#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩৩
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
চৈত্র মাস। রোদে চোখ মেলে রাখা দায়। চিকচিক করা সূয্যিমামার তেজ সহ্য করা দুষ্কর। ধূসর সাদা মেঘ বড়ো মায়া করে রয় সমস্ত আকাশ জুড়ে। সূর্যকে আগলে রাখার বড্ড দায় যেন তার!
পুষ্পি ছাদে কাপড় শুকাতে আসে। সদ্য গোসল করে এসেছে সে। কপাল, ঘাড়, কাপড়ের আঁচল ভিজে আছে পানিতে। মাথার চুল গামছা দিয়ে বাঁধা থাকলেও কপালের কাছে বেড়িয়ে থাকা চুলগুলো বেয়ে জল গড়ায়। পুষ্পি পরিহিত কাপড়ের আঁচলখানা কোমড়ে গুজে দেয়। হাতের দুটো লাল কাচের চুড়ি ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে। এত স্নিগ্ধ দেখায় মেয়েটাকে! কাপড় রোদে দিতে দিতে গুন গুন করে, “আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন, খুঁজি তারে আমি আপনায়! আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি, আমার পিয়াসী বাসনায়!”
এমন সময় মুনমুন আসে ছাদে। খয়েরী রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটা। ছোট চুলগুলো বেণি করা। কাঁধ ছুঁতে পারে ছোট এই বেণিটা।
পুষ্পি মুনমুনকে দেখে সুন্দর হাসে। জিজ্ঞেস করে, “কলেজ নেই আজ?”
মুনমুন জবাব দেয়, “ভালো ক্লাস নেই আজ। তাই ক্লাস করিনি। তবে কোচিংটা করে আসবো ভাবছি। সামনে এক্সাম। এখন কোচিং-টোচিং বাদ দেয়া ঠিক হবে না।”
পুষ্পি সহাস্যে জবাব দেয়, “ইমম…তা ঠিক। নামাজ পড়েছো? কোচিং কখন?”
“নামাজ পড়বো এখন। কোচিং তিনটায়, ভাবি।”
পুষ্পি বলে, “ওকে, নিচে যাও। আমি নামাজ পড়ে আসছি৷ খাবার বেরে দিব। খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে যেও।”
মুনমুন সম্মতি জানিয়ে বলে, “আচ্ছা।”
আচ্ছা বলার পরও মুনমুন নিচে না গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। যেন কিছু বলতে চাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ।
পুষ্পি রোদের তাপে ভালোমতো চাইতে পারছিল না। তাও একটু ঘুরে জানতে চায়, “কী ব্যাপার? কিছু বলবা মুন?”
মুনমুনের খানিক জড়তা, খানিক অস্বস্তি। আমতা আমতা করে বলে, “কিছু চাইবো, দিবা ভাবি?”
পুষ্পি কিঞ্চিৎ অবাকই হয়। মুনমুন তার কাছে কখনো এভাবে কিছু চায়নি। যা প্রয়োজন হয়, মাকে বলে, মা শাহরিয়ারকে কিংবা হাসনাত সাহেবকে বলে। পুষ্পি বিয়ে হয়ে আসার পর এই প্রথমই বোধহয় এমন করে কিছু চাইল মেয়েটা। পুষ্পি মুনমুনের কাছে এগিয়ে যায়। কাধে হাত রেখে সহাস্যে জানতে চায়, “কি চাও? বলো? এমন করে তো কখনো কিছু চাওনি!”
মুনমুন উচ্ছ্বসিত হয়ে জানতে চায়, “তাহলে দিবা বলো?”
পুষ্পি এমনিতেও খুব একটা ‘না’ করতে পারে না, আর এখানে তো তার না করা প্রায় অসম্ভব প্রায়। বলে, “আচ্ছা দিব। কি চাই বলো।”
মুনমুন একটু অস্বস্তি, একটু জড়তা নিয়ে আবদার করে, “আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবা? খুব আর্জেন্ট, প্লিজ?”
পুষ্পি বিষয়টা মোটেও সিরিয়াস ভাবে নেয়নি। বরং খুব হালকা ভাবে নিয়ে বলে, “এই ব্যাপার? এজন্য এত অস্বস্তি? তোমার টাকা লাগবে, যখন লাগবে বলবা। তোমার ভাই থাকতে টাকা চাইতে এত কুন্ঠাবোধ কেন? আচ্ছা আমি তাকে বলবো তোমায় জেন টাকা দেয়।”
মুনমুন আঁতকে উঠে বলে, “না না! ভাইয়াকে বলবা না প্লিজ। ভাইয়া, মা, কাউকে বলবা না প্লিজ। আমি তোমার থেকে চাইছি, তুমি দিবা।”
পুষ্পি হেসে দিয়ে বলে, “শোনো বোকা মেয়ের কথা! আমি কি রোজকার করি? আমাকে তো তারাই দেয়। আমার সব তো তাদেরই।”
মুনমুন আবদার অপরিবর্তনীয় রেখেই বলে, “অতো কিছু বুঝি না। আমি তোমার থেকেই নিতে চাই, তুমিই দিবা। আর কাউকে বলবা না প্লিজ।”
পুষ্পি বুঝতে পারে, মেয়েটাও হয়েছে তার ভাইয়ের মতো নাছোরবান্দা। তাই হার মেনে নিয়ে বলে, “আচ্ছা, দিলাম। কত লাগবে বলো?”
মুনমুন চোখমুখ করুন করে বলে, “খুব বেশি না ভাবি। চার-পাঁচ হাজার হলেই হবে।”
পুষ্পি বেশ অবাক হয়। ছোট মানুষ যা লাগে বাবা এবং ভাই এক বলাতেই এনে দেয়৷ বলা বাহুল্য বলার আগেই সব পেয়ে যায়৷ তাও মাস শেষে একটা এমাউন্ট হাত খরচ হিসেবে সাবেরী খাতুনের কাছে দিয়ে রাখে শাহরিয়ার। সাবেরী খাতুনও সেখান থেকে রোজ কিছু হাতখরচ দেয়। কিন্তু আকস্মিক এত টাকা প্রয়োজন হওয়ার কারণ খুজে পায় না পুষ্পি। চলন-বলনেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এসেছে মেয়েটার। হয়তো কৈশোর পার হচ্ছে, বড়ো হচ্ছে, তাই ভেবে খুব একটা গা করে না সে। তাও আজ একটু অবাকই হলো বৈকি। জানতে চাইল, “এত টাকা দিয়ে কি করবে হঠাৎ?”
মুনমুন মলিন মুখ করে বলে, “দিবা না বললেই হয়। এত প্রশ্ন করছো কেন? আমি বড়ো হইনি? কিছু বাড়তি হাত খরচ লাগতে পারে না আমার? মায়ের কাছে চাইলে মাও এমন উদ্ভট প্রশ্ন করতো তাই চাইনি। তোমার কাছে চেয়েছি। তুমিও দেখছি সেই একই কাজ করছো। না দিলে না দিবা, ব্যাস। এত প্রশ্ন করবে না প্লিজ।”
পুষ্পি হতচকিত হয়ে বলে, “রাগ করছো কেন? জানতে চেয়েছি শুধু। জানতে পারি না? আমায় ফ্রেন্ডলি ভাবো না তুমি?”
মুনমুন একটু নরম হয়। পুষ্পিকে সে পছন্দ করে, ফ্রেন্ডলি মিশে, এটা সত্য। তাই অস্বীকার করার উপায় নেই৷ স্বাভাবিক হয়ে বলে, “আসলে, আমরা ফ্রেন্ডরা মিলে একটু হ্যাংআউট করতে চাচ্ছি৷ আর ওদের বলেছি, আজ আমি ট্রিট দিব ওদের৷ তাই লাগবে। পারবে তুমি দিতে?”
পুষ্পির কাছে আছে কিছু টাকা জমানো। শাহরিয়ার যা হাতখরচ দেয়। তার প্রায় সিংহভাগই রয়ে যায়। খুবই মিতব্যয়ী হওয়ার ফল স্বরূপ বেশ কিছু টাকা জমেছেও। সে বলল, “আজই লাগবে?”
মুনমুন আদুরে ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। পুষ্পি বলল, “আচ্ছা যাওয়ার সময় নিয়ে যেও।”
মুনমুন খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, “ইউ আর দ্যা বেস্ট, ভাবী। আই লাভ ইউ।”
পুষ্পির মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। আপন মানুষকে খুশি করতে পারা কত যে আনন্দের! শাহরিয়ারও যখন ছোট ছোট কারণগুলোতে খুশি হয়, তখনও খুব ভালো লাগে পুষ্পির। পুষ্পি শরীরে হাত-পা দেয়া একদম পছন্দ করে না। অস্বস্তি হয়। কিন্তু শাহরিয়ার প্রায়শই তার বলিষ্ঠ শরীরে হাত-পা পুষ্পির উপর দিয়ে রাখে। পুষ্পি মাঝেমধ্যে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ কাজটি সে করে না। কারণ শাহরিয়ার এতে কম্ফোর্ট জোন খুঁজে পায়, তার ভালো লাগে, তাই পুষ্পিও ভালো লাগা খুঁজে নেয় এতে। অভ্যস্ত করে ফেলে নিজেকে। প্রিয় মানুষের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস তো করাই যায়। প্রিয় মানুষের সুখ স্বর্গীয় আনন্দ দেয়।
মুনমুন খাওয়াদাওয়া শেষ করে কোচিং-এ যাওয়ার পূর্বে পুষ্পির থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে যায়৷ সুন্দর করে সেজেগুজে বের হচ্ছে মেয়েটা। পুষ্পি ওয়ার্নিং দিয়ে দেয়, “মাশাআল্লাহ, সুন্দর লাগছে। তবে বেশি দেরি করো না ফিরতে। সন্ধ্যার আগেই ফিরে এসো। তোমার ভাইয়া জানতে পারলে রাগ করতে পারে।”
মুনমুন পুষ্পিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “কোনো চিন্তা করো না। ভাইয়া ফেরার আগেই ফিরে আসবো। থ্যাংকস এগেইন।” বলেই সে বেড়িয়ে যায়।
মুনমুন চলে যাওয়ার পর পুষ্পি একটু নিজের রুম পরিপাটি করে ঘন্টা খানেক ঘুমায়। রোজ ভাবে দুপুরের টাইমটাতে না ঘুমিয়ে কিছু কাজ করবে৷ হাতের কিছু কাজ পারে, সেগুলো করবে। কিন্তু দুপুরের খাওয়ার পর এত ঘুম পায় তার। চোখ লেগে আসে। কখনও কখনও খাটে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পরে। আজ অবশ্য নিজ ইচ্ছায় শুল। ঘুমে চোখ মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। পুষ্পির ঘুম ভাঙল আছরের আযানের ধ্বনিতে। উঠে ওজু করে নামাজ পরে। সাবেরী খাতুনকে ডেকে দেয় নামাজের জন্য। সে এই কাজটা প্রায়ই করে।
সাবেরী খাতুনও উঠে নামাজ পড়ে।
পুষ্পি চা করে আনে। সময় তখন ছয়টার কাছাকাছি। পাচটার আগেই অন্য সময় মুনমুন চলে আসে। আজ দেরি দেখে সাবেরী খাতুন পুষ্পিকে বলে, “মা, মুনকে একটু কল দিয়ে দেখো তো দেরি হচ্ছে কেন।”
পুষ্পি বলে, “দুশ্চিন্তা করবেন না মা। ও আমায় বলে গিয়েছে আজ একটু দেরি হবে। তবে বলেছে মাগরিবের আগে চলে আসবে।”
যেহেতু বলে গিয়েছে তাই সাময়িক ভাবে সাবেরী খাতুনের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকে না।
আসল চিন্তা শুরু হয় মাগরিবের পরও মুনমুনের না ফেরায়!
এবার পুষ্পিরও দুশ্চিন্তা হয়। শাহরিয়ার তখনও আসেনি বাসায়। হয়তো মাগরিব মসজিদ থেকে পরে আসবে। এদিকে পুষ্পির বেশ ভালোই চিন্তা হতে থাকে। সাবেরী খাতুনও অস্থিরতা অনুভব করতে থাকে। মাগরিব নামাজ শেষ করেই পুষ্পি মুনমুনের ফোনে কল করে। কিন্তু প্রকৃত অস্থিরতা তখনই শুরু হয়, যখন দেখে মুনমুনের ফোন বন্ধ! পুষ্পির বুকটা ধুক করে ওঠে। ফোন বন্ধ কেন?
সাবেরী খাতুন জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার মা? এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমায়?”
পুষ্পি আরো কয়েকবার ফোন দিয়ে বলে, “ফোন বন্ধ বলছে, মা!”
হাসনাত সাহেব শহরে বাহিরে ব্যাবসায়ীক কাজে। যা তার প্রায়শই থাকতে হয়। তবে শাহরিয়ার ততক্ষণে চলে আসে। ঘরে প্রবেশ করতে করতে সাবেরী খাতুনকে সালাম দেয়। সাবেরী খাতুন সালাম নিয়ে বলে, “বাবা এসেছিস। দ্রুত আয়। মুন তো এখনও বাসায় ফেরেনি!”
শাহরিয়ারের ভ্রু কুচকে আসে। বলে, “বাসায় ফেরেনি মানে? ও কলেজ গিয়েছিল? কই দেখিনি তো!”
পাশ থেকে পুষ্পি বলে, “ক্লাস করেনি। তবে বিকেলের দিকে কোচিং-এ গিয়েছিল।”
শাহরিয়ার আরও অবাক করার কথা বলে, “না তো! ও তো কোচিং-এও যায়নি। আমি তো গিয়েছিলাম ওর কোচিং এ। বলল, যায়নি! আমি ভাবলাম শরীর-টরীর খারাপ হয়তো!”
পুষ্পি যারপরনাই অবাক হয়।
শাহরিয়ার প্রশ্ন করে, “পুষ্পি তুমি আমায় খুলে বলো তো, ও তোমায় কি বলে গিয়েছিল?”
পুষ্পি বুঝতে পারে, কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। তাই সে সবটা খুলে বলে।
শাহরিয়ার রেগে আগুন হয়ে যায়। সাবেরী খাতুনও অবাক। শাহরিয়ার অনবরত মুনমুনের নাম্বারে কল করে৷ ফোন বন্ধ।
পুষ্পি বলে, “আপনি অস্থির হবেন না প্লিজ। একটু শান্ত হোন। আমার মনে হয় বন্ধুরা মিলে মজা করছে তাই……!”
শাহরিয়ার ধমকে উঠে পুষ্পিকে থামিয়ে দেয়। পুষ্পির উপর প্রচন্ড রাগ হয় তার। সাবেরী খাতুন দুশ্চিন্তায় স্তম্ভিত হয়ে রয়।
শাহরিয়ার পুষ্পিকে উদ্দেশ্য করে বলে, “তোমার কি এটুকুও বুদ্ধি নেই পুষ্পি? এমন নির্বোধের মতো কাজ কি করে করলে তুমি? ভালোবাসা মানেই কি যা চাইবে তাই দিয়ে দিতে হবে? কোনো শাসন-বারণ নেই? কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়, সেটুকু বোঝার বোধ নেই তোমার? বোকা মতো করো সবসময়!”
পুষ্পি এইমূহুর্তে শাহরিয়ারের কথায় কোনো দুঃখ নেয় না। কারণ এখন সবচেয়ে বেশি জরুরী মুনমুনের ফিরে আসা। সে বলে, “ঠিক আছে, মেনে নিচ্ছি আমার দোষ। এখন আগে মুনকে খুঁজে আনুন প্লিজ।”
শাহরিয়ার নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বলে, “কই গিয়েছে, কোথায় হ্যাংআউট করবে, বলেছে কিছু।”
পুষ্পি ভয়ে ভয়ে না সূচক মারা নাড়ায়৷ শাহরিয়ার কিড়মিড়িয়ে ওঠে। তার অবস্থা এমন, ‘না পারছে কইতে, না পারছে সইতে!’ বলে, “ওর কোনো ফ্রেন্ডের নাম্বার আছে কারো কাছে? নাকি তাও নেই?”
পুষ্পি দ্রুত নিজের ফোন চেক করে। সৌভাগ্যবশত সেখানে লাবণ্যর নাম্বার খুঁজে পায়। ভাগ্যিস কোনো এক কথার ফাঁকে নিয়ে নিয়েছিল নাম্বার।
পুষ্পি ভীত স্বরে বলে, “লাবণ্যর নাম্বার আছে।”
শাহরিয়ার ক্ষিপ্রতার সহিত বলে, “কল দাও, বোকার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে।”
পুষ্পি কল দেয়। দুবার রিং হওয়ার পর লাবণ্য কল রিসিভ করে। ওপাশ থেকে লাবণ্য সালাম দেয়৷ পুষ্পি সালাম নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়েই প্রশ্ন করে, “লাবণ্য, তোমরা কোথায় আছো? মুনমুন কোথায়? ও তো এখনও বাসায় ফিরেনি। সবাই দুশ্চিন্তা করছে। মুনকে একটু ফোনটা দাও।”
লাবণ্য অবাক মিশ্রিত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করে, “মুনমুন তো আমার সাথে নেই। ও তো আজ কলেজও আসেনি! কোচিং-এও না। ফোনও বন্ধ পেলাম। কিছু কি হয়েছে? স্যার কোথায়?”
লাউড স্পিকার বাড়ানো থাকায় সবাই সব শুনতে পায়। শাহরিয়ার পুষ্পির থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে লাবণ্যকে জিজ্ঞেস করে, “লাবণ্য? তোমার স্যার বলছি। আজ কি তোমাদের হ্যাংআউট করার প্ল্যান ছিল?”
লাবণ্য প্রথমে সালাম দেয়৷ একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “ন….না তো স্যার! ইভেন আমরা প্রায় সবাই তো আজ ক্লাস করলাম, কোচিং করলাম। মুন আর ইফাজ ছাড়া! এমন কোনো প্ল্যান তো ছিল না!”
এ কথা শোনার পর পুষ্পির হাত-পা কাঁপতে থাকে রীতিমতো। সাবেরী খাতুনের মাথায় হাত৷ শাহরিয়ার ঘামে ভিজে ওঠে। মাথা কাজ করছে না। তার বোন, এত আদরে, যত্নে, শাসনে গড়ে তোলা বোন বখে গেল! চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল।ধপ করে সোফায় বসে পরে বলল, “ইফাজের নাম্বারটা দিতে পারবে?”
লাবণ্য নাম্বার দিল। এরপর শাহরিয়ার বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল। পুষ্পি জানতে চাইল, কই যাচ্ছে৷ শাহরিয়ার গম্ভীর কন্ঠে বলল, “একটা কথাও বলবে না আমার সাথে পুষ্পি, একটা কথাও না। আমার বোন কোথায় যাচ্ছে, সেটুকু খেয়াল যখন দ্বায়িত্ব সহকারে রাখতে পারোনি, আমি কোথায় যাচ্ছি তা জানারও কোনো প্রয়োজন নেই তোমার।”
পুষ্পির কান্না পেয়ে গেল। যতটা না কষ্ট পেয়েছে শাহরিয়ারের রুড ব্যবহারে, তার চাইতেও বেশি পেয়েছে এই ঘটনাটার সাথে নিজের জড়িয়ে যাওয়াতে। শাহরিয়ারের বড্ড আদরের বোন। যতটুকু শাসন উপরে উপরে দেখায়, তার চাইতেও বেশি সে বোনকে ভালোবাসে, আগলে রাখে। আর কেউ না জানুক, না বুঝুক, সে বুঝে শাহরিয়ারের কাছে মুনমুন ঠিক কতটা ইম্পর্ট্যান্ট। এহেন পরিস্থিতি তার কাছে মেনে নেওয়া কঠিন হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু সে কি করে বুঝবে মুনমুন এমন কিছু করতে পারে! সে তো তার মন রক্ষার্থেই এমনটা করেছে! সাবেরী খাতুনও ভুল বোঝে। তিনি বলেন, “আমার কাছেও তো শেয়ার করতে পারতে বিষয়টি তুমি। আল্লাহ না করুক আজ যদি আমার মেয়েটার কিছু হয়ে যায়, কখনো ক্ষমা করতে পারবো না তোমায়। না আমি, না আমার ছেলে। তুমি পারবে নিজেকে নিজে মাফ করতে?”
কোন উত্তর নেই পুষ্পির কাছে। নিজেকে নিজের চপটাঘাত করতে ইচ্ছে করে। ভাবে, শাহরিয়ার ঠিক বলেছে, এত বোকা, নির্বোধ, দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন সে!
(চলবে)……
#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
রাত সাড়ে দশটায় শাহরিয়ার বাড়ি ফিরল সাথে মুনমুনকে নিয়ে। পুষ্পি এবং সাবেরী খাতুন দুজনই সাময়িক ভাবে হাফ ছেড়ে বাঁচল। ঘরে প্রথমে শাহরিয়ার প্রবেশ করল, শাহরিয়ারের পেছন পেছন মুনমুন। ভয়ে তটস্থ মুখশ্রী, নিভুনিভু দৃষ্টি। মুনমুন প্রবেশ করতেই সাবেরী খাতুন টেনে মুনমুনকে একটু দূরে সরিয়ে নিল। মা তো, তাই শুরুতে রাগ না দেখিয়ে দুশ্চিন্তার-ই প্রকাশ ঘটাল। এক হাত ধরে রেখেই জানতে চাইল, “কই গিয়েছিলি?”
মুনমুন মাথা নিচু করে ফেলে।
শাহরিয়ার রক্তবর্ণ দৃষ্টি, রাগে কিড়মিড় করে দাঁত, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করা। প্রচন্ড জেদ নিয়ে বলে, “এখন জেনে কি হবে, কই গিয়েছে, না গিয়েছে? এটুকু রেসপনসেবলিটি তোমাদের নেই, মেয়ে কই যাচ্ছে, কি করছে, কোনো কিছুর খোঁজ রাখতে পারো না। শাসন-বারণ তো করোই না, আমি করতে গেলে বারংবার বাধা দিয়েছো। দেখেছো প্রশ্রয়ের ফলাফল? বেয়াদবের শীর্ষস্থান জয় করে ফেলেছে। ইচ্ছে করছে….” বলেই তেড়ে যেতে চায় মুনমুনের কাছে।
পুষ্পি আটকায়। শাহরিয়ার ক্রোধ নিয়ে বলে, “মা, এই বেয়াদব এর আর পড়াশোনা হবে না৷ পড়াশোনায় মন নেই তার। বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, ফুর্তি আর দুঃসাহসে মেতে উঠেছে সে। ফাজিল, বদমাইশ ছেলেপেলের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, জানো তুমি মা? পড়াশোনা করতে হবে না ওর আর। বিয়ে দিয়ে দাও, সংসার করুক।”
রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মানুষটা। যা মুখে আসছে, তাই বলছে। কোনটা বলা উচিৎ, কোনটা অনুচিত তা নিয়ে দু’বার ভাবছে না।
ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করছে পুষ্পির, তাও আটকানো প্রচেষ্টা ছাড়েনি। সামনে দাঁড়িয়ে পথ রোধ করে দুহাত ধরে আটকে রাখে। নরম কন্ঠে বলে, “একটু শান্ত হোন। কিসব বলছেন!”
শাহরিয়ার দমে যায় ঠিকই তবে ফলস্বরূপ রাগ সম্পূর্ণটা টার্ন করে পুষ্পির উপর।
শাহরিয়ার ঘন ঘন শ্বাস ফেলে, রাগান্বিত মুখ নিয়ে পুষ্পির দিকে চায়। পুষ্পির হাত ছাড়িয়ে দিয়ে বলে, “পারলে ভালো কিছুতে প্রশ্রয় দিবে, ভালো কিছু শিখাবে। বাজে কাজে প্রশ্রয় দিয়ে, আজেবাজে কাজ করতে উৎসাহিত করবে না। যদি সেটুকু না পারো নেক্সট টাইম এমন কিছু করবে না, যার ফলে আমার বোনের ক্ষতি হবে।”
পুষ্পি বিস্ময় নিয়ে জানতে চায়, “কেবলই আপনার বোন? আমার বোন না ও?”
“যদি হতোই তবে, আজকে যা করেছ, যেভাবে নিরব সায় দিয়েছো, তা করার আগে হাজার বার ভাবতে কমনসেন্স দিয়ে; আদো এটা ভুল নাকি ঠিক। এমন নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে না।”
কথাটা বলেই উপরে চলে গেল মানুষটা। অথচ তার এই দুই লাইনের বাক্যটিতে যে একটা মানুষের হৃদয়ে দহনের সৃষ্টি হলো তা বুঝতেও পারল না।
পুষ্পি প্রচন্ড দুঃখ পেল। দুঃখে ভারী হয়ে এলো বুক। ছলছল চোখ সামলে নিয়ে মুনমুনের কাছে এলো। শাহরিয়ার তো কিছুই বলেনি। তাই মুনমুনের কাছেই জানতে চাইল, “কই গিয়েছিলে? বলেছিলে না হ্যাংআউট করবে? মিথ্যে কেন বলেছ আমায়?”
মুনমুন বলে, “ভাবী…”
সাবেরী খাতুন মুনমুনকে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই তার কাছে টেনে এনে সজোরে মুনমুনের গালে চড় বসালো। বলল, “আমতা আমতা করছিস কেন? অসভ্য! বল কই গিয়েছিস? নাহয় তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো।” বলে পুনরায় মুনমুনের দিকে তেড়ে আসতে চায়।
পুষ্পি এবারও সাবেরী খাতুনকে আটকায়। বলে, “আগে বলার সুযোগ তো দিন। প্লিজ মারবেন না।”
সাবেরী খাতুন রাগান্বিত হয়ে বলে, “শাহরিয়ার ঠিকই বলেছে, সুযোগ দিয়ে দিয়ে এটাকে ফাজিল বানিয়েছি। পড়াশোনার বয়সে যা নয় তাই করে বেড়াচ্ছে। এই বয়সে প্রেম করছে, ভাবতে পারছো? কতটা অধঃপতন হয়েছে!”
মুনমুন পুষ্পির এক হাত জড়িয়ে ধরে রেখেছে৷ চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু গড়াচ্ছে।
পুষ্পি বলে, “বাদ দিন না মা। ছোট মানুষ ভুল করেছে। ভুল থেকেই তো শিখে মানুষ। আপনার ছেলে তো এত বকলো। এখন আপনিও যদি….! সবাই মিলে শাসন করলে কেমন করে হবে?”
সাবেরী খাতুন কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে যায়। মুনমুনের এমন কাজ পরিবারের কারো পক্ষে মেনে নেওয়াই সম্ভব নয়।
পুষ্পি মুনমুনকে উদ্দেশ্য করে বলে, “চলো, রুমে চলো। এখানে আর থাকতে হবে না।”
পুষ্পি মুনমুনকে নিয়ে রুমে আসে। মুনকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। ততক্ষণে সে খাবার রেডি করে নিয়ে আসে রুমে। মুনমুন প্রথমে খাবে না বলে জেদ করলেও, শেষে পুষ্পির কাছে হার মানে। কারণ ও জানে, আজ ওর কারণে অনেক কিছু সইতে হয়ে পুষ্পিকে। পুষ্পি খাইয়ে দিতে দিতে জানতে চায় বিস্তারিত। মুনমুন খানিক সময় নিয়ে বলে, “আমি বুঝতে পারিনি এত দেরি হয়ে যাবে।”
পুষ্পি বলে, “তুমি কার সাথে ঘুরছিলে?”
মুনমুন আমতা আমতা করে বলে, “ইফাজ।”
পুষ্পি জিজ্ঞেস করে, “তোমার ইয়ারমেট সেই বন্ধুটা? একটু দুষ্টু টাইপ?”
মুনমুন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
পুষ্পি অবাক হয়ে বলে, “এতসময় ধরে কই ঘুরছিলে তোমরা?”
মুনমুন বলে, “প্রথমে কিছু জায়গায় ঘুরেছি। তারপর একটা রেস্টরন্টে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা পার্টি হচ্ছিল, আমরা পার্টিতে অ্যাটেন্ড করলাম। যার ফলে কখন যে এত দেরি হয়ে গেল, বুঝতে পারিনি।”
পুষ্পি বিস্ময় নিয়ে বলে, “তুমি জানো, তুমি যে কত বড়ো অন্যায় করেছো? আজ যদি তোমার কিছু হতো, তাহলে কি হতো ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারো? খুব অন্যায় করেছো।”
মুনমুন কাঁদতে কাঁদতে বলে, “ভাইয়াও তো অন্যায় করেছে৷ তুমি জানো ভাবী? ভাইয়া ওর বাবাকে ডাকিয়েছে। অতো মানুষের সামনে ওর বাবা ওকে থাপ্পড় মেরেছে। আমি জানি, বাসায় নিয়ে হয়তো আরো মারবে। ভাইয়া কাজটা ঠিক করেনি ভাবি, একদম ঠিক করেনি। ও অতোটাও খারাপ না, যতটা ভাইয়া ভাবে, বিশ্বাস করো ভাবী।”
পুষ্পি বুঝতে পারে মুনমুন সম্পূর্ণ আবেগে ডুবে আছে৷ রিয়্যালিটি বোঝা তার জন্য দুষ্কর। তাকে ধীরে ধীরে বুঝাতে হবে। মুনমুন যেন উল্টা পাল্টা কিছু না করে, সেজন্য তাকেই প্রশ্রয় দিয়ে বলে, “হ্যাঁ ভুল করেছে। তুমি ঘুমিয়ে পড় এখন, আমি সবটা বুঝিয়ে বলবো তোমার ভাইয়াকে। তুমি কষ্ট পেও না। আর এমন কাজ কখনো করো না। অন্তত আমাকে সত্যিটা বলো।”
মুনমুন পুনরায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
মুনমুনকে খাইয়ে পুষ্পি সাবেরী খাতুনকেও জোর করে খাওয়ায়। শাহরিয়ার আজ নিচে নামবে না জেনেই খাবার নিয়ে উপরে যায়।
শাহরিয়ার সটান হয়ে, কপালের উপর বাহাত রেখে চোখ বুজে ছিল। পুষ্পি অনুধাবন করে, শাহরিয়ারের রাগ করাটা অনর্থক নয়। ওর উপর রাগ করাটাও অযাচিত নয়। সে তো ভুল করেছেই৷ সম্পূর্ণ খোঁজ না নিয়ে মুনমুনকে প্রশ্রয় দেয়া তার অনুচিত ছিল। আরেকটু দ্বায়িত্ববান হওয়া উচিৎ ছিল।
শাহরিয়ারের উপর অভিমান ভুলে পুষ্পি ভয়ে ভয়ে ডাকে, “শুনছেন?”
শাহরিয়ার সায় দেয় না। পুষ্পি জানে ঘুমায়নি সে। তাই পুনরায় ডাকে, “উঠুন, অল্প করে খেয়ে নিন।”
শাহরিয়ার গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয়, “তুমি খেয়ে নাও। খাব না আমি। ক্ষুধা নেই। লাইট অফ কর।”
পুষ্পি আর জোর করার সাহস পায় না। একবার যেহেতু না বলেছে, সে কিছুতেই খাবে না।
পুষ্পিও খেলো না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে রইল। বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারি করে, আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। চাঁদের সৌন্দর্যও মলিন লাগে। মন ভালো না থাকলে কিছু ভালো লাগে না। বেশ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে মাঝরাত্তিরের দিকে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। খাটের এক কিনারে এসে জুবুথুবু হয়ে শোয়।
পুষ্পির যখন সকালে ঘুম ভাঙে তখন দেখে, শাহরিয়ার একদম তার কাছ ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে। এত কাছে যে, হার্ট বিটও অনুভব করা যায়।
কে বলবে, রেগে গেলে এই মানুষটাই এমন ভয়ংকর! শাহরিয়ারের চোখের নিচে একটা তিল। শ্যামবর্ণ মুখিটাতে তিলটা ফুটে উঠেছে যেন। এই শ্যামবর্ণ মুখটা আর চোখের নিচের তিলটা পুষ্পিকে ভীষণ আকৃষ্ঠ করে সর্বদা। পুষ্পি একবার আঙুল দিয়ে তা ছুঁয়ে দেয়। মনে মনে বলে, মাশাআল্লাহ, নজর না লাগুক।
পুষ্পির কাধের নিচে শাহরিয়ারের হাত থাকায়, পুষ্পির বার কয়েক নড়াচড়ায় শাহরিয়ারের ঘুম হালকা হয়ে যায়। ধীরে ধীরে চোখ মেলে চায় সে।
পুষ্পি হকচকিয়ে তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ইশশ! কি লজ্জার কান্ড! কি ভাববে ভেবেই অস্থির মেয়েটা। কাল এত গুলো কথা শুনাল, কই রাগে ফুলে থাকবে, তা না, সব ভুলে কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিল! ইশশ…ছিঃ!
পুষ্পির ভাবনার এই পুরোটা সময়েই শাহরিয়ার পুষ্পির দিকে চেয়ে ছিল। ঘুমের ভাব পুরোপুরি কাটেনি তখনও।
পুষ্পি উঠে যেতে লাগে, শাহরিয়ার আরো কাছে টেনে নেয়। হাতে পায়ে আঁকড়ে রেখে বলে, “পুষ্প, তুমি আমার এত কাছে এসে ঘুমাও কেন? আর কখনও আমার এত কাছে এসে ঘুমাবে না। রুদ্ধশ্বাস মায়া জন্মায়।”
পুষ্পি নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলে, “মোটেও আমি আপনার কাছে গিয়ে ঘুমাই না। বরং আপনিই আমার কাছে এসে ঘুমান। আমার এত শখ নেই আপনার মতো বদরাগী মানুষের কাছ ঘেঁষে ঘুমানোর।”
শাহরিয়ার ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলে, “কোনো প্রুফ আছে আমি যে তোমার কাছ ঘেঁষে ঘুমাই?”
পুষ্পি ভ্রুকুটি করে বলে, “এখন কে ধরে রেখেছে আমায়?”
শাহরিয়ার বলে, “তুমি ধরে রেখেছো আমায়। দেখো আমার হাতের উপর তোমার হাত।”
পুষ্পি অবাক বনে যায়। বিস্ময় জড়ানো কন্ঠে বলে, “যে অন্ধ তাকে পথ চেনানো যায়, কিন্তু যে অন্ধ সেজে থাকে তাকে কখনও পথ চেনানো সম্ভব নয়। খারাপ লোক, আমি আপনার হাত সরানোর জন্য আপনার হাতের উপর হাত দিয়েছি কেবল। ছাড়ুন আমায়, ছাড়ুন বলছি। বদ লোক একটা!”
শাহরিয়ার হাসে। সুন্দর হাসি। গলা জড়িয়ে রেখে কানের কাছে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। বলে, “আমার বউ, আমি ইচ্ছে হলে ছাড়বো, ইচ্ছে না হলে ছাড়বো না, ইচ্ছে হলে বকবো, ইচ্ছে হলে আদর করবো। তোমার তাতে কি? চুপচাপ শুয়ে থাকো।”
শাহরিয়ারের মজাচ্ছলে বলা কথায় পুষ্পির কষ্ট জেগে ওঠে। সে জানতে চায়, “আমার কোনো ইচ্ছে নেই? সব আপনার ইচ্ছে? আমাকে বোঝার দ্বায় নেই আপনার? আমি কি ভেবে কি করতে পারি, এতটুকু আস্থাও নেই?”
শাহরিয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুঝতে পারে চাপা অভিমান-অভিযোগ জেগে উঠেছে। বলে, “আছে, দ্বায় আছে, বিশ্বাস আছে, ভরসা আছে, আস্থাও আছে। আর আছে বলেই, তোমার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বোকামিও আমায় পীড়া দেয়। আমি বিশ্বাস করি তুমি অত্যাধিক বুদ্ধিমতি। কোনো বোকামি তো তোমার সাথে যায় না। পুষ্প, এই সংসার আগলে রাখার দ্বায় কিন্তু এখন সবচেয়ে বেশি তোমার। ভালো-খারাপের অংশীদারও তাই তুমিই বেশি হবে। মুনকে বুঝাও। ওকে বোঝানোর দ্বায়ও কিন্তু তোমার।”
পুষ্পির চোখে জল আসে। বলে, “আপনি তো ওকে শুধু আপনার বোন বলেছেন। আমি তো পর!”
শাহরিয়ার পুষ্পিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। মুখে বলে, “কে বলেছে? আমি? আমি গাধা, গর্ধব! তুমি তো সবচেয়ে বেশি আপন, জনম জনমের আপনজন; আমার, আমার পরিবারের।”
পুষ্পি বলে, “আবার আপনার পরিবার বলেছেন।”
শাহরিয়ার হেসে উঠে বলে, “দুঃখিত মহারানী। আমাদের পরিবার, আপনার পরিবার।”
(চলবে)……