#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৩
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
প্রায় মাস খানেক সময় নিয়ে দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল শাহরিয়ার। পুষ্পি দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ায়। পড়নে তার ময়ূরপঙ্খী বর্ণের শাড়ি। চুলগুলো আলগোছে বাঁধা, মধ্যিখানে সিঁথি আঁকা। দু’হাতে দুটো করে চুড়ি। ছিপছাপ গরনে, ভারী স্নিগ্ধ দেখতে লাগছে।
শাহরিয়ার আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতেই, দরজায় দাঁড়ান এই স্নিগ্ধ রমণীর পানে দৃষ্টি যায়। শাহরিয়ার ঘুরে তাকায়। চোখ সরে না তার। সেই প্রথম দিনের মতো বুকের ভেতর দুরুদুরু কম্পন সৃষ্টি হয়। যেন সদ্য বিয়ে করে আনা বউ তার। সে সবসময় যেমন করে ডাকে, তেমন করেই ডাকল, “পুষ্প, কাছে আসো তো।”
পুষ্পি মাথা দুলিয়ে, তার আহ্বান নাকচ করল। আদুরে বউ হয়ে জানতে চাইল, “কই জান?”
শাহরিয়ার নিজেই এগিয়ে গেল তার অবাধ্য বউয়ের কাছে। কপালের কাছে বেড়িয়ে আসা কিছু চুল কানের পেছন গুঁজে দিতে দিতে জবাব দিল, “কলেজ যাই।”
পুষ্পি বলে, “আজই? আজ না গেলে হয় না?”
শাহরিয়ার বলে, “হয়। তবে শুধু শুধু না যাবই বা কেন? বাসায় থেকে লাভ কি?”
পুষ্পি ভ্রুকুটি করে বলে, “কত লাভ আছে! খুঁজলেই পাবেন।”
শাহরিয়ার সুমিষ্ট হাসে। পুষ্পি কথার বান সে খুব সহজেই ধরতে পারে। মেয়েটা ধীরে ধীরে সহজ হচ্ছে। তাঁর সাথে, তাঁর আচরণের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে ভাবতেই মনে প্রশান্তির বন্যা বয়ে যায়। সুন্দর হাসিতে চোখ বুঝে আসে। পুষ্পির মাথার পেছনে হাত রেখে বলে, “কলেজ শেষে এসে, নিরালয় বসে, সকল লাভ খুঁজব। এখন যাই? দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
পুষ্পি কাঠখোট্টা জবাব দেয়, “যান, নিষেধ করেছে কে? ধরে রেখেছি? ধরে তো রেখেছেন আপনি। ছাড়ুন আমায়।”
শাহরিয়ার বলে, “এভাবে না! সুন্দর করে বিদায় দাও। কত দিন পর যাচ্ছি। বউয়ের সুন্দর হাস্যজ্বল মুখের বিদায় নিয়ে গেলে, দিন ভালো যায়।”
পুষ্পির মনে মনে ভালো লাগে, শাহরিয়ারের এই কথাগুলো। সবসময়ই ভালো লাগে। তবে সেটা কখনোই সে মুখে প্রকাশ করে না। ওই যে মুখচোরা স্বভাব! সে মুখে বলে, “পারবো না হাসি হাসি মুখ করতে। কারণ আমি রেগে আছি।”
বলতে বলতে সে সরে যায়।
শাহরিয়ার বাইকের চাবি খুৃঁজতে গিয়ে চাবি পায় না। শুরুতে পুষ্পিকে জিজ্ঞেস করতে চায় না। যদি আবার ‘বাইক চালাতে পারবে না’ শর্ত মনে পড়ে যায়, সেই ভয়ে। শেষে উপায়ন্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলে।
“এই? পুষ্প? বাইকের চাবি দেখেছ? এখানেই রেখেছিলাম, পাচ্ছি না।”
পুষ্পি পাল্টা জিজ্ঞেস করে, “বাইকের চাবি দিয়ে আপনার কাজ কি? ওই ফালতু বাহন আপনার জন্য নিষিদ্ধ করে দিয়েছি, মনে নেই? রিকশায় করে গেলে যাবেন, না গেলে হেঁটে যাবেন। ভুলেও বাইক-ফাইকের কথা মুখে নিবেন না।”
শাহরিয়ার প্রচন্ড দুঃখী মানুষের মতন করে বলে, “ইয়া আল্লাহ! এ কোন মসিবতে ফেললা!”
পুষ্পি বলে, “কোনো মসিবতে ফেলেনি। বরং এমন ভালো বউ জুটিয়েছে কপালে যে, মসিবত থেকে দূরে রাখছে।”
শাহরিয়ার অনুনয় করে, “প্লিজ দাও না খুঁজে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
পুষ্পি বলে, “খুঁজে দিব কি? চাবি তো আমার কাছেই! নিষেধ মানে নিষেধ। আপনি সহজে আমার নিষেধ মানবেন না, আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। তাই লুকিয়ে রেখেছি। দেওয়া হবে না। এমনিতে গেলে যান, না গেলে নাই।”
শাহরিয়ার বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, “কি সাংঘাতিক! পুষ্প, এত চালাকি কবে থেকে করতে শিখে গেলা!”
পুষ্পি খুব ভাব নিয়ে বলে, “যেমনের সাথে তেমন হতে হয়।”
কথাটা বলেই খানিক বিরতি দিয়ে পুনরায় বলে, “দেখি স্থির হয়ে দাঁড়ান।”
বলতে বলতে এক হাত দিয়ে শাহরিয়ারের বাহু ধরে। তারপর মনেমনে দোয়া-দরুদ পড়ে সমস্ত শরীরে ফু দিয়ে দেয়। এবং শেষে বলে, “প্রিয় অবাধ্য স্বামী, এবার আপনি আসতে পারেন।”
শাহরিয়ার হতভম্ব, বাকরুদ্ধ। সব সয়ে নিলেও, শেষে কিনা অবাধ্যের খেতাব!
কিন্তু সব শেষে সকালটা তার সুন্দর। পদ্মপাতার জলের মতো স্বচ্ছ। বাইক না পেয়ে কলেজ সে বাসে এসেছে। এবং সারাটা পথে পুষ্পির কথাই মনে পড়েছে। ক্রমশ মায়া বাড়ছে। সম্পর্কের ভীত ভীষণ মজবুত হচ্ছে। নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে।
বহুদিন ছুটি কাটিয়ে কলেজে আসায় তার সহকর্মীরা সকলেই অভিবাদন জানাচ্ছে। কেউ কেউ টিটকারি-মশকারি করছে। বাইকের ঘটনা শোনার পর কেউ কেউ মজা করলেও, কয়েকজন তার প্রতি পুষ্পির দুশ্চিন্তারও তারিফ করেছে। সিঙ্গেল সহকর্মীরা আফসোস করতে ছাড়ছে না মোটেও, কেন তাদের এমন কেয়ারিং ওয়াইফ নাই! শাহরিয়ার এই সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দেয়।
কলেজে তার ব্যাপক আবেদন। ছেলেমেয়েরা তাকে ভয় পায় যেমন, তেমন খুব মান্যও করে। নিজের বউয়ের কাছে ঠোঁটকাটা, বাকপটু আর রসিক খেতাব পেলেও ছাত্রছাত্রীদের কাছে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানব। গুরুগম্ভীর, রগচটা আর ভয়ানক কড়া শিক্ষক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তাকে। পড়াশোনার ব্যাপারে ‘নো ছাড়’ টাইপ অবস্থা। খিলখিল হইহট্টগোল নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে যায় তার বিচরণে। ‘আসসালামু আলাইকুম, স্যার’ বলে কেউ এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না তার সম্মুখে।
তবে বিস্ময়ের বিষয় এই-যে, ভয় পাওয়া স্বত্বেও তার ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সর্বাধিক! ফাঁকিবাজ ছাত্রছাত্রীরা আড়ালে গাল-মন্দ করে। ‘বিয়ে হবে না’, ‘বউ পাবে না’, ‘বউ পেলেও ঝগড়ুটে হবে’ ; বলে বদদোয়া দেয়।
অন্যদিকে পড়ুয়াদের কাছে সে ‘ফেভারিট’ টিচার।
সে ছাত্রছাত্রীদের সাথে মজা করে, দুষ্টুমি করে সীমিত, আবার শাসনের বেলায় এক বিন্দু ছাড় নেই। ইংরেজিতে সে দূর্দান্ত। বুঝানো স্টাইল চমৎকার।
তার বোনের বন্ধুমহল আড্ডায় মজাচ্ছলে বলে, এই মুন? তোর ভাই, ইংরেজদের বংশধর নয়তো? কেমন জানি ইংরেজ ইংরেজ গন্ধ আসে কথা থেকে। এত ভালো কেমনে কয়, ইংরেজ না হইলে?
মুন ভারী রাগ হয়ে বলে, “ভাইয়া ঠিক বলে, তোরা একেকটা বেদ্দপের হদ্দ। আমার ভাইকে নিয়ে আজাইরা কথা বললে উষ্ঠা দিব। ম্যানার নাই, কিচ্ছু না। ফাজিল।”
শাহরিয়ার বহুদিন পর ক্লাসে আসায় মোটামুটি তাকে পছন্দ করা, অপছন্দ করা সকল স্টুডেন্ট-ই উচ্ছ্বসিত।
শাহরিয়ার ক্লাসে ঢুকতেই সকল ফিসফিসানি বন্ধ। দাঁড়িয়ে সালাম দেয় সকলে। লাবণ্যের পাশ থেকে নিচু কন্ঠে সায়মা বলে, “এই লাবু? স্যার মনেহয় আরো হ্যান্ডসাম হয়ে গেছে, না?”
লাবণ্য নিজের ভেতর অনেকখানি পরিবর্তন এনেছে। স্যারকে কেবল স্যারের নজরেই দেখছে সে। মিথ্যে ফ্যাসিনেইশন কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। শাহরিয়ারকে দেখলে মন নরম হয়ে আসে। তাও নিজেকে সামলে নেয়। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে। এই মানুষটার জন্য কেবল শ্রদ্ধাই প্রযোজ্য।
সে সায়মাকে জবাব দেয়, “চুপ কর।”
ক্লাস যেহেতু ইংরেজি। তাই বেশিরভাগ স্পিচ শাহরিয়ার ইংরেজিতেই দেয়।
অনেকদিন পর ক্লাস নেওয়ায় মিনিট দশেক ছাত্রছাত্রীদের সাথে ভাব বিনিময়ে কাটে। কথার ফাঁকে ফাঁকে কেউ কেউ জানিয়েছে, তারা ভীষণ মিস করেছে।
শাহরিয়ার খানিক রসিকতা করে জানতে চেয়েছে, “তাই? আমি তো জানি, তোমরা আমায় দেখতে পারো না!”
সকলে তখন সমস্বরে বলে ওঠে, “মিথ্যা! আপনি আমাদের খুব পছন্দের!”
শাহরিয়ার দন্ত বিকশিত হাসে। বেশ দীর্ঘ সময় নিয়েই হাসে৷ এবং শেষে বলে, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন পড়া শুরু করি?”
সকলে প্রতিত্তুর করে, “ওকে স্যার।”
মিয়াদ পাশের বেঞ্চ থেকে ফিসফিসিয়ে মুনমুনকে ডেকে বলে, “এই তোর ইংরেজ ভাই দেখি আবার হাসতেও জানে!”
মুনমুন বলে, “চুপ থাক!”
লাবণ্য বলে, “ইংরেজ ভাই কি? হ্যাঁ? তোর কি হয়? রেস্পেক্ট কিভাবে দিতে হয় শিখিসনি? বেয়াদব!”
শাহরিয়ার পেছনের এই ফিসফিসানি লক্ষ্য করে। লেকচার বন্ধ করে বলে, “পিছনে কিসের আলাপচারিতা চলছে? তোমাদের না বলেছি একত্রে না বসতে?”
মুনমুন ভয়ে ভয়ে বলে, “স্যরি স্যার, নেক্সট ক্লাস থেকে বসবো।”
ভাই হলেও কলেজে সে স্যার বলেই সম্মোধন করে।
ভাইকে প্রচন্ড ভয় করে, সমীহ করে চলে সে।
শাহরিয়ার আর বকাঝকা করে না। পুনরায় পড়ায় ফেরত যায়।
মিয়াদ বলে, “আবার আগের রূপে ফিইরা গ্যাছে। ভাবছিলাম…..”
লাবণ্য চোখ রাঙিয়ে পাশে তাকাতেই চুপ হয়ে যায় মিয়াদ।
বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়। ব্যাস্ত মানবকুল ব্যাস্ততা ঝেড়েঝুড়ে যে যার বাড়ি ফেরে।
শাহরিয়ার টিউশনি করায় না আজ আর। কলেজ শেষ করে বাড়ি ফেরে। তবে বাড়ি ফিরে দেখে এলাহি কান্ড! ঘরদোর খুব সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। ফুলটুল দিয়ে ডেকোরেশনও করা হয়েছে টুকটাক।
মুনমুন শাহরিয়ার সাথেই ছিল। সে আগে আগে ভেতরে চলে গেল ব্যাপার কি দেখতে। শাহরিয়ার আসতে নিলে পুষ্পি বাঁধা দিয়ে বলল, “উপহার এনেছেন?”
শাহরিয়ার জানতে চাইল, “কিসের উপহার? আজ কোনো বিশেষ দিন আছে?”
পুষ্পি হাসিখুশি মুখটা গোমড়া করে ফেলে। অসন্তোষ ভঙ্গিতে বলে, “আপনি জানেন না? আজ মা-বাবার বিবাহ বার্ষিকি!”
শাহরিয়ারের বিস্ময় বাড়ে। সে অবাক বিস্ময়ে বলে, “তাই? মা আমায় কখনোই বলেনি তাদের বিবাহ বার্ষিকি কবে! বরং জানতে চাইলে বকা দিয়েছে! কিংবা বলেছে, মনে নেই! পুষ্প তুমি এটাও জেনে নিয়েছো! ইউ আর জিনিয়াস! আসো একটু জড়ায় ধরি!”
পুষ্পি হতভম্ব! এ কেমন ঠোঁটকাটা পুরুষ মানুষ! এমন জায়গায় বেফাঁস কথা বলতে দু’বার ভাবে না!
পুষ্পি আশেপাশে দেখে, কেউ শুনে ফেলল না তো আবার! চোখ রাঙিয়ে বলে, “আজেবাজে কথা রেখে দ্রুত উপহার নিয়ে এসে ঘরে প্রবেশ করুন। অন্যথায় আজ আপনি বাহিরেই থেকে জান।” কথাগুলো বলতে বলতে এক হাতে ঠেলে শাহরিয়ারকে দরজার কাছ থেকে সরিয়ে, দরজা লাগিয়ে দেয়।
শাহরিয়ার হাসতে হাসতে বলে, “এমন ঘাড়ত্যাড়া বউ আমার! জেদি….!”
কিন্তু ভালো লাগার ব্যাপার শাহরিয়ারের কাছে এই যে, এতগুলো বছরেও ও যা করতে পারেনি, পুষ্পি অল্প দিনেই তা করে দেখিয়েছে। এই মেয়েটা সত্যি এত ঘরোয়া! সকলকে নিয়ে তার কি ভীষণ ভাবনা! কত যত্ন, আদর আর মায়া তার প্রতিটি কাজে!
শাহরিয়ার উপহার নিয়েই ফিরল। সকলে মিলে ছোটখাটো একটা উৎসবের মতো করে উদযাপন করল সময়টা। শাহরিয়ার মজাচ্ছলে বলল, “কি সাংঘাতিক! ঝগড়াঝাটি করে করে তোমরা ত্রিশ বছর পার করে ফেললে একত্রে! বড়ো আচানক কান্ড!”
পুষ্পি কপাল কুঁচকে বলল, “মাশাআল্লাহ বলুন।”
সবাই হেসে দিল। শাহরিয়ার বলল, “মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ।”
তারপর দুই ভাইবোন মা বাবাকে আলিঙ্গন করল। দোয়া চাইল। এবং শেষে শাহরিয়ার দোয়া করে বলল, “তোমরা আরো শতবর্ষ এমনই করে কাটিয়ে দাও, আল্লাহ সেই তৌফিক দিক।”
পুষ্পি ছোট্ট করে বলে, “আমিন ইয়া রব্বুল আলামিন।”
পুষ্পির সাথে সাথে মুনমুনও বলে।
ছোটখাটো এই উৎসব শেষ হতে রাত অনেক কেটে যায়। ঘড়ির কাটা বারো ছুঁইছুঁই।
শাহরিয়ার রুমে এসেই বিছানায় শুয়ে পরে। পুষ্পি আনমনা হয়ে বিছানা গোছাচ্ছিল। শাহরিয়ার তা লক্ষ্য করে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “কী ভাবছো?”
পুষ্পি জবাব দেয়, “ভাবছি, ত্রিশ বছর কত দীর্ঘ সময়! নাহ?”
শাহরিয়ার বলে, “হুম। অনেক দীর্ঘ সময়।”
এরপর একটু থেমে বলে, “আমার রিসেন্ট ড্রিম প্রজেক্ট কী, জানো?”
পুষ্পি কাথা গোছানো রেখে জানতে চায়, “কী?”
শাহরিয়ার শোয়া থেকে উঠে বসে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার মতন করে বলে, “আমাদের একসাথে পথচলার একশো বছর পূর্তি হবে, তুমি আমি দু’জনই বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব। দাঁত-টাত সব পড়ে যাবে। কিন্তু তখনও তুমি থাকবে স্বতঃস্ফূর্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর! আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ডাকব, সুন্দরীতমা আমার!”
পুষ্পি মুখ বাকিয়ে বলে, “ইশ! এক বছর-ই হলো না! আবার শতবর্ষ!”
শাহরিয়ার হাত টেনে দাঁড়িয়ে থাকা পুষ্পিকে বসায়। আর খুব আদুরে হয়ে কয়, “হয়নি তো কি হয়েছে? হবে! এক বছর, দু’বছর, শত বছর! মিষ্টি মিষ্টি ছানাপোনা আসবে, একটা, দু’টো, তিনটে….না, পাঁচটা! তিনটে রাজকন্যা, দুইটা রাজপুত্র। এবং সবগুলো দেখতে তোমার মতো হবে। মায়ায় মাখানো মুখ! ইনশাআল্লাহ। এই হলো আমার ড্রিম প্রজেক্ট। আর তুমি হলে তার পার্টনার। লাভলী পার্টনার।”
পুষ্পি খিলখিল করে হাসে! হাসতে হাসতে তার চোখে জল চলে আসে। এমন প্রাণবন্ত হাসি, মুগ্ধ হয়ে দেখা যায় এক জনম।
(চলবে)….
#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
অনেকদিন কেটে যায় ভালোবাসা আর মায়ায়। এরপর এলো ঝড়ের দিন। বাহিরে সেদিন তুমুল ঝড়। পথঘাট আধার হয়ে আসে, মন খারাপের মেঘের মতো। শো শো করা বাতাসে গাছপালা নুইয়ে পড়ে।
পুষ্পি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখে। আজ তার বৃষ্টি ভালো লাগছে না। মন বিষন্ন লাগছে। রাত হয়ে যাওয়ার পরও শাহরিয়ার বাড়ি ফিরছিল না দেখে পুষ্পি বারংবার কল দিচ্ছিল। কিন্তু বারবার এক কথা, ‘আপনার ডায়েল কৃত নাম্বারটিতে এই মূহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।’ পুষ্পি দুশ্চিন্তায় পরে গেল। সিঁড়ি ঘরে গিয়ে দেখল বাইক আছে কিনা। বাইক যথা স্থানেই রয়েছে।
সে এরপরও কয়েকবার কল করল, রিসিভ হচ্ছে না। কেটে দিচ্ছে!
পুষ্পি সাবেরী খাতুনকে গিয়ে বললেন, “মা? আপনার ছেলে এখনও আসছে না কেন? বাহিরে এত ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।”
সাবেরী খাতুন বললেন, “চলে আসবে মা। দুশ্চিন্তা করো না। হয়তো কোথাও আটকা পড়েছে ঝড়ের কারণে।”
পুষ্পি বলল, “মা, কল রিসিভ হচ্ছে না। কখন থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
সাবেরী খাতুন বললেন, “হয়তো নেটওয়ার্ক এ সমস্যা করছে।”
এরপর পুষ্পির হাত ধরে ভরসা দেয়ার মতন করে বলল, “শোনো, বিয়ের প্রথম প্রথম তোমার শ্বশুর যখন দেরি করে আসতো, আমারও এমন দুশ্চিন্তা হতো। কিন্তু বেটা ঠিকই হেলতে-দুলতে আসতো। বিয়ের এতকাল পেরোলাম, দেখ এখনও তার সেই আগের স্বভাবই রয়ে গিয়েছে। পুরুষ মানুষ একটু এমনই। ঘরের চিন্তা তাদের কম ছুঁতে পায়। তুমি এখানে চিন্তায় মরছো, আর দেখ গিয়ে আমার সোনাচান ছেলে কোনো এক টং দোকানে বসে চা পান করছে। সে এমন আগেও করেছে। সেজন্য দুশ্চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছি আমি, তুমিও ছেড়ে দাও। অযথা দুশ্চিন্তা করো না। তার চাইতে বরং আমরা চালভাজা করে খাই, চলো। মুনমুনকে ডেকে আনো যাও।”
পুষ্পি শাশুড়ীকে আর কিছু না বললেও মনে মনে তার ভারী দুশ্চিন্তা হয়। উসখুস করে উঠে যায়, শাশুড়ীর নির্দেশ মোতাবেক। যতসব আজেবাজে চিন্তা আসে মাথায়। তবুও নিজেকে শান্ত রাখে।
এরপর যখন রাতে শাহরিয়ার ফেরে সে যেন প্রাণ ফিরে পায়। ভেজা শরীর নিয়ে সে ফিরে আসে। তবে বিষন্ন মুখ। পুষ্পি শাহরিয়ারকে তোয়ালে এগিয়ে দেয়। তবে মাথা মুছে দিতে চাইলে শাহরিয়ার হাত সরিয়ে দেয়। এই এতগুলো মাসে এই প্রথমবারের মতো শাহরিয়ার এমনটি করল। অথচ শাহরিয়ারই বরং অন্যসময় আবদার করে। আজ কি হলো? পুষ্পি একটু না, বরং বেশ অনেকটা অবাক হয়। এবং এও লক্ষ্য করে, এসে থেকে শাহরিয়ার তার সাথে একটা কথাও বলে না, এমনি একবার লক্ষ্য করে তাকায়ও না।
পুষ্পি জানতে চায়, “কী হয়েছে আপনার?”
শাহরিয়ার কোনো জবাব না দিয়েই ওয়াশরুমে যায়।
পুষ্পি দুশ্চিন্তায় পরে যায়৷ কি হলো হঠাৎ! রেগে আছে কেন! সকালেও তো ভালো ছিল। একসাথে কলেজ গেল। ওকে নামিয়ে দিয়ে তাঁর কলেজ গেল। তাঁর কলেজে কি কিছু হলো?
পুষ্পির এসব ভাবনা চিন্তার মাঝেই শাহরিয়ার ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
পুষ্পি বলল, “আপনি কি নিচে গিয়ে খাবেন? নাকি খাবার নিয়ে আসবো এখানে?”
শাহরিয়ার সময় না নিয়েই খুব গম্ভীর হয়ে জবাব দিল, “খাব না। খিদে নেই।”
পুষ্পি কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে কোনো কারণে রেগে আছে, তা বেশ বুঝতে পারছে। হালকা হালকা ভয়ও পাচ্ছে। তাই বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও পাচ্ছে না। রেগে থাকলে এত ভয়ানক হয়ে ওঠে মানুষটা!
এরই মাঝে শাহরিয়ার ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে আকস্মিক চেঁচিয়ে উঠল, “আমার বইটা এখানে নামিয়ে রেখেছে কে? এটা কি বই রাখার জায়গা?”
পুষ্পি ছুটে গেল। নরম স্বরে বলল, “আমি রেখেছি। দিন আমায় সরিয়ে রাখছি।”
শাহরিয়ার বলল, “সরিয়ে রাখছি মানে কী? আগে সরিয়ে রাখোনি কেন? এখানে এটা থাকবেই বা কেন? তোমাকে আমি কতদিন বলেছি, আমার জিনিস এলোমেলো জায়গায় রাখা আমার পছন্দ না।”
পুষ্পি বুঝতে পারছে না, এই সামান্য বিষয়টা এভাবে বাড়াচ্ছে কেন। সে বলল, “ভুল হয়েছে। আমাকে দিন, সরিয়ে রাখছি।”
শাহরিয়ার অনেকটা আওয়াজ করেই বলল, “পুষ্প তোমার সবসময় ভুলই হয়! ঠিক করে কিছু করতে পারো না? করতে না পারলে করবে না। সবসময় এই লেইম এক্সকিউজ দিবা না, ভুল হয়েছে।”
পুষ্পির কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। সে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে, যার কারণে এত বিভৎস ভাবে কথা শোনাচ্ছে তাকে!
শাহরিয়ার রাগে উন্মাদের মতো করছিল। সে বিছানায় বসে পড়ল। ঘনঘন দুবার নিশ্বাস নিল। পুষ্পি এরপরও পানি এনে বলল, “নিন, পানি খেয়ে নিন। আমার মনে হচ্ছে আপনি ঠিক নেই। কী হয়েছে আমায় বলবেন?”
শাহরিয়ার চোখ তুলে তাকাল পুষ্পির দিকে। রক্তবর্ণ দৃষ্টি! কি ভয়ংকর লাগছে এই রাগী শাহরিয়ারকে দেখতে। সে উঠে দাঁড়ায়। পানির গ্লাসটা নিয়ে দূরে ছুড়ে মারে৷ বিকট আওয়াজে আতংকিত হয় মেয়েটি। খানিকটা সরে দাঁড়ায়।
শাহরিয়ার খুব রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করে, “ছেলেটা কে?”
পুষ্পি হতভম্ব হয়ে যায়। সে পাল্টা জানতে চায়, “কোন ছেলে?”
শাহরিয়ার বলে, “খুব ইনোসেন্ট সাজছো কেন? কোনো ছেলের সাথে আলাপ নেই তোমার?”
পুষ্পি সোজাসাপ্টা জবাব দেয়, “না, নেই।”
শাহরিয়ার তাচ্ছিল্য করে হাসে। বলে, “হাও ইনোসেন্ট ইউ আর, পুষ্প!”
পুষ্পি চুপ করে থাকে। শাহরিয়ার নিজেকে চুপ রাখতে পারে না। সে বলে, “তোমাকে আমি বলিনি, আমার অগোচরে কিছু করবে না? বলো, বলিনি?”
পুষ্পি জবাব দেয়, “বলেছেন।”
“তাহলে কেন করেছো?”
“কী করেছি?”
“কিছু করোনি?”
পুষ্পি খুব ধীরে ধীরে রাগ ওঠে বলে উঠতে সময় নিচ্ছে। সে কোনো প্রতিত্তুর করে না। আর এই বিষয়টাই শাহরিয়ারের রাগ বাড়িয়ে তোলে। সে ধমকে উঠে বলে, “চুপ করে আছো কেন? কথা নেই কোনো? কথা খুঁজে পাচ্ছো না?”
এই পর্যায়ে এসে পুষ্পি প্রতিত্তুর করে, “কি করেছি আমি? চুরি করেছি, না ডাকাতি করেছি? খুন করেছি কাউকে? কী করেছি বলুন? সেই কখন থেকে রাগ দেখিয়ে যাচ্ছেন আমাকে!”
শাহরিয়ার বলে, “আমায় তোমার ভালো লাগে না, সেটা আমায় বলতে। মেনে নিতাম আমি, স্বাধীন করে দিতাম তোমায়। কিন্তু অন্য কারো কাছে কেন হেয় করেছো আমায়? বলো? এতটাই জঘন্য আমি?”
পুষ্পি কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। কিসব আবল-তাবল বলছে মানুষটা। পুষ্পি তখনও নরম হয়ে জানতে চায়, “কী বলছেন এসব আপনি? আমি আপনাকে পছন্দ করি না, এসব কে বলেছে আপনাকে? আপনি ছাড়া আর কে আছে আমার? বলুন?”
শাহরিয়ার আরতনাদ করে বলে, “কত ইনোসেন্ট লাগছে পুষ্প তোমায়, এবং তোমার কথাগুলো! কিন্তু আমি কেন একসেপ্ট করতে পারছি না, তোমার এই ইনোসেন্টনেস!”
পুষ্পি ছলছল দৃষ্টিতে চায়।
শাহরিয়ার এবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “রিকশায় তোমার সাথে ছিল, ছেলেটা কে? সেদিন লাইব্রেরিতেও দেখেছি। কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। আরো অনেকবার অনেক জায়গায় তোমার সাথে ওকে দেখেছি। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে তোমার ডিপার্টমেন্টেরও না! এমনকি তুমি বলেছ, তাহুরা নামের মেয়েটি ব্যাতিত তোমার কোনো ফ্রেন্ড নেই কলেজে। তবে কিসের এত সখ্যতা এই ছেলের সাথে তোমার?”
পুষ্পি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শাহরিয়ারের দিকে। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। সামান্য এই বিষয় নিয়ে শাহরিয়ার এতকিছু ভেবে বসবে, কখনো কল্পনাতেও আনেনি সে। পুষ্পি বুঝতে পারে, শাহরিয়ার মাহদীর কথা বলছে। এটা সত্য, ছেলেটার সাথে ওর প্রায়শই দেখা হয়। ও কথা না বললেও, মাহদী সেধে সেধে এসে কথা বলে। এটাসেটা জিজ্ঞেস করে। পুষ্পি দশ কথায়, এক কথা জবাব দেয়। তাও মাহদী পথেঘাটে দেখা হলে কথা বলবেই। এমনকি ছেলেটা এও জানে, পুষ্পির যে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একদিন তো বলেই বসল, “এই? তোমার বিয়েতে দাওয়াত দিলে না কেন? তুমি জানো, কতদিন বিয়েটিয়ে খাই না! লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললে!”
তারপর একটু থেমে বলল, “যদিও তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে শুনে একটু খারাপ লেগেছে, বাট ইট’স টোটালি ওকে।”
এরপর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, “এই তোমার হাজবেন্ড ভালো তো?”
পুষ্পি ভ্রু কুঁচকে জবাব দেয়, “খুব বেশি কথা বলো তুমি।”
মাহদী এক গাল হেসে বলে, “হ্যাঁ, সবাই বলে।”
আজকের ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিন্ন। রিকশায় যে মাহদীকে পুষ্পি সানন্দে তুলেছে, বিষয়টা এমন না। পুষ্পি আসছিল সেই মূহুর্তে মাহদী রিকশা থামিয়ে রিকোয়েস্ট করল, “পুষ্পি, রিকশা পাচ্ছি না। আমাকে একটু লিফট দিবে? প্লিজ? ইমিডিয়েট বাসায় যেতে হবে। মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, বাসায় কেউ নেই। প্লিজ?”
বৃষ্টির কারণে রিকশা কম ছিল কথাটা সত্য। তাছাড়া মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে পুষ্পিও আর না করতে পারেনি।
কিন্তু কোনো কিছু না জেনেই শাহরিয়ারের এমন বিরূপ মনোভাব পুষ্পিকে আঘাত করল। পুষ্পি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকায়, শাহরিয়ার আরো রেগে গেল। সে রাগে-জিদে পারছে না সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলতে। না পেরে শুধু অস্থিরতা দেখাচ্ছিল। বলল, “তুমি আমার সাথে চিট করছো পুষ্প? আমার দূর্বলতার সুযোগ নিচ্ছ! আমায় ছেড়ে দিবে তুমি?”
পুষ্পি কেঁদে ফেলল। কি বিচ্ছিরি শোনাচ্ছে কথাগুলো! শাহরিয়ার পুনরায় বলল, “কতদিন ধরে চিট করছো আমার সাথে? নাকি বিয়ের আগে থেকেই? ওর জন্যই এই কলেজে এডমিট নিয়েছো?”
পুষ্পি বলে, “এত জঘন্য জঘন্য অপবাদ দিতে একটু কষ্ট হচ্ছে না আপনার? আমাকে মেরে ফেলুন, এর থেকে ভালো। প্লিজ, মেরে ফেলুন।”
শাহরিয়ার নিজেরও চোখ ভিজে রয়েছে। রাগ এবং দুঃখের সম্মেলনে এই অশ্রুপাত! সে ফোন নেয়। এরপর কিছুক্ষণ কিছু একটা খোঁজে ফোনে। বেশ খানিকক্ষণ ঘাটাঘাটির পর মেসেজ বের করে পুষ্পিকে দেয়। বেশ কিছু ছবি দেখায়। মাহদীর সাথে ওর ছবি।
পুষ্পি অশ্রুসিক্ত চোখেই ফোন হাতে নেয় ভালোভাবে দেখার জন্য। তারও তো জানতে হবে কেন এমন করছে শাহরিয়ার।
অনেকটা সময় নিয়ে মেসেজ গুলো পড়ে পুষ্পি হতভাগ হয়ে যায়! মাহদী খুব জঘন্য ভাবে এটা বোঝাতে চেয়েছে, পুষ্পির সাথে ওর সম্পর্ক চলছে। এবং অনেক আগ থেকে তারা একে-অপরকে পছন্দ করে, ভালোবাসে। পুষ্পির অনিচ্ছায় এই বিয়ে হয়েছে। সে শাহরিয়ারকে পছন্দ করে না। এবং খুব শীঘ্রই সে শাহরিয়ারকে ছেড়ে যাবে।
পুষ্পি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদে। আর্তনাদ করে বলে, “মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা! এসব কথা মিথ্যা। ও একটা মিথ্যাবাদী! আপনি ওকে বিশ্বাস করছেন কি ভাবে!”
শাহরিয়ার বলে, “মিথ্যে হলে, ও এত কনফিডেন্স পেয়েছে কই? বলো?”
পুষ্পি কি বলবে ভেবে পায়না! তার বলারই বা কি আছে? নিজেকে কখনও জাস্টিফাই করতে হবে শাহরিয়ারের কাছে; এ কথা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি! এ দিনের জন্য তো সে কখনও প্রস্তুত-ই ছিল না। মাহদীর এই অপকর্ম ওকে যতটা না আঘাত করেছে, তার চাইতেও বেশি আঘাত করছে ওর প্রতি শাহরিয়ারের এই হঠাৎ অবিশ্বাস! একটা ছেলের ভিত্তিহীন কথা কেন এত দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলবে? নিজে খুঁজে দেখবে না এর সত্যতা?
পুষ্পি উঠে যেতে লাগে। শাহরিয়ার বাঁধা দেয়। পুষ্পির অনবরত কান্না ওর মন নরম করে দিয়েছে। রাগ ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। ছেলেটার কথাগুলো শুরুতে যতটা আঘাত করেছে, পুষ্পির প্রতি অবিশ্বাস তৈরি করেছে; তা অনেকটাই কেটে যাচ্ছে। শুধু পুষ্পির সীকারোক্তিতে বলা ‘ সব মিথ্যা’ কথাটিতে।
শাহরিয়ার অনেকটা নরম হয়ে বলে, “আমি ওর কথা বিশ্বাস করছি তা কিন্তু না। তবে তোমায় নিয়ে আমার মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল। মাথা কাজ করছিল না৷ ও যখন থেকে আমায় এসব মেসেজ দিয়েছে, আমি মেসেজ গুলো দেখার পর থেকে মনে হচ্ছিল, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এটা সত্যি হলে, সইতে পারতাম না আমি! সারাদিন বাহিরে বাহিরে ঘুরেছি, বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছি, কতটা সময় নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানো না! এক মূহুর্তের জন্য মনে হয়েছি, ছেলেটা সত্যি বলেছে। দেখ কথাগুলো বলতে বলতে এই ঠান্ডার ভেতরেও আমার ঘাম হচ্ছে! কিন্তু এখন আমার সংশয় দূর হয়েছে। আমি তোমায় বিশ্বাস করি। তোমার একটা কথা, সবার সব কথার উর্ধ্বে। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি পুষ্প! এত ভালো এ জীবনে আর কাউকে বাসি নাই। বিশ্বাস করো।”
পুষ্পি এরপর আর একটা কথাও বলেনি। ভীষণ আঘাত করেছে এই পুরো বিষয়টি তাকে৷ সাদা কাগজের মতো চরিত্রে কলঙ্ক লেপনের প্রচেষ্টা; হৃদয় ভেঙে দিয়েছে তার। শাহরিয়ারের জীবনে তো চারুর প্রলেপ আছে। কিন্তু ওর জীবনে তো এই একটা পুরুষ ব্যাতিত আর কেউ নেই! আর কারো জন্য তার মন উতলা হয়নি, আর কারো জন্য তো উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেনি, আর কারো জন্য তো প্রণয়নের ঘর বাঁধেনি সে! তবে কেন তার প্রণয় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? কেন সংশয় তৈরি হবে? কেন মিথ্যে অপবাদ সইতে হবে? সে প্রতিবাদ করতে জানে না বলে? সব আপসে সয়ে নেয় বলে?
এবার শাহরিয়ারের প্রতি তার যেই দুঃখটা তৈরি হলো তার গভীরতা বৃহৎ। এরপর ওর মনের সেই সুপ্ত আক্ষেপটা জাগ্রত হয়, ওর যাওয়ার কোথাও নেই!
(চলবে)….