্পি ধীর গতিতে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। মুখে তার উজ্জ্বল হাসির রেখা। মন বুঝি গলতে শুরু করেছে। ভয়ংকর পুরুষ, একদিনের স্থায়িত্বে রাগ গলিয়ে ফেলার সক্ষমতা রাখে!

পুষ্পি দরজা খুলতে খুলতে দরজার বাহিরে অবস্থানরত পল্লী বালিকা চলে গিয়েছে। যেন তার রাজ্যের তাড়া। দু-দন্ড অপেক্ষা করা দায়। পুষ্পি শাহরিয়ারকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি যাবেন?”

শাহরিয়ার হাতের ঘড়িটা খুলছিল তখন। পুষ্পির কথার প্রতিত্তুর করতে তার পানে চাইল। ঘড়িটা খুলে রেখে একটু এগিয়ে এল। তারপর সম্মোহনীর মতো ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি চাও? তুমি যা চাও, তাই। আমি তো চাই, সর্বক্ষণ তোমার সাথে সাথে রই। লোকে আমায় আড়ালে নাম দিবে, বউ পাগল শাহরিয়ার।”
এতটুকু বলে প্রশ্ন জুড়ে দেয়, “এখন বলো, তুমি কি চাও?”
পুষ্পির মুখ সোনালী রঙের হাসিতে ভরে ওঠে। কী মায়াবী, স্নিগ্ধ দেখায় এই হাসি। হিজাব খুলে কারুকাজে আঁকিবুঁকি করা মোলায়েম শালটা শরীরে জড়িয়ে নিতে নিতে বলে, “ঠোঁটকাটা পুরুষ মানুষ। আপনি আমার পেছন পেছন আসবেন না একদম। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন, উন্মাদ ইংরেজ মাস্টার।” বলতে বলতেই রুম ত্যাগ করে, সদ্য অভিমানের পারদ থেকে বেড়িয়ে আসা সুন্দর এই রমনী।

শাহরিয়ার তার চিরচেনা সেই অট্টহাসি হেসে ওঠে। ‘উন্মাদ ইংরেজ মাস্টার!’ এমন সম্বোধন সে বুঝি কল্পনাতেও ভাবেনি! তাও নিজের বউ এর কাছে! শাহরিয়ার হাসতে হাসতেই বিড়বিড় করে, “ভেরি ইন্টারেস্টিং! টু ফানি! আই এম ইন লাভ, পুষ্প।”

পুষ্পি এসব কিছুই শুনতে পায় না। সে সামনের বড়ো রুমটাতে এসে দেখে, মোটামুটি একটা জোট বেঁধে গিয়েছে এখানে। বড়ো ছোটো সবাই একত্রে হট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। বড়োদের ভেতর আবার বাগবিতণ্ডা চলছে।
পুষ্পি ছোট্ট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “কী হচ্ছে এখানে? আমি কি দেখতে পারি?”
পুষ্পির কন্ঠস্বর শুনে সবাই তার দিকে চায়। কুসুম, পুষ্পিকে ডেকে এসেছে যে, শাহরিয়ারের মেঝো চাচার মেয়ে, পনেরো বছরের কিশোরী, শ্যাম সুন্দরী; সে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এসে বলে, “ভাবী জানো কি হইছে?”
পুষ্পি ‘না’ সূচক মাথা নাড়ায়। কুসুম খুব রহস্য করে বলে, “ছোডো কাকী নাকি কাইল মাঝ রাইতে আলেয়া দেখছে।”
পুষ্পি লক্ষ্য করে দেখে সবাই দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সে ভেবে পায় না, একটা নামে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? আলেয়া তো সুন্দর একটা নাম। মনে মনে ভাবে, সে কি খারাপ মানুষ?
পুষ্পির নির্লিপ্ততা সাবেরী খাতুন আর মুনমুন বাদে সবাইকে অবাক করে দেয়। ইউনুস নামে পরিবারের সবচাইতে ছোট ছেলেটা বিস্ময় প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে, “কাকী তুমি ডরাও নাই? দেহ আমার পাও কাঁপতাছে।”

সাবেরী খাতুন হেসে দিয়ে বলে, “তোরা তোদের ঢং বন্ধ কর ফাজিল গুলা। আমার নিরীহ বউটারে ডর দেখাবি না খবরদার। ও এসব চিনিবো কেমনে? ঘরকুনো, শহুরে বাচ্চা আমার৷”

তারপর পুষ্পিকে আস্বস্ত করে বলে, “তুমি ভয় পাইও না মা। এসব আলেয়া-ফালেয়া কিচ্ছু না।”

পুষ্পির কৌতুহল বাড়ে বৈ কমে না। সে জানতে চায়, “আলেয়া কী জিনিস? এটা তো মানুষের নাম। কোনো খারাপ মানুষ নাকি?”
এই বিশাল কাঁপাকাঁপি জনগোষ্ঠী এবার কাঁপাকাঁপি বাদ দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

কুসুম বলে, “ও খোদা! তুমি আলেয়া কি হেইডাই জানো না! হায় আল্লাহ!”
কুসুমের মা, শাহরিয়ারের মেঝো চাচী মেয়ের মাথায় চাটি মেরে বলে, “আস্তে বল হতচ্ছাড়ি!”

পুষ্পি পুনরায় জানতে চায়, “এটা কী জিনিস, বলো না কেউ আমায়?”

কুসুম এবার ফিসফিসিয়ে বলে, “জ্বীন গো, জ্বীন। আগুনের গোলার মতোন রূপ ধইরা থাহে। একবার ধরলে আর রক্ষা নাই।”

পুষ্পি যেন আকাশ থেকে পড়ে। জ্বীনকে যে এতক্ষণ যাবত ‘আলেয়া আলেয়া’ করছে তা যেন ভাবতেও পারেনি সে৷ তবে সে মোটেও সাহসী না। বরং বলা বাহুল্য ভীতু স্বভাবেরই। এসব গালগল্প কখনোই গালগল্প মনে হয় না তার। খুব সহজে বিশ্বাস করে বসে। সে তার স্থান ত্যাগ করে সাবেরী খাতুনের কাছে গিয়ে বসে। ভয় বুঝতে না দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও সে প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে থাকে, আয়াতুল কুরসি পড়তে থাকে।
সাবেরী খাতুন সবাইকে ধমকের স্বরে বলে, “দেখছো কান্ড! ফাজিলগুলা সত্যি সত্যি ভয় লাগিয়ে দিয়েছে।”
পুষ্পিকে আস্বস্থ করে বলে, “আরে অসব কিছু না। কি দেখতে কি দেখেছে তার নাই ঠিক, এখন এসব গল্প বানাচ্ছে৷ তুমি রুমে যাও তো মা।”

বাকি সেনাসন্য সবাই এক প্রকার তেড়ে এসে বলে, “তুমি বিশ্বাস না করলে নাই। এত সাহস হইলে একলা বাগনের মধ্যে গিয়া খাঁড়াইয়া থাইকো তো দেহি। দেহুমনে কেমন পারো।”

পুষ্পি বলে, “বাগানে কিছু আছে নাকি? আমি যে সকালে গেলাম!”
ছোট চাচী বলে, “আরে ডরানোর কিছু নাই। এডি সব সময় থাহে না। সময় বিশেষ দেহা দেয় আর কি। দোয়া-দরুদ পইড়া থাকলে কিছু করতারে না। তুমি ভয় পাইও না।”

মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক চলে এই ভূত আড্ডা। জীবনে যে যত ভূতপ্রেত দেখছে, না দেখেছে সকল ইতিহাস খুলে বসেছে যেন একেকজন। তিল কে তাল বানিয়ে, গল্প রসালো করেছে। যে জীবনে ভূতের ‘ভ’ ও দেখে নাই সেও বলে উঠেছে, ‘আমি একবার দেখছি, একটা রশি সাপ হইয়া গেছে!’

সকলের হরেক রকম ভূতের গল্প শুনে পুষ্পি আর পুষ্পি রইল না। সে এক রুম থেকে যে অন্য রুমে যাবে সেই সাহসও সঞ্চয় করতে পারছে না। তার উপর আবার ওয়াশরুম হলো বাহিরে। ওয়াশরুমের চিন্তাতেও অর্ধেক বিমূঢ় হয়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। কুসুম এক ফাঁকে সতর্ক করে দিল, “ভাবী একলা বাইরে যাইবা না কিন্তু। খবরদার।”

মনের ভেতর একরাশ ভয় নিয়ে পুষ্পি রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করল সকলের সাথে মিলে।
এই ভূত সংক্রান্ত আলাপচারিতার ব্যাপারে শাহরিয়ার তখন অব্দি অবগত নয়। পুষ্পি যাওয়ার পর কিছুক্ষণ শুয়ে রইল, কলেজ রিলেটেড কিছু ই-মেইল চেক করল। নেটওয়ার্ক এর যা জঘন্য অবস্থা, অনেক সময় নিয়ে চেক করতে হয়েছে৷ ঢাকায় ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে। ইমেইল চেক-টেক করে, কিছুক্ষণ বই ঘাটাঘাটি করল এবং শেষে খাওয়ার ডাক পড়ায় খেতে গেল। সে খেয়ে-দেয়ে রুমে আসল পনে দশটা নাগাদ। গ্রামে সর্বদাই বেশ জোড়াল ভুড়িভোজ হয়। খেতে খেতে খাবার গলা অব্দি উঠে যায়, তাও অতৃপ্ত হয় না অন্তর৷ আর খাওয়ার পরপরই চাই, একটা শান্তিপূর্ণ ঘুম।
পুষ্পি এল আরো মিনিট ত্রিশেক পর। ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা শিশুসুলভ মন। পুষ্পিদের রুমটার সাথেই লাগোয়া সেই বিখ্যাত বাগান। এতদিন ভালো লাগতো, আজ আর লাগছে না। রুমে ঢুকেই সর্ব প্রথম দৃষ্টি পড়ল সেই দিকে। জানালা খোলা। শো শো করে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে ভেতরে। ঝিঝি পোকার ডাক ভেসে ভেসে আসছে। ভয়ে হিম হয়ে যায় মেয়েটা। দুরুদুরু মন নিয়ে দ্রুত গতিতে শাহরিয়ারের পাশে গিয়ে বসে।
আচমকা পুষ্পির এহেন কান্ডে শাহরিয়ার কৌতূহল নিয়ে চায়। সঙ্গে প্রশ্ন জুড়ে দেয়, “কী হলো?”
পুষ্পি কিছুতেই নিজের স্বামীর কাছে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। সে জবাব দেয়, “ওই জানালাটা আটকে দিয়ে আসুন।”

শাহরিয়ার কিঞ্চিৎ অনুমান করতে পারে৷ বলে, “ভয় পাচ্ছো নাকি? আরে ভীতু! হা হা!”

পুষ্পি বলে, “মোটেও না৷ ভয় পাব কেন? এটা আপনার পানিশমেন্ট। নামুন দ্রুত। আপনি না বলেছেন, আগামী এক মাস আমার সব কথা মান্য করবেন? ভুলে গেলেন মূহুর্তের মাঝে?”

শাহরিয়ার হাসতে হাসতে বিছানা থেকে নামে। মাথা হেলিয়ে বলে, “অপরাধ ক্ষমা করিবেন মহারানী। আপনার আদেশ গ্রহণ করিলাম।” বলতে বলতেই আগায়। তবে জানালার কাছে যেতে নিলে কি মনে করে যেন পুষ্পি বাঁধা প্রদান করে৷ বলে, “একা যেয়েন না। আমার সাথে চলুন।”

শাহরিয়ার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে কিছু একটা ব্যাপার যে আছে, তা স্পষ্ট। জানালা আটকানোর পর পুষ্পি বলে, “দেখি দাঁড়ান সোজা হয়ে।”
শাহরিয়ার মনে শঙ্কা নিয়ে দাঁড়ায়। পুষ্পি মনে মনে কিছু দোয়া-দরুদ পড়ে ফু দিয়ে দেয় সমস্ত মুখমন্ডলে, শরীরে। শাহরিয়ারের সমস্ত শঙ্কা জলাঞ্জলিতে যায়। তার নিজের প্রতি পুষ্পির নিগূঢ় মমতা, মায়া, প্রেম টের পায়। বুকে এসে লাগে ভালোবাসার আহাজারি। চোখে জুড়ে সৃষ্টি হয় স্নিগ্ধ প্রেম

রাতে ঘুমানোর সময় পুষ্পি শাহরিয়ারের এক হাত ধরে রাখে৷ যেনতেন ভাবে না। খুব শক্ত করে ধরে রাখে। এবার আর শাহরিয়ার নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। জিজ্ঞেস করেই ফেলে, “ব্যাপারটা কি বলো তো পুষ্প?”

পুষ্পি বলে, “কই, কি ব্যাপার! কোনো ব্যাপার-ট্যাপার নাই। শুনেছি দুজন একসাথে থাকলে খারাপ কিছু সংস্পর্শে আসতে পারে না। তাই আপনার হাত ধরেছি। অসুবিধা হলে বলুন, ছেড়ে দিব।”
শাহরিয়ার ছেড়ে দিতে দিবে দূর, বরং অপর হাত দিয়ে বাঁধন মজবুত করে। পুষ্পির দিকে ঘুরে বলে, “ছাঁড়তে তো কখনোই দিব না। আর খারাপ কিছু সংস্পর্শে আসবে মানে? নাকসা ফাটিয়ে দিব না একদম!”
পুষ্পি মিষ্টি করে হাসতে হাসতে বলে, “ইশশ! সাহস কত! সাহসী বীর পুরুষ এসেছে আমার!”
বড্ড আপন আপন লাগে কথাগুলো শাহরিয়ারের কছে৷ সে পুষ্পির আরেকটু সন্নিকটে যায়৷ পুষ্পির মধ্যখানের সিঁথিতে এলোমেলো হয়ে থাকা ছোট চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নিচু কন্ঠে বলে, “হ্যাঁ তাই তো। আমি তো তোমার সাহসী বীর পুরুষই। আর তুমি আমার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা, মুখচোরা পল্লী বধূ!”

এরপর নিশুতি রাতটা হেলে পড়ে পুবের জঙ্গলে। হিসহিসিয়ে গান তোলে অতিপ্রাকৃতিক জীবজন্তুরা। শিয়ালের ডাক রাতের গভীরতায় শিরশির করা ভয়ের সৃষ্টি করে।

পুষ্পির ঘুম ভেঙে যায় ঠিক মধ্যরাতে। চারদিক নিঝুম, নিশ্চুপ। কেউ একটা ফুলের টোকা দিলেও যেন তা এসে কানে বাজবে! শাহরিয়ারের হাত সরিয়ে পুষ্পি উঠে বসে। খুব নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাচ্ছে মানুষটা। একবার ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে, তো আরেকবার ইচ্ছে করছে না; এত সুন্দর ঘুমটা ভাঙাতে। কিন্তু একা একা বাহিরে যাবে, সে সাহসও কুলাচ্ছে না মনে।
বহু কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বিছানা থেকে নেমে দরজা অব্দি গেল, কিছু একটা শব্দ হতেই হুলুস্থুল গতিতে বিছানায় এসে পা তুলে বসল। খানিক সময় থম মেরে বসে রইল, শুয়ে ঘুমানোর প্রচেষ্টা চালাল, শেষে বাধ্য হয়ে পুনরায় উঠে বসল। কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে শাহরিয়ারের বাহুতে হাত রেখে খুব শীতল কন্ঠে ডাকল, “শুনছেন?”
শাহরিয়ার আড়মোড়া দিয়ে, “হু” শব্দ করে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ল। পুষ্পি আবার ডাকল, “এই? উঠুন না! শুনছেন? আমার ভয় লাগছে।”

এবার শাহরিয়ার শুনল। হতচকিত হয়ে উঠে বসল। পুষ্পির কাধে হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে?”
পুষ্পি আমতা আমতা করে বলে, “বাহিরে যাব। একা একা আমার ভয় লাগছে।”
শাহরিয়ার মুখে হাসির রেখা এঁকে, চোখ কচলায়। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে, “বোকা! কিসের ভয়? ঠিক আছে চলো সাথে যাচ্ছি।”

এরপর দুজন এক সঙ্গে বাহিরে যায়। এবং পুরোটা সময় পুষ্পি শাহরিয়ারকে ধরে রাখে। এত ভীতু মেয়েটা!

বাড়ি থেকে পনেরো বিশ কদম দূরত্ব ওয়াশরুমের। এটুকু পথও পুষ্পির কাছে মাইল এর পর মাইল দূরত্ব লাগল। শাহরিয়ারকে বারবার করে ওয়ার্নিং করে গেল, “এখান থেকে একটুও নরবেন না কিন্তু৷ আমি ভয় পাই।”
শাহরিয়ার এক গাল হেসে সায় জানায়, “আচ্ছা ঠিক আছে। যথা আজ্ঞা!”

তবে বিপত্তি ঘটল তখনই, যখন তার সায়, যথা আজ্ঞাতে সীমাবদ্ধ রইল না।

পুষ্পি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে প্রথমেই তার চোখ পরে ঘন জঙ্গলটার উপর। শো শো করে বিভৎস আওয়াজ আসছে। এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো, ও বোধহয় অন্য গ্রহে চলে এসেছে। শাহরিয়ারকেও দেখতে পাচ্ছে না কোথাও। কই গেল মানুষটা? এত করে নিষেধ করল! এত ভয়ংকর অনূভুতি হচ্ছিল যে তার মনে হলো এক্ষুনি জ্ঞান হারাবে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে রীতিমতো। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ডাকল, “কই গেলেন আপনি? আমার ভয় লাগছে! দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
বলতে বলতেই চোখে জল চলে এল তার। জায়গা থেকে নরতে পারছে না। কেউ যেন আটকে রেখেছে তাকে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে এসে কাঁধে হাত রাখল শাহরিয়ার। পুষ্পি সে মূহুর্তে তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। রীতিমতো শরীর কাঁপছে তার। শাহরিয়ার বুঝতে পারল, সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে মেয়েটা। সে আস্বস্ত করে বলল, “আমি একটু ওদিকটায় গিয়েছিলাম। ভয় পেও না, বোকা মেয়ে! ইজি হও পুষ্প৷ চল, ভেতরে চল।”

পুষ্পি একটা কথাও বলল না। নির্বিকার ভাবে রুমের ভেতরে এলো। শাহরিয়ার পানি ঢেলে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। বলল, “পানি খাও, স্থির হও। এত ভয় পাচ্ছ কেন? টেইক ইট ইজি, পুষ্প।”

পুষ্পি ঠেলে গ্লাস সরিয়ে দেয়। রাগ, ভয়, অভিমান, অনুযোগের সংমিশ্রণের মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয় তার মনে। জীবনে বিশটি বসন্ত পেরিয়ে আসা তরুণীটি এই মিশ্র অনুভূতির ফলে এক অদ্ভুত কান্ড করে বসল।
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে কইল, “কেন সরে গিয়েছিলেন আপনি? নিষেধ করেছিলাম আমি। কখনোই আমার কথা শোনেন না। আপনি এই পৃথিবীর সব চাইতে খারাপ স্বামী। একটুও ভালোবাসেন না আমায়। ছুঁবেন না আমায়। সরুন।”
শাহরিয়ার হতভম্ব হয়ে যায়। সে বোঝাতে চায়। কাছে বসে বলে, “এই বোকা! কাঁদছো কেন? এই সামান্য বিষয়ে এত ভয় পাচ্ছ! এদিক তাকাও, বোকা মেয়ে!”

পুষ্পি দু হাতে ঠেলে শাহরিয়ারকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, “দূরে সরুন আপনি। একদম কাছে আসবেন না আমার। আপনি খুব খারাপ!”

শাহরিয়ার এক প্রকার আর্তনাদ করে বলে, “ইয়া আল্লাহ!”

(চলবে)……..

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২২
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

সারারাত একপ্রকার নির্ঘুম কাটিয়ে দুটো প্রাণ নিদ্রা যাপন করে ফজরের নামাজের পর।
নাছোরবান্দা শাহরিয়ার যত আহ্লাদ করেছে, ভীতু বউ তার তত নিজ মর্জিমাফিক ত্যাড়ামি বৃদ্ধি করেছে। দিনদিন পুষ্পির এই নিরব ঘাতকের মতন দমন করার কৌশল শাহরিয়ারের মনে চিন্তায় উদ্রেক ঘটায়৷

মনে মনে সে ঠিক করল দু-এক দিনের মাঝেই শহরে ফিরে যাবে তারা। এবং এও অনুধাবন করলো, পুষ্পির প্রতি তার মনোযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে, সম্পর্কে আরো সময় দিতে হবে। পুষ্পির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধানও নেহাৎ-ই কম নয়। প্রায় নয় বছরের ব্যবধান। তার মানসিকতার সাথে পুষ্পির মানসিকতার একটা বিস্তর ফারাক থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে অস্বাভাবিক হবে তখনই যখন সে এই ব্যবধানের মাত্রা কমানোর কৌশল অবলম্বন না করে বরং বৃদ্ধি করায় ভূমিকা রাখবে। যেহেতু তার বোঝার ক্ষমতা বেশি, তাই সামলানোর বিষয়টিও তার তরফ হতে বেশি হওয়া উচিৎ।
তবে শাহরিয়ার কিঞ্চিৎ সংশয় অনুভব করে। কারণ শুরুতে যতটা সহজে পুষ্পির মন বোঝা যাবে ভেবেছিল, তা যে কতখানি ভুল ছিল তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে সে। বরং অন্তর্মূখী স্বভাবের হওয়ার ফলশ্রুতিতে তা আরো কঠিন হয়ে পড়েছে তার কাছে৷ হঠাৎ হঠাৎ বড়োই অচেনা-অজানা লাগে পুষ্পিকে তার৷ এর কিছু কারণ পুষ্পি ইদানীংকালের কিছু আচরণ।
কিছু বলে না, মনের কোনো ভাব প্রকাশ করতে চায় না সহজে, মুখ ফুটে কিছু কয় না, সব কিছু বুঝে বুঝে নিতে হয়! এ স্বভাব শুরু থেকে হলেও ক্রমশ তা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কী ভীষণ অসহায় লাগে শাহরিয়ারের নিজেকে মাঝেমধ্যে! সবসময় তো মন-মানসিকতা এক থাকে না। প্রচন্ড রাগ লাগে কিছু কিছু সময়৷ পরক্ষণে আবার সামলে নেয়। তাও অবচেতন মনে কিংবা সচেতন মনেই রাগ দেখিয়ে ফেলে। সে মনে মনে দোয়া করে, ‘ইয়া আল্লাহ! আমায় নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দাও!’

ভোরে ঘুমানোর ফলে শাহরিয়ারের ঘুম ভাঙে দশটা নাগাদ। পুষ্পি উঠে যায় আরো অনেক আগে। সকাল সকাল ওঠার অভ্যাস বলে, সকালে খুব একটা ঘুম হয় না তার। ঘুমাতে চাইলেও পারে না। কর্মপটু মেয়েটা যেখানেই যায়, স্থানটা আপন করে নেয়। নিজে থেকেই কাজ করবে। কেউ নিষেধ করলেও শুনবে না। প্রয়োজনে একা সব সামলে নেয়ার সক্ষমতা রাখে। কিছু না করে অযথা বসে থাকতে পারে না সে। কী সুন্দর বৈশিষ্ট্য এটি তার!
আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। এ বাড়িতে সকালের নাস্তার দ্বায়িত্ব ছোট কাকীর হাতে। সকালের আহারের ব্যাবস্থা তাই সেই করে। দুপুর এবং রাতেরটা বাকি দুজনের উপর। এমন করেই মিলেঝিলে রয় সকলে। ঝগড়াঝাটি বাঁধে, আবার নিজেরাই মিলেঝিলে যায়৷ এই সুন্দর খুনশুটিময় পরিবেশের জন্য পুষ্পি কখনো কখনো এমন করে সকলে মিলে থাকতে ইচ্ছে করে। আবার পরক্ষণেই নিজের অমিশুক স্বভাব নিয়ে শঙ্কায়ও পরে।

কাজ করতে করতে ছোট চাচী এক বিব্রতকর প্রশ্ন করলেন।
“তা পুষ্পি? তোমগো বিয়া হইল তো, মেলাদিন হইয়া গেল। কোনো সুসংবাদ-টংবাদ আছে নিহি?”
গলার স্বর একেবারে নিন্মে নামিয়ে প্রশ্নটি করেন তিনি।
পুষ্পির একটু ভালো লাগে না এধরণের প্রশ্ন৷ সে যেহেতু প্রকাশের ক্ষেত্রে খুবই নাজুক, তাই তার বিরক্তি কিংবা অপছন্দতা কেউ ধরতে পারে না। সে ছোট্ট করে জবাব দেয়, “তেমন কিছু নেই কাকী।”

ছোট চাচী গলার স্বর আরো একটু নিচু করে বলে, “হোনো মাইয়া, পুরুষ মানুষ বাইন্ধা রাহনের মোক্ষম উপাই হইলো পোলাইন। পোলা-মাইয়া হইলে একছের তারের লাহান সোজা হইয়া যাইব।”

এরপর একটুও বিরতি না দিয়ে বিশেষ কাহিনী বলার মতন কইরা বলে, “তোমগো ছোডো চাচা কেমন আছিল জানো? কি যে লাগাম ছাড়া আছিল! সংসারের উপর কোনো টানই আছিল না হের। হারাদিন টই টই কইরা ঘুইরা বেড়াইত। বন্ধুবান্ধব, বাজে আড্ডা, রাইত কইরা বাড়িত ফেরন সহ, যত রকমের আকাম-কুকাম আছিল হেয় করছে। কি যে দূর্দিন গ্যাছে হেই সময় আমার! হেরপর আনিস আইল। বিশ্বাস করো, তোমগো চাচা তারের লাহান সোজা হইয়া গেল। এক্কেরে যাদুর লাহান। আমার প্রতি তার ভালোবাসাও বাইরা গেল। কি যে যত্ন-আত্তি করতো! সব বাজে স্বভাব দূর হইয়া গেল তার। হের লইগা কইতাছি, বেশি দেরি কইরো না। এহনই সময়। আমার তো শাহরিয়ারের মতিগতি বেশি সুবিধার ঠেকে না।”

এটুকুতেও তার কথা শেষ হয় না। একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরো বলতে শুরু করেন,
“ভালোটালো বাসেনি তোমারে? আমার তো কেমন কেমন জানি সন্দেহ লাগে। হেই পরত্থম দিন এক লগে আইলো না। কিয়ের চারু না টারু হের মারে দেখতে গেল গা! ক্যানরে? হেই ছেড়ির কি আত্মীয়স্বজন নাই? হের কেলেজ্ঞা যাইতে হইবো? হেরপর আবার হেইদিন দেখলাম হারাদিন বাইরে বাইরে আছিল! আমার কিন্তু বাফু এইসব একছের সুবিধার ঠেকতাছে না৷ দিন কাল তো ভালা না। চোখে চোখে রাহো মাইয়া। নাইলে পরে কাইন্দাও কুল পাইবা না। এহনই সময়, বুজ্জ?”

পুষ্পির খুব বেশি অস্বস্তি লাগে৷ না পারে সইতে, না পারে কইতে। তার বলতে ইচ্ছে করে, প্লিজ কাকী চুপ করুন। আমার এসব কথা ভালো লাগে না। খুব খারাপ লাগে৷
মনে মনে শাহরিয়ারের প্রতি চাপা অভিমান সৃষ্টি হলেও বলতে ইচ্ছে করে, আমার স্বমীকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলবেন না। তিনি ভালো মানুষ! আমায় নিশ্চয়ই ভালোবাসে৷ আপনার ধারণা ভুল।

কিন্তু এসবের কিছুই সে বলে না। কেবল ছোট্ট করে জবাব দেয়, “উনি অমন না। উনাকে নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই। আল্লাহ যা চাইবে, তাই হবে। দোয়া করুন কাকী।”

ছোট চাচী একটু অসন্তোষ হলো বৈ কি! কিঞ্চিৎ ঠেস মেরে বললেন, “তোমরা আজকাইলকার পোলা মাইয়া, আমগো লাহান মুক্ষ-সুক্ষ মাইনষের কথায় গুরুত্ব দিবা না, ওইডাই স্বাভাবিক। তয় কইলাম, আমার কথা ভাইবা দেইখ। আজকাইলার বেডা মাইনষের তো আরো ভরসা নাই। সতর্ক থাকতে তো দোষ নাই।”

পুষ্পির আর সহ্য হয় না। শাহরিয়ারের অসম্মান হয় এমন কথা হজম করা বড্ড কষ্টকর লাগে। উঠে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হুট করে তো উঠে যেতে পারে না। তাই বসে সহ্য করে সব।
কিন্তু ‘মেঘ না চাইতে জল’ এর মতো একটা উপায় সৃষ্টি হয় এই প্রসঙ্গ এবং ঘটনা পারিপার্শ্বিক আবহাওয়া হতে বাহির হতে।

হঠাৎ বাহির হতে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। পিচ্চি বাহিনী ঝগড়া লেগেছে সম্ভাবত। পুষ্পি ‘আমি দেখে আসি’ বলে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। বিষয়টি দেখতে বাহিরে আসে। এসে দেখতে পায়, মণি আর মুক্তা মারামারি করছে। এরা দুজন শাহরিয়ার মেঝো চাচীর ছোট দুই জমজ কন্যা। বয়স তাদের নয় ছুঁইছুঁই। মণি মুক্তা একে অপরের চুল ধরে টানছে আর বাশফাটা কন্ঠে চিৎকার করছে৷ কাঁদছে, তাও কেউ কারো চুল ছাড়ছে না।

পুষ্পি বলল, “আরে আরে, করছো কি? দুজন দুজনকে ছেড়ে দাও, এক্ষুনি তোমাদের মা আসছে।”

মণি ছেড়ে দিলেও মুক্তা তখনও ধরে রেখেছে। মণি হাতে চিমটি কেটে তা ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছে। শেষে পুষ্পি হাত টেনে ছাড়ানোর পর ছেড়েছে।
জমজ হলেও দুজন পুরো আকাশ পাতাল ব্যাবধান। তবে দুজনে মধ্যে মুক্তা একটু বেশি চঞ্চল স্বভাবের।
পুষ্পি জানতে চাইল, “কি হয়েছে? আমায় বলো?”

মুক্তা বলল, “হে আমার কিলিপ পড়ছে কা? দেহ মাথায় আমার কিলিপ দিয়া রাখছে।”

পুষ্পি দেখল মনির মাথার একপাশে ছোট্ট একটা ক্লিপ। চুল টানাটানির ফলশ্রুতিতে ক্লিপ অনেকটা হেলে পরে আছে। পুষ্পি কিছু বলার আগেই মণি পাল্টা প্রতিক্রিয়া করলো, “মিছা কথা কয় ভাবী। এইডা আমার কিলিপ। তুমি মারে জিগাইয়া দেহ৷ হে নিজেরটা হারাইয়া, আমারটা নিয়া যাইতে চায়।”

পুষ্পি বলে, “ইশ! এই একটা ক্লিপের জন্য ঝগড়া করছো! খুবই খারাপ! তোমরা যদি ঝগড়া না করো তবে আমি তোমাদের এর থেকেও সুন্দর ক্লিপ দিব।”
মনি মুক্তা নতুন ক্লিপের কথা শুনে দুজন দুজনের থেকে সরে দাঁড়ায়। অর্থাৎ তারা বোঝাতে চাইল, নতুন ক্লিপের মোহে ঝগড়াঝাটি ত্যাগ করে ফেলেছে।

শাহরিয়ার দূর থেকে এই সব কিছু দেখে। পুষ্পি কিভাবে পুরো বিষয়টি সামলে নেয় তাও লক্ষ্য করে। মুখে এক চিলতে হাসির রেখা একে বলে, “কী চলে এখানে?”
মণি মুক্তা নিজের দোষ ঢেকে সমস্বরে বলে, “কিছু না ভাইয়া। আমরা তো খেলি। তাই না ভাবি, কও?”

তাদের এই দোষ ঢাকার নমুনা দেখে ফিক করে হেসে ফেলে শাহরিয়ার, সাথে পুষ্পিও। সে তাদের সায় দিয়ে বলে, “হ্যাঁ, ঠিক তো। ওরা তো খেলে।”

শাহরিয়ার ওদের কাছে ডাকে। দুজন কাছে গেলে শাহরিয়ার মনির মাথা থেকে ছোট্ট সুন্দর ক্লিপটা খুলে হাতে নেয়৷ পাতার শেইপের একটা ক্লিপ, নিচে একটা ফুল জুড়ে দেয়া। সুন্দর দেখতে।

শাহরিয়ার সেটা কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দুই বোনকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “আচ্ছা বল তো, এই ফুল বেশি সুন্দর, নাকি ওই ফুল?” শেষের কথাটা বলল পুষ্পির দিক নির্দেশ করে।
মেয়ে দুটো প্রথমে বুঝলোই না কিছু। পরক্ষণে কি ভেবে যেন দুজন একত্রে বলে উঠল, “ভাবীইইই!”

পুষ্পি হতভম্ব। এই পুরুষ মানুষটা পাগল? আস্ত উন্মাদ! বাচ্চাদের সাথেও রসিকতা করে!
শাহরিয়ার দুই বোনের গাল টেনে বলে, “উত্তর সঠিক হয়েছে। তোমরা দুজন পাচ্ছো আমার তরফ থেকে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।”

পুষ্পি অস্ফুট স্বরে ‘পাগল’ বলতে বলতে ভেতরে চলে আসে।
শাহরিয়ার উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে গায়, “লোকে পাগল বলুক, মাতাল বলুক…..আমি, তোমার পিছু ছাড়বো না।”
.

নানান স্মৃতি আর অনেক অনেক নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রামের সময়গুলো প্রায় ফুরিয়েই এলো সকলের এবং সেই সাথে পুষ্পিরও। অনেক কিছু শিখেছে, জেনেছে এবং বুঝেছে। নিজের স্বামীর প্রতি তার অন্যরকম অনুভূতির উপলব্ধিও এই গ্রামে এসেই করতে পেরেছে সে। এই একটা মানুষের প্রতি তার যে অকৃত্রিম অধিকার বোধ তৈরি হয়েছে এটা বোধহয় গ্রামে না এলে এত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারতো না৷ চারুর সাথে দেখা না হলে অনেক কিছুই হয়তো উপলব্ধি করা হতো না তার। কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা যেমন হয়েছে তেমনি সুন্দর কিছু স্মৃতির মালিকও হয়েছে। সহজ-সরল কিছু প্রাণের দেখা যেমন মিলেছে, তেমনই কিছু অন্যরকম মন-মানসিকতার মানুষের দেখা মিলেছে। একরাশ বিষন্নতা যেমন ঝেকে ধরেছে কখনো কখনো, তেমনই প্রফুল্লতায় মন মেতে থেকেছে অনেকটা সময়। সব মিলিয়ে গ্রামের এই দীর্ঘ সময় উপভোগ করেছে সে। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছে সে।

গ্রামের শেষটা সুন্দর হলেও ঢাকায় পদার্পনের যাত্রাটা মোটেও শুভ হয়নি।

পুষ্পির চোখের সামনে বাইক এক্সিডেন্টে একটা তরতাজা তরুণের মৃত্যুর ঘটনাটা তাকে তাৎক্ষণিক ট্রমায় ফেলে দিল৷ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে কাঁপুনি উঠে গেল সেই মূহুর্তেই। শাহরিয়ার আর পুষ্পি ছিল রিকশায় তখন। তারা ছিল পেছনের রিকশায়। পরিবারের বাকিরা অন্য রিকশায় আরো এগিয়ে তখন।
তাই পুষ্পিকে সামলানোর ভার পুরোটাই শাহরিয়ারের উপর। সে রিকশাওয়ালাকে বলে তাৎক্ষণিকভাবে স্থান ত্যাগ করলেও বিশেষ লাভ হয়নি। কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেল মেয়েটা। স্বচক্ষে এমন মর্মান্তিক দৃশ্য সহ্য করাও দায় বটে। অমন শক্ত মানসিকতা সবাই রাখে না। তার উপর যদি হয় এমন নরম মনের মানুষ! তার জন্য সহ্যের মাত্রা মাইনাস লেভেলে থাকে।
শাহরিয়ার পাশের দোকান থেকে পানি নিয়ে পানি খাওয়ায়। চোখেমুখে পানির ছিটে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। দুহাতে আগলে রাখে। পুষ্পি অনবরত বলে যেতে লাগল, “ছেলেটা বোধহয় বাঁচবে না। তাকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে না কেন কেউ! কত রক্ত। আপনি কেন চলে এলেন! মরে যাবে ছেলেটা, মরে যাবে। প্লিজ কিছু করুন, ওইখানে চলুন।”

শাহরিয়ার বলে, “শান্ত হও পুষ্প। কিচ্ছু হবে না। পুলিশ এসে পড়েছে, এম্বুলেন্সও চলে এসেছে দেখেছি। এক্ষুণি নিয়ে যাবে হসপিটাল। আমি-তুমি গেলে তো কোনো লাভ নেই, বোকা মেয়ে। একদম দুশ্চিন্তা করো না। একটু শান্ত হও। জোরে জোরে নিশ্বাস নেও। স্থির হও, প্লিজ!”

পুষ্পি পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায় ঘটনাটার পর৷ শাহরিয়ারের হাত এক মূহুর্তের জন্য ছাড়ে না সে। যেন ও হাত ছেড়ে দিলেই শাহরিয়ারেরও কিছু হয়ে যাবে।
শাহরিয়ার অনেক ধীরস্থির ভাবে বোঝাতে বোঝাতে, পুষ্পি কিঞ্চিৎ স্থির হয়। একটু স্বাভাবিক হয়। কিন্তু তার কান্না কমে না। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়াতে থাকে। শাহরিয়ার মন অদ্ভুত রকমের অনুভূতির সাক্ষী হয়! এই মেয়েটা কেমন যেন! আদুরে, নিস্পাপ, এত মায়ার! এত নির্মল সতেজ আর নরম তার মন!

বাড়িতে এসেও পুরোপুরি স্তব্ধ থাকে মেয়েটা। একটু সময় তো লাগবেই। শাহরিয়ার পরিবারের সকলকে ঘটনাটির ব্যাপারে অবগত করে। এবং পুষ্পির কিছু সময় লাগবে স্বাভাবিক হতে তাও বুঝায়। সবাই খুব সহজেই বুঝতে পারে বিষয়টি।

রাতে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাওয়ানো হয় তাকে। এরপর নিজে গিয়েই চুপচাপ শুয়ে পরে। এমনকি শাহরিয়ারের আগেই শুয়ে পরে এসে।
শাহরিয়ার রুমে এসে দেখতে পায় ঘুমিয়ে পরেছে। মায়া লাগে ভীষণ। তবে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তারপর সে তার নিজের কিছু কাজ গোছগাছ করে। কাল থেকেই ক্লাস নেওয়া শুরু করবে ঠিক করে। অনেক গ্যাপ পড়ে গিয়েছে। পুরোনো রুটিনে ফিরতে হবে।
সব গোছগাছ শেষে শাহরিয়ার নিজে শুতে আসে। পুষ্পির গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেয়। মশারী টানায়। রোজ পুষ্পি যেই কাজগুলো করে, সেই সব করে সে নিজে। এবং নিখুঁত ভাবেই করে। যত্ন সহকারে করে। যত্নশীল পুরুষ মানুষ!

কিন্তু ব্যাপার ঘটে সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর। হঠাৎ পুষ্পির ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার আওয়াজে ঘুম কেটে যায়। হকচকিয়ে উঠে বসে। দ্রুত পানি ঢেলে, পানি খাওয়ায়। মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে জানতে চায়, কি হয়েছে।
পুষ্পি কিচ্ছু বলে না, শুধু কাঁদে। শাহরিয়ার পুষ্পির এক হাতের উপর অন্য হাত রেখে পূর্ণ ভরসার সহিত বলে, “পুষ্প! একটু থামো! এমন করছো কেন! বলো আমায়, কী হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”

পুষ্পি শাহরিয়ারের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলে, “আপনি আমায় প্রতিজ্ঞা করুন, আপনি আর বাইক চালাবেন না। প্লিজ প্রতিজ্ঞা করুন। আমি ঘুমাতে পারছি না।”

শাহরিয়ার বুঝতে পারে, ট্রমার ফলে তাকে নিয়েও ভয় ঢুকে গিয়েছে ওর মনে। কিন্তু এমন প্রতিজ্ঞা সে করে কেমন করে! এটা তো সমাধান না। শাহরিয়ার বলে, “শোনো বোকা মেয়ের কথা! বাইক না চালানোটা তো সলিউশন না! আচ্ছা আমি সাবধানে চালাবো। ওকে? এখন ঘুমাও, আসো।”

পুষ্পি নাছোড়বান্দা হয়ে বেঁকে বসে। কেঁদে কেঁদে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলে। সে নিজের কথায় অনড় থেকে বলে,

“না, না, না! আপনি আমায় প্রতিজ্ঞা করুন, এই ফালতু জিনিস চালাবেন না, যা মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। প্লিজ প্রতিজ্ঞা করুন। আপনার কোনো আঘাত সইতে পারবো না আমি। আমার কষ্ট লাগছে। প্লিজ প্রতিজ্ঞা করুন। দয়া করুন আমার উপর!”

এত মায়া, এত চিন্তা, এত অনুরাগ পুষ্পির বলা প্রতিটা শব্দে! তাদের বিয়ের এই এতগুলো মাসে এই প্রথমবারের মতো শাহরিয়ার উপলব্ধি করে, পুষ্পির জীবনের তার ভূমিকা কতখানি বৃহৎ আকার ধারণ করে বসেছে।

শাহরিয়ার বলে, “পুষ্প! তোমার মতো পুন্যময়ী বউ যার আছে, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে সকল বিপদ-আপদ থেকে এমনিতেই রক্ষা করে ফেলবে। অযথা দুশ্চিন্তা করছো তুমি। আমার কিচ্ছু হবে না, ইনশাআল্লাহ।”

পুষ্পি বলে, “আমি অত কিছু বুঝি না। আপনি আর এই ফালতু বাহনটি চালাতে পারবেন না। এটাই আমার শেষ কথা। আপনি আমার এই কথা না মানলে আমি আপনার সাথে কথা বলবো না। কক্ষনো না।”

শাহরিয়ার একগাল হেসে পুষ্পিকে কাছে টেনে নেয়। মাথার এক পাশে হাত রেখে বলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন ঘুমাও।”

(চলবে)…..