একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-২৭+২৮

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৭
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

ভোররাতে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় পুষ্পির। ধরফর করে উঠে বসে। পাশের ড্রেসিং টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি পান করে। কাপড়ের আঁচলে কপাল আর গলার ঘাম মোছে। স্বপ্নটা দেখে সে শাহরিয়ারকে নিয়ে। ভয়ে রীতিমতো হাত-পা কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। শাহরিয়ারকে নিয়ে দেখা বাজে স্বপ্ন তাকে পুরোপুরি উতলা করে তুলল। খুব করে আল্লাহর নাম নিতে থাকে মনে মনে। পাশ ফিরে শাহরিয়ারের দিকে চায়। কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে! পুষ্পি এক মূহুর্তের জন্য নিজের সমস্ত রাগ-ক্ষোভ ভুলে গেল। স্বামীর প্রতি তার অসম্ভব মায়া উপেক্ষা করতে পারে না সে। শাহরিয়ারের মাথায় হাত রেখে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে।
সম্পূর্ণ অচেনা ছিল যে মানুষটা, তার প্রতি এত মায়া, এত টান, এত অধিকার বোধ কেমন করে জাগ্রত হলো মনে, তাই ভেবে বিস্মিত হয়ে যায় পুষ্পি। যেখানে জীবনের কাছে চাওয়া-পাওয়ার কিছু ছিল না, সেখানে সমস্ত জীবনটা জুড়েই যেন এই একটা মানুষের বিচরণ! পুষ্পি চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বিড়বিড় করে বলে, “আল্লাহ আপনাকে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে হেফাজত করুক।”
রাতটা এরপর তার নির্ঘুমেই কাটে। তাহাজ্জুদ পড়ে, বারান্দায় পায়চারী করে, শাহরিয়ারের মাথার কাছে এসে খানিক বাদে বাদে বসে, জিকির করে, দোয়া-দরুদ পড়ে। ফজরের আজান দিলে নামাজ পড়ে, কিছুক্ষণ কোরআন মাজিদ পড়ে নিচে যায়, নাস্তা তৈরি করতে। নামাজ-কালাম পড়ার পর মনটা একটু স্থির হয়েছে।

ভোরের আলো পরিপূর্ণ ভাবে ফোটেনি তখনও। তবে একটা-দুইটা পাখির ডাক ভেসে আসছে। পুষ্পি দরজা জানালাগুলো খুলল প্রথমে। সাবেরী খাতুনও রুম থেকে বের হয়েছে। ফজরের সময়টাতে মোটামুটি সবাই সজাগ হয়ে যায়। মুনমুনকে যদিও একটু ডাকাডাকি করে উঠাতে হয়। সে দ্বায়িত্ব থাকে হাসনাত সাহেবের। তিনি জামাতে যাওয়ার পূর্বে মেয়ের দরজায় নক করে ডাকে, “মা! উঠে পড়। নামাজ আদায় করো। ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ওঠো।”
মুনমুন কিচ্ছুক্ষন অলস হয়ে থেকে বাবার অনবরত ডাকে উঠে পড়ে। বলা বাহুল্য না উঠে পারেই না।
মেয়েকে উঠিয়ে দিয়ে শাহরিয়ার এবং তিনি দুই বাপ-বেটা একত্রে মসজিদে যায়।
এই পুরো সময়টা খুব সুন্দর, মনোরম এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ।
প্রত্যেক দিনের এই কর্মকান্ডের ব্যাতিক্রম আজও ঘটল না।
শাহরিয়ার পোশাক পালটে মাথায় টুপি পড়ে নিচে এলো। রোজকারকার মতো রান্নাঘরে দিকে একবার চোখ বুলাল। পুষ্পি রুটি বানানোর জোগাড়জান্ত করছে। সবাই কাজে যাবে, কেউ যেন অভুক্ত না বের হয় সেদিকে ভীষণ সতর্ক সে। এমনকি কেউ যদি কখনো না খেয়ে বের হতে চায়, পুষ্পির জন্য শেষ অব্দি সফল হতে পারে না সে৷ এছাড়া বলার আগেই সব প্রস্তুত করে রাখে সে। এত পাংচুয়াল মেয়েটা। কখনও এদিক-সেদিক হয় না তার রুটিনের।

শাহরিয়ার একটা তৃপ্তিদায়ক হাসি দিয়ে মাথার টুপিটা ঠিক করল। হাসনা সাহেবও ওজু করে বেড়িয়েছে। শাহরিয়ার বলল, “আব্বা, চলো।”
হাসনাত সাহেব বললেন, “চল।”

উনারা বেরিয়ে পড়লেন। এদিকে পুষ্পি সাবেরী খাতুনকে রান্নাঘরে ঘেঁষতেও দিল না। একা একা সব করতে লাগল। সাবেরী খাতুনের শরীরটাও খুব একটা ভালো না, তাই আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা।

নামাজ আদায় শেষে দুই বাপ ছেলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করে। তারপর হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরে। আজও ব্যতিক্রম হলো না।

শাহরিয়ার হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে হাসনাত সাহেবকে জিজ্ঞেস করে, “আব্বা? একটা প্রশ্ন করি?”
হাসনাত সাহেব জবাব দেয়, “নিশ্চয়ই।”

শাহরিয়ার একটু ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করে, “জীবনে একজন উত্তম জীবনসঙ্গী পাওয়ার থেকেও উত্তম কোনো নেয়ামত আছে আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে?”
হাসনাত সাহেব খুব ধীরস্থির ভাবে জবাব দেয়, “খুব দারুন একটা প্রশ্ন করেছ। তবে মানুষের জন্যে তো আল্লাহর নেয়ামতের শেষ নেই। অসংখ্য নেয়ামত আমরা আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে পেয়ে থাকি। আর উত্তম সঙ্গীর চেয়ে, উত্তম নেয়ামত আর কি-ই বা হতে পারে বলো? দুনিয়া এবং আখিরাতের জীবনের জন্যেও যে আল্লাহর তরফ থেকে প্রশান্তি বয়ে আনে, তার জন্য তো আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যায় না। তার সাথে তো অনন্তকাল পারি দেয়া যায়। সে তো অবশ্যই সর্বত্তম নেয়ামত।”

শাহরিয়ারের খুব শান্তি শান্তি লাগে কথাগুলো। সে ছোট করে জবাব দেয়, “হুম।”

এরপর বাকি পথ হাসনাত সাহেব যদিও গুনগুন করে নাতে রসূল গায়। তবে শাহরিয়ার চুপচাপ হাঁটে আর পুষ্পির কথা ভাবে। ইদানীং তার অবসরের সিংহভাগ সময় পুষ্পির ভাবনাতেই কাটে। পুষ্পিকে এখন সে মোটেও দায়বদ্ধতা থেকে ভালোবাসে না, কাছে টানে না, মায়াময় কথা বলে না, যেটা সে বিয়ের প্রথম প্রথম করতো। এখন সে যা করে পুরোটাই আসে ভেতর থেকে, অন্তরের অন্তস্তল থেকে। অদ্ভুত একটা মায়া কাজ করে। কেমন যেন পবিত্র টান অনুভব করে। মেয়েটার সামান্য মন খারাপ, দুঃখ-কষ্ট অসম্ভব বিচলিত করে। চারুর কথা তার একবিন্দুও মনে আসে না। গ্রাম থেকে ফেরার পর তো একদমি না। বরং গ্রাম থেকে ফেরার পর থেকে পুষ্পি তার আরো বেশি আপন হয়ে উঠেছে।
সে জানে পুষ্পি এবার তার কথায় অনেক আঘাত পেয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে সে নিজেও জানে না, সে এত কেন রিয়্যাক্ট করেছে। চারু যখন ওর সাথে সম্পর্ক ভাঙনে কথা বলেছিল, তখনও এত রিয়্যাক্ট করেনি, বলা বাহুল্য কোনো রিয়্যাক্ট-ই সে তখন করেনি, আপসে মেনে নিয়েছিল সবটা। কিন্তু মাহদীর কথায় পুষ্পির প্রতি তার এই রিয়্যাকশনটা অবিশ্বাসের চাইতেও বেশি ছিল, কতটা সে পুষ্পিকে নিয়ে পসেসিভ, পুষ্পিকে নিয়ে সে কখনোই আপস করতে পারবে না। পুষ্পি তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি! পুষ্পির দ্বারা এমন কাজ করা কখনও সম্ভব নয়; এ ধারণা, এ বিশ্বাস ছিল বলেই, মাহদীর দেয়া ফটোশোপ করা পিকচার আর ফেইক কনভারসেশন গুলো তাকে বেশি উতলা করে দিয়েছিল, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করে দিয়েছিল।
তবে শাহরিয়ার এও বুঝতে পারছে, তার অবিশ্বাস পুষ্পিকে কতটা আশাহত করেছে, কতটা আঘাত দিয়েছে। এবিং এমন পরিস্থিতি গ্রহণ করা পুষ্পির জন্য কতটা কঠিন! আর সে কারণেই পুষ্পির সকল কথা এখন সে আপসে মেনে নিচ্ছে, সয়ে নিচ্ছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, পুষ্পি তার জীবনে নেয়ামত হিসেবে এসেছে।

বাসায় ফিরে শাহরিয়ার নিজের রুমে যায়। রোজকারকার মতো গোসল সারে। পোশাক পরে তৈরি হয়। পুষ্পিও নাস্তা তৈরি করে রুমে আসে। ধীরস্থির ভাবে শাহরিয়ারকে বলে, “আসুন, নাস্তা করবেন।”
শাহরিয়ার চুল আঁচড়াচ্ছিল। পুষ্পির কন্ঠ শুনে ওর দিকে চাইল। চুলগুলো হাত দিয়ে গোছ করে পুষ্পির কাছে আসে। স্বভাবসুলভ পুষ্পির মাথার একপাশে হাত রেখে বলে, “এসেছ, ভালো হয়েছে। করবো নাস্তা। তবে তার আগে তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল আমার।”
পুষ্পি শাহরিয়ারের হাত সরিয়ে দেয়। এমনকি তার দৃষ্টি নত। অর্থাৎ বোঝাতে যায়, কিছু সে শুনতে চায় না।
অবাধ্য শাহরিয়ার পুনরায় হাত রাখে। খুব ধৈর্য নিয়ে বলে, “আমি জানি, তুমি রেগে আছো। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু পুষ্প, তুমি আমাকে যেভাবে ভাবছ, আমার রিয়্যাকশন যেভাবে নিচ্ছ, তোমার নেওয়ার পদ্ধতিটা পুরোপুরি ঠিক নয়। সে যাইহোক, আমি নিজেকে জাস্টিফাই করছি না। তোমার যতদিন ইচ্ছে রাগ করে থাকো, আমাকে বকা দাও, যা ইচ্ছে করো। যতদিন রাগ না পড়বে, যেভাবে ইচ্ছে বিহেইভ কর। আমার কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু প্লিজ এই ধারণাটুকু দ্বিতীয়বার মনে এনো না, তুমি আমার কাছে মূল্যহীন! এই কথাটা আমায় ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। তুমি আমার কাছে সবচাইতে মূল্যবান! এতই মূল্যবান যে, আজকাল আমার সমস্ত আমিটাকে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তোমার কাছে। পুষ্প, ইউ আর মাই সানফ্লাওয়ার। আই লাভ ইউ ইনফিনিটি। ডোন্ট হেইট মি, প্লিজ!”

শাহরিয়ার নিচে চলে আসে। পুষ্পি দাঁড়িয়ে থাকে। কি অদ্ভুত এক সম্মোহনী পাওয়ার আছে লোকটার মাঝে। ম্যাজিকের মতো সব দুঃখ দূর করে ফেলেতে পারে কথা দিয়ে।
কাল রাত থেকেই পুষ্পির চাপা অভিমান-অভিযোগ একটু একটু করে পড়তে শুরু করেছে, সকালের দুঃস্বপ্ন মন আরো অনেকখানি নরম করে দিয়েছে। নিজেকে অনেকটা হালকা লাগছে। তবে পুরোপুরি ক্ষমা সে তার স্বামীকে করতে পারছে না, এটাই সত্য।
যাওয়ার আগে শাহরিয়ার বাইকের চাবিটা চেয়েছিল। বাসে করে যেতে তার অসুবিধা হচ্ছে, আর অনেক সময়সাপেক্ষ মনে হচ্ছে। কিন্তু পুষ্পি কিছুতেই চাবি দিচ্ছে না। আজও দিল না। শাহরিয়ার চাইল আর পুষ্পি ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ব্যাস শাহরিয়ারের মুখ বন্ধ। সে বাধ্যছেলের মতো বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, দিতে হবে না। বাসেই যাব, আসব। আগুনে ঘি ঢালতে চাই না।”
পুষ্পির একটুখানি হাসি পেলেও হাসলো না।

সকাল নয়টার ভেতর মোটামুটি সবাই বেড়িয়ে যায়। থাকে কেবল সাবেরী খাতুন আর পুষ্পি যেদিন কলেজ যায় না সেদিন সেও থাকে। এছাড়া সেও দশটার ভেতর বেড়িয়ে যায়।
সামনে এক্সাম, তাই সে ঠিক করে আজ কলেজ যাবে। কিন্তু কলেজ এসে তার মন-মেজাজ পুনরায় খারাপ হয়ে যায়। কলেজ গেইটে ঢুকতেই দেখা হয় মাহদীর সাথে। পুষ্পি এড়িয়ে যেতে চাইলেও মাহদী বাঁধা দেয়। সে পথ আটকে বলে, “আমার কথা শোনো একটু?”

পুষ্পি বলে, “সামনে থেকে সরো।”

মাহদী বলে, “বিশ্বাস করো, আমি ইন্টেনশনালি কিছু করিনি। আমার তোমাকে সত্যি খুব ভালো লাগে, সেই স্কুল লাইফ থেকে। কিন্তু কখনো বলতে পারিনি। যখন তোমায় অনেকদিন পর আবার কলেজে দেখতে পেয়েছিলাম, জানোনা কত খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু এরপর যেদিন জানলাম, তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। প্লিজ কথা বলা অফ করো না আমার সাথে!”
পুষ্পির রাগে দম আটকে আসে। বেশ কয়েকটা থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করে মাহদীকে। কিন্তু এ কাজ কখনোই সম্ভব নয় তার দ্বারা। তাই খুব ক্ষিপ্রতার সহিত বলে, “তোমার মতো নিকৃষ্ট, নিচুমানের ব্যাক্তি আমার সামনে আর দু সেকেন্ড থাকলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে আমার। সরে যাও সামনে থেকে। তোমার সাথে কথা বলার রুচি নেই আমার।”

মাহদী ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, “ও! আমি নিকৃষ্ট, না? আর তোমার ওই মাস্টার বর? সে খুব ভালো, মহান, না? মাথায় তুলে রাখছে তোমায়?”

পুষ্পির আর এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য কুলায় না। সে খুব দ্রুত গতিতে মাহদীকে এড়িয়ে একপাশ হয়ে নিজের ভবনের দিকে এগিয়ে যায়। আর মনে মনে আফসোস করতে থাকে, কেন এলো কলেজে!

ক্লাসে এসে চুপচাপ বসে থাকে। লেকচারে মন নেই তার। কিছুই নোট করছিল না। বিষয়টা নোটিস করলো তাহুরা। সে চুপিসারে জানতে চাইল, “কি ব্যাপার? মন খারাপ তোমার?”
পুষ্পি না সূচক মাথা নাড়ায়। তাহুড়া জানতে চায়, তাহলে? এমন অন্যমনস্ক হয়ে আছো কেন?
পুষ্পি জবাব দেয়, “এমনি।”
তাহুরাও আর জোর করে না। কারণ সে জানে, পুষ্পির স্বইচ্ছা ব্যাতিত তার মুখ থেকে কিছু বের করা সম্ভব নয়। যখন ইচ্ছে করবে, নিজ থেকেই বলবে।

পুষ্পি একটা ক্লাস করেই বাসায় ফেরত এলো। মনটা খুব অস্থির অস্থির লাগছে তার। সকাল থেকেই এমন লাগছিল, ক্রমশ যেন অস্থিরতা বাড়ছে! সাবেরী খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার মা? আজ এত দ্রুত চলে এলে!”

পুষ্পি বলল, “ভালো লাগছে না মা। আপনার ছেলেকে একটা কল দিবেন?”

সাবেরী খাতুন বললেন, “একটু আগেই কথা হলো। তোমার কথা জিজ্ঞেস করল, কলেজ গিয়েছ কিনা জানতে চাইল। তোমার সাথে কথা হয়নি? ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ কেন?”

সাবেরী খাতুনের সাথে কথা হয়েছে শুনে একটু স্থির হলো মনটা। জবাব দিল, “এমনি, মা। কিছু হয়নি।”
বলেই উপরে চলে এলো। ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে, নামাজ পরে, অল্প করে খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল আছরের পর। আছর নামাজ পরে নিচে এলো। সবাই ড্রয়িংরুমে, হাসনাত সাহেব, সাবেরী খাতুন, মুনমুন। হাসনাত সাহেব খবর দেখছিলেন। পুষ্পিকে দেখে বললেন, “আরে আমার আম্মাজান! আসেন আসেন, এখানে বসেন।”

পুষ্পি হাসিমুখে পাশের সোফাটায় বসে। পুষ্পি নিজের জন্মদাতা পিতার থেকে যেই ভালোবাসা পায়নি তার সমস্তটাই যেন এই ভদ্রলোক উশুল করে দিয়েছেন। জীবনে পিতার ভালোবাসা সত্যিকার অর্থে আস্বাদন করতে সহায়তা করছে। তাকে যখন ‘আম্মাজান’ বলে ডাকে, মনেহয় যেন নিজের বাবা!
মুনমুন কিছুটা আশাহত’র সুরে বলে, “ভাইয়া বলেছিল, আজ মাগরিবের আগেই চলে আসবে। মাগরিবের পর আমাদের নিয়ে ঘুরতে বের হবে। কই, এখনও তো এলো না! শুধু শুধু মিথ্যা আশ্বাস দেয়।”

শাহরিয়ার নাম উল্লেখ হতেই, পুষ্পির মন আবার আনচান করতে শুরু করে। বলে, “একটা ফোন করে দেখ না, কতদূর সে?”
মুনমুন গোমড়া মুখে বলে, “পারবো না। আজ প্রমিস ব্রেক করলে, কথাই শুনবো না আমি তাঁর!”

পুষ্পি কিছু বলতে যাবে এরমাঝেই হঠাৎ খবরে ব্রেকিং নিউজ আসে।
‘ঢাকায় একটি মালবাহী ট্রাকের সঙ্গে বাস সংঘর্ষে ঘটনা স্থলে নিহত হয়েছেন তেরো জন। এবং গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আরো ত্রিশজন বলে ধারণা করা যাচ্ছে।’

(চলবে)…..

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৮
#কাজী_সানিজিদা_আফরিন_মারজিয়া

এমনিতেই তো মনটা উতলা হয়ে ছিল। তার উপর ব্রেকিং নিউজটা দেখার পর থেকেই হঠাৎ পুষ্পি নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। পরিবারের সকলের সামনে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। পুষ্পির এমন আকস্মিক প্রতিক্রিয়া কেউ-ই শুরুতে হজম করতে পারেনি। সবাই ওর কাছে এগিয়ে এসে জানতে চায়, কি হয়েছে!
কিন্তু পুষ্পি নির্বিকার। সে কেবল কেঁদেই যাচ্ছে।

সাবেরী খাতুন কিছু একটা অনুমান করতে পারার মতন করে বললেন, “নিশ্চয়ই আমার বদমাইশ ছেলেটা কিছু করেছে, তাই না? আসুক আজ! ওর একদিন কি, আমার একদিন।”
হাসনাত সাহেব কিছু না বুঝতে পেরে জানতে চায়, “কী করেছে?”
সাবেরী খাতুনের জবাবের পূর্বেই পুষ্পি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, “উনি কিচ্ছু করেনি, কিচ্ছু না। মা? বাবা? প্লিজ ওনাকে একটা কল দিন। উনি আমার কল রিসিভ করছে না। মা….প্লিজ!”

সাবেরী খাতুন বলে, “আরে বোকা মেয়ে! সামান্য কল ধরছে না বলে কাঁদছো?”

মুনমুন বলে, “ভাইয়ার তো চলে আসার কথা এতক্ষণে! এখনও আসছে না কেন?”
সাবেরী খাতুন বললেন, “জ্যামে হয়তো!”

জ্যামের কথা বলতেই মুনমুনের মনে এলো, দূর্ঘটনাটার কথা। সে ইতস্তত করে বলল, “বাবা? তুমি একটা কল দাও ভাইয়াকে।”

হাসনাত সাহেব তাই করলেন। কিন্তু সেই একই কথা, ‘আপনার ডায়েল কৃত নাম্বারটিতে এই মূহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না।’

মুনমুন বলল, “বাবা আমাদের কলেজের কেয়ারটেকার আংকেলকে কল দিয়ে দেখ তো, ভাইয়া কখন বেরিয়েছে?”

মুনমুন নাম্বার এনে দেয়ার পর হাসনাত সাহেব সেখানে কল করে জানতে পারলেন, শাহরিয়ার আরো ঘন্টাখানেক আগে বেড়িয়ে গিয়েছে।

শাহরিয়ার যেই রোড দিয়ে আসে দূর্ঘটনাটা সেই রাস্তাতেই ঘটে।
মুনমুন টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দূর্ঘনার লাইভ টেলিকাস্ট এর।
এবার বাকিদের মনেও ভয়ের দানা বিধে। পুষ্পির উতলা হওয়ার কারণ ধরতে পারে। সাবেরী খাতুন বলে, “ইয়া আল্লাহ! আমার ছেলে তো এই রোড দিয়েই আসে। ও তো বাইক নিয়ে যায়নি৷ বাসেই তো আসা-যাওয়ার করে এখন।”

পুষ্পি কান্নার বেগ বৃদ্ধি পায়। মনে অহেতুক অপরাধবোধ জাগ্রত হয়, কেন সে বাইক নিয়ে যেতে দেয়নি। ভয়ে, আতংকে দম বন্ধ হয়ে আসে তার।
হাসনাত সাহেব মেকি ধমকের স্বরে বলে, “কিসব আজেবাজে চিন্তা করছো তোমরা! এসব কিছুই হয়নি আমার ছেলের। ইনশাআল্লাহ, সহিসালামতেই ফেরত আসবে দেখ।”
বলেই সে উঠে পরে। উপরে উপরে এটা বললেও, ভেতরে ভেতরে তারও ভয় কাজ করে৷ তবুও মনকে শান্তনা দেয়ার জন্য ওসব বলা। তিনি ঘটনা স্থলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
বাকি তিনটি মানুষ আতংকে অস্থির হয়ে রয়৷ সাবেরী খাতুন দোয়া-দরুদ পরে যাচ্ছিলেন মনে মনে। বড়ো আদরের ছেলে তার!
পুষ্পি বেখেয়ালি হয়ে রইল। কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছিল তার! কি করবে, না করবে; কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

এরমধ্যে হাসনাত সাহেব দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলতে গিয়ে অনুধাবন করলেন, হাত রীতিমতো কাঁপছে তার। ওই আতংক নিয়ে দরজা খুলেই খানিক চমকে উঠলেন। দেখতে পেলেন শাহরিয়ার জুতা খুলছে! যে ছেলেকে ঘিয়ে, এত ভয়, এত আতংক আর অস্থিরতা; সে জুতা খুলছে!

অপ্রত্যাশিত কিছু দেখলে মানুষ যেমন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, হাসনাত সাহেবের ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম ঘটল না। তিনি আওয়াজ করে শুকরিয়া আদায় করে, আনন্দের সহিত বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! আমার ছেলে ফিরে এসেছে দেখ!”

হাসনাত সাহেবের উচ্ছ্বাস ভেতরের সবাইকে স্পর্শ করল। ঘর হতে সকলে বেড়িয়ে এলো দোরগোড়ায়। শাহরিয়ার হঠাৎ করে তাদের উচ্ছ্বাসের কারণ ধরতে পারল না। খানিক ভ্রু কুঁচকে, কাছে এসে মা বাবা দুজনকেই সালাম দিল। এরপর জানতে চাইল, “কিছু কি হয়েছে? হঠাৎ এমন খুশি হয়ে গেলে কেন সকলে?”

মাগরিবের আযান পড়ে গিয়েছে ততক্ষণে চতুর্দিকে। হাসনাত সাহেব বললেন, “কিছু হয়নি বাপ, চল মসজিদে যাই। একেবারে নামাজ আদায় করে ঘরে প্রবেশ করি।”
শাহরিয়ার দ্বিমত করল না। দুই বাপ-ছেলে নামাজে চলে গেল। ঘরের মানুষগুলা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সাবেরী খাতুন বারংবার বলতে লাগলেন, “আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া। সকল বালামছিবত থেকে দূরে রাখুক আমার সন্তানকে।”

নিশ্চিন্তমনে নামাজ আদায় করতে গেল সকলে। একটা ঝড়ো হাওয়া ছুঁতে গিয়েও, ছুঁল না যেন তাদের!

পুষ্পির অঝোর কান্না তখনও থামেনি পুরোপুরি। সে নামাজে বসেও কাঁদে। শাহরিয়ারের প্রতি তার যত রাগ-ক্ষোভ ছিল সব নিমিষেই দূর করে ফেলে। এই মানুষটার কিছু হলে বাঁচবে কেমন করে! তাঁর প্রতি যে অগাধ মায়া! তাঁর কথা শোনার জন্য যে তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে মন! তাকে ছাড়া যে একটা মূহুর্ত কল্পনা করাও দ্বায়!

যদি মানুষটার প্রতি একটুও মনে কষ্ট রাখার জন্য, তার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়, আল্লাহ না করুক; তবে কিছু কিছুতেই তার বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না! পুষ্পি একদম ঠিক করে ফেলে, শাহরিয়ার এরপর থেকে যতই রাগ দেখাক, সে কিছুতে মনে কষ্ট রাখবে না৷ এই মানুষটা পুষ্পির সবকিছু। সকল চাওয়া-পাওয়া এখন তাকে ঘিরেই। রাগ-ক্ষোভ সয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষয়ক্ষতি সইতে পারবে না।
মোনাজাতে শাহরিয়ারের জন্য দোয়া করতে করতে ফুঁপিয়ে ওঠে সে। ‘ইয়া রব! মানুষটাকে ভালো রেখো তুমি! কখনো কোনো দুঃখ-কষ্ট যেন তাকে ছুঁতে না পায়। পৃথিবীর সমস্ত সুখ-শান্তি তার হোক। আমার সুখের সমস্ত ভাগও আমি তাকে দিলাম। ইয়া আল্লাহ, কবুল করো!”

শাহরিয়ার রুমে এসেছে যখন, পুষ্পি তখনও জায়নামাজে। তার মোনাজাত আজ যেন ফুরাচ্ছেই না! ইশশ যদি জানত শাহরিয়ার, এই সমস্ত দোয়া কেবল তার!
শাহরিয়ার পথে আসতে আসতে হাসনাত সাহেবের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনতে পেয়েছে৷ এবং এও জানতে পেরেছে, পুষ্পি কতটা উতলা হয়ে উঠেছিল, তার বিপদের কথা চিন্তা করে।
তার মন জুড়ে এখন কেবল, প্রশান্তি আর প্রশান্তি৷ অন্ততপক্ষে এই উছিলায় পুষ্পির মন তো খানিকটা গলেছে! আল্লাহ কাছে শুকরিয়া আদায় করে সে নিজেও।
তারপর শাহরিয়ার বিছানায় গিয়ে বসে। আড়চোখে পুষ্পির দিকে চায়। দিন দিন আরো বেশি সুন্দরীতমা হয়ে উঠছে তার বউ। যাকে মুগ্ধ হয়ে দেখা যায় জন্ম-জন্মান্তর! পুষ্পি জায়নামাজে বসে থেকে হাতের ইশারায় শাহরিয়ারকে ডাকে।

শাহরিয়ার জানে, এখন পুষ্পি কি করবে! মৃদুমন্দ হেসে কাছে গিয়ে বলে, “ভীতু পুষ্পরানী আমার!”

এক হাঁটু ভাঁজ করে পুষ্পির ডান পাশে বসে শাহরিয়ার। পুষ্পি সব সময়কার মতো বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পরে শাহরিয়ার সমস্ত গায়ে ফু দেয়।
শাহরিয়ার বিমোহিত হয়ে বলে, “আমার বউ! তুমি কি জানো? তুমি যতবার আমার সাথে এমনটা করো, নিজেকে খুব শুদ্ধ লাগে তখন, স্বর্গীয় অনুভূতি হয়। প্রিয়তমা আমার, তুমি দৈনিক তিনবেলা এমন করে ফু দিবা আমায়। মনে থাকবে?”

পুষ্পি অনেক দিন পর শাহরিয়ারের কথার বিপরীতে সুন্দর হাসি ফেরত দেয়। সে এপাশ-ওপাশ মাথায় নাড়িয়ে জানায়, মনে থাকবে তার।

পুষ্পি জায়নামাজ উঠিয়ে রাখে। সকাল-সন্ধ্যা কোরআন মাজিদ পড়ার অভ্যাস তার, আজও তার ব্যতিক্রম হয় না।
এরপর শাহরিয়ারের কাছে জানতে চায়, “কিছু লাগবে আপনার?”
শাহরিয়ার কিছু একটা কাজ করছিল। সে কাজ বন্ধ করে জবাব দেয়, “হুম, তোমাকে।”

পুষ্পি পাল্টা জবাব দেয়, “আমি তো আছি-ই।”

শাহরিয়ার চমৎকার হাসে। বলে, “কাছে এসে বসো। আমি একটু দেখি আমার সুন্দরী ভীতু বউটাকে।”

পুষ্পি বলে, “পারবো না। আপনার এতো দেখার ইচ্ছে হলে, আপনি কাছে এসে দেখুন।”

শাহরিয়ার বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, “এই? তুমি খুব কথা বলা শিখেছো কিন্তু। আই এম সারপ্রাইজড!”
পুষ্পি মিটিমিটি হেসে জবাব দেয়, “অল ক্রেডিট গোস টু ইউ। এমন বাকপটু স্বামী যার, একেবারে চুপ হয়ে কেউ থাকে কেমন করে? আমিও শিখে গিয়েছি।”
জবাবটা শাহরিয়ারের ভেতর স্পর্শ করে। সে বিছানা থেকে নেমে সত্যি সত্যি পুষ্পির কাছে যায়। কামুক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে একটু টেনে টেনে বলে, “তাইইই? আর কী কী শিখেছো, শুনি?”

পুষ্পি পিছিয়ে গিয়ে শাহরিয়ারের মতন করে উত্তর দেয়, “অনেএএক কিছু। কিন্তু বলবো না!”

শাহরিয়ার তার প্রিয় কাজটা করে। পুষ্পির হাত টেনে একেবারে কাছে এনে বুকের সাথে লাগিয়ে ফেলে। খুব আদর দিয়ে বলে, “দূরে সরে যাও কেন? তুমি থাকবে কাছে, খুব কাছে, বুকের মধ্যিখানে। যতন করে রাখবো, আগলে রাখবো জনম জনম।”
পুষ্পির মনে শিতল বাতাস বয়। তাও বলে, “পারবো না।”
শাহরিয়ার উল্টো বলে, “পারতে হবে।”
পুষ্পি দু হাতে শাহরিয়ারকে জড়িয়ে রেখে বলে, “আজেবাজে সাহিত্য পড়ে, আপনার এই অধঃপতন মাস্টারমশাই।”
শাহরিয়ার সহাস্যে বলে, “নো, ইউ আর রং, মাস্টারের বউ। আমার জীবনে সুবাস তুমি, অধঃপতনে যাই কেমন করে কও? আমার জীবন পুষ্পের সুবাসে সুবাসিত।”
পুষ্পি দ্বিমত পোষণ করে বলে, “উঁহু!”
শাহরিয়ার বাঁধন আরো শক্ত করে বলে, “হুম। ট্রাস্ট মি!”

ছোট ঘরটায় ভালোবাসা উতলে উতলে পরে। এক দেয়াল যেন অন্য দেয়ালের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ভালোবাসা সুন্দর!’

ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে মুনমুন। আহ্লাদী স্বরে ডাকে, “ভাবী? ও ভাবী? বিচার আছে শোনো?”

দুজন দুজনকে ছেড়ে দাঁড়ায়। শাহরিয়ার বিছানায় গিয়ে বসে আফসোসের সুরে বলে, “শিট! দুনিয়ায় শান্তি নাই। বিলুপ্তির পথে। একটু ভালোবাসাবাসি সহ্য হয় না কারো।”
পুষ্পি দরজা খোলার আগে ইশারায় চুপ করতে বলে শাহরিয়ারকে। শাহরিয়ারের আর উপায় কি? সে চুপ থাকে।
দরজা খুলতেই মুনমুন একটু নিচু স্বরে বলার চেষ্টা করে, “ভাবী? তোমার জামাই, প্রমিস ব্রেক করে কেন? সে ঘুরতে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে, রুমে বসে আয়েশ করছে কেন? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”

আদতে সে নিচু স্বরে বললেও। কন্ঠস্বর উঁচু প্রজাতির হওয়ায় সকল কথাই শাহরিয়ারের কানে পৌঁছায়। শাহরিয়ার ভেতর থেকে জবাব দেয়, “এই ফাজিল! রেডি হ গিয়ে। সময় দশ মিনিট। দ্রুত রেডি হ।”

মুনমুন খুশিতে পুষ্পিকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে, “দেখছো, তোমার মাস্টার জামাইর কানের কি পাওয়ার? আস্তে বলা কথাও শুনে ফেলে।”

পুষ্পি হেসে ফেলে। ভেতরে শাহরিয়ারও হাসে। তবে সে স্বরণ করিয়ে দেয়, “রেডি হওয়ার সময় কিন্তু দশ মিনিট।”

মুনমুন পুষ্পিকে বলে, “আমি যাই, রেডি হই। তুমিও দ্রুত রেডি হও। নয়ত তোমার বদরাগী জামাই আবার বকাবকি শুরু করে দিবে।”

মুনমুন চলে যায় নিচে। পুষ্পি ভেতরে এসে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “আপনি খুব রুড হয়ে থাকেন কেন মুনমুনের সাথে? কী পরিমাণ ভয় পায় মেয়েটা।”
শাহরিয়ার হাতের বইটা বন্ধ করে রেখে দিতে দিতে বলে, “মা আর আব্বা যথেষ্ট লাই দেয়, আমিও যদি লাই দেই, হিতে বিপরীত হবে, বখে যাবে। সবাই মিলে প্রশ্র‍য় দিতে হয় না। পরিবারের কাউকে না কাউকে একটু স্ট্রিক্ট থাকতে হয়, রুড হতে হয় ক্ষেত্রবিশেষে। এতে পোলাপান ভালো থাকে, বখে যায় না।”

তারপর শাহরিয়ার খানিক রসিকতা করে বলে, “এখন আপনি তৈরি হয়ে নিন, মিসেস মাস্টার।”
পুষ্পি মুখ বাকিয়ে বলে, “আমি যাব না।”
শাহরিয়ার বলে, “আপনি যাবেন।”
পুষ্পি বলে, “আপনার কথায়?”
শাহরিয়ার বলে, “হ্যাঁ।”
পুষ্পি মুখ ঘুরিয়ে বলে, “ইশ!”
শাহরিয়ার উল্টো ভেঙায়, “ইশশশশ!”
এরপর ঘরটা হাসিতে মেতে ওঠে। এত সুখ, বহুদিন পর ছোয় এই কপোত-কপোতীকে!

খানিক আমোদপ্রমোদ শেষে শাহরিয়ার তার বোন আর বউকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। মেলা হচ্ছিল সেখানে যায়। দুজনের যার যা কিনতে ইচ্ছে হয়, তাই কিনে দেয়। আনন্দে আনন্দে দিশেহারা হয়ে যায় পুষ্পি এবং মুনমুন৷ তবে মুনমুন নিজের ইচ্ছেমতো কিনলেও, পুষ্পি স্বভাবসুলভ তেমন কিছু কিনছিল না দেখে শাহরিয়ারই পছন্দ করে করে এটা-সেটা কিনে দিচ্ছিল৷ এই মেয়েটা এমনই। তার কোনো আবদার নেই, চাওয়া নেই, পাওয়া নেই। চুড়ি কেনার সময় শাহরিয়ার যখন পুষ্পির হাতে পরিয়ে পরিয়ে দেখছিল, কোনটা মানাচ্ছে, তখন পুষ্পি লজ্জায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিল। বারবার হাত সরিয়ে নিতে চাচ্ছিল, আর বলছিল, “আমায় দিন, আমি পরছি। আপনি হাত ধরবেন না, প্লিজ।”
অবাধ্য শাহরিয়ার বারবারই জবাব দিচ্ছিল, “একশবার ধরবো। আমি আমার বউয়ের হাত হাজার বার ধরবো।”
পুষ্পি মনে মনে ভাবে তখন, একটা কথা যদি শুনত মানুষটা! অবাধ্য পুরুষ!

তবে নাগরদোলায় চরার সময় ঘটল মজার ঘটনা। মুনমুন উঠে বসলেও পুষ্পিকে কিছুতেই উঠানো গেল না। তার নাকি ভয়ে অন্তরআত্মা কেঁপে ওঠে। শাহরিয়ার সেই মেলা ভর্তি মানুষের মাঝেই হো হো করে হাসতে হাসতে বলে, “হায়রে ভীতুর ডিম! পাগলী একটা।”
শাহরিয়ার জোরে জোরে বললেও পুষ্পি মুখ ফুলিয়ে আস্তে আস্তে বলে, “উফফ! চুপ করুন। হাসি থামান প্লিজ। দেখুন সবাই তাকিয়ে আছে!”

সে কারো তাকানোর ধার ধারে না৷ শাহরিয়ারের হাসি এরপরও অনেকক্ষণ যাবত স্থায়ী ছিল।

মেলা-টেলা ঘুরে তারা বেশকিছু হাবিজাবিও খেলো। ফুসকা খেতে গিয়ে পুষ্পির অবস্থা রফাদফা। সে ঝাল খেতে পারে না৷ ফুসকা ওয়ালাকে নিষেধ করে দেয়ার পরও ঝাল দেয়ার কারণে, ফুসকা ওয়ালার সাথে এক প্রকার চেঁচামেচিই শুরু করে দিয়েছিল। পুষ্পির জন্য সফল হতে পারেনি। সে বুঝিয়ে শুনিয়ে সেখান থেকে শাহরিয়ার আর মুনমুনকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে, “আপনি সব সময় এমন করেন। ঝগড়ুটে একটা।”

শাহরিয়ার বলে, “ঠিক করেছি। বেটাকে ঝাল দিতে নিষেধ করার পরও দিয়েছে কেন? ফাজিল বেটা!”

মুনমুন ফিকফিক করে হাসে। শাহরিয়ার ধমক দিয়ে বলে, “তুই হাসিস কেন? ফাজিল মেয়ে।”

মুনমুন কিছু বলার আগে পুষ্পি বলে, “আরো বেশি করে হাসো, মুন।”
এরপর বিড়বিড় করে বলে, “দুনিয়ায় সবাই ফাজিল, শুধু সে একা ভালো! নিজে যে আরো দুই ডাবল ফাজিল, তা আর বলে না।”

এ কথা শুনে মুনমুনের হাসির বেগ আরও বেড়ে যায়। সে খিলখিলিয়ে হাসে৷ মেয়েটার হাসি সুন্দর।

ফুসকা ওয়ালার প্রতি শাহরিয়ারের রাগ তখনও কমেনি। সে গজগজ করতে করতে বলতে লাগে “ইচ্ছে হচ্ছে…”
কিন্তু সে কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না। তার আগেই পুষ্পি বলে, “এই মাথাখারাপ মানুষটা! আপনি চুপ করবেন?”
শাহরিয়ার বাধ্য স্বামীর মতো নিজেকে দমিয়ে রেখে বলে, “করলাম চুপ।”

মুনমুন পুষ্পির কাছে এসে চুপিচুপি বলে, “ভাইয়া দেখি তোমায় ভয় পায় ভাবী!”
পুষ্পি বলে, “কচু পায়!”

পেছন থেকে শাহরিয়ার বলে, “এই তোরা আমায় নিয়ে কি ফুসুরফাসুর করছিস রে?”

পুষ্পি জবাব দেয়, “আপনার মাথা!”
শাহরিয়ার আহত ভঙ্গিতে বলে, “হাউ রুড ইউ আর, পুষ্প।”

পুষ্পি মিটিমিটি হাসে। তার সাথে সঙ্গী হিসেবে আছে মুনমুন। দুজন মিলে কুটকুট করে হাসে৷ ভাবখানা এমন যেন, খুব জব্দ করতে পেরেছে একা এই পুরুষ মানুষটাকে।

(চলবে)……