#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৫
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
কেবল একটা ক্লাস করিয়ে শাহরিয়ার কলেজ থেকে বেড়িয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য পুষ্পির কলেজ। সে ঠিক করেছে মাহিদীর সাথে কথা বলবে। সে কি চাচ্ছে, জানতে চাইবে। এমন নিন্দনীয় কর্মকান্ডে কেন লিপ্ত হয়েছে, সে প্রশ্নও করবে। তবে মাহদীর সাথে দেখা করার আগে সে আরো কিছু কাজ সারে। তার এই কর্মকান্ডে যারা যারা সহায়তা করেছে কিংবা ইন্দ্রন জুগিয়েছে তাদের ডেকে পাঠিয়েছে। মাহদীকে ডাকেনি কারণ জানে, সে আসবে না।
মাহদীর বন্ধুদের সাথে কথা বলার পর মনটা হালকা হয়ে গিয়েছে। ভালো অনুভূতি হচ্ছে। বাহিরে চিরিচিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এ কয়দিন দিনের সিংহভাগ সময়তেই আকাশের কান্না চলে। মন খারাপের ভার আর সইতে পারছে না যেন।
শাহরিয়ার একটা সিএনজি করে পুষ্পির কলেজ আসে। পুষ্পি আজ কলেজ আসেনি। এমনকি রাত থেকে শাহরিয়ারের সাথে একটি কথাও বলেনি। অবশ্য প্রত্যেক বারই অভিমান কিংবা রাগ করলে পুষ্পি এমনটাই করে। শাহরিয়ার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে এখন। তাই সেও আর কথা বলে বিরক্ত করতে চায়নি। পুষ্পির প্রতি একটু অন্যায় যে সে করেছে তার কিঞ্চিৎ উপলব্ধি তার ভেতর হচ্ছে৷ তবে পুরো দায় নিতে নারাজ। তার জায়গায় যে কেউ থাকলে শুরুতে এমন রিয়্যাক্ট-ই করতো শুরুতে। আর যা করেছে, পুষ্পিকে ভালবাসে বলেই তো করেছে। পুষ্পির প্রতি পসেসিভনেস করতে বাধ্য করেছে।
শাহরিয়ার সিনএনজি থেকে নেমে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিজ্ঞানের ভবনের দিকে যায়। দু-একজন লেকচারের সাথে দেখা হলে কথাবার্তা বলে। তবে একটু তাড়া দেখিয়ে এড়িয়ে যায়। দোতলার ভবন ঘুরে তিনতলায় গিয়ে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয় মাহদীর। শাহরিয়ার ছবি দেখেছে, তাই মাহদীকে চিনতে অসুবিধে হয়নি। চ্যাকপ্রিন্টের একটা শার্ট আর জিন্স পরে আছে ছেলেটা। চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। হ্যাংলাপাতলা গরন। ভরপুর তারুন্য চোখেমুখে। খুবই নমনীয় এবং ভদ্র দেখতে। এধরণের ছেলেগুলো সাধারণত নম্র-ভদ্রই হয়। কিন্তু এ ছেলে বিগড়ে গেল কেমন করে? শাহরিয়ার বেশ লক্ষ্য করে পর্যবেক্ষণ করে।
অন্যদিকে মাহদী তো শাহরিয়ারকে চিনেই। তার বন্ধু পারভেজ একদিন রাস্তায় দেখিয়ে জানিয়েছিল, সে পুষ্পির হাজবেন্ড। এবং শাহরিয়ারের সকল তথ্য-উপাত্ত পারভেজই বের করে দেয়। পারভেজের সঙ্গ দেয় রাসেল নামক আরেক বন্ধু। দুজন মিলে বুদ্ধি দেয় শাহরিয়ার আর পুষ্পির মাঝে ফাটল সৃষ্টি করতে। কিভাবে কি করতে হবে তার আইডিয়াও ওরাই দেয়।
মাহদী অনুমান করতে পেরেছিল, শাহরিয়ার উতলা হয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবে। সে কুটিল হেসে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম, স্যার! ভালো আছেন? চিনতে পেরেছেন আমায়? মাহদী হাসান…!”
শাহরিয়ার গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয়, “চিনেছি৷ অত ডিটেইলস বলতে হবে না। বাচ্চা ছেলে, তোমায় চেনা কঠিন কোনো বিষয় না।”
মাহদী বলে, “আমি জানতাম, আপনি আসবেন। আমার অনুমান ক্ষমতা প্রবল।”
শাহরিয়ার নিজেকে স্বাভাবিক রাখে। সে বলে, “পাশে একটা কফিশপ দেখলাম, ওখানে চলো।”
মাহদী বলে, “হ্যাঁ। ওখানের কফিও মজা। আমি আর পুষ্পি অনেকবার খেয়েছি একত্রে। পুষ্পিও খুব পছন্দ করে ওখানকার কফি। চলুন আজ আমরা দুজন খাই।”
শাহরিয়ারের রক্ত গরম হয়ে যায়৷ এখানে সে কিছুতেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না। অনেকে তাকে চেনে সম্মানিত শিক্ষক হিসেবে। তার চাইতে বড়ো বিষয় পুষ্পি এখানে পড়ে! পুষ্পির ইমেজ সে মরে গেলেও খারাপ হতে দিবে না। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। চোখমুখ শক্ত করে বলে, “এসো আমার সাথে।”
মাহদী মুখ বাকিয়ে হাসে। শাহরিয়ারের রাগ ধরতে পেরে খানিকটা তাচ্ছিল্যের হাসি।
শাহরিয়ার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। সাথে মাহদীও।
কফি শপে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখানে যায়না৷ এই এড়িয়ার বাহিরে যেতে সিএনজিতে ওঠে। মাহদী বলে, “তো স্যার? আপনি কি জেলাস হয়ে কফিশপ বয়কট করে দিলেন?”
শাহরিয়ার বলে, “উঠে বস।”
মাহদী ঠোঁট উল্টে বলে, “ওকে স্যার।”
মাহদী ‘স্যার’ বলাটা মোটেও সম্মানের সহিত ছিল না। খানিক কটাক্ষ করেই বলা যেন।
তারা একটা রেস্টরন্টে আসে। একটু পেছনে গিয়ে বসে। মাহদী বলে, “তাহলে দুটো কফি অর্ডার দেই, স্যার?”
শাহরিয়ার বলে, “আমি এখানকার খেতে আসিনি। একটা অর্ডার দাও। কথা আছে আমার।”
মাহদী একদমই পাত্তা না দেয়ার মতো করে বলে, “ওঃ! ঠিক আছে।”
তারপর ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার করে।
এরপর শাহরিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তো কি কথা? কী জানতে চান? আপনার বউ এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”
শাহরিয়ার ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে। কিন্তু উপরে তা কিছুই প্রকাশ করছে না। বরং মাহদীর কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়। একটু সামনে ঝুঁকে বলে, “বলেই তো দিলে আমার বউ! আমার বউয়ের সাথে আমার চাইতে জোড়াল সম্পর্ক তো আর কারো হবে না; এটুকু তো তুমি নিজেও জানো, তাই না? তুমি আমায় বলো, নিজেকে এত নিচে নামিয়ে ফেলেছ কেন? শুনেছি তুমি ভালো স্টুডেন্ট। এতকাল ছাত্র পড়িয়ে, কখনো তো দেখিনি, ভালো ছাত্রদের এমন গর্ধবের মতো থার্ডক্লাস কাজ করতে! তুমি করলে কেন?”
কফি চলে এসেছে ততক্ষণে।
মাহদীর কনফিডেন্স বোধকরি অর্ধেক কমে গিয়েছে শাহরিয়ারের জবাবে৷ তবে দমে যায়নি সে। জবাব দিল, “আমি গর্ধব হওয়া স্বত্বেও তো আপনার বউ আমার কাছে চলে আসতে চাচ্ছে। আপনি মহাজ্ঞানী হয়ে কী করতে পারলেন স্যার? নিজের বউকে আটকে রাখতে পারলেন না? সো স্যাড স্যার!”
শাহরিয়ার এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। আর জেন্ট্যালম্যান হয়ে থাকতে পারে না। গরম কফিটা নিয়ে টেবিলে রাখা মাহদীর হাতে ঢেলে দেয়। মাহদী যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে। হাত সরিয়ে টিশ্যু পেপার দিয়ে হাত চেপে ধরে। শাহরিয়ার একটু হেলে বলে, “এবার তো শুধু এটুকু শাস্তি পেলে। আর একটিবার যদি আমার ফুলের মতো সুন্দর চরিত্রের অধিকারী বউকে নিয়ে একটি বাজে কথা মুখে আনো, এই ইনোসেন্ট মুখটা আর কাউকে দেখাতে পারবে না। হোল লাইফ হেল করে দিব। একদম পুতে দিব মাটিতে।”
এরপর রহস্যময় হেসে বলে, “আমি এখানে তোমার কথা শুনতে আসিনি বাবু। আমি এখানে বলতে এসেছি। তোমার কাজ তো শুধু শোনা। এত কথা বলছো কেন? পটর পটর করতে তো তোমায় ডাকিনি বাবু! যেই মিথ্যা কর্মকান্ড গুলো করে আমায় আঘাত করেছ, আমার বউটার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছ, তার শাস্তি হিসেবে আমি তোমার অনেক ক্ষতি করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। দিজ ইজ মাই ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং। নিজেকে শুধরানোর শেষ সুযোগও বলতে পারো। এরপর আর সুযোগ পাবে না। মনে থাকে যেন।”
এরপর আরও বলে, “আর হ্যাঁ, ভালো বন্ধুদের সাথে চলাফেরা করো, যারা তোমায় সু-বুদ্ধি দিবে, কু-বুদ্ধি না। যেমনটা তোমাকে তোমার দুই বন্ধু দিয়েছে৷ আবার দেখ, দুই টোকা দিতেই হুরহুর করে সব শিকার করে ফেলেছে।”
এরপর একটু পরামর্শ দেয়ার মতো করে বলে, “ভালোবাসাকে এতটা সস্তা বানাবে না। সম্মান করতে শেখো। যাকে ভালোবাসো বলে দাবী করছো, তার চরিত্রে দাগ লাগাতে কষ্ট লাগল না? এবং একটিবার ভাবলেও না, তোমার এই কর্মকান্ডের ফলে পুষ্প কতটা কষ্ট পেয়েছে! তোমার কোনো ধারনা আছে? নেই, না? থাকলে নিশ্চয়ই করতে না এমনটা।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরো বলে, “দেখ, তুমি বাচ্চা মানুষ। যথেষ্ট কম বয়স। হয়তো এ কারণে ম্যাচিউরিটি আসেনি। তাই এমন ইম্যাচিউরের মতো কাজ করেছ। যেটাকে তোমার ভালোবাসা মনে হচ্ছে, সেটা তোমার ফ্যাসিনেইশন। যেটা চাইলেই তুমি কাটিয়ে তুলতে পারবে। কিংবা বলা বাহুল্য, দুদিন পর এমনি কেটে যাবে। কাউকে ভালোলাগা দোষের কিছু না। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু ভুল মানুষকে পছন্দ করাটা নিশ্চয়ই অন্যায়। পুষ্প আমার বিয়ে করা বউ। লাইফ পার্টনার। লাইফ পার্টনার বোঝ তো, না? আশা করি আর বুঝিয়ে বলতে হবে না কিছু।”
বলেই শাহরিয়ার উঠে দাঁড়ায়। এবং প্রস্থানের আগে বলে, “মন দিয়ে পড়াশোনাটা করো, ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। ভুল কাজ জীবন নাশ করে দিবে। শুভ কামনা, মাহদী।”
শাহরিয়ার চলে যায়। মাহদী এই পুরোটা সময় নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে। শাহরিয়ারের কাছে সত্য ফাঁস হয়ে যাওয়া, বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং পুষ্পিকে আর কখনোই না পাওয়া, এমনকি কথা বলার সুযোগটাও হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণার কাছে; হাতে পরা গরম কফির যন্ত্রণাও ফিকে হয়ে গেল। অনুতাপের জায়গায় নিজের ভেতর জেদ আরো প্রকট রূপ ধারণ করল। গাল বেয়ে গড়াল এক ফোঁটা তেজী অশ্রু।
.
পুষ্পি বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। পড়নে তাতের কাপড়। চুলগুলো হাতখোঁপা করে রাখা। দু-তিনটা চুল বেড়িয়ে আছে কানের কিনারে। দু হাতে দুটো চুড়ি৷ চুড়িগুলো তার বিয়ের, তাই কখনো খুলে না। সারা রাত ঘুমায়নি, সারাদিন বিষন্ন হয়ে ছিল আকাশটার মতো। আকাশে মেঘ জমেছে খুব। বৃষ্টি নামবে এক্ষুনি। ভীষণ বাতাস বাহিরে। বাতাস এবং ধুলাবালি এসে চোখে লাগছে, পুষ্পি নড়ছে না তাও। প্রতিটা মূহুর্ত খুব বিষাক্ত লাগছে তার কাছে। নিজেকে খুব নগন্য লাগছে। নিজেকে মনেহয় জলে ভাসা পদ্ম, যার নিজস্ব কোনো ঠিকানা নেই। স্রোত যেখানে নিয়ে ফেলবে, সেখানেই স্থান গড়ে নিতে হবে। এতটাই তুচ্ছ সে! ক্ষনে ক্ষনে কান্না পেয়ে যাচ্ছে তার। বারংবার গাল বেয়ে দুফোঁটা করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আর পুষ্পি তা আঁচলে মুছে।
প্রত্যেকদিন শাহরিয়ারের আসতে আসতে আটটা-নয়টা বেজে যায়৷ আজ খুব জলদি-ই চলে এলো। জামাতে মাগরিব নামাজ আদায় করেই বাড়ি চলে আসে। প্রত্যেকদিন পুষ্পি দরজা খুলে দিলেও আজ তার ব্যাতিক্রম হলো। মুনমুন দরজা খুলল। শাহরিয়ার জুতা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, “তোর ভাবী কই?”
মুনমুন জবাব দেয়, “রুমে মনেহয়। নিচে নামেনি সন্ধ্যার পর আর।”
শাহরিয়ার ‘আচ্ছা’ বলে উপরে চলে যায়৷ রুমে এসে পুরো রুমে কোথাও পুষ্পিকে দেখতে না পেয়ে প্রথমে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়৷ আস্তে আস্তে উচ্চারণ করে, “পুষ্প!”
পরে বারান্দায় চোখ যেতে নিশ্চিত হয়। পুষ্পি টের পায় শাহরিয়ার এসেছে। সে দ্রুত চোখ-মুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। তবে বারান্দা থেকে সরে না সে। ওখানে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রয়।
শাহরিয়ার রোজকারকার মতো ওয়াশ রুমে যায়। ফ্রেশ হয়, পোশাক পরিবর্তন করে, একটা টি-শার্ট আর টাওজার পরে। বারান্দায় তাকিয়ে পুষ্পিকে তখনও ওখানেই দেখতে পায়। নিজের ভেতর অপরাধ বোধ কাজ করে। অনেক বাজে বাজে ব্লেইম করেছে সে তার এত ভালো বউটাকে। নিজেকে নিজে গালি দেয়, ‘নির্বোধ, গর্ধব, গাধা’ বলে। নিজে কিছু যাচাই-বাছাই না করেই এমন জঘন্য রিয়্যাক্ট করেছে! তার চাইতে বড়ো বিষয় পুষ্পিকে সে অবিশ্বাস করলোই বা কি করে? ওর মতো মেয়ে, যে কিনা জলের মতো স্বচ্ছ! নিজে এত এতবার ভুল করার পরও হাসি মুখে সব সয়ে নিয়েছে যে, তার প্রতি এটুকু আস্থা রাখা গেল না? একটু ধৈর্য ধরা গেল না? এত অধৈর্যশীল!
মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছে শাহরিয়ারের৷ কাল থেকে এত প্রেশার যাচ্ছে ব্রেইনে, ব্যাথা করাটাই স্বাভাবিক।
কলেজ থেকে আসার পর প্রত্যেকদিন পুষ্পি হুলুস্থুল কান্ড বাধিয়ে ফেলে; কি লাগবে, না লাগবে ভেবে। কখনো কখনো মাথা ব্যাথা করে শুনলেই ঠান্ডা শাসন শুরু করে দেয়। ‘এত প্রেশান দেন কেন, ব্রেইনে।’ ‘সারাক্ষণ পড়া, পড়া আর পড়া!’ ‘এত বই পড়লে তো মাথা ব্যথা করবেই!’ ‘মাথাটাও ঠিক মতো মুছতে জানেন না! দেখি, আসুন তো, মুছে দেই।’ ‘আমার একটা কথাও শুনতেন যদি আপনি!’ ‘চা খাবেন? চা করে দেই?’
আজ এসবের কিছুই হলো না। শাহরিয়ার চুল থেকে ফোঁটাফোঁটা পানি ঘাড় গড়িয়ে পড়ে।
চায়ের কথা মনে পড়ায় ভাবল, আজ সে চা বানাবে৷ যেই ভাবনা, সেই কাজ।
তবে রান্নাঘরে যেতেই সাবেরী খাতুন প্রশ্নবিদ্ধ করলেন।
“কিরে বাপ? পুষ্পি কই? তুই এসেছিস কেন এখানে?”
শাহরিয়ার বলল, “আমার আসা নিষেধ নাকি মা? পুষ্পর শরীর ভালো না। তাই আমি ওকে আজ চা করে খাওয়াবো।”
সাবেরী খাতুন বললেন, “কি বলিস? শরীর খারাপ! কি হয়েছে?”
শাহরিয়ার চা বসাতে বসাতে বলে, “উফফ মা! এত প্রশ্ন করো না তো। আমার বউকে আমি চা করে খাওয়াতে পারি না? তুমিই তো বলেছ, আমি ভালো চা বানাতে পারি, মজা হয়। তো পুষ্পর থেকে সার্টিফিকেট নিতে হবে না বলো?”
সাবেরী খাতুন একগাল হেসে ছেলের গালে হাত রেখে বলে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই৷”
বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। শাহরিয়ার চা বানিয়ে দুটো মগে ঢেলে নিয়ে উপরে এলেন। রুমে এসেই সরাসরি বারান্দায় চলে গেল। গলা খ্যাকাড়ি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করল। বিশেষ লাভ হয়েছে বলে মনে হলো না। একটা মগ পুষ্পর দিকে এগিয়ে দিয়ে কাজী নজরুলের একটা কবিতার দুটো লাইন বলল,
“বাহির আমার পিছল হলো,
কাহার চোখের জলে?
স্মরণ ততই বারণ জানায়,
চরণ যত চলে!”
পুষ্পি বলে, “চা খাবো না।”
শাহরিয়ার বলে, “এত রাগ হয়েছে? যদিও হওয়াটাই স্বাভাবিক। এত বড়ো স্টুপিড আমি!”
এরপর পুনরায় চায়ের মগ এগিয়ে দিয়ে বলে, “রাগ তো আমার উপর হয়েছে, চা কি ক্ষতি করলো? চা-টা নাও প্লিজ! আমি বানিয়েছি। তোমার জন্য।”
পুষ্পি শাহরিয়ারের দিকে চায়। শাহরিয়ার খানিক বিস্মিত হয়। চোখ দুটো ফুলে আছে, নাক লাল হয়ে আছে, কান্না স্পষ্ট চোখের কোনায়।
শাহরিয়ার বলে, “কেঁদেছ তুমি?” বলতে বলতেই পুষ্পির গালে হাত রাখে শাহরিয়ার। এক ফোটা জল এসে শাহরিয়ারের হাতে লাগে৷ এই অশ্রু মোটেও অভিমানের নয়। এই অশ্রু পুষ্পির নিজের প্রতি নিজের রাগের, এই অশ্রু শাহরিয়ারকে অসম্ভব কিছু কথা প্রতিত্তুর করতে না পারার অপারগতার, এই অশ্রু পুষ্পির নিজেকে নিজে যথার্থ সম্মান দিতে না পারার৷
পুষ্পি এক হাতে শাহরিয়ারের হাত নামিয়ে দেয়। এরপর খুব দৃঢ় কন্ঠে বলে, “আপনি কত দ্রুত সব ভুলে যান, না? ইশশ! আমিও যদি পারতাম এমন!”
শাহরিয়ার কথা খুঁজে পায় না৷ কাল সে যা করেছে তার জন্য আরও ভয়ানক কিছু আছে, এটা সে বুঝতে পারে স্পষ্ট।
পুষ্পি ভেতরে চলে যেতে চাইলে শাহরিয়ার পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আটকায়। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে খুব অনুনয়ের স্বরে বলে, “মাফ করে দাও। আই এম স্যরি। এক্সট্রিমলি স্যরি। রাগ হলে আমার কি যেন হয়! আবলতাবল বলে ফেলি। আমি তখন নিজের ভেতর থাকি না। আমি কাল যা বলেছি সব রাগের মাথায় বলেছি, ট্রাস্ট মি! এবং এও স্বীকার করছি, ভুল বলেছি আমি। আমি একটা স্টুপিড। ভুল হয়েছে আমার। স্যরি!”
পুষ্পি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। শাহরিয়ারের দুই হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, খানিকটা সরে দাঁড়ায় শাহরিয়ার কাছ থেকে। তারপর ওর দিকে ঘুরে খুব তীক্ষ্ণ আঘাত হানার মতো করে বলে, “মিস্টার শাহরিয়ার, আমি আপনার কাছে যতটা সস্তা হয়ে গিয়েছি, আপনার স্যরিও আমার কাছে ঠিক ততটাই সস্তা হয়ে গিয়েছে৷ ”
কথাটা বলেই রুমের ভেতর চলে গেল। বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির আঁচ এসে শাহরিয়ারের গায়ে লাগে। চায়ের মগটা বারান্দার কার্নিশে রেখে পুষ্পির যাওয়ার প্রান্তে তাকিয়ে থাকে সে। ছোট একটা বাক্য বলেছে মেয়েটা। কিন্তু মস্তিষ্ক এবং মনে আঘাত হানার মতো; কি কঠিন একটা কথা বলেছে, যদি জানতো মেয়েটা! ইশশ!
(চলবে)…..
#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৬
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
শাহরিয়ার বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়ায়। বাহিরের ঝুম বৃষ্টির ছাট এসে গায়ে লাগে, চোখে লাগে, মুখে লাগে। মনের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। অনুতাপের অস্থিরতা। নিজের স্যরি পুষ্পির কাছে মূল্যহীন কিংবা সস্তা হয়ে গিয়েছে, এ কথাটা যতটা না পিড়া দিয়েছে, তার চাইতে বেশি আত্মগ্লানিতে ভোগাচ্ছে, পুষ্পি নিজেকে ওর কাছে সস্তা ভাবছে; এই ভাবনা। শাহরিয়ার নিজের মাথা এবং গালে হাত বুলাল। বিড়বিড় করে বলল, “গাধা একটা আমি!”
পুষ্পি নিচে এসে পড়ে। সাবেরী খাতুন আহ্লাদিত হয়ে পুষ্পিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তুমি এলে মা? শাহরিয়ার বৃষ্টির সময় খিচুড়ি খেতে খুব পছন্দ করে। ছোট বেলা কি করত জান? বাহিরে বৃষ্টি হতে দেখলে খিচুড়ি খাওয়ার আবদার জুড়ে দিত।”
তারপর মুখে একরাশ হাসির রেখা এঁকে বললেন,”এতকাল আমি করে খাইয়েছি, এখন দায়িত্ব তোমার।”
পুষ্পি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মুখে অনিচ্ছাকৃত হাসি। মনে এক ফোটা শান্তি নেই। নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে, সয়ে যেতে যেতে আর আপস করতে করতে এতটা পথ এসে বড্ড ক্লান্ত লাগছে তার। আজকাল শরীরটাও খারাপ লাগছে, সেই কথা বলে না সে কাউকে। লাগুগ খারাপ, কিছু মানুষের ভালো লাগতে নেই কখনো।
পুষ্পি খিচুড়ির প্রস্তুতি করতে থাকে। সাবেরী খাতুন সহায়তা করে। আকস্মিক একটা প্রশ্ন করে বসে, “মা? কাল রাতে তোমাদের রুম থেকে মনেহয় আওয়াজ পেলাম! সকালে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিসের আওয়াজ হয়েছিল?”
পুষ্পির চোখের সামনে গতরাতের সমস্ত ঘটনা মনে পড়তে থাকে। কানে বাজতে থাকে প্রতিটা শব্দ! পুষ্পির ভীষণ কষ্ট হয়। বেখেয়ালে গরম তেল ছিটকে হাতে পড়ে। কিন্তু নিরবে সব সয়ে যাওয়া মেয়েটা, এবারও নিরব রইল। আর্তনাদ তো করলোই না বরং কাজের গতি বাড়িয়ে দিল।
সাবেরী খাতুনকে জবাব দিল, “তেমন কিছু হয়নি মা। কাচের গ্লাসটা পড়ে ভেঙে গিয়েছিল।”
সাবেরী খাতুন বললেন, “সেই সাথে আমি শাহরিয়ারের খানিক চেঁচামেচিও শুনতে পেলাম মনে হলো!”
এবার পুষ্পি চুপ করে রইল। কি বলবে সে? কিছু তো বলার নেই।
সাবেরী খাতুন বোধহয় কিছু আঁচ করতে পারলেন। তিনি পুষ্পির কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বুঝেছি। এসব একটু আকটু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। স্বাভাবিক। তুমি মন খারাপ করো না। আমার ছেলেটা একটু কেমন জানি! যখন ভালো, তখন সে অত্যাধিক ভালো, যত্নশীল, বুঝদার। কিন্তু রেগে গেলেই মুশকিল। ভালো মন্দের বোধবুদ্ধি থাকে না। সাংঘাতিক মরিয়া হয়ে ওঠে।”
এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “কেমন ফাজিল ছেলে, তোমার মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের সাথে রাগারাগি করে! একদম ছেড়ে দিবে না বুঝলে? অন্যায় আচরণ করলে অবশ্যই প্রতিবাদ করবা। একটা বললে, দুইটা বলবা। আমার ছেলে তো কি হয়েছে? অন্যায় সবার বেলাতেই অন্যায়, ছেলে বলে সাতখুন মাফ করে দেব, তা হবে না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা কোনো খারাপ কিছু না।”
সাবেরী খাতুন হয়তো আরো কিছু বলত। কিন্তু ভেতর থেকে মুনমুনের ডাক আসায়, তিনি প্রস্থান নিলেন। অথচ তিনি জানলেন না, একটার বিপরীতে দুইটা বলে প্রতিবাদ না করেও, নিরবতা কী ভীষণ কঠিন প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চিৎকার-চেচামেচি না করেও, খুব শীতল স্বরে কী ভয়ংকর কথার বান ছুড়ে দেয়া যায়!
রাতের খিচুড়ি সবাই ভিষণ মজা করে খেল। বেশি সুনাম করলেন শ্বশুর মশাই। খুব আয়েশ করে খেতে খেতে বললেন, “আম্মাজান? আপনাকে আমি দশে বারো দিলাম। টু প্লাস পয়েন্ট। অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছে।”
মুনমুনও বাপের সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “আই এম এগ্রি উইথ ইউ বাবা। ভাবি ইজ জিনিয়াস।”
শাহরিয়ার মৃদু হাসল। তবে কোনো কমপ্লিমেন্ট দিল না তখন। সে বোধহয় একটু একটু ভয় পাচ্ছে পুষ্পির নিরব রাগকে। প্রতিবাদ না করেও যেন নিরব ঘৃণা করছে মেয়েটা তাকে। অপরাধের মাত্রা অতিক্রম করে ফেলার ভয়ে অস্থির লাগে মন।
শাহরিয়ার কিছু বলছিল না দেখে সাবেরী খাতুনই বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “এই বদমাইশ? তুই চুপ করে আছিস কেন? তোর জন্য এত কষ্ট করে রেঁধেছে মেয়েটা, আর তুই ফাজিল চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছিস।”
শ্বশুর মশাই বললেন, ” আহা! তুমি তো বিষয়টা বুঝলে না! ছেলে আমার তার বউয়ের হাতের এমন সুস্বাদু রান্না খেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে, যেমনটা বিয়ের প্রথম প্রথম আমি তোমায় রান্না খেয়ে হতাম!”
বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন। সাবেরী খাতুন অস্বস্তি বোধ করলেন এবং কপট রাগ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকালেন। তবে এতে তার কিছু এলো-গেলো বলে মনে হলো না। সে সানন্দে হেসেই যাচ্ছিল।
শাহরিয়ার ছোট করে কেবল বলল, “অনেক মজা হয়েছে।”
বলতে বলতে আড়চোখে পুষ্পির দিকে তাকাল। কিন্তু পুষ্পির ভাবভঙ্গি দেখে মনেই হলো না, শাহরিয়ার কোনো কথা তার কাছে পৌঁছেছে। কিংবা পৌঁছালেও বিশেষ গুরুত্ব পেল না যেন। সে তার নিজ কাজ করছে। সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। শাহরিয়ারের দিকে একবারও তাকাচ্ছে না।
খাবার খেয়েই শাহরিয়ার রুমে চলে গেল। তার মা-বাবাও চলে গেলেন তাদের রুমে। পুষ্পি কিছুক্ষণ নিচে রইল। হঠাৎ করেই মুনমুন জিজ্ঞেস করল, “ভাবী? তোমার মন খারাপ?”
এই এক যন্ত্রণা না! মন খারাপের সময়, ‘মন খারাপ কিনা’ জিজ্ঞেস করলে আরো বেশি খারাপ হয়ে যায় মন। সাথে একটু কান্না কান্না পায়। পুষ্পি হাসার চেষ্টা করে বলল, “না। তুমি ঘুমাবে, নাকি পড়বে?”
মুনমুন বলে, “তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছ ভাবী! আমি জানি, তোমার মন খারাপ।”
পুষ্পি বলে, “না, মন খারাপ না। মাথা ব্যথা করছে। ভাবছি, চা করবো। তোমার জন্য দিব?”
মুনমুন দু’পাশে মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানায়৷ কিন্তু সে জানে, তার ভাবীর মন একটুও ভালো নেই। পুষ্পি উঠে যাওয়ার সময় মুনমুন পুষ্পির হাত ধরে। খুব মায়া করে বলে, “আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি ভাবী। ইউ আর দ্যা বেস্ট। ভাইয়ার থেকেও বেস্ট। ভাইয়া তোমার কাছে ফেইল।”
পুষ্পির মনের বিষন্নতা অনেকখানি কাটিয়ে দেয় মেয়েটা এই দুটো বাক্য বলে।
পুষ্পি মুনমুনের গালে হাত রেখে বলে, “ইউ আর দ্যা প্রিটিয়েস্ট।”
এই ছোট কনভারসেশন এর শেষে দুজনের মুখে চমৎকার হাসির রেখা ফুটে ওঠে। পুষ্পি চা করে আনার পর দুই ননদ-ভাবী মিলে কুটকুট করে আরো কিছু কথপোকথন চালিয়ে যায়। দুজনের হাসি মুক্ত দানার মতো ঝড়ে ঝড়ে পড়ে। খুব সুন্দর এই দৃশ্য।
পুষ্পি রুমে এসে দেখতে পায় শাহরিয়ার বুকসেল্ফে কিছু খুঁজছে। অন্য সময় হলে হয়তো জানতে চাইত, কি খুঁজছে। তারপর মূহুর্তের মাঝে খুঁজে বের করে দিত। তারপর তার বিশ্বজয় করা হাসি। তবে এই মূহুর্তে কিছুতেই তার সেই জানার আগ্রহটুকু জন্মায়নি। বারান্দার দরজা খোলা ছিল, সে গিয়ে সেটা আটকে দিল। জানালা আটকালো। শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করে, “পুষ্প, আমার ‘দ্যা গার্ল আই লাভ’ বইটা দেখেছো? পাচ্ছি না।”
পুষ্পি শাহরিয়ারের দিকে না ফিরেই জবাব দিল, “না।”
শাহরিয়ার আবদার করে বলে, “একটু খুঁজে দিবা?”
পুষ্পি বলে, “না।”
শাহরিয়ার খোঁজা বন্ধ করে থেমে দাঁড়ায়। ঘুরে তাকায় পুষ্পির দিকে। হাতের বইগুলো সেল্ফে রেখে পুষ্পির কাছে আসে। জিজ্ঞেস করে, “তুমি তো কখনো না বলো না! রেগে আছো বলে না বলছো?”
পুষ্পি ফ্যাকাসে হেসে জবাব দেয়, “আমার কি জীবন দেখুন! নিজের কোনো ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। মতামতের কোনো মূল্যায়ন নেই। জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে কেবল কৈফিয়ত, কৈফিয়ত আর কৈফিয়ত!”
শাহরিয়ারের বিস্মিত হওয়া ব্যাতিত আর কিছুই বলার নেই যেন। সে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে কেবল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর খুব বিনয়ী হয়ে ডাকে, “পুষ্প!”
পুষ্পি বলে, “যার পৃথিবীতে মা নেই, তার পৃথিবীতে আপন কেউ থাকে না। সবাই তখন ওঁৎ পেতে থাকে, অপমান আর অপদস্ত করার জন্য। আমি না এই কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম!”
শাহরিয়ার এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। খুব বেশি আত্মগ্লানিতে ভেসে যায় মন। দু’হাতে৷ টেনে নেয় পুষ্পিকে। তারপর খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পুষ্পি কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। অপমানের তার সমস্ত মন ভার হয়ে রয় তখনও। জীবনে কম মানুষের কম কথা শোনেনি, কম অপমানিত হয়নি। কিন্তু এই মানুষটাকে সে কেমন করে বোঝাবে, যতটা কষ্ট সে তার মাধ্যমে পেয়েছে, এমন কষ্ট সে অন্য কারো দ্বারা পায়নি। অপ্রত্যাশিত সকল কিছুই বোধহয় মানুষকে ব্যকুল করে দেয়। সেই প্রথম দিনের শাহরিয়ার, একদম অপরিচিত একটা মানুষ, তার মতো সব-হারা মেয়েটাকে আগলে নিল কেমন মায়া করে! তারপর ধীরে ধীরে কেমন একটা প্রত্যাশার জায়গা গড়ে নিল মনে। প্রশ্রয়ে মনের সকল প্রনয়ন নিংড়ে দিতে লাগল উজাড় করে। কী যে সুখের দিন গেল কয়েকটি দিন। পুষ্পির কেবলই মনে হতো, নিজের একটা মানুষ থাকা এত সুখে!
এরপর অসুখের আর মন ভাঙার দিন। ধীরে ধীরে একের পর এক ধাক্কা শাহরিয়ারের তরফ থেকে, একটু একটু করে গুড়িয়ে দিতে লাগল যেন সেই সুখ! জীবনে ভালোবাসার অভাবে বড়ো হওয়া মেয়েটার মনে ভালোবাসা হারানো ভয় হলো। এরপর তো এমন দিন এল যে, সমস্ত তাকে বিলিন করে দিল, চরিত্রে কলঙ্গ লেপন করে দিয়ে! কেমন করে সইবে এই বেদনা, এই অপমান!
পুষ্পি কাঁদতে কাঁদতেই শাহরিয়ারকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল। দু হাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। এমন জোয়ান বলিষ্ঠ পুরুষ মানুষের সাথে সে পেরে ওঠে কেমন করে? সে যতই ছাড়াতে চায়, শাহরিয়ার ততই যেন শক্ত করে ধরে।
পুষ্পি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, “ছাড়ুন আমায়, ছাড়ুন। যেই চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেছেন, সেই চরিত্র বহনকারী মেয়েকে ছুঁবেন না। দয়া করে ছাড়ুন আমায়। দম বন্ধ লাগছে আমার।”
শাহরিয়ারের কষ্টে বুক ফেটে যায়। আরও কঠিন শাস্তির যোগ্য সে। সত্যিই তো! এমন জঘন্য অপরাধ সে করল কেমন করে! সে পুষ্পির মাথাটা বুকে চেপে রেখে বলে, “ছাড়ব না। কক্ষনো না, কিছুতেই না। আমার বউ, আমার অভিমানিনী, আমি এমন করেই ধরে রাখবো তোমায়। যেই মুখে আমি আমার ফুলের মতো পবিত্র বউয়ের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, আমার সেই মুখ ঝলসে যাক।”
পুষ্পির অঝোরে কান্না! সে তখনও শাহরিয়ারকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। খুব আদুরে হয়ে বলে, “না, না, না। আমি আর আপনার মায়ার কথায় গলবো না।”
শাহরিয়ার বলে, “ঠিক আছে।”
পুষ্পি বলে, “আমি আর আপনায় ভালোবাসবো না।”
শাহরিয়ার বলে, “আচ্ছা, বেসো না।”
পুষ্পির কান্না বাড়ে বৈ কমে না। সে বড্ড দুঃখ নিয়ে বলে, “আমার কেউ নেই, কেউ না। বাবা, মা, স্বামী….!”
শাহরিয়ার বরাবরের মতোই অবাধ্য হয়। বলে, “এইতো আমি আছি, থাকবো অনন্তকাল৷”
পুষ্পি বলে, “আপনি আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, আমি আপনার কথার উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছি। আপনার কথা আমার কাছে কেবলই কথার কথা মনেহয়।”
শাহরিয়ার বলে, “আমার মতো গর্ধবের জন্য উপযুক্ত শাস্তি হচ্ছে। আমি এক্সেপ্ট করে নিচ্ছি, মাথা পেতে নিচ্ছি।”
পুষ্পি বলে, “কতটা জঘন্য ছিল আপনার প্রতিটি কথা, যদি জানতেন! অমন কথা শোনার চাইতে মরন উত্তম। আমার মনে আপনার অবস্থান ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। আমি আপনাকে কক্ষনও ক্ষমা করবো না, কক্ষনও না।”
শাহরিয়ার মেনে নিয়ে বলে, “হুম, কোরো না। আমার একটা কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ।”
(চলবে)…..