একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-৩১+৩২

0
14

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩১
#কাজী_সানিজিদা_আফরিন_মারজিয়া

আষাঢ় মাস। ক্ষণেক্ষণে বৃষ্টির আগমনী বার্তা। আষাঢ়িয়া হুংকারে হুটহাট আকাশ কেঁদে ওঠে যেন। শীতল বাতাস ঘরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। পুষ্পি পঞ্চম মাসে পদার্পণ করেছে কেবল। মাঝেমাঝে একটু কষ্ট লাগে। মাথা ঘুরায়, বমিবমি পায়৷ মেজাজ খিটখিটে লাগে। অকারণ অযথা রাগ হয়৷ রাতে ঠিক মতো ঘুম হতো না। শাহরিয়ার দ্বায়িত্ববান স্বামীর ন্যায় সাহস যোগায় ঠিক, তবে পুষ্পির কষ্ট পুষ্পিরই। এর মাঝে শেষবার যখন চেক আপ করাতে যায় তখন ডাক্তার একটু সতর্ক বার্তাই দেয়। জেনেটিক্যালি পুষ্পির উচ্চরক্তচাপ আছে। এত অল্প বয়স, অথচ উচ্চরক্তচাপে প্রায়শই কাবু করে ফেলে তাকে। ডাক্তার পুষ্পিকে ‘হাইরিস্ক মাদার’ এর তালিকায় আওতাভুক্ত করে খুব বেশি সতর্ক থাকতে পরামর্শ দেয়।
সেই থেকে মনে অজানা কোনো এক ভয় কাজ করছে। অশুভ চিন্তা মাথায় ঘোরে। একটু দূর্বল লাগলেই মনোবল হারিয়ে ফেলে। শাহরিয়ার কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেও নিজেকে সামাল দিয়ে রাখতে পারে এবং পুষ্পিকেও ভরসা যোগাতে জানে। কিন্তু যা হবার তা তো হবেই। সৃষ্টিকর্তার চাইতে উত্তম পরিকল্পনাকারী তো কেউ নয়!

বৃহস্পতিবার। একটু অন্ধকারাবৃত পরিবেশ। সন্ধ্যা থেকেই পুষ্পি প্রচন্ড অসুস্থবোধ করে। শাহরিয়ার মসজিদে তখন। নামাজ সেরে আসতে আসতে পুষ্পি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে যায়। রক্তক্ষরণ হয়। পরিবারের সকল সদস্য বেশ ঘাবড়ে যায়। সর্বদা সকল পরিস্থিতিতে স্ট্রং থাকা শাহরিয়ার বোধ এই প্রথম এত বেশি বিচলিত হয়। দ্রুত এম্বুলেন্স ডেকে পুষ্পিকে হসপিটালে নেয়। তার প্রার্থনা, পুষ্পির যেন কোনো ক্ষতি না হয়। সাবেরী খাতুন আর মুনমুন বাসাতেই থাকে। সাবেরী খাতুন জায়নামাজ বিছিয়ে বসে থাকে। মুনমুনকেও একই নির্দেশ দেয়। শাহরিয়ার আর হাসনাত সাহেব পুষ্পিকে নিয়ে হসপিটাল চলে যায় ততক্ষণে।
তবে শেষ রক্ষা কিছুতেই হয় না। অনাগত নতুন অতিথিকে নিয়ে পরিকল্পিত সকল স্বপ্ন নিমিষেই গুড়িয়ে যায়৷ বিশ সপ্তাহের মাথাতেই পুষ্পির মিসক্যারেজ হয়ে যায়! মিসক্যারেজ….এই একটা শব্দে ভেঙে যায় অসংখ্য স্বপ্ন।

মিসক্যারেজের পর পুরো পরিবারটাই যেন কেমন মুষড়ে যায়৷ সকলের মুখ আঁধারে ঢেকে থাকা। সাবেরী খাতুন নতুন অতিথির জন্য তৈরি করা পোশাক গুলো নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। অশ্রুকণায় চোখের পাতা টলমলিয়ে ওঠে। সে আবার তা আড়াল করে ফেলে। হাসনাত সাহেব তা বুঝতে পেরে শান্তনা দেয়, ‘আলহামদুলিল্লাহ বলো, বউমার বিশেষ কিছু ক্ষতি হয়নি। হয়তো এখনই প্রপার সময় নয়, তাই আল্লাহর এমন সিদ্ধান্ত! আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। সব ঠিক হয়ে যাবে। সময় তো ফুরিয়ে যায়নি, না?’
সাবেরী খাতুন কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, “কিন্তু আমার এত দিনের স্বপ্ন! সব ভঙ্গ হয়ে গেল। কি এমন হতো মেয়েটা আর একটু সতর্ক থাকলে। আমার কোনো নিষেধও ঠিকঠাক শোনেনি! বেশি ভালোবাসা দিয়েছি বলে?”

হাসনাত সাহেব কিঞ্চিৎ অবাক হয়। তিনি বিশ্বাস করেন, তার চাইতেও বেশি সাবেরী খাতুনই পুষ্পিকে আদর করে, স্নেহ করে। এবং এই মূহুর্তে তারই পুষ্পিকে বেশি বুঝতে পারা উচিৎ। সেই তিনিই এমন পরিস্থিতিতে পুষ্পিকে নিয়ে অভিমান পুষবে; তা যেন কল্পনাতীত। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, “মেয়েটাকে দোষারোপ করছো কেন তুমি? ও তো মা! নিজের অস্তিত্বের ক্ষতি কেউ ইচ্ছে করে চায়? এখানে তো ওর দোষ নেই। আল্লাহর ইচ্ছে ছিল এমন, তাই এমন হয়েছে। এরচেয়ে উত্তম কোনো প্রতিদান দিবেন হয়তো তিনি। এত অল্পেই নিরাশ হচ্ছো কেন?”

সাবেরী খাতুন নিজেও এসব জানেন, বোঝেন। কিন্তু তিনি তার মনকে কেন যেন মানাতে পারছে না। বারংবার পুষ্পিকেই দোষতে ইচ্ছে হচ্ছে।

মুনমুনের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকই। সে অতশত বোঝে না। তার ভাইয়ের মতোই তার কাছে তার ভাবীর শারীরিক অবস্থাটা অধিক প্রাধান্য পায়।
হসপিটাল থেকে আসার পর থেকে পুষ্পির যত্ন-আত্তি করছে৷ এটাসেটা এগিয়ে দিচ্ছে। সাবেরী খাতুন মুখ ভার করে থাকাটা যে তার অপছন্দ হচ্ছে তাও মাকে জানাচ্ছে। প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সাবেরী খাতুন মুনমুনকেই উল্টো বকাঝকা করছে। সহজে গলা উঁচু না করা মানুষটা ছোটছোট বিষয়ে গলা উঁচিয়ে কথা বলছে।

বিস্ময়ের বিষয় হলো, পুষ্পির প্রতিক্রিয়া প্রচন্ড অস্বাভাবিক। ও যেমন নরম মনের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে ওর কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যাওয়া মানানসই। কিন্তু সে তা না করে বরং শান্ত হয়ে রইল। হসপিটালে একরাত থেকে পরদিন বাড়ি নিয়ে আসে পুষ্পিকে।
শাহরিয়ার দুটো দিন ছুটি নিয়ে পুষ্পির পেছন ছুটোছুটি করে ঠিক, তবে কোথাও একটা তার ব্যাথার উপদ্রব হয়। সুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। বাসায় নিয়ে আসার পর থেকে খুব বেশি বাক্য বিনিময়ও হয়নি পুষ্পির সাথে।

তবে সে যথাযথ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাতের বেলা শাহরিয়ার পুষ্পিকে ডাইনিং এ আনলো না। বেডরেস্ট প্রয়োজন মেয়েটার। তাই সে রুমে খাবার এনে খাইয়ে দিল। পুষ্পি বিরূপ প্রতিক্রিয়া না করে বাধ্য মেয়ের মতো খেয়েও নিল। শাহরিয়ার খাওয়াতে খাওয়াতে জানতে চায়, “শরীর কেমন লাগছে এখন? বেশি অসুস্থ লাগছে?”

পুষ্পি না সূচক মাথা নাড়ে। পরনের মলিন কাপড়টার আঁচল টানে। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু….কোন এক অজানা কারণে পারছে না। ভাতের নালা গুলো গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। সে এও বলতে পারছে না, ‘খাবার আমার গলা দিয়ে নামছে না।’
কষ্ট, আহাজারি, দুঃখ চেপে রাখার কি দূর্দান্ত প্রচেষ্টা মেয়েটার! এবং কত চমৎকার ভাবেই না উতরে যাচ্ছে এই চেষ্টায় সে! খাবারের সাথে সাথে কষ্টটাকেও যেন গিলে খাচ্ছে!
শাহরিয়ার জানতে চায়, “আর একটু ভাত নিব? খাবে?”
পুষ্পি এবারও না সূচক মাথা নাড়ে। আড়চোখে শাহরিয়ার দিকে চায়। ভাবে, কি শান্ত হয়ে গেছে মানুষটা। নিশ্চয়ই মনে মনে প্রচন্ড দুঃখ পেয়েছে। রাগ হচ্ছে। কিন্তু প্রকাশ করছে না৷ তা নাহয় এত অল্প কথা বলার মানুষ তো সে না। এই এইটুকু সময়ে কত অসংখ্য কথা বলে ফেলত। ওর প্রতি রাগ বলেই দায়সারা কথা বলছে! পুষ্পির কষ্টে বুক ফেটে যায়। চোখ টলমল করে উঠতে চাইলে দ্রুত সামলে নেয়। কাঁদবে না সে, কিছুতেই কাঁদবে না৷ আল্লাহর উপর অভিমান হয়। মনে মনে বলে, যত কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয়, দাও আল্লাহ। সয়ে নিতে জানে পুষ্পি।

শাহরিয়ার প্লেট রেখে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পুষ্পি পানি খেতে খেতে তার চুলের খোঁপা খুলে যায়। পুষ্পির হাতে ব্যথা। খোঁপা করতে কষ্ট হয়৷ শাহরিয়ার তা লক্ষ্য করে। সে বলে, ওদিক ঘুরে বসো, আমি করে দিচ্ছি।

এইটুকু কথাতেই পুষ্পির মনটা ভরে যায়। তার সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে শাহরিয়ারের দিকে চায়। কি যে প্রেমময় লাগে এই মানুষটাকে তার! ভালোবাসায় আঁকড়ে ধরে দুঃখ বিলাস করতে ইচ্ছে হয়।
শাহরিয়ার পুনরায় বলে, “কি হলো? ঘুরে বসো।”

পুষ্পি বলে, “আপনি তো খোঁপা করতে পারেন না। উল্টাপাল্টা প্যাঁচিয়ে রাখেন। আমিই করে নিচ্ছি।”

শাহরিয়ার এবার আর পুষ্পির ঘুর বসার অপেক্ষায় রইল না। তোয়ালেতে হাত মুছে, দু’হাতে নিজেই পুষ্পিকে ঘুরিয়ে দিল। সে সত্যি ঠিকঠাক খোঁপা করতে জানে না। তবুও প্রত্যেকবার পুষ্পিকে খোঁপা করতে দেখলেই, নিজে করে দিতে চাইবে৷ এবং আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হবে। এই কাজটা করতে সে উপভোগ করে। এবং ব্যার্থ হওয়ার পর পুষ্পির টিটকারিতে আমোদিত হয়।

শাহরিয়ার লম্বা চুলগুলো হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলে, “আমার উল্টাপাল্টা খোঁপাই তোমার চুলে বেশি শোভা পায়। তুমি তা জানো না।”

এবং সবচাইতে আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো প্রথমবারের মতো শাহরিয়ার খোঁপা করায় সফল হলো। মনের মাঝে চাপা কষ্টের মাঝেও শাহরিয়ারের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
শাহরিয়ারের অতি চমৎকার কথা এবং সেই সাথে শাহরিয়ারের খোঁপা করায় প্রথম সফলতায় অভিভূত হয়ে রয় পুষ্পি৷ পেছন হাত রেখে খোঁপাটা ছোঁয়। শাহরিয়ার বলে, “কি? পারলাম তো? একটু আস্থা রাখতে পারছিলে না, বোকা মেয়ে!”

পুষ্পির কান্নাকান্না পায়, কিন্তু এবারও সে কাঁদে না। কোনো কিছুতেই কাঁদবে না বলে ঠিক করেছে যখন, সে তার প্রতিজ্ঞায় অবিচল রয়। খুব ধীর কন্ঠে বলে, “আমার আস্থার পুরোটা জুড়েই আপনি। আস্থা না রেখে উপায় কই! বোকা পুরুষ মানুষ!”

পুষ্পির এই একটা কথাতেই যেন শাহরিয়ারের সমস্ত চাপা দুঃখ, অপূর্ণ সুখ উবে যায়। ভালো লাগার আবেশে মনটা ভরে যায়৷ কিন্তু প্রতিক্রিয়া স্বরূপ পুষ্পির মাথায় হাত বুলিয়ে স্থান ত্যাগ করে।
বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। পুষ্পি এক দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রয়৷ ইশশ! এমনটা তার সাথে কেন হলো! কেন মানুষটার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো! কেন, কেন, কেন? এই কেন’র কোনো উত্তর নেই। তাইতো প্রশ্নটা কেবলই নিরুত্তর হয়ে রয়। পুষ্পি একপাশে ফিরে শুয়ে রইল।
শাহরিয়ার বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে রয়। বারান্দার এক কোনায় বাচ্চাদের একটা খেলনা গাড়ি। গোল বৃত্তাকার আকৃতি, ছোট ছোট চাকা যুক্ত। দেখতে খুব কিউট। দু’দিন আগেই কিনে এনেছিল। শাহরিয়ার হাত চেয়ারের হাতলে ভাজ করে রেখে, গালে দুই আঙুল রেখে, একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সেই খেলনা গাড়িটার দিকে চেয়ে রয়। মৃদু বাতাসে ঝুনঝুন টাইপ আওয়াজ হয়। আর শাহরিয়ারের মনে হয় সৃষ্টি হয় হাহাকার!
ইশশ! কত দ্রুত স্বপ্ন ভেঙে যায়! দু’দিন আগেও যেখানে নিজেকে সবচাইতে সুখী মনে হচ্ছিল, আজ সেখানে মনে হচ্ছে সবচাইতে দূর্ভাগা, হতভাগা, আনলাকি! অবচেতন মন পুষ্পির সাথেও দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতে চাইছে, দোষারোপ করতে চাইছে৷ কিন্তু শাহরিয়ার এই চাওয়া প্রশ্রয় দিতে চাইছে না। কারণ সে জানে, বোঝে, পুষ্পির কোনো দোষ নেই এতে। ইট’স আ এক্সিডেন্ট। যার ভুক্তভোগী পুষ্পি নিজেও। বলাবাহুল্য সকলের চাইতে তার কষ্টের ভাগটাই বরং বেশি।

বারান্দায় কিছুক্ষণ থেকে রুমে এলো শাহরিয়ার। পুষ্পি ততক্ষণে ঘুমিয়ে গিয়েছে। ভীষণ ক্লান্ত মেয়েটা। শরীর, মন দুটোই। শাহরিয়ার হাতের ঘড়ি খুলছিল তখন এলো মুনমুন। জানতে চাইল,
“ভাইয়া, খাবে না? মা ডাকছে।”
শাহরিয়ার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়, “উ’হুম….তোরা খেয়ে নে। ক্ষুধা নেই।”
“অল্প করে খাও।” মুনমুন মিনতিপূর্বক যাচঞা করে।
শাহরিয়ার মেকি রাগের সহীত বলে, “না করলাম, শুনিসনি? যা।”

মুনমুন আর অনুরোধ করে না। অত সাহস তার নেই। সে চলে যায়। তবে ছেলের না খেতে আসাটাও সাবেরী খাতুনকে আহত করে। ছেলের আশাহতের বেদনার কথা চিন্তা করে তার বেদনা দ্বিগুণ হয়। চিরাচরিত শ্বাশুড়ির ন্যায় পুত্রবধূর উপর অভিমান পুষে। ‘নিজে খেয়ে নিল, স্বামীর খাবার নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই! খেল কি, না খেল; তা নিয়ে ভাবনা নেই! এমন স্বার্থপর হয়েছে। বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি কি?’
পুষ্পির প্রতি অভিমান থেকেই কিনা জানা নেই, তবে রাতে সাবেরী খাতুনও খেল না।
হাসনাত সাহেব এবং মুনমুন কারোর কথাই শুনল না। কারো আবদার, অনুরোধে কান তো দিলই না, বরং আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া করে ডাইনিং টেবিল ত্যাগ করে। মুনমুন হাসনাত সাহেবকে বলে, “দেখলে বাবা? মা শুধু শুধু ভাবীর উপর রাগ করছে না? ভাবীর কি দোষ এখানে? মা তো এমন ছিল না। এমন টিপিক্যাল শ্বাশুড়িদের মতো করছে কেন?”

হাসনাত সাহেব ধীরস্থির ভাবে জবাব দিল, “তোর মাকেও এখানে পুরোপুরি দোষ দেয়া যায় না। হুট করে এতদিনের উচ্ছ্বাস বিনষ্ট হওয়ায় তার মনেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে৷ যেহেতু বিষয়টির সঙ্গে পুষ্পি ওতপ্রতভাবে জড়িত তাই স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগের তীর আর কারো দিকে না পেরে পুষ্পির দিকে নিক্ষেপ করছে। একটু সময় দে, দুদিন পর নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে। আমি তো চিনি তোর মাকে, এই স্বভাবের সাথে সে অভ্যস্ত নয়। ঠিক হয়ে যাবে। একটু কষ্ট পেয়েছে, সময় তো লাগবেই কষ্ট লাঘবের।”

শাহরিয়ার কিছুক্ষণ আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে থাকে। আধ-পড়া নোভেলটা অল্পসময় নেড়েচেড়ে রেখে দেয়। কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছে মনের ভেতর। কি যেন নাই নাই লাগছে। রোজ রাতে ঘুমানোর আগে ‘ছোট্টপাখি-মিষ্টিপাখিকে’ নিয়ে খুনসুটি গুলো মিস করছে। পুষ্পির ঠোঁট ফুলিয়ে আহ্লাদ মাখা কথাগুলো মিস করছে। প্রেগন্যান্সির এই ছোট্ট সময়টাতে শাহরিয়ার সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তার আরেকটি ছোট্ট উদাহরণ হলো, রোজ ঘুমানোর সময় সে তার এবং পুষ্পির মাঝখানে একটা কোলবালিশ রাখত। যাতে করে এক্সিডেন্টলি হাত লেগে কিংবা অন্যকোনোভাবে আঘাত না লাগে পুষ্পির। পুষ্পি আবার এটা নিয়ে খুব হাসত। কুটকুট করে হাসত আর বলত, “আপনি সত্যি একটা পাগল! কত ভাবি আপনাকে আর পাগল বলবো না। কিন্তু না বলে পারিই না! এমন এমন কাজ করেন!”

আজ এই কোলবালিশটাকেও মিস করছে শাহরিয়ার। পায়ের কাছ থেকে কোলবালিশটা এনে রোজকার মতোই মাঝে রাখল। তারপর কোলবালিশের উপর হাত রেখে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল!

পুষ্পির সেই চিরাচরিত স্বভাব। রাত যত বাড়ে, পুষ্পির চাপা কষ্ট তত বাড়ে। বুকের ভেতর কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসে। ঘুম তখন অসম্ভব হয়ে ওঠে। মস্তিষ্কে বাক্যব্যয় হয়, ‘পুষ্পি, তোর অনেক কষ্ট, অনেক। একটু কাঁদ, একটু দুঃখ বিলাস কর।’
পুষ্পি শোয়া থেকে উঠে বসে। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। খাটের পাশের ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস হাতে নিতে গিয়ে উপলব্ধি করলো তার হাত কাঁপছে। হার্ট খুব দ্রুত বিট হচ্ছে। বাহিরে তখন তুমুল বৃষ্টি। জানালা খোলা থাকায় বাতাসে পর্দা উড়ছে। পর্দা সরে বৃষ্টির আচ ঘরের মেঝে স্পর্শ করছে। পুষ্পি এক পলক সে দৃশ্য দেখল কিন্তু বিছানা থেকে নেমে জানালা আটকালো না। কোনো কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। শরীর কেমন অবশ অবশ লাগছে। কেবল এবং কেবলমাত্র চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। জীবনকে সে যতবারই সুখী উপাখ্যান করতে চেয়েছে, ততবারই কোনো না কোনো ভাবে জীবন তাকে উপলব্ধি করিয়েছে, সুখ তার জন্য কেবলই অভিলাষ, দুষ্প্রাপ্য বস্তু। এক হাত ঘাড়ের পেছনে রেখে চোখ বন্ধ করল পুষ্পি। এবার আর মেয়েটা নিজের চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারল না। টপটপ করে চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়ে। হুহু করে কেঁদে ওঠে। এবং ক্রমশ সেই কান্নার গতি বৃদ্ধি পায়।
শাহরিয়ারের ঘুম পাতলা হওয়ায় সে প্রতিবারের মতোই সজাগ হয়ে যায়৷ তবে ব্যতিক্রমী বিষয়টি ছিল, সজাগ হওয়ার পরও সঙ্গে সঙ্গে উঠে না যাওয়া। কিছুক্ষণ শুয়েই থাকে। ভেতরে একটু তোলপাড় হয়, তবুও চুপ করে রয়।
পুষ্পি হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদে। এত কষ্ট, এত! কান্নায় দম বন্ধ হয়ে আসে। শাহরিয়ার ধীরেসুস্থে উঠে বসে। মুখ গুঁজে থাকা পুষ্পির কাঁধে হাত রাখতেই পুষ্পি শাহরিয়ারকে জড়িয়ে ধরে। যেন মেয়েটা এই মূহুর্তটারই অপেক্ষায় ছিল। ভরসা খুঁজে পায় যে বুকে, সে বুকেই মুখ লুকায়।
এবার শাহরিয়ার মোমের মতন নরম হয়ে যায়, যেমন নরম তার বউটা! কন্ঠরোধ হয়ে আসে অনুরক্তিতে। পুষ্পির মাথায় হাত বুলায়। খুব আদর দিয়ে ডাকে, “পুষ্প!”
পুষ্পি কেবলই কাঁদে। কোনো কথা বলে না, বলা বাহুল্য বলতে পারে না।
শাহরিয়ার বলে, “কাঁদছ কেন? কতদিন নিষেধ করেছি এমন করে কাঁদতে! ইট’স ভেরি নরমাল। টেইক ইট ইজি। কাঁদবে না একদম।”

পুষ্পির কান্না বাড়ে বৈ কমে না। দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে থেকেই বলে, “নিষেধ করবেন না প্লিজ৷ আমার খুব কাঁদতে মন চাইছে, খুব খুব! এত কান্না আমি আটকে রাখতে পারছি না আর। আমায় একটু কাঁদতে দিন।”
শাহরিয়ার বরাবরের মতোই ব্যার্থ হয়। প্রশ্রয় দিয়ে কয়, “কাঁদো তবে। যত ইচ্ছে কাঁদো। আমি আছি তো। কোনো দুঃখ নেই।”

(চলবে)…….

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩২
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

মাসখানেক সময় অতিবাহিত হয়। পরিবারের উচ্ছলতায় যেই ভাটা পড়েছিল, তা উতরে ওঠার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়েছে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য। শাহরিয়ারের গতিবিধি এমন হয়ে ওঠে যে, মনেই হবে না সদ্যই সে এক প্রকট দুঃখ কাটিয়ে উঠেছে।
পুষ্পি শাহরিয়ারের মতো অত শক্তমনের নয়। আর তা নয় বলেই, অথবা তার সাথে বাচ্চাটা ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিল বলেই, এতদিনে দুঃখ কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। মা তো! মায়েরা দুঃখ লুকাতে জানে, ভুলতে নয়! প্রায়শই দলাপাকিয়ে কান্না জমে চোখে। কাজ করতে করতে কিংবা অলস সময়ে, আনমনে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কতদিন রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয় না। মাঝ রাতে উঠে বারান্দায় যায়, রুমে পায়চারী করে, কিংবা কখনও কখনও নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকে।
শাহরিয়ার কখনও কখনও টের পায়, কখনও বা পায় না। সে বোঝে, বোঝায়, “কেন অযথা এত মন খারাপ করছো? এত আল্লাহ ভীরু তুমি, অথচ আল্লাহর ফয়সালা আপসে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তোমার! আরে বোকা, আল্লাহর উপর ভরসা করো তো নাকি? তিনি যা করেছেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেছেন। তাঁর ফয়সালাই তো আমাদের জন্য সর্ব উত্তম।”
পুষ্পি দ্রুত মাথা নাড়ায়, “জানি, জানি তো। আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে আমার। কাঁদছি না তো আমি।”
মুখে এ কথা বললেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন। অঝোরে অশ্রু গড়ায় কপোল বেয়ে। শাহরিয়ার কাছে টেনে নেয়, মাথায় হাত বুলায়, “এত কেঁদো না প্লিজ।”

অনেক বোঝাতে বোঝাতে কিছুটা স্বাভাবিক হয় পুষ্পি। এও ভাবে, এই মানুষটা এমন না হলে, কেমন করে সামলাতো সব!

সাবেরী খাতুনের সাথে পুষ্পির যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তা গ্রহণ করতে মেয়েটার আরো বেশি কষ্ট লাগে। এই সময়টাতে যে সবচাইতে বেশি বুঝবে বলে প্রত্যাশা করেছিল, তার থেকে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোটেও কাম্য নয়। পুষ্পি ঘুরেফিরে সাবেরী খাতুনকে জিজ্ঞেস করে, আর তিনি দায়সারা জবাব দিয়েই এড়িয়ে যায়। মন খারাপ হয় পুষ্পির। ক্লাসে যাচ্ছে না আপাতত সে। ইচ্ছেই করে না!
মাঝেমধ্যে শাহরিয়ার তার কাছে পড়তে বসতে বলে। পুষ্পির লজ্জা লাগে, তাই সে নাকচ করে। খুব ধীরে বাক্যবাণ ছুড়ে, “আপনি ইংরেজী মাস্টার। আমার বাংলা সাহিত্যের কি বুঝবেন?”

শাহরিয়ার অট্টহাসিতে মাতোয়ারা হয়। হালকা পিঞ্চ মারার স্বরে কয়, “ও…তাই তো! কিছুই তো বুঝবো না!”

পুষ্পি ভ্রু’কুটি করে চায়। শাহরিয়ার অনুনয় করে, “আরে আসো বোকা! একটু বসো। দেখি কতটুকু কি পারো।”
পুষ্পি মনখারাপ করে জবাব দেয়, “কিচ্ছু পারি না৷ এত কঠিন! আমি গাধা স্টুডেন্ট। আপনি পরে হাসবেন।”
শাহরিয়ার এবারও হাসে। তবে তা মিটিমিটি। বলে, “আসো, কাছে আসো। হাসবো না। দেখি আমার গাধা বউকে আদর-সোহাগে মানুষ করতে পারি কিনা।”
পুষ্পি প্রতিত্তোর করে “ইশশ!” বলে।

শাহরিয়ার নিজেকে জাহির করে বলে, “তোমার মাস্টার স্বামীর, মাস্টার হিসেবে কিন্তু ভালোই সুনাম আছে। ফ্রিতে পাচ্ছো বলে, মূল্য দিচ্ছো না? পস্তাবে কিন্তু।”

এবার পুষ্পি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। কি নির্মল সুন্দর এই হাসি। শাহরিয়ার মুগ্ধ হয়ে চায়। এই টুকিটাকি কথপোকথন এর জেরে পুষ্পির জড়তা কেটে যায়। পড়তে বসে। এবং পড়তে পড়তে সে নিজেও মানতে বাধ্য হয়, তার স্বামী মোটেও আনাড়ি শিক্ষক নয়। তার দক্ষতা অসাধারণ। নয়তো ইংরেজির শিক্ষক হয়ে, বাংলায় এমন অনবদ্য দক্ষতা কখনই সম্ভব হতো না।
পড়া শেষে পুষ্পি বলে, ” টিচার হিসেবে আপনাকে আমি দশে সাড়ে নয় দিলাম।”

নিজের ইংরেজি বইগুলো নাড়তে নাড়তে শাহরিয়ার জানতে চায়, “বাকি হাফ কেন নয়?”
পুষ্পির মুখ গুমোট হয়ে যায়। বলে, “কারণ পড়ানোর সময় আপনি ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যান। এত সিরিয়াস শিক্ষক আমার ভাল্লাগে না। তাই হাফ কাটা।”
শাহরিয়ার না হেসে পারেই না।
এটা সত্যি যে পড়াতে গেলে সে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃত হয় যে বিষয়টি এমন না। অটোমেটিক হয়ে যায়।
এভাবেই যেতে থাকে দিন। পুষ্পির জড়তা কেটে যাওয়ার পর প্রায়শই পড়া পড়ে নেয় শাহরিয়ারের কাছে। আনমনে ভাবে, “বাহ! শিক্ষক স্বামী হলে লাভ আছে তো!”

এমনি সব পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক চললেও, কেবল সাবেরী খাতুনের সাথের অদৃশ্য দেয়ালটা দূর হচ্ছিল না কিছুতে। পুষ্পি আর পারছিলও না সইতে। একদিন বিকেলে তেল নিয়ে এলো সাবেরী খাতুনের কাছে। সাবেরী খাতুন দেখেও এড়িয়ে যেতে চাইল যেন। পুষ্পি সামনে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ায়। মায়াবী চোখ, মলিন মুখ।
সাবেরী খাতুন জিজ্ঞাসা ছুড়ে দেয়, “কি? কিছু দরকার?”
পুষ্পি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। মাথা নত করে অনুনয় করে, “মা? একটু তেল দিয়ে দিবেন চুলে? আপনি দিয়ে দিলে আরাম লাগে।”
সাবেরী খাতুনের নরম মন, শক্ত হয়ে থাকার মেকি ভান, “পারবো না এখন। কাজ আছে। পরে এসো।”

পুষ্পির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। সাবেরী খাতুনও যে কখনো এতটা রুড হবে কল্পনাও করতে পারেনি মেয়েটা।
সাবেরী খাতুনের নাকচের পর বিনাবাক্য ব্যায়ে চলে যেতে লাগে পুষ্পি।
সাবেরী খাতুন বোধহয় আর রুড হয়ে থাকতে পারলেন না। দুঃখ পেলে যার মুখ এমন মায়াকাড়া হয়ে যায়, তাকে দুঃখ দেয়া যে বড্ড দায়!

তিনি পেছন ডেকে বললেন, “দ্রুত আসো। হাতে অনেক কাজ আছে। এত আহ্লাদ করার সময় কই?”

রুড রুড আহ্বান হলেও পুষ্পি খুশি হয়ে যায়। মেয়েটাকে খুশি করা এত সহজ!

সাবেরী খাতুন আলতো করে চুলে তেল লাগিয়ে দিচ্ছিল। একপর্যায়ে পুষ্পি নরম স্বরে ডাকে, “মা!”

সাবেরী খাতুনের হৃৎস্পন্দন যেন বেড়ে যায়। কি দারুণ ভাবে ডাকে মেয়েটা!
সাবেরী খাতুন জবাব দেয়, “হুম!”

পুষ্পি বলে, “মা, আমার উপর রেগে আছেন?”
রুক্ষ জবাব, “না। বেশি বেশি ভাবার প্রয়োজন নেই।”
পুষ্পি দরদ দিয়ে কয়, “মা, আমার মাকে আমি পাইনি। মা বলতে আমি আপনাকেই বুঝি। মায়ের স্বাদ আমি আপনার সকল কাজে পাই। প্লিজ মা, এমন করে আমায় দূরে ঢেলে দিবেন না। আপনার ছেলে রাগ হলেও এত কষ্ট হয় না বোধহয়, যত কষ্ট আপনি রাগ করে থাকায় হচ্ছে।”
সাবেরী খাতুনের চোখ হঠাৎই ছলছল করে ওঠে। মেয়েটার উপর আসলে তো তার রাগ নেই, আছে কেবল অভিমান। তার অবাধ্য হয়ে, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নেয়ায়, এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটেছে বলে মনে হয় তার। আর সে কারণে অভিমান। নিজেকেও দায়ী করেন খানিক, আরেকটু যদি যত্নশীল হতো সে! পরক্ষণেই চিন্তায় আসে, আরেকটু যত্নশীল হলেই বা কি লাভ! তার কথা গ্রাহ্য করেছে কই? আর সে কারণেই অভিমানের পারদ এত বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে বিস্ময়ের বিষয়, সাবেরী খাতুনের অভিমানও আকস্মিক উধাও হয়ে যায়। মানুষের কথা কি শক্তি! সামান্য কথা দিয়ে সকল বেদনা নিরাময় করা যায়! কি আশ্চর্য।

সাবেরী খাতুন চুলে বিনুনি করতে করতে বলে, “পাগলি! তোর সাথে আমার কোনো কথা নাই। তুই আমার একটা কথাও শুনিস না। নিজেকে নিয়ে এত খামখেয়াল হলে হয়? আমি কি এতই খারাপ শাশুড়ি যে, আমার কোনো কথা শোনা যায় না! তুই আমায় অনেক বড়ো দুঃখ দিয়েছিস! সামান্য মনভুলানো কথা দিয়ে সব রাগ দূর করে দিবি ভেবেছিস? কিছুতেই না। অত ভালো শাশুড়িও না আমি।”

ব্যাস এটুকুতেই পুরো চিত্র পাল্টে যায়। পুষ্পি সেই পুরনো ভরসা করার কাধ খুঁজে পায়। কোমড় জড়িয়ে হুরহুর করে কেঁদে ফেলে। বলে, “আপনার থেকে ভালো শাশুড়ি হতেই পারে না কেউ। ইউ আর দ্যা বেস্ট। বেস্ট শাশুড়ি এভার!”

সাবেরী খাতুনের সাথে সেই পূর্বের ন্যায় খুনসুটি শুরু হয়ে যায়।
বাসায় ফিরে বাসার পরিবেশ পূর্বের ন্যায় দেখে, শাহরিয়ার বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, “এই তুমি এমন সবাইকে পটিয়ে ফেলো কি করে বলো তো?”

শাহরিয়ারের সাথে থেকে থেকে পুষ্পিও খুব কথার জবাব দিতে শিখে গিয়েছে। সে বলে, “ইট’স ম্যাজিক, মাস্টার মশাই।”

শাহরিয়ারও রসিকতা করে বলে,”আমাকেও একটু ম্যাজিক শিখাবেন, ম্যাজিশিয়ান বউ আমার?”

পুষ্পি জবাব দেয়, “নেভার। কখনো কি কোথাও দেখেছেন, ম্যাজিশিয়ানদের তাদের ম্যাজিক ট্রিকস শেখাতে? আমি শেখাবো কেন?”

এভাবেই খুনসুটি চলতে থাকে। রাতে ঘুমানোর সময় শাহরিয়ার বলে, “একটা গান শুনাবে? খুব শুনতে ইচ্ছে করছে তোমার কন্ঠে গান।”

পুষ্পিও শুয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ফিরে ছিল, শাহরিয়ারের কথা শুনে তার দিকে ফিরে। চমৎকার হাসে। মাথাটা শাহরিয়ারের একটু কাছে এনে নাকচ করে বলে, “উঁহু, গান পারি না।”

শাহরিয়ার সচরাচর যেই কাজটা করে, সেই কাজটাই করলো প্রথমে। পুষ্পি চুলে আঙুল বুলাতে লাগল। মুখে তার বিস্তর হাসি। অনুনয় করে, ” প্লিজ, দয়া করো! একটুখানি, আচ্ছা এক কলি?”
মানুষটা সবসময় এমন করে। অবাধ্য পুরুষ! পুষ্পিও পারে না, তার কোনো আবদার ফেলতে। ঠিক যেন বাধ্য বউ।
পুষ্পি গুনগুনিয়ে গান ধরে…..

“আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো,
গন্ধ বিলিয়ে যাই!
আমি মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো,
জোছনা ঝরিয়ে যাই!
আমি গানে গানে প্রানের যতো
বেদনা লুকাতে চাই!
আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো
গন্ধ বিলিয়ে যাই!

বুকেরই মাঝে, যে বাঁশী বাজে
অকারনে বার বার,
পায় না তো অধিকার!
আজো এ কথা আমি যে শুধু
নিজেকে বোঝাতে চাই!
আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো,
গন্ধ বিলিয়ে যাই!”

গান শেষ করে পুষ্পি শাহরিয়ারের দিকে চায়। শাহরিয়ারের চোখেমুখে মুগ্ধতা। কপালে ওষ্ঠ স্পর্শ করে বলে, “সত্যিই আমার রজনীগন্ধা! এত ঘ্রাণ, এত সুমিষ্ট, দিশেহারা আমি!”

পুষ্পি শাহরিয়ারের হাতে মাথা রেখে চোখ বুজে বলে, “আর আপনি আমার গন্ধরাজ! এখন ঘুমান, মাস্টার। সকালে ক্লাস আছে আপনার।”

শাহরিয়ার জীবনের সমস্ত দুঃখ ভুলে যায়, পুষ্পি যখন ওর খুব কাছাকাছি থাকে। মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখলে কোনো কষ্টই যেন কষ্ট নয়, এমন লাগে। এই প্রেম, শুদ্ধ প্রেম।
শাহরিয়ার খুব নিরীহ ভাবে ডাকে, “পুষ্প?”
পুষ্পি চোখ বুজে থেকেই জবাব দেয়, “হু?”

শাহরিয়ার তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। পুষ্পির দিকে চেয়ে বলে, “রিসেন্টলি আমি একটা ব্যাপার এনালাইসিস করেছি।”

“হুম!” পুষ্পির ছোট জবাব।

শাহরিয়ার বলে, “আরেহ! চোখ মেলো! মন দিয়ে শোনো কি এনালাইসিস করেছি?”

পুষ্পি বাধ্য হয়ে চোখ মেলে চায়। বলে, “শুনছি তো!”

শাহরিয়ার গুরুত্ব সহকারে বলে, “আচ্ছা শোনো। আমি অনুধাবন করলাম, বিয়ের আগে প্রেমে পড়া, নরমাল। কিন্তু বিয়ের পর প্রেমে পড়া, ডেঞ্জারাস। নট অনলি ডেঞ্জারাস, ইট’স ভেরি ডেঞ্জারাস।”

পুষ্পি ধপ করে উঠে বসে। ভ্রুকুটি করে চেয়ে বলে, “মানে? বিয়ের পর প্রেম মানে? এই? আপনি পরকীয়া করছেন? ছিঃ! আল্লাহ!”

শাহরিয়ার হো হো করে হেসে ওঠে। টানা পাঁচ মিনিট সে ননস্টপ হাসে। কিছুতেই সে তার হাসি থামাতে পারছিল না।

পুষ্পি ঠোঁট উল্টে কপট রাগের সহিত বলে, “পরকীয়া করেন, আবার হাসেন! এই…আপনি আমার কাছ থেকে সরুন তো। খারাপ স্বামী!”

শাহরিয়ার দূরে যাওয়ার বদলে বরাবরের মতোই কাছে আসে। বলে, “ইশশ! নিষ্ঠুর! কাছে টানার বদলে দূরে যেতে বলো! মায়া-দয়া নাই অন্তরে? প্রেমের দহন তো বোঝো? বোঝো তো না-ই, বরং বাড়িয়ে দিচ্ছো, নির্দয় বউ!”

“এমন পরকীয়া করা পুরুষের জন্য দয়া হবে, অতোটাও আলাভোলা বউ আমি নই!”

শাহরিয়ার এবারও হাসে। পুষ্পি আরো রেগে যায়৷ বলে, “খারাপ! আপনার নামে আমি থানায় মামলা দিব। এমন ভালো বউ রেখে পরকীয়া করছেন, আবার সেটা জাস্টিফাই করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বউয়ের কাছেই! ছিঃ….!”

পুষ্পির কপালের কাছে এসে জমে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, নির্মল প্রেম নিয়ে শাহরিয়ার বলে, “কোন পুরুষের সাধ্য আছে, এমন সুন্দরীতমাকে রেখে অন্য নারীর প্রেমে পরার? ওহে প্রেমময়ী তব প্রেম দাও বিলিয়ে, মোর মনে-প্রাণে।”

পুষ্পি শুরুতেই বুঝেছিল শাহরিয়ার বিয়ের পর প্রেমের কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল। তাও মেকি রাগ দেখিয়েছে। আসলে স্বভাবটা সে শাহরিয়ারের থেকেই জব্দ করেছে। বুঝেও না বোঝার ভান, অযথা কথার বাণ! সে বলে, “না, দিব না।”
শাহরিয়ার অনুনয় করে, “প্লিজ দাও।”
পুষ্পি চোখেমুখে স্বতঃস্ফূর্ত হাসির রেখা এঁকে পুনরায় একই জবাব দেয়, “উঁহু! পারবো না।”

শাহরিয়ার দুখী দুখী হয়ে ছন্দ মিলায়,
“তুমি দিও না আমায় ফিরিয়ে, ওহে নিষ্ঠুর নারী,
ফিরাইয়া দিলে তুমি, আমি মরিয়া যাইতে পারি।”

পুষ্পি সচরাচর আওয়াজ করে হাসে না। কিন্তু শাহরিয়ারের এমন উদ্ভট কর্মকান্ড প্রায়শই তাকে তার নিজস্ব গন্ডি থেকে বের করে আনে। সে হাসতে হাসতেই শাহরিয়ারকে উপাধি দেয়, “পাগল মাস্টার! ইশশ, মাস্টারী করলে মানুষ সত্যি এমন পাগল হয়ে যায় বুঝি!”

শাহরিয়ার পাল্টা প্রতিত্তোর করে, “উঁহু, মাস্টারি করলে না, মাস্টারের ঘরে এমন সুন্দরী রমনী থাকলে সে নির্ঘাত পাগল হবেই। এমনকি শুধু পাগল না, পাগলের সাথে সাথে ছাগল, গরু, মহিষ, ভেড়া, যা কিছু হয়ে যেতে পারে! কোনো গ্যারান্টি নাই।”

পুষ্পি আর্তনাদ করে বলে, “ইয়া আল্লাহ! এই পাগল নিয়ে কই যাই!”
শাহরিয়ার পুষ্পির হাত টেনে কাছে এনে বলে, “চলো, আমি দেখাই কই যাবা!”

(চলবে)……