একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-২৯+৩০

0
12

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_২৯
#কাজী_সানিজিদা_আফরিন_মারজিয়া

দুই হাস্যজ্বল তরুণীকে নিয়ে শাহরিয়ার বাড়ি ফিরে প্রায় বারোটার দিকে। খিলখিলিয়ে হেসেখেলে সুন্দর একটা রাত উদযাপন করল তারা!
তারা ফিরতে ফিরতে হাসনাত সাহেবের এক ঘুম হয়ে গেলেও; ছেলে-মেয়েগুলো বাড়ি না ফেরা অব্দি ঘুমাতে পারল না সাবেরী খাতুন। তিনি অপেক্ষারত মা-জননী হয়ে জাগ্রত রইলেন। কলিংবেল বাজতে না বাজতেই তিনি দরজা খুলে দিলেন। পুষ্পি এগিয়ে এসে বলল, “মা! তুমি এখনও জেগে আছো! সব তোমার ছেলের দোষ, তার জন্য লেইট হয়েছে!”
মুনমুন সায় জানিয়ে বলে, “কারেক্ট। আই সাপোর্ট ইউ ভাবী।”
শাহরিয়ার স্তম্ভিত! হা হয়ে রয় কিছুক্ষণ। এবং বলে, “আমার দোষ?”
এরপর সাবেরী খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ব্যাগগুলো তুমি দেখ মা! ঘুরে-ঘুরে জিনিসপত্র কিনল কারা? হোয়াট ইজ দিজ! দুইটা মেয়ে একটা নিরীহ ছেলেকে কেমন করে ফাঁসায়, দেখ! এ তো রাত-বিরেতে পুরুষ নির্যাতন!”

পুষ্পি আর মুনমুন মিলিত হয়ে মুখে হাত রেখে খিটখিট করে হাসে।বড়োই প্রাণবন্ত রাতদুপুরের এই হাস্যজ্বল দৃশ্য। মুগ্ধ হয়ে দেখা যায় অনেকক্ষণ।
সাবেরী খাতুন বলেন, “হয়েছে হয়েছে! আর নালিশ-সালিশ করতে হবে না। অনেক রাত হয়েছে, খেয়েদেয়ে ঘুমা সবগুলা।”

শাহরিয়ার ভেতরে যেতে যেতে বলে, “যথা আজ্ঞা মাতারানী! আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই হইবে।”

সাবেরী খাতুন এক গাল হেসে বললেন, “ফাজিলের ফাইজলামি আর কমলো না।”

এবার শাহরিয়ারকে ফাজিল বলায় পুষ্পি এবং মুনমুন দুজনেই যেন বেশ খুশি হলো। পুষ্পি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেয়ার মতন করে বলল, “দেখলা মুন? দিজ ইজ কল্ড রিভেঞ্জ অব ন্যাচার! ঘুরেঘুরে সবাইকে ফাজিল বলে, শেষে এসে নিজেই ফাজিল হলো। বেশ হয়েছে, ঠিক হয়েছে।”

মুনমুন হাসতে হাসতে হেলে পড়ে।

সাবেরী খাতুন ঘুমাতে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন সবাইকে খাওয়া-দাওয়ার করে নিতে। কেউ যেন না খেয়ে, না ঘুমায়। তবে তার আদেশ সকলেই অমান্য করল। রাতে আর কেউ খেল না। বাহিরে এত হাবিজাবি খেয়েছে যে, কারো পেটে আর যায়গা নেই। শাহরিয়ার নিজে না খেলেও অবশ্য পুষ্পি আর মুনমুনকে জোর করেছে খেতে। কিন্তু তারা এক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করল শাহরিয়ারকে। সে খানিক হতাশ হয়ে বলে, “বেয়াদব দুইটা! একজন স্বামী কথা অমান্য করে, আরেকটা ভাইয়ের কথা! কঠিন শাস্তি ডিজার্ভ করিস তোরা! আমি দয়াবান দেখে শাস্তি-টাস্তি থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছিস৷ শুকরিয়া আদায় কর এক্ষুনি গিয়ে!”

এবং এবার দুজন তাকে কোনোরূপ পাত্তা-টাত্তা দিল না। দুজনেই মুখ বাকিয়ে বুঝাল, ডোন্ট কেয়ার। মুনমুন তার নিজের রুমে চলে গেল। আর পুষ্পি উপরে চলে গেল। শাহরিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেও উপরে চলে গেল। মনেমনে ভাবলো, কি দিন এল, কেউ-ই তাকে পাত্তা দিচ্ছে না।

শাহরিয়ার এবং পুষ্পি দুজন যখন শুতে গেল, তখন ঘড়ির কাটা একটার কাটা ছুঁইছুঁই। পুষ্পি চুলে বেনী করতে করতে বিছানায় বসে। রোজ ঘুমানোর আগে বেনী করা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। শাহরিয়ার নিজের বালিশে শুয়ে ছিল। সেখান থেকে মাথা সরিয়ে সে পুষ্পির কোলে মাথা রাখল। নির্মল সতেজ হাসল। কোনোরূপ ভণিতা ছাড়াই বলল, “জনম জনম এমন করেই আমি তোমার কোলে মাথা রাখতে চাই৷ অনিন্দ্য সুন্দর সুন্দরীতমা আমার, আরো সহস্র রজনী আমি তোমায় জড়িয়ে রাখতে চাই, ভালোবাসায় আর মায়ায়। শুভ বিবাহবার্ষিকী বউ। ধন্যবাদ আমার জীবন এত আনন্দময় করে দেয়ার জন্য। ধন্যবাদ আমার হওয়ার জন্য। আমি তোমায় ভালোবাসি।”

পুষ্পি স্তব্ধ! সে বেমালুম ভুলে বসে আছে আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী! এত সুন্দর শুভেচ্ছা বার্তার বিপরীতে সে জিজ্ঞেস করল, “ও মাস্টার! আজ কয় তারিখ? এক বছর হয়ে গেছে সত্যি?”

শাহরিয়ার অট্টহাসিতে মাতিয়ে ফেলে। শোয়া থেকে উঠে বসে। টাউজারের পকেট থেকে একটা বক্স বের করে। বক্স খুলে সেখান থেকে দুটো স্বর্ণের চুড়ি বের করে। পুষ্পির হাত দুটিতে সেই চুড়ি দুটি পরিয়ে দিতে দিতে বলে, “কি সুন্দর লাগছে! মাশাআল্লাহ! আল্লাহ আমায় এর সুন্দর বউ দিয়েছে! আমার বউয়ের সৌন্দর্যের কাছে সকল সৌন্দর্য ফেইল! আমি ধন্য!”
শাহরিয়ারর যখন প্রথম প্রথম এমন করে তার রূপের প্রশংসা করতো, লাজে মুখ লাল হয়ে যেত। কিন্তু নিজের স্বামীর মুখে নিজের সৌন্দর্যের প্রশংসা পুষ্পি এতবার শুনেছে যে, এখন আর তেমন লজ্জা লাগে না, অভ্যাস হয়ে গেছে। অন্যরকম ভালোলাগার আবেশে মন ছুঁয়ে যায়। পুষ্পির চোখমুখ খুশিতে চিকচিক করে। এত সুখ তার জীবনে! সে বলে, “আপনাকে দেয়ার মতো কিছু তো নেই আমার কাছে। কী দেই এখন?”
শাহরিয়ার হাসে। সে বলে, “শুধু ভালোবাসা দাও। আর এমনই থাকো, শুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও স্বচ্ছ।”

পুষ্পি শাহরিয়ারের বুকে মাথা রাখে। নিজেকে সে এতদিনে সহজ করে নিয়েছে শাহরিয়ারের কাছে। সহজে মুখ ফুটে মনের কথা না বলা মেয়েটা বলে, “আপনি আমার জীবনটা অর্থবহ করে দিয়েছেন। আমি এখন আপনাকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। আপনি আমার জীবনের রঙ।”

শাহরিয়ার আলতো করে পুষ্পির গালে হাত রাখে। তারপর বলে, “এত সুন্দর তোমার সম্বোধন আমি বাধাই করে রাখতে চাই। আমার মুখচোরা লাজুক বউ, রঙে রাঙিয়ে দিতে চাই তোমার জীবন।”

পুষ্পি সত্যি লজ্জা পায় এবার। সে বলে, “আপনি একটা পাগল। পাগল মাস্টার।”
শাহরিয়ার বলে, “হুম। আর তুমি সেই পাগল মাস্টারের বউ।”
পুষ্পি বলে, “ইশশ!”

শাহরিয়ার বলে, “এত সুন্দর করে ইশশ বলো, পাগল না হয়ে পারিই না!”

ওই দিনের পর পুষ্পি আর শাহরিয়ারের সংসার সত্যিকার অর্থে আরো রঙিন হয়ে ওঠে। ছোট একটা সুখী পরিবারে সুখের কৌটা যেন পরিপূর্ণ!
কিন্তু এই পরিপূর্ণ কৌটার সুখ খানিক উপচে পড়ার স্বাদ দিতেই যেন একদিন বাড়তি সুখ হয়ে এল একটি সুসংবাদ।

তার আগের কয়েকদিন যাবত পুষ্পির মাথা ঘুরায়, বমি পায়, মুখে অরুচিকর লাগে সব খাবার, ক্লান্তি লাগে৷ খুব অস্বস্তিতে থাকা স্বত্ত্বেও কাউকে কিছু বুঝতে দিতে চায় না মেয়েটা। শেষদিন সকালে শাহরিয়ার কলেজ যাওয়ার সময়ে তার সামনে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে লাগলে পুষ্পি। শাহরিয়ার ধরে ফেলে। নচেৎ পড়েই যাচ্ছিল। শাহরিয়ার ধরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। একটু সেবাআত্তি করে যখন খানিক স্বাভাবিক হয়, তখন জানতে চায়, কি সমস্যা। পুষ্পি প্রথমে ‘কিছু না’ ‘কিছু না’ বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও শাহরিয়ারের কপট রাগের কবলে পড়ে শিকার করে, কয়েকদিন যাবত শরীরটা কেমন যেন লাগছে।
শাহরিয়ার রাগ দিয়ে বলে, “এত কেয়ারলেস কেউ কি করে হতে পারে নিজেকে নিয়ে! পুষ্প, তোমার এই স্বভাব পরিবর্তন করবে। আমার এটা একদমই পছন্দ না৷ শরীর; হেয়ালি করার বস্তু নয়। আমাকে সব কথা শেয়ার করতে তোমার অসুবিধা কোথায়? এতদিনেও আপন হতে পারিনি তোমার? অসুস্থতাও লুকিয়ে রাখার বিষয়?”

পুষ্পি ভীত কন্ঠে বলে, “আপনি অযথা রাগ করছেন। তেমন কিছুই হয়নি। ঠিকঠাক খেতে পারছি না তো কয়েকদিন, তাই হয়তো শরীরটা দূর্বল হয়ে গিয়েছে।”
শাহরিয়ার খাওয়ার স্যালাইন গুলে পুষ্পিকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলে, “চুপ, একদম চুপ। ঠিকঠাক খেতে পারছ না মানে কি? এ ব্যাপারে জানিয়েছো আমাকে?”

শাহরিয়ারের চেঁচামেচিতে পরিবারের বাকি সদস্যরাও এসে হাজির হয় সেখানে। সাবেরী খাতুন জানতে চায়, “কি হয়েছে? বকছিস কেন মেয়েটাকে?”

শাহরিয়ার বলে, “কেন বকছি, সেটা তোমাদের আদুরীকে জিজ্ঞেস করো। সে তো আমার কোনো কথাই শোনে না।”

পুষ্পি শাহরিয়ারের হাত চেপে ধরে থামতে বলে। কিন্তু এতে আরও হিতে-বিপরীত হয়। সে বলে, “কি সমস্যা? খোঁচাখুচি করছো কেন?”

পুষ্পি লজ্জায় মরে যায়। এ কেমন মানুষ! বলার আগে দুবার ভাবে না কিছু।
এবং এতেও শান্ত হয়নি সে৷ মা-বাবাকে অবগত করে পুষ্পির অসুস্থতার ব্যপারে। তারাও মেকি ধমকা ধমকি করে পুষ্পিকে।
পুষ্পি শাহরিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে, “হয়েছে তো। এখন কলেজ যান। লেইট হয়ে যাচ্ছে না?”
শাহরিয়ার বলে, “কলেজ যাব মানে? দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। হসপিটাল যাব।”

বউয়ের প্রতি ছেলের সিন্সিয়ারিটি মা-বাবা দুজনকে মুগ্ধ করে। তারা পুষ্পিকে বলে, “মাথা-পাগলটাকে রাগিও না। যাও ডাক্তার দেখিয়ে আসো৷ কি জন্য এমন হচ্ছে তাও তো জানা জরুরী। আন্দাজে ঔষধ খাওয়া ঠিক নয়।”

সবার চাপাচাপির কাছে, পুষ্পির না বলার জো নেই। সে রেডি হয়ে নেয়। এবং শাহরিয়ারের সাথে হসপিটাল যায়।
তারা যেই ডাক্তার দেখায়, তিনি মধ্যবয়সী মহিলা ডাক্তার। তিনি লক্ষন গুলো শুনে কিছু টেস্ট করায়। তার মাঝে একটা ছিল প্রেগন্যান্সি টেস্ট। সব রিপোর্ট-ই নরমাল আসে। এবং শেষে আসে প্রেগ্ন্যাসি রিপোর্ট। ডক্তার রিপোর্ট হাতে পেয়ে সুন্দর হাসেন৷ শাহরিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলে, “মিষ্টি আনুন। রিপোর্ট পজেটিভ। আপনার ওয়াইফ দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা।”

শাহরিয়ার যেন প্রথমে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারে না৷ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় সে। কন্ঠে আওয়াজ আসে না কোনো। একবার পুষ্পির দিকে চায়, তারপর ডাক্তারকে বলে, “থ্যাংক ইউ ম্যাম।”
ডাক্তার হেসে দেন। তিনি বলেন, “আমাকে থ্যাংক্স দিচ্ছেন কেন? বাসায় যান। প্রেগ্ন্যাসির সময়ে হাজবেন্ডের সাপোর্ট সর্বাধিক প্রয়োজন। ওনার প্রোপার টেক-কেয়ার করবেন, ঠিকঠাক খাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। কোনোরূপ স্ট্রেস নেয়া যাবে না। এবং সময়ে সময়ে এসে চেক আপ করিয়ে যাবেন। শুভকামনা রইল।”

শাহরিয়ার ভেবেই পেল না, আদতে তার কি করা উচিৎ কিংবা কি বলা উচিৎ। পুষ্পি লাজে রাঙা হয়ে গেল। সে নিজের ভেতরের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে। শাহরিয়ার পুষ্পিকে নিয়ে, রিপোর্ট নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এল। পুষ্পির সাথে কোনো কথা বলল না।

রিকশায় উঠেও দুটো মানুষ নিরব। কোনো কথা নেই কারো মুখে। শাহরিয়ারের এত বেশি নিরবতা যেন আবার পুষ্পির কাছে একটু আন-এক্সপেক্টেড। সেকারণেই বোধহয় সে-ই প্রথম জানতে চাইল, “চুপ করে আছেন যে! আপনি খুশি না?”

শাহরিয়ার হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে পুষ্পির হাত ধরে খুব শক্ত করে। রিকশাওয়ালাকে বলে, “মামা? আস্তে চালাও, খুব আস্তে আর সাবধানে।”

এরপর পুষ্পির হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখে, আলতো হাতে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “আমি কখনোই আমার সুখ প্রকাশ করতে পারি না, এ কথা আমি অনেকবার বলেছি তোমায় পুষ্প। সুখ প্রকাশে বড্ড আনাড়ি আমি। কিন্তু পুষ্প, তুমি কি জানো, এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে, আমি এই পৃথিবীর সর্বাধিক সুখী ব্যক্তি? খুশিতে আমার পাগল পাগল লাগছে। আমার সুখ প্রকাশ করতে ইচ্ছে। সারা দুনিয়ায় জানান দিতে ইচ্ছে হচ্ছে, আজ আমি কত খুশি, কত পরিপূর্ণ!”

খুশিতে চোখ ছলছল করে ওঠে শাহরিয়ারের। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। এত সুখ, এর পূর্বে বোধহয় সে এমন করে অনুধাবনই করতে পারেনি কখনো। আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে একেবারে। ধরে আসা কন্ঠেই সে এবার বলে, “পুষ্প? থ্যাঙ্কিউ আমার জীবনটা এমন মিনিংফুল করে দেওয়ার জন্য, থ্যাংক ইউ আমার সুখ হয়ে আমার জীবনে আসার জন্য। আই এম গ্রেটফুল।”

পুষ্পির কিছুই বলার থাকে না। সে সব সময়কার মতোই চুপ রয়। সে এতবার শাহরিয়ারের মুখে এই একই কথা শুনেছে যে, গুনে শেষ করা যাবে না। রোজ একবার করে বললেও যেন, লোকটার কৃতজ্ঞতা ফুরায় না। প্রত্যেকবার মানুষটার কথা শুনে কান্না করে দিতে ইচ্ছে করে তার। জীবন এতটাও সুখের হয় কি? মাঝেমধ্যে তার হঠাৎই ভয় হয়, এত সুখ সইবে তো? এমন মায়া আর ভালোবাসায় জীবন কেটে যাবে তো? সুখের মূহুর্তে এই ভয়ের আশংকা সুচের মতো এসে বিঁধে মনে। ছোট এই মানব জীবনে এতটুকু সুখ ব্যতিত আর কিছু চায় না মেয়েটা।

(চলবে)……

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩০
#কাজী_সানিজিদা_আফরিন_মারজিয়া

সুন্দর এই সু সংবাদটি, বহুদিন পর যেন শাহরিয়ার মঞ্জিলে সুখের আবেশ তৈরি করে। পুরো বাড়ির আনাচে-কানাচে খুশির হৈ-হুল্লোড় বেধে যায়।

সাবেরী খাতুন, হাসনাত সাহেব তো বাচ্চাদের মতো আমোদ করতে লাগে। মুনমুন বাবুর নাম অব্দি ঠিক করে ফেলে। যদিও সে অনেক গুলা নাম নিয়ে কনফিউজড। কোনটা রেখে কোনটা রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। তার চাইতে বড়ো কথা ছেলে বাবু নাকি মেয়ে বাবু, সেটাই তো জানে না! সে মারাত্মক দ্বিধাদন্দে পড়ে যায়। রাত-দিন পায়চারী করে করে নাম ভাবে।
সাবেরী খাতুন তার সমস্যাযুক্ত দৃষ্টি দিয়েই কাথা সেলানো শুরু করে দিয়েছে। পুষ্পিকে কোনো কাজে হাত দিতে দিচ্ছে না। পুষ্পি অনুনয় করে বলে, “মা! সারাক্ষণ এভাবে শুয়ে-বসে থাকতে ভালো লাগে না আমার।”
“শুয়ে-বসে থাকতে ভালো না লাগলে ঘুমাও।” সাবেরী খাতুন কাথাতে সূচ ফুটাতে ফুটাতে জবাব দেয়।
পুষ্পি নিরাশ হয়ে ফিরে যায়। কেউ তার কথা পাত্তাই দিচ্ছে না ভেবে মন খারাপ করে। একটু কাজ করলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? ডাক্তারও তো তাকে সারাক্ষণ এমন শুয়ে-বসে থাকতে বলেনি! কি যন্ত্রণা!

অন্যদিকে শাহরিয়ার তার সকল টিউশন ছেড়ে দিয়েছে যেন দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারে। আরো একটু বেশি সময় পুষ্পিকে দিতে পারে৷ তার চোখমুখ ঝিকঝিক করে খুশিতে। ইশশ! সারা জগৎ জানান দেয়া যেত যদি এই খুশি!

সে আজকাল রোজ বাড়ি ফেরার আগে পুষ্পিকে কল করে জানতে চায়, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা। এই মূহুর্তে সে পুষ্পির কোনো ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখতে চায় না।
পুষ্পিরও অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস খেতে ইচ্ছে করে ইদানীং। শাহরিয়ার সারা বাজার ঘুরেঘুরে সেসব খাবার নিয়ে আসে। সেই সাথে বাচ্চাদের ছোট ছোট খেলনা, এবং হরেকরকম জিনিসপত্র যা-ই দেখে, তা-ই নিয়ে আসে রোজ একটু একটু করে। তার ইচ্ছে করে বাচ্চাদের সকল কিছু নিয়ে তার রুম বোঝাই করে রাখতে।
পুষ্পি রুমে থাকতে থাকতে বোর হয়ে যায়। শাহরিয়ারকে খানিক বাদে বাদেই কল করে। সাবেরী খাতুন, মুনমুন পর্যাপ্ত সময় দিলেও, খোঁজখবর নিলেও, যত্নআত্তি করলে, তার মন খালি শাহরিয়ারকে বেশি কাছে চায়। আগে যেই মেয়ে দিনে একবারও কল দিত না শাহরিয়ারকে, সেই মেয়ে এখন শাহরিয়ার ফিরতে ফিরতে শত কল দিয়ে ফেলে। বড্ড অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করে, “কই আপনি? এখনও আসছেন না কেন? দ্রুত আসুন। আমার আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।”
শাহরিয়ার পাগলপাড়া হয়ে ছুটে আসে৷ কোনোমতে জুতোটা খুলেই উপরে চলে আসে। ড্রেস চেঞ্জ না করেই হাতটা কেবল ধুয়ে, সাথে করে আনা খাবার গুলো খাওয়ায়৷ যে খাবার গুলোর জন্য পাগলপাড়া হয়ে যায়, সেই খাবার গুলো আনার পর আর পুষ্পি একবারের বেশি দুবার মুখে নিতে চায় না৷ কেবল বমি পায় তার। পুষ্পির একটু বমি হতে দেখলেও শাহরিয়ার অস্থির হয়ে ওঠে। বমি করে তার শরীর ভাসিয়ে ফেললেও একটুও নাক ছিটকায় না, বিরক্ত হয় না। বরং সেগুলো নিজে পরিষ্কার করে। পুষ্পিকে স্থির করে। আদর করে। জানতে চায়, কি করলে ভাল্লাগবে।
পুষ্পির একটু একটু অপরাধী লাগে এসময়ে। সারাদিন পরিশ্রম এসেও কত খাটে মানুষটা! সামান্য বিরক্তি ছাড়া এমন নির্মল যত্ন!

শাহরিয়ার ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে। বাবুর জন্য কিনে আনা জিনিসপত্রগুলো বের করে৷ একটা করে জিনিস বের করে আর তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ফুটে ওঠে৷ পুষ্পিও সেসব দেখে ভীষণ খুশি হয়৷ খেলনা-টেলনাগুলো নেড়েচেড়ে বলে, “আপনি একটা পাগল! এত আগে এতসব কিছু কেউ আনে? পাগল মানুষ।”

শাহরিয়ার নরম হয়ে আসে। আলতো করে পুষ্পির হাত ধরে। আহ্লাদে ধরে আসা কন্ঠে বলে, “পুষ্প, আমি বোধহয় সত্যিই পাগল হয়ে যাব কিছু দিনের মধ্যে। এত খুশি, আমি স্থির থাকতে পারছি না। খুশিতে অস্থির অস্থির লাগছে৷”

পুষ্পি চমৎকার হাসে। আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “দেখি, আজ কি কি এনেছেন?”

শাহরিয়ার জিনিসপত্রগুলো এগিয়ে দিয়ে, উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে, “অনেক কিছু এনেছি। এই দেখ! আমার তো ইচ্ছে করে বেবিশপের সকল কিছু নিয়ে আসি! এত কিউট, পুষ্প! তুমিও দেখলে পাগল হয়ে যাবা।”
পুষ্পি মুচকি হেসে জিনিসগুলো হাতে নেয়। বাচ্চাদের হরেক রকমের সামগ্রী! ছোট ছোট পোশাক, হাত মোজা, পা মোজা, আরো কত কি! পুষ্পি বিস্ময় নিয়ে বলে, “ইশশ, কত ছোট!”

শাহরিয়ার পুষ্পির হাত মুঠোয় নিয়ে বলে, “আমার ছোট্টপাখি-মিষ্টিপাখির জন্য যে!”

কত আনন্দ পুরো বাড়ি জুড়ে! বাড়ির প্রত্যেকটা ব্যক্তি যে কি পরিমাণ উদগ্রীব হয়ে ছিল একটা ছোট প্রাণের জন্য, তা প্রতি মূহুর্তে টের পাচ্ছে পুষ্পি। সাবেরী খাতুন খানিক বাদে বাদে এসে জিজ্ঞেস করে যায়, কি খেতে ইচ্ছে করছে। অলস মুনমুনও বেশ কামেলি হয়ে গিয়েছে। ভাবিকে নিয়ে খুবই চিন্তিত সে। তার থেকেও বেশি চিন্তিত ছেলে বাবু হবে নাকি মেয়ে বাবু হবে তা নিয়ে। শাহরিয়ারের বাবা হাসনাত সাহেব, সেও যেন অন্যরকম আনন্দিত হয়ে উঠলেন। একটু পর পর পুষ্পির রুমে এসে খোঁজ নিতে লাগলেন।

শাহরিয়ার প্রচন্ড সতর্ক। সে প্রায় প্রত্যেক মাসে মাসেই চেক-আপের জন্য নিয়ে যায়। পুষ্পি যতবার কষ্টময় সময় পার করে, ততবারই শাহরিয়ার ভরসা হয়ে যত্ন নেয়। পুষ্পির সাথে সাথে অনেক রাত শাহরিয়ারও নির্ঘুম কাটায়। ঘুমে চোখ বুজে আসে, তাও ঘুমায় না। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সকালে ক্লাস করায়। এভাবে কাটিয়েছে অনেক রাত৷ আর ম্যাচিউর পুষ্পিও খুব ইমম্যাচিউর আচরণ করে মাঝেমধ্যে৷ খুব বেশি মুডসুইং হয় সময়ে-অসময়ে। দেখা গেল, রাত বারোটা-একটা নাগাদ তার গ্রীল খেতে ইচ্ছে করছে, শাহরিয়ার সেই সময়ে ঢাকা শহরের অলিগলি খুঁজে দেখত, কোন দোকান খোলা আছে, আর কোথা থেকে সেই জিনিস খুঁজে এনে তার বউয়ের আবদার মেটাতে পারবে। এমনও হয়েছে সে নিজে রান্না শিখেছে, তার আনাড়ি হাতে রান্নাও করেছে শুধু মাত্র পুষ্পির যখন-তখন যা-তা খেতে ইচ্ছে হলে তা করে খাওয়াতে পারত! একদিন পুষ্পির অদ্ভুত ইচ্ছে হলো, তার নাকি পান্তাভাত দিয়ে দধি মাখিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। শাহরিয়ার তো সেদিন হেসে খুন। সে বলল, “পুষ্প! তুমি তো আমায় পাগল বলতে বলতে, নিজে একটা পাগলি হয়ে যাচ্ছো। কি কি না খেতে ইচ্ছে করে তোমার!”
পুষ্পি ঘনঘন রাগ করত। মুখ ফুলিয়ে বলত, “আচ্ছা, আর কিছু খেতে চাইব না। যান, সরুন সামনে থেকে।”
অবাধ্য শাহরিয়ার বলে, “নাহ, সরবো না। আলাদিনের চেরাগ হয়ে আপনার সকল আবদার মেটাবো, মহারানী আমার! কেবল হুকুম করুন।”

এমন করেই কষ্ট ও আনন্দ মিলিয়ে বেশ অনেকটা সময় চলে যায়। প্রায় পাঁচ মাস! এই পাঁচ মাসে পুষ্পির বাড়ি থেকে তার একটা খালা ব্যতিত আর কেউ আসেনি। নানুর পরে এই খালাটাই তার একটু-আধটু খোঁজখবর রেখেছে। তার সংসারেও অশান্তি লেগে থাকত বলে, খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ সে বোনঝির সাথে করতে পারত না। আর এলেও কেবল দুঃখের কথা বলত। দুঃখের কথা শুনতে পুষ্পির একটুও ভালো লাগে না। জীবনে এত বেশি দুঃখের মুখোমুখি সে হয়েছে যে, দুঃখময় কিছু তার আর একদম ভালো লাগে না এখন আর। অস্বস্তি হয়। দম বন্ধ লাগে।
খালা তাকে বলে, “পুষ্পি, মা! বলেছিলাম না, তুই অনেক সুখী হবি? দেখলি, মিলল আমার কথা? অনেক সুখী হ মা, অনেক সুখী হ।”

আনন্দ আর সুখের সংমিশ্রণে পুষ্পির চোখে জল জমা হয়। ইশশ! আজ যদি তার মা বেঁচে থাকত! কেমন খুশি হতো তিনি, মেয়ের এমন সুখ দেখে? কেমন দোয়া করতো সে? কতই না আরো আনন্দময় হতো তার সময়গুলো! মাকে নিয়ে সে বেশি ভাবতে পারে না। চোখ মুছে বলে, “খালা তুমি আরো বেশি বেশি আসবা আমায় দেখতে। তোমায় দেখলে আমার শান্তি লাগে।”

প্রায় মধ্যবয়সী মানুষটা পুষ্পিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “পাগলী মা আমার! আচ্ছা আসবো।”

পাঁচ মাসের ঠিক শেষদিন পুষ্পির জন্য আগমন হলো আরও একটি দূর্লভ মূহুর্ত। পুষ্পির বাবা পুষ্পিকে দেখতে এলো! বিকেল বেলা। পুষ্পি তখন ঘুমে। সাবেরী খাতুন রুমে এসে পুষ্পির মাথার কাছে বসে মাথায় হাত রেখে আস্তে করে ডাকলেন, “পুষ্পি? মা?”
পুষ্পির কান পাতলা। অল্প ডাকেই সে শুনতে পায়, সে যতই গভীর ঘুমে থাকুক না কেন! সে চোখ মেলে তাকায়। সাবেরী খাতুন সুন্দর করে হেসে বললেন, “আমার সাথে একটু নিচে চলো মা! তোমার জন্য চমক আছে।”
পুষ্পি শোয়া থেকে উঠে বসে। ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে, “কি চমক মা?”
সাবেরী খাতুন বললেন, “এলেই দেখতে পাবে।”

পুষ্পি আর কোনো প্রশ্ন করে না। মেয়েটা বরাবরই এমন। পুষ্পি সাবেরী খাতুনের সাথে নিচে আসে। এবং নিচে এসেই সে আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। সোফায় বসে থাকা ভদ্রলোককে পেছন থেকে দেখেও চিনতে অসুবিধা হয়নি মেয়েটার। শত হলেও বাপ তো! যতই অভিমান-অভিযোগ থাকুক না কেন, রক্তের টান!
পুষ্পি ধীরে ধীরে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শাহরিয়ারের বাবা আর পুষ্পির বাবা দুজন বসে কথা বলছিল। পুষ্পি গিয়ে দাঁড়াতেই, পুষ্পির বাবা উঠে দাঁড়ায়। পুষ্পি সালাম দিতেই ভদ্রলোকের মুখ হাস্যজ্বল হয়ে ওঠে। তিনি কাছে গিয়ে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছিস মা?”
পুষ্পি জবাবে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাকে অনেক ভালো রেখেছে।”

তিনি যে খুশি হলেন তা তার চোখেমুখে ফুটে উঠল। বলল, “আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! শুনে আমার বুকটা ভরে গেল রে মা।”

ভদ্রলোক আরো অনেক কথাই বললেন। এতদিন দেখতে আসতে না পারার ঠুনকো কারণও এক্সপ্লেইন করলেন। পুষ্পির প্রত্যেকবারই তার বাবাকে কড়া কথা শুনাতে ইচ্ছে করে, কঠিন কঠিন প্রতিত্তোর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মেয়েটা কোনোবারই এমনটা করতে পারে না। কারোর সাথে যেমন পারে না, বাবার সাথেও তেমন পারে না। চুপচাপ নীরবে শুনে যায় কেবল।

পুষ্পির বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে পুষ্পি নির্লিপ্ত হয়ে রয়। শাহরিয়ার এলেও তার সাথে কোনো কথা বলে না। শাহরিয়ার নিজে নিজেই কত কথা বলতে থাকে। অন্যদিন প্রতিত্তোর করলেও আজ চুপচাপ। শাহরিয়ার প্রথমে মুডসুইং ভেবে চুপ করে থাকলেও পরে গিয়ে সে জানতে চায়, কি হয়েছে। কিন্তু পুষ্পি তাও কিছু জবাব দেয় না। একটা সময় এই বাবা নামক মানুষটাকে অত্যাধিক ভালোবাসতো বলেই হয়তো তার প্রতি অভিমানের পারদ অত্যাধিক।

শাহরিয়ার পুষ্পির পাশে বই হাতে নিয়ে বসে, মেয়েটা কখন মুখ খুলবে সে আশায়। শাহরিয়ারের আশা পূরণ হয় ঘন্টাখানেক বাদে৷ পুষ্পি নিস্তেজ কন্ঠে বলে, “আপনি আর একটু কাছে এসে বসুন। আপনাকে একটা আশ্চর্যের কথা বলি।”

শাহরিয়ার ভ্রুকুটি করে চায়। বই বন্ধ করে পুষ্পির কাছে আরো কাছে যায়। মায়াময় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জানতে চায়, “মন খারাপ? কেন? কী হয়েছে? আমায় বলো।”

পুষ্পি মলিন হাসে। বলে, “মন খারাপ না। এমনি, ভাবছিলাম।”

শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করে “কী ভাবছিলে?”
পুষ্পি বলে, “কি ভাবছিলাম, তা বাদ দিন। আপনাকে আশ্চর্যের সেই কথাটা বলি।
” হুম।”
“আমার ছোট বেলার অল্প কিছু স্মৃতিতে যতটুকু মনে পড়ে, আমার বাবা কিন্তু আমার মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। আমার স্মৃতিতে তাদের দুজনের কোনো ঝগড়াঝাটি কিংবা ঝামেলার স্মৃতি নেই নেই। তাও দেখুন মা মারা যেতে না যেতেই, বাবা মাকে বেমালুম ভুলে গেলেন। এবং কত দ্রুত নিজের জীবন নতুন করে সেট ফেললেন! কি আশ্চর্য! ইশশ, পুরুষ মানুষ এত কঠিন!”

কথাগুলো বলতে বলতে চোখ ছলছল করে ওঠে পুষ্পির। শাহরিয়ার সান্ত্বনার কাঁধ বাড়িয়ে দেয়। সে বলে, “ওঃ! বাবাকে নিয়ে অভিমান হচ্ছে! এত অভিমান আমার বউয়ের! এতসব ভেবো না বোকা মেয়ে। অভিমান পুষে রেখো না বাবার প্রতি। শোক বয়ে বেড়ানোও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। শোক সামলে এগিয়ে চলাই জীবন। তোমার মায়ের শোকে পাথর হয়ে থেকে, তোমার বাবা নিজের জীবন দুঃখের সাগর বানিয়ে রাখলে কি খুব ভালো হতো? বলো? তখন কি তোমারও ভালো লাগতো?”

পুষ্পির মনে অন্য আরেক প্রশ্ন উঁকি দিল। সে বলল, “ওহ! এর মানে কখনো যদি আমার কিছু হয়, আপনিও এমনটা করবেন, তাই না?”

শাহরিয়ার হতচকিত হয়ে বলে, “ইয়া আল্লাহ! কি বলি আর কি বোঝে, এই মেয়ে! আহারে বোকা, আমি তো জাস্ট বলার জন্য বললাম। অন্য ভাবে নিচ্ছো কেন?”
এটুতেই থামে না। শাহরিয়ার বিরতি না দিয়ে দোষ মাথা পেতে নেয়৷ বলে, “আচ্ছা, স্যরি। ভুল বলেছি। তোমার বাবা একদমই ঠিক কাজ করেনি। আমার বউটা এত অভিমানী হয়ে উঠেছে কেবল তার কারণেই৷”
প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই, অতি অল্পে কেঁদে ফেলার, দুঃখ পাওয়ার এক বাজে স্বভাব হয়েছে পুষ্পির। আজও কেঁদে ফেলল। চোখের জলে, নাকের জলে একাকার!
শাহরিয়ার পড়ে ফ্যাসাদে। বলে, “আহ্হারে! কাঁদে কেন আবার! কাঁদে না প্লিজ।”

পুষ্পি বলে, “না আমি জানি, আপনিও এমনটাই করবেন। আমার বাবা, মাকে এত ভালোবাসতেন, তাও ছয় মাস সময় নেয়নি ভুলে যেতে! আর আপনি তো আমার ভালোই বাসেন না! আপনি তো দুই দিনও সময় নিবেন না, ভুলে যেতে!”

শাহরিয়ার এবার হেসে ফেলে। কেমন বোকা বোকা কথা মেয়েটার। সে হাসতে হাসতে পুষ্পিকে বাহুডোরে আঁকড়ে নেয়। তারপর হাসি থামিয়ে গভীর মমতায় বলে, “কে বলেছে আমি তোমায় ভালোবাসি না? কই পাও এই ফাও কথা? তুমি তো আমার প্রাণভোমরা, পুষ্পরানী! তোমায় ভালো না বেসে উপায় কই? তার উপর আবার ভালোবাসার পাল্লা ভারী করতে নিজের সাথে যুক্ত করেছো, ছোট্টপাখি-মিষ্টিপাখিকে! কত চালাক তুমি, পুষ্প! আমাকে পুরোপুরি আটকে ফেলার ধান্দা!”

সমস্ত দুঃখ ভুলে, শাহরিয়ারের শেষের কথাগুলোতে পুষ্পিও কাঁদতে কাঁদতে হেসে ফেলে।
পুষ্পিকে ভুলানোর কি অভিনব কায়দা শাহরিয়ারের!
(চলবে)…..