একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু পর্ব-৩৭

0
11

#একি_বন্ধনে_জড়ালে_গো_বন্ধু
#পার্ট_৩৭
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

শাহরিয়ারের এক বন্ধু নিউরোলজিস্ট। পুষ্পি যখন ঘুমিয়ে গেল শাহরিয়ার তখনই তাকে মেসেজ করল। স্বাভাবিকভাবেই গভীর রাত হওয়াতে রেসপন্স পেল না। এবং রাতভর সে পুষ্পির সমস্যাগুলো নিয়ে নানান বই ঘাটাঘাটি করল। সারা রাত আর ঘুমায়নি। পুষ্পি তখন ঘুমেই। কিন্তু ঘুমের মাঝে নড়ে উঠলেও যেন শাহরিয়ার আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যাচ্ছিল। নিজের উপর নিজের একটু রাগও হচ্ছিল, আরও আগে কেন লক্ষ্য করেনি! সামন্য মুডসুইং ভেবে উড়িয়ে দিয়েছে!
যদিও সমস্যা এতদিন এতটা গাঢ় ছিল না, বিগত দু-তিন দিন যাবত যতটা বেড়েছে!

বিছানায় কিছুক্ষণ হাসফাস করে বারান্দায় গিয়ে বসে রইল। পুষ্পির শেষের কথাগুলো খুব বেশি অস্থির করে তুলছে। রাতটা এভাবেই পার করে। এবং ঠিক করেই ফেলে সকাল হতেই পুষ্পিকে নিয়ে নিউরোলজিস্ট এর কাছে যাবে।

ফজরের আজান হতেই সে নামাজে যায়। এবং ফজরের নামাজ পড়ে এসে দেখে পুষ্পিও ঘুম থেকে জেগে গিয়েছে। নামাজ পড়ছে। মোবাইল চেক করে দেখে তার বন্ধুও রেসপন্স করেছে। শাহরিয়ার খানিক ভাব-বিনিময় করে তার সাথে এপয়নমেন্টও ফিক্সড করে ফেলল।
পুষ্পি ফজরের পর আর ঘুমায় না সচারাচর। কিন্তু আজ ঘুমাল। শাহরিয়ারের ঘুম নাই। সে পুষ্পির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পুষ্পি পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে যেন। নিশ্চিতের ঘুম।
পুষ্পির এর পরের ঘুম ভাঙল নয়টায়। ঘুম ভেঙে সে দেখল, শাহরিয়ারের হাত তার মাথায়, এবং এলোমেলো ভাবে ঘুমিয়ে আছে। পুষ্পি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে নয়টা বাজে। শাহরিয়ার কলেজ যায়নি দেখে খানিক বিস্মিত হয়। কিন্তু মানুষটা এমন ভাবে ঘুমাচ্ছিল যে তার ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে করেনি। থাক, একদিন ক্লাস না করালে কি এমন হবে? ঘুমাক মানুষটা। রাতে ঘুম হয়নি বোধহয়! আচ্ছা, রাতে ঘুম হয়নি কেন?

পুষ্পি কপাল থেকে হাত সরিয়ে উঠতে লাগলেই শাহরিয়ারের ঘুম ভেঙে যায়। সাড়ে এগারোটায় এপয়েনমেন্ট। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। জানতে চায়, “কয়টা বাজে?”
পুষ্পি বলে, “শান্ত হোন। কলেজ যেতে হবে না আজ আর।”
শাহরিয়ার ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখে। তারপর বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, “কলেজ যাব না। তোমাকে নিয়ে ঘুরবো আজ। অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাই না আমরা।”

পুষ্পি প্রতিত্তোর করে না। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। সাবেরী খাতুন একা একা নাস্তা করছিল দেখে পুষ্পি তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যায়। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে, “ডাকলেন না কেন, মা? ফজর পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম৷ একটু ডাকা যেত না আমায়।”

সাবেরী খাতুন সুন্দর হেসে বললেন, “রোজ তো তুমিই বানাও। আজ একদিন আমি বানিয়েছি, তো কী হয়েছে? তোমার প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে রান্নাবান্না ভুলতে বসেছি। এই দেখ ভাজিতে হলুদ বেশি দিয়ে ফেলেছি।”
পুষ্পি মৃদু হেসে বলে, “আপনি, আপনারা এত ভালো যে আমার নিজের কাছে নিজের অনুতাপ হয়, ওতোটা ভালো বোধহয় আমি হতে পারিনি এখনো। দেখি সরুন তো মা। দেখুন কি অবস্থা করেছেন নিজের, ঘেমে-টেমে একাকার! বাকিটা আমি করে দিচ্ছি। আপনি গিয়ে বসুন।”
তারপর কিছু একটা মনে পড়ার মতো করে জিজ্ঞেস করে, “ঔষধ খেয়েছেন তো?”

সাবেরী খাতুন হেসে জবাব দেয়, “খেয়েছি গো খেয়েছি। পাক্কা গিন্নী! সব দিকে খেয়াল।”

পুষ্পির মাথাটা হালকা চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হয়। সে চোখ বুজে মাথায় হাত রাখে। নাস্তা মোটামুটি প্রস্তুতই ছিল। ও কেবল ভাজিটা নামিয়ে বাটিতে নেয়। রুটি আর ভাজি টেবিলে এনে রাখতে রাখতেই শাহরিয়ার উপর থেকে ডাকে, “পুষ্প! এই পুষ্প!”
পুষ্পি প্রথম ডাক শুনতে পায় না। দ্বিতীয় ডাক শুনে তড়িঘড়ি করে যেতে লাগলে পড়ে যেতে নিলে সাবেরী খাতুন ধরে ফেলে। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে, “তোমাকে কতদিন আমি আর শাহরিয়ার বলেছি, একটু সাবধানে চলাফেরা করতে! শাহরিয়ার দেখতে পেলে তো খুব রাগ করতো এখন।”

পুষ্পি মৃদু হেসে নিজেকে সামলে নেয়। উপরে আসতেই শাহরিয়ার বলে, “পুষ্পি রেডি হও। রেডি হয়ে একেবারে নাস্তা করে বেড়িয়ে যাব। লেইট হয়ে যাচ্ছে।”
পুষ্পি জানতে চায়, “কিসে লেইট হচ্ছে?”

শাহরিয়ারের একটা স্পেশাল গুন, মনে হাজারও দুশ্চিন্তা রেখে রসিকতা করতে পারে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। বললো, “তোমার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করায় লেইট হচ্ছে। ঝটপট একটু সাজুগুজু করে নাও তো। আমি একটু দেখি প্রাণভরে!”

পুষ্পি সুন্দর হাসে। মানুষটা এমন পাগল! মেয়েটা বলে, “কী আর সাজবো? বোরকাই তো পরবো।”

শাহরিয়ার কাছে আসে। মাথায় হালকা টোকা মেরে বলে, “কী বলে এই বোকা মেয়ে! তুমি জানো, বোরকা আর নেকাবে যে তোমায় পরী লাগে?”

পুষ্পি সরে গিয়ে আলমারি থেকে বোরকা বের করতে করতে মৃদুমন্দ হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে মুখে। মানুষটা এমন করে কথা বলে, যে কেউ গলে যাবে!

বাসা থেকে হসপিটাল আসতে ঘন্টা খানেক সময় লাগে ওদের। হসপিটালের সামনে বাইক থামিয়ে শাহরিয়ার বলে, “নামো। চলে এসেছি।”

পুষ্পি কিছুটা কৌতুহলী হয়। হসপিটাল নিয়ে এলো কেন মানুষটা? প্রশ্ন করে, “হসপিটাল কেন? আপনি না বললেন ঘুরতে যাবেন?”

শাহরিয়ার পুষ্পির মাথা থেকে হেলমেট খুলে, নিজেরটা খুলতে খুলতে জবাব দেয়, খুব স্বাভাবিক জবাব, “হুম, যাব তো। আগে একটু হসপিটাল থেকে ঘুরে আসি, তারপর ঘুরতেও যাব। সারা শহর ঘুরবো আজ তোমায় নিয়ে।”

পুষ্পি খানিকটা চুপ হয়েই যায়। না বলে হসপিটাল আনায় কি রাগ হলো তার? শাহরিয়ার বোঝার চেষ্টা করলো প্রথমে। পরে বিষয়টা আরও খানিক নরমালাইজ করার জন্য হাঁটতে হাঁটতে বললো,

“আমার বন্ধু আহসান, খুবই নামকরা নিউরোলজস্ট। অনেকদিন দেখা হয় না ওর সাথে। কাল কথা হয়েছিল। বলল, আজ একবার দেখা করে যেতে। ভাবলাম, দেখা করাও হলো, কিছু রেগুলার চেক-আপ, টেক-আপও করা হয়ে গেল। কেমন নামকরা নিওরোলজিস্ট যাচাই করে দেখা, বন্ধু হিসেবে আমার কর্তব্য না? বলো?”

পুষ্পি কোনো জবাব দিল না। তবে সে বেশ বুঝতে পারলো, মূলত তার জন্যই আজ হসপিটাল আসা। আর ও যেন কষ্ট না পায় সেজন্য এত গল্প!

চেম্বারে যাওয়ার পর শুরুতে বন্ধুসুলভ আচরণ-ই হলো। ডাক্তার হিসেবে তিনি যে খুবই বিনয়ী তা বুঝতে দ্বিধা নেই। প্রথম দুজন একত্রে গেলেও পরে দুজনের সাথে আলাদা আলাদা কথা বলে। বেশ কিছু টেস্ট দেয়। অত:পর বিদায়কালে শাহরিয়ারকে বলে, “আমার সাথে কাল-পরশু একবার এসে দেখা করে যাইস তো বন্ধু।” এবং সঙ্গে সঙ্গেই সিরিয়াসনেস’টা আড়াল করার জন্যই বোধহয় খানিক কৌতুক করে বলে, “তুই তো জানিস আমি একটা ইনোসেন্ট, লাজুক ছেলে। ভাবির সামনে তোকে উত্তম-মাধ্যম দিতে পারলাম না। এক ফাঁকে এসে নিজের পাওনা গুলো বুঝে নিয়ে যাইস।”

শাহরিয়ার উঠে দাঁড়ায়। আহসানের এক হাতের সাথে হাত মিলিয়ে টেনে নিজের কাঁধের সাথে কাঁধ লাগিয়ে বলে, “শা*লা বাটপার! তোর বাটপারি আর গেলো না।”
আহসান হেসে দিয়ে বলে, “একটা বউ থাকলে নাহয় চিন্তা করে দেখতাম, বাটপারি পেশা ছেড়ে দিয়ে ভালো-টালো হওয়া যায় কিনা। বউ নাই, টও নাই, ভালো হবো কার জন্য?”

আহসানের কথায় শাহরিয়ার তো হাসলোই পুষ্পিও হাসলো মৃদুমন্দ।
শাহরিয়ার বলল, “ওকে বন্ধু, আসি আজ। বউয়ের জন্য ধার্য্য করা দিন, তোর পিছনে তো আর ওয়েস্ট করতে পারি না, তাই না?”

আহসানও হেসে বিদায় দিল। তবে মজার ছলে বিদায় নিয়ে এলেও আহসানের পারসোনালি ওকে বলা কিছু কথা মাথায় ঘুরে এলোমেলো ভাবে। যদিও সেই চিন্তাটা প্রস্ফুটিত করে না পুষ্পির সামনে। কী এমন কথা ভাবুক করেছে শাহরিয়ারকে?

পুষ্পি বলে উঠে, “আপনার এই বন্ধুটা অনেক আনসিরিয়াস টাইপ মানুষ। কেউ কথা বলে বুঝতেই পারবে তার কাজ এত সিরিয়াস একটা সেক্টরে!”

শাহরিয়ার সায় দিয়ে বলল, “হুম, ও বরাবরই এমন। স্কুল-কলেজেও সারাবছর ফাইজলামি করে, বছর শেষে টপ করতো।”

পুষ্পি আর কথা বাড়াল না এই প্রসঙ্গে।
শাহরিয়ার মূহুর্তের ভেতর ডিসিশন নিয়ে কাছের একটা রেস্টরন্টে গেল। পুষ্পি যেতে চায়নি যদিও। কিন্তু শাহরিয়ার কী আর ‘না’ শুনার পাত্র?
নিয়ে গিয়েও খান্ত হলো না। জোর করে করে এটা-সেটা খাওয়াতে লাগল। এত মানুষের ভেতর পুষ্পির চুপ করে হজম করা ছাড়া কিছুই করার নেই যেন।
এক পর্যায়ে না পেরে বলেই বসলো, “আপনি এত খারাপ! না খাইয়ে মারে শুনেছি। আপনি তো আমায় খাইয়ে খাইয়ে মেরে ফেলবেন!”

শাহরিয়ার এই মানুষ ভর্তি রেস্টরন্টের মানুষদের ডোন্ট কেয়ার করে হো হো করে হেসে উঠল। একটু কাছে হেলে বলল, “ভালোবাসার মরনেও আরাম। সাদরে গ্রহণ করতে হয়। জানো না তুমি?”

পুষ্পি মুখ ফিরিয়ে বলে, “ইশশ!”

খাবারের পালা চুকিয়ে মোটামুটি বেশ দূরের একটা পার্কে গেল। যথারীতি এখানে এসেও পুষ্পি আপত্তি জানাল, “বাড়ি যাবেন না? বাড়ি যাবেন কখন?”
শাহরিয়ার কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বলল, “পুষ্প? তুমি এত হোম-ফ্রিক কেন বলো তো? কোথায় জামাই ঘুরতে নিয়ে আসায় খুশিতে নাচানাচি করবা, তা না করে বাড়ি যাওয়ার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করছো। স্ট্রেঞ্জ!”

পুষ্পি খুব সুন্দর করে হাসলো। কিছু মানুষের হাসি এত সুন্দর হয় যে, তার হাসির কাছে সব সৌন্দর্য মলিন হয়ে পরে।
সম্ভবত চারটা বাজে। নীল-সাদা আকাশের বুকে একখন্ড তেজহীন ঝলমলে সূর্য। পার্কের আশেপাশে অসংখ্য বনফুল, ঘাসফুল, রোপণ করা ফুল। চতুর্দিকে যেন ফুলের সমারোহ।

বেশ কিছুক্ষণ হাটাহাটি করল। এটা-সেটা কিনে খেল। তারপর একটা জায়গায় বসলো। ওরা যেখানে বসলো তার ঠিক পাশেই একটা মধুমালতী গাছ। আশেপাশে মানুষ নেই তেমন। অনেকটা নির্জন পরিবেশ। শাহরিয়ার একবার পুষ্পির দিকে চেয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়। পুষ্পি শাহরিয়ারের বাহুতে হাত রেখে বলে, “চলুন, এবার চলে যাই!”
শাহরিয়ার মধুমালতী গাছটার দিকে তাকিয়ে সুর তোলে,
“চাঁপা বনে অলির সনে আজ
লুকোচুরি গো লুকোচুরি!
আলো ভরা কালো চোখে…
কী মাধুরী গো কী মাধুরী!
মন চাহে যে ধরা দিতে,
মন চাহে যে ধরা দিতে…
তবু সে লাজে সরে যায়….
মধু মালতী ডাকে আয়!”

পুষ্পি খানিকটা অবাকই হয়। আশেপাশে তাকায়, একজন বউ অন্তঃপ্রাণ স্বামী তার বউকে গান শুনাচ্ছে; কেউ শুনে নিল না তো?

শাহরিয়ার বিষয়টা লক্ষ্য করে উপভোগ করে। তার চোখেমুখে হাসি। এত লাজুক বউ তার! একটু রসিকতা করেই বলে, “গাইব নাকি আরেক কলি?”

পুষ্পি ছোট্ট করে জবাব দেয়, “উঁহু। এখানে না।”

শাহরিয়ার জানতে চায়, “তাহলে কোনখানে?”

পুষ্পি ভ্রুকুটি করে চায়। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলে, “আপনি আমার কোনো কথাই শোনেন না। এজন্যই একদিন আমি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাব।”

শাহরিয়ার প্রতিত্তোর করে, “তুমি পাগল হবা কেন? তুমি হবা পাগলী, আর আমি হবো পাগল। তারপর আমাদের সংসার হবে, পাগলা-পাগলীর সংসার।
ভেবে দেখ কত ইউনিক হবে বিষয়টা?”

পুষ্পি না হেসে পারেই না। এমনও মানুষ হয়? কোনো কথাতেই পারা যায় না।

শাহরিয়ার পুষ্পির হাতের উপর হাত রাখে। পড়ন্ত বিকেল যেন খুব চমৎকার একটি দৃশ্য নিয়ে হারিয়ে যেতে থাকে। মৃদু বাতাস যেন গুনগুন করে গায়।
পুষ্পি বিস্ময় নিয়ে উপলব্ধি করে সেই সকালের পরে, এত ঘুরোঘুরির পরও আজ সারাদিন তার মাথায় যন্ত্রণা করেনি। এই একটা মানুষ যেন তার জাগতিক শান্তি! কী আশ্চর্য!

(চলবে)………..